১৮ কার্তিক ১৩২৫ সিলেট যাবার পথে করিমগঞ্জ রেল জংশনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যে মানপত্র প্রদান করা হয়েছিল তা পাঠের পর কবি প্রত্যুত্তরে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেছিলেন, “পাশ্চাত্য হইতে কোন গৌরব যদি আমি ভারতবর্ষে বহন করিয়া আনিয়া থাকি সেটা আমার একার নহে সেটা আমার দেশের, দেশের গৌরব, জাতির গৌরব, প্রত্যেক ভারতবাসীর গৌরব।” এই গৌরবে আমাদের গৌরবান্বিত করেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’। তবে বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ নয়, ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ —‘সং অফারিংস’-এর জন্য নােবেল পান রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩-এ। আর ২০১৩ নােবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ।
ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ মূলত রবীন্দ্রনাথের বাংলা কবিতার অনুবাদ একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু অন্য ভাষায় রবীন্দ্রনাথের নিজের কবিতা অনুবাদ করার কথা মনে হল কেন? ইংরেজি গীতাঞ্জলির ঠিক এক দশক বা তার একটু বেশি পেছনে তাকালে আমরা দেখব যে ১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘নিষ্ফল কামনা’র একটি বিক্ষিপ্ত অনুবাদ করেন। এটাই বােধহয় তার প্রথম নিজের কবিতার অনুবাদ। এরপর অবশ্য অনেকদিন আর কোনাে অনুবাদের কথা জানা যায় না। তবে কবি বা লেখক হিসেবে বিশ্বের আঙিনায় পৌঁছানাের প্রেরণা তার বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যেমন ছিল, তেমনই ছিল ইংরেজিতে সফল অনুবাদ করতে পারার সন্দেহজনক বার্তা। জগদীশচন্দ্র বসু ২ নভেম্বর ১৯০০-এ লণ্ডন থেকে রবীন্দ্রনাথকে লেখেন,
“তুমি পল্লীগ্রামে লুক্কায়িত থাকিবে, আমি তাহা হইতে দিব না। তুমি তােমার কবিতাগুলি কেন এমন ভাষায় লিখ যাহাতে অন্য ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব? কিন্তু তােমার গল্পগুলি আমি এদেশে প্রকাশ করিব।… আর ভাবিয়া দেখিয়াে তুমি সার্বভৌমিক।”
জগদীশচন্দ্রের মতে রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার গল্পে। বন্ধুত্বের যথাযথ পরিচয় তিনি দেন। রবীন্দ্রনাথের ছয়টি গল্প অনুবাদ করে ইংরেজি কাগজে ছাপতে উদ্যত হন। রবীন্দ্রনাথ নিজে তখন ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিগ্ধ ছিলেন। জগদীশচন্দ্রকে উত্তরে লেখেন,
“আমার রচনা-লক্ষীকে তুমি জগৎ-সমক্ষে বাহির করিতে উদ্যত হইয়াছ—কিন্তু তাহার বাঙ্গলা ভাষা-বস্ত্রখানি টানিয়া লইলে দ্রৌপদীর মত সভাকক্ষে তাহার অপমান হইবে না?”
দুঃখের কথা, জগদীশচন্দ্রের অনূদিত ছয়টি গল্প ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘হারপার্স ম্যাগাজিন’ প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, গল্পগুলাে ‘অরিজিন্যাল’ নয় এবং ‘দ্য ওয়েস্ট ওয়াজ নট সাফিসিয়েন্টলি ইন্টারেসটেড ইন ওরিয়েন্টাল লাইফ। ১৯০৯ সালে বিলেতে পাঠরত রবি দত্ত রবীন্দ্রনাথের এগারােটি গান ও কবিতার অনুবাদ তার ‘ইকোস ফ্রম ইস্ট অ্যাণ্ড ওয়েস্ট’এ সংকলিত করেন। অন্যদিকে অজিতকুমার চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি কবিতার অনুবাদ এডােয়ার্ড কারপেন্টারকে পাঠান। সঙ্গে চিঠিতে লেখেন ‘অল আই ক্যান ডু ইজ টু গিভ আ রাফ ট্রানস্লেশন..হুইচ সামওয়ান মাস্ট হুইপ আপ ইনটু প্রপার শেপ। কারপেন্টার কবিতাগুলাে যথাযথ কারণেই ফিরিয়ে দেন।
এই ঘটনাগুলাে থেকে আমরা অনুমান করে নিতে পারি, রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন যে বিশ্বসাহিত্যে কবি হিসেবে স্থান পেতে গেলে তার ভাষা হতে হবে ইংরেজি। তিনি এও বুঝেছিলেন যে তার বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ রূপ ও মাধুর্য ইংরেজি অনুবাদে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। অতএব, বাংলা ভাষার বা তার কবিতার নিপুণ কলাকৌশল ও শৈলী নয়, অনুবাদে তিনি দিতে পারবেন তার কবিতার ভাব ও ভাবনা। অতএব, তিনি বেছে নেন গদ্য-অনুবাদের পথ।
পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু তাকে বার বার বলেছেন, তিনি পৃথিবীর কবি, পৃথিবীর মানুষের তার কথা আরাে বেশি করে জানা উচিত। এর মধ্যে তিনি বিলেত যাওয়ার জন্য প্রস্তুতও হয়েছিলেন কিন্তু বিদায় নেওয়ার বহু বিস্তৃত সক্রিয়তায় অসুস্থ (মূর্ছিত) হয়ে পড়ায় চিকিৎসকের নির্দেশে ১৯১২-র ১৯ মার্চের সেই যাত্রা তাকে স্থগিত রাখতে হলাে। মাদ্রাজ থেকে ফিরে এলেন তিনি। একটু সুস্থ হয়ে চলে গেলেন শিলাইদহে। সেখানে ‘গীতিমাল্য’-এর গান তৈরি হচ্ছে আর একটি-দুটি করে অনুবাদ হচ্ছে কবিতার। ইন্দিরা দেবীকে সেখান থেকে চিঠিতে লিখছেন যে, শিলাইদহেই শুরু হয়েছিল তার অনুবাদের কাজ। নিজের ইংরেজির দখল নিয়ে তার সংকোচ ছিল। কৌতুক করে ইন্দিরাকে সে কথা বারবার বলেছেন। এ কথা আমরা কবির বিনয় বলেই মনে করব,
“তখন চৈত্র মাসে আমের মােলের গন্ধে আকাশে আর কোথাও ফাক ছিল না এবং পাখির ডাকাডাকিতে দিনের বেলার সকল কটা প্রহর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল। তার আলাে, তার হাওয়া, তার গন্ধ, তার গান একটুও আমার কাছে বাদ পড়ল না। কিন্তু এমন অবস্থায় চুপ করে থাকা যায় না, হাড়ে যখন হাওয়া লাগে তখন বেজে উঠতে চায়, ওটা আমার চিরকেলে অভ্যাস, জানিস তাে। অথচ কোমর বেঁধে কিছু লেখবার মতাে বল আমার ছিল না, সেইজন্য এই গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি নিয়ে একটি একটি করে ইংরেজিতে তর্জমা করতে বসে গেলুম।”
একটা ছােট খাতার পাতাগুলাে আস্তে আস্তে ভরে এল। এর মধ্যে শান্তিনিকেতনে ফিরে এসেছেন, সেখানেও অনুবাদের কাজ চলেছে। এরপর ১৯১২-র ২৭ মে রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমা দেবীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মুম্বাই থেকে জাহাজে লণ্ডন রওনা হলেন।
বিখ্যাত ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম রথেনস্টাইন (১৮৭২-১৯৪৫) ভারতে এসেছিলেন ১৯১০-এ, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ও হয়েছিল। তিনি মূলত চিত্রশিল্পী, প্রাচীন ভারতের শিল্প সম্বন্ধে তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা ছিল। শিল্পী হিসেবে মূলত অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গেই তার আদান-প্রদান হয়েছে। তাদের এই আলাপ রথেনস্টাইনকে বিশেষ মুগ্ধ করেছিল। লণ্ডনে ফিরে তিনি ‘দ্য মর্ডান রিভিউ’ পত্রিকায় নিবেদিতার করা রবীন্দ্রনাথের গল্পের (সম্ভবত ‘কাবুলিওয়ালা’) ইংরেজি অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন, আরও পড়তে চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা। গল্প হয়তাে পাননি, কিন্তু অজিতকুমার চক্রবর্তীর করা কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ (যে অনুবাদ এডােয়ার্ড কার্পেন্টারকে ভালাে লাগেনি) তার হাতে এল, তা পড়ে তিনি আরও বেশি করে মুগ্ধ হলেন, গভীর বিস্ময়ও জাগল তার। এত বড় একজন অধ্যাত্মচেতনার কবি ইউরােপের কাছে অজ্ঞাত পড়ে থাকবেন? তিনি লণ্ডনে ব্রাহ্ম নেতা প্রমথলাল সেন আর ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে অনুরােধ জানালেন রবীন্দ্রনাথকে যেন অবশ্যই লণ্ডনে আসতে লিখে দেন তারা। এলে তাকে তিনি সানন্দে অভ্যর্থনা করবেন, আতিথ্য দেবেন। একদিন তার কাছে সেই আনন্দ-সন্দেশ পোঁছাল যে রবীন্দ্রনাথ লণ্ডনে আসছেন। নিশ্চয় তার কবিতার তাগাদাও রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেছিল।
