আধুনিক বাঙালি কবিদের রচনায় শব্দের যে বিপুল বৈচিত্র্য দেখা যায় তার বহুবিধ কারণ আছে। ক্রমেই বেড়ে যায় মানুষের অভিজ্ঞতার জগত। ভাবনার সম্ভারে যুক্ত হয় বহু নতুন বিষয় এবং দেখা যায় নতুন দৃষ্টিকোণ। আর এই নতুন ভাব প্রকাশের জন্য কিংবা পুরোনো ভাবনাকে নতুন দিক থেকে উপলব্ধি করবার এবং করাবার জন্য তৈরি হয় নতুন ভাষা, অর্থাৎ নবতর শব্দ সমবায়। চলে আসে এমন অনেক শব্দ যা সাধারণত আগে এভাবে ব্যবহৃত হয়নি।
কবিতায় কোনো শব্দ ব্যবহারে বাধা নেই। আর এই বিষয়ে সংস্কারমুক্ত ছিলেন আধুনিক কবিরা। রবীন্দ্রনাথের বরং দ্বিধা ছিল। গভীর, মন্দ্রিত, ললিত, মধুর, মহান, বিচিত্র, প্রশান্ত ভাবের কবিতায় অতিরিক্ত নিত্য চলিত শব্দ তেমন ব্যবহার করতেন না। এবং বিদেশি শব্দ প্রয়োগের বিষয়েও বেশ কুষ্ঠিত ছিলেন তিনি। বিশেষত, বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে যদি একটুও দুরূহতা এসে যেত, তা বর্জন করবারই যেন নির্দেশ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘কবিতা’ (সম্পাদক : বুদ্ধদেব বসু) পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (আশ্বিন, ১৩৪২) বিষ্ণু দে’র পাঁচ স্তবকে সাজানো ‘পঞ্চমুখ’ কবিতার দুটো লাইন ছিল—
‘তোমার হৃদয়—পাইনের বনে কী কানাকানি।…
আমাদের ভালোবাসা বিপ্লেকস লিলি।
পছন্দ হয়নি রবীন্দ্রনাথের। বুদ্ধদেব বসুকে একটি চিঠি লিখলেন। ‘কবিতা’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা (পৌষ, ১৩৪২) চিঠিটি প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-‘ঘাট বাঁধানো দীঘির পাশাপাশি পাইন বনের ছবি আমাদের চোখে স্পষ্ট হতে পারে না। সাইকোলজির আঁকাড়া ইংরেজি শব্দ বাংলা কাব্যের জঠরে চালান করতে পারো কিন্তু সেটা হজম না হয়ে আস্ত থেকেই যাবে।’
জীবনানন্দ তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬) কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন। অতি সংক্ষিপ্ত একটি চিঠি তিনি জীবনানন্দ দাশকে পাঠিয়েছিলেন। লিখছেন—‘তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।
‘ক্যাম্পে’ কবিতার দুটি লাইন—
‘আজ এই বসন্তের রাতে।
এইখানে আমার নকটার্ন।’
‘নকটার্ন’ (রাত্রি) শব্দের প্রয়োগে তো নিশ্চয়ই খুশি হতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। একই রকমভাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি নজরুলের ‘খুন’ শব্দের ব্যবহারে। কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় লিখলেন—
‘কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর।
বাঙালীর খুনে লাল হল ক্লাইভের খঞ্জর…
উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’
নজরুল এই গান রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন। এই গানে রক্তের বদলে ‘খুন’ দেখে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলামের অভিমত, রবীন্দ্রনাথ ‘হত্যা’ অর্থে ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি করেননি; কিন্তু ‘রক্ত’ অর্থে খুনের ব্যবহার সমর্থন করতে পারেননি।
রবীন্দ্রনাথ ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারির (ফাল্গুন ১৩৩৪) ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘বাংলার কথা লেখায় লিখছেন-‘সাহিত্যে এই রকম নতুন হয়ে ওঠবার জন্যে যাদের প্রাণপণ চেষ্টা তারাই উচ্চৈঃস্বরে নিজেদের তরুণ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু আমি তরুণ বলব তাদেরই যাঁদের কল্পনায় আকাশ চির পুরাতন রক্তরাগে অরুণ বর্ণে সহজে নবীন, চরণ রাঙাবার জন্যে যাঁদের ঊষাকে নিয়ু মার্কেটে ‘খুন’ ফরমাস করতে হয় না। আমি সেই তরুণদের বন্ধু, তাদের বয়স যতই প্রাচীন হোক। আর যে বুদ্ধদেব মরচে-ধরা চিত্ত-বীণায় পুরাতনের স্পর্শে নবীন রাগিনী বেজে ওঠে না, তাদের সঙ্গে আমার মিল হবে না, তাদের বয়স নিতান্ত কাঁচা হলেও।’
‘বাংলার কথা’ পড়ে নজরুল ভাবলেন, রবীন্দ্রনাথ তাকে লক্ষ্য করেই একথা বলেছেন। নজরুলও অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে ১৯২৭ সালে ডিসেম্বরের (পৌষ, ১৩৩৪) সাপ্তাহিক ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় ‘বড়র পিরীত বালির বাঁধ’ লেখায় লিখলেন-‘বাংলার কথা’য় দেখলাম, যিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রের পক্ষ হয়ে পঞ্চ পাণ্ডবকে লাঞ্ছিত করবার সেনাপত্য গ্রহণ করেছেন, আমাদের উভয় পক্ষের পূজ্য পিতামহ, ভীষ্মসম সেই মহারথী। কবিগুরু এই অভিমন্যু বধে সায় দিয়েছেন। এই অভিমোর রক্ষী মনে করে কবিগুরু আমায়ও বাণ নিক্ষেপ করতে ছাড়েননি। তিনি বলেছেন, আমি কথায় কথায়-’রক্ত’কে ‘খুন’ বলে অপরাধ করেছি।… ‘উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার’–এই গানটি সেদিন কবিগুরুকে দুর্ভাগ্যক্রমে শুনিয়ে ফেলেছিলাম এবং এতেই হয়তো তার ও কথায় উল্লেখ। তিনি রক্তের পক্ষপাতী অর্থাৎ ও লাইনটাকে— ‘উদিবে সে রবি মোদেরই রক্তে রাঙিয়া পুনর্বার’ও করা চলত। চলত, কিন্তু ওতে ওর অর্ধেক ফোর্স কমে যেত। আমি সেখানে ‘খুন’ শব্দ ব্যবহার করেছি, যেখানে ‘রক্তধারা’ লিখবার, সেখানে জোর করে ‘খুন ধারা’ লিখি নাই। তাই বলে ‘রক্তখারাবী’ও লিখি নাই, হয় ‘রক্তারক্তি’ না হয় ‘খুনখারাবী’ লিখেছি। কবিগুরু মনে করেন, রক্তের মানেটা আরো ব্যাপক। ওটা প্রেমের কবিতাতেও চলে, কিন্তু ওতে ‘রাগ’ মেশাতে হয়। প্রিয়ার গালে যেমন ‘খুন’ ফোটে না—নেহাৎ দাঁত না ফুটালে। প্রিয়ার সাথে ‘খুনাখুনি’ খেলিনা। কিন্তু খুনসুটি হয়তো করি!… ‘খুন’ আমি ব্যবহার করি আমার কবিতায়, মুসলমানী বা বলশেভিকী রং দেওয়ার জন্য নয়। হয়তো কবিও দুটোর একটারও রং আজকাল পছন্দ করছেন না, তাই এত আক্ষেপ তাঁর।’
