ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটে। জাতীয় জীবনের এই পটভূমিতে রাজা রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ মনীষীগণ এক যুক্তিনিষ্ঠ মুক্ত বুদ্ধির চেতনা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তাদের মননধর্মী ধর্মচেতনা সর্বত্রগামী হয়নি। সমাজের উচ্চ সংস্কৃতিসম্পন্ন শিক্ষিত মহলেই তা আলােড়ন তুলেছিল—এনেছিল নবজাগরণের জোয়ার। সমাজের নিম্নস্তরের জীবন ছিল একই জায়গায় আবদ্ধ। এই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হয় ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে। যুক্তিবাদী একেশ্বরবাদের বিশ্বজনীনতা নয়, আচার সর্বস্ব, জাত-পাতের ভেদাভেদে জীর্ণ পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের বৈদান্তিক রূপকে স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলেন। আমেরিকার চিকাগােয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে (১৮৯৩) হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে নিজ পরিচয় দিতে উঠে বলেছিলেন, “যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমত সহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই স্বীকার করি।” হিন্দু ধর্মের আপামর জনসাধারণ ও ধর্মপ্রবক্তাদের মতামত যাই হােক না কেন স্বামী বিবেকানন্দের হৃদয়ের এই আন্তরিক প্রকাশ সন্দেহাতীত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, চিকাগােয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যােগদানকারী ভারতীয় হিন্দু হিসেবে বিবেকানন্দই কিন্তু একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না। জন হেনরি বুরাে সম্পাদিত ১৬০০ পৃষ্ঠার দুখণ্ডে সম্পূর্ণ ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস পার্লামেন্ট অফ রিলিজিয়ানস্’ নামক ওই ধর্মসভার বিষয়ে সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থটিতে দেখা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থাৎ সিংহল সহ মূল ভারত ভূখণ্ড থেকে মােট ২০ জন গিয়েছিলেন ওই ধর্মর্সভাতে যােগ দিতে। ওই গ্রন্থের প্রতিবেদন অনুসারে যাঁর বক্তব্য শ্ৰোতৃমণ্ডলীতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ জাগিয়েছিল তার নাম সিংহল থেকে আগত এইচ ধর্মপাল। তিনি বলেছিলেন বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে, তার জন্য এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে ২৩ পৃষ্ঠা এবং শ্রোর্তৃমণ্ডলীদের কৌতুহল জাগানাের জন্যে গুরুত্ব দিয়ে বম্বের মণিলাল দ্বিবেদীকে ২০.৫ পৃষ্ঠা দেওয়া হয়েছে, তার বক্তব্যের বিষয় ছিল হিন্দুধর্ম— “Hinduism is a wide term, but at the same time a vague term’ বলে শুরু হয়েছিল তার ভাষণ; মণিলাল দ্বিবেদীর পরে যে ভারতীয়ের ভাষণ সাড়া ফেলেছিল তার নাম প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, তিনি গিয়েছিলেন কলকাতা থেকে, তার বিষয় ছিল ব্রাহ্মধর্ম, তিনি এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছেন ১৯ পৃষ্ঠা জুড়ে এবং সনাতন ধর্ম সম্বন্ধে ভাষণদাতা স্বামী বিবেকানন্দ এই গ্রন্থে ১৫ পৃষ্ঠাব্যাপী স্থান পেয়েছেন।
যেসব পত্রিকাতে ওই ধর্মসভার প্রতিদিনের কর্মসূচি ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হত সেগুলি ছিল—‘দ্য ডেইলি ইন্টার ওসান’, ‘দ্য চিকাগাে হেরাল্ড’, ‘নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন’ ও ‘দ্য নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড’। এইসব পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে মার্কিন বংশােদ্ভূত মুসলমান মহম্মদ আলেকজাণ্ডার ওয়েবের একাধিক বিবাহের পক্ষে সওয়াল যথেষ্ট উত্তেজনা ও বাকি বক্তব্য প্রচুর করতালি জাগিয়েছিল এবং অভিনব গেরুয়া সন্ন্যাসীবেশ পরিহিত তরুণ স্বামী বিবেকানন্দের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষক ও ‘ভগিনী’ বলে মার্কিন মহিলাদের প্রতি সম্ভাষণ মার্কিন নারীকুলকে বিশেষ অভিভূত করেছিল। স্বামীজীর সন্ন্যাসী পরিচয়টাই ছিল সকলের কাছে সবচেয়ে কৌতুহলােদ্দীপক ও আকর্ষণীয়। কী সুদর্শন কী সুবক্তা এই নবীন সন্ন্যাসী! একজন সন্ন্যাসীর বা ধর্মগুরুর কাছে আমাদের কী প্রত্যাশা ? অবশ্যই আধ্যাত্মিক উন্নতির পথনির্দেশ তথা ধর্মীয় শিক্ষা।
যাইহােক, সারাজীবন জাতিকে স্বামী বিবেকানন্দ অন্য ধর্মীয় মতবাদকে শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিতে দেখার শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। নিজ ধর্মের প্রতি অবিচল আস্থা, সুদৃঢ় বিশ্বাসই মানুষকে পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তােলে। দুঃখের বিষয়, স্বামীজীর এই শিক্ষার মর্ম আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হলাম কই? আজও আমরা পরধর্ম বিশেষ করে ইসলামকে একটা ‘বহিরাগত উৎপাত’ বলেই মনে করে থাকি। ইসলামের অসাধারণ বৈপ্লবিক গুরুত্ব আর তার বৃহত্তর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্বন্ধে আমাদের অধিকাংশেরই সামান্য ধারণাও নেই, তার সহৃদয় অনুশীলন তাে দূরের কথা। অথচ আমাদের কল্যাণের স্বার্থে এমন বিরূপ মনােভাবের অপনােদন জরুরী।
বিশ্বখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ও বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, “মহাপুরুষ মােহাম্মদের অনুশাসিত ইসলামের আকস্মিক উত্থান এবং নাটকীয় বিস্তৃতি মানবজাতির সভ্যতার ইতিহাসে একটা বিরাট চমকপ্রদ অধ্যায়। নিতান্ত নির্লিপ্ত ও নৈর্ব্যক্তিক মন নিয়ে মানব ইতিহাসের এই অধ্যায়টি পাঠ করলে দ্বন্দ্বসঙ্কুল বর্তমান ভারতের জন্য অনেক আশার আলাের সন্ধান পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক দিক থেকে এর অনুশীলনের মূল্য আপনার গুরুত্বেই অধিক; তাছাড়া একটা সাধারণ জ্ঞানানুসন্ধিৎসা নিয়ে পড়লেও যে কেউই এর থেকে প্রভুত উপকার লাভ করতে পারবে। কিন্তু ইসলাম ইতিহাসে তথা মানব সভ্যতার সংস্কৃতিতে কী দিয়েছে, তা বিশেষ করে ভারতীয় হিন্দুদের যথাযথভাবে জানা, পারস্পরিক বিদ্বেষ-বিষ জর্জরিত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে একটা বিরাট আশার এবং অশেষ মঙ্গলেরই ইঙ্গিত দেয়।…
এ (ইসলামের বিজয়) যেন এক ভীষণ ঐন্দ্রজালিক কাণ্ড! কীভাবে আজগুবি ব্যাপার সম্ভব হল এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে গিয়ে ঐতিহাসিকেরা আজও হতভম্ব হয়ে যান। আজকে জগতের সত্যিকার শিক্ষিত লােকেরা ‘ইসলামের উত্থান শান্ত ও সহিষ্ণু লােকদের উপর গোঁড়ামির জয়’, এই ঘৃণ্য অভিমত পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইসলামের এই বিজয় অভিযানের কারণ ছিল অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে লুকিয়ে। গ্রীস, রােম, পারস্য, চীন, এমনকী ভারতবর্ষেরও প্রাচীন সভ্যতায় ঘুণ ধরে যাওয়ায় বিপুল জনসাধারণ যে চরমতম দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হল তা থেকে বাঁচিয়ে ইসলাম এক আলাে ঝলকিত দেশের নির্দেশ তাদের দিতে পেরেছিল বলেই তার এই অসাধারণ বিস্তার সম্ভব হয়েছিল।”১
বিশ্ব সংস্কৃতিতে ইসলামের অবদানের কথা তথা বিশ্ব ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে ইসলামের এই অনন্য জীবনীশক্তি সম্বন্ধে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন বলেই স্বামী বিবেকানন্দ ইসলামের গণতান্ত্রিক ও বলিষ্ঠ মনােবলের প্রশংসা করতেন। তিনি হিন্দু জাতির মধ্যে এই মনােবল সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ মহান ভারত গড়বার লক্ষ্যে ইসলামকে তাই যথাযােগ্য মর্যাদা না দিয়ে পারেননি। তাঁর লেখায় ও বক্তৃতায় ইসলাম, কোরান, মুসলমান ও মুসলিম সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ বার বার এসেছে নানা আঙ্গিকে। যখনই তিনি ধর্মীয় আলােচনা করেছেন তখনই বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে ইসলাম প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। ইসলাম ধর্মের মহৎ গুণগুলি বারবার তিনি উল্লেখ করেছেন। বিশ্ব ইতিহাসে ইসলাম ও তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক হজরত মােহাম্মদের (সঃ) স্থান এবং ভারতবর্ষে মুসলিম-শাসন সম্বন্ধে তিনি বহু কথা বলেছেন। ব্যক্তি জীবনেও বহু মুসলমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন : “স্বামীজীর লেখায় বা কথায় ইসলাম প্রসঙ্গ আপেক্ষিকভাবে মােটেই কম নয়। কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেব, স্বামীজী মসীজীবী ছিলেন না বলে, যে কোন বিষয়ে রাশি রাশি লেখার প্রয়ােজন বােধ করতেন না। তাঁর রচনাবলী বলে পরিচিত বস্তুর বড় অংশ তার বক্তৃতা ও ঘরােয়া আলাপের নােট। বলাবাহুল্য এমন সংকলন সর্বাত্মক হতে পারে না। ঘরােয়া আলাপের ক্ষেত্রে নােট-লেখক তাঁর ব্যক্তিগত রুচি অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করে তাকে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেকালের হিন্দুদের মুসলমান-ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল না বলে তারা স্বামীজী সে প্রসঙ্গ তুললেও, সেসব লিখে রাখার উৎসাহ দেখাননি, কিন্তু স্বামীজীর পাশ্চাত্য শিষ্যরা অপরপক্ষে ব্যাপকতর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি দেখতে সমর্থ ছিলেন বলে তাকে যথােচিত গুরুত্ব দিয়েছেন।২
১৯২১-এর ৩০শে জানুয়ারী বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মােৎসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন গান্ধীজী। সেই উৎসবে গান্ধীজীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন খিলাফৎ আন্দোলনের প্রধান হােতা বিখ্যাত বিপ্লবী মাওলানা মহম্মদ আলি। গান্ধীজী স্বামীজীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবার পর মাওলানা মহম্মদ আলি উচ্ছ্বসিত ভাষায় স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছিলেন।৩ এতেই প্রমাণ হয় স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু সাধক পুরুষদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন বটে কিন্তু তার উদার ধর্ম দর্শনের প্রভাব তখনকার ভারতীয় মুসলমান সমাজে কম পরিব্যাপ্ত ছিল না। সেই জন্যই মাওলানা মহম্মদ আলির মত প্রখ্যাত মুসলমান নেতারা তাঁকে ভারতের অন্যতম নের্তৃস্থানীয় পুরুষ বলে স্বীকার করতেন।
এর প্রধান কারণ ছিল এই যে, স্বামী বিবেকানন্দ ইসলাম ধর্ম ও সাধারণভাবে মুসলমান সমাজকে ভারতের বাইরের কোনাে বস্তু হিসাবে কখনও চিন্তা করতেন না। এ বিষয়ে স্বামীজী নিজের ধারণা পরিষ্কার করে বলেছিলেন : “যখনই কোনাে ব্যক্তি উঠিয়া বলে, আমার ধর্মই সত্য ধর্ম, আমার অবতারই একমাত্র সত্য অবতার, সে ব্যক্তির কথা কখনই ঠিক নহে, সে ধর্মের ‘ক’ পর্যন্ত জানে না। ধর্ম কেবল কথার কথা বা মতামত নহে অথবা অপরের সিদ্ধান্তে কেবল বুদ্ধির সায় দেওয়া নহে। ধর্মের অর্থ প্রাণে প্রাণে সত্য উপলব্ধি করা; ধর্মের অর্থ ঈশ্বরকে সাক্ষভাবে স্পর্শ করা, প্রাণে অনুভব করা, উপলব্ধি করা যে, আমি আত্ম-স্বরূপ আর সেই অনন্ত পরমাত্মা এবং তাহার সকল অবতারের সহিত আমার একটা অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রহিয়াছে। …তােমরা সকল দেশের সকল যুগের ধর্মপ্রাণ মহান নরনারীগণকে চিনিতে শিখ আর ইহাও লক্ষ্য করিও বাস্তবিক তাহাদের পরস্পরের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নাই।”৪
স্বামী বিবেকানন্দ ধর্ম-পুরুষদের এবং ধার্মিকদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। কাউকেই তিনি ছােট বা খাটো করে দেখেননি। ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে মানুষ ও মনুষ্যত্বকে হনন করার ঘাের বিরােধী ছিলেন তিনি। ‘ধর্ম’ নামক প্রবন্ধে তিনি সেই শ্রদ্ধাপূর্ণ কথা ব্যক্ত করেছেন : “বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কখনও বিরােধ ছিল না, অথচ প্রত্যেক ধর্মই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্য-সাধন করিয়া গিয়াছে—সেইজন্যই এখানে প্রকৃত ধর্মভাব এখনও জাগ্রত।…সকল ধর্মে ভালাে ভালাে লােক আছে, এই কারণেই সেইসব ধর্ম লােকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া থাকে, সুতরাং ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়।”৫ আসলে ধর্মের ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাগ নিয়ে বাড়াবাড়ি বা মাতামাতি না করে মূলত ‘দার্শনিক’ ভাগকে গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছেন বলেই স্বামীজী এমন সর্বধর্মসমন্বয়ী মানসিকতা পােষণ করতে পেরেছেন এবং এর ফলে পক্ষান্তরে তার প্রখর মানবপ্রেমী ও মানবতাবাদী মানসিকতার সুচারু প্রকাশ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