উইলিয়াম রথেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে অনুবাদের ছােট খাতাটি তুলে দিলেন। পড়ে রথেনস্টাইন আত, পড়ে সমগ্র পৃথিবী আপুত হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ -র ইংরেজি অনুবাদ ইংল্যাণ্ডের বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রথম পৌঁছায় এই রথেনস্টাইনের মাধ্যমে। তাদের বীণার ঝঙ্কারে ‘গীতাঞ্জলি’র সুর ও স্বর সুরভিত হয় দিক-দিগন্তে, যাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও আন্তরিক উদ্যোগ নােবেল প্রাইজ পেতে রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছে।
রথেনস্টাইন ‘গীতাঞ্জলি’ -র পাণ্ডুলিপির তিনটি কপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনজন দিকপালের কাছে স্টপফোর্ড ব্রুক, ব্র্যাডলী ও ডব্লু.বি.ইয়ে। ১৯১২, ৩০ জুন রােথেনস্টাইনের বাসভবনে ইয়েটস ও তাঁর যৌথ উদ্যোগে ‘গীতাঞ্জলি’ -র অনুবাদগুলাে পাঠের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ওই চাঁদের হাটে যে সমস্ত নক্ষত্রদের উদয় হয়েছিল তারা হলেন—আণ্ডারহিল, আর্নেস্ট রীস্, চার্লস ট্রেভেলিয়ন, এজরা পাউণ্ড, অ্যালিস মেনেল, হেনরি নেভিনসন, চার্লস ফ্রিয়ার, অ্যান্ড্রুজ প্রমুখরা। এই ঐতিহাসিক সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা বির্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কেমব্রিজ থেকে ছুটে এসেছিলেন দেখা করতে জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক বার্টাণ্ড রাসেল, বার্ণার্ড শ ছাড়া বহু সাহিত্যরসিক ও সাহিত্যিকরা। সেই সন্ধ্যার বিচিত্র অনুভূতি ও উপস্থিত সকলের অভিভূত হৃদয়ের ছবি কবি পরবর্তীকালে অনেকবার উল্লেখ করেছেন, “রথেনস্টাইনের বাড়িতে ইয়েস সেদিন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে সভার আয়ােজন করলেন। গীতাঞ্জলি শােনাবার জন্য। সে যে কি সংকোচবােধ করেছিলাম বলতে পারিনে। বারবার বলেছি কাজটা ভাল হবে না। ইয়েল্স শুনলে না কিছুতে। অদম্য সে, আয়ােজন করল। বড় বড় সব লােকেরা এলেন, হল ‘গীতাঞ্জলি’ পড়া। কারও মুখে একটি কথা নেই—চুপ করে শুনে, চুপচাপ সব বিদায় নিয়ে চলে গেল—না কোন সমালােচনা, না প্রশংসা, না উৎসাহসূচক একটি কথা। লজ্জায় সংকোচে আমার তাে মনে হতে লাগল ধরণী দ্বিধা হও। কেন ইয়েল্স-এর পাল্লায় পড়ে করতে গেলুম একাজ। আমার আবার এইসব মনে হয় আর অনুতাপ অনুশােচনায় মাথা তুলতে পারি না। তার পরদিন থেকে আসতে লাগল চিঠি, উচ্ছ্বসিত চিঠি, চিঠির স্রোত, প্রত্যেকের কাছ থেকে চিঠি এল একেবারে অপ্রত্যাশিত রকমের। তখন বুঝলুম সেদিন ওরা এত ‘মুভড’ হয়েছিল যে কিছু প্রকাশ করতে পারেনি। ইংরেজরা সাধারণত একটু চাপা, তাদের পথে তখনই কিছু বলা সম্ভব। ছিল না। যখন চিঠিগুলি আসতে লাগল কি যে আশ্চর্য হয়েছিলুম এত আমি প্রত্যাশাও করিনি, কল্পনাও করিনি। বন্ধু ইয়েট্রক্স খুব খুশি হয়েছিল।”
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন সেই সন্ধ্যার কথা, “রােটেনস্টাইনের বাড়িতে এক আসরে য়ে তার ভাবগম্ভীর কণ্ঠে গীতাঞ্জলি-অনুবাদের কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করে শােনালেন। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন আর্নেস্ট রীস, অ্যালিস মেনেল, হেনরি নেভিন, এজরা পাউন্ড, মে সিনক্লেয়ার, চার্লস ট্রেভেলিয়ান, সি.এফ. অ্যান্ড্রুজ ও আরাে অনেকে। আবৃত্তি শেষ হল, সভাস্থ সকলে কবিতা সম্বন্ধে একটি কথাও না বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। পরের দিন উচ্ছ্বসিত প্রশংসার চিঠি আসতে লাগল তাদের কাছ থেকে।”১
সেই প্রশংসার চিঠির’ ধরণ কেমন ছিল—তারও নমুনা দিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ। তখনকার দিনের জনপ্রিয় ব্রিটিশ মহিলা কবি কথাসাহিত্যিক মে সিনক্লেয়ার (১৮৬৩-১৯৪৬) রবীন্দ্রনাথকে যে চিঠি লিখেছিলেন তার বয়ান ছিল এরকম “কাল রাতে আপনার কবিতার বিষয়ে কোনাে কথা বলি মনের তেমন অবস্থা ছিল না। এ কবিতা এমন পর্যায়ের যে, এর সম্বন্ধে প্রথাগতভাবে দু-চার কথা বলা অসম্ভব। আজ আমি কেবল এইটুকুই বলতে পারি, আবার যদি এ কবিতা নাও শুনি তবু এর রেশ আজীবন আমার মনে বাজতে থাকবে। নিছক কবিতা হিসেবে বিশুদ্ধ এবং সর্বাঙ্গসুন্দর বলেই নয়, এই কবিতায় এমন এক ঐশী স্পর্শ আছে যা আমি কদাচিৎ হঠাৎ-আলাের ঝলকের মতাে, নিতান্ত ক্ষণিকের জন্য, মনে মনে অনুভব করেছি। জানি না আর একজনের চোখ দিয়ে দেখা যায় কিনা, তা সম্ভব নয় বলেই মনে হয়, তবে এ কথা নিশ্চিত যে, আর একজনের প্রত্যয় দিয়ে নিজের প্রত্যয়কে দৃঢ় করে নেওয়া সম্ভব। …তৃপ্তি, পূর্ণ তৃপ্তি, আমি পেয়েছি কাল রাত্রে আপনার রচনায়। ইংরেজি ভাষায়, বা পাশ্চাত্য দেশের অন্য কোনাে ভাষায়, যেসব কথা লিখিত হতে পারে বলে ভরসাও করিনি, স্বচ্ছ ইংরেজিতে আপনি তা প্রকাশ করেছেন।”২
কবি ইয়েটস-এর সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারের খবর জানিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমােহন সেনকে চিঠিতে লিখেছেন,
“কাল রাত্রে এখানকার কবি ইয়েল্স-এর সঙ্গে একত্রে আহার করেছি। তিনি আমার কবিতার কতকগুলি গদ্য তর্জমা কাল পড়লেন। খুব সুন্দর করে সুর করে তিনি পড়লেন। আমার নিজের ইংরেজির উপর আমার কিছুমাত্র ভরসা ছিল না—তিনি বললেন যদি কেউ বলে এ লেখাকে কেউ আরাে ইমপ্রুভ করতে পারে সে সাহিত্যের কিছুই জানে না।..আমার এই গদ্য তর্জমাগুলাে ইয়েটস নিজে এডিট করে একটা ইনট্রোডাকশান লিখে ছাপাবার ব্যবস্থা করবেন।”৩
ব্যক্তিগতভাবে কবির সঙ্গে অনেকে পরিচিত হলেও ইয়েটস প্রমুখ সাহিত্যিক বন্ধুরা উৎসুক হলেন কবিকে ব্যাপকভাবে ইংল্যাণ্ডের চিন্তাশীল সমাজের সঙ্গে পরিচিত করতে। এ সময় দু’এক স্থানে কবিকে সংবর্ধনা জানাতে দেখা যায়। ‘ইউনিয়ন অফ দ্য ইস্ট অ্যাণ্ড ওয়েস্ট’ ক্লাবে কবিকে সংবর্ধনার জন্য নিমন্ত্রণের ব্যবস্থা হয়। দিন দুই পরে সকলের চেষ্টায় লণ্ডনস্থিত ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সােসাইটি’ও (যাতে যুবক সুকুমার রায় অন্যতম সদস্য ছিলেন) রবীন্দ্রনাথকে এক সান্ধ্য ভােজে সংবর্ধিত করে। সে সংবর্ধনা সভা হয় ‘ট্রোকাডেরাে রেস্টুরেন্ট’-এ, তারিখ ছিল ১০ জুলাই ১৯১২। এটাই ছিল লণ্ডনে রবীন্দ্রনাথের বড় ধরণের আনুষ্ঠানিক পরিচিতি। ‘ট্রোকাডেরাে রেস্টুরেন্ট’-এ সান্ধ্য সভায় ইংল্যাণ্ডের প্রায় ৭০ জন বড় বড় সাহিত্যিক ও সুধী উপস্থিত ছিলেন। বিখ্যাত সােসালিস্ট ঔপন্যাসিক এইচ. জি. ওয়েলস, হ্যাভেল, উদীয়মান কবি রলেসটন, নেভিনসন, ম্যাসফিল্ড, রথেনস্টাইন প্রমুখ সবাই উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় সভাপতি ছিলেন আইরিশ কবি ইয়ে। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর রচিত ‘গীতাঞ্জলি’ সম্পর্কে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তারই পরিবর্ধিত রূপ পাওয়া যাবে ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ -র ভূমিকায়।
