পূর্ব বর্ধমানের উত্তর সদর বিভাগের আউসগ্রাম টু ব্লকের অন্তর্গত একটি পুরাতাত্ত্বিক স্থান। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বলা যায়, আউসগ্রামের রামনগর পান্ডুক রসফআল্লাহ পুকুরপাড়ে ‘রাজা পোঁতার ডাঙ্গা’ বা পান্ডু রাজার ঢিবি পশ্চিমবঙ্গে প্রাপ্ত সর্বপ্রথম তাম্রাশ্ম্য (Chalcolithic) আশ্রিত পুরাতাত্ত্বিক স্থান। প্রকৃতপক্ষে বলা যেতে পারে, কালটি প্রস্তর যুগ থেকে ব্রোঞ্জ যুগে উত্তরণের কাল। সময় হিসাবে বলা যেতে পারে আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগের কোন এক কাল। ১৯৫৪-৫৭ সাল নাগাদ প্রত্নতত্ত্ববিদ বি বি লালের তত্ত্বাবধানে ব্যাপক খননকার্য শুরু হয়। বিভিন্ন দশায় ১৯৬২-৬৫ ও ১৯৮৫ পর্যন্ত চলে।
সাড়ে তিন হাজার বছর কিন্তু কোন কম সময় নয়? ভাবতে আশ্চর্য লাগলেও সেই সময় বাংলার বুকে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই এলাকার মানুষ তৎকালীন সময়ে যেমন শিকারি ও মেছুয়া ছিল তেমনই চাষবাস করে থিতুও হয়েছিল। খাদ্য তালিকায় ছিল চাল থেকে তৈরি ভাত, মাংস, সব্জি, মাছ ইত্যাদি। খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির প্রলেপ দেওয়া সুদৃশ্য বাসভবনও বানাত।
২০০ মিটার উচ্চতা ও ১৭০ মিটার চওড়া এলাকায় ৪×৪ ও ৫×১০ আকারের ৫৩ টি স্থানে ৫৫ থেকে ৬২ সাল পর্যন্ত খনন কার্যের পর মোট ছয়টি স্তর পাওয়া গেছে। রাস্তা থেকে উৎখননের সর্বোচ্চ স্থানটি ছিল ৫ মিটারের মত উচ্চতাসম্পন্ন।
১) ম স্তর- একেবারে তলায় হস্ত নির্মিত ছাই রঙের বা লালচে পাত্রের মাঝামাঝি জায়গায় ধানের তুষ ও মানুষের কিছু দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। ঠিক উপরে তামা বা কোন ধাতুর স্তর পাওয়া যায়নি, মনে করা হয় তখনও ধাতুর যুগ আসেনি। কালচে-লাল বর্ণের, ধূসর গাঢ় লাল বর্ণের চীনা মাটির পাত্র পাওয়া যায়।
২) য় স্তর- এইসময় ব্রোঞ্জ ও তামার ব্যবহার দেখা যায় যা বাংলার বুকে ধাতব যুগের আরম্ভ বলে মনে হয়। মাটির পাত্র ও চিনা মাটির পাত্রের নির্মাণ রঙের ব্যবহারে ব্যাপক বৈচিত্র দেখা যায়। ধূসর, ঈশৎ লাল, গাঢ় লাল, বাদামি, বেগুনি, কালো রংয়ের ব্যবহার হতো। পাত্রের ভিতরের দিকে ক্রিম রং-এর ব্যবহারও আছে। পাত্রগুলিতে ডিসের উপর কাপ সাজানো বা নলাকার বদনার মতো ছুঁচালো জল ঢালার আকৃতিও দেখা যায়। চিনা মাটির পাত্র গুলিতে রংবেরঙের প্রচুর স্পট, পলকা ডট দেখা যায়, তেমনই একটি স্টার ফিশের ছবিও দেখা যায়. তামার তৈরি বর্ষামুখ পুঁথি, পাত্র, বালা, আংটি পাওয়া গিয়েছে। টেরাকোটার অন্তত একটা মাতৃমূর্তি, ব্যায়ামরত মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।
৩) য় স্তর-এই স্তরে লোহার ব্যবহার দেখা যায়। লৌহ নির্মিত বর্ষা মুখ, তরবারি, কাস্তে; অস্থি এবং তামার ব্যবহার ও চিনা মাটির নকশা ব্যবহারেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। একটি ভাঙ্গা স্বর্ণমুদ্রাও পাওয়া গেছে।
৪) র্থ স্তর- তামা, অস্থি, লৌহ নির্মিত যুদ্ধাস্ত্র, যেমন পাওয়া গেছে তেমনই দেখা গেছে, পাত্রর গায়ে অঙ্কিত সার সার ময়ূর, সার সার মাছ, মাছ ধরার জালের ছবিরও নান্দনিক দিক।
৫)-ম স্তর- ধাতব ও চীনা মাটির ফুলদানি, সসপ্যান, নানা ধরন ও আকারের রংবেরঙের নকশাদার পাত্রের সঙ্গে কনিস্কো-১-এর সমকালীন স্বর্ণমুদ্রাও পাওয়া গেছে।
