১৯৩৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলায় হিন্দু মহাসভার জন্ম হয়। কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় নেতা বিনায়ক দামােদর সাভারকর (১৮৮৩-১৯৬৬) প্রথম গেরুয়া ঝান্ডা তােলেন এই বাংলায়। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী (১৯০১-১৯৫৩) ছিলেন তার সহযােগী। এই ঘটনা ইংরেজ বড়লাটকে বেশ আনন্দিত করে তােলে স্বাভাবিক কারণেই। এরপর ১৯৪০ সালে শ্যামাপ্রসাদ বাংলার হিন্দু মহাসভার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে কংগ্রেস করতেন, কিন্তু ত্রিশের দশকের শুরুতে কংগ্রেস ‘হিন্দুস্বার্থ’ ঠিকমতাে রক্ষা করতে পারছিল না দেখে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন। তার মনে হয় হিন্দু মহাসভা হিন্দুস্বার্থ রক্ষা করতে পারবে। তিনি তার সংসদীয় জীবনের প্রথম পর্ব থেকেই রাজ্য বিধানসভার হিন্দু সদস্যরা তাদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করার তাগিদ এত তীব্রভাবে অনুভব করতেন এবং সেইমতাে কাজ করতেন যে, সংসদীয় রাজনীতির পরিমণ্ডলে এসে শ্যামাপ্রসাদ তার সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিকাশের একটা বড় ধরনের সুযােগ পেয়ে যান। ১৯২৯-র ১১ আগস্ট রাজ্য বিধানসভায় প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে একটি বিল উত্থাপিত হয়। এই বিলের বিরােধিতা করেন বিধানসভার ৪০ জন হিন্দু সদস্য। মূলত শ্রেণিস্বার্থের নিরিখেই জমিদারদের উপর কর বসাবার প্রস্তাবের (উল্লেখ্য উক্ত বিলে জমিদারদের উপর কর বসানাের প্রস্তাব ছিল) তারা ছিলেন ঘাের বিরােধী। কেননা মুসলিম প্রাধান্যযুক্ত বাংলায় মুসলিম প্রজার শিক্ষা বিস্তারের জন্য হিন্দু জমিদার কর দেবেন এটা মেনে নেওয়ার মতাে ঔদার্য তৎকালীন হিন্দু বিধায়কদের ছিল না। বিধানসভার এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মধ্যে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদের সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা বিধায়ক শ্যামাপ্রসাদকে সাম্প্রদায়িক কৌণিক অবস্থান নিতে অনেকখানিই সাহায্য-সহযােগিতা করেছিল। অসাধারণ বাগ্মী শ্যামাপ্রসাদের যাবতীয় গুণাবলি ধীরে ধীরে চাপা পড়ে গিয়েছিল, প্রকট হয়ে ওঠে তার সাম্প্রদায়িক চরিত্র।১ যে ফজলুল হকের প্রথম দফার (১৯৩৭-৪১) মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব শ্যামাপ্রসাদ পালন করেছিলেন, সেই ফজলুল হকের দ্বিতীয় দফার (১৯৪১-৪৩) মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন ছিল শ্যামাপ্রসাদের। এটা তার রাজনৈতিক দ্বিচারিতার একটি উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।
(১)
বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সমস্যার মূলে ছিল ভূমি-সমস্যা। এখানে অধিকাংশ জমিদার ছিলেন হিন্দু এবং প্রজারা ছিলেন মুসলমান। ফলে অর্থনৈতিক বিরােধ ক্রমশ সাম্প্রদায়িক চরিত্র নিতে থাকে। চাষির স্বার্থে আইনসভায় যে কোনও প্রস্তাব হিন্দু জমিদারদের স্বার্থকে বিপদগ্রস্ত করে তুলত। এই সময় থেকে শ্যামাপ্রসাদ প্রধানত হিন্দু স্বার্থরক্ষার জন্য সচেতন হতে শুরু করেন।
তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে কোনওদিন যেতে চাননি। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে হিন্দু জমিদারদের অভাব ছিল না। কিন্তু সরাসরি জমিদারদের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযােগ কংগ্রেসের ভেতরে থেকে ছিল না। ফলে দেখা যেত, আজ যে হিন্দু মহাসভা কালই আবার সে কংগ্রেস, আবার পরের দিন ফের হিন্দু মহাসভা। এই পরিস্থিতিতে হিন্দু জমিদাররাই এগিয়ে এলেন বাংলায় হিন্দু মহাসভা সংগঠিত করতে। কেউ কেউ আবার তাদের জমিদারিতে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনের ব্যবস্থা করে দেন। শ্যামাপ্রসাদের পৃষ্ঠপােষকতায় বাংলায় হিন্দু মহাসভার এই বাড়-বাড়ন্ত বাংলার পক্ষে খুব একটা শুভ হয়নি। ১৯৪১ সালের মার্চে মিথ্যা গুজবের ফলে ঢাকায় দাঙ্গা বাঁধে। তাতে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যে ত্রাণকার্য শুরু করা হয়, তা কংগ্রেসের ঘােষণা অনুযায়ী, কেবল হিন্দুদের জন্য। শুধুমাত্র হিন্দুদের জন্য ত্রাণকার্যে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্বেরও অনুমােদন ছিল।২ এখানেই শেষ নয়, ঢাকা দাঙ্গা অনুসন্ধান কমিটির সামনে কংগ্রেস হিন্দু মহাসভার সঙ্গে একজোটে হিন্দুপক্ষ সমর্থন করে।৩
যাই হােক, যে হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল সেই সংগঠনটির উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্পর্কে কোনও মতান্তর কি থাকতে পারে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন। মানুষের মধ্যে? যে নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে ফজলুল হক ক্যাবিনেটের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, সেই নির্বাচন ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঘােষিত ‘সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ’-এর ভিত্তিতে হয়েছিল। অথচ মুসলিম সম্প্রদায়ের আইনসভায় আগের চেয়ে বেশি আসন লাভের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এই শ্যামাপ্রসাদই। ফজলুল হক দ্বিতীয় দফায় (১৯৪১-৪৩) ক্ষমতায় আসার পর তার সঙ্গে পারিবারিক যােগসূত্রকেই মূল অবলম্বন করে শ্যামাপ্রসাদ আবার হক-মন্ত্রীসভার সদস্য হন। স্যার আশুতােষ ফজলুল হককে খুব স্নেহ করতেন, কন্যা কমলার গৃহশিক্ষকও তিনি ফজলুল হককে নিযুক্ত করেছিলেন। অথচ মন্ত্রী হয়ে শ্যামাপ্রসাদ ফজলুল হকের বিশ্বাসের যথােচিত মূল্য দেননি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে আবুল মনসুর আহমদ সেই সময়েইহক সাহেবের অনুমতি নিয়ে শ্যামাপ্রসাদকে ময়মনসিংহে যৌথ প্রচার করবার ঐকান্তিক আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ চাতুর্য সহকারে সেই প্রস্তাব এড়াতে তখন চলে গেলেন মেদিনীপুরে।।
ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রীসভার আমলে মুসলিমদের উন্নতি বিধানে যে কোনও প্রচেষ্টারই তীব্র বিরােধিতা করতেন শ্যামাপ্রসাদ তার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। তবুও বাস্তব রাজনীতির কথা ভেবে ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদকে তঁার মন্ত্রীসভায় নিয়ে যে প্রখর বাস্তববােধ, সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু আদৌ তার কোনও মর্যাদা রাখেননি। এই পর্যায়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে স্যার আজিজুল হকের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রবল দাবি সত্ত্বেও মূলত শ্যামাপ্রসাদের প্রবল বিরােধিতায় তাকে দ্বিতীয় দফার জন্যে উপাচার্য নিয়ােগ করতে পারেনি হক-মন্ত্রীসভা। এ ঘটনা ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবনে যথেষ্ট ক্ষতি করেছিল। ১৯৪২-এর আন্দোলনে মেদিনীপুরে পুলিশ অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল। অথচ চতুর শ্যামাপ্রসাদ অত্যাচারের সমস্ত দায়ই ফজলুল হকের উপর চাপিয়ে দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে হক-মন্ত্রীসভা থেকে লােক দেখানাে পদত্যাগ করে হিন্দুদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রাখেন।
আর এই শ্যামাপ্রসাদ আবার ১৯৪২-এর আন্দোলনের মােকাবিলায় ব্রিটিশেরা যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তার সমালােচনা করতে অসম্মত হন। হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে ঘােরালাে করার সঙ্গে সঙ্গে মুখে সম্প্রীতির কথা বলা শ্যামপ্রসাদের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্রের একটা বড় দৃষ্টান্ত। হক-মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিজের পছন্দের এইচ দত্ত কোম্পানিকে চালের বরাত পাইয়ে দিয়ে ১৯৪৩-এর মন্বন্তরকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। দুর্ভিক্ষে ত্রাণ বিলির নামেও তিনি তাঁর সাম্প্রদায়িক চরিত্রের পরিচয় রেখেছিলেন। সংঘ পরিবারের সদস্য ভারত সেবাশ্রম সংঘের সঙ্গে একজোটে তিনি কেবলমাত্র হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাতেই ত্রাণ বণ্টন করেছিলেন।৪ এই সময়ে ন্যাশনালিস্ট’ নামে একটি সংবাদপত্রও শ্যামাপ্রসাদ প্রকাশ করেন। বাংলায় মুসলিম লিগের বিরােধিতা করে সাম্প্রদায়িকতার পারদটিকে ঊর্ধ্বমুখী করাই ছিল এই সংবাদপত্রের একমাত্র লক্ষ্য।
অনেকে আজ প্রশ্ন তােলেন শ্যামাপ্রসাদ সাম্প্রদায়িক ছিলেন কিনা? তিনি কি অসুস্থ নজরুলকে সাহায্য করেননি? ফজলুল হক কি তার বন্ধু ছিলেন না? এমন দৃষ্টান্ত আরও দেওয়া যায়। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের বিভেদমূলক রাজনীতি ও বিদ্বেষমূলক কথাবার্তাকে অস্বীকার করব কী করে? ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করতে পারে এমন কিছু শ্যামাপ্রসাদ বরদাস্ত করতে রাজি ছিলেন না। তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছেন, “ভারতে বা ভারতের কোনও প্রান্তে ইসলামের পতাকা উড়তে থাকবে এ আমরা স্বীকার করতে চাই না। সারা হিন্দুস্তানে শতকরা ৭৫ জন হিন্দু, যদি গণতন্ত্রবাদের ওপর ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে গড়ে ওঠে, এটা স্বীকার করতে হবে যে তাহলে সারা ভারতে যে গভর্ণমেন্ট হবে তার মধ্যে হিন্দুর প্রভাব বেশী থাকবে।” তিনি আরও লিখেছেন, “…হিন্দু কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে সেটা চিন্তা করেও দেখে না। একটা ‘Civil War’ ছাড়া হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হবে না। ‘Civil War’ আমরা চাই না— কিন্তু যদি অপরপক্ষ তৈরী হয়ে ওঠে আর আমরা প্রস্তুত না থাকি, তাহলে আমরাই ঠকবাে শেষ পর্যন্ত…এই সামান্য সত্য কথা হিন্দু তার এত বুদ্ধি, এত অর্থবল থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারে না।” ১৯৪৬ সালের ৪ জানুয়ারী শ্যামাপ্রসাদ তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘Force must in the last analysis be met with force. An internal policy of non-resistance to armed violence would eventually would condemn any society to dissolution.’ এই কথা ভেবেই বােধ হয় তিনি হিন্দু মহাসভার তারকেশ্বর সম্মেলনে হিন্দুস্তান ন্যাশনাল গার্ড তৈরি করার ডাক দিয়েছিলেন, যার সদস্য সংখ্যা হবে ১.৫ লক্ষ। শ্যামাপ্রসাদ পরিকল্পিত এই গার্ড বাহিনীর অধুনা সংস্করণ তাে আজকের আর এস এস-র লেঠেল বাহিনী, বজরং বাহিনী, শিবসেনা, ত্রিশূল বাহিনী। এরা শুধু উগ্র সাম্প্রদায়িক নয়, চরম হিংস্র ও নৃশংসও।
শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্যবােধ ছিল বর্ণহিন্দুদের জন্য, এলিট হিন্দুদের জন্য, বিত্তশালী হিন্দুদের জন্য। যুক্তবাংলার মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সমান অধিকার দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর ঘাের আপত্তি ছিল। তিনি মনে করতেন, উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই শিক্ষা-সংস্কৃতিমেধা ও কর্মদক্ষতায় শ্রেষ্ঠ। তাই শাসন করার ও সমাজে আধিপত্য করার একমাত্র অধিকারী হচ্ছে উচ্চবর্ণের মানুষেরা। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী পেপারস্ অধ্যয়ন করলে তার চিন্তা-কর্ম সম্বন্ধে এরকম বহু তথ্য পাওয়া যাবে। তিনি কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদী ছিলেন না, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য নষ্ট করতেও প্রয়াসী ছিলেন। বাংলার মুসলমান সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হল: “এঁরা হচ্ছে হিন্দু সমাজের তলানীর নােংরা হতে ধর্মান্তরিত একদল মানুষ, যারা সবদিক দিয়ে হীনতর।” দেশভাগের বছরখানেক আগে (১৯৪৬) লেখা শ্যামাপ্রসাদের এই ব্যক্তিগত নােটে তিনি মুসলিম লিগের শাসনে বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে মুল্যায়ন করে বলেন: “বাংলা যদি পাকিস্তানে রূপান্তিরত হয় …বাংলার হিন্দুরা স্থায়ীভাবে মুসলমান শাসনের অধীন হয়ে যাবে। হিন্দুধর্ম ও সমাজের ওপর যেভাবে আঘাত আসছে তা বিবেচনা করলে বলা যায়, এটা হল বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির সমাপ্তি। কিছু নিম্নশ্রেণির হিন্দু থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে শান্ত করতে হলে অতি প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিকেই বিসর্জন দিতে হবে।” তাই বলি, তিনি শুধু ধর্মে-ধর্মে নয়, জাতিতে-জাতিতে, বর্ণে-বর্ণে বিদ্বেষ ছড়িয়ে গেছেন। স্বাধীনতার পরও তার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তথা দ্বিজাতিতত্ত্বজনিত দ্বেষকর কর্মতৎপতার কমতি ছিল না। তিনি হিন্দুদের জাগ্রত করার জন্য ১৯৫১ সালে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করলেন। এই জনসংঘ (যেটা আজকের বিজেপি নামে খ্যাত) ভারতের রাজনীতি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামায় কোন ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল তা এক উন্মুক্ত ইতিহাস।
(২)
জয়া চ্যাটার্জি তার ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গ্রন্থে৫ বাংলার জাগরণের সুফলভােগী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বর্ণহিন্দু বাঙালির ধর্মীয় তথা ভদ্র সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ এবং বাংলা ভাগের নাটকীয় কাহিনিতে এই শ্রেণির বিশেষ ভূমিকা ও বহু বিস্মৃত কীর্তির ধর্মীয় চরিত্র উদঘাটন করেছেন ও একই সঙ্গে এই শ্রেণির কায়েমি স্বার্থের অসংকোচ পরিপােষণার বহু দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করেছেন। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে এই শ্রেণিরা বিশেষত শ্যামাপ্রসাদের মতাে উচ্চবর্ণের মানুষেরা নিজেদের সাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়তাবাদের মােড়কে ঢেকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল এবং বাংলা ভাগের পথকে প্রশস্ত করেছিল। এ প্রসঙ্গে জয়া চ্যাটার্জি মাড়ােয়ারি বণিক সম্প্রদায়ের প্ররােচনার কথা ব্যাখ্যা করেছেন। আর শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন এইসব বণিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলা অখণ্ড থাকলে কলকাতার ওপর অবাঙালি ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র আধিপত্য আর থাকবে না।
বস্তুত বেশ কয়েক বছর ধরেই জি ডি বিড়লা ছিলেন বাংলা ভাগের একজন বলিষ্ঠ সমর্থক। ১৯৪২-র জুলাই মাসে তিনি মহাদেব দেশাইয়ের কাছে বলেছিলেন যে, “আমি বাংলা বিভাগের পক্ষে। আমি মনে করি না যে, এটা অবাস্তব বা বাঙালি হিন্দুদের স্বার্থের বিরুদ্ধে।” কলকাতার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে বাংলা বিভাগ স্পষ্টত আর্থিক দিক থেকে উত্তম বলে মনে হয়। কিন্তু ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত পূর্ব বাংলার দুর্বল বাজার দখলের বিষয়টি কলকাতার ব্যবসায়ীদের কাছে তখন যথেষ্ট লােভনীয় ছিল না। ফলে ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার প্রাক্কালে ভারতীয় বাজারের প্রধান অংশ নিশ্চিতভাবে দখলের লােভনীয় সম্ভাবনার আশা পােষণ করার যথেষ্ট কারণ তাদের ছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সুফল প্রাপ্তির জন্য বাংলাকে অবশ্যই ভাগ করতে হবে। কলকাতার মাড়ােয়ারি সম্প্রদায়ের একথা বিশ্বাস করার কোনও কারণ ছিল না যে, মুসলিম লিগ সরকারের অধীনে তারা ভালাে করবে। বস্তুত বাংলা লিগ, যা ছিল এইচ ইস্পাহানির আর্থিক সমর্থনের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল, স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতার পর মুসলমান ব্যবসায়ীদের উন্নয়নে তারা উদ্যোগ নেবে। অন্যদিকে বাংলায় কংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ওই সরকার হবে মাড়ােয়ারি সম্প্রদায়ের পুতুল সরকার। একমাত্র বাংলা বিভাগের মাধ্যমে কংগ্রেস বাংলায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলােকে ভারতে রাখা সহ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করা হলে কলকাতাকে প্রস্তাবিত হিন্দু প্রদেশে রাখা সম্ভব হবে। এ ধরণের বিভক্তি বড় বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থের অনুকূল বলেই প্রতিভাত হয়। বাংলা ভাগের আন্দোলনে তাই বিড়লা ও তার সম্প্রদায়ের সদস্যরা নিখুঁত ব্যবসায়িক স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
