নবাব মুর্শিদকুলি খান এর সময় থেকে সুবা বাংলা এক রকম স্বাধীন হয়ে পড়ে। এ সময় সুবাকে নিজামত এবং নিজামতের শাসককে বলা হত নাজিম। নাজিম থেকেই নবাব শব্দটির উৎপত্তি হয়। এ পর্যায়ে নবাব পদটি বংশগত হয়ে পড়ে। নাজিমগণ মসনদে বসে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে অনুমােদন লাভ করতেন এবং স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। মুর্শিদকুলি খান (১৭১৭-১৭২৭) ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। তার সময় থেকেই বাংলায় নবাবি আমলের সূত্রপাত। তিনি প্রথমে বাংলার দেওয়ান এবং পরে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তিনি মুঘল প্রথা ভেঙে সুবাদারি ও দেওয়ানি এক হাতে গ্রহণ করেন। যদুনাথ সরকার, আবদুল করিম ও এন কে সিংহ প্রধানত আঠারাে শতকের শেষ দিকের ইংরেজি ও ফারসি দলিলের উপর ভিত্তি করে মুর্শিদকুলির শাসনকাল ও তার রাজস্ব ব্যবস্থার বিস্তারিত আলােচনা করেছেন।১
মুর্শিদকুলি খানের বংশ পরিচয় সম্বন্ধে সঠিকভাবে জানা যায় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে লেখা শাহনওয়াজ খানের ‘মাসির-উল-উমারা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, তিনি দাক্ষিণাত্যের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।২ হাজি শফি ইস্পাহানি নামে শায়েস্তা খানের (১৬৬৪-৭৮) একজন দেওয়ান এই বালককে ক্রয় করে তার নাম মুহাম্মদ হাদি রাখেন।৩ তিনি বালককে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন এবং তাকে পারস্যে নিয়ে যান। পারস্যে মুহাম্মদ হাদির শিক্ষাদীক্ষা সমাপনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে হাজি শফি মুঘল সাম্রাজ্যে ‘দেওয়ান-ই-তান’ নিযুক্ত হন। তিনি ১৬৭৮ ও ১৬৮০ সালে বাংলার দেওয়ান এবং ১৬৮৩-৮৯ অবধি দাক্ষিণাত্যে দেওয়ানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবসর গ্রহণ করে পারস্যে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন তিনি তার সঙ্গে মুহাম্মদ হাদিকে নিয়ে যান। প্রভুর মৃত্যুর পর ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মুহাম্মদ হাদি ভারতে মুঘল শাসনামলে ফিরে এসে বেরার প্রদেশে চাকরি গ্রহণ করেন।৪ নিষ্ঠা, সততা, বুদ্ধিমত্তা, কষ্টসহিষ্ণুতার পরিচয় পেলে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) মুহাম্মদ হাদিকে হায়দ্রাবাদের দেওয়ান নিযুক্ত করেন। পরবর্তীকালে তিনি বিহার ও বাংলায় রাজস্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। ঔরঙ্গজেব মুহাম্মদ হাদির রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞতার জন্য তাঁকে ‘করতলব খান’ উপাধি দেন।৫
ঔরঙ্গজেব করতলব খানকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার দেওয়ান৬ নিযুক্ত করেন, তিনি তার উপর মখসুদাবাদের (মুর্শিদাবাদ) ফৌজদারীর দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। ইতিমধ্যে তাকে আরও অতিরিক্ত দায়িত্বও দেওয়া হয়। তিনি একাধারে মেদিনীপুর ও বর্ধমানের ফৌজদার (২৩ জুন ১৭০১), উড়িষ্যার দেওয়ান (৪ আগস্ট ১৭০১) এবং শাহজাদা আজিমউদ্দিন তথা আজিমুসসানের সম্পত্তির দেওয়ান নিযুক্ত হন। ঔরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলার দেওয়ান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কর্মদক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে ঔরঙ্গজেব করতলব খানকে ১৭০২-র ২৩ ডিসেম্বর ‘মুর্শিদকুলি’ উপাধিতে ভূষিত করেন।৭ বাংলার সুবাদার শাহজাদা আজিমুসসান (১৬৯৭-১৭০৩) মুর্শিদকুলির নিয়ােগ সহজভাবে নিতে পারেননি। কারণ ব্যয় সংকোচনের জন্য মুর্শিদকুলি শাহজাদার সাত হাজার দেহরক্ষীকে কর্মচ্যুত করেন। এর ফলে শাহজাদার প্ররােচনায় দেহরক্ষীগণ একদিন মুর্শিদকুলিকে রাস্তায় অপদস্ত করেন। ঘটনাটি সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে জানানাে হয় এবং তাঁর অনুমতিক্রমে মুর্শিদকুলি তার রাজস্ব বিভাগ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গিরনগর বা ঢাকা থেকে ভাগীরথীর তীরে মখসুদাবাদে৮ স্থানান্তরিত করেন। এই স্থানান্তর বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। মখসুদাবাদ পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদে রূপান্তরিত হয়। কবে এই রূপান্তর ঘটে এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আলিবর্দি খানের অধস্তন অষ্টম পুরুষ এস এম রেজা আলি খান বলেন, ১৭০৪ সালেই মুর্শিদকুলি খান মখসুদাবাদের নতুন নামকরণ করলেন মুর্শিদাবাদ।৯ এ ব্যাপারে তিনি মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের অনুমতি নিয়েছিলেন। সলিমউল্লাহর ‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা’ ও গােলাম হােসেন সলীমের ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’-এর বিবরণ অনুযায়ী মুর্শিদাবাদের প্রতিষ্ঠা ১৭০৪ সালে। আধুনিক গবেষক আবদুল করিমও মনে করেন যে, মুর্শিদাবাদের পত্তন হয় ১৭০৪ সালেই। মনে হয় এটাই ঠিক। কারণ মুর্শিদকুলি যখন দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরছেন তখন ইংরেজ কোম্পানির কটকের ভারতীয় প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে কটকে দেখা করেন এবং সেটা ১৭০৪ সালের গােড়ার দিকেই। তাছাড়া মুর্শিদাবাদের টাকশালে প্রথম যে মুদ্রা তৈরি হয় তাতেও ১৭০৪ সাল লেখা ছিল। সুতরাং এ সমস্ত দিক বিবেচনা করে বলা যায় যে, মুর্শিদাবাদের পত্তন হয়েছিল ১৭০৪ সালেই।১০ আর এ সময় থেকেই সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকার পরিবর্তে মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয়, যার মর্যাদা ১৭৭২ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল।১১
সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭) পর তাঁর পুত্র বাহাদুর শাহ (১৭০৭-১২) সিংহাসনে উপবেশন করেন। আজিমুসসান যখন বাংলার সুবাদার তখন তার ষড়যন্ত্রে মুর্শিদকুলি খানকে বাংলা থেকে প্রথমে উড়িষ্যা এবং আরও পরে ১৭০৮ ও ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান নিযুক্ত করা হয়। দু’বছর পর ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে তাকে পুনরায় বাংলার দেওয়ান হিসেবে প্রেরণ করা হয়। তিনি তিন হাজার মনসবদারে উন্নীত হন। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে উত্তরাধিকার নিয়ে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব শুরু হয়। তার ফলে আজিমুসসান নিহন হন এবং জাহান্দার শাহ (১৭১২-১৩) সিংহাসনে উপবেশন করেন। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে ফারুখশিয়ার (১৭১৩-১৯) যখন মুঘল সিংহাসন লাভ করেন তখন তার শিশুপুত্র ফরকুন্দাশিয়ারকে (১৭১৩-১৩) বাংলার সুবাদার নিয়ােগ করা হয়। ফরকুন্দাশিয়ারের মৃত্যুর পর মীরজুমলা (১৭১৩-১৭) বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন এবং তখন মুর্শিদকুলি খান তার নায়েব সুবাদারের দায়িত্ব পালন করতেন। এরপরে মুর্শিদকুলি খান বাংলার সুবাদার১২ নিযুক্ত হন। তাঁর শাসনামল ছিল গৌরবােজ্জ্বল। কারণ দাক্ষিণাত্যে ঔরঙ্গজেব যখন সমরাভিযনে ব্যস্ত ছিলেন তখন বাংলা থেকে মুর্শিদকুলি খান প্রতি বছর কোটি টাকার রাজস্ব মুঘল রাজকোষে পাঠাতেন।১৩ তার শাসনামলে বাংলায় কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
(১)
১৭০০ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান যখন দেওয়ান নিযুক্ত হয়ে বাংলায় আসেন তখন ভূমি-রাজস্ব সম্পর্কে কোনাে সুষ্ঠু ব্যবস্থা ছিল না। প্রথম পাঁচ বছরের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মুর্শিদকুলি নগদ টাকা পাওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন। ইউরােপীয় চিঠিতে দেখা যায় যে, তখন নগদ টাকার ঘাটতি হেতু সাধারণ জিনিসপত্রের মূল্য ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। এক্ষেত্রে মুর্শিদকুলির বণিকদের উপর অত্যাচারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন ইউরােপীয়গণ। অন্যদিকে শাহজাদা আজিমউদ্দিনের (১৬৯৭-১৭০৩) অহেতুক টাকা সঞ্চয়ের প্রসঙ্গও অন্যতম কারণ বলে তারা ধরেছেন।১৪ তাছাড়া শােভা সিংহ ও রহিম খানের বিদ্রোহের দরুন উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। ফলে মুদ্রা ঘাটতির বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। এই অবস্থায় বেশীরভাগ বণিকরা পালিয়ে গিয়েছিল। তার উপর দাক্ষিণাত্যে লড়াইয়ের জন্য মুঘল সম্রাটের নগদ টাকার দরকার ছিল। এরপর ইউরােপীয় বাণিজ্যের প্রচলন ঘটলে মুর্শিদকুলি মুকসুদাবাদে ১৭০৪ সালে টাঁকশাল চালু করেন। ফলে ১৭০৫ সালের পর থেকে মুদ্রা ঘাটতির পরিমাণ বেশ কমে গিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে মুর্শিদকুলির রাজস্ব ব্যবস্থার আলােচনা করলে বােধহয় ভাল হবে।১৫
তখন বাংলায় ভূমি রাজস্ব থেকে সরকারের কোনােরূপ আয় হত না বললেই চলে। সমগ্র বাংলা প্রদেশের ভূভাগ মুঘল কর্মচারীদের মধ্যে নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গীররূপে বন্টন হয়ে গিয়েছিল। ফলে সরকারের নিজস্ব খাস জমি বলে কিছু অবশিষ্ট ছিল না। এছাড়া বাংলার ভূমি রাজস্ব পুরাতন প্রথায় চলছিল। মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্বেও বাংলার ভূমি রাজস্ব নির্ধারণের জন্য নিয়মিত জরিপ ব্যবস্থা প্রচলিত হয়নি। জমিদাররা সরকারকে একটা নির্দিষ্ট রাজস্ব দিতেন এবং তারা প্রজাদের নিকট থেকে নিজেদের নির্ধারিত হারে অর্থাৎ ইচ্ছামত খাজনা আদায় করতেন। এতে একদিকে প্রজারা নির্যাতিত হত, অন্যদিকে অতিরিক্ত রাজস্ব সরকারী কোষাগারে জমা হত না। রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিপূর্ণ। মুর্শিদকুলি রাজস্ব সংস্কারের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
কোন বছর মুর্শিদকুলি সুবাদার হন তা অস্পষ্ট। যদুনাথ সরকার ১৭১৭ সাল ধরেছেন।১৬ ওই বছর ফররুখশিয়ার ইংরেজদের বাণিজ্যের জন্য যে ফরমান দেন তাতে সুবাদার জাফর খানের (মুর্শিদকুলির) নাম আছে। আবদুল করিম ওই সালটায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, সালটা আসলে ১৭১৭ নয়, ১৭১৬ হবে।১৭ আবদুল করিমের বক্তব্যই সঠিক বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরি।১৮ মির্জা মুহম্মদের ‘ইবাদতনামা’ গ্রন্থ অনুসারে ১৭১৬ সালের কোনাে এক সময় মীরজুমলার পর মুর্শিদকুলি বাংলার সুবাদার হন।
সে যাইহােক, মুর্শিদকুলি বাংলায় এক কল্যাণময় ও সমৃদ্ধ অধ্যায়ের সূচনা করেন। রাজস্ব সংস্কারে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। মুর্শিদকুলি খান বাংলার দেওয়ান হিসেবে আসার পর লক্ষ্য করেন যে, রাজস্ব ব্যবস্থায় ভূমি রাজস্ব খাত থেকে। বিশেষ কর আদায় হয় না; বাণিজ্য শুল্কই ছিল রাজকোষের একমাত্র আয়ের পথ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, শেরশাহ বাংলায় প্রথম ভূমি জরিপ ও কর নির্ধারণ করেন। এরপর ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে আকবরের আমলে রাজা টোডরমল এই জরিপ সংশােধন করেন। এরপর শাহ সুজা (১৬৩৯-৫৯) ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনেন। মুর্শিদকুলি খান। তার আমলে মেদিনীপুর বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্বে মেদিনীপুর উড়িষ্যার অন্তর্গত ছিল।
