লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
মহীশূরের বাঘ টিপু সুলতান শহীদ (রহঃ) ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । যেমন পিতা তেমনি পুত্র। পিতা হায়দার আলী যেমন বীর ছিলেন তেমনি টিপু সুলতানও বীর ছিলেন। পিতার মত তিনিও চাইতেন ব্রিটিশ বেনিয়াদের দেশছাড়া করতে।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (রহঃ) – এর মহান পুত্র শাহ আব্দুল আজীজ দেহলবী (রহঃ) ফতোয়া জারী করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য। সেই ফতোয়াকে কেন্দ্র করেই টিপু সুলতান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি চেয়েছিলেন ব্রিটিশদেরকে এদেশ থেকে উৎখাত করার জন্য। সেজন্য তিনি মরণপণ যুদ্ধ করে পরপর তিন বার ব্রিটিশদের পরাস্ত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্র তিনি শহীদ হন।
১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলী মারা যান। পিতা মারা গেলে সুলতান হন টিপু। ঐতিহাসিক বিকাশ গুপ্ত লিখেছেন,
“বয়সে তরুন হলেও তিনি সুদক্ষ সেনাপতি । তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল কলঙ্কহীন।”
টিপু সুলতানের বাহিনী ১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই ফেব্রিয়ারী ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাস্ত করেন। ফলে ইংরেজ সেনাপতি স্টুয়ার্ট বন্দীবাস ও করঙ্গুলি থেকে সেনা বাহিনী হাটাতে বাধ্য হন। এরপর বেদনুর দুর্গের অধিপতি এয়াজ ইংরেজ সেনাপতি ম্যাথুজের কাছে আত্মসমর্পণ করলে টিপু সুলতান দেবনুর দুর্গ আক্রমণ করেন ফলে যুদ্ধ চলে ১৮ দিন ধরে। দীর্ঘ ১৮ দিন যুদ্ধ চলার পর ম্যাথুজ পরাজিত হন এবং আত্মসমর্পণ করেন। এরপর সেনাপতি মন্ট গোলাবীও টিপু সুলতানের কাছে পরাস্থ হয়।
১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ২৯শে জানুয়ারী সেনাপতি ক্যাম্পবেল প্রচণ্ড আক্রমণ হানেন । কিন্তু কোন ফল হয়নি। ক্যাম্পবেল টিপুর বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে ম্যাঙ্গালোর দুর্গ ছেড়ে পলায়ন করে। এরপর কাদালোর যুদ্ধেও ব্রিটিশ বাহিনী টিপুর বাহিনীর কাছে চুড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ব্রিটিশরা গতি খারাপ বুঝে ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ১১ই মার্চ টিপুর সাথে সন্ধি করে এবং ম্যাঙ্গালোর চুক্তি সম্পাদিত হয়। ইংরেজরা টিপুর সাথে অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে সন্ধি করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা সে চুক্তি ভঙ্গ করে এবং নিজাম ও মারাঠাদের সহযোগিতায় ভিন্ন দিক হতে মারাঠা আক্রমণ করেন।
টিপু সুলতান এক বছর পর্যন্ত তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখেন, কিন্তু অবশেষে পরাজয় বরণ করেন এবং ইংরেজদের সাথে সন্ধি করেন। চুক্তিতে অর্ধেক রাজ্য, প্রচুর অর্থ এবং তাঁর দুই পুত্রকে ইংরেজদের কাছে জমিন রাখেন। পিতার কাছে এ এক চরম মনোবেদনা। কিন্তু তিনি থেমে থাকলেন না, তিনি ভীষণ দূরদর্শিতা ও তৎপরতায় সৈন্যবাহিনী গঠন করেন এবং পিতা হায়দার আলীর মত মারাঠা ও নিজামের সাথে সন্ধির আবেদন জানালেন কিন্তু মারাঠারা সে সন্ধি করেন। তারা সন্ধি পুরোপুরী প্রত্যাখ্যান করেছিল।
