বিশ্ব ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে পৃথিবীর নাভিকুণ্ড আরবের মক্কায় ৫৭০ সালে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। সারা বিশ্বে অবলুপ্তপ্রায় যৌবনকে তিনি যেন ফিরিয়ে আনলেন। যেন ষষ্ঠ শতকের বিপ্ন তার মত এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের জন্য অপেক্ষামানই ছিল। ঐতিহাসিক ফিলিপ কে হিট্টি ‘হিস্টরি অফ দ্য আরবস্’ গ্রন্থে বলেন, “মহান ধর্মীয় ও জাতীয় নেতার আবির্ভাবের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত হয়েছিল এবং সময়টিও ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত।”১ চল্লিশ বছর বয়সে (৬১০ সাল) হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের মাধ্যমে নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং মহাপ্রয়াণ ঘটে ৬৩২ সালে। তার ৬২ বছরের জীবনের মধ্যে শেষ ২২ বছরই (৬১০-৩২) ইসলাম প্রচারের যুগ, বিশেষ করে ৬২২ সালে মদিনায় হিজরতের (জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ) পরের ১০ বছর। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তার নেতৃত্বে শত বিভক্ত আরব সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়, বিভিন্ন গােত্র প্রথার স্থলে সম্মিলিত চিন্তার উদ্ভব ঘটে। এককথায় তাঁর শিক্ষা আরবদের মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করে। তাঁর সমকালীন মুসলমানরা রাজ্য বিজয় শুরু করেন এবং অল্পকালের মধ্যেই আরবরা সামরিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সভ্য জগতের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করে সেখানে ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত মােহাম্মদের (সাঃ) পর খােলাফায়ে রাশেদিনের (ইসলামের চার খলিফা) আমল ৬৩২ থেকে ৬৬১ সাল প্রায় ৩০ বছর এবং ৬৬১ থেকে ৭৫০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০ বছর। উমাইয়া বংশের রাজত্বকাল। তারপর ৫০০ বছরের ওপর রাজত্ব করেন আব্বাসীয় খলিফাগণ ৭৫০ সাল থেকে ১২৫৮ সাল পর্যন্ত। এই সুদীর্ঘ সময়টাই ইসলামের ক্রম-প্রসারণ যুগ। কখনও বিজয়, কখনও অভ্যন্তরীণ সংগঠন। এরই মাঝে ৭১২ সালে খলিফা প্রথম ওয়ালিদের রাজত্বকালে (৭০৫-১৫) ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সিন্ধুদেশ আরবগণ দখল করে মুহাম্মদ বিন কাসিম এর নেতৃত্বে।
সপ্তম শতকের প্রারম্ভে ইসলামের আবির্ভাব ও তার ‘নাটকীয়’ বিস্তার পৃথিবীর ইতিহাসে “একটা বিরাট চমকপ্রদ অধ্যায়।…জগতে যত অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে ইসলামের প্রসার তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। …একটা বেদুইন দলের নিকট প্রাচীনকালের দু-দুটো বৃহৎ সাম্রাজ্য অবিৰ্বাস্য দ্রুত গতিতে কিভাবে ধর্মান্তর গ্রহণ ও পরাজয় বরণ করল, তা ভাবলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। …কিভাবে এত বড় আজগুবি ব্যাপার সম্ভব হল এ প্রণের মীমাংসা করতে গিয়ে ঐতিহাসিকেরা আজও হতভম্ব হয়ে যান।”২ এইচ এ এল ফিসারও বিস্ময়ে বলেন, “এর পূর্বে আরব রাষ্ট্রের হদিস কেউ কোনােদিন পায়নি, তাদের সুসংগঠিত সেনাবাহিনী বা রাজনৈতিক আদর্শের কথা কেউ কোনােদিন শােনেনি। আরবেরা ছিল কবিস্বপ্নবিলাসী, তারা করত যুদ্ধ আর ব্যবসা। তারা রাজনীতির ধার ধারত না, যে ধর্মের পূজারী তারা ছিল তার মধ্যে একীকরণের কিংবা স্থিতির কোনাে শক্তিই কোনােদিন তারা প্রত্যক্ষ করেনি। বহু দেব-দেবীর উপাসনা করত তারা, তাও অত্যন্ত জঘন্যভাবে। অথচ কিছুকাল পর এই অন্ধ অসভ্যেরাই জগতে একটা বৃহত্তম শক্তির অধিকারী হয়ে উঠল—সিরিয়া এবং মিশর করল জয়, পারস্যকে পদানত এবং ইসলামে দীক্ষিত করল, পশ্চিম তুর্কিস্তান এবং পাঞ্জাবের কতকাংশের উপর করল আধিপত্য বিস্তার। বাইজানটাইন এবং বেরবের (বারবারস্ অফ আলজিরিয়া) জাতির কাছ থেকে আফ্রিকা ছিনিয়ে নিল। আর ভিসিগথদের থেকে স্পেন কেড়ে নিল। পশ্চিম কনস্টানটিনােপােলের পূর্বপ্রান্ত ফ্রান্স তাদের ভয়ে কেঁপে উঠল। আলেকজান্দ্রিয়া ও সিরিয়ার বন্দরগুলিতে তাদের জাহাজ তৈরি হল, ভূমধ্যসাগরে নির্ভয়ে চলাফেরা করল, …আর বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের নৌশক্তিকে আহ্বান জানাল প্রতিদ্বন্দ্বিতার। একমাত্র পারস্যবাসীরা ও অ্যাটলাস্ পার্বত্য অঞ্চলের বেরবেররা ছাড়া তাদের তেমন কোনাে বাধাই কেউ দিতে পারল না। এত সহজে তারা কৃতকার্য হল যে অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে এই প্রইে সকলের মনে জাগল, সত্যি তাদের এই অবাধ জয়ের পথে আর কোনাে বাধাই দেওয়া যাবে না? ভূমধ্যসাগরের উপর রােমকদের আধিপত্য গেল নষ্ট হয়ে। ইয়ােরােপের একপ্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সারা খ্রিস্ট জগৎ প্রাচ্যের এক নবীন বিধাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত নতুন প্রাচ্য সভ্যতার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল।”৩
বস্তুত ৬২২ খ্রিস্টাব্দে আরবের বিশ্বনবী হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক ইসলামি প্রজাতন্ত্র স্থাপনের মাত্র একশ বছরের মধ্যে ভারত উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত—একথায় এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরােপ এই তিন মহাদেশে ইসলাম আধিপত্য বিস্তার করতে সম হয় এবং এই তিন মহাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জগৎ তাতে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। ঐতিহাসিক ডডওয়েল তাই বলেছেন,
“The advent of Islam begins a great series of Indian Chronicles…the Muslim Chronicles are far superior to our (English) medieval Chronicles.”
এই দিগ্বিজয়ী আরবদের সম্বন্ধে অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। রামপ্রাণ গুপ্ত বলেন,
“ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পরেই মুসলমানগণ স্বর্ণপ্রসূ ভারতবর্ষের প্রতি সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করেছিল। এই সময় থেকে আরবগণ পরস্বাপহরণ মানসে বহুবার ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন।”৪
রামপ্রাণ গুপ্তর এই ধারণা ভ্রান্তিপূর্ণ ও অগ্রহণযােগ্য। মুসলমানগণ ভারতবর্ষে লুটতরাজ অথবা বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করতে আসেননি। এখানে একটা কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে, যখন হযরত মােহাম্মদের (সাঃ) প্রয়াণের (৬৩২) কুড়ি বছরের মধ্যেই আরবগণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরােপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করল, তখন ভৌগােলিক দিক থেকে ভারতবর্ষ আরবদেশের নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও সেখানে অভিযান করতে কেন এত বিলম্ব? অথচ আরবদের সঙ্গে ভারতবর্ষের পরিচয় ছিল স্মরণাতীতকাল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রে। বস্তুত ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় একশত বছর পরে। (৬১০ হতে ৭১২) আরব মুসলমানগণ ভারতবর্ষের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে সক্ষম হন।
ভারতবর্ষে আরবদের অভ্যুত্থান কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং ইসলামি সম্প্রসারণ নীতির একটি ফলপ্রসূ প্রয়াস বলে মনে করা হয়। আর এ সম্প্রসারণ বা বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছিল শুধু শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার কাজের মাধ্যমেই।৫ তাই এক্ষেত্রে নতুন ধর্মীয় উন্মাদনার বাসনার সূত্র খোঁজা দুষ্কর, অথচ সে উদ্দেশ্য থাকলে তা চরিতার্থের জন্য একশ বছর অপোর দরকার হয় না, ইসলাম সম্প্রসারণ নীতির শুরুতেই সেটা হতে পারত। মুসলিমরা পরস্পাপহরণ করতে আসেননি এক হাতে কুরআন এবং অপর হাতে তরবারি নিয়ে ধর্ম প্রচারার্থেও নয়।৬ অপর এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বলিষ্ঠ ভাষায় বলেন, ভারতবর্ষে বলপূর্বক ইসলাম বিস্তার করা হয়নি, কারণ ইতিহাসে অমুসলমানদের প্রতি অকথ্য নির্যাতনের কোনাে নজির নেই।৭ স্যার টি ডব্লিউ আর্নল্ডের মতে, বল প্রয়ােগ নয়, বরং শান্তিপূর্ণ পন্থায় স্বাভাবিক প্রচারণাই ছিল ইসলাম ধর্ম প্রচারের বৈশিষ্ট্য ও ধারা।৮ তিনি আরও বলেন, অত্যাচারী ও নিপীড়কদের বর্বরতা অথবা গোড়াপন্থীদের নির্যাতনে ইসলাম প্রচারের মূল সূত্র পাওয়া যাবে না, বরং বণিক ও ধর্ম প্রচারকদের অকুণ্ঠ আত্মত্যাগ এবং তাদের শান্তিপূর্ণভাবে ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই ইসলাম পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তার লাভ করে।৯
মানবেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, “আজকে জগতের সত্যিকার শিক্ষিত লােকেরা ইসলামের উত্থান শান্ত ও সহিষ্ণু লােকদের উপর গোঁড়ামির জয়’, এই ঘৃণ্য অভিমত পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইসলামের এই বিজয় অভিযানের কারণ ছিল এক অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে লুকিয়ে। গ্রীস, রােম, পারস্য, চীন, এমনকী ভারতবর্ষেরও প্রাচীন সভ্যতায় ঘুণ ধরে যাওয়ায় বিপুল জনসাধারণ যে চরমতম দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হল তা থেকে বাঁচিয়ে ইসলাম এক আলাে ঝলকিত দেশের নির্দেশ তাদের দিতে পেরেছিল বলেই তার এই অসাধারণ বিস্তার সম্ভব হয়েছিল।…আরবদের বিস্ময়কর সামরিক সফলতা এটাই প্রমাণ করে যে, তাদের তলােয়ার ইতিহাসের সেবায় তথা মানবতার অগ্রগতির পথেই চালিত হয়েছিল।”১০
সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতবর্ষ
সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতবর্ষের সার্বিক অবস্থা আমরা প্রসঙ্গত আলােচনা করতে পারি—
প্রথমত, মহামতি অশােক (খ্রীষ্টপূর্ব ২৭৩-২৩২) এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ভারতবর্ষে একক রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সম হন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ অব্দে তার মৃত্যুর পর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের জন্য এ বিশাল সাম্রাজ্য টুকরাে টুকরাে হয়ে যায়। ৩২৪-১৮৬ খ্রিস্টপূর্ব মৌর্যরা উত্তর ভারতে এক বিশাল অখণ্ড রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্য কিছুটা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের সাথে বিদ্যমান থাকে। এরপর আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে।
প্রাক-ইসলামি যুগে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বশেষ গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে পূর্ব পাঞ্জাবের থানেরের পুষ্যভূতি বংশ। এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন হর্ষবর্ধন (৬০৮-৬৪৮)। দ্বিতীয় রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর ৬০৬ সালে (তার ভাই) হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে বসে উত্তর-পশ্চিম ভারতের সর্বেসর্বা শাসক হিসেবে শাসন শুরু করেন এবং মৌর্য ও গুপ্ত যুগের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। ৪০ বছরের শাসনে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। হর্ষবর্ধনের সময় কাঠেীর স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। সপ্তম শতাব্দীতে দুর্লভবর্ধন একটি শক্তিশালী হিন্দু রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে হিউয়েন সাঙ (৬২৯-৪৫) কাশ্মীর পরিদর্শন করেন।
যশােবর্মন অষ্টম শতাব্দীর প্রথমভাগে কনৌজের ক্ষমতায় আরােহন করেন। তার সময়ে পূর্বে বাংলা হতে শুরু করে উত্তরপশ্চিমে থানের এবং উত্তরে হিমালয় হতে শুরু করে দক্ষিণে নর্মদা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এরপরে বাংলায় দীর্ঘদিন অরাজকতা চলতে থাকে। পরে গােপাল কর্তৃক বাংলায় পাল বংশ প্রতিষ্ঠিত হলে আবার বাংলায় স্বস্তি ফিরে আসে।
৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর সিন্ধু স্বাধীন হয় এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় রাজপুত রাই রাজবংশ। রাজবংশের শেষ শাসক ছিলেন রাই সাহাসি (২য়)। রাই সাহাসির (২য়) জনৈক ব্রাহ্মণমন্ত্রী সিলাইজপুত্র চাচ সিন্ধুতে রাজপুত শাসনের পতন ঘটিয়ে নিজে রাজা হন এবং চাচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। চাচ এর পর পুত্র দাহির সিন্ধুর সিংহাসনে আরােহন করেন। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুরাজ দাহিরকে পরাজিত করে সিন্ধু দখল করেন। রাজা দাহিরের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ছিল না। সিন্ধুর অধিকাংশ আদিবাসী ছিল বৌদ্ধ। ব্রাহ্মণরাজ দাহিরের শাসনকালে তারা যথেষ্ট শােষিত-উৎপীড়িতঅত্যাচারিত হয়েছিল।
হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক শশাঙ্ক (৬০৬-৩৭) গৌড়ের (বাংলা) সিংহাসন দখল করেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর আসামের রাজা ভাস্করবর্মন হর্ষবর্ধনের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে গৌড় দখল করেন। এ সময় পাণ্ড্য, চোল, চেরা বা কেরালা নামে তিনটি রাজ্য ভারতের সুদূর দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। আধুনিক মাদুরা, তিনেভেলী ও ত্রিবাঙ্কুর অঞ্চল নিয়ে পাণ্ড্য রাজ্য গঠিত ছিল। বর্তমান মহীশূর ও মাদ্রাজ জেলা চৌল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। কোচিন ও মালাবার নিয়ে চেরা বা কেরালা রাজ্য গঠিত ছিল। এ রাজ্যগুলাে নিজেদের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকতাে। ফলে এ অঞ্চলে কোনাে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না।
এই আলােচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, আরবদের আক্রমণ ঠেকানাের মতাে কোনাে রাষ্ট্র তৎকালীন ভারতে ছিল না। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংহতি ছিল না। ভি ডি মহাজনের মতে,
“There was no sense of unity which could bring together the various states of India in the face of a common danger. The clash of arms was not between people with any sense territorial patriotism but between the loyal or mercenary personal adherents of ambitious monarchs.”
তৎকালীন রাজাগণ প্রজাবান্ধব না হওয়ায় সাধারণ জনগণের সহানুভূতি অর্জন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সপ্তম ও অষ্টম শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণভাবে রাজতন্ত্র চালু ছিল। রাজা সাধারণত তার বড় ছেলে বা মনােনীত কোনাে সন্তানকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করতেন। রাজ্যের অভিজাত শ্রেণির দ্বারাও রাজা মনােনয়নের দৃষ্টান্ত ভারতে লক্ষ করা যায়। যেমন—বাংলার পাল বংশের রাজা গােপাল, কাঞ্চিতে পল্লবরাজা নন্দিবর্মন এবং থানেধরের রাজা হর্ষবর্ধন অভিজাতবর্গের দ্বারা মনােনীত হয়েছিলেন। নারীরাও রাজার উত্তরাধিকারী মনােনীত হতেন। কাশ্মীর, উড়িষ্যা ও দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে নারীরা উত্তরাধিকারী মনােনীত হয়েছিলেন। সাধারণত রাজাকে পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিভূ মনে করা হত। তিনি একাধারে প্রশাসনিক কার্যাবলির প্রধান, সমর নায়ক এবং প্রধান বিচারপতি। সকল ক্ষমতা রাজার হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে রাজাগণ সাধারণত স্বৈরাচারী হয়ে পড়তেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে এর প্রভাব লক্ষ করা যেত। তাই এযুগে রাজধর্ম প্রজাধর্মে পরিণত হয়েছিল।
রাজার একার পক্ষে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। তাই শাসনকার্যে সহায়তার জন্য তিনি মন্ত্রী নিয়ােগ করতেন। মন্ত্রীদের সংখ্যা নির্ভর করত তৎকালীন পরিস্থিতির উপর। দুই রকমের মন্ত্রী ছিল যথা মন্ত্রী এবং সচিব। কয়েকজন মন্ত্রীর নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। যেমন—সন্ধি বিগ্রহিক (যুদ্ধ ও শান্তির মন্ত্রী), সুমন্ত (পররাষ্ট্র মন্ত্রী), মহাদ্বন্দ্ব দণ্ডনায়ক, মহাবলাধ্যক্ষ্য, অমাত্য, অর্থ পাটা ভিকিত্যা প্রভৃতি। উল্লিখিত মন্ত্রী ছাড়াও পুরােহিত বা রাজগুরু ছিলেন যিনি ধর্ম মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতেন। মন্ত্রীদের মর্যাদা নির্ভর করত তার চরিত্র, মেধা এবং বিস্ততার উপর। মন্ত্রী অফিস অনেক সময় বংশগত ছিল আর সবকিছু নির্ভর করত রাজার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
প্রত্যেকটি রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। উত্তর ভারতের প্রদেশগুলােকে ভুক্তি বলা হত এবং দক্ষিণ ভারতের প্রদেশগুলােকে বলা হত মণ্ডল। রাষ্ট্র অথবা দেশ এ সম্পর্কে প্রযােজ্য হত। প্রত্যেকটি প্রদেশ একজন অফিসারের অধীনে থাকত। বলা হত তাকে উপরিক। একটি প্রদেশ কতকগুলাে জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলাগুলােকে বলা হত বিশ। বিশের প্রধানকে বিশপতি বলা হত। জেলাগুলাে অনেকগুলাে ইউনিটে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেকটি গ্রাম গ্রামপ্রধান কর্তৃক শাসিত হত। গ্রাম পঞ্চায়েত বয়স্কদের নিয়ে গঠিত হত। পঞ্চায়েতে আবার সাব কমিটি ছিল এবং তারা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করত। গ্রামের প্রধানকে অধিকারী বা অধিকারীণ বলা হত। শহরের প্রধান ছিলেন নগরপতি। নগরপতিকে নগরবাসী মনােনীত করতেন। রাষ্ট্রের প্রধান আয় ছিল ভূমি রাজস্ব, সামন্ত কর, বাণিজ্য কর, সেচ কর, রাস্তা কর, ফেরিঘাটের রাজস্ব, খনি রাজস্ব প্রভৃতি। উৎপন্ন পণ্যের ১/৬ অংশ রাষ্ট্রীয় পাওনা ছিল। একে ভাগ বলা হত।
তৃতীয়ত, মুসলিমদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতবর্ষে তিনটি ধর্ম প্রচলিত ছিল। ধর্ম তিনটি হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও হিন্দু বা সনাতনধর্ম। বাংলা ও বিহারে বৌদ্ধধর্ম এবং দক্ষিণ ভারতে জৈনধর্ম প্রচলিত ছিল। গুপ্ত শাসন হতে বৌদ্ধধর্মের পতন এবং হিন্দুধর্মের (সনাতন) পুনর্জাগরণ শুরু হয়। অধিকাংশ রাজা ছিলেন হিন্দু। ফলে হিন্দুধর্ম রাজধর্ম হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। হিন্দুগণ সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ব্রাহ্মণ, সংহারকর্তা হিসেবে শিব এবং পালনকর্তা হিসেবে বিষ্ণুর পূজা করতাে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র প্রধানত এ চার শ্রেণিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিভক্ত ছিল। পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে অত্যাচারীর ভূমিকা পালন করেছিল।
ধর্মীয় ব্যাপারেও শাসনকার্যে ব্রাহ্মণদের অধিকার ছিল একচেটিয়া। বৈশ্য ও শূদ্রগণ ছিল নির্যাতিত, নিষ্পেষিত এবং নিম্নশ্রেণির হিন্দুরা ছিল অস্পৃশ্য। অধ্যাপক মােহাম্মদ হাবিব বলেন, ‘ব্রাহ্মগণ ইচ্ছাপূর্বক জনগণকে অজ্ঞ করে রাখতেন। এভাবে তারা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেন। দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে অত্যাচারী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এ সময় হিন্দুগণ সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ব্রহ্মা, সংহারকর্তা হিসেবে শিব এবং পালনকর্তা হিসেবে বিষ্ণুর পূজা করত। এককথায় হিন্দু ধর্মের শ্রেণিগত বিবাদ-বিসংবাদ এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সাথে হিন্দুদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে মুসলমানগণ অতি সহজেই ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
চতুর্থত, প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা মােটামুটি ভাবে ভালাে ছিল বলা যায়। তবে আরবদের সিন্ধু দখলের পূর্বে বা সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভাঙন লক্ষ করা যায়। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠে। ব্রাহ্মণগণ পৌরােহিত্যের পাশাপাশি হয়ে উঠে ভূ-স্বামী, সেনাধ্যক্ষ্য ও সরকারি আমলা। কৃষকগণ সামন্ত ভূ-স্বামীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে ভূমিহীন কৃষকদের উপর আর্থিক উৎপীড়নের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা, ব্রাহ্মণ ও অভিজাতদের স্বেচ্ছাচারিতার জন্যে সম্পদের সুষম বন্টন ব্যাহত হয়। ফলে একটি শ্রেণির হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হতে থাকে। ভূ-স্বামীরা অত্যন্ত ক্ষমতাশীল হয়ে উঠে।
