১৮৭৬ খৃষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বরঙ্গালী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৮-এর ১৬ই জানুয়ারি তিনি পরােলােকগমন করেন। তাঁর গেঁয়াে নাম বা ডাক নাম ছিল ‘নেড়া’। ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুল ছেড়ে তিনি তাঁর মামার বাড়ি ভাগলপুর যান এবং সেখান হতে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। ১৮৯৫-এ তিনি জুবিলী কালেজে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু তাঁর মায়ের মৃত্যুতে পড়াশােনায় ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। ১৮৯৬ থেকে খেলাধুলা, সাহিত্যচর্চা, অভিনয় ইত্যাদি করে সুনাম অর্জন করে আদমপুর ক্লাবের সম্মান শ্রীবৃদ্ধি করেন। ১৯০১ হতে হাতে লেখা পত্রিকা ‘ছায়া’-তে তাঁর কিছু লেখা বের হতে থাকে। গান বাজনায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন বলে জমিদার মহাদেব সাহুর অধীনে অনেকদিন ছিলেন। সেই সময় তাঁর পিতার মৃত্যু হলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় তাঁর এক মামা লালমােহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাসায় আসেন। ১৯০৩-এ রেঙ্গুনে তাঁর মেসোেমশাই উকিল অঘােরনাথ বাবুর কাছে চলে যান। ১৯০৫ সালে তাঁর মেসাের মৃত্যু হলে তিনি কেরাণীর চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯০৭ সালে তাঁর ‘বড়দিদি’ উপন্যাস মাসিক পত্রিকা ‘যমুনা’-তে প্রকাশিত হয়, ১৯১৩ -তে তা পুস্তকাকারে আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর ‘বিরাজ বৌ’ প্রথম পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। স্বাস্থ্যহানির জন্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একবছরের ছুটি নিয়ে বাজেশিবপুরে আসেন। ১৯১৯-এ ‘বসুমতী’-তে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯২১-এ তিনি কংগ্রেসে যােগ দেন। ১৯২২ সালে তাঁর শ্রীকান্ত প্রথম পর্বের ইংরাজি অনুবাদ করেন থিওডােসিয়া টমসন। ১৯২৩ সালে তিনি ‘জগত্তারিণী’ পদক লাভ করেন। ১৯২৫-এ ঢাকায় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনীর সাহিত্য শাখার তিনি সভাপতিত্ব করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনেকগুলাে উপন্যাস রচনা করেন যেমন বড়দিদি, চন্দ্রনাথ, দেবদাস, রামের সুমতি, পথনির্দেশ, বিন্দুর ছেলে, নারীর মূল্য, চরিত্রহীন, মহেশ, পরিণীতা, বৈকুণ্ঠের উইল, বিরাজ বৌ, পণ্ডিতমশাই, অরক্ষণীয়া, গৃহদাহ, দত্তা, পল্লীসমাজ, নিষ্কৃতি, বামুনের মেয়ে, স্বামী, দেনাপাওনা, নব বিধান, বিপ্রদাস, শেষের পরিচয়, শুভদা, ষোেড়শী, শেষ প্রশ্ন, পথের দাবী ইতাদি।
শরৎচন্দ্রের প্রকাশ্য রাজনীতি করতেও কোন দ্বিধা ছিল না। তিনি সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস ও গান্ধীজির সঙ্গে একত্রে কাজ করেছেন।
যে সব বীর বিপ্লবী লেখকদের লেখা ইংরেজের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে শরৎচন্দ্র এক বিশিষ্ট গ্রহরত্ন। তাঁর পথের দাবী ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। সুতরাং শুধু কথাশিল্পী উপাধি দিলেই তাঁকে প্রকৃত সম্মান দেওয়া হয় বলে মনে হয় না, তাঁকে ‘স্বাধীনতা শিল্পী’ বলে চিহ্নিত করা অনেক আগেই প্রয়ােজন ছিল। আমরা যাঁদের স্বাধীনতার অগ্রদূত বলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছি, ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁদের এমন কোন রচনা পাওয়া যায় না যা সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঐ বিখ্যাত ‘পথের দাবী’ ১৯২৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি বাজেয়াপ্ত হয়। বইটি সম্বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল – “The most powerfut of sedition in almost every page of the book.”
