লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
২০১৪ মে মাসে ভারতের নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার এক মাস কাটতে-না-কাটতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে রাজ্যে রাজ্যে নির্দেশ পাঠানো হল সমস্ত সরকারি কাজে ‘কৃপা’ করে দেশের সমস্ত সরকারি কাজে হিন্দি ব্যবহার তার প্রতিক্রিয়া জানান যে, কৃপা করে দেশের সমস্ত সরকারি কাজে হিন্দি ব্যবহার করলে দেশের হিন্দিভাষী নাগরিকরা প্রথম শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে এবং অহিন্দিভাষীরা হয়ে যাবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। নরেন মােদি সরকারের বৃহত্তম অ-বিজেপি সমর্থক এডিএমকে নেত্রী জয়ললিতাও ওই নির্দেশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ওড়িশার বিধানসভায় স্পিকারও এই নির্দেশকে রাজ্যবাসীকে দ্বিধাবিভক্ত করার ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। সি পি এম নেত্রী বৃন্দা কারাটও গৃহমন্ত্রকের ওই নির্দেশকে বলেছেন গৃহভাগের মন্ত্রণা।
১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র ভারতের জন্মের আগেই। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি বই বেরিয়েছিল ভারতের ভাষা ও ভাষাসমস্যা নিয়ে। তাতে তিনি যে প্রস্তাব করেছিলেন তা গিয়েছিল হিন্দিকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। আমার সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে কথাও হয়। এখানে না বলে পারছিনা, দুর্ধর্ষ পণ্ডিত হলেও তিনি ছিলেন দুর্লভ উদারতার অধিকারী। আমার মতো অর্বাচীনের কথা শুনে তিনি বলেছিলেন হাওড়া স্টেশনের মুটের সঙ্গে যে-ভাষায় কথা বলতে পারবে বম্বে স্টেশনের মুটের সঙ্গেও সেই ভাষাতেও কথা বলতে পারবে—এটাই হচ্ছে রাষ্ট্রভাষার শর্ত, পণ্ডিতদের সভাতে যে-হিন্দি বলা হয় সেটা রাষ্ট্রভাষা নয়। রাষ্ট্রভাষা হিন্দিকে খাড়িবোলি হিন্দি আর পণ্ডিতসভার হিন্দিকে শুদ্ধ হিন্দি বলা ভালো। কিন্তু প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পরেই প্রথম নেহরু মন্ত্রীসভার কথাবার্তা ও দাবিদাওয়া শুনে এবং বিশেষত প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের হিন্দির পক্ষে মতদানের কাণ্ড দেখে সুনীতিকুমারের মত পালটে যায়। কমিশনের সভাপতি হিসেবে তিনি যে পেট নেই সরকারের কাছে ক্ষমা নে তাতে তিনি সংস্কৃতের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন। তাতে তিনি বলেন যে বাঙালি কি মারা কি তামিলের মধ্যে কাজ চালাবার ভাষা এক জিনিস আর দিল্লির বাবুদের মধ্যে কাজ চালাবার ভাষা অন্য জিনিস। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করলে যে বাবুদের মাতৃভাষা হিন্দি তারা বিশেষ সুবিধে পাবে, সুতরাং এমন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা উচিত যা ভারতীয় ভাষা হলেও কারও মাতৃভাষা নয়, যে-ভাষা প্রত্যেক বাবুকেই অনুশীলন-পুর্বক শিক্ষা করতে হবে এবং তেমন ভাষা হল সংস্কৃত ভাষা।
কিন্তু নেহেরুর দ্বিতীয় মন্ত্রীসভা থেকে আবার হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য দাবি উঠতে থাকে। এদিকে পঞ্চাশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজ্যপুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ভাষার ভিত্তিতে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, গুজরাত প্রভৃতি রাজ্য গঠিত হয়েছে। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে যাটের দশকে দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত তামিলনাড়ুতে প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু হয়। আবার তার পালটা আন্দোলন শুরু করে উত্তর ভারতে হিন্দিভাষীরা। দু-পক্ষকে শান্ত করার জন্য নেহরু সংসদে ঘোষণা করলেন সব পক্ষের সায় না-পাওয়া পর্যন্ত হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে না। কিন্তু নেহরুর সে ঘোষণাকে সংসদের প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করতে গেলে হিন্দিভাষীরা আবার তুমুল অশান্তি সৃষ্টি করে। ফলে নেহরুর সে-ঘোষণা আজও একটা মৌখিক আশ্বাসই থেকে গেছে, সংসদে নথিভুক্ত হয়নি।