শ্যামাপ্রসাদ এবং হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের কিছু নেতা সভা-সমিতি করে হিন্দুদের বুঝিয়ে চললেন, “বাঙালী হিন্দুর সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভাষা ও ঐতিহ্য গত দশ বছরের শাসনের (মুসলিম লিগের) ফলে ধ্বংস হইতে চলিয়াছে। এই জন্য হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ দাবী তুলিয়াছে। এই স্বতন্ত্র হিন্দু বাংলার সবটাই, দার্জিলিং হইতে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের বিপন্ন হিন্দুদের একটি প্রকান্ড আশ্রয়স্থল হইবে।…স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠনের পর যেমন কতক হিন্দু পূর্ববঙ্গে থাকিয়া যাইবেন। তেমনি সেই সংখ্যার। মুসলমানও পশ্চিমবঙ্গে থাকিয়া যাইবেন। এইরূপ অবস্থায় পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর কোনরূপ অত্যাচার করিবার পূর্বে লিগ গভর্নমেন্টকে যথেষ্ট চিন্তা করিয়া কাজ করিতে হইবে।”৬ শ্যামাপ্রসাদ সরদার প্যাটেলকে এক চিঠিতে লিখলেন, “আমি আশা করি শেষ মুহূর্তে মুসলিম লিগের ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। মি. জিন্না যদি অবস্থার চাপে তা করতে বাধ্যও হয়, অনুগ্রহ করে বাংলাকে বিভক্ত করার ব্যাপারটা ব্যর্থ হতে দেবেন না। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় যেরকম ভাবা হয়েছে সেরকম একটা শিথিল কেন্দ্রীয় সরকার স্থাপিত হলে বাংলায় আমাদের কোনওরকম নিরাপত্তা থাকবে না। পাকিস্তান হােক বা না হােক, আমরা বাংলার বর্তমান সীমানার মধ্যে দুটি প্রদেশ গঠন করার দাবি করছি।”৭ ভারতভাগ অনিবার্য না হলেও যে বাংলা ভাগের দাবি অনিবার্যভাবে উত্থাপিত হত শ্যামাপ্রসাদের এই বক্তব্য থেকে তা-ই প্রমাণিত হয়।
এর পূর্বে হােসেন শহিদ সােহরাওয়ার্দি বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাবের বিরােধিতা করে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে, বাংলা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান থেকে পৃথক থাকবে। বাংলাকে বিভক্ত করার প্রস্তাব বাঙালির আত্মহত্যারই শামিল। বাঙালির উচিত হবে এক অখণ্ড ও অবিভক্ত, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলা গঠন। ১৯৪৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর সঙ্গে এবং ৮ সেপ্টেম্বর লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করে সােহরাওয়ার্দি একটি বিবৃতিতে নেহরু ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের কাছে আবেদন জানান, কংগ্রেস সাড়া দিলে জিন্নাহ তার দাবির অনেক কমে রাজি হতে প্রস্তুত আছেন।৮ কিন্তু কংগ্রেস আগেও সাড়া দেয়নি, তখনও দিল না। যখন সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেস ও লিগ কোনাে বােঝাপড়ায় এল না তখন সােহরাওয়ার্দি চেয়েছিলেন হিন্দুদের মনে আস্থা সৃষ্টির জন্য বাংলায় লিগ ও কংগ্রেস একসাথে কাজ করুক। তার ধারণা হয়েছিল, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের রাজনীতির বিকাশের উপর নির্ভর করছিল বাংলার সমস্যাগুলির সমাধান।
আবুল হাশিম, যিনি ১৯৪৩-এর শেষের দিকে বাংলা প্রাদেশিক লিগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, তিনি শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে বাংলাকে অখণ্ড রাখার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছে ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল একটি বিবৃতি প্রদান করেন। কলকাতার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় উক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে বাংলার অখণ্ড সংস্কৃতি ও সত্ত্বার কথা তুলে ধরে বাংলার বিভক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য জনগণকে আবেদন জানান। আবুল হাশিম বলেন, “বর্তমানে বাংলা এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে একটি পথ স্বাধীনতা ও গৌরবের দিকে ধাবিত, আর একটি পথ স্থায়ী দাসত্ব ও অপমানের নির্দেশক। সুতরাং বাংলাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি বর্তমানে সুযােগ হারিয়ে যায়, তাহলে তা আর কখনই আসবে না।” হিন্দু-মুসলিম উভয়ের স্বার্থে সার্বভৌম ও ঐক্যবদ্ধ বাংলা গঠনের ওপর তিনি গুরুত্বারােপ করে বলেন : “শতকরা একশাে ভাগ ভারতীয় এবং ইঙ্গ-মার্কিন বিদেশী পুঁজি বাংলাকে শােষণ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়ােগে করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সমাজতান্ত্রিক প্রবণতা বিদেশী শােষকদের চিত্তে দখলিচ্যুত হওয়ার ভীতি সৃষ্টি করেছে। তাদের এ বিচক্ষণতা আছে যার দ্বারা তারা স্বাধীন ও অবিভক্ত বাংলায় তাদের অসুবিধার কথা উপলব্ধি করতে পারছে। বিদেশী পুঁজির স্বার্থে বাংলাকে বিভক্ত, পঙ্গু এবং নিষ্প্রভ করার প্রয়ােজন রয়েছে যাতে করে শােষণকে প্রতিহত করার কোনাে ক্ষমতা বাংলার কোনাে অংশেরই অবশিষ্ট না থাকে।..খুব উচ্চগুণসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাবে দেশ হীন স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা নিদারুণভাবে নির্যাতিত ও শােষিত হচ্ছে। বাংলার যুবক হিন্দু ও মুসলমানদের উচিত একতা বজায় রেখে নিজেদের দেশকে বৈদেশিক প্রভাবের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বাংলার বিলুপ্ত মর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং ভারতের ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ জাতিসমূহের কাছে সম্মানের আসন লাভের প্রচেষ্টা করা।”৯
আবুল হাশিম চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর কথা উল্লেখ করে এটাও বললেন যে, ‘Let the Hindus and Muslims agree to CR Das’s formula of 50:50 enjoyment of political power and economic privileges, I appeal to the youths of Bengal in the name of her past traditions and glorious future to unite.’ তিনি এও বলেছেন যে, ১৯৪৬-এর নভেম্বরের প্রথমে গান্ধী নােয়াখালিতে যাবার পথে তার সঙ্গে তারা সােহরাওয়ার্দির বাড়িতে এ সম্পর্কে আলােচনার জন্য বসেছিলেন। মহাত্মা তাদের বলেন, সংযুক্ত মন্ত্রীসভার প্রতি আমার কোনাে মােহ নেই। আমি এক পার্টির সরকারে বিশ্বাসী। তাই আমি বাংলায় সংযুক্ত মন্ত্রীসভা হােক তা চাইনা।১০ তারা তা কখনােই চাননি, বরাবর বাধাই দিয়েছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মতাে বিড়লা প্রমুখ বড় মুৎসুদ্দিরাও বাংলায় হিন্দু-মুসলমান ঐক্য চাননি। কলকাতা, নােয়াখালি এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ভয়াবহ দাঙ্গা যখন হচ্ছে তখনও তারা সেই নীতিতে অবিচল থাকলেন।
নীরদ সি চৌধুরী (যিনি এই সময়ে শরৎচন্দ্র বসুর ব্যক্তিগত সচিবের কাজ করতেন এবং সুভাষকেও চিঠিপত্রের ব্যাপারে সাহায্য করতেন) লিখেছেন, “বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যাতে ঐক্য গড়ে উঠতে পারে সেটাই ছিল বিড়লার মুখ্য উদ্দেশ্য। আমি নিঃসন্দেহে, মুসলিম মন্ত্রীসভাকে সমর্থনের নাম করে বিড়লা চেয়েছিল বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সহযােগিতার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেওয়া। ইংরেজদের কৌশলই মারােয়াড়ীরা গ্রহণ করেছিল।”১১ অন্যত্র নীরদ চৌধুরী বলেছেন, সুভাষের মনে হয়েছিল যে, বিড়লা হস্তক্ষেপ করছেন। বিড়লার কাছে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বা বাংলায় সংযুক্ত মন্ত্রিসভা আশঙ্কার হেতু ছিল, কারণ তা কলকাতার মাড়ােয়ারিদের অর্থনৈতিক আধিপত্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হত। নীরদ চৌধুরীর মতে, গান্ধী সচেতনভাবে মারােয়াড়ীদের স্বার্থে কাজ করছিলেন।১২
১৯৪৭-এর ২৬ এপ্রিল মাউন্টব্যাটেন যখন জিন্নাহকে সােহরাওয়ার্দির স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ বাংলার কথা বললেন তখন জিন্নাহ একটুও ইতঃস্তত না করে বলেছিলেন, “আমি আনন্দিত হব…তারা ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন থাকুক সেটাই ভালাে হবে।” ১৯৪৭-এর ২৮ এপ্রিল মাউন্টব্যাটেনের প্রধান সচিব মিয়েভিলএর আলােচনার সময় লিগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলি খানও বলেছিলেন, “বাংলা কখনও বিভক্ত হবে না এই তার বিশ্বাস, তাই তিনি বাংলা নিয়ে উদ্বিগ্ন নন। তিনি মনে করেন যে, বাংলা হিন্দুস্থানে বা পাকিস্তানে যােগদান করবে না এবং পৃথক রাষ্ট্র থাকবে।” জিন্নাহ ও লিয়াকত তাদের এই সম্মতি বারবার জানিয়েছেন।১৩
১৯০৫ সালে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ রদের জন্য কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে সারা বাংলায় যেভাবে হিংসা ও সন্ত্রাসের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, ১৯৪৭ সালেও তেমনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করার দাবিতে বাংলায় এবং উত্তর ভারতে প্রচণ্ড আকারে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে ২৩ এপ্রিল ১৯৪৭ জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেনের মধ্যে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের প্রস্তাব নিয়ে আলােচনা হয়। মাউন্টব্যাটেন স্বীকার করলেন যে, বাংলায় যদিও ভাগ বন্ধ হতে পারে কিন্তু পাঞ্জাবে শিখ ও মুসলমানরা আলােচনায় বসতেও রাজি নয়। বাংলায় এটা সম্ভব হতে পারে একটি শর্তে যে, বাংলা পাকিস্তান বা ভারতে যােগ দেবে না। সে কথার উত্তরে জিন্নাহমাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন যে, তিনি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলাকে স্বাগত জানাবেন। কারণ কলকাতা না পেলে বাংলাদেশের বাকি অংশ নিয়ে কি লাভ হবে? এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক স্ট্যানলি ওলপার্ট লিখেছেন, “..একই আলােচনার সময় (১৯৪৭-র এপ্রিলের শেষে) ভাইসরয় জিন্নাহকে জানালেন যে, সােহরাওয়ার্দী আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই শর্তে তিনি বাংলাকে অবিভক্ত রাখতে পারবেন যে বাংলা পাকিস্তান কিংবা হিন্দুস্তান কোন পক্ষেই যােগদান করবে না। আমি জিন্নাহকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, পাকিস্তানের বাইরে থাকার ক্ষতি বিবেচনায় রেখে ‘অখণ্ড স্বাধীন বাংলা’ গঠন সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি নিঃসংকোচে জবাব দিলেন, বাংলা স্বাধীন হলে আমি খুশি হব। কলকাতা ছাড়া বাংলার কোনাে মূল্য নেই। তারা (বাঙালিরা) যদি একত্র থাকে এবং অখণ্ড বাংলা গঠন করে, তাহলে তাদের ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল হবে। আমি নিশ্চিত তারা পাকিস্তানের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবে। আমি আরও উল্লেখ করলাম যে, ‘সােহরাওয়ার্দী বলেছেন। বাংলা স্বাধীন এবং অখণ্ড পৃথক দেশ হিসেবে কমনওয়েলথের ভেতর থাকতে চায়।’ জিন্নাহ জবাব দিলেন, “নিশ্চয়, আমিও আপনার কাছে ব্যক্ত করেছি যে পাকিস্তানও কমলনওয়েলথের ভেতর থাকতে চায়।’ মাউন্টব্যাটেন তাকে সংশােধন করে বললেন, না, আপনি আমাকে বলেছেন পাকিস্তান স্বাধীন হলে তারা কমনওয়েলথের সদস্য পদ লাভের জন্যে আবেদন করবে। জিন্নাহমাউন্টব্যাটেনকে সংশােধন করে বললেন, ‘আপনি সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছেন, আমরা সদস্য হবার প্রশ্ন তুলছি না, আমরা জানতে চাই আপনারা কি আমাদের কমনওয়েলথ থেকে বের করে দেবেন?’ চার্চিল আমাকে বলেছেন এই ব্যাপারে আমি যেন শক্ত হই এবং দাবি করি আমাদের কমনওয়েলথ থেকে যেন তাড়ানাে না হয়। আমরা যদি তাই করি তাহলে আমাদের কেউ তাড়াতে পারবে না। ব্রিটেন রাজভক্ত সদস্যদের তাড়াতে সাহস করবে না।”১৪
‘অখণ্ড স্বাধীন বাংলা’ গঠন সম্পর্কে জিন্নাহর এই কথাগুলাের মধ্য দিয়ে বাংলা সম্পর্কে জিন্নাহর চিন্তাধারার সুন্দর, সরল ও সহজ অভিব্যক্তি ঘটেছে। তার এই চিন্তাধারা সম্পর্কে ওলপার্ট লিখেছেন: “বাংলা এক অবিভক্ত, অখণ্ড দেশ হিসেবে থাকবে—এ কথা জিন্নাহবিশ্বাস করেছিলেন। এই ব্যাপারে তার সহকর্মী লিয়াকত আলি খানও জিন্নাহর সাথে একমত পােষণ করতেন। লিয়াকত আলি খান ভাইসরয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি স্যার এরিক মিয়েভিলকে বলেছিলেন যে, তিনি বাংলা ভাগ নিয়ে কোনও চিন্তা-ভাবনা করেন না। কারণ তিনি জানেন বাংলাকে ভাগ করা হবে না, বাংলা পাকিস্তান অথবা হিন্দুস্তান কোনও পক্ষেই যােগদান করবে না, হয়তাে বাংলা এক পৃথক দেশ হবে। লিয়াকত মিয়াভিলের কাছে শিখস্তানের পাকিস্তানে যােগদানের সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং সেক্ষেত্রে মুসলিম লিগ তাদেরকে অত্যন্ত উদার শর্ত প্রদান করবে বলেও জানান। জিন্নাহ পাতিয়ালার মহারাজা ও বলদেব সিং সহ শিখ নেতাদের সাথে বেশ কয়েকটি গােপন বৈঠকে মিলিত হন এবং তাদেরকে পাকিস্তানে যােগদানের জন্য প্রবৃত্ত করেন। অপরদিকে নেহরু এবং প্যাটেল তার চেয়েও বেশি সুবিধাদান করেন এবং সেই সাথে নেহরুর মন্ত্রীসভায় বলদেবকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বহাল রাখার মাধ্যমে মাস্টার তারা সিং সহ বলদেব ও তার দলকে ভারতের প্রতি অনুগত রাখতে সক্ষম হন। সুতরাং জিন্নাহ সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, বাংলা এবং পাঞ্জাবের সর্বনাশা বিভক্তিকে রােধ করে অখণ্ডতা বজায় রাখতে পারবেন এবং একই সাথে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলােকে ভারতীয় ইউনিয়নের কবল থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হবেন এবং বাংলাদেশ হবে পূর্বাঞ্চলীয় এক স্বাধীন অখণ্ড দেশ।”১৫ কিন্তু জিন্নাহর এ বিশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ ভারতের কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মতাে সংগঠনগুলাে এবং বাংলার হিন্দু এলিটরা তা হতে দেয়নি। কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বরাবর বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। পাকিস্তান হােক আর না হােক, তবু বাংলাকে ভাগ করতে হবে—এই ছিল তাদের দাবি। তারা চেয়েছিলেন, বাংলাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্ত দিক থেকে পঙ্গু করতে। বিড়লা প্রমুখ মাড়ােয়ারি বড় বড় মুৎসুদ্দিদের ঘাঁটি কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গকে তারা কখনাে হাতছাড়া করতে প্রস্তুত ছিলেন না।
(৩)
স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা সম্পর্কে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতাদের মধ্যে ১৯৪৭ সালের মে মাসে নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হত শরৎচন্দ্র বসুর বাসভবন ১নং উডবার্ণ পার্কে। এইসব আলােচনা শুরু হওয়ার সময় শরৎ বসু মুসলিম লিগ ওয়ার্কিং কমিটির বিবেচনার জন্য নিম্নলিখিত প্রস্তাব উপস্থিত করেন :
- In Bengal, a Sovereign, Socialist, Democratic, State must be set up.
- Joint electorate and adult franchise would be the basis of this new state.
- If the above two conditions were accepted, then for the interim period the present Cabinet would be dissolved and a new Cabinet formed.
- The proposed new Cabinet for the interim period would be com posed of 4 Hindus and 4 Muslims. In addition to them the Chief Minister would be a Muslim but the Home Minister must be a Hindu.
- No controversial Legislation to be introduce during the interim period.
- State Services would be distributed between the Hindus and the Muslims on a 50 : 50 basis.
- British Government to transfer power to this new Cabinet.
- After transfer of Powers by the British Government–the new Cabi net, in proper time, to set up a Constituent Assembly on the basis of Joint Electorate.
- After the formation of the New Sovereign Bengal State by the Constituent Assembly, Sovereign Bengal would have the option to join any fedaration of its free choice.