মুর্শিদকুলির খান রাজস্ব ব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনাে সমসাময়িক দলিল, হিসাবের খাতা বা ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় না। সমসাময়িক ইতিহাস-লেখক সলিমউল্লাহর ‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা’ বইতে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কিছু বর্ণনা আছে। কোম্পানির কর্মচারী জেমস গ্র্যান্ট ১৭৮৬ সালে গভর্ণর-জেনারেল ও কাউন্সিলের কাছে এক রিপাের্ট দাখিল করেন : “An Historical and Comparative Analysis of the Finances of Bengal, chronologically arranged in different parts from the Mogul Conquest to the present time.’ জেমস গ্র্যান্ট বলেছেন যে, এই রিপাের্ট সংকলনের জন্য তিনি ফারসি ভাষায় লিখিত বহু ‘ফর্দ’ (ভূমি-রাজস্ব সংক্রান্ত হিসাবের খাতা) ব্যবহার করেছিলেন। এই রিপাের্টের প্রথম অংশে টোডরমলের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন (১৫৮২) থেকেমুর্শিদকুলির সংস্কার (১৭২২) পর্যন্ত সুদীর্ঘকালের মােটামুটি বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
সলিমউল্লাহ বলেছেন, মুর্শিদকুলি জরিপ করিয়ে চাষের জমির পরিমাণ ও খাজনা, অনাবাদী ও পতিত জমির পরিমাণ প্রভৃতি নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। এই মন্তব্য সাধারণভাবে সত্য হতে পারে, কিন্তু সমগ্র বাংলা জরিপ করানাে হয়নি। সলিমউল্লাহ নিজেই বলেছেন যে, বীরভূমের মুসলমান জমিদার আসাদউল্লাহ খানের জমি জরিপ হয়নি, কারণ তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন এবং ধর্ম সংক্রান্ত কাজের জন্য তিনি জমিদান করতেন। এটি প্রশাসনের উপর ধর্মের প্রভাবের একটি উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্ত। সেকালে অনেক হিন্দু জমিদার দেবতার নামে জমিদান করতেন। তাঁরা কেউ এই অজুহাতে জরিপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদুনাথ সরকারও এমন অভিযােগ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, তখন তিনটি প্রান্তিক জমিদারি ছিল ‘পেশকাশি’ অর্থাৎ তারা শুধু উপঢৌকন বা নজরানা দিত। এদের মধ্যে ছিল দুটি হিন্দু জমিদারী, যাদের অভ্যন্তরীণ শাসনে হস্তক্ষেপ করা হয়নি। আসাদউল্লাহ খান ছিলেন এই ধরণের ‘পেশকাশি’ জমিদার। গােলাম হােসেন সলীম ‘রিয়াস-উস-সালাতিন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মুর্শিদকুলি খান সকল জমিদারদের অধীনস্থ ভূমি জরিপ করেননি, যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের জমিদারি জরিপ করা হয়।১৯ মুর্শিদকুলির অনুগত জমিদারদের ভূমি জরিপ করা হয়নি। যদুনাথ সরকার মুর্শিদকুলির রাজস্ব ব্যবস্থাতে জামিনী ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটা তার শাসনের গােড়ার দিকে চালু করলেও পরে তা লােপ করেন। যদুনাথ সরকার আখাম-ই-আলমগিরি’র২০ ভিত্তিতে ‘মালজামিনী’ প্রথার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ‘আখাম-ই-আলমগিরি’ কেবল ঔরঙ্গজেবের রাজত্ব কালের জন্য প্রযােজ্য, মুর্শিদকুলির গােটা শাসনকালের জন্য প্রযােজ্য নয়।
যাইহােক, মুর্শিদকুলি খান বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থায় স্থবিরতা লক্ষ্য করে কর আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমত, তিনি কর্মচারীদের জায়গীরগুলােকে সরকারি খাস জমিতে পরিণত করেন।২১ এ সমস্ত কর্মচারীদের জন্য উড়িষ্যার জায়গীর নির্দিষ্ট করা হয়।২২ দ্বিতীয়ত, বাংলায় রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে তিনি ভূমি জরিপের বন্দোবস্ত করেন এবং উৎপাদনের ভিত্তিতে করের হার নির্ধারণ করেন। জমিদারী প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করে তিনি রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারা প্রথা চালু করেন। বিলাসপ্রিয় ও উচ্চাভিলাষী জমিদারগণ নিয়মিত ও নির্দিষ্ট হারে কর দিত না। ইজারাদারগণ জমিদারী খাজনা নিয়মিত হারে রাজকোষে জমা দিতে থাকে। প্রথমে বিঘার পরিমাণে জমির জরিপ করা হয়। প্রতি জমির বছরে উৎপাদন ক্ষমতা ও শস্যের বার্ষিক গড়ের উপর ভিত্তি করে এক-তৃতীয়াংশ কর নির্ধারণ করা হয়। এই কর শস্যে অথবা টাকায় প্রদান করা হত। যেহেতু করের হার নির্ধারিত ছিল সেহেতু জমিদার অথবা ইজারাদারগণ মাত্রাধিক কর কৃষকদের নিকট থেকে আদায় করতে পারতেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস চর্চা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ও ‘বাঙালি সমাজ’ গ্রন্থের প্রবন্ধকার মাহবুব আহমেদ উল্লেখ করেছেন যে, মুর্শিদকুলির সময় ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্তের রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারি কর্মচারী নিয়ােগ ছাড়াও বেশ কিছু চুক্তিদার সৃষ্টি করা হয়। এসব কর্মচারীরা সরকারি রাজস্ব কর্মচারী ছিল না, অথচ সরকার কর্তৃক রাজস্ব আদায় করার জন্য অনুমােদিত চুক্তিদার ছিল। যেখানে রাজস্ব আমিন ও শিকদার দ্বারা সংগ্রহ করা হত সে প্রথাকে রায়তওয়ারী প্রথা বলা হত। এ প্রথায় রায়তের সাথে রাষ্ট্রের এক প্রকার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। যেখানে রাজস্ব চুক্তিদাতাদের দিয়ে সংগ্রহ করা হত সে প্রথাকে জমিদারি প্রথা বলা হত। এ প্রথায় রাষ্ট্রের সাথে চুক্তিদারদের বন্দোবস্ত হত এবং চুক্তিদারের সাথে রায়তের সম্পর্ক ছিল।।
প্রশাসনের দিক থেকে বাংলা ৩২টি ‘সরকারে’ বিভক্ত ছিল। মুর্শিদকুলি এই ব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাকে ১৩টি ‘চাকলা’তে ভাগ করলেন। সাধারণত একটি চাকলার ভূমি-রাজস্ব আদায়ের ভার একজন কর্মচারীর উপর ন্যস্ত থাকত। তাকে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে একাধিক জমিদারের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে হত। কোম্পানির আমলের প্রথম দিকে ইংরেজ শাসকেরা চাকলাকে ‘জেলা’ নাম দিয়ে প্রশাসনিক বিভাগ রূপে ব্যবহার করত। বাদশাহী আমলের ‘পরগণা’র অস্তিত্ব মুর্শিদকুলি বজায় রেখেছিলেন। তার সময়ে পরগণার সংখ্যা ছিল ১৬৬০। ভূমি-রাজস্ব সংক্রান্ত কাগজপত্রে সরকার ও পরগণা—এই দুটি নামের প্রচলন বহাল ছিল।
মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থা ‘মাল জামিনী’ নামে পরিচিত। মাল অর্থ ভূমি রাজস্ব, জামিন অর্থ জামিন দেওয়া বা জামিন রাখা, অর্থাৎ মুর্শিদকুলি খান নতুন ইজারাদার নিযুক্ত করে তাদের নিকট ভূমি-রাজস্ব জামিন রাখেন। এর অর্থ এই যে, ইজারাদারগণ রাজস্ব সংগ্রহ করে সরকার নির্ধারিত অঙ্কের রাজস্ব সরকারের নিকট প্রদান করতে জামিন থাকবেন। অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “উত্তর ভারতে সরকারী কর্মচারীরা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত। বাংলায় এই প্রথা (‘জাবিত’) প্রবর্তিত হয়নি। এখানে সরকার ভূমি-রাজস্ব গ্রহণ করত জমিদারদের কাছ থেকে, তারা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। বিভিন্ন সময়ে প্রতিপত্তিশালী হিন্দু ও মুসলমান বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারী লাভ করেছিলেন—রাজার অনুগ্রহে, কোন কোন ক্ষেত্রে বাহুবলে। তাদের উত্তরাধিকারীরা বংশানুক্রমে জমিদারী ভােগ করতেন। কালক্রমে তাঁদের মধ্যে অনেকেই অলস ও অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিলেন। খাজনা আদায়ে শৈথিল্য, কর্মচারীদের অসাধুতা প্রভৃতি কারণে অনেক সময় তারা সরকারী রাজস্ব সময়মত দিতে পারতেন না। মুর্শিদকুলি নিয়মিতভাবে সরকারী রাজস্ব আদায়ের জন্য নতুন ব্যবস্থা করলেন। অকর্মণ্য জমিদারদের হাত থেকে খাজনা আদায়ের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল; প্রথমে তাদের ভরণপােষণের জন্য কিছু জমি (‘নানকর’ জমি) দেওয়া হল, কিন্তু কয়েক বৎসর পরে এই জমিও সরকারের অধিকারভুক্ত হল। খাজনা আদায়ের ভার দেওয়া হল সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ইজারাদারদের। তাদের কাছ থেকে জামিন নেবার ব্যবস্থা হল ‘মাল জামিনী’—যাতে তারা সরকারের প্রাপ্য নির্দিষ্ট সময়ে মিটিয়ে দিতে বাধ্য থাকে। তাদের নগদ বেতন দেওয়া হত, অথবা তাদের সংগৃহীত রাজস্বের উপর কমিশন দেওয়া হত, অথবা সাময়িকভাবে জায়গীর দেওয়া হত…।”২৩
(২)
সলিমউল্লাহ লিখেছেন যে, মুর্শিদকুলি রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে হিন্দুদের ব্যতীত আর কাউকেই নিয়ােগ করতেন না। কারণ তিনি মনে করতেন যে, হিন্দুগণ স্বভাবত শাসকদের প্রতি অনুগত থাকে।২৪ এইজন্য তিনি রাজস্ব ব্যবস্থার বিষয়ে হিন্দুদের বিশ্বাসযােগ্য মনে করতেন। মুর্শিদকুলি আরও মনে করতেন যে, হিন্দুরা রাজস্বের ব্যাপারে দুর্নীতি অবলম্বন করতে সাহস করবে না। মুসলমান জমিদারদের রাজস্ব বাকি পড়ত। রাজস্ব বিভাগের মুসলমান কর্মচারীরা অনেক সময়ে রাজস্বের টাকা আত্মসাৎ করতেন। এইজন্য মুর্শিদকুলি হিন্দু ইজারাদারদের উপর রাজস্ব আদায়ের ভার অর্পণ করেন।২৫ পরবর্তীতে নবাবগণও তাঁর প্রদর্শিত নীতি অনুসরণ করে চলতেন। তবে কোনাে কোনাে উচ্চাভিলাষী হিন্দু ইজারাদার বিদ্রোহী হন। ইজারাদারগণ এবং কৃষকদের মধ্যে সেতু বন্ধন সৃষ্টি করেন। এর ফলে অবশ্য এক ধরনের রায়ত গােষ্ঠীর সৃষ্টি হয় এবং তারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ঔরঙ্গজেব ও মুর্শিদকুলি খান রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিশেষ তৎপর ছিলেন এবং হিসাবনিকাশে কড়া নজর দিতেন।
মুর্শিদকুলি মেদিনীপুর চাকলাকে উড়িষ্যা প্রদেশ থেকে পৃথক করে বাংলার সাথে জুড়ে দেন।২৬ তিনি প্রদেশের খাজনা অনাদায়ী জমিদারদের বন্দী করেন এবং তাদের মহলে অভিজ্ঞ ও সৎ রাজস্ব আদায়কারী প্রেরণ করে তিনি খাজনা ক্রোক করেন এবং বকেয়া রাজস্ব আদায় করেন।২৭ মুর্শিদকুলি বিশ্বস্ত হিন্দু আমিল (খাজনা আদায়কারী) নিয়ােগ করেন এবং প্রত্যেক মহালের রাজস্ব আদায় জরিপ করেন। দেওয়ান মুর্শিদকুলি স্বয়ং বিভিন্ন স্থান সফর করেন।২৮ তিনি এলাহাবাদ থেকে ভূপতি রাই ও কিশাের রাই নামে দু’জন অভিজ্ঞ হিন্দু কর্মচারী নিয়ােগ করেন। ভূপতি রাইকে তিনি নিয়ােগদান করেন তার একান্ত সচিব হিসাবে এবং কিশােরকে নিয়ােগদান করেন মুনসি হিসাবে।২৯
মুর্শিদকুলি খানের আদেশক্রমে আমিলগণ পরগণায় প্রত্যেক গ্রামে শিকদার ও আমিন প্রেরণ করেন, কৃষি জমি ও পতিত জমির হিসাব নেন এবং সে জমির দাগ হিসাবে পুনরায় চাষীদের মধ্যে ইজারা দেন। গরীব চাষীকে কৃষিঋণ দেওয়া। হয় এবং জমির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তাগিদ প্রদান করা হয়।৩০ দেওয়ান একটি প্রকৃত রাজস্ব তালিকা প্রস্তুত করেন এবং কৃষি জমি থেকে মওসুম হিসাবে পণ্যে খাজনা আদায় করেন, ভূমি রাজস্ব আদায় করেন। সায়ের কর৩১ ও ফিস আদায় করেন।
(৩)
মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থায় বিন্যাসের ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পায়। তার সুবাদারি গ্রহণের পূর্বে বাংলায় রাজস্বের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। ‘মাল জমিনী’ প্রথা চালু করে তিনি এই ঘাটতি দূর করেন, ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। এই আদায়কৃত অর্থ থেকে মুর্শিদকুলি খান মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক নিয়মিত ১ কোটি ৩ লাখ টাকা পাঠাতেন।৩২ তার রাজস্ব ব্যবস্থায় প্রজাদের উপকার হয়। জমিদার ও ইজারাদাররা প্রজাদের নিকট থেকে শুধু নির্দিষ্ট খাজনা আদায় করতেন। কোনােরূপ অতিরিক্ত কর আদায় করতে পারতেন না। এই ব্যবস্থা কড়াকড়িভাবে কার্যকরী করা হয়। অতিরিক্ত কর বন্ধ হওয়ায় ও দেশে পূর্ণ শান্তি বিরাজিত থাকায় প্রজাদের খাজনা দেওয়ার সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। মুর্শিদকুলি ভূমি-রাজস্ব ১,৪২,৪৫,৫৬১ টাকা নির্দিষ্ট করেন। তা ব্যতীত তিনি জমিদার ও ইজারাদারদের নিকট থেকে ‘আবওয়াব-ই-খাসনবিস’ (হিসাব লেখকের কর) আদায় করতেন। তার পরিমাণ ছিল ২,৫০,৮৫৭ টাকা।
মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব নীতির ফলে বাংলায় হিন্দু জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। নাটোরে রঘুনন্দন এরূপ একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। রঘুনন্দন কানুনগাে পদে থেকে তার ভাই রামজীবনের নামে অনেক ভূসম্পত্তি করেন। তিনি ভূষণার বিদ্রোহী জমিদার সীতারাম রায়ের৩৩ জমিদারীর কিয়দংশও লাভ করেন। ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর (ভূষণা) অঞ্চলকে অত্যাচারী সীতারাম রায় নলদী পরগণার জমিদারে রূপান্তরিত করেন। ভূষণা থেকে ১০ মাইল দূরবর্তী মুহম্মদাবাদে তিনি তার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে স্বাধীনভাবে জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি পার্শ্ববর্তী জমিদারীতে লুণ্ঠন করে সম্পদ আহরণ করেন এবং রাজকোষে কর প্রদান বন্ধ করেন। মুর্শিদকুলি খান ভূষণার ফৌজদার মীর আবু তােরাবকে সীতারামের বিরুদ্ধে পাঠান। সীতারাম তােরাবকে হত্যা করলে মুর্শিদকুলি তার বিরুদ্ধে এক সেনাবাহিনী পাঠান। সংঘর্ষে সীতারাম পরাজিত ও বন্দী হয়ে মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হন। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়।
সলিমউল্লাহ ও গােলাম হােসেন সলীম সীতারামের বিদ্রোহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেছেন। সলীম বলেছেন যে, সীতারাম সরকারি আমলাদের তার জমিদারিতে ঢুকতে দেননি যেটা বিদ্রোহের সামিল। আবদুল করিম এটি মেনে নিয়েছেন যদিও বলছেন যে, ওঁর বিদ্রোহের কারণ খুব স্পষ্ট নয়। উনি সমকালীন ইংরেজ নথির সাহায্যে সীতারামের পতন ধরেছেন ১৭১৩ সালের শেষে বা ১৭১৪ সালের প্রথমে। ফলে বিদ্রোহ হয়েছিল এমন একটা সময়ে যখন মুঘল সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে। সীতারামের জমিদারি ভূষণার ফৌজদারির মধ্যে পড়ে এবং কেন তিনি ফৌজদারকে আসতে দেবেন না সেটা বােঝা যায় না। যাই হােক, সীতারামকে বন্দি করা হয়েছিল বিদ্রোহী হিসেবে সাবেকি মুঘল প্রথা মেনেই। তবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল কিনা এমন কোনাে প্রমাণ নেই।
গােলাম হােসেন সলীম বলেছিলেন যে, সীতারামকে ফাঁসি দেওয়া হয়, তার নিকট পরিবারকে বন্দী করা হয় এবং বাকিদের হত্যা করা হয়। কিন্তু সলিমউল্লাহ বলেছেন যে, সীতারামকে শূলে চড়ানাে হয়—এই বক্তব্য চার্লস স্টুয়ার্ট মেনেছেন। কিন্তু স্টুয়ার্ট বলেছেন যে, সীতারামের ঘনিষ্ঠ পরিবার (অর্থাৎ স্ত্রী ছেলে ও মেয়ে) মহম্মদপুরে ফিরে আসে এবং বাকিদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। ১৭১৪ সালের দুটি ভূমিদান দলিল থেকে দেখা যায় যে, ওর ছেলে মহম্মদপুরে ফিরে এসেছিল এবং পুরানাে জমিদারির মূল অংশ তারা ফেরৎ পেয়েছিলেন।৩৪
তবে এটা নিঃসন্দেহ যে, ১৭১৪ সালের শেষ দিকে সীতারাম মুর্শিদাবাদে মারা যান। সম্ভবত বন্দীদশাতেই মারা যান, ফাঁসি দেওয়া বা শূলে চড়ানাে কোনােটাই হয়নি। ইংরেজদের ১১ ফেব্রুয়ারি ১৭১৪ সালের নথি থেকে মনে হয়, তখন সীতারাম ছিলেন মরণাপন্ন। সীতারামের বড় ছেলের ভূমিদান দলিল নভেম্বর ১৭১৪ ও নভেম্বর ১৭১৫ যেগুলি মহম্মদপুর থেকে পাওয়া গেছে। প্রথমটি মুর্শিদাবাদে সীতারামের মৃত্যু উপলক্ষে দশদিন পর শ্রাদ্ধ হয়েছিল তার জন্য ভূমিদান। মৃত্যুর দশদিন বাদে শ্রাদ্ধ করা মানে ওর সাধারণ কারণেই মৃত্যু হয়েছিল। ওকে হত্যা করা হলে তিনদিন বাদে শ্রাদ্ধ হত। সুতরাং সীতারামের মৃত্যু হয়েছিল ১৭১৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে অথবা নভেম্বরের প্রথমের দিকে।
জানা যায় যে, এ সময়ে অর্থ ডজনেরও অধিক জমিদারির পতন ঘটে। মুর্শিদকুলি খান রাজশাহী জেলার দেবীনগরের জমিদারের অবাধ্যতার জন্য তার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করেন। দেবীনগর জমিদারি থেকে নাটোর জমিদারর সূত্রপাত হয়। রাজস্ব প্রদানে গাফিলতির জন্য বেনগাচি, ভাতুরিয়া, সুলতানপুর, স্বরূপপুরের জমিদারদেরকে ও অন্যান্য কয়েকজন জমিদারকে তাদের জমিদারি থেকে উৎখাত করা হয়। নাটোর জমিদারি এসব জমিদারির বৃহত্তর অংশ রঘুনন্দন তার জমিদারির সঙ্গে জুড়ে নেন। অষ্টাদশ শতকের একটি প্রধান জমিদারি নাটোর এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
রঘুনন্দনের বিশ্বস্ত কর্মচারী দয়ারাম রায়ও ভূষণার কিয়দংশ ইজারা পান এবং রাজশাহীর বিখ্যাত দিঘাপতিয়া জমিদার পরিবারের গােড়াপত্তন করেন। ইনি ছিলেন ভেলীগােত্রের এবং রঘুনন্দনের ভৃত্য। দয়ারাম রায় সীতারামের ভূষণা জমিদারির একটি অংশ লাভ করেন এবং তাঁর রাজধানী লুটে-অংশ নিয়ে ধনী হয়ে উঠে। মুর্শিদকুলি শ্রীকৃষ্ণ হালদার নামে এক বরেন্দ্র ব্রাহ্মণকে কানুনগাে নিয়ােগ করেন এবং তাঁকে ময়মনসিংহ পরগণার ইজারা দেন ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে। তিনি শ্রীকৃষ্ণ আচার্য নামক অন্য একজন বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ ও রাজস্ব কর্মচারীকে আলপশাহী পরগণার (মুক্তাগাছা) ইজারাদার নিয়ােগ করেন। এর ফলে ময়মনসিংহে দু’টি হিন্দু জমিদারীর সৃষ্টি হয়। শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসনীয় কার্যের স্বীকৃতিস্বরূপ মুর্শিদকুলি খান তাকে ‘তালপাত্র’ উপাধি এবং মােমেনশাহী পরগণার রাজস্ব আদায়ের ইজারাদার নিয়ােগ করে পুরস্কৃত করেন। শ্রীকৃষ্ণের পুত্র চাঁদ রায় আলিবর্দির সময়ে খালসা বিভাগের প্রধানরূপে চাকরিতে নিয়ােজিত ছিলেন এবং তিনি পিতার জন্য জাফরশাহী পরগণা (ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম দিক) লাভ করেন।
বর্ধমান, নবদ্বীপ (নদীয়া) ও দিনাজপুরের হিন্দু জমিদারগুলাে মুর্শিদকুলির পূর্বে খুবই ছােট ছিল। মুর্শিদকুলির রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্গঠনের ফলে এরা অনেকগুলাে পরগনা ইজারা পায় এবং এদের জমিদারীর আয়তন বৃদ্ধি পায়। দিনাজপুরের জমিদারী রাজা রমানাথের পূর্বপুরুষগণও মুর্শিদকুলি খানের নিজামতের আমলে তাদের জমিদারির সঙ্গে বহু এলাকা যুক্ত করেন। অন্যান্য অনেক ক্ষুদ্র হিন্দু জমিদার মুর্শিদকুলির রাজস্ব-সংস্কার থেকে উপকৃত হন এবং প্রতিপত্তিশালী জমিদারের মর্যাদা লাভ করেন।
পুরাতন জমিদারগুলাের মধ্যে বীরভূমের জমিদার পরিবার উল্লেখযােগ্য। সুবাদার ইসলাম খানের আমলে শামস খান ছিলেন বীরভূমের জমিদার এবং তিনি সম্রাট জাহাঙ্গিরের বশ্যতা স্বীকার করেন। মুর্শিদকুলি খানের আমলে এই পরিবারের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময়ে বীরভূমের জমিদার ছিলেন আসাদউল্লাহ খান। সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ তাঁকে একজন শক্তিশালী জমিদার হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ছিলেন একজন ধর্মভীরু মুসলমান। তিনি ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেন এবং নিষ্করভূমি দান করেন। আসাদউল্লাহ খানের ধর্মীয় ও দাতব্য কার্যাবলীর স্বীকৃতিস্বরূপ মুর্শিদকুলি খান ভূমিজরিপ ব্যবস্থা থেকে তার জমিদারিকে অব্যাহতি দান করেন। আসাদ উল্লাহর পুত্র বদিউজ্জামান খানের ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতার খ্যাতি ছিল এবং তিনি দেওয়ানজী নামে সুপরিচিত ছিলেন।
মুর্শিদকুলি খান ও তদীয় উত্তরাধিকারী নবাব সুজাউদ্দিনের (১৭২৭-৩৯) নিজামতের রাজস্ব বিবরণ পর্যালােচনায় দেখা যায় যে, তখন বাংলায় কমপক্ষে ২০টি জমিদার পরিবার, বহু মজকুরী তালুকদার ও ৯৮ জন হুজুরী তালুকদার ছিলেন। প্রদেশের ১,৬৬০টি পরগণার মধ্যে কমপক্ষে ১,২০০টি পরগণা তাদের এলাকাভুক্ত ছিল। সরকারি রাজস্ব ১,৪২,৪৫,৫৬১ টাকার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক, অর্থাৎ প্রায় এক কোটি টাকা বাংলার এই জমিদারদের ও তালুকদারদের নিকট থেকে আদায় হতাে। এতে প্রদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে জমিদারদের প্রাধান্য প্রকাশ পায়। জমিদারগণ ছাড়াও নিজামত আমলে একদল জায়গিরদারের অস্তিত্ব দেখা যায়। তারাও জমিদার পরিবারগুলির সঙ্গে বাংলার ভূ-স্বামী অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মুর্শিদকুলি তাঁর আমলে রাজস্ব বিভাগে রঘুনন্দন, ভূপতি রাই ও কিশাের রাই ছাড়াও দর্পনারায়ণ, কিঙ্কর রায়, আলমাদ, লাহারীমল, দিলপৎ সিংহ, হাজারিমল এবং আরও কয়েকজন হিন্দু দেওয়ানকে অন্যান্য উচ্চপদে নিযুক্ত করেন। মুর্শিদকুলির জামাতা ও উত্তরাধিকারী নবাব সুজাউদ্দিনের আমলেও আলমচঁাদ, জগৎশেঠ, যশােবন্ত রায়, রাজবল্লভ, নন্দলাল এবং আরও অনেক হিন্দু কর্মচারী দায়িত্বপূর্ণ রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নবাব আলিবর্দির সময়ে (১৭৪০-৫৬) রাজপদে হিন্দুদের আরও উন্নতি হয়। এই সময় চিন রায়, বীরু দত্ত, কিরাচঁাদ ও উমেদ রায় খালসাবিভাগের দেওয়ান ছিলেন, জানকীরাম ও রাজনারায়ণ বিহারের দেওয়ান ও নায়েব সুবাদারের আসন লাভ করেছিলেন। রায়দুর্লভ উড়িষ্যার নায়েব সুবাদার এবং রাজবল্লভ জাহাঙ্গিরনগরের দেওয়ান নিযুক্ত হন। শ্যামসুন্দর গােলন্দাজ সৈন্যদলের বখশী ও রামরাম সিংহগুপ্ত পুলিশ বিভাগের প্রধান ছিলেন। রবার্ট ওর্ম লিখেছেন যে, নবাব আলিবর্দি খান রাজকার্যে ও ব্যবসায় ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য দিয়েছেন এবং এর ফলে শাসনকার্যে হিন্দুদের প্রভাব প্রতিপত্তি স্থাপিত হয়েছিল।৩৫
নবাবদের পৃষ্ঠপােষকতায় মুর্শিদাবাদের শেঠ পরিবার ও কলকাতার উমিচাদ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। জগৎ শেঠ নবাব সরকারের ব্যাঙ্কার ছিলেন এবং সরকারি লেনদেনের কাজ করে তিনি বছরে চল্লিশ লক্ষ টাকা মুনাফা করতেন। জগৎ শেঠের ঐশ্বর্যের বিষয়ে রবার্ট ওর্ম লিখেছেন, “মখসুদাবাদে (মুর্শিদাবাদ) এক হিন্দু পরিবার ছিল এবং এই পরিবারের প্রধান ছিলেন জগৎ শেঠ। জগৎ শেঠ সামান্য অবস্থা হইতে সাম্রাজ্যের সর্বোপেক্ষা সমৃদ্ধ ব্যাঙ্কার হইয়া উঠিয়াছিলেন, সাম্রাজ্যের বহু স্থানে তার দালাল ছিল এবং সেখানে তারা লেনদেনের কাজ করত। এই সকল দালালের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যের শাসনকার্যের বিষয়ে অনেক তথ্য অবগত হইতেন।…তিনি জমিদার ও ইজারাদারদের দেয় রাজস্বের জন্য জামিন হইতেন। দেশের যে কোন অর্থ সংকটে তার সাহায্যের প্রয়ােজন হত।”৩৬
(৪)
মুর্শিদকুলি-ঔরঙ্গজেবের পত্রালাপের মধ্যে পাওয়া যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে কর সংগ্রহ কমে যায় ও সংগ্রহকারী আমিনরা খাজনা আত্মসাৎ করতে থাকে। ফলে কর সংগ্রহকারকদের সম্পর্কে মুর্শিদকুলি কঠোর হয়েছিলেন যার কথা ঐতিহাসিক গােলাম হােসেন সলীম বলে গিয়েছেন ও কঠিন শাস্তি দেওয়া হত তার কথাও বলেছেন।৩৭
