মহারাষ্ট্রে তখন বইছে জাতীয় আন্দোলনের জোয়ার। আন্দোলনকে আরও গতিশীল করতে এবং সমস্ত মানুষকে ‘জাতীয়’ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে মহারাষ্ট্র-কংগ্রেসের প্রাচীনপন্থী নেতা বালগঙ্গাধর তিলক গণপতি উৎসবের প্রবর্তন (১৮৯৩) করেন। গণপতি উৎসবের সাফল্য তাকে অনুপ্রাণিত করে শিবাজী উৎসবের আয়ােজনে। এই উৎসবের ধারণা তাঁর মাথায় আসে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা থেকে। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে এক ইংরেজ ভদ্রলােক একটি চিঠি ছাপেন ছত্রপতি শিবাজীর (১৬৪৭-৮০) রাজধানী রায়গড়ে তাঁর সমাধিসৌধের ভগ্নদশার উল্লেখ করে। সেই চিঠি পড়ে সমাধির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন করেন মহারাষ্ট্রের মানুষ। আবেদনে সাড়া দিয়ে নামমাত্র বার্ষিক পাঁচ টাকা ভাতা মঞ্জুর করে সরকার। সরকারের এই ঔদাসীন্যে ক্ষুব্ধ তিলক জনমত গঠন করেন তার ‘কেশরী’ পত্রিকা মারফৎ। জনগণের বদান্যতায় গড়ে ওঠে কুড়ি হাজার টাকার এক তহবিল। সেই অর্থে সংস্কার হয় শিবাজীর সমাধিসৌধের। সংস্কারপ্রাপ্ত সমাধিসৌধের উদ্বোধন দিবসে এক জনসভার আয়ােজন করা হয় পুনেতে। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন শিবাজীর গুরু রামদাসের এক বংশধর। ফলে সভা এক আলাদা মাত্রা পায়। টেলিগ্রাম করে অভিনন্দন জানান সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতা মহাদেব গােবিন্দ রাণাড়ে। এই সভায় বিপুল জনসমাগমে অভিভূত তিলকের মাথায় আসে শিবাজী উৎসবের কল্পনা। তাছাড়া ‘হিন্দু জাতীয়তা’র যুগে অখন্ড হিন্দু ভারতের নির্মাতারূপে ‘জাতীয়’ বীরের মর্যাদায় ভূষিত হন শিবাজী—মারাঠা নেতা শিবাজী তার সামগ্রিক ক্ষমতা দিয়ে মুসলমান রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে বিরাট মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব হয়েছিল বিঘ্নিত। এই আপাত ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণ আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছিল তিলককে। ফলে ১৮৯৫-এ মহারাষ্ট্রে তিলকের নেতৃত্বে শিবাজী উৎসব প্রবর্তিত হয়।
(১)
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ বালগঙ্গাধর তিলক বলেছিলেন, ‘Swaraj is my birth right and I must have it.’ তিলকের বদ্ধমূল সংস্কার ছিল ধর্মই হল জাতি গঠনের ভিত্তি, সুতরাং হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। তিলকের জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষে হিন্দুত্ববাদ। তিনি হিন্দুত্বের আবেগে ইন্ধন যােগাবার জন্যই গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসবের প্রবর্তন করেন মহারাষ্ট্রে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবের উন্মেষ ঘটিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল এই উৎসব দুটির প্রধান উদ্দেশ্য। তিলক গণপতি এবং শিবাজীকে ‘জাতীয়’ উৎসবে পরিণত করেছিলেন। তিনি শিবাজীর বীরত্ব, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং দেশপ্রেম সম্বন্ধে আলােচনার ব্যবস্থা করেন। শিবাজীর উদ্দেশ্যের সঙ্গে এই নব্য স্বাধীনতাকামীদের একটি ঐক্যমত্য ছিল তা হল, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
শিবাজীর চরিত্র গৌরব প্রতিষ্ঠার জন্য বালগঙ্গাধর বালগঙ্গাধর তিলক যে সব প্রবন্ধাদি লেখেন তাতে মুসলিম বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিলকের আন্দোলনের অল্পকালের মধ্যেই শিবাজী চরিত্রের নব নির্মাণের প্রবল প্রচেষ্টা আরম্ভ হয়। ‘Shivaji and Swaraj were synonymous words.’ একই সঙ্গে চলতে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) বিরুদ্ধে নানারকম কুৎসা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের মধ্যে শঙ্কা এবং ভীতির সঞ্চার হয়।
শিবাজী কতৃক আফজল খানকে হত্যার সমর্থনে১ বালগঙ্গাধর তিলক লেখনী ধারণ করেছিলেন এই জন্য যে, শিবাজীকে তিলক বিবেচনা করতেন জঙ্গী হিন্দুত্বের একজন আদর্শ প্রতিনিধি হিসাবে। শিবাজী যাঁকে ছত্রপতি অর্থাৎ হিন্দুধর্ম অনুযায়ী যিনি বিশ্বের প্রভু, তাঁর জন্মদিন কেন দেশে পালিত হচ্ছে না সেই কারণে দুঃখ প্রকাশ করে তিলক লিখলেন: …জগতের অন্য কোনও দেশের মানুষ এইভাবে একজনকে বিস্মৃত হয়নি যিনি আমাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যিনি হিন্দু হিসাবে আমাদের মর্যাদাকে উর্বে তুলে ধরেছিলেন এবং যিনি আমাদের ধর্মকে বিশেষভাবে একটা পথ দেখিয়েছিলেন।২
বালগঙ্গাধর তিলকের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে শিবাজীর উপর দেবত্ব ও মাহাত্ম্য আরােপের মাধ্যমে ধর্মকে রাজনীতির ক্ষেত্রে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করা। আর গণপতি পুজা একান্তরূপেই পৌরাণিক হিন্দু আচারসম্মত একটি অনুষ্ঠান এবং কোনও অহিন্দুর পক্ষে এরূপ পূজার মাধ্যমে ভারতীয় সত্তার সঙ্গে নিজেকে সনাক্ত করা অসম্ভব। তাই তিনি ধর্ম বলতে স্পষ্ট করে ‘হিন্দু’ শব্দটাই ব্যবহার করেছেন। ‘স্বরাজ’ বলতেও তিনি বুঝিয়েছেন ‘হিন্দু স্বরাজ’ আদর্শকে—যেখানে অহিন্দুদের স্থান নেই। গাে-হত্যা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন: ‘How can I bear this heart rending spectacle? Have all our leaders become like helpless figures on the Chess board ? What misfortune has overtaken the land ?’ কংগ্রেসের কোনও উদারপন্থী নেতা তিলকের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সমালােচনা করলে তিলক উত্তরে বলেন: “There was nothing wrong in providing a platform for the Hindus of all high and low classes to stand together and discharge a joint national duty.’৩
১৮৯৩ সালের আগস্ট মাসে বম্বেতে এক সাঙ্ঘাতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। বােম্বাই এর ইংরেজ গভর্ণর ভারত সরকারের নিকট এক বার্তায় এই দাঙ্গার জন্য ‘গাে-রক্ষা সমিতি’র অত্যুৎসাহী সদস্যদের বাড়াবাড়িকেই দায়ী করেন। যদিও বালগঙ্গাধর তিলক এবং ‘গােরক্ষা সমিতি’ এই অভিযােগ অস্বীকার করেন। এই সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার যে প্রতিবেদন তৈরি করেন তাতে বিবৃত হয় যে, তিলক এবং তাঁর অনুগামীরা এই দাঙ্গা সম্পর্কে আলােচনার জন্য পুনেতে একটি জনসভার ডাক দেন। রাণাডে এবং গােখেল সতর্ক করে বলেন যে, এর দ্বারা সাম্প্রদায়িক সংঘাত আরও বৃদ্ধি পাবে। ওই প্রতিবেদনে আরও লিপিবদ্ধ হয় যে, তৎসত্ত্বেও সভা হল এবং সেখানে রক্ষণশীল হিন্দু নেতারা হিন্দুদের ডাক দিলেন যাতে তারা মুসলমানদের মহরম উৎসবে যােগ না দেয়। এযাবৎ অথাৎ ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত পুনেতে মহরম উৎসবে মুসলমানের সঙ্গে হিন্দুরাও যােগ দিত। এভাবে হিন্দুধর্মীয় চিন্তার নব উন্মেষ ঘটতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার প্রণীত এই সমস্ত প্রতিবেদনে যে যথেষ্ট অতিরঞ্জন রয়েছে সেই সম্পর্কে সন্দেহ নেই। কারণ তিলককে হেয় করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু গণপতি উৎসব যে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার উৎসব সে সম্পর্কে সন্দেহের কারণ নেই। গণপতি উৎসব এযাবৎ পেশােয়াদের পারিবারিক ধর্মোৎসব হিসাবেই পালিত হত। সাধারণ পূজা হিসাবে এর কোনও প্রচলন ছিল না। পেশােয়াদের পতনের পর উৎসবও প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। কিন্তু ১৮৯৩ সালে পুনায় উক্ত জনসভার এক সপ্তাহ পরই দশদিনব্যাপী বিশেষ সমারােহের সঙ্গে এই উৎসব পালিত হল। তিলক তাঁর রক্ষণশীল অনুগামীদের সহযােগিতায় এই রকম বিস্মৃতপ্রায় একটি হিন্দুধর্মীয় উৎসবকে ব্যাপকভাবে সাধারণ্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং কয়েক বছরের মধ্যেই মহারাষ্ট্রে এই উৎসবই হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পরিগণিত হল। তিলকের রাজনৈতিক চরিতকার স্ট্যানলি ওলপার্ট মন্তব্য করেছেন: ‘গণপতি উৎসবের সূচনা করে তিলক এযাবৎকাল বিচ্ছিন্নভাবে জেগে ওঠা রক্ষণশীল চিন্তাভাবনাকে ব্যাপক করবার একটা প্রতিষ্ঠানগত ও প্রথাগত কাঠামাে সৃষ্টি করার উচ্চাকাঙ্খ চরিতার্থ করলেন।৪ তিলক এই সব উৎসবের মধ্যে হিন্দুদের একটা বাৎসরিক ধর্মীয় সমাবেশের আয়ােজন করলেন এবং রাজনীতি ও ধর্মকে একাকার করে দিলেন। অবশ্য এই প্রসঙ্গে এটাও স্মরণ করা প্রয়ােজন যে, তিলক গণপতি উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করার প্রয়াস করেছিলেন—ওই উৎসব উপলক্ষে নানা সেমিনার, বক্তৃতা ইত্যাদি আয়ােজন করে মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশ ঘটানাের প্রয়াস চলত।
তিলকের ধর্মীয় ভাবনা শিক্ষানীতি সম্পর্কে তাঁর চিন্তাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে তিনি স্পষ্টই বলেছেন যে, অন্যান্য কতকগুলি বিশেষ দিকে লক্ষ্য রাখার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাও ধর্মনিরপেক্ষ না হয়ে তা ধর্মভিত্তিক হওয়া প্রয়ােজন। কারণ ধর্মের মধ্য দিয়েই মানুষ ঈশ্বরত্ব প্রাপ্ত হয়। এই ধর্মীয় শিক্ষা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও প্রচলিত হওয়া প্রয়ােজন—এটাই ছিল তাঁর অভিমত। তিনি বলেছেন, বিদ্যালয়ে হিন্দুদের জন্য হিন্দুত্ব এবং মুসলমানদের জন্য ইসলাম শিক্ষা দেওয়া উচিত, যদিও তিনি মনে করতেন সব ধর্মের মধ্যে হিন্দুধর্মই সর্বাপেক্ষা সহনশীল। আর তাঁর এই রক্ষণশীল ধর্মভিত্তিক চিন্তা-ভাবনার জন্যই তিনি সমস্ত রকম সমাজ-সংস্করণ প্রচেষ্টায় বিরােধিতা করেছিলেন। তাই তিনি রাণাডে, গােখেল পৃষ্ঠপােষিত এর সংস্কার প্রচেষ্টার ঘােরতর বিরােধী ছিলেন এবং ১৮৯৫ সালেপুনেতে কংগ্রেস অধিবেশন মন্ডপে এই সংস্কারপন্থী সংগঠনের অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা করেছিলেন।৫
মােটামুটিভাবে বলা যেতে পারে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে তিলকের আপসহীন অসামান্য অবদান সত্ত্বেও তাঁর সমাজ-চিন্তা ও ধর্মচিন্তা রক্ষণশীলই ছিল। তিলকের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সমালােচনা করে মাইকেল এডওয়ার্ডস ‘The Last years of British India’ গ্রন্থে৬ বলেছেন: ‘Tilak had been first to recognise the power of religious feeling as a weapon against the British, Jinnah learned the lesson and turned it against Congress.’