এই সভায় ইয়েটস কবি অনূদিত কয়েকটি কবিতার ইংরেজি গদ্যানুবাদ পাঠ করেন। তার মধ্যে একটি কবিতা ‘নৈবেদ্যে’র। ‘জীবনের সিংহদ্বারে পশিনু যে ক্ষণে’ এবং ‘মৃত্যুও অজ্ঞাত মাের’—মৃত্যুর উপরে লিখিত এই দুটি কবিতাকে ভেঙে ইংরেজি অনুবাদ একটি করে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়টি গীতাঞ্জলির একটি গান— “শ্রাবণ ঘন গহন মােহে গােপন তব চরণ ফেলে।” কৃষ্ণ দত্ত এবং অ্যান্ড্রু রবিনসন লিখিত ‘রবীন্দ্রনাথ টেগাের দ্য মিরিয়াড-মাইনডেড ম্যান’ গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫) এসব ঘটনার সবিস্তার বিবরণ রয়েছে। ‘গীতাঞ্জলি’ -র ভূমিকায় যেমন তিনি বলেছিলেন, তেমনি সেদিনও তার বক্তৃতায় ইয়েটস বলেছিলেন,
“I know no man in my time who has done anything in the English language to equal these lyrics, even as I read them in these literal prose translations, they are as exquisite in style as in thought.”
তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে আরও বলেছিলেন,
“It had, he said, besides, a feeling of natural beauty which linked it with the poets of the Revolution period in English literature,-with Keats and Shelley and Wordsworth. At the same time it was singularly and wholly original. It dealt with elemental thoughts of life and death, of home and children, and of the love of God.”
ইয়েটস-এর সেই উচ্ছ্বাস অব্যাহত আছে ‘সং অফারিংস’-এর ভূমিকাতেও,
“I have carried the manuscript of these translations about with me for days, reading it in railway trains, or on the top of omnibuses and in restaurants, and I have often had to close it best some stranger would see how much it moved me. These lyrics,which are in the original, my Indians tell me, full of subtlety of rhythm, of untranslatable delicacies of colour, of metrical invention, display in their thought a world I have deramed of all my life long. The work of a supremeculture, they yet appear as much the growth of the common soil as the grass and the rushes. A tradition, when poetry and religion are the same thing, has passed through the centuries, gathering from learned and unlearned metaphor and emotion, and carried dack again to the multitude the thought of the scholar and of the noble.”৪
এই সংবর্ধনার প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে যে ভাষণ দেন তার বাংলা রূপ ছাপা হয় ‘প্রবাসী’তে। তার অংশ বিশেষ। “আজ এই সন্ধ্যায় আপনারা আমাকে যে সম্মানে সম্মানিত করিলেন, আমার ভয় হয়, যে ভাষার মধ্যে আমি জন্মগ্রহণ করি নাই সে ভাষায় আপনাদিগকে ধন্যবাদ জানাইবার যথেষ্ট ক্ষমতা আমার নাই।…সেইজন্য আমি কেবলমাত্র আপনাদিগকে এইটুকু স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারি যে এ দেশে আসা অবধি যে নিরবচ্ছিন্ন প্রীতি দ্বারা আপনারা আমাকে গ্রহণ করিয়াছেন তাহা আমাকে এত মুগ্ধ করিয়াছে যে, আমি প্রকাশ করিয়া বলিতে পারি না। আমি একটি শিক্ষা লাভ করিয়াছি এবং সহস্র মাইল পথ সেই শিক্ষা। লাভের জন্য আমার আসা সার্থক—সে যদিও আমাদের ভাষা, আমাদের আচার-ব্যবহার সমস্ত পৃথক তথাপি ভিতরে ভিতরে আমাদের হৃদয় এক। নীল নদীর তীরে যে বর্ষার মেঘ উৎপন্ন হয়, সে যেমন সুদূর গঙ্গার উপত্যকাকে শস্য শ্যামল করিয়া দেয়, তেমনি পূর্বাকাশের সূর্যালােকের অনিমেষ দৃষ্টির নিম্নে যে আইডিয়া আকার প্রাপ্ত হইয়াছে তাহাকে হয়তাে সমুদ্রপার হইয়া পশ্চিমে আসিতে হইবে—সেখানকার মনুষ্য হৃদয়ের মধ্যে তাহার সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণ করিবার জন্য। প্রাচী প্রাচীই এবং প্রতীচীই প্রতীচী সন্দেহ নাই। এবং ঈশ্বর না কন যে ইহার অন্যথা হয়—তথাপি এই উভয়ই মিলিতে পারে। না—সখ্যে, শান্তিতে এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ পরিচয়ে ইহারা একদিন মিলিবেই। ইহাদের ভিতরে প্রভেদ আছে বলিয়াই ইহাদের মিলন আরাে সফল মিলন হইবে—কারণ সত্যকারের প্রভেদ কখনােই বিলুপ্ত হইবার নয়—তাহা ইহাদের উভয়কে বি মানবের সাধারণ বেদিকার সম্মুখে এক পবিত্র বিবাহ বন্ধনে মিলিত করিবার দিকেই লইয়া চলিবে।”৫
এই ভাষণে প্রাক্-নােবেল পর্বের রবীন্দ্রনাথের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মনীষার মিলন প্রত্যাশী মনােভাব খুব স্পষ্ট। সেদিন ইংল্যাণ্ডের অনেক সুধী স্বীকার করেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও চিন্তাশীল ব্যক্তি, এ বিষয়ে তার তুল্য দ্বিতীয় ব্যক্তি জগতের কোন দেশে নেই। ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান লিখল,
“রবীন্দ্রনাথের আগমনে এদেশে যে সম্মান ও সন্ত্রম-প্রশংসা ও কৌতুহল উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে এবং রসিকসমাজে যে সাড়া পড়েছে এমনটি এ যুগের লােকের জীবদ্দশায় কখনও কোন প্রাচ্য অতিথির জন্য হতে দেখা যায়নি।”
এরপর কবির কাছে ভক্তির অর্ঘ্য বহন করে বহু পত্র এসেছে। তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কুমারী র্যাডফোর্ডের পত্র। তিনি লিখেছেন, “আমার মনে পড়ে না যে গত রাত্রে যেমন অনুভব করেছিলাম জীবনে আর কোনদিন সেরূপ অনুভব করেছি কিনা।” ‘গীতাঞ্জলি’ -র ইংরেজি সংস্করণ ১৯১২-র অক্টোবরের মাঝামাঝি প্রকাশ পাবে ভেবেছিলেন কবি। কিন্তু দেরী হবে জেনে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা বেরিয়ে পড়েন। এর মধ্যে সম্ভবত ১ নভেম্বর ১৯১২ তারিখে ৮০ পৃষ্ঠা যুক্ত ‘গীতাঞ্জলি’ -র ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সােসাইটি সংস্করণ (ইংল্যাণ্ডে) প্রথম প্রকাশিত হয়।
(২)
‘গীতাঞ্জলি’ -র অসাধারণ সুর ও স্বরে মত্ত হয়ে সাহিত্য সমালােচক স্বতােৎসারিত মনের আবেগ প্রকাশ করলেন নানাভাবে,
১. গীতাঞ্জলি’ -র প্রথম সমালােচনা ছাপে ‘The Times৬ লেখাটির নাম ছিল ‘Mr. Tagore’s Poem’-
“ইংরেজি কাব্যে এমনকি পৃথিবীর কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির প্রবেশ একটি বিশেষ ঘটনা। আন্তরিক গভীর বিশ্বাসের সহিতই আমি এই কথা বলিতেছি যে রবীন্দ্রনাথের লণ্ডনে আগমনহেতু পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে সখ্য নিকটতর হইয়া আসিল।”
২. সাহিত্য রসিক অ্যাণ্ডুজ সাহেব থাকতে না পেরে বলে উঠেছিলেন—“জ্যোতিষীর দৃষ্টিতে অপরিচিত নতুন জ্যোতিষ্ক ধরা দিলে সে যেমন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, কোনাে কথা মুখে সরে না, তেমনই বিস্ময় আমার হয়েছিল ‘গীতাঞ্জলি’ -র পাঠ শুনে।”
৩. ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত ‘নেশান’ পত্রিকায় ‘গীতাঞ্জলি’ -র সমালােচনা লেখেন ইভলিন আণ্ডারহিল। সমালােচনা প্রকাশের পর তিনি রােথেনস্টাইনকে যা লিখেছিলেন, সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—I am delighted that my review of Mr. Tagore’s poems did not displease you and that you even think he may like it. Myself, I felt it to be horribly in adequate although I tried my best…he is too big to sentimentalize over.’