এই প্রস্তাব আলােচিত হওয়ার সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগ কাউন্সিলের একটি অধিবেশন ১৯৪৭ সালের ১৭ মে অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশন কংগ্রেসের সঙ্গে আলােচনার সময় মুসলিম লিগ সাব-কমিটির উপর যে শর্ত আরােপ করেন তা হল এই যে, অখণ্ড বাংলা ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকতে পারবে না। মুসলিম লিগ ভারত বিভক্তির সময় হিন্দুস্থান, পাকিস্তান এবং অখণ্ড বাংলা এইতিন অংশে দেশ বিভক্ত হওয়াকে স্বীকার করে নেবে কিন্তু বাংলা ভারতীয় ইউনিয়নে যােগদান করতে পারবে না। আলােচনা শেষ হয় ১৯ মে।
অবশেষে কংগ্রেস ও লিগের পক্ষে শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশিম ১৯৪৭-র ২০ মে শরৎচন্দ্র বসুর বাসভবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন, সার্বভৌম ও অখণ্ড বাংলা গঠন করা। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন: তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দি, ফজলুর রহমান (মন্ত্রী), মােহাম্মদ আলি (মন্ত্রী), আবুল হাশিম, আবদুল মালেক (এম.এল.এ.), কিরণশংকর রায়, সত্যরঞ্জন বক্সী ও শরৎচন্দ্র বসু। উক্ত বৈঠকে উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে শরৎচন্দ্র বসু এবং আবুল হাশিম যে সাময়িক চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন সেটি হল:
১. বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হইবে এবং ভারতের অন্যান্য অংশের সহিত তাহার কি সম্পর্ক হইবে তাহা এই স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রই স্থির করিবে।
২. স্বাধীন বঙ্গ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে বাংলার আইন পরিষদের নির্বাচন সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হইবে। হিন্দু ও মুসলমানদের সংখ্যানুপাতে সংরক্ষিত আসন সহ যুক্ত নির্বাচন ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতেই পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হইবে। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতে আইন পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হইবে। হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলি বর্ণ-হিন্দু ও তফসিলী হিন্দুদের মধ্যে সংখ্যানুপাতে অথবা তাহারা উভয়ে মিলিয়া যে পন্থা স্থির করিবেন। সেই পন্থা অনুযায়ী ভাগ করা হইবে। একই নির্বাচন কেন্দ্রে একাধিক সদস্যের আসনের ব্যবস্থা থাকিবে। কিন্তু ভােটদাতা ভােট দেওয়ার বেলায় একজনকেই সমস্ত ভােট না দিয়া ভােটগুলি ভাগ করিয়া দিবেন। নির্বাচনে যে প্রার্থী তাহার নিজ সম্প্রদায়ের সর্বাপেক্ষা বেশি ভােট পাইবেন এবং অন্য সম্প্রদায়ের প্রদত্ত ভােটের শতকরা ২৫টি পাইবেন, তিনিই নির্বাচিত হইবেন। কোনাে প্রার্থী যদি এইসব শর্ত পূরণ করিতে না পারেন, তাহা হইলে যিনি নিজ সম্প্রদায়ের সর্বাপেক্ষা বেশি ভােট পাইবেন তিনিই নির্বাচিত হইবেন।
৩. ব্রিটিশ সরকার স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের এই পরিকল্পনা গ্রহণ করিলে এবং বাংলাদেশকে বিভক্ত করা হইবে না বলিয়া ঘােষণা করিলেই বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভাঙিয়া দেওয়া হইবে এবং তস্থলে একটি নূতন মধ্যকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে। এই মধ্যকালীন মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী বাদে হিন্দু (তফসিলি হিন্দু সহ) ও মুসলমান সমান সমান আসন পাইবে। এই মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিন্দু হইবেন।
৪. স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের নূতন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী আইনসভা ও মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত হিন্দু (তফসিলি সহ) ও মুসলমানগণের চাকুরীতে সমান অংশ থাকিবে। মিলিটারী এবং পুলিশ বিভাগের জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে। সমস্ত চাকুরীতে কেবলমাত্র বাঙ্গালীদিগকে নিয়ােগ করা হইবে।
৫. বাংলার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনার জন্য যে গণপরিষদ গঠিত হইবে, সেই গণপরিষদে মােট ৩০ জন সদস্য নির্বাচিত হইবেন। তন্মধ্যে ১৬ জন হইবেন মুসলমান সদস্য ও ১৪ জন হইবেন হিন্দু সদস্য। বর্তমান আইনসভার হিন্দু ও মুসলমান সদস্যগণই উক্ত গণপরিষদের সদস্য নির্বাচন করিবেন। গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচনকালে বর্তমান আইনসভার ইউরােপীয় সদস্যদের কোনাে ভােটাধিকার থাকিবে না।”১৬
উপরােক্ত দলিল কংগ্রেস ও লিগ সংগঠনের হাইকমান্ডের নিকট পেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ২৩ মে এ বিষয়ে শরৎচন্দ্র বসু গান্ধীকে দেবেন দে’র হাতে পাটনায় একটি পত্র পাঠান। তাতে শরৎচন্দ্র বসু লেখেন, “আপনার কলকাতা থেকে চলে যাবার পর আমি অনেকগুলি বৈঠক আহ্বান করি যেগুলিতে মুসলিম লিগের কতিপয় নেতা এবং কিরণ ও সত্যবাবু যােগদান করেছিলেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় (২০ মে) আমার বাসভবনে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত সম্মেলনে সােহরাওয়ার্দি, ফজলুর রহমান (মন্ত্রী), মােহাম্মদ আলি (মন্ত্রী), আবুল হাশিম (বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সম্পাদক, বর্তমানে ছুটিতে রয়েছেন), আবদুল মালেক (বঙ্গীয় আইনসভায় শ্রমিকদের প্রতিনিধি সদস্য), কিরণ ও সত্যবাবু যােগদান করেন। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে এ চুক্তিতে উপনীত হয়েছি এবং আপনার বিবেচনার জন্য তার একটি কপি সংযােজিত করা হলাে। সনাক্তকরণের জন্য সেটি অন্য সকলের উপস্থিতিতে আবুল হাশিম ও আমার দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটা অবশ্যই কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ সংগঠনের সামনে উপস্থিত করতে হবে। আমাদের যে আলােচনা হয়েছিল তার ধারা থেকে আমার মনে হয় যে, বাংলার কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের কথা যদি ধরা যায় তাহলে সাময়িক চুক্তিটি এখানে-সেখানে কিছু রদবদল করে তাদের দ্বারা অনুমােদিত হবে। সাময়িক চুক্তিটিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্য আপনার নির্দেশ, সাহায্য ও উপদেশ এবং প্রতিক্রিয়ার বিষয় জানার জন্য আমি খুবই উদ্বিগ্ন রয়েছি। সােদপুরে আপনাকে যা বলেছি তার পুনরুক্তির প্রয়ােজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমার আরও মনে হয়, আপনার সাহায্য, উপদেশ ও নির্দেশ অনুসারে সাময়িক চুক্তিটির লাইন অনুযায়ী যদি একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে উপনীত হতে পারি তাহলে আমরা বাংলার এবং সেই সঙ্গে আসামেরও সমস্যার সমাধান করতে পারব। ভারতের অপরাপর অঞ্চলের উপরও এর সুস্থ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আপনি যদি চান দিল্লীতে গিয়ে এ বিষয়ে আরও আলাপ-আলােচনা আপনার সাথে করি। আমার বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, আপনার বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি গিয়ে উপস্থিত হব। পরিস্থিতি খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে এবং আমার কথা বলতে গেলে, আমার মনে হয় আপনার সাথে আরও আলাপ-আলােচনার বিশেষ প্রয়ােজন রয়েছে।”
সাময়িক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সমগ্র দেশে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। শরৎ বসু গান্ধীকে যেদিন পত্র লেখেন সেই দিনই অর্থাৎ ২৩ মে ১৯৪৭ তিনি কলকাতায় এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে চুক্তিটির শর্তাবলী সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “I want to impress upon the public of Bengal and of the rest of India that the cure of communalism is not communalism…. The Solution I have offered is the creation of Socialist Republics-call them free States, if you will… By the word “free’I mean freedom not only from political bondage but also freedom from social and Economic servitude… It is true that our political vision has been clouded for the moment but I have every hope that our political workers, both Hindus and Muslims, will seize the present opportunity and combine to open a new chapter in the history of Bengal and eventually in the history of India itself.”
২৩ মে ১৯৪৭ ‘জীবন, না মৃত্যু’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তেও উপরােক্ত সাময়িক চুক্তিটির পূর্ণ বিবরণ দেওয়ার পর তাতে বলা হয়, “মােটামুটিভাবে উপরােক্ত শর্তগুলি আলােচনা করিলে দ্বিধাহীন চিত্তে বলা চলে যে, যেসব মূলনীতির স্বীকৃতির উপর হিন্দু ও মুসলমানের আপােসে মীমাংসা সম্ভব সেইসব মূলনীতি সর্বতােভাবে এই শর্তগুলিতে স্বীকৃত হইয়াছে। একদিকে সর্বধ্বংসী দাঙ্গা ও সর্বনাশা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আওয়াজে বাংলার আকাশ বাতাস বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে। তার অপরদিকে এই শর্তগুলিতে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্রে সুখ, শান্তি ও সৌহার্দ্যের সহিত বসবাসের প্রতিশ্রুতি, বাঙ্গালী হিন্দু ও মুসলমানের ন্যায্য অধিকার দাবীর স্বীকৃতি সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান ইহাদের মধ্যে কোনটি বাছিয়া লইবে? মৃত্যু না জীবন, অভিশাপ না আশীর্বাদ, বেহেস্ত না দোজখ— কি তাহারা বাছিয়া লইবেন? অতি সত্বর মন স্থির করুন। কারণ আগামী ২ জুন বৃটিশ সরকার তাহাদের ঘােষণা প্রচার করিবেন। সুতরাং আর অপেক্ষার সময় নাই। ২ জুনের পূর্বেই বাঙ্গালী হিন্দু ও মুসলমানকে এই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছিতে হইবে এবং বাংলার প্রতিটি গৃহ হইতে তাহাদের সেই সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করিতে হইবে।”
কোনাে কোনাে মহল থেকে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করা হয়। আবার কোনাে কোনাে মহল পুরােপুরি এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ এই সাময়িক প্রস্তাবের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার ভূত খুঁজে পেলেন এবং এর তীব্র সমালােচনা করে বললেন, ‘Sovereign Bengal is sugar-coated alternative to Pakistan.’ লিগের তরফে সভাপতি আকরাম খান প্রস্তাবটির বিরােধী ছিলেন। স্বাধীন অখন্ড বাংলা গঠনের বিশদ বিবরণের জন্য অমলেন্দু দে রচিত ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা’১৭ খুব মূল্যবান ইতিহাস-গ্রন্থ। সাম্প্রদায়িক হিন্দু ও সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের সঙ্গে গান্ধীবাদী নেতারাও একই সুরে একই ভাষায় কথা বলা শুরু করলে নেহরু বিরক্ত ও হতাশ হয়ে ভাইসরয়কে বললেন, ‘The Cabinet Mission Plan was the best solution of it cluld be carried through-the only real alternative was the partition of Punjab and Bengal.’
(৪)
বাংলা ভাগের নামে যে বিপুল বিরাট নরমেধের আয়ােজন হয়েছিল সেদিন, বিড়লা-প্যাটেলদের অনুগামী হয়ে এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে শ্যামাপ্রসাদ সেই যজ্ঞে বেশ ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। এবার সে প্রসঙ্গে আসছি।
১৯৪৭ সালের ৩০ এপ্রিল কলকাতায় বেঙ্গল ন্যাশানাল চেম্বার অফ কমার্সের প্রভাবশালী শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের একত্রিত করে আর এস এস, হিন্দু মহাসভা পর্দার আড়াল থেকে ৪ঠা মে-র সভার জন্য কলকাঠি নাড়ে। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন ডি সি ড্রাইভার। বাংলা ভাগের পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করেন এন আর সরকার। বাংলা ভাগের দাবিকে বাস্তবায়িত করতে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী ক্ষমতালােভীগােষ্ঠীর মদতে এই সভা থেকে ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের নিয়ে একটি কমিটি হয়। এই কমিটিতে ছিলেন ডি এল সেন, ডি সি ড্রাইভার, বি এম বিড়লা, বি এল জালান, জে কে মিত্র, বদ্রিদাস গােয়েঙ্কা, এম এল শাহ, এস সি শাহ, এন আর সরকার, এস বি দত্ত প্রমুখ।১৮ অখণ্ড বাংলা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাংলা ভাগের সমর্থনে যৌথ বিবৃতি দেন শ্যামাপ্রসাদ এবং তৎকালীন প্রাদেশিক কংগ্রেস সভাপতি সুরেন্দ্রমােহন ঘােষ।১৯ এ বিষয়ে সংবাদপত্রে লেখা হয়: “Mr. Surendra Mohan Ghose, President of Bengal Provincial Congress Committee, commenting on the recent statement issued from Delhi by Mr. Suhrawardy opposing the partition of Bengal, says that over and above the ghost of Communalism, he (Mr. Suhrawardy) has evoked the ghost of provincialism and has added a note of threat at the end of his statement. This is not the way to present partition. An undivided Bengal in a divided india is an impossibility. Let Mr. Suhrawarday repudiate the two nation theory and abandon Communalism, and he will be able to prevent the partition of Bengal…”
আর এস এস-এর নির্দেশে শ্যামাপ্রসাদ তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া লর্ড লিস্টওয়েলকে একটি তারবার্তা পাঠিয়ে বলেন, যদি ভারত বিভক্ত হয় তা হলে বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলকেও বিভক্ত করতে হবে। আর পশ্চিমবঙ্গে একটি পৃথক প্রদেশ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত অনতিবিলম্বে বর্তমান মন্ত্রিসভাকে ভেঙে দিতে হবে। এই মুহুর্তেই পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে দুটো আঞ্চলিক মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে।২০
এই বাংলা ভাগের ইস্যুতে কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতৃত্বের গরিষ্ঠ অংশ এবং আর এস এস ও হিন্দু মহাসভা কেবলমাত্র অন্নদাশঙ্কর রায় ছাড়া সমস্ত অকমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদেরই প্রভাবিত করে ফেলেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে শ্যামাপ্রসাদ যে জনসভার আয়ােজন করেন। সেখানে বক্তা হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন। এই জনসভার একটি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় দিল্লি থেকে অনেক দূরে বাংলার কোচবিহার শহরে। শ্রী সেনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে সেখানে একটি জনসভা করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক তথা সুরেন্দ্রনাথ সেনেরই সহপাঠী অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ রায়, তাকে সেই জনসভার সাহায্য করেছিলেন তার ছাত্র পরবর্তীকালের প্রখ্যাত সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদার এবং অধ্যাপক রায়ের শ্যালক-পুত্র তৎকালীন বামপন্থী কর্মী অরুণ মৈত্র, পরবর্তীকালে অরুণবাবু অবশ্য কংগ্রেসে যােগদান করেন। ৭০-এর দশকে তিনি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিও হয়েছিলেন। বাংলা ভাগের দাবিতে আর এক সহপাঠী প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার সােচ্চার হয়ে ওঠেন। ৭ মে রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার যদুনাথ সরকার, মেঘনাথ সাহা, শিশির মিত্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লিস্টওয়েলের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে বলেন, কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করা প্রয়ােজন: “… Education, trade and industry in Bengal have almost collapsed owing to recurrent riots causing in security of life and property. The present Communal ministry is totally incapable of maintaining law and order. We strongly support the immediate formation of a separate West Bengal Province guarnteeing under a non-communal ministry. Safety of life and unhindered progress in education, industry and commerce, with the continuance and development of Calcutta a vital part of West Bengal, as a moral, intellectual social and economic centre.” এই টেলিগ্রামের প্রতিলিপি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং স্যার জন অ্যাণ্ডারসনকেও পাঠানাে হয়।২১
দেশভাগের সমর্থনে বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে সমবেত করার কাজে শ্যামাপ্রসাদের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। তাঁর উপাচার্য পদের প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের পরেও তিনি ব্যবহার করেছিলেন। উনিশ শতকের নবজাগরণের পর্বের কথা ধরা যাক। এই সময়কালের ইতিহাস লিখতে গিয়ে যদুনাথ সরকার ব্রিটিশ শাসনের প্রশংসার পাশাপাশি আধুনিক বাংলার ইতিহাসে মুসলমানদের অবদানকে কেবল তিনি অস্বীকারই করেননি, নেতিবাচকভাবেই আধুনিক বাংলা গঠনে মুসলমানদের অবদানকে তিনি দেখিয়েছিলেন। বিস্ময়ের বিষয় এই যে, পলাশির ষড়যন্ত্র ও তার জন্য ভারতের তথা বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার ঘটনাকে যদুনাথ সরকার সংকীর্ণ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ২৩ জুন ১৭৫৭-তে বাংলার বুকে পলাশির প্রান্তরে ঘটেছিল নবযুগের সূচনা। এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হয় না। পরাধীনতার সূচনাক্ষণকে বাংলা তথা ভারতের নব যুগের সূচনা বললে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরণীয় ঐতিহ্যকেই অপমান করা হয়। যদুনাথ সরকার বােধহয় যুক্তির চেয়ে আবেগের দ্বারাই বেশী প্রভাবিত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, ‘বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডে’ পরিণত হতে বাংলা তথা ভারতকে বহু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। কবি নবীনচন্দ্র সেন মনে করেন পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। কেবল নবীনচন্দ্র নন, বেশীরভাগ ব্যক্তি একথা মনে করেন। তাঁরা আরও মনে করেন যে, এই যুদ্ধের ফলে বাংলার জীবনে এক ঘােরতর দুর্দিন নেমে আসে।
নবাব মীরজাফর হলেন ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতে ক্রীড়নক। ক্লাইভ তথা কোম্পানি পেল বিপুল অর্থ এবং বাংলায় বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিকার। পরে মিরজাফর কোম্পানির দাবি মেটাতে না পেরে সরে যেতে বাধ্য হলেন। মীরকাশিমকে নবাব করল, তারপর তার সঙ্গেও বিবাদ। মীরকাশিম অযােধ্যার নবাব ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আমলের সাহায্য নিয়েও কোম্পানির বিরুদ্ধে বক্সারের যুদ্ধে ১৭৬৪-তে যখন হেরে গেলেন, তখন কোম্পানির ক্ষমতা আরও বাড়লাে। ইতিমধ্যে অবশ্য কোম্পানি মীরকাশিমকে সরিয়ে আবার মীরজাফরকে গদিতে বসিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৭৬৫তে কোম্পানির তরফে লর্ড ক্লাইভ যখন মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা সুবার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায় ও বিলি বন্দোবস্তের ভার পেল তখন দেশের সূর্য সত্যি অস্ত গেল। ঔপনিবেশিকতার ভিত পাকা হয়ে গেল।
কোম্পানিরই এক কারিগর লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৯-তে নিজেই স্বীকার করেছিলেন : ‘I may safely assert that one-third of the Company’s territory in Hindusthan is now a jungle inhabited by wild beasts.’ এই জঙ্গলের রাজত্বে কোথায়ই বা আধুনিকতা, কোথায় বা উন্নয়নশীল সংস্কার? পলাশির যুদ্ধের আগে ইংরেজদের বাণিজ্যের চুয়াত্তর শতাংশ অর্থ আসতাে ইংল্যাণ্ড থেকে আমদানিকৃত ও রৌপ্যপিণ্ডের সাহায্যে। পলাশি পরবর্তী যুগে সােনা-রূপা আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ তাে হলই, বরং এদেশে থেকে প্রাপ্ত টাকায় ব্যবসা চালিয়ে, মাইনে দিয়ে, মুনাফা স্বদেশে পাঠিয়ে, সােনা-রূপা পর্যন্ত চীনে রপ্তানি শুরু হল। ওই ঔপনিবেশিক শাসনের স্বরূপ সম্পর্কে ১৮৫৩-র ২৫ জুন ‘ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে কার্ল মার্কস লিখলেন যে, ভারতে কোম্পানির শাসন হল: ‘European despotism, planted upon Asiatic despotism, by the British East India Company, forming a more monstrous combination than any of the divine monsters startling us in the temple of Salsetti.’ বাংলা থেকে অপরিমিত ধন সম্পদ লুঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন লাভবান হয়, অপরদিকে তেমনি ক্লাইভ ও অনান্য কর্মচারীরা রাতারাতি প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে নবাবী কায়দায় জীবন যাপন করতে থাকেন। কিন্তু এর মাসুল গুনতে হয় বাংলার জনগণকে। সারাদেশ জুড়ে এক নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক সংকট বাংলার জীবনকে দুর্বিসহ গঠনে মুসলমানদের অবদানকে তিনি দেখিয়েছিলেন। বিস্ময়ের বিষয় এই যে, পলাশির ষড়যন্ত্র ও তার জন্য ভারতের তথা বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার ঘটনাকে যদুনাথ সরকার সংকীর্ণ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ২৩ জুন ১৭৫৭-তে বাংলার বুকে পলাশির প্রান্তরে ঘটেছিল নবযুগের সূচনা। এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হয় না। পরাধীনতার সূচনাক্ষণকে বাংলা তথা ভারতের নব যুগের সূচনা বললে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরণীয় ঐতিহ্যকেই অপমান করা হয়। যদুনাথ সরকার বােধহয় যুক্তির চেয়ে আবেগের দ্বারাই বেশী প্রভাবিত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, ‘বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডে’ পরিণত হতে বাংলা তথা ভারতকে বহু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। কবি নবীনচন্দ্র সেন মনে করেন পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। কেবল নবীনচন্দ্র নন, বেশীরভাগ ব্যক্তি একথা মনে করেন। তাঁরা আরও মনে করেন যে, এই যুদ্ধের ফলে বাংলার জীবনে এক ঘােরতর দুর্দিন নেমে আসে।
নবাব মীরজাফর হলেন ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতে ক্রীড়নক। ক্লাইভ তথা কোম্পানি পেল বিপুল অর্থ এবং বাংলায় বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিকার। পরে মিরজাফর কোম্পানির দাবি মেটাতে না পেরে সরে যেতে বাধ্য হলেন। মীরকাশিমকে নবাব করল, তারপর তার সঙ্গেও বিবাদ। মীরকাশিম অযােধ্যার নবাব ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আমলের সাহায্য নিয়েও কোম্পানির বিরুদ্ধে বক্সারের যুদ্ধে ১৭৬৪-তে যখন হেরে গেলেন, তখন কোম্পানির ক্ষমতা আরও বাড়লাে। ইতিমধ্যে অবশ্য কোম্পানি মীরকাশিমকে সরিয়ে আবার মীরজাফরকে গদিতে বসিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৭৬৫তে কোম্পানির তরফে লর্ড ক্লাইভ যখন মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা সুবার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায় ও বিলি বন্দোবস্তের ভার পেল তখন দেশের সূর্য সত্যি অস্ত গেল। ঔপনিবেশিকতার ভিত পাকা হয়ে গেল।
কোম্পানিরই এক কারিগর লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৯-তে নিজেই স্বীকার করেছিলেন : ‘I may safely assert that one-third of the Company’s territory in Hindusthan is now a jungle inhabited by wild beasts.’ এই জঙ্গলের রাজত্বে কোথায়ই বা আধুনিকতা, কোথায় বা উন্নয়নশীল সংস্কার ? পলাশির যুদ্ধের আগে ইংরেজদের বাণিজ্যের চুয়াত্তর শতাংশ অর্থ আসতাে ইংল্যাণ্ড থেকে আমদানিকৃত ও রৌপ্যপিণ্ডের সাহায্যে। পলাশি পরবর্তী যুগে সােনা-রূপা আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ তাে হলই, বরং এদেশে থেকে প্রাপ্ত টাকায় ব্যবসা চালিয়ে, মাইনে দিয়ে, মুনাফা স্বদেশে পাঠিয়ে, সােনা-রূপা পর্যন্ত চীনে রপ্তানি শুরু হল। ওই ঔপনিবেশিক শাসনের স্বরূপ সম্পর্কে ১৮৫৩-র ২৫ জুন ‘ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে কার্ল মার্কস লিখলেন যে, ভারতে কোম্পানির শাসন হল: ‘European despotism, planted upon Asiatic despotism, by the British East India Company, forming a more monstrous combination than any of the divine monsters startling us in the temple of Salsetti.’ বাংলা থেকে অপরিমিত ধন সম্পদ লুঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন লাভবান হয়, অপরদিকে তেমনি ক্লাইভ ও অনান্য কর্মচারীরা রাতারাতি প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে নবাবী কায়দায় জীবন যাপন করতে থাকেন। কিন্তু এর মাসুল গুনতে হয় বাংলার জনগণকে। সারাদেশ জুড়ে এক নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক সংকট বাংলার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলল। পলাশি লুণ্ঠনের ফলে বাংলার অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ল। বাংলার জনগণের দুঃখ দুর্দশার অন্ত ছিল না। টমসন ও গ্যারেটের ভাষায় বলা যায়, ‘To engineer a revolution has been revealed as the most paying game in the world. A gold lust unequalled since the hysteria that took hold of the Spaniards of Cortes and pizarro’s age filled the English mind. Bengal in particular was not to know peace again until it had been bled white.’ (Rise and fulfilment of British rule in India).