(২)
কলকাতায় শিবাজী উৎসবের প্রচলন হয় ১৯০২-এ। এ-সম্পর্কে প্রফুল্লকুমার সরকার লিখেছেন, “১৯০২ সালের আর একটি স্মরণীয় ঘটনা কলিকাতায় ‘শিবাজী উৎসব’। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রভৃতি নব জাতীয়তাবাদীদের উদ্যোগে এই শিবাজী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মহারাষ্ট্র-নেতা লােকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক এই উৎসবে যােগ দিবার জন্য পুণা হইতে কলিকাতায় আসেন। এই শিবাজী উৎসবের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল শক্তিরূপিণী ভবানীর পূজা।…এই উৎসব উপলক্ষে কলিকাতা টাউন হলে যে বিরাট সভা হয়, রবীন্দ্রনাথ তাহাতে তাঁহার বিখ্যাত কবিতা ‘শিবাজী উৎসব’ পাঠ করেন।”৭ বলে রাখা ভাল যে, পরিবেশ এমন একটা জিনিস যার কিছু না কিছু প্রভাব মানুষকে প্রভাবিত করেই। রবীন্দ্রনাথের ‘শিবাজী উৎসব’ (১৯০৪) কবিতাটি সেই পরিবেশেরই ফসল। ১৯০২ থেকে ১৯০৭ শিবাজী উৎসবের উল্লেখযােগ্য পর্ব। তিলকের এই উৎসবের উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দু জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ করা, গাে-হত্যা বন্ধ করা।৮ স্বদেশী যুগের বিশেষ সময়ে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক পটভূমিকায় এই উৎসব হিন্দু জাতীয়তাবােধের সহায়ক ও সমর্থক হয়ে উঠেছিল।
‘শিবাজী উৎসব উপলক্ষে সখারাম গণেশ দেউস্করের ‘শিবাজী দীক্ষা’ নামে লিখিত পুস্তকের ভূমিকাস্বরূপ ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতাটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই কবিতায় শিবাজী রবীন্দ্রনাথের কাছে শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরই ছিলেন না, ছিলেন আরও বিরাট কিছু
“তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎপ্রভাবৎ
এসিছিল নামি—
‘এক ধর্মরাজ্য’ পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেঁধে দিব আমি।”
রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর অন্যায় কার্যাবলীর জন্য যেভাবে ইতিহাসকেই মিথ্যাময়ী আখ্যা দিয়েছেন তা সঠিক নয়, বহু ক্ষেত্রে শিবাজীর অসংখ্য ন্যায়নীতি বিবর্জিত কার্যকলাপের বিবরণও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। শিবাজী ১৬৬৪ সালে (জানুয়ারি) প্রথম সুরাট লুণ্ঠনের সময় যে নৃশংসতার নিদর্শন রেখেছেন তার তুলনা ভারতের ইতিহাসে দুর্লভ: “যে তিনদিন শিবাজী সুরাট নগরে ছিলেন, সেই তিনদিন এমন কোনও পাশবিক কাজ নেই যা তাঁর দল করেনি। লুঠপাট, ঘরে আগুন দেওয়া, হাজার হাজার মানুষের হাত কেটে দেওয়া, মাথা কেটে দেওয়া, নারীদের ওপর চরম নির্যাতনে সুরাট অধিবাসীর কান্না যে। কোনও মানুষকেই ব্যথিত করে তােলে।”৯
স্যার যদুনাথ সরকার শিবাজীর প্রথম সুরাট লুণ্ঠন সম্পর্কে বলেছেন: “মঙ্গলবার, ৫ই জানুয়ারি, প্রাতে সুরতবাসীগণ সভয়ে শুনিল দুইদিন পূর্বে শিবাজী সসৈন্য আটাশ মাইল দক্ষিণে পৌঁছিয়াছেন এবং সুরতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হইতেছেন। অমনি শহরময় শােরগােল উঠিল; আতঙ্কে লােকজন পলাইতে শুরু করিল।…বুধবার (৬ই জানুয়ারি ১৬৬৪) দুপুরবেলা শিবাজী সুরত শহরের বাহিরে আসিয়া পৌঁছিলেন, এবং ‘বুহানপুর দরজার’ সিকি মাইল দূরে একটি বাগানে নিজ তাম্বু খাটাইলেন। মারাঠা অশ্বারােহীগণ। অমনি অরক্ষিত অর্ধ জনশূন্য শহরে ঢুকিয়া বাড়ীঘর লুট করিয়া তাহাতে আগুন ধরাইয়া দিতে লাগিল। একদল শহরের মধ্য হইতে দুর্গের দেওয়াল লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুঁড়িতে লাগিল, ভয়ে দুর্গরক্ষী বীরগণ কেইই মাথা তুলিল না, বা শহরলুটে বাধা দিল না।
বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি এই চারিদিন ধরিয়া শহর অবাধে লুণ্ঠিত হইল। মারাঠারা প্রত্যহ নূতন নূতন পাড়ায় ঘর জ্বালাইয়া দিতে লাগিল।…সুরত লুণ্ঠনের ফলে অগণিত ধন লাভ হইল। বহু বৎসরেও এই সময়ের মত অর্থ রত্ন ইত্যাদি শহরে সংগৃহীত হয়। নাই। মারাঠারা সােনা, রূপা, মােতি, হীরা ও রত্ন ভিন্ন আর কিছুই ছুইল না। মারাঠারা সুরতবাসীদের ধরিয়া আনিয়া কোথায় তাহারা নিজ নিজ ধনসম্পত্তি লুকাইয়া রাখিয়াছে। তাহার সন্ধানের জন্য কোন প্রকার নিষ্ঠুর পীড়নই বাকী রাখিল না; চাবুক মারা হইল, প্রাণ বধের ভয় দেখানাে হইল, কাহারও এক হাত কাহারও বা দুই হাত কাটিয়া ফেলা হইল, এবং কতক লােকের প্রাণ পৰ্য্যন্ত লওয়া হইল। মিষ্টার এন্টনি স্মিথ (ইংরাজবণিক) স্বচক্ষে দেখিলেন যে, শিবাজীর শিবিরে একদিনে ছাব্বিশজনের মাথা এবং ত্রিশজনের হাত কাটিয়া ফেলা হইল; বন্দীদের যে-কেহ যথেষ্ট টাকা দিতে পারিল না তাহার অঙ্গহানি বা প্রাণবধের আজ্ঞা হইল। শিবাজীর লুঠের প্রণালী এইরূপ, প্রত্যেক বাড়ী হইতে যাহা সম্ভব লইয়া, গৃহস্বামীকে বলা হইল যে যদি বাড়ী বাঁচাইতে চাও ত তাহার জন্য আরও কিছু দাও। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই টাকা আদায় হইল, অমনি নিজ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া ঘরগুলি পুড়াইয়া দিলেন!’ (সুরত কুঠীর পত্র) একজন বুড়া বণিক আগ্রা হইতে চল্লিশটি বলদ বােঝাই করিয়া কাপড় আনিয়াছিল, কিন্তু তাহা বিক্রয় না হওয়ায়, নগদ টাকা দিতে না পারিয়া সে ঐ সমস্ত মাল শিবাজীকে দিতে চাহিল; তবুও তাহার ডান হাত কাটিয়া তাহার কাপড়গুলি পুড়াইয়া তাহাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইল। অথচ একজন ইহুদী মণি-বিক্রেতা বেশ বাঁচিয়া গেল; সে ‘আমার কিছু নাই’ বলিয়া কঁদিতে লাগিল; মারাঠারাও ছাড়িবে না, তাহাকে বধ করিবার হুকুম হইল; তিন তিনবার তরবারি তাহার মাথার চারিদিকে ঘুরাইয়া ঘাড়ে ছোঁয়ান হইল, কিন্তু সে কিছুই দিতে না পারিয়া যেন মৃত্যুর অপেক্ষায় বসিয়া আছে এরূপ ভান করিল; অবশেষে আশা নাই দেখিয়া শিবাজী তাহাকে ছাডিয়া দিলেন। ইংরাজকুঠীর কর্মচারী এন্টনি স্মিথ ডচ ঘাটে নামামাত্র বন্দী হইয়া তিন দিন শিবাজীর শিবিরে আবদ্ধ ছিলেন; অন্যান্য বন্দীর সহিত তাঁহারও ডান হাত কাটার হুকুম হইল; কিন্তু তিনি উর্দু ভাষায় চেঁচাইয়া শিবাজীকে বলিলেন, ‘কাটিতে হয় আমার মাথা কাট, হাত কাটিও না। তখন মারাঠারা তাহার মাথার টুপী খুলিয়া দেখিল যে, তিনি ইংরাজ; দণ্ডাজ্ঞা রদ হইল। পরে তিনশত পঞ্চাশ টাকা দিয়া তিনি মুক্ত হন।”১০
শিবাজী ১৬৭০ সালের ৩ অক্টোবর ১৫ হাজার সৈন্য নিয়ে আবার সুরাট বন্দর লুট করেছিলেন। এসময় সমস্ত ভারতীয় বণিক ও সরকারী কর্মচারী সকলে শহর ছেড়ে দূরে পালিয়ে গিয়েছিল।১১ এ সম্পর্কে আচার্য যদুনাথ সরকার আরও লিখেছেন: “সুরত ছাড়িবার সময় শিবাজী শহরের শাসনকর্তা এবং প্রধান বণিকদের নামে এই মর্মে এক চিঠি পাঠাইলেন যে, যদি তাহারা বৎসর বৎসর বারাে লাখ টাকা কর না দেয়, তবে তিনি আগামী বৎসর আসিয়া বাকী ঘরগুলিও পুড়াইয়া দিয়া যাইবেন।”১২ শিবাজীর মধ্যে এই লুণ্ঠনবৃত্তি এমন প্রবল ছিল যে, মৃত্যুর কয়েকমাস আগেও মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত জালনা শহরে ঢুকে নির্বিচারে লুণ্ঠন চালান ও সৈয়দ জান মহম্মদ নামক পীরের আস্তানাতেও তাণ্ডব চালান। যদুনাথ সরকার লিখেছেন: “On 4th November, Shivaji marched out of Selgur ( 92 k.m i,e 55 Miles west of Bijapur). His cavalry 18000 strong, rapidly moved north wards in two parallel divisions under shivaji and Anand Rao and poured like a floor through the districts of Mughal deccan, plundering and burning all the places in their track and taking an immense booty in cash and kind. In the middle of the month, Jalna, a popular trading town, 64 km. (40 miles) east of Aurangabad was captured and plundered. Here the godly saint Sayyid Jan Muhammad, had his hermitage in a garden in the suburds. Most of the wealthy men of Jalna had taken refuse in his hermitage with their money and jewels. The raiders finding very little booty in the town and learning of the concealment of the wealth in the saints abode, entered it and robbed the refugees, wounding many of them. The holy man appealed to them to desist, but they only abused and threatened him for his pains. Then the man of God, who has marvellous efficacy of prayer, cursed Shivajee, and popular belief ascribed the Rajah’s death five months after wards to these curses.১৩ শিবাজীর মৃত্যুর পরে তাঁর গুরু বৃদ্ধ রামদাস পদ্যে একটি চিঠি লেখেন শিবাজীর পুত্র শম্ভুজীকে এবং সেই চিঠির একলাইন এরকম:‘শ্রম করিয়া আক্রমণ করিবে স্নেচ্ছের উপর।১৪ শিবাজী ‘লুঠপাটের উদ্দেশ্যে দুঃসাহসিক কাজ করতেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি আলাউদ্দিন কিংবা তৈমুর লঙের হিন্দু সংস্করণ ছিলেন।১৫ নেহেরু তাঁর ‘Discovery of India’-তে শিবাজীকে ‘ডাকাত’ বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন ঐতিহাসিক জেমস লেইন তার ‘শিবাজী: এ হিন্দু কিং ইন ইসলামিক ইন্ডিয়া’ বইতে শিবাজীর এমন অজানা বহু দিক তথ্য সহকারে তুলে ধরেছেন। জেমস লেইন ভক্তিবাদের সন্ন্যাসীদের প্রতি শিবাজীর অনাগ্রহ ইত্যাদিরও উল্লেখ করেছেন। লেইন আরও দেখিয়েছেন যে, নিজের রাজ্যকে স্বাধীন করার চেয়ে নিজের সাম্রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করতে শিবাজী বেশি যত্নশীল ছিলেন। এমনকি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মুঘল ভারতে শিবাজীর নানাবিধ আপসমূলক পন্থার কথাও লেইন-এর বইতে জানানাে হয়েছে। জেমস লেইন শিবাজীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রচলিত বীরগাথা উদগীরণকারী বীরপূজোর ছকে হাঁটেননি। বরং ঐতিহাসিকরা কীভাবে মারাঠা বীর শিবাজীকে কেন্দ্র করে অজস্র গৌরবগাথার অবতারণা করেছেন তা তিনি দেখিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় লেখকরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবােধের জাগরণের জন্য মারাঠা গৌরববােধ সদা জাগ্রত রাখতে আর সর্বোপরি এক সার্বিক ভারতীয় হিন্দুত্বের চেতনাবােধ গড়ে তুলতে কীভাবে শিবাজী কেন্দ্রিক নানা কল্প-কাহিনির আশ্রয় নিয়েছেন তা লেইন-এর বইয়ের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়।
অত্যাচারী ও শােষক হিসাবে মারাঠারা মুঘলদের তুলনায় কোনাে অংশে কম ছিল না; বরং এক ধাপ এগিয়ে ছিল। কাফি খান লিখেছেন, “সবচেয়ে অত্যাচারী ফৌজদারের চেয়ে তারা (মারাঠা কর-গ্রাহকরা) দুই বা তিন গুণ বেশি আদায় করত।”১৬ নিজস্ব এলাকা বা স্বরাজ্যের বাইরে মারাঠারা অবাধ লুঠতরাজ চালাত। আসলে গােড়ার দিকে কৃষকরা শিবাজীকে মদত১৭ দিলেও, শিবাজী তাদের সুহৃৎ ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে ইরফান হাবিবের মন্তব্য: “সবচেয়ে বড় ভুল হবে যদি শিবাজী ও মারাঠা সর্দারদের কৃষক অভ্যুত্থানের সচেতন নেতা বলে ধরা হয়।”১৮ মারাঠাদের অত্যাচার বর্ণনা করতে গিয়ে ইরফান হাবিব লিখেছেন, “মারাঠা রাজ্যে চাষিদের উপর অত্যাচার হত না, এরকম বিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেই। শিবাজী তার এলাকায় চাষিদের সঙ্গে কীরকম আচরণ করতেন ফ্রায়ার তার বর্ণনা দিয়েছেন। ১৬৭৫-৭৬ সালে তিনি ওই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেছিলেন। শিবাজী আগের আমলের চেয়ে দ্বিগুণ হারে রাজস্ব দাবি করতেন এবং চাষিদের প্রায় কোনােক্রমে বেঁচে থাকার উপায়ও রাখতেন না। শিবাজীর অত্যাচারের ফলে জমির চারের তিন ভাগে সার পড়ে না।”১৯ মজার কথা শিবাজী কৃষকদের নিয়েই তার সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। লুঠতরাজ করেই এইসব সৈন্য তাদের দিন অতিবাহিত করত। কিন্তু এর ফলে চাষিরা শেষ পর্যন্ত লাভবান হয়নি। বরং এতে তাদের ক্ষতিই হয়েছিল। বহু চাষিই এই লুঠেরার দলে নাম লিখিয়েছিল। এই লুঠেরার দল শিবাজীর সাম্রাজ্য বহির্ভুত অঞ্চলে লুঠতরাজ চালাত। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই মারাঠাদের ভয়ের চোখে দেখত। রাজনৈতিক বা সামরিক উদ্দেশ্যে নয়, অত্যাচার ও প্রজা নিপীড়নই ছিল মূল লক্ষ্য। গ্রাম ও ছােটো শহরের নিরাপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষের কাছে মারাঠারা ত্রাস ও ধ্বংসের বার্তা বহন করে আনত। এইভাবে শিবাজী লুঠপাটের যে পথ দেখিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে মারাঠারা তা শাসনের অঙ্গ বা ঐতিহ্য হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। বাংলায় মারাঠা বর্গীদের অত্যাচার২০ তাে প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। শিবাজীর সময়ের প্রায় ২০০ বছর পরেও গ্রান্ট ডাফ মারাঠাদের এই লুণ্ঠনের কথা বলেছেন। এই অত্যাচার মারাঠা শক্তিকে কলঙ্কিত করেছিল।