সমসাময়িক শিলালিপি হতে ব্রাহ্মণদের ভূমি দানের কথা জানা যায়। তবে সীমিত ভাবে হলেও অন্য পেশার মানুষকেও ভূমিদান করা হত। বাংলার সামন্ততান্ত্রিক রাজারা এধরনের ভূমি দানের অধিকারী ছিলেন। উত্তর ভারতের গুর্জর প্রতিহার সাম্রাজ্যের সামন্ত রাজারাও একই ভাবে ভূমি দান করতেন বলে জানা যায়।
বাণিজ্য অনেকের পেশা ছিল। কৃষি ও বাণিজ্যের প্রসারের ফলে শিল্প যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। দেবল, গুজরাট, বারাণসী ও দাক্ষিণাত্যের কাঞ্চি, গােয়া প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। গুজরাট ও বাংলাদেশ বড় শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আর্থিক প্রাচুর্যের জন্য সমাজের উচ্চ শ্রেণির লােকেরা বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতেন।
পঞ্চমত, বিভিন্ন শিলালিপি, দলিলপত্র, সমসাময়িক ইতিহাস গ্রন্থ এবং চৈনিক ও আরব পর্যটকদের বিবরণী হতে তৎকালীন ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে জানা যায়। সে সময়ে হিন্দু সমাজ চার শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। ব্রাহ্মণদের প্রধান পেশা ছিল পৌরােহিত্য করা। ক্ষত্রিয়গণ যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশগ্রহণ করত। বণিক ও বিত্তবান কারুশিল্পীরা নিজেদের বৈশ্য বলে পরিচয় দিত। শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষেরা শূদ্র জাতি হিসেবে পরিচিত হত।
সমাজে বৈশ্য ও শূদ্ররা ছিল অধঃপতিত ও অসহায়। বেদবাক্য শুনলে কিংবা বেদ-গীতা পাঠ করলে তাদেরকে কঠোর শাস্তি ভােগ করতে হত। সমাজে তাদেরকে অপবিত্র ও অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হত। ব্রাহ্মণগণ ছিলেন সমাজের বিশেষ সুবিধার অধিকারী। রাষ্ট্রের গুরুতর শাস্তি হতেও তারা রেহাই পেতেন। হিন্দু ধর্ম ও সমাজের অধঃপতনের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন “ধর্ম কুসংস্কারে ভারাক্রান্ত ছিল ও সমাজ একটি কঠোর বর্ণনীতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, যা বিভিন্ন দলের ভিতর ঐক্য স্থাপনকে অসম্ভব করে তুলেছিল।”
জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা বিদ্যমান থাকায় অন্তঃসাম্প্রদায়িক বিবাহ কদাচিৎ লক্ষ করা যেত। সমাজে বহু বিবাহ, সতীদাহ ও সহমরণ প্রথা ছিল। বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল না। সমাজে অধিকাংশ মানুষই নিরামিষভােজী ছিল। সমাজে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বাংলা, বিহার ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহারগুলাে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল। সমাজের নিম্নশ্রেণির লােক ও দরিদ্র ঘরের সন্তানদের শিক্ষালাভের সুযােগ-সুবিধা ছিল। হিন্দুসমাজ বিভিন্ন বর্ণ, ধর্ম ও শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল।
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের সার্বিক অবস্থার আলােচনায় এটা প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালীন ভারতের রাজ্য কাঠামাের অন্তর্নিহিত ও বাহ্যিক শক্তিতে অবক্ষয় আসে, দুর্বল উত্তরাধিকারীরা রাজ্যের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসে, রাজ্য অন্তর্কলহে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। এরূপ অবস্থায় রাজ্য যখন ব্যর্থ রাজ্যে পরিণত হওয়ার শেষপ্রান্তে তখন শক্তিশালী বিদেশী আক্রমণ হয় শেষ উপলক্ষ। এর ফলে দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত রাজ্য কাঠামাে শক্তিশালী বিদেশী আক্রমণে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
আরব ও ভারত : প্রাচীন সম্পর্ক
আরব, প্যালেস্টাইন, মিশর প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অতি প্রাচীন।১১ মালাবার উপকূল থেকে গ্রীকগণ চাল, আদা ও দারুচিনি আমদানি করতেন।১২ গ্রীক ও রােমানগণ ভারতীয় আমদানি-রপ্তানী সম্পর্কে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তৃতীয় শতকে পিউটিনগােরিয়ানের বিবরণ হতে জানা যায় যে, আলেকজান্দ্রিয়ায় ভারতীয় বণিকদের বসতি ছিল। তৃতীয় শতকের প্রারম্ভে কারাকাল সেটি ধ্বংস করেন।১৩ বম্বে প্রেসিডেন্সির গেজেটিয়ার-এ লুৎফুল্লাহ ফরিদি চৌল, কল্যাণ ও সুপারা নামক স্থানে প্রাক-মুসলিম আরব বসতির কথা উল্লেখ করেন। অ্যাগাথারসাইডস্-এর সময়ে মালাবার উপকূলে প্রচুর আরবীয় বসবাস করতেন। সুতরাং বলা যায় যে, আরবে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার পূর্বেই মালাবার উপকূলে বহু আরবীয় বসবাস করতেন। টলেমি তৎকৃত ভারতীয় মানচিত্রে মেলিজিগােরিস শব্দটি ব্যবহার করেন, যার শেষ অংশটি হচ্ছে দ্বীপবােধক আরবি শব্দ ‘জাজিরাহ’। রেনাে বলেন,
“সবকিছুতেই এটাই বিধাসযােগ্য করে তােলা যে, পারসিকদের সঙ্গে মিলিতভাবে তারা অর্থাৎ আরবীয়গণ চতুর্দশ শতক পর্যন্ত সেসব উপকূলে এমন প্রতিপত্তি খাটান, যেমন খাটাতেন পর্তুগীজরা আরও পরবর্তীকালে।”১৪
উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম মালাবার উপকূলে সপ্তম শতকের শেষের দিকে মুসলমান আরব বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের আগমন হয় এবং সেখানে তাদের প্রথম বসতি স্থাপিত হয়।১৫ ফ্রান্সিস ডে পরম্পরাগত তথ্য বিশ্লেষণ থেকে এই মতকে গ্রহণযােগ্য বলে মনে করেন।১৬ স্টারকও মালাবারের আদি মুসলমান বা মােপলাদের১৭ সম্পর্কে প্রদত্ত তার বিবরণে এই মতকে অনুমােদন করে বলেন, “এটা সুপরিজ্ঞাত যে, সপ্তম শতকের পর থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় বিভিন্ন বন্দরে পারসিক-আরব বণিকরা বিপুল সংখ্যায় বসবাস করতে শুরু করেন ও স্থানীয় মেয়েদের বিবাহ করেন। মালাবারের বসতিই ছিল বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ। সে অঞ্চলের বন্দরসমূহে বণিকদের সকল প্রকার উৎসাহদানের রীতি অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল বলে মনে হয়।”১৮ অন্যদিকে সপ্তম শতকের শেষের দিকে আরব বণিকগণ মালাবার উপকূল দিয়ে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলেও এসেছিলেন। ইবন বতুতার বৃত্তান্ত থেকে স্পষ্ট বােঝা যায় যে, চট্টগ্রামে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগেই সেখানে মুসলিমদের (আরবীয় বণিক ও সুফি) আগমন ও বসবাস শুরু হয়েছিল। চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছিল আরব উপনিবেশ। চট্টগ্রামের ভাষায় প্রচুর আরবি শব্দ ও ক্রিয়াপদের পূর্বে ‘না’ শব্দের ব্যবহার এবং চট্টগ্রামের কতিপয় স্থানের আরবি নাম, যেমন সুলক বহর (সুলকুল বহর), আলকরণ, বাকালিয়া এবং চট্টগ্রামের সমাজজীবনের উপর আরব সংস্কৃতির প্রভাব ইত্যাদি প্রমাণ করে যে, এসময়ে আরবরা চট্টগ্রামে এসেছিলেন বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। ভূগােলবিদ মাসুদি ও সােলায়মানের বিবরণ হতে জানা যায় যে, আরব মুসলমান বণিকেরা সমুদ্রপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্য করত এবং বাংলার সমুদ্র উপকূলের সঙ্গেও তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
গােলাম মকসুদ হিলালী তার ‘ইরান ও ইসলাম’ গ্রন্থে এমন কয়েকটি আরবি শব্দ চিহ্নিত করেছেন, যার মূল ভারতীয়।১৯ সন্দেহ নেই এসব শব্দ বাণিজ্যিক লেনদেনের ফলশ্রুতি। ইসলাম প্রচারের আগে থেকেই ভাষা-বিন্যাসে তারা স্থান করে নিয়েছে। আরবিকে বলা হয় ছন্দোবদ্ধ ভাষা, অর্থাৎ এই ভাষায় নতুন কোনাে শব্দ সহজে স্থান করে নিতে পারে না, যেমনটা পারে ইংরেজি ভাষায়। এমন রিজিড ভাষায় বাংলা বা ভারতীয় কোনাে শব্দের স্থান করে নেওয়াটা উভয়ের মধ্যকার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে স্পষ্টায়িত করে।
অষ্টম শতকে আরব নৌবহর ব্রোচ ও কাথিয়াবাড় উপকূলের বন্দরসমূহ আক্রমণ করে, ফলে আরবদের ব্যবসা ও বসতি স্থাপন ক্রমে সেখানে বিস্তারলাভ করতে থাকে। ভারতে তাদের বসতি স্থাপনের প্রথম প্রত্যক্ষ্য ভাবে নথিভুক্ত প্রমাণও অষ্টম শতক থেকেই পাওয়া যায়।২০ এরপর থেকে মুসলিম প্রভাব দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রায় একশ বছরের মধ্যে মালাবার উপকূলে মুসলিমগণ সুপ্রতিষ্ঠিত হন। বণিকরূপে তাদের স্বাগত জানানাে হয় এবং দৃশ্যত বসতি স্থাপন, ভূমি লাভ ও প্রকাশ্যে ধর্মাচরণের ব্যাপারেও তারা স্বাধীনতা লাভ করেন। বসতি স্থাপনের কিছু পরেই ধর্ম প্রচারে তারা ব্রতী হয়ে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। এভাবে নবম শতকের শেষের দিকে তারা ভারতের পশ্চিম উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েন।
তবে পূর্ব উপকূলে আরবগণ বহু পূর্বে আগমন করেন। দারিউস (৫১৯-৪৮৪ খ্রিষ্টপূর্ব) যখন ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর প্রণালীসমূহ বেঁধে দেন ও মিশরীয় বাণিজ্যকে ধ্বংস করেন তখন ইয়েমেনের বণিকগণ এসবের উত্তরাধিকার লাভ করেন।২১ খ্রিস্টীয় গণনার প্রথম দিককার শতক সমূহে আরব ও ইহুদিরা শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ ভারতে বসতি স্থাপন করেন। গ্রীক ও রােমানগণ। পূর্ব উপকূলের সঙ্গে উল্লেখযােগ্য বাণিজ্য করতেন। গ্রীক ও রােমানদের নৌযান সমূহ অধিকাংশই পরিচালিত হত আরবদের দ্বারা। আরব বণিক চীন যাওয়ার পথে করমণ্ডল উপকূল হয়ে যেতেন। ক্যানটনে প্রাক-মুসলিম আরবদের নিদর্শন এখনও পরিলক্ষিত হয়। কাস্ট-এর মতানুসারে,
“নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইয়েমেন ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই। ক্রমাগত বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।”২২
আরবদেশের সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের সম্পর্ক স্থাপনের (ত্রে দুটি অঞ্চল, বিশেষ করে সিন্ধু এবং দক্ষিণ আরবের উপকূলীয় এলাকাসমূহের দূরত্ব এত কাছের যে, অঞ্চল দুটির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং অন্যান্য যােগাযােগ স্থাপিত হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। প্রাক-ঐতিহাসিক যুগের সম্পর্কের ব্যাপারে যতদূর জানা যায়, নবীগণের (আল্লাহর বার্তাবাহক) জীবন কাহিনি সম্বলিত গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে যে, মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদমকে (আঃ) জান্নাত বা স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করার পর তিনি ভারতের দক্ষিণ উপকূলীয় দ্বীপ শ্রীলঙ্কায় আগমন করেন (তখন দ্বীপটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথেই সংযুক্ত ছিল)। আর আদি মাতা হযরত হাওয়া (আঃ) অবতরণ করেন আরবদেশের জেদ্দাতে। অতঃপর আরাফাতের ময়দানে। এসে স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাৎ ঘটে। এই ভূ-মণ্ডলে আরব ও অবিভক্ত ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে সেটাকেই প্রথম সাক্ষাৎকার বলা যেতে পারে। বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহর বাণী বাহক হিসেবে ফেরেস্তা দেবদূতের সর্দার হযরত জিব্রাইল (আঃ) পৃথিবীর যে স্থানে। প্রথম প্রদার্পণ করেন সেও এই ভারতবর্ষে, যেহেতু প্রথম নবী আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এই ভারতেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ‘তফসীরে জালালাইন’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে পাওয়া যায়, হযরত আদম (আঃ) ভারত হতেই পৃথিবীর কেন্দ্রভূমি মক্কায় রওনা হয়েছিলেন। হযরত আদমের (আঃ) পরে দ্বিতীয় নবী হযরত শিসের (আঃ) বসতি স্থানও ছিল এই ভারতবর্ষ। আযাদ বিলগ্রামীর ‘সাবহাতুল মারজান’ গ্রন্থে এ ধরনের কয়েকটি বর্ণনা একস্থানে সন্নিবেশিত হয়েছে। এভাবে আযাদ বিলগ্রামী তার প্রিয় জন্মভূমির মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
আজাদ বিলগ্রামী একথার দিকেও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, হযরত আদম (আঃ) যখন জান্নাত বা স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত হন, তখন হাজরে আসওয়াদ’ বা পবিত্র স্বর্গীয় কৃষ্ণপ্রস্তর তার সাথেই ছিল। অবশেষে তা শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ভারতের মাটি স্পর্শ করে মুসলমানদের পবিত্রতম স্থান কাবাতে স্থাপিত হয়। এছাড়া আরবীয় ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, দক্ষিণ ভারত থেকে যেসব সুগন্ধীযুক্ত দ্রব্য, ফল এবং মসলা ইত্যাদি আরব দেশে যেত, এগুলাে সেখান থেকে সারা দুনিয়ায় পৌঁছত। এগুলাে মূলত সেসব জান্নাতী বা স্বর্গীয় উপঢৌকনেরই নিদর্শন, যেগুলাে হযরত আদম (আঃ) স্বর্গ থেকে তার সাথে করে এ মাটির পৃথিবীতে এনেছিলেন। এও কথিত আছে যে, আরবি-ফারসিতে ‘তােবা’ নামক যে বৃক্ষটিকে জান্নাতী বা স্বর্গীয় বৃক্ষ বলা হয়, অবিভক্ত ভারতের কয়েকটি ভাষায় সেটি জান্নাতের নাম হিসেবে উল্লেখিত। বিশ্বনবি হযরত মােহাম্মদের (সাঃ) একটি হাদিসও বর্ণনা করা হয় যে, তিনি বলেছেন, “হিন্দুস্তানের দিক থেকে আমার প্রতি স্নিগ্ধ শীতল মৃদু হাওয়ার হিল্লোল ভেসে আসে। অর্থাৎ হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) নিজেও ভারতকে ভালােবাসতেন। হাদিসটি দুর্বল হলেও এ থেকেও অনুমান করা যায় যে, হযরত মােহাম্মদের (সাঃ) শ্রোতারা কিংবা হাদিসের বর্ণনাকারী হিন্দুস্তান তথা এই বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিলেন।
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলি (রাঃ) এমন কথাও বলে গেছেন, যার মর্মার্থ হল “ভারতভূমি— যেখানে হযরত আদম (আঃ) স্বর্গ হতে নেমে এসেছিলেন এবং মক্কা ভূমি যা হযরত ইব্রাহিমের (আঃ) দ্বারা সম্বন্ধযুত্ত, এই দুই স্থান উত্তম ভূখণ্ড।”
হযরত আলিকে (রাঃ) সিরিয়ার এক পণ্ডিত প্রশ্ন করেছিলেন, “বিভূমণ্ডলে সবচেয়ে গুরুত্বব্যঞ্জক দেশ কোনটি?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “সেই দেশ যাকে সরন্দ্বীপ (শ্রীলঙ্কা) বলা হয়, যেখানে হযরত আদম (আঃ) স্বর্গচ্যুত হয়ে নেমে এসেছিলেন।” হযরত মােহাম্মদের (সাঃ) বিখ্যাত সাহাবি বা সহচর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় জানা যায় যে, আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ পাঠানাের পূর্বে সমস্ত আত্মাকে একত্রিত করে প্রশ্ন করেছিলেন, আমি কি তােমাদের প্রতিপালক নই? উত্তরে প্রত্যেক মানুষের আত্মা বলেছিল, নিশ্চয়ই আপনি আমাদের প্রভু। বলা বাহুল্য, এই আত্মা-সমাজের একত্রিকরণ পৃথিবীর যে স্থানে হয়েছিল তা ভারতভূমির মধ্যে গণ্য।
বস্তুত, আরব দেশ এবং অবিভক্ত ভারতের মধ্যে অতি সুপ্রাচীনকাল থেকেই এমন যােগসূত্র স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল যে, এর ফলে উভয় অঞ্চল এবং সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসের উপরই এর একটি প্রভাব পড়ে। ইতিহাসবেত্তারা বলেন, এই উপমহাদেশের উৎপন্ন দ্রব্য এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর প্রয়ােজন ইউরােপ এবং মিশরবাসীর সকল সময়ই ছিল। আরব ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যসামগ্রী জাহাজ যােগে ভারতীয় সামুদ্রিক বন্দর থেকে ইয়ামেন এবং অন্যান্য স্থলপথে সিরিয়া পর্যন্ত পৌঁছত। সেখান থেকে এসব পণ্যসামগ্রী জাহাজে ভর্তি হত এবং ইউরােপ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছত।
যাইহােক, ভারত উপমহাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিম সাগরতীরের হিন্দু রাজাদের সহনশীল নীতির ফলে আরব বণিকগণ উপকূলবর্তী অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকেন। কালিকটের ‘জামােরিন’ নামক হিন্দু রাজা নিম্ন শ্রেণির জনসাধারণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ নাবিকের চাকরি গ্রহণ করে দেশ-দেশান্তরে ব্যবসা উপলক্ষে গমন করেন।২৩ বলা বাহুল্য যে, এদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার হতে থাকে। অবশ্য ধর্মপ্রচারক সুফি-দরবেশদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম বিস্তারে ব্যাপকতা লাভ করে।
ভারতবর্ষে প্রাথমিক অভিযান
সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে ইসলামের আবির্ভাব ও নবােঙ্খিত একটি কেন্দ্রীয় শাসনাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবল বেগ সঞ্চার করে। মুসলিম সামরিক বাহিনী দ্রুত সিরিয়া-পারস্য জয় করে ও ভারত সীমান্তে উপনীত হয়। মুসলিম বণিকগণ পারসিক নৌ-বাণিজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করেন এবং আরব নৌবহর ধীরে ধীরে ভারতীয় সমুদ্রে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সিন্ধু নদীর মােহনায় উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে ক্যাম্বে উপসাগরে গিয়ে মালপত্র আদান-প্রদান করা। এই সূত্রে তারা এ সময়ে ভারতের মালাবার উপকূলেও আসত।
উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদের সময় (৭০৫-৭১৫) সিন্ধু, মুলতান ও তার পার্ববর্তী অঞ্চল বিজিত হয়েছিল।২৪ কিন্তু এই বিজয়ের পূর্বে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের (রাঃ) আমলে (৬৩৪-৪৪) মুসলমানগণ ভারতে তাদের অভিযান শুরু করেন।২৫ তখন থেকে খলিফা হযরত মােয়াবিয়া (রাঃ) পর্যন্ত সিন্ধু ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে সামরিক অভিযান প্রেরিত হতে থাকে। হযরত ওমরের (রাঃ) রাজত্বকালে পারস্য বিজয় সম্পন্ন হবার পর থেকে আরবদের দৃষ্টি পাকাপাকিভাবে ভারতবর্ষের দিকে নিবদ্ধ হয়। প্রথমত, পারস্য জয়ের পর মুসলিম অভিযানকে প্রাচ্যে সুদূরপ্রসারী করার প্রয়ােজনীয়তা ছিল। দ্বিতীয়ত, হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) এবং খােলাফায়ে রাশেদীনের সময় (ইসলামের চার খলিফার সময়কাল, ৬৩২-৬১) থেকে বহু ভাগ্যান্বেষী ব্যবসায়ী বাণিজ্যের জন্য দূর-দূরাঞ্চলে গমন করে প্রাচ্যের ঐধর্য এবং বৈভব সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতবর্ষের সম্পদও সম্ভবত আরবদের আকৃষ্ট করে কিন্তু তারা পরস্পাপহরণ করে সম্পদশালী হতে চাননি। ব্যবসা-বাণিজ্য করে অথবা দেশ জয়ের দ্বারা তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। ইসলামি সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মপ্রচার মুসলমান রাষ্ট্রনায়কদের একটি দায়িত্ব ছিল। সুতরাং রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক কারণেই আরবগণ পারস্য বিজয়ের পর ভারতবর্ষে আগমনের সুযােগের অপেক্ষায় ছিলেন।
হযরত ওমর (রাঃ) ১৫ হিজরিতে (৬৩৬) ওসমান ইবনে আবুল আবি সাকিফি নামক বিজ্ঞ বীরকে আম্মান ও বাহরিনের গভর্ণর নিযুক্ত করেন। এই নিয়ােগের পরেই ওসমান নিজের ভাই হাকামকে বাহরিনের কর্তারূপে নিযুক্ত করে নিজে চলে গেলেন আম্মানে। সেখান হতে তিনি ভারত সীমান্তে সর্বপ্রথম ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে চালুক্যবংশীয় রাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর (৬১১৪২) সমসাময়িককালে একটি অভিযান প্রেরণ করেন বম্বের নিকটবর্তী থানের বিরুদ্ধে। এই অভিযান সমাপ্ত করে তিনি পুনরায় তার অপর ভ্রাতা মুগিরাকে দেবল (বর্তমান করাচি) অঞ্চলে অভিযানের উদ্দেশ্যে পাঠান। বিপুল বাধার সম্মুখীন হয়েও মুগিরা জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ-জয় দ্বারা রাজ্য অধিকার এই অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না বরং ভবিষ্যৎ অভিযানগুলির পথ। নির্দের্শক হিসেবে আঞ্চলিক অভিযান দ্বারা পথঘাট নিরূপণ এবং পরিবেশ যাচাই করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। উত্তাল সমুদ্রে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে নৌ-অভিযান হযরত ওমর (রাঃ) পছন্দ করতেন না এবং এই কারণে তিনি পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের উপকূলে অপর কোনাে অভিযান প্রেরণ থেকে বিরত থাকেন। ঐতিহাসিক তারাচাঁদ লিখেছেন,
