লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
তিতুমীরের আসল নাম ছিল মীর নিসার আলী। তাঁর পিতা নাম মীর হাসান আলী আর মায়ের নাম ছিল আবেদা রোকাইয়া খাতুন। তিতুমীর কুরআনের হাফিয ও মাওলানা ছিলেন। তিনি ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দের চব্বিস পরগণা জেলার বাদুড়িয়া থানার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮২২ সালেন জেহাদী (ওহাবী) আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমদ শহীদ ব্রেলভীর হাতে কোলকাতায় মুরীদ হন এবং জেহাদী আন্দোলনের আগামী পরিকল্পনা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হন। মক্কায় থাকাকালীন তিনি সৈয়দ আহমদের কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মক্কা থেকে ফিরে এসে আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন।
তিতুমীরের আন্দোলন ধর্মীয় ইস্যুতে সূচনা হলেও পরবর্তীতে তাঁর আন্দোলন জমিদার শ্রেণীর সামন্ত সম্প্রদায়, নীলকর অত্যাচারী শোষক ও ব্রিটিশ সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে এই আন্দোলন এক বৃহত্তর গণআন্দোলনের রুপ ধারণ করে। সৈয়দ আহমদের আন্দোলন ছিল সীমান্ত প্রদেশে আর তিতুমীরের আন্দোলন ছিল অবিভক্ত বাংলায়। আব্দুল গফুর চৌধুরী লিখেছেন,
“ইংরেজের বিরুদ্ধে তখন প্রকাশ্য জিহাদ ঘোষণা না করলেও যুদ্ধে প্রাণ দেবার জন্য প্রচুর নওজোয়ানকে তিনি দলে দলে পাঠিয়ে দিতেন, সঙ্গে প্রচুর টাকা পয়সা পাঠাবারও ব্যবস্থা করতেন। সৈয়দ নিসার আলীর একটা বড় সম্বল ছিল, তা হচ্ছে অগ্নিবর্ষক সৃজনশীল বক্তৃতা করার ক্ষমতা। নিসার আলী নিজেও একজন বিখ্যাত কুস্তিগীর ও ব্যায়ামবীরও ছিলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের নিজের সশস্ত্র ট্রেনিং দিতেন। (শহীদ তিতুমীর, পৃষ্ঠা – ৩০/৩১)
তিতুমীরের বক্তৃতার ক্ষমতা এমন ছিল যে তিনি আরবী, ফারসী ও বাংলা ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। তিতুমীর দেখেছিলেন, বাংলাদেশে জমিদারতন্ত্র বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, আর সেই জমিদারেরা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অনুগত এই হিন্দু জমিদারদের প্রবল দাপট ছিল। তিনি এও লক্ষ্য করেছিলেন, হিন্দু জমিদাররা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল প্রজার কাছ থেকে জোর করে পূজোর চাঁদা, বেআইনী কর, আবওয়াব ইত্যাদী আদায় করে। ইংরেজ নীলকররা হিন্দু জমিদারদের বন্ধু এবং তাই নীলকরদের সাথে সাথে হিন্দু জমিদারদের দ্বারাও বাংলাদেশের কৃষক সমাজ নির্যাতিত ও নিপীড়িত।
তিতুমীর তা সহ্য করতে না পেরে নীলকর কুঠিয়াল ও হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তিনি জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে আওয়াজ তুললেন। তিতুমীরের এই আন্দোলনে বাংলার নীলকর ও জমিদার গোষ্ঠী প্রমাদ গুণলেন। এই জমিদারদের মধ্যে পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়, গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি। সমস্ত জমিদারেরা তিতুমীরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন যে কোনভাবেই তিতুমীরকে শায়েস্তা করতে হবে। অবশেষে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীরকে শায়েস্তা করার জন্য পাঁচদফা ফরমান জারি করলেন এবং মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধানের উপর হস্তক্ষেপ করলেন। তিতুমীর জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে ইসলামের বিধিবিধানের উপর হস্তক্ষেপ প্রত্যাহার করার জন্য একটি পত্র দিলেন। সেই পত্রটির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। কেননা এই পত্রে তিতুমীরের উদার মানসিকতার পরিচয় মেল। পত্রটি ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে তাঁর ‘বাঙালী বুদ্ধিজীবি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন । তিতুমীরের সেই পত্রটি হলঃ