(৩)
এমন কোনও প্রমাণ নেই যে, মুসলিমদের বিদেশী উৎপীড়ক মনে করে শিবাজী তাদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন। ঘটনা এই যে, প্রায়ই মুসলিম সামন্ত রাজাদের সঙ্গে জোট বেঁধে যুদ্ধ করে গেছেন তিনি। জীবনের শেষ লগ্নে তার সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবেশী রাজ্য গােলকোণ্ডার সুলতান। দু’জনে যুদ্ধ করে গেছেন সাধারণ শত্ৰু ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে। ঔরঙ্গজেব তার শক্তি ও অর্থের একটা বড় অংশ ব্যয় করে গেছেন বিজাপুর ও গােলকোণ্ডার মুসলিম সুলতানদের বিরুদ্ধে। সেই তুলনায় সামান্য ব্যয়িত হয়েছিল মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। তাছাড়া ঔরঙ্গজেবপুত্র রাজপুত্র আকবর যখন বিদ্রোহী হলেন, তখন তার প্রধান বন্ধু শিবাজীপুত্র শম্ভুজী। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তখন ঔরঙ্গজেবের রাজপরিষদে অতি সম্মানিত রাজপুরুষরূপে স্বীকৃত হয়েছিলেন শিবাজী। এই সময় ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে ‘রাজা’ খেতাবে ভূষিত করে বেরারের এক ‘জাগির’ দান করেছিলেন। পূর্বে অবশ্য শিবাজীকে দমন করার জন্য ঔরঙ্গ জেব তার শ্রেষ্ঠ সৈনাধ্যক্ষ রাজপুত জয়সিংহকে পাঠিয়েছিলেন। ১৬৬৫ সালের ২জুন শিবাজীর ৩৫ দুর্গের মধ্যে ২৩টি দখল করল মুঘল এবং আদায় করল মুঘল বাহিনীতে ৫,০০০ অশ্বারােহী প্রদানের প্রতিশ্রুতি। আসলে বিজাপুরের বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধে মুঘলকে সমর্থন জানিয়েছিলেন শিবাজী।
শিবাজীর সেনাবাহিনী হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের নিয়ে গঠিত ছিল। জয়সিংহের মুঘলবাহিনীর বিরুদ্ধে শিবাজীকে সাহায্য করেছিলেন পাঠান মুসলিমরা, যারা শিবাজীর প্রশাসনে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিল। শিবাজীর সেক্রেটারী ছিলেন হায়দার খান। শিবাজীর সেনাবাহিনীতে দৌলত খান, ইব্রাহিম খান, সিদ্দি সম্বল ও সিদ্দি মিশরী প্রমুখ মুসলমান নায়ক ছিলেন।২১ শিবাজীর গােলন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইব্রাহিম খান, নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন দৌলত খান, পদাতিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন নূর খান বেগ। শিবাজীর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন মাদারি মেহতাব। আগ্রা থেকে পালানাের নাটকীয় উপকথার মত ঘটনাটিতে এই মুসলমান যুবকটি শিবাজীকে সাহায্য করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে ঔরঙ্গজেবের সহকারীরা এক হিন্দু ব্রাহ্মণ রাজদূতকে পাঠিয়েছিলেন শিবাজীর সঙ্গে মিত্ৰতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে শিবাজী পাঠিয়েছিলেন হায়দার খানকে তার দূত হিসেবে। আরও এক মুসলমানের কথা জানা যায়, যিনি ছিলেন শিবাজীর অন্যতম সহায়ক, তার নাম সামা খান।২২ অহিন্দু সম্পর্কে শিবাজীর বিদ্বেষ ছিল না।২৩ যদুনাথ সরকার লিখেছেন: “তিনি (শিবাজী) নিজে নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন।…অথচ যুদ্ধযাত্রায় কোথাও একখানি কোরান পাইলে তাহা নষ্ট বা অপবিত্র না করিয়া সযত্নে রাখিয়া দিতেন এবং পরে কোনাে মুসলমানকে তাহা দান করিতেন; মসজিদ ও ইসলামী মঠ দেখিলে তাহা আক্রমণ না করিয়া ছাড়িয়া দিতেন। গোঁড়া মুসলমান ঐতিহাসিক কাফী খাঁ শিবাজীর মৃত্যুর বর্ণনায় লিখিয়াছেন, ‘কাফির জেহান্নমে গেল’; কিন্তু তিনিও শিবাজীর সৎ চরিত্র, দয়া দাক্ষিণ্য এবং সর্বধর্মে সমান প্রভৃতি দুর্লভ গুণের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছেন। শিবাজির রাজ্য ছিল ‘হিন্দবী-স্বরাজ’, অথচ অনেক মুসলমান তাহার অধীনে চাকরী পাইয়াছিল, উচ্চপদে উঠিয়াছিল।”২৪
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথও শিবাজীর প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। শিবাজীকে তিনি ‘robber’, ‘wicked’, ‘treacherous’ ইত্যাদি বিশেষণেই ভূষিত করেছেন। এই স্মিথও লিখতে বাধ্য হয়েছেন—Sivaji prossessed and practised certain special virtues which nobody would have expected to find in a man occupying his position in his time and surroundings. It is a curious fact that the fullest account of those special virtues is to be found in the pages of the Muhammadan historian, Khafi Khan, who ordinarily wirtes of Sivaji as “the reprobater’ ‘a sharp son of the devil, “a father of fraud and so forth.An author who habitually applies such terms of abuse to his subject cannot be suspected of undue partiality towards him. Nevertheless Khafi Khan honours himself as well as Sivaji by the following passage: …He made it a rule that wherever his followers went plundering, they should do no harm to the mosque, the Book of God, or the women of any one. Whenever a copy of the Kuran came into his hands, he treated it with respect, and gave it to some of his Musalman followers.’২৫
হিন্দুধর্মে প্রগাঢ় বিশ্বাস সত্বেও পরধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অন্যায় আচরণ তিনি করেননি। সেখ মহম্মদ নামে জনৈক মুসলমান সাধককে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন এবং বাবা ইয়াকুত নামে জনৈক মুসলমান দরবেশের দরগা নির্মাণের জন্য তিনি জমি দান করেছিলেন। মুসলমানদের পবিত্র স্থানে প্রদীপ জ্বালাবার ব্যয়ের জন্য তিনি অর্থ দান করেন।২৬ তিনি মুসলমান নারী ও শিশু বন্দীদের প্রতি সৎ ব্যবহার করতেন। খ্রিষ্টান যাজকদের প্রতিও তিনি উদারতা দেখাতেন। সুরাট লুণ্ঠনের সময় শিবাজী খ্রিস্টান যাজকদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেছিলেন। এই সমস্ত উদারতার দৃষ্টান্ত থেকে তার হৃদয়ের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় তাকে শঠতা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য সমকালীন পরিস্থিতিই দায়ী ছিল।
শিবাজীর উদারতা সম্বন্ধে যদুনাথ সরকার লিখেছেন: “সর্ব জাতি, সর্ব সম্প্রদায় তাহার রাজ্যে নিজ নিজ উপাসনার স্বাধীনতা এবং সংসারে উন্নতি করিবার সমান সুযােগ পাইত। দেশে শান্তি এবং সুবিচার, সুনীতির জয় এবং প্রজার ধনমান রক্ষা তাহারই দান। ভারতবর্ষের মত নানা বর্ণ ও ধর্মের লােক লইয়া গঠিত দেশে শিবাজীর অনুসৃত এই রাজনীতি অপেক্ষা অধিক উদার ও শ্রেয় কিছুই কল্পনা করা যাইতে পারে না।”২৭
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে শিবাজীর সহিষ্ণুতার কথা লেখা আছে নানাভাবে, বিবিধ ঐতিহাসিক নথিপত্রে। কাফী খান লিখেছেন, “অনুচরেরা যেখানে লুটপাট করত, সেখানেই শিবাজী নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে মসজিদ, কোরআন ও মেয়েদের অপমান যেন না ঘটে। যখনই তার হাতে এক খণ্ড কোরান এসেছে, তখনই শ্রদ্ধার সঙ্গে রেখে দিয়ে পরে কোন মুসলমান অনুচরকে তিনি দিয়ে দিতেন। হিন্দু বা মুসলমান মেয়েরা যুদ্ধকালে বন্দী হলে তাদের আত্মীয়স্বজন এসে যথাযােগ্য মূল্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি নিজে তাদের দেখাশােনা করতেন।”২৮ শিবাজীর রাজ্যাভিষেকে তাই কেবল হিন্দু ও বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের ভিড় হয়নি; মুসলমান ও খ্রীষ্টানরাও উপস্থিত ছিল, তাদের জন্য আলাদা রান্নাঘরেরও ব্যবস্থা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মসজিদ ও অন্যান্য মুসলিম প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণ করাও মারাঠা রাষ্ট্রনীতির অঙ্গ ছিল।২৯ ১৭৪৬-৪৭ সালের একটি সনদ থেকে জানা যায়, কসবা থানার মহাগিরি পাখাড়ি গ্রামে একটি মসজিদের জন্য দেড় বিঘা জমি দান করা হয়।৩০
শিবাজী হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু রাজা হিসেবে ধর্মের ভিত্তিতে তিনি কখনােই জনগণের মধ্যে কোনাে বিভেদ বৈষম্য করতেন না। তিনি হিন্দুদের সঙ্গে একরকম ও মুসলমানদের সঙ্গে ভিন্নরকম আচরণ করতেন না। হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে তিনি কখনােই মুসলিমদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন না। তাঁর ধর্মবিশ্বাস যুক্তিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এক চিঠিতে শিবাজী বলেন, “কোরআন গ্রন্থটি ঈশ্বরেরই বাণী। এটি একটি স্বর্গীয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থে ঈশ্বরকে সারা দুনিয়ারই ঈশ্বর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটিতে ঈশ্বরকে শুধুমাত্র মুসলমানদেরই ঈশ্বর বলা হয়নি। কারণ, হিন্দু এবং মুসলমান—উভয়েই তার দৃষ্টিতে অভিন্ন। মুসলমানরা যখন মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা করেন, বস্তুতপক্ষে তারা ভগবানের কাছেই প্রার্থনা করেন। হিন্দুরাও একই কাজ করেন, যখন তারা মন্দিরে গিয়ে ঘন্টা বাজান। কোনাে ধর্মকে অত্যাচার করা তাই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণারই সামিল।”৩১
মুসলমানদের প্রতি শিবাজীর সহিষ্ণুতার আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ রয়েছে। ১৬৪৮ সালে বিজাপুর সেনাবহিনীর প্রায় পাঁচশ-সাতশ পাঠান সেনা শিবাজীর বাহিনীতে যােগ দিতে এলেন। সেই সময় গােমাজি নায়েক পানসম্বল শিবাজীকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, সেটা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সেই উপদেশের উপর ভিত্তি করেই শিবাজী পরবর্তীতেও তার নীতি চালিয়ে গেছেন। গােমাজি বলেছিলেন, “এই লােকগুলাে এসেছে তােমার খ্যাতির কথা শুনে। তাদের ফিরিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। তুমি যদি মনে কর যে শুধুমাত্র হিন্দুদেরই সংগঠিত করবে এবং অন্যদের নিয়ে মাথা ঘামাবে না, তাহলে তােমার শাসন কায়েম করতে তুমি সফল হবে না। যিনি তার শাসন কায়েম করতে চান, তাঁকে আঠারােটি জাতি এবং চারটি বর্ণের সব মানুষকেই নিজ নিজ কাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে।” ১৬৪৮ সালেও শিবাজীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই উপদেশাবলী শিবাজীর ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনীতিকে ব্যাখ্যা করার পক্ষে যথেষ্ট। ঐতিহাসিক গ্র্যাণ্ড ডাফও তার শিবাজী সম্পর্কিত জীবনী গ্রন্থটিতে গােমাজিনায়েকের উপদেশের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, “এরপর শিবাজী বিপুল সংখ্যায় মুসলমানদের নিযুক্ত করেন তার সেনাবাহিনীতে, এবং এটি তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রভূত পরিমাণে সহায়তা করেছিল।”৩২
শিবাজীর অনুসৃত ধর্মনীতি অসাম্প্রদায়িক ছিল। শিবাজীর ধর্মগত উদারতা সম্বন্ধে যদুনাথ সরকার তার ‘Shivaji’ গ্রন্থে বলেছেন: “Religion remained with him an ever fresh fountain of right conduct and generosity…it did not obsess his mind nor harden him into a bigot. The sincerity of his faith is provided by his inpartial respect for holy men of all sects (Muslim as much as Hindu) and toleration of all creeds. His chivalry to women and strict enforcement of morality in his camp was a wonder in that age and extorted the admiration of hostile crities like Khafi Khan. How well he deserved to be king is proved by his equal treatment and justice to all men within his realm, his protection and endowment of all religions, his care for the pleasantry.৩৩
(৪)