ধর্মীয় গোঁড়ামির উগ্রতা একসময় মানুষকে ধর্মোন্মত্ত করে তােলে এবং তার পরিণতি হয় ভয়াবহ ও করুণ। ধর্ম ভালাে, কিন্তু ধর্মোন্মত্ততা কখনওই ভালাে নয়। ধর্মোন্মত্ত মানুষ এই পৃথিবীকে চিরকাল হিংসায় পূর্ণ করেছে, নরশােণিতে সিক্ত করেছে, সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে
এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করেছে। তাই স্বামীজী ধর্মোন্মত্ততা দূর করে সহৃদয়তার সঙ্গে নিজের ধর্মকে পালন করে অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীকে মান্য ও সম্মান প্রদর্শনের উপর জোর দিয়েছেন। আর তার দৃঢ় বিশ্বাস এরই ফলে প্রতিষ্ঠিত হবে সার্বিক মানবপ্রেম ও মানবকল্যাণ। এইজন্য ধর্মে ধর্মে পার্থক্য থাকলেও উৎস ও ভগবৎগত কোনও পার্থক্য নেই বলে তিনি মনে করতেন। কারণ, উপনিষদে আছে—‘একমেবাদ্বিতীয়াম দ্বিতীয়া নাস্তি’ এবং ‘কঠোপনিষদে’ নিরাকার ঈশ্বরের কথা ব্যক্ত হয়েছে। আর ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মােহম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)’, যার অর্থ—আল্লাহই একমাত্র উপাস্য, হজরত মােহাম্মদ (সঃ) তারই প্রেরিত রসুল (বার্তাবাহক)। স্বামীজী তাই ধর্ম, শাস্ত্র ও ঋষি সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে বিশ্বজনীন ধর্মের আদর্শ, গীতাতত্ত্ব, ভারতীয় মহাপুরুষ, যিশুখ্রিস্ট, হজরত মােহাম্মদ (সঃ) প্রভৃতিকে নিয়ে আলােচনা করেছেন। পাশ্চাত্যে বিভিন্ন সম্মেলনে তিনি উদারতা ও সমন্বয়ের ভাবাদর্শ ব্যক্ত করেছেন এই বলে : “একটি ধর্ম যদি সত্য হয়, তবে সবগুলিই সত্য হইবে।…সেইজন্য হিন্দুধর্ম যতটা আমার ততটা তােমাদেরও।”
উপরােক্ত মন্তব্যের ভাবসম্প্রসারণ করে তিনি বলেন : “আমরা জানি নিম্নতম বস্তু হইতে উচ্চতম অদ্বৈতবাদ পর্যন্ত, সকল ধর্মই সমভাবে অসীমকে উপলব্ধি এবং অনুভব করিবার বিভিন্ন প্রচেষ্টামাত্র। সেই জন্য এই সকল কুসুম চয়ন করিয়া, প্রেমের সূত্রে একত্র গ্রথিত করিয়া পূজার জন্য একটি অপূর্ব স্তবক রচনা করি।” মহাপুরুষ-সিদ্ধপুরুষ যখন ঈশ্বরের নৈকট্য পেয়ে যান, তখন তার মধ্যে আর ধর্মাচ্ছাদন বড় হয়ে দেখা দেয় না—সব ধর্মের মূলে বা পরিণতিতে তারা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেন; দ্বন্দ্ব-কলহ-বিবাদ শুধু ধর্মান্ধ ধর্মোন্মত্তদের। স্বামীজী তাই হজরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে ‘হজরত মহম্মদ’ প্রবন্ধে নানামুখী আলােচনায় ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। আমেরিকা বাসকালে হজরত মােহাম্মদ সম্পর্কে যে সমস্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা সংকলন’-এ তা বাংলায় হজরত মহম্মদ’ শিরােনামে সংক্ষেপে প্রকাশিত হয়। সেখানে হজরত মােহাম্মদ (সঃ), ইসলাম ধর্ম এবং প্রসঙ্গত অন্য ধর্মকথা আলােচিত হয়েছে। শুরুতেই স্বামীজী বলেছেন সৎ ও প্রিয়দর্শন যুবক হজরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিত্তবান বিধবা খাদিজা তাঁকে বিয়ে করেন। প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়ে তিনি রােম-পারস্যে আধিপত্য বিস্তার করেন। পাপাচরণ, পৌত্তলিকতা, উপাসনার নামে ভণ্ডামী, কুসংস্কার, নরবলি প্রভৃতি দেখে ব্যথিতচিত্তে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে নিজেকে নিয়ােজিত করেন।
হজরত মােহাম্মদের (সঃ) সাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে স্বামীজী খুবই গুরুত্ব দিতেন। আমেরিকায় বক্তৃতাকালে (৩ এপ্রিল ১৯০০) হজরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে তিনি বলেন: “আমাদের দৃষ্টি সেই মহাপুরুষের (মহম্মদের) দিকে নিপতিত হয়, যিনি জগতে সাম্যভাবের বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন। তােমরা জিজ্ঞাসা করিতে পার: মহম্মদের ধর্মে আবার ভালাে কি থাকিতে পারে? তাহার ধর্মে নিশ্চয়ই কিছু ভালাে আছে—যদি না থাকিত, তবে উহা এতদিন বাঁচিয়া রহিয়াছে কিরূপে? যাহা ভাল, তাহাই স্থায়ী হয়, অন্য সমুদয়ের বিনাশ হইলেও উহার বিনাশ হয় না। যাহা কিছু ভাল তাহাই সবল ও দৃঢ়, সুতরাং তাহা স্থায়ী হয়। এই পৃথিবীতেই বা অপবিত্র ব্যক্তির জীবন কতদিন? পবিত্রচিত্ত সাধুর প্রভাব কি তাহা অপেক্ষা বেশি নয়? নিশ্চয়ই: কারণ পবিত্রতাই বল, সাধুতাই বল। সুতরাং মহম্মদের ধর্মে যদি কিছুই ভালাে না থাকিত তবে উহা এতদিন বঁচিয়া আছে কিরূপে? মুসলমান ধর্মে যথেষ্ট ভালাে জিনিস আছে। মহম্মদ সাম্যবাদের আচার্য—তিনি মানবজাতির ভ্রাতৃভাব— সকল মুসলমানের ভ্ৰাতৃভাবের প্রচারক, ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ।
সুতরাং আমরা দেখিতেছি, জগতের প্রত্যেক অবতার, প্রত্যেক ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ..বিশেষ সত্যের বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন। যদি তােমরা প্রথম সেই বাণী শ্রবণ কর এবং পরে আচার্যের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত কর, দেখিবে ঐ সত্যের আলােকে তাহার সমগ্র জীবনটি ব্যাখ্যাত হইতেছে। অজ্ঞ মূর্খেরা নানাবিধ মত-মতান্তর কল্পনা করিয়া থাকে, আর নিজ নিজ মানসিক উন্নতি অনুযায়ী, নিজ নিজ ভাবানুযায়ী ব্যাখ্যা আবিষ্কার করিয়া এই সকল মহাপুরুষে তাহা আরােপ করিয়া থাকে। তাহাদের উপদেশসমূহ লইয়া তাহারা নিজেদের মতানুযায়ী ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করিয়া থাকে। কিন্তু প্রত্যেক মহান আচার্যের জীবনই তাহার বাণীর একমাত্র ভাষ্য…।”৬
হজরত মােহাম্মদের (সঃ) ধর্ম নিয়ে যেমন পাশ্চাত্যের লােক প্রশ্ন তুলেছিল, তেমনি প্রশ্ন তুলেছিল তার বহু বিবাহ নিয়ে। স্বামীজী ধর্ম সংস্কারমুক্ত উদারভাবাপন্ন মন নিয়ে এক্ষেত্রে হজরত মােহাম্মদ (সঃ) ও ইসলামধর্মকে সমীক্ষা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন কুসংস্কার ও গোঁড়ামিযুক্ত মন দিয়ে কাউকে দেখলে যথার্থরূপে দেখা হয় না। হজরত মােহাম্মদের (সঃ) মতাে বার্তাবহগণ নিশ্চয়ই ঈশ্বরের কাছ থেকে আসেন, তা না হলে তিনি মহান হতে পারতেন না। স্বামীজী সান ফ্রান্সিসকোতে ২৫ মার্চ ১৯০০ সালের একটি বক্তৃতায় খুব চাঁছাছােলা ভাষায় হজরত মােহাম্মদের (সঃ) সমালােচকদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন : “..আপনারা খুবই কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বশবর্তী! এই বার্তাবাহকগণ নিশ্চয়ই ঈশ্বরের নিকট হইতে আসেন, নতুবা তাহারা কিভাবে এই মহান হইতে পরিয়াছিলেন? …পরবর্তী জীবনে মহম্মদ অনেক পত্নী গ্রহণ করেন। মহাপুরুষেরা প্রত্যেকে দুইশত পত্নী গ্রহণ করিতে পারেন। আপনাদের (আমেরিকান) মতাে দৈত্যকে এক পত্নী গ্রহণ করিতেও আমি অনুমতি দিব না। মহাপুরুষদের চরিত্র রহস্যাবৃত। তাঁদের কার্যধারা দুৰ্জ্জেয়। তাঁহাদিগকে বিচার করিতে যাওয়া আমাদের অনুচিত। খ্রিস্ট বিচার করিতে পারেন মহম্মদকে। আপনি আমি কে? —শিশুমাত্র। এই সকল মহাপুরুষকে আমরা কি বুঝিব?”৭ দুর্জনেরা সর্বদাই দোষত্রুটি খোঁজে তিনি উপদেশ দিয়েছেন এইভাবে : “..মাছি ক্ষত অন্বেষণ করে, আর মধুমক্ষিকা শুধু ফুলের মধুর জন্য আসে। মক্ষিকাবৃত্তি অনুসরণ করবেন না, মধুমক্ষিকার পথ ধরুন।”৮ স্বামীজী বলেছেন, কোনও কিছু হঠাৎ বা সব সময় অনায়াসে হয় না। মহৎ কাজ করতে বিরাট প্রস্তুতির প্রয়ােজন। দিন-রাত প্রার্থনার পর হজরত মােহাম্মদ (সঃ) স্বপ্নে অনেক কিছু দর্শন করতেন। জিব্রাইল স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে বলেন, হজরত মােহাম্মদই (সঃ) সত্যের বার্তাবহ যিশু-মুসা ও অন্যান্য নবী বা প্রেরিত পুরুষদের বাণী লুপ্ত হয়ে যাবে। তাই ঈশ্বর হজরত মােহাম্মদকেই (সঃ) ধর্মপ্রচারের আদেশ দেন। তখন খ্রিস্টানরা যিশুর নামে রাজনীতি এবং পারসিকরা দ্বৈতভাব প্রচার করেছেন দেখে হজরত মােহাম্মদ (সঃ) বলেন— “আমাদের ঈশ্বর এক। যাহা কিছু আছে, সবকিছুরই প্রভু তিনি। ঈশ্বরের সঙ্গে অন্য কাহারও তুলনা হয় না।”৯ হজরত মােহাম্মদ (সঃ) এই মত প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে অনেক নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। অনেক ত্যাগ ও পরিশ্রমে তাঁরই নেতৃত্বে একদিন সমগ্র আরবজাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লার নামে হজরত মােহাম্মদের (সঃ) ধর্ম জগৎ প্লাবিত করে।
বিবেকানন্দের এসব উক্তি অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে মান্য করতে হয়। সহৃদয়শীল ছাড়া হৃদয়ের ভাব উপলব্ধি করতে পারে না যেমন, ঠিক তেমনি ধর্মীয় ভাবে পূর্ণতা ছাড়া অন্য ধর্মগুরুকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যায় না। আর যা উপলব্ধি নয়, তা নিয়ে বিচারবিশ্লেষণেও সত্যতা থাকেনা, যথার্থও হয় না। বিবেকানন্দের এই উক্তি শুধু হজরত মােহাম্মদ (সঃ) কেন যে কোনও ধর্মগুরু সম্পর্কে সমানভাবে প্রযােজ্য। ‘হজরত মহম্মদ’ শীর্ষক বক্তৃতায় বিবেকানন্দ আরও বলেছিলেন : “মহম্মদের ধর্ম আবির্ভূত হয় জনসাধারণের জন্য বার্তারূপে।…তাঁহার প্রথম বাণী ছিল—‘সাম্য’।…একমাত্র ধর্ম আছে—তাহা প্রেম। জাতি বর্ণ বা অন্য কিছুর প্রশ্ন নেই। এই সাম্যভাবে যােগ দাও। সেই কার্যে পরিণত সাম্যই জয়যুক্ত হইল। …সেই মহতী বাণী ছিল খুব সহজ সরল : স্বর্গ ও মর্তের স্রষ্টা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হও। শূন্য হইতে তিনি সব কিছু সৃষ্টি করিয়াছেন। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিও না।”
এই বক্তৃতাতে স্বামী বিবেকানন্দ আচারের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের অত্যধিক সরলতার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন এক ব্যক্তির পিছনে অসংখ্য ব্যক্তি সারবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়ে—সাম্যের এ এক বড় দৃষ্টান্ত : “মসজিদগুলিতে..সঙ্গীত, চিত্র ও প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ। এককোণে একটি বেদী; তাহার উপর কোরান রক্ষিত হয়। সব লােক সারিবদ্ধ হইয়া দাঁড়ায়। কোন পুরােহিত, যাজক বা বিশপ নাই। …যে নামাজ পড়ে (পড়ায়), সেও শ্ৰোতৃমণ্ডলীর একপার্শ্বে দণ্ডায়মান থাকিবে।”১০
স্বামীজী হজরত মােহাম্মদের (সঃ) জীবনের ঐতিহাসিকতা নিয়ে নিঃসংশয় ছিলেন। এ বিষয়ে স্বামীজীর কথা : “ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবল বুদ্ধ ও মহম্মদের ভাগ্যেই ‘শত্রু মিত্র উভয়’ লাভই ঘটিয়াছিল, সুতরাং তাহাদের জীবনের ঐতিহাসিক অংশে সন্দেহের লেশ মাত্র নাই। আর শ্রীকৃষ্ণ, তিনি তাে সকলের চেয়ে বেশি অস্পষ্ট…।”১১
ইসলাম ধর্মে এবং মুসলমানের ভাবানুভূতিতে হজরত মােহাম্মদের (সঃ) স্থান যে কত গভীরে সে বিষয়েও স্বামীজী সম্যক অবগত ছিলেন। হজরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে তার বক্তব্য : “যদি কেহ হজরত মহম্মদকে বাদ দিয়া ইসলাম ধর্মের তত্ত্বগুলি প্রচার করিতে অগ্রসর হয়, তবে মুসলমানগণও তাহাকে সহ্য করিবে না। কারণ বাস্তব উদাহরণ-মহাপুরুষ ও পয়গম্বরের জীবনকাহিনীই তত্ত্বাংশকে সর্বতােভাবে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।”১২ এইসব দৃষ্টান্ত থেকে হজরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রতি তথা ইসলামের ‘আচার্যের’ প্রতি স্বামীজীর শ্রদ্ধাপূর্ণ মনােভাবকে আমরা লক্ষ্য করতে পারি। তাছাড়া পাশ্চাত্যে যেখানে ইসলাম ধর্ম ও হজরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কেনানা নেতিবাচক ও সংশয় উদ্রেককারী প্রশ্ন উঠেছিল, সেখানে স্বামীজী ইসলামের প্রতি তাদের ভ্রান্ত ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। উপরন্তু আরব মরুতে ইসলামের উদয় ও তার প্রচারকের প্রভাব সম্পর্কে উচিত মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি। স্বামীজীর কথায়: “জম্বু দ্বীপের তাড়ায় ইয়ােরােপের বর্বর আর ইয়ােরােপের ধ্বংসাবশিষ্ট রােমক-গ্রীক মিলে এক অভিন্ন জাতির সৃষ্টি হলাে; এ সময়ে ইহুদীজাতি রােমের দ্বারা বিজিত ও বিতাড়িত ইয়ে ইয়ােরােপময় ছড়িয়ে পড়ল, সঙ্গে তাদের নতুন ধর্ম ক্রিশ্চানীও ছড়িয়ে পড়ল।…
এদিকে আবার আরব মরুভূমে মুসলমানি ধর্মের উদয় হােলাে। বন্য পশুপ্ৰায় আরব এক মহাপুরুষের প্রেরণা বলে অদম্য তেজে, অনাহত বলে পৃথিবীর উপর আঘাত করলে। পশ্চিম-পূর্ব দু’প্রান্ত হতে সে তরঙ্গ ইওরােপে প্রবেশ করলে। …জম্বুদ্বীপের মাঝখান হতে সেলজুল তাতার নামক অসুর জাতি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে আশিয়া-মাইনর প্রভৃতি স্থান দখল করে ফেললে।”১৩
এ প্রসঙ্গে আর একটি ছােট্ট কথা যুক্ত করা উচিত। শুধু হজরত মােহাম্মদ (সঃ) নয়, ইসলামপন্থী সাধক-সাধিকার বিষয়েও তিনি শ্রদ্ধাশীল ও উৎসাহী ছিলেন। ১৮৮৫ সালের ১১ জুলাই-এর দিনলিপিতে রাবেয়া নামক এক ফারসি কবিতা (সম্ভবত বঙ্গানুবাদ) পাওয়া যায়। হজরত রাবেয়া (রহঃ) ইসলামের নিষ্ঠাবান সাধিকা ছিলেন। ১৪ কবিতাটি ইসলাম সাধক-সাধিকা সম্পর্কে তার আগ্রহের চিহ্ন বহন করে।