৬)-ষ্ঠ স্তর- এই স্তরে এসে দেখে মনে হয় হঠাৎ করে এলাকাটি পরিত্যক্ত হয়েছে। কিছুকাল পরে বৌদ্ধ পাল যুগের কিছু নিদর্শন দেখা যায়। মজার বিষয় এই স্তরে পোড়ামাটির বেড় দেওয়া কুঁয়ো দেখা যায়। মেঝে নির্মাণে যেমন গোবর লেপা দেখা যায় তেমনই দেখা যায় চুন-সুরকির ব্যবহার।
প্রাপ্ত ১৪ জন পুরুষ স্ত্রী ও শিশুর কঙ্কাল ও মাথা পরীক্ষা করে দেখা গেছে,মাথা লম্বা, শরীর গাঁট্টা- গোট্টা মাঝারি থেকে, উচ্চতা সম্পন্ন, প্রোটো অস্ট্রেলিয়েড গোষ্ঠীর অনেকটা আধুনিক সাঁওতাল শবরদের মত।
সেই সময় অজয় থেকে ভাগীরথী পর্যন্ত নদনদী গুলির নাব্যতা এতটাই বেশি ছিলো যে দেশীয় ও বহির্বাণিজ্য চলত। তাই দেখা যায় ময়ূরাক্ষী (উত্তর), ব্রাহ্মণী, কোপাই, অজয়, কুনুর, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শিলাবতী, রূপনারায়ন (দক্ষিণ), ভাগীরথীর পশ্চিম অংশ উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ় জুড়ে বিস্তীর্ণ এক সভ্যতার উন্মেষ যার সঙ্গে পান্ডবদের নাম জুড়ে গেলেও সভ্যতাটি ছিল সাঁওতাল শবরদের মত অন্ত্যজ শ্রেণীর।
তৃতীয় স্তরকে বলা হয় ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। এই সময় থেকে প্রস্তর, ব্রোঞ্জ ও তামার পর আধুনিক সভ্যতার হাতিয়ার লৌহের ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ( শ্যামচাঁদ মুখার্জী বাংলা পিডিয়া থেকে।)
যদিও বহু জনন মনে করেন ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে এই উপাদানগুলি হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক। এগুলি সাক্ষ্য-প্রমাণ, লিখিত কোন ইতিহাসের অঙ্গ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস লিখিত শুরু হয় মুসলিমদের আগমনের পর।
বাংলায় গুপ্ত যুগ শুরু হয় চতুর্থ শতক থেকে। তারও আগে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আর্য ভাষাভাষীরা বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে। তবে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আর্যীকরণ সম্পন্ন হতে আরও প্রায় হাজার খানেক বছর লেগে যায়। ততদিনে আর্যীকরণ ফিকে হয়ে গেছে। বুঝতেই পারছেন ১০০০ খ্রিস্টাব্দে বা তারপরে উত্তর-পূর্ব থেকে মঙ্গলয়েডরা, বৌদ্ধরা এসেছে, মুসলিমরা এসেছে। আর্য ভাষাভাষীরা মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন সম্ভ্রান্ত, আগ্রাসী, অন্ত্যজ শ্রেণীকে অস্বীকার ও ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিল। তাই দেখা যায় সেনদের আমলে সভায় আমজনের মুখের ভাষা বাংলাকে ব্রাত্য করে সংস্কৃত ভাষার রমরমা।
কিন্তু তারই আগে বৌদ্ধ পালদের সময় চর্যাপদের আদি বাংলার ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছিল। আগ্রাসী ব্রাহ্মণ সেন শাসন তাদের তীব্বতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেও বৌদ্ধ পালদের সাম্যবাদের নীতিকে অস্বীকার করা যায় না।
বৌদ্ধরা এবং মুসলিমরা আর্যিকরণ ও সেনদের বিপরীত সাম্যবাদের সংস্কৃতি এনেছিল। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বাহিনি জনবিচ্ছিন্ন, বিলাসী সেন রাজত্বকে নবদ্বীপ ও বাংলার পশ্চিম অংশ থেকে উচ্ছেদ করে পূর্ববঙ্গে বিতাড়িত করে। সেন রাজত্ব পূর্ববঙ্গে প্রায় ২০০ বছর টিকে থেকে পশ্চিম অংশকে অশান্ত করবে এ তো স্বাভাবিক কথা। কিন্তু খুব বেশিদিন পারেনি।