‘পথের দাবী’ বাংলা সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হওয়ায় শরৎচন্দ্র অত্যন্ত দুঃখিত হন, কারণ এই বইখানির প্রতি তাঁর বিশেষ মমতা ছিল। হঠাৎ তাঁর মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যদি ‘পথের দাবী’র উপর সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে একটু প্রতিবাদ জানান তাহলে হয়তাে বইখানি রাহুমুক্ত হতে পারে। এই উদ্দেশ্যে একদিন তিনি রবীন্দ্রনাথের সকাশে উপস্থিত হয়ে তাঁকে একনি বই উপহার দেন [নিষিদ্ধ বাংলাঃ শিশির কর, পৃষ্ঠা ২৩-২৪]
রবীন্দ্রনাথ বইটা পড়ে শরৎচন্দ্রকে কী লিখেছিলেন বা কিরকম ভূমিকা নিয়েছিলেন তা এই পুস্তকে অন্যত্র আলােচনা হয়েছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘পথের দাবী’ বাজেয়াপ্ত হওয়ায় যে কত বেদনা পেয়েছিলেন তা তাঁর ভাষা থেকেই জানা যায়। অল বেঙ্গল লাইব্রেরী অ্যাসােসিয়েশনের প্রথম অধিবেশন যখন অনুষ্ঠিতব্য তখন তিনি অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী বিশেষ ব্যক্তিদের বলেছিলেন-আচ্ছা তােমাদের এটা তাে সারা বাংলার লাইব্রেরীর ব্যাপার। তােমরা একটা কাজ কর না, অব মােদেরই তাে এটা কাজ। এই যে সরকার আমার ‘পথের দাবী’-কে আটকে রেখেছে, এটা ছাড়বার একটা প্রস্তাব সভা থেকে মঞ্জুর করাতে পার? প্রকাশ্য সভা থেকে আর একটা প্রদিবাদ হলে অনেক কাজ হবে — সরকারের একটু টনক নড়বে। আমার আর পাঁচখানা বই যদি সরকার বাজেয়াপ্ত করত, তাহলে আমার এত দু:খ হত না।” [নিষিদ্ধ বাংলা, পৃঃ ৩৩]
বিপ্লবী শরৎচন্দ্র মৃত্যু যন্ত্রণার সময়ও তাঁর ঐ বইয়ের কথা ভুলতে পারেন নি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি ঐ বইকে ‘রাহুমুক্ত’ দেখে যেতে পারেন নি। শ্রীশিশির কর লিখেছেন, “সুখের বিষয়, এই সভার দুই মাসের মধ্যে বাংলা সরকার কর্তৃক ‘পথের দাবী’র উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয় ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বকালে। এবং অচিরেই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়” (পৃষ্ঠা ৩৪)। ১৯৩৯-এর ১৩ই মে ‘পথের দাবী’ নাটকরূপে অভিনীত হয়। অবশ্য অবশেষে ১৯৪০ সালে ঐ নাট্যাভিনয়ের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়।
আমাদের মতে শরৎচন্দ্রকে ‘কথাশিল্পী’ বলে, শুধু সাহিত্যিক বলে, আর নজরুলকে শুধু ‘বিদ্রোহী কবি’ বলে শেষ করা একটা ভাওতাবাজী ছাড়া কিছু নয় এ মনে করা অস্বাভাবিক নয় যে, শরৎচন্দ্র হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও : মূল্যায়ন হয়নি আসল কারণ যাই-ই হােক শরৎচন্দ্রের লেখায় একটা জিনিসের বড়ই অভাব। সেটাই কি তাঁর অযােগ্যতা? সেটা হচ্ছে তিনি তাঁর বইপুস্তকের কোন স্থানে ইসলাম ধর্ম, মুসলমান জাতি ও মুসলিম মানসকে আঘাত দেননি বা অপমান করেন নি। শরৎচন্দ্র নিজেই গর্ববােধ ও আনন্দবােধ করতেন যে, তিনি মুসলমান বিদ্বেষী নন। তাই তিনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “দেশবন্ধু [চিত্তরঞ্জন] বলিলেন, আপনার মুসলমান-প্রীতি প্রসিদ্ধ। ভাবিলাম, মানুষের কোন সাধু ইচ্ছাই গােপন থাকিবার যাে নাই, খ্যাতি এতবড় কানে আসিয়াও পৌঁছিয়াছে।” (বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি : এন. জে. চৌধুরী, পৃষ্ঠা১০৯, টীকা ২)
