লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
বিভিন্ন ড্রাগ অর্থাৎ মাদকদ্রব্য ও পর্ণের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়না। তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পর্ণ দেখার ফলে আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের আনন্দদানকারী রাসায়নিক বা কেমিক্যাল পদার্থের উৎপন্ন হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল এই একই ধরণের কেমিক্যাল ড্রাগ বা বিভিন্ন মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কেও উৎপন্ন হয়। পর্ণ বা ড্রাগে আসক্ত মস্তিষ্ক নতুন করে নিউরাল সার্কিট (Neural Circuit) তৈরি করা শুরু করে।
এখানে একটি উল্লেখ্য যে, নেশার জন্য ড্রাগ বা বিভিন্ন মাদকদ্রব্যগুলির উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে আইনের চোখে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্নভাবে কাঠখড় পুড়িয়ে গোপনে সংগ্রহ করতে হয়, কিন্তু পর্নগ্রাফি ডাউনলোড করা হয় একেবারেই বিনামূল্যে, ফ্রিতে। ড্রাগের নেশা খুব দ্রুত প্রবল হতে থাকে, অন্যদিকে পর্নের নেশাটি নির্ভর করে ইন্টারনেটের দ্রুততা বা স্পিড কিরকম তার উপর। তবে এদের মধ্যে একটাই মিল সেটা হল মস্তিষ্কের ভেতর। দুটোতেই মস্তিষ্কের উপর মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে।
যাঁরা নিউরোলজিষ্ট তাঁরা ভালভাবেই জানেন যে আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে রিওয়ার্ড প্যাথওয়ে (reward pathway) বা পুরষ্কার তৈরীর পথ বলে একটি ব্যাপার থাকে। এই রিওয়ার্ড প্যাথওয়ের কাজটা হল, আপনাকে ঠিক সেভাবে পুরস্কৃত করে ঠিক যেভাবে সে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সহজ ভাবে বলতে গেলে, মস্তিষ্কের এই সার্কিটটি আপনাকে আনন্দ দেয় যখন আপনি আপনার জীবনকে অগ্রসর করার মতো কোন কিছু করেন। সুস্বাদু কোন খাবার খাওয়ার সময় আমাদের মস্তিষ্কে এমনটা ঘটে থাকে তখন আমাদের মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এদের মধ্যে সাধারণত যে রাসায়নিক পদার্থটি নির্গত হয় তার নাম হচ্ছে ডোপামিন, কিন্তু অক্সিটোসিনের মতো অন্য রাসায়নিক পদার্থটি নির্গত হয়।
এইসব রাসায়নিক পদার্থগুলি ব্যাপক হারে হারে উৎপন্ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ, স্বস্তি পাওয়া যায় এমন যেকোনো কিছুতেই এইসব রাসায়নিক পদার্থগুলি উৎপন্ন হতে থাকবে। মহান সৃষ্টিকর্তা এভাবেই এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন। এদের কাজ আমাদের পরিতৃপ্ত হয় এমন কিছুকে অনুভব করানো, বিভিন্ন মানুষদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করা এবং আনন্দদায়ক কোনো কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। তবে এর একটা সমস্যাও আছে তা হল, এই রিওয়ার্ড প্যাথওয়ে হাইজ্যাকড্ (hijacked) হবার সম্ভাবনাও রয়েছে।
নেশা জাতীয় দ্রব্যগুলো সেবনের সময় অধিক পরিমানে ডোপামিন নির্গত করতে চায়। ফলে এইসব ডোপামিনগুলি মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড প্যাথওয়েতে আঘাত হানে। ফলে নেশাখোরেরা মাতাল হয়ে উন্মাদের মত আচরণ করে। আশ্চর্যের বিষয় হল পর্নগ্রাফীও ঠিক সেরকম আচরণটিও করে থাকে পর্ণ এডিক্টদের উপর।