“৬৩৬ খ্রীস্টাব্দে প্রথম মুসলিম নৌবহর ভারতীয় জলসীমায় উপনীত হয়। তখন খলিফা উমরের শাসনকাল। বাহরাইন ও উম্মান-এর গভর্ণর উসমান সকীফি সমুদ্র পথে তান-এ সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন। এজন্য খলিফা তাকে তিরস্কার করেন এবং সতর্ক করে দেন যে এমন পরীক্ষামূলক কার্যের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তার স্বজনদের পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে। প্রায় একই সময়ে ব্রোচ ও দবুল-এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু উমরের নিষেধের ফলে সশস্ত্র অভিযান সাময়িক বন্ধ থাকে। খলিফা উমরের আমলে স্থলপথে ভারতে পৌঁছানাের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হয় এবং এ ব্যাপারে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অষ্টম শতকে মুহম্মদ বিন কাসিম-এর সিন্ধু বিজয় ছিল সেই উদ্যোগেরই ফলশ্রুতি।”২৬
তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রাঃ) খিলাফত (৬৪৪-৫৬) লাভ করলে সর্বপ্রথম মুসলিম নৌ-বহর গড়ে ওঠে। তিনি আবদুল্লাহ বিন আমরকে ইরাকের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়ােগ করে তৎকালীন ভারত সীমান্তের সংবাদ সংগ্রহের জন্য নির্দেশ দেন। ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের শাসনকর্তা হিসেবে আবদুল্লাহ বিন আমর কিরমান অধিকার করে সিওস্তান অভিমুখে। যাত্রা করেন। তিনি সিওস্তানের হিন্দু রাজাকে পরাস্ত করে একটি বশ্যতামূলক চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য করেন। অতঃপর বিজয়ী সেনাধ্যক্ষ্য আবদুল্লাহ মাকরান বা বেলুচিস্তান অভিমুখে রওনা হন এবং সিন্ধু ও মাকরানের সম্মিলিত বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। ইতিপূর্বে আবদুল্লাহ অবশ্য হাকিম ইবনে জাবালকে ভারত সীমান্তে প্রেরণ করেছিলেন বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য। তিনি যা রিপাের্ট দিলেন তার সারমর্ম হল—ভারতে আর না যাওয়াই ভালাে, কারণ সেখানে খাদ্য, পানীয় ও সবকিছুরই অসুবিধা। ফলে আবদুল্লাহ ভারতে বিজয় অভিযান পরিচালনা করতে চাইলেও উক্ত সমস্যার কারণে খলিফা হযরত ওসমানের (রাঃ) নির্দেশে তা স্থগিত রাখা হয়।
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলির (রাঃ) শাসনকালে (৬৫৬-৬১) ৬৫৯ সালের শেষের দিকে হারিস বিন মুররা আল আবাদি ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বিজয় লাভ করেন। কিন্তু খােরাসানের সীমান্তবর্তী সিন্ধুর অন্তর্গত কাইকান নামক স্থানে ৬৬২ সালে কিছু সৈন্য ছাড়া সকলে শত্রুর হাতে নিহত হন।
খলিফা মােয়াবিয়ার (রাঃ) রাজত্বকালে (৬৬১-৮০) ৬৬৪ সালে মুহাল্লাব বিন আবু সাফরা ভারত সীমান্তে অভিযান পরিচালনা করেন এবং বান্না ও আহওয়াজ পর্যন্ত গমন করেন। এটি কাবুল ও মুলতানের মধ্যবর্তী স্থান ছিল। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে তিনি স্থানীয় শাসকদের সঙ্গে কঠোর সংগ্রামও করেছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণবশত তার এই অভিযান এখানেই শেষ হয়ে যায় এবং তিনি সেখানে মৃত্যু মুখে পতিত হন। মুহাল্লাবের মৃত্যুর পর মােয়াবিয়া আব্দুল্লাহ বিন সওয়ার আল আবাদিকে ভারত সীমান্তে প্রেরণ করেন। তিনি কাইকানের যুদ্ধে জয়লাভ করে বিদেশীর ভূমিকায় কিছু মালপত্র নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। অবশ্য পরে তুর্কি দস্যুর আক্রমণে তিনি নিহত হন। তারপর আজদ গােষ্ঠীর রাশেদ ইবনে আমর জদিদি কাইকানে সংগ্রাম পরিচালনা করে এটা পুনর্দখল করে নেন। কিন্তু কিছুদিন পর ময়দ-দেবল’ নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ হয়, তাতে তিনি নিহত হন। এহেন সংবাদ পেয়েই সেনান ইবনে সালমা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে আবার বিজয়ীদের আহ্বান জানান। পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। এবার সেনান জয়লাভ করেন ও দু’বছর সেখানে শাসনকার্য চালান। তিনি একজন সৎ ও সদাচারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সৈন্যদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের জন্য শপথ গ্রহণ করেন। অতঃপর মােয়াবিয়া আবদুল্লা ইবনে জিয়াদকে সামরিক বাহিনীর প্রধান করে ভারত সীমান্তে পাঠান। তিনি মাকরান ও তার পার্শ্ববর্তী নগরসমূহ দখল করেন। এরপর মুনজির ইবনে জরুদ আবদি ভারত সীমান্তে আসেন। এবং নুকান ও কাইকান জয় করেন।
উমাইয়া খিলাফত (৬৬১-৭৫০) প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামি সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নবযুগের সূচনা হয়। খলিফা প্রথম ওয়ালিদের (৭০৫-৭১৫) রাজত্বকালে একদিকে স্পেন অপরদিকে সিন্ধু অঞ্চল ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ওয়ালিদের প্রাচ্য দেশীয় প্রদেশসমূহের সুযােগ্য শাসনকর্তা তথা ইরাকের গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের (৬৯৪-৭১৪) অদম্য প্রচেষ্টায় শুধু খােরাসান, বুখারা, সমরকন্দ, ফরগনাই অধিকৃত হয়নি, বরং তার নেতৃত্বে সর্বপ্রথম একটি সুসংবদ্ধ মুসলিম অভিযান ভারতবর্ষে প্রেরিত হয়।
সিন্ধু অভিযানের কারণ
পূর্ববর্তী এই প্রাথমিক অভিযানগুলির পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে আরব মুসলমানদের সিন্ধু অভিযান যে কোনাে আকস্মিক ঘটনা নয়২৭ তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে সিন্ধু অভিযানের বিশেষ কিছু কারণ ছিল—
১. উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫-১৫) দামেস্কের সিংহাসনে আরােহন করেন ৭০৫ সালে। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী শাসক। সৌভাগ্যক্রমে প্রথম ওয়ালিদ মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন জিয়াদ, কুতাইবা, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রমুখ দক্ষ যােগ্য সমরকুশলী সেনাপতি লাভ করেন। তিনি স্পেন, মধ্য এশিয়া ও ভারত জয়ের আশা পােষণ করেন। আসলে তার রাজত্বকালে সম্প্রসারণবাদের যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় সিন্ধু অভিযান তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক কারণে ইসলামের সম্প্রসারণ অপরিহার্য ছিল এবং এই কারণে একদিকে যেমন তারিক বিন জিয়াদ স্পেনে অভিযান পরিচালনা করেন, অপরদিকে ভারতবর্ষে মুহম্মদ বিন কাসিম অভিযান পরিচালনা করেন।
২. সিন্ধু অভিযানের পেছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণারও একটা বড় ভূমিকা ছিল। নতুন নতুন অঞ্চল দখল করে সেখানে ইসলামের বিস্তার করা সেকালের অর্থাৎ ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের বিজেতাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
৩. পারস্য বিজয়ের ফলশ্রুতিস্বরূপ মুসলিম বাহিনী মাকরান বা বেলুচিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল কেরান অধিকার করলে তারা রাজা দাহিরের সিন্ধু রাজ্যের অতি সন্নিকটে এসে পড়েন। রাজা দাহির মাকরানের শাসনকর্তার সাথে একত্রিত হয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার প্রয়াস পান কিন্তু আরব সেনাপতি আবদুল্লাহ বিন আমর শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করেন। এর ফলে একদিকে যেমন সম্প্রসারণ ব্যতীত মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমান্ত অরক্ষিত থাকবার সম্ভাবনা থাকে, অপরদিকে রাজা দাহিরের শত্রুভাবাপন্ন মনােভাব এবং সামরিক হস্তক্ষেপ মুসলমানদের যুদ্ধাভিযানে উৎসাহিত করে।
৪. মুসলিমগণ বুখারা, সমরখন্দ, ফরগনা প্রভৃতি অঞ্চল সিন্ধু বিজয়ের পূর্বেই দখল করেন। সবশেষে অষ্টম শতকের প্রথম দশকে ইবন আল হারিরির নেতৃত্বে মাকরান বা বেলুচিস্তান দখলের মাধ্যমে সিন্ধু বিজয়ের পথ প্রশস্ত হয়। কেননা এসব অঞ্চল থেকে মুসলিম সমরকুশলীগণ সিন্ধুর ভিতর-বাহির অভ্যন্তরীণ সমস্যার সবকিছুই অনুধাবন করতে থাকেন। বিশেষ করে সিন্ধুর সামরিক দুর্বলতা মুসলিমদের অজানা ছিল না। সেইসঙ্গে জাঠ ও মেধদের সহযােগিতার আঘাস আরবদের সিন্ধু অভিযানে উৎসাহিত করে। বহু যুগ পূর্ব হতে নির্ভীক আরব নাবিকগণ ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ক্রমশ তাদের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করতে থাকে। হরমুজ বন্দর ও পারস্যের অন্যান্য বন্দর থেকে আরব বণিকগণ ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূল এবং সিংহলে সমুদ্রযাত্রা করত। অসংখ্য আরব বণিক এই সমস্ত অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বসবাস করত। ব্যবসার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যই আরবদের সিন্ধু আক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
৬. প্রাচীনকাল হতে আরবের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ভারতের বিশাল ধন-সম্পদের সাথে আরব বণিকগণ পরিচিত ছিলেন। খলিফাগণ মুসলিম বাহিনীদের আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টি চিন্তা করে নতুন নতুন রাজ্য জয়ের অনুমতি দিতেন। আরব খলিফাগণ এ কারণে ভারতে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন।
৭. ইরাকের গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের (৬৯৪-৭১৪) কঠোর শাসনে বহু ইরাকী বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই বিদ্রোহীরা সীমান্ত পেরিয়ে সিন্ধুরাজ দাহিরের রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। হাজ্জাজ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দূত পাঠিয়ে দাহিরকে বিদ্রোহীদের প্রত্যর্পণ করার দাবী জানান। কিন্তু উদ্ধত স্বভাবের দাহির তা করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে হাজ্জাজ দাহিরকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি সুসংঘবদ্ধ সৈন্যদল প্রেরণ করেন এবং বিদ্রোহীদের হস্তগত করবার প্রয়াস পান।
৮. আরবদের সিন্ধু অভিযানের প্রত্যক্ষ্য কারণ কারাে মতে, সিংহলরাজ (শ্রীলংকার রাজা) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন উমাইয়া খলিফার প্রতি আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ আটটি জাহাজে করে উপঢৌকন প্রেরণ করেন।২৮ সে জাহাজগুলাে সিন্ধুর দেবল বন্দরে জলদস্যু কর্তৃক লুষ্ঠিত হয়। ইরাকের প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধুরাজ দাহিরের নিকট লুণ্ঠিত জাহাজগুলাের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু তার দাবি সিন্ধুরাজ দাহির কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়।
৯. কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন, সিংহলে যে সমস্ত আরব বণিক বাণিজ্যিক স্বার্থে বসবাস করতেন, তাদের অনেকের মৃত্যু ঘটে। তখন তাদের পরিবারবর্গকে সিংহলরাজ জাহাজে করে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজের নিকট অর্থাৎ ইরাকে প্রেরণ করছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে দেবলের জলদস্যুরা এই জাহাজ লুণ্ঠন করে।
১০. আবার কারাে মতে, সিন্ধু প্রদেশের উপর সামরিক অভিযানের পেছনে কারণ ছিল আরব বাণিজ্যের উপর সিন্ধুরাজ দাহিরের আক্রমণ। খলিফা আল ওয়ালিদ ত্রীতদাসী ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ের জন্যে কয়েকজন অনুচরকে জাহাজে করে ভারতে প্রেরণ করেন। অনুচরগণ কর্তৃক ত্রীতদাসী ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ের পর ফেরার পথে সিন্ধুস্থ দেবল বন্দরে কতিপয় জলদস্যু কর্তৃক জাহাজগুলাে লুষ্ঠিত হয়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধুরাজ দাহিরের কাছে জাহাজগুলাে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। উত্তরে দাহির বলেন, এগুলাে জলদস্যুদের কাজ এবং তাদের উপর তার কোনাে কর্তৃত্ব নেই। পরােক্ষ ভাবে তিনি হাজ্জাজের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেন। এছাড়া ভারত আগমনে সমুদ্রপথের নিরাপত্তা বিধানে সিন্ধুর বিপক্ষে সামরিক অভিযান প্রেরিত হতে পারে। এককথায় বলা যায়, জলদস্যু ও রাজা দাহিরকে সমুচিত শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে ভারত উপমহাদেশে আরব অভিযান পরিচালিত হয়।২৯ আধুনিক ঐতিহাসিক এস এম ইকরাম এ বিষয়ে লিখেছেন “তখন ইরাকের গভর্নর ছিলেন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ। আরব ইতিহাসে বীরত্ব, সাহসিকতা, প্রশাসনিক যােগ্যতা এবং যুলুম-নিপীড়নের জন্যে হাজ্জাজ অধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। সে সময় সিন্ধুর শাসনকর্তা ছিলেন রাজা দাহির। রাজা দাহির পূর্বেই মাকরানের গভর্নর সাঈদ ইবনে আসলামের হত্যাকারীদেরকে তার দেশে আশ্রয় দিয়ে আরব রাষ্ট্রের সাথে বৈরিতার বীজ বপন করে রেখেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন খলিফা ভারতে সেনা অভিযানের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি রাজা দাহিরের সাথে লড়াই করার প্রয়ােজন বােধ করেননি। এ ঘটনার কয়েক বছর পর শ্রীলংকার রাজা একবার কতিপয় জাহাজ বােঝাই করে হাজ্জাজের নামে কিছু উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন। যাত্রীদের সাথে হজ্জগামী সেসব মুসলমানের স্ত্রী-কন্যা ও শিশু সন্তানরাও ছিল…। প্রতিকূল হাওয়া তাদের জাহাজটিকে দেবল উপকূলে নিয়ে যায়। দেবল ছিল বর্তমান করাচী থেকে অনতিদূরে অবস্থিত তৎকালীন সিন্ধু দেশের সামুদ্রিক বন্দর। দেবলে ‘মেধ’ জলদস্যুরা ঐসব জাহাজের সকল মাল-সামান, সহায়-সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। জাহাজের নারী-পুরুষদের বন্দী করে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আটক করে। হাজ্জাজের কানে এ খবর পৌঁছার পর তিনি বিব্ধ হয়ে উঠলেন এবং রাজা দাহিরের কাছে এ মর্মে দূত পাঠালেন যে, বন্দি মুসলিম নারী-পুরুষদের যেন মুক্তি দেওয়া হয় এবং উপঢৌকনসমূহ রাজধানীতে পৌছিয়ে দেওয়া হয়। রাজা দাহির পত্রোত্তরে জানান, এসব হচ্ছে সামুদ্রিক জলদস্যুদের কাজ। তাদের উপর আমার কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই। দাহিরের এই জবাবে হাজ্জাজ সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি রাজা দাহিরকে উপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্যে ভারতের উপর হামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।”৩০ অথচ সাধারণ পাঠ্য পুস্তকগুলিতে এই ইতিহাসকে এমনভাবে লেখা হয় যেন ইসলাম ধর্ম বিস্তারের জন্যই সিন্ধু প্রদেশে সামরিক অভিযান হয়েছিল।
যুদ্ধের ঘটনা
সিন্ধুরাজ দাহির ও জলদস্যুদের শায়েস্তা করতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৭১১ খ্রিস্টাব্দে উবায়দুল্লাহ ও এর কিছু পরে বুদায়েলের নেতৃত্বে দুটি সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। রাজা দাহিরের পুত্র জয়সিংহ মুসলিম সৈন্যদের পরাস্ত করে ওই দুই সেনাপতিকে হত্যা করে। এই পরাজয়ে হাজ্জাজ অত্যন্ত মর্মাহত হন। বিশেষ করে বুদায়েলের মৃত্যু তাকে অধিক ব্যথিত করে। সুতরাং তিনি খলিফা প্রথম ওয়ালিদের অনুমতিক্রমে ভারতে প্রতিশােধ মূলক আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে ৭১১ সালেই আরেকটি বাহিনী সজ্জিত করেন। এ অভিযানে তিনি তার জামাতা সপ্রতিভ মুহাম্মদ বিন কাসিম কে সেনাপতি নিয়ােগ করেন।৩১ বিন কাসিমের তখন বয়স ছিল মাত্র ১৭। তিনি ইরানের সিরাজ নগর থেকে যুদ্ধযাত্রা করেন। ইতিমধ্যে ছয় হাজার সিরীয় ও ইরাকি সৈন্য, ছয়। হাজার উষ্ট্রারােহী, ৩,০০০ ব্যাকট্রিয় ভারবাহী পশু, মাকরানের কিছু মুসলিম, জাট ও মেধ মুহম্মদ বিন কাসিমের দলে যােগ দেয়। এই সময়ে মাকরানের গভর্ণর ছিলেন মােহাম্মদ হারুন। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিম কে শুধু সৈন্য নয়, প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়েও সহায়তা করেন। এ যুদ্ধে আরবগণ আরুশাখ বা ছােট্ট কণে বা মানজানিক বা বলিস্ত নামে এক প্রকার প্রস্তর নিক্ষেপক কামান ব্যবহার করে। এই কামানের একটিকে চালাতেই ৫০০ জন উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের প্রয়ােজন হত।৩২
আরব বাহিনী পারস্যের (বর্তমান ইরানের) সিরাজ নগর হয়ে মাকরানে (বেলুচিস্তান) উপস্থিত হয়। বিন কাসিম সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। তিনি কান্নাজবুর ও আরমাইল জয় করেন এবং সে স্থান থেকে দেবল বিজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। দেবল বর্তমান পাকিস্তানের করাচী শহরের ৪০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। দেবল ছিল বাণিজ্যিক পােতাশ্রয় ও বন্দর। সেখানকার দূর্গে দাহিরের প্রচুর সৈন্য মােতায়েন ছিল। দূর্গের চারিদিকে পরিখা খনন করে ও পাথর দিয়ে প্রকার নির্মাণ করে তারা নিজেদের সুরক্ষিত রাখার প্রয়াস করেছিল এবং প্রচণ্ড বাধাও দিয়েছিল আরব অভিযানকারীদের। কিন্তু দুর্গের উপর ‘বলিস্ত’ কামান এত ভয়ঙ্করভাবে বর্ষিত হতে লাগল যে, তাদের হার না মেনে উপায় থাকল না। তাছাড়া দেবলে একটি বড় মন্দির ছিল। মন্দিরের উপরে একটি লাল পতাকা উড়ানাে হত। দেবলবাসীর ধারণা ছিল, এই পতাকা যতদিন উড়বে, দেবল ততদিন সুরক্ষিত থাকবে। আরবগণ এ তথ্য স্থানীয়দের মাধ্যমে জানার পর মন্দিরের এ পতাকা ধ্বংস করেন। পতাকা ধ্বংসের ফলে ভীতিজনক অবস্থা তৈরি হয়। জনগণ হতাশায় নিমজ্জিত হয়। তখন দেবলের শাসক ছিলেন রাজা দাহিরের ভ্রাতুস্পুত্র কাকাস। দেবলবাসী তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দেবল আবরদের দখলে আসে। মুহাম্মদ বিন কাসিম দেবলে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। নগরীর নিরাপত্তার জন্য ৪০০০ সৈন্যের একটি গ্যারিসন তৈরি করেন।৩৩ তিনি একজন মুসলিম শাসক নির্বাচিত করে দেবল ত্যাগ করেন।
অতঃপর বিন কাসিম নিরুনের দিকে অগ্রসর হন। থাট্টা হতে হায়দারবাদ সড়কের নিকটবর্তী এক শহর নিরুন। নিরুন শহরটি বৌদ্ধ সন্নাসীদের (সামানি বা শ্ৰমণ) তত্ত্বাবধানে ছিল। তারা বিনা যুদ্ধে মুহাম্মদ বিন কাসিম এর আনুগত্য স্বীকার করে। নিরুন দখলের পর আরবরা মাকরান বা বেলুচিস্তানের দিকে যাত্রা করে। শিবিস্তান বা সেহওয়ান দাহিরের খুড়তুতাে ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তিনি ছিলেন চান্দার-পুত্র বাছেরা।৩৪ তিনি যথাসাধ্য বাধাপ্রদান করেও আরবদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেননি। সেহওয়ান শহরবাসীরা আরবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করলেও সেহওয়ান শাসক সন্ত্রস্ত হয়ে আরব বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।৩৫ সেহওয়ান হতে বিন কাসিম সিসামের দিকে অগ্রসর হন ও জাঠদের বিরােধিতা দমন করেন।
৭১২ খ্রিস্টাব্দের জুনে রাওয়ার নামক স্থানে আরব বাহিনীর বিপক্ষে রাজা দাহিরের পঞ্চাশ হাজার সৈন্য প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। হাতিতে চড়ে রাজা দাহির যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু আরব বাহিনীর একটি তীব্র আঘাতে রাজা দাহির মাটিতে পড়ে যান। তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে তীর নিক্ষেপকারীর সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু মাথায় তরবারির আঘাত পেলে তিনি (রাজা দাহির) মারা যান।৩৬ ২০ জুন, ৭১২ রাজা দাহিরের স্ত্রী রানীবাঈ যখন দেখেন যে, পরাজয় অনিবার্য, তখন তিনি ১৫,০০০ সৈন্য নিয়ে রাওয়ার দুর্গে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। রানীবাঈয়ের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। রানীবাঈ যুদ্ধবন্দি হওয়া থেকে মুক্তি পেতে সকল নারীদের প্রতি জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, “আমাদের সম্মান। নিঃশেষ, আমাদের প্রাণদণ্ড অনিবার্য, পালানাের কোন সুযােগ নেই। চল কাঠ, কার্পাসবস্ত্র এবং তেল সংগ্রহ করি। আমি মনে করি আমাদের আত্মাহুতি দেওয়া এবং আমাদের স্বামীদের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিত।”৩৭ রানীবাঈ তার বক্তব্য মত একটি বাসায় প্রবেশ করেন এবং নিজেদের জ্বলন্ত আগুনে আত্মাহুতি দেন।৩৮ এভাবে আরবগণ মুহাম্মদ বিন কাসিম এর নেতৃত্বে সিন্ধুরাজা দাহিরকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন।
রাওয়ার দখল শেষে মুহাম্মদ বিন কাসিম ব্রাহ্মণবাদের (বাহমনাবাদের) দিকে অগ্রসর হন। ঈশ্বরী প্রসাদ তাঁর গ্রন্থের পাদটীকায় ব্রাহ্মণবাদের পরিচয় সম্পর্কে বলেন,
‘It is a ruined city in the Sinjhora Toluka of Thar and Parker district Sindh (Pakistan).৩৯