“ব জনাব জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মহাশয়,
সমীপেষু, পুঁড়ার জমিদার বাড়ি,
মহাশয়,
আমি আপনার প্রজা না হলেও আপনার স্বদেশবাসী। আমি লোক পরম্পরায় জানতে পারলাম যে, আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাকে ওহাবী বলে আপনি মুসলমানদের নিকট হেয় করবার চেষ্টা করেছেন। আপনি কেন এ’ রকম করছেন বুঝতে পারছি নে। আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নি। যদি কেহ আমার বিরুদ্ধে আপনার নিকট কোন মিথ্যা কথা বলে আপনাকে উত্তেজিত করে থাকে, তাহলে আপনার উচিত ছিল, সত্যের অনুসন্ধান করে হুকুম জারি করা। আমি ‘দ্বীন – ইসলাম’ প্রচার করছি। মুসলিমদেরকে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দিচ্ছি। এতে আপনার অসন্তোষের কি কারণ থাকতে পারে? যার ধর্ম সেই বুঝে। আপনি ইসলাম ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করবেন না। ওহাবী ধর্ম নামে পৃথিবীতে কোন ধর্ম নেই । আল্লাহর মনঃপূত ধর্মই ইসলাম। ইসলাম ধর্মের অর্থ হচ্ছে শান্তি। একমাত্র ইসলাম ধর্ম ব্যাতিত আর কোন ধর্মই জগতে শান্তি আনয়ন করতে পারে না। ইসলামী ধরণের নাম রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছোট রাখা, ঈদুল আজহার কোরবানী করা ও আকিকা কোরবানি করা, মুসলমানদের উপর আল্লাহর ও আল্লাহর রসুলের (সঃ) নির্দেশ । মসজিদ প্রস্তুত করে আল্লাহর উপাসনা করাও আল্লাহর হুকুম। আপনি ইসলাম – ধর্মের আদেশ, বিধিনিষেধের উপর হস্তক্ষেপ করবেন না। আমি আশা করি আপনি আপনার হুকুম প্রত্যাহার করবেন।
ফকত হাকির ও না-চিজ
সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর”
(বাঙালী বুদ্ধিজীবি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, পৃষ্ঠা – ৪৫)
তিতুমীরের পত্র পেয়ে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় রোষে উন্মত্ত হয়ে উঠেন এবং পত্রবাহক আমিনুল্লাহকে বন্দী করে রাখেন। বন্দী অবস্থায় আমিনুল্লাহর মৃত্যু হয় । ফলে জটিলতা আরও বেড়ে যায়। তিতুমীর চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে। তিনি হিন্দু মুসলমান সকলে মিলে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিদেশী শক্তিকে উচ্ছেদ করতে কিন্তু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম বিদ্বেষের দরুন সব বানচাল হয়ে যায়।
ঐতিহাসিক অমরদণ্ড লিখেছেন,
“তিতুমীর প্রথম জীবনে ধনী হিন্দু গৃহে চাকরি করতেন। ………সরফরাজপুর গ্রামে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধ উপস্থিত হলে তিনি সেখানে যান এবং জুম্মা নামাযের পর হিন্দু – মুসলমানকে সম্বোধন করে বলেন যে, কেবলমাত্র ধর্মের ব্যবধানের জন্য অমুসলমানদের সঙ্গে মুসলমানের সঙ্গে বিরোধ আল্লাহর অপছন্দ এবং দুর্বল অমুসলমানকে সাহায্য করা মুসলমানদের কর্তব্য। সুবক্তা তিতুমীরের বক্তৃতা শোনার জন্য দলে দলে হিন্দু মুসলমান উপস্থিত থাকতেন – তিতুমীরের বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ইসলামে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা, হিন্দু কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার প্রতিরোধ করা। জমিদারের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেক হিন্দু কৃষকও তিতুমীরকে আশ্রয় করতেন। তিতুমীরের দল বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে পুঁড়ার জমিদার ও নীলকর কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীরের অনুগামীদের দাড়ির উপর (মাথা পিছু আড়াই টাকা), মসজিদ নির্মানের জন্য অতিরিক্ত কর, পিতা – পিতামহ বা আত্মীয় স্বজনদের দেওয়া নাম পরিবর্তন করে ও ওয়াহাবী মতে আরবী নামকরণের জন্য অতিরিক্ত কর ইত্যাদি জারি করেন। তিতুমীর তাঁর শিষ্য আমিনুল্লাহের মাধ্যমে জমিদারের কাছে এক পত্র প্রেরণ করেন এবং অন্যায় আদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন । জমিদার আমিনুল্লাহকে গারদে নিক্ষেপ করেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। আমিনুল্লাহ তিতুমীর প্রবর্তিত আন্দোলনের প্রথম শহীদ।” (উনিশ শতকের মুসলিম মানস ও বঙ্গভঙ্গ, পৃষ্ঠা – ২৫)
তিতুমীর শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সরাসরি জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। দেশের অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হিন্দু মসলমান সকলেই তিতুমীরের আহ্বানে সাড়া দেন। আব্দুল গফুর সিদ্দিকি লিখেছেন,
“গোবরডাঙার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথা রায়, কলকাতার নামকরা জমিদার লাটু রায়, মোল্লা আটির নীলকুঠির ম্যানেজার ডেভিস সাহেব প্রায় হাজার খানেক লাঠিয়াল ও সশস্ত্র বরকান্দাজ নিয়ে তিতুমীরের মুজাহিদ বাহিনীকে আক্রমণ করলে দুপক্ষে সংঘর্ষ বাঁধে। ডেভিস সাহেব কোনমতে পালিয়ে যেতে সমর্থ হলেও দেবনাথ রায় হলেন নিহত।” (শহীদ তিতুমীর, পৃষ্ঠা – ৭৯)
১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দের তিতুমীরকে জব্দ করার জন্য ছোট লাটের নির্দেশ পেয়ে মিঃ আলেকজান্ডার বাদুড়িয়া গ্রামে আসেন। ফলে তিতুমীরের মুজাহিদ বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয় কিন্তু মিঃ আলেকজান্ডার প্রাণ বাঁচিয়ে পলায়ন করেন। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন,
“এদিকে দলে দলে হিন্দু মুসলমান চাষী মজুর তিতুর নেতৃত্বে জোটবদ্ধ হচ্ছিলেন। তাঁরা তিতুকে রাজা বলে স্বীকৃতিও দিলেন।” (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা – ২২৭/২৭৯)
এম. মুনিরুজ্জামান লিখেছেন, “এবার তিতুমীর নীল চাষীর উপর জুলুমের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ালেন । তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু আর মুসলমান রায়তরা এ উপলক্ষে সংঘবদ্ধ হলেন। অত্যাচারী জমিদারদের সঙ্গে নীলকররা হাত মেলালেন। তিতুমীরের শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তিরা নানা সত্য – মিথ্য রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে তাঁকে বৃটিশ বিরোধী ও শান্তি ভঙ্গকারী রুপে চিহ্নিত করতে চাইলেন। বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ আলেকজান্ডার আলীপুরের জজ এবং জমিদার কৃষ্ণদেব রায় নাড়কেলবেড়িয়া এলেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে, সংঘর্ষ শুরু হল। সাহেব গুলি ছুঁড়বার নির্দেশ দিলেন কিন্তু মুজাহিদ বাহিনীর দৃঢ় প্রতিরোধ শক্তি দেখে পিছু হটতে বাধ্য হলেন। এ সংঘর্ষে কেউ নিহত হননি। তিতুমীরের এই সাফল্য চব্বিশ পরগণা, যশোর ও নদীয়ার বিস্তৃত এলাকায় তাঁর প্রভাব সম্প্রসারিত হল। প্রতিক্রিয়াশীল কোন কোন শক্তি তিতুমীরের এই অগ্রগতিতে তাঁর বশ্যতা স্বীকারও করলেন। তিতুমীর পূর্ণ আজাদী (স্বাধীনতা) ঘোষণা করলেন।” (উপমহাদেশের মুসলমান, খণ্ড – ১, পৃষ্ঠা – ৮৪)
তিতুমীরের এই বিরাট সাফল্য জমিদারদেরকে বিচলিত করে তোলে। লর্ড বেন্টিংকও বিচলিত হয়ে পড়লেন। জমিদার ও নীলকর সাহেবরা তিতুমীরের বাহিনীর কাছে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তিতুমীর বেশ কয়েকটি নীলকুঠী দখল করে নেন। জমিদার ও নীলকরদের হাতে ছিল গোলাগুলি ও আধুনিক অস্ত্র, তিতুমীরের মুজাহিদদের হাতে ছিল ইঁট, কাঁচাবেল, তরবারি, তীর, সড়কি, বল্লম, লাঠি। তবুও সংঘর্ষ শুরু হলে প্রতিপক্ষের সৈন্যরা মার খেলেন এবং পালাতে বাধ্য হলেন।