আসলে বণিকশ্রেণি যখন রাজশক্তি হাতে পেল, অথচ তা ভােগ করার কোন দায়িত্ব গ্রহণ করল বা করতে পারল না তখন অন্যায় অত্যাচারই তার স্বাভাবিক পরিণতি। বাংলার দুর্বল নবাবদের পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কোনভাবেই সম্ভব হয়নি। সুতরাং বাংলার পক্ষে পলাশির যুদ্ধ এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। তবে এটা ঠিক যে, পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনের সংস্পর্শে এসে বাঙালি পাশ্চাত্য শিক্ষা, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয় এবং তার ফলে বাংলায় এক নবযুগের সূত্রপাত হয়। কিন্তু পলাশির যুদ্ধের সঙ্গে এর যােগ কতটুকু? পলাশির যুদ্ধের ফলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল মাত্র। ইংরেজি শিক্ষা ও আদর্শের সংস্পর্শে আসার কোনও সুযােগই তখন ছিল না বা সেই ধরণের কোনও প্রয়ােজনও তখন অনুভূত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে পলাশির যুদ্ধের অনেক পরে ঊনবিংশ শতকের গােড়ার দিকে বাংলার এক নবযুগের সূত্রপাত হয়েছিল—বাংলা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে শিক্ষা সংস্কৃতিতে অধিকতর অগ্রসর হয় ও আধুনিকতার পথে পা বাড়ায়।
স্যার যদুনাথ বলেছিলেন যে, ১২০০-১৭৫৭ কালপর্বে মুসলমানেরা বাংলাকে কেবলমাত্র রক্তাক্তই করেছে। নিরবচ্ছিন্ন বর্বরতাই তারা দেশকে দিয়েছে। অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই তারা করেননি (‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’)। স্যার যদুনাথের মতে, সংস্কৃতি আর আলােকিত আধুনিক যুগে মুসলমানের এতটুকু ঠাই নেই। তিনি আধুনিক বাংলাকে হিন্দু ভদ্রলােকের সৃষ্টি হিসেবেই দেখিয়েছেন। ব্রিটিশের থেকে পাওয়া দীপ্তির দ্বারাইহিন্দুভদ্রলােকেরা আবার বাংলাকে ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে—এমনটাই অভিমত স্যার যদুনাথের। তাই তার মতে, অধিকার বলেই বাংলা কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দুদের। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেইনবজাগরণ কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দু ভদ্রলােকের সংস্কৃতিরই প্রতীকমাত্র। তার মতে, এটি একান্তই হিন্দু বাংলার, যার সঙ্গে মুসলমানের সম্পর্ক নেই। এই চিন্তাধারাতে বাঙালি মুসলমানের বাঙালি জাতীয়তাকে অস্বীকার করা হয়েছিল। যদিও এই ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারার অল্প কিছুকালের ভিতরেই বাঙালি জাতীয়তার বিজয়বৈজয়ন্তী উড়েছিল পূর্ববঙ্গে। যদুনাথের সঙ্গেই সুর মিলিয়ে শ্যামাপ্রসাদেরও অভিমত ছিল যে, মুসলিম শাসন ছিল অবৈধ। তারা মনে করতেন, মুসলিম শাসন তাদের নিজেদের পরবাসী করেছে। আজ আর এস এস এবং তাদের শাখা সংগঠন বিজেপি এই আত্মঘাতী দর্শন ও চিন্তাধারারই প্রসার, প্রচার ও প্রয়ােগ করে চলেছে। (এই সম্পর্কিত একটি প্রধান সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল অমৃতবাজার পত্রিকাতে ১৯৩৯ সালের ৫ এপ্রিল। সেই সম্পাদকীয়তে লেখক বাঙালি হিন্দুদের জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেখানে নিজের বিবেচনায় চিন্তা-ভাবনা করার ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচির জন্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল)। সেখানে মুসলমান কর্তৃক হিন্দুদের নিজ প্রদেশে ভূমিদাস করে রাখার যে কথা বলা হয়েছিল, সেটিই ছিল শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভার গােটা বাংলাব্যাপী সাম্প্রদায়িক প্রচারের মূলমন্ত্র।
(৫)
১৯৪৬-এর গ্রীষ্মে (মে মাসে) দিল্লিতে ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের কয়েক প্রস্থ আলাপ আলােচনা হয়। এই আলােচনাকালে বাংলাতে নানারকম জল্পনা কল্পনা ছড়াতে থাকে। কলকাতা এবং পশ্চিমবাংলার বাঙালি হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তখনও বাংলা বিভাগের পক্ষেই তাদের অভিমত জানাতে থাকেন। তাদের অভিপ্রায়টা ছিল পশ্চিমবাংলাকে হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র হিসেবেই গড়ে তুলতে। মুসলমানদের স্থায়ী শাসন হিন্দুদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেশভাগ পশ্চিমবাংলার বাঙালি হিন্দু জনগােষ্ঠীর কাছে অধিকতর গ্রহণযােগ্য বিষয় বলেই মনে হতে শুরু করে।
দেশভাগের এই ক্রান্তিলগ্নে ছেচল্লিশের দাঙ্গার কথা স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। এই প্রসঙ্গে আমরা সােহরাওয়ার্দির ভূমিকা নিয়েই সব থেকে বেশি আলাপ আলােচনায় ব্যস্ত থাকি। কিন্তু বাঙালি হিন্দু নেতারা এই ঘটনার সঙ্গে কীভাবে এবং কতখানি জড়িত ছিলেন, সেই দিকে আমরা খুব একটা লক্ষ্য নজর দিই না। এই রক্তক্ষয়ী ঘটনা সম্পর্কে প্রস্তুতি যে কেবলমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়ের ছিল— এটা ভাবলে ভুল হবে। চরম প্রস্তুতি বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি অংশও নিয়েছিল। গত শতকের তিনের দশকের শেষের দিকে এবং চারের দশকের প্রথম দিকে অবিভক্ত বাংলার কলকাতা এবং সংলগ্ন মফসসল শহরগুলিতে হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর যে সাংগঠনিক দৌরাত্ম্য দেখা গিয়েছিল, সেটি এই সময়কালের ইতিহাস রচয়িতাদের অনেকেই এড়িয়ে যেতে চান। এইসব সংগঠনের নীতিই ছিল হিন্দুদের যে কোনও মূল্যে ঐক্যবদ্ধ করা। এই কাজে হিন্দু যুবকদের দৈহিক যােগ্যতার উপরে সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা সবথেকে বেশি জোর দিতেন। সংগঠনের কর্মীদের আধা সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে নানাভাবে উৎসাহিত করা হত। এই হিন্দু সংগঠন তৈরির কাজে সবথেকে জোরদার এবং সুসংগঠিত ভাবে কাজ করত আর এস এসের সহযােগী সংগঠন ‘ভারত সেবাশ্রম সংঘ’। ছেচল্লিশের ১৬ আগস্ট কলকাতা এবং সন্নিহিত মফসসলকে কেন্দ্র করে মুসলিম হত্যায় সবথেকে সংগঠিতভাবে অংশগ্রহণ করেছিল আর এস এসের সহযােগী এই সংগঠনটি।
চল্লিশের দশকে ভদ্রলােক হিন্দুদের ভিতরে এইভারত সেবাশ্রম সংঘ ধীরে ধীরে অত্যন্ত ভালােভাবে শিকড় বিস্তার করতে শুরু করে দেয়। ১৯৪৭ সালেও দেখা গেছে ক্ষমতার অলিন্দের কাছাকাছি মানুষজনদের সঙ্গে এই চরম মুসলিম বিদ্বেষী, হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সংগঠনটির দারুণ সখ্যতা। প্রাক্তন আই সি এস এবং সেই সময়ের মন্ত্রী বিজয় প্রসাদ সিংহরায় এই সময়কালে ভারত সেবাশ্রম সংঘ আয়ােজিত একটি হিন্দু সম্মেলনের অধিবেশনের উদ্বোধন করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট অধিবেশনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য পি এন বন্দ্যোপাধ্যায় সভাপতিত্ব করেছিলেন।
কংগ্রেস এই সময়কালে শ্যামাপ্রসাদ পরিচালিত হিন্দু মহাসভার রাজনীতির পাল্টা চাল দিতে গিয়ে রাজনৈতিক হিন্দুদের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে কার্যত হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণ করত কংগ্রেস এই সময়ে নিজেদের ছত্রছায়ার ভিতরে কিছু রাজনৈতিক হিন্দু সংগঠন তৈরি করেছিল।
সেই সংগঠনগুলি সরাসরি ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাম্প্রদায়িক সভা-সমিতিতে যােগ দিত। চন্দ্রনাথ মন্দির তথাকথিত অপবিত্র করবার ঘটনা সেই সময়কালের একটি বড় সাম্প্রদায়িক প্ররােচনামূলক ঘটনা। রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের পক্ষ থেকে এই ঘটনার দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর।
হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডে ‘Basic Principles of Formation of New West Bengal Province’ নামে স্যার যদুনাথের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ৮ জুলাই ১৯৪৭ সালে। রাজশাহি এবং মালদার সীমান্ত কমিশনের কাছেও একটি স্মারকলিপি পাঠান স্যার যদুনাথ।২২ প্রভাবশালী বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা এভাবেই দেশভাগের দাবির সমর্থনে আর এস এস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সাথে এক মঞ্চে চলে আসেন। কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা একযােগে বহু সভা-সমিতি করে। ফরওয়ার্ড ব্লকও সেই সভায় অনেক সাহায্য করে। কলকাতা কর্পোরেশনও দেশভাগের সমর্থনে প্রস্তাব নেয় ১৩ মে ১৯৪৭।২৩ ১৯৪৭ সালের মে মাসে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলা বিভাগের দাবিতে যৌথভাবে কলকাতায় এক বিরাট জনসভার আয়ােজন করে। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার। প্রাদেশিক পর্যায়ে উভয় দলের নির্বাহীদের মধ্যে এ ধরনের সহযােগিতা স্থানীয় পর্যায়েও লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
গান্ধীজির ইচ্ছাকে২৪ বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে সায় দেয় তার পিছনে সবথেকে বড় ভূমিকা ছিল বল্লভভাই প্যাটেলের। ১৯৪৭-এর এপ্রিল মাস থেকেই নেহরু ও প্যাটেলের কাছে বঙ্গভঙ্গের দাবিতে বহু চিঠি, টেলিগ্রাম ইত্যাদি আসতে থাকে। আর এস এস অত্যন্ত কৌশলে প্রভাবিত করে প্যাটেলকে। প্যাটেলের কাছে বঙ্গভঙ্গের দাবিতে যেসব চিঠি গেছে তাদের প্রায় প্রত্যেকটিকেই গুরুত্ব সহকারে দেখেছেন প্যাটেল। হিন্দু মহাসভার বঙ্গভঙ্গের দাবির প্রধান গুরুই ছিলেন প্যাটেল।২৫ ১৯৪৬ সালের ২৭ এপ্রিল কলকাতা থেকে অখিল দত্ত নামক এক ব্যক্তি বঙ্গভঙ্গের দাবির সঙ্গে সহমত পােষণ না করবার জন্য প্যাটেলকে 601678, “Partition of Bengal is fundamentally wrong on all grounds Political Economic Cultural Linguistice and Social.It is outcome of defeatist mentality and is misconcived remedy against communal goverment in Bengal.” কিন্তু প্যাটেল এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হননি।
অখণ্ড বাংলার দাবিকে ‘আজাদ পাকিস্তানের দাবি হিসেবে তুলে ধরতে চায় মুসলিম লিগ বলে একযােগে প্রচার চালায় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা। আজাদ পাকিস্তান নামক একটি ইস্তাহার তখন সত্যিই বেনামিতে প্রকাশিত হয়েছিল। অনুমান করা যায়, হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে সব দোষ লিগের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ধরনের বেনামী প্রচার চালানাে হয়। এই ইস্তাহারটি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতা নীহারে দত্তমজুমদারকে। তিনি ইস্তাহারের একটি প্রতিলিপি প্যাটেলকে পাঠিয়ে দেন। এই ইস্তাহারটি পেয়ে প্যাটেল নিহারে দত্ত মজুমদারকে লেখেন, “The Enclosures of the letter have not come to me as a surprise. Those who wish to include Hindu majority areas in Muslim Provines are bound to resort to all means, fair and foul, to secure their objective. They will create panic and intimidate people. The letters which you have enclosed are only intended to carry out his object.” রেল অনুসন্ধান কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান কে সি নিয়ােগী প্যাটেলের কাছে হােসেন শহিদ সােহরাওয়ার্দির বিবৃতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করেন। প্যাটেল তার উত্তরে নিয়ােগীকে লেখেন, সােহরাওয়ার্দিহতাশা থেকে এই ধরনের কথা বলছেন। প্যাটেলের বক্তব্যের সঙ্গে আরএসএস, হিন্দুমহাসভার বক্তব্যের তখন আদৌ কোনও ফারাক ছিল না। এক গভীর ষড়যন্ত্রমূলক চিঠি শ্যামাপ্রসাদ পাঠান প্যাটেলকে। শ্যামাপ্রসাদ লেখেন, “We are naturally extremely anxious about the final development.” প্যাটেল শ্যামাপ্রসাদকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে চিঠি লেখেন। বিনয়কুমার রায় নামক এক অপরিচিত ব্যক্তির চিঠিকেও গুরুত্ব দিয়ে তার উত্তর দিয়েছিলেন প্যাটেল। কিন্তু শরৎ বসুর অসাম্প্রদায়িক ভূমিকাকে সমালােচনা করতে ছাড়েননি প্যাটেল। শরৎ বসুর সঙ্গে যােগদানের জন্য কিরণশঙ্কর রায়কে কার্যত হুমকি দেন প্যাটেল।
(৬)