এ শহরের শাসক ছিলেন রাজা দাহিরের পুত্র জয়সিংহ (জায়সিয়া)। জয়সিংহ মুহাম্মদ বিন কাসিম এর বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে হেরে যান। শহরবাসী আত্মসমর্পণ করে। রাজা দাহিরের অপর স্ত্রী লাদী এবং দুই কন্যা সুরজদেবী ও পরিমলদেবী যুদ্ধবন্দি হন। শহরবাসীর জীবন, সম্পদ ও জমাজমি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। শহরবাসী। নির্দিষ্ট পরিমাণ জিজিয়া দিতে সম্মত হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিম মুসলিম সেনাদের ভালাে ব্যবহার করার আদেশ দেন।
আলােয়ার ছিল সিন্ধুর রাজধানী। রাজা দাহিরের পুত্র জয়সিংহ ছিলেন সেখানকার প্রশাসক। তার সাথে মুহাম্মদ বিন কাসিমের যুদ্ধ হয়। কিছুদিন অবরােধের পর আলােয়ার দুর্গ অধিকৃত হয় এবং মুহাম্মদ বিন কাসিম চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হন।
সিন্ধু বিজয় সুসম্পন্ন করে আরব বাহিনী মুলতানের দিকে অগ্রসর হয়। সিন্ধুনদের তীরে অবস্থিত উচ নামক দুর্গ দখল করে মুলতানের দুর্গের মূল ফটকে উপস্থিত হন মুহাম্মদ বিন কাসিম। মুলতানের হিন্দুরা প্রায় দু’মাস যাবৎ প্রতিরােধ গড়ে তুলেও পরাজয় এড়াতে পারেনি। ফলে ৭১৩ সালে মুলতানও আরবদের দখলে চলে আসে। মুলতান দখলের সাথে রাজা দাহিরের গােটা রাজ্য দু’বছরের মধ্যে আরবদের দখলে আসে। মুহাম্মদ বিন কাসিম অতঃপর সৌরাষ্ট্রে সৈন্য প্রেরণ করেন, কিন্তু সেখানকার রাষ্ট্রকুট শাসক অচিরেই সন্ধিতে আবদ্ধ হন। আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে তিনি হিন্দের অনেক রাজার নিকট পত্র প্রেরণ করেন। যাইহােক, ‘চাচনামা’৪০ থেকে জানা যায়, দেবল হতে কাশ্মীর সীমান্ত পর্যন্ত অঞ্চল মুহাম্মদ বিন কাসিম এর হস্তগত হয়। তার রাজ্য সীমানা ছিল এরূপ—পূর্বে কাশ্মীর, পশ্চিমে মাকরান, দক্ষিণে দেবল ও আরবসাগর এবং উত্তরে কারডন ও কাইকান পাহাড়।
আরবদের সাফল্যের কারণ
সিন্ধুতে আরব অভিযানের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সিন্ধুর রাজশক্তির দুর্বলতা। রাজা দাহিরের সঙ্গে তার বড় ভাই দাহারসিয়ার সিংহাসন নিয়ে বিরােধ ছিল। এই বিরােধের ফল হিসেবে সিন্ধু রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দাহারসিয়ার মৃত্যুর পর দাহির তার রাজ্য দখল করেন। কিন্তু এ অঞ্চলের সামন্তরা দাহিরের বশ্যতা স্বীকার করেনি। তারা পক্ষান্তরে যুদ্ধে আরবদের সহযােগিতা করেছিল।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এর সিন্ধুজয়ের পশ্চাতে ভারতীয় রাজাদের ও জনগণের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বড় ভূমিকা ছিল, বিশেষত দুটি ধর্ম হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের পারস্পরিক বিরােধিতাও এই বিজয়ে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।৪১ যে সময় মুহম্মদ বিন কাসিমের সেনাবাহিনী আক্রমণ করে, তখন সিন্ধুরাজ দাহিরের কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী নীতির কারণে বৌদ্ধ ও নিম্ন শ্রেণির হিন্দুরা ক্ষুব্ধ ছিল। এ সময় সিন্ধুতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের জনসংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না। রাজা ছাড়াও অভিজাতবর্গ ও উচ্চবর্ণের লােকেরা সকলেই এদের অত্যাচার করতেন। ব্রাহ্মণদের তুলনায় বৌদ্ধ-জৈনরা নিজেদেরকে অসহায় ও নিরুপায় মনে করত এবং তাদের অত্যাচার থেকে মুক্তি চাইছিল। অত্যাচারিত জনগণের অনেকেই মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং যুদ্ধকালে দাহিরের সহযােগিতা না করে মুসলমানদের নিকট রাষ্ট্রের গােপন তথ্য জানিয়ে দিয়েছিল। এছাড়া ব্যবসায়ী, জাঠ, মেধ এমনকি দেবল মন্দিরের একজন ব্রাহ্মণ পুরােহিতও আরব বাহিনীকে সহযােগিতা করেছিল।
দাহিরের রাজ্যটি খুব ঐক্যবদ্ধ ছিল না। দাহির বৌদ্ধদের হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ফলে বৌদ্ধদের একাংশ মুহাম্মদ বিন কাসিম এর সঙ্গে যােগ দেন। স্থানীয় সামন্তদের অনেকেই আবার আরবদের গােপনে সাহায্য করেছিল। দাহিরের সামন্তদের মধ্যে মােকা নামে এক প্রতাপশালী নেতা ও তার ভাই আরবদের সাফল্য নিশ্চিত করে।
তাছাড়া আরবদের বিজিত অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা, ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের সংবাদও সিন্ধুর জনগণ পাচ্ছিল। সেজন্য তারা মুসলমানদের প্রতি সন্ধি ও প্রীতির হাত অগ্রসর করেছিল। আমরা দেখতে পাই যে, ঠিক যে সময় মুহাম্মদ বিন কাসিম এর বিজয়ী সেনা নিরুন শহরে পৌঁছল তখন সেখানকার জনগণ বৌদ্ধপূজারীদের তাদের কাছে পেশ করল এবং জানা গেল যে, তারা নিজেদের বিশেষ দূতকে ইরাকে গভর্নর হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়ে নিরাপত্তা (আশ্রয়) লাভ করে নিয়েছে। সেজন্য তারা মুহম্মদ বিন কাসিমকে সুন্দরভাবে অভ্যর্থনা জানাল। তাদের রসদের ব্যবস্থা করল। তাদেরকে নিজের শহরে নিয়ে গেল এবং পুরােপুরি সন্ধি রক্ষা করল। অর্থাৎ বিজয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক বৌদ্ধরা মুসলমানদের সর্বপ্রকার সাহায্য করেছিল।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এর উন্নত আচরণের প্রভাব সিন্ধুর অন্যান্য বাসিন্দাদের উপর পড়ল। তারা একটা বিষয় জানত যে, আরববাসীরা প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেন, তারা যে বিষয়ে অঙ্গীকার করে, তারা সেটা পূর্ণ করেন। সেজন্য সিওস্তানের বৌদ্ধরা তাদের শাসককে (বিজয় রায়) বলল এবং উপদেশ দিল যে, আপনি মুহাম্মদ বিন কাসিম এর সাথে সন্ধি করে নিন, কিন্তু রাজা বিজয় রায় সেটা মানলেন না, যার ফলে যুদ্ধ হল এবং তিনি পরাজিত হলেন। সেখানকার প্রজারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের আনুগত্য স্বীকার করল। ইতিহাস থেকে এটাও জানা যায় যে, সিওস্তান পর্যন্ত ইসলামি সেনা পৌঁছতে নিরুনের শাসক সর্বপ্রকার সাহায্য করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বরং সেখানকার প্রজাগণও রাজা বিজয় রায়কে সাহায্য করেনি। এই যুদ্ধে মুহম্মদ বিন কাসিম ও তার সেনাবাহিনী কোনােরূপ অত্যাচার করেনি, অন্যায়ভাবে হত্যাও করেনি।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এর উত্তম ব্যবহার দ্বারা সিন্ধু প্রদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রভাবিত হয়েছিল। তিনি যেখানেই গিয়েছেন তাকে সম্বর্ধনা জানানাে হয়েছে। জনগণও এক নতুন রাজার চরিত্র ও কৃতিত্ব দ্বারা এমনই প্রভাবিত হয়েছিল যে, তারাও তার প্রতি আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে ক্ষমা, শান্তি ও স্বস্তি পেয়েছিল। রাজা দাহিরের এক মন্ত্রী শিয়াকর, তিনি বিন কাসিমের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলে ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। শিয়াকরের প্রতি অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করলেন বিন কাসিম, শ্রদ্ধায় কোনাে ত্রুটি রাখেননি। তাকে আমিরদের দ্বারা অভ্যর্থনা জানিয়ে মহামন্ত্রী করে নেওয়া হয়। তারপর থেকে তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিম এর উদারতায় মুগ্ধ হয়ে তার বিস্ত অনুচর তথা পরামর্শদাতা হয়ে উঠলেন।৪২ শিয়াকর একদিন বললেন “হে ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ! আপনি ভূমি রাজস্ব আদায়ের যে পূর্বতন পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন তাতে কোনােরূপ অত্যাচার হয়নি, প্রজাদের উপর রাজস্বের বােঝা চাপানাে হয়নি, সেজন্য প্রজারা অত্যন্ত আনন্দে আছে। প্রজাপালন ও ইনসাফের আইন ও নীতি এইরূপ হয়ে থাকে। সকল শত্রু নির্মূল হয়ে যাবে, প্রজারা সুখে থাকবে এবং দেশ জয় হবে।”৪৩ দাহিরের অপর খুড়তুতাে ভাই কাকাসও (চান্দার পুত্র, তিনি ছিলেন পণ্ডিত ও দার্শনিক) মুহাম্মদ বিন কাসিম এর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।৪৪ মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান এবং বলেন যে, দাহিরের পরিবারের সকলেই জ্ঞানী, গুণী, বিধাসী ও ন্যায়পরায়ণ। এতে কাকাস এতই আনন্দিত হলেন যে, তিনিও তৎক্ষণাৎ মুহাম্মদ বিন কাসিমের এক বিধস্ত অনুচরে পরিণত হন। কাকাস মুহাম্মদ বিন কাসিমের শাসন ব্যবস্থায় কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন। তিনি বিন কাসিমকে সকল বিষয়ে সৎ পরামর্শ দিতেন।৪৫ মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁকে ‘সৌভাগ্যশালী মন্ত্রণাদাতা’ উপাধি দেন।৪৬
সিন্ধুর শাসকবর্গের সবচেয়ে অজ্ঞতা ও অদূরদর্শিত হচ্ছে সমসাময়িককালে আরবে যে বিশাল ধর্ম বিপ্লব ও শক্তিশালী মুসলিম খিলাফতের উদ্ভব ঘটেছে সে সম্বন্ধে কোনাে সংবাদই তারা রাখেননি। আরবরা যখন সিন্ধুর সীমান্তের নিকটবর্তী মাকরান অঞ্চল (বেলুচিস্তান) জয় করল তখনাে দাহির সীমান্ত রক্ষার কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। সিন্ধুদেশের নিম্নভাগে দেবল, নিরুন প্রভৃতি স্থানগুলাে যখন মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হচ্ছিল তখন দাহির বাধা দেওয়ার কোনাে চেষ্টা করেননি।
আরবদের অভিযানের প্রাক্কালে সিন্ধুদেশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে সিন্ধুর সামরিক সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি। দাহিরের সামরিক প্রস্তুতিও ছিল দুর্বল। তার নৌশক্তি ছিল না বললেই চলে। তিনি সিন্ধুর উপকূল, দেবল বন্দর প্রভৃতি মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষায় অক্ষম ছিলেন। পাশাপাশি নৌশক্তিতে সবল হওয়ায় আরবদের পক্ষে দ্রুত সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয়।
সামরিক নৈপুণ্যের দিক থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিম এর সৈন্যবাহিনী দাহিরের বাহিনীর তুলনায় ছিল অনেক বেশি সবল। আট শতকের শুরুর দিক থেকে আরব সৈন্যবাহিনী বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আরব বাহিনীর মধ্যে ছিল যথেষ্ট শৃঙ্খলা এবং আক্রমণের উন্নত কৌশল। সমুদ্রের উপর আরবদের আধিপত্য থাকায় তারা সহজেই স্বদেশ থেকে সৈন্য ও রসদ আনতে সক্ষম হয়েছিল। এস এ এ রিজভি লিখেছেন, “তাক লাগানাে এক ঘটনা বলে বর্ণনা করা চলে মুহাম্মদ বিন কাশেমের সিন্ধু বিজয়ের ব্যাপারটিকে। এ বিজয় ছিল একেবারে চূড়ান্ত ধরনের। আর তা সম্ভব হয়েছিল অধিকতর উপযােগী ও উন্নততর সামরিক কৌশলের সাহায্যে। সমুদ্রপথে ও স্থলপথে তার সৈন্যদের ভিতরে চমৎকার সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলেন তিনি। আর তাতেই তার অভিযান সাফল্যমণ্ডিত হতে পেরেছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে তার দুর্গগুলিকে রক্ষা করার যে চেষ্টা দাহির করেছিলেন তা ছিল নেহাতই দুর্বল ধরনের। তাদের ধরে রাখতে গেলে মনে যে আগ্রহ ও উৎসাহ থাকা প্রয়ােজন তাও বিশেষ ছিল না তার অধীনস্থ রাজপুরুষ ও সর্দারদের। পরিখাবেষ্টিত ব্রাহ্মণবাদের দুর্গে স্থাণু হয়ে অপেক্ষা করছিলেন তিনি সুযােগ বুঝে এগিয়ে গিয়ে শত্রুকে আঘাত হানেননি যখন মহম্মদের সৈন্যদল ও তাদের যুদ্ধাংগুলি রােগে অশক্ত হয়ে পড়েছিল সিন্ধুর উপনদীতীরে।”৪৭
সামরিক শক্তি ছাড়াও সম্পদশালী দেশে রাজ্য বিস্তার ও ধর্মপ্রচারের প্রেরণা মুসলিম বাহিনীকে অতিরিক্ত শক্তি যুগিয়েছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম অত্যন্ত যােগ্যতার সঙ্গে তার সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বলা যায়, আরব বাহিনীতে অবশ্যই ইতিবাচক এমন কিছু ছিল, যা রাজা দাহিরের বাহিনীতে ছিল না। আর এজন্যই আরব বাহিনী বিজয় লাভ করে। রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন যে, দাহিরের যুদ্ধনীতি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। শুধু তাই নয়, বরং দাহিরের প্রজারাও তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুপক্ষে যােগদান করে। তখন দেশে এমন এক ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, শীঘ্রই দেশ মুসলিমদের হস্তগত হবে, সুতরাং যুদ্ধ করা অর্থহীন। দাহিরের প্রতি বিরূপ মনােভাব এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ফলে মুসলমান আক্রমণকারীরা অল্প কষ্টে সিন্ধুদেশ অধিকার করতে সক্ষম হয়।৪৮
মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু
মুলতান জয়ের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম আবু হাকিমের নেতৃত্বে দশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী তৈরি করেন এবং কনৌজ দখলের জন্যে আদেশ দেন। কিন্তু খলিফার নিকট হতে নিষেধাজ্ঞা আসায় আরব বাহিনীর বিজয় পর্ব আপাতত এখানেই শেষ হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিমকে রাজধানীতে ডেকে পাঠানাে হয়, পৌঁছলে তাঁকে কারারুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু শুধু রােমাঞ্চকর নয় বেদনাদায়কও বটে। আসলে রাজনৈতিক কোন্দলে এই আরব সেনাপতি এক অশুভ পরিণতির শিকার হয়েছিলেন। তার মৃত্যু সম্পর্কে বেশ কয়েকটি মত পাওয়া যায় ।
১. রাওয়ারের যুদ্ধে রাজা দাহিরের দুই কন্যা সুরজ দেবী ও পরিমল দেবীসহ বেশ কয়েকজন যুদ্ধবন্দি হিসেবে খলিফার দরবারে প্রেরণ করা হয়। যুদ্ধবন্দিদের সাথে খলিফা সাক্ষাৎ করতে এলে কন্যাদ্বয় মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানীর অভিযােগ আনেন। খলিফা অগ্নিশর্মা হয়ে ঘােষণা করেন যে, এখুনি লবণ মাখানাে গরুর চামড়ায় মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ভরে দ্রুত পাঠানাে হােক। এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই অনুগত সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম নিজেই খলিফার আদেশমতাে লবণ মাখানাে গরুর চামড়ায় নিজেকে মুড়িয়ে অন্যের দ্বারা সেলাই করে নেন। এর তিনদিন পর তিনি মারা যান। তার মৃতদেহ সুরজ দেবী ও পরিমল দেবীর সামনে প্রদর্শন করলে তারা আবেগতাড়িত হয়ে সত্যতা ঘােষণা করেন যে, তারা মাবাবার হত্যার প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিপক্ষে শ্লীলতাহানীর মিথ্যা অভিযােগ এনেছেন। এ সংবাদ অবগত হয়ে খলিফা অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং রাজা দাহিরের দুই কন্যাকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘােড়ার লেজে বেঁধে দিতে আদেশ দেন। ‘চাচনামা’র বর্ণনা অনুযায়ী এই দুই বােনকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়।
যাইহােক, ‘চাচনামা’য় মুহাম্মদ বিন কাসিমের শােচনীয় পরিণতি প্রসঙ্গে উক্ত দু’বােনের যে ঘটনার উল্লেখ৪৯ করা হয়েছে তা কল্পিত। ‘চাচনামা’য় এই ঘটনা যেভাবে বিধৃত হয়েছে তাতে অনেক অসঙ্গতি লক্ষ করা যায়। কোনাে ক্ষেত্রে তখনকার খলিফা আব্দুল মালিক বলা হয়েছে এবং তার রাজধানী বলা হয়েছে বাগদাদ। আব্দুল মালিকের সময় নয়, বরং তার পুত্র আল-ওয়ালিদের সময় সিন্ধু বিজিত হয়েছে এবং উমাইয়া খলিফাদের রাজধানী ছিল দামেস্কে, বাগদাদে নয়। উপরন্তু একজন খলিফা যে কোনাে অভিযােগের সঠিকতা যাচাই না করে কোনাে নিষ্ঠুর আদেশ দিতে পারেন তা কোনাে বিবেকসম্পন্ন লােক গ্রহণ করবে বলে সংশয় আছে। তাছাড়া মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু আল-ওয়ালিদের পর তাঁর ভ্রাতা সােলায়মানের শাসনামলে হয়েছিল বলে আল বালাজুরী মত প্রকাশ করেছেন। এই অবস্থায় ‘চাচনামা’য় বর্ণিত মুহাম্মদ বিন কাসিমের গােচামড়ায় সেলাই অবস্থায় মৃত্যু অসঙ্গতিপূর্ণ ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতার পরিপন্থী। অথচ ভি ডি মহাজন এই কল্পিত কাহিনিকে তাঁর ‘হিস্টরি অফ মিডিয়াভেল ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেমব্রিজ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া’ (খণ্ড-৩) গ্রন্থে এই রােমাঞ্চকর কাহিনির কোনাে ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।৫০
২. খলিফা আব্দুল মালিক (৬৮৫-৭০৫) তার দুই পুত্র আল ওয়ালিদ ও সােলায়মানকে পর পর খলিফা হওয়ার জন্য মনােনীত করেন। কিন্তু প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫-৭১৫) ভাই সােলায়মানের মনােনয়ন বাতিল করে নিজ সন্তানকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফার এ মনােনয়ন সমর্থন করেন। এতে খলিফা সােলায়মান হাজ্জাজ বিন ইউসুফের প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জামাতা হিসেবে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতি তিনি বিরূপ আচরণ করেন। খলিফা সােলায়মান (৭১৫-১৭) হাজ্জাজ বিদ্বেষী ছিলেন। সে হিসেবে হাজ্জাজ ও মুহাম্মদ বিন কাসিমও খলিফা সােলায়মান বিদ্বেষী ছিলেন। সােলায়মানের খলিফা হওয়ার পূর্বেই হাজ্জাজ মারা যায়। এর ফলে হাজ্জাজের পরিবারের উপর বিপদ নেমে আসে।
বিজয় পর্ব স্থগিত রেখে সিন্ধু থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে রাজধানী দামেস্কে ডেকে পাঠানাে হয়। রাজধানীতে পৌঁছলে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। খলিফা সােলায়মানের নির্দেশে হাজ্জাজ কর্তৃক নিহত আহমদ-এর ভাই সালিহ মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হত্যা করে। মীর মাসুমের ‘তারিখ-ই-মাসুমী’ ও ঐতিহাসিক আল্লামা আহমদ ইবন ইয়াহইয়া বালাজুরীর ‘ফুতুহুল বুলদান’ গ্রন্থে৫১ এই ঘটনাকে সত্য বলে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদের লেখায়ও এর সমর্থন রয়েছে।৫২ এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক এস এম ইকরামের বক্তব্যও আমরা তুলে ধরতে পারি। তিনি লিখেছেন,
“চাচনামা’র বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের সৈন্যগণ উত্তর পাঞ্জাবের এমন এলাকায় গিয়ে উপনীত হয় যেখানে ঝিলাম নদী একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় গিয়ে প্রবেশ করেছে। এখানেই কামেীর এবং রাজা দাহির অধিকৃত এলাকার সীমান্ত এসে মিলিত হয়েছে। মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের পূর্ব দিকে অগ্রসর হবার ইচ্ছা ছিল। সুতরাং তিনি কনৌজের কাছে যুদ্ধ পয়গাম পাঠালেন। তার শাসন বলয় পশ্চিমে আজমীর (সম্ভবত মধ্য পাঞ্জাব) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু নানান কারণে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ৭১৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের শ্বশুর ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ মৃত্যুবরণ করেন। তাতে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম শােকাহত হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে খলীফা ওয়ালীদেরও ইনতেকাল ঘটে। তারপর বলা চলে, দামেস্কে এক বিপ্লবই ঘটে যায়। ওয়ালিদের স্থলাভিষিক্ত হলেন তার ভ্রাতা সুলায়মান। তার সাথে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পুরাতন বৈরিতা ছিল। সুলায়মান খলীফা হয়েই হাজ্জাজের সকল নিকটাত্মীয় এবং বন্ধুবান্ধবের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দমননীতি অবলম্বন করেন। মুহাম্মদ ইবনে কাসিমকে সুলায়মান সিন্ধু থেকে ডেকে আনেন এবং তাকে ও তার আত্মীয়-স্বজনকে কঠোর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেন।”৫৩
আরবদের সিন্ধু শাসন
সিন্ধুদেশ জয় করে ভারত ভূমিতে মুসলিম আধিপত্য বিস্তার করার পর বিজয়ােল্লাসে মুহাম্মদ বিন কাসিম বৃথা রক্তপাত, অত্যাচার-উৎপীড়ন করেননি। বরং তিনি ইসলামের শান্তির বাণী সাম্যবাদ সিন্ধুদেশে প্রচার করতে মনােনিবেশ করেন। সেই লক্ষ তার নেতৃত্বে সিন্ধুদেশে একটি উদার, বাস্তব ও যুগােপযােগী ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বিন কাসিমের প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা তাকে সেনাপতি থেকে প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। তিনি ভারতে প্রায় সােয়া তিন বছর (৭১২১৫) অবস্থান করেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেও তিনি রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় যে দক্ষতা ও নিয়ম-শৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পরাজিতদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও উদারনীতি অবলম্বন করে তিনি শত্রুদের মন জয় করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের উদারনীতির জন্য অনেকে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয়, যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি তারাও আরব শাসন মেনে নিয়েছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম হাজ্জাজের নির্দেশমতাে সিন্ধু অধিবাসীদের সব ধরনের নাগরিক অধিকার দিয়েছিলেন।