১৭৯১ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই মার্চ সেনাপতি কর্ণওয়ালিশ টিপুর বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং মহীশূরের সেনাপতি কৃষ্ণ রাওএর বিশ্বাঘাতকতায় ব্যাঙ্গালোরের পতন হয়। সেনাপতি রায় বাহাদুর ৭০ বছর বয়সে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হন, তাঁর এই বৃদ্ধ বয়সে বীরত্ব দেখে ব্রিটিশ সেনাপতি মুগ্ধ হয়ে তাঁর মৃতদেহ টিপু সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বীরের সম্মান দেন।
টিপুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে মারাঠা, নিজাম ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করল। ফলে ব্রিটিশ বাহিনী আরও শাক্তিশালী হয়ে উঠল। ৬ই ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ বাহিনীর ২২ হাজার সৈন্য, ৪৪টি কামান, নিজাম বাহিনীর ১৮ হাজার অশ্বারোহী, মারাঠা বাহিনীর ১২ হাজার অশ্বারোহী আক্রমণ করল শ্রীরঙ্গপত্তনম। টিপু সুলতানের কাছে ছিল ৪০ হাজার পদাতিক, ৫০০ অশ্বারোহী ও ১০০টি কামান। সেনাপতি হয়েছেন স্বয়ং টিপু সুলতান। ৬ই ফেব্রুয়ারী কর্ণওয়ালিশ আক্রমণ করলেন। সেনাপতি মেডোসের নেতৃত্বে ৯০০ গোরা, আর ২৪০০ ভারতীয় সৈন্য। স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ১৪০০ গোরা, ২৩০০ ভারতীয় সৈন্য, সেনাপতি ম্যাক্সওয়েলের নেতৃত্বে ৫০০ গোরা এবং ১২০০ ভারতীয় সৈন্য।
চলল ব্রিটিশদের সাথে টিপুর তুমুল যুদ্ধ। অন্ধকারে রাত্রে টিপু কামান দাগতে পারলেন না। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ১৫০০ এবং টিপুর বাহিনীর ২০০০ সৈন্য নিহত হয়। টিপুর বাহিনী আবার টিপুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল এবং ৫৭ জন সুশিক্ষিত ফরাসী সৈন্য টিপুর সাথ ছেড়ে দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগদান করল এবং সমস্ত রহস্য ফাঁস করে দিল। ৯ই ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশের ৫২ হাজার সৈন্য বাহিনীর সাথে ক্রোমবির আরও ২০০০ ইংরেজ সৈন্য এবং ৪০০০ ভারতীয় সৈন্য যোগ দিল। এবং ব্রিটিশ বাহিনী ১৮ই ও ১৯শে ফেব্রুয়ারী আবার হামলা করল। কিন্তু তারা সফল হল না। ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারী তারা কিছুটা সফল হলেও শেষ পর্যন্ত ২৪শে ফেব্রুয়ারী শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয়।
১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারী সেনাপতি হ্যারিস ২১ হাজার সৈন্যবাহিনী নিয়ে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। ইতিহাস প্রসিদ্ধ সম্রাট নেপোলিয়ানকে যিনি পরাজিত করেছিলেন সেই ব্রিটিশ সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলী বা ডিউক অব ওয়েলিংটন ২০শে ফেব্রুয়ারী ১৬ হাজার সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হলেন টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে। তার সাথে যোগ দিলেন সেনাপতি স্টুয়ার্ট তাঁর ৬৪২০ জন সৈন্য নিয়ে। যোগ দিলেন সেনাপতি রিড এবং ব্রাউন তাঁদের সৈন্য সামন্ত নিয়ে । ৫ই মার্চ শুরু হল সেনাপতি হ্যারিসের নেতৃত্বে চারিদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ। টিপুর সেনাপতি পুর্ণিয়া ও সৈয়দ সাহেব বিশ্বাসঘাতকতা করে গোপনে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে যোগ দিলেন।