রবীন্দ্রনাথ নজরুলের ‘বড়র পিরীত বালির বাঁধ’ লেখার কোনো উত্তর না দিলেও প্রমথ চৌধুরী (বীরবল) কতকটা রবীন্দ্রনাথের পক্ষ নিয়েই ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারির (মাঘ, ১৩৩৪) ‘আত্মশক্তি’তে ‘বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা’ লেখায় লিখলেন-“রবীন্দ্রনাথ যে কাজী সাহেবকে লক্ষ্য করে একথা বলেছেন, এ সন্দেহ আমার মনে উদয় হয়নি, যদিচ যে-সভায় তিনি ও-কথা বলেন সে-সভায় আমি উপস্থিত ছিলুম। যতদূর মনে পড়ে, কোন উদীয়মান তরুণ কবির নবীন ভাষার উদাহরণ স্বরূপ তিনি খুনের কথা বলেন। কোনও উদিত কবির প্রতি তিনি কটাক্ষ করেননি।
বাংলা কবিতায় যে ‘খুন’ চলছে না, এমন কথা আর যেই বলুন রবীন্দ্রনাথ বলতে পারেন না। কারণ, কাজী সাহেব এ পৃথিবীতে আসবার বহু পূর্বে নাবালক ওরফে বালক রবীন্দ্রনাথ ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নামক যে কাব্য রচনা করেছিলেন, তার পাতা উল্টে গেলে ‘খুনে’র সাক্ষাৎ পাবেন। কিন্তু এ সব খুন যে, হঠাৎ তা কারও চোখে পড়ে না।
প্রমথ চৌধুরী তাঁর লেখায় রবীন্দ্রনাথের বলা ‘বাঙালী হিন্দু কবি’ কথাটা না বললেও প্রমথ চৌধুরীর এই লেখাটা পড়েই নজরুল নিজের ভুল বুঝতে পারেন। এরপর তিনি একদিন প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করেন। রবীন্দ্রনাথও পূর্ববৎ নজরুলকে সস্নেহে গ্রহণ করলেন।
আধুনিক কবিরা সত্যি সত্যিই শব্দ সম্পর্কে দ্বিধামুক্ত হয়েছিলেন। অগ্রজদের নির্দেশ তারা গ্রাহ্য করেননি। রক্ষণশীল পাঠকদের বিমুখতা তাদের নিরস্ত করতে পারেনি। তাঁরা একদিকে সাহস পেয়েছিলেন অব্যহিত পূর্ববর্তী কোনো কোনো কবির (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত) কাছ থেকে। যাঁদের কাব্যভাষায় আরবি, ফারসি, কিছু ইংরেজি আর প্রচুর দেশজ শব্দ প্রযুক্ত হয়েছিল।
পাশ্চাত্য কাব্য আন্দোলন থেকেও এ ব্যাপারে নিজেদের আদর্শ খানিকটা গড়ে নিয়েছিলেন বাঙালি কবিরা। প্রত্যক্ষ ছিল তাদের সামনে ইংল্যাণ্ডের ইমেজিস্ট (চিত্রকল্পবাদী) কবিদের ইস্তেহার। ১৯১৫ সালে ইমেজিস্ট কবিরা ‘সাম ইমেজিস্ট পোয়েটস্’ নামে ছ’জন কবির একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। সংকলনের শেষে দীর্ঘ ভূমিকায় কবিতা রচনার ছটি নিয়ম নির্দেশ করা হয়। আর এই লিখনটি ‘ইমেজিস্ট ম্যানিফেস্টো’ নামে বহু পরিচিত। এই ম্যানিফেস্টোর প্রথম সূত্রটি শব্দ সম্পর্কিত—’To use the language of common speech, but to employ always the exact. Word, not the nearly-exact, nor the merely decorative word.’ অর্থাৎ ‘ব্যবহার করতে হবে সাধারণ কথোপকথনের ভাষা, কিন্তু সেই সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে একেবারে যথাযথ শব্দটি, প্রায় যথাযথ নয়, কেবল অলঙ্করণের জন্যও নয়।’ কবির শব্দ প্রয়োগের শর্ত একটিই—যথার্থ কিংবা যথাযথ। সে শব্দ যেমনই হোক—সুন্দর বা কুৎসিত, মসৃণ বা কর্কশ, দেশি বা বিদেশি—তা নিয়ে চিন্তিত হওয়া নিষ্প্রয়োজন। এই আদর্শ সামনে রেখেই ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ (পোড়ো জমি) দীর্ঘ কবিতায় এলিয়ট হব্যাগনার রচিত ‘ত্রিস্তান উন্ড ইসোলদে’ নামের অপেরা থেকে জার্মান ভাষায় লেখা গানের টুকরো; বোদলেয়ার, ভের্লেন এবং নার্ভালের কবিতা থেকে ফরাসি শব্দগুচ্ছ এবং লাইন, দান্তের কাব্য থেকে ইতালীয় ভাষার চরণাংশ, লাতিন কবিতা থেকে গৃহীত শব্দাবলী উপনিষদের সংস্কৃত ভাষার মন্ত্র থেকে তুলে নেওয়া শব্দ ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি। এলিয়টের কাছ থেকে অনেকখানি সাহস পেয়েছিলেন বাঙালি এবং বাংলার কবিরা—তাতে সন্দেহ নেই।
জীবনানন্দ দাশের কাব্যভাষার ‘মৌলিক অভিনবত্ব’ এসেছে শব্দ থেকে যতটা নয়, শব্দের পূর্বাপর বিন্যাস থেকে ততটা। কবিতার ভাষায় এই বিন্যাসটি মূলমন্ত্র। ‘সমাচার’ শব্দের আগের ‘তুমুল’; ‘শসা’ শব্দের আগে ‘নষ্ট’; ‘রৌদ্র’ শব্দের আগে ‘রূঢ়’; ‘খঞ্জনা’ শব্দের আগে ‘ছিন্ন’; ‘চাঁদ’ শব্দের অগে ‘কস্তুরি আভা’; ‘নদী’ শব্দের আগে ‘বিকলাঙ্গ’; ‘মেঘ’ শব্দের আগে ‘নরকের নির্বচন’; ‘স্তব্ধতা’ শব্দের আগে ‘নিওলিথ’; ‘সুখ’ শব্দের আগে ‘ব্যথার’, ‘আহ্লাদ’ শব্দের আগে ‘অবোধ’, ‘পিপাসা’ শব্দের আগে ‘পুরানো’; ‘কুয়াশা’ শব্দের আগে ‘ধারালো’; ‘পাখির ডিম’ শব্দের আগে ‘ঠান্ডা—এই ধরনের শব্দ সমবায় অন্য কোনো কবির ভাষাতে পাওয়া যাবে না। সমবায় শৃঙ্খলের প্রশ্ন ছাড়াও, কেবলমাত্র শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রেও জীবনানন্দের স্বাতন্ত্র একটা দাবি রাখে। দেশজ এবং অতি প্রাত্যহিক শব্দের পাশে আশ্চর্য ধরনের তৎসম, তদ্ভব, দেশজ এবং বিদেশি শব্দের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি।