একজন মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী বা পর্নগ্রাফি এডিক্ট যত বেশী মাদকদ্রব্য সেবন করে বা পর্ন দেখে, তাদের মস্তিষ্কে এই প্যাথওয়েগুলো তত বেশি উৎপন্ন হয়। মাদক বা পর্ন ব্যবহার আরও সহজতর করতে থাকে। যার ফলে উক্ত মানুষগুলো বার বার মাদক সেবন করতে চায় কিংবা পর্ন দেখার জন্য তাদের মন ছটফট করতে থাকে।
পর্ন ব্যবহারকারীরা কিন্তু সহজে তাদের মস্তিষ্কের এইসব পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারে না। কেননা তাদের মস্তিষ্ক থেকে এতটাই ডেপামিন উৎপন্ন যে তারা অতিরিক্ত ডোপামিনের বোঝা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মস্তিষ্ক কিছু পরিমান ডোপামিন রিসেপ্টর (dopamine receptor) কমিয়ে ফেলে। রিসেপ্টর কম থাকার ফলে ডোপামিনের পরিমান কমে গেছে বলে মনে হয়। তাই একই রকমের পর্ন ব্যবহারকারী আগের মতো আর উত্তেজনা দেয়না। ফলে অনেক পর্ন ব্যবহারকারীরা আরো অধিক পরিমাণে পর্ন সার্চ করতে থাকে, আরো এক্সট্রিম লেবেলের পর্নের দিকে তারা ঝুঁকে পড়ে। তাদের একটাই উদ্দেশ্য তা হল অতিরিক্ত পরিমাণে ডোপামিন উৎপাদনের মাধ্যমে আগের উত্তেজনা ফিরে পাওয়া, আধিক পরিমাণে উত্তেজনা সৃষ্টি করা। যেমনটা ড্রাগ সেবনকারীরা সময়ে ড্রাগ না পেলে পাগলের মত আচরণ করে অনুরুপ পর্ন এডিক্টরাও আরো এক্সট্রিম লেবেলের পর্ন দেখতে না পেলে তারাও পাগলের মত আচরণ করে থাকে। আইনজীবী ওয়েনডি সেলজার ইয়েল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের একজন সহকর্মী, তিনি বলেন,
“পর্নে আসক্ত ব্যক্তির চাহিদা আরও অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। (ইন্টারনেটের) বিনামূল্যের পর্নগুলো তাদের জন্য যথেষ্ট চাহিদার খোরাক জোগায় জোগায় না, বরং তাদের ক্ষুধা বৃদ্ধি করে দেয়। বিনামূল্যের পর্নগুলো দেখতে দেখতে তারা পেইড পর্নের দিকে ঝুকে পড়ে।”
এর জন্য দায়ী ইন্টারনেটের সেইসব ওয়েবসাইট এবং সেই সকল ওয়েব ব্রাউজারগুলো যাদের গর্ভে পর্ন বিস্তার লাভ করছে এবং ডোপামিনের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুণ সমাজকে। ইউ.এস. সিনেট কমিটিকে, ডঃ জেফারি স্যাটিনোভার পর্নের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বলেছিলেন,
“আমরা যেন নতুন এক হিরোইনের উদ্ভব ঘটিয়েছি.. যা নিজের ঘরে সম্পূর্ণ প্রাইভেসির মধ্যে ব্যবহারযোগ্য এবং চোখের মাধ্যমে সরাসরি চলে যায় মস্তিষ্কে।”
এতক্ষণ আলোচনা করা হল পর্নগ্রাফি কিভাবে মস্তিষ্কে ড্রাগের মত প্রভাব বিস্তার করে। এবার আলোচনা করব পর্ণ কিভাবে মানুষের মস্তিষ্কের গঠনকে পরিবর্তন করে ফেলে। আগেই বলা হয়েছে যে, আসক্তি সৃষ্টকারী ড্রাগের মতো পর্নও আমাদের মস্তিষ্কে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিনের উৎপন্ন করে। পর্ন যতবার দেখা হয় ঠিক ততবার আমাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিক পদার্থ বয়ে যেতে থাকে। তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন রিওয়ার্ড প্যাথওয়ে (reward pathway) যা একজন পর্ন ব্যবহারকারীর মস্তিষ্কের গঠনকে একেবারে পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে পর্নের প্রতি মারাত্মক রকমের আসক্তি সৃষ্টি হয়। শুনতে আশ্চর্য লাগলে এটাই সত্যি যে পর্ন আমাদের মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তন করে দেয়। স্নায়ুবিজ্ঞানীদের মুখে শোনা যায়: “Neurons that fire together, wire together”। অনেকে এটা ভেবে অবাক হবেন যে নিউরোনে আবার আগুন