টিপু সুলতান বিপদ বুঝে এইসব ইতিহাস প্রসিদ্ধ সেনাপতিদের বিরুদ্ধে আর সরাসরি আক্রমণ করলেন না। শুরু করলেন গেরিলা আক্রমণ বা খণ্ডযুদ্ধ। সেনাপতি হ্যারিস ও বেয়ার্ডের আক্রমণকে ব্যর্থ করতে টিপু সুলতান যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তা দেখে হ্যারিস ও বেয়ার্ড বিস্ময় হয়ে গিয়েছিলেন। আবারও টিপুর সেনাপতি কাওমরউদ্দিন খাঁ টিপুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সাথে যোগ দিলেন। টিপুর সেনাপতিরাও তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে টিপুর আদেশ মানতে অস্বীকার করেছিল। ফলে রাতভর যুদ্ধ চললেও অনেকগুলি ঘাঁটি টিপুর হাতছাড়া হয়ে যায়।
ব্রিটিশদের টানা অবরোধে তাদের রসদও ফুরিয়ে আসে। কিন্তু এই মুহুর্তে বিশ্বাসঘাতক মীর সাদেক, পূর্ণিয়া, কাওমরউদ্দিন খাঁ প্রমূখরা টিপুর দূর্গের দুর্বল অংশের গোপন সংবাদ দিয়ে ব্রিটিশদেরকে সাহায্য করেন। সাদেক আলী টিপুর সৈন্যদেরকে বেতন দেবার লোভ দেখিয়ে অন্যদিকে নিয়ে চলে যায়। এই সুযোগে ব্রিটিশরা আতর্কিত হামলা করে। টিপু কিন্তু বীর বিক্রমেই যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, ব্রিটিশের গোলা এসে লাগে টিপুর বুকে এবং তিনি এবং তিনি প্রচণ্ড আহত হন। গোলাতে টিপুর ঘোড়াটিও মারা যায়। টিপুকে ইংরেজরা বন্দী করে এবং তাঁর পরিচয় জানতে৪ চাওয়া হল, কিন্তু টিপু তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এই চরম মুহুর্তেও টিপু সুলতান তলোয়ার ছেড়ে দেননি। ইংরেজরা তা কাড়তে চাইলে ব্যর্থ হয়। ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় টিপু তলোয়ার দিয়ে টিপু ব্রিটিশ সৈন্যকে আঘাত হেনেই চলেছেন। ব্রিটিশ সৈন্য টিপুর চোখের নিচে গুলি করে এবং তিনি লুটিয়ে পড়েন। যুদ্ধের ময়দানে বীরের মত মৃত্যুবরণ করেন।
বিশ্বাসঘাতক মীর সাদিককে দেশের জনগণ ক্ষমা করেনি। পালিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় । ক্ষিপ্ত জনতা তার লাশ কবর থেকে তুলে প্রতিশোধ নেয়। আজও শ্রীরঙ্গপত্তমের তার কবরে লোকেরা ঢিল ছোঁড়ে।
টিপু সুলতান শহীদ হয়ে যাবার পর ইংরেজরা বুঝে গিয়েছিল যে তাদেরকে পিটিয়ে তাড়ার মত ক্ষমতা যার ছিল তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। তাই ইংরেজদের ভবিষ্যৎ এখন উজ্জ্বল। তাদের পথে বাধা দেওয়ার আর কেউ নেই। ঐ যুদ্ধের প্রধান নায়ক মিঃ মর্ণিংটনকে টিপু সুলতানকে হত্যা করার জন্য প্রধান বিচারপতি Sri John Anstruther ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ১৭ই মে যে চিঠি দিয়েছিলেন তা থেকে এটা প্রমাণ হয়। তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন,
“It is with the most sincere satisfaction and heartfelt that I congratulate you upon the most brilliant and glorious event which ever occurred in our Indian history.” [Rise of the Christian Power in India, Major B.D. Basu, Page-332)
তবে এটা অবশ্যই সঠিক যে, যদি মীর সাদিক, পূর্ণিয়া, কৃষ্ণ রাও, কাওরমরউদ্দিন, মীর নাদিম এবং ফরাসী সৈন্যরা যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করত তাহলে টিপু সুলতানকে পরাজিত করা কর্ণওয়েলেসলীর পক্ষে সম্ভব হত না।