সলিমউল্লাহ লিখেছেন যে, মুর্শিদকুলি রাজস্ব আদায় ও হিসাব রাখার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করতেন। যদি রাজস্ব বাকি পড়ত, তাহলে তিনি জমিদার, আমিল, কানুনগাে ও মুৎসুদ্দিদের দেওয়ানখানায় আটক করে রাখতেন।৩৮ তাদের খাদ্য বা জল কিছুই দেওয়া হত না। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাদের আটক রাখা হত। কোনাে কোনাে সময়ে তাদের মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রাখা হত এবং চাবুক মারা হত। রাজস্ব অনাদায়ে হিন্দু জমিদারদের স্ত্রী-পরিজন সমেত মুসলমান করা হত।৩৯ যদুনাথ সরকার লিখেছেন, মুর্শিদকুলি নদিয়ার জমিদার কৃষ্ণরাম রায়কে কারারুদ্ধ করেন এবং কানুনগাে দর্পনারায়ণকে মেরে ফেলেন।৪০ সলিমউল্লাহ আরও লিখেছেন যে, মুর্শিদকুলির দৌহিত্রীর স্বামী ও নায়েব দেওয়ান সৈয়দ রাজী খান রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে আরও বেশি কড়াকড়ি করতেন। তিনি বকেয়ার জন্য জমিদার ও আমিলদের আবর্জনাপূর্ণ গর্তে (বৈকুণ্ঠ) ফেলতেন।৪১
‘রাজাবলী’তে শাস্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে, “..কারাগারে জমিদারদিগকে মহিসের চর্ম পরাইয়া মহিসের দুগ্ধমাত্র আহার দিতে আজ্ঞা করিতেন। তাহার শৌচ প্রস্রাবকালেও সে মহিসের চর্ম গুলিতে (খুলিতে) পারিতেন না। তাহাতেই শৌচাদি করিত, জমিদাররা কদ হইতে খালাস হওয়া পর্যন্ত এইরূপ দুঃখ পাইত।”৪২ ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ এ হুগলির ফৌজদার জিয়াউদ্দিন খানের পেশকর কিঙ্কর সেনের শাস্তির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা একইভাবে বীভৎস ও নিষ্ঠুর। দিল্লি থেকে ফিরে কিঙ্কর সেন হুগলির চাকলাদার পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মুর্শিদকুলি খান তার অসদ্ব্যবহারে অত্যন্ত রুষ্ট ছিলেন। তাই কিছুদিন পরে “সালতামামির সময় হাল বকেয়া রাজস্ব ও সায়ের কর তছরূপের অভিযােগ আনয়ন করিয়া, কিঙ্কর সেনকে বাগুরাবদ্ধ মার্জারের ন্যায় কারারুদ্ধ করিলেন ও বলপূর্বক তাহাকে বিরেচক ঔষধ সেবন করাইয়া কঠোর স্বভাব প্রহরীর তত্ত্বাবধানে রাখিলেন। কিঙ্কর পরিধেয় বস্ত্র মধ্যে বারম্বার মলত্যাগ করিতে লাগিলেন এবং অবশেষে তদবস্থাতেই মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন।”৪৩
এক্ষেত্রে মুর্শিদকুলিকে দোষারােপ করা হয় এইজন্য যে, তিনি নাকি জমিদারদের উপর ‘আবওয়াব-ই-খাসনবিস’ নামে নতুন কর চাপিয়েছিলেন। এন কে সিংহ মনে করেছেন যে, এটা নজরানা’র পরিবর্তে চালু করা হয়েছিল। কিন্তু নজরানা’ কোনাে কর নয়, এটা প্রথাগত উপঢৌকন। যার সঙ্গে নতুন করের কোনাে মিল নেই। ‘নজরানা’র বন্ধ হয়ে যাবার কোনাে উল্লেখ নেই। প্রথম দিকে নতুন করের পরিমাণ ছিল ২,৫৮,৪৫৭ লক্ষ টাকা। মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর নবাব সুজাউদ্দিন এটিকে ১৯ লক্ষ টাকাতে নিয়ে চলে যান। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি পাবার পর ইংরেজরা রাজস্বকে আড়াই কোটি টাকা করে, যদিও ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সে সম্পর্কে প্রায় নীরব থেকে মুর্শিদকুলিকে দোষারােপ করে গিয়েছেন। অর্থাৎ ১৭২২ সালের পর খাজনা বাড়ে প্রায় এক কোটি তের লক্ষ টাকার মত। সুতরাং এথেকে বােঝা যায় যে, মুর্শিদকুলির রাজস্ব কত কম খাতে ধরা হয়েছিল। মুর্শিদকুলির জোর ছিল কড়া হাতে রাজস্ব সংগ্রহ করার দিকে, যার ফলে অত্যাচারের কাহিনি শুরু হতে থাকে।৪৪ সলিমউল্লাহ মুর্শিদকুলি ও রাজী খানের শাস্তি ব্যবস্থার অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়েছেন। জমিদার, আমিল প্রভৃতি পদস্থ ব্যক্তিদের মাথা নিচের দিকে করে ঝুলিয়ে রাখা, মারা ও আবর্জনাপূর্ণ গর্তের বৈকুণ্ঠে ফেলে শাস্তি দেওয়া কল্পনা করাও যায় না। বৈকুণ্ঠ সম্পর্কে সলিমউল্লাহ কোনাে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাননি। সলিমউল্লাহর বর্ণনা থেকে বােঝা যায় যে, তিনি এটা সস্তা জনরব থেকে জানতে পেরেছিলেন। ফলে তার বর্ণনায় যথেষ্ট অতিরঞ্জন রয়েছে। গ্লাডউইন অবশ্য বলেছেন যে, বাস্তবিকপক্ষে কাউকেই বৈকুণ্ঠে পাঠানাে হয়নি; এটা শুধু ভীতি প্রদর্শনের জন্য প্রচার করা হয়েছিল এবং এই ভীতি প্রদর্শনের ফলে ফলও লাভ হয়েছিল। খেলাপকারিগণ যেমন করে হােক ব্যাংকারের জামিনের মাধ্যমে রাজস্ব পরিশােধের ব্যবস্থা করতেন। বর্বরােচিত শাস্তি দেওয়া হলে কোনাে জমিদার, ইজারাদার ও আমিল মুর্শিদকুলির সময়ে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করতে স্বীকৃত হতেন না। রাজস্ব অনাদায়ের জন্য তাদের দেওয়ানখানায় আটক রাখা হত এবং টাকার জন্য কেহ জামিন হলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হত। রাজস্ব আদায় কার্যে সচরাচর কিছুটা কঠোরতা ও তিক্ততা বিদ্যমান থাকে। কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ লােকই সাধারণত রাজস্ব পরিশােধের ব্যাপারে গাফিলতি করে থাকে। কড়াকড়ি না করলে সরকারি রাজস্ব বকেয়া পড়ে থাকে। সুতরাং মুর্শিদকুলি খান এবং তার দেওয়ান অনিবার্য কারণে আদায়ের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন।
রাজস্ব আদায়ের জন্য হিন্দু জমিদারদের পরিবার-পরিজনসহ মুসলমান করা হত, এই অভিযােগ অমূলক। এমন ঘটনা একজন জমিদারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়নি। বাস্তবে ঘটলে অন্তত সীতারাম ও রাজশাহীর জমিদার উদয়নারায়ণের পরিবারবর্গের উদাহরণটাও আমাদের গােচরে আসত।৪৫ আসলে বিদ্রোহ করার জন্য অথবা রাজস্ব অনাদায়ের জন্য কিছু হিন্দু এবং মুসলমান জমিদার জমিদারীচ্যুত হন। মুর্শিদকুলি খান ইচ্ছা করলে, এই সমস্ত হিন্দু জমিদারদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং বহু সংখ্যক হিন্দু কর্মচারী মুর্শিদকুলি খান কর্তৃক দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। তঁার রাজস্ব নীতির ফলশ্রুতিস্বরূপ বহু সংখ্যক হিন্দু জমিদারের উদ্ভব হয়েছিল। এই সমস্ত প্রমাণাদি এই অভিমত খণ্ডন করে যে, মুর্শিদকুলি খান ধর্মগত কারণে হিন্দুদের প্রতি কঠোর নীতি গ্রহণ করেছিলেন। দেওয়ান অনেক মুসলমান জমিদারের জমিদারী রাজস্ব অনাদায়ের জন্য কেড়ে নিয়ে হিন্দু ইজারাদারকে দিয়েছেন। এই অবস্থায় হিন্দু জমিদারকে মুসলমান করলে তিনি রাজস্বের ক্ষতি করতেন। রাজস্ব বৃদ্ধি করা মুর্শিদকুলির উদ্দেশ্য ছিল। তিনি কোনাে হিন্দু জমিদারকে মুসলমান করেছেন বলে জানা যায় না।
আগেই বলা হয়েছে, দর্পনারায়ণকে উচ্চপদে নিযুক্ত করেছিলেন মুর্শিদকুলি খান এবং সমকালীন ইংরেজদের লেখা চিঠি থেকে জানা যায় যে, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মুর্শিদকুলির উপর তার বিলক্ষণ প্রভাব ছিল। দর্পনারায়ণের মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছিল।৪৬ নদিয়ার জমিদার কৃষ্ণরাম রায় কারারুদ্ধ হয়েছিলেন কর না দেবার কারণে। আসলে মুর্শিদকুলির আমলে নদিয়ার জমিদারী বৃদ্ধি পায়, যে কথা ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেছেন।৪৭
মুর্শিদকুলি হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি বরং মুসলমানকে সরিয়ে হিন্দুদের জমিদারী দিয়েছেন। তাঁর পৃষ্ঠপােষকতায় বাংলার বড় বড় হিন্দু জমিদারীগুলির উৎপত্তি হয় এবং অনেক হিন্দু রাজস্ব শাসনের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন, যেটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
‘মালজামিনী’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময়ে মুর্শিদকুলিকে নানা রকম বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হয়। যে সকল আমিলকে বরখাস্ত করা হয়েছিল তারা দেওয়ানের বিরুদ্ধে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নিকট অভিযােগ করেন যে, মুর্শিদকুলির নিযুক্ত ইজারাদাররা প্রজাদের উপর দৌরাত্ম্য করে টাকা আদায় করছে এবং কৃষির অবনতি হচ্ছে। এর উত্তরে মুর্শিদকুলি তার রাজস্ব সংস্কার সম্বন্ধে সম্রাটকে পূর্ণ বিবরণ দেন এবং বিরক্ত হয়ে লিখলেন যে, “আমি সুবার কৃষির উন্নতি করেছি, কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহ করেছি। কিন্তু কিছু স্বার্থপর ব্যক্তি আমার কাজকর্ম বানচাল করে দিতে চাইছে। আমার অনুরােধ, আমার পদে অন্য কাউকে নিয়ােগ করুন।”৪৮ আরও জানান যে, প্রথম থেকেই তিনি কৃষকদের নিরাপত্তার জন্য ইজারাদারকে অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছেন এবং তাদের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য কিস্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাঁর ব্যবস্থায় সম্রাট ঔরঙ্গজেব সন্তুষ্ট হন এবং তিনি মুর্শিদকুলিকে লেখেন, “আপনাকে তিনটি প্রদেশের পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন দেওয়ান নিয়ােগ করা হয়েছে এবং শাহজাদার (আজিমউদ্দিন) সম্পত্তির দেওয়ানরূপেও আপনাকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আপনি সুবাদারের পরামর্শ নিয়ে ও তাঁকে সন্তুষ্ট রেখে রাজস্বের সুব্যবস্থার জন্য যা যুক্তিযুক্ত মনে করেন, তা করবেন।…আমি জেনেছি যে, আপনি উড়িষ্যা শাসনের ব্যাপারে পূর্ববর্তীদের অপেক্ষা বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন এবং জমিদারের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করতে সমর্থ হয়েছেন। এই জন্য আপনি প্রশংসা পাওয়ার যােগ্য।” ওইপত্রে ঔরঙ্গজেব আরও লেখেন, “আপনি দেওয়ান এবং ফৌজদার। আপনি পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী এবং আপনার বিরুদ্ধে কারাের অভিযােগ আমার কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। আপনার প্রতি আমার ভরসা সম্পর্কে আপনার কেন সন্দেহ হচ্ছে? কোনাে শয়তানের প্ররােচনায় কিছু হবে না। আল্লাহ এইসব শয়তানদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করবে। আপনি মনে কোনাে শঙ্কা রাখবেন না। আগের চেয়ে আরও বেশি মন দিয়ে রাজস্ব সংগ্রহ করুন।”৪৯ ১৭০৪ সালে বাদশাহ আর এক চিঠিতে দেওয়ান মুর্শিদকুলির প্রতি তার মুগ্ধতা প্রমাণ করে লেখেন, “আপনি একই ব্যক্তি বাংলা এবং বিহারের দেওয়ান এবং উড়িষ্যার নাজিম ও দেওয়ান। আপনার হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা। আমার নিজের এত কাজ করার ক্ষমতা নেই।”৫০ মুর্শিদকুলি খানের প্রতি ঔরঙ্গজেবের এতটাই আস্থা ছিল যে, তিনি শাহজাদার সুপারিশ করা ব্যক্তিদের বাতিল করে দেওয়ান মুর্শিদকুলির পছন্দের ব্যক্তিকে ফৌজদার পদে নিয়ােগ করতেন।
‘মালজামিনী’ ব্যবস্থার ফলে অনেক পুরাতন জমিদার, বিশেষত মুসলমান পরিবার জমিদারী হারান এবং যে সমস্ত জমিদারী অবশিষ্ট থাকে সেগুলিও ইজারাদারদের প্রতিপত্তি ও নিজেদের আর্থিক অধঃপতনের দরুন কিছুকালের মধ্যে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। ইজারাদাররা ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা বংশগত করে নেয় এবং পরে এরা জমিদার হিসাবে পরিচিত হন এবং রাজা, মহারাজা প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হয়।
(৫)
এম এ রহিম মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন এবং এর দ্বারা সরকার এবং জমিদার উভয় শ্রেণি লাভবান হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। আবদুল করিমের মতে, মুর্শিদকুলি রায়তদের স্বার্থ রক্ষার দিকে নজর রাখতেন এবং জমিদার ও জমিদারদের হাতে রায়তরা যাতে নিষ্পেষিত না হয় সেদিকে নজর রাখতেন। এম এ রহিমের মতে, এ রাজস্ব ব্যবস্থায় সরকারের আয় বৃদ্ধি পায়, ফলে সরকার লাভবান হয়। তবে কৃষকদের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা হল এই যে, রাজস্ব হার নির্দিষ্ট থাকায় কর্মচারীরা বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারত না।
মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব সংস্কারের ফলে বাংলায় রাজস্ব ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসে। কৃষকরা নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব প্রদান করতে সক্ষম হয়। আবদুল করিমের মতে, মুর্শিদকুলি খান আমিন ও জমিদারদের শােষণ থেকে প্রজা তথা কৃষকদের রক্ষা করতেন। কিন্তু যদুনাথ সরকার এই রাজস্ব ব্যবস্থায় কৃষকদের শােষণের কথা উল্লেখ করেছেন। কৃষকদের নগদ রৌপ্য টাকায় রাজস্ব দিতে বলা হত। কিন্তু চাষির পক্ষে মুদ্রা সংগ্রহ সহজ ছিল না। ফলে সরকারের প্রাপ্য ভূমি রাজস্ব পরিশােধের জন্য বাধ্য হয়ে কৃষকেরা মহাজনদের নিকট অনেক কম দামে ফসল বিক্রি করে মুদ্রা সংগ্রহ করত। ফলে গ্রাম বাংলার কৃষক তথা জনসাধারণের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়ছিল। কিন্তু এ সত্বেও সাধারণ প্রজারা সুখেই ছিল। এক্ষেত্রে নবাবের সুনজর ছিল লক্ষ্যণীয়। খাদ্যশস্যের দাম যাতে বাড়তে না পারে সেজন্য মুর্শিদকুলি শস্য মজুতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। সরকার পণ্যের মূল্য নির্দিষ্ট করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছিল। সপ্তাহে একদিন বাজার মূল্যের সঙ্গে সরকার-নির্ধারিত মূল্য যাচাই করা হত। কোনাে পণ্যের মূল্য সামান্য বৃদ্ধি পেলে মহাজনদের শাস্তি দেওয়া হত। এ সময় বাংলা দস্যুদের উপদ্রব থেকে মুক্ত ছিল। এ বিশাল সুবা বাংলা র শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য মােতায়েন ছিল মাত্র ২০০০ অশ্বারােহী ও ৪০০০ পদাতিক।
মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব নীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এই যে, তার সময়ে বাংলার রাজস্ব বিভাগে উত্তর ভারতের লােকদের নিয়ােগ না করে বাংলার শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমানদের নিয়ােগ করা হত। পরবর্তী সময়ে এদের মধ্য থেকে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে এবং এ শ্রেণি পরবর্তী সময়ে বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
(৬)
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মুর্শিদকুলির সুবাদারির অন্যতম প্রধান অবদান। এ সমৃদ্ধির মূলে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। তিনি ইরানী বণিকদের পৃষ্ঠপােষকতা করেন। তার সময়ে হুগলি একটি সমুদ্র বন্দরে পরিণত হয়। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ফররুখশিয়ারের নিকট হতে ইংরেজ বণিকগণ বার্ষিক ৩০০০ টাকা নজরানা দিয়ে সমগ্র বাংলায় বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্য করার সুযােগ লাভ করেন। এটি ফারুখশিয়ারের ফরমান নামে পরিচিত।৫১ কলকাতা, সুতানুটি ও গােবিন্দপুর মৌজার অতিরিক্ত পার্শ্ববর্তী আরও ৩৮টি মৌজার জমিদারি স্বত্ব কোম্পানিকে প্রদান করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, মাদ্রাজী মুদ্রা বাংলায় কোনাে প্রকার বাট্টা ছাড়াই গ্রহণযােগ্য হবে। কোম্পানির মালামাল চুরি হলে তা উদ্ধার করে কোম্পানিকে ফেরত দিতে সরকার ব্যবস্থা নিবে। জাহাজ বা নৌকাডুবি হলে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থেকে পালিয়ে যাওয়া দেনাদার ও অন্যান্য অপরাধীকে কোম্পানির কাছে সােপদের জন্য সুবা সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকবে। মুর্শিদাবাদ টাকশাল থেকে ইংরেজ বণিক কোম্পানির আমদানিকৃত ধাতব দ্বারা মুদ্রা প্রচলনের অধিকার লাভ করে। এর পাশাপাশি হাসবুল হুকুম দ্বারা কোম্পানি আরও কয়েকটি সুযােগ-সুবিধা লাভ করে। যেমন কুঠির প্রধান একটি দস্তক বা অনুমতিপত্র প্রদান করলে, সেটি দেখালে নবাবের কোনাে কর্মচারি জাহাজ পরীক্ষা করে দেখবেন না এবং কোম্পানি মুর্শিদাবাদের টাকশাল ব্যবহার করতে পারবে।
এর ফলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। ইংরেজদের কলকাতা বাণিজ্য-কেন্দ্রের উন্নতি হয়। পর্তুগীজ, আর্মেনিয়ান, ইরানী ও হিন্দু ব্যবসায়ীরা কলকাতায় উপনিবেশ স্থাপন করে। এ সময়ে ইংরেজ বণিকরা বাণিজ্যের প্রতিযােগিতায় ওলন্দাজ বণিকদেরকেও হার মানায়। সম্রাট ফররুখশিয়ার প্রদত্ত ফরমানকে ঐতিহাসিক ওরম ‘বাংলায় ব্রিটিশ বাণিজ্যের ম্যাগনাকার্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এটি ছিল ইংরেজদের কুটনৈতিক জয়ের প্রতীক। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল থেকে প্রদেয় সকল সুযােগ-সুবিধা নবায়ন করে এতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফলে কোম্পানি পূর্বের সুবিধার চেয়ে অধিক পরিমাণে সুবিধা পায়। পূর্বের অন্য যে কোনাে ফরমানের তুলনায় ফররুখশিয়ারের ফরমান অবাধ বাণিজ্যে অধিক পরিমাণে নিশ্চয়তা দান করে। ফরমানটি ঘােষিত হওয়ার সাথে সাথে ইংরেজদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। এটি অনুমােদিত হওয়ায় ব্রিটিশ বাণিজ্যের একটি বড় অংশ শুল্ক থেকে রেহাই পায়।
এ ফরমানের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে পি জে মার্শাল বলেন, ‘The prestige of a Mughal forman was enormous and the grant of 1717 represented a remarkable British triumph…the principle that the major part of Britsh trade was exempt from customs was never to be challenged.৫২ এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এর ফলে কোম্পানির ক্ষমতা ও শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়, দেশীয় ও ইউরােপীয় বণিকদের কাছে তারা মর্যাদা ও সম্রম আদায় করতে সক্ষম হয়।
বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রমাগত সমৃদ্ধি আসতে থাকে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৭১৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিনিয়ােগের মােট পরিমাণ ছিল ২,৭৮,৫৯৩ পাউন্ড। ১৭২৯ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৬৩,৯৭৯ পাউন্ডে। কলকাতার গুরুত্বও বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। ১৭২৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা বন্দর দিয়ে কোম্পানির মাধ্যমে বছরে ১০ হাজার টন মালামাল যাতায়ত করে। এর ফলে তাদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার এক সুবর্ণ সুযােগ উপস্থিত হয়। বাণিজ্যিক প্রতিযােগিতায় অন্যান্য ইউরােপীয় বণিক সংস্থা তাদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়তে থাকে।
স্পেনের সাথে যুদ্ধের ফলে এবং নিজেদের মধ্যে কলহের দরুণ ফরাসী বণিকদের বাণিজ্যের অবনতি হয়েছিল। সম্রাট ফররুখশিয়ার ওলন্দাজ বণিকদের জন্য বাণিজ্য শুল্ক হ্রাস করে শতকরা ২ টাকা ধার্য করেছিলেন। মুর্শিদকুলি ফরাসি বণিকদেরকেও শুল্ক বিষয়ে অনুরূপ সুবিধা দান করেন। এর ফলে ফরাসীদের বাণিজ্য আবার উন্নতির পথে অগ্রসর হয়।
উল্লেখ্য যে, মুর্শিদকুলি খানের সময়ে বাংলায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রভূত প্রসার হয়। সপ্তদশ শতক থেকে ইউরােপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলাে বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে থাকে। তারা এখানে থেকে সিল্ক, সূতীবস্ত্র, লাক্কা, চিনি, চাউল এবং শােরা (গন্ধক) প্রচুর পরিমাণে ইউরােপে এবং অন্যান্য স্থানে রপ্তানি করত। এই সময়ে ইউরােপীয়দের রপ্তানি তালিকায় শােরা, সিল্ক, সুতীবস্ত্র অত্যধিক প্রাধান্য লাভ করে। তাদের আমদানি ছিল সাধারণত গরম কাপড়।
মুর্শিদকুলি খান আয়ব্যয়, লেনদেন, ব্যবসা বাণিজ্য অর্থাৎ সমগ্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ভাল বুঝতেন, দেশের সমৃদ্ধিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই তিনি ইউরােপীয় কোম্পানির সুযােগ সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখতেন। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করায় ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা হয়, পণ্য আনানেওয়ার প্রতিবন্ধকতা দুর হয় এবং যােগাযােগ ব্যবস্থাও নির্বিঘ্ন হয়। তবে মুর্শিদকুলি খান ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি এবং কর ফঁকি বরদাশত করতেন না।
মুর্শিদকুলি খান ইংরেজদেরকে এ ফরমানের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করতে দেননি। তিনি পরিষ্কারভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার কেবলমাত্র সেসব দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে, যেগুলাে সরাসরি ভারত থেকে সমুদ্রপথে আমদানি বা রপ্তানি করা হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসার ক্ষেত্রে এই সুযােগ পাওয়া যাবে না। কলকাতার সন্নিকটে ৩৮টি গ্রাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে তিনি বাধা সৃষ্টি করেন। ফলে স্থানীয় জমিদারগণ ওই গ্রামগুলাে বিক্রি করতে নিষেধ করেন। একইভাবে তিনি ইংরেজদেরকে মুর্শিদাবাদ টাকশালও ব্যবহার করতে দেননি।
কোম্পানি মুর্শিদকুলি খানকে ভালাে করেই জানত যে, তিনি এ সনদ দ্বারা প্রাপ্ত অধিকারসমূহ হয়ত মানতে চাইবেন না। বাংলার একজন শক্তিশালী এবং বিচক্ষণ সুবাদার হিসেবে মুর্শিদকুলি ইংরেজ বণিকদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির বিপদ বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্য তিনি ইংরেজদেরকে ১৭১৬-১৭১৭ সালে ঘােষিত ফরমান অনুযায়ী বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন।৫৩ কোম্পানি ও নবাবের মধ্যে ক্রমশ খারাপ সম্পর্কের এক বড় কারণ ছিল এ ফরমান। অভাবী সম্রাট হতে অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা হয় এ সনদটি, যা রাজ্যের সার্বভৌমত্বকে মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন করেছিল। কিন্তু তারা এটাও জানত যে, বাংলায় জবরদস্তিমূলক ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য তিনি তাদেরকে কিছু আইনগত ভিত্তি দিয়েছিলেন এবং আইনগতভাবে যুদ্ধ করে সুবিধা আদায়ের সুযােগ দিয়েছিলেন। অনেক সময় দেশীয় বণিকদের কাছে তারা দস্তক বিক্রি করত। এরূপ অপব্যবহারের ফলে সরকারের প্রচুর ক্ষতি হত। নবাব নীতিগতভাবে বাংলায় ইউরােপীয় বণিকদের ব্যবসাবাণিজ্যে উৎসাহ দিলেও এই ধরনের অন্যায় ও অপব্যবহার সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না।
এ বিষয়গুলােকে কেন্দ্র করে মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে ইংরেজদের সাথে মাঝে মাঝে বিরােধ বাঁধতাে। ১৭২৬ সালের মে মাসে হুগলি ও মুর্শিদাবাদের ফৌজদার দস্তকের অপব্যবহার সম্পর্কে অভিযােগ জানিয়ে কলকাতা কাউন্সিলকে চিঠি পাঠান। কলকাতা কাউন্সিল এই অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইংরেজরা নবাবকে নানাভাবে কর ফাঁকি দিতে চেষ্টা করত। তথ্যে উল্লিখিত হয় যে, কলকাতা নগরীর রাজস্ব বকেয়া (৪০০০ রূপী) রাখার দায়ে ১৭২৬ সালে কোম্পানির উকিলকে মুর্শিদাবাদে আটক রাখা হয়। এই ইস্যুতে কোম্পানি ও নবাব মুর্শিদকুলি খানের মধ্যে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে এবং পরিশেষে মুর্শিদাবাদের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ফতেহ চাঁদের (পরবর্তীতে জগৎ শেঠ নামে পরিচিত) মধ্যস্থতায় সংকট নিরসন হয়।
মুর্শিদকুলি খানের সময়ে অনেক সাহা পরিবার রাজপুতানা থেকে এসে বাংলায় হুণ্ডী ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়। এদের মধ্যে হিরানন্দ সাহার পরিবার প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং তারাই পরে জগৎ শেঠ উপাধি পেলে জগৎ শেঠ পরিবারের উত্থান হয়। হিরানন্দের এক ছেলে মাণিক চাঁদ বাংলায় আসেন এবং নগর শেঠ উপাধি লাভ করেন। মাণিক চাঁদের মৃত্যুর পরে তার ভাগিনা এবং দত্তকপুত্র ফতেহ চাদ তার মহাজনী ব্যবসায়ের মালিক হন। এই ফতেহ চাদ ১৭২৩ সালে মুর্শিদকুলি খানের সুপারিশে সম্রাটের নিকট থেকে জগৎ শেঠ উপাধি লাভ করেন।