ধরে কীভাবে? নিউরন হলো ব্রেইনের একটি কোষ (cell), মানুষ যখন কিছু দেখে, শোনে বা কোনো ধরনের ঘ্রাণ পায় ঠিক তখনি মস্তিষ্কের এই কোষগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। যেমন যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রী বা যে কোন নারীকে স্পর্শ করে তখন তার মস্তিষ্ক থেকে যে রাসায়নিক পদার্থটি নির্গত সেটি হচ্ছে অক্সিটোসিন। এটি মানুষের সাথে সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে সহায়তা করে।
ড্রাগের মতো পর্ন আমাদের মস্তিষ্ককে ডোপামিনে ডুবিয়ে দেয়। পর্নগ্রাফি দেখার ফলে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত পরিমাণে ডোপামিন উৎপন্ন হয়ে থাকে। অতিরিক্ত ডোপামিন নির্গত হওয়ার ফলে তা থেকে রক্ষা পাবার জন্য মস্তিষ্ক কিছু পরিমাণ ডোপামিন রিসেপ্টর কমিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক নিউরনের শেষ প্রান্তে থাকা ছোট কানের মতো অংশকে ব্যবহার করে থাকে। এটি ডোপামিনের পরিমাণ নির্ণয় করে। এর আগে আমরা জেনেছি যে, যখন মস্তিষ্কে রিসেপ্টর কম থাকে, তখন পর্ন দেখার ফলে ডোপামিন উৎপন্ন হতে থাকলেও, পর্ন আসক্ত ব্যক্তিরা এর প্রভাব খুব একটা বুঝতে পারে না। তাই একই লেবেলের পর্ন আর আগের মতো তাদের মনে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারেনা। ফলে অনেক পর্ন ব্যবহারকারীরা আরো অধিক পরিমাণে পর্ন সার্চ করতে থাকে, তাদের আরো এক্সট্রিম লেবেলের পর্ন দেখার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাদের একটাই উদ্দেশ্য অতিরিক্ত পরিমাণে ডোপামিন উৎপাদনের মাধ্যমে আগের উত্তেজনা ফিরে পাওয়া। আধিক পরিমাণে উত্তেজনা সৃষ্টি করা। যেমনটা ড্রাগ সেবনকারীরা সময়ে ড্রাগ না পেলে পাগলের মত আচরণ করে অনুরুপ পর্ণ এডিক্টরাও আরো এক্সট্রিম লেবেলের পর্ণ দেখতে না পেলে পাগলের মত আচরণ করে থাকে। পর্ন ছাড়া টিকে থাকাটা তাদের কাছে অসম্ভব হয়ে পড়ে। পর্নগ্রাফি এতটাই আসক্তিকর। শুধু তাই নয় একজন পর্ন ব্যবহারকারীর জীবনে নিত্য নতুন সমস্যা দেখা দেয়, কারণ, পর্ন আসক্তি মস্তিষ্কের ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে ফলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
ভালোলাগা পদ্ধতি বা liking system হল মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারের একটি ছোট ভাগ বা অংশ। এটা আনন্দময় মুহূর্তের অনুভূতি দেয় যখন মানুষ কোন কাজে সফল হয় তখন আনন্দ উপভোগ করে, দুঃখজনক বা ক্ষতিকর কোন কিছু ঘটলেও এ পদ্ধতিটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেমন, নেশাজাতীয় কোন কিছু সেবন করা বা পর্ন দেখা প্রভৃতি। ফলে প্রথমদিকে যে কাজগুলো শুধু ভালো লাগতো পরবর্তীকালে আসক্তিতে পর্যবসিত হয়।
যখন কোনো কিছু আপনার মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে সক্রিয় করে তোলে আর মানুষ ভালোলাগার আধিক্য অনুভুতি লাভ করে, তখন মস্তিষ্কে ‘CREB’ নামক একটি ক্যামিকেল পদার্থ নিঃসৃত করতে শুরু করে। CREB আপনার রিওয়ার্ড সিস্টেমে কিছু বাধার সৃষ্টি করে। এটা সাধারণত আনন্দকে বিলীন করে দেয়, আপনাকে তৃপ্ত করে তোলে আর জীবনে সামনে অগ্রসর হতে প্রস্তুত করে তোলে। তবে liking system সময়ে সময়ে অধিক সক্রিয় হয়ে উঠলে (যা ড্রাগজাতীয় দ্রব্য ও পর্নের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে) CREB লেভেল বেড়ে