৪. স্টপফোর্ড ব্রুক ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে অভিভূত হয়ে লিখেছিলেন— Thave read them with more than admiration with gratitude for their spiritual help and for the joy they bring and confirm and for the love of beauty which they deepen and for more than I cannot tell. I wish I were worth of them.’
৫. হ্যারল্ড হারনে উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন— “..আমি গীতাঞ্জলি পড়েছি। গভীর আবেগ ও সুউচ্চ প্রেরণা হৃদয়কে আশ্চর্য উদ্দীপনায় পবিত্র করে তােলে। গীতিকবিতায় এমন উচ্চতর সুর আর কখনাে শােনা যায়নি।” নিছক কবিরূপে বা ‘বিশ্বের বিবদমান জাতি, সংস্কৃতি, আদর্শের সমন্বয় প্রতীক’ রূপে রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃত হননি। ‘গীতাঞ্জলি’তে পশ্চিমের বিদগ্ধজন শুনেছিলেন মিস্টিক কাব্যের দূরাগত স্মৃতির পুনরুচ্চারণ। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন, ‘গীতাঞ্জলি’ -র বা রবীন্দ্র রচনায় ইংরেজি অনুবাদ শুনে বা পড়ে এগুলির কাব্যিক সৌন্দর্যের যত না আলােচনা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি আলােচনা হয়েছিল এগুলির দর্শন নিয়ে। যদিও তখনকার ‘অ্যানালিটিক্যাল ফিলােজফি’র যুগের দর্শন আর গীতাঞ্জলির দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন। শংকর, রামানুজ, কান্ট এবং হেগেল যে অর্থে দার্শনিক ঠিক সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথকে দার্শনিক বলা যায় না। তবে উপনিষদের ঋষি যে অর্থে দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ সেই অথে দার্শনিক। এদিক থেকে গীতাঞ্জলি’র কবি বৈদান্তিক কবি, ঔপনিষদিক কবি নন।
তবে রবীন্দ্রনাথের মিস্টিসিজমের গভীর প্রশান্তি ও লিরিসিজমের নান্দনিক অভিনবত্ব (যার পেছনে শুধু এলিজাবেথীয় গদ্যের সুর নয়, উপনিষদের মন্ত্র ও কালিদাসের কাব্যের সুরও শােনা যায়) পশ্চিম শেষ পর্যন্ত নেয়নি। কবিকে তারা ঋষি, দ্রষ্টা, প্রবত্তা ইত্যাদি বিশ্লেষণে ভূষিত করে ছেড়ে দিয়েছিল। তার বিশ্ববােধও গুরুত্ব পায়নি, পশ্চিম ও পূর্বের উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের কাছে পরাস্ত হয়েছিল। শুধু কাইজারলিং সােয়াইটসার, রোম্যা রোলার মত কিছু শ্রেষ্ঠ মানব এবং আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাের মত শ্রেষ্ঠ মানবী শ্রদ্ধা দ্বারা, ভালবাসার দ্বারা তাকে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। ওকাম্পাের ভাষায়,
levante… not only stands for the East but is like a bridge in the making between East and West.
একথা ভুললে চলবে না যে, পাশ্চাত্য কবিদের উদ্যোগেই রবীন্দ্রনাথের জগৎ জোড়া যশগাথার সূত্রপাত ঘটে। উল্লেখ্য যে, বন্ধুকবি ‘ইয়েন্স ও রথেনস্টাইনের উদ্যোগে সং অফারিংস’ প্রাথমিক পর্যায়ে প্রধানত ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সােসাইটির সদস্যদের মধ্যে বিতরিত হবার জন্যই প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ১৯১৩ সালের মার্চে ম্যাকমিলান কোম্পানি বইটি প্রকাশ ও প্রচারের ভার গ্রহণ করে।
(৩)
বলাবাহুল্য, ইংরেজি গীতাঞ্জলি’তে কোন বাংলা গ্রন্থ থেকে ক’টি কবিতা অনুদিত হয়েছে তার একটা তালিকা এখানে দেওয়া যেতে পারে গীতাঞ্জলি-৫৩, গীতিমাল্য-১৭, নৈবেদ্য-১৬, খেয়া-১১, শিশু-০৩। এছাড়া একটি করে কবিতা নেওয়া হয়েছে। ‘অচলায়তন’, ‘কল্পনা’, ‘চৈতালী’ ও ‘উৎসর্গ’, ‘স্মরণ’ গ্রন্থ থেকে মােট ১০৫। রচনাকালগত দিক থেকে এই ১০টি গ্রন্থ বিভিন্ন সময়কালের সৃষ্টি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দুটি বই শারীরিকভাবে আলাদা। কতগুলাে মামুলি তুলনার প্রসঙ্গ এনে জানানাে যায় প্রথমটির ভাষা বাংলা, দ্বিতীয়টির ইংরেজি। প্রথমটিতে ছন্দমিলযুক্ত কবিতা, দ্বিতীয়টিতে গদ্যছন্দের একমাত্রিক প্রয়ােগ। প্রথমটিতে ১৫৭ টি কবিতা, যার মাত্র ৫৩টির অনুবাদ দ্বিতীয়টিতে আছে। দ্বিতীয়টিতে কবিতা সুরহীন। এ ছাড়া আরও দুটি পরবর্তী রচনা জুড়ে দেন অনুবাদে। ওদুটি ইংল্যান্ডে পৌঁছানাের পর রচিত হয়েছিল। দুই বই আলাদা, তবু দুটি বই এক। এর কারণ শুধু গণিতের হিসাব নয়, অর্থাৎ বাংলা গীতাঞ্জলির মােট ৫৩ টি গান ইংরেজিতে স্থান পেয়েছে বলে নয়। দুটিরই মূল কথা এক অধ্যাত্ম কিংবা মৃত্যু বিষয়ক ভাবনা নিয়েই ঈশ্বরের প্রতি যে আত্মসমর্পণ সেই সুরটি প্রধান হয়ে উঠেছে। কে রবীন্দ্রনাথের এই ঈশ্বর। এ নিয়ে অনেক পাণ্ডিত্য ও ভাবুকতাপূর্ণ গবেষণা হয়েছে, আমরা আর সে পথে অগ্রসর হব না।
বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন,
“এ আমার জীবনের ভিতরের জিনিষ, এ আমার সত্যিকার আত্ম নিবেদনের মধ্যে আমার জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ সমস্ত সাধনা বিগলিত হয়ে আপনি আকার ধারণ করেছে।”
গীতাঞ্জলির মর্মবাণী উপলব্ধি করতে হলে কবির জীবনের এই সময়ের শােকাবহ ঘটনা স্মরণ করলে বিশেষভাবে রবীন্দ্র অনুভূতি পরিস্ফুট হবে। ১৮১৯ সালে আদরের ভাই বলেন্দ্রনাথ, ১৯০২ সালে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুতে শােকাহত কবি গভীর বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন। এই শােকাবহ ঘটনার দশ মাসের মধ্যে প্রিয় কন্যা রেণুকা যক্ষ্মা রােগে আত্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, এই বছরেই শান্তিনিকেতনের শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায় পরলােকগমন করেন। ১৯০৭ সালে আদরের কন্যা রেণুকার মৃত্যুর পর। আরাে একটি ভয়ঙ্কর আঘাত এল কবির জীবনে, পুত্র শমীন্দ্রনাথের অকাল বিয়ােগ। যমরাজ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু কী? জবাবে ধর্মপুত্র বলেছিলেন পিতার স্কন্ধেপুত্রের মৃতদেহ। এই বিষম ভার বহন করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। প্রকৃতপক্ষে ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০৭ সাল ব্যাপী একের পর এক মৃত্যুর মিছিল রবীন্দ্রনাথকে করেছে আত্মসমাহিত ও ধ্যানমগ্ন।