তাহলে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এ সভ্যতা গুলি কারা তৈরি করেছিল? সুজাসুজি একটি কথায় বলা যায় নিষাদ, অস্ট্রো-এশীয় বা প্রোটো অস্ট্রালয়েডরা; যাদের আমরা সাঁওতাল, কোল, ভীল, সবর, গোন্ড ইত্যাদি অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে ফেলে রাখি।
বাংলায় প্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্রের নমুনা পাওয়া যায়, পশ্চিম বর্ধমানের দামোদর উপত্যকার দুর্গাপুরের বীরভানপুর থেকে, বাঁকুড়ার বিহারীনাথ পাহাড়, পুরুলিয়ার কয়েকটি স্থানে। এলাকায় হাতিয়ারই পাওয়া গেছে কোন পাত্র যায়নি। বীরভানপুর থেকে পান্ডু রাজার ঢিবি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
খননের জন্য নতুন করে আন্দোলন:
আউসগ্রাম-এর পান্ডুরাজার ঢিবি এলাকাতে সংরক্ষণশালা তৈরি এবং এবং একাধিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন শুরু করল পান্ডুরাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্র। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য এই এলাকাটিকে সংরক্ষণ করে রাখা এবং ভারতের ইতিহাসে এর অবদান সম্বন্ধে সকলকে জানানো। সংগঠনের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী, পুরাতত্ত্ব বিভাগ ও পান্ডু রাজার ঢিবির দায়িত্বে থাকা কালনা অফিসে ইমেইল করা হয়েছে।
পান্ডু রাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্রের সম্পাদক রাধা মাধব মন্ডল বলেছেন,
“প্রায় ৪ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসকে চেপে যাওয়ার একটা চক্রান্ত চলছে। তবে প্রাগৈতিহাসিক পান্ডু রাজার ঢিবির সমস্ত তথ্য সামনে আনতে দীর্ঘ লড়াই চলবে। এখানকার সমস্ত তথ্য সামনে এলে ভারতবর্ষের ইতিহাস পাল্টে যাবে।”
তমাল দাশগুপ্তের মত দেশ-বিদেশের বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ ‘পান্ডু রাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্র’-এর পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই লড়াই এখন দিল্লিতেও হবে। প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে,
“নতুন করে আন্দোলন শুরু হওয়ায় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এলাকাটিকে দায়সারা গোছের পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। রাধামাধব বাবু বলেছেন, শুধু ঘাস পরিষ্কার করে কি হবে? আমাদের মুখ বন্ধ করার জন্য শুধুমাত্র দায়সারা কাজ? আমাদের আন্দোলন আরও বৃহত্তর জায়গায় চলবে। দেখি আর কতদিন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ চুপচাপ থাকে”।
পান্ডুরাজা গবেষণা কেন্দ্রের দাবি এখনও ৮৫ শতাংশ জায়গায় খননকার্য হয়নি। পুরাতত্ত্ববিদ পরেশনাথ দাশগুপ্তের মতে সমস্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রত্নবস্তু একত্রিত করে একটি সংগ্রহশালা তৈরি করতে হবে।
‘৫৫ থেকে ‘৬২ ও ১৯৮৫ পর্যন্ত পরেশ দাশগুপ্ত, দেব চক্রবর্তী, শ্যামচাঁদ মুখার্জি, ডি শর্মা, ধীরাজলাল সংখলিয়া, বি লাল ইত্যাদি পুরাতত্ত্ববিদেরা উৎখননে পেয়েছেন প্রায় ৪০০০ প্রত্নবস্তু।
দায়িত্বে থাকা কালনা পুরাতত্ত্ব বিভাগের সিইও গঙ্গাধর দাস বাবু বলেছেন,
“এই বিষয় নিয়ে আলোচনার এক্তিয়ার তাঁর নেই। তিনি পুরাতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে খবর পাঠিয়েছেন এবং তাঁরা যা নির্দেশ দেবেন তাই করবেন”।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।