যায় যা মানুষের আনন্দ-উপভোগকে অসাড় করে দিতে সক্ষম। গবেষকরা বলেন, CREB এর কারণে আসক্তরা এইসব আসক্তির কাজগুলিকে সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করে। অর্থাৎ অধিক পরিমাণে আনন্দ লাভ করার জন্য একই কাজ বার বার করতে থাকে। এমনকি মস্তিষ্কে CREB এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার জন্য মানুষকে সবধরনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে সক্ষম। এজন্যই একজন আসক্ত ব্যক্তি উদাসীনতা ও বিভিন্ন ধরণের মানসিক ডিপ্রেসন অনুভব করে।
ডেল্টাফসবি নামক প্রোটিনটি শক্তিশালী ট্রিগারের মত কাজ করে। এরকম ট্রিগার প্রতিটি আসক্তির মধ্যে রয়েছে। একজন ধূমপানকারীর কাছে ট্রিগার হতে পারে বিড়ি বা সিগারেটের ঘ্রাণ, একজন মদ্যপের জন্য ট্রিগার হতে পারে মদের বোতল বা মদখোর সঙ্গীর ডাক। অনুরুপ একজন একইভাবে পর্ন আসক্তির কাছে ট্রিগার হতে পারে পর্ন দৃশ্য মনে পড়ে যাওয়া অথবা কোনো নির্জন জায়গা বা পরিবেশ অথবা এমন কোনো সময যখন সে নির্জনে একাকী ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে পারে। একজন পর্নগ্রাফি আসক্ত ব্যক্তির কাছে আশেপাশের যে কোন কিছুই ট্রিগার হতে পারে যা তাকে পুনরায় আসক্তির কাছে নিয়ে যেতে পারে। ক্রমে মস্তিষ্কে পর্নের পাথওয়ে এতই সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে যার দ্বারা আসক্ত ব্যক্তি আশেপাশের যেকোনো কিছু মাধ্যমেই ট্রিগারড হতে পারে। তারা আগের মতো আনন্দ লাভের জন্য আরও বেশি সময় ধরে পর্ন দেখে, আরও এক্সট্রিম লেবেলের পর্ন দেখতে থাকে। অনেক পর্ন ব্যবহারকারীরা পর্নের আগ্রাসী ও সহিংস দৃশ্যগুলোকে নিয়ে কল্পনায় মেতে থাকে, এমনকি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার জন্য মেতে ওঠে। এভাবে পর্ন ব্যবহারকারীর রুচি আরও নিচে নামতে থাকে আর পর্নোগ্রাফাররা গ্রাহক ধরে রাখার জন্য আরও কুরুচিকর ভিডিও বানাতে থাকে। চলতে থাকে ইন্টারনেটের অন্ধকার জগতের রহস্যময় ব্যবসা। পুঁজিপতিরা আরও পুঁজির মালিক হয়ে ওঠে আর পর্ন আসক্ত ব্যক্তির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার ও হতাশা।
প্রায় ১০ বছরেরও অধিক সময় ধরে করা কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ড্রাগ আসক্তি মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবকে সংকীর্ণ করে ফেলে। ফ্রন্টাল লোব মস্তিষ্কের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। এটি বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যায়, শুধুমাত্র ড্রাগ আসক্তিই মস্তিষ্কের এই অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, যারা বেশি পর্ন দেখে, তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতিও তত মারাত্মক হয়, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে সুখবর হচ্ছে- এই কু-অভ্যাস পরিত্যাগের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ককে আগের মত সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাই সঠিক সময়ে যদি পর্ন আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসা না যায় তাহলে এই পর্নের মায়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