অবশ্য ‘গীতাঞ্জলি’ -র অন্তর্ভুক্ত গানগুলির মধ্যে বেশকিছু অন্য স্বাদের রচনাও আছে—কেবলই আধ্যাত্মিক নয়। যেমন—“হে মাের চিত্ত’, ‘হে মাের দুর্ভাগা দেশ দেশাত্মবােধক প্রাকৃতিক—‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ’, ‘আমার নয়ন ভুলানাে এলে’, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’, ‘আজ বারি ঝরে ঝরঝর’, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’, ‘শরতে আজ কোন অতিথি’ ইত্যাদি। আরও লক্ষণীয়, বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ তে উৎসর্গপত্র নেই।
বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’র আত্মপ্রকাশ হয় ১৩১৭-র ভাদ্র মাসে। ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস ছিল প্রকাশনার দায়িত্বে। দুশাে পাতার বই। মূল্য ছিল এক টাকা। ছাপা হয়েছিল এক হাজার কপি। ‘গীতাঞ্জলি’র প্রথম কুড়িটি গান ১৯০৮ সালে শারদোৎসবে ছাপা হয়েছিল। ‘গীতাঞ্জলি’তে যা প্রকাশিত হয়েছে তার সবগুলাে গান নয়। মাত্র ছাপান্নটিতে সুর দেওয়া হয়েছিল। শারদোৎসবে প্রকাশিত কুড়িটি গান বাদ দিলেও ১৩৭ টি গানের মধ্যে ছিয়ানব্বইটি গান শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। শিলাইদহে অবস্থান কালে ষােলােটি রচনা করেছিলেন। কলকাতায় বসে তেরােটি এবং তিনধরিয়ায় অবস্থান কালে বারােটি। বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা লিখেছিলেন তাতে উল্লেখিত হয়েছে— “এই গানের প্রথম কয়েকটি গান পূর্বে অন্য দুএকটি পুস্তকে প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে যে সমস্ত গান পরে পরে রচিত হইয়াছে তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটা ভাবের ঐক্য থাকা সম্ভবপর মনে করিয়া তাদের সকলগুলিই এই পুস্তকে একত্রে বাহির করা হইল।”৭ বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ গানের বই হিসাবে পরিচিত। প্রথম আত্মপ্রকাশকালে গীতাঞ্জলি’র গানের শিরােনাম মনে রাখার মতাে। যেমন—প্রার্থনা, আষাঢ়-সন্ধ্যা, দিনান্তে, বিশ্ব যখন নিদ্রাগমন, আজি ঝড়ের রাতে, তােমার অভিসার, আমার মাথা নত করে দাও, আর নাইরে বেলা নামলাে ছায়া, হে মাের চিত্ত, পরিসমাপ্তি প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘গীতাঞ্জলি’ প্রথমে তেমন সমাদৃত হয়নি। বহু সাহিত্য সমালােচক ‘গীতাঞ্জলি’র খুঁত ধরার জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠেছিলেন। যেমন ‘গীতাঞ্জলি’তে প্রকাশিত ‘আজি শ্রাবণ ঘন গহন মােহে’, গােপন তব চরণ ফেলে/নিশার মতাে নীরব ওহে’, ‘সবার চিঠি এড়ায়ে চলে’—প্রভৃতি গানগুলাের সমালােচনা করে বলা হয়েছিল,
“শ্রাবণের ঘন গহনে পরিণত হইল, তাহাও বুঝিলাম। কিন্তু চরণ কেমন করিয়া গােপন হইল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। সাপের চরণ গােপন বটে। কিন্তু এ গােপন চরণ কাহার?”
এরকম সমালােচনা আরও আছে। এই সমালােচনায় যদিও কবি দুঃখ পেয়েছিলেন, তবুও ‘গীতাঞ্জলি’র জনপ্রিয়তা ক্রমে ক্রমে ব্যাপক হয়েছিল। কবিও সুযােগ পেয়ে গিয়েছিলেন সমালােচকদের উত্তর দেওয়ার। তিনি এক পত্রে লিখলেন—
“বস্তুত এই গানগুলাের মধ্যে আমার জীবনের বিকাশ হইতেছে। এই গানগুলি আমার জীবনের পাথেয়—এগুলি আর কেহ যদি গ্রহণ না করেন, তথাপি ইহা আমার কাজে লাগিতেছে, সেই আমার লাভ।”
একটু আগেই বলা হয়েছে বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’র মােট গানের সংখ্যা ১৫৭টি। প্রথম সংস্করণে ১টি গান—“যাবার দিন এই কথাটি’ ছিল না, পরবর্তীকালে (১৩৩৪ বঙ্গাব্দে) এই গানটি সংযুক্ত হয়। অন্যদিকে এই গ্রন্থের ‘বাঁচান বাঁচি মারেন মরি’ গানটি একবার মাত্র ছাপানাের পরে বাতিল করা হয়েছে। ‘গীতাঞ্জলি’র প্রথম গান ‘আমার মাথা নত করে এবং শেষেরটি দিবস যদি সাঙ্গ হল’—এই ক্রমটিও ‘সং অফারিংস’-এ রক্ষিত হয়নি। সেখানে প্রথম কবিতা— Thou hast made me endless’ (‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’ গীতিমাল্য’ ২৩ সংখ্যক কবিতা) এবং শেষ কবিতাটি হল— ‘In one salutation to thee’ (একটি নমস্কারে প্রভু’ / গীতাঞ্জলি’ ১৪৮ সংখ্যক গান )।
রবীন্দ্রজীবনে ৫২তম বর্ষে ‘নােবেল পুরস্কারে’র সম্মান এসে পৌঁছল বিশ্বের দরবার থেকে সেবারে রবীন্দ্র জন্মদিনটি প্রতিপালিত হয়েছিল শিলাইদহে অত্যন্ত ঘরােয়াভাবে। কিন্তু এই সময়কার উপলব্ধিটি অন্য কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছিল কবিমন তা শুনেছে। চিঠিতে লিখেছেন—“…আমার এই ৫২ বৎসরের জন্মদিনের উৎসব খুব একটা ঝড়-জলের মধ্যে সমাধা হয়ে গেছে। মনে মনে তাই আশা করছি এই ঝড়ে আমার জীবনে আরেকটা পর্যায় বুঝি সূচনা করে দিচ্ছে—পুরাতনের সমস্ত জীর্ণ পাতা উড়িয়ে দিয়ে জীবনের শেষ ফল ফলাবার জন্যে এবার বুঝি একবার নূতন সবুজে সাজতে হবে।”৮ আরও একটি চিঠিতে আছে এমনই অন্তরঙ্গ অনুভূতির কথা—
“…আমার জন্মদিনের অপরাহে বাতাস বইতে মেঘ জমতে জমতে অবশেষে প্রচুর বর্ষণ হয়ে দিন শেষ হল। আমার মনে হল সমস্ত দিন অপো করে আমি তার কাছ থেকে এই জন্মদিনের আশীর্বাদপত্র পেলুম—সংবাদ এল শুষ্কতা এবং ব্যর্থতার মধ্যে দিন অবসান হবে না—সন্ধ্যা আসবার আগেই বর্ষণ হয়ে যাবে—কেবলি বার বার ওই মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে না।”৯
সত্যের মুখােমুখি হবার জন্য যে পূর্ণতার সাধনা রবীন্দ্রনাথের একান্ত অভীপা ছিল, তারই প্রতিফলন ঘটেছে ‘সং অফারিংস’এ ‘আমির’ সঙ্গে ‘তুমির’ খেলায়—ধরা দেওয়া, ধরা পড়া, ধরতে চাওয়া, কিংবা ধরতে না-পারা নিয়েই ১০৩টি কবিতা পুনরায় রচিত বা অনূদিত হয়েছে। সীমার মাঝে অসীমের প্রতিরূপ দেখাই নয়, সমগ্র কাব্যগ্রন্থখানি স্বগতােক্তিতে ভরা। ক্রোধ, রােষ, সন্দেহ, বিদ্রোহ বা নঙর্থক ভাবনা নয়—রবীন্দ্রনাথ জীবনশিল্পী, তিনি সবকিছুকে নিবিড় করে গ্রহণ করেন, তাঁর মুক্ত চিন্তা—উদার চিত্ত। আত্মসমর্পণ—কিন্তু কখনও আত্মবিসর্জন নয়। ‘আমি’ও আছে, লুপ্ত হয়নি কখনও আমার মধ্যে তােমার প্রকাশ তাই এত মধুর।
বইটি প্রকাশের কয়েক দিন পরে ৬ নভেম্বর ১৯১২ রথেনস্টাইন লেখেন রবীন্দ্রনাথকে— The book is out, and looks very pure & virginal in its covering of white and gold. Directly reviews appear I shall go to see Macmillan.’ এবং এই ঐতিহাসিক ঘটনার পরে পরে রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার পরিচিতি ঘটতে থাকে ইউরােপ ও আমেরিকায়। এই প্রশংসা রবীন্দ্রনাথের নিজের কাছেও ছিল অভাবিত। ১৯১৩-র ৬ মে লণ্ডন থেকে ইন্দিরা দেবীকে কবি লিখেছেন,
“গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমা যে কেমন করে লিখলুম এবং কেমন করে লােকের এত ভালাে লেগে গেল, সে কথা আমি আজ পর্যন্ত ভেবেই পেলুম না। আমি যে ইংরেজি লিখতে পারি না সে কথাটা এমনি সাদা যে, এ সম্বন্ধে লজ্জা করবার মতাে অভিমানটুকুও আমার কোনােদিন ছিল না।…রথেনস্টাইন…যখন কথাপ্রসঙ্গে আমার কবিতার নমুনা পড়বার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, আমি কুণ্ঠিত মনে তার হাতে আমার খাতাটি সমর্পণ করলুম। তিনি যে অভিমত প্রকাশ করলেন সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারলুম না। তখন তিনি কবি ইয়েল্স-এর কাছে আমার খাতা পাঠিয়ে দিলেন।”১০
এই খাতা সম্পর্কে বিশ্ববাসী কিছুই হয়তাে জানতে পারতাে না, কেননা পাণ্ডুলিপি নিয়ে রথীন্দ্রনাথ যখন কবির সঙ্গে স্টেশন থেকে পাতাল রেল ধরে ব্লুমসূবেরি হােটেলে আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছিলেন সেই সময় অ্যাটাচি কেসটি রথীন্দ্রনাথ পাতাল রেলেই ভুলে ছেড়ে আসেন। রথীন্দ্রনাথ লিখছেন,
“পরের দিন বাবা যখন রােটেনস্টাইনের বাড়ী যাবেন, অ্যাটাচির খোঁজ পড়ল আর তখনই বােঝা গেল সেটি টিউবে ফেলে আসা হয়েছে। আমার অবস্থা অনুমেয়, শুকনাে মুখে আমি চলে গেলাম টিউব রেলের লস্ট প্রপার্টি অফিসে। সেখানে যেতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হারানাে ধন ফেরৎ পাবার পর আমার প্রাণে যে কী গভীর স্বস্তি হয়েছিল— সে আমি কখনাে ভুলবাে না।”১১
এই পাণ্ডুলিপির মুদ্রিত রূপ কিভাবে বিশ্বজোড়া খ্যাতির মুখােমুখি করে দিল কবির নােবেল প্রাপ্তির সুবাদে তা সকলের জানা।
কবির নােবেল প্রাপ্তির ইতিহাস বিশদে উল্লেখ করেছেন রবি জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায় ও প্রশান্ত পাল। রবীন্দ্রনাথ নিজে গিয়ে নােবেল কমিটির কাছে বই জমা দেবেন, তা তাে হবে না। সুপারিশ করতে হবে কোনও স্বীকৃত সাহিত্য সংগঠনকে— যারা কাব্যগুণ বিচার করে বলবে, এই কবিকে নােবেল দেওয়া হােক। ভারতে তখন সাহিত্য সংগঠন থাকলেও তাদের কোনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল না। আর অন্য একটা পথও ছিল—কোনও নােবেল লরিয়েট যদি সুপারিশ করতেন। তাও হওয়ার নয়। তারা কেন রবীন্দ্রনাথের কথা ভাবতে যাবেন। লণ্ডনে, নাম সুপারিশের অধিকার ছিল ‘রয়্যাল সােসাইটি অফ লিটারেচার অফ দ্য ইউনাইটেড কিংডম’-এর। তার অন্যতম সদস্য স্টার্জ মুর অবশেষে রবীন্দ্রনাথের নাম সুপারিশে রাজি হন। রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করলেও তেমন কোনও প্রশংসাবাক্য উচ্চারিত হল না। দু’লাইনের চিঠিতে বলা হল, রবীন্দ্রনাথকে নােবেল পুরস্কার দেওয়া হােক। বিশ্বে এত কবি সাহিত্যিক থাকতে রবীন্দ্রনাথকে কেন দেওয়া হবে, সেটা তাে বলতে হবে? পরে দেখা গেল রয়্যাল সােসাইটির অধিকাংশ সদস্যই রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে। তাদের ৯৭ সদস্য সুপারিশ করলেন টমাস হার্ডির নাম। ইউরােপীয় সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। যেখানে যা বেরােত সংগ্রহ করে পড়তেন। লেখক-কবিদের সঙ্গে পত্রালাপও চলত। সেই বন্ধুত্ব কাজে লাগল না। সবাই যে প্রতিযােগী! নিশানায় নােবেল পদক। সবার স্বপক্ষে লম্বা লম্বা প্রশস্তি। প্রশংসার স্রোতে তারা উচ্ছ্বসিত। অকুল দরিয়ায় একা ভাসছেন রবীন্দ্রনাথ। দাবিদার বাড়ছে। স্পেনের বেনিতাে পেরজ গ্রামডস, সুইজারল্যাণ্ডের কেয়ার স্পিটেলার, ইতালির গ্রাজিয়া ডেলেডা, ফ্রান্সের এমিলি ফগেট পুরস্কার প্রতিযােগিতায় নামলেন। ডেনমার্ক, ফিনল্যাণ্ড, সুইডেন, বেলজিয়ামের স্রষ্টারাও পুরস্কারের প্রত্যাশায় সরব হলেন। নােবেল পুরস্কার কাকে দেওয়া হবে তা ঠিক করার দায়িত্ব সুইডিশ একাডেমির ১৮ জন আজীবন সদস্যের। তাঁদের সবাই যে সাহিত্যবােদ্ধা, তা নয়। রাজনীতিক, ইতিহাসবিদ, আইনজীবী, ভাষাতাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদ, স্থপতি, প্রত্নতাত্ত্বিক, দার্শনিক, বিশপ, ধর্মতত্ত্ববিদরাও সদস্য। প্রস্তাবিত বই নিয়ে তারা নাড়াচাড়া শুরু করলেন। এ যেন বড় বড় নয়নাভিরাম ফুলের বাগানে বিচরণ। এত সুন্দরের মধ্যে সেরা বলা যায় কাকে। সুইডিস একাডেমির পক্ষে থেকে এই প্রস্তাবের গ্রহণযােগ্যতা বিচারের দায়িত্ব পড়ে নােবেল কমিটির সদস্য হ্যালস্ট্রম-এর ওপর। ২৯ অক্টোবর ১৯১৩ হ্যালস্ট্রমের রিপাের্ট জমা পড়ে। সে প্রস্তাবে ‘গীতাঞ্জলি’র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার রিপাের্ট ও সমালােচনায় যে রবীন্দ্র পরিচিতি আছে তার উল্লেখ ছিল। ওই বছর ইংল্যাণ্ডের হার্ডি, ফ্রান্সের আনাতােল ফাঁন্স জার্মানির রােসেজার প্রমুখ সাহিত্যিক নােবেল প্রতিদ্বন্দ্বিতার শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন। সুইডিস একাডেমির সভাপতি হ্যারল্ড হারনে অবশ্য পূর্বেই লিখেছিলেন—
“আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের নাম আনন্দ বিস্ময়ের মত দেখা দিল। ঘটনাচক্রে সভাপতি হ্যারল্ড হারনের মৃত্যুর পর হ্যালস্ট্রম-ই নােবেল কমিটির সভাপতি হলেন।
তখন সুইডিস একাডেমিতে এমন একজন সদস্য ছিলেন যিনি বাংলা জানতেন। তিনি বয়স্ক প্রাচ্যবিদ সুইডেনের Esaias Henrik Vilhelm তার সুপারিশও কমিটিকে তেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। কিন্তু বরফ গললাে, যখন সমকালের সুইডেনের শ্রেষ্ঠ কবি Carl Gustaf Verner Von Heidenstam, যিনিও ছিলেন সুইডিস একাডেমির সদস্য, প্রায় রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী (১৮৫৯-১৯৪০) ও সমান পরমায়ুর এই কবি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে প্রস্তাব করলেন। অন্য কোন বইকে তিনি বিবেচনার মধ্যে আনতে রাজি নন। বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯১৩-র পর ১৯১৪ এবং ১৯১৫ নােবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। পরের বছর ১৯১৬-তে Carl Gustaf Verner Von Heidenstam-ই নােবেল পান সাহিত্যে। ‘গীতাঞ্জলি’ তথা ‘সং অফারিংস’ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।
Carl Gustaf Heidenstam ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদে পেলেন এক অসামান্য প্রতিভার সন্ধান। আপ্লুত কবি Heidenstam লিখলেন,
“The intense and living piety that permeats his every thought and feeling, the purity of heart, the noble and natural sublimity of his style, all combine to create a whole that has a deep and rare spiritual beauty.”