কেন তবে শিবাজীর ধর্মরাজ্য স্থায়ী হল না? তবে কেন মারাঠারা শেষ পর্যন্ত একটি সুসংবদ্ধ পূর্ণাবয়ব রাষ্ট্রসংঘে পরিণত হতে পারল না? শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন অধ্যাপক শরৎকুমার রায় প্রণীত ‘শিবাজী ও মারাঠাজাতি’ (১৯০৮) গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নের উত্তর দেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: “ধর্ম সমস্ত জাতিকে এক করিয়াছিল এবং স্বার্থই তাহাকে বিশ্লিষ্ট করিয়া দিয়াছে, ইহাই মারাঠা অভ্যুত্থান ও পতনের ইতিহাস।”৩৪ শিবাজীর ‘ধর্মসাধনা একদিন তার উত্তরাধিকারীদের ‘স্বার্থসাধনে’ বিকৃত হয়ে গেল এবং ঈর্ষা অবিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতায় মারাঠা প্রতাপ নিস্তেজ হয়ে গেল। এই ব্যাখ্যাও কিন্তু যথেষ্ট নয়। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ মারাঠাদের পতনের কারণ আরও গভীরভাবে নির্ণয় করেন। তার সে অভিমত পাওয়া যায় শরৎকুমার রায় প্রণীত ‘শিখগুরু ও শিখজাতি’ (১৯১১) পুস্তকের ‘শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’ শীর্ষক ভূমিকায়। এখানে শিখ ইতিহাসের তুলনায় মারাঠা শক্তির উত্থান-পতনের কারণও আলােচিত হয়েছে। শিবাজীর অভিপ্রায় ও লক্ষ্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ওই ভূমিকায় বলেন: “..শিবাজী হিন্দুরাজ্য স্থাপনের উদ্দেশ্যকে মনের মধ্যে সুপরিস্ফুট করিয়া লইয়াই ইতিহাসের রঙ্গক্ষেত্রে মারাঠাজাতির অবতারণা করিয়াছিলেন; তিনি দেশজয় শত্রুবিনাশ রাজ্যবিস্তার যাহা কিছু করিয়াছেন সমস্তই ভারতব্যাপী একটি বৃহৎ সংকল্পের অঙ্গ ছিল।…
শিবাজী যে চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহা কোনাে ক্ষুদ্র দলের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। তাহার প্রধান কারণ তিনি যে হিন্দুধর্মকে মুসলমান শাসন হইতে মুক্তিদান করিবার সংকল্প করিয়াছিলেন তাহা আয়তনে ব্যাপক; সুতরাং সমগ্র ভারতের ইতিহাসকেই নতুন করিয়া গড়িয়া তােলাই তঁাহার লক্ষ্যের বিষয় ছিল, ইহাতে সন্দেহ নাই।…
শিবাজী যে-সকল যুদ্ধবিগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহা সােপান-পরম্পরার মতাে; তাহা রাগারাগি-লড়ালড়ি মাত্র নহে। তাহা সমস্ত ভারতবর্ষকে এবং দূর কালকে লক্ষ্য করিয়া একটি বৃহৎ আয়ােজন বিস্তার করিতেছিল, তাহার মধ্যে একটি বিপুল আনুপূর্বিকতা ছিল। তাহা কোনাে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রকাশ নহে, তাহা একটি অভিপ্রায় সাধনের উদযােগ।”৩৫
এই মহৎ অভিপ্রায় ও বৃহৎ আয়ােজন শেষ পর্যন্ত সমস্ত ভারতবর্ষে ও সুদূরকালে ব্যপ্ত হয়ে অনতিদীর্ঘ কালের মধ্যেই ব্যর্থ হয়ে গেল কেন? রবীন্দ্রনাথের উত্তর : “শিবাজীর মনে যাহা বিশুদ্ধ ছিল, পেশােয়াদের মধ্যে তাহা ক্রমে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতারূপে কলুষিত হইয়া উঠিল।৩৬ তারই বা কারণ কি? কারণ এই: “শিবাজীর চিত্ত সমস্ত দেশের লােকের সহিত আপনার যােগ স্থাপন করিতে পারে নাই। এইজন্য শিবাজীর অভিপ্রায় যাহাই থাক কেন, তাহার চেষ্টা সমস্ত দেশের চেষ্টারূপে জাগ্রত হইতে পারে নাই।”৩৭
শিবাজীর অভিপ্রায় ও চেষ্টা যে সমস্ত দেশের অভিপ্রায় ও চেষ্টা হয়ে উঠতে পারেনি, রবীন্দ্রনাথের মতে তার কারণ আমাদের সমাজের বিচ্ছিন্নতা। ঐক্যই ভাবকে ধারণ করে রাখতে পারে। আমাদের সমাজে সমস্ত মহৎ ভাব তার বিচ্ছিন্নতার ফাঁক দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। এইজন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: “আমাদের দেশে বারংবার ইহাই দেখা গিয়াছে যে, এখানে শক্তির উদ্ভব হয়, কিন্তু তাহার ধারাবাহিকতা থাকে না। মহাপুরুষেরা আসেন এবং তাঁহারা চলিয়া যান, তাহাদের আবির্ভাবকে ধারণ করিবার, পালন করিবার, তাহাকে পূর্ণ পরিণত করিয়া তুলিবার স্বাভাবিক সুযােগ এখানে নাই।…এইজন্য মহৎ চেষ্টা বৃহৎ চেষ্টা হইয়া উঠে না এবং মহাপুরুষ দেশের সর্বসাধারণের অক্ষমতাকে সমুজ্জলভাবে সপ্রমাণ করিয়া নির্বাণ লাভ করেন।”৩৮ এখানেই শিবাজীর রাষ্ট্র সাধনার দুর্বলতা। যে হিন্দু সমাজে তিনি রাষ্ট্রসাধনায় প্রবর্তনা দিলেন তাকেই তিনি ওই সাধনার যােগ্য করে গড়ে তুলতে চেষ্টিত হননি। এটাই হচ্ছে মারাঠার ব্যর্থতার গােড়ার কথা।
আর এই শিবাজীই রবীন্দ্রনাথের শিবাজী উৎসব কবিতায় আদর্শ বীর ও অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা এক মহানায়ক হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। ফলে সমস্যা দেখা দিল: “শিবাজী উৎসব আন্দোলন হিন্দু জাতীয়তাবােধ হইতে উদ্ভূত; শিবাজী মহারাজ মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া হিন্দুরাজ্য স্থাপন করেন। সুতরাং শিবাজী সম্বন্ধে গৌরববােধ হিন্দুদেরই হওয়া সম্ভব, মুসলমানদের নহে; সুতরাং, বিংশ শতাব্দীতে এই শ্রেণীর কোনও বীরকে অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার প্রতীকরূপে গ্রহণ করা সম্ভব নহে। রবীন্দ্রনাথ বােধ হয় এই কবিতাটির দুর্বলতা কোনখানে তাহা আবিষ্কার করিতে পারিয়াছিলেন। এবং তজ্জন্য তাঁহার কোনও কাব্যগ্রন্থে স্থান দেন নাই।”৩৯ তবে কবিতাটি বর্তমান প্রচলিত সঞ্চয়িতায় প্রাপ্তব্য।
প্রখ্যাত এক বুদ্ধিজীবী লিখেছেন, “সেকালে বাংলায় আমাদের মহৎ বীরদের সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় রাজপুত, মারাঠা ও শিখ বীরদের জীবনী আমদানি করতে হয়েছে।…জাতীয়তাবাদী নেতাগণ রাজনৈতিক গরজে সামগ্রিকভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। এমনকী শিবাজী-উৎসব’ এ মুসলমানকে টেনে আনার উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করে ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা করতেন ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিতেন।”৪০ শিবাজী সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, “খড়গহস্ত শিবাজীকে রঘুপতি যােজনা করেছিল যবনদিগের বিরুদ্ধে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে। শ্রী অরবিন্দও শিবাজীর এ খড়গ তুলে দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের হাতে, স্বদেশীদের হাতে। লক্ষ্য ওই একই ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠা।”৪১
তাছাড়া এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা একটি নামকরা রচনা যেখানে ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পােহলে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে’ ছত্রটি বহুল উদ্ধৃত। তিনি এক ধর্মরাজ্যের কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ মানবধর্ম অর্থে কথাটি ব্যবহার করেছেন। কবিতাটিতে শিবাজীর প্রতি স্তুতিবাদ আছে কিন্তু মুসলিম বিদ্বেষ নেই, নেই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, আছে উদার মানবিক দৃষ্টি, তবে সবটা ইতিহাসসিদ্ধ নয়। তিনি অবশ্য এই মতের সংশােধন করেন যা সকলের অবগত হওয়া একান্ত আবশ্যক: “শিবাজী তাঁহার সমসাময়িক মারাঠা-হিন্দু সমাজে একটা প্রবল ভাবের প্রবর্তন এতটা পর্যন্ত করিয়াছিলেন যে, তাহার অভাবেও কিছুদিন পর্যন্ত তাহার বেগ নিঃশেষিত হয় নাই। কিন্তু শিবাজী সে ভাবের আধারটি পাকা করিয়া তুলিতে পারেন নাই, এমনকি চেষ্টামাত্র করেন নাই। সমাজের বড় বড় ছিদ্রগুলির দিকে না তাকাইয়া তাহাকে লইয়া ক্ষুব্ধ সমুদ্রে পাড়ি দিলেন। তখনই পাড়ি না দিলে নয় বলিয়া এবং পাড়ি দিবার আর কোন উপায় ছিল না বলিয়াই যে অগত্যা এই কাজ করিয়াছিলেন তাহা নহে। এই ছিদ্রটাই পার করা তঁাহার লক্ষ্য ছিল। শিবাজী যে হিন্দু সমাজকে মােগল আক্রমণের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন আচার বিচারগত বিভাগ-বিচ্ছেদ সেই সমাজেরই একেবারে মূলের জিনিস। সেই বিভাগমূলক ধর্ম সমাজকেই তিনি সমস্ত ভারতবর্ষে জয়ী করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ইহাকেই বলে বালির বাঁধ বাঁধা, ইহাই অসাধ্য সাধন।
শিবাজী এমন কোনাে ভাবকে আশ্রয় ও প্রচার করেন নাই যাহা হিন্দু সমাজের মূলগত ছিদ্রগুলিকে পরিপূর্ণ করিয়া দিতে পারে। নিজের ধর্ম বাহির হইতে পীড়িত অপমানিত হইতেছে এই ক্ষোভ মনে লইয়া তাহাকে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিজয়ী করিবার ইচ্ছা স্বাভাবিক হইলেও তাহা সফল হইবার নহে; কারণ, ধর্ম যেখানে ভিতর হইতেই পীড়িত হইতেছে, যেখানে তাহার ভিতরই এমন সকল বাধা আছে যাহাতে মানুষকে কেবলই বিচ্ছিন্ন ও অপমানিত করিতেছে, সেখানে সেদিকে দৃষ্টিপাত মাত্র না করিয়া, এমনকি, সেই ভেদবুদ্ধিকেই মুখ্যত ধর্মবুদ্ধি বলিয়া জ্ঞান করিয়া সেই শতদীর্ণ ধর্ম সমাজের স্বরাজ্য এই সুবৃহৎ ভারতবর্ষ স্থাপন করা কোনাে মানুষেরই সাধ্যায়ত্ত নহে; কারণ, তাহা বিধাতার বিধানসংগত হইতে পারে না।”৪২ ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতাকে তার এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিমতের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে। এমনকি তিনি এও বলেছেন, “মারাঠার এই উদযােগ পরিণামে ভারতের অন্যান্য জাতির পক্ষে বর্গীয় উপদ্রবরূপে নিদারুণ হইয়া উঠিয়াছিল।”৪৩
শিবাজী সমস্ত ভেদ দূর করে বৃহৎ হিন্দু সমাজকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করতেপারেননি। তাঁর মহৎ সংকল্প ও অভিপ্রায় ওই সমাজের ছিদ্রপথেই নির্গত হয়ে যায়। মারাঠা শক্তির ব্যর্থতা সম্বন্ধে এই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত অভিমত। ইদানীংকালে মহাত্মাজির স্বরাজ সাধনা সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথের এই আশঙ্কা ছিল। তাই তাকে বারবার সতর্কতার বাণী উচ্চারণ করতে হয়েছিল।
(৫)
শিবাজীর ব্যর্থতা ও মারাঠা শক্তির পতন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই অভিমত আচার্য যদুনাথের কাছেও পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে। মারাঠা রাজ্যের পতনের বিভিন্ন কারণের মধ্যে জাতিভেদকেই তিনি প্রথম স্থান দিয়েছেন। শিখগুরু ও শিখজাতি’ গ্রন্থের পূর্বোক্ত ভূমিকাটি যদুনাথ ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘The Rise and Fall of the Sikh Power’ নামে ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন ১৯১১-এ।৪৪ যদুনাথের ইংরেজি ‘শিবাজী’ গ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। তাতে দেখা যায় তিনি শিবাজীর ব্যর্থতার কারণ নির্ণয় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত অনুমােদন করে তার উক্তি উদ্ধৃত করেন। যদুনাথ বলেন: “Why did Shivaji fall to create and enduring state?…An obvious cause was, no doubt, the shortness of his reign, barely ten years, after the final rupture with the Mughals in 1670. But this does not furnish the true explanation of his failure. It is doubtful if with a very much longer time at his disposal he could have averted the ruin which befell the Maratha State under the Peshwas, for the same moral canker was at work among the people in the 17th century as in the 18th. The first danger of the new Hindu Kingdom established by him in the Decean lay in the fact that the national glory and prosperity resulting from the victories of Shivaji and Baji Rao created a reaction in favour of Hindu orthodoxy; it accentuated caste distinction which rain counter to the homogeneity and simplicity of the poor and politically depressed early Maratha society. Thus his political success sapped the main foundation of that success. In the security, power the wealth engendered by their independence, the Marathas of the 18th century forget the past record of Muslim persecution; …the social grades turned against each other…we have unmistakable traces of it as early as the reign of Shivaji. Caste grows by fission. It is antagonistic to national union. In proportion as Shivaji’s ideal of a Hindu Swaraji was based on orthodoxy, it contained within itself the seed of its own death.