বাংলাকে ভাগ করার আন্দোলনে হিন্দু মহাসভা ও বাংলা কংগ্রেস একযােগে কাজ করছিল। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে শ্যামাপ্রসাদ যে সম্মেলনে ঘােষণা দিলেন যে, দেশভাগ করা ছাড়া বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের জীবনে শান্তি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অসম্ভব, সেই সম্মেলনেই দলের পক্ষ থেকে তাকে সকল জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে একত্র হয়ে বাংলার হিন্দুদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। অবিকল মুসলিম লিগের আচরণ, নেতাকে একক কর্তৃত্ব দেবার ব্যাপার, পার্থক্যটা এই যে মহাসভার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী বলতে হিন্দুদের বােঝানাে হয়েছে, যেমন লিগের দিক থেকে বােঝানাে হতাে মুসলমানদেরকে। দ্বিজাতিতত্ত্ব ও আপসহীনতার ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদ ও জিন্নাহ পরস্পরের অত্যন্ত নিকটেই ছিলেন। কংগ্রেসের প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটিও কিন্তু ৪ এপ্রিল ১৯৪৭-এ দেশভাগের পক্ষে প্রায় একই ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তাদের প্রস্তাবে জানানাে হয় যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যদি চরিত্রগত ভাগে সাম্প্রদায়িক এবং বাংলাকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর মুসলিম লিগ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় তা হলে বাংলার যে সকল অংশ ভারতীয় ইউনিয়নে থাকতে ইচ্ছুক তাদেরকে সেভাবে থাকতে দিতে এবং ভারতীয় ইউনিয়নের অংশ হয়ে তাদেরকে স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করার অধিকার দিতে হবে। সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে দেওয়া যাবে না, ভাগ করতে হবে এবং ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গঠন করতে হবে, বক্তব্য এটাই। কারণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠিত হলে সেটা শেষপর্যন্ত সার্বভৌম থাকবে না, অচিরেই পাকিস্তানভুক্ত হয়ে যাবে—এই ভয় ছিল। উল্লেখ্য যে ওয়ার্কিং কমিটির ওই সভায় আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ ও নলিনী সরকার, যিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।২৬ ভাগের পক্ষে স্রোত তৈরি হয়েছে, তাতে সবাইকে চাই। যদিও শরৎ বসু ১৯৪৬-এরমাঝামাঝি সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন, তবু তিনি বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি সম্বন্ধে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, এটা একটা গােষ্ঠী শাসিত প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান ঐতিহাসিক দিনগুলিতে তাদের উপদলীয় স্বার্থে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ ছিল।২৭
প্যাটেলের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের তখন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ। ১৭ মে শ্যামাপ্রসাদকে প্যাটেল লিখেছিলেন, “কার্যকরী ও সুষ্ঠুভাবে পরিস্থিতির মােকাবিলা করার জন্য আপনি আমাদের উপর নির্ভর করতে পারেন। বাংলার হিন্দুরা যতক্ষণ দৃঢ় থাকবেন এবং যে সাহায্য তারা শুধু আমাদের দিতে পারেন সেই সাহায্য দেবেন, ততক্ষণ তাদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নিরাপদ।” অর্থাৎ বাংলা ভাগ হবেই। ১১ মে তারিখে শ্যামাপ্রসাদ প্যাটেলকে যে চিঠি দিয়েছিলেন সেই মর্মেই নেহরুকেও একটি চিঠি পাঠান। প্রত্যুত্তরে ১৪ মে নেহরু শ্যামাপ্রসাদকে লেখেন, “(ভারতীয়) ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন সার্বভৌম বাংলার ধারণা ব্যক্তিগতভাবে আমি মােটেই পছন্দ করি না।…৩১ মে দিল্লীতে কংগ্রেস কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক হবে। মনে হয় ওই সময়ে আপনি দিল্লীতে উপস্থিত থাকলে সুবিধা হবে।২৮
আগের আমন্ত্রণটা ছিল প্রাদেশিক কমিটির বৈঠকে উপস্থিতির জন্য, এবারেরটা একেবারে কেন্দ্রীয় কমিটি বৈঠকে যােগদানের। কেন্দ্র ও প্রদেশে তখন আর কোনাে ভেদাভেদ নেই।২৯ দেশভাগের ব্যাপারে বিশেষভাবে বিরােধী ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায়। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এঁদের উভয়কেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, শরৎবসুকে কিছুটা মৃদুভাবে, কিরণশঙ্করকেতুলনায় কড়াভাবে। স্মরণীয় যে, এর আগে শরৎ বসু কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছিলেন, গান্ধীর অনুরােধে পুনরায় কংগ্রেসে যােগ দান করেছিলেন বটে কিন্তু কোনাে কর্মকর্তা ছিলেন না, কিরণশঙ্কর ছিলেন প্রাদেশিক আইনসভায় বিরােধী দলের নেতা।
একদিকে যেমন তিরস্কার করা হচ্ছিল, অন্যদিকে তেমনি প্রলােভন দেখানাের কাজও চলছিল। ঢাকার ক্ষিতীশকুমার নিয়ােগী ছিলেন কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য। প্রথমে তিনি দেশভাগের বিরােধী ছিলেন। প্যাটেল তাকে জানালেন যে, দেশভাগের পক্ষে সমর্থন দিলে কেন্দ্রীয় আইনসভা যখন ভেঙে যাবে তখন নিয়ােগীর কথা তিনি মনে রাখবেন, এবং তার সাধ্যমতাে যা করার করবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন, ১৯৪৭-এ ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে কেন্দ্রে যে কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা গঠিত হয় নিয়ােগীকে তাতে স্থান করে দেওয়া হয়েছিল।৩০ কংগ্রেসের দিক থেকে দেশভাগের পক্ষে তৎপরতা চলছিল সমাবেশ, জনসংযােগ, স্মারকলিপি পেশ, জনমত জরিপ ইত্যাদির। এরই ধারাবাহিকতায়, মে মাসেই দেশভাগের সমর্থনে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার যৌথ উদ্যোগে কলকাতায় একটি জনসভা হয় যাতে সভাপতিত্ব করেন স্যার যদুনাথ সরকার।৩১
শ্যামাপ্রসাদের চিন্তা ছিল সম্ভাব্য পাকিস্তানের হাত থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাঁচানাে। খেয়াল করেননি যে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভাগাভাগিটা সম্প্রদায়গত ভাবে হবার কথা নয়, হবার কথা মতাদর্শিক ভাবে। তার চেয়েও বড় কথা, বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে ভয় করবার কোনাে যৌক্তিক কারণ ছিল না। সংখ্যার দিক থেকে দুই সম্প্রদায়ের ভেতর ব্যবধানটা আকাশ পাতালের তাে ছিলই না, ছিল নিতান্ত সামান্য। তদুপরি শিক্ষা, চাকুরী, পেশা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবদিক দিয়েই হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা অনেক বেশি এগিয়ে ছিল, প্রতিবেশী মুসলমানদের তুলনায়। তাই রাজনৈতিক ক্ষমতা মুসলমানদের কাছে চলে গেলেও, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দু প্রাধান্যই থাকবার কথা।
আর রাজনৈতিক ক্ষমতা যে নিরঙ্কুশভাবে মুসলমানদের কজাগত হবে এমন কোনাে আশঙ্কাও ছিল না। ১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের অসম্মতির দরুন ফজলুল হক মুসলিম লিগের সঙ্গে যে যৌথ মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন এমনকী তাতেও হিন্দু সদস্যরা ছিলেন এবং মুসলমান হিন্দুর সংখ্যানুপাতটি ছিল ৬: ৫। বাংলার আসল সমস্যাটা সম্প্রদায়গত ছিল না, ছিল শ্রেণিগত, যেজন্য দেখা যায় হক সাহেব কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার মন্ত্রীসভায় তার দলের সদস্য ছিলেন তাকে সহ মাত্র দু’জন এবং এটাও অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ যে, মন্ত্রীসভার এগারাে জন্য সদস্যের ভেতর আটজনই ছিলেন কোনাে না কোনাে ভাবে ভূসম্পত্তির মালিক।৩২ হক মন্ত্রীসভা থেকে মুসলিম লিগ যখন সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল, হক সাহেব তখন যে ‘প্রগ্রেসিভ’ যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠন করতে উদ্যোগ নেন, তাতে শরৎচন্দ্র বসুর হবার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী; সেটা সম্ভব হয়নি, কারণ যেদিন তার শপথ নেবার কথা সেদিন সকালেই শরৎ বসুকে গ্রেফতার করা হয়। মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদের থাকার কথা ছিল, তিনি ছিলেনও, তঁাকে দেওয়া হয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এটাও তাৎপর্যহীন নয় যে, হক সাহেব যদিও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু মন্ত্রীসভা পরিচিত হয়েছিল শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা নামে; হিন্দু নামটি আগে এসেছে, মুসলিম নামটি পরে। পরবর্তীতে খাজা নাজিমুদ্দিন যে মন্ত্রীসভা গঠন করেন তাতেও হিন্দু সদস্যরা ছিলেন। ১৯৪৬-এর নির্বাচনের পরে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দিআন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন কংগ্রেসের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠনের। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি মূলত কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে।৩৩
আসলে ১৯৩৭-এর মতাে ১৯৪৬-এ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে লিগকে গুরুত্বপূর্ণ করতে চায়নি। অন্যদিকে জিন্নাহও চাননি মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলাক। তার আশঙ্কা ছিল ওই কাজটি করলে যে অলঙ্খনীয়’ পার্থক্যের ওপর পাকিস্তানের দাবীটি নির্ভরশীল সেটি হয়তাে বা দুর্বল হয়ে যাবে। তাছাড়া হােসেন শহিদ সােহরাওয়ার্দি দ্বিতীয় ফজলুল হকে পরিণত হয়ে তার একক নেতৃত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলুক এটাও তার কাম্য ছিল না। সব মিলিয়ে সত্যটা তাে ছিল এই যে, ভয়ের কোনাে বস্তুগত কারণ ছিল না। মূল ব্যাপারটা ছিল পাকিস্তান হবে মনে করে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতর যারা তুলনামূলকভাবে বিত্তবান, যাদেরকে বর্ণহিন্দু বলা হয়, তাদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং কলকাতা যাতে কিছুতেই তাদের হাত ছাড়া না হয়ে যায় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। পূর্ববঙ্গের হিন্দু, যাদের অধিকাংশই নিম্নবর্ণের, দেশভাগ হলে তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে সে নিয়ে ওই ভদ্রলােকদের মাথা ব্যাথা ছিল না।
১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলির ঘােষণার দুদিন পরেইশ্যামাপ্রসাদ বাংলার ছােটলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি করলেন যে, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ করলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করে তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।৩৪ শ্যামাপ্রসাদ ১৯৪৭ সালের ১৯ মার্চ এক বিবৃতিতে বললেন, “প্রদেশটি যে গুরুতর সাম্প্রদায়িক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান হচ্ছে বাংলার বিভাজন। এর ফলে যে যে অঞ্চলে বাংলার দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য আছে সেখানে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিকশিত করার পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে।”৩৫
তাই আজ যারা বলছেন, শ্যামাপ্রসাদ না থাকলে ভারতে আজকের পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব থাকত কিংবা বাঙালির একটা বড় অংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেত, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, যিনি ১৯৪৭-এর এপ্রিলে তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত তিনদিনের (৪ থেকে ৬ এপ্রিল) হিন্দু মহাসভার বার্ষিক প্রাদেশিক সম্মেলনে (এই সম্মেলন বাংলায় হিন্দুদের জন্য একটি পৃথক প্রদেশ গঠনের উদ্দেশ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য শ্যামাপ্রসাদকে কর্তৃত্ব প্রদান করে) ৫ এপ্রিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা ভাগের দাবির পুনরাবৃত্তি করে বলেন: I conceive of no other solution of the communal problem in Bengal than to divide the province and let the two major communities residing herein live in peace and freedom.৩৬ তিনি কোনও অবস্থাতেই কোনও শুভবুদ্ধি মানুষের কাছে প্রণম্য হতে পারেন না। বঙ্গভঙ্গের প্রবক্তাকে যদি আমরা বাঙালির নায়ক বা পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা বলে মানতে চাই, তাহলে শ্যামাপ্রসাদ নয়, কার্জনকেই আমাদের পূজোর বেদিতে বসিয়ে আরাধনা করা উচিত। আর শ্যামাপ্রসাদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ভারতে আছে—এর চেয়ে অসত্য কথা আর হতে পারে না।৩৭
(৭)
শ্যামাপ্রসাদের গুণগ্রাহী হিন্দু মহাসভার নেতা বলরাজ মাধােক লিখেছেন যে, শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন, “কংগ্রেস ভারত বিভাজন করেছিল আর আমি করেছিলাম পাকিস্তান-বিভাজন।”৩৮
শ্যামাপ্রসাদ দাবি করেছেন যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে তিনিই পশ্চিমবাংলা ও পূর্বপাঞ্জাবকে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ দাবি একান্তই হাস্যকর হত না যদি বাংলা ও পাঞ্জাব-বিভাজন এত মর্মান্তিক না হত। এই বিভাজনে শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার কী ভূমিকা ছিল সে তাে ইতিহাস। তবে সেদিন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকার গুরুত্বের পরিমাপ কিছুটা হয়েছিল ১৯৪৫-এর শেষের দিকে কেন্দ্রীয় আইনসভার এবং ১৯৪৬-এর প্রথম দিকে প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নির্বাচনে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেনি। সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গেই আপস করেছিল এবং সেই আপসের ফলেই বাংলা ও পাঞ্জাব-বিভাজন তথা ভারত বিভাজন হয়েছিল। এক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদরা ছিলেন অবান্তর। আমরা দেখেছি বিড়লা-গান্ধী-নেহরু-প্যাটেলরা দীর্ঘদিন ধরে চেয়েছিলেন হয় অখণ্ড ভারত অথবা বাংলা ও পাঞ্জাবকে চিরে এই দুই প্রদেশের এক এক খণ্ড তাদের শাসিত ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিতে। দ্বিতীয়টা ছিল তাদের ন্যূনতম দাবি এবং সেই দাবি তারা আদায়ও করেছিলেন। পরে পাকিস্তানকে যারা বিভাজন করেছিলেন তারা হচ্ছেন পূর্ব বাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১-এ। তাছাড়া পাকিস্তানের হিংস্র কবল থেকে সমগ্র বাংলাকে বাঁচানােই যদি বাংলাভাগের কারণ হয়, তাহলে ভারতের সীমানার মধ্যেও তাে অখণ্ড বাংলা গড়তে পারতেন শ্যামাপ্রসাদ ও তার অনুগামীরা। কেনই বা তারা ভারতের মধ্যকার অখণ্ড বাংলারও বিভাজন চেয়েছিলেন ?