১৯২৭ সালে জীবনানন্দ দাশে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়। ৩৫টি কবিতা স্থান পায়। প্রায় প্রতিটি কবিতায় আরবি, ফারসি শব্দের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো ছিল। তবুও সমালোচক সুমিতা চক্রবর্তী ‘কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দ ; জীবনানন্দ’ লেখায় লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের প্রথম কবিতা সংকলন ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭)-এ বেশ কিছু আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ চোখে পড়ে। সব সময়েই যে সেই শব্দ একেবারে যথাযথ অর্থাৎ এগজ্যাক্ট শব্দ হিসেবে প্রযুক্ত হতে পেরেছে—তা নয়। তরুণ কবি, তখনও নিজস্ব কাব্যভাষার সর্বায়ত গড়নটি আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। নিঃসন্দেহে একটি নতুন ভাষার সন্ধানে রত ছিলেন তিনি। তারই প্রাথমিক প্রয়াসের চিহ্ন এই সংকলনের শব্দ চয়নে। আরও বহু সমালোচক মনে করেন জীবনানন্দ দাশের ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থটির কবিতা এবং কবিতার নামকরণ রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল এবং নজরুলের কবিতার অবচেতন অনুকরণ। জীবনানন্দের সমালোচক গোপালচন্দ্র রায় লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের প্রথম যুগের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রভৃতির কবিতার কিছু কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।’ আব্দুল হোসেন লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের অনেক কবিতাই নজরুলীয় পুনরুক্তিপূর্ণ। সমালোচক অমল দত্ত লিখেছেন, ‘ঝরা পালকে’র সাকী-সরাই-পেয়ালা-দিলদার, বেদুইনদের নির্থস্থ জীবন বা সেমিটিক শব্দরাজির অব্যবহিত অবচয় মোহিতলাল থেকে—’স্বপন-পসারী’র পাশাপাশি তা অগৌণে অনুধাবন করা যায়। লক্ষ্য স্থলে মোহিতলালকে ব্যবধান করে ‘ঝরা পালক’ নিশ্চয় বিস্তার হয়েছে তার স্বখাতে, নিশ্চয় উপকরণের অর্থান্তরও হয়েছে, তাতেও অসম্বন্ধ হয় না।
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর হরপ্রসাদ মিত্র ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থে ব্যবহৃত জীবনানন্দের ‘প্রিয় শব্দাবলীর একটি তালিকা’—মূলত আরবি-ফারসি শব্দের তালিকা তৈরি করে ‘কবিতার বিচিত্র কথা’ লেখায় লিখেছিলেন, “সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল এবং মোহিতলালরা সব শব্দই ব্যবহার করে গেছেন। তাঁরাই পথ দেখিয়েছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের জীবনীকার আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘জীবনানন্দ ও মোহিতলাল’ বইয়ে আরও ঘনিষ্ঠ পর্যালোচনা করে লিখলেন, ‘জীবনানন্দ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারে মোহিতলালের দ্বারাই প্রধানত উদবোধিত হয়েছিলেন এবং এ বাবদে তিনি নজরুলের চেয়ে মোহিতলালের কাছেই বেশি ঋণী।’ তিনিও একটি শব্দতালিকা করে সে ঋণ দেখান স্পষ্ট।
জীবদ্দশায় জীবনানন্দের গ্রন্থগুলো বহুল আলোচিত না হলেও কিছু আলোচিত হয়েছিল। ‘কল্লোল’ পত্রিকায় (অগ্রহায়ণ, ১৩৩৪) ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনা—’ঝরা পালক কবিতার বই। শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত প্রণীত। দাম এক টাকা।। কয়েক বৎসরের মধ্যেই শ্ৰী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত কাব্যসাহিত্যে আপনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তরুণ কবির সমস্ত কবিতাতেই তারুণ্যের উল্লাস ধ্বনিত। তাঁর ছন্দ ভাষা ভাব সবেতেই বেশ বেগ আছে। ত্রুটি যা কিছু আছে তা কখনও কখনও সেই বেগের অযথা আতিশয্য। নজরুল, মোহিতলালের প্রভাব তিনি এড়াতে পারেননি বটে কিন্তু সে প্রভাবকে নিজের বৈশিষ্ট্যের পথে ফেরাতে পেরেছেন বলে মনে হয়।’
আধুনিক কবিদের মধ্যে দুই শ্রেণির কবি দেখা যায়। এক : যাঁদের কবি প্রতিভা তর্কাতীত কিন্তু যারা বাংলা কবিতার চিরপ্রচলিত পন্থার অনুসরণকারী; দুই : যাঁরা বাংলা কবিতার নতুন সৃষ্টির—নতুন অবদানের গৌরব প্রার্থী। জীবনানন্দ এই দ্বিতীয় শ্রেণির। জীবনানন্দের কবিতার মিল, অন্ত্যমিল—তাঁর মিলের কুশলতা অতুলনীয়। বিষয়, উপমা, অনুপ্রাস সর্বতোভাবে তার নিজস্ব। তা ছাড়া তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু, কবিতার একটি অশ্রুত সুর তাঁর স্বাতস্ত্র সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করে। এটুকু সত্যই বড়ো অভিনব। তাঁর কবিতার অনুভূতি, প্রকৃতি, জীবন, মৃত্যুকাল-সমস্তই তাঁর কাছে রক্ত-মাংসে জীবন্ত।
জীবনানন্দের কাব্যের প্রাণ হল তাঁর অদ্ভুত মিশ্রণে—অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, পুরোনোর সঙ্গে নতুনের, অসম্ভবের সঙ্গে সম্ভবের, অবিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসের, গ্রামের সঙ্গে শহরের; বাংলার সঙ্গে আরবি-ফারসির—অপূর্ব সংযোজন। তার এক-একটি উপমাই একটি কবিতার স্বাদ আনে এবং সে উপমা বেশিরভাগ সময়েই স্বচ্ছ ও অর্থকরী করার। জন্য ব্যবহৃত হয়নি, কেবলমাত্র একটি আবহাওয়া সৃষ্টিই তার উদ্দেশ্য। স্বভাবতই কবিতা মাঝেমধ্যেই দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। একটি ভাবের সঙ্গে আরেকটি ভাবের যোগসূত্র আবিষ্কার দুরূহ হয়ে পড়ে। সাধারণ পাঠক অন্ধকার দেখেন। জীবনানন্দ এলিয়টের মতো বললেন : ‘কবিতার জন্য কবিতা।’