ইসলামের সাম্যের আদর্শ স্বামীজীকে খুবই নাড়া দিয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দ ইসলাম ধর্মকে সম্মান রেখে বলেছেন হজরত মােহাম্মদের (সঃ) বাণী মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। তিনি বলেছেন, হজরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রথম বাণী হল সাম্য। স্বর্গ-মর্ত্যের স্রষ্টা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখা সেই সাম্যের প্রধান সােপান। ইসলামের সাম্যবাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামীজী বলেছিলেন : “মহম্মদ নিজ জীবনের দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইয়া গেলেন যে, মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ সাম্য ও ভ্রাতৃভাব থাকা উচিত। উহার মধ্যে বিভিন্ন জাতি, মতামত, বর্ণ বা লিঙ্গ ভেদ কিছু থাকিবে না। তুরস্কের সুলতান আফ্রিকার বাজার হইতে একজন নিগ্রোকে কিনিয়া তাহাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া তুরস্কে আনিতে পারেন। কিন্তু সে যদি মুসলমান হয়, আর যদি তাহার উপযুক্ত গুণ থাকে, তবে সে সুলতানের কন্যাকেও বিবাহ করিতে পারে। মুসলমানদের এই উদার ভাবের সহিত এদেশে (আমেরিকায়) নিগ্রো ও রেড ইণ্ডিয়ানদের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা হয় তুলনা করিয়া দেখ। আর হিন্দুরা কী করিয়া থাকে? যদি তােমাদের একজন মিশনারি হঠাৎ কোনও গোঁড়া হিন্দুর খাদ্য চুঁইয়া ফেলে, সে তৎক্ষণাৎ উহা ফেলিয় দিবে। আমাদের এত উচ্চ দর্শনশাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও কার্যের সময়, আচরণের সময়, আমরা কিরূপ দুর্বলতার পরিচয় দিয়া থাকি তাহা লক্ষ্য করিও। কিন্তু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় এইখানে মুসলমানদের মহত্ত্বজাতি বা বর্ণ বিচার না করিয়া সকলের প্রতি সাম্য ভাব প্রদর্শন।১৫
এ প্রসঙ্গে তার আরও একটি উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক : “এ দেশীয় (আমেরিকা) একজন রেড ইণ্ডিয়ান যদি মুসলমান হয় তাহা হইলে তুরস্কের সুলতানও তাহার সহিত একত্র ভােজন করিতে কুণ্ঠিত হইবেন না এবং সে বুদ্ধিমান হইলে যে কোন উচ্চপদ লাভে বঞ্চিত হইবে।”১৬ সাম্য প্রসঙ্গে মুসলমানদের মহত্ত্বকে তিনি আরও ওজস্বী ভাষায় স্বীকার করেছেন। এই বলে : “ইসলাম ধর্ম অন্তর্গত সকল ব্যক্তিকে সমান চক্ষে দেখিয়া থাকে। …এইখানেই মুসলমান ধর্মের নিজস্ব বিশেষ মহত্ত্ব।”১৭ ইসলামের এই সাম্য মহত্ত্বের স্বীকৃতি তিনি প্রায় একই ভাষাতে অন্যত্রও জানিয়েছেন।
বিবেকানন্দের ইসলাম প্রীতি সম্পর্কে ভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন, “ইসলামের নাম উচ্চারণমাত্রে আচার্যদেবের মনে যে চিত্রের উদয় হইত, তাহা উক্ত ধর্মাবলম্বীদের সাগ্রহ ভ্রাতৃত্ববােধের চিত্র—যাহা সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতা দান করিয়াছে এবং উচ্চ অবস্থার মানুষদের মনে গণতান্ত্রিক চেতনা আনিয়া দিয়াছে।”১৮
বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ ইসলামের মহত্ত্ব স্বীকার করেছেন। তিনি নানাভাবে ইসলামধর্ম সম্বন্ধে প্রচারিত ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তার একটি ইসলাম ধর্মের মতে নাকি নারীর আত্মা নেই। বিবেকানন্দ লণ্ডনে এক আলােচনা সভায় বলেন, “এই প্রকার যে উক্তি আমাদের কাছে করা হয়েছে, তা ভ্রান্ত। আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি, খ্রীস্টানদের মধ্যে এই ভ্রান্তি বহুদিনের, এবং তারা এই ভ্রমটি ধরে রাখা পছন্দ করেন। মানুষের এই অদ্ভুত স্বভাব—সে যাকে পছন্দ করে না, তার সম্বন্ধে খুব খারাপ কিছু প্রচার করতে উৎসুক।” তিনি আরও বলেন : “আমি মুসলমান নই, কিন্তু ঐ ধর্ম অনুশীলনের সুযােগ আমার হয়েছে। আমি দেখেছি, কোরানে এমন একটি উক্তিও নেই যার অর্থ নারীর আত্মা নেই। বস্তুতঃ কোরান বলে, নারীর আত্মা আছে।”১৯ তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, মুসলমান নারীর এমন কতকগুলি অধিকার আছে, প্রগতিশীল মার্কিন নারীরাও তা থেকে বঞ্চিত।
আনুষ্ঠানিকতা বর্জনের ব্যাপারে প্রােটেস্টান্টরা যে অগ্রাধিকার দাবি করে, স্বামী বিবেকানন্দ তাকে স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। এ ব্যাপারে ইসলামের কৃতিত্বই তার কাছে অধিক স্বীকার্য ছিল : “পৌরােহিত্যের ভাব একেবারে ভূমিসাৎ করে দেওয়া—সেটা মুসলমান ধর্মই একমাত্র করেছে। প্রার্থনার ব্যাপারে যিনি নেতৃত্ব করেন, প্রার্থনাকারীদের দিকে তার পিছন ফিরানাে থাকে, এবং বেদী থেকে একমাত্র কোরানই পাঠ করা চলতে পারে। প্রােটেস্টান্ট ধর্ম এই ভাবটিই আনবার চেষ্টা করেছে।”২০
বিবেকানন্দের সাহসিক সত্যদর্শন এদেশের ইংরেজি শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত ইতিহাসবােধ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে কতখানি পৃথক ছিল তা দেখা যায়, তরবারি যােগে খ্রীস্টানদের ধর্মপ্রচার ও তরবারিযােগে মুসলমানদের ধর্মপ্রচারের মধ্যে পার্থক্য করার ব্যাপারে। প্রচারশীল খ্রীস্টান ধর্মের নিতান্ত সংকীর্ণতার পাশে প্রচারশীল ইসলামের আপেক্ষিক উদারতার দিকটি তিনি যেরূপ তীক্ষভাবে তুলে ধরেছেন তা একদিকে যেমন বিস্ময়কর, অন্যদিকে তার ইসলাম প্রীতির পরিচায়ক।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ইতিহাস-সচেতক ব্যক্তি। মুসলমানগণ কর্তৃক আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী পােড়ানাে যে একেবারে ভ্রান্ত এবং খ্রিস্টানরাই যে এই কাজ করেছিল, তা তিনি অবহিত ছিলেন : “এই মিশরেই সে আলেকজান্দ্রিয়ানগর, সেখানকার বিদ্যালয়, পুস্তকাগার, বিদ্বজ্জন জগৎপ্রসিদ্ধ হয়েছিল। সে আলেকজান্দ্রিয়া মূখ গোঁড়া-ইতর ক্রিশ্চানদের হাতে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল—পুস্তকালয় ভস্মরাশি হল—বিদ্যার সর্বনাশ হল।”২১
সেই সময়ের খ্রীষ্টানদের এই ধ্বংসাত্মক তথা আক্রমণাত্মক মনােভাবের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে। কার্কপ্যাট্রিক সেল তার ‘দ্য কঙ্কোয়েস্ট অফ প্যারাডাইস’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, কলম্বাসের সমুদ্রাভিযানের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটা অন্তিম ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ করার জন্য স্বর্ণের সন্ধান ও সংগ্রহ। আর কার্কপ্যাট্রিক সেল-এর এই তত্ত্বের সূত্র স্বয়ং কলম্বাসের আত্মজীবনী যা ১৮৯২ সালে পুনর্মুদ্রিত হয়, কিন্তু তার পরে আর হয়নি। কেন সেই আত্মজীবনী আর প্রকাশিত হয়নি তার কারণ অনুমান করা যেতে পারে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে স্বামী বিবেকানন্দ কি কলম্বাসের তথা ক্যাথলিক রাণি ইসাবেলার তীব্র মুসলিম বিদ্বেষের কথা জানতেন? এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে হয়তাে তারাই পারবেন যাঁরা বিশেষভাবে বিবেকানন্দ গবেষক। তবে তেমন গবেষক না হয়েও দেখতে পাচ্ছি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারী মার্কিন মুলুকের একটি গির্জায় ‘বিশ্বজনীন ধর্মলাভের উপায়’ শীর্ষক ভাষণে বিবেকানন্দ বলেন, ‘খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীগণ মুসলমান ধর্মকে যত বেশি ঘৃণা করে, এরূপ আর কোনও ধর্মকেই করে না। আর এই উচ্চারণের ৯৬ বছর পরে স্যামুয়েল হান্টিংটন ‘দ্য ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেসন’ গ্রন্থে এটাই প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, খ্রিস্টান সভ্যতা এবং মুসলিম সভ্যতার সংঘাতই বিগত সহস্রাব্দের প্রকৃত ইতিহাস। হান্টিংটন-বর্ণিত প্রকৃত ইতিহাস একপাশে রেখে যদি আমরা স্বামীজীর ওই ভাষণটি আরও খানিকটা শুনি তাহলে শুনব, খ্রিস্টানরা মনে করেন যে, ইসলামের মতাে নিকৃষ্ট ধর্ম আর কখনও হয়নি। কিন্তু দেখুন, যখনই একজন লােক মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিল, অমনি সমগ্র ইসলামী সমাজ তাহাকে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে ভ্রাতা বলিয়া বক্ষে ধারণ করিল। এরূপ আর কোনও ধর্ম করে না।…এদেশে আমি এ পর্যন্ত এমন একটিও গির্জা দেখি নাই যেখানে শ্বেতকায় ব্যক্তি ও নিগ্রো পাশাপাশি নতজানু হইয়া প্রার্থনা করিতে পারে। এই কথাটি একবার ভাবিয়া দেখুন!”২২
স্বামী বিবেকানন্দ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেছেন, মুসলমান ধর্ম জগতে যে বার্তা প্রচার করিতে আসিয়াছে, তাহা সকল মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কার্যে পরিণত এই ভ্ৰাতৃভাব, ইহাই মুসলমান ধর্মের অত্যাবশ্যক সারাংশ।২৩ এই পর্যন্ত পড়ে মনে হতেই পারে মুসলমান ধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজীর একটা দুর্বলতা, এমনকী একটা বিশুদ্ধ সশ্রদ্ধ মানসিকতা ছিল। এবং তাঁর এই উক্তি পাঠ করে মুসলমান ধর্মাবলম্বীগণ তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ আগ্রহ অনুভব করতেই পারেন। কিন্তু এগুলিরই পাশাপাশি যদি ইংল্যাণ্ডে প্রদত্ত ‘বিশ্বজনীন ধর্মের আদর্শ’ নামক ভাষণটি পাঠ করি তাহলে দেখব এখানে তিনি বলেছেন, “মুসলমানগণ ‘সার্বজনীন ভ্রাতৃভাব ভ্রাতৃভাব’ করে, কিন্তু বাস্তবিক কাজে তাহা কতদূর দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এই, যে মুসলমান নয়, তাহাকে আরও এই ভ্রাতৃসংঘের ভিতর লওয়া হইবে না—তাহার গলা কাটা যাইবার সম্ভাবনাই অধিক।”২৪ অতঃপর প্রচ্ছন্ন অসূয়কতার সঙ্গে তিনি পরামর্শ ও জ্ঞান দেন, “এইরূপে আমরা সার্বজনীন ভ্রাতৃভাব’ ও সাম্যের অনুসন্ধানে সারা পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। যখন তুমি কোথাও এই ভাবের কথা শুনিবে, তখনই আমার অনুরােধ, তুমি একটু ধীর ও সতর্ক হইবে, কারণ এই সকল কথাবার্তার অন্তরালে প্রায়ই ঘাের স্বার্থপরতা লুকাইয়া থাকে। কিন্তু কথাটা বলে ফেলার পরে তিনি হয়তাে মনে মনে একটা খোঁচা টের পান প্রশ্নের আকারে : কথাটা ঠিক বলা হল কি? তখন নিজের প্রশ্নটার উত্তর দেন, ধর্মের সার্বভৌমিকতার বাস্তব রূপ বলিয়া কিছু খুঁজিয়া বাহির করা খুব কঠিন; তথাপি আমরা জানি, উহা আছে ঠিক।২৫ ইংল্যাণ্ডে প্রদত্ত ‘যুক্তি ও ধর্ম’ নামক আর একটি ভাষণে তিনি খ্রিস্টান ও মুসলমানকে দিয়ে বলিয়েছেন, আমার শাস্ত্র বলে, ‘সব কাফেরকে হত্যা কর।’২৬ যদিও এই উক্তি এক কাল্পনিক কথােপকথনের অংশ তবু প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, স্বামীজীর মনে একথা এল কী করে যে সব কাফের তথা মূর্তিপূজারী অথবা অমুসলমানকে হত্যা করার আদেশ দেওয়া আছে মুসলমান শাস্ত্রে? তাহলে তাে মুসলমানও বলতে পারে যে হিন্দুশাস্ত্রের সার কথা, যুদ্ধ করাে, হত্যা করাে, রাজ্য জয় করাে। আবার বাইবেলেও বলা হয়েছে, শান্তির জন্য নয়, যুদ্ধের জন্য আমি তরবারি এনেছি। অধিকাংশ ধর্মশাস্ত্রেই এমন কিছু কথা আছে যা সােজা ভাবে নিলে মানুষের সাধারণ ধর্মবােধকে গভীর আঘাত করে। তেমন কোনও কথা দিয়ে প্রাসঙ্গিক ধর্মকে বােঝা সম্ভব নয়—এটা কি স্বামীজী জানতেন না? তাহলে সেরকম একটা কথা দিয়ে ইসলাম ধর্মকে তিনি বােঝাবার চেষ্টা করলেন কেন? তিনি কি ওই জাতীয় কোনও উদ্ধৃতি বা বক্তব্য দিয়ে হিন্দুশাস্ত্রকে বােঝাবার চেষ্টা করতেন?
‘যুক্তি ও ধর্ম’ সম্বন্ধীয় আলােচনাকালীন স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন : “বহির্জগতে বিজ্ঞান ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তত্ত্বানুসন্ধানের যে পদ্ধতিগুলি অবলম্বিত হয়, ধর্মবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সেই একই পদ্ধতি অবলম্বিত হওয়া উচিত। …এই অনুসন্ধানের ফলে ধর্মের ভিতর যা-কিছু খাদ আছে, সেসবই দূরীভূত হইবে নিঃসন্দেহ, কিন্তু ধর্মের যাহা সারভাগ, তাহা এই অনুসন্ধানের ফলে বিজয়-গৌরবে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে।…যেসব ব্যক্তি ধর্মের মধ্যে কোন যুক্ত-সঙ্গত তত্ত্বানুসন্ধানের উপযােগিতা অস্বীকার করেন, আমার মনে হয়, তাহারা যেমন কতকটা স্ববিরােধী কাজ করিয়া থাকেন। যেমন খ্রীস্টানরা দাবি করেন যে, তাহাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম;কারণ অমুক-অমুক ব্যক্তির কাছে তাহা প্রকাশিত হইয়াছিল।মুসলমানরাও নিজেদের ধর্ম সম্বন্ধে একই দাবি জানান যে, একমাত্র তাহাদের ধর্মই সত্য, কারণ এই এই ব্যক্তির কাছে তাহা প্রত্যাদিষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু খ্রীস্টানরা মুসলমানদের বলেন, “তােমাদের নীতিশাস্ত্রের কয়েকটি বিষয় ঠিক বলিয়া মনে হয় না। একটি উদাহরণ দিই, দেখ, ভাই মুসলমান, তােমার শাস্ত্র বলে যে, কাফেরকে জোর করিয়া মুসলমান করা চলে; আর সে যদি মুসলমানধর্মে দীক্ষিত হইতে না চায়, তবে তাহাকে হত্যা করাও চলে। আর এরূপ কাফেরকে যে মুসলমান হত্যা করে, সে যত পাপ, যত গর্হিত কর্মই করুক না কেন, তাহার স্বর্গলাভ হইবেই। মুসলমানরা ওই কথার উত্তরে বিদ্রুপ করিয়া বলিবে, ইহা যখন শাস্ত্রের আদেশ, তখন আমার পক্ষে এরূপ করাই সঙ্গত। এরূপ না করাটাই আমার পক্ষে অন্যায়। খ্রীস্টানরা বলিবে, কিন্তু আমাদের শাস্ত্র একথা বলে না। মুসলমানরা তাহার উত্তরে বলিবে, তা আমি জানি না। তােমার শাস্ত্রপ্রমাণ মানিতে আমি বাধ্য নই। আমার শাস্ত্র বলে, সব কাফেরকে হত্যা কর। কোনটা ঠিক কোন্টা ভুল, তাহা তুমি জানিলে কিরূপে? আমার শাস্ত্রে যাহা লিখিত আছে, নিশ্চয়ই তাহা সত্য। আর তােমার শাস্ত্রে যে আছে, হত্যা করিও না, তাহা ভুল। ভাই খ্রীস্টান, তুমিও তাে এই কথাই বলাে; তুমি বলাে যে জিহােবা ইহুদীদিগকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই যথার্থ কর্তব্য; আর তিনি তাহাদিগকে যাহা করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন, তাহা করা অন্যায়। আমিও তাহাই বলি; কতকগুলি বিষয়কে কর্তব্য বলিয়া এবং কতকগুলি বিষয়কে অকর্তব্য বলিয়া আল্লা আমার শাস্ত্রে অনুজ্ঞা দিয়াছেন;ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ের তাহাই চূড়ান্ত প্রমাণ।”২৭ এই বিবাদের মীমাংসা একমাত্র যুক্তির দ্বারাই সম্ভব।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, কোরান অন্য কথা বলে। কোরান উদাত্ত কণ্ঠে ঘােষণা করেছে—“(ইসলাম) ধর্মে জবরদস্তি নাই। (লা-ইকরাহা ফিদ্দীন…) এবং তােমার জন্য তােমার ধর্ম আমার জন্য আমার ধর্ম।” (লা কুম দ্বীনুকুম ওয়ালিইয়া-দ্বীন) অতএব কোরানে ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত।