তিতুমীরের বাহিনীতে ফকির বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক মিশকিন শাহ যোগ দিলে তিতুমীরের শক্তি আরও বৃদ্ধি পেল। তিতুমীর মন্ত্রী পরিষদ গঠন করলে তিনি নিজে হলেন খলিফা, প্রধানমন্ত্রী হলেন মুনশী ময়জুদ্দীন আর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হলেন মিশকিন শাহ। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন,
“A highly developed organization to which then no parallel in the history of revolutionary movement against British ……… the 19th Century.” (History of Freedom Movement. Page – 280/281)
রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের মুসলমানদের উপর নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব তিতুমীর সহ্য করতে পারলেন না। রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের মুসলিম বিদ্বেষ তিতুমীররের মুজাহিদ বাহিনী মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুদের উপর চড়াও হতে বাধ্য করেছিল। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর ৩০০ অস্ত্রধারী মুজাহিদ বাহিনী জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য রওনা হলেন। তাঁরা গ্রামের বারোয়ারি তলায় এসে তাঁরা গরু জবাই করেন। মন্দিরের পুরোহিত মন্দিরের প্রাঙ্গনে গরু জবাইয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মুজাহিদ বাহিনীর উপর অস্ত্র চালান। ঘটনাস্থলেই কয়েকজন মুজাহিদ শহীদ হন। প্রতিশোধ নেবার জন্য মুজাহিদ বাহিনী মন্দিরের পুরোহিতকে হত্যা করেন।
বেশ কয়েকটি সংঘর্ষে তিতুমীর চুড়ান্ত সফল হওয়াতে তিনি উৎসাহিত হন। একবার পুঁড়ায় দাঙ্গা হাঙ্গামা হলে জমিদারের দেড়শ বাহিনী তিতুমীরকে গ্রেফতার করতে আসেন। মুজাহিদ বাহিনী বাধা দিলে জমিদার বাহিনীর সাথে তিতুমীরের বাহিনীর সংঘর্ষ বাধে। এই ঘটনায় দারোগা নিহত হন এবং অনেক পাইক বরকান্দাজ হতাহত হন। সৈয়দ আহমদ শহীদ পেশোয়ারে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করলে তিতুমীরও উৎসাহিত হয়ে উঠেন এবং ঘোষণা করেন এ দেশে ইংরেজদের থাকার কোন অধিকার নেই। মুসলমানদের উৎখাত করে এদেশে ইংরেজ ক্ষমতা দখল করেছে তাই মুসলমান এ দেশের দাবিদার। মুসলমানের প্রতিনিধি হিসাবে জমিদারের কাছ থেকে তিনি রাজস্ব দাবি করলেন। (উপমহাদেশের মুসলমান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা – ৮১, এম মুনিরুজ্জামান)
বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে সাফল্য লাভ করার পর তিতুমীরের বাহিনী যখন পুনর্গঠিত হল তখন সেই বাহিনীর কর্তৃত্বের ভার পড়ল তিতুমীরের ভাগনে সেখ গোলাম মাসুমের উপর।
সাময়িক সাফল্য লাভ করলেও তিতুমীর বুঝতে পেরেছিলেন বিরোধী জমিদার ও নীলকররা বসে থাকার পাত্র নয় । তারা আবার তাঁর উপর আঘাত হানতে পারে। তাই তিনি সুরক্ষার জন্য নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা নির্মান করলেন। এবং সেখানে হাতিয়ার হিসাবে রাখলেন তীর, বর্শা, লাঠি, ইঁট, পাথর ও কাঁচা বেল। বিহারীলাল সরকার লিখেছেন, “কেল্লা বাঁশের হউক, ভরতপুরের মাটির কেল্লার মতন সুন্দর সুগঠিত সুরক্ষিত না হউক সে কেল্লার রচনাকৌশল দৃশ্যময়। কেল্লার ভিতর যথারীতি অনেক প্রকোষ্ঠ নির্মিত হইয়াছিল, কোন প্রকোষ্ঠে আহার্যদ্রব্য স্তরে স্তরে বিন্যস্ত ছিল। কোন প্রকোষ্ঠে তরবারি, বর্শা, সড়কি। বাঁশের ছোট লাঠি সংগৃহীত ও সজ্জিত ছিল, ……… কোন প্রকোষ্ঠে স্তুপাকারে কাঁচাবেল ও ইষ্টখণ্ড (ভাঙ্গা ইট) সংগৃহীত হইয়াছিল। এই কেল্লার কৌশল কায়দা তিতুর বুদ্ধি ও শিল্প চাতুর্যের পরিচায়ক। তিতুমীর তাঁহার অনুচরবর্গের ধারণা হইয়াছিল এই কেল্লা বাঁশের হইলেও প্রস্তর নির্মিত দুর্গ অপেক্ষা দুর্জয় ও দুর্ভেদ্ ।” (তিতুমীর, পৃষ্ঠা – ৭০)