বাংলা ‘শিবাজী’ গ্রন্থে যদুনাথ এই কথাই অন্যভাবে প্রকাশ করেছেন। তাও এখানে উদ্ধৃত করা অনুচিত হবে না: “মারাঠারা যখন শিবাজীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভের জন্য খাড়া হয় তখন তাহারা বিজাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ, তখন তাহারা গরিব ও পরিশ্রমী ছিল, সাদাসিদেভাবে সংসার চালাইত, তখন তাহাদের সমাজে একতা ছিল, জাত বা শ্রেণীর বিশেষ পার্থক্য বা বিবাদ ছিল না। কিন্তু শিবাজীর অনুগ্রহে রাজত্ব পাইয়া বিদেশ লুঠের অর্থে ধনবান হইয়া তাহাদের মন হইতে সেই অত্যাচারস্মৃতি এবং তাহাদের সমাজ হইতে সেই সরলতা ও একতা দূর হইল; সাহসের সঙ্গে সঙ্গে অহংকার ও স্বার্থপরতা বাড়িল। ক্রমশ সমাজে জাতিভেদের বিবাদ উপস্থিত হইল।…জাতের সঙ্গে জাত, এমনকি একই জাতের মধ্যে এক শাখার সঙ্গে অপর শাখা বিবাদ করিতে লাগিল। সমাজ ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল, রাষ্ট্রীয় একতা লােপ পাইল, শিবাজীর অনুষ্ঠান ধুলিসাৎ হইল।”৪৫
রমেশচন্দ্র মজুমদার শিবাজী সম্বন্ধে বলেছেন, “হিন্দুর রাষ্ট্রীয় অনৈক্যের ছিদ্র কতকটা পূর্ণ করিয়া, সমাজের ছিদ্র পূর্ণ করিবার সরঞ্জাম জোগাইয়াছিলেন।”৪৬ আর যদুনাথ সরকার সেখানে বলেছেন, ‘সমাজ ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া গেল, রাষ্ট্রীয় একতা লােপ পাইল।৪৭
রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন: “শিবাজী যে হিন্দু-সমাজকে আক্রমণের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, আচার বিচারগত বিভাগ-বিচ্ছেদ সেই সমাজের একেবারে মূলের জিনিষ। সেই বিভাগমূলক ধর্মসমাজকেই তিনি সমস্ত ভারতবর্ষে জয়ী করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইহাকেই বলে বালির বাঁধ বাঁধা—ইহাই অসাধ্য সাধন।
শিবাজী এমন কোনাে ভাবকে আশ্রয় ও প্রচার করেন নাই যাহা হিন্দু সমাজের মূলগত ছিদ্রগুলিকে পরিপূর্ণ করিয়া দিতে পারে। নিজের ধর্ম বাহির হইতে পীড়িত অপমানিত হইতেছে এই ক্ষোভ মনে লইয়া তাহাকে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিজয়ী করিবার ইচ্ছা স্বাভাবিক হইলেও তাহা সফল হইবার নহে; কারণ ধর্ম যেখানে ভিতর হইতেই পীড়িত হইতেছে, যেখানে তাহার ভিতরেই এমন সকল বাধা আছে যাহাতে মানুষকে কেবলি বিচ্ছিন্ন ও অপমানিত করিতেছে, সেখানে সেদিকে দৃষ্টিপাত মাত্র না করিয়া, এমনকি সেই ভেদবুদ্ধিকেই মুখ্যত ধর্মবুদ্ধি বলিয়া জ্ঞান করিয়া, সেই শতদীর্ণ ধর্মসমাজের স্বরাজ্য এই সুবৃহৎ ভারতবর্ষে স্থাপন করা কোনাে মানুষেরই সাধ্যায়ত্ত নহে, কারণ তাহা বিধাতার বিধানসঙ্গত হইতে পারে না।”৪৮
মারাঠা রাজ্যের পতনের কারণ আর একটু বিশ্লেষণ করে যদুনাথ বলেছেন—“মারাঠারা রাজ্য হারাইয়াছে, তাহাদের ভারতব্যাপী প্রাধান্য লােপ পাইয়াছে, তাহাদের আবার বিজাতির পদানত হইতে হইয়াছে, তবুও তাহাদের চৈতন্য হয় নাই, তাহাদের মধ্যে এই জাতে জাতে বিবাদ আজও চলিয়াছে—জাতিভেদের বিষ এতই ভীষণ।”৪৯ তিনি নিজের মত সমর্থনের জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’ নামক ভূমিকা-রচনা থেকে দীর্ঘ পরিচ্ছেদ উদ্ধৃত করেছেন। যদুনাথ সরকার যখন রবীন্দ্রনাথের মতামতকে ইতিহাসসম্মত বলে স্বীকার করেছেন তখন সেই মতকে নিশ্চয়ই কবিকল্পনা বলে তুচ্ছ করা যায় না। তবু প্রশ্ন থেকে যায় যে, মুসলমান বা শিখদের মধ্যে তাে জাতিগত বা আচারবিচারগত বিভেদের প্রাচীর গড়ে ওঠেনি তবে ওই শক্তিগুলির কেন পতন হল? আমরা জানি রাষ্ট্রশক্তি ও সামরিক শক্তির দুর্বলতা এবং যােগ্য উত্তরাধিকারীর অভাব যে কোনাে সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই শিবাজী পরবর্তী মারাঠা শাসকদের দুর্বলতার কথা বলেছেন এবং তার সঙ্গে আমরা যােগ করতে পারি বিদেশি শক্তির সঙ্গে তাদের অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মারাঠাদের পতনের মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক দৃষ্টি দিয়ে শিবাজীর কৃতিত্ব ও মহত্ত্বকে যেমন চিত্রিত করেছেন আবার কোথায় তিনি অসফল হয়েছিলেন সেকথাও নির্দেশ করেছেন। তার মতে, শিবাজীর অভ্যুত্থান একজন সামান্য দস্যুর অভ্যুত্থান নয়। শিবাজীর প্রবল ব্যক্তিত্ব ক্ষণকালের জন্য মারাঠাজাতিকে একটি ঘনসংবদ্ধ সামরিক শক্তিতে পরিণত করল। কিন্তু যখন সেই ব্যক্তিত্ব, সেই কর্মশক্তি মারাঠা রাজ্যকে ভবিষ্যৎকালের জন্য সুদৃঢ় করে রেখে যেতে পারল না তখনই রবীন্দ্রনাথের কাছে শিবাজী সমালােচনার যােগ্য।৫০
ঐতিহাসিক চরিত্র আলােচনার সময় তিনি কতটা করেছেন তার হিসেব নেওয়া যেমন প্রয়ােজনীয় তেমনই তিনি আরও কি করলে ইতিহাসের চেহারা কি হতে পারত তারও একটা হিসেব নেওয়া হয়ে থাকে। এটা ইতিহাস আলােচনার একটা ধারা।৫১ শিবাজী যে একজন বড় যােদ্ধা ছিলেন, মুঘলদের পর্যদস্ত করেছিলেন, সুশাসক ছিলেন, সংগঠনী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন সেকথা নিঃসন্দেহে সত্যি এবং এ কথাগুলি সত্যি বলেই শিবাজীর কাছে সামাজিক ভেদাভেদগুলি দূরীভূত করার সচেষ্ট প্রয়াস আশা করা যেতে পারত। কারণ কোনও ধর্মগুরুর পক্ষে যা সম্ভব নয় তা সম্ভব হতে পারে কোনও রাজা অথবা রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহারে। ধর্মগুরুর ক্ষমতা শুধু তার ভাবের রাজ্যে কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতা তার আইন, তার সামরিক শক্তির ব্যবহারে যা সে তার শাসিত ব্যক্তিদের উপর সহজেই কার্যকরী করতে পারে। আর রাষ্ট্রপতি শিবাজী হয়ত সেটা করতেও পারতেন। এ মতের বিরােধিতা করে বলা যেতে পারে সে-যুগে এ সম্ভব ছিল না। কিন্তু শিবাজীর পূর্বে আকবরকে আমরা এক উদার ধর্ম প্রবর্তনের জন্য প্রয়াসী দেখি। তার প্রবর্তিত ‘দীন-ই-ইলাহী’ সাফল্য লাভ করেনি সত্য কিন্তু বুঝতে পারি আকবর সচেতন ছিলেন যে, ধর্মবিভেদ মানুষকে অকারণে বা অতি তুচ্ছ কারণে উত্তেজিত করে তােলে।৫২ দুঃখের বিষয়, আকবরের নীতি তার উত্তরাধিকারীরা কেউই সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করেননি। কিন্তু আমরা জানি যে, ধর্মীয় বিভেদই অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার মূলে থাকে। শিবাজী যদি সামাজিক বর্ণভেদ দূরীভূত করার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করতেন এবং হিন্দু ধার্মিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারতেন তাহলে হয়ত মারাঠা রাষ্ট্র আরও দীর্ঘজীবন লাভ করত।
তবে শিবাজীর কৃতিত্ব এই যে, তিনি শতধা বিভক্ত খণ্ড-ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত মারাঠাদের এক নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে, এক পরাক্রান্ত জাতিরূপে গড়ে তােলেন। মারাঠা জাতীয়তাবাদের প্রথম উদ্গাতা ও সংগঠনকারী হিসেবে শিবাজীর অবদান সর্বাপেক্ষা স্মরণযােগ্য। এইদিক পর্যালােচনা করেই যদুনাথ সরকার তার ‘শিবাজী অ্যান্ড হিজ টাইমস্’ গ্রন্থে৫৩ বলেছেন: ‘I regard him as the last great constructive genius and nation builder that the Hindu race has produced.’ অবশ্য মারাঠা ঐতিহাসিক জি এস সরদেশাই তার গ্রন্থে৫৪ বলেছেন যে, শিবাজী এক সর্বভারতীয় হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু সরদেশাইয়ের এই মতবাদ আচার্য যদুনাথ সরকারসহ বহু ঐতিহাসিক স্বীকার করেননি। যদুনাথ সরকারের মতে, তিনি সারাজীবন আত্মরক্ষার যুদ্ধে এত ব্যাপৃত ছিলেন যে, কোনও নতুন রাজনৈতিক আদর্শে রাষ্ট্রগঠনের পরিকল্পনা করার মতাে অবসর ও সুযােগ তিনি পাননি। এমনকি তিনি উত্তর ভারতের রাজাদের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ারও চেষ্টা করেননি। সুতরাং শিবাজী এক অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করেন, তা বলা যায় না। এমনকি শিবাজী মারাঠাদের মধ্যে যে জাতিভেদ ছিল, তাও দূর করতে পারেননি। এরই ফলশ্রুতিস্বরূপ শিবাজীর রাজ্যাভিষেকের সময় তিনি ক্ষত্রিয় নন বলে ব্রাহ্মণরা তার সিংহাসনে আরােহনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তােলেন।৫৫ শিবাজীর শাসনব্যবস্থাতেও দেখা যায়, তার আটজন মন্ত্রীর মধ্যে ছ’জন ব্রাহ্মণ ছিলেন। মারাঠাদের একটি প্রকৃত জাতিতে রূপান্তরিত করার জন্য সেরকম কোনাে নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করার সুযােগ বা অবসর তিনি পাননি। প্রায় সকল মারাঠা ঐতিহাসিকই শিবাজীর প্রতি দুর্বলতা হেতু তাঁকে সমগ্র ভারতবর্ষ নিয়ে এক অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রের উদ্ভাবক বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি জি এস সরদেশাইএর মতাে ঐতিহাসিকও ভাবাবেগবশত এমন কথা বলেছেন যে, শিবাজী আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে ঔরঙ্গজেবকেই ক্ষমতাচ্যুত হতে হত। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই মন্তব্যকে কল্পনা বলে মনে করেন।
মারাঠাদের মতাে একটি রিক্ত, নিঃস্ব নির্যাতিত জাতিকে নতুন আশার আলাে দেখাতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে তিনি হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন বা তার মারাঠা রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রকৃতিতে কতটা হিন্দুত্ব ছিল, তা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু তিনি যে মারাঠা জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা, সে ব্যাপারে কোনাে বিতর্কের অবকাশ নেই। মারাঠা রাজ্য ও সামরিক ব্যবস্থাকে তিনি স্বীয় উদ্ভাবিত রীতি-নীতির দ্বারা গড়ে তােলেন। রণজিৎ সিংহের মতাে বিদেশীদের (ফরাসি) দ্বারা তিনি সৈন্যদলকে সুশিক্ষিত করার চেষ্টা করেননি। মারাঠা বাহিনী মারাঠাদের দ্বারাই কার্যকরী রূপ নিয়েছিল। শিবাজী নিরক্ষর ছিলেন। অপর কোনাে উন্নত রাষ্ট্রের দরবার বা সৈন্যব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার সুযােগ তিনি পাননি; তা সত্ত্বেও স্বীয় সহজাত প্রতিভা ও চেষ্টার বলে তিনি একটি রাজ্য, এক দুর্ধর্ষ বাহিনী এবং এক কল্যাণকর প্রশাসন ব্যবস্থা৫৬ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মারাঠা জাতির মধ্যে অনেক অনৈক্য থাকা সত্ত্বেও, ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ কর আদায়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন তাদের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনি অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি হয়। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মারাঠারা সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেনাবাহিনীকে সুসংহত করতে সমর্থ হয়। যদিও শিবাজী প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র স্থায়ী হয়নি। তাঁর স্বল্প-পরিসর জীবন শত্রুদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কাজেই ব্যয়িত হয়েছে এবং তার কাজের ফললাভ তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তিনিই মারাঠা জাতিকে সঞ্জীবিত করে তাদের জন্য একটি সুগঠিত রাষ্ট্রের পত্তন করবার চেষ্টা করেন। শিবাজী মুঘলদের বিরুদ্ধে অবিরাম আত্মরক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় মারাঠা সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করে যেতে পারেননি। তবে এখানে একটা বিষয় উল্লেখযােগ্য, তা হল— মারাঠারা যতদিন মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, ততদিন তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল; কিন্তু তারপরেই মারাঠাদের এই জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। রাষ্ট্রের স্বার্থের থেকে তখন নিজ নিজ ‘জাগির’ রক্ষার ক্ষেত্রে মারাঠা সর্দাররা আত্মনিয়ােগ করেন। শিবাজীর মতাে উপযুক্ত ব্যক্তি না থাকায়, মারাঠারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতবর্ষের মতাে দেশে জাতীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ না হলে কোনাে রাষ্ট্রনৈতিক ভিত্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। মারাঠাদের ভাগ্যেও তাই ঘটে। তবু সামগ্রিকভাবে বলা যায়, অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও শিবাজীই হলেন প্রথম মারাঠা জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা।
তথ্যসূত্রঃ