অনেকের ধারণা যে পর্নগ্রাফি র প্রতি আসক্তি বলে কিছু নেই। তাঁরা মনে করেন, কোনো কিছু শরীরে প্রবেশ না করালে আসক্তি সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের মত শরীরে প্রবেশ না করে আসক্তি হয় না। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান অন্য কথা বলে। মানুষের এই প্রাচীন ধারণাকে বিজ্ঞান একেবারে পরিবর্তন করে দিয়েছে। বর্তমান বিজ্ঞানীদের মতে অতিরিক্ত পর্ন ব্যবহারের ফলে আসক্তির সৃষ্টি হয়। US National Institute on Drug Abuse (NIDA) এর ডিরেক্টর ডঃ নরা ভলকোর এর বক্তব্য পর্ন আসক্তি সত্য। শুধু তাই নয় তিনি NIDA এর নাম এমনভাবে রাখার পরামর্শ দেন বলেন যাতে নাম দেখলেই বোঝা যায় যে, “পর্নোগ্রাফি, জুয়া, অতিরিক্ত ভক্ষণ আসক্তির কাতারে পড়ে”।
এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ইন্টারনেটে যা সার্ফিং হয় তার সবকিছুর মধ্যে পর্নের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে অধিক। আমাদের মস্তিষ্কে “রিওয়ার্ড সেন্টার” নামক একটা স্থান আছে। এটি জীবন ধারণের জন্য যেসব কাজের প্রয়োজন সেইসব কাজের উপর জোর দেয়। আমরা যখন আমাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করি তখন “রিওয়ার্ড সেন্টার” আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ তৈরি করে। বিজ্ঞানীদের মতে পর্ন হচ্ছে সেক্সচুয়াল জাংক ফুডের মত, যখন কেউ এটা দেখতে থাকে, তখন তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন উৎপন্ন হতে হতে উপচে পড়ার উপক্রম হয়। অতিরিক্ত পরিমাণে নির্গত হওয়ার জন্য পর্ন, জাংক ফুডের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। পর্ন দেখার সময় মানুষের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারে বার্তা যায়। এটি মস্তিষ্কে ডোপামিন নির্গত করার জোর দেয়। পরবর্তীতে ডেলটাফসবি (DeltaFosB) সহ অন্যান্য কেমিক্যাল নির্গত হতে থাকে। যা শরীরের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর।
ডেলটাফসবি এর কাজ হল মস্তিষ্কে নতুন নার্ভ প্যাথওয়ে সৃষ্টি করা। এর সাহায্যেই কাজ ও অনুভূতির মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। পর্ন দেখার এই অনুভূতিগুলো এতো বেশী শক্তিশালী হয় যে, এগুলো মস্তিষ্কের অন্যান্য অনুভূতি সৃষ্টকারী সংযোগগুলোকে অতিক্রম করে, ফলে একজন পর্ন ব্যবহারকারী অন্য কাজগুলোর উপর পর্নকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। ডেলটাফসবি এর আর একটি কাজ হল পরিমিত পরিমাণে উৎপন্ন হওয়ার মাধ্যমে একটি জেনেটিক বা জিনের পরিবর্তন ঘটায়। এতে একজন পর্ন আসক্তি ব্যক্তির পর্নের প্রতি আরো বেশি দুর্বল হয়ে যায়। এর আরেকটি নাম হল “মলিকিউলার সুইচ ফর অ্যাডিকশন”। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই ঝুঁকি আরো বহুগুণ। কারণ তাদের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টার একজন প্রাপ্তবয়স্কের মস্তিষ্কের চেয়ে দুই থেকে চারগুণ দ্রুত সাড়া দেয়। উৎপন্ন হয় আরো বেশি ডোপামিন ও ডেলটাফসবি। এই অতিরিক্ত ডোপামিনের উৎপন্ন হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মস্তিষ্ক আরেকটি রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যার নাম হল CREB (Cyclic Adenosine Monophosphate Response Element Binding Protein!)