এদিকে সরকারে হিন্দি বিভাগ খোলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে হিন্দি শিক্ষার দৌলতে প্রমোশনের ও বেতন বৃদ্ধির এবং হিন্দি যেসব ছাত্রছাত্রীর মাতৃভাষা নয় তারা হিন্দি শিখলে তাদের জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এইসব ব্যবস্থার সুফল পাওয়ার জন্য মৈথিলি, মাগধি প্রভৃতি ভাষাভাষীর উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেদের হিন্দিভাষী বলে জনগণনার সময় পরিচয় দেয় ও হিন্দির চর্চাতে ব্যাপৃত হয়। এজন্য ১৯৬২ ও ১৯৭১-এর জনগণনাতে হিন্দিভাষীদের চমকপ্রদ সংখ্যাবৃদ্ধি দেখা যায়।
আশির দশকে ভাষার প্রশ্ন ক্রমশ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, জেগে ওঠে ধর্মের প্রশ্ন। ভারতীয় জনতা পার্টির জন্ম হল, মুসলিমদের তুষ্টিকরণের প্রশ্ন তোলা হল, ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র কোথায় জন্মেছিলেন সেই আঁতুড়ঘরটির সঠিক স্থানটি চিহ্নিত হল, বহু হাজার বছরের ঘটনাকে পুরাণ থেকে ইতিহাসে রূপান্তরিত করা হল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গঠিত হল,নব্বইয়ের দশকজুড়ে দাঙ্গা বিস্ফোরণ শিবসেনা হত্যাযজ্ঞ ইত্যাদিদুরন্ত হিংসাকাণ্ডের ইতিহাস শিখরস্পর্শ করল ২০০২-এর গোধরা কাণ্ডে। দস্যু রত্নাকর যদি ঋষি বাল্মীকি হতে পারেন, চণ্ডাশোক যদি ধর্মাশোক হতে পারেন, তা হলে ২০০২-এরনরেন্দ্র মোদিও ২০১০ সালে নরেন্দ্র দামোদর দাস ভাই মোদি হতে পারেন। কিন্তু ঘটনা এই যে নরেন্দ্র
সরকার গঠনের এক মাসের মধ্যেই আবার ভাষার প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
সেই গত শতকের ষাটের দশকে মনস্বী অন্নদাশঙ্কর রায় ‘যে দেশে বহুধর্ম বহু ভাষা’ নামে একটি অমূল্য প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যে দেশে বহু ধর্ম সে দেশে সংখ্যাগুরু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মকে এবং যে দেশে বহুভাষা সে দেশে সংখ্যাগুরুর ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করলে দেশ অখণ্ডতা হারিয়ে বহু খণ্ড খণ্ড দেশে পরিণত হয়। ভারত তেমন একটি দেশ যার বহু ধর্ম বহু ভাষা। এখানে কোনো একটি ধর্মকে সংখ্যাগুরুর ধর্ম বলে রাষ্ট্রধর্ম করলে অথবা সংখ্যাগুরুর ভাষা বলে রাষ্ট্রভাষা করলে এদেশ অচিরে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
আমাদের সংবিধানের অষ্টম সারণিতে ২২টি ভাষাকে ভারতের ভাষা হিসেবে সূচিবদ্ধ করা হয়েছে। এবং ১৯৫৪-তে গঠিত ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি মণিপুরি, মৈথিলি প্রভৃতি আরও কয়েকটি ভাষাকে সংবিধান স্বীকৃত ভাষার সঙ্গে যোগ করেছে। ভাষাকে শুধু প্রশাসন পরিচালনের একটা হাতিয়ার হিসেবে ধরলে মারাত্মক ভুল হবে। ভাষা একটা ভূগোলের মধ্যে বাসকারী জনগোষ্ঠীর আবেগ ও আত্মা। ভারতের ঘরের পাশেই দৃষ্টান্ত আছে যে ভাষা কীভাবে ধর্মের কুয়োকে ছাপিয়ে একটা দেশ সৃষ্টি করতে পারে আর সেই দেশের দৃষ্টান্তে বিশ্ববাসী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। নতুন ভারত সরকারের ভাষার প্রশ্ন নিয়ে মাথা না-ঘামিয়ে উন্নয়ন প্রশাসন বিকাশ শান্তিশৃঙ্খলা শিক্ষাস্বাস্থ্য মুদ্রাস্ফীতি রোধ ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোই উচিত, তা হলেই দেশের মঙ্গল। ভাষা সমস্যার সমাধান আপনিই হবে কালের বা যুগের বাস্তব পরিস্থিতির অবদানরূপে। যেমন ফুটবল বিশ্বকাপের মজা আরও বেশি উপভোগ করার জন্য আমাদের মধ্যে আপনিই জেগে ওঠে ইংরেজি ভাষা জানা ও বোঝার আরও বেশি ইচ্ছে।