টিপু সুলতান যেমন একদিকে ছিলেন বীর পিতার বীর পুত্র, মুজাহিদে মিল্লাত, অন্যদিকে ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় ও বিশুদ্ধ আকিদার মুসলমান। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি জীবন বাজি রেখে আমরণ লড়াই করে গেছেন। আর এটাই ছিল তাঁর জীবনের চাওয়া পাওয়া। এটাই ছিল তাঁর মিশন। সুন্নাতে নববীর অনুসরণে তিনি ছিলেন অনুপম দৃষ্টান্ত। একজন বুযুর্গ আলেম থেকে তিনি কোন অংশে কম ছিলেন না। তিনি জীবনের দীর্ঘ পরিসর অতিক্রম করে কর্ম জীবনে এসে তিনি তৎকালীন বিশিষ্ট ও স্বনামধন্য বীর সেনানী জেহাদী (ওহাবী) আন্দোলনের নেতা হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রায়বেলেববী (রহঃ)কে একটি ঈমানদীপ্ত চিঠি লেখেন। চিঠির ভাষা ছিল এইরকমঃ-
“মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অশেষ কৃপায় ও পরম অনুগ্রহে এবং নবী করীম (সাঃ) এর বরকতে মুসলিম সৈন্যদের অশ্বগুলো কাফেরদেরকে এমনভাবে পদপিষ্ট করেছে যে, তারা অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও পরাস্ত হয়েছে।”
হযরত টিপু সুলতান শহীদ (রহঃ) ২রা আগস্ট ১৭৮৬ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মাদ বেগ খান হামদানীর নিকট একখানি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি লিখেন যে,
“মুসলমানদের উপর নেমে আসা দুর্ভোগ, দুর্যোগ ও দুর্দিনের জন্য দিল্লীর শাসক গোষ্ঠীর দুর্বলতায় সবচেয়ে বেশী দায়ী । আজও যদি মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য এবং বিলুপ্ত সম্মান – সম্ভ্রন্ত ফিরে আসবে । তখন খোদাদ্রোহী কাফেরদের কোথাও আশ্রয় গ্রহণের ঠাঁই হবে না। সুতরাং মুসলিম নেতাদের এমন কোন কাজ করা উচিৎ নয়, যাতে আপামর মুসলিম জনসাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই চরম অধঃপতনের হেতু হিসাবে কাল কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে নবী করীম (সাঃ) – এর সামনে লজ্জিত ও অপমানিত হতে হয়।”
টিপু সুলতানের লেখা উল্লিখিত পত্রাবলীর ভাষায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ইসলামের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক ও অন্তরঙ্গতা। ফুটে উঠেছে তাঁর একনিষ্ঠ দেশপ্রেম, ইসলাম, মুসলমান ও স্বদেশের প্রতি তাঁর জীবন উৎসর্গকারী অদম্য স্পৃহা চিঠিগুলোর প্রতিটিশ শব্দে শব্দে সুর্য কিরণের মতো উজ্জ্বল। তাঁর সারাটি জীবন অতিবাহিত হয়েছে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদের উত্তপ্ত ময়দানে। দেশ, ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির ঐকান্তিক ফিকিরেই তাঁর দিন – রাত অতিবাহিত হত। বলতে গেলে এই ব্যাথায় তিনি সারাক্ষণ ছটফট করতেন। তিনি অন্য একটি পত্রে লিখেছেন,
“আজকের চিঠিতে আমি ঐ সকল মুসলিম সন্তানকে সতর্ক করছি যারা ইসলামের সাথে চরম গাদ্দারী করে বেড়াচ্ছে। যা ইসলামী শরীয়াতের বিপক্ষে অবস্থানকারী কাফের-মুশরিকদের আচরণেরই নামান্তর। প্রকারান্তরে তা কাফেরদের সাথে ঐক্যমতেরই শামিল। এ কারণেই আমি সম্প্রতি আল্লাহ ও রাসুলের বিভিন্ন বিধান সম্বলিত বহু হাদীস লিপিবদ্ধ করে গোটা দেশে সতর্কবাণীরুপে বিতরণ করে দিয়েছি।”
এই চিঠি দ্বারা বুঝা যায় যে টিপু সুলতান কুরআন ও হাদীসের কতখানী প্রচারক ছিলেন এবং জাতির জন্য কতখানি ব্যাথিত ছিলেন।