। যার কাজ হল রিওয়ার্ড সেন্টারকে অধিক পরিমাণে ডোপামিন উৎপন্ন করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা থেকে মানুষকে বিরত রাখা। মস্তিষ্কে যখন CREB নির্গত হয় তখন একজন পর্নের প্রতি আসক্ত ব্যক্তিকে আর আগের মতো আনন্দ দান করতে পারে না। তাই সে আগের উত্তেজনা ও আনন্দ পাওয়ার জন্য আরো অধিক পরিমাণে পর্নগ্রাফি দেখে। গবেষকদের মতে CREB এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। পর্নের প্রতি এই আসক্তিকে বলা হয় “টলারেন্স”, যা সব ধরনের আসক্তির ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে কাজ করে ডেল্টাফসবি, একে বলা হয় ‘আসক্তির আণবিক সুইচ’। কারণ প্রোটিনটা মানুষের বিভিন্ন ধরণের চাহিদাকে জাগ্রত করে তোলে। মস্তিষ্কে এর পরিমান বেড়ে গেলে এটা জিনের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে যা মানুষের আসক্তিকে আরও বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছে দিতে সক্ষম।
একজন পর্নগ্রাফি আসক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনের কাজ করে আর আনন্দ পায় না যা তারা আসক্তির আগে পেত। যেমন, খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা প্রভৃতি। তারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলি পর্ন দেখে ব্যয় করে দেয়। তাদের পর্নের প্রতি আকাঙ্খা এতটাই তীব্র হয়ে যায় যে সব কাজ ছেড়ে দিয়ে পর্নের পিছনে সময় ব্যয় করতে থাকে। ক্রমাগত এই অভ্যাস তীব্র হয়ে যাওয়ার জন্য তারা আরও এক্সট্রিম লেবেলের পর্ন দেখতে শুরু করে। পর্নে আসক্তদের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু পরিবর্তনও দেখতে পাওয়া পায়। যেসব যৌন ক্রিয়া তাদের কাছে জঘন্য বলে মনে হতো, পর্ন দেখার পর থেকে সেগুলোই তাদের কাছে উত্তেজনাকর হয়ে দাঁড়ায়। একথা সবাই জানেন, ইঁদুর পচা লাশের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। জিম ফস্ট নামক একজন গবেষক ইঁদুরের এই স্বভাবটা পরিবর্তন করার জন্য একটা মহিলা ইঁদুরের গায়ে এক ধরণের লিকুইডযুক্ত স্প্রে মারেন যার গন্ধ পচা লাশের মতো। এরপর তিনি একটি খাঁচার ভেতর কিছু পুরুষ ইঁদুরের মধ্যে সেই মহিলা ইঁদুরটিকে ছেড়ে দিলেন। অবাক করা তথ্য হল যখন পুরুষ ইঁদুরগুলো তারা মহিলা ইঁদুরটির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, যে পচা লাশের গন্ধের ব্যাপারটা পুরোপুরি এড়িয়ে যায়। এবং যখন পুরুষ ইঁদুরগুলো মৃত পচা লাশের দুর্গন্ধযুক্ত মহিলা ইঁদুরের সাথে সেক্স করাতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন জিম ফস্ট এক কাজ করলেন, তিনি সেই মহিলা ইঁদুরটিকে এবং পুরুষ ইঁদুর থেকে আলাদা একটি খাঁচায় রেখে বিভিন্ন ধরণের খেলনা দিয়ে খেলতে দিলেন। তবে সেইসব খেলনার মধ্যে বেশ কয়েকটি খেলনায় সেই পচা লাশের গন্ধযুক্ত লিকুইড স্প্রে করেন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পুরুষ ইঁদুরগুলো সব খেলনার মধ্যে পচা লাশের গন্ধযুক্ত খেলনাগুলোকে নিয়েই খেলতে শুরু করলো। সেইসব ইঁদুরগুলোর কাছে পচা লাশে গন্ধটাই এখন পছন্দনীয় হয়ে ওঠেছিল। এখন প্রশ্ন হল, ইঁদুরের একটা স্বাভাবিক স্বভাবকে কীভাবে বদলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে? এর উত্তর হল, সব ধরণের স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কে “রিওয়ার্ড সেন্টার” নামক একটা জিনিস আছে। এটি আমাদের ভালো অনুভূতি দেয়। মস্তিষ্কে বিভিন্ন আনন্দ দানকারী কেমিক্যালের মিশ্রণে অনুভূতির উদ্ভব হয়। ভাল কিছু করার সময় সেই দিকে আমাদের ধাবিত করে আবার ক্ষতিকর কোন কিছু করার সময় মস্তিষ্কের এই অংশটি আমাদের সেইদিকেই ধাবিত করে অর্থাৎ মস্তিষ্ক পুরর্গঠিত (rewired) হয়ে আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতার বিপরীতটা কাজটা করে থাকে।