বিবেকানন্দের চিন্তাধারার মধ্যে আপাতভাবে পিছটান বা স্ববিরােধিতা সম্পর্কে অনেকের অভিযােগ সম্পর্কিত আরও কয়েকটি কথা বলা প্রয়ােজন। ভারতে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণ হিসাবে অনেকের মতাে বিবেকানন্দও মনে করতেন—ভারতীয়দের তরবারির দ্বারা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন—“তাহারা (মুসলমানরা) তরবারির সাহায্যে প্রত্যেক পদ অগ্রসর হইয়াছিল—তাহাদের এক হস্তে ছিল কোরান, অপর হস্তে তরবারি; হয় কোরান গ্রহণ কর, নতুবা মৃত্যু আলিঙ্গন কর, আর অন্য উপায় নাই! ইতিহাস-পাঠক-মাত্রেই জানেন, তাহাদের অভূতপূর্ব সাফল্য হইয়াছিল। ছয়শত বৎসর ধরিয়া কেহই তাহাদের গতিরােধ করিতে পারে নাই; কিন্তু পরে এমন এক সময় আসিল, যখন তাহাদিগকে অভিযান থামাইতে হইল। অপর কোন ধর্ম যদি ঐরূপ পন্থা অনুসরণ করে, তবে তাহারও একই দশা হইবে।”২৮ “ভারতে মুসলমানেরাই প্রথম পরধর্মাবলম্বীর বিরুদ্ধে তরবারি ধারণ করিয়াছিলেন।”২৯
অন্যত্র বলেছেন— “মুসলমানদের সঙ্গে-সঙ্গেই ভারতে ধর্ম সম্বন্ধীয় মতামত লইয়া হত্যা, অত্যাচার প্রভৃতি প্রবেশ করিয়াছে, তাহারা আসিবার পূর্ব পর্যন্ত ভারতে আধ্যাত্মিক রাজ্যে শান্তি বিরাজিত ছিল।”৩০
“মুসলমানরা সবচেয়ে বেশী হিংসার পথ অবলম্বন করেছে। তিনটি বৃহৎ প্রচারশীল ধর্মের মধ্যে তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে কম। মুসলমানদেরও একসময় প্রতিপত্তির দিন এসেছিল।”৩১ বিবেকানন্দের উপরােক্ত বক্তব্য তথা মন্তব্য পাঠান্তে অনেকে তাকে মৌলবাদী ভেবে থাকতে পারেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পূর্বে সমকালীন ভারতবর্ষ তথা ভারতীয় ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করা প্রয়ােজন, বিবেকানন্দের উপরােক্ত বক্তব্য ছিল তদানীন্তন ইংরেজ প্রণীত ইতিহাসভিত্তিক এবং প্রচলিত ধারণা-নির্ভর। ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠের পর এবং ভারত তথা বিশ্ব পর্যটনের পর তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। আর যে তরবারির সমালােচনা বিবেকানন্দ করেছেন ধর্মের ব্যাপারে সেই তরবারি ইসলামের স্বীকৃত নয়। কোরানে প্রত্যেকের ধর্মীয় স্বাতন্ত্রকে স্বীকার করা হয়েছে। ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তিকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না, যেটা পুর্বেই বলা হয়েছে।
তবে মােটের উপর স্বামী বিবেকানন্দ যে মুসলমান ধর্মের প্রতি অনুরাগ বােধ করতেন একথা বলা যেতে পারে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেসব ক্ষেত্রে ইসলামের অগ্রগতির প্রতি স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একান্তই শ্রদ্ধাশীল। তিনি আধুনিক ইউরােপের নবজাগরণের পশ্চাতে ইসলামীয় সংস্কৃতির উদার জ্ঞানচর্চার অবদানের কথা বহুস্থানে আলােচনা করেছেন। মধ্যযুগের ধর্মান্ধ খ্রীস্টান-সম্প্রদায়ের বিজ্ঞান-বিরােধিতার সঙ্গে ইসলামের মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার তুলনা করে দেখিয়েছেন, ইসলামে বিজ্ঞান-অনুরাগ প্রবল ছিল। তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন : “আজ যে মনুষ্যের বিদ্যা এবং বিজ্ঞানে প্রবেশ আছে, তার কি অকপট ক্রিশ্চান হওয়া সম্ভব? নিউ টেস্টামেন্ট-এ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কোনও বিজ্ঞান বা শিল্পের প্রশংসা নেই। কিন্তু এমন বিজ্ঞান বা শিল্প নেই যা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কোরান বা হাদিসের বহু বাক্যের দ্বারা অনুমােদিত এবং উৎসাহিত নয়।”৩২ পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের পেছনে মুসলমানদের অবদানের বিষয়ে স্বামীজী অবহিত ছিলেন। এ ঋণের কথা স্কুল কলেজে ইতিহাসের পাঠ্য বইগুলিতে উল্লিখিত হয় না বটে, কিন্তু ১৩০৬-০৮ বঙ্গাব্দে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ লেখার সময় তিনি লিখেছিলেন, ‘এদিকে মূর নামক মুসলমান জাতি স্পন (স্পেন) দেশে অতি সুসভ্য রাজ্য স্থাপন করলে, নানা বিদ্যার চর্চা করলে, ইউরােপে প্রথম ইউনিভার্সিট হল; ইতালি ফ্রান্স, সুদূর ইংলণ্ড হতে বিদ্যার্থী শিখতে এল; রাজারাজড়ার ছেলেরা যুদ্ধবিদ্যা আচার কায়দা সভ্যতা শিখতে এল। বাড়ী ঘরদোর মন্দির সব নূতন ঢঙে বানাতে লাগল।৩৩ প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবিদ্যার চর্চায়, শিল্প-সাহিত্যের চর্চায়, ইউরােপের মানুষ মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিকালে যে অগ্রগতি লাভ করে তার মূলে ছিল মুসলমানদের অবদান।
স্বামী বিবেকানন্দ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’-এ আরও বলেছেন: “এখন ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীব্যাপী ক্ষিপ্র সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে ক্রিশ্চান ধর্মের প্রথম তিন শতাব্দীর তুলনা কর। ক্রিশ্চান ধর্ম প্রথম তিন শতাব্দীতে জগৎসমক্ষে আপনাকে পরিচিত করতে সমর্থ হয়নি এবং যখন কনস্টানটাইনের তলওয়ার একে রাজ্যমধ্যে স্থান দিলে, সেদিন থেকে কোন্ কালে ক্রিশ্চানী ধর্ম আধ্যাত্মিক বা সাংসারিক সভ্যতা বিস্তারের কোন্ সাহায্য করেছে? যে ইওরােপীয় পণ্ডিত প্রথম প্রমাণ করেন যে পৃথিবী সচলা, ক্রিশ্চান ধর্ম তার কি পুরস্কার দিয়েছিল? কোন্ বৈজ্ঞানিক কোন কালে ক্রিশ্চানী ধর্মের অনুমােদিত? ক্রিশ্চানী সংঘের সাহিত্য কি দেওয়ানী বা ফৌজদারী বিজ্ঞানের শিল্প বা পণ্য কৌশলের অভাব পূরণ করতে পারে? আজ পর্যন্ত ‘চার্চ’ প্রােফেন (ধর্ম ভিন্ন অন্য বিষয়াবলম্বনে লিখিত) সাহিত্য প্রচারে অনুমতি দেন না।…ইওরােপের সর্বপ্রধান মনীষিগণ ইওরােপের ভলটেয়ার, ডারউইন, বুকনার, ফ্লমারিয়, ভিক্টর হুগাে কুল বর্তমানকালে ক্রিশ্চানী দ্বারা কটুভাষিত এবং অভিশপ্ত, অপরদিকে এই সকল পুরুষকে ইসলাম বিবেচনা করেন যে এই সকল পুরুষ আস্তিক, কেবল ইহাদের পয়গম্বর-বিশ্বাসের অভাব। ধর্ম সকলের উন্নতির বাধকত্ব বা সহায়কত্ব বিশেষরূপে পরীক্ষিত হােক; দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায়ই আদিমনিবাসীদের রক্ষা করেছে। সেসব জাত সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান। যদি মুখ চাষার দল না থাকত তাহলে ক্রিশ্চানী তার ঘৃণিত জীবন ক্ষণমাত্র ধারণ করতে সমর্থ হত না এবং সমূলে উৎপাটিত হত; কারণ নগরস্থিত দরিদ্ৰবর্গ এখনই ক্রিশ্চানী ধর্মের প্রকাশ্য শত্রু! এর সঙ্গে ইসলামের তুলনা কর। মুসলমান দেশে যাবতীয় পদ্ধতি ইসলাম ধর্মের উপরে সংস্থাপিত এবং ইসলামের ধর্ম শিক্ষকেরা সমস্ত রাজকর্মচারীদের বহু পূজিত। এবং অন্য ধর্মের শিক্ষকেরাও সম্মানিত।”
সামাজিক সাম্যের ধারণা ইসলাম ধর্মে কোন বিমূর্ত তত্ত্ব নয়, তা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত সত্য। স্বামীজীর চোখেও এই সত্য ধরা পড়েছিল। মহম্মদ সরফরাজ হােসেনকে এক চিঠিতে (জুন ১০, ১৮৯৮) তিনি আলমােড়া থেকে লিখেছিলেন : “আমি আপনার পত্রে বিশেষ মুগ্ধ হইয়াছি এবং আমি ইহা জানিয়া যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি যে ভগবান আমাদের সজ্ঞাতসারে আমাদের মাতৃভূমির জন্য সব অপূর্ব আয়ােজন করিতেছেন।
ইহাকে আমরা বেদান্তই বলি আর যাই বলি, আসল কথা এই যে, অদ্বৈতবাদ ধর্মের এবং চিন্তার শেষ কথা, কেবল অদ্বৈতভূমি হইতেই মানুষ সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়কে প্রীতির চক্ষে দেখিতে পারে। আমার বিশ্বাস যে, উহাই ভাবী শিক্ষিত মানব সমাজের ধর্ম। হিন্দুগণ অন্যান্য জাতি অপেক্ষা শীঘ্র শীঘ্র এই তত্ত্বে পৌঁছানাের কৃতিত্বটুকু পাইতে পারে, কারণ তাহারা হিব্রু কিংবা আরব-জাতিগুলি অপেক্ষা প্রাচীনতর; কিন্তু কর্মপরিণত বেদান্ত যাহা সমগ্র মানব জাতিকে নিজ আত্মা বলিয়া দেখে এবং তদনুরূপ ব্যবহার করিয়া থাকে— তাহা হিন্দুগণের মধ্যে সর্বজনীনভাবে এখনও পুষ্টিলাভ করে না।
পক্ষান্তরে আমার অভিজ্ঞতা এই যে, কখনও যদি কোনাে ধর্মের লােক দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে এই সাম্যের কাছাকাছি আসিয়া থাকে, তবে একমাত্র ইসলাম ধর্মের লােকেরাই আসিয়াছে; এইরূপ আচরণের যে গভীর অর্থ এবং ইহার ভিত্তি স্বরূপ যে সকল তত্ত্ব বিদ্যমান, সেসম্বন্ধে হিন্দুগণের ধারণা পরিষ্কার; এবং ইসলাম-পন্থিগণ সে বিষয়ে সাধারণত সচেতন নয়।
এইজন্য আমার দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্মপরিণত ইসলাম ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানবজাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই—যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরাণও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরাণের সমন্বয়ের দ্বারাই ইহা করিতে হইবে।…
আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলামধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই—বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ—একমাত্র আশা।
আমি মানস চক্ষে দেখিতেছি এই বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।”৩৪
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে স্বামী বিবেকানন্দ এই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক এবং ইসলামীয় দেহ বলতে কী বুঝিয়েছেন। বৈদান্তিক মস্তিষ্কের অর্থ হল, বেদান্ত দর্শনের তত্ত্ব অনুযায়ী সমগ্র মানবজাতিকে আত্মা বলে দেখা এবং সবার সঙ্গে সেরূপ আচরণ করা। ‘ইসলামীয় দেহ’-এর অর্থ ইসলামীয়রা যেমন তাদের সমাজের দিক থেকে পরস্পরকে নিজ ভাইয়ের মত একাত্ম করে দেখেন এবং সেরূপ ব্যবহার করেন। এই যদি বিবেকানন্দের ধর্ম হয় তাহলে মৌলবাদী শক্তিগুলি কোন ধর্মের কথা বলছেন? হিন্দু মৌলবাদীদের প্রধান কর্মসূচী হল রামমন্দির নির্মাণ। অযােধ্যায় মন্দির না হলে যেন হিন্দুধর্মই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘হিন্দু ধর্মে দেবমন্দিরের তেমন প্রাধান্য নেই। যদি সব মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও ধর্মের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। তাছাড়া যে কোন সংহতির মূল কথাই হল ছােট গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে সমাজজীবনের কোন সংহতি অসম্ভব। আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমান সংহতির ক্ষেত্রে, উভয় সমাজকেই নিজের পরিচয়ের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করতে হবে। হিন্দু-মুসলিম উভয়ের শাস্ত্রেই অনেক উচ্চ চিন্তা ও মূল্যবােধের তত্ত্ব মিলবে। কিন্তু জাতিগত আচরণে মুসলিম যদি উলটো চলে, হিন্দু যদি বাঁকা পথে ধায়—তবে মুখের কথায় সংহতি অসম্ভব।
সােজা কথা ভারত জাগবে বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ নিয়ে। মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের উন্নতি নয়, মুসলমানকে ভারতের উন্নতিতে সম্মানীয় শরিক করেই এ দেশ জেগে উঠবে। এই ছিল মনীষী স্বামীজীর উদার চিন্তার দৃষ্টান্ত। কিন্তু একটা খটকা লাগে। তিনি যে ইসলামীয় দেহের গুণগ্রাহী এটা বােঝা যায়। কিন্তু মুসলিমদের মস্তিষ্কগুণ বর্জিত মনে করলেন কি কারণে? অথবা ওই বিষয়ে তিনি নিশ্ৰুপ থাকলেন কেন? ১৫-১৬ শতকে ইউরােপে যে নবজাগরণ ঘটে, তার প্রধান সূত্র যে মুসলিম মনীষা এই তথ্যের উল্লেখ তাে তিনি নিজেই করেছেন ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ নামক প্রবন্ধে। অথচ আমরা আধুনিকতাবাদীরা প্রায় স্মরণে রাখি না যে, মুসলিম ব্রেন ব্যতীত ইউরােপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ সম্ভব ছিল না। নতুন সৃষ্টি হয়তাে হতে পারতাে, কিন্তু পুনর্জাগরণ কি হতে পারতাে?