তিনি একটা জেলার কংগ্রেসের একটানা নেতৃত্বের চেয়ার গ্রহণ করেছিলেন বটে কিন্তু ঐ রাজনীতি তাঁকে দোদুল্যমান অবস্থায় দ্বিধাগ্রস্ত করেছিল। তাই তিনি চন্দননগরের আলাপ-সভায় বলেছিলেন ? “এই যে দেশটা ত্যাগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আমার মনে হয় ঠিক এরই মধ্যে কোথায় একটা গলদ ঢুকে আছে সেটা খুঁজেও পাচ্ছিনা।…কোন উপায় চোখের উপর দেখতেও পাইনা … কোনখানটায় গলদ আছে – যার জন্য এত বড় শাস্তি ভােগ ছি। আমিও মনে করেছি Politics-এ আর থাকব না।” [দ্র: ঐ, পৃষ্ঠা ১১৭, টীকা ১)
চিত্তরঞ্জন দাসের অনুরােধেই তিনি কংগ্রেসের সভাপতির পদ নিয়েছিলেন। তিনি চিত্তরঞ্জনকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। যেটা তাঁর বুঝে আসতােনা তাঁকে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন। সন্ত্রাসবাদীদের ডাকাতি করা ও রক্তারক্তি ঘটনা তাঁকে বিচলিত করতাে, কিন্তু চিত্তরঞ্জন যেহেতু কংগ্রেসে আছেন সেহেতু স্বাধীন মত প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধা করতেন। একদিন তিনি চিত্তরঞ্জন দাসকে জিজাসা করেছিলেন – শরৎচন্দ্রের ভাষায় “আমি জিজ্ঞাসা করিলাম আচ্ছা, এই রিভোলিউশনারদের সম্বন্ধে আপনার যথার্থ মতামত কি?.. তিনি — আস্তে আস্তে বলিলেন, এদের অনেককে আমি অত্যন্ত ভালবাসি, কিন্তু এদের কাজ দেশের পক্ষে একেবারে ভয়ানক মারাত্মক এই এ্যাকটিভিটিতে সমস্ত দেশ অন্ততঃ পঁচিশ বছর পিছিয়ে যাবে। খুনোখুনি রক্তারোক্তি আমি অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করি, শরতৎবু।” [ দ্রষ্টব্য বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা ৭৬ ]।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কংগ্রেস করলেও তিনি গান্ধীজীর সকল পন্থায় একমত ছিলেন না। গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র তাঁর জন্য লিখেছেন—“তাঁর আসল ভয় সােশিয়ালিজমকে তাঁকে ঘিরে রয়েছে ধনিকরা, ব্যবসায়ীরা। সমাজতান্ত্রিকদের তিনি গ্রহণ করবেন কি করে? এইখানে মহাত্মার দুর্বলতা অস্বীকার করা চলে না।” [বর্তমান রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, চতুর্থ সম্ভার, পৃষ্ঠা ৩৯৮]
গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর মতবিরােধের অর্থ হচ্ছে গান্ধী ছিলেন অহিংসবাদী; তাঁর এই মতবাদে শরৎচন্দ্র পূর্ণভাবে বিশ্বাসী ছিলেন না। অপরদিকে হিংসাবাদীদের সঙ্গে তাঁর সমর্থন থাকলেও তিনি ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন যেহেতু তাঁর পিছনে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস। কিন্তু দেশবন্ধুর ১৯২৫ সালে অকাল মৃত্যুতে তাঁর ভারসাম্য আর বজায় রাখা সম্ভব হয়নি বা রাজনীতির মঞ্চে তাঁর ভাবান্তর শুরু হয়।
কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ও স্বীকার করেছেন যে, তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়াচ থেকে তিনি নিজেকে তাে বাঁচিয়ে ছিলেনই উপরন্তু তাঁর কল্যাণ কামনা ছিল বিশ্ব-মানুষের জন্য; সেখানে হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি ও খৃষ্টান কেউ অবহেলিত নয়। ঠিক এইভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সাম্প্রদায়িকতার পঙ্কিল থেকে নিজস্ব শক্তিতেই উঠতে পেরেছিলেন এবং উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, বহু সম্প্রদায় ও জাতি থাকলেও হিন্দু-মুসলমানের একত্র মিলন ও শক্তি ছাড়া সর্বভারতীয় উন্নতি ও শান্তি সম্ভব নয়। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, শরৎচন্দ্রের সারা জীবনের অসাম্প্রদায়িক নীতি-ব্যুহে কার আঘাতে যে ফাটল ধরল এবং তা বিদীর্ণ হয়ে গেল তাবলা মুশকিল। সারাজীবন যে কলমে অমৃত বর্ষণ করলেন সেই কলমের অমৃতধারা শুকিয়া কিভাবে তা বিষধারায় পরিণত হােল তা চিন্তার বিষয়। উদাহরণস্বরূপ শরৎচন্দ্রের উক্তি উদ্ধৃত করা যায়—“মুক্তি অর্জনের ব্রতে হিন্দু যখন আপনাকে প্রস্তুত করিতে পারিবে তখন লক্ষ্য করিবারও প্রয়ােজন হইবে না, গােটাকয়েক মুসলমান ইহাতে যােগ দিল কিনা। ভারতের মুক্তিতে ভারতীয় মুসলমানেরও মুক্তি মিলিতে পারে, এ সত্য তাহারা কোনদিনই অকপটে বিশ্বাস করিতে পারিবেনা।” [বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা, অষ্টম সম্ভার, পৃষ্ঠা ৩৭২]
পরে দেখা গেল তিনি গান্ধীজীর বিরুদ্ধেও তরুণ দলকে আহ্বান করতে ছাড়েন নি। যেমন তিনি বলেছেন, “…কিন্তু অন্ধের মতন মহাত্মাজী হুকুম করলেও নয়, কংগ্রেস সমস্বত্ত্বের প্রতিধ্বনি করে বেড়ালেও নয়। ভারতের বিশ লাখ টাকার খাদি দিয়ে আশি ক্রোর টাকার অভাব পূর্ণ করা যায় না, গেলেও তাতে মানুষের কল্যাণের পথ প্রশস্ত হয় না।” [তরুণের বিদ্রোহ শরৎ সাহিত্য সংস্করণ, ১৩শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৭]
গান্ধীজীর প্রতি শরৎচন্দ্রের ভক্তির পান্না একদিকে যেমন হাল্কা হতে থাকলে তেমনি চরমপন্থীদের দিকে ভক্তির পান্তা ক্রমশ ভারী হতে থাকলাে—তাঁর বুকের প্রতি চিন্তা করলে এটা খুব সহজেই প্রমাণিত হবে।
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘শরৎচন্দ্রের রচনাবলী’-তে সংকলিত হয়েছে—যেটা শুৎচন্দ্র তাঁর নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেহ্নে—“বস্তুত মুসলমান যদি কখনও বসে–হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হতে পারে ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসেনাই। সেদিন কেবল লুণ্ঠন করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চুর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুত অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের ‘পরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোন সঙ্কোচ মানে নাই। দেশের রাজা হইয়াও তাহারা এই জঘন্য প্রবৃত্তির হাত হইতে মুক্তি লাভ করিতে