এবার আসি ইঁদুরের স্বাভাবকেকেন বদলে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল তার ব্যাপারে। পচা লাশের দুর্গন্ধযুক্ত মহিলা ইঁদুরের সাথে সেক্স করার ফলে উক্ত পুরুষ ইঁদুরগুলোর মস্তিষ্ক পুরর্গঠিত (rewired) হয়েছিল। অর্থাৎ, যে গন্ধ ইঁদুর সহ্য করতে পারেনা সেই গন্ধটাই তাদের ভালো লাগাতে শুরু হয়েছিল। একইভাবে ইঁদুরের উক্ত ঘটনার মত মানুষের মস্তিষ্কও পর্নগ্রাফি দ্বারা পুনর্গঠিত (rewired) হয়ে থাকে। পর্ন আসক্তিদের বক্তব্য যে তারা শুধু বিনোদনের জন্য পর্ন দেখে, কারও ক্ষতি তো করে না। কিন্তু ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে অন্যের ক্ষতি না করলেও ভয়ঙ্কর ক্ষতিটা হচ্ছে তাদের নিজেদের মস্তিষ্কে। মানুষ যখন আরাম করে পর্ন দেখে, তখন মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয়না। মস্তিষ্ক মানুষের যৌন অনুভূতিকে পর্নের সাথে সংযুক্ত করাতে ব্যস্ত থাকে। তাই তাদের আরো এক্সট্রিম পর্ন দেখার প্রতি প্রবণতা বাড়তে থাকে। নতুন ক্যাটাগরীর পর্ন সার্চ করে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। বাড়ে বিকৃত যৌনাচার।
একবার ১৫০০ জন পর্ন আসক্ত যুবকের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। তাদের শতকরা ৫৬ জন বলে যে, যতই তারা পর্ন দেখতে থাকে, তাদের রুচি ততোই এক্সট্রিম লেবেলের পর্নের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্নে যেসব বিকৃত যৌনাচার দেখার আগে তারা অনৈতিক ও জঘন্য কাজ বলে মনে করত পর্নে আসক্ত হওয়ার পর সেগুলোই তাদের কাছে ভাল লাগাতে পরিণত হয়ে যায়। ঠিক উপরোল্লিখিত ইঁদুরের মত। এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে পর্নে আসক্ত ব্যক্তিরা তাদের স্ত্রীর যৌন আবেদনে সাড়া দেয়না, কিন্তু পর্ন দেখার সময় ঠিকঠাক দেখে নিচ্ছে। অবস্থাটা কতটা নির্মম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তা সহজেই বোঝায় যাচ্ছে। পর্নে যেসব বিকৃত যৌন ক্রিয়া দেখানো হয় সেগুলো দেখতে দেখতে পর্নে আসক্ত ব্যবক্তিরা সেই বিকৃত যৌনাচারকেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নেয়। অথচ আগে এই বিকৃত যৌনাচারকেই তারা ঘৃণা করত। গবেষণায় দেখা গেছে যারা পর্ন দেখে তারা উগ্র সেক্স করা, এমনকি পশুর সাথে যৌন ক্রিয়া করাকেও তারা অস্বাভাবিক মনে করেনা। শুধু অস্বাভাবিক মনে করে না এমন নয় তারা এসব ব্যক্তিগত জীবনেও প্রয়োগ করাকে স্বাভাবিক মনে করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, পর্নগ্রাফি দেখার ফলে মানুষের যৌন চেতনাতেও পরিবর্তন আসে। পর্নগ্রাফি আসক্ত ব্যক্তিরা নারী নির্যাতনের মতো জঘন্য কাজকেও সমর্থন করে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে পর্নগ্রাফি আসক্ত পুরুষদের দ্বারা নারীরা প্রতারণার শিকার বেশি হয়। ২০১৫ সালে ৭টি দেশে ২২টি গবেষণায় দেখা যায় যারা অতিরিক্ত পর্নে আসক্ত তারা অনেকেই যৌন নির্যাতনকে সমর্থন করে এবং তারা নিজেরাও যৌন নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে।
তথ্যসূত্রঃ
সাড়া জাগানো তুর্কী ওয়েব সিরিজ “দিরিলিস আরতুগ্রুল” কেন একাধিক রাষ্ট্রে বাজেয়াপ্ত করা হল?