টিপু সুলতানের পররাষ্ট্র বিষয়ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ‘নিশানে হায়দারী’ নামক গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, তিনি তাঁর শাসনকালীন সময়ে ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ব্রিটিশ বিরোধীতা তখন দুটি দেশকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসে । সে সময় তিনি আফগানিস্তানের তৎকালীন বাদশাহকে আপন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন। তখন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই টিপু সুলতানের রাষ্ট্রদূতগণ তাঁকে ভারতের রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং তাতে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। আর এ ব্যাপারে তারা বাদশাহকে সীমাহীন সাহায্য সহায়তাও করেছিলেন।
টিপু সুলতান ১৭৮৪ খ্রীষ্টবাব্দে তুর্কীর সুলতান আব্দুল হামীদকে এক পত্র লেখেন যে, খ্রীষ্টানরা ব্যবসার ছদ্মবেশে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে আজ সেখানকার উপকূলীয় এলাকাগুলো জবরদখল করে নিচ্ছে। তাই ইসলামের খাতিরে আপনি কিছু সৈন্য ও রসদ পাঠিয়ে আমাদের সাহায্য করবেন বলে আমরা দৃঢ় আশাবাদী। আপনার সৈন্যদের বেতন – ভাতা টিপু (সুলতান) বহন করবে । এই আবেদনের পর তুর্কী সুলতানও তাঁর বন্ধুত্ব ও হিতাকাঙ্খীসুলভ হাত প্রসারিত করেন। এরপর ইরান ও অ-স্থিতিশীল মুঘল শাসকদের প্রতিও টিপু সুলতান সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন।
যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে টিপু সুলতান যুদ্ধ করছিলেন সেই সময় সে যুগের বীর সেনানী ও জেহাদী (ওহাবী) আন্দোলনের যুগশ্রেষ্ঠ মুজাহিদ হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রায়বেরেলী (রহঃ) – এর প্রতি টিপু সুলতান একটি পত্র লিখেন। পত্রে তিনি লিখেনঃ-
“মহা পরাক্রমশালী আল্লাম রব্বুল আলামীনের অপার অনুগ্রহে আমি শত্রু পক্ষকে নানাভাবে পর্যুদস্ত করে কৃষ্ণ সাগরের ওপারে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছি। তখন তারা অত্যন্ত বিনীতভাবে আমার নিকট সন্ধির আবেদন জানালো। অহেতুক মুসলমানদের জীবন নষ্ট না হয় এই চিন্তা করে আমি কিছু কঠোর শর্তে তাদের আবেদন মঞ্জুর করি। কিন্তু এখন আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা যে, আমি সেসব লোকদেরকে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করব; যারা মুসলমানদেরকে মসজিদে আযান দিতে বাধা দেয়। তাদেরকে এমন কঠিন শাস্তি দেব যেন সকল দুষ্ট প্রকৃতির এবং ভ্রান্ত মতবাদের আগাছা – পরগাছা থেকে দুনিয়াটা সাফ (পরিস্কার) হয়ে যায়। সর্বোপরি নবী করীম (সাঃ) – এর প্রাচারিত দ্বীন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।”
হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) টিপু সুলতানের প্রসঙ্গে লিখেছেন, টিপু সুলতান সৈয়দ আহমদ শহীদকে এক পত্রে লেখেন, তিনি ইংরেজ রাজকে উৎখাত করে ইসলামী আদর্শে দেশ গঠন করতে চান।
টিপু সুলতান অতি মাত্রায় ধর্মভীরু ছিলেন এবং জীবনে কখনো নামায কাযা করেন নি। মহীশূরের জামে মসজিদ নির্মিত হলে তার প্রথম জামাতে ঘোষণা করা হয় যে, মসজিদে তিনিই ইমামতি করবেন যিনি ‘সাহেবে তারতীব’, যে পূণ্যবান ব্যক্তির গোটা জীবনে পাঁচ ওয়াক্তের বেশী নামায কাযা নেই তাঁকে ফিকহী পরিভাষায় ‘সাহেবে তারতীব’ বলা হয়। টিপু সুলতানের এই ঘোষণা করার পর কেউ নামায পড়াতে এগিয়ে এলেন না। শেষ পর্যন্ত টিপু সুলতান স্বয়ং সেই নামায পড়ান। ইতিহাসের এই অকুতোভয় বীর সেনানী টিপু সুলতান প্রতিনিয়ত অধিক পরিমানে কুরআন শরীফ পাঠ করতেন, তাঁর কখনো তাহাজ্জুদ বাদ পড়ত না। তিনি ‘সাহেবে তারতীব’ ছিলেন । তাঁর অনুপম লজ্জাশীলতা সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তাঁর দুই পায়ের টাখনু, হস্তদ্বয় এবং মুখমণ্ডল ব্যাতীত অপদমস্তক সারা শরীরই সব সময় আবৃত থাকত। কখনও তিনি কারো সামনে অন্য কোন অঙ্গ অনাবৃত করতেন না । তাঁর মুখে দাড়ি ছিল।