১. শিবাজী উত্তরােত্তর লুণ্ঠন কার্যে লিপ্ত হতে থাকলে বিজাপুর সরকার শাহজীকে পুত্রের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার আদেশ দিলে তিনি অক্ষমতা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, শিবাজী তাঁর শাসনের বাইরে। তারপর বিজাপুর সরকার শিবাজীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হন। আফজল খান নামক একজন বিশ্বস্ত ও দক্ষ সেনাপতিকে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। আফজল খান মহারাষ্ট্রে প্রবেশ করে সৎ উপদেশের দ্বারা শিবাজীকে সৎ পথে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। শিবাজী আফজল খানের সততার পূর্ণ সুযােগ। গ্রহণ করলেন এবং নিঃসঙ্গ অবস্থায় দুজনে মিলিত হয়ে সন্ধির শর্তসমূহ আলাপ আলােচনার প্রস্তাব দেন। আফজল খান বিনা দ্বিধায় এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং নির্ধারিত সময়ে ও নির্ধারিত স্থানে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শিবাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু শিবাজী পূর্ব হতে আফজল খানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। তিনি আফজল খানকে বাঘনখ দ্বারা আক্রমণ করেন এবং ধরাশায়ী করেন। আহত অবস্থায় আফজল খান কোনােক্রমে পালিয়ে নিজ শিবিরে আশ্রয় নেন। বিজাপর-বাহিনী সেনাপতির এই অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং এই সুযােগে শিবাজীর সেনাবাহিনী আফজলের বাহিনীকে আক্রমণ করে পরাজিত করে এবং পালকির ভিতরস্থ আফজল খানের শিরচ্ছেদ করে।।
আফজল খানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে দুটি বিপরীতমুখী মতামত পাওয়া যায়। মারাঠা ঐতিহাসিকদের মতে, আফজল খানই ষড়যন্ত্র করে শিবাজীকে হত্যার চেষ্টা করলে আত্মরক্ষার্থে শিবাজী নিজ বাঘনখ দ্বারা আফজলকে হত্যা করেন। যদুনাথ সরকারের অভিমতও তাই (যদুনাথ সরকার, শিবাজী, ওরিয়েন্ট লংম্যান, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ৩৩-৩৪)। এ বিষয়ে মারাঠা উপকরণসমূহের এবং বিশেষ করে উগ্র জাতীয়তাবাদী মারাঠা ঐতিহাসিকদের বিবরণ গ্রহণযােগ্য নয়। আমরা যদি যদুনাথ সরকারের ‘শিবাজী-আফজল খান সাক্ষাৎ’ সংক্রান্ত পর্বটি খুঁটিয়ে পড়ি তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মূল ষড়যন্ত্রীই ছিলেন শিবাজী নিজেই। কারণ আফজল খান যেখানে প্রকাশ্যে কোমরে তলােয়ার ঝুলিয়ে রাখলেন সেখানে শিবাজী কেন বাঘনখ ও ছােরা গােপনে রাখলেন? শিবাজী অদৃশ্য বর্মও পরিধান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, প্রতাপগড় দুর্গের দু’পাশের জঙ্গলে গােপনে শিবাজীর সৈন্য মােতায়েন রাখা হয়েছিল। তাছাড়া আফজল খানের প্রধান দেহরক্ষী তলােয়ার-বাজ বীর সৈয়দ বান্দাকে শিবাজীর নির্দেশেই প্রতাপগড় দুর্গের সাক্ষাৎ স্থান হতে সরিয়ে দেওয়া হয়। সর্বোপরি বলতে হয় যে, মৃত্যুপথযাত্রী কোনােদিন মিথ্যা বলতে পারেন না। যদুনাথ সরকার মৃত্যুপথযাত্রী আফজল খানের জন্য লিখেছেন: আফজল খাঁ চেঁচাইয়া উঠিলেন—‘মারিল, মারিল, আমাকে প্রতারণা করিয়া মারিল! যদুনাথ সরকারের দেওয়া এসব তথ্যই আফজলকে নির্দোষ প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট। দেখুন-যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০-৩৪।। সমসাময়িক ঐতিহাসিক কাফি খান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, শিবাজীই ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পরিকল্পনার সাহায্যে আফজল খানকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। গ্রান্ট ডাফ প্রমুখ ইউরােপীয় ঐতিহাসিকেরা কাফি খানের এই উক্তি সমর্থন করেন। আফজল খানের মতাে সুদক্ষ দশ হাজার সেনাবাহিনীর সেনাপতির পক্ষে শিবাজীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। যুদ্ধই যথেষ্ট ছিল এবং সেটাই বীরত্বের নিদর্শন হত। আফজল কিন্তু শিবাজীর দুর্বল কাতর কণ্ঠের আবেদন মঞ্জুর করে বীরত্বের পরিবর্তে মহত্বের পরিচয় দিয়ে খােলা মনে সন্ধির জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন। প্রাচীনকাল হতেই নিয়ম আছে সন্ধি বা চুক্তি করার সময় আমন্ত্রিত শত্রুপক্ষকে হত্যা করা মানবতা বিরােধী। শিবাজী কিন্তু এই কাজটাই করেছিলেন। ১৯৪৬ সালের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রচিত পাঠ্য ইতিহাস পুস্তক ‘ইতিহাস পরিচয়’-এ বলা হয়েছে: “শিবাজী দেখিলেন যে, প্রকাশ্য যুদ্ধে তিনি পারিবেন না, তাই তিনি এক মতলব আঁটিলেন; সন্ধির প্রস্তাব করিয়া তিনি আফজল খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলেন। দুই জনে সাক্ষাৎ হইল। সাক্ষাতের সময় কোনপক্ষেই বেশী লােকজন ছিল না। সাক্ষাৎকালে উভয়ে যখন উভয়কে আলিঙ্গন করিতেছিলেন, সেই সময়ে শিবাজী তঁাহার পােষাকের নীচে লুক্কায়িত ‘বাঘনখ’ নামক অস্ত্র দ্বারা হঠাৎ আফজল খাঁকে আক্রমণ করিয়া তাহাকে নিহত করিলেন। ইহার ফলে আফজল খাঁর সেনাদল ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল; তখন শিবাজী তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়া অনায়াসেই পরাজিত করিলেন।” দেখুন-ইতিহাস পরিচয়, হিন্দুস্থান প্রেস, ১০ রমেশ দত্ত স্ট্রীট, কলকাতা, ১৯৪৬, পৃ. ১৪৮-৪৯। আসলে শিবাজী প্রথম হতেই লুঠতরাজ এবং বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারা নিজ উন্নতির পথ উন্মুক্ত করেন। সুতরাং ইতিহাসের কষ্টিপাথরে বিচার করলে শিবাজীর পক্ষে মারাঠা ঐতিহাসিকদের যুক্তি ধােপে টেকে না।
২. স্ট্যানলি ওলপার্ট, তিলক অ্যান্ড গােখলে: রিভােলিউশন অ্যান্ড রিফর্ম ইন মেকিং অফ মডার্ন ইন্ডিয়া, বার্কলে অ্যান্ড লস এঞ্জেলস, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৬২, পৃ. ৮০।
৩. সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, ডি এম লাইব্রেরী, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ২০৪।
৪. স্ট্যানলি ওলপার্ট, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬-৬৭।
৫. তিলক:স্পিচ ডেলিভার্ড অ্যাট নাসিক ইন ১৯০৮, সিলেকটেড ডকুমেন্টস, রবীন্দ্রকুমার সম্পাদিত, খণ্ড-৪, পৃ. ৫০; স্ট্যানলি ওলপার্ট, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১-৭২।
৬. মাইকেল এডওয়ার্ডস, দ্য লাস্ট ডেজ অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, ক্যাসেল অ্যান্ড কোম্পানি, লন্ডন, ১৯৬৩।
৭. প্রফুল্লকুমার সরকার, জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ, গৌরাঙ্গ প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৩৬৭, পৃ.৪৪।
৮. দেবীপদ ভট্টাচার্য, গিরিশচন্দ্র ঘােষ : সাহিত্য-সাধনা অংশ, গিরিশ রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ৩০।
৯. জে সি দে, শিবাজীজ সুরাট এক্সপিডিশন অফ ১৬৬৪, ইন্ডিয়ান কালচার’, এপ্রিল ১৯৪০।
১০. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭-৫০।
১১. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩।
১২. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪।
১৩. যদুনাথ সরকার, এ শর্ট হিস্টরি অফ ঔরঙ্গজেব, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, ১৯৭৯, পৃ.১৯৬-৯৭। যদুনাথ সরকার তাঁর ‘শিবাজী’ গ্রন্থে লিখেছেন :“ শিবাজী ৪ঠা নভেম্বর (১৬৭৯) সেলগুড় হইতে বাহির হইয়া মুঘল-রাজ্যে ঢুকিলেন; দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া পথের দু’ধারে লুটিয়া পুড়াইয়া দিয়া ছারখার করিয়া চলিতে লাগিলেন। প্রায় ১৫ই তিনি জালনা শহর (আওরঙ্গাবাদের ৪০ মাইল পূৰ্বে) লুঠ করিলেন। কিন্তু এই জনপূর্ণ বাণিজ্যের কেন্দ্রে তেমন ধন পাওয়া গেল না। তখন জানিতে পারিলেন যে জান্নার সব মহাজনেরা নিজ নিজ টাকাকড়ি শহরের বাহিরে সৈয়দ জান মহম্মদ নামক মুসলমান সাধুর আশ্রমে লুকাইয়া রাখিয়াছে, কারণ সকলেই জানিতে যে শিবাজী সব মন্দির ও মসজিদ, মঠ ও পীরের আস্তানা মান্য করিয়া চলিতেন, তাহাতে হাত দিতেন না। তখন মারাঠা-সৈন্যগণ ঐ আশ্রমে ঢুকিয়া পলাতকদের টাকা কাড়িয়া লইল, কাহাকেও কাহাকেও জখম করিল। সাধু তাহার আশ্রমের শান্তি ভঙ্গ করিতে নিষেধ করায় তাহারা তাহাকে গালি দিল ও মারিতে উদ্যত হইল।তখন ক্রোধে সেই মহাশক্তিমান পুণ্যাত্মা পুরুষ শিবাজীকে অভিসম্পাত করিলেন। ইহার পাঁচ মাস পরে শিবাজীর অকালমৃত্যু হইল; সকলেই বলিল যে পীরের ক্রোধের ফলেই এরূপ ঘটিয়াছে।” দেখুন-যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৯।
১৪. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৫।
১৫. সমকালীন ঐতিহাসিক কাফি খানের এই অভিযােগের খুব একটা ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। শিবাজী অনাবশ্যক নিষ্ঠুর আচরণ করতেন না। যুদ্ধের সময় তিনি হিন্দুমুসলিম নির্বিশেষে কোনাে নারী বা শিশুর প্রতি অশালীন বা নিষ্ঠুর আচরণ করতেন। শিবাজীর নির্দেশ ছিল : “শত্রুর দেশে স্ত্রীলােক বা শিশুকে ধরিবে না, শুধু পুরুষ মানুষ পাইলে বন্দী করিবে। গরু ধরিবে না, ভার বহিবার জন্য বদল লইতে পার। ব্ৰহ্মণদের উপর উপদ্রব করিবে না, চৌথ দিবার জামিন-স্বরূপ কোনও ব্রাহ্মণকে লইবে না। কেহ কু-কৰ্ম্ম করিবে না।…কেহ নিয়ম-বিরুদ্ধ কাজ করিয়া থাকিলে, তাহার প্রকাশ্য অনুসন্ধান ও বিচার করিয়া তাহাকে দূর করিয়া দেওয়া হইবে।” (যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯। মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়ে আরও জানতে হলে দেখুন- গােবিন্দ পানসারে, কে ছিলেন শিবাজি, মনীষা গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ২৫-২৭। ১৯৮৮ সালে বইটি মূল মারাঠী ভাষায় রচনা করেন গােবিন্দ পানসারে, উদয় নারকার ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ‘হু ওয়াজ শিবাজি’ নামে। ইংরেজি সংস্করণ থেকে বাংলায় অনূদিত হয় ‘মনীষা গ্রন্থালয়’-এর উদ্যোগে)। কাফি খান অবশ্য এজন্য শিবাজীর প্রশংসাও করেছেন। তবে রাষ্ট্রের প্রয়ােজনে শিবাজী কপটতা ও নিষ্ঠুরতার পথ যে অবলম্বন করতেন একথা বলাই যায়।
১৬. উদ্ধৃত-গৌতম ভদ্র, মুঘল যুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৪২০, পৃ. ১৪৪। সমসাময়িক লেখক আজাদ বিলগ্রামি জমিনদারি অধিকার সম্পর্কে মারাঠাদের প্রবল আসক্তির বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন:“সাধারণভাবে মারাঠাদের, এবং বিশেষত দক্ষিণের ব্রাহ্মণদের মধ্যে এক অদ্ভত আকাঙ্খা লক্ষ্য করা যায়। তারা চায় জনগণকে, জীবনধারণের রসদ থেকে বঞ্চিত করে সেগুলি নিজেরা আত্মসাৎ করতে। রাজার জমিন্দারি থেকে শুরু করে অন্য ছােটোখাটো ভূম্যধিকারীর, যেমন গ্রামের মােড়ল বা নায়েবের জমিন্দারি পর্যন্ত তারা রেয়াত করে না। প্রাচীন বংশগুলিকে উচ্ছেদ করে নিজেদের দখল কায়েম করে। কোঙ্কনের ব্রাহ্মণরাই হবে সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি, এই তাদের অভিলাস।” দেখুন-আজাদ বিলগ্রামি, ইরফান হাবিব কর্তৃক উদ্ধৃত, দ্য অ্যাগরেরিয়ান সিস্টেম অফ মুঘল ইন্ডিয়া ১৫৫৬-১৭০৭, এশিয়া পাবলিশিং হাউস, বম্বে, ১৯৬৩, পৃ. ৩৪৯।
১৭. প্রজারা যাতে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত না হয় সেদিকে শিবাজী কড়া নজর রাখতেন। তিনি নিজ কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এই বলে যে, তার ‘স্বরাজ্যে’ তাদের নিপীড়নে যেন কৃষকরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পলায়ন না করে। “তিনি রাজস্ব সংগ্রহকারীদের মর্জিমাফিক কর আদায় বন্ধ করে দিলেন। জমির মাপ অনুযায়ী কর নির্দিষ্ট করে দিলেন। কর সংগ্রহকারীদের কড়া নির্দেশ দিলেন যে আইন অনুযায়ী যতটা কর ধার্য আছে, ঠিক ততটাই যেন রায়তদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। শুধু তাই নয়, তার আদেশ ঠিকমত পালিত হচ্ছে কিনা, সে বিষয়েও তিনি সচেতন ছিলেন। খরার সময় ঋণ মুকুব করে দিতেন তিনি রায়তদের। কিভাবে কৃষক কর দেবে, যদি তার ক্ষেত্রে কিছু উৎপন্নই না হয়? শিবাজি কৃষকদের অবস্থার কথা বুঝতেন, এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। তিনি যে শুধুই কর মকুব করতেন তা নয়, তিনি তাদের অতিরিক্ত সুযােগ সুবিধাও দিতেন।” (গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩)। মারাঠা ঐতিহাসিক ডি কে রাজওয়াড়ে তার গ্রন্থ ‘মারাঠানছে ইতিহাসছি সাধনে’র অষ্টম খণ্ডে শিবাজির নিজস্ব বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন। যখন শিবাজির সৈন্যদল চিপলুনে তাবু গেড়ে ছিল, তখন শিবাজি কয়েকটি বিধিনিষেধ জারী করেছিলেন—“মানুষ নিশ্চয় বর্ষার দিনের জন্য খড় সংগ্রহ করেছে। হতে পারে, সেগুলি এখনও এধার ওধার পড়ে আছে। সেটা লক্ষ্য না করে যদি কোন কারণে ধুনি জ্বালায় বা এক ছিলিম তামাক খায়, তাহলে অসাবধানে খড়ে আগুন লেগে যেতে পারে, এবং তার থেকে মহাক্ষতি হয়ে যেতে পারে। পুরাে অশ্বারােহী বাহিনী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তখন ঘােড়াদের মৃত্যুর জন্য তােমরা দায়ী হবে। আর একটি নির্দেশে শিবাজি বলেন—“তােমাদের টাকা দেওয়া হয়েছে। যা কিছু প্রয়ােজন, বাজার থেকে টাকা দিয়ে কিনে নেবে। তা না করে যদি সাধারণ মানুষের কোন ক্ষতি কর, তাহলে মানুষ ভাবতে পারে, এর থেকে মােঘলরা ছিল ভাল। (গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০)। শিবাজির সেনাবাহিনী অহেতুক রায়তদের উপর নিপীড়ন করত না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন- গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮-৩২।
১৮. ইরফান হাবিব, মুঘল ভারতে কৃষি ব্যবস্থা (অনূদিত), কেপি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮৫, পৃ. ৩৭৩।
১৯. ইরফান হাবিব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৪।