অথচ দাহিরের পিতা চাচ৫৪ ছিলেন একজন গোঁড়া শাসক। তিনি সিন্ধুতে চাচবংশ প্রতিষ্ঠা করে বৌদ্ধ শাসনকে উচ্ছেদ করে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান। তিনি তার প্রজাদের একাংশের জন্যে কঠোর ও অত্যাচারমূলক আইন চালু করেছিলেন। তাদের জন্যে অস্ত্র রাখা, রেশমি কাপড় পরা, ঘােড়ার পিঠে গদি দিয়ে সওয়ার হওয়াকে তিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন। চাচ-এর কড়া নির্দেশ ছিল, প্রজাদের ওই বিশেষ শ্রেণির লােকেরা নগ্নপদ, নগ্নশির ও কুকুরের সাথে করে চলতে হবে। তিনি চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। চাচের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা চান্দার হিন্দুধর্মের পরিবর্তে বৌদ্ধধর্মকে পৃষ্ঠপােষকতা দান করেন এবং বল প্রয়ােগ করে ধর্মান্তরিত করার প্রয়াস চালান।৫৫ কিন্তু তার মৃত্যুর পর চাচপুত্র রাজা দাহির ভাই দাহারশিয়াকে হটিয়ে সিন্ধুর সিংহাসন দখল করেন এবং পিতাকে অনুসরণ করে পুনরায় ব্রাহ্মণ্যবাদকে চাঙ্গা করতে অত্যাচারমূলক প্রয়াস চালান। অথচ বিজয়ী বিন কাসিম বিজিতদের সাথে বুদ্ধিমত্তা ও সৌজন্যমূলক আচরণ করতেন। ইসলামের ২য় খলিফা হযরত ওমরের (রাঃ) সময়ে (৬৩৪-৪৪) নিয়ম ছিল যে, আরবরা পরাজিত অঞ্চলে কোনাে সম্পত্তি অধিকার করতে পারবেন না। উমাইয়া আমলেও (৬৬১-৭৫০) এ নিয়ম প্রচলিত ছিল। বিন কাসিম সিন্ধু প্রদেশে একই নীতি অনুসরণ করেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম তার অধিকৃত সিন্ধুদেশে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করেছিলেন। সিন্ধুদেশকে তিনি কয়েকটি ইক্তা বা জেলায় ভাগ করেন। ইক্তা পরিচালনা করার জন্য প্রতি ইত্যায় একজন করে আরব সামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। তাদের উপর দায়িত্ব ছিল দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং বিদেশী আক্রমণকে প্রতিহত করা। শাসনকর্তাগণ অনেক েত্রে স্বায়ত্ত্বশাসন ভােগ করতেন। তবে প্রয়ােজনে খলিফাকে সামরিক সাহায্য প্রদান করার ব্যাপারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
বিন কাসিম ছিলেন একজন দূরদর্শী প্রশাসক। তিনি সিন্ধুর প্রচলিত শাসননীতির খুব একটা পরিবর্তন করেননি। তিনি রাজা দাহিরের বেসামরিক প্রশাসনকে শুধু সংস্কার করেন। সিন্ধুর ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় না থাকার জন্যে তিনি আপােস নীতির মাধ্যমে স্থানীয়দের বেসামরিক প্রশাসনে নিয়ােগ দেন। এ কারণে তিনি রাজা দাহিরের সময়কার উচ্চপদস্থ ব্রাহ্মণ কর্মচারীদের স্বপদে বহাল রাখেন। তিনি নগরীর সকল ব্রাহ্মণকে নিয়ে একটি সম্মেলন আয়ােজন করলেন। সেই সম্মেলনে বিন কাসিম ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“দাহারের রাজত্বকালে আপনারা সবাই দায়িত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত ছিলেন। আপনারা অবশ্যই নগরবাসী ও গ্রামবাসী লােকেদের সাথে সুপরিচিত। এদের মধ্যে কোন ব্যক্তি প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত এবং আমাদের কাছ থেকে আনুকূল্য পাবার যােগ্য সেটা অবশ্যই আপনারা আমাদেরকে জানাবেন। তাহলে আমরা তাদেরকে যথাযােগ্য সম্মান ও ন্যায্য আনুকূল্য প্রদান করতে পারবাে। যেহেতু আমি আপনাদের প্রতি সুস্থিত-অভিমত পােষণ করি এবং আপনাদের বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে তাই আমি আপনাদেরকে আগের মর্যাদায় বহাল রাখলাম। রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্মের ব্যবস্থাপনা ও সেগুলাের প্রশাসনিক ক্ষমতা আমি আপনাদের যােগ্য হাতে অর্পণ করলাম এবং বংশানুক্রমিকভাবে এই অধিকার আপনাদের সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের ওপরেও অর্পিত থাকবে। এইভাবে পরবর্তীকালেও এই অনুজ্ঞা বাতিল বা পরিবর্তনের কোনােরকম আপত্তি থাকবে না।”
এরপর ব্রাহ্মণগণ এবং নবনিযুক্ত কর্মকর্তাগণ সেখান থেকে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়লেন। তারা জনসাধারণকে বললেন,
“ওহে রাজ্যের সর্বজনবিদিত ভদ্রলােক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ, আপনাদের সবাই অবগত আছেন যে, রাই দাহার নিহত হয়েছেন এবং তাঁর রাজত্বের চিরতরে অবসান হয়েছে। এখন হিন্দ বা সিন্ধের অন্তর্গত সব রাজ্যই সম্পূর্ণভাবে আরবীয়দের দখলে চলে এসেছে। তাদের কাছে উচ্চ-নীচ, নগরবাসী-গ্রামবাসী কোনাে অসমতা নেই। আমরা গুটিকতক ব্যক্তি যা করছি তা মহান শাসনকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী করছি। আমাদেরকে তারা অত্যন্ত সন্তোষজনক আশা ভরসা দিয়ে বিশেষ কাজে এখানে পাঠিয়েছেন। আমরা যদি এই আরবীয়দের কাছে বশ্যতাস্বীকার না করি এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করি তাহলে কোনাে প্রকার সম্পত্তিও আমরা ফিরে পাবাে না। ভরণপােষণের কোনাে উপায়ও আমাদের থাকবে না। আমরা অসহায়, সম্বলহীন ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এই মুহূর্তে আমরা একমাত্র মহানুভব শাসনকর্তার দয়া ও সদাশয়তার মাধ্যমেই আমাদের অবস্থান ও সম্মান সুরতি করতে পারি।”৫৬
ব্রাহ্মণ, রাজা দাহিরের নিকট আত্মীয় প্রমুখ ব্যক্তি উচ্চপদে নিয়ােগ পেয়েছিল। ভি ডি মহাজন বলেন, ‘বিধর্মীদের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল। অনেকক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের বিন কাসিম আস্ত করেছিলেন এই বলে যে, সেই পদ তাদের বংশধরদের মধ্যেও বজায় রাখা হবে। এই প্রতিজ্ঞা ও আবেদনের ভালাে প্রভাব পড়েছিল। সেই ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে প্রচার করল যে, তারা যদি আরবীয়দের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাহলে তারাও তাদের দয়া-দাক্ষিণ্যের যােগ্য হয়ে উঠবে। ব্রাহ্মণদের দ্বারা এরূপ প্রচারের দরুণ হিন্দু কৃষিজীবীদের উপর বিশেষ প্রভাব পড়ল। ব্রাহ্মণরা রাজস্ব আদায়ের অধিকারও পেয়েছিল। এভাবে মুহাম্মদ বিন কাসিম অতি দ্রুত স্থানীয় অধিবাসীদের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করায় কোনাে দ্বিধা ছিল না।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এর উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই সিন্ধু শাসনের বহু আইন ও আচার-পদ্ধতি অপরিবর্তিত থাকে। তিনি রাজা দাহিরের প্রধানমন্ত্রীকে নিজ পদে বহাল রেখেছিলেন। তার পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা পূর্ণ আস্থার সঙ্গেই হিন্দুদের হাতেই নস্ত হয়েছিল।৫৭ বৌদ্ধদেরও প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তবে সামরিক শাসনভার আরবরা নিজেদের হাতেই রেখেছিল। এ সময় আরব সৈন্যরা বেতন হিসেবে জায়গীর লাভ করত। তবে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে অর্থ দ্বারাও মাসিক বেতন দেওয়া হত। নিজেদের জায়গীরে তারা হিন্দু রমণী বিয়ে করে সামরিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাছাড়া হিন্দু মহিলারাও মুসলমানদের বিবাহ করার অধিকার লাভ করে। স্থানীয় সামন্তরা ইসলাম গ্রহণ না করেও সম্পত্তি ভােগের অধিকার পায়।
প্রদেশ ও জেলায় কাজি-উল-কুজ্জাত নামে বিচারক ছিলেন। তিনি ইসলামি বিধান মতে আইনের ব্যাখ্যা দান, শাস্তি প্রদান ইত্যাদি কাজ করতেন। মীর আদল বিচারককে বিচার কাজে সহযােগিতা করতেন। হিন্দুদের ক্ষেত্রে স্থানীয় পঞ্চায়েতের মাধ্যমে মামলার মীমাংসা করা হত।৫৮ হিন্দুগণ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব আইন ও প্রথাপদ্ধতি অনুসারে বিবাহ, উত্তরাধিকার এবং অন্যান্য সামাজিক বিষয়গুলাে সমাধান করত। আইনের ক্ষেত্রে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে কোনাে ধরনের বিভেদ করা হত না। সকল নাগরিক সমান ও রাষ্ট্রে সকলের সমান অধিকার’ নীতির কারণে সকলে সমানভাবে উপকৃত হয়।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এর সিন্ধুতে একটি শক্তিশালী উদার রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি গ্রাম ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে নিযুক্ত করেন এবং নির্ধারিত হারে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এ নীতি অনুসরণের ফলে স্থানীয় জনসাধারণের মনে সাহস ও নিরাপত্তার ভাব বিরাজ করত। যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের তিনি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। রাজস্ব অফিসারদের প্রতি বিন কাসিমের নির্দেশ ছিল “সুলতান এবং জনগণের মধ্যে সততার সঙ্গে কার্য করুন। যদি কোনাে বন্টন আবশ্যক হয়, তবে সেটি ন্যায়নীতির ভিত্তিতে করুন এবং পরিশােধের সামর্থ্য অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করুন। আপনাদের নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখুন, একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করবেন না, দেশকে দুর্দশায় ফেলবেন না।”৫৯ তিনি রাজা দাহিরের নির্যাতনমূলক কর বিলােপসাধন করেন। রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল ভূমিকর। একে বলা হতাে খারাজ। তাছাড়াও ছিল বাণিজ্য কর, মুসলমানদের জন্য প্রদেয় যাকাত ও সদকা এবং অমুসলিমদের জন্য প্রদেয় জিজিয়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে জলসেচের ব্যবস্থা করা হলে উৎপন্ন ফসলের এক-পঞ্চমাংশ এবং সেচের ব্যবস্থা না থাকলে এক-চতুর্থাংশ খারাজ হিসাবে আদায় করা হত। অমুসলিমদের নিকট হতে জিজিয়া আদায় করা হতাে। মুসলিমগণ যাকাত ও সদকা দিত। জিজিয়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনটি শ্রেণি ছিল—ধনীদের ৪৮ দিরহাম, মধ্যবিত্তদের ২৪ দিরহাম এবং নিম্নবিত্তদের ১২ দিরহাম।৬০ অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে নারী, শিশু বা ১৪ বছরের নিম্নের ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, সাধু-সন্ত, ধর্মযাজক, ব্রাহ্মণ, অন্ধ, পঙ্গু, ভিখারি, তীর্থযাত্রী, নিঃস্ব, অসহায়, দিন মজুর, ত্রীতদাস, পাগল, সম্বলহীন, সরকারি সকল কর্মচারী, কৃষকদের জিজিয়া হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।৬১
জিজিয়ার প্রগ্নে বিন কাসিমের সমালােচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এস এম ইকরাম লিখেছেন “কিন্তু যখন লক্ষ করা যায় যে, মুসলমান নাগরিকদেরকে যাকাত, সাদকা এমন দু’খাতে অর্থ দিতে হয়, যেগুলাে থেকে হিন্দুরা মুক্ত ছিল, তাহলে তাদের তুলনামূলকভাবে অনেক কম জিজিয়া কর বসানােটা কিছুতেই অন্যায় ছিল না। বায়তুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মুসলমানদেরকে শতকরা আড়াই ভাগের অধিক এবং কোনাে কোনাে সময় শতকরা সাড়ে বার ভাগ পর্যন্ত সম্পদ জমা দিতে হতাে কিন্তু অমুসলমানরা মাত্র বছরে অনুর্ধ্ব পাঁচ দিনার দিলেই চলত। এছাড়া সামরিক কর্মকাণ্ড থেকে হিন্দুরা ছিল মুক্ত। অথচ ইসলামি রাষ্ট্রে প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে ধর্মীয়ভাবে জিহাদ ছিল ফরজ। সাধারণত জিজিয়া কর আদায়ের দায়িত্ব ছিল ব্রাহ্মণদের উপর। গরিব হিন্দুদের নিকট থেকে জিজিয়া কর নামমাত্র আদায় করা হত। আদায়কারী ব্রাহ্মণরা যে কোনাে অবস্থায় এদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতেন।”৬২
রাজ্য জয়ের পর আরবরা ধর্ম প্রচারে মনােযােগ দিলেও সিন্ধুতে তারা ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছিল। চাচনামা হতে জানা যায়, মুহাম্মদ বিন কাসিম ও তার অনুগামীরা স্থানীয় জনগণকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীথিত করেননি। বরং তারা অমুসলিম জনগণের ধর্মপালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দান করেছিল। জিজিয়া কর প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে অমুসলমান হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় নির্বিঘ্নে তাদের ধর্মকর্ম ও উৎসবাদি পালন করত।পাশাপাশি মন্দিরের পুরােহিত ও দরিদ্র অমুসলিমরা জিজিয়া কর না দিয়েও নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারত। ব্রাহ্মণরা আগের মতােই নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব পালন করত।৬৩ এবং তাদের মন্দির ও উপাসনালয় যাতে কোনাে কারণে আত্রান্ত না হতে পারে, সেই ব্যবস্থা অবলম্বন করেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। তাছাড়া যুদ্ধের সময়ে যে মন্দিরগুলি লুষ্ঠিত ও ধ্বংস করা হয়, তা পুনঃনির্মাণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মুলতানের সূর্যদেবের ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের কথা। ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন,
“The Arab were not so fanatical as the Turks who followed them later. They granted tokeration to the Hindus.”
সিন্ধু ও মুলতানে আরবদের শাসন সম্পর্কে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আদেশনামায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সিন্ধুর ব্রাহ্মণাবাদ তথা বাহমনাবাদ অঞ্চলে একটা বড় বৌদ্ধ মন্দির ছিল। সিন্ধু অভিযানের সময় লােকেদের এখানে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিম বিজয়ের পর ভয়ে লােকেরা এখানে আসত না, সেজন্য আয় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। মন্দিরের রক্ষকেরা অনাহারে দিন কাটাতে লাগল। একদিন তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে হাজির হল এবং ফরিয়াদ জানাল,
“হে ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ! আপনি দীর্ঘজীবী হউন, আমরা মন্দিরের পূজারী, এই বুদ্ধের মন্দির থেকেই আমাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। আপনি সকলের প্রতি দয়া করেছেন, সওদাগরদের সম্পদ দিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের ব্যবস্থা করেছেন, অন্যান্যদের সুরক্ষিত নাগরিকরূপে গ্রহণ করে নিজেদের কাজে নিয়ােজিত করেছেন। আমরাও আশা করি যে, আপনি বৌদ্ধদের নির্দেশ দিবেন যে, তারা যেন বুদ্ধের মন্দিরে গিয়ে উপাসনা করতে পারে।”৬৪
মুহাম্মদ বিন কাসিম এই সকল বিষয় ইরাকের শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে লিখে পাঠালেন। হাজ্জাজের নিকট থেকে উত্তর এল “সমগ্র পরিস্থিতি জানতে পারলাম, ব্রাহ্মণবাদের মুকাদ্দামরা (প্রধান ব্যক্তি) বুদ্ধের মন্দির নির্মাণ করতে চায়, এবং ধর্মীয় বিষয়ে সহনশীলতার জন্য অনুরােধ করেছেন। তারা যখন আমাদের আনুগত্য মেনে নিয়েছেন এবং দারুল খিলাফতে (রাজকোষে) নিয়মিত জিজিয়া কর প্রদানের জন্য অঙ্গীকার করেছে ও পরিশােধের নিশ্চয়তাও তারা প্রদান করেছে, তখন সেই সম্পদ ছাড়া অন্য কিছুর উপর আমাদের অন্য কোনাে অধিকার নেই। তখন তাদের জানমালে কোনােরূপ নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ বৈধ নয়। তাদেরকে মন্দির নির্মাণের ও সেখানে স্বীয় দেবতাদের পূজা করার অনুমতি দেওয়া হােক। কোনাে ব্যক্তির উপর যেন অত্যাচার না করা হয়, তারা নিজের গৃহে যেমনভাবে ইচ্ছা থাকতে পারে।”৬৫
হাজ্জাজের এই ফরমান পৌঁছানাের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম ব্রাহ্মণবাদের গণ্যমান্য ব্যক্তি, মুক্কাদ্দম ও ব্রাহ্মণদের ডেকে নির্দেশ দিলেন যে, তারা নিজেদের মন্দির নির্মাণ করুক, মুসলমানদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করুক, তারা নির্ভয়ে থাকুক, নিজেদের অবস্থার উন্নতি করুক, দরিদ্র ব্রাহ্মণদের সাথে ভাল ব্যবহার করুক, তাদের পূর্বপুরুষদের প্রথারীতি পালন করুক, ব্রাহ্মণদের যেরূপ দক্ষিণা দেওয়া হত তা এখনও দেওয়া হবে (আদায়কৃত রাজস্বের শতকরা তিন টাকা ব্রাহ্মণদের জন্য পৃথক করে রাখা হত, যাতে প্রয়ােজনের সময় তাদের সাহায্য করা যায় এবং অবশিষ্ট অর্থ রাজকোষের অন্তর্ভুক্ত করা হত, তাতে কোনােরূপ আত্মসাৎ করা হত না)—এই সকল প্রথা প্রচলিত রাখা হবে।৬৬ ব্রাহ্মণদের সকল কথা মেনে নেওয়ার সাথে সাথে মুহম্মদ বিন কাসিম এটাও ঘােষণা করলেন যে, তাদের মন্দিরকে ঠিক সেই রকমই মনে করা হবে, যেমনটা ভাবা হয় সিরিয়া ও ইরাকের ইহুদি ও খৃষ্টানদের উপাসনাগৃহ এবং অগ্নিপূজকদের উপাসনাগার, তাদেরকে ইচ্ছামত উপাসনা করার অনুমতি দেওয়া হল।৬৭ সিন্ধু প্রদেশে বিন কাসিম কর্তৃক অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের কথা ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদও উল্লেখ করেছেন।৬৮ মুহাম্মদ বিন কাসিম ব্রাহ্মণবাদের ‘মুকাদ্দম’দের ‘রাণা’ উপাধিতেও ভূষিত করলেন।৬৯
এ সমস্ত নীতি নির্ধারণের কারণে স্বাভাবিকভাবেই সিন্ধুবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য মুহাম্মদ বিন কাসিম লাভ করেছিলেন। সর্বোপরি আরবদের শাসন সেখানে বলবৎ হওয়ায় বহু লােক বিজয়ীদের ধর্ম গ্রহণ করেছিল। সিন্ধুর কয়েকজন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য তৎকালীন খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজের (৭১৭-২০) আহ্বানে সাড়া দেন।৭০ বিজয়ীদের প্রেরিত বিভিন্ন চিঠিপত্রে অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে প্রায়ই উল্লেখ পাওয়া যায়।৭১ পত্র যােগাযােগের ফলে ব্রাহ্মণাবাদ তথা বাহমনাবাদের রাজা জয় সিংহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এসকল ধর্মান্তর যে মূলত স্বেচ্ছাভিত্তিক ছিল তা এ থেকে বােঝা যায় যে, প্রথম অভিযানের সহিংসতার পরে আরবরা তাদের অমুসলিম প্রজাদের প্রতি সহনশীলতা দেখিয়েছিলেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, বাহমনাবাদ শহর দখলে আসার পরে সেখানকার জনগণকে তাদের মন্দির মেরামত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। মন্দির ছিল ব্রাহ্মণদের জীবিকা অর্জনের উপায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চাচনামার বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম দেবল অবরােধের পর সেখানকার জনগণের সাথে দুর্ব্যবহার করার কোনাে কোনাে উদ্ধৃতি অতিরঞ্জিত এবং অগ্রহণযােগ্য। এছাড়া দ্বিতীয় যে জিনিসটি এখানে লক্ষ করার বিষয়। তা হল, মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন একটি প্রতিশােধমূলক অভিযানের নেতা। কতিপয় নিরাপরাধ মুসলিম নারী-পুরুষ শিশুকে জাহাজ থেকে গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে দেবল কিল্লায় আটক করে রাখা হয়েছিল। বুদায়েল এবং আবদুল্লাহর সৈন্যবাহিনীকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া ওই যুগে নিয়ম ছিল, যেখানে স্বীকৃত যুদ্ধনীতি লঙ্ঘিত হতাে এবং আক্রমণকারী সৈন্যরা অধিক প্রতিরােধের সম্মুখীন হত, সেখানে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও অধিক গৃহীত হত।
যাইহােক, মুহাম্মদ বিন কাসিম এর অনুসৃত উদারনীতির দরুণই বিদেশী আরব শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ করেনি। কয়েকটি শহর-জনপদ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তার আনুগত্যে এসে যায়। আরব শাসনের এই উদারতা তৎকালীন ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।ঐতিহাসিক আবদুল করিম লিখেছেন “বিজিত এলাকায় গুণী ও গুণের আদর করাই মােহাম্মদ বিন কাসিমের সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব। তিনি যেমন গুণের আদর করিয়াছিলেন এবং বিজিতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিলেন, বিজিতেরাও তাঁহাকে নিখুঁতভাবে ভালােবাসিয়াছিলেন এবং তাহার সাহায্যার্থে প্রাণপণে আগাইয়া আসেন। ফলে শুধু যে স্বল্প আয়াসে সিন্ধু-বিজয় সম্পন্ন হইয়াছিল তাহা নয়, বরং বিজিত এলাকায় আরবদের সুনাম ছড়াইয়া পড়ে। মনে হয়, ইহাই মােহাম্মদ বিন কাসিমের জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব এবং এই জন্যই তিনি ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ রাজনীতিকরূপে স্মরণীয় হইয়া থাকিবেন।”৭২ ঐতিহাসিক বালাজুরী ‘ফুতুহুল বুলানে’ লিখেছেন, খলিফা বদলের পর মুহাম্মদ ইবনে কাসিম যখন বন্দী হয়ে ইরাকে প্রেরিত হন তখন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলে তার জন্যে রীতিমতাে ক্রন্দন করেছে।৭৩ এমনকি করাচী এলাকার হিন্দু জনগণ ভক্তিআতিশয্যে তার স্ট্যাচু (মূর্তি) তৈরি করেছিল। বিজয়ী সেনাপতির জন্য এর চেয়ে বড় কৃতিত্ব আর কি হতে পারে ?