আজকের দিনে টিপু সুলতানের যে ছবি ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকগুলিতে দেখানো হয় প্রকৃতপক্ষে সে ছবি টিপু সুলতানের নয়। কেননা, সেই ছবিতে টিপু সুলতানের মুখে দাড়ি নেই। অথচ বাস্তবে টিপু যেমন নিয়মিত নামায পড়তেন তেমনি তাঁর মুখে দাড়িও ছিল। ‘উলামায়ে দেওবন্দ কিয়া আওর কৌন হ্যায়’ কিতাবের মধ্যে লেখা আছেঃ-
“নেসাবে তালিমমে আজ ইউনিভার্সিটি আওর কলেজকে নেসাব মে সুলতান টিপু কি তারিখ কো মুকাম্মাল তৌর সে পড়ায়া নহী জাতা। আজ সুলতান টিপু কো ওহ তাসবীর যো কিতাবোঁ মে আপ লোগো কো দিখায়া যাতি হ্যায় ওহ সুলতান টিপু কি তাসবীর নহী হ্যায়। হালাঁকে সুলতান টিপু নে সারি জিন্দেগী দাঢ়ি নহী মুণ্ডায়ী। লেকিন সুলতান টিপু কা যো ফোটো জো কিতাবোঁ মে ছাপায়া গিয়া হ্যায় ইসমে দাঢ়ি নেহী হ্যায়। লেকিন সুলতান নে সারি জিন্দেগী কভী দাঢ়ি পর উস্তরা নহী ফিরায়া। সুলতান টিপু দাঢ়িহ কি সুন্নত কা পাবন্দ থা।” (পৃষ্ঠা-৮)
অর্থাৎ – “কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির পাঠ্যপুস্তকে টিপু সুলতানের ইতিহাস পূর্ণাঙ্গভাবে পড়ানো হয় না। আজকাল টিপু সুলতানের যে ছবি যা বইয়ের মধ্যে আপনাদেরকে দেখানো হয় সেটি টিপু সুলতানের ছবি নয়। কেননা টিপু সুলতান জীবনে কখনো দাড়ি মুণ্ডন করেননি। কিন্তু টিপু সুলতানের যে ছবি বই-পুস্তকে ছাপা হয়েছে সেখানে দাড়ি নেই। অথচ সুলতান জীবনে কখনো দাড়ির উপর খুর চালাননি। টিপু সুলতান দাড়ির সুন্নতের পাবন্দ ছিলেন।”
অনেকে টিপু সুলতানকে হিন্দু বিদ্বেষী, মন্দির ধ্বংসকারী ও ৩০০ জন ব্রাহ্মণকে হত্যাকারী বলেছেন। সত্যের খাতিরে বলতে হয় এই তথ্য সঠিক নয়। তিনি ধর্মভীরু হলেও একজন অসাম্প্রদায়িক ও পরধর্মসহিষ্ণু সুলতান ছিলেন। ব্রিটিশরা ঐতিহাসিকরাই টিপু সুলতানকে হেয় প্রতিপন্ন করার উক্ত গল্প ফেঁদেছেন। কেননা, ব্রিটিশরা ছিল টিপুর প্রথম সারির শত্রু। পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের পোষ্যপুত্র ভারতীয় মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু ঐতিহাসিকরাও টিপুকে হিন্দু বিদ্বেষী বলেছেন এবং ব্রিটিশের চর্বিত চর্বন করেছেন। যেমনটা তাঁরা মহান সম্রাট ঐরঙ্গজেবকে হিন্দু বিদ্বেষী সাজিয়েছেন।
টিপু সুলতানের পরধর্মসহিষ্ণুতার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন তিনি হিন্দু পুর্ণিয়া নামক ব্যক্তিকে নিজের প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। তাঁর প্রধান সেনাপতি কৃষ্ণ রাও ছিলেন হিন্দু। যদিও এরা পরপর্তীকালে টিপুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। টিপু সুলতান প্রতিদিন রঙ্গনাথস্বামীর মন্দির দর্শন করতেন। শৃঙ্গেরী মঠের অধ্যক্ষ্য জগৎগুরু শঙ্করাচার্যের সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ইংরেজ ঐতিহাসিক Praxy Fernandes তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণাগ্রন্থ The tigers of Mysore, A Biography of Hyder Ali and Tipu Sultan গ্রন্থে টিপু সুলতানের পরধর্মসহিষ্ণুতার কথা লিখেছেন এবং হিন্দু বিদ্বেষী তথ্যের খণ্ডন করে লিখেছেনঃ-