২০. এই বর্গীর আক্রমণ ও ঘটনা সম্পর্কে কালীকিঙ্কর দত্ত লিখেছেন : ‘The origin of the Maratha invasions of Bengal is to be sought in the triumphant Maratha imperialism of the period. The Marathas now sought, as it were, to wreak vengeance on the moribund Mughal Empire, which had in its hayday opposed their national aspirations, and made a gigantic bid for supremacy over India. The policy of founding a Maratha Empire on the ruins of the Mughal Empire, initiated by the first Peshwa Balaji Viswanath, was definitely formulated by his bold and imaginative successor, Balaji Rao I, when he suggested to his master Shahu ; Let us strike at the trunk of the withering tree (the Mughal Empire); the branches will fall of themselves. Thus should the Maratha flag fly from Krishna to the Indus.’ (কে কে দত্ত, আলিবর্দী অ্যান্ড হিজ টাইমস্ ওয়ালর্ড প্রেস, কলকাতা, ১৯৬৩, পৃ. ৪৫) এবং পরিণামে ‘Some people of West Bengal saved their honour and wealth, by fleeing away to Eastern and Northern Bengal (Ducca Maldha, and Rampur Boalia) where they settled permanently ইত্যাদি। দেখুন কে কে দত্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯। মারাঠারাজ রঘুজী ভেঁসলের বাসনা ছিল পেশােয়ার স্থলে নিজে সাঁতরার শাসক হওয়া। কিন্তু বাজীরাওয়ের সুশিক্ষা, জন্মসূত্রে লব্ধ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা উত্তর-পূর্বে ও পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় তার আধিপত্য বিস্তারের উত্তম-পথ হিসেবে বিবেচনা করেন। এই সময় তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দির গৃহশত্রুর পক্ষ থেকে কটক আক্রমণের আমন্ত্রণ লাভ করেন। এটা ছিল তার কাছে অতি সুসংবাদ।কেননা, এর কিছু পুর্বে কর্ণাটক অভিযান থেকে তিনি মােটেই লাভবান হতে পারেননি। কারণ তার প্রতিপক্ষের মারাঠা নেতারা ছিল অতিশয় লােভী। শুধু কর্ণাটক অভিযানের ব্যর্থতাই নয়, পেশােয়ার প্রভাবধীন এলাকাসমূহ আক্রমণ করেও তিনি তেমন কিছুই করতে পারেননি। এই সময় তিনি সৈনিকদের বাড়তি ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে ঋণে হাবুডুবু খেতে থাকেন। তাই তার সামনে একমাত্র পথ খােলা ছিল ভারতীয়দের কাছে সম্পদের ভাণ্ডার’ নামে পরিচিত বাঙলা রাজ্য লুণ্ঠন করা, যারা তখনাে পর্যন্ত মারাঠাদের কোনাে চৌথ প্রদান করতাে না। (Sir Jadunath Sarkar, Fall of the Mughal Empire, Vol.-I, Orient Longman Ltd. Bombay, Calcutta. Madrass, New Delhi, Third edition, Reprinted, 1971, PP. 42-45). রঘুজী ভোসলে এই দায়িত্ব অর্পণ করেন তার সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের ওপর। ভাস্কর পণ্ডিত ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে পঁচিশ হাজার নিয়মিতমারাঠা সৈন্য এবং ‘লুণ্ঠনেচ্ছু আরাে পনেরাে হাজার অর্থাৎ মােট চল্লিশ হাজার, মতান্তরে দশ-বারাে হাজার বা ষাট হাজার বা আশি হাজার মারাঠা নিয়ে বঙ্গদেশে প্রবেশ করেন। এই সময় নবাব আলীবর্দি উড়িষ্যার বিদ্রোহ দমন শেষে কটক থেকে মুর্শিদাবাদ ফিরছিলেন। হুগলির মােবারক মঞ্জিলের নিকট পৌঁছে তিনি সংবাদ পান যে, মারাঠা বাহিনী নাগপুর থেকে পাচেটের মধ্য দিয়ে বঙ্গে প্রবেশ করছে। নবাবের সঙ্গে তখন মাত্র তিন চার হাজার অশ্বারােহী এবং পাঁচ হাজার পদাতিকের অধিক সৈন্য ছিল। নবাব আলীবর্দি এই সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মারাঠাদের প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ বর্ধমান অভিমুখে ধাবিত হন। অপরদিকে মারাঠারাও দ্রুত অন্য পথে বর্ধমান পৌঁছে শহরের বৃহদাংশ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।নবাব বর্ধমানে উপস্থিত হয়ে রাণীর দিঘির পাড়ে সেনানিবাস স্থাপন করেন। এখানে কয়েকদিন যাবৎ উভয়পক্ষের মধ্যে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে মারাঠারা নবাব শিবির অবরােধ করে ফেলে। এমনকি নবাব শিবিরে রসদ সরবরাহের পথ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। অপরদিকে তারা প্রত্যহ তাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযােগ করতে থাকে। এর ফলেই অচিরেই নবাব শিবিরে চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। জনগণ বর্গীয় ভয়ে গৃহের রুদ্ধ কক্ষে অবস্থান করে। প্রয়ােজনীয় খাদ্যশস্যের সরবরাহের অভাবে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। বর্গী আক্রমণের ফলে মানুষের জীবনধারণ তখন অসহনীয় হয়ে ওঠে। নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়। এই দুঃসময়ে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য কি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে কবি গঙ্গারাম তা উল্লেখ করেছেন—
“বরগির তরাসে কেহ বাহির না হ এ।
চতুর্দিকে বরগির তরে রসদ না মিল এ।
চাউল কলাই মটর মুষরি খেসারি।
তেল ঘি আটা চিনি লবণ এক সের করি।।
টাকা সের হইল আনাজ কিন্তে নাই পাত্র
খুদ্র কাঙাল যত মইরা মইরা জাএ।
গাজা ভাংগ তামাক না পাত্র কিনিতে।
আনাজ নাহি পাওয়া যাএ লাগিল ভাবিতে।
কলার আইঠা জত আনিল তুলিয়া।
তাহা আনি সব লােক খাএ সিজাইয়া।
ছােট বড় লস্করে যত লােক ছিল।
কলার আইঠা সিদ্ধ সব লােকে খাইল।
বিসম বিপত্য বড় বিপরিত হইল।
অন্যপরে কা কথা নবাব সাহেব খাইল।”
কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় : বাঙ্গালার ইতিহাস (অষ্টাদশ শতাব্দী নবাবী বাংলা), স্টুডেন্টস লাইব্রেরী, কলকাতা, ১৩১৫, পৃ. ৫৬১; দে’জ পাবলিশিং, প্রথম সংস্করণ, ২০০৩, পৃ.৩৭০। আরও দেখুন-যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী সম্পাদিত, মহারাষ্ট্র পুরাণ, নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ, নবদ্বীপ, ২০০২, পরিবেশক-পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ. ১৪। এই বর্ণনার সমর্থন পাওয়া যায় ঐতিহাসিক সৈয়দ গােলাম হুসায়ন তাবতাবায়ীর ইতিহাস গ্রন্থে : “সৈনিকেরা খাদ্যাভাবে বৃক্ষপত্র, ছাল এবং পিপীলিকার মত ক্ষুদ্রপ্রাণ ভক্ষণ করতাে।’ (সৈয়দ গােলাম হুসাইন খান তাবতাবায়ী : সিয়ারে মুতাখখিরীণ, প্রথম খণ্ড, অনুবাদক-এম. আবদুল কাদের, প্রথম প্রকাশ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৮, পৃ. ৪৬৯) অপর ঐতিহাসিক গােলাম হােসেন সলীম বলেছেন: ‘নবাব সৈনিকেরা অনাহারজনিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কলাগাছের মূল, পশুপাল ও বৃক্ষপত্র খেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এ সবেরও অভাব হয়। প্রাতঃরাশ ও নৈশাহারের জন্য সূর্য ও চন্দ্র ব্যতীত অন্য কিছু তাদের সামনে ছিল না। দেখুন-গােলাম হুসেন সলিম: রিয়াজ-উস-সালাতিন, অনুবাদক-আকবরউদ্দিন, বাংলার ইতিহাস, প্রথম সংস্করণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃ. ২৬৬।
২১. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯।
২২. গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯-৪০।
২৩. জন্মগত কারণে বােধহয় শিবাজীর সঙ্গে অহিন্দু বিশেষ করে মুসলমানদের সম্পর্ক বিদ্বেষমূলক ছিল না। শিবাজীর পিতার নাম শাহজী ও দাদুর নাম মালােজী। দীর্ঘদিন যাবৎ পুত্র সন্তান না হওয়ায় মালােজী সকল দেবদেবীর পূজা করে হতাশ হয়ে অবশেষে শাহ শরিফ নামক একজন মুসলমান ফকিরের দরবারে দোওয়া প্রার্থী হন। কিছুদিন পর তার ঘরে দুটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। ফকিরের প্রতি সম্মানার্থে তিনি তাদের একজনের নাম রাখেন শাহজী ও অপর জনের নাম রাখেন শরিফজী। দেখুন-এডওয়ার্ড সুলিভান, দ্য প্রিন্সেস অফ ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৮৭৫, পৃ. ৪৪৩-৪৪।
২৪. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬।
২৫. ভি এস স্মিথ, অক্সফোর্ড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৭, পৃ. ৪৩২-৩৩।
২৬. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬১।
২৭. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬।
২৮. হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, মুঘল ও ব্রিটিশ ভারত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, পৃ. ১৪০। আরও দেখুন-গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০। ১৬৬৯ সালের ২ নভেম্বর জারি করা শিবাজীর এক আদেশনামা উদ্ধৃত করেছেন রঘুনাথ পণ্ডিতরাও। সেখানে শিবাজী বলেছেন : “শ্রীমৎ মহারাজের নির্দেশ এই যে, সকলেই স্বাধীনভাবে তার ধর্মাচরণ করতে পারে। কোনােরকম ব্যাঘাত সৃষ্টি করার অনুমতি দেওয়া হবে না কাউকেই।” গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০।
২৯. মারাঠা রাষ্ট্রনীতির সম্বন্ধে সবিশেষ জানতে হলে দেখুন-সুরেন্দ্রনাথ সেন, দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সিস্টেম অফ দ্য মারাঠাজ, কলকাতা, ১৯২৮। আরও দেখুনসতীশচন্দ্র, দ্য মারাঠা পলিটি অ্যান্ড ইটস অ্যাগরেরিয়ান কনসেকোয়েন্সেস, অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বেশ্বর প্রসাদ সম্পাদিত, আইডিয়াজ ইন হিস্টরি, এশিয়া পাবলিশিং হাউস, বম্বে, ১৯৬৩।
৩০. দ্য পেশওয়াস ডায়েরি, খণ্ড-২, দলিল নং-১৭১, পৃ. ১০১।
৩১. গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ.
৫১। ৩২. গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০-৪১।
৩৩. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, পঞ্চম ইংরেজি সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৫২, পৃ. ৪০৩।
৩৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবাজী ও মারাঠা জাতি’, দেখুন-প্রবাসী, চৈত্র ১৩১৬।
৩৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’, অন্তর্ভুক্ত-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইতিহাস, বিশ্বভারতী, পুনর্মুদ্রণ, কলকাতা, ১৩৯৫, পৃ. ৬৫-৭৩; প্রবাসী, চৈত্র ১৩১৬।
৩৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩।
৩৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩।
৩৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৪।
৩৯. প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র-সাহিত্য প্রবেশক, খণ্ড-২, বিশ্বভারতী, কলকাতা, পৃ. ১২৭।
৪০. এস এ সিদ্দিকি, ভুলে যাওয়া ইতিহাস, রফিক মঞ্জিল, চট্টগ্রাম, ১৯৭৫, পৃ. ৯৩।
৪১. গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, শ্রীঅরবিন্দ ও বাংলায় স্বদেশীযুগ, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃ.১১।
৪২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬-৭৭।
৪৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩।
৪৪. মডার্ন রিভিউ, এপ্রিল ১৯১১।
৪৫. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭০-৭১।
৪৬. রমেশচন্দ্র মজুমদার, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ,শতবার্ষিক জয়ন্তী উৎসর্গ, কলকাতা, পৃ. ২৮।
৪৭. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭১।
৪৮. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭২।
৪৯. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭১।
৫০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২-৭৩।
৫১. ই এইচ কার, হােয়াট ইজ হিস্টরি? বাংলা অনুবাদ- ইতিহাস কাকে বলে? কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ১১।
৫২. ঈশ্বরী প্রসাদ, এ শর্ট হিস্টরি অফ দ্য মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া, দ্য ইন্ডিয়ান প্রেস (পাবলিকেশনস) প্রাইভেট লিমিটেড, এলাহাবাদ, ১৯৬৫, পৃ. ২৬৮।
৫৩. যদুনাথ সরকার, শিবাজী অ্যান্ড হিজ টাইমস্, কলকাতা, ১৯১৯।
৫৪. জি এস সরদেশাই, নিউ হিস্টরি অফ মারাঠা, খণ্ড-১, বম্বে, ১৯৫৭।
৫৫. ঐতিহাসিক গােবিন্দ পানসারে লিখেছেন, “শিবাজির ছত্রপতি হওয়ায় মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণবর্গ এর বিরােধিতা করেছিল, একথা সর্বজন জ্ঞাত। হিন্দু বর্ণাশ্রম অনুসারে একমাত্র ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের রাজা হবার অধিকার আছে। শিবাজি যদিও বড় যােদ্ধা ছিলেন, যুদ্ধ করে তিনি যা অর্জন করেছিলেন সেটাকে একটা রাজ্য বলা যেতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় আইনে তিনি রাজা হতে পারেন না। রাজা হবার যােগ্যতা তাঁর ছিল না। অনেকের সন্দেহ ছিল যে শিবাজি ক্ষত্রিয় নন। অনেকের কাছে শিবাজি ক্ষত্রিয় ছিলেন কি ছিলেন না, তাতে কিছু যেত আসত না। কারণ, শিবাজি যদি ক্ষত্রিয় কুলে জন্মগ্রহণ করেও থাকেন, তাহলেও তার সংস্কার ক্ষয় হয়েছে। তার উপনয়ন হয়নি, এমনকি তার বিবাহও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মেনে হয়নি। কীভাবে তাহলে এই ব্যক্তি রাজা হতে পারেন?