(৭)
যদুনাথ সরকার মুর্শিদকুলির সময়ে বাংলার অর্থনৈতিক দূরবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক আবদুল করিম এর বিপরীত চিত্র খুব দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন। মুর্শিদকুলির সময়ে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েনি। যেহেতু তখনাে পর্যন্ত জমির মালিকানা জমিদারদের হাতে পুরােপুরি চলে যায়নি (যা ইংরেজ আমলে ঘটল) তাই কেবল খাজনা অনদায়ের অভিযােগে কৃষককে তার জমি হতে উচ্ছেদ করা সম্ভব ছিল না। একজন কৃষক স্বচ্ছন্দে ষােলাে বিঘা জমি চাষ করে বছরে ছমাস অবকাশ ও চার-পাঁচ জনের একটি পরিবার প্রতিপালন করতে পারত। রামেশ্বর চক্রবর্তীর ‘শিবায়ন’সহ। অষ্টাদশ শতকের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে লক্ষ করা যায় দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভের জন্য শিব কৃষিকার্যে ব্রতী হয়েছে। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ হয়েও কৃষিকার্যকেই জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্র বলে গ্রহণ করেছিলেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রদত্ত ‘ফিফথ রিপাের্ট’-এ জেমস গ্রান্ট কৃষকদের আর্থিক অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে উপরােক্ত বক্তব্যের সত্যতা মেলে। জেমস গ্রান্ট যে হিসেব দিয়েছেন তাতে এক বিঘার উৎপাদনের মূল্য ছিল ছয় টাকার সমান। তার ভিত্তিতে দেখা যায় বাংলায় ভূমিকর দেওয়ার পরে ‘উপরতলার রায়তদের হাতে থাকত ৬০০ টাকা অবধি আর প্রায় ৫০ টাকা থাকত ‘নিচুতলার’ রায়তদের হাতে।
চাষ ছাড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন কোনাে উদ্ভাবনী শক্তি ছিল না। ১৭২৯ সালে খােদ রাজধানী মুর্শিদাবাদেই এক টাকায় সবচেয়ে ভাল চাল ১ মণ ১০ সের এবং মােটা কুরাশালী চাল ৭ মণ ২০ সের পাওয়া যেত (তখন এক মণ ছিল ৩৭.৫ কেজি)। “এমনকি কেহ এক টাকা ব্যয় করিলেই একমাস পর্যন্ত পােলাও কোর্মা আহার করিতে পারিত। এজন্য তাঁহার শাসনকালে গরিব-দুঃখী সকলেই স্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করিয়াছিল।”৫৪
উৎপাদন পদ্ধতি ও হাতিয়ারে কোনাে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটার জন্য গ্রামগুলি কূপমণ্ডুকতা, স্থবিরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার শিকার হয়ে পড়েছিল। গ্রামে সাধারণত তিন ধরনের লােক বাস করত। জমিদার, তার আমলা এবং কৃষকরা। অবশ্য মহাজনও থাকত কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবু এদের মধ্যে জাতপাতের ভেদাভেদ অত্যন্ত তীব্র ছিল। স্বনির্ভরশীল অর্থনীতিতে নির্ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামগুলির সঙ্গে বহির্জগতের যােগাযােগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। মুদ্রা মজুর, ব্যবসায়ী এবং অংশীদার রায়ত বাস করত তারাও কোনাে না কোনােরকমভাবে ওই জমির সঙ্গেই বাঁধা ছিল।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্ত মালিকেরা কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিজাত দ্রব্য আত্মসাৎ করত কিন্তু রাষ্ট্রের হাতে তা তুলে দেওয়ার ফলে কখনােই পণ্যরূপে বিবেচিত হয়নি। ফলে শহর আর গ্রামের মধ্যে কদাচিৎ পণ্যবিনিময় ঘটেছে।
যেহেতু উদ্বৃত্ত সামাজিক সম্পদের সিংহভাগ সুবাদার এবং আমলারা নিশ্চিন্তে ভােগ করতেন তাই তারা স্বচ্ছন্দে বিলাসবহুল দুর্নীতিপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। অবশ্য মুর্শিদকুলি খান এবং আলিবর্দি খান যােগ্য ব্যতিক্রম ছিলেন। নবাব সুজাউদ্দিন সাকি আর সুরা নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন। এমনকি মুর্শিদকুলি খানের প্রিয় নাতি সরফরাজ খানও (১৭৩৯৪০) একই দোষে দুষ্ট ছিলেন।
(৮)
বিভিন্ন ধর্মের বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে উঠেছিল। ধুর্জটীপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় তাঁর ‘সােসিওলজি অব ইন্ডিয়ান কালচার’ গ্রন্থে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষে তিনটি নির্দিষ্ট ধারার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি সংমিশ্রণের অব্যাহত ধারা, যেমন মুসলমানদের খাদ্য, পােশাক, ভদ্রতার আদব-কায়দা প্রভৃতির অনুকরণ। দ্বিতীয়ত সাধারণ আইন এবং ইসলামীয় দণ্ড বিধির আওতায় হিন্দু-মুসলমানের দীর্ঘকালের বসবাস। আর তৃতীয়ত সামাজিক রীতিনীতি যা আমাদের ব্যবহার, সামাজিক দায় এবং বিধি ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই একইভাবে পালন করে। ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত-ইতিহাস রচনা’ গ্রন্থে হরবংশ মুখিয়া লিখছেন, “একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার আমাদের লক্ষ্য করা উচিত, সপ্তদশ শতকে যখন মারাঠা, শিখ ও জাঠ অভ্যুত্থান দেখা দিল এবং মােগল রাষ্ট্রের সঙ্গে মারাঠী ও শিখদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ বাঁধালাে, তখনাে কিন্তু সামাজিক জীবনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। এমনকি ঔরঙ্গজেবের সর্বাধিক “স্বৈরাচারের পর্বেও হয়নি।”৫৫ সুতরাং এ সময়ে সত্যপীরের কল্পনার মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা সামাজিক দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। সমসাময়িক বহু কবি সত্যপীরের গুণাগুণ করে কাব্য রচনা করেছেন। ঘনরাম চক্রবর্তীর লেখা থেকেই বােঝা যায় কীভাবে ধীরে ধীরে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। হিন্দু কবিরা যখন সত্যপীরের আশীর্বাদ কামনায় গান বাঁধছেন তখন বাংলার শাসক মুর্শিদকুলি খান হিন্দুদের জন্য রাজস্ব দপ্তরের দরজা খুলে দিচ্ছেন। বাংলায় এ সময়ে দলে দলে উদারমতাবলম্বী শিয়া মুসলমানদেরও আগমন ঘটেছিল।
ধর্মভীরু হিন্দু-মুসলমান উভয়েই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত। কিন্তু সমস্ত ধর্মের মধ্যেই ক্রমশ অনাচার আর দূর্নীতি ঢুকে পড়েছিল। ভণ্ড পুরােহিত আর আলেমরা ধর্মভীরু মানুষের অজ্ঞতার পূর্ণ সুযােগ নিয়েছিল। এরা সম্রাটের ধর্মভীরুতার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করছিল। একইভাবে লােকপ্রিয় বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যেও অনেক ভণ্ডের আবির্ভাব ঘটেছিল। ভারতচন্দ্র একবার এরকম ভণ্ডদের দলে ভিড়ে পড়ে পুরী ঘুরে এসেছিলেন। সেখানে দু’বেলা পেট ভরে প্রসাদ খেতেন আর প্রাণভরে হেসে গেয়ে বেড়াতেন।
তবে সবাই কিন্তু ভণ্ড ছিল না। দুই ধর্মের মধ্যেই অনেক প্রকৃত পণ্ডিত ছিলেন। শুধু প্রজারাই নয় স্বয়ং প্রাদেশিক শাসন কর্তারাও ধর্মভীরু ছিলেন। শােভা সিংহ ও রহিম শাহ-এর বিদ্রোহ দমন করে আজিমুসসান সর্বপ্রথম শাহ ইব্রাহিমের দরগায় শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বর্ধমান গিয়েছিলেন। মুর্শিদকুলি খান প্রকৃত সুন্নি মুসলমানের অবশ্য করণীয় আচার অনুষ্ঠানগুলি অতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। ধর্মসভাতেও যােগ দিতেন। প্রতি বছর নিজের হাতে পবিত্র কুরআন নকল করে মুসলমানদের বিভিন্ন তীর্থস্থানে পাঠাতেন।
বাঙালির জীবনে পালা-পার্বণ দোল-দুর্গোৎসবের কোনাে অভাব ছিল না। কথায় আছে বারােমাসে তের পার্বণ। শাস্ত্র নির্দিষ্ট ধর্মীয় উৎসবগুলি খুব ধুমধামের সঙ্গে হত। আলােকসজ্জা আর আতসবাজি পােড়ানাে উৎসবের অন্যতম অঙ্গ ছিল। ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ থেকে জানা যায়, কীরকম আন্তরিকতার সঙ্গে মুর্শিদকুলি খান ১২ রবিউল আওয়াল তারিখে পয়গম্বর হজরত মােহাম্মদের (সঃ) জন্ম-বার্ষিকী ও মহাপ্রয়াণ দিবস পালন করতেন। এই দিনটি প্রতি বছর ভাব-গম্ভীর পরিবেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হত। মাটির প্রদীপ সাজিয়ে মহিনগর থেকে লালবাগ সারারাত আলােকিত করা হত। পয়গম্বর হজরত ইলিয়াস (আঃ) বা খাজা খিজিরের (রহঃ) উৎসবও খুব জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হত। বাঁশের তৈরি খেলনার মতাে ছােট ছােট নৌকায় লাল, নীল পতাকা আর ছােট্ট মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে জলে ভাসানাে হত। এরকম এক নয়, হাজার হাজার নৌকা নদীর জলে ভাসানাের রেওয়াজ ছিল, অনেকে একে ‘বেড়া’ ভাসানােও বলেন। দোল উৎসবের জনপ্রিয়তাকে স্বয়ং মুসলমান সুবাদার মুর্শিদকুলিও এড়িয়ে যেতে পারেননি।
(৯)
মুর্শিদকুলি খান জ্ঞানচর্চার পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। তাঁর দরবারে জ্ঞানী-গুণীর সমাদর ছিল। ‘রিয়াজ উস সালাতিন’-এর লেখকের মতে, মুর্শিদকুলির শিক্ষার পারদর্শিতা জ্ঞানের সমস্ত শাখাতেই প্রসারিত ছিল। তখন ফারসি ভাষা ও শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র ছিল হুগলি। পারস্য থেকে অনেক শিক্ষক ও চিকিৎসক হুগলিতে এসে স্থায়ী বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। আজিমাবাদ (পাটনা) ইসলামি শিক্ষা-দীক্ষার অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল। সৈয়দ গােলাম হােসেন খান তাবতাবায়ী যিনি ১৭১২ সালে ‘সিয়ারউল মুতাক্ষরীণ’ (নবাবি আমল সম্পর্কে একটি অপরিহার্য গ্রন্থ) লেখা শেষ করেন, তিনি আজিমাবাদ শহরের বিদ্যাচর্চা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ছােটবেলার কথা যতদূর স্মরণ করতে পারেন তাতে মনে হয় তাবতাবায়ী অন্তত তিনশাে-চারশাে ছাত্রকে ন’দশ জন অধ্যাপকের নিকট পাঠ নিতে দেখেছেন। অনুমান করা যায়, এরকম ছাত্র-অধ্যাপক সংখ্যায় কম হলেও অন্যান্য শহরগুলিতেও ছিল। হিন্দুদের লেখাপড়া সেই পুরানাে রীতি অনুযায়ী টোলকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এই সময়ে নদিয়া বিদ্যাচর্চার অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল। নালন্দা এবং বিক্রমশীলার মতাে বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবলুপ্তির পর নদিয়াই ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্রভূমি হয়ে দাঁড়াল। নবদ্বীপ, শান্তিপুর এবং গােপালপাড়া এই তিন জায়গায় নদিয়ার তিনটি শাখা ছিল। এ সময়ে নবদ্বীপে প্রায় চার হাজারের মতাে ছাত্র এবং ছ’শাের মতাে শিক্ষক ছিল। ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে নদিয়ায় রামরুদ্র বিদ্যানিধি জ্যোতির্বিদ্যার একটি প্রধান অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করেন।
সাধারণভাবে পাঠশালাতে বাংলা ভাষার চর্চা হত। দলিল, দস্তাবেজ, চিঠি বাংলা ভাষায় লেখা হত। তবে বাংলা গদ্যের মান বিশেষ উন্নত ছিল না, প্রচুর সংস্কৃত ও ফারসি শব্দের বাহুল্য লক্ষ করা যায়। ভাষা শিক্ষার কোনাে প্রণালি ছিল না। স্ত্রীশিক্ষা সম্পূর্ণভাবে অবহেলিত ছিল। দু’একজন পারিবারিক প্রচেষ্টায় স্বশিক্ষিত হলেও বাল্যবিবাহ এক্ষেত্রে প্রচণ্ড অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। বেশিরভাগই নিরক্ষর ছিলেন। এ ব্যাপারে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মহিলাদেরই ছিল একই অবস্থা। বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার অভাব থাকলেও একথা স্বীকার করতে হবে শিক্ষার ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক—যদিও ধর্মশিক্ষাই ছিল প্রধান বিষয়বস্তু।