অবশ্য সেই নবজাগরণ শুধু ধ্রুপদী পশ্চিমের চর্চা করেনি, নতুন সৃষ্টির নামে খ্রীষ্টান ধর্মেরও জয়গান করেছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলাঞ্জেলাে প্রমুখের শিল্পে আর দান্তে, পেত্রার্ক প্রমুখের সাহিত্যে। তাছাড়া ইউরােপের নবজাগরণের আর একটা অঙ্গ হল সমুদ্র অভিযানের পর্ব। অর্থাৎ যার মানে দেশে দেশে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা ছিল সমুদ্র অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্যগুলির একটা—এবং প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্যই একটা ছিল, যা আজকাল সচরাচর উল্লেখ করা হয় না।
অনেকে হয়তাে ভাবছেন এমন প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে আসছে কি করে! আসছে এই জন্য যে বিবেকানন্দের বিশ্বখ্যাতির সুত্রপাত হয় চিকাগােতে প্রদত্ত হিন্দুধর্মের উপর দেওয়া বক্তৃতা থেকে। আর ওই মঞ্চ আহ্বান করা হয়েছিল ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। উল্লেখ্য কলম্বাসের আগেই আমেরিকা অভিযানে সফল হয়েছিল উত্তর ইউরােপের ভাইকিংরা কিংবা পূর্ব চীনের দুঃসাহসিক নৌজীবীরা। এরা কলম্বাসের আগেই পশ্চিম আমেরিকাতে যাতায়াত করত। কিন্তু তাহলে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কথা এখানে উঠে আসছে কেন? উঠছে এজন্য, পােপের অনুমতিক্রমে কলম্বাসই প্রথম ইউরােপ ভূখণ্ড থেকে পশ্চিমের জলরাশি অতিক্রম করে এক মহাদেশের সন্ধান নিয়ে আসেন। কলম্বাস পশ্চিমের জলরাশি অতিক্রম করেছিলেন কেন? এর জবাবে একালের ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন যে, ভারতে আসার বাণিজ্য পথের সন্ধান করতে গিয়ে নাকি কলম্বাস এক অজানা ভূখণ্ডে গিয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে যে, কাকপ্যাট্রিক সেল তার কঙ্কোয়েস্ট অফ প্যারাডাইস’ গ্রন্থে স্বয়ং কলম্বাসের আত্মজীবনীর (১৮৯২) ভিত্তিতে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রমাণ করেন যে, ইউরােপ থেকে মূরদের অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের এবং সাধারণভাবে আরব মুসলিমদের বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে একটা চূড়ান্ত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংগঠনের পরিকল্পনা করে স্বর্ণ সংগ্রহের জন্য কলম্বাস ওই সমুদ্র অভিযান করেছিলেন এবং তাঁর প্রধান সমর্থক ছিলেন স্পেনের রাণী ইসাবেলা।।
যাইহােক কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মত চিকাগাে ধর্মসভা আহ্বানের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অনেকে বিশ্বাস করেন যে, ধর্মে ধর্মে সম্প্রীতি যাতে গড়ে ওঠে সেজন্য আয়ােজন করা হয়েছিল ওই ধর্মসভার। কিন্তু চিকাগাে থেকে ফিরে এলে কলকাতায় দেওয়া অভিনন্দনের উত্তরে বিবেকানন্দ কি বলেছিলেন তা উল্লেখ করা যেতে পারে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “এই ধর্মমহাসভার যথার্থ ইতিহাস যদি জানিতে চাও, যথার্থ উদ্দেশ্য যদি জানিতে চাও, তবে আমার নিকট শুন। তাহাদের ইচ্ছা ছিল আপনাদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা। তথাকার অধিকাংশ লােকের ইচ্ছা ছিল খ্রীষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং অপর সকলকে হাস্যাস্পদ করা।”৩৫ কিন্তু সমস্ত ধর্মের মধ্যে খ্রীষ্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে উদ্যোগীদের পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকাবাসীদের এই সম্ভাষণ দিয়ে—সিস্টার্স অ্যাণ্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা। পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য যে সমাজে সেখানে ভ্রাতৃবর্গের পূর্বে সহােদরাতুল্য মহিলাবর্গের উল্লেখে বিবেকানন্দ যে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন, তা সন্দেহাতীত। সর্বোপরি তিনি এই যে মানুষের জয়গান করেছেন—মানুষকে ভাই-বােন সম্বােধন করেছেন, তাতে অভিভূত হয়েছিলেন আমেরিকাবাসী।
আসলে মানবতাবাদী এই ভাবুক সন্ন্যাসী সকল ধর্মের সমন্বয় শুধু বক্তব্যের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তা কাজে করেও দেখিয়েছেন। তিনি যেমন মন্দিরে যেতেন, তেমনি চার্চে কিংবা মসজিদেও যেতেন। তিনি আজমীরে গিয়েছিলেন বিখ্যাত সুফি খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি-র (রহঃ) সমাধিক্ষেত্রে শ্রদ্ধা জানাতে। শ্রীনগর অবস্থানকালে বিবেকানন্দ যে হাউস বাের্ডে থাকতেন তার মুসলমান মাঝির শিশু কন্যাটিকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
মুসলমান সমাজ প্রসঙ্গে স্বামীজীর ভাবনার আর একটি দিক তুলে ধরা দরকার। স্বামীজী ভারতীয় মুসলমানদের অবশ্যই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন। আজকাল প্যান-ইসলামের ধারণায় অনেকের বুকের ছাতি ফুলে ওঠে! এর কোন সঙ্গত কারণ দেখি না। ইসলাম দুনিয়ার উল্লেখযােগ্য প্রতিনিধিরা ‘খাঁটি মুসলমান’ (!) হিসেবে ভারতীয়দের স্বীকারই করে না। তবু অনেকে প্যান-ইসলাম-এর তালে তালে নাচে! যাক সে কথা। ভারতের মুসলমান সম্পর্কে স্বামীজী বলেছিলেন “ভারতের মুসলমান ধর্ম অন্যান্য দেশের মুসলমান ধর্ম হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কেবল যখন মুসলমানেরা অপর দেশ হইতে আসিয়া তাহাদের ভারতীয় স্বধর্মীদের নিকট বলিয়া থাকে যে, তাহারা কেমন করিয়া বিধর্মীদের সহিত মিলিয়া মিশিয়া রহিয়াছে, তখনই অশিক্ষিত গোঁড়া মুসলমানের দল উত্তেজিত হইয়া দাঙ্গা-হাঙ্গামা করিয়া থাকে।”৩৬ ভারতীয় মুসলিমদের স্বাতন্ত্র ও মুসলিম কর্তৃক দাঙ্গা উভয়ই তিনি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু দাঙ্গার জন্য সরাসরি ভারতীয় মুসলিমদের দায়ী করেননি। দাঙ্গা হয়েছে। বহিরাগতদের উস্কানিতে—এ কথাও তিনি বলেছিলেন। বলাই বাহুল্য, যে উস্কানিতে ধর্মীয় দাঙ্গা হয়েছিল সে উস্কানি ধর্মের নয়, রাজনীতির। প্রসঙ্গিক কারণে মুসলমান ও বহিরাগত বিষয়ে আরও কিছু বলা যেতে পারে। অতীতের অনেকে এবং ইদানিংকালের কেউ কেউ মুসলমানদের ‘বিদেশী’ বলে আখ্যাত করে থাকেন। মুসলমান শাসনের প্রথম দিকে যারা ভারত আক্রমণ করেছিল তারা বিদেশী ছিল। তবে তারা ছিল মুষ্টিমেয়। কিন্তু ভারতে লক্ষ লক্ষ যে সাধারণ মুসলমান তারা বহিরাগত ছিল না। আক্রমণকারীও ছিল না। এইসব মুসলমানরা পুরােপুরিই ভারতীয় জনসমাজ-সস্তুত। তারা পুরােপুরিই ভারতীয়। তথাপি মুসলিমদের যে বিদেশী বা আক্রমণকারী হিসেবে বলে তার উৎস হল ব্রিটিশদের অনেকের মুসলিম বিরাগের মনােভাব ও এই মনােভাবজাত তাদের রচনা। স্যার হেনরী এলিয়ট, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জেমস টড, এফ.ডব্লু. টমাস প্রমুখদের রচনায় মুসলমানদের ‘বিদেশী’ ও আক্রমণকারী হিসেবে দেখানাে হয়েছে। এর পিছনে ব্রিটিশের উদ্দেশ্য ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ভারতের ইতিহাসকে ব্রিটিশ যেভাবে বিশ্লেষণ করেছে অনেকেই আমরা সেই তালে মাথা নেড়েছি! এবং মুসলমানদের সবাইকেই নির্বিচারে বহিরাগত বলেছি! স্বামীজী এই গতানুগতিক পথে হাঁটেননি। তাঁর চোখে ভারতীয় মুসলমানরা পুরােপুরিই ভারতীয় ছিল।
ভারতীয় মুসলিম সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন, “ভারত তাহার মুসলমান বিজেতাগণকে ইতিমধ্যে জয় করিয়াছে। শিক্ষিত মুসলমানগণ সকলেই সুফী —তাহাদিগকে হিন্দু হইতে পৃথক করিবার উপায় নাই।”৩৭ ফলে, ভারতীয় মুসলমানের প্রতি স্বামীজীর দুর্বলতা একটু বেশি ছিল। ভারত তাহার মুসলিম বিজেতাগণকে ইতিমধ্যে জয় করিয়াছে’ কথাটি ধর্মীয় দিক থেকে নয় সাংস্কৃতিক দিক থেকে অধিক সত্য।
চিকাগােতে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কী ছিল তার সেদিনকার বক্তৃতাগুলিতে? সেদিনকার তার ভাষণের কয়েক টুকরাে তুলে ধরতে পারি :…হিন্দুধর্ম দুটো জিনিস শিখিয়েছে—সহনশীলতা আর বহনশীলতা। শুধু সইব না, সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াব। হিন্দুধর্ম সব ধর্মকে শুধু মেনে নেয় না—টেনেও নেয়। হিন্দুধর্ম এও শেখায় যে সর্বধর্মই সমান মহান। ধর্ম সম্পর্কে বিবেকানন্দের আর একটি উক্তি স্মরণীয়, ‘যে ধর্ম বা ঈশ্বর বিধবার অমােচন করতে পারে না, অথবা অনাথ শিশুর মুখে এক মুঠো খাবার তুলে দিতে পারে না, আমি সে ধর্মে বা সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। …ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা বলা বা দর্শনশাস্ত্র শােনানাে অপমান করা।’ স্বামী বিবেকানন্দ যে হিন্দুধর্মকে মানবিক ধর্মের উচ্চ সােপানে উন্নীত করেছিলেন আজ মৌলবাদীরা তাদের নীতি ও কার্যপ্রণালী দ্বারা সেই হিন্দুধর্ম তথা বিবেকানন্দকেই কার্যত আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন। এদেরই বােধহয় বিবেকানন্দ কটাক্ষ করে বলেছিলেন— ‘সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করতে থাকো। তােমরা যে নিজেদেরকে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে খাঁটি হিন্দু বলে পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করে থাকো, তা ছেড়ে দাও।
১৮৯৩ খ্রিঃ ১১ই সেপ্টেম্বর চিকাগাে ধর্মসভার প্রথম দিনের অধিবেশনে বিবেকানন্দ যা বলেছিলেন তার আংশিক এখানে তুলে ধরা হচ্ছে, “..যে ধর্ম বিশ্বকে সহিষ্ণুতা এবং সার্বজনীন সমঝােতা—এই উভয় আদর্শ শিখিয়েছে সেই ধর্মে বিশ্বাসী বলে আমি গর্বিত। আমরা কেবল সর্বজনীন সহিষ্ণুতায় বিশ্বাস করি না, উপরন্তু ধর্মই সত্য বলে গ্রহণ করি। বিশ্বের সমস্ত জাতি এবং ধর্মের দ্বারা নির্যাতিত এবং আশ্রয় ভিক্ষু মানুষদের যে জাতি আশ্রয় দান করেছে আমি সেই জাতির মানুষ বলে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। ওই চিকাগােতেই তিনি বলেন, কুসংস্কার মানুষের প্রবল শত্রু কিন্তু ধর্মান্ধতা আরাে জঘন্য।
অথচ এই ধর্মান্ধতাকে হাতিয়ার করে ভারতে মুসলমান আগমনের পূর্ব থেকেই হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষরা নিম্নবর্ণের মানুষদের উপর কম অত্যাচার করেনি। আজও উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের স্পর্শ করা অন্নজল গ্রহণ করাকে দোষণীয় বলে মনে করে। কিন্তু হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি আজ অবধি হিন্দুত্বের এই পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যকে দূরীভূত করার বিষয়ে কতটা চিন্তাভাবনা করছেন? হরিজনেরা আজ কাদের সৃষ্টি? হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য আজ অবধি কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন ছাড়া অধিক কী করেছে? এক সময় উচ্চবর্ণের পথচারীকে সতর্ক করে দেবার জন্য মাদ্রাজের পরিয়াদেরকে (নিম্নবর্ণের) গলায় ঘন্টা বেঁধে পথ চলতে হত। বিবেকানন্দ কিন্তু হিন্দু সমাজের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত নিম্নবর্ণের মানুষবর্গের উদ্ধারে প্রয়াসী হয়েছিলেন। হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথার অত্যাচার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অনেককেই অন্য ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছিল। ১৮৯৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর কার্যত পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবী মহলকে জয় করে বিবেকানন্দ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুরু করেন। দেশে ফিরে তিনি যেসব বক্ততা দেন সেসবের মধ্যে মাদ্রাজে প্রদত্ত ভারতের ভবিষ্যৎ প্রবন্ধটি বিশেষ উল্লেখ্য। এই ভাষণে তিনি বলেন, “একচেটিয়া অধিকার ও একচেটিয়া সুবিধা ভােগের দাবির দিন ভারতের মাটি থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেছে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এইটাই মস্ত বড় আশীর্বাদ। এমনকি মুসলমান শাসনেও আমরা একই বিরাট আশীর্বাদ লাভ করেছি, একচেটিয়া সুবিধা ভােগের ধ্বংস-সাধন। মুসলমান শাসন আসলে তত মন্দ ছিল না। কোনাে জিনিসই সম্পূর্ণ মন্দ নয় কোনাে জিনিসই সম্পূর্ণ ভালাে নয়। মুসলমানের ভারত বিজয় নিপীড়িত দরিদ্রদের মুক্তির রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল। সেই কারণে আমাদের এক-পঞ্চমাংশ লােক মুসলমান হয়ে গেছে। শুধু তরবারির দ্বারা সেটা সম্ভব হয়নি। এটা চরম বাতুলতা বলে পরিগণিত হবে যদি বলা হয় যে এ সবই তরবারি ও বন্দুকের বলে সাধিত হয়েছিল।” খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণের অনুকরণে অনেক হিন্দুধর্মাবলম্বী ঐতিহাসিক একথা প্রবল উৎসাহে প্রচার করে থাকেন যে, এক হাতে অস্ত্র আর এক হাতে শাস্ত্র নিয়ে মুসলমানরা ভারতে ইসলাম প্রচার করেছে। হিন্দুত্ববাদীরা তাে এই প্রচারকর্মকে একটা পবিত্র কর্তব্যে পরিণত করেছে। কিন্তু এই প্রচারের এক অত্যন্ত কার্যকর প্রতিষেধক হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দ কথিত ইসলাম প্রচারের ব্যাখ্যা। অতি সাম্প্রতিককালেও ভারতের বহুস্থানে ইসলাম ধর্মান্তরের অর্থাৎ ধর্মগ্রহণের ঘটনা ঘটেছে তার কারণ উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতনে দরিদ্র ও দলিতদের এক উল্লেখযােগ্য অংশ বারে বারে ইসলাম অথবা বৌদ্ধধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। দশচক্রে যেমন ভগবান ভূত হয় তেমনই হিন্দুত্ববাদীদের প্রচণ্ড প্রচারে বহু সাধারণ ভারতীয় একথাই মনে করে যে, জবরদস্তি মুসলিম ধর্মান্তরীকরণ হয়েছে এবং ‘ভারতের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক ভাষণের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা সম্বন্ধে অধিকাংশ স্বামী বিবেকানন্দ ভক্তই অজ্ঞ।
বিবেকানন্দ লিখেছেন, “আমরা যখন বৈদান্তিক, তখন নিশ্চয় করিয়া জানি, যদি নিজের অনিষ্ট নিজেরা না করি, তবে জগতে এমন শক্তি নাই যাহা আমাদের অনিষ্ট করিতে পারে। ভারতের এক পঞ্চমাংশ অধিবাসী মুসলমান হইয়াছে। …এখনই প্রায় দশ লক্ষের অধিক খ্রীস্টান হইয়া গিয়াছে। ইহা কাহার দোষ? আমাদের একজন ঐতিহাসিক চিরস্মরণীয় ভাষায় বলিয়া গিয়াছেন, যখন অনন্ত জীবন-নিঝরিণী নিকটেই বহিয়া যাইতেছে, তখন এই দরিদ্র হতভাগ্যগণ ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় মরিবে কেন? প্রশ্ন এই ইহাদের জন্য আমরা কি করিয়াছি? কেন ইহারা মুসলমান হইবে না?”৩৮
তিনি আবার বলেছেন, “মুসলমানদের ভারত অধিকার দরিদ্র ও পদদলিতদের উদ্ধারের কারণ হয়েছিল। ভারতবর্ষে দরিদ্রদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশী কেন? একথা বলা মূর্খতা যে, কেবল তরবারির জোরে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়। বস্তুত জমিদার ও পুরােহিতদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যই তারা ধর্মান্তর গ্রহণ করেছিলেন, সেইজন্য বাংলাদেশে, যেখানে কৃষকদের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমান বেশী।…ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি কোন একটি বিশেষ নরগােষ্ঠী, ধর্মসম্প্রদায় বা সামাজিক শ্রেণীর একক প্রচেষ্টার দ্বারা সৃষ্টি হয়নি বা এজন্য কোন একটি শ্রেণী, সম্প্রদায় বা বর্ণের লােক বিশেষ গৌরব দাবী করতে পারে না।”৩৯ পুরােহিততন্ত্রের প্রতি তাঁর সরব প্রতিবাদ এরূপ ছিল, ‘এসাে, মানুষ হও! পুরােহিতগুলােকে পদাঘাতে দূর করাে। তারা কখনাে শােধরাবে না, তাদের হৃদয় প্রসার হবে না, তারা সর্বদা প্রগতির শত্রু। হিন্দু মৌলবাদীদের দাবী কয়েকশ বছর আগে রামমন্দির ভেঙে নাকি বাবরি মসজিদ গড়া হয়েছিল, এখন তারা সেটাকে উদ্ধার করতে চায়। শুধু তাতেই তারা সন্তুষ্ট নয়, এরপর তারা নাকি ভারতে এইরকম আরও মসজিদ থেকে মন্দির উদ্ধার করবে। যতি তর্কের জোরে আপাতত মেনে নিই যে অতীতে এরূপ ঘটনা ঘটেছে তাহলেও কী মসজিদ ভেঙে এখন মন্দির উদ্ধার যুক্তিযুক্ত? এটা যদি মসজিদ ভাঙার যুক্তি হয় তাহলে আজ পুরীর জগন্নাথ মন্দির বৌদ্ধদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। বিবেকানন্দই বলেছেন যে, পুরীর জগন্নাথ মন্দির আসলে ছিল বৌদ্ধমঠ। হিন্দুরা বৌদ্ধদের তাড়িয়ে সেটাকে জগন্নাথ মন্দির বানিয়েছে। এমনিভাবে ভারতে বহু বৌদ্ধমঠ ভেঙে হিন্দু মন্দির করা হয়েছে। বিবেকানন্দ তার শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছেন, “ভারতবর্ষের এই যে সব সন্ন্যাসীর মঠ ফঠ দেখতে পাচ্ছিস—এসব বৌদ্ধদের অধিকারে ছিল, হিন্দুরা সেই সকলকে এখন তাদের রঙে রাঙিয়ে নিজস্ব করে বসেছে।”৪০ হিন্দু মৌলবাদীদের মসজিদ ভাঙার ঐ যুক্তি মানলে বৌদ্ধদের মন্দির ভাঙার যুক্তিও মানতে হয়।
বিবেকানন্দের মানবপ্রেম এত সর্বব্যাপক ও সক্রিয় ছিল যে, মুসলমানদের হাত থেকে মুসলমানী রুচি অনুযায়ী প্রস্তুত খাদ্য গ্রহণে তার দ্বিধা ছিল না। এরকম দুটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন ভগিনী নিবেদিতা তার ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম’ গ্রন্থের ১১ পৃষ্ঠায়। এই সর্বাত্মক সহানুভূতির ফলে পরিব্রাজক জীবনে স্বামীজী মুসলমানদের নিকটও যে কত সহৃদয় ব্যবহার পেয়েছিলেন তার সীমা নেই। কাশ্মীর ভ্রমণের সময় একজন বর্ষীয়সী দরিদ্র মুসলমান রমণী তাকে যেভাবে সযত্নে আপ্যায়িত করেন—সে বৃত্তান্ত তার পাশ্চাত্য শিষ্যাদের কাছে বারে বারে উল্লেখ করেও ক্লান্তিবােধ করতেন না স্বামীজী।…ধর্মান্ধ হিন্দুরাই মুসলমানদের বিজাতীয় বলে ভাবতে শিখিয়েছে। তাদের এই দৃষ্টি বিভ্রমই সরলচিত্ত মুসলমানকে হিন্দুর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধার সৃষ্টি করেছে। আমেরিকা যাত্রার পূর্বে ভারত ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে হায়দ্রাবাদের নবাব বাহাদুর স্বামীজীকে নিজের প্রাসাদে পরম সমাদরে অভ্যর্থনা করে শুধু যে উচ্চ মর্যাদা প্রদর্শন করেন তা নয়, পাশ্চাত্য দেশে স্বামীজীর সমন্বয়ী বেদান্ত ধর্মের আদর্শ প্রচারকে সফল করবার জন্য অর্থ সাহায্য করতেও প্রস্তুত হন। দ্বিতীয়বার ইংল্যাণ্ড যাত্রার সময় জাহাজ যখন জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করছিল আত্মমগ্ন স্বামীজী ভগিনী নিবেদিতাকে তীরভূমির দিকে নির্দেশ করে ভাবাবেগ কণ্ঠে বলেছিলেন : “তুমি কি তাহাদিগকে দেখ নাই? (পুনরায়) তুমি কি তাহাদিগকে দেখ নাই? তীরে অবতরণ করিয়া তাহারা (মুসলমানরা) দ্বীন দ্বীন (ধর্ম ধর্ম) ধ্বনিতে দিক মুখরিত করিতেছে। একথা বলে স্বামীজী আধঘন্টা ধরে নিবেদিতার নিকট ইসলাম পতাকাবাহী আরব বীরগণের স্পেন বিজয় কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন।৪১ মুসলমানদের গােমাংস খাওয়া নিয়ে বর্তমানেও মৌলবাদী নেতাদের বিরাট প্রচার, লেখালেখি ও ভাষণ চলে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে—এ সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দেরও কি ঐরকম কোন বিশেষ ভূমিকা বা দুর্বলতা ছিল? আমাদের মতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে এবং রাজনীতি করার বিষয়ে তার যে ভূমিকাই থাক না কেন, তার কাজে ও কথায় তিনি মুসলিম বিরােধী ছিলেন—এ কথা মােটেই প্রমাণ হয় না। তাছাড়া তার মত আমেরিকা ঘােরা বিশ্ববিখ্যাত নেতার পক্ষে গােমাংস নিয়ে সঙ্কীর্ণ ধারণা রাখা মােটেই সম্ভব ছিল না। এ প্রসঙ্গে গােরক্ষা আন্দোলনের তথা গাে-রক্ষিণী সভার এক প্রচারকের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের কথােপকথনের এক চিত্তাকর্ষক বিবরণ উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
স্বামীজী—আপনাদের সভার উদ্দেশ্য কি? প্রচারক—আমরা দেশের গাে মাতাগণকে কসাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করে থাকি।
স্বামীজী—মধ্য ভারতে এবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছে..আপনাদের সভা এই দুর্ভিক্ষকালে কোনও সাহায্যদানের আয়ােজন করেছে কি?