“Tipo not only continued Inam Grants of Brahmins and temples but also Sanctioned fresh ones. In the course of the Third Anglo-Mysore war, when he visited Conjevaram, he gave 10,000 huns to words the construction ofv the Gopur temple, whose foundation had been laid by his father. A greenish jade lingam was installed in the Nanjan-desware temple of Nanjangud on the Sultan’ orders. The magnificient temples of Sri Ranganath, Sri Narasimha and Sri Gandeswara Situated near Tipu’s place as Sri Rangapattanam still bear eloquent testimony to Sultan’s liberalism.” (The Martyr of Mysore: Abdus Subhan: The Sunday, Statement, 22.12.91)
টিপু সুলতান একজন সফল বীর ছিলেন বলেই তাঁকে ‘Tigers of Mysore’ বা ‘মহীশূরের বাঘ’ বলা হয় । তিনি কাপুরুষের জীবন যাপন অপেক্ষা বীরত্বের সাথে মৃত্যু বরণ করাকেই পছন্দ করতেন। সেজন্যই তিনি মৃত্যুর সময় ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় বলেছিলেন,
“শৃগালের মত শত বছর বেঁচে থাকার চেয়ে হিংহের মত এক দিনের জীবনই শ্রেয়। শহীদের রক্ত বৃথা যায় না। এক রক্ত থেকে জন্ম নেওয়া জাতি আযাদির পতাকাবাহীদের জন্ম দিয়ে থাকে।”
সত্যই টিপু সুলতান বাঘই ছিলেন। তাঁর সিংহাসনটিও ছিল ব্যাঘ্রচিহ্নিত। পতাকাটিও ছিল ব্যাঘ্রচিহ্নিত। পরে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু টিপু সুলতানের ব্যাঘ্রচিহ্নিত পতাকাটি ভারতের জাতিয় পতাকা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
টিপু সুলতান ও তাঁর পিতা হায়দার আলী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ৩৮ বছর ধরে যুদ্ধ করেছেন তবুও ব্রিটিশ বেনিয়াদের কাছে মাথা নত করেন নি। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে টিপু সুলতান ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই মে যুদ্ধের ময়দানে ময়দানে শহীদ হয়েছেন। টিপুর শহীদ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর ১২জন পুত্র এবং ৪ জন কন্যাকে ভোলার দুর্গে আটক করা হয়। বন্দী অবস্থায় বিদ্রোহ করতে পারে জেনে ইংরেজরা তাঁদেরকে কোলকাতায় নির্বাসনের ব্যবস্থা করে।
টিপুর ১২ জন পুত্রের মধ্যের জৈষ্ঠপুত্র ফতেহ হায়দার সুলতান ছিলেন ১৮৫৭ খ্রীষ্টদাব্দের মহাবিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।
ভাগ্যের কি পরিহাস দেখুন টিপু সুলতানের ষষ্ঠ বংশধর আখতার শাহ ১৯৯১ খ্রীষ্টাব্দে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। তাঁর পুত্রদের মধ্যে আনোয়ার শাহ, দেলওয়ার শাহ, সানওয়ার শাহ ও মুহাম্মাদ হোসেন শাহ ভাগ্যচক্রে আজ রিক্সাচালক। টালিগঙ্গের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আজ তাঁদের হাতছাড়া। ৭৭ বিঘা জমির লিজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সে জমি আজ তাঁরা পুনর্দখল পাননি। সেসব কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আজ ভোগ করছে রয়েল কোলকাতার গলফ ক্লাবের সদস্যরা। কোলকাতার ধর্মতলায় টিপু সুলতান মসজিদ নির্মান করেছেন তাঁর বংশধরেরা। আজ তাঁরা দরীদ্রের চরম সীমানায়। মুসলমানদের এই চরম মুহুর্তকে দেখেই উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন,
“একশত সত্তর বৎসর পূর্বে বাঙ্গালার একজন ভদ্র মুসলমানের গরীব হওয়া অসম্ভব ছিল, এখন তার পক্ষে ধনী হয়ে চলাই অসম্ভব।”