অত্যন্ত গোঁড়া ব্রাহ্মণরা আরও চরম মন্তব্য করলেন। তাদের মতে ‘নন্দনতম ক্ষত্রিয় কুলম’-নন্দবংশ ও রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গে তাে ক্ষত্রিয়কুল শেষ হয়ে গেছে। তারপর তাে কোন ক্ষত্রিয় বেঁচেই ছিল না। কৃষ্ণ ভট্ট শেশা লিখলেন যে আকবরের সময়ের একটি গবেষণাপত্র পাওয়া গেছে—‘শূদ্রাচার শিরােমণি। তার বক্তব্য এই যে পরশুরাম পৃথিবীর বুক থেকে সমস্ত ক্ষত্রিয়দের নিধন করেছিলেন। এখন হিন্দুধর্মে কোন ক্ষত্রিয় নেই, যার মধ্যে কোন রাজকীয় গুণ আছে, বা যিনি কোন রাজবংশ জাত। এমতাবস্থায় শিবাজি কীভাবে রাজা হতে পারেন? সমগ্র মহারাষ্ট্রে এমন একজন ব্রাহ্মণ পাওয়া যায়নি, যিনি এই কাজে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতে রাজী ছিলেন। তখন বারাণসী থেকে গাগা ভট্ট নামে একজন ব্রাহ্মণকে আনা হল, যিনি বৈদিক নিয়মে এই রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। এক সময়ে গাগা ভট্টের পরিবার মহারাষ্ট্রের নানদেদ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি বারাণসীর একজন বিদ্বান পণ্ডিত হিসাবেই খ্যাত ছিলেন। শিবাজি এই সকল ব্রাহ্মণদের প্রচুর পরিমাণে মহার্ঘ উপহার প্রদান করেন। শােনা যায়, তিনি এঁদের এত পরিমাণ স্বর্ণ প্রদান করেন যে তাদের তা বহন করে নিয়ে যাওয়াই কষ্টকর হয়েছিল। মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণরা শিবাজির রাজ্যাভিষেকের বিরােধিতা করেছিলেন। আমরা দেখেছি, তাকে যাতে পরাজিত করে মির্জা রাজা জয়সিংহ বিজয় পান, তার জন্য তাঁরা কোটি চণ্ডী যজ্ঞ করেছেন। কিন্তু এই ঘটনা থেকে যদি কেউ ভাবেন যে মহারাষ্ট্রের সমগ্র ব্রাহ্মণকুল শিবাজি বিরােধী ছিলেন, তাহলেও ভুল হবে। এটা এক ধরনের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে অন্য ধরনের ব্রাহ্মণদের সংঘাত ছিল না। এটা কারাে কোন ব্যক্তিগত লড়াই ছিল। এমনকি কোন বিশেষ পুরােহিতের ব্যাপারও ছিল না। সব প্রশ্নের মূলে ছিল— চতুর্বর্ণ বা বর্ণাশ্রম। সেটা আজও বর্তমান।
ধর্মানুসারে একজন শূদ্র কখনাে রাজা হতে পারবে না। কারণ শূদ্রের জন্ম প্ৰজাপিতার পদযুগল থেকে। তাই তাদের ধর্মীয় কর্তব্য হল বাকী তিন উচ্চতর বর্ণে জাত ব্যক্তিদের সেবা করা। ভগবান কিছু পরিমাণে রাজার মধ্যে বর্তমান থাকেন। কিন্তু ভগবানের পক্ষে তাে শূদ্রের মধ্যে বর্তমান থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং একজন শূদ্রের পক্ষে রাজা হওয়া কোনমতে সম্ভব নয়। একজন মুসলমান রাজা হতে পারেন। গোঁড়া হিন্দুধর্ম এটাই বলে। শিবাজির রাজ্যাভিষেকে স্বয়ং ধর্মই তাে বিরুদ্ধাচরণ করেছে।…. প্রশ্নটা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের নিয়েই নয়, ব্যাপারটা গোঁড়া হিন্দুধর্মের। ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাও ছিল। শিবাজি নিজেও এই সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েছিলেন। অনেকটা সেই কারণে দুটি অত্যন্ত হাস্যকর ঘটনা ঘটেছিল সেই সময়ে। শিবাজির সংসার নেই এই কথার প্রতিবাদ স্বরূপ গাগা ভট্ট শিবাজির ৪৪ বৎসর বয়সে তার উপনয়ন সম্পন্ন করেন। মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে তাঁর দ্বিতীয়বার ধর্মানুসারে বিবাহ হয়। শিবাজিকে বিশাল অঙ্কের অর্থ এবং স্বর্ণ প্রদান করতে হয়েছিল ব্রাহ্মণদের। আজকের সুযােগসন্ধানী মৌলবাদীরা ‘হিন্দুধর্মের রক্ষক’ এই তকমা এঁটে দিতে চায় শিবাজির নামের সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা কি সেই ঐতিহাসিক সত্যকে আচ্ছাদিত করতে পারবেন যে এই হিন্দুধর্মের রক্ষকরা শিবাজির রাজ্যাভিষেক মেনে নেননি। তাকে ৪৪ বৎসর বয়সে উপনয়ন করাতে হয়েছিল এবং ৪৪ বৎসর বয়সে নিজের স্ত্রীকে আচার পালন করে দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে হয়েছিল। কি হাস্যকর!… আমরা সবাই জানি, ১৬৭৪-এ জুন মাসের ৫ তারিখে রাজগড়ে তার প্রথম রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। অনেকেই এটা জানেন না যে ঠিক তিনমাস পরে তাঁর দ্বিতীয়বার রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। নিশ্চিলপুরী গােসাভী নামক একজন যজুর্বেদীয় তান্ত্রিক ছিলেন। রাজ্যাভিষেকের পর তার সঙ্গে শিবাজীর সাক্ষাৎ হয়। শিবাজীর মাতা মহান জিজাবাঈ রাজ্যাভিষেকের ঠিক তেরাে দিন পর মারা যান। তার সেনাপতি প্রতাপরাও গুজরও মারা যান। তার অন্যতম স্ত্রী শশীবাঈয়েরও মৃত্যু ঘটে। তখন নিশ্চলপুরী জোরের সঙ্গে বলেন, ‘এইসব পর পর ঘটছে, কারণ গাগা ভট্ট রাজ্যাভিষেকের সময়ে সমস্ত আচার নিয়মনিষ্ঠাভরে ঠিকমত পালন করেননি। যে দিনটি তিনি ধার্য করেছিলেন, সেই দিনটি শুভ ছিল না। বহু দেবতা এই যজ্ঞে তৃপ্ত হননি, কারণ পশুবলি দেওয়া হয়নি। সেইসব কারণে এই সকল দুর্ঘটনা ঘটছে। শিবাজী এবং তার উপদেশদাতারা সবাই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা পাশা সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। অবশ্য তাদের বিবেক এবং সমসাময়িক সময়ের এক বাধ্যবাধকতা ছিল। নিশ্চলপরীর কথা তাদের ঠিক বলে মনে হয়, এবং দ্বিতীয়বার রাজ্যাভিষেকের আয়ােজন করা হয়। অবশ্য দুবার রাজ্যাভিষেক, বিভিন্ন দেবমূর্তি ও ব্রাহ্মণদের দেওয়া প্রচুর অর্থ ও উপঢৌকন খুব একটা কার্যকরী হয়নি। এইসবের পরেও শিবাজী আর মাত্র ছয় বৎসর জীবিত ছিলেন। ছয় বৎসর পর, যথেষ্ট কম বয়সে শিবাজীর মৃত্যু হয়।… শুধুমাত্র ব্রাহ্মণেরাই শিবাজীকে শূদ্র বা নীচু জাতের বলে মনে করতেন, এমনটা নয়। মারাঠাদের ৯৬টি পরিবার, যাঁরা নিজেদের ক্ষত্রিয় বা মহান বলে মনে করতেন, তারা শিবাজিকে প্রথমে রাজা বলে মানতেই চাননি। এই গর্বিত ও উচ্চবর্ণের পরিবারগুলির ৯৬টি পদবি ছিল। ভোসলেরা এই তালিকায় ছিলেন না। এমনকী আজকের দিনেও যেসব মারাঠারা বিবাহসংক্রান্ত বিষয় স্থির করার আগে জাতিবর্ণ এবং পারিবারিক মর্যাদার মত বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেন, তারাও ভোসলে পদবির লােকদের নীচু জাতের বলেই মনে করেন।… সংক্ষেপে, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরাই হােক বা উচ্চবর্ণের মারাঠারাই হােক, তারা প্রথমে শিবাজীকে তাদের নেতা বা রাজা হিসেবে মানতে চাননি। শিবাজীকেও চতুর্বর্ণের অসাম্যর জন্য ভুগতে হয়েছিল। অবশেষে ধর্মীয় কাঠামাের মধ্যে তিনি উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন, কারণ, তিনি তার ধর্ম অনুসরণ করে চলেছিলেন। ব্রাহ্মণদের ইচ্ছা ও অধিকারের মধ্য দিয়ে তিনি তার সুযােগ পেয়েছিলেন। তিনি এমন রাজ্যের রাজা ছিলেন যা তিনি তার শক্তি, সাহস ও চতুর কৌশল এবং রণনীতির সাহায্যে অর্জন করেননি। কিন্তু হিন্দুধর্ম তাকে মর্যাদা দেয়নি। তাই তাঁর দু’বার রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। তাঁকে ধর্মীয় সম্মতিও অর্জন করতে হয়েছিল।” গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫৫৯।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় নিয়ে আমরা আলােচনা করতে চাই। বিষয়টি হল শিবাজী ‘গােব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ ছিলেন কিনা। ঐতিহাসিক গােবিন্দ পানসারে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন: “শিবাজীর নামের সঙ্গে অসংখ্য উপাধি জড়িত আছে। তারমধ্যে যে উপাধিটি সর্বাধিক শ্রুত ও পরিচিত, তা হলাে ‘গাে-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ (গাে-ব্রাহ্মণের রক্ষাকর্তা)। নিরবচ্ছিন্নভাবে এই কথাটি ঘােষিত হয়েছে যে শিবাজি ছিলেন ‘গাে-ব্রাহ্মণের রক্ষাকর্তা।
ছত্রপতি শিবাজীর বেশকিছু চিঠিপত্র আছে, যেগুলি প্রামাণ্য বলে মনে হয়, এবং এখন সহজেই লব্ধ। সেইসব চিঠিপত্রে তিনি কোথাও নিজেকে ‘গাে-ব্রাহ্মণের রক্ষাকর্তা’ বলে দাবী করেননি। তাকে লেখা সমসাময়িক অনেকের চিঠি পাওয়া যায়; তাঁরাও কেউ তাঁদের চিঠিপত্রে শিবাজীকে ‘গাে-ব্রাহ্মণের প্রতিপালক’ বলে উল্লেখ করেননি। বরং আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘােষিত হবার পর লেখা ২৯টি প্রামাণ্য চিঠি পাওয়া গেছে, যেসব চিঠিতে তিনি নিজেকে ‘ক্ষত্রিয় কুলওয়াতন শ্রী রাজা শিব ছত্রপতি’ বলে উল্লেখ করেছেন। কোনটাতে তিনি নিজেকে ‘গাে-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলে উল্লেখ করেননি। তাহলে এই ‘গাে-ব্রাহ্মণ’ ব্যাপারটা এল কোথা থেকে? শ্রী বি. এম. পুরন্দর দাবী করেছেন যে শিবাজী নিজেকে ‘গাে-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলে উল্লেখ করেছেন, এবং প্রমাণস্বরূপ তিনি “শিব চরিত্র সাধনের পঞ্চম ভলিউম থেকে ৫৩৪ এবং ৫৩৭ অনুচ্ছেদ বা ধারার উল্লেখ করেছেন। সেই প্রমাণ এবং চিঠিপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে সেজওয়ালকর এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ৫৩৪ নং চিঠিতে শিবাজী নিজেকে ‘গাে-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলেননি। বরং যে ব্রাহ্মণ এই চিঠি লিখেছেন তিনি এই কথা বলেছেন। ৫৩৭ নং চিঠিতে কোথাও গাে-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলাই নেই। এটি একটি নির্দোষ মিথ্যা মাত্র। শিবাজী নিজেকে ‘গােব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলে উল্লেখ করছেন, আর ব্রাহ্মণেরা তাকে ঐ উপাধিতে ভূষিত করছে—এই দুইয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। যে কেউ রাজার কাছে কিছু পাবার আশায়, এমনকি কোন সুবিধা পাবার আশায় যদি রাজার কাছে যায়, তাহলে সে রাজাকে প্রতিপালক’ বলে সম্বােধন করবে, এতে আশ্চর্য হবার মত কী আছে?
তাহলে এই উপাধি অনেকটা জোর করেই শিবাজির উপর চাপিয়ে দিল কে? গরুদের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়। তাহলে উত্তরটা খুবই পরিস্কার। মহান ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে খুবই চাতুর্য এবং যত্ন সহকারে কোন একটা উপাধি জুড়ে দেবার রেওয়াজ আছে। অধিকাংশ অশিক্ষিত হওয়ায় দীর্ঘদিন এটা কারাে চোখে পড়ে না। নজরে এলেও সাধারণ মানুষ কোনাে কিছুর মূলে গিয়ে কোনাে জিজ্ঞাসা বা অনুসন্ধান করে না। কিন্তু এই চালাকি ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয় না।… মারাঠাদের মত সকল ব্রাহ্মণ তার পক্ষে ছিলেন না। অনেকেই তার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। সেদিক দিয়ে দেখলেও শিবাজী ‘গাে-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ এই উপাধি পেতে পারেন না। তিনি যে ‘গাে-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ উপাধি নিজে গ্রহণ করেননি তাতে কোনাে সন্দেহ নেই।” দেখুন- গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩-৫৪।
৫৬. এক্ষেত্রে শিবাজীর কল্যাণকর প্রশাসন ব্যবস্থার অন্তত দুটি দিক আমরা তুলে ধরতে পারি, যেগুলি ঐতিহাসিকেরা খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। এই দুটি দিক হল— ব্যবসা-বাণিজ্য নীতি ও দাসপ্রথায় নিষেধাজ্ঞা। প্রত্যেক কল্যাণকর রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্র থেকে কোনাে দ্রব্য আমদানী করার ক্ষেত্রে রাজস্ব ধার্য্য করে। রাষ্ট্রের নিজস্ব শিল্প ও ব্যবসাকে বাঁচাতেই এটা করা জরুরী। কিন্তু অবাকের বিষয় এই যে, মধ্যযুগেও দেশীয় শিল্পকে উৎসাহ দিতে শিবাজী আমদানীর উপর বিশেষ রাজস্ব ধার্য করেছিলেন। ঐতিহাসিক গােবিন্দ পানসারে লিখেছেন, “১৬৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর তারিখে কুদালের সুবেদার নরহরি আনন্দরাওকে তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন। তিনি আনন্দরাওকে বলেছিলেন যে সঙ্গমেশ্বরে লবণের উপর চুঙ্গীকর ধার্য করার সময় তিনি যেন খুব সতর্ক থাকেন। আধিকারিক বলেছিলেন যে কর যেন একটু বেশী ধার্য করা হয়। তা না হলে রাজ্যের বাইরের ব্যবসায়ীরা একাধিপত্য বিস্তার করবে এবং ধীরে ধীরে রাজ্যের নিজস্ব ব্যবসায়ীরা বসে যাবে। এটা তার দূরদর্শিতার প্রমাণ। তিনি স্বরাজ্যে কৃষির উপরে জোর দিতেন। তার সময়ে ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা মহারাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করত। তারা ব্যবসা করার অনুমতি চেয়েছিল। তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কিছু শর্ত আরােপ করেছিলেন। এমন একটি শর্ত ছিল ‘চুঙ্গী’ কর সম্বন্ধীয়। তার রাজ্যে ব্যবসা করবার অনুমতি দিয়েও একটি ওলন্দাজ কোম্পানীকে ১৬৭৭ সালের ২৪শে আগস্ট তারিখে একটি আদেশ জারি হয়েছিল; তাতে বলা হয়েছিল এই ওলন্দাজ কোম্পানীকে জিনজি প্রদেশে ব্যবসা করার জন্য অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তারা কুড়ালােরে তাদের মালপত্রের উপর ২.৫ শতাংশ হারে চুঙ্গী কর দিতে বাধ্য থাকবে। যদি আমদানি ও রপ্তানি বিষয়ে অগ্রিম খবর দেওয়া হয়, তাহলে আধিকারিকরা পরীক্ষার জন্য পার্সেল খুলবে না। ঠিকমত কর না দিলে হাবিলদার পর্যায়ের আধিকারিকরা যেন কোন মাল ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়। এই ধরনের আদেশ আরও একটি প্রয়ােজনীয় বিষয়ে বলবৎ ছিল। এতদিন পর্যন্ত এই আদেশনামা কারাে নজরে আসেনি। বলা হয়েছে, মুসলমান রাজত্বকালে কোন বাধা ব্যতিরেকে তােমরা নারী-পুরুষ নিবিচারে ক্রীতদাস হিসাবে বেচাকেনা করেছ। কিন্তু আমার রাজত্বে নারী-পুরুষকে ক্রীতদাস হিসাবে কেনাবেচা চলবে না। তােমরা যদি এই কাজ করতে চেষ্টা কর—আমার লােক তােমাদের বাধা দেবে। অত্যন্ত কঠোরভাবে এটা মানতে হবে। যখন ভারতের অন্যান্য স্থানে দাস ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, যখন নারী-পুরুষ নির্বিচারে ভারতীয়দের বন্দী করে মজদুর হিসাবে চালান করা হচ্ছিল, তখন শিবাজি তার রাজ্যে দাস ব্যবসায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। সকল সম্ভবপর উপায়ে রায়তদের দেখাশােনা করা এবং তাদের ভাল করা শিবাজির রাজ্যের নীতি ছিল।” দেখুন- গােবিন্দ পানসারে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩।