লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
যে বছর বালাকোটের মুজাহিদগণ রাজা রঞ্জিত সিংহের সেনাপতিদেরকে পরাজিত করেন এবং একের পর এক শিখ অধিকৃত অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়েছিলেন সেই বছরেই গাঙ্গুহ নামক স্থানে হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যখন ৭ বছর বয়সে উপনীত হন তখন থেকেই তাঁর একনিষ্ঠ খোদা প্রেমিক ও অনুপম ধর্মনিষ্ঠ প্রিয় জননীর নিকট পবিত্র কালাম পাকের শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। ধী শক্তির পরম ও চরম উৎকর্ষতার ফলে তিনি অতি অল্প সময়েই পবিত্র কুরআন শেষ করেন।
এগারো বছর বয়সে তিনি মৌলবী মুহাম্মাদ বখস (রহঃ) এর কাছ থেকে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের অনুবাদ শুনেন। আয়াতটির ভাবার্থ হল, “বিচার দিবসে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নির্দেশে অপরাধীদেরকে এবং নেককারদেরকে পৃথক করে দেওয়া হবে।” এটা শোনার পর তিনি সারা রাত কাঁদতে কাঁদতে কাটিয়ে দেন । তাঁর এহেন অবস্থা দেখে তাঁর মা তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি উত্তরে বললেন,
“আম্মাজান! আমার এ কান্না শুধু এই ভয়ে যে, বিচার দিবসে আমি যেন অপরাধীদের অন্তর্ভূক্ত না হই।”
হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী বাল্যকাল থেকেই অধিকা মাত্রায় খোদাভীরু ছিলেন, তিনি দিন রাত্রির পুরো সময়টাই শুধু ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়ে দিতেন । তাঁর সময়কার বিশিষ্ট আলেমগণও তাঁর এই অভূতপূর্ব ও দুর্লভ সাধনা দেখে হতবাক হয়ে যেতেন।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গাঙ্গুহতেই সমাপ্ত করেন। পরে তিনি ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি যান । দিল্লীতে তিনি হযরত মাওলানা আব্দুল গণী (রহঃ) এবং মামলুক আলী (রহঃ) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁদের আধ্যাত্মিক দরসে শামিল হয়ে যান। স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং ধী শক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হওয়ার জন্য মীর জাহেদ, কাজী সদরা ইত্যাদি দর্শন ও তর্ক শাস্ত্রের কঠিন থেকে কঠিনতর গ্রন্থসমূহ অদ্যোপান্ত মুখস্ত করে ফেলেন।
তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ) এর সহপাঠি ছিলেন। একই সাথে তাঁরা লেখাপড়া করেন। তাঁদের উস্তাদগণ তাঁদের আল্লাহ প্রদত্ত বৈশিষ্টাবলীর ভূয়সী প্রসংশা করতেন । অবাধ জ্ঞান ও আসমানী ইলম ও খোদাভীতির নমূনা কাসেম নানুতুবী ও রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী একই সাথে হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহঃ) এর কাছে ইসলাহী বায়াত গ্রহণ করেন। হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী মাত্র ৪০ দিনের মাথায় স্বীয় পীরের কাছ থেকে খেলাফত লাভ করে ধন্য হন। এই মহান প্রাপ্তির পাশাপাশি তিনি একজন বিশিষ্ট জমিদার ও প্রচুর সম্পদশালী ছিলেন। তিনি অঢেল সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তাঁর এত সম্পত্তি থাকা সত্বেও তাঁর চলাফেরা ও পোষাক পরিচ্ছদ দেখে মনেই হোত না তিনি একজন এত সম্পত্তির মালিক। তিনি বিলাসিতা বিবর্জিত অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর ব্যুৎপত্তি, অগাধ পাণ্ডিত্য ও পারদর্শিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহঃ) বলেন,
“আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন আল্লামা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ) ইমাম শামী (রহঃ) থেকেও বড় ফকীহ এবং আইনজ্ঞ ছিলেন।”
তিনি এত বড় আলেম হওয়া সত্ব্যেও অন্যান্য জগদ্বিখ্যাত ইসলামী মনীষীদের ন্যায় দুর্লভ জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সমর্থক ও নির্ভিক সংগ্রামী সিপাহসালার ছিলেন। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে যখন মহাবিদ্রোহের আন্দোলন ও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল এবং যুদ্ধের বিভিষিকা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং শ্যামলীর রণাঙ্গনে যে দেশপ্রেমী হাজার হাজার আলেম এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তখন হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ) একটি বিরাট জামাআতের নেতৃত্বে ছিলেন। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং চির স্মরণীয় অবদান রাখেন।
অধ্যাপক শান্তিময় রায় লিখেছেন,
“দার-উল-উলেমা দেওবান্দের প্রতিষ্ঠাতাগণ বিপ্লবের সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন, বহিঃ দিল্লীর সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করেছেন এমনকি তাঁরা যে সকল অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে বহিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল দিল্লীর অদূরে বর্তমান মুজফফরনগর জেলার (উঃ প্রঃ) ছোট শহর শামলিতে। হাজি ইমদাদুল্লাহ (১৮৭১-৯৯) যিনি ব্দ্রোহের বিফলতার পর মক্কা গমণ করেন, তিনিই ছিলেন শামলিতে এই ব্রিটিশ বিরোধী জেহাদের ইমাম। এবং রসিদ আহমদ গাঙ্গোহি (১৮২৮-১৯০৫) ছিলেন তাঁর বাহিনীর সেনাপতি।” (ভারতের মুক্তি সংগ্রামে মুসলিম অবদান, পৃষ্ঠা-২৬)
যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি পাঞ্জাশালায় চলে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর তাঁর উপর গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী হয়ে যায়। তিনি বিপদের পূর্বাভাস পেয়ে অতি গোপনে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে যান রামপুর। সেখানে দিন কতেক অবস্থান করার পর একদিন সাহারানপুরের কর্ণেল গার্ডেন ফ্রান্সেস গোলাম আলী একদিন সত্তর জন সদস্যের সৈন্য নিয়ে রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীকে গ্রেফতার করার জন্য গাঙ্গুহে তল্লাশী অভিযান চালায়। মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সম্ভাব্য পুলিশী অভিযানের গোপন সংবাদ পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আত্মগোপন করেন। এদিকে পুলিশ বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে তাঁরই চেহরার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তাঁর মামাত ভাই মাওলানা আবুন নসরকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরে আসল পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে ছেড়ে দেয়। পরবর্তীতে সৈন্যরা কৌশল করে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টীম পাঠিয়ে আতর্কিত অভিযান চালায়। কিন্তু তা সত্ব্যেও তারা হযরত গাঙ্গুহীকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। পরে রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী গ্রেফতার হওয়াটাই কল্যানকর মনে করে নিজেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে পুলিশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
ইংরেজ সৈন্যরা তাঁকে গ্রেফতার করে হাতে হাতকড়া পরিয়ে এবং পায়ে বেড়ি পরিয়ে মুজাফফর নগর কারাগারে নিয়ে যায় এবং সেখানে বন্দী করে রাখে। সেখানে ইংরেজরা তাঁর প্রতি ছয় মাস ধরে নির্যাতন চালায়। শত কষ্ট সহ্য করেও তিনি সেখানে অবসর থাকেননি। বিভিন্ন শ্রেণীর কয়েদীদের মাঝে নিরলসভাবে দ্বীনি তা’লিম, ওয়াজ-নসীহত ইত্যাদি চালিয়ে গেছেন। ছয় মাসের এই কারাগারের জীবনে তিনি অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করেছেন।
মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর সতী-স্বাধী স্ত্রীর পিতা মৌলবী তকীউদ্দিন (রহঃ) কে ইংরেজ জালিমরা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহীদ করেছিল। যখন মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ইংরেজদের হাতে বন্দী তখন তাঁর স্ত্রী হেসে হেসে বলেছিলেন,
“গতকাল আমার আব্বাজানও এই ইংরেজ হায়েনাদের জুলুম-অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। আর আজ আমার স্বনামধন্য স্বামীও যন্ত্রণাদায়ক কঠিন কারাজীবন বরণ করেছেন। আজ আমি আমার পিতা ও স্বামীর বীরত্ব-সাহসীকতার উপর যতই গর্ব করিনা কেন তা নিতান্তই কম।”
ব্রিটশদের বিচারে রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর ফাঁসির রায় শোনানো হয়। তাই তিনি অন্ধকার কারাগারে বসে মৃত্যুর দিন গণনা করছিলেন। একদিন মহারানী ভিক্টোরিয়া উদারতার নামে প্রহসনে একবার সমস্ত বন্দী ও আসামীদেরকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা করেন। সেই সময় তিনিও ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়ে যান। এইভাবে চরম নির্যাতন ও নিপীড়নের পর তাঁকে ছয় মাসের মাথায় মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি দেওয়া হলেও অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী মুরিদ ও মেহমানের ছদ্মবেশ ধারণ করে তাঁর পিছনে অসংখ্য গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয়। তারা তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত এভাবেই তাঁর পেছনে লেগে। তিনি সারাটি জীবন ইসলামের প্রচার-প্রসারের কাজই করে যান। প্রাণ নিবেদন করেন দেশ ও জাতির মুক্তি সংগ্রামে। এ সংগ্রাম করতে গিয়েই তিনি জেল জুলুম থেকে শুরু করে ইংরেজ দুঃশাসনের অকথ্য অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেন।
মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ) বলেছিলেনঃ-
“ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা আমাদের বৈশিষ্ট। শঙ্কা ও বিপদের ঘোর অমানিশা আমাদেরকে বিন্দুমাত্রও ভীত সন্ত্রস্ত করতে পারবে না। পরাধীনতার প্রতিটি মুহুর্ত লাঞ্ছনা ও অপদস্ততার আয়না স্বরুপ। তাইতো আমার প্রতি যাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি আছে তাদের কেউই জিহাদের ফরজ আদায়ের শৈথিল্য প্রদর্শন করবে না।”
ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন
১) শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহঃ): এক ঐতিহাসিক পটভূমি
২) সৈয়দ আহমদ শহীদ ব্রেলভী ও ভারতে ওহাবী আন্দোলন
৩) চেপে রাখা মোপলা বিদ্রোহের অজানা ইতিহাস
৪) বাংলার বীর তিতুমীরের অজানা ইতিহাস
৫) নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোসের রাজনৈতিক গুরু মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর রাজনৈতিক অভিযান