১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল বাংলা ভাগের দাবিতে দিল্লির জনসভায় শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন: “This separation must not be dependent on Pakistan.Even if Pakistan is not conceded and some form of a week and loose centre envirage in the Cabinet Mission Scheme is accepted by the Muslim Leauge, we shall demand the creation of a new Province composed of the Hindu Majority areas in Bengal.”৩৯ অর্থাৎ বাংলা ভাগের ব্যাপারটা যে পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত নয়, শ্যামাপ্রসাদের এই বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট হয়। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতা বি. বি. সিনহা প্যাটেলকে অনুরূপ এক চিঠিতে লেখেন, “পুরাে বাংলাও যদি ভারতে যােগ দেয়, তাহলেও বর্তমানে যে অবস্থা আছে সেই অবস্থাই বজায় থাকবে এবং বাংলায় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিস্থাপন করার ধারণা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হবে। নিজেদের হাতে প্রশাসনের ভার না থাকলে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। অতএব ভারতে থাকতে চাইলেও বাংলাকে অখন্ড রাখা যাবে না।”৪০
পরে সুরেন্দ্রমােহন ঘােষ এক সাক্ষাৎকারে গর্ডনকে বলেছিলেন যে, শ্যামাপ্রসাদ সেই সময় একান্তে বলেছিলেন: “এখন আমরা বিভক্ত করি এবং ইংরেজরা চলে গেলে তারপর আমরা সমগ্র অঞ্চল দখল করে নেব।’৪১ সুরেন্দ্র মােহন ঘােষের এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা আছে। কারণ বাংলা তথা ভারত বিভাজন ঠিক হয়ে যাবার পরেই হিন্দু মহাসভা কর্তৃক এক গৃহীত প্রস্তাব থেকে মনে হয় শ্যামাপ্রসাদ মাত্র কিছুদিন আগে (১৯ মার্চ) বাংলা বিভাজনের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছিলেন তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন এবং যুদ্ধং দেহি’ মনােভাব গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু মহাসভার প্রস্তাবে বলা হয়: “…যতক্ষণ না বিচ্ছিন্ন অংশগুলােকে ভারতীয় ইউনিয়নে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে এবং এর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শান্তি আসবে না।”৪২ হিন্দু মহাসভা বিশ্বাস করত, ভারতীয় ইউনিয়নে পূর্ব বাংলাকে ফিরিয়ে আনা মাত্র সময়ের প্রশ্ন।৪৩ কংগ্রেসের শীর্ষনেতারাও নিশ্চিত ছিলেন, পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তান হিন্দুস্তানে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। প্যাটেলও এই বক্তব্য রেখেছিলেন।৪৪
যাইহােক, ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন পরিকল্পনা ঘােষণা করলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা একত্রে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে আরও জোরদার করলেন। এ সময় উভয় দলের মধ্যে কাজের সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার প্রয়াসে বাংলার ‘খাদি-গ্রুপের নেতারা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে কংগ্রেস নেতা হিসেবে পশ্চিমবাংলার মন্ত্রিসভায় যােগদানের আহ্বান জানায়। সেখানে উপস্থিত হিন্দু মহাসভার নেতারা তাকে এই প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন। জানা যায়, শ্যামাপ্রসাদ নিজে ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিমবাংলায় একটা মন্ত্রির পদ গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। তবে বােঝা যায় যে, শীর্ষ কংগ্রেস নেতাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে কংগ্রেস দলে যােগদান করতে হবে বলে তিনি ওই পদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
বাংলা ভাগের যৌথ আন্দোলনে কংগ্রেস ছিল অধিকতর অগ্রণী অংশীদার। আর এই বিভক্তির আন্দোলনে এর ভূমিকা (যাকে বলে নেতৃত্বের মর্যাদায়) হিন্দু মহাসভার সাথে শুধু সহযােগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সারা বাংলায় হিন্দু মহাসভা ছাড়াই কংগ্রেস স্বতন্ত্রভাবে বাংলা ভাগের আহ্বান জানিয়ে জনসভার আয়ােজন করে। কলকাতার বালিগঞ্জে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলার বিখ্যাত গান্ধীবাদী নেতা প্রফুল্লচন্দ্র রায়—এ ধরণের জনসভার মধ্যে এটাই ছিল বহুল প্রচারিত। বাংলা ভাগের জন্য ৭৬টি জনসভার আয়ােজন করা হয়েছিল বলে জানা যায়—এর মধ্যে কংগ্রেস একাই কমপক্ষে ৫৯টি জনসভার আয়ােজন করে। ১২টি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে আর মাত্র ৫টি জনসভা হয় যৌথ উদ্যোগে। স্বভাবতই এটা স্পষ্ট যে, বাংলা কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি থেকে বাংলা ভাগের আন্দোলন যে শক্তি লাভ করে তা মােটেও কম বলা যায় না।
বাংলা কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উসকানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে বােঝাতে লাগলেন যে, হিন্দুরা বিপন্ন, বাংলা ভাগ ছাড়া উপায় নেই। বাংলা পাকিস্তানে গেলে তাে বটেই, স্বাধীন সার্বভৌম হলেও এমনকী ভারতে থাকলেও হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে। এক সভায় হিন্দু মহাসভার বিশিষ্ট নেতা নির্মল চ্যাটার্জি বললেন: “Our demand for partition today is …to prevent the disintegration of the nationalist element and to preserve Bengal’s culture and to secure a Homeland for the Hindus of Bengal which will constitute a Nationalist State as a part of India.”৪৫ অপরদিকে শ্যামাপ্রসাদদের সম্পূর্ণভাবে মদত দিয়েছিলেন বিড়লা, গােয়েঙ্কা ও জালানদের মতাে কলকাতাস্থিত বৃহৎ শিল্পপতিরা।৪৬ হিন্দু মহাসভা এবং বৃহৎ পুঁজিপতিদের চাপে কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতৃত্ব যেভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার সাবেকি ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিতে উদ্যোগী হয়েছিল ১৯৪৬-৪৭ সালে, তা কিছু প্রাচীন কংগ্রেসি নেতা মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু তারা ছিল সংখ্যালঘু।
(৮)
এখানে লক্ষ্য করার মতাে ব্যাপার হল, ১৯০৫ ও ১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের বৈপরীত্য। ১৯০৫ সালে যাঁরা কার্জন পরিকল্পিত বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে বুকের রক্ত দিয়ে বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন করেছিলেন, মাত্র ৪২ বছরের ব্যবধানে সেই শ্রেণির মানুষেরা বাংলা ভাগের আন্দোলন শুরু করেন। তবে দুই-একজন মুসলিম নেতা ১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করেছিলেন। কারণ তাতে তাদের প্রভাবের ক্ষেত্র কমে যাবে। কিন্তু দু’একজন বাদে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা একজোট হয়ে বাংলার প্রায় সব হিন্দু নেতা বঙ্গভঙ্গের জন্য লাগাতার আন্দোলন করেছেন। কারণ ১৯৪৭ সালে বাংলার রাজনীতিতে মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা অখণ্ড থাকলে সেখানে হিন্দুদের প্রাধান্যের কোনও রকম সম্ভাবনা নেই। তারা বুঝেছিলেন যে অখণ্ড বাংলা যদি ভারতের মধ্যেও থাকে, তা হলেও সেখানে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকবে। মন্ত্রিসভার প্রধান একজন মুসলমানই হবেন। এ বিষয়টা হিন্দু নেতাদের একেবারেই অপছন্দ ছিল। তাই ‘হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায়’ বদ্ধপরিকর থাকতে শ্যামাপ্রসাদ ও অন্যান্য হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের দৃঢ় সমর্থক হয়ে পড়েন এবং অখণ্ড বাংলা মেনে নিতে পারেননি। তাদের বাংলার পাকিস্তান ভুক্তির বিরােধিতা সমর্থন করা যেতে পারে। স্বাধীন বাংলার বিরােধিতাও ভারতপ্রেমের অজুহাত দিয়ে ঢাকা যায়। কিন্তু ভারতের মধ্যে থাকলেও বঙ্গভঙ্গ করার দাবি, নিজেদের কায়েমি ক্ষুদ্র স্বার্থচরিতার্থ করা ছাড়া আর কী দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়?
বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার বিশেষ প্রয়ােজনীয়তা ইংরেজ বা দিল্লিওয়ালা অনুভব করতে পারেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ অবিভক্ত বাংলার যে সর্বনাশ করে গেলেন, সেই সর্বনাশ থেকে বাঙালি জাতি কি আর কোনও দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে১৯৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টিই তাে প্রমাণ করে শ্যামাপ্রসাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। ১৯৫২ সালে নদিয়ার চাকদহে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন : “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম তাহলে বাংলা ভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যােগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।”
১৯৪৭-এর পরবর্তী সময়ে ওপার বাংলায় বিভিন্ন সময়ে হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার চলে, সে সম্পর্কে কোনও আইনসভা বা বিধানসভায় প্রশ্ন তােলার সুযােগও এপার বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের ছিল না। কারণ বাংলা ইতিমধ্যেই ভাগ হয়ে গেছে। এপার বাংলার যেসব নেতারা নিজেদের ‘আগে হিন্দু তারপর বাঙালি’ মনে করতেন তাদের কাছে একটাই প্রতিকার ছিল এবং তা হচ্ছে, এপার বাংলায় মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানাে ও মুসলমান-বিরােধী দাঙ্গা বাধানাে বা বাধাবার চেষ্টা করা। দু-একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রও এতে মদত দিয়েছিল। উলটোদিকে এটা সত্য ঘটনা যে, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা দাঙ্গা ঠেকানাের যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ
১. শ্যামাপ্রসাদ বিগত শতকের এক বর্ণময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি কেবল পিতৃগৌরবে মহিমান্বিত ছিলেন না, শিক্ষাজগৎ ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তিনি নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু রাজনীতি ক্ষেত্রে সম্প্রদায়গত কৌণিক অবস্থান এই স্মরণীয় ব্যক্তিকে কারও কাছে নিন্দিত আবার কারও কাছে পূজিত করেছে। এমনটা বােধহয় সাম্প্রতিককালে কোনও রাজনীতিকেরই ক্ষেত্রে ঘটেনি। তবে এটা বাস্তব সত্য যে, সংকীর্ণ মানসিকতার ঊর্ধ্বে শ্যামাপ্রসাদ এক মুহুর্তের জন্যেও নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। আর এই মানসিকতার সাথেই তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন হিন্দু ধারাবাহিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী, যা খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হত শ্যামাপ্রসাদের সার্বিক চরিত্রে। অথচ বিপদের কথা, বহু সুস্থ চেতনার মানুষ শ্যামাপ্রসাদ নিরপেক্ষ জাতীয় নেতা ছিলেন, এই ধরনের কথা বিভিন্ন লেখাপত্রের মাধ্যমে লিখে আরও জলঘােলা বা ধোঁয়াশার সৃষ্টি করছেন, যা রাজনৈতিকভাবে বিজেপি-র হাতকে মজবুত করে তুলছে। স্যার আশুতােষ মুখার্জির সন্তান হয়েও সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা শ্যামাপ্রসাদের মানসিক গঠনকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তার সমগ্র জীবন পর্যালােচনা করলেই খুব সহজেই বুঝতে পারা যায়। শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ এর সাম্প্রদায়িক ভূমিকার কথা প্রায়ই চেপে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এর থেকে সাধারণ মানুষের ধারণা হতে পারে, রাজনীতিবিদ শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে বহু সীমাবদ্ধতা থাকলেও শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ এর ভূমিকা সমস্ত সমালােচনার ঊর্ধ্বে। কিন্তু বিষয়টি আদপে সেরকম নয়। বাস্তব ঘটনা হল, রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদ যতখানি সাম্প্রদায়িক ছিলেন শিক্ষাবিদ হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ তার চেয়ে কোনও অংশেই কম ছিলেন না। কোনও অবস্থাতেই তিনি তার সংকীর্ণ ধর্মীয় স্বার্থের বাইরে এক পা ফেলতেও রাজি ছিলেন না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে (১৯৩৪৩৮) তিনি তার কাজকর্মের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বহু স্বাক্ষর রেখে গেছেন—
১. উপাচার্য হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের নানা কথাবার্তা ও সিদ্ধান্ত মুসলিমদের নানাভাবে আহত করত। ১৯৩৫-৩৬ সাল নাগাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুসলিমদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে তার পিছনে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদের প্রচ্ছন্ন মদত ছিল।
২. শ্যামাপ্রসাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অত্যন্ত সচেতনভাবে হিন্দু অনুষঙ্গযুক্ত নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই সময়ে তারই প্রত্যক্ষ মদতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য মুসলিম-সংক্রান্ত ইতিহাস যথেচ্ছভাবে বিকৃত করা হয়েছিল।
৩. উপাচার্য থাকাকালীন শ্যামাপ্রসাদের আচরণ মুসলিমদের এমন বিক্ষুব্ধ করেছিল যে, ১৯৩৬ সালে মাসিক মােহাম্মদী’ পত্রিকায় লেখা হয়: “কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য হইতে মুসলমানকে ও মুসলমানের নিজস্ব সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ অস্পৃশ্যরপে বর্জন করিয়া রাখা হইয়াছে।” স্যার মােহাম্মদ আজিজুল হক লিখেছিলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তকসমূহ প্রায়ই সংস্কৃত উদ্ধৃতিযুক্ত হিন্দু পুরাণ কাহিনী ও কিংবদন্তীতে পরিপূর্ণ। …মুসলমান ছাত্রদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে পাঠ্যপুস্তক…।” এইসব প্রতিবাদ সত্ত্বেও শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন নির্বিকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তার কোনও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। বরং তিনি এসবে মদত দিয়েছেন।
৪. ১৯৩৭ সালে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীক্ষান্ত ভাষণ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা কেবল উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদের সাম্প্রদায়িক ও পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্য বয়কট করে। (গৌতম রায়, আর এস এস ও হিন্দুত্বের স্বরূপ, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ২০০৩, পৃ. ১৯-৩০। আরও দেখুন- গৌতম রায়, দেশভাগের অন্তিম পর্যায় :কংগ্রেস-সংঘ-হিন্দু মহাসভা, দেশহিতৈষী :শারদ ২০১৮, কলকাতা)।
৫. শ্যামাপ্রসাদের উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে মাধ্যমিক শিক্ষা এনেছিলেন তৎকালীন অখন্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক। এই সময় মাট্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। ফজলুল হকের প্রস্তাব ছিল, ম্যাট্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতার বাইরে এনে পৃথক একটি বাের্ডের উপর এই পরীক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব অর্পণ করা হােক। সংশ্লিষ্ট বাের্ডে মুসলিম প্রতিনিধির উপস্থিতি সুনিশ্চিত করা হয়েছিল, যাতে মুসলিমরা পক্ষপাতিত্বের শিকার না হয়। বর্ণ হিন্দুদের নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ এই বিলের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন করেন, ফলে বিলটি আইনে রূপান্তরিত হতে পারেনি। এটি ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দফার (১৯৩৪-৪১) ঘটনা।
৬. শ্যামাপ্রসাদের উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে আব্দুল মজিদ ও আব্দুল আজিজ নামে দুই ছাত্র সংস্কৃতে এম এ পড়তে চাইলে সহানুভূতি দেখানাে তাে দূরের কথা শ্যামাপ্রসাদ সরাসরি তাদের দাবি নাকচ করে দিয়েছিলেন।
৭. শ্যামাপ্রসাদের উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম অধ্যাপক ছিলেন মাত্র ২ জন, হিন্দু ছিলেন ২৩ জন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অখণ্ড বাংলায় সেই সময় মুসলিমদের মধ্যে যথেষ্ট যােগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা তাদের জন্য বন্ধই ছিল বলা যায়। পােষ্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকদের মধ্যে হিন্দু ছিল ১৫৮ জন, মুসলমান ছিল মাত্র ১২। এই ১২ জনের মধ্যে আবার ৮ জনই আরবি ও ফারসি বিভাগের। এই সময়ে রেজিস্টারের অফিসে একজনও কর্মচারী মুসলিম ছিল না। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে মােট ১৮ জন মুসলিম অশিক্ষক কর্মচারী ছিল। হিন্দু কর্মচারীদের জন্য সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসে খরচ হত ১১৬৫৯৬ টাকা আর মুসলিমদের জন্য মাত্র ৩৫২৫ টাকা। (গৌতম রায়, শ্যামাপ্রসাদ আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক ছিলেন, নন্দন, নভেম্বর ২০০০, কলকাতা। আরও দেখুন- গৌতম রায়, শ্যামাপ্রসাদ ও পরাধীন ভারতে তিন-চারের দশক, সৃষ্টির একুশ শতক : শারদ ২০১৮, কলকাতা)
৮. উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে শুক্রবার (জুম্মার নামাজের দিন) নানা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার দিনধার্য করা হত।
৯. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক ‘শ্রীপদ্ম’ নিয়ে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদের সহজাত ভূমিকা ছিল যথেষ্ট বেদনাদায়ক। মুসলিমদের তীব্র আন্দোলনের ফলে ঐ প্রতীক প্রত্যাহৃত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চরিত্রের জন্য মুসলিমরা (শ্যামাপ্রসাদের সময়ে) একে ‘কালী বিদ্যাপীঠ’, যবন বর্জিত বিদ্যাপীঠ’ বলে অভিহিত করত। এইভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র, সিলেবাস, শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী নিয়ােগ—সবক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংকীর্ণতাবােধ থেকে শ্যামাপ্রসাদ চরম প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেইসঙ্গে উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে পরীক্ষা ব্যবস্থায় নানা দুর্নীতির সঙ্গেও তিনি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এমন বহু তথ্য প্রখ্যাত অধ্যাপক সুবােধচন্দ্র সেনগুপ্তের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়। শ্রী সেনগুপ্ত শ্যামাপ্রসাদের অন্যান্য গুণের প্রশংসা করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদের নামে যে সব ‘মিথ’ প্রচলিত ছিল অধ্যাপক সেনগুপ্তের আত্মজীবনীতে তার কোনও ছাপই নেই। উল্টে তিনি লিখেছেন, “শ্যামাপ্রসাদবাবুর সদিচ্ছা ও কর্মতৎপরতার যতই প্রশংসা করি না কেন, ইহাও বলিব যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনার পক্ষে তিনি তাঁহার পিতার মতই সম্পূর্ণ অযােগ্য ছিলেন। শিক্ষা জগতের অধিকর্তা শিক্ষার মান উঁচু রাখিবেন ইহাই প্রত্যাশা করা উচিত। এইজন্য পরিচালকরা যােগ্য অধ্যাপক ও পরীক্ষক নিয়ােগ করিবেন ইহাই তাহাদের প্রধান কর্তব্য। তাহারা ‘Safety Lamp’ অথবা ঐ জাতীয় মৌলিক কিছু আবিষ্কার করিতে না পারেন, কিন্তু মাইকেল ফ্যারাডেকে চিনিয়া লওয়ার ক্ষমতা তাঁহাদের থাকা চাই। সেই ক্ষমতা বা সেই ইচ্ছা শ্যামাপ্রসাদবাবুর একেবারেই ছিল না।” অধ্যাপক সেনগুপ্ত তার এই বক্তব্যের সমর্থনে অনেকগুলি উদাহরণ উপস্থিত করেছেন: “পরীক্ষক নিবার্চন বিষয়ে অনুরূপ কাহিনী আছে। কোনও এক বৎসর ইন্টরমিডিয়েটের পরীক্ষায় লজিকের প্রধান পরীক্ষক ছিলেন পি কে চক্রবর্তী। পরীক্ষার সময় তিনি গরহাজির এবং তাহার কোনই খবর পাওয়া গেল না। সুতরাং দর্শনের ভূতপূর্ব অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ মিত্রকে তার জায়গায় নিযুক্ত করা হইল। পরীক্ষা চলিতেছে। পরীক্ষকদের সভায় প্রধান পরীক্ষককে প্রশ্নপত্র বিচার করিয়া নির্দেশ দিতে হইবে; খগেনবাবু বাংলারও প্রধান পরীক্ষক। ‘ভাইস চ্যান্সেলর’ শ্যামাপ্রসাদবাবু হুকুম দিলেন যে, লজিকের সমস্যা তাে সমাধান হউক। খগেনবাবুর জায়গায় বাংলায় আর একজন কাহাকেও দিলেই হইবে। একটু পরেই নাকি তিনি জানালা দিয়া প্যারীচরণ সরকার স্ট্রিটের দিকে তাকাইতেছিলেন—পথ দিয়া বিহার প্রবাসী অবসর প্রাপ্ত এক উকিলকে দেখিতে পাইলেন। ইনি এম বি বি এল এবং তখন পাকাপাকিভাবে কলিকাতায় বাস করিতেছিলেন; বােধ হয় কলিকাতায় আসিয়া শ্যামাপ্রসাদবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়াছিলেন। ইহার বাংলা ভাষায় অধিকার বা পঠন-পাঠনের অভিজ্ঞতার কথা কিন্তু কেহ জানিতে পারেন নাই। ইনি বেশ কয়েক বছর প্রধান পরীক্ষকের কাজ করিয়াছেন। পরের যে কাহিনি বলিব তাহা একাধিক রসের আস্বাদন বহন করে। ১৯১৯-২০ সালে (ইংরেজীর স্বনামধন্য অধ্যাপক) স্যার প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষ আই এ পরীক্ষার ইংরেজি পত্রের প্রধান পরীক্ষক ছিলেন। তখন তাহার অপেক্ষা বর্ষীয়ান এক ভদ্রলােক তাহার অধীনে পরীক্ষক ছিলেন। স্যারের ধারণা এই লােকটি একেবারেই মূখ; অবিশ্যি স্যারের নিক্তিতে ওজন করিলে আমরা ঐ মন্তব্যে কোন বিচলিত হই নাই। যখনকার কথা বলিতেছি—তখন ১৯৩৬৩৮ সাল হইবে—তখন শ্যামাপ্রসাদ ইহাকে প্রবেশিকা বা মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রধান পরীক্ষক করিয়া দিলেন। এই স্থবির ভদ্রলােক যদি বা কিছু জানিতেন, তখন তাহাও ভুলিয়া গিয়াছেন। পরীক্ষকদের মিটিং অল্প কিছুদূর অগ্রসর হইতেই অন্যতম পরীক্ষক তারকনাথ সেন মিটিং হইতে চলিয়া আসিয়া আমাদিগকে বলিলেন যে, প্রধান পরীক্ষক যে নির্দেশ দিতেছেন তাহা এত ভুলে ভরা যে, আগামী বৎসরের পরীক্ষায় ‘Correction বা অশুদ্ধিশুদ্ধি প্রশ্নে উহা দেওয়া যাইতে পারিবে। হঠাৎ স্যার আসিয়া উপস্থিত এবং তারকের মন্তব্য শুনিয়া তৎক্ষণাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইয়া ভাইস চ্যান্সেলারকে তিরস্কার করিলেন। অবিচলিত শ্যামাপ্রসাদবাবু প্রধান পরীক্ষককে ডাকাইলেন। স্যারকে দিয়া নির্দেশাবলী লিখাইয়া লইলেন এবং অবিচলিত প্রধান পরীক্ষক মিটিং-এ প্রত্যাবর্তন করিয়া উপস্থিত পরীক্ষকদিগকে বলিলেন, ‘Gentelmen, these are my received directions!’—। ”তাছাড়া পরীক্ষায় প্রিয়জনদের নম্বর বাড়ানাের ব্যাপারটা স্যার আশুতােষ মুখার্জির আমল থেকে চলে আসছিল। শ্যামাপ্রসাদের সময়েও এই ব্যাপারটা ঘটতে দেখা যায় বলে শ্রী সেনগুপ্ত তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। (বেণু গুহঠাকুরতা, শতবর্ষে শ্যামাপ্রসাদ, কাশ্মীর : নতুন মূল্যায়ন, নতুন গতি, ২৭ আগষ্ট ২০০১, কলকাতা)।
২. মহাত্মা গান্ধীকে লেখা রাজেন্দ্র প্রসাদের ১৬-০৪-১৯৪১-এর চিঠি।
৩. নলিনীরঞ্জন সরকারের কাছে লেখা কামিনীকুমার দত্তের ০৮-০৫-১৯৪১ এর চিঠি।
৪. P. R Greenough, Prosperity and Misery in Modern Bengal : The Famine of 1943-44, Oxford, Oxford university press, 1983, P.106.