তিতুমীরের এই বাঁশের কেল্লা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এক অভিনব কৌশল ছিল। বাঁশের কেল্লার সম্পর্কে ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন,
“ইয়া এক অপূর্ব যুদ্ধ । অদ্ভুত এক বাঁশের কেল্লা। বর্বর মদমত্ত ইংরেজরা তিতুর অদ্ভুত সাহস আর আর রণ নৈপুণ্য দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গে । পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে এর কোন তুলনা নাই ।” (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম)
দিনটা ছিল ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর। কর্ণেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ইংরেজ সৈন্যবাহিনী নারকেলবেড়িয়া গ্রামে এসে পৌঁছাল। কর্ণেল এসেছিলেন তিতুমীরকে গ্রেফতার করতে। কর্ণেল গ্রেফতারী পরোয়ানা পাঠ করে জানালেন যে তিতু আত্মসমর্পন কররে রাজি আছে কিনা। তিতুমীর জানিয়ে দিলেন যে তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না। কর্ণেলের আদেশে গুলিবর্শন শুরু হল। মুজাহিদ বাহিনীও তীর ছুঁড়তে শুরু করল। শুরু হয়ে গেল ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। কর্ণেল বাহিনীর কাছে হাতিয়া হিসাবে ছিল, তরবারী, বন্দুক, কামান প্রভৃতি অত্যাধানিক হাতিয়ার কিন্তু তিতুমীরের বাহিনীর কাছে ছিল তীর, বর্শা, লাঠি, ইঁট, পাথর ও কাঁচা বেল প্রভৃতি অনুন্নত হাতিয়ার। প্রথমে উভয় পক্ষের কোন ক্ষতি হয়নি। কর্ণেল কামানের ফাঁকা আওয়াজ ছুঁড়লেন কিন্তু মুজাহিদ বাহিনীর তীর বর্ষন চলতেই থাকল। তিতুমীর বুঝতে পেরেছিলেন কামানের সামনে তাঁর সামান্য অস্ত্র কিছুতেই টিকতে পারবে না। তাই তিতুমীর, মাসুম আলী ও মিসকিন খাঁ মুজাহিদ সৈন্যদের বললেন – আমাদের কামান নেই, হয়ত মৃত্যু হতে পারে; যাতের ইচ্ছা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে পার। কিন্তু এমন একটিও দুর্বল হৃদয় সেদিন পাওয়া গেল না, যে প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত। যুদ্ধ আরম্ভ হতেই হুঙ্কার ছেড়ে ইংরেজ সৈন্যদের আক্রমণ করলো বিপ্লবী সৈন্য। ইংরেজ সৈন্য ছত্রভঙ্গ হবার উপক্রম, কিন্তু কালবিলম্ব না করে বিরাট কামান গর্জে উঠল। কামান পরিচালককে হত্যা করার জন্য সেনাপতি মাসুম বিদ্যুৎগতিতে লাফিয়ে গিয়ে কামানের উপর দাঁড়ালেন। কিন্তু তার কয়েক সেকেন্ড পুর্বেই কামান দাগা হয়ে গিয়েছিল। অজস্র বিপ্লবী সৈন্য ইংরেজের কামানের গোলায় ছিন্ন – ভিন্ন হয়ে মৃত্যুর কোন ছিটিয়ে পড়ল। ওদিকে মাসুম তো একেবারে ইংরেজদের কোলে গিয়ে উপস্থিত । আর কয়েক সেকেন্ড আগে দিতে পারলে হয়তো কামান মাসুমের হাতেই এসে যেত। মাসুম বন্দী হলেন। (চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তাজা, পৃষ্ঠা – ২১৪)
কামানের গোলায় এবং আকাশে বাতাসে আগুন ঝরতে লাগল। বিষাক্ত বারুদের গন্ধে দিগন্ত জুড়ে ধুমাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। সেই সময় তিতুমীর নামায পড়ছিলেন। কামানের গোলায় তিতুমীরের ডান হাতের হাড় ভেঙ্গে চুর্ণ – বিচুর্ণ হয়ে গেল। তিতুমীর বীরের মত যুদ্ধ করে শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। এই চরম যুদ্ধে বাংলার বীর নায়কের জীবন অবসান হয়।
যাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং ইংরেজ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের শুরু হয় বিচারের নামে প্রহসন। সেনাপতি গোলাম মাসুমকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়। বিহারী লাল সরকার লিখেছেন, “বন্দীদিগের বিচার আলীপুরে হইয়াছিল। সর্বমোট তিনশত বন্দীর মধ্যে একশত চল্লিশ জনের কারাদণ্ড হইয়াছিল। সেনাপতি সেখ গোলাম মাসুমের প্রাণদণ্ড হইয়াছিল।” (তিতুমীর, পৃষ্ঠা – ৭০)
Kinealy লিখেছেন, “আলীপুরের জজ ও কালেক্টর বন্দীদিগকে লইয়া নাড়কেলবেড়িয়া গ্রামে গিয়াছিলেন। সে স্থানে তিতুমীরের আড্ডার সম্মুখস্থিত প্রাঙ্গনে এক সভা হইয়াছিল………..। বিচারে সেখ গোলাম মাসুমের প্রাণদণ্ড, কতকগুলি লোকের দ্বীপান্তর এবং কতকগুলি লোকের কারাদণ্ড হইয়াছিল। মাসুমের ফাঁসি তিতুর আড্ডার সম্মুখস্থিত ময়দানেই হইয়াছিল। সর্বমোট বন্দীর সংখ্যা ছিল আট শত।” (The Wahabis in India. উদ্ধৃতি এম আব্দুর রহমান, শহীদ বীর তিতুমীর, তথ্যসূত্র উপমহাদেশের মুসলমান, পৃষ্ঠা – ১১৪)
যাইহোক, ৮০০ জন বন্দীর মধ্যে ৩০০ জনের বিচার হয় এবং বিচারে ১২৫ জনের ২ – ৭ বছর ও ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অনেকের দ্বীপান্তর হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে সাজন শাহ ছিলেন একজন। মিসকিন শাহ অন্তর্ধান হয়ে যান।
তিতুমীরের মৃত্যুর পর তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ হুগলী গ্রামের লোকেরা সমাধিস্ত করে বলে জানা যায়। অনেকের ধারণা মিঃ আলেকজান্ডার তিতুমীরের লাশকে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন যাতে শহীদের স্মৃতি স্তম্ভ না রচিত হয় এবং তিতুর মুজাহিদ অনুগামীরা যাতে পুনরায় অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত না হয়। কিন্তু প্রকৃত শহীদের মৃত্যু কোথায়। আল্লাহ বলেছেন, “ওয়ালা তাকুলু লিমান ইয়াকতুলু ফি সাবিলিল্লাহি আমওয়াত” অর্থাৎ যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে তাঁদেরকে মৃত বল না, বরং তাঁরা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পার না।
সুতরাং তিতুমীর জীবিত আছেন বাংলার মানুষের অন্তরে । জীবিত থাকবেন চিরকাল।
তিতুমীরের আন্দোলনের পর্যালোচনা
তিতুমীরের আন্দোলন ছিল বাংলায় ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রথম জেহাদী (ওহাবী) আন্দোলন। তিতুমীর সৈয়দ আহমদ শহীদের নিকট অনুপ্রাণিত হয়েই এই আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই আন্দোলনলে অনেকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেখেছেন এবং এটাকে হিন্দু – মুসলমানের লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু কোনভাবেই তিতুমীরের এই গণআন্দোলন সাম্প্রদায়িক ছিল না। হিন্দুরা এই আন্দোলনকে সমর্থন না করলে তিতুমীরের পক্ষে এই আন্দোলনের বিস্তার লাভ করা সম্ভব হত না। জমিদার, উচ্চশ্রেণীর এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর হিন্দুরা তিতুমীরের বিরুদ্ধে অবস্থান করলেও খেটে খাওয়া কৃষক শ্রেণীর হিন্দুরা চিরকাল তিতুমীরকে সমর্থন জানিয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে হিন্দু জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই হিন্দু জনগণের বিরুদ্ধে রুপান্তরিত হলেও নির্যাতিত ও শোষিত হিন্দুরা জমিদার ও নীলকরদের শোষনের বিরুদ্ধে তিতুমীরের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেজন্যই তিতুমীরের আন্দোলন ক্রমে অল্প সময়ের মধ্যেই এক রাজনৈতিক গণআন্দোলনে রুপান্তরিত হয়েছিল।