মুহাম্মদ বিন কাসিম এর পর উমাইয়া খলিফা সােলায়মান (৭১৫-১৭) ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাবকে সিন্ধু অভিযানের শাসনভার অর্পণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর হাবিব সিন্ধু ও মুলতানের শাসক হন। তারপর খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের (৭১৭-২০) শাসনকালে ইসলাম প্রচারের জন্য দু-একজন শাসক নিযুক্ত হন। তার কয়েক বছর পর খলিফা হিশামের রাজত্বকালে (৭২৪৭৪৪) জুনাইদ সিন্ধুর শাসনভার গ্রহণ করে আলােয়ার, মালব, বাহমনাবাদ ও রাজপুতানার একটা বড় অংশের উপর আরব আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। দাহিরের পুত্র জয়সিংহ পুনরায় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে বিদ্রোহ করলে জুনাইদ তাকে পরাজিত ও নিহত করে সমগ্র সিন্ধু অধিকার করেন। জুনাইদ সিন্ধুবাসীদের ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে বহুলােক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। জুনাইদ সিন্ধু অঞ্চল থেকে অন্যান্য স্থানে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। তিনি রাজপুতনার মধ্য দিয়ে ভারুচ দখলের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু রাজপুতানার প্রতিহার রাজ প্রথম নাগভট্টের (৭২৫-৪০) প্রতিরােধের জন্য আরবরা ভারতের অভ্যন্তরে রাজ্য বিস্তার করতে পারেননি। জুনাইদের পর তামিম বিন জায়েদ আল উতবী ও তারপর হাকিম বিন আওয়ানা আল কালবি সিন্ধুর শাসনভার গ্রহণ করেন। এই সময় হাকিম ভারতমুখী হদের উত্তর পাশে ‘আল মাহফুজা’ নামে একটি শহর নির্মাণ করেন।
এই হ্রদের অপর পাশে আর একটি শহর নির্মাণ করা হয়, যার নাম হয় ‘আল মনসুরা’। উমাইয়া শাসনামলে (৬৬১-৭৫০) সিন্ধুতে এসব নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠে। এভাবে উমাইয়া শাসনকালে সিন্ধু ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে শাসনকর্তা নিয়ােগ করে বিদ্রোহ দমন ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
অন্যদিকে ৭৫০ সালে সিরিয়াতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। উমাইয়া খিলাফতের স্থলে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা হয়। আব্বাসীয় আমলে বহির্বিধে পুনরায় ইসলামি শক্তি প্রসারের প্রচেষ্টা শুরু হয়। আরবরা ভারতের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালিয়ে পশ্চিম ভারতে কয়েকটি প্রদেশ হস্তগত করে ও উজ্জয়িনী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এ সময় একে একে আবদুর রহমান, মুসা। বিন কাবুত তামিমি, হিশাম বিন আমর, উমর বিন হাফস, দাউদ বিন ইয়াজিদ, আমরান বিন মুসা, ফজল বিন মাহান, মুহাম্মদ বিন ফজল, মাহান প্রমুখেরা সিন্ধুমুলতান ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে প্রশাসক নির্বাচিত হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। কিন্তু এর কিছুকাল পরে আব্বাসীয় খলিফাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে সিন্ধুর আরবরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সিন্ধুতে আরবরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মুলতান ও ব্রাহ্মণবাদের আরব শাসনকর্তাদের মধ্যে কোন্দলের (৮৭১) ফলে সিন্ধুতে আরব শক্তির পতন ঘটে।
সিন্ধুজয়ের প্রভাব
আধুনিক ঐতিহাসিকেরা সিন্ধুদেশে আরব শাসনের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেন না। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে লেনপুল বলেছেন যে, ‘…ভারতবর্ষ ও ইসলামের ইতিহাসে আরবদের সিন্ধু বিজয় একটি উপাদান মাত্র, এটি একটি নিস্ফল বিজয়’।৭৪ এই উক্তি সুচিন্তিত নয় এবং এই মন্তব্যে আপাতসত্য থাকলেও তাৎপর্যগত দিক থেকে একে পুরােপুরি গ্রহণ করা যায় না। আসলে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরব ও ভারতের সঙ্গে যােগাযােগের কথা খেয়াল করেননি বলেই এই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। আরবদের সিন্ধু বিজয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ইংরেজ ঐতিহাসিক জেমস্ টড় তার ‘অ্যানাল অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস অফ রাজস্থান’ গ্রন্থে আরব বিজয়ের গুরুত্ব পর্যালােচনা করেছেন।
সিন্ধুতে স্বল্পকালের (৭১২-১৫) উপস্থিতির কারণে মুহাম্মদ বিন কাসিম নব বিজিত অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এক্ষেত্রে উমাইয়া খলিফাদের সুষ্ঠু এবং পরিকল্পিত নীতির অভাবও অনেকাংশে দায়ী। খলিফা প্রথম ওয়ালিদের (৭০৫-৭১৫) পরে উমাইয়া শাসকগণ সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ নীতির পরিবর্তে সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করেন। ফলে আরবদের উদ্যম, উৎসাহ ও নতুন নতুন রাজ্যজয়ের নেশা হারিয়ে যায়। দামেস্কের উমাইয়া খলিফাদের গােত্রকলহ, অভ্যন্তরীণ গােলযােগ, গৃহযুদ্ধ, এককথায় উমাইয়া খলিফাদের দুর্বলতা সিন্ধু প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ঐতিহাসিক ই বি হ্যাভেল বলেন, “রাজনৈতিক দিক হতে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ঘটনা, মুসলিম জগতের অন্যান্য ঘটনার তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু সমগ্র ইসলামি সংস্কৃতির ফলাফল বিচারে এ জয়ের যে গুরুত্ব, বাস্তব ক্ষেত্রে তা বিশেষ উপলব্ধ হয়নি। তবে রাজনৈতিক ফলাফল আপাত দৃষ্টিতে নেতিবাচক হলেও বলা যায়, মুহাম্মদ বিন কাসিম এর পরে অনেকদিন (প্রায় ১৫৩ বছরের মত) সিন্ধু ও মুলতানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের সূত্র ধরে ভারতবর্ষে ইসলামের বীজ রােপিত হয়েছিল। ভবিষ্যতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে আক্রমণকারীরা (যেমন গজনভি, ঘােরি প্রমুখেরা) ভারতে প্রবেশ করে। সিন্ধু বিজয়ই ছিল তাদের অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে, এই সমস্ত বিজয়ীরা সিন্ধুতে আরব শাসনের ভিত্তির উপরই তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন।
উল্লেখ্য, তখন দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শের সংঘর্ষ চলছিল। নব হিন্দুধর্ম আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। রাজনৈতিকভাবেও সেটা ছিল অস্থিরতার যুগ। চের রাজবংশ ক্ষমতা থেকে অপসারিত হচ্ছিল এবং সে স্থান দখল করছিল নতুন রাজবংশ। স্বাভাবিক ভাবেই জনগণের মানসিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত বিচলিত। তারা নতুন শান্তিবাদী আদর্শের জন্য উৎসুক ছিল। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বাসের সহজ-সরল তত্ত্ব, সুগঠিত-সুসংহত মতবাদ ও সমাজ গঠনের সংঘর্ষমুক্ত গণতান্ত্রিক তত্ত্ব বহন করে ইসলামের আগমন ঘটে, এর প্রভাব হয় ব্যাপক। এই সময় মালাবারের চেরামন পেরুমল বংশীয় শেষ রাজা নবধর্ম ইসলামে দক্ষিত হন। তাঁর নতুন নাম হয় আবদুর রহমান সামরি।৭৫ প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ সুরজিৎ দাশগুপ্ত এ বিষয়ে লিখেছেন, “মালাবার রাজাদের মধ্যে চেরামন পেরুমলই প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পেরুমল বংশীয় শেষ রাজা।…শুধু নিজে ধর্মান্তরিত হয়েই চেরামন পেরুমল ক্ষান্ত হননি, প্রজাদের মধ্যেও ইসলাম ধর্ম প্রচারে তিনি সচেষ্ট হন।…তবে যেদিক থেকেই দেখা হােক না কেন একজন দৰিণ ভারতীয় রাজা অন্তরের আকর্ষণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং তার প্রচারের জন্য বিদেশ গিয়ে চেষ্টা করেছেন, এই ব্যাপারটা অশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বহু পুরুষ বাহিত ধর্ম ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় উদ্দীপ্ত চিত্তে শাসকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এরকম নজির ভারতবর্ষের অন্যত্র বিরল।”৭৬
ইসলাম গ্রহণের পর ওই রাজা মালাবার থেকে আরব যান। কেউ কেউ বলেন, মালাবারের রাজা চেরামন আরবের মক্কায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) এই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন আল্লাহর দেওয়া কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য সঙ্গে নিয়ে। তার অসাধারণ সাধুতা, সততা ও সুবুদ্ধির পরিচয় পেয়ে মক্কাবাসী তাকে ‘আল আমিন’ বা ‘চির বিশ্বাসী’ বলে সম্বােধন করত। নবী হিসেবে আখ্যায়িত বা নবুয়ত লাভের পর হতে সারা বিৰ্থের আনাচে-কানাচে তার আলােচনা শুরু হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, এই শুভ সংবাদ মালাবারের আরবদের ও অন্যান্য অধিবাসীদের কর্ণগােচর হতে দেরী হয়নি। আরব নাবিক ও বণিকগণ সর্বদা বঙ্গদেশ ও কামরূপ হয়ে চীন দেশে যাতায়াত করতেন। আর মালাবারই ছিল তাদের মধ্য পথের প্রধান বন্দর। এখানকার আদি বাসিন্দাদের ভাষাও ছিল আরবি। সুতরাং হযরত মােহাম্মদের (সাঃ) ও ইসলাম ধর্মের সকল প্রকার বিবরণ যে তারা যথাসময় সম্যক রূপে অবগত হতে পেরেছিলেন, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। পাশাপাশি এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, আরব বণিকরাই ছিল এশিয়া-আফ্রিকায় ইসলাম প্রচারের প্রধান ও প্রথম উদ্যোগী। আর এই উৎসাহী প্রচারকদের সংশ্রবে আসার ফলেই মালাবারের আদি আরবগণ হযরত মােহাম্মদের (সাঃ) জীবনকালে—খুব সম্ভব হিজরী সনের প্রথমের। দিকে (৬২২-২৩ সাল) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মালাবারের অনারব অধিবাসীদের মধ্যে ইসলামের প্রচার শুরু হয়, এর কিছুকাল পরে স্থানীয় ওই রাজার ইসলাম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে।
বিশ্বকোষ প্রণেতা মালাবারের ওই হিন্দু রাজা সম্বন্ধে লিখেছেন, “পরাবৃত্ত পাঠে জানা যায়, চেরর রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমন পেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন ত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণ অভিলাষে মক্কা নগরীতে গমন করেন।”৭৭ শেখ জয়নুদ্দিন কৃত ‘তুহফাৎ-উল-মুজাহিদিন’ গ্রন্থেও ভারতের একজন হিন্দু রাজার মক্কা গমন, তার হয়রত মােহাম্মদের (সাঃ) খেদমতে হাজির হওয়া ও স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। পূর্বোক্ত ‘তুহফাৎ-উল-মুজাহিদিন’-এর বরাত দিয়ে এস এম ইকরাম এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “হিজরী তৃতীয় শতকে (নবম শতকের প্রথমার্ধে) যখন মুসলিম সাধকদের একটি দল শ্রীলংকায় হযরত আদমের (আঃ) পদচিহ্ন যিয়ারত করার জন্যে যাচ্ছিলেন, তখন প্রতিকূল হাওয়া তাদের জাহাজটি মালাবারের কঙ্কলুর (কদঙ্গানূর) শহর উপকূলে নিয়ে যায়। সেখানকার রাজা জেমােরন (সামেরী) তাদের যথেষ্ট সমাদর করেন। তিনি ঐ সমস্ত মুসলমানের নিকট তাদের ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সাধক-মুসলমানদের মুখে ইসলামের বর্ণনা শুনে রাজা এতই অভিভূত হলেন যে, যখন শ্রীলংকা সফরকারীরা সেখান থেকে ফিরে আসেন তখন রাজা জেমােরন রাজত্বের সকল দায়-দায়িত্ব অন্যান্য নেতৃপর্যায়ের লােকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঐসব মুসলমানের সাথে আরব দেশে চলে যান।”৭৮
চার বছর পর ওই রাজা সেখানে মারা যান। আরবে থাকাকালে তিনি শংসাপত্র দিয়ে সপরিবারে মালিক ইবনে দীনার, শরিফ ইবনে মালিক ও মালিক ইবনে হাবিবকে মালাবারে পাঠান। রাজার নির্দেশকে মান্যতা দিয়ে তাদের প্রতি মালাবারে অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করা হয় এবং তাদের মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়। তার ফলে মালাবার উপকূলে তখন এগারাে স্থানে মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। আসলে রাজার ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ তখনকার জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
মালাবারে সেই ঘটনার স্মৃতিকে বহু বছর ধরে সজীব রাখা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, কালিকটের জামােরিন রাজার অভিষেকে তাকে মাথামুন্ডন করে মুসলিমদের পােষাক পরিয়ে মাথায় মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয় যে, জামােরিন আরব থেকে চেরামন পেরুমল-এর ‘প্রত্যাবর্তনাকাঙ্খী প্রতিনিধিরূপে সিংহাসন গ্রহণ করেন।৭৯ পরবর্তীতে ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজগণও তাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে তরবারী হাতে এইভাবে শপথ নিতেন যে, আমার মক্কাগত পিতৃব্যের ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এই তরবারী সংরক্ষণ করব।”৮০
পূর্বোক্ত জামােরিন রাজার উৎসাহ ও পৃষ্ঠপােষকতায় বহু আরব বণিক তার রাজ্যে বসতি স্থাপন করে। তিনি এই আদেশ দেন যে, তার রাজ্যের প্রতিটি জেলে পরিবারের এক বা একাধিক পুরুষ সদস্যকে মুসলমান রূপে লালিত-পালিত হতে হবে।৮১ এভাবে পরবর্তী শতক সমূহে ইসলামের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরিব্রাজক ও ভূগােলবিদদের বিবরণ তারই সাক্ষ দেয়। ভূগােলবিদ মাসুদি ৯১৬ সালে ভারত সফরে আসেন। তিনি চৌল-এ আম্মান, বসরা, বাগদাদ থেকে আগত দশ হাজারেরও বেশি মুসলমান দেখতে পান। সেই সঙ্গে ছিলেন সেখানে জন্মগ্রহণকারী আরবীয়দের পরিবার। চৌল-এর বন্দরে তখন মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়। শুধু চৌল নয়—মনসুরা, মুলতান, দেবল ও নিরুনে আরবদের বেশ ঘন বসতি ছিল। এইসব মুসলমান বসতিপূর্ণ এলাকায়ও অমুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। কিন্তু মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে পূর্ণ সদ্ভাব বজায় ছিল। আরবরা সেখানে গাে-হত্যা নিষিদ্ধ করেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমানদের মনােভাবের দিকে লক্ষ রেখেই এই নির্দেশ জারি করা হয়।
ত্রয়ােদশ শতকে ইবনে সাইদ উল্লেখ করেন যে, ভারতীয় উপকূলে মুসলমানগণ বসবাস করছিলেন। ইবন বতুতা চতুর্দশ শতকে ক্যাম্বে থেকে পশ্চিম উপকূল ধরে তার ভ্রমণপথে সকল বন্দরে নামেন। সকল স্থানেই তিনি মুসলমানদের দেখতে পান। মসজিদও তিনি দেখেছিলেন। ম্যাঙ্গালােরে ওই সময় চার হাজার মুসলমান বাস করতেন, তাদের মধ্যে ইয়েমেনের বণিকরাও ছিল। তাদের মসজিদের প্রচুর সম্পদ ছিল ও মসজিদে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও আশ্রিত ছিল। কালিকটের প্রধান বণিক বাহরাইনের ইব্রাহিম শাহ ছিলেন মুসলমান। কৌলম-এ (বর্তমানে কুইলন) বহু মুসলমান বণিক ছিল। সেখানকার কয়েকটি মসজিদ ছিল স্থাপত্যগুণে সমৃদ্ধ। সেখানকার অমুসলমান রাজাও ইসলামধর্ম ও মুসলমানদের সমীহ করতেন।
পরিব্রাজক আবদুর রাজ্জাক ১৯৪২ সালে ভারত ভ্রমণ করেন। তিনি কালিকট সম্পর্কে বলেন, “এখানে যথেষ্ট সংখ্যক স্থায়ী মুসলমান অধিবাসী রয়েছেন। এখানে তারা দুটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। প্রতি শুক্রবার নামাজ পড়ার জন্য তারা মসজিদে মিলিত হন। এই বন্দরের ব্যস্ততা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অষ্টম শতকেই ক্যান্টনে বহু মুসলিম বসতি স্থাপন করে। ৭৫৮ সালে তাদের বিদ্রোহ যথেষ্ট আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল।৮২ মালিক উল মুলক-এর নেতৃত্বে ১০৫০ সালে মুসলমানগণ মাদুরায় প্রবেশ করেন। নেলসন এ সম্বন্ধে অনেক কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন।৮৩ অষ্টম শতকে মুসলমানগণ দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম উপকূলে আগমন করে। সেখানে তারা মসজিদও নির্মাণ করে। সে সময়ে তামিল অঞ্চলে আরাে মুসলিম বসতি ছিল। মালিক কাফুর সম্পর্কে বিবরণ দিতে গিয়ে আমির খসরু ক্যান্নানােরবাসী মুসলমানদের কথা উল্লেখ করেছেন। ইবন বতুতা বর্ণনা করেছেন যে, তার সময়ে মাদুরার শাসক ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আল দমঘানি। রাজা বীর বল্লালের কুড়ি হাজার মুসলমান সৈন্যের এক বাহিনী ছিল। এভাবেই দক্ষিণ ভারতে মালিক কাফুরের সেনাবাহিনী পৌঁছানাের পূর্বেই মুসলমানগণ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র সমূহে বসতি স্থাপন করে এবং তাদের প্রতিবেশী জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়।
এসব তথ্য থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, হযরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রয়াণের (৬৩২) অনতিকাল পরেই মুসলমানগণ ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে আগমন করেন এবং শীঘ্রই মালাবারের হিন্দু শাসকদের কাছ থেকে সুযােগ-সুবিধা ও প্রভাবপ্রতিপত্তি লাভে সমর্থ হন। আর এসবের নেপথ্যে যে মুহাম্মদ বিন কাসিম এর সিন্ধু অভিযানের প্রভাব সুস্পষ্ট রয়েছে তা আর বলার অপো রাখে না।
সিন্ধু বিজয়ের ফলে সিন্ধুর অমুসলিমগণ ইসলামের আদর্শের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযােগ পায়। যেখানেই মুসলমান সৈন্যরা অভিযান পরিচালনা করেছে বা বণিকরা বসতি স্থাপন করেছে, সেখানেই মুসলিম ধর্মপ্রচারকগণ উপস্থিত হয়েছেন। আর এই ধর্ম প্রচারকরাই ইসলামকে সমকালীন সমাজে জনপ্রিয় করে তুলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন। নবম শতকে আবু হিফস রাব্বি বিন সাহিব আল বসরি (রহঃ) সিন্ধুতে আগমন করেন। দশম শতকে মনসুর হল্লাজ (রহঃ) সমুদ্র পথে ভারতে আসেন এবং স্থলপথে উত্তর ভারত ও তুর্কিস্থান হয়ে আরবে প্রত্যাবর্তন করেন।৮৪ একাদশ শতাব্দীতে সহযাত্রী দরবেশদের সঙ্গে নিয়ে বাবা বিহান (রহঃ) বাগদাদ থেকে ভারতের ব্রোচে আসেন। ১০৫০ সালে মালিক উল মুল্ক মাদুরাই প্রবেশ করলে তার সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত দরবেশ হযরত আলিয়ার শাহ (রহঃ)। তিনি এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।৮৫ দ্বাদশ শতকের প্রথমার্ধে নূর আল দীন (১০৯৪-১১৪৩) গুজরাটের কুম্ভি, খারওয়া ও কোরি অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। একাদশ শতকে ‘কাশফুল মাহজুব’ গ্রন্থ প্রণেতা আলি বিন ওসমান (রহঃ) লাহােরে ইসলাম প্রচার করেন। এই সময়ে শেখ ইসমাইল বুখারি (রহঃ) ও বিখ্যাত ‘তাজকিরাতুল আওলিয়া’ গ্রন্থ প্রণেতা ফরিদউদ্দিন আত্তার ভারত পরিভ্রমণ করেন। ১১৯৭ সালে আজমিরে আগমন করেন খাজা মইনউদ্দিন চিশতি (রহঃ)। ভারতে তার ইসলাম প্রচারের ইতিহাস আজও অবিস্মরণীয়। ত্রয়ােদশ শতকের প্রারম্ভে জালালউদ্দিন তাবরেজি বঙ্গদেশে আসেন। বিখ্যাত ‘ইনসান-ই-কামিল’ গ্রন্থের প্রণেতা আবদুল করিম জিলানি (রহঃ) ভারত সফর করেন ১৩৮৮ সালে এবং সৈয়দ মােহাম্মদ গিসুদারাজ (রহঃ) পুনে ও বেলগাম জেলায় ইসলাম প্রচার করেন। পির সদরউদ্দিন (রহঃ), সৈয়দ ইউসুফউদ্দিন (রহঃ), ইমাম শাহ (রহঃ) প্রমুখেরা পঞ্চদশ শতকে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন ও ইসলাম প্রচার করতেন।
অন্যান্য প্রসিদ্ধ সন্ত, যারা ভারত ভ্রমণে আসেন বা ভারতে বসবাস করেন, তারা হচ্ছেন—দিল্লিতে সমাহিত কাদেরিয়া মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা বড়পির আবদুল কাদের জিলানি (রহঃ)-এর পুত্র সৈয়দ শাহ মীর (রহঃ), বিখ্যাত কুতুবমিনার-এর সঙ্গে যার নাম জড়িত সেই কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহঃ), বাহাউদ্দিন জাকারিয়া (রহঃ), মুলতানে বসবাসকারী জালালউদ্দিন (রহঃ), সম্রাট হুমায়ুনের গুরু বা পির মােহাম্মদ গওস (রহঃ), শাহ মাদার (রহঃ) প্রমুখ। এছাড়াও বহু পির, দরবেশ, আউলিয়া ইসলাম প্রচারকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.), চট্টগ্রামের বায়ােজিদ বােস্তামী (রহ.), বগুড়ার মাহমুদ মাহী সওয়ার (রহ.), বাগেরহাটের খানজাহান আলি (রহ.), রংপুরের হযরত কারামত আলি (রহ.), সিলেটের হযরত শাহ জালাল (রহ.), শাহ পরাণ (রহ.), হজরত মখদুম শাহ মাহমুদ গজনভী (মঙ্গলকোট), শাহ। তুকরান শহিদ (বগুড়া), হজরত মাহমুদ শাহ (শাহজাদপুর), তকিউদ্দিন আরাবি (রাজশাহী, ১২৪৮), শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা ও শরফউদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরি (সােনারগাঁও, ১২৭৮), জাফর খান গাজি (উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গ, ১২৯৮), সৈয়দ নাসিরউদ্দিন শাহ (দিনাজপুর, ১৩০২), সৈয়দ আহমদ কল্লাহ শহিদ (কুমিল্লা ও নােয়াখালি, ১৩০৩), মীরান শাহ (ফেনি, ১৩০৩), শেখ আখি সিরাজউদ্দিন (গৌড়-পান্ডুয়া, ১৩২৫), সৈয়দ আসরাফ কাবুলি-বান্দারি শাহ-শাহ মােবারক আলি (চট্টগ্রাম, ১৩৪০), শাহ মােহাম্মদ বাগদাদি (কুমিল্লা ও নােয়াখালি, ১৩৫১-৮৮), শেখ নূর কুতুব উল আলম-আনােয়ার শহিদ-শেখ জাহিদ (উত্তর ও পূর্ব বঙ্গ, ১৩৫০-১৪৪৭), একদিল শাহ (২৪ পরগণা, ১৪৯৩-১৫১৯), হাজি বাহরাম সার্কি (পশ্চিমবঙ্গ), খাজা শরফউদ্দিন চিশতি (ঢাকা, ১৫৫৬-১৬০৬) প্রমুখ অন্যতম। এসব পির-দরবেশ-আউলিয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দলে দলে নির্যাতিত হিন্দু সম্প্রদায় ইসলামের সাম্যবাদী আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে তার পতাকাতলে হাজির হয়। সিন্ধু বিজয় এসবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তাছাড়া এই উপমহাদেশে আরব অভিযানের ফলে যে কলােনী স্থাপিত হয় তা মালয়, জাভা, সুমাত্রাতে ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।৮৬
সামাজিক ক্ষেত্রে আরবগণ হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসে এবং উভয়ের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এর ফলে আর্য ও সেমেটিক জাতির সংমিশ্রণে একটি নতুন জাতির উদ্ভব ঘটে। এই নুতন জাতি পরবর্তীকালে ভারতের ইন্দো-সেমেটিক সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করে। পূর্বেই বলা হয়েছে—মনসুরা, মুলতান, দেবল, নিরুনে আরবদের বেশ ঘনবসতি ছিল। ফলে এসব স্থানে বড় জুম্মা মসজিদ ও শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। এর ফলে মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর্য ও সেমেটিক জাতির সংমিশ্রণে সিন্ধুর লােকাচার ও সামাজিক রীতিনীতি তাদের প্রাত্যহিক জীবনে অনুপ্রবেশ করে। আবার সিন্ধুবাসীর দৈনন্দিন জীবনেও আরবীয় বৈশিষ্ট্যের অনুপ্রবেশ ঘটে।।
মুসলিম সংস্কৃতির উপর সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরব ও ভারতবর্ষ উভয়েই উপকৃত হয়। কারণ কৃষ্টির গতি একমুখী নয়, উভয়মুখী। আরবীয় মুসলিমগণ মিশরীয়, মেসােপটেমীয়, গ্রিক ও পারসিক জাতির সংস্কৃতির সাথে একত্রিত হয়। আরবীয়গণ তাদের সংস্কৃতির সাথে নিজেদের সংস্কৃতির সমন্বয়সাধন করেন। নিজেদের এবং বিভিন্ন জাতি থেকে প্রাপ্ত সংস্কৃতি আরবীয় মুসলিমগণ ভারতীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে নিয়ে আসেন। ফলে ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রিক, মিশরীয়, পারসিক ও আরবীয় সংস্কৃতির সাথে মিশ্রণের ফলে সমৃদ্ধ হয়। অনেকে বলেন যে, আরবি ভাষার প্রভাব সিন্ধি ভাষার উপর পড়েছিল। সিন্ধি ভাষায় প্রচুর আরবি শব্দ পরিলৰিত হয়। ৮৮৬ সালে কোরআন অনূদিত হয়েছিল সিন্ধি ভাষায়, আর এ কাজ হয়েছিল এক আরব পণ্ডিতের দ্বারা এক হিন্দু সামন্ত রাজার অনুরােধে।৮৭ সিন্ধুর অমুসলমানরা আরবদের প্রতি এত অনুরক্ত হয়ে পড়ে যে, তারা আরবদের পক্ষে সুদূর রােম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও যুদ্ধযাত্রা করতে কুণ্ঠিত হয়নি।
ঐতিহাসিক আবদুল করিম লিখেছেন,
“অনেক সিন্ধী পরিবার এখনও তাহাদের পূর্বপুরুষ আরবদেশ হইতে আগত বলিয়া দাবি করেন। হয়ত এইরূপ অনেক পরিবারের দাবি অলীক, কিন্তু মনে হয়, সিন্ধুদেশে আরব দেশাগত পরিবারের অভাব নাই। সিন্ধুর সমাজ-ব্যবস্থাও অনেকটা আরব দেশের অনুকরণে উপজাতীয় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আরবদের উপজাতীয় সর্দারকে যেমন ‘শায়খ’ বলা হয়, সিন্ধুদেশে তাঁহাকে ‘ওয়াদেরা’ বলা হয়। আরবদের মতাে সিন্ধিরাও অতিথিবৎসল এবং সিন্ধুদেশে এখনও আরবি ভাষার বিশেষ চর্চা হয়।”৮৮
দশম শতাব্দীতে অনেক আরবীয় ঐতিহাসিক এ অঞ্চল পরিদর্শনে এসে লক্ষ্য করেছিলেন যে, শহরের লােকজন কথা বলে আরবি ও সংস্কৃত—এই দুই ভাষাতেই। এভাবে সাংস্কৃতিক লেনদেনের ফল ভালই হয়েছিল। ভারতীয়রা আরবদের কাছ থেকে বিশুদ্ধ একেরবাদ, শােষণ-শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা ও ভ্রাতৃত্ববােধের আদর্শ এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা, পার্থিব শিক্ষা।
পদ্ধতি, একই ধরণের শাসন ব্যবস্থা, আচার অনুষ্ঠান ও পােশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। আরবদের প্রভাবে ভারতীয় সমাজ থেকে কুসংস্কার-অস্পৃশ্যতা অনেকাংশে দূরীভূত হয়। শুধু তাই নয়, কুফার চর্মকারদের কাছে মাকরান ও সিন্ধুর চর্মকারেরা খেজুরের সাহায্যে কঁচা চর্মকে পাকা করে নেবার কৌশল আয়ত্ব করেছিল। ফলে এদেশের চর্মশিল্প আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হল। আরবীয়দের কাছ থেকে উৎকৃষ্ট উট প্রজননের বিদ্যা শিখে নিল সিন্ধুবাসী। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলিতে সিন্ধু থেকে আমদানি করে আনা উটের চাহিদা অনেকাংশে বেড়ে গেল।৮৯ অপরদিকে, আরবগণ ভারতীয় দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাস্ত্র, সংগীত, শিল্পকলা ইত্যাদির সংস্পর্শে আসেন এবং স্পষ্ট অনুভব করতে পারেন যে, ভারতবর্ষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি উচ্চমানের। আব্বাসীয় খলিফাগণ ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন।
কয়েকজন হিন্দু পণ্ডিত ৭৭১ খ্রিস্টাব্দে আর্যভট্টের ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ নামে জ্যোতির্বিদ্যার একটি গ্রন্থ নিয়ে খলিফা আল মনসুরের (৭৫৩-৭৪) দরবারে হাজির হন। খলিফার পৃষ্ঠপােষকতায় গণিতবিদ আল ফাজারীর নেতৃত্বে হিন্দু পণ্ডিতদের সহায়তায়। গ্রন্থটির অনুবাদ করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় ‘সিন্ধহিন্দ’। গণিতশাস্ত্রেও আরবরা ভারতীয়দের নিকট থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে। আরবদের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা গাণিতিক সংখ্যার লিখন বিন্যাস পদ্ধতি ভারতীয়দের নিকট থেকে শিক্ষা করেছে।৯০ একারণে তারা অঙ্কশাস্ত্র ও এর সংখ্যাসমূহকে যথাক্রমে ‘হিন্দাসা’ ও ‘অ্যাবাকাস-এ-হিন্দিয়া’ বলে থাকে। ইউরােপীয় জাতিসমূহ আরবদের নিকট অঙ্কশাস্ত্র শিক্ষালাভ করেছে। একারণে তারা ভারতীয় গাণিতিক সংখ্যাকে ‘অ্যারাবিক নিউমেরাল’ কিংবা আরবি সংখ্যা’ বলে থাকে। তার পূর্বে আরবরা অক্ষরের সাহায্যে সংখ্যা লিপিবদ্ধ করত। পরবর্তী পর্যায়ে গাণিতিক সংখ্যা লিখতে শুরু করে। পাশ্চাত্যবাসী পূর্বে রােমান অঙ্কের ক্ষেত্রে রােমান সংখ্যা ব্যবহার করত যা তুলনামূলকভাবে অনেক জটিল ছিল। তবে এ তথ্যটি অজ্ঞাত যে, ‘অ্যাবাকাস-এ-হিন্দিয়া’ বা ভারতীয় গাণিতিক সংখ্যার প্রচলনটি আরব দেশে কখন পৌঁছেছিল। অনুমান করা হয় যে, যে পণ্ডিত ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থ নিয়ে বাগদাদ গিয়েছিলেন, তিনিই আরবদের নতুন পদ্ধতির অংকশাস্ত্র শিখিয়ে থাকবেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং অঙ্কশাস্ত্র ছাড়াও ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপরও আরবদের বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। ভারতীয় বেদগ্রন্থটি আরব পণ্ডিতরা পড়তেন। বাগদাদ দরবারে হিন্দু চিকিৎসকদের বিশেষ কদর ছিল। খলিফাগণ হিন্দু বিদ্বানদের বাগদাদে আহ্বান করতেন এবং হাসপাতালসমূহে প্রধান চিকিৎসক হিসেবে নিয়ােগ দিতেন এবং তাদেরকে (হিন্দু বিদ্বানদের) জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদের জন্য বলা হত। এভাবে ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কীয় জ্ঞান আরবগণ ভারতীয় হিন্দুদের নিকট হতে অর্জন করে।৯১ আরবগণ তাদের এ অর্জিত বিদ্যা আরাে উন্নত করে শুধু তাদের নিজের দেশেই নয়, ইউরােপেও ছড়িয়ে দিয়েছিল।৯২ এতে সন্দেহ নেই যে, আবু মাশর নামে জনৈক পণ্ডিত বারানসীতে এসে হিন্দু পণ্ডিতদের সান্নিধ্যে দীর্ঘ দশ বছর জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষালাভ করেন। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মনে করেন, আরব কর্তৃক সিন্ধুদেশ জয়ের পর আরবদের সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের কোনাে নিকট সাংস্কৃতিক যােগাযােগ স্থাপিত হয়নি। তাঁর মতে, এই যুগে ভারতের গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা-বিষয়ক গ্রন্থাদি আরবিতে অনুদিত হয়েছিল কিনা তাও জানা যায় না। আর্যভট্টের ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ এরকম একটি গ্রন্থ।
আরব ঐতিহাসিক আল তাবারির বর্ণনা হতে জানা যায় যে, খলিফা হারুন অল রসিদ (৭৮৬-৮০৮) এক কঠিন রােগে আত্রান্ত হলে তার আমন্ত্রণে মনাকা নামে এক ভারতীয় হিন্দু চিকিৎসক তাকে বাগদাদে গিয়ে রােগমুক্ত করেন। তারপর খলিফা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বিপুল উপঢৌকনে ভূষিত করেন। শুধু তাই নয়, ওই ভারতীয় চিকিৎসককে খলিফা হারুন অল রশিদ অনুবাদভবনে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থাবলীর অনুবাদের কাজে নিয়ােজিত করেন। এমনিভাবে আরেকবার যখন। খলিফা হারুনের চাচাতাে ভাই রােগে আত্রান্ত হয়ে পড়েন এবং শাহী দরবারের ইউনানী চিকিৎসক তার মৃত্যু অতি আসন্ন বলে ঘােষণা করেন, তখন অপর এক ভারতীয় চিকিৎসকই তাকে চিকিৎসার মাধ্যমে আরােগ্য করে তুলেছিলেন। আব্বাসীয় খলিফাদের বিখ্যাত বারমাকী উজিরদের স্থাপিত হাসপাতালের উচ্চ কর্মকর্তাও ছিলেন একজন ভারতীয়। অপর চিকিৎসকদের সাথে মিলিত হয়ে সংস্কৃত থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ গ্রন্থ তৈরির জন্যে তিনি আদিষ্ট ছিলেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের যেসব গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষা থেকে আরবিতে অনূদিত হয়েছে ওইগুলাের মধ্যে ‘শত’ এবং ‘চরকে’র গ্রন্থাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।৯৩ এ দুটি গ্রন্থই ছিল বিশেষভাবে প্রচলিত। গ্রন্থ দুটিতে গাছ-গাছড়ার গুণাবলী বর্ণিত ছিল। এক হিন্দু বিদূষী পণ্ডিতের একটি গ্রন্থও আরবিতে অনূদিত হয়েছিল। ওই গ্রন্থে নারী রােগের চিকিৎসা পদ্ধতির কথা লিপিবদ্ধ ছিল। বিষক্রিয়ার প্রভাব এবং তার লক্ষণসমূহের বিবরণ সম্বলিত গ্রন্থাবলীও অনূদিত হয়েছে। পশু চিকিৎসার ক্ষেত্রে চানৈক্য পণ্ডিতদের গ্রন্থাবলীও আরবি ভাষায় রূপান্তরিত করা হয়। ভারতের সঙ্গীতবিদ্যাও আরবদের প্রভাবিত করে। বিখ্যাত আরব কবি জাহিদ হিন্দুদের সঙ্গীতবিদ্যার প্রশংসা করেন এবং আরাে জানান যে, আরবেরা ভারতের সঙ্গীতশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থও অনুবাদ করেন।৯৪
সংস্কৃত ভাষায় লিখিত আরাে গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়। অনেকে মনে করেন যে, আরব্য উপন্যাসের কয়েকটি গল্প প্রথমে ভারতে প্রচলিত ছিল ও পরে আরবদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে।৯৫ যেমন কালীলা ওয়া দিমনা’ (ভারতীয় গ্রন্থকার বিদপাই এর রচয়িতা) এবং ‘বুযাসিক’ ও ‘বনূহর’—বিধাময় খ্যাতিসম্পন্ন গ্রন্থাবলী। ‘কালীলা ওয়া দিমনা’ হচ্ছে পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ। সর্বপ্রথম এ গ্রন্থখানা সাসানীয় শাসকদের আমলে সংস্কৃত থেকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। অতঃপর হিজরি দ্বিতীয় শতকে আবদুল্লাহ ইবনে আল মুকাফফা এর আরবি অনুবাদ করেন। এর ফারসি অনুবাদটির কোনাে সন্ধান পাওয়া না গেলেও আরবিতে অনূদিত গ্রন্থখানার অস্তিত্ব রয়েছে। এ গ্রন্থখানা এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, পদ্য-গদ্যে এর বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এই আরবি সংস্করণ থেকে বিশ্বের অনেক সভ্য ভাষাতেই এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ‘বুযাসিক’ ও ‘বলুহর’ গ্রন্থদ্বয় ‘কালীলা ওয়া দিমনা’র ন্যায় ব্যাপক খ্যাতি লাভ করতে পারেনি। তবে এর গুরুত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব কালীলা ওয়া দিমনা’র চেয়ে অধিক ছিল। এই গ্রন্থে ছিল গৌতম বুদ্ধের জন্ম, প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন কাহিনি।
রবদের সময়ে সিন্ধুর কৃষি ও বাণিজ্য খুবই উন্নতি লাভ করে। আরব ভৌগােলিকেরা ওই এলাকার উন্নত কৃষি ব্যবস্থার বেশ প্রশংসা করেছেন। সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরবদের সাথে ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরাে দৃঢ় হয়। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে আরবগণ সমুদ্র-বাণিজ্যপথ দিয়ে বাংলায় আসে এবং মাঝেমাঝে তারা সরন্দ্বীপ ও রহুমীতেও আসত। দশম শতাব্দী পর্যন্ত চট্টগ্রামে আরব বণিকদের বসবাস করতে দেখা যায়। সিন্ধুর সঙ্গে বহির্বিশ্বের বাণিজ্যও চলত। স্থলপথে বাণিজ্য অন্যান্য এলাকায় বিস্তৃত ছিল এবং জলপথে বাণিজ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে চলত। সিন্ধু দেশের অমুসলিমগণ বহির্বাণিজ্যে বিশেষ অংশগ্রহণ করত। এই সময় আলােয়ার ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের সর্ববৃহৎ কেন্দ্র। আব্বাসীয় আমলে সিন্ধু ও মুলতানের রাজস্ব ১২ কোটি দিরহামেরও বেশি ছিল। এতেই আরবদের সময়ের সিন্ধু ও মুলতানের আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সুতরাং বলা যায়, আরবদের সিন্ধু বিজয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ তাৎপর্য পরিলক্ষিত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে আরব ও ভারতীয় পণ্ডিতদের যােগাযােগের মাধ্যমে। অর্থাৎ বলা যায়, সিন্ধু বিজয়ের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আর এটা সম্ভব হয়েছিল সিন্ধুতে আরবীয় শাসন প্রতিষ্ঠার দরুনই। স্বভাবতই আমরা সিন্ধু বিজয়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য অস্বীকার করতে পারি না। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম এর আকস্মিক মৃত্যু, দামেস্কে খলিফাদের বৈদেশিকনীতি পরিবর্তন আরবদের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যর্থতার কারণ ছিল। বিন কাসিমের পরে যােগ্য সামরিক নেতার অভাবে আরবরা সামরিক ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করতে পারেনি। তাছাড়া সিন্ধুর এক পার্থে রাজপুতদের শক্তিশালী অবস্থান এবং অন্যদিকে মরুভূমি হওয়ার কারণে সিন্ধু ছাড়া ভারতের অন্য অঞ্চল মুসলিমদের পক্ষে দখল করা সম্ভব হয়নি। দূরবর্তী অঞ্চল হিসেবে সিন্ধুতে আরব খলিফাগণ বিশেষ সহযােগিতাও করতে পারেননি। আরবরা ভারত অপেক্ষা আফ্রিকা মহাদেশে সামরিক ব্যাপারে বেশি ব্যস্ত থাকায় ভারতে তারা তেমন মনােযােগ দিতে পারেননি। তবে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের উপর আর সি মজুমদারের মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেন, “মুসলিম কর্তৃক ভারত বিজয় অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা যা পরবর্তী সময়ের উপর একটি স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছে। আর্যগণের আক্রমণের পর ভারতবর্ষের ইতিহাসে এটাকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কেননা ভারতবর্ষের ইতিহাসের চেহারাকে তা সম্পূর্ণভাবে বদলিয়ে দিয়েছে, আজ পর্যন্ত কিংবা ভবিষ্যতে কোনাে ঘটনা তা করতে পারেনি বা পারবে না।”৯৬ ড. দশরথ শর্মা জানিয়েছেন যে, আরব আক্রমণ ভারতের ইতিহাসে একটি নিষ্ফল ঘটনা নয়। আরব আক্রমণের পর প্রতিহার, চৌহান, পারমার ও সােলাঙ্কিরা পুরানাে শাসকদের সরিয়ে ভারতের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ কাজ তারা বেশ দক্ষতার সঙ্গে পালন করে, এ ঘটনার গুরুত্ব কম বলা যায় না।৯৭ সুতরাং ভারতবর্ষের সিন্ধুতে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের কাহিনির প্রতি লক্ষ্য রাখলে মনে হয় আরবদের সিন্ধু বিজয় নিষ্ফল বা শুধু কাহিনি সর্বস্ব নয়, এর সুদূরপ্রসারী ফল ও প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. ইসলাম ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বিখ্যাত পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ উইলিয়াম ড্রেপার বলেছেন, “তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি মানব জাতির উপরে সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করে গেছেন।” (Of all men, Mohammad has exercised the greatest influence upon the human race.’ দেখুন-উইলিয়াম ড্রেপার, দ্য হিস্টরি অফ দ্য ইন্টেলেকচুয়্যাল ডেভেলপমেন্ট অফ ইউরােপ, খণ্ড-১, পৃ. ৮২৯)। ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’তেও একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ‘Mohammad is the most successful of all prophets and religious personalities.’ মাইকেল এইচ হার্ট বিধের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের জীবনের নানাদিক বহু বিচার-বিশ্লেষণ করে হযরত মােহাম্মদকে (সঃ) বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে একক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহিত করেছেন। দেখুন- মাইকেল এইচ হার্ট, দ্য হান্ড্রেড বির্বশ্রেষ্ঠ শতমনীষীর জীবনী, বাংলা অনুবাদ অধ্যাপক আবদুল আজিজ, পরিবেশক- তাফহীম প্রকাশনী, ঢাকা, মার্চ-২০০৯, পৃ. ৯-১৩।
- ২. মানবেন্দ্রনাথ রায়, দ্য হিস্টরিক্যাল রােল অফ ইসলাম, ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, বাংলা অনুবাদক-মােহাম্মদ আবদুল হাই, রেনেসাঁস, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৭ ও ৯-১০। আরাে দেখুন- সুবােধ কুমার মুখােপাধ্যায়, আদিমধ্য ও মধ্যযুগে ভারত, মিত্রম, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৬৫।
- ৩. এইচ এ এল ফিসার, এ হিস্টরি অফ ইউরােপ, লন্ডন, ১৯৫৭, পৃ. ১৩৭-৩৮।
- ৪. রামপ্রাণ গুপ্ত, পাঠান রাজবৃত্ত, কলকাতা, ১৩১৮, পৃ. ১-২।
- ৫. টি ডব্লিউ আর্নল্ড, দ্য প্রিচিং অফ ইসলাম, ইসলাম প্রচারের ইতিহাস, বাংলা অনুবাদক-মােহাম্মদ সিরাজ মান্নান ও ইব্রাহিম ভূঁইয়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃ. ৩০০।
- ৬. টি ডব্লিউ আর্নল্ড, দ্য প্রিচিং অফ ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭।
- ৭. ঈশ্বরী প্রসাদ, এ শর্ট হিস্টরি অফ মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া, দ্য ইন্ডিয়ান প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, এলাহাবাদ, ১৯৬২, পৃ. ৯।
- ৮. টি ডব্লিউ আর্নল্ড, দ্য প্রিচিং অফ ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬।
- ৯. টি ডব্লিউ আর্নল্ড, দ্য প্রিচিং অফ ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭।
- ১০. এম এন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০-১২।
- ১১. ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা মালাবার। এই মালাবার আরবদের জন্য একটি বিশেষ ব্যবসা কেন্দ্রীক ঘাঁটি ছিল। মালাবারকে আরবরা ‘মা’বার’ বলতেন, আরবিতে এর অর্থ পারঘাট। আরব বণিক, নাবিকগণ এই ঘাটের ওপর দিয়ে মক্কা, হেজাজ, মিশর ও চীনের মধ্যে যাতায়াত করতেন। বলাবাহুল্য, মা’বার নাম তাদেরই রাখা।
- ১২. কেনেডির প্রতিবেদন, জার্নাল অফ রয়েল এশিয়াটিক সােসাইটি, ১৮৯৮, পৃ. ২৪১।
- ১৩. তারাচাঁদ, দ্য ইনফ্লুয়েন্স অফ ইসলাম অন ইন্ডিয়ান কালচার, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব, বাংলা অনুবাদ করুণাময় গােস্বামী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ২৪।
- ১৪. তারাচাঁদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫।
- ১৫. রাওল্যান্ডসন সম্পাদিত, শেখ জায়নুদ্দিন তুহুফাৎ-উল-মুজাহিদিন, ১৯৩৭, উপক্রমিকা দ্রষ্টব্য।
- ১৬. ফ্রান্সিস ডে, দ্য ল্যান্ড অফ পেরুমলস্, ত্রিবান্দ্রম, ১৯১৮, পৃ. ৩৬৫।
- ১৭. মালাবারে আগত আরবীয় ও অন্যান্য মুসলিমরা যথেষ্ট সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেছিল। তাদেরকে মােপলা উপাধি দেওয়া হয়। এর অর্থ হচ্ছে বড় ছেলে (মহা + পিলা বা পলা)। এটি আদর বা সম্মান ও শ্রদ্ধাবােধক উপাধি। এস এ এ রিজভি বলেছেন, মােপলা শব্দটি এসেছে ‘মাপিলা’ থেকে—এর অর্থ বিয়ের বর হতে পারে, আবার শিশুও হতে পারে। মােপলাদের উৎপত্তি হয়েছে আরবদের ও স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে বৈবাহিক সংযােগের ফলে। (এস এ এ রিজভি, দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, অনুবাদক-অংশুপতি দাশগুপ্ত, অতীতের উজ্জ্বল ভারত, খণ্ড-২, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ৬১)। মােপলা সম্বন্ধে বিকোষ প্রণেতা লিখেছেন, “ইহারা অধ্যাবসায়শীল, কর্মক্রম এবং বর্ধিষ্ণু। ইহারা আবার সুগঠিত ও বলিষ্ঠ …ইহারা দেখিতে সুশ্রী ..ইহাদের ন্যায় পরিশ্রমী দ্বিতীয় জাতি ভারতবর্ষে আর কোথাও দৃষ্ট হয় না।…সাহসিকতায় ইহারা চিরপ্রসিদ্ধ…আরবীয় ধর্ম মতে দীক্ষাদানই ইহাদের প্রধান কাজ। ইহারা শ্মশ্রুধারণ করে। কেশ কর্তন করে। সকলেই মস্তকে টুপি দেয় ..ইহারা স্বভাবতঃ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।” দেখুন- বিশ্বকোষ, খণ্ড-১৪, পৃ. ৬১৭।
- ১৮. স্টারক, সাউথ কানাডা ম্যাড্রাস ডিস্ট্রিক্ট ম্যানুয়েলস, পৃ. ১৮০ দেখুন- তারাচঁাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬।
- ১৯. গােলাম মকসুদ হিলালী, ইরান ও ইসলাম, ঢাকা, ১৯৭৬, পৃ. ২৮-২৯।
- ২০. তারাচাঁদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭।
- ২১. কেনেডি, দ্য আরলি কমার্স অফ ব্যাবিলন উইথ ইন্ডিয়া, জার্নাল অফ রয়্যাল এশিয়াটিক সােসাইটি, ১৯৯৮।
- ২২. দ্রষ্টব্য-এডকিনস্, এনসিয়েন্ট নেভিগেশন ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওসান, জার্নাল অফ দ্য রয়েল এশিয়াটিক সােসাইটি, ১৯৯৮, দেখুন-তারাচঁাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১।
- ২৩. তারাচাঁদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯।
- ২৪. তারাচাঁদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬।
- ২৫. চাচনামা (ফারসি) মুহাম্মদ আলি বিন আবুবকর কুফী, ইংরেজি অনুবাদ- মির্জা কালিচ বেগ, করাচি, ১৯০০ বাংলা, অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৮৭-৮৮। তারাচঁাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫।
- ২৬. তারাচাঁদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫-২৬।