মুর্শিদকুলি খানের আমলে বাংলায় বিশেষ করে ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর এবং মুর্শিদাবাদে বিভিন্ন ধরনের ইমারত নির্মিত হয়। ঢাকার বেগম বাজারের করতলব খানের পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি মুর্শিদকুলি খানের আমলে তৈরি। এ মসজিদটিতে মুঘল স্থাপত্যের প্রভাব থাকলেও দাক্ষিণাত্যের বাউলি বা কূপ দেখা যাবে এ মসজিদের প্রাঙ্গণে। রাজধানী মুর্শিদাবাদ অপূর্ব ইমারতে সজ্জিত। এই প্রাচীন রাজধানী এখনও দর্শকদের আনন্দের উৎস। ভাগীরথীর বামতীরে অবস্থিত মুর্শিদাবাদে নবাব মুর্শিদকুলি একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাটরা মসজিদ স্থাপন করেন। কাটরা অর্থ বাজার এবং মসজিদটি বাজারের প্রাণকেন্দ্র। কাটরা সংলগ্ন একটি সমাধিতে মুর্শিদকুলি সমাহিত রয়েছেন। মুঘল স্থাপত্যের চরম বিকাশ ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং কাটরা মসজিদ সেই স্থাপত্য কীর্তির একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
(১০)
সমসাময়িক ইতিহাসে সুবাদার মুর্শিদকুলি খান খুবই প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি ধর্মপরায়ণ, নীতিবাগীশ, বিজ্ঞ, বদান্য, উদার, ন্যায়নিষ্ঠ ও প্রজাদরদী ছিলেন। তিনি ধর্মভীরু ছিলেন এবং নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তেন। তাছাড়া সকাল থেকে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত তিনি কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি পবিত্র কুরআন নিজ হাতে নকল করতেন এবং বিক্রয়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে প্রেরণ করতেন। কুরআন বিক্রয়ের অর্থ দিয়েই তিনি তার ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহ করতেন। কুরআন পাঠের চর্চার জন্য তিনি ২৫০০ কারী ও আলেম নিয়ােগ করেন। তিনি একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি ‘মাখফি’ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন।৫৬ তিনি ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ছিলেন। তিনি হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের জন্য রাজকোষ থেকে অর্থদান করতেন। সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য তিনি নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। সপ্তাহে দু’বার তিনি বিচারকার্য করতেন। অত্যাচারী ও উৎপীড়কদের তিনি কঠোর হস্তে শাস্তি দেন।
ঐতিহাসিক আবদুল করিম লিখেছেন, “শাসক হিসেবে মুর্শিদকুলি খান অত্যন্ত কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তার অভিভাবক হাজি শফি ছিলেন একজন দিওয়ান, রাজস্ব প্রশাসনে অভিজ্ঞ ও পটু। মুর্শিদকুলি খানও তাই ছােটবেলা থেকে রাজস্ব প্রশাসনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। দিওয়ান হিসেবে তিনি অপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় দেন এবং স্বীয় কর্তব্যে অবিচল থেকে শাহজাদা এবং সুবাদার আজিমউদ্দিনের সঙ্গেও বিবাদে লিপ্ত হন। কারণ সুবাদারের অবৈধ কাজকর্ম তিনি সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু তিনি সম্রাটের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন এবং সম্রাটের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনাে কাজ করেননি। এই কারণে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তার প্রতি আস্থা স্থাপন করেন। পরবর্তী সম্রাটেরা তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন, কারণ তিনি উত্তরাধিকারের যুদ্ধে কোনাে পক্ষ না নিয়ে নিরপেক্ষ থাকেন। কিন্তু পরবর্তী সম্রাটেরা তাঁর প্রতি সাময়িকভাবে বিরূপ হলেও তারা কেউ তার ক্ষতি করেননি, কারণ তারা সকলেই
জানতেন যে, তিনি ছিলেন একজন যােগ্য ও দক্ষ অফিসার। এই কারণে তিনি ধাপে ধাপে উন্নতি করে শেষ পর্যন্ত প্রাদেশিক সুবাদারের পদে উন্নীত হন।”৫৭
পূর্ববর্তী সুবাদারগণ যেভাবে বাংলাকে শােষণ করেছিল, তা থেকে মুর্শিদকুলি বাংলা সুবাকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সাফল্য আরও বােঝা যায় যখন দেখি তারই সমকালে অন্যান্য সুবাদাররা ছিলেন ব্যর্থ।৫৮ তিনি রায়তদের স্বার্থরক্ষা করে একটি নতুন জরিপ কাজ সমাধা করে রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করেন, সুবার রাজস্ব বৃদ্ধি করেন এবং সুবা বাংলার সার্বিক অগ্রগতির পথ সুগম করেন। তার ব্যক্তিজীবন সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মতাে অনাড়ম্বর এবং বিলাসিতাবর্জিত ছিল। সরকারের প্রাপ্য রাজস্বের বাইরে একটা কড়িও অন্যায়ভাবে আদায় করেননি। তার শাসনকালের শেষ দশ বছর কোনােরকম জুলুমের প্রয়ােজন হয়নি। তাই বাংলার সফল মুঘল সুবাদারদের তালিকায় মুর্শিদকুলি খানের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ঐতিহাসিক সলিমউল্লাহর মতে, শায়েস্তা খানের পর ভারতীয় উপমহাদেশে কোথাও মুর্শিদকুলি খানের মত কোনাে আমির জন্মগ্রহণ করেননি। গ্ল্যাডউইন লিখেছেন: “Excepting Shaista Khan there has not appeared in Bengal, nor indeed in any part of Hindoostan, an Ameer who can be compared with Moorshid Cooly; …for wisdom…for rigid and impartial justice, in redressing wrongs, and punishing offenders.’৫৯
তথ্যসূত্রঃ
১. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৭২, পৃ. ৩৯৭ – ৪২১, অধ্যায়টি যদুনাথ সরকারের লেখা; আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস, ঢাকা, ১৯৬৩; এন কে সিংহ, ইকনমিক হিস্টরি অফ বেঙ্গল (৩ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ, ১৯৬২), খণ্ড-৩, কলকাতা, ১৯৬৮, পৃ. ১-২২।
২. মাসির-উল-উমারা : শাহনওয়াজ খান, এইচ বেভারিজ কৃত অনূদিত, খণ্ড-৩, কলকাতা, ১৯৫২, পৃ. ৭৫১; যদুনাথ সরকারও মুর্শিদকুলিকে দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ সন্তান বলে মনে করেন। (দেখুন-যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০০। আরও দেখুন-কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস-নবাবী আমল, দে’জ পাবলিশিং হাউস, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ৩০)। আবদুল করিম এই তথ্যকে প্রামাণ্য বলে মনে করেন। দেখুন-আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫।
৩. অনিরুদ্ধ রায়, মধ্যযুগের বাংলা, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ২৯১।
৪. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০০।
৫. সলিমউল্লাহ : তারিখ-ই-বাঙ্গালা, এস এম ইমামউদ্দিন সম্পাদিত, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ. ৩৩।
৬. ইন্দো-মুসলিম ইতিহাসে বিভিন্ন আমলে দেওয়ানের বিভিন্ন অর্থ দেখা যায়। সুলতানি আমলে এর দ্বারা বােঝাত বিভাগ বা মন্ত্রণালয়। রাজস্ব বিভাগ দেখাশােনা করতেন সাহেব-ই-দিওয়ান বা খাজা। সম্রাট আকবরের রাজস্ব মন্ত্রীকে বলা হয় দেওয়ান এবং মন্ত্রণালয়কে বলা হয় দেওয়ানি। তিনি রাজস্বকে প্রশাসন থেকে পৃথক করেন। ঔরঙ্গজেবের সময় দেওয়ান ও সুবাদারের দায়-দায়িত্ব পৃথক পৃথকভাবে ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়। উভয়ে সময় সময় সম্রাট-কর্তৃক জারিকৃত আদেশ দ্বারা পরিচালিত হন। দেখুন-আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭।
৭. যদুনাথ সরকার, মুর্শিদকুলি খান, বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট, খণ্ড-৬৬, ১৯৪৬।
৮. টিফেনথেলারের মতে, বর্তমান মুর্শিদাবাদ শহর বাদশাহ আকবরের রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজও এর একটি মৌজার নাম ‘আকবরপুর। গােলাম হােসেন সলীমের গ্রন্থ হতে জানা যায়, আকবরের সময়ে মখসুস খান নামে এক ব্যবসায়ী প্রথমে জায়গাটির উন্নতি সাধন করেন। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে একজন মখসুস খানের নাম পাওয়া যায়, যিনি একজন মুঘল অমাত্য হিসেবে ষােলাে শতকের শেষ দিকে বাংলা ও বিহারে রাজকর্মে নিযুক্ত ছিলেন। মখসুস খান ওখানে একটি সরাইখানা নির্মাণ করেন এবং স্থানটি তার নাম অনুসারে মখসুদাবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। (দেখুনগােলাম হােসেন সলীম, রিয়াজ-উস-সালাতিন-বাংলার ইতিহাস, রামপ্রাণ গুপ্ত কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, সােপান পাবলিশার, নতুন সংস্করণ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ২৮; কে এম মহসিন, এ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট ইন ট্রানজিশান :মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, ১৯৭৩, পৃ. ৪)। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় লিখেছেন যে, মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবাদ আছে যে, সুলতান হুসেন শাহের সময় মুখসূদন দাস নামে এক নানকপন্থী সন্ন্যাসী তাকে অসুখ থেকে সুস্থ করে তােলায় তিনি তাকে ওই স্থান দান করেন এবং ওই সন্ন্যাসীর নাম অনুসারে ওই স্থানটির নাম হয় মখসুদাবাদ। (দেখুন-নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, কলকাতা, ১৯০২, পৃ. ৩৩৮-৩৯)। কিন্তু ঐতিহাসিক কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “বৈষ্ণব মুকসূদন দাসের নামে মুকসুদাবাদ নাম হইয়াছিল, একথা অকিঞ্চিৎকর।” দেখুন- কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬।
৯. এস এম রেজা আলি খান, মুর্শিদাবাদ ও বাংলার নাজিম, পুঁথিপত্র প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ. ১২।
১০. আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩।
১১. নিখিল সুর, আঠারাে শতকের বাংলা, আশাদীপ, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ২৪।
১২. প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা সুবাদারকে সাধারণভাবে বলা হত নবাব। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুকাল (১৭০৭) পর্যন্ত নবাবেরা বাদশাহের অধীনে কাজ করতেন। তাদের নিয়ােগ, পদচ্যুতি, বদলি প্রভৃতি বাদশাহের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত।
১৩. আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।
১৪. অনিরুদ্ধ রায়, ফরাসীদের চোখে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমে বাংলা, ইতিহাস অনুসন্ধান, খণ্ড-১০, ফার্মা কে এল এম, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ২৬২-৬৫।
১৫. অনিরুদ্ধ রায়, মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থা : একটি আলােচনা, ইতিহাস অনুসন্ধান, খণ্ড-১৫, ফার্মা কে এল এম, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ২৭৩। ১৬. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯৯।
১৭. আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস্, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪।
১৮. সুশীল চৌধুরি, নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ২৪।
১৯. গােলাম হুসেন সলীম: রিয়াজ-উস-সালাতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৫।
২০. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, আখাম-ই-আলমগিরি (ঔরঙ্গজেবের চিঠিপত্রের সংকলন, ইহা ‘অ্যানেকডােটস অফ ঔরঙ্গজেব’-এর মূল ফারসি গ্রন্থ, যদুনাথ সরকার কর্তৃক অনূদিত, কলকাতা, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৬৩।
২১. সলিমউল্লাহ, তারিখ-ই-বাঙ্গালা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪-৩৫।