প্রচারক—আমরা দুর্ভিক্ষা দিতে সাহায্য করি না। কেবলমাত্র, গােমাতৃগণের রক্ষাকল্পেই এই সভা স্থাপিত।
স্বামীজী—যে দুর্ভিক্ষে আপনাদের জাত ভাই মানুষ লক্ষ লক্ষ মৃত্যুমুখে পতিত হল তাদের অন্ন দিয়ে সাহায্য করা উচিত মনে করেনি?
প্রচারক—না, লােকের কর্মফলে, পাপে, এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যেমন কর্ম তেমনি ফল হয়েছে…
এর উত্তরে স্বামীজী বলেন—‘কর্মফলে মানুষ মরছে—এই রূপে কর্মের দোহাই দিলে জগতের কোনও বিষয়ের জন্য চেষ্টা চরিত্র করাটাই একেবারে বিফল বলে সাব্যস্ত হয়। আপনাদের গােমাতারা আপন কর্মফলেই কসাইদের হাতে যাচ্ছে ও মরছে। আমাদের ওতে কিছু করার নেই।
প্রচারক একটু অপ্রতিভ হয়ে বললেন—হ্যাঁ, আপনি যা বলেছেন তা সত্য। কিন্তু শাস্ত্র বলে—গরু আমাদের মাতা।
স্বামীজী হাসতে হাসতে বললেন—হ্যা, গরু আমাদের যে মা, তা বিলক্ষণ বুঝেছি— তা না হলে এমনসব কৃতী সন্তান আর কে প্রসব করবেন?৪২
এরপরেও প্রচারক বিবেকানন্দের কাছে অর্থ সাহায্য চাইলে তিনি বললেন : “আমার পয়সা কোথায়? তবে আমার হাতে যদি কখনও পয়সা আসে তবে আগে তা মানুষের কল্যাণে ব্যায় করব।”—আমাদের বক্তব্য হল, প্রচারককে অতি সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য করার ক্ষমতাও কি বিবেকানন্দের ছিল না? নিশ্চয় ছিল; তবুও কেন যে তিনি তা করেননি তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়ােজন। রামায়ণ-মহাভারতেও গাে-হত্যা এবং গােমাংস ভক্ষণ নিয়ে বহু উক্তি লক্ষ্য করা যায়। তাই প্রাচীন ভারতে গােমাংস ভক্ষণ শুধু যে বহুল প্রচলিত ছিল তাই নয়, ব্রাহ্মণেরাও যে বিনা দ্বিধায় গরুর মাংস খেতেন একথা বিবেকানন্দ জোরালাে ভাষায় বলে গেছেন। তিনি বলেছেন, এই ভারতবর্ষেই এমন একদিন ছিল যখন কোনও ব্রাহ্মণ গরুর মাংস না খেলে ব্রাহ্মণই থাকতে পারতেন না। আমরা বেদে পড়ি যে, যখন কোনও সন্ন্যাসী, রাজা কিংবা বড় মানুষ বাড়িতে আসতেন তখন সবচেয়ে ভাল ষাঁড়টিকে কাটা হত৷৪৩ খাদ্যাখাদ্যের ব্যাপারে তাঁর মতামত এবং ব্যক্তিগত অভ্যাস ছিল উদার ও বিজ্ঞানসম্মত। এ বিষয়ে অনেক লেখায় ও বক্তব্যে তিনি বলেছেন, মানুষের পক্ষে যে খাদ্য পুষ্টিকর এবং বলবর্ধক, সে খাদ্যই গ্রহণ করা বিধেয়। আমেরিকা বাসের সময় তিনি নিজে গরু মাংস সহ সব রকম আমিষ খাদ্যই গ্রহণ করতেন। রােমা রোঁলা লিখিত গ্রন্থে ৪৪ এ বিষয়ে সবিশেষ উল্লেখ রয়েছে।
বিদেশে বিবেকানন্দের প্রভাবে আতঙ্কিত হয়ে খ্রিস্টান মিশনারীরা এক সময়ে বিবেকানন্দের গাে-মাংস খাওয়া নিয়ে ফলাও করে প্রচার করে। ফলে তাঁর ভারতীয় শিষ্যদের অনেকে উদ্বিগ্ন হয়ে এ বিষয়ে তাকে চিঠি লেখেন এবং সমালােচনা করেন। উত্তরে বিবেকানন্দ শুধু যে নিজ খাদ্যাভ্যাসকে জোরালাে সমর্থন করেন তাই নয়, শিষ্যদের তীব্র ভৎর্সনাও করেন। দুর্ভাগ্যবশত রামকৃষ্ণ মিশন এই চিঠি সম্পূর্ণ প্রকাশ করেনি। কিন্তু যেটক করেছে। তার ভাষাও দ্ব্যর্থহীন। বিবেকানন্দ বলেছেন, “ভারতবাসীরা যদি চায় যে আমি একমাত্র হিন্দু খাবার খাই, তবে তারা যেন আমাকে একজন রান্নার লােক এবং তার জন্য অনেক টাকা পাঠায়।..আমি কারও আদেশে চলি না। আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্য জানি এবং আমার কোনও সংকীর্ণতা নেই। আমি যতখানি ভারতীয়, ততখানি বিশ্বমানব।…কোন দেশের বিশেষ অধিকার আছে আমার উপর? আমি কি কোনও জাতির ক্রীতদাস? … তােমরা কি বলতে চাও যে আমি ঐ জাতিভেদে জর্জরিত, কুসংস্কারচ্ছন্ন, নিষ্ঠুর, ভন্ড, নাস্তিক ও কাপুরুষ শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যেই জীবন কাটাবার জন্য এবং মরবার জন্য জন্মেছি?”৪৫ অথচ যখন দেখি এই গাে-হত্যা বা গাে-মাংস খাওয়া নিয়ে হিন্দু ধর্মের তথাকথিত ঠিকাদাররা দাঙ্গা বাধান, হত্যালীলায় মেতে উঠেন তখন অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে বৈকি।
যে সময় কোন হিন্দুর পক্ষে মুসলমানের হাতে খাওয়া অকল্পনীয় ছিল সেই সময় সমাজসংস্কারকে তুচ্ছ করে তিনি মুসলমানের হাতে খেয়েছিলেন। এর বহু দৃষ্টান্ত মিলবে। জি.এস. ভাট তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, বেলগাঁওয়ে (১৮৯২) থাকাকালে স্বামীজীকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি অ-হিন্দুদের কাছ থেকে খাদ্য গ্রহণ করবেন কিনা। তিনি বলেন, বস্তুতঃপক্ষে বেশ কয়েকবারই তাকে মুসলমানদের দেওয়া খাবার খেতে হয়েছে।৪৬ স্বামী অখণ্ডানন্দ ও স্বামীজী যখন আলমােড়া যাচ্ছিলেন তখন স্বামীজী অসুস্থ হয়ে পড়েন ক্ষুধায়। জুলফিকার আলি নামে এক নিষ্ঠাবান ফকিরের দেওয়া শশা খেয়ে তিনি সুস্থ হন।৪৭ পরে স্বামীজী সেই ফকিরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। (সেই ফকিরের মাজার ও তার উত্তরসুরিরা আলমােড়ায় এখনও আছে। আলমােড়ার রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম সেই মাজারের রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং ফকির পরিবারকে এখনও অর্থ সাহায্য করে)।
প্রমথনাথ বসু অন্যত্র উল্লেখ করেছেন, “শেঠজীর বাগানে (মীরাটে) থাকার সময়ে অখণ্ডানন্দ তাহার নিকট তাহার পূর্ব পরিচিত কাবুলের আমিরের এক আত্মীয়কে আনয়ন করেন। এই ভদ্রলােক স্বামীজীকে দেখিতে আসিবার সময় অজু (নামাজের পূর্বে হস্তপদাদি প্রক্ষালন করিয়া পবিত্রভাবে প্রচুর মিষ্টান্নাদি উপটৌকন লইয়া আসিতেন। স্বামীজী তাহার সহিত শ্বাতের সুপ্রসিদ্ধ মুসলমান ফকির আখুদের সম্বন্ধে কথাবার্তা বলিলেন।৪৮
১৮৯১-এর ফেব্রুয়ারিতে স্বামীজী যখন আলােয়ারে যান, তখন এক শিক্ষক-মৌলবী সাহেবের আমন্ত্রণে, তিনি মৌলবী সাহেবের বাড়িতে যান। মৌলবী সাহেবের আতিথ্য গ্রহণ করেন। মৌলবী সাহেবের সাধুসেবা দেখিয়া আরও কয়েকজন ভক্ত মুসলমান বন্ধু অতিশয় আগ্রহের সহিত স্বামীজীকে নিজ নিজ ভবনে নিমন্ত্রণ করিয়া ভােজন করাইলেন।৪৯
নিবেদিতা লিখেছেন: “পাঞ্জাবে ঢুকবার সময়ে, যেমন তার শেষ জীবনে বারাণসীতে করেছিলেন। তিনি একজন মুসলমান মিষ্টান্ন বিক্রেতাকে ডেকে নিয়ে তার হাত থেকে মুসলমানী খাবার খেয়েছিলেন।”৫০
১৮৯১-এর এপ্রিলে স্বামীজী আবুপাহাড়ের এক গুহাতে তপস্যাদি করছিলেন। জনৈক মুসলমান উকিল তাঁকে গৃহে আমন্ত্রণ করেন। স্বামীজী সেই মুসলিম উকিলের বাড়িতে গেলে বহু লােক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তাদের মধ্যে খেতড়ি রাজার প্রাইভেট সেক্রেটারি মুন্সি জগমােহন মুসলমানের বাড়িতে স্বামীজীর থাকা পছন্দ করেননি। তিনি স্বামীজীকে বলেছিলেন, “আপনি তাে হিন্দু সাধু, আপনি মুসলমান বাড়িতে আছেন কি করে? আপনার খাদ্য হয়তাে অপরে (মুসলমান) কখনাে-সখনােছুঁয়েই ফেলে।” এইঅনুদার প্রশ্নের জবাবে স্বামীজী সবিস্ময়ে বলেছিলেন, “আপনি বলছেন কি? আমি তাে সন্ন্যাসী, আমি আপনাদের সমস্ত সামাজিক বিধিনিষেধের উর্ধ্বে। আমি ভঙ্গীর (মেথরের) সঙ্গে পর্যন্ত খেতে পারি। ভগবান অপরাধ নেবেন, সে ভয় আমার নেই; কেননা এটা ভগবানের অনুমােদিত। শাস্ত্রের দিক থেকেও আমার ভয় নেই। কেননা, শাস্ত্রে এটা অনুমােদিত। তবে আপনাদের এবং আপনাদের সমাজের ভয় আছে বটে। আপনারা তাে আর ভগবান বা শাস্ত্রের ধার ধারেন না। আমি দেখি বিশ্বপ্রপঞ্চের সর্বত্র ব্রহ্ম প্রকাশিত আছেন, আমার দৃষ্টিতে উচ্চনীচ নেই।”৫১ ছোঁয়াছুঁয়ির ক্ষেত্রে মুসলমানের প্রতি সমাজের যে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি ছিল—স্বামীজী তা থেকে পুরােপুরি মুক্ত ছিলেন।
মহীশূরের প্রধানমন্ত্রী কে.পি.পুওনা চেট্টিয়ার-এর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, বিবেকানন্দ তিন কি চার সপ্তাহের জন্য দেওয়ান কে. শেষাদ্রি আয়ারের অতিথি হয়েছিলেন। তাঁর অবস্থানকালে তার দর্শন পাবার জন্য স্বধর্মর্ভুক্ত মানুষই কেবল উদগ্রীব হতেন না, অন্য ধর্ম মত ও পথের মানুষেরাও একই আগ্রহবােধ করতেন। রাজ্য-কাউন্সিলের সদস্য পরলােকগত আবদুল (আব্দুর) রহমান সাহেব কোরানের কোন একটি বিষয় সম্বন্ধে সন্দেহ মিটিয়ে নেবার জন্য তার কাছে গিয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ সন্দেহ মেটাতে সমর্থ বুঝেই তিনি নিশ্চয় তার কাছে যান। রহমান সাহেব হিন্দু ফকিরের মুসলমান ধর্মশাস্ত্রে এরূপ গভীর জ্ঞান দেখে স্তম্ভিত হন। ৫২ এ থেকে বােঝা যায় বিবেকানন্দ কোরানের অর্থও আয়ত্ত করেন।
১৮৯২ সালে ত্রিবান্দ্রমে স্বামী বিবেকানন্দের সহযাত্রী হয়েছিলেন সাধারণ একজন মুসলমান পিয়ন। অধ্যাপক সুন্দররাম আয়ার তার স্মৃতি-কথায় বলেছেন : “১৮৯২ খ্রীঃ ডিসেম্বর মাসে ত্রিবান্দ্রমে স্বামী বিবেকানন্দের সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি ভারতের অনেক স্থান পর্যটন করিয়া এইখানে উপস্থিত হইয়াছিলেন। তাহার সহিত একজন মুসলমান অনুচর ছিল। তাহারও (স্বামী বিবেকানন্দের) বেশভূষা এইরূপ যে দেখিয়া মুসলমান বলিয়া ভ্রম হইত। আমার দ্বাদশবর্ষ বয়স্ক দ্বিতীয় পুত্র তাহাকে মুসলমান মনে করিয়া সেইভাবে আমাকে খবর দিল। আমি তাহাকে উপরে লইয়া গিয়া তাহার যথার্থ পরিচয়প্রাপ্তির পর তাঁহাকে সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিলাম। তিনি সর্বপ্রথমেই আমাকে মুসলমান সঙ্গীটির আহারের বন্দোবস্ত করিতে বলিলেন। সে ব্যক্তি কোচিন রাজের একজন পিয়ন। দেওয়ানের সেক্রেটারি মিঃ ডব্লিউ রামাইয়া তাহাকে স্বামীজীর সঙ্গে পাঠাইয়াছিলেন। শুনিলাম, দুইদিন হইতে তিনি দুগ্ধ ব্যতীত অন্য কোন খাদ্য গ্রহণ করেন নাই, কিন্তু অগ্রে মুসলমান অনুচরটির আহারের ব্যবস্থা হইলে স্বয়ং আহার করিতে সম্মত হইলেন না।”৫৩ স্পষ্টতই বােঝা যায় মুসলিমদের প্রতি গোঁড়ামি বা সঙ্কীর্ণতাজাত আচরণকে তিনি কোনমতে সহ্য করতেন না।
১৮৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পরিব্রাজক বিবেকানন্দ হায়দ্রাবাদে পৌঁছলে বহুসংখ্যক সম্রান্ত মুসলমান তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এঁদের মধ্যে ছিলেন শামসুল উলামা সৈয়দ আলি বেলগ্রামী, নবাব ইসাদজঙ্গ বাহাদুর, নবাব দুলা খাঁ বাহাদুর, নবাব ইমাদ নওয়াজ জঙ্গ বাহাদুর, নবাব সেকেন্দর নওয়াজ জঙ্গ বাহাদুর প্রমুখ।
সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে মুসলিমদের সঙ্গে যে আন্তরিক একাত্মতার দৃষ্টান্ত স্বামীজী ব্যক্তিজীবনে স্থাপন করে গেছেন, তাতে করে সামাজিক জীবনে হিন্দু-মুসলিম ভাবভালােবাসার দুয়ার উন্মােচিত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, তার মুসলমান সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি, সর্বসমক্ষে সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন নিজের জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে। মুসলমানদের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালােবাসা ছিল। নিবেদিতাকে তিনি বলেছিলেন, ‘কি জানাে, আমার মুসলমানদের আমি ভালবাসি।৫৪ হিন্দু-মুসলিমের সামাজিক মেলামেশার পথে স্বামীজী ছিলেন দৃঢ়তম মাইলস্টোন!