পারে নাই। ঔরঙ্গজেব প্রভৃতি নামজাদা সম্রাটের কথা ছাড়িয়া দিয়াও যে আকবর বাদশাহের উদার বলিয়া এত খ্যাতি ছিল, তিনিও কসুর করেন নাই। আজ মনে হয় এ সংস্কার উহাদের মজ্জাগত হইয়া উঠিয়াছে… হিন্দু নারী হরণ ব্যাপারে সংবাদ পত্র ওয়ালারা প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করেন মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাঁহাদের সম্প্রদায়ের লােকেরা যে পুনঃপুনঃ এত বড় অপরাধ করিতেছে, তথাপি প্রতিবাদ করিতেছেন না কিসের জন্য? মুখ বুজিয়া নিঃশব্দে থাকার অর্থ কী? কিন্তু আমার ত মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল। তাঁহারা শুধু অতি বিনয় বশতঃই মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না, বাপু, আপত্তি করিব কি, সময় এবং সুযােগ পেলে ও কাজে আমরাও লেগে যেতে পারি।” [শরৎচন্দ্রের রচনাবলী, পৃষ্ঠা ১৯৬-৯৭]
ডক্টর রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে বলেছেন— “তিনি (শরৎচন্দ্র) এই প্রবন্ধে হিন্দুদের সংঘ ও ঐক্যবদ্ধভাবে বীর্য এবং শক্তি সঞ্চয়ের জন্য আহ্বান জানালেন। এককথা, হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল ও গােষ্ঠীগুলি এতদিন যা প্রাণপণ চিৎকার করে হিন্দুদের বােঝাবার চেষ্টা করে আসছিলাে শরৎচন্দ্র প্রায় একই সুরে সেই আবেদন জানালেন।” [শরৎ সম্পুট, পৃ. ২৭১]
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরও লিখলেন, “হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে এ দেশে তাহার চিত্ত নাই।” [দ্রঃ শরৎচন্দ্রের রচনাবলী; শরৎ সম্পুট, পৃষ্ঠা ২৭১]
সারা জীবন ধরে এতগুলাে গ্রন্থ-পুস্তক উপন্যাস লেখবার সময় সম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত অগ্নি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জাতির কাছে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশী জনপ্রিয় ও মনপ্রিয় ছিলেন মুসলিম জাতির কাছে। তবে এ কথা সত্যি যে, মুসলমান সাজ শরৎচন্দ্রকে উন্নতির চরম চূড়ায় যখন টেনে তুলছিল তখন হিন্দু সমাজের অনেক বুদ্ধিজীবী তাঁকে টেনে নীচে নামাবার চেষ্টা করেছিলেন। শ্রীরবীন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখা থেকেই তা প্রমাণ করা যায়ঃ
“যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) তাে শরৎচন্দ্রকে ‘তুলনামূলক সাহিত্যের তুলনায় বাতিল করে দিয়েছেই, অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও শরৎচন্দ্রকে নিয়ে তেমন কিছু ঘটাপটা করতে নারাজ। জগত্তারিণী পদকের মর্যাদা সে তাঁকে দেয়নি ঐ পদকটি অনেক রাম শ্যামও পেয়েছেন। অতএব শরৎচন্দ্রও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে লেখক হিসাবে একজন রাম বা শ্যাম! বাংলা অনার্সে শরৎচন্দ্র পাঠ্য নন স্পেশাল বাংলা পর্যন্ত উঠতে পারেন, তার বেশী নয়। স্পেশাল পেপারে সমগ্র author হিসাবে আছেন মধুসূদন, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র কদাপি নন! পাশ কোর্সে চিরকাল বঙ্কিমচন্দ্র, কখনও শরৎচন্দ্র নন! এম. এ.