বাংলা ভাষায় সর্বাধিক বিদেশি শব্দের উৎসভাষা আরবি আর ফারসি, তারপরে ইংরেজি। অন্যান্য ভাষা থেকে গৃহীত শব্দ—সব মিলিয়েও এই দুই উৎসজাত শব্দের চেয়ে অনেক কম।
জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালকে’র ৩৫টি কবিতার প্রতিটি কবিতাতে দু’চারটি আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার থাকলেও তার ভেতর ১২/১৩টি কবিতায় দশের বেশি আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার রয়েছে—
১) আমি কবি-সেই কবি (চার স্তবকের চব্বিশ লাইনের কবিতা)—আঁখি, ইশারা, আখের, দিওয়ানা, জিঞ্জির, খেয়াল, খোশ, পেয়ালা, চুমি, তোতা, দরিয়া, ফরাশ, রেওয়াজ, গজল। ১৪টি আরবি-ফারসি শব্দ।
২) মরীচিকার পিছে (সাত স্তবকের বিয়াল্লিশ লাইনের কবিতা)-গালিচা, দিলদার, দরিয়া, খুন, খারাবী, জিন-সর্দার, নার্গিস, পশমিনা, খর্জুর, তালাশ, পেয়ালা, খেয়াল, আঁখি, জৌলস, সোয়ার। ১৫টি আরবি-ফারসি শব্দ।
৩) জীবন-মরণ দুয়ারে আমার (বিরাশি লাইনের কবিতা)—শার্শি, দিলদার, পেয়ালা, বেহুশ, আখের, দিলওয়ার, রবাব, ক্যারাভেন, মস্তানা, বান্দা বেদুঈন, আওয়াজ, খুন, রোশনাই, নিরালা, খুশবরাজী, মুসাফের, তুরাণী, জিঞ্জির, রোজা, ঈদ, মসগুল, দিওয়ানা, পান্থশালা, দস্তুর, তাবিজ, খেয়াল, সাহারা, জনম, মশলাদার, তাতার, সরাইখানা। ৩২টি আরবি-ফারসি শব্দ।
৪) বেদিয়া (আটত্রিশ লাইনের কবিতা)—পিঞ্জর, বান্দা, রংমহল, মোতিমহল, বাঁদী, নিশানা, বেদিয়া, দুল, বালা। ৯টি আরবি-ফারসি শব্দ।
৫) নাবিক (ছেষট্টি লাইনের কবিতা)-খেদ, শির, খুন, শামিয়ানা, আঁখি, সিন্দবাদ, শের, আখের, দারুচিনি, পরী, চুমি, বেদিয়া, বেদুঈন, মীননারী, চামর, পান্থশালা। ১৬ আরবি-ফারসি শব্দ।
৬) সাগর-বলাকা (ছয় স্তবকের ত্রিশ লাইনের কবিতা)বেশ, শারাবখানা, মসল্লাত খুন, নহর, ফেনা, মুসাফের, ফিকা, আঁখি। ৯টি আরবি-ফারসি শব্দ।
৭) চলছি উধাও (একানব্বই লাইনের কবিতা)-আশেক, ঝাঁঝ, জনম, শারাবশালা, সরাইখানা, দিলপিয়ালা, গুলজারিয়া, নাশপাতি, আঁখি, ফাগ, ঘায়েল, ক্যারাভেন, ইবলিশ, দরাজ, নার্গিস, পিছে, খুন, দুশমন, ভিখ, মাগছে, দিওয়ানা, কয়েদী, সাকী, কবর, পেয়ালা, মুঝে। ২৬টি আরবি-ফারসি শব্দ।
৮) একদিন খুঁজেছিনু যারে (উনপঞ্চাশ লাইনের কবিতা)—তাতার, গাগরী, চুমি, মুসাফের, খেদ, পেয়ালা, মসজেদ, শারাব, কলেজ, কবর। ১০টি আরবি-ফারসি শব্দ।
৯) সিন্ধু (ছেষট্টি লাইনের কবিতা)—পরী, তলোয়ার, আশেক, ছারখার, বেলোয়ারি, তিতা, চুমুরিয়া, ভিখারি, কলেজ, পান্থ, খঞ্জর, চুরমার, বাঁকা। ১৩টি আরবি-ফারসি শব্দ।
১০) হিন্দু-মুসলমান (চৌষট্টি লাইনের কবিতা)—নামাজ, আজান, মুয়াজ্জেন, ঈদগা, তসবী, ফকির, কোরান, পীর, মসজিদ, মুসলমান, আরব, তাতার, তুর্কী, ইরান, মোসলেম, দরিয়া, তখতে, শাহনশাহা, মোগল, ফতেহপুর, তাজমহল, আকবরী আইন, সেলিম, শাজাহাঁ, একশা, মিনার, কবর, শাহদারা, মোতিমহল, মেহেরাব, বেগম, বাঁদী, গজল, ইলাহী, বহিন, কাফের, টুটিয়া আশান। ৩৮টি আরবি-ফারসি শব্দ।
১১) মিশর (দশ স্তবকের উনপঞ্চাশ লাইনের কবিতা)—কাফন, ইশিশ, চুমা, শিরে, ভুখ, খিলান, গুম, কিনারা, কবর, খুনখারাবী, খেলাপ, খবরদারী, দরিয়া, ঝাণ্ডাঝালর, মরুমশান, নীলা। ১৬টি আরবি-ফারসি শব্দ।
১২) মরুবালা (সাত স্তবকের বিয়াল্লিশ লাইনের কবিতা)—খালি, মশান, কবর, বারুদ, পাশা, সাহারায়, চুমা, জবান, কাফন, সোয়ার, চক্কর, খিঁচে খিঁচে, শেখ সেনানী, লাল, শের, ঘায়েল, বুরুজ, ক্যারাভেন, মাসুদ ডাকাত, তাতার, হাড্ডি, ফোফরা, দরদ, ঘুন্টি, কারবালা, রুখে। ২৬টি আরবি-ফারসি শব্দ।
১৩) চাঁদিনীতে (পঞ্চাশ লাইনের কবিতা)—বারোয়ার, ফরাশ, পরদেশী, জাজিম, শিরে, শরাব, শিশি, পরী, গাগরি, জর্দা, জাফরি, একেলা, ব্ৰুবেদুর, কবর, সফর, আরব। ১৬টি আরবি-ফারসি শব্দ।
১৪) দক্ষিণা (পঞ্চাশ লাইনের কবিতা)—আঁখি, কিনারে, ফর্দা, পর্দা, ডালিম, বালা, পেয়ালা, খুন, এস্রাজ, ফাগুয়া, লাল, ছুরি, ফরাশ, হারা, পায়েল। ১৫টি আরবি-ফারসি শব্দ।
১৫) ওগো দরদিয়া (তেতাল্লিশ লাইনের কবিতা)—দরদিয়া, তাজিয়া, নেশাখোর, আঁখি, বুজে, হারা, পান্থশালা, মুসাফের, পেয়ালা, ইয়োসোফ, আরবার, ফাগরাগ, ঝাঝ, কবর। ১৪টি আরবি-ফারসি শব্দ।
জীবনানন্দ যেসব আরবি-ফারসি শব্দ একাধিকবার ব্যবহার করেছেন সেগুলি হল—আঁখি, আখের, দিওয়ানা, খেয়াল, পেয়ালা, দরিয়া, খুন, মুসাফের, কবর।
‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থে এমন কয়েকটি কবিতা আছে, যেখানে পশ্চিম এশিয়ার ইসলামি সভ্যতার সাংস্কৃতিক আবহটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, জীবনযাপন, সংস্কৃতি বেশ খানিকটা আকর্ষণ করেছিল বাংলার কবিদের—‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ জাতীয় রোম্যান্টিক বাসনার একটি ধারা আরব-মরুভূমির বাতাবরণে কল্পনার আকার সন্ধান করেছে। পারিপার্শ্বিক কারণও ছিল। এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড ১৮৫৯ সালে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের ৭৫টি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর সারা বিশ্বে বিপ্লব ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। যে আলোড়নের জোয়ার বাংলাদেশেও বিশ শতকের শুরুতে এসে লাগে।
61
Here with a loaf of breed beneath the bough
A flarle of wine, a book of verse and thou
Beside me singing in the wildreness
And wildreness is paradise erow.