বিবেকানন্দ তার সৃষ্ট সাহিত্যে শব্দ ব্যবহার ও প্রয়ােগের মধ্যেও তার ইসলামী সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের প্রমাণ দিয়েছেন। বিবেকানন্দের বাংলা ভাষা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী, বেগবান এবং মাটির কাছাকাছি। বাংলা ভাষায় বিশেষ করে প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার কথ্য ভাষাতে যেসব আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার রয়েছে সেগুলি এ ভাষাকে জীবনমুখী করে রাখতে অনেকটা সাহায্য করেছে। বিবেকানন্দ তার রচনায় বহু আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন : বাকী, হুশিয়ার, জবাব, রােজ, জমি, খুব, খবর, হুকুম, মুশকিল, দখল, আসবাব, ঈশা (বহুস্থানেই যীশুখ্রীস্ট না বলে ঈশা বলেছেন; ইমিটেশন অফ ক্রায়েষ্ট গ্রন্থের নামকরণ করেছেন—ঈশানুসরণ’) বাদশাহ, পয়গম্বর, সুফী, তােফা, তাকিয়া, বরবাদ, রাজী, বাদে, ফতে, লােকসান (নুকসান), পরােয়া, হুঁশিয়ার এবং আরও অসংখ্য আরবি ফারসি শব্দ। বিবেকানন্দ ‘জল হাওয়া’ ব্যবহার না করে ‘আবহাওয়া ব্যবহার করেছেন। বিবেকানন্দের এই শব্দ-প্রয়ােগ যে সংস্কৃতি সমন্বয়ে সাহায্য করেছে এ কথা অস্বীকার করা যায় না।৫৫ রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষাদর্শের ক্ষেত্রেও মুসলিমদের সাদরে স্থান করে দিয়েছেন তিনি। স্বামী অখণ্ডানন্দকে লেখা এক চিঠিতে (১০ অক্টোবর, ১৮৯৭) তিনি নির্দেশ দেন, আশ্রম বিদ্যালয়ে “মুসলমান বালকও লইতে হইবে বৈকি এবং তাহাদের ধর্ম নষ্ট করিবে না। তাহাদের খাওয়া-দাওয়া আল করিয়া দিলেই হইল এবং যাহাতে তাহারা নীতিপরায়ণ, মনুষ্যত্বশীল এবং পরহিতরত হয় এই প্রকার শিক্ষা দিবে।… আর ধর্মের যে সর্বজনীন ভাব, তাই শিখাইবে।”৫৬ ইসলাম সম্পর্কে স্বামীজীর অন্তর যে খুবই সহানুভূতিশীল ছিল— আশা করি এইসব দৃষ্টান্তের মধ্যে দিয়েই তা পরিস্ফুট হবে।
ইসলামের শাস্ত্র বলতে মূলত পবিত্র কোরান ও হাদিসগ্রন্থগুলিকে বােঝায়। এ বিষয়ে স্বামীজীর দু-একটা বক্তব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমটি কোরান সম্পর্কে। স্বামীজী কোরানের পাঠের শুদ্ধতার বিশ্বাস করতেন। ১৮৯১-এর ফেব্রুয়ারিতে, আলেয়ারে স্বামীজী কোরান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “কোরান সম্বন্ধে এই আশ্চর্য বিশেষত্ব দেখা যায় যে, এগারশত বৎসর পূর্বে উহা যেমন ছিল, এখনও ঠিক তাই আছে, এর সুপ্রাচীন বিশুদ্ধতা রক্ষিত হয়েছে, এবং কেউ এর উপর কলম চালাতে পারেনি।”৫৭ অর্থাৎ কোরানের বিশুদ্ধতায় স্বামীজী পুরােপুরি বিশ্বাস করতেন।
এসব কথা স্বামীজী আবেগে বলেননি। তিনি খুব ভাল করে ইসলামী শাস্ত্র জানতেন। তাঁর বাড়িতেই কোরান পাঠ হত।৫৮ এবং তিনি নিজেও কোরান অনুশীলন করেছিলেন। কোরান অনুশীলনে তাঁর গভীর নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায় তারই উক্তি থেকে। কোরান নাকি নারীর আত্মায় বিশ্বাস করে না—এমনই এক ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করতে গিয়ে স্বামীজী বলেছিলেন : “মুসলমান ধর্মাবলম্বীগণ স্ত্রীজাতির কোন আত্মা আছে বলিয়া বিশ্বাস করে না—এই প্রকার যে উক্তি এখানে আমার নিকট করা হইয়াছে তাহা ভ্রান্ত। …কথা প্রসঙ্গে বলিয়া রাখি যে আমি মুসলমান নই, কিন্তু উক্ত ধর্ম সম্বন্ধে অনুশীলন করিবার সুযােগ আমার হইয়াছিল এবং আমি দেখিয়াছি, কোরানে এমন একটিও উক্তি নাই যার অর্থ নারীর আত্মা নাই; বস্তুত কোরান বলে নারীর আত্মা আছে।”৫৯ এর থেকে প্রমাণিত হয়, কোরানের সারতত্ত্ব তার জানা ছিল। তাই কোরান সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মানুষের সঙ্কীর্ণ সমালােচনাকে তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।
স্বামীজী এক জায়গায় বলেছেন যে, মুসলমান আক্রমণের সময়ে দেশে হত্যালীলা ও নিধন যজ্ঞের সূত্রপাত হয় কিন্তু হিন্দু সমাজের মধ্যে প্রচলিত নিষ্ঠুর প্রথাগুলি সম্বন্ধে তিনিই বলেছেন: “যদি কোনাে শুদ্র বেদমন্ত্র শ্রবণ কোরতাে তাহলে তার কর্ণকহরে জুলন্ত সিসা ঢেলে দেওয়া হােতাে, যদি সে বেদমন্ত্র উচ্চারণ কোরতাে তার জিহ্বা ছেদন করা হােতাে। যদি সে ব্রাহ্মণকে ‘ওহে ব্রাহ্মণ’ বলে সম্বােধন কোরতাে তাহলেও তার জিহ্বা ছেদন করা হােতাে। ঋক ও অথর্ব বেদে দাস ও দস্যু জাতিকে অগ্নিসংযােগে হত্যা করবার নির্দেশ দেওয়া আছে।”
স্বামীজীর মতে, “স্বাধীনতা ছাড়া কখনই উন্নতি লাভ সম্ভব নয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধর্মীয় চিন্তাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং তাই আমাদের রয়েছে এক অভূতপূর্ব ধর্মদর্শন, কিন্তু তারা সমাজকে পায়ে কঠিন বেড়ি বেঁধে রেখে দিয়েছিলেন এবং তাই আমাদের সমাজ, এক ভয়ঙ্কর পৈশাচিক। পাশ্চাত্যদেশে সমাজ সকল সময়ে মুক্ত ছিল এবং তাই তাদের অবস্থা দেখুন। ওদিকে তাদের ধর্মদর্শনের অবস্থাও দেখুন।…আমরা জাগতিক সভ্যতা সম্বন্ধে নির্বোধের মত কথা বলি। সে নির্বুদ্ধিতাকে মেনে নিয়েও ধরুন ভারতে এক লক্ষ সত্যকার আধ্যাত্মিক পুরুষ আছেন। এই এক লক্ষ সাধুকে সাধুত্বে রাখবার জন্যে কি ভারতের ত্রিশ কোটি লােককে দুর্দশা ও উপবাসের মধ্যে থাকতে হবে? হিন্দুরা মুসলমানদের নিকট পরাজিত হয়েছিল কেন? কারণ হিন্দুরা জাগতিক সভ্যতা সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল। এমনকি সেলাই করা জামাকাপড় পরতে মুসলমানরাই তাদের শিখিয়েছিল। এমনকি পরিষ্কারভাবে খাবার খাওয়াও তারা মুসলমানদের নিকট থেকে শিখেছিল।”৬০
বর্তমান হিন্দু সমাজের গােড়াপত্তনই হয়েছিল জাতি বিভাগের বিকৃত অর্থসৃষ্টি ও তার প্রয়ােগের উপর। সেই কারণে এ সমাজে অসাম্য ও অবিচার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছিল তখন থেকেই। এই সামাজিক অসাম্য ও অবিচার একদিকে হিন্দু সমাজকে পাকাপাকিভাবে বিভক্ত করে দিয়েছিল অন্যদিকে এই অসাম্য ও অবিচারের সমর্থক ও পৃষ্ঠপােষক শ্রেণি এক বিকৃত মানসিকতার জন্ম দিয়েছিলেন যার ফলে তারা সমগ্র মনুষ্য সমাজের এই মানসিকতাকে ঘৃণার বস্তু হিসাবে চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন। মুসলমানের ভারত আক্রমণ কালক্রমে অন্যায় ও অত্যাচারী মানসিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মের সাম্যের বন্দনা যাতে ভারতের অত্যাচারিত শ্রেণিকে লাভবান করে তুলতে পারে সেই প্রচেষ্টারও রূপ নিয়েছিল।
বিবেকানন্দের নামের সঙ্গে যাঁদের নাম ওতপ্রােতভাবে জড়িত তাদের একজন হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস (যিনি বিবেকানন্দের গুরু) আর একজন হলেন ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা ছিলেন বিবেকানন্দের অন্যতম প্রধান পাশ্চাত্য শিষ্যা। ইসলাম এবং মুসলমানদের জীবন ও সংস্কৃতি বিষয়ে নিবেদিতার চিন্তাদর্শ ছিল স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারার অনুরূপ। নিবেদিতা মুসলমানদের প্রতি গভীর প্রীতি-সম্পন্ন ছিলেন। এই প্রতি তিনি তার গুরু স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছেন, স্বামীজীর সূত্র ধরেই নিবেদিতা তার ইসলাম-সমাদরের ব্যাপারে অগ্রসর হয়েছেন।৬১
ভারতীয় জীবনে ইসলামের সামগ্রিক প্রভাব আলােচনা প্রসঙ্গে নিবেদিতা বলেছেন : “…যেখানেই শিক্ষা মুসলমান চেতনাকে ছুঁয়েছে, সেখানেই প্রতিযােগিতার মাধ্যমে দেখা দিয়েছে সুগঠিত জাতি। যেখানে ইসলামের সঙ্গে সংযােগ হয়নি, যেমন একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে সেখানে এই মানসিক শক্তি জাতীয়তাবাদকে জাগাতে পারেনি।…আমরা এও দেখেছি যে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে যেসব যুদ্ধ হয়েছিল, সেগুলােও ছিল অনেকটা ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের শক্তি পরীক্ষার মত। এক্ষেত্রে লড়াই ছিল ব্যক্তিগত, দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব নয়। বিজয়ী পক্ষ কখনােই জয়ের পর প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্প্রদায়কে পদচ্যুত কিংবা উভয়ের মধ্যে পার্থক্যও সৃষ্টি করত না। বাংলায় বড় বড় মহাজন ও অভিজাতরা নবাবী শাসনে ঠিক তেমনভাবে হিন্দুই থেকে গিয়েছিল, যেমন হিন্দু সিংহাসনের ছায়ায় মুসলমানও তার ধর্মবিশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই বজায় রেখেছিল।৬২
ইসলামের আদর্শ, ইসলামের শিক্ষা, ইসলামিক সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে নিবেদিতা যে বিশেষ জ্ঞানার্জন করেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ মিলে তঁার ‘ভারতে ইসলাম ধর্ম’ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধ নিবেদিতার গভীর ইতিহাস-চেতনা ও পয়গম্বর হজরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রতি তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধার স্বাক্ষর বহন করছে।
ভারতের ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের ভূমিকা সম্পর্কে স্বামীজী কি মনােভাব পােষণ করতেন এবং স্বামীজীর দৃষ্টিতে মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে কি চিত্র ফুটে উঠেছিল সে বিষয়ে বলতে গিয়ে নিবেদিতা লিখেছেন: “(ভারতের গৌরবের) কথা বলতে গিয়ে তিনি রাজপুত বীরত্ব, শিখ সম্প্রদায়ের গভীর ধর্মবিশ্বাস, মারাঠাদের অপূর্ব সাহসিকতা, সাধু-সন্তের নিষ্ঠা এবং মহীয়সী রমণীদের পবিত্রতা ও গভীর অনুরক্তি প্রভৃতিকে যেন আবার জীবন্ত করে তুলতেন। মুসলমানেরা যাতে বাদ পড়ে যায় তেমন কিছু তিনি করতে পারতেন না। হুমায়ুন, শেরশাহ, আকবর, শাহজাহান এরা প্রত্যেকে এবং আরও শতাধিক কৃতবিদ্য নাম তার প্রতিদিনের তালিকা স্থলে স্থান পেতাে। কখনও কখনও তিনি আকবরের রাজ্যাভিষেক সঙ্গীত সম্বন্ধে আমাদের বলতেন যা দিল্লীর পথে পথে এখনও গীত হয়ে থাকে। এমনকি তা তানসেনের সৃষ্ট ছন্দ ও তালেই আমাদের পরিবেশন করতেন। কখনও কখনও বলতেন। মােগল বংশে বিধবারা কখনও পুনর্বিবাহ করতেন না, হিন্দু বিধবাদের মতই ধর্মসাধনা বা অধ্যয়নে নিঃসঙ্গ বাকি জীবন কাটিয়ে দিতেন। কখনও কখনও সেই জাতীয় প্রতিভার কথা বলতেন যিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ভারতের প্রত্যেক শাসক মুসলমান পিতা ও হিন্দু জননীর সন্তান হওয়া চাই। কখনও কখনও আমরা নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে শুনতাম সিরাজদ্দৌলার উজ্জ্বল কিন্তু দুর্ভাগ্যমণ্ডিত শাসনকালের ইতিহাস। সেই হিন্দু সেনাপতি যিনি বিশ্বাসঘাতকের আদেশ শুনতে পেয়ে পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে বলেছিলেন: “তাহলে সব শেষ হয়ে গেল এবং অশ্বারােহণে গঙ্গাগর্ভে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন তার কথাও স্বামীজী বলতেন। সবার শেষে বলতেন সেই নিষ্ঠাবতী বিধবার কথা যিনি একটি সাদা শাড়ি পরে একাকী তার প্রয়াত প্রভুর কবরে প্রদীপ জ্বেলে দিতেন। তাঁহার মুখে ঐসকল কথা শুনিবার সময়ে দৃশ্যগুলি যেন প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিত।”৬৩
কাশ্মীরে অমরনাথ গুহা দর্শন করতে যাবার সময়ে বহু হিন্দু সন্ন্যাসীর ভিড় হয়েছিল সেখানে, সবাই গৈরিক রংয়ের তাবু খাটিয়ে থাকতেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা পাণ্ডিত্যমণ্ডিত ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই স্বামীজীর কাছে এসে নানা আলােচনা করে যেতেন। নিবেদিতা লিখছেন : “স্বামীজী যখন এইসব সাধুদের দৃষ্টি বহির্বিশ্বে আকর্ষণ করবার চেষ্টা করতেন তারা তখন বলতেন, স্বদেশ বিদেশের পার্থক্য কী আছে সবাই’ত মানুষ। ওদিকে মহম্মদীয় ধর্মের প্রতি স্বামীজীর ভালােবাসা ও সহানুভূতির গভীরত্ব তারা অনেকেই বুঝতে পারতেন না। হিন্দু এবং মুসলমান যেখানে পরস্পরের বিপরীতধর্মী সেখানে তাদের মধ্যে একটা মিলনের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতেও এঁরা পরান্মুখ ছিলেন। এঁদের মতে পাঞ্জাবের মাটি স্বীয় ধর্মে বিশ্ববাসীদের রক্তে সিক্ত হয়েছিল। সেইহেতু এইরূপ একটু গোঁড়ামিতে এঁরা দোষের কিছু দেখতেন না।
এদিকে সেখানকার তহশিলদার এবং অনেক কর্মচারি ও ভৃত্যবৃন্দ মুসলমান ছিল এবং এটা অনেকটা স্ববিরােধী মনে হতে পারে যে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে তারা যখন অমরনাথের গুহায় প্রবেশ করল তখন কেউই আপত্তি করেনি। এটা কেউ খুব অস্বাভাবিক বা অসঙ্গতিপূর্ণ মনে করেনি যে পরে ওই তহশিলদার এবং আরও কেউ কেউ স্বামীজীর শিষ্য হবার জন্য তাঁর নিকট প্রার্থী হয়েছিল।”৬৪
যথার্থ ধর্মবােধ মানুষকে সকল প্রকার সংস্কার থেকে মুক্ত করে। বিবেকানন্দ ছিলেন সংস্কারমুক্ত পুরুষ। এই প্রসঙ্গে নিবেদিতা ১৮৯৮ জুন মাসের শ্রীনগর উপত্যকার একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন : “তাহার সহিত আমরা নিকটের গােলাবাড়িতে প্রবেশ করিলাম। সেখানে দেখিলাম, গাছের তলায় এক অসাধারণ সুন্দরী বর্ষীয়সী মহিলা বসিয়া আছেন। তাহার মাথায় কাশ্মরী নারী-সুলভ গাঢ় লাল রঙের টুপি, তদুপরি শ্বেত অবগুণ্ঠন। তিনি বসিয়া পশমের সুতা কাটিতেছিলেন এবং চারিপাশে বসিয়া তাহার দুই পুত্রবধূ ও তাহাদের পুত্র-কন্যারা তাহাকে সাহায্য করিতেছিল। স্বামীজী পূর্ববর্তী শরৎকালে এই গােলাবাড়িতে একবার আসিয়াছিলেন, এবং পরে বারবার এই মহিলার স্বধর্মে বিশ্বাস ও গৌরবানুভূতির কথা বলিয়াছিলেন। তিনি সেবার তাহার কাছে জল খাইতে চাহিলে মহিলা তৎক্ষণাৎ তাহা দেন। বিদায় লইবার কালে স্বামীজী তাহাকে ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করেন, “মা, আপনার ধর্ম কি?’ গর্ব ও উল্লাসের ঝঙ্কারিত কণ্ঠে বৃদ্ধা বলেন, “আল্লার দয়ায় আমি মুসলমানী!’ এখন সমগ্র পরিবার তাহাকে পুরাতন বন্ধুরূপে গ্রহণ করিল, এবং তিনি যে সকল সঙ্গীসহ আসিয়াছিলেন তাঁহাদের প্রতি সর্বপ্রকার সৌজন্য প্রকাশে ব্যাপৃত রহিল।৬৫
কাশ্মীরে একদল মুসলমান রাখালকে নামাজ পড়তে দেখে নিবেদিতার মনে যে ভাবােদয় হয়েছিল তার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন—“একদিন গােধূলি সময়ে উচ্চ নদীতীরে ভ্রমণ করিতে করিতে দেখিতে পাইলাম, একদল মুসলমান রাখাল মাথা বাঁকানাে লম্বা ছড়ি হাতে কতকগুলি রামছাগল তাড়াইয়া লইয়া গ্রামের দিকে যাইতেছে। কয়েকটি আপেল গাছের নিকট পৌঁছিয়া তাহারা একটু থামিল এবং প্রার্থনাকালে ব্যবহৃত গালিচার পরিবর্তে কম্বল বিছাইয়া সেই ঘনায়মান গােধূলি-আলােকে সান্ধ্য উপাসনা আরম্ভ করিল। হৃদয় বলিয়া উঠে, এ সৌন্দর্যের অন্ত নাই, বাস্তবিক অন্ত নাই।”৬৬
স্বামী বিবেকানন্দ জঙ্গলে নির্জন বাস করতে যাবার আগে উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলেন, মাথার উপর নবীন চন্দ্রে শােভা। সহসা দিব্যভাবে তার কণ্ঠ আবিষ্ট হয়ে উঠল, বললেন “দেখ, মুসলমানেরা দ্বিতীয়ার চাদকে বিশেষ সমাদরের চোখে দেখে। এস, আমরাও এই নবীন চন্দ্রমার সঙ্গে নবজীবন আরম্ভ করি।”৬৭