তিনি পরিস্কারভাবে আরও জানিয়ে দিলেন, ‘Now that we have finally found an ideal poet of really great stature. We should not pass him over.’ পুরস্কার কমিটির অনেকেই বললেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা যতই ভাল হােক, এখনই তাকে পুরস্কৃত করতে হবে তার কী মানে! আরও দু-চার বছর ফেলে রাখা হােক, তারপর দেখা যাবে। গর্জে উঠলেন Carl Gustaf Heidenstam, বললেন ‘We must not tarry and miss the opportunity by waiting till another year.’ অন্য সদস্যরা থমকালেন। তাঁরা মন দিয়ে ‘সং অফারিংস’ পড়তে লাগলেন। কী এমন রতন সেখানে আছে, খোঁজার চেষ্টা করলেন। এতদিন তারা ধরে নিয়েছিলেন, এমিলে ফগেটকে নােবেল দেওয়াটাই বিবেচনার কাজ হবে। রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে ফগেটের নামটা তাদের মেমরি থেকে উড়ে গেল। যাইহােক, Heidenstam-এর লেখা ও হ্যালস্ট্রমের প্রতিবেদন একাডেমির সদস্যদের প্রভাবিত করল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ভােটাভুটির দিন। ১৯১৩-র ১৩ নভেম্বর ১৩ জন সদস্য ভােট দিতে এলেন। একটি বাদে ১২টি ভােট পেলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্ব জুড়ে ধ্বনিত হল রবীন্দ্রনাথের নাম। হ্যালস্ট্রম লিখেছেন,
“More and more of the academicians began to read Gitanjali and gradually succumbed to the charm of these rhythmic ideas. Then the unexpected happened. The committee’s recommendation on behalf of Emile Faguet was rejected by decision of the academy in pleno. Of the thirteen who voted on November 13, twelve were infavour of Rabindranath Tagore.”
১৯১৩-র ১৩নভেম্বর খবরটি ঘােষিত হয়,
“The Noble Prize forLiterature for 1913 has been awarded to the Indian Poet Rabindranath Tagore.’
কলকাতায় অধুনালুপ্ত ‘এম্পায়ার’ নামে এক সান্ধ্য দৈনিক সংবাদটি ছেপেছিল ওই ১৩ তারিখেই। উল্লেখ্য, সুইডেনের নােবেল ফাউন্ডেশন ১৯০১ সালে নােবেল পুরস্কার প্রবর্তন করার পর এবং রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন এগারজন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দ্বাদশতম এবং ইউরােপের বাইরে প্রথম। তার আগে চারজন জার্মান, তিনজন ফরাসি এবং সুইডেন, নরওয়ে, পােল্যাণ্ড ও ইংল্যাণ্ডের একজন করে এই পুরস্কার লাভ করেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের একজন কবি বাহান্ন বছর ছয় মাস ছয় দিন বয়সে এই পুরস্কার লাভ করায় সারা পৃথিবীতে হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল। পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ছিল আট হাজার পাউণ্ড, তৎকালীন ভারতীয় মুদ্রায় এক লাখ বিশ হাজার টাকা। রবীন্দ্রনাথের নােবেল প্রাপ্তি বিশ্ব সাহিত্যে ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে গেল।
(৪)
নােবেল প্রাইজের সংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই যাঁকে স্মরণে আনলেন তিনি রথেনস্টাইন। কবি তখন তাঁকে লিখেছেন—
“যে মুহূর্তে নােবেল পুরস্কার দানের সংবাদ পেলাম, তৎক্ষণাৎ আমার অন্তর আপনার প্রতি ভালবাসায় ও কৃতজ্ঞতায় স্বতই বাধিত হয়েছিল। আমি জানি আমার বন্ধুদের মধ্যে এই সংবাদে আপনার মত তৃপ্ত আর কেউ হবেন না। যারা আমাদের প্রতি প্রিয় তারা সুখী হবে, এতেই পরম আনন্দ। কিন্তু এই সম্মান আমার পক্ষে বিষম পরীক্ষার বিষয় হয়ে উঠেছে। পাবলিক উত্তেজনার রীতিমত যে ঘূর্ণিবায়ু উঠেছে, তা বিভীষিকাময়। একটি কুকুরের লেজে টিন বেঁধে দিলে, বেচারা নড়লেই যেমন শব্দ হয় এবং চারদিকে লােকের ভিড় জমে আমার দশাও সেরূপ। গত কয়েকদিনের টেলিগ্রামে ও পত্রের চাপে আমার বাস বন্ধ হয়ে আসছে। যেসব লােকের আমার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই, বা যারা আমার রচনার একটি ছন্দও পড়েনি, তারাই তাদের আনন্দ জ্ঞাপনে বেশি মুখর। এইসব উচ্ছ্বাস আমাকে যে কী পরিমাণ ক্লান্ত করছে আমি বলতে পারি না। এই অবাস্তবতার আধিক্য ভয়াবহ। সত্য কথা কি, এরা আমি যে সম্মান লাভ করেছি, সেই সম্মানকে সম্মান দেখাচ্ছে—আমাকে নয়।”
রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র সম্মান ও পুরস্কার ‘নােবেল প্রাইজ’ ঘােষণায় রথেনস্টাইনের যে আনন্দোচ্ছাস হয়েছিল, যেটি বিভারতী রবীন্দ্রসদনে সুখস্মৃতি হয়ে আছে আজও—
‘I open the times and great shout comes from it Rabindranath has won the Noble Prize.’
রথেনস্টাইন ছাড়াও স্টার্জ মুর, আর্নেস্ট রিজ, রবার্ট ব্রিজেস, ইভলিন আন্ডারহিলসহ আরাে অনেক বিদেশি বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে চিঠি বা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এই প্রাইজের সংবাদে সারা পৃথিবী চমকে উঠল। ‘রয়টার’-এর তার যােগে পৃথিবীময় এ সংবাদ রাষ্ট্র হলে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া একত্রে দেখা দিল—একদিকে আনন্দ ও বিস্ময় অপরদিকে বিদ্বেষ বিক্ষোভ—ভাল, মন্দ, নিন্দা, প্রশংসামিশ্রিত নানারূপ মতামত। দ্রে একটা কবিতারই বই তাও আবার অনুবাদ কী করে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার পাবার উপযুক্ত বলে গণ্য হল—তারই গবেষণা শুরু হল সর্বদেশে। সমসাময়িক একখানি কাগজও ছিল না যাতে বাঙালি কবির এই কৃতিত্বের সংবাদটি সমালােচনাসহ প্রকাশিত হয়নি। ইংল্যাণ্ডের খ্যাতনামা সাহিত্যিকগণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নােবেল কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ব্রিটিশ প্রেস বা ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা সম্বন্ধে এতদিন কোন কথাই বলেননি—এটাই ছিল ইউরােপের বিস্ময়ের মূল কারণ। ব্রিটিশ প্রেসের দৌলতে পরাধীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে সমগ্র ইউরােপ ও আমেরিকায় একটি অদ্ভুত মনােভাব বিদ্যমান ছিল—অশিথিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন অসভ্য ভারতবর্ষই তাদের চোখে প্রতিভাত হত। নােবেল পুরস্কার ঘােষণার পর প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রের সুর বদলে গেল। সৃষ্টিকে দূরে রেখে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্রষ্টাকে নিয়ে। তখন কবির সমালােচনায় যাঁরা প্রবৃত্ত হলেন, তারা রাজনৈতিক, সাম্রাজ্যবাদী—ইংরেজ আর্টিস্ট, সাহিত্যিক বা ভাবুক সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নন। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ কারাের কাছে পেয়েছেন প্রশংসা, আবার কারাের কাছে পেয়েছেন কুৎসার কালি। এ যেন কন্টকিত সতেজ গােলাপ, গরল ও অমৃতের সমন্বয়।
আজ এমন একটা নােবেল প্রাপ্তির শতবর্ষের সন্ধিক্ষণে একটা কথা বলা যেতে পারে, কবি তার জীবদ্দশায় বহুবার ইউরােপ ভ্রমণ করেছেন ঠিকই, কিন্তু কবির বিখ্যাতির উৎস কিন্তু সুইডেন। ১৯১৩ সালে নােবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর রচনা বিভিন্ন ইউরােপীয় ভাষায় অনুদিত হয় এবং পরবর্তীকালে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তা বিধের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে। যায়। নােবেল পুরস্কার পাওয়ার সংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছায় ১৪ নভেম্বর বিকেলে। শান্তিনিকেতন থেকে মােটর গাড়িতে চেপে চৌপাহাড়ি শালবনে বেড়াতে যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সাথে পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুরবাড়ির অন্য একজন সদস্য দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পথিমধ্যে টেলিগ্রাম পেলেন কবি—তিনি নােবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তারিখটা ছিল বাংলা ১৩২০ সনের ২৯শে কার্তিক, ১৫ই নভেম্বর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে। বিদ্যালয়, ছাত্র, শিক্ষক ও আশ্রমিকরা এই অসাধারণ সংবাদলাভে আনন্দে বিহ্বল হয়ে ওঠেন। তৎকালীন ছাত্র প্রমথনাথ বিশী স্মৃতিচারণা করছেন ‘লক্ষ্য করিলাম, অজিতবাবুর চলাফেরা প্রায় নৃত্যের তালে পরিণত হইয়াছে…। সন্ধ্যা থেকেই দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টেলিগ্রামের বন্যা বইতে শুরু করেছিল। বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান স্কুলের অধ্যাপক এডওয়ার্ড টমসন সেদিন ভাগ্যচক্রে শান্তিনিকেতনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
‘This rush of success embarassed as much as it cheered.’
নােবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কবির কাজকর্মের পরিধি ও অন্যান্য কাজের চাপ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। একদিকে বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংস্থানের চিন্তা, অন্যদিকে খ্যাতির বিড়ম্বনায় কবি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখা চিঠিটির কথাই ভাবুন। ১ অগ্রহায়ণ ১৩২০ ওই চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ সম্মানের ভূতে আমাকে পাইয়াছে, আমি মনে মনে ওঝা ডাকিতেছি—আপনাদের আনন্দে আমি সম্পূর্ণ যােগ দিতে পারিতেছি না। আপনি হয়ত ভাবিবেন এটা আমার অত্যুক্তি হইল কিন্তু অন্তর্যামী জানেন আমার জীবন কিরূপ ভারাতুর হইয়া উঠিয়াছে। প্রশান্তকুমার পাল বিষয়টি আমাদের নজরে আনলেও অস্বীকারের উপায় নেই, নােবেল প্রাপ্তি গােটা বিধে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করল। এশিয়া মহাদেশ জুড়ে নন্দিত হলেন তিনি। বাড়ল তার বইয়ের বিক্রিও। আবার পুরস্কার প্রাপ্তির ‘অন্তরালের কাহিনি’ জানাতেও কলম ধরলেন কেউ কেউ। কেউ বললেন, টমাস হার্ডি বা আনাতল ফ্রসকে বঞ্চিত করা হল।
জীবননাট্যের নানা যন্ত্রণা সহ্য করার অসীম শক্তির পরীক্ষা যিনি দিয়ে এসেছেন, তিনি নােবেল প্রাইজ প্রতিক্রিয়ার নিন্দা ও ধিক্কারের জ্বালায় আর উদাসীন থাকতে পারেননি। নােবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বােলপুরে তাকে সংবর্ধনা জানানাের উত্তরে তিনি যে বিব্ধে ভাষণ দিলেন তা সমস্ত দেশের বুকে তুমুল আলােড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। ১৯১৩ সালের ২৩ নভেম্বর কলকাতা থেকে একখানি বিশেষ ট্রেনে অগণিত মানুষ বােলপুর শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন কবির নােবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাতে। কিন্তু সেই সভায় কবি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ঐতিহাসিক অধ্যায় হিসাবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছে—
“আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন, তা অসংকোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি, এমন সাধ্য আমার নেই। যারা জনসাধারণের নেতা, যাঁরা কর্মবীর সর্বসাধারণের সম্মান তাদেরই প্রাপ্য এবং জন-পরিচালনার কাজে সেই সম্মানে তাদের প্রয়ােজনও আছে। যারা লক্ষ্মীকে উদ্ধার করবার জন্য বিধাতার মন্থনদণ্ডরূপ হয়ে মন্দার পর্বতের মতাে জনসমুদ্র মন্থন করেন। জনতরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে তাদের ললাটপটকে সম্মান ধারায় অভিষিক্ত করবে, এইটেই সত্য এইটেই স্বাভাবিক।
কিন্তু কবির সে ভাগ্য নয়। মানুষের হৃদয়ক্ষেত্রেই কবির কাজ এবং সেই হৃদয়ের প্রীতিকেই তাঁর কবিত্বের সার্থকতা। কিন্তু এই হৃদয়ের নিয়ম বিচিত্র, সেখানে কোথাও মেঘ কোথাও রৌদ্র। অতএব প্রীতির ফসলই যখন কবির দাবি তখন একথা তার বলা চলবে না যে, নির্বিশেষে সর্বসাধারণেরই প্রীতি তিনি লাভ করবেন। যাঁরা যজ্ঞের হােমাগ্নি জ্বালাবেন তারা সমস্ত গাছটাকেই ইন্ধনরূপে গ্রহণ করতে পারেন, আর মালা গাঁথার ভার যাঁদের উপরে তাদের অধিকার কেবলমাত্র শাখার প্রান্ত ও পল্লবের অন্তরালে থেকে দু’টি-চারটি করে ফুল চয়ন করা।
কবি বিশেষের কাছে কেউ বা আনন্দ পান, কেউ বা উদাসীন থাকেন, কারাে বা তাতে আঘাত লাগে এবং তারা আঘাত পান। আমার কাব্য মনােনীত এই স্বভাবের নিয়মের কোনাে ব্যতিক্রম হয়নি। একথা আমার এবং আপনাদের জানা আছে, দেশের লােকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে, তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয়নি এবং এতােকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। এমন সময় কি জন্য যে বিদেশ হতে আমি সম্মান লাভ করলুম তা এখনাে পর্যন্ত আমি নিজেই ভালাে করে উপলব্ধি করতে পারিনি। আমি সমুদ্রের পূর্বতীরে বসে যাঁকে পূজার অঞ্জলি দিয়েছিলাম তিনিই সমুদ্রের পশ্চিমতীরে সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করবার জন্য সে তার দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করেছিলেন সে কথা আমি জানতুম না। তার সেই প্রসাদ আমি লাভ করেছি—এই আমার সত্য লাভ। যাইহােক, যে কারণেই হােক, আজ য়ুরােপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করলেন তার যদি কোন মূল্য থাকে তবে সে কেবল গুণীজনের রসবােধের মধ্যেই আছে। আমাদের দেশের সংগে তার কোনাে আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। নােবেল প্রাইজের দ্বারা কোনাে রচনার গুণ বা রসবৃষ্টি করতে পারে না…।”
শেষে বলি, রবীন্দ্রনাথের নােবেল পুরস্কারের ৩৪ বছর পর আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পাই। সেই স্বাধীনতার আনন্দে অবশ্য মিশেছিল দেশভাগের বিষাদের ছায়া, সাম্প্রদায়িকতার শ্লেষ, আপােশের বেদনা। কিন্তু এর বহু বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ যে মুক্তি এনে দিয়েছিলেন তা বিশুদ্ধ, সার্বিক ও মৌলিক। মে ১৯১৩ সালের এক অপ্রকাশিত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ইয়েটসকে লিখেছিলেন। যে, জাতীয়তাববােধ তথা গভীর দেশপ্রেম থেকেই তিনি ভারতবর্ষের জন্য চেয়েছিলেন স্বীকৃতি, যে ভারতবর্ষকে পশ্চিম দুনিয়া অপমান করেছে।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতৃস্মৃতি, সংস্করণ ১৩৭৮, কলকাতা, পৃ. ১৫১।
- ২. রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতৃস্মৃতি, সংস্করণ ১৩৭৮, কলকাতা, পৃ. ১৫৩।
- ৩. দেশ, ২০ অগ্রহায়ন ১৩৯৩, পত্র-৩২।
- ৪. Rabindranath Tagore, Gitanjali Song offerings, Macmillian and co.limited, London, 1959
- ৫. ‘প্রবাসী’, ভাদ্র ১৩১৯।
- ৬. “The Times, Literary Supplement”, নভেম্বর ১৯১২।
- ৭. শান্তিনিকেতন, বােলপুর, ৩১ শ্রাবণ, ১৩১৭।
- ৮. জগদানন্দ রায়কে লিখিত রবীন্দ্রপত্র, ২৯শে বৈশাখ, রবিবার ১৩১৯।
- ৯. অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লিখিত রবীন্দ্রপত্র, ২৯শে বৈশাখ ১৩১৯, রবিবার।
- ১০. ১৯১৩-র ৬ মে, লণ্ডন, চিঠিপত্র-৫, ১৪০০, পৃ. ১৯-২০।
- ১১. রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতৃস্মৃতি, সংস্করণ ১৩৭৮, কলকাতা, পৃ. ১৪৯-৫০।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।