তিতুমীরের অনুগামী মুজাহিদরা প্রথমে কিছু হিন্দু বিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলেই ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর ৩০০ অস্ত্রধারী মুজাহিদ বাহিনী মুসলিম বিদ্বেষী জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য রওনা হলেন। তাঁরা গ্রামের বারোয়ারি তলায় এসে তাঁরা গরু জবাই করেন। মন্দিরের পুরোহিত মন্দিরের প্রাঙ্গনে গরু জবাইয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মুজাহিদ বাহিনীর উপর অস্ত্র চালান। ঘটনাস্থলেই কয়েকজন মুজাহিদ শহীদ হন। প্রতিশোধ নেবার জন্য মুজাহিদ বাহিনী মন্দিরের পুরোহিতকে হত্যা করেন। আর এসবের জন্য দায়ী ছিলেন মুসলিম বিদ্বেষী জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। কৃষ্ণদেব রায় অবৈধভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিনিষের উপর হস্তক্ষেপ করেছিলেন এবং মুসলমানদের দাড়ির উপর, মুসলিম নামকরণের উপর কর চাপিয়েছিলেন এবং মুসলমানদের মসজিদ ধ্বংস করেছিলেন। সেজন্যই মুজাহিদ বাহিনী কিছু হিন্দুবিরোধী কার্যকলাপ করেছিলেন। যদিও তা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক ছিল না। কিন্তু জমিদারের অতি মুসলিম বিদ্বেষের জন্যই মুজাহিদদেরকে এটা করতে বাধ্য করেছিল।
এটা ভুললে চলবে না যে, সব মুসলমানও তিতুমীরকে ভাল চোখে দেখতেন না। মুসলমা জমিদাররা তো আছেনই সেই সাথে তিতুমীরের মতাদর্শের বিরোধী মুসলমানরাও তাঁকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। বিদআতপন্থী কবরপূজারী মুসলমানরা তিতুমীরকে ‘ওহাবী’ বলে গালিগালাজ করত। রক্ষণশীল মুসলমানরাও তিতুমীরের প্রভাব খর্ব করার জন্য হিন্দু জমিদারের শরণাপন্ন হয় সেজন্য উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের প্রতি তিতুমীর মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই দেখা যায় যখন তিতুমীরের বাহিনী পুঁড়া আক্রমণ করেন তখন তাঁরা বেছে বেছে শুধু হিন্দুদের বাড়িই আক্রমণ করেন নি অনেক মুসলমানের বাড়িও আক্রমণ করেছিলেন। এইসব মুসলমান তারাই ছিল যারা তিতুমীরের দলে যোগ দেয়নি। তিতুমীর শেরপুরে ইয়ার মুহাম্মাদ নামে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের বাড়িও লুঠ করেন। তাই বলা যায় তিতুমীরের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে ছিল না। এই সংগ্রাম ছিল শোষিত জনগণের পক্ষে শাষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে।
তিতুমীর যে শাষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন এই ব্যাপারটিকে স্মিথ শ্রেণীসংগ্রাম হিসাবে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন,
“The struggle was a pure class struggle, and the communalist confusion of the issue evaporated. The Movement made use of a religion’s ideology, as class struggles in Pre-industrialistic society have often done, but thought religious it was not communalist.” স্মিথ আরও লিখেছেন, “The mutiny, like political Jihads of the “Wahabis’ emphasizes the Muslim Community of India as a religio-political unit; but at the sametime emphasized cooperation between that community and the Hindus in face of a common enemy.” অর্থাৎ হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় একত্রে মিলে শত্রুর মুকাবিলা করেছে । উভয় সম্প্রদায়ের শত্রু হল ইংরেজ রাজশক্তি । তাই স্মিথ স্পষ্টভাবেই বলেছেন, “They proclaimed anJihad against the infidel, and appealed not only to the oppressed to unite against their exploiters, but to the muslims to unite for the defence of their religion. Non of these political activities, however, was anti-Hindu.” (Modern Islam in India, 2nt edition, London, 1945, Page – 192)
হিন্দুরা তিতুমীরকে সমর্থন করেছিল বলেই কয়েকজন হিন্দুকে আটক করেছিল। বহু হিন্দু ওহাবীদের সংগ্রামী তহবিলে অর্থ সাহায্য করেছিলেন বলেও জানা যায়। বিহারীলাল সরকার লিখেছেন,
“তিতু আপন ধর্মমত প্রচার করিতেছিল, সে ধর্মমত প্রচারে পীড়ন তাড়ন ছিল না। লোকে তাহার বাগ – বিন্যাসে মুগ্ধ হইয়া স্তম্ভিত হইয়া তাহার মতকে সত্য ভাবিয়া, তাহাকে পরিত্রাতা মনে করিয়া তাহার মতাবলম্বী হইয়াছিল এবং তাহার মন্ত্র গ্রহণ করিয়াছিল। কিন্তু প্রথমে শোনিতের বিনিময়ে প্রচার সিদ্ধি করিতে চাহে নাই। জমিদার কৃষ্ণদেবের জরিমানায় ব্যবস্থায় তাহার শান্ত প্রচারে হস্তক্ষেপ করিলেন ।” (তিতুমীর বা নারকেলবেড়িয়ার লড়াই, পৃষ্ঠা – ৪৭)
সাজন গাজীর গানের সংকলনের ভূমিকায় লেখা আছে,
“তিতুমীর ধর্মপ্রাণ ব্যাক্তি ছিলেন। এই কারণে তিনি মক্কা যান এবং সেখানে উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলীর সৈয়দ আহমদের সঙ্গে পরিচিত হন। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম যুগে ব্রিটেন মুসলমানদের হাত থেকে ভারতের শাসনবভার কেড়ে নেওয়ায় সাধারণ মুসলমান তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেন তা নিয়ে বর্তমানকালে অনেক ধরণের গবেষণা হয়েছে। তবে সকলেই স্বীকার করেছেন যে, এই সকল আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতা ও ব্রিটিশের সমর্থক হিন্দু জমিদারেরও বিরোধিতা করা।……… তিতুমীরের ওপর সৈয়দ আহমদের আন্দোলনের প্রভাব ছিল, কিন্তু তিতুমীর কখনও সাধারণ হিন্দু কৃষকদের বিরুদ্ধে ছিলেন না। জমিদারের নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেক হিন্দুও তাঁর দলে যোগদান করেন এবং তাঁরা তিতুমীরের বক্তৃতা থেকে জেনেছিলেন যে – তিতুমীর মনে করতেন হিন্দু কৃষকদের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার বন্ধ করা সম্ভব। নীলকর শুধু ইউরোপীয়রা ছিলেন না, অনেক হিন্দু জমিদারও নীলকুঠি স্থাপন করেছিলেন।” (সাজনের গানে তিতুমীরের লড়াই, পৃষ্ঠা – ৮)
সুতরাং তিতুমীরের লড়াই সেইসব হিন্দুদের বিরুদ্ধে ছিল যারা ব্রিটিশদের বন্ধু ও কৃষকদের শত্রু ছিল। সাধারণ হিন্দুদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই কোনদিনই ছিল না। গিরীন্দ্রনাথ দাস লিখেছেন,
“এক শ্রেণীর মানুষ ব্রিটিশ রাজশক্তির আশ্রয়ে কৃষক জনসাধারণের ওপর যেভাবে শাসন, জীবিকার ওপর হস্তক্ষেপ, রুজি – রোজগারের সিংভাগ ছিনতাই করতো তারা স্থানীয় জমিদার। কামার, কৃষক, কুমার, তাঁতী, পটুয়া মৎসজীবি প্রভৃতি হিন্দু – মুসলিম প্রজাগণের উপর সেই জমিদারগণ তাঁদের নায়েব, গোমস্তা, পাইক, গুণ্ডা, লাঠিয়াল প্রভৃতির সাহায্যে খাজনা আদায়ে সর্বস্ব হরণ করে আসছিল। প্রত্যক্ষদর্শী ও অভিজ্ঞ কৃষক তিতুমীর সেই শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে চাইলেন। ………ইসলামী আদর্শে শান্তি – সাম্য – সৌভ্রাতৃত্বভিত্তিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সকলকে সামিল হতে তিতুমীর আহ্বান জানালেন।” (সাজনের গানে তিতুমীরের লড়াই, পৃষ্ঠা – ২১)
ঐতিহাসিক শান্তিময় রায় লিখেছেন, “তখন হিন্দু ও মুসলমান বিশেষ করে উভয় সম্প্রদায়ের নিপীড়িত কৃষক সম্প্রদায় বিদ্রোহী তিতুমীরের পতাকা তলে এসে সমবেত হন। এই বিদ্রোহই ইতিহাসে বারাসাতের অভ্যুত্থান হিসাবে বিখ্যাত হয়ে আছে (১৮৩১, ১৭ নভেম্বর) আজও বাংলার লোকগাথা ও লোক সংগীতের মধ্যে একজন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর শহীদ হিসাবে তিতুমীরকে স্মরণ করা হয়।” (ভারতের মুক্তি সংগ্রামে মুসলিম অবদান, পৃষ্ঠা – ১৭)
তাই তিতুমীরের এই আন্দোলনকে কোনদিনই সাম্প্রদায়িক এবং হিন্দুবিরোধী বলা যেতে পারে না। এটা ছিল নির্যাতিত ও নিপীড়িত কৃষকদের পক্ষে জমিদারশ্রেণীর বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক গণআন্দোলন।