নিবেদিতার কথায় জানা যায়, ইংল্যাণ্ড যাবার সময়ে একবার তিনি খুব আনন্দের সঙ্গে বলছিলেন তুর্কিদের সমুদ্র বিষয়ক জ্ঞান কতটা নিখুঁত, তারা ব্যবহারে কত ভদ্র। জাহাজের মুসলমান ভৃত্যরা তাকে শিশুদের মত ভক্তি করছে দেখে তিনি খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং বললেন: “দেখাে, আমি দেশের মুসলমানদের ভালােবাসি। নিবেদিতা বললেন: ‘কিন্তু প্রত্যেক মানুষের ভালাে দিকটা দেখার এই যে প্রবণতা এটা আপনি কোন সূত্রে পেয়েছেন? এর মধ্যে কোনাে ঐতিহাসিক ধারা কি আপনি দেখতে পেয়েছেন? না শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা থেকে আপনি এটা লাভ করেছেন?’ স্বামীজী বললেন : এটা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের শিক্ষা থেকেই আমি লাভ করেছি। আমরা সকলেই তার দেখানাে পথেই চলেছি। অবশ্য সেটা খুব কঠিন ছিল না কারণ তিনি নিজেই এসব আদর্শ কার্যে পরিণত করেছিলেন। তিনি যাদের সম্বন্ধে জানতে চাইতেন তাদের খাদ্য খেতেন এবং তাদের পােষাক পরতেন, তাদের কাছে। শিক্ষা নিতেন এবং তাদের ভাষার কথা বলতেন। তিনি বলতেন: ‘একেবারে অন্যের আত্মার সঙ্গে একাত্ম হতে পারার শিক্ষাই প্রয়ােজন। এবং সেইটাই তার নিজস্ব রীতি ছিল। ভারতবর্ষে তার আগে কেউ একাধারে পর্যায়ক্রমে ক্রীশ্চান, মুসলমান ও বৈষ্ণব হতে পারেনি।৬৮
নিবেদিতা আরও লিখেছেন: “(স্বামীজীর মতে) খৃষ্টধর্ম বর্তমানকালে যেভাবে কাজ করছে সেটাকে গ্রহণ করা কঠিন। কিন্তু আর একটি অহিন্দু ধর্মবিশ্বাস ইসলামের বেলা সে কথা খাটে না। ইসলামের নামে আমার গুরুর মনে যে চিত্র ফুটে উঠতাে সেটা হচ্ছে আবেগময় সৌভ্রাতৃত্ব, সাধারণ মানুষকে মর্যাদাবান করে তােলা এবং উচ্চ শ্রেণীকে সাম্যের ভাবে নিয়ে আসা। বর্তমান ভারতের বিবর্তনের ইতিহাসে তিনি ইসলামী বহিরাগতদের অবদানের কথা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারতেন না যারা অতীতের ভারতীয় সভ্যতা ও শাসন ব্যবস্থাকে আনুগত্যের সঙ্গে গ্রহণ করে নিজস্ব করে নিয়েছিল। তিনি এটাও ভুলতে পারতেন না যে তারা শুধুমাত্র জন্মসূত্রে নিম্নজাতীয়দের সামাজিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেনি পরন্তু এক অতি সহিষ্ণুতাপরায়ণ জাতির মধ্যে সংঘবদ্ধ সংগ্রাম এবং প্রতিরােধের আদর্শকে সঞ্জীবিত ও বিকশিত করবার কাজেও আত্মনিয়ােগ করেছিল। তিনি বারবার উল্লেখ করতেন যে মুসলমানদের মধ্যেও চারটি ‘জাতি’ আছে— সৈয়দ, পাঠান, মােগল এবং শেখ। এদের মধ্যে শেখদের ভারতভূমিতে এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের উপর এক জন্মগত অধিকার রয়েছে যেটা যে কোনাে হিন্দুর ক্ষেত্রে যেমন তেমনি সুপ্রাচীন এবং অবিসম্বাদিত। একটি অবিজ্ঞজনােচিত বক্তব্যকে লক্ষ্য করে তিনি এক শিষ্যকে বলেছিলেন: শাহজাহান যদি শুনতে পান তাঁকে বিদেশী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে তাহলে তিনি তার কবরের মধ্যেও ছটফট করতেন। সর্বোপরি তার দেশমাতৃকার মঙ্গলের জন্যে তার মহত্তম প্রার্থনা এই ছিল যে ‘বৈদান্তিক হৃদয় এবং ইসলামি দেহের যৌথ আদর্শ দেশে প্রতিষ্ঠিত হােক।৬৯
বিবেকানন্দের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল এই সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গী। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে ম্লেচ্ছ বলে আর কেউ নেই, অন্ত্যজ বলেও কেউ নেই। তারা সকলেই নারায়ণ।’ বিবেকানন্দের এই ঘােষণার পর বহুকাল গত হয়ে গেছে। তার মৃত্যুর (১৯০২) ১১০ বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু এত দীর্ঘ সময়ের পরও একবিংশশতকে দাঁড়িয়ে আমরা ভারতবাসীরা আর এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। বিবেকানন্দের সহিষ্ণুতার বাণী বর্জন করে ভারতবাসী পুনরায় পিছু হাঁটছে। পিছু হাঁটছে স্থবিরতার দিকে, পিছু হাঁটছে জাতপাতের ভেদাভেদের দিকে, পিছু হেঁটে চলেছে এক ঘৃণ্য ধর্মান্ধতার অন্ধকারে। স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিচ্ছবি পূজিত হচ্ছে ঘরে ঘরে। অথচ বিবেকানন্দের বাণী সম্পর্কে কেউ সচেতন নয়। তিনি বলেছেন, ‘কোন মানুষ নিজের ভ্রাতার অবনতি ঘটিয়ে নিজে অবনতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে কি?’ স্বামী বিবেকানন্দ একাধিক জায়গায় উল্লেখ করেছেন হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়, প্রেম, প্রীতি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা। হিন্দু-মুসলমানের যুগ্ম সাধনাই ভারতবর্ষকে এক উন্নত, সুসংহত জীবনের ধারণা দিতে পারে।
তথ্যসূত্র :
১. মানবেন্দ্রনাথ রায়, দ্য হিস্টোরিক্যাল রােল অফ ইসলাম, বাংলা অনুবাদ-অধ্যাপক এম আবদুল হাই, রেনেসাঁস, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৭-১০।
২. শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, খণ্ড-৫, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ৩৮৯।
৩. রােমা রােলাঁ, দ্য লাইফ অফ বিবেকানন্দ, ঋষি দাস কর্তৃক অনুদিত- বিবেকানন্দের জীবনী, অদ্বৈত আশ্রম, কলকাতা, পৃ. ৩৬২।
৪. মহাপুরুষ প্রসঙ্গ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৮৮।
৫. স্বামী বিবেকানন্দ, ধর্ম’, ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী সঞ্চয়ন’,উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৫৩।
৬. মহাপুরুষ প্রসঙ্গ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৯৫।
৭. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৩৫৭।
৮. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১২৭।
৯. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১২৬।
১০. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৮ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৩৫৬ – ৫৮।
১১. ভগিনী নিবেদিতা, স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ৪৫; ৯ জুন ১৮৯৮-এর নােট, আলমােড়া; স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা, খণ্ড-৯, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ২৮৩।
১২. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ২৭৫।
১৩. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৬, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৬০-১৬২।
১৪. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৪, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, দেবযানী; স্বামী প্রেমঘনানন্দ সম্পাদিত, তপস্বিনী রাবেয়া, কলকাতা, পৃ. ৪৫৫-৪৬১।
১৫. মহাপুরুষ প্রসঙ্গ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ.১৯৪-১৯৫।
১৬. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৮৮; ক্যালিফোর্ণিয়া বক্তৃতা, ২৮ জানুয়ারি ১৯০০।
১৭. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৮৯; ক্যালিফোর্ণিয়া বক্তৃতা, ২৮ জানুয়ারি ১৯০০।
১৮.ভগিনী নিবেদিতা, দ্য মাস্টার অ্যাজ আইস হিম, স্বামী মাধবানন্দ অনুদিত—স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৮৪,পৃ. ২৪৯।
১৯. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধনী কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪১৭
২০. ভগিনী নিবেদিতা, স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ৯৬।
২১. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৬, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৯৭।
২২. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, তৃতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৮৮-১৮৯।
২৩. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, তৃতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৮৯।
২৪. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, তৃতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৫৪।
২৫. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, তৃতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৫৫।
২৬. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, তৃতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৩৩।
২৭. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, তৃতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৩২-৩৩।
২৮. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৮৬ – ৮৭।
২৯. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৯, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪৩৯।
৩০. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৯, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪৩৯।
৩১. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৫, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪২২।
৩২. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ২১২।
৩৩. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ২০৮।
৩৪. পত্রাবলী, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, পৃ. ২৫ – ২৬।
৩৫. ভারতে বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৩৩২।
৩৬. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৯, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪৯২ – ৯৩, বস্টন-এ প্রশ্নোত্তরের সময়ে বলা।
৩৭. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৯, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ.৪৩৯; ‘ভারতের জীবনব্রত প্রসঙ্গে’, সানডে টাইমস, লণ্ডন, ১৮৯৬।
৩৮. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৫, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৫৬ – ৫৭।
৩৯. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৫, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৯১।
৪০. দেখুন- নবগােপাল বিশ্বাস, বিবেকানন্দের চেয়ে প্রকৃত হিন্দু কেউ নয়, যুবমানস, জুন ১৯৯৩, কলকাতা।
৪১. সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, বিবেকানন্দ চরিত, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৫৯, পৃ. ২৯৫।
৪২. সত্যপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মানবপ্রেমিক বিবেকানন্দ; দেখুন-বিবেকানন্দ স্মৃতি, সাহিত্যম, কলকাতা, পৃ. ৬৮-৬৯।
৪৩. কালেকটেড ওয়াকর্স অফ স্বামী বিবেকানন্দ, খণ্ড-৩, অদ্বৈত আশ্রম, কলকাতা, একাদশ মুদ্রণ, ১৯৮৮, পৃ. ১৯৪।
৪৪. রােমাঁ রােলাঁ, দ্য লাইফ অফ বিবেকানন্দ, ঋষি দাস কর্তৃক অনুদিত, বিবেকানন্দের জীবনী, অদ্বৈত আশ্রম, কলকাতা, পৃ. ৪৪।
৪৫. দেখুন-জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাকাব্য ও মৌলবাদ, এলায়েড পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৩, পৃ. ১৩০।
৪৬. শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৫ম খণ্ড, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ৩৮৫-৮৬।
৪৭. প্রমথনাথ বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯৪-৯৫, পৃ. ১৫৯-৬০।
৪৮. প্রমথনাথ বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯৪-৯৫, পৃ. ১৬৯
৪৯. প্রমথনাথ বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯৪-৯৫, পৃ. ১৭৩-৭৪ ও ১৭৮-৭৯।
৫০. শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, স্বামী-শিষ্য সংবাদ, পূর্বকাণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ১৫১-১৫২
৫১. স্বামী গম্ভীরানন্দ, যুগনায়ক বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, কলকাতা, পৃ. ৩১২-৩১৪।
৫২. প্রমথনাথ বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯৪-৯৫, পৃ. ২৪৪
৫৩. ভারতবর্ষ, ৫ম খণ্ড, কলকাতা, পৃ. ৩৮৫।
৫৪. ভগিনী নিবেদিতা, দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম, স্বামী মাধবানন্দ কর্তৃক অনূদিত স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ষষ্ঠ সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৮৪, পৃ. ১৫৬।
৫৫. আবুল হাসনাত, বিবেকানন্দের ইসলাম ভাবনা, উদ্বোধন, আশ্বিন ১৩৯২, পৃ. ৬৫০।
৫৬. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৭-৮; অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্করীপ্রসাদ বসু ও শঙ্কর সম্পাদিত, বিশ্ব বিবেক, বাক সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৬৩, পৃ. ১৪৮।
৫৭. প্রমথনাথ বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯৪-৯৫, পৃ. ৩০৩-৩০৪।
৫৮. মহেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দের বাল্যজীবনী, মহেন্দ্র পাবলিশিং কমিটি, কলকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৫১।
৫৯.স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪১৭; ‘আত্মানুসন্ধান বা আধ্যাত্মিক গবেষণার ভিত্তি’—লণ্ডনের বক্তৃতা।
৬০. সিলেকশনস্ ওয়ার্কস অফ স্বামী বিবেকানন্দ, ইংরেজির অনুবাদ, অদ্বৈত আশ্রম, ১৯৪৪, পৃ. ৫৩৮।
৬১. শঙ্করীপ্রসাদ বসু, নিবেদিতা লােকমাতা, খণ্ড-২, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ১৬৪।
৬২. কাঞ্চন বসু সম্পাদিত, নিবেদিতা সমগ্র, খণ্ড-১, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশান, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১১৯-১২০
৬৩. ভগিনী নিবেদিতা, দ্য মাস্টার অ্যাজ আইস হিম, স্বামী মাধবানন্দ অনুদিত—স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৮৪, পৃ. ৪২-৪৩।
৬৪. শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, স্বামী-শিষ্য সংবাদ, পূর্বকাণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ ১১৯-১২০।
৬৫. ভগিনী নিবেদিতা, স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ৬৯-৭০।
৬৬. ভগিনী নিবেদিতা, দ্য মাস্টার অ্যাজ আই সহিম, স্বামী মাধবানন্দ অনুদিত—স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৮৪, পৃ.৭৮-৭৯।
৬৭. ভগিনী নিবেদিতা, দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম, স্বামী মাধবানন্দ অনুদিত—স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৮৪, পৃ. ৮৭।
৬৮. শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, স্বামী-শিষ্য সংবাদ, পূর্বকাণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ ২২৮-২২৯।
৬৯. ভগিনী নিবেদিতা, দ্য মাস্টার অ্যাজ আইস হিম, স্বামী মাধবানন্দ অনুদিত—স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৮৪, পৃ. ২৩৯-২৪০।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।