২২. এরকম ব্যবস্থা সম্ভব হল, কারণ মুর্শিদকুলি দীর্ঘকাল উড়িষ্যার দেওয়ান ছিলেন। কিন্তু এই পরিবর্তনের পরেও বাংলায় তেরটি বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত জায়গীর ছিল, তাদের মােট আয় ছিল ৩৩,২৭,৪৭৭ টাকা।
২৩. অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মধ্যযুগে বাংলা ও বাঙালী, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৯৯৯, পৃ. ১৩৩।
২৪. চার্লস স্টুয়ার্ট, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, পৃ. ৭৭।
২৫. সলিমউল্লাহ, তারিখ-ই-বাঙ্গালা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫-৪৬।
২৬. সলিমউল্লাহ, তারিখ-ই-বাঙ্গালা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৫। সম্রাট আকবরের খাজনা তালিকায় মেদিনীপুরকে দেখানাে হয়েছে। উড়িষ্যার জলেশ্বর সরকারের (জিলা) আওতাভুক্ত দুই দুর্গ বিশিষ্ট একটি নগরী হিসেবে। মুর্শিদকুলি খান কর্তৃক এটিকে উড়িষ্যা থেকে বাংলায় স্থানান্তর পর্যন্ত এটি ওরূপই ছিল। মেদিনীপুরের পূর্বাংশ সুহমা বা তমলুকের প্রাচীন নাম তাম্রলিপ্ত রাজ্যের অংশ বিশেষ ছিল। তা অর্থাৎ তামা নাম থেকে তাম্রলিপ্ত হয়েছে। এ ধাতু কোনাে এক সময় প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা হত। দেখুন-ইম্পারিয়াল গেজেট অফ ইন্ডিয়া, বেঙ্গল, খণ্ড-১, পৃ. ৩০১। ২৭. দেখুন- ইম্পারিয়াল গেজেট অফ ইন্ডিয়া, বেঙ্গল, খণ্ড-১, পৃ. ৩০১।
২৮. উইলসনের মতে, ইংরেজ কোম্পানির কুঠিয়ালরা মুর্শিদকুলির সঙ্গে বালাশাের, হুগলি প্রভৃতি স্থানে সাক্ষাৎ করেন।
২৯. সলিমউল্লাহ, তারিখ-ই-বাঙ্গালা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০। আরও দেখুন- কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬। চার্লস স্টুয়ার্ট এই দু’জন হিন্দু কর্মচারীকে মুর্শিদকুলি খানের আত্মীয় এবং দাক্ষিণাত্যবাসী বলে মত ব্যক্ত করেছেন। এই অভিমত যে একেবারেই ভ্রান্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেখুন- কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬।
৩০. সলিমউল্লাহ, তারিখ-ই-বাঙ্গালা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৬।
৩১. ভাষাগতভাবে সায়েরের অর্থ হল দেওয়ানকর। কিন্তু আলােচ্য সময়ে এর দ্বারা ভূমিরাজস্ব ছাড়া সমস্ত আয়কে বােঝাত। দেখুন-আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস্, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯, টীকা।
৩২. গােলাম হােসেন সলীম, রামপ্রাণ গুপ্ত কৃত অনূদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭। সলীম লিখেছেন, “বৎসরের প্রারম্ভে পুণ্যাহান্তে মুর্শিদকুলি খাঁ দুইশত শকটপূর্ণ করিয়া এককোটী তিন লক্ষ মুদ্রা ছয়শত অশ্বারােহী ও পাঁচশত পদাতিক বরকন্দাজ দ্বারা দিল্লিতে রাজস্ব স্বরূপ প্রেরণ করিতেন। জায়গীরের আয় এবং অন্যান্য করও এই সময় প্রেরিত হইত। তদ্ব্যতীত উৎকৃষ্ট হস্তী, টাঙ্গন জাতীয় অশ্ব, পােষা হরিণ ও শিকারী পক্ষী, ঢাকাই মসলিন, শ্রীহট্ট দেশীয় গন্ডার চর্ম নির্মিত ঢাল, শীতলপাটি (যাহার উপর দিয়া সর্পও চলিতে পারে না), গঙ্গাজলি মশারি, গজদন্ত, মৃগনাভি কস্তুরি ও ইউরােপীয় নানাবিধ দ্রব্য পাঠান হইত। রাজস্ব প্রেরণের সময় স্বয়ং নবাব অশ্বারােহণে দলবলসহ রাজধানীর প্রান্ত (ঝিনাইদহ) পৰ্য্যন্ত গমন করিতেন এবং তাহা রিপাের্টে ও সংবাদপত্রে লিখিয়া রাখিতেন। রাজস্ব প্রেরণের প্রণালী এইরূপ ছিল।” দেখুন-গােলাম হােসেন সলীম, রিয়াজ-উস-সালাতিন, রামপ্রাণ গুপ্ত কৃত অনূদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭-৬৮।
৩৩. সীতারামকে যদুনাথ সরকার দক্ষিণ বাংলার অর্ধেকের অধিপতি এবং বাংলার শেষ হিন্দু রাজারূপে বর্ণনা করেছেন (দেখুন- যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১৬-১৭)। এই বর্ণনা অতিরঞ্জিত। তার রাজধানী মােহাম্মদপুর সামরিক দিক থেকে সুরক্ষিত ছিল এবং এখানে তিনি বহু প্রাসাদ ও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সুবাদার ইব্রাহিম খানের শাসনকালে তার অভ্যুদয়ের সূচনা হয়েছিল। ১৭১৩ সালে হুগলির ফৌজদারকে নিহত করে তিনি প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন।
৩৪. অনিরুদ্ধ রায়, অ্যাডভেঞ্চারার্স, ল্যান্ডওনার্স অ্যান্ড রেবেলস, নিউ দিল্লি, ১৯৯৮, পৃ. ১৭৫-১৮৬।
৩৫. রবার্ট ওর্মে, হিস্টরি অফ দ্য মিলিটারি ট্রানজ্যাকসন্স অফ দ্য ব্রিটিশ নেশন ইন হিন্দুস্তান, খণ্ড-২, লন্ডন, ১৭৭৮, পৃ. ৫৩।
৩৬. রবার্ট ওর্মে, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯।
৩৭. গােলাম হােসেন সলীম, রিয়াজ-উস-সালাতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৭-২০০।
৩৮. মুশিদকুলি খান জমিদারদেরকে তাদের এলাকায় জরিপ পদ্ধতি কার্যকারী করতে তার সঙ্গে সহযােগিতা করার জন্য আহ্বান করেন। ক্ষুদ্র জমিদারগণ পরিমাপ কার্য বাস্তবায়নে আমিল ও অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে সহযােগিতা করেন। কেবল কতিপয় বড় জমিদার—যাদের নিকট থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি, তাদেরকে মুর্শিদাবাদে আটক রাখা হয়েছিল এবং তাদের জমিদারিতে পরিমাপ কার্য সম্পন্নের জন্যে বিশ্বস্ত কর্মচারীদেরকে প্রেরণ করা হয়েছিল। তাদের জমিদারিতে জরিপকার্যে বিঘ্ন সৃষ্টি থেকে জমিদারদেরকে বিরত রাখার জন্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। জরিপ প্রথা বাস্তবায়নের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা’র লেখক সলিমউল্লাহ লিখেছেন, “তিনি (মুর্শিদকুলী খান) সুবার জমিদারদের ডেকে পাঠান এবং তাদেরকে আটক রাখার আদেশ দেন। প্রয়ােজনীয় পরীক্ষা এবং চুক্তিপত্র গ্রহণের পর তিনি বকেয়া ও হাল রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রতি মহাল ও চাকলায় অভিজ্ঞ আমিল নিয়ােগ করেন। তিনি রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের জমিদারদের প্রভাব খর্ব করেন। উপরােল্লিখিত আমিলগণ প্রতিটি পরগণায় শিকদার, আমিন, কারকুন ও জমি জরিপদল প্রেরণ করে, প্রতিটি গ্রাম, প্রতিখণ্ড জমি ও প্রতিটি রায়তের আবাদি ও অনাবাদি ভূমির পরিমাপের ব্যবস্থা করেন। এবং এভাবে তিনি জমি বন্দোবস্ত সমাপ্ত করেন। বীজ ক্রয় করার জন্যে দরিদ্র প্রজাদেরকে তাকাবি ঋণ (কৃষিঋণ) প্রদান করা হতাে। চাষাবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানাের ফলে, প্রত্যেক মহালের রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। অতীত ও বর্তমানের (হাস্ত অবুদ) উৎপন্ন শস্যের একটি তুলনামূলক তালিকা তৈরি করা হয় এবং এর ভিত্তিতে রাজস্বের তালিকাসমূহ (আমদানি খান ফস বা ফসল) প্রস্তুত করা হয়। জমিদারদের অতিরিক্ত খরচপত্র (অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহে তাদের অতিমাত্রিক অংশ) বন্ধ হয়ে যায় এবং তাদেরকে পারিশ্রমিক স্বরূপ কেবল ননকর প্রদান করা হয়। বর্ধিত ভূমি রাজস্ব, সায়ের এবং ব্যয় হ্রাস ইত্যাদি রাজকোষের হিসেবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।” দেখুন- সলিমউল্লাহ, তারিখ-ই-বাঙ্গালা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫; গােলাম হােসেন সলীম, রিয়াজ-উস-সালাতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৬; আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস্, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭। সলিমউল্লাহ উপরােক্ত বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুর্শিদকুলি খান জমিদারদের অধীনস্থ ভূমিসহ সকল শ্রেণির ভূমির পরিমাপকার্য করেন এবং অতীত ও বর্তমানের উৎপন্ন ফসলের উপর তিনি রাজস্ব নিরূপণের ব্যবস্থা করেন। অন্য কথায়, তিনি টোডরমলের বন্দোবস্তের আদর্শই অনুসরণ করেন যাতে বিগত দশ বছরের উৎপন্ন ফসল ও তার মূল্যের গড়পড়তার ভিত্তিতে রাজস্ব নিরূপিত হয়। (টোডরমলের পদ্ধতিতে বিগত দশ বছরের উৎপন্ন ফসল ও তার মূল্য রাজস্ব নিরূপণ করার জন্য বিবেচনা করে দেখা হত)।
৩৯. সলিমউল্লাহ, তারিখ-ই-বাঙ্গালা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০; যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১১।
৪০. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৯-১২।
৪১. সলিমউল্লাহ, তারিখ-ই-বাঙ্গালা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০, ৩২।
৪২. মৃত্যুঞ্জয় শর্মা কৃত, রাজাবলী, কলকাতা, ১৮৮৯, পৃ. ১৪৫।
৪৩. গােলাম হােসেন সলীম, রিয়াজ-উস-সালাতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭০-৭১।
৪৪. এন কে সিংহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫।
৪৫. কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০।
৪৬. অথচ দর্পনারায়ণের মৃত্যুর জন্য মুর্শিদকুলি খান দায়ী বলে উল্লেখ করেছেন সলিমউল্লাহ এবং জেমস স্টুয়ার্ট এটি পুরােপুরি মেনে নেন। যদুনাথ সরকারও এদের বক্তব্যকে মেনে নিয়েছিলেন। এটা যে পুরােপুরি মিথ্যা সেটা সমকালীন ইংরেজি দলিল পত্র থেকে আবদুল করিম তা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন। দেখুন-আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭-৬৮
৪৭. আবদুল করিম, মুর্শিদকুলি খান অ্যান্ড হিজ টাইমস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৮।
৪৮. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, দ্য হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০১।
৪৯. যদুনাথ সরকার, দ্য হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০১।
৫০. যদুনাথ সরকার, দ্য হিস্টরি অফ বেঙ্গল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০২।
৫১. মুহাম্মদ মােহর আলি, হিস্টরি অফ দ্য মুসিলমস অফ বেঙ্গল, ইবনে সাউদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, খণ্ড-১, পৃ. ৫৬৮।
৫২. পি জে মার্শাল, ইস্ট ইন্ডিয়া ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দ্য এইটটিন্থ সেঞ্চুরি, অক্সফোর্ড, ১৯৭৬, পৃ. ৯০-৯১।
৫৩. আর সি মজুমদার সম্পাদিত, অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, ম্যাকমিলন, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৫, পৃ. ৬৪২।
৫৪. গােলাম হােসেন সর ইতিহাস ১২০০-১৮৫৭, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০১২, ঢাকা, পৃ. ২০৫।
৫৮. সি আর উইলসন, আর্লি অ্যানালস অফ দ্য ইংলিশ ইন বেঙ্গল, খণ্ড-২, পার্ট-১, লন্ডন, ১৯০০, পৃ. ৪৩; আরও দেখুন শ্যামাপ্রসাদ বসু, মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে বাংলা, দে’জ, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ১৪১।
৫৯. এফ গ্ল্যাডউইন, এ ন্যারেটিভ অফ দ্য ট্রানজাকশান্স ইন বেঙ্গল, কলকাতা, ১৭৮৮, চার্লস স্টুয়ার্ট এর গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত, পৃ. ২৫৬।লীম, রিয়াজ-উস-সালাতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১।
৫৫. হরবংশ মুখিয়া, মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, অন্তর্ভুক্ত-থাপার-মুখিয়া-চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২য় মুদ্রণ, ১৯৮৯।
৫৬. সৈয়দ গােলাম হােসেন খান তাবতাবায়ী : সিয়ারউল মুতাক্ষরীণ, প্রথম খণ্ড, অনুবাদক-এম. আবদুল কাদের, প্রথম প্রকাশ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৮, পৃ. ৩৪৫।
৫৭. আবদুল করিম, বাংলা
লিখেছেনঃ বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আমিনুল ইসলাম