৫. জয়া চাটার্জি, বেঙ্গল ডিভাইডেড : হিন্দু কমিউনালিজম অ্যান্ড পার্টিশন ১৯৩২-১৯৪৭, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ১৯৯৪; প্রথম বাংলা সংস্করণ, এল অ্যালমা পাবলিকেশনস্, কলকাতা, ২০০৩। বাংলার মুসলিমরা এই সময় পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন দেওয়ায় হিন্দুরা ভেতরে ভেতরে ফুষছিল। তারা মুসলমানদের একটি উচিৎশিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রহর গুণছিল। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস তাদের সে সুযােগ এনে দেয়। এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক হারুন-অর-রসিদ তার ‘দ্য ফরশ্যাডােয়িং অফ বাংলাদেশ : বেঙ্গল মুসলিম লিগ অ্যান্ড মুসলিম পলিটিক্স ১৯৩৬-১৯৪৭ alap al 1676901, Congress and Hindus used the opportunity offered by Direct Action Day to teach the Muslims in Calcutta a lesson and kill them in great numbers. Thus, the riots opened the way to a partition of Bengal between a Hindu-dominated Western Bengal including Calcutta and a Muslim-dominated Eastern Bengal (nowadays Bangladesh). অর্থাৎ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কংগ্রেস ও হিন্দুরা কলকাতার মুসলমানদের একটি উচিত শিক্ষা দেওয়ার এবং বিপুলসংখ্যক মুসলমানকে হত্যা করার একটি সুযােগ হিসাবে ব্যবহার করে। এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বঙ্গদেশকে কলকাতাসহ হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) বিভক্ত হওয়ার পথ খুলে দেয়।
৬. আরও দেখুন-নজরুল ইসলাম, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ভাল করার উপায়, মিত্র ও ঘােষ, কলকাতা, ১৪০২, পৃ. ৪৫।
৭. দুর্গাদাস, সর্দার প্যাটেল করেসপন্ডেন্স ১৯৪৫-৫০, খণ্ড-৪, নবজীবন পাবলিশিং হাউস, আহমেদাবাদ, ১৯৭১, পৃ. ৪০-৪১।
৮. শীলা সেন, মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল ১৯৩৭-৪৭, ইমপেক্স ইন্ডিয়া, নিউদিল্লি, ১৯৭৬, পৃ. ২২১।
৯. আবুল হাশিম, আমার জীবন ও বিভাগ-পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সােসাইটি লিমিটেড, দ্বিতীয় প্রকাশ, চট্টগ্রাম-ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ১৪৩-৪৪।
১০. আবুল হাশিম, ইন রেট্রোসপেকশন, সুবর্ণ পাবলিকেশন, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃ. ১৪২-৪৩।
১১. Nirad C. Chaudhuri, Thy Hand, Great Anarch! India 1921-1952, Addison Wesley Publishing Co.,Boston, 1988, P. 486.
১২. লিওনার্ড গর্ডন, বেঙ্গল:দ্য ন্যাশনালিষ্ট মুভমেন্ট ১৮৭৬-১৯৪০, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক, ১৯৭৪, পৃ. ২৮৫।
১৩. Nicholas Mansergh (ed.), Constitutional Relations Between Britain & India :The Trransfer of Power 1942-47, Vol.-X, Her Majesty’s Stationery Office, 1981, P. 472, 479, 512, 454-55.
১৪. স্ট্যানলি ওলপার্ট, জিন্নাহ অফ পাকিস্তান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক, ১৯৮৪, পৃ. ৩২২-৩২৩।
১৫. স্ট্যানলি ওলপার্ট, জিন্নাহ অফ পাকিস্তান, প্রাগুক্ত, পৃ.৩২৩-৩২৪। হডসন তার ‘দ্য গ্রেট ডিভাইড’ গ্রন্থে ফাঁস করে দেন যে, জিন্নাহ এমনকি বাংলার হিন্দুদের ছাড় দিতেও চেষ্টা করেছেন। কোনাে এক সময় বাংলাকে যুক্ত রেখে পাকিস্তানের বাইরে রাখার প্রস্তাবের উপর তিনি বলেন যে, “তিনি এতে খুশি হবেন। কলকাতা ছাড়া বাংলার কি দাম আছে? বরং তাদের উচিত যুক্ত এবং স্বাধীন ধাকা। আমি নিশ্চিত তারা পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করবে।” হডসন আরও বলেন যে, “ক্ষমতা হস্তান্তরের মূল পরিকল্পনায় বাংলার জন্য একটি ইউনিট হিসেবে স্বাধীনতার পক্ষ বেছে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া ছিল।” পরবর্তীকালে মাউন্টব্যাটেন বাংলা বিভাগে তার নিতান্ত দুরভিসন্ধিপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করেন। লন্ডনে রাজকীয় সাম্রাজ্য সমিতিতে ৬ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “তিনি (জিন্নাহ) অত্যন্ত জোরাল যুক্তি খাড়া করেন যে, প্রদেশগুলােকে (বাংলা এবং পাঞ্জাব) বিভক্ত করা উচিত হবে না। তিনি বলেন যে, তাদের নিজস্ব জাতীয় চরিত্র আছে এবং বিভক্ত হলে তা বিপর্যয়কারী হবে। আমি স্বীকার করি, কিন্তু বলি যে, আমি আর কত অনুধাবন করব যে, একই বিবেচনা সমগ্র ভারত বিভাগের বেলাতেও প্রযােজ্য। তিনি তা পছন্দ করেন না এবং ব্যাখ্যা দিতে থাকেন—কেন ভারত বিভাগ করতে হবে। অতএব আমরা তঁত গাছের ঝােপঝাড়ের মাঝ দিয়ে চলতে থাকি যতক্ষণ না তিনি বুঝতে সক্ষম হন যে, তিনি অবিভক্ত বাংলা ও পাঞ্জাবসহ যুক্ত ভারত অথবা বিভক্ত ভারত বিভক্ত পাঞ্জাব এবং বিভক্ত বাংলা—এ দুয়ের যে কোনাে একটা গ্রহণ করতে পারেন। তিনি শেষ পর্যন্ত শেষেরটাই মেনে নেন।” (দেখুন-কামরুদ্দিন আহমদ, সােসিও-পলিটিক্যাল হিস্টরি অফ বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য বার্থ অফ বাংলাদেশ, পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেস, চতুর্থ সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৭৫, পৃ. ৮৩)।
১৬. দ্য স্টেটসম্যান: ২৩-০৫-১৯৪৭, কলকাতা; মিল্লাত পত্রিকা : ২৩-০৫-১৯৪৭; দ্য নেশন : ৩০-০১-১৯৪৯; আবুল হাশিম, ইন রেট্রোসপেকশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৩-১৫৪। আরও দেখুন আবুল হাশিম, আমার জীবন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫-৫৭।
১৭. অমলেন্দু দে, স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা: প্রয়াস ও পরিণতি, রত্না প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৭৫।
১৮. The Statesman : 01-05-1947.
১৯. The Statesman : 02-05-1947.
২০, The Statesman : 08-05-1947.
২১. Hindustan Standard: 08-05-1947.
২২. Hindusthan Standard: 19-07-19 47
২৩. The Statesman : 14-05-1947.
২৪. স্বাধীন বাংলা’র নেতৃত্ব বার বার গান্ধীজির সঙ্গে আলােচনা করার পর, তাদের পন্থা-পদ্ধতি স্থির করেন ১৯৪৭-র ২০ মে। স্বাভাবিকভাবেই ২৩ মে শরৎচন্দ্র বসু গান্ধীজিকে চিঠি লিখে পূর্বাপর জানান। এই চিঠিতে, তাঁর বাড়িতে ২০মে-র সভার বিশদ বিবরণ জানিয়ে ‘সনদের একটি প্রতিলিপিও পাঠান এবং সমঝােতা সম্পর্কে গান্ধীজির প্রতিক্রিয়া উপদেশ ও সাহায্য চান, যাতে এই সনদের রদবদলের মাধ্যমে উভয়পক্ষেই গ্রহণযােগ্য করা যায়, যাতে বাংলা ও আসামের সমস্যার সমাধান করা যায়। শরৎচন্দ্র ঐ চিঠিতে গান্ধীজির নির্দেশ পেলেই দিল্লি যাবেন এমন প্রস্তাবও দেন। (অমলেন্দু দে, স্বাধীন বঙ্গভূমী গঠনের পরিকল্পনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১-৪৪)। এর উত্তরে গান্ধী পাটনা থেকে ২৪ মে ১৯৪৭-এ শরৎচন্দ্রকে এক পত্রে লেখেন : “আমি তােমার নােট পেয়েছি। খসড়ায় কিন্তু এমন কিছু নেই, যাতে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনাে কিছু করা সম্ভব। সরকারের প্রতিটি কর্মে, প্রশাসনিক (মন্ত্রীসভা) ও আইনসভার হিন্দু সদস্যদের কম পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন থাকা দরকার। বাংলার সার্বিক মাতৃভাষা ‘বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতির স্বীকৃতি থাকা প্রয়ােজন। কেন্দ্রীয় মুসলিম লিগের সমর্থন নিশ্চিত করবে, কারণ এই সম্পর্কে খবরের কাগজে উলটো খবর বের হচ্ছে। তােমাকে যদি দিল্লিতে দরকার হয় তাহলে টেলিফোন বা টেলিগ্রাফ মারফৎ জানাবাে। আমি এই প্রস্তাব নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আলােচনা করব।” (অমলেন্দু দে, স্বাধীন বঙ্গভূমী গঠনের পরিকল্পনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩-৪৪)। গান্ধীজি তার উপরােক্ত চিঠিতে যে সব শর্তের দাবি জানিয়েছিলেন, বােধ হয় তা আলােচনার প্রয়ােজন আছে। শর্তটি হল “সরকারের প্রতিটি কর্মে, প্রশাসনিক (মন্ত্রীসভা) ও আইনসভার হিন্দু সদস্যদের কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন থাকা দরকার।” এর অর্থ মন্ত্রীসভার দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু সদস্যরা সমর্থন না করলে, মন্ত্রীসভা কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, অনুরূপভাবে আইনসভায় দুই-তৃতীয়াংশের হিন্দুর সমর্থন না পেলে আইনসভা কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। অর্থাৎ আইনসভা কোনাে আইন, অর্থ বিল, কোনাে কিছুই পাশ করতে পারবে না। কার্যত সব সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার, তা সে মন্ত্রীসভারই হােক বা আইনসভারই হােক, থাকবে শুধু মাত্র হিন্দু সদস্যদের হাতে, হিন্দুরা বাংলায় সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও। এই ধরনের শর্ত শুধু হিন্দু আধিপত্যে বিশ্বাসীর কাছ থেকে আসতে পারে। ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব, মুসলমান-সম্পর্কিত প্রস্তাব বিল ইত্যাদিতে মুসলমান সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, তাই গান্ধীজি ও জওহরলালের মনে হয়েছিল তাদের হাত পা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। ক্যাবিনেট মিশনের ঐ প্রস্তাব কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল যদি অস্বীকার না করতেন তাহলে ভারত ভাগের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিত না।। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ সহ ভারতভাগের প্রস্তাব প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শরৎচন্দ্র বসু কংগ্রেস ও লিগ নেতৃবৃন্দকে অনুরােধ করেন, তারা যেন প্রস্তাব গ্রহণ না করেন। তিনি তখনাে জানতেন না যে, একদিন আগেই, অর্থাৎ ২ জুন কংগ্রেসের তরফে জওহরলাল, প্যাটেল ও কৃপালনী, লিগের তরফে জিন্নাহ আর অকালী শিখদের তরফে বলদেব সিং প্রস্তাব গ্রহণ করে বসে আছেন। (অমলেন্দু দে, স্বাধীন বঙ্গভূমী গঠনের পরিকল্পনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯-৯০)। কিছু গান্ধী-স্তাবক ঐতিহাসিকদের মতে, গান্ধীজি ৩ জুনের প্রস্তাবের বিরােধী ছিলেন। তারা ৫ জানুয়ারি, এ আই সি পি-র প্রস্তাবের কথা বেমালুম ভুলে যান—যে প্রস্তাব সম্পর্কে কংগ্রেস সমাজবাদীদেরই বলতে শােনা গিয়েছিল, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে জওহরলাল দেশভাগের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন। জওহরলালের ভাষায় গান্ধী মানে কংগ্রেস, আর কংগ্রেস মানেই গান্ধী’—সেই গান্ধীকে প্রস্তাব সম্পর্কে কোনাে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। তাহলে কি, মৌনং সম্মতি লক্ষণম্। না কি প্রস্তাবটি গান্ধীর অগােচরে গােপনে গৃহীত হয়েছিল ? তবে ‘স্বাধীন-সার্বভৌম-বাংলা আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেকটি পােতার সৎকর্মটি যে গান্ধী করেছিলেন, তা সন্দেহাতীত। ১৯৪৭ সালের ৮ জুন দিল্লিতে প্রার্থনাসভায়,গান্ধীর বক্তব্য বিভিন্ন পত্রিকায় যা বেরিয়েছিল তার অংশবিশেষ : “অবিভক্ত সার্বভৌম বাংলার আন্দোলন সম্পর্কে গান্ধীজি ৮ জুনের দিল্লিতে প্রার্থনাস্তিক ভাষণে বলেন, কিছু কিছু লােক তাকে বলেছেন, এই আন্দোলন দুরভিসন্ধিমূলক। তারা বলছেন, হিন্দুরা জর্জরিত হয়ে পড়েছেন এবং পশ্চিমকে পূর্ববঙ্গ থেকে আলাদা করতে চাইছেন, মুসলিম লিগও এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছে এবং বলা হচ্ছে। তিনি (গান্ধী) এই আন্দোলনের পিছনে আছেন, সেই কারণেই কিছু লােক এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি (গান্ধী) পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চান যে, কোনাে সন্দেহজনক ব্যাপারকে তার সমর্থন করার প্রশ্নই উঠে না। আরাে বলা হয়েছে যে, যুক্তবঙ্গের পক্ষে ভােট-সংগ্রহের জন্য জলের মতাে অর্থ বায়িত হচ্ছে। তিনি ঐক্যকে দামী মনে করেন কিন্তু ন্যায় ও সম্মানের মূল্যে নয়। শরৎবাবুকে সমর্থন করার জন্য তাকে (গান্ধীকে) কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। তিনি (গান্ধী) তার (শরৎচন্দ্রের) বন্ধু অনস্বীকার্য। তার (গান্ধীর) সঙ্গে তার (শরৎচন্দ্রের) পত্রালাপও আছে। কিন্তু যা কিছু প্রকাশ্যে ও সততার সঙ্গে সমর্থন করা যায় না এমন কাজকে সমর্থন করার দায়ে তাকে কখনই দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। এটাই তার সর্বকালীন কার্যপ্রণালী। সন্দেহজনক পথে কোনাে ভাল কাজ করা যায় বলে তিনি বিশ্বাস করেন না।” (অমলেন্দু দে, স্বাধীন বঙ্গভূমী গঠনের পরিকল্পনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০-৯১)।
মনে থাকা উচিত, মে মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে, এই আন্দোলনের উদ্যোক্তারা, বারে বারে সােদপুরে গান্ধীজির সঙ্গে বিশদ আলােচনা করে তাকে এই আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত করেন। শরৎচন্দ্র বসুর পত্রের উত্তরে লেখা (২৪ মে) পত্রে গান্ধীজি কিছু অযৌক্তিক দাবি তুলেছিলেন, যা কারাে কাছেই গ্রহণযােগ্যতা হতে পারে না। গান্ধীজি চেয়েছিলেন “দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু সদস্যদের সমর্থন না থাকলে, মন্ত্রীসভা বা আইনসভা কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।” হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও এক কথায় তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলায় হিন্দু-আধিপত্যের দাবি জানিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কার বা কাদের কাছে গান্ধীজিকে কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল? কোথায় বা কীভাবে গান্ধী শরৎচন্দ্রকে সমর্থন জানিয়েছেন? শরৎচন্দ্র এমনকী করলেন, যা প্রকাশ্যে ও সততার সঙ্গে সমর্থন করা যায় না? আন্দোলনের সমর্থকরা কি সন্দেহজনক পথে চলেছিলেন? গান্ধীজি নিজে, স্বভাবসিদ্ধভাবে এইসব প্রশ্নের জবাব দেননি, কারণ সত্যের পূজারি গান্ধীর বক্তব্য স্বভাবত স্বতঃসিদ্ধ সত্য। মুশকিল গান্ধী-স্তাবক ঐতিহাসিকদের নিয়ে। তারা, এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দূরে থাক, এর পিছনে সত্যের সন্ধানের চেষ্টা না করে গান্ধীকে একমাত্র দেশভাগ বিরােধীর সার্টিফিকেট দিয়ে সমস্যাকে কার্পেটের তলায় চাপা দিয়েছেন। প্রশ্নগুলি নিয়ে আলােচনা করা যাক। প্রথম প্রশ্ন, কার বা কাদের কাছে গান্ধীকে কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল? গান্ধী কংগ্রেসের সাধারণ সদস্যও ছিলেন না, অতএব কংগ্রেস সংগঠনের পক্ষে তার কাছে কৈফিয়ত দাবি করার প্রশ্ন উঠে না। তাহলে নিশ্চয় ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কারা এই কৈফিয়ত চাইতে পারে? স্বাভাবিকভাবে এই কৈফিয়ত দাবি তাদের কাছ থেকে আসতে পারে, ‘অবিভক্ত-সার্বভৌম-বাংলা’ যাদের রাজনৈতিক স্বার্থের বিরােধী। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মাত্র দু’জনের পক্ষে গান্ধীর কাছে কৈফিয়ত দাবি করা সম্ভব ছিল, তারা হলেন, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং এঁরা দুজনেই ‘অবিভক্ত-সার্বভৌম-বাংলা’র কট্টর বিরােধী। তাহলে কি জওহরলাল আর প্যাটেল গান্ধীর কাছে কৈফিয়ত চেয়েছিলেন এবং আন্দোলনও দুরভিসন্ধিমূলক’ সেই খবরও কি এই দুই স্বনামধন্য গান্ধীকে দিয়েছিলেন? ৮ জুনের প্রার্থনান্তিক ভাষণে গান্ধী নিজে না জেনে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে, বিশেষত, তার তথাকথিত বন্ধু’ শরৎচন্দ্রের কাছ থেকে অভিযােগের সত্যতা সম্পর্কে কোনােরকমের যাচাই-এর চেষ্টা না করে, স্বাধীন-সার্বভৌম-বাংলা’র আন্দোলনের বিরুদ্ধে আনা অভিযােগের ভিত্তিতে আন্দোলনকে আত্মসমর্থনের সুযােগ না দিয়ে দোষী সাব্যস্ত করেন দেন! গান্ধীর ৮ জুনের প্রার্থনান্তিক ভাষণে ব্যথিত শরৎচন্দ্র, ৯ জুন এক টেলিগ্রাম করে গান্ধীকে তার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার দাবি জানান। ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ে গান্ধীর ৮ জুন শরৎচন্দ্রকে লেখা পত্রে। এই পত্রে গান্ধী জানান, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল, দুজনেই ‘অবিভক্ত-সার্বভৌম বাংলা’র কট্টর বিরােধী এবং তাদের মনে সন্দেহ হয়েছে যে, বাংলার ব্যবস্থাপক সভার অনুন্নত (!) সদস্যদের ভােট বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ভাঙাবার প্রচেষ্টায় অজস্র টাকা ঢালা হচ্ছে। বলিহারি সত্যের পূজারি! এই পত্রের উত্তরে ১৪ জুন শরৎচন্দ্র গান্ধীকে যে পত্র লেখেন, সেটি একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল: “আপনার ৮ তারিখের চিঠি আমি গতকাল দুপুরের পর পেয়েছি। জানতে পারলাম যে, জওহরলাল আর বল্লভভাই দুজনেই প্রস্তাবের কট্টর বিরােধী। এই প্রস্তাব হিন্দু ও অনুন্নত শ্রেণির নেতাদের বিভক্ত করার ছল মাত্র। তাদের এই মতের সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। গত জানুয়ারি থেকে মুসলিম লিগের নেতাদের সঙ্গে এবং তারপর কিছু কংগ্রেসি নেতাদের সঙ্গে আলােচনার ভিত্তিতে, আমি জোর দিয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই প্রস্তাবে কোনাে প্রকার ছল বা চাতুরির স্থান নেই। জওহরলাল ও বল্লভভাই বলেছেন, তাদের মনে হয়েছে যে অনুন্নত সদস্যদের ভােট সংগ্রহের জন্য যথেচ্ছ অর্থ ব্যয়িত হচ্ছে’–এর অর্থ আমার বােধগম্য হয়নি। ঘটনা সম্পর্কে আলােচনা সম্ভব। কিন্তু ‘শুধু সন্দেহ বা মনে হওয়া নিয়ে কিছু করা যায় না। তা সত্ত্বেও আমি বলেছি যে, অনুন্নত সদস্যদের ভােট কেনার জন্য অর্থ ব্যয়িত হচ্ছে—এ কথা মনে হবার বা এই সন্দেহের কোনাে ভিত্তিই নেই। আমার বিশ্বাস অবিচলিত এবং আমি আমার ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে বাংলার ঐক্যের জন্য কাজ করে যাবে। ঢাকঢােল পিটিয়ে, দেশভাগের পক্ষে যে প্রচন্ড প্রচার চালানাে হচ্ছে, তারপরও যদি ‘গণভােট’ নেওয়া হয়, আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, বাংলার হিন্দুদের বেশিরভাগই ‘দেশভাগের বিপক্ষে ভােট দেবেন। এই মুহূর্তে বাংলার কণ্ঠরােধ সম্ভব হলেও, আমি যথেষ্ট আশাবাদী যে, বাংলা আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।” (অমলেন্দু দে, স্বাধীন বঙ্গভূমী গঠনের পরিকল্পনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯২-৯৩)।
২৫. দুর্গাদাস সম্পাদিত, সর্দার প্যাটেল করেসপন্ডেন্স ১৯৪৫-৫০, খণ্ড-৪, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫।
২৬. সুনীতিকুমার ঘােষ, বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি-রাজনীতি, নিউ হরাইজন বুক ট্রাস্ট, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ২৬৫।
২৭. সুনীতিকুমার ঘােষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৮।
২৮. দুর্গাদাস সম্পাদিত, সর্দার প্যাটেল করেসপন্ডেন্স ১৯৪৫-৫০, খণ্ড-৪, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫।
২৯. সুনীতিকুমার ঘােষ, প্রাগুক্ত,পৃ. ২৬৫।
৩০. সুনীতিকুমার ঘােষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৬-৬৭।
৩১. সদানন্দ বিশ্বাস, মহাপ্রাণ যােগেন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ১০২।
৩২. Sugata Bose, Subhash Chandra Bose & Indian Struggle against India, New Delhi, 2011, P. 50. হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল, সংগঠনটির উগ্র হিন্দুত্ববাদী চরিত্র সম্পর্কে কোনও মতান্তর থাকতে পারে না। বরং হিন্দু মহাসভা মুসলিম লিগের চেয়েও আক্রমণাত্মক ছিল।
ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রীসভার আমলে (১৯৩৭-৪১) মুসলিমদের উন্নতি বিধানে যে কোনও প্রচেষ্টারই তীব্র বিরােধিতা করতেন শ্যামাপ্রসাদ তার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। তবুও বাস্তব রাজনীতির কথা ভেবে ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদকে তার মন্ত্রীসভায় নিয়ে যে বাস্তববােধ ও সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু আদৌ তার কোনও মর্যাদা রাখেননি। হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে ঘােরালাে করার সঙ্গে সঙ্গে মুখে সম্প্রীতির কথা বলা শ্যামপ্রসাদের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্রের একটা বড় দৃষ্টান্ত।
৩৩. ১৯৪৭ সালের ২৮ মে বঙ্গীয় লিগ ওয়ার্কিং কমিটি মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন করে এবং হাশিম-সােহরাওয়ার্দির স্বাধীন অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনা নাকচ করে দেয়। একই সময়ে ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনও দ্রুতগতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকায় যাঁরা অখণ্ড ও সার্বভৌম বাংলায় বিশ্বাসী ছিলেন তারা বেশিদূর এগােতে পারেননি। অন্যদিকে নেহেরু ও জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ বাংলা বিভাজনসহ ভারত বিভক্তির প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে মনস্তাত্বিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। এই অবস্থায় ১৯৪৭ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন বঙ্গভঙ্গ সহ ভারত বিভাগের যে পরিকল্পনা ঘােষণা করেন তা নেহরু, জিন্নাহ ও শিখ নেতা বলদেব সিংহ গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে আবুল হাশিম বলেন : “এভাবে ১৯৪০ সালের বিখ্যাত প্রস্তাবকে (লাহাের প্রস্তাব) অনাড়ম্বরভাবে আরব সাগরে নিক্ষেপ করা হলাে এবং জিন্নাহ এক সময় যাকে ছিন্নভিন্ন পােকায় কাটা আখ্যায়িত করেছিলেন সেই পাকিস্তানকে দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করে নিলেন। যে নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেস দৃঢ়ভাবে ভারত বিভাগের বিরােধিতা করেছিলাে, তারা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত, বাংলা এবং পাঞ্জাব বিভাগে সম্মত হলেন।” (আবুল হাশিম, আমার জীবন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৩)। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, যখন ভারত বিভাগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সর্বভারতীয় মুসলিম লিগ এবং কংগ্রেস আলােচনারত ছিল, তখন মুসলিম লিগের নেতৃত্ব দেন কেবল জিন্নাহ, লিয়াকত আলি খান এবং সরদার আব্দুর রব নিশতার। আলাপ-আলােচনার টেবিলে কোনাে বাঙালি ছিল না। তখন মাউন্টব্যাটেন বাংলা এবং আসামের মুসলমানদের প্রতি বড় ধরনের অন্যায় করার দুঃসাহস বেড়ে যায়, বিশেষ করে যখন তিনি রাজধানী কলকাতাকে সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম বাংলার ভাগে ফেলে দেন। যদি তা না হত তবে কংগ্রেস অথবা হিন্দু মহাসভা কেউই বাংলা বিভাগের জোর দাবি করতে এত সাহস পেত না। মুসলিম লিগ নেতৃত্ব এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য পূর্ববাংলা মুসলিম লিগের পূর্ববাংলা গ্রুপকে কলকাতার ওপর থেকে দাবি ছেড়ে দিতে উৎসাহিত করেন যেন সােহরাওয়ার্দি একঘরে হয়ে যায়। একই সময়ে তারা পূর্ববাংলা বা যুক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতাকে পাকিস্তানের রাজধানি করার দাবি প্রতিহত করেন। একইভাবে যখন পাঞ্জাবকে বিভাগ করা হয় তখন পাঞ্জাব মুসলিম লিগের চাপের মুখে মাউন্টব্যাটেন লাহােরকে মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম পাঞ্জাবকে প্রদান করেন।
৩৪. অমৃতবাজার : ২৮-০২-১৯৪৭।
৩৫. লিওনার্ড গর্ডন, ব্রাদার্স এগেনেস্ট দ্য রাজ: এ বায়ােগ্রাফি অফ শরৎ অ্যান্ড সুভাষচন্দ্র বােস, ভাইকিং পেঙ্গুইন, নিউদিল্লি, ১৯৯০, পৃ. ৫৭৪-৭৫৷
৩৬. অমৃতবাজার পত্রিকা: ০৬-০৪-১৯৪৭। আরও দেখুন-সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, অবিভক্ত বাংলার শেষ অধ্যায়: ১৯৩৭-৪৭, চতুরঙ্গ : অক্টোবর ১৯৯০। সুরজিৎ দাশগুপ্তও তার ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থে ২৮১ পৃষ্ঠায় এই তথ্য উল্লেখ করেছেন।
৩৭. ১৯৪৭-এর বাংলা ভাগের বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন একটি জরুরি। ভারত ভাগের পাশাপাশি তখন বাংলাকেও ভাগ করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার একটি প্রচার চলছে যে, বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সঠিক ছিল। বাংলাকে ভাগ করা না হলে গােটা বাংলাই পাকিস্তানে ঢুকে যেত এবং বাঙালিদের, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের নিজস্ব পরিচিতি লােপ পেয়ে যেত। শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় এই দুর্ভাগ্য থেকে বাংলাকে বিশেষত বাঙালি হিন্দুদের রক্ষা করেছিলেন ইত্যাদি। পূর্ব পাকিস্তানে ও তার পরের বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকে বাংলা ভাগের পক্ষের যুক্তি হিসেবে সাজানাে হচ্ছে। বাংলা ভাগের বিষয়টির যথার্থ মূল্যায়ন করতে গেলে খােলা চোখে এইসব বক্তব্যের বিচার করা প্রয়ােজন। প্রথমত, অবিভক্ত বাংলার ৯৯ শতাংশ হিন্দু যদি বাংলা ভাগকে সমর্থন করে থাকেন, অর্থাৎ হিন্দুদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও মুসলমানদের জন্য পূর্ববঙ্গ—এই বিভাজনের পক্ষে থেকে থাকেন, তাহলে তাে ওপার বাংলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোনও নৈতিক অধিকারই থাকে না। কিন্তু আসলে কথা হচ্ছে যে, বাংলা ভাগের প্রশ্নে হিন্দুদের মধ্যে কোনও গণভােট নেওয়া হয়নি। যে ‘ওপিনিয়ন পপাল’ হয়েছিল তা ছিল মূলত বাঙালি উচ্চবর্ণীয় ও উচ্চবিত্ত ভদ্রলােকদের মতে, বাংলার ব্যাপক সংখ্যক দলিত ও মধ্যবর্ণীয়দের মতাে নয়। আইনসভায় যখন এই প্রশ্নে ভােটাভুটি হয় তখন যুক্তসভায় বাংলা ভাগকে নাকচ করা হয়। তারপর আলাদাভাবে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার ৭৯ জন সদস্য ভােটে অংশ নেন, কেউ কেউ বিরত থাকেন। এদের মধ্যে ৫৮ জন বাংলাভাগের পক্ষে ও ২১ জন বিপক্ষে ভােট দেন। মুসলমান সদস্যরা সকলেই বাংলাভাগের বিপক্ষে ভােট দেন। কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা কিরণশঙ্কর রায় বাংলা ভাগের পক্ষে ভােট দেননি এবং সে কারণে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। আরও বলার কথা, সেসময় সমগ্র বাংলার জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ ছিল মুসলমান, ৪৫ শতাংশ ছিল হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, প্রধানত হিন্দু। ৫৫ শতাংশ মুসলমান বাকি ৪৫ শতাংশের পরিচিতিকে বিলুপ্ত করে দিতে সমর্থ ছিল এটা নিতান্তই মুখের ভাবনা। বাংলা ভাগ না হলে অবিভক্ত বাংলা পাকিস্তানে ঢুকে যেত এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে থাকত, এই যুক্তিটি যে কতটা অসার তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, অবিভক্ত বাংলার একটি অংশ অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ প্রথম থেকেই পাকিস্তানি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নানাভাবে বিদ্রোহ করেছে এবং অবশেষে আলাদা হয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে, বাংলা অবিভক্ত থাকলে তা পাকিস্তানে ঢুকে যেত, তাহলে এটাও নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, ১৯৭১-র অনেক আগেই বাংলা আলাদা হয়ে যেত, কারণ সেটা ছিল ঐক্যবদ্ধ বাংলা। আজকের বাস্তবতা হচ্ছে যে, ওপার বাংলার ইসলামাবাদের দিকে তাকানাের কোনও প্রশ্ন নেই, কিন্তু এপার বাংলাকে দিল্লির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। একাধিক গবেষকের লেখায় রয়েছে যে, মারােয়াড়ি পুঁজিপতিদের নেতা বিড়লাগােষ্ঠী বাংলা ভাগের প্রস্তাবকে কার্যকর করার জন্য পয়সা ঢেলেছিল। তাদের দিক থেকে এটা অবশ্য স্বাভাবিক। এর কারণ বাংলার হিন্দু ও মুসলমান মধ্যশ্রেণি ঐক্যবদ্ধ হলে এই বানিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থের ক্ষতি হত। ১৯৩৮সালে ঘনশ্যামদাস বিড়লা চেয়েছিলেন যে মুসলমান মন্ত্রীসভা থাকুক, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান কোয়ালিশন যেন না হয়। ১৯৪৭ সালেও তার এই দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত ছিল। গত দু-তিন দশকে দেখা যাচ্ছে যে, ওপার বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার কদর বেড়েছে, কিন্তু এপার বাংলায় ইংরেজির কদর বেশি, যদিও এপার বাংলার ইংরেজি শিক্ষা থেকে শিক্ষার প্রত্যয় চলে গিয়ে সে জায়গা দখল করছে ইংলিশ মিডিয়ামের হীনমন্যতা। বাঙালির আত্মঘােষণার ক্ষমতা যে এখন অনেকটাই স্তিমিত সে বিষয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় ও তার অনুগামীদের যে যথেষ্ট অবদান রয়েছে নিঃসন্দেহে বলা যায়। তার সঙ্গে বােধহয় এটা বলাও অযৌক্তিক হবে না যে, পশ্চিমবঙ্গের ‘ভদ্রলােকরা বাঙালি জাতিসত্তার পুনর্জাগরণ ঘটাবার ক্ষমতা হারিয়েছেন।
৩৮. B.Madhok, ‘Dr Shyamaprasad Mukherjee’, in S. P. Sen (ed.), Distionary of National Biography, Vol.-III, Calcutta, 1974, P.174.
৩৯. অমৃতবাজার পত্রিকা : ২৫-০৪-১৯৪৭।
৪০. দুর্গাদাস সম্পাদিত, সর্দার প্যাটেল করেসপন্ডেন্স ১৯৪৫-৫০, খণ্ড-৪, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২-৫৪।
৪১. সুনীতিকুমার ঘােষ, বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি-রাজনীতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৪।
৪২. নৃপেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পাদিত, দ্য ইন্ডিয়ান অ্যানুয়্যাল রেজিস্টার, খণ্ড-১, ১৯৪৭, কলকাতা, পৃ. ৭৪।
৪৩. লিওনার্ড গর্ডন, ব্রাদার্স এগেনেস্ট দ্য রাজ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮৭।
৪৪. লিওনার্ড মােসলে, দ্য লাস্ট ডেজ অফ দ্য ব্রিটিশ রাজ, জয়কো পাবলিশিং হাউস, মুম্বাই, ১৯৭১, পৃ.১০৭।
৪৫. জয়া চাটার্জি, বেঙ্গল ডিভাইডেড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪১।
৪৬. দ্য স্টেটসম্যান : ০১-০৫-১৯৪৭।