-তে শরৎচন্দ্র কোন একটা পত্রের অর্ধেও পাঠ্য হতে পারেন না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎচন্দ্রের নামে এ বছরে একটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি হল, কিন্তু এত দীর্ঘকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীরব উপেক্ষায় যথেষ্ট শরৎ নিগ্রহ হয়নি কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথমে শরৎকে ডি. লিট দিয়ে সম্মানিত করেছিল। এপার বাংলার বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতগণের কাছে শরৎচন্দ্রের মত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীহীনের এই সম্মানটা আদৌ মনঃপূত হয়নি। শরৎচন্দ্র ডি. লিট. পাওয়ায় তাঁকে নিয়ে কাগজপত্রে গালিগালাজের বন্যা বয়ে গেল’ [অবিনাশচন্দ্র ঘােষালঃ শরৎচন্দ্রের টুকরাে কথা, পৃ. ৭২; শরৎ সম্পুট, পৃ. ৪৩৮)।
মুসলিম বহুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে উপাচার্য আব্দুর রহমান সাহেবের হাত দিয়ে শরৎচন্দ্রকে যখন ডি, লিট উপাধি দেওয়া হল তখন হিন্দু পরিচালিত পত্রিকা ও বিরুদ্ধবাদী হিন্দু পণ্ডিতদের লেখার কিছু নমুনা ডক্টর রবীন্দ্র গুপ্তও উল্লেখ করেছেন : “হায় শরৎচন্দ্র, তােমার প্রাণের দায়ে কাঙ্গালপনা দেখিয়া সত্যই তােমাকে কৃপা করিতে ইচ্ছা হয়” [একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়। বাঞ্ছিত ডি. লিট. যখন নভেল লিখেই পাওয়া গেল এবং তা যখন রহমান সাহেবের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) হাত দিয়েই এল তখন এই ব্রাহ্মণ বটু আতিশয্যে বলে ফেললেন, তিনি (শরৎচন্দ্র) অতপর মুসলমান ভাইদের নিয়ে নভেল চালাবেন।” (শরৎ সম্পুটঃ রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত, পৃ.৪৩৮)
তাহলে প্রমাণিত হােল যে, মুসলমান জাতির বুকভরা ভালবাসা ও ভক্তি শ্রদ্ধার পুস্পার্ঘ পেয়েছিলেন দরদী ও বিপ্লবী শরৎচন্দ্র। শরৎচন্দ্রও তাঁর কাজকর্ম এবং লেখনী নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মহান লেখকের মত লিখে গেলেন। ইংরেজের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মত ইংরেজ বিরােধী ভূমিকাও নিলেন। বই বাজেয়াপ্ত হওয়ার বেদনাও সহ্য করলেন। কিন্তু অবশেষে সেই সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ তাঁকেও রেহাই দিল না। প্রথমে তিনি বিষকৃষ্ণ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হলেন। পরক্ষণেই সাম্প্রদায়িকতার ললিহান অগ্নিশিখায় পরিবেষ্টিত হয়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেল তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার সাধ ও স্বপ্ন। তাঁর কীর্তি-পােড়া ছাই ছড়িয়ে দিয়ে আজ সাম্প্রদায়িক দলগুলাে মানুষকে বােঝাতে চাইছে—আমাদের দলে বহু বড়মানুষ আছেন, বহু ঋষি, বহু ‘সম্রাট’-এর সঙ্গে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রও আছেন; এস, তােমরা আমাদের সঠিক (!) পথের যাত্রী হও।
লিখেছেনঃ গোলাম আহমাদ মোর্তাজা