কান্তিচন্দ্র ঘোষ ১৯১৯ সালে ৭৫টি রুবাইয়াত বাংলায় অনুবাদ করেন, প্রকাশ করার পর বাঙালি পাঠকের ভেতরেও একটা উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। তারপর থেকে বাংলায় ১০২ জন ওমর খৈয়াম রসজ্ঞ রুবাইয়াতের বিভিন্ন রুচি ও পরিবেশ অনুযায়ী অনুবাদ করেন। নজরুল ইসলাম ১৯৩৪-৩৭ সালের মধ্যে অনুবাদ করলেও বই হিসাবে প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে।।
‘তাঙ্গি মেয়ে লাল খাহাম ব’ দিওয়ানী
সদ্দ রামাকী বায়াদ ব’ নেসনে নানী,
ব’ নগাহ মান ব’ তো নিশাসতে দার ব’ রানি
খোশতার বুদ আষ মামলাকাতে সুলতানি।
সেই অনুবাদ তখন বাঙালি কবিতা পাঠকের মুখে মুখে ফিরত—
‘এক সোরাটি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর
প্রিয় সাকী, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ
এই যদি পাই চাইব নাকো তখত আমি শাহানশার।
(রুবাইয়াৎ-ই খৈয়াম : নজরুল ইসলাম)
একপাত্র সুরা, একটুকরো রুটি, একটি কবিতার বই, একজন সুন্দরী সঙ্গিনী—মরুভূমি স্বর্গ হবে তাতে—এই ভাবের কবিতা বাংলা লেখা হল, অনুবাদ ছাড়াও।
পানশালা বা সরাইখানায় আশ্রয় নেওয়া দিওয়ানা মুসাফের বা আপনভোলা প্রেমিক তার উদাসী দার্শনিকের দৃষ্টি আর সুন্দরী সাকি’র হাতে ঢালা সুরায় পানপাত্র পূর্ণ করে নেওয়া—এই কল্পনাবৃত্তটি এসেছে বারবার। ধর্মনিরপেক্ষ ‘ফকির’ আর ‘আরব বেদুঈন’ এর দুঃসাহসিকতার কল্পনা মিশ্রণও ছিল। এই ভাব-আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের পরিবেশেই। তাই বাংলা কবিতায় এসেছে ইসলামি (আরবি, ফারসি) শব্দের স্রোত। আরও একটি কল্পনা-উৎস ছিল ইসলামি সভ্যতার নাগরিকতায়—‘চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের রোজা’; ‘আমার গগনে ঈদরাত কভু দেয়নি যে হায় দেখা’; ‘মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনি (আজান!) গগনে গগনে বাজে’, ‘তাজমহলের তরুণিমা আজো ঊষার : অরুণে জাগে; ‘আয় রে বালুর ‘কালবালা’তে, অন্ধকারের সাঁঝে, ইবলিশেরি সঙ্গে তাহার লড়াই হল শুরু’; ‘তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ।’ রোজা, ঈদরাত, মুয়াজ্জেন, তাজমহল, কারবালা, ইবলিশ, সিন্দবাদ-ইসলামি ধর্মশাস্ত্র এবং উপকথার উৎস অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়। বাংলা কবিতায় এ ধরনের শব্দের প্রচলন নেই।
জীবনানন্দের কবিতায় আরবি, ফারসি শব্দের ব্যবহার নিয়ে সমালোচক সুমিতা চক্রবর্তী ‘কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দ : জীবনানন্দ’ লেখায় লিখেছেন— ‘ঝরা পালক পর্বের কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ মানানসই এবং বিষয় বস্তুসিদ্ধ ঠিকই। কিন্তু একটি ক্ষেত্ৰআধারকে জাগাবার জন্য অনিবার্য বিকল্পহীন যে ‘এগজ্যাক্ট’ শব্দের ধারণাটি ইমেজিস্ট কবিরা দিতে চেয়েছিলেন—ঝরা পালকের সম্ভবত একটিমাত্র কবিতাই (‘ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল’) ভাব ও রূপের সেই অচ্ছেদ্য সংলগ্নতায় অবয়ব লাভ করতে পেরেছে। পার্থিব অস্তিত্বের গহনে, গোপনচারিণী রহস্যময়ী নারীকল্পনাকে ঘিরে মানুষের মনে জমে ওঠে এক অনতিস্পষ্ট অথচ দুর্দম—আশ্চর্য আর অপরূপ আকাঙ্ক্ষা। সেই অতৃপ্ত মানবতৃষ্ণার স্বরই রাজার দুলালের ভাষায় ধ্বনিত হয়। সেই নারী-রূপে বিশ্বের প্রতি কোণ থেকে ভাব-কল্পনা এসে মিশেছে। সেই নারীকে মনোলোকে প্রত্যক্ষ করবার মুহূর্তটিও রহস্যময় সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ-‘মেঘের বুরুজ ভেঙে অস্তাদ দিয়েছিল উঁকি… কিবে-গালিচাখাটে রাজবধূ-ঝিয়ারীর বেশে’ সেই নারীকে কবি দেখবার কথা ভেবেছেন কিন্তু সেই সাজানো ঘরে তাকে পাওয়া যায়নি। কোন রূপে সে এসছিল আমরা জানি—অধোমুখী বালিকা—‘সাপিনীর মতো বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ।’ এই কবিতায় ‘বুরুজ’ (আরবি), ‘কিঙ্খাব’ (ফারসি), ‘গালিচা’ (তুর্কি) যথার্থ শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলা যায়।..
‘ঝরা পালক’ পর্ব অতিক্রম করেই জীবনানন্দ আরবি, ফারসি শব্দের প্রকৃত জাদুটা কবিতায় লগ্ন করতে পেরেছিলেন—ধূসর পাণ্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায়।
সহজ, চলিত, কমন স্পীচের কাছাকাছি চলে আসছে তখন জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষা। বাড়ছে সেই সব আরবি-ফারসি শব্দের পরিমাণ, যাদের শরীর থেকে মুছে গেছে বিদেশি গন্ধ। যেসব শব্দ এখন অকৃত্রিম বাংলা-মোম, কাগজ, দালান, পেয়ালা, তাজা, তলোয়ার, ঠান্ডা, কিনার, হাওয়া, পরী, জমি, লাল, আয়না, সাহারা, নরম, মশান, বন্দর, দেয়াল, শিকার, বন্দুক, শয়তান, মিনার, গম্বুজ, পর্দা, গালিচা, তরমুজ, ইশারা, ফোয়ারা, জৌলস, দরদালান, তালাশ, শার্শি, পাতাল, নাশপাতি, কবর, মরুমশান, খালি, খবরদারী, বারুদ, জরি, পাপ, সুপারিশ, পাপী, ফকির, কোরান, শৌখিন, নামাজ, আজান, মসজিদ, মুসলমান, ঈদগা, বেগম, কারবালা, ফোফরা, ফেনা, সালিশী, আঁখি, শির, লোকন, মসলিন, চুমি, বেদুঈন, পান্থশালা, বালিশ, নিশানা, বেহুশ, আপসোস, মশলাদার, লবেজান, ইতর, ইবলিশ, ভিখ, সাকী, কয়েদী, তামাশা, নিশান, বাঁকা, খঞ্জর, সরাইখানা জুলপি, আরশি, কিঙ্খাব, মশাল, উজির, পাগড়ি, তাজমহল, কামিন, পরদেশী, একেলা, সফর, রুখে, জনম, ঈদ, রোজা, দস্তুর, তাবিজ, শামিয়ানা, পীর, ঝান্ডা, পালা।
‘ধূসর পান্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের ‘ক্যাম্পে’ কবিতায়—
‘কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার…
শুয়ে শুয়ে থেকে,
বন্দুকের শব্দ শুনি।
‘শিকার’ (ফারসি), ‘বন্দুক’ (ফারসি) শব্দ দুটি অ-বিকল্প প্রয়োগ। কবিতার সুর ও ভাবের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। ‘ধূসর পান্ডুলিপি’র আরেকটি ‘কয়েকটি লাইন’ কবিতা—
‘শয়তানের সুন্দর কপালে
পাপের ছাপের মত সেই দিনও।
মাঝরাতে মোম যারা জ্বালে
রোগা পায়ে করে পাইকারি
দেয়ালে যাদের ছায়া পড়ে সারি সারি
সৃষ্টির দেয়ালে।’
‘শয়তান’ (হিব্রু), ‘পাপ’ (ফারসি), ‘মোম’ (আরবি), ‘দেয়াল’ (আরবি)—এইসব। শব্দ এখানে তার পূর্ণ অভিঘাত এবং অর্থ নির্দিষ্টতা নিয়ে উপস্থিত। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের ‘শকুন’ কবিতা—
‘সব বাসি, সব বাসি—একেবারে মেকি’
‘বাসি’ (আরবি), ‘মেকি’ (ফারসি)। অনেকেরই ‘মেকি’ শব্দটিকে ইংরেজি শব্দ মনে হতে পারে। কিন্তু ‘মেকি’ ফারসি শব্দ। ব্যবহারও একেবারে উপযুক্ত। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘বেড়াল’ কবিতা—
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে।
‘জাফরান’ (আরবি) শব্দ পাঠককে বিস্মিত করে না। ‘বনলতা সেনে’র ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায়—
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা।
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ…
পর্দায় গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ।
‘খিলান’ (ফারসি), ‘গম্বুজ’ (ফারসি), ‘নাশপাতি’ (ফারসি), ‘পর্দা’ (ফারসি), ‘গালিচা’ (তুর্কি), ‘তরমুজ’ (ফারসি)—এগজ্যাক্ট শব্দ।
‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘স্থবির যৌবন’ কবিতায়—
‘এইসব সোনা রূপা মসলিন যুবাদের ছাড়ি…
তাহার ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে
কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশ।’
‘মসলিন’ (ফারসি) সূক্ষ্ম কাপড় অর্থে নয় কিন্তু, বিলাসিতার সূক্ষ্ম পালিশে মাজা নাগরিকতার অর্থটি বোঝাবার জন্য কী আশ্চর্য যথাযথ প্রয়োগ ‘মসলিন’ শব্দটির। ‘কিনারে’ (আরবি), জাফরান’ (আরবি)—নিশ্চয়ই বৈকালিক সূর্যাস্ত-আভার কমলা রঙ আছে ‘জাফরান’ শব্দে।
‘মহাপৃথিবী’র ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা— শো
‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে..
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।
‘লাশ’ (ফারসি), ‘চিৎ’ (আরবি)। দুটি শব্দই একই অনুষঙ্গে ব্যবহৃত। চিৎ হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে লাশ।
‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে ‘মনোসরণি’ কবিতায়—
‘দেওয়ালের কার্নিশে মক্ষিকারা স্থিরভাবে জানে..
পাঁচ ফুট জমিনের শিষ্টতায় মাথা পেতে রেখেছে আপোষে
হয়তো চেঙ্গিস আজো বাহিরে ঘুরিতে আছে করুণ রক্তের অভিযানে…
লবেজান হাওয়া এসে গাঁথুনির ইট সব করে ফেলে ফাঁস।
‘দেয়াল’ (আরবি), ‘কার্নিশ’ (ফারসি), ‘জমিন’ (ফারসি), ‘আপোষ’ (আরবি), ‘চেঙ্গিস’ (ফারসি), ‘লবেজন’ (ফারসি), ‘ফাঁস’ (ফারসি)। চারটি লাইনে সাতটি অদ্ভুত আকর্ষক শব্দ।
‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’—
‘দরদালানের ভিড়—পৃথিবীর শেষে…
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হয়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ।’
‘দরদালান’ (ফারসি) শব্দটি পৃথিবীর সীমারেখায় ভেসে থাকা এক রহস্যময় তর-প্রাসাদের প্রাঙ্গণে পৌঁছে দেয় পাঠককে। ‘বেলোয়ারি’ (ফারসি) ঝকমকে—কিন্তু ভঙ্গুর। এই পণ্য সভ্যতার আপাত জৌলস—কিন্তু অন্তরে সর্বনাশা ভাঙনের চিড়—একথাই কি বলতে চান কবি? ‘নরক’ (আরবি)। নারীর বিনুনি কি নরকের মেঘ। ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থের ‘লঘু মুহূর্ত’ কবিতা—
‘এমন কী হতো জাহাবাজ।
এই নিয়ে চারজনে করে গেল ভীষণ সালিশী।
‘জাহাবাজ’ (ফারসি), ‘সালিশী’ (ফারসি)—শব্দ দুটির মধ্যেও সেই একই যথার্থতা।
মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি সভ্যতায় এক বিশেষ ধরনের রোম্যান্টিকতা আছে— মিনারশোভিত শ্বেতপাথরের জাফরি কাটানো খিলান; রেশমি পর্দা আর গালিচা সাজানো ঘর; ফোয়ারা ছলকানো বাগিচা; মখমল-কিঙ্খাব-মসলিনের পোশাক; আতর-সুর্মা-হেনা’র বিলাস; মনজিল, মহফিল, মুশায়েরা, দরবার, রংমহল, শিশমহল, মোতিমহল, মিনাবাজারের সম্ভার-সম্পন্ন প্রাসাদ; আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, লোভ, দ্বেষ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, খোশ-খেয়ালের নিত্য আততি-টারিত প্রাত্যহিকতা—এই বাতাবরণে জাগ্রত হয় সেই রোম্যান্টিক বিমুগ্ধতার বোধ। আর আমির, সুলতানদের জীবন-যাপন থেকে, তাদের রম্য বিলাস থেকে একধরনের ভাবাবেগ স্পষ্ট রোম্যান্টিকতার পরিবেশ মনে মনে গড়ে নিলেন বাংলার বাঙালি কবি, জীবনানন্দ দাশ। এইসব কবিতার রূপ-রচনায় সচেতনভাবে কুশল কলারীতিতে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ করেছেন জীবনানন্দ, শব্দগুলোর নিবিড় এবং যথাযথ বিন্যাস পাঠককে কেবল মুগ্ধই করে না একেবারে কবিতাটির মর্মে গিয়ে আলোক সম্পাতিত করে।
‘ঝরা পালক’ থেকে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে আরবি-ফারসি শব্দের বহুল ব্যবহার কলেও, মহাপৃথিবী থেকে আরবি-ফারসি শব্দের অনুপাত কমে যেতে থাকে, বেড়ে যেতে থাকে অদ্ভুত সব ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের বাংলা অর্থসহ) তালিকা
ইশারা (আরবি)—ইঙ্গিত, দরিয়া (ফারসি)—সমুদ্র, আখের (আরবি)—পরিণাম, দিওয়ানা (ফারসি)—আপনভোলা প্রেমিক, মুসাফের (আরবি) বিদেশ ভ্রমণকারী, জিঞ্জির (ফারসি)—শিকল, খেয়াল (আরবি)—কল্পনা, খোশ (আরবি)—আনন্দিত, চুলবুল (ফারসি)—অস্থিরতা, বন্দুক (ফারসি)—গুলি ছোঁড় বার অস্ত্র, জাগরক (আরবি)—জাগরিত, আমির (আরবি)—নবাব, ইয়াসিন (ফারসি)-কোরানের একটি সুরা, পেয়ালা (ফারসি)—কাপ, তোতা (ফারসি)—টিয়া, ফরাশ (আরবি)—মেঝেতে পাতবার জন্য কার্পেট, গজল (আরবি)—উর্দু ভাষার গীতিকবিতা, রেওয়াজ (আরবি)—রীতি, দিলদার (আরবি)—হৃদয়বান, ফোয়ারা (ফারসি)—কৃত্রিম উৎস, তরমুজ (ফারসি)—সমুদ্রের বালিয়াড়িতে চাষজাত বড়ো আকারের লাল শাঁসওয়ালা ফল, ফেনশির (ফারসি)—একসঙ্গে ফুলে ওঠা বুদবুদ রাশি, মকবুল (ফারসি)—পছন্দ, গালিফ (আরবি)—ইসলামিক বড়ো কবি, গালিচা (তুকী)-ভেড়ার ললামের তৈরি কারুকার্য করা দামি আসন, খারাবি (আরবি)—ক্ষতি, জৌলস (আরবি)—চাকচিক্য, জিন (ফারসি)—ঘোড়ার পিঠের চামড়ার আসন, সর্দার (ফারসি)—দলপতি, নার্গিস (আরবি) এক ধরনের তীব্র সুগন্ধ ফুল যা প্রথম বসন্তে ফোটে, পশমিনা (ফারসি)—ভেড়ার লোমের তৈরি পোশাক, দরদালান (ফারসি)—ছাদওয়ালা প্রশস্ত বারান্দা, মোম (আরবি)—মৌমাছির নিঃসৃত আঠালো লালা যা দিয়ে মৌচাক তৈরি হয়, তনুবাত (ফারসি)—দেহকথা, মহম্মদ (আরবি)—ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক, হানিফ (আরবি)—হজরত ইব্রাহিমকে অনুসরণকারী, তালাশ (আরবি)—অনুসন্ধান, সোয়ার (ফারসি)—অশ্বারোহী, বান্দা (আরবি)-ভৃত্য, রংমহল (আরবি)-—নবাব বাদশাহের বিলাসবহুল অন্তঃপুর, মোতিমহল (আরবি)—মুক্তা দিয়ে সাজানো অন্তঃপুর, শার্শি (ফারসি) কাচের জানালা, বারোয়ার (ফারসি)—সংগীতের রাগিনী বিশেষ, ফাগুয়া (আরবি)—আবির, কাগজ (আরবি)—বাঁশ কাপড় তুলোর মণ্ড থেকে তৈরি লেখার পাতা, পাতাল (আরবি)—ভূ-গর্ভ, কারিম (আরবি)-দয়াময় ঈশ্বর, আজিজ (আরবি)—মনপছন্দ, পর্দা (ফারসি)—কাপড় দিয়ে তৈরি আড়াল, খুন (আরবি)—হত্যা, শারাব (আরবি)—মদ, নাশপাতি (ফারসি)—আপেলের মতো মিষ্টি স্বাদের রসালো পাহাড়ি ফল, দরাজ (ফারসি)-লম্বা, কাফন (আরবি)—ইসলামি রীতিতে কবর দেওয়ার আগে মৃতদেহকে যে কাপড়ে ঢাকানো হয়, কবর (আরবি)—সমাধি, মরুমশান (ফারসি)—জল ও উদ্ভিদহীন বালুকাময় স্থান, খালি (আরবি)—শূন্য, উসখুশ (আরবি)—অস্থিরতার ভাব, আস্ফোট (ফারসি)—আস্ফালন, বেটপকা (ফারসি)—হঠাৎ উৎপত্তি, খেলাপ (ফারসি)—বিপরীত, খবরদারী (আরবি)—নজর রাখা, খিলান (ফারসি)—ইটের অর্ধবৃত্তাকার গাঁথুনি, ঝান্ডা (আরবি)—পতাকা, বারুদ (আরবি)—কামানের মধ্যে ভরে গোলা ছোড়বার জন্য ব্যবহৃত বিস্ফোরক বিশেষ, সাহারা (আরবি)—আশ্রয়, জারি (আরবি)—সোনালি তার, ঝাল্ডাঝালর (ফারসি)—কাপড়ের তৈরি কেঁচকানো পাড়, শয়তান (হিব্রু)—ঈশ্বরবিরোধী পাপাত্মা, সুপারিশ (ফারসি)—কাউকে কোনো সুযোগ দেওয়ার জন্য শক্তিশালী ব্যক্তিকে অনুরোধ, ভুলচুক (আরবি)—দোষত্রুটি, জবান (আরবি)—প্রতিশ্রুতি, দরদ (আরবি)—ব্যথা, মস্তানা (আরবি)—অসংযত ব্যক্তি, খুশরোজী (ফারসি)—আনন্দিত, রোশনাই (আরবি)—আলোর ছটা, রবাব (ফারসি)—মেজাজ, পিছে-পিছে (আরবি)–পেছন পেছন, পাপ (ফারসি)—-অধর্ম, বুজিয়া (ফারসি)—বন্ধ করে, কারারা (আরবি)—জোরে, শরী (ফারসি)—পুঁটিমাছ, বেদিয়া (ফারসি)—যাযাবর জাতিবিশেষ, নামাজ (আরবি)—মুসলমানদের রীতি অনুযায়ী আল্লাহর উপাসনা, আজান (আরবি)—নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ থেকে উচ্চস্বরে আহ্বান, মুয়াজ্জেন (আরবি)—যিনি আজান দেন, ঈদগা (আরবি)—মুসলমানগণ যেখানে একত্রিত হয়ে নামাজ পড়েন, তসবি (আরবি)—মুসলমানদের জপমালা, ফকির (আরবি)—মুসলমান ভিক্ষুক, কোরান (আরবি)—ইসলাম ধর্মের মূল শাস্ত্রগ্রন্থ, শেখসেনানী (ফারসি)—মুসলমান বংশোদ্ভুত সৈন্য, শৌখিন (আরবি)—অভিনব রুচি, কৃষাণ (আরবি)—কৃষক, লোকসানী (ফারসি)—ক্ষতি করেন যে, পীর (আরবি)—সুফি সম্প্রদায়ের গুরু, মসজিদ (আরবি)—ইসলাম ধর্মে দীক্ষিতদের উপাসনা স্থান, মুসলমান (আরবি)—ইসলাম ধর্মাবলম্বী, আরব (আরবি)—দেশ বিশেষ, তাতার (ফারসি)—মধ্য এশিয়ার জাতি বিশেষ, তুকী (ফারসি)—দেশ বিশেষ, ইরান (আরবি)—দেশ বিশেষ, শের (আরবি)—বাঘ, হাড্ডি (আরবি)—হাড়, পাশা (ফারসি)—খুঁটি নিয়ে খেলা বিশেষ, পাশী (ফারসি) তুরস্কের সম্প্রদায় বিশেষ, ইয়েসোফ (ফারসি)—হজরত ইয়াকুবের পুত্র, আসন (আরবি)—লাঘব, তখত (ফারসি)—সিংহাসন, শাহানশা (ফারসি)—রাজাধিরাজ, আকবরী আইন (ফারসি)—আকবরের সময়কার বিধি, সেলিম (আরবি)—পরিপূর্ণ, শাজাহাঁ (আরবি)—পৃথিবীর মালিক, কারবালা (আরবি)—দুঃখ ও বিপদের জায়গা, কানা (আরবি)—অন্ধ, খোঁজা (ফারসি)—অন্বেষণ করা, ত্যাজিয়া (ফারসি)—ক্রোধযুক্ত গর্জন, মীনা (ফারসি)—ধাতুর উপর কাচের মতো মসৃণ পদার্থের কলাই, মেহেরাব (ফারসি)—দাপট, বেগম (আরবি)—বাদশাহের স্ত্রী, বাঁদী (আরবি)—দাসী, কাফের (আরবি)—মুসলমানের কাছে বিধর্মী, মিনার (ফারসি)—গম্বুজ আকৃতির স্তম্ভ, জাফরান (আরবি)—গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ বিশেষ ও তার ফুল, ফোঁফরা, (ফারসি)—আঁঝরা, কামিজ (ফারসি)—শরীরের ওপরের অংশ ঢাকার জ্য হাতাওলা জামা, ফেনা (ফারসি)—জলীয় পদার্থ থেকে ওঠা বুদবুদের পুঞ্জ, ফাগরাগ (ফারসি)—উৎসবের গান, তাজা (আরবি)—টাটকা, বেলোয়ারি (ফারসি)—কাঁচের চুড়ির মততা, জাহাবাজ (ফারসি)—বহুদর্শী, সালিশী (ফারসি)—বিচার প্রক্রিয়া, আঁখি (ফারসি) চোখ, শির (আরবি)—মাথা, লম্পু (ফারসি)—ছোটো বাতি, লোকসান (আরবি)—ক্ষতি, মসলিন (ফারসি)—খুব মিহি বস্তু বিশেষ, শামিয়ানা (আরবি)—চাদোয়া, সিন্দবাদ (ফারসি)—চির সমুদ্রযাত্রী নাবিক, চুমা (আরবি)—চুম্বন, বেদুঈন (ফারসি)—আরব দেশের যাযাবর, পান্থশালা (আরবি)—পথিকের জন্য আহার ও বিশ্রামস্থল, ঠান্ডা (আরবি)—শীতল, বালিশ (আরবি)—শোওয়ার জন্য মাথা রাখার আধার, পাপী (আরবি)—পাপাত্মা, চক্কর (ফারসি)—ঘুরে আসা, বিসমাল্লা (আরবি)—আল্লাহর দোহাই, মাগে (ফারসি)—চাওয়া, নিশানা (উর্দু)—লক্ষ্য, খর্জুর (ফারসি)-খেজুর, লাশ (ফারসি)—শব, বেহুশ (ফারসি)—জ্ঞানশূন্য, দিলওয়ার (ফারসি)—প্রিয়পাত্র, ক্যারাভেন (ফারসি)—যাযাবর, কিনার (আরবি)—কূল, জমিন (আরবি)—ভূখণ্ড, লঙ্গরখানা (আরবি)—যেখান থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়, হদিশ (আরবি)—সন্ধান, আওয়াজ (আরবি)—কণ্ঠস্বর, জনম (আরবি)—জন্ম, রোজা (আরবি)—ইসলামের বিধান অনুযায়ী রমজান মাসের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস পালন, ঈদ (আরবি)—ইসলামি রমজান মাসের শেষে অনুষ্ঠিত ইসলাম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব, মজগুল (আরবি)—বিভোর, দস্তুর (ফারসি)—প্রথা, তাবিজ (আরবি)—মাদুলি, কিনারা (আরবি)—তীর, হাওয়া (আরবি)—বাতাস, চেঙ্গিস (ফারসি)—রুটি খাবার পাত্র, খামির (ফারসি)—গরম জলে সেদ্ধ, আপসোস (আরবি)—অনুতাপ, মশলাদার (ফারসি)—সুস্বাদু করার উপকরণ বিশেষ, সোয়াদ (ফারসি)—স্বাদ, শারাবখানা (আরবি)—মদের দোকান, মুসলাত (ফারসি)—চেষ্টা, ফিকা (আরবি)—হালকা রঙের, শারাবশালা (আরবি)—মদ যেখানে পাওয়া যায়, পরী (ফারসি)—পাখা আছে এমন অঙ্গরা বিশেষ, লবেজান (ফারসি)—প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। এমন, ইতর (ফারসি)—অধম, খাতক (ফারসি)-ঋণী, দিলপিয়ালা (আরবি)—হৃদয়ের মতো, ইবলিশ (আরবি)—শয়তান, ভিখ (আরবি)—ভিক্ষা, সাকী (ফারসি)—মদ পরিবেশনকারী, কয়েদী (আরবি)—বন্দী, পুছে (ফারসি)—জিজ্ঞাসা, মুঝে (ফারসি)—নিজেকে, তামাশা (আরবি)—কৌতুক, নিশান (উর্দু)—চিহ্ন, রেবা (ফারসি)—নর্মদা নদী, তিতা (ফারসি)—তেতো, কলেজা (আরবি)—হৃৎপিণ্ড, বাঁকা (আরবি)—তির্যক, তলোয়ার (আরবি)—লম্বা ফলাবিশিষ্ট ঈষৎ বাঁকানো ও একদিকে ধারযুক্ত অস্ত্র, খঞ্জর (আরবি)—ছোরা যার দুদিকেই ধার, সরাইখানা (আরবি)—পথিকদের বিশ্রামস্থান, গুলজারিয়া (ফারসি)—কোলাহলপূর্ণ, লাল (ফারসি)—পুত্র, বল্লম (ফারসি)—বর্শা, খারিজ (আরবি)—বাতিল, মোজেইক (ফারসি)—লাল রঙের পাথর দিয়ে দেওয়াল কিংবা মেঝে নকশা, ঘায়েল (আরবি)—কাবু, দুশমন (আরবি)-শত্রু, গাগরী (ফারসি)—কলসি, ঈশিশ (ফারসি)-অধিপতি, ক্ৰবেদুর (ফারসি)—যাযাবর, পায়দল (আরবি)—পায়ে হেঁটে চলা, ফর্দা (আরবি)—টুকরো, জুলপি (ফারসি)—লম্বা চুল, আয়না (ফারসি)—দর্পণ, আরশি (আরবি)—আয়না, বিসার (ফারসি)—শক্তি, মরকত (ফারসি)—সবুজ পান্না, হারা (আরবি)—নিখোঁজ, বুরুজ (আরবি)—দুর্গের প্রাচীর, কিম্বাব (ফারসি)—রেশমি কাপড়, বহিন (ফারসি)—বোন, টুটিয়া (ফারসি)—ভেঙেছে এমন, শাহদারা (ফারসি)—বাদশার পুত্র, ইলাহী (আরবি)—ঈশ্বর, মশাল (আরবি)—ছোটো লাঠির ডগায় তেল মাখানো ন্যাকড়া বেঁধে বানানো বাতি, উজির (আরবি)—মন্ত্রী, পাগড়ি (আরবি)—মাথায় জড়ানো কাপড়, একশা (আরবি)—এক সমান, মোসলেম (ফারসি)—মুসলমান, ফতেহপুর (আরবি)—উত্তরপ্রদেশের জায়গা বিশেষ, মোগল (আরবি)—জাতি বিশেষ, তাজমহল (আরবি)—শিরোভূষণ বাড়ি, আরবিয়ান (আরবি)—আরব দেশের ভাষা, বন্দর (ফারসি)—সমুদ্রতীরে জাহাজ নোঙর করবার স্থান, কামিন (ফারসি)—রমণী, ঈশা (ফারসি)—খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, পরদেশী (আরবি)—বিদেশি, জাজিম (ফারসি)—বিছানার উপর পাতবার মোটা নকশাদার চাদর, শিশি (ফারসি)—কাঁচের তৈরি ছোটো বোতল, জাফরি (ফারসি)—বাঁশের চটা দিয়ে বোনা চৌকো ছিদ্রযুক্ত বেড়া, জর্দা (ফারসি)—পানের সঙ্গে মশলা হিসেবে খাওয়ার শুদ্ধ তামাক চূর্ণ, একেলা (আরবি)—একা, এস্রাজ (ফারসি)—তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র বিশেষ, সফর (আরবি) বিদেশ ভ্রমণ, শিকার (ফারসি)—বনের পশুপাখি হত্যা, গুনাগার (আরবি)—অপরাধী, ঘুরনি (ফারসি)-আবর্তন, মেকি (আরবি)—কৃত্রিম, আরবার (আরবি)—পুনর্বার, ডালিম (ফারসি)—বেদানা জাতীয় ফল, মাসুদ ডাকাত (ফারসি)—মুসলিম দস্য, খিঁচে খিঁচে (ফারসি)—টেনে টেনে, মশান (আরবি)—প্রাচীনকালে শূলে চড়ানোর জায়গা, নীলা (আরবি)—নীল, চুরমার (আরবি) টুকরো টুকরো করে ভাঙা, ছারখাপ (ফারসি)—ধ্বংস, নহর (ফারসি)—ক্ষীণ জলধারা, গুম (ফারসি)—অদৃশ্য, অপ্সরী (আরবি)—স্বর্গের নর্তকী, মীননারী (ফারসি)—মৎস্যনারী, চামর (ফারসি)—চব্বরী গোরর লেজের লোমে তৈরি এক ধরনের পাখা, ঝাঝ (ফারসি)—উগ্রতা, রুখে (ফারসি)-রোখা, দারুচিন (ফারসি—মিষ্ট জাতীয় দ্রব্য, ফাগ (ফারসি)—উৎস বিশেষ, খেদ (ফারসি)—দুঃখ, আশেক (ফারসি)—প্রেমিক, পালা (আরবি)—সরু, তুরাণী (ফারসি)—তুরকিস্তানের অধিবাসী, পিঞ্জর (ফারসি)—খাঁচা, চিৎ (ফারসি)-উপরের দিকে মুখ করে শায়িত, ফাস (ফারসি)—জালে আবদ্ধ করা, কার্ণিশ (ফারসি)—ছাদের শেষে যে অংশ সাধারণত দেওয়ালের বাইরে থাকে, আপোষ (আরবি)-মিটমাট, গম্বুজ (ফারসি)—মসজিদের গোলাকার চূড়া, খিচে (ফারসি)—পেশির টান, বাসি (আরবি)—আগের দিনে প্রস্তুত, নরক (আরবি)—কল্পিত স্থান যেখানে পাপীদের আত্মা মৃত্যুর পরে শাস্তি ভোগ করে, দালাল (ফারসি)—ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগকারী, তমুরা (ফারসি)—তানপুরা, খুন—খারাবী (ফারসি)—রক্তারক্তি, পিয়ারা (ফারসি)—আদরের, নরম (উর্দু)—কোমল, ছুরি (আরবি)—ছোরার চেয়ে ছোটো অস্ত্রবিশেষ, দেয়াল (আরবি)—প্রাটীর।
তথ্যসূত্র
- সুমিতা চক্রবর্তী—কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দ : জীবনানন্দ
- হরপ্রসাদ মিত্র—কবিতার বিচিত্র কথা
- আবদুল মান্নান সৈয়দ—জীবনানন্দ ও মোহিতলাল।
- গোপালচন্দ্র রায়—জীবনানন্দের কবিতায় স্বদেশী ও বিদেশী প্রভাব
- নারায়ণ হালদার—বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।