- ২৭. তবে আরব মুসলমান কিংবা মুহাম্মদ বিন কাসিমের আগে বহু বিজয়ী ভারতে প্রবেশ করেছেন। বস্তুত খাইবার গিরিপথ তাে আক্রমণকারীদের পথ প্রদর্শকের ভূমিকাই পালন করেছে। তাদের কারাে নাম আর্য, কেউ গ্রীক, কুষাণ, হুন ইত্যাদি। হর্ষচরিত হতে জানা যায় যে, হর্ষবর্ধনের পিতার সঙ্গে সিন্ধুরাজের শত্রুতা ছিল। হর্ষ সিন্ধু আক্রমণ ও দখল করেছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের বৈশিষ্ট্যই ছিল স্বতন্ত্র—এই প্রথম ভারতের ইতিহাসে দেখা গেল, বিজয়ী শক্তি ইসলামীয় নীতি অনুসারে পরাজিত শক্তিকে রক্ষা করে শুধু নয়, তাদের জীবন-সম্পদ-মর্যাদাকে নিজেদের আমানত তথা গচ্ছিত সম্পদ হিসেবে ঘােষণা করে।
- ২৮. ডব্লিউ হেগ সম্পাদিত, কেমব্রিজ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৩, নিউইয়র্ক, ১৯২৮,পৃ. ২-৯।
- ২৯. তারাচঁাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬।
- ৩০. এস এম ইকরাম, উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা সংস্কৃতির ইতিহাস, বাংল অনুবাদ-জুলফিকার আহমদ কিসমতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ১৭। অরাে দেখুন- সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭।
- ৩১. কাশ্মীরের রাজকীয় ইতিহাস ‘রাজতরঙ্গিনী’তে বলা হয় যে, রাজা যশােবর্মণ কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যের স্তুতিকারে পরিণত হন। এই সময় তুর্কিরা পাঞ্জাবের জলন্ধর, কাংড়া ও পুঞ্জ অধিকার করে। এই বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, যশােবর্মন ললিতাদিত্যের সামন্তে পরিণত হন। এই সময় আবার আরবরা মাকরান দখল করে কাসিমকে শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন। পরবর্তী সময়ের সিন্ধু বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম মাকরানের শাসনকর্তা উক্ত কাসিমের পুত্র। মুহাম্মদ বিন কাসিম শৈশবে পিতৃহারা হন। দেখুন- সৈয়দ আমির আলি, হিস্টরি অফ স্যারাস্যান্স, কলকাতা, ১৯৭৯, পৃ. ৪৫।
- ৩২. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৯ এস এ এ রিজভি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২।
- ৩৩. ঈশ্বরীপ্রসাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬।
- ৩৪. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৫।
- ৩৫. এস এম ইকরাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮।
- ৩৬. ঈশ্বরী প্রসাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০।
- ৩৭. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৩। ঈশ্বরী প্রসাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০।
- ৩৮. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৩। এ কে এম আবদুল আলিম, ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ, ২০১১, পৃ. ১২।
- ৩৯. Imperial Gazetteer-IX, P-8, দেখুন-ঈরী প্রসাদ, প্রাগুক্ত,পাদটীকা, পৃ. ৩১।
- ৪০. চাচনামা সিন্ধুর আঞ্চলিক ইতিহাসের ওপর লিখিত একটি প্রাথমিক উৎস গ্রন্থ। এ গ্রন্থটিতে রাজা দাহিরের পিতা চাচের সিংহাসন লাভ এবং আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সপ্তম শতকে রাজপুত বংশীয় রাই সাহাসি নামে এক রাজা সিন্ধু রাজ্য শাসন করতেন। তার পুত্র ছিলেন রাই সাহিরাস। তার রাজ্যসীমা পূর্বে কামীর, পশ্চিমে মাকরান, দক্ষিণে সমুদ্র উপকূল ও উত্তরে কাইকান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দেবল ছিল এই রাজ্যের প্রধান বন্দর ও রাজধানী ছিল আলােয়ার নগর। ব্রাহ্মণাবাদ বা বাহমনাবাদ, সিওস্তান, ইসকান্দা ও মুলতান ছিল সিন্ধু রাজ্যের চারটি প্রদেশ। পারস্য রাজের সঙ্গে এক যুদ্ধে রাজা সাহিরাস নিহত হলে তার পুত্র দ্বিতীয় রাই সাহাসি সিন্ধুর সিংহাসনে আরােহন করেন। সিলাইজ-পুত্র চাচ নামক এক ব্রাহ্মণ ছিলেন রাজা দ্বিতীয় রাই সাহাসির মহামন্ত্রী। মহামন্ত্রী চাচ পরবর্তীতে রাজা দ্বিতীয় রাই সাহাসির মৃত্যুর পর সিন্ধুর সিংহাসন দখল করেন এবং রাজার বিধবা পত্নী রানী সুহান্দীকে বিবাহ করেন। এদেরই দুই পুত্র দাহির ও দাহারশিয়া এবং কন্যা বাঈ। (চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১-৪২)। চাচের মৃত্যুর পর সহােদর চান্দার (তার দুই পুত্র—বাছেরা ও কাকাস) সিংহাসনে বসলে প্রাদেশিক শাসকগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ অবশ্য আরও গভীরে ছিল। জ্যোতিষ বচনের অজুহাত দিয়ে সাম্রাজ্যের লােভে নিজের বােন বাঈকে বিয়ে করার মাধ্যমে দাহিরের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গ ও বিশেষ করে নিজের ভাই দাহারশিয়ার সাথে বিরােধ-বিচ্ছেদ ঘটে। দাহির ভাই দাহারশিয়াকে হটিয়ে সিংহাসন দখল করেন। তিনি কৌশলে প্রদেশগুলাের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করেন। যাইহােক, চাচনামা গ্রন্থে চাচনামা বলে কোনাে শব্দ লিখিত হয়নি। আসলে এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে কোনাে নাম ছিল, বরং এর ভূমিকায় ‘ফতেহনামা’ নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এলফিনস্টোন এই গ্রন্থটিকে ‘তারীখ-ই-হিন্দ ও সিন্দ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। পরবর্তীকালে নুল হক তার ‘যােবদাত উত-তাওয়ারীখ’ গ্রন্থে, নিযামুদ্দীন আহমদ বখশী তার ‘তাবাকাত-ই-আকবরী’ গ্রন্থে এবং আবুল কাসিম ফিরিস্তা ও মীর মাসুম তাদের গ্রন্থে এই গ্রন্থ হতে উপকরণ গ্রহণ করেছেন। নিযামুদ্দীন আহমদ বখশী এই গ্রন্থটিকে চাচনামা বলে উল্লেখ করেছেন। এই গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেন স্যার হেনরি ইলিয়ট। তিনি ১৮৬৭ সালে ‘হিস্টরিয়ান্স অফ সিন্ধ’-এর ভলিয়মে ‘চাচনামা’ নাম দিয়ে এ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। তখন থেকেই এই গ্রন্থটির নাম ‘চাচনামা’ নামে খ্যাতি লাভ করে। মূলত এই চাচনামা মূল আরবি হতে ফারসিতে অনূদিত হয়েছে। মূল আরবি গ্রন্থটি কখন রচিত হয়েছিল তা সঠিক করে বলা যায় না। তবে বিভিন্ন প্রেথিত বিচার করে বলা যায় যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু বিজয়ের পর সমসাময়িককালে কোনাে সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক আরবি ভাষায় দাহিরের পিতা চাচের ক্ষমতা দখল ও রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজয়, তার পরবর্তী ঘটনা ও প্রশাসনিক অবকাঠামাের ওপর আলােকপাত করে এই গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। গ্রন্থটির কোথাও রচনাকালের উল্লেখ নেই। সবদিক বিচার-বিবেচনা করে আরবি গ্রন্থটির রচনাকাল ৭১২ সাল থেকে ৭৫৪ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায়। তবে আমাদের মনে হয় গ্রন্থকার মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের সময় এখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন কাল্পনিক গল্প পরিবেশন করে তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন। চাচনামার মূল আরবি গ্রন্থ হতে মুহাম্মদ বিন আলী বিন হামিদ বিন আবুবকর কুফী কর্তৃক নাসিরউদ্দিন কুবাচার সময় ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে ফারসিতে অনূদিত হয়। অনুবাদক আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে উন্নত জীবিকার সন্ধানে নিজ মাতৃভূমি কুফা পরিত্যাগ করে ভারতের উচ প্রদেশে আসেন। ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে তার ৫৮ বছর বয়ঃক্রমকালে তিনি সকল চিন্তামুক্ত হয়ে সুখ্যাতির প্রত্যাশায় ভারতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজয়, মুসলিম সমাজ গঠন ও শিক্ষার সম্প্রসারণ, মসজিদ ও মাদ্রাসা বিনির্মাণ এবং সিন্ধুর অধিপতি রাজা চাচের পুত্র দাহিরের পরাজয় প্রভৃতি বিষয়ের ওপর উপাত্ত ও উপকরণ সংগ্রহ করে গ্রন্থ রচনা করতে মনস্থ করেন। এতে করে একদিকে তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করার প্রত্যাশা করেন এবং অপরদিকে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে তিনি সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে একটি গ্রন্থের সন্ধান পান। আরবিতে লেখা এই গ্রন্থটি তিনি পাঠ করেন এবং এটিকে সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে একটি উন্নতমানের গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেন। পরে ফারসিতে মুহাম্মদ বিন আলি বিন হামিদ বিন আবুবকর কুফী গ্রন্থটির ভাষান্তরিত করেন। বালাজুরীর ‘ফুতুহুল বুলদান’-এর বর্ণনার সঙ্গে ‘চাচনামা’য় বর্ণিত ঘটনার দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সিন্ধু ও মুলতান এবং পার্ববর্তী অঞ্চলের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাস জানার জন্য ‘চাচনামা’ গ্রন্থের উপর পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকগণ অনেকটাই নির্ভর করেছেন। তাছাড়া ভারতের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভূইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য এটি মুখ্য লিখিত উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ‘চাচনামা’ সম্পর্কে এই মূল্যায়নের সমর্থনে ঐতিহাসিক ডওসনের উদ্ধৃতিটি প্রণিধানযােগ্য, “An air of truth pervades the whole, and though it reads more like a romance than history, yet it is occasioned more by the intrinsic interest of subject, than by fictions proceeding from the imagination of the author’ এরই প্রাসঙ্গিকতায় ঐতিহাসিক এলফিনস্টোনের মূল্যায়ণ যথার্থ বলে মনে হয়। ‘চাচনামা’ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন ‘Though loaded with tedious speeches, and letters ascribed to the principal actors, it contains a minute and consistent account of the transactions during Mohammad Kasim’s invasion, and some of the preceding Hindu reigns. It is full of names of place, and would throw much light on the geography of that period, if examined by any person capable of ascertaining the ancient Sanskrit names, so as to remove the corruptions of the original Arab writer and the translator,
- besides the innumerable errors of the copyist.’
- ৪১. এস এ এ রিজভি লিখেছেন, “ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের (বৌদ্ধদের) সরিয়ে দিয়ে। বৌদ্ধদের দ্বারা ব্রাহ্মণ-শক্তির বিরুদ্ধতা যে এই পরাজয়ের অন্যতম কারণ তা জোর দিয়েই বলতে হবে।” দেখুন- এস এ এ রিজভি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪।
- ৪২. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৮।
- ৪৩. দেখুন-জাকাউল্লা প্রণীত, তারিখে হিন্দুস্তান, খণ্ড-১, ১৯৪৮, পৃ. ২১২।
- ৪৪. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৭।
- ৪৫. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৭। আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৯।
- ৪৬. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৭।
- ৪৭. এস এ এ রিজভি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪।
- ৪৮. মজুমদার দত্ত চৌধুরী, অ্যান অ্যাডভান্সড় হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮২। আরাে দেখুন- সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯।
- ৪৯. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৫-৬৯।
- ৫০. ডব্লিউ হেগ সম্পাদিত, কেমব্রিজ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭। রাজা দাহিরের পুত্র জায়সিয়া (জয় সিংহ) সম্পর্কেও যে অভিযােগ উত্থাপন করা হয়েছে তা অনেকটা কল্পকাহিনির মতাে মনে হয়। জায়সিয়া সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে তার পার্ববর্তী রাজন্যবর্গের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার প্রয়াস পান। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি সাতশত পদাতিক ও অর্বারােহী সৈন্যসহ কুরিজে দুর্গে উপনীত হন। সেই দুর্গাধিপতি দ্রোহার তাকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানান। প্রথা অনুযায়ী দ্রোহার সপ্তাহের একদিনে সুরাপান ও নাচগানের উৎসবের আয়ােজন করতেন। এই উৎসবে জায়সিয়াকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তাতে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন যে, তিনি একজন সাধু এবং নিজ স্ত্রী ছাড়া কোনাে অপরিচিত রমনীর মুখ দর্শন করেন না। দ্রোহার তার কথায় মুগ্ধ হন এবং তাকে এই উৎসবে যােগদান করা হতে অব্যাহতি দান করেন। মহিলারা জায়সিয়ার দর্শনে মুগ্ধ হন এবং দ্ৰোহারের ভগ্নি জানকী তার প্রেমাসক্ত হন। তার সাথে দৈহিক মিলনের প্রস্তাব দিলে একজন সাধু হিসেবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে অপমান বােধ করে জানকী তার ভ্রাতা দ্ৰোহারের নিকট অভিযােগ উত্থাপন করে যে, সাধু জায়সিয়া তার কক্ষে ঢুকে শ্লীলতাহানি করেছে। প্রতিশােধ হিসেবে তাকে হত্যা করতে হবে। দ্রোহার একজন রাজকীয় অতিথিকে হত্যা করা যায় না বলে একটি বিশেষ কৌশলের মাধ্যমে তাকে হত্যা করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তার অপকৌশল সফল হয়নি, বরং জায়সিয়া তার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। চাচনামায় বর্ণিত এই ঘটনাটি (চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৯-৫৪) অনেকটা উপাখ্যান বলে মনে হয়। তবে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এরূপ কল্পকাহিনির সন্ধান মেলে। সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে ঔৎসুক্য সৃষ্টি করার লক্ষ এরূপ কাহিনির অবতরণ নিরর্থক নয়। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে এটি বাস্তবধর্মী না হয়ে কল্পনাধর্মী এপিসােড হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
- ৫১. ‘ফুতুহুল বুলদান’ গ্রন্থের লেখক ঐতিহাসিক আল্লামা বালাজুরী ভারত উপমহাদেশে সফর করেননি, তবে তিনি আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের (৮৪২-৬১) সন্তানদের গৃহশিক্ষক হওয়ার সুবাদে সরকারের দপ্তর থেকে তথ্য গ্রহণ করার সুযােগ পেয়েছেন। উপরন্তু তিনি মানসুর বিন হাতেম থেকে সিন্ধুর ইতিহাস সম্পর্কে উপাদান ও উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। এছাড়াও বালাজুরী আল-মাদাইনী ও ইবন আল-কালবি থেকে সিন্ধুর ইতিহাস সম্পর্কে উপাদান গ্রহণ করেছেন। ‘ফুতুহুল বুলদান’ গ্রন্থে আরবদের প্রাথমিক নগর ও শহর বিজয়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। উমাইয়া আমল (৬৬১-৭৫০) পর্যন্ত আরব মুসলমানগণ যেসব দেশ বিজয় করেন সেগুলাের মধ্যে সিরিয়া, মেসােপটেমিয়া, মিশর, পারস্য, আরমেনিয়া, ট্রান্সজাকসিয়ানা, আফ্রিকা, স্পেন প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তাছাড়া মুসলমানগণ কর্তৃক ভারত উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে অভিযানের এক ধারাবাহিক বর্ণনাও আল-বালাজুরী তাঁর গ্রন্থে প্রদান করেছেন। তিনি বিশেষ করে সিন্ধু, মুলতান ও পার্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের বিজয় সম্পর্কে যে ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন তা বস্তুনিষ্ঠ বলে অনুমিত হয়। এছাড়াও এই গ্রন্থে সিন্ধু ও তার পার্ববর্তী অঞ্চলের ভৌগােলিক অবস্থান, নৈসর্গিক দৃশ্য ও নদ-নদী সম্পর্কে বালাজুরী যে তথ্য প্রদান করেছেন তা সত্যিই মূল্যবান। মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজয় থেকে শুরু করে আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর রাজত্বকাল পর্যন্ত উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলের সিন্ধুর প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের নাম ও তাদের কার্যক্রমের উপরও বালাজুরি তার গ্রন্থে আলােকপাত করেছেন। উপরন্তু সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতির পরিচয় তিনি তাঁর গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন। সার্বিক পর্যালােচনায় বলা যায়, কিছু অসঙ্গতি থাকলেও বালাজুরী সিন্ধুর ঘটনাবলীর উপস্থাপনে একজন। নির্মোহ ও সূক্ষ্মাদ্রষ্টা ঐতিহাসিকের ভূমিকা পালন করেছেন। দেখুন-আল্লামা বালাজুরী ফুতুহুল বুলদান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন সম্পাদিত, বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৯৮। ‘ফুতুহুল বুলদান’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট প্রাচ্যবিশারদ পণ্ডিত এম. জি. ডি. জুইয়া বলেন, “এ-গ্রন্থটি সম্পর্কে মন্তব্য করার মতাে ভাষা আমার জানা নেই। কেবল এতটুকু বলব, এ যেন একটি দর্পণ, যাতে ইসলামি রাজ্যসমূহের প্রাথমিক যুগের চিত্র চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এ-গ্রন্থের পাঠক ইসলামি রাষ্ট্রের সার্থক রূপকার উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে একজন সুযােগ্য নেতা এবং ইসলামি চরিত্র-মাহাত্ম্যের উন্নত আদর্শরূপে দেখতে পাবেন। মুত্তাকী, বিনয়ী, মিতব্যয়ী, দরিদ্র, নিঃস্বদের তােষণ-পােষণকারী অথচ ইসলামের শত্রুদের প্রতি কঠোর। তিনি লােকজনের সম্পদের প্রতি লােভ করা এবং বিলাস-ব্যাসন প্রদর্শনীকে ঘৃণা করতেন। তিনি নগরবাসীদেরকে যাযাবরদের আগ্রসী তৎপরতা থেকে রক্ষা করতেন। মক্কার বৈরী ভাবাপন্ন সমাজপতিদের বাড়াবাড়ি থেকে সাহাবীদের হকের হিফাজত করতেন। এই গ্রন্থের পাঠক এটাও লক্ষ করবেন যে, আরব কীভাবে রােম ও ইরানে তাদের বিজয় অভিযান। চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের নিরক্ষরতা যাযাবর জীবন এবং নাগরিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সুদীর্ঘকাল ধরে অনবহিত সত্ত্বেও তারা কীভাবে কঠোর পরীক্ষাসমূহে উত্তীর্ণ হয়ে তাদের একক উদ্দেশ্য অর্থাৎ দ্বীন ইসলামের প্রচার প্রসার ও আরব জাতির বিজয়-বৈজয়ন্তী উড়িয়ে যাচ্ছেন।” দাক্ষিণাত্যের বিখ্যাত উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দ্রাবাদ থেকে ১৯৪৭ সালের বিভাগ পূর্বকালে ‘ফুতুহুল বুলদান’এর উর্দু অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। অনুবাদ করেছিলেন সাইয়েদ আবুল খায়ের মওদূদী। করাচিতে বিখ্যাত ‘নফিস একাডেমি’ ১৯৬২ সালে এ উর্দু সংস্করণটির ১ম পাকিস্তানি সংস্করণ প্রকাশ করেন। উক্ত উর্দু সংস্করণের ভূমিকায় মুহাম্মদ ইকবাব সলীম গাহেন্দরী বালাজুরীর জন্মসাল ২০৩ হিজরি এবং মৃত্যু ২৭৯ হিজরিতে বাগদাদে হয় বলে উল্লেখ করেছেন। ‘বালাজুর’ নামক একপ্রকার ফল সেবনে আল্লামা বালাজুরীর মৃত্যু ঘটে। ফলটি না চিনে তা সেবন করার ফলে তার এ দশা হয়েছিল। কথিত আছে যে, এ ফলটি সেবনে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অধিক সেবনে মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়। বালাজুরীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
- ৫২. ঈশ্বরীপ্রসাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬।
- ৫৩. এস এম ইকরাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮-১৯।
- ৫৪. চাচ ছিলেন বাগ্মী অলংকারশাস্ত্র, নীতিবিদ্যা, আইনশাস্ত্রে তার পাণ্ডিত্য ছিল লক্ষণীয়। চাচ নিজের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে “আমার নাম চাচ, পিতার নাম সিলাইজ, আমরা ব্রাহ্মণ। আমার সহােদর চান্দার। এবং পিতা সিলাইজ সহ আলাের নগরীর সন্নিকটে এক পাড়াগাঁয়ের দেবালয়ে আমরা বাস করি।” দেখুন- চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মুধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮-২৯।
- ৫৫. চাচনামা,বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৫ ও ৬৭।
- ৫৬. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ.২২৯-২৩০।
- ৫৭. এস এম ইকরাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০।
- ৫৮. এস এম ইকরাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১। আরাে দেখুন- সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯।
- ৫৯. ঈশ্বরীপ্রসাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫। চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩০।
- ৬০. চাচনামা, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ.২২৭।
- ৬১. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বাংলা অনুবাদ-সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ১৪০। এ কে এম আবদুল আলিম, ভারতে মুসলিম শাসন ব্যবস্থার ইতিহাস, মাওলা ব্রাদার্স, চতুর্থ সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ১৪২। চার্লস হ্যামিলটন কর্তৃক অনূদিত ও এস গ্রোভ সম্পাদিত, হিদায়া, খণ্ড-২, লন্ডন, ১৯৭০, পৃ. ২১১-২১৪ আরও দেখুন-Thomas Patrick Hughes, ibid, P. 248 এবং এন পি আগনাইডস, মহামেডান থিয়ােরিজ অফ ফিনান্স, পৃ. ৩৯৮-৯৯।
- ৬২. এস এম ইকরাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০।
- ৬৩. ঈশ্বরীপ্রসাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬, দেখুন-ইলিয়ট ও ডওসন সম্পাদিত, হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টরিয়ান, খণ্ড-১, লন্ডন, ১৮৬৭, পৃ. ১৮৫ চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩১।
- ৬৪. একই বক্তব্য পাওয়া যাবে ‘চাচনামা’য়, বাংলা অনুবাদ- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত,পৃ. ২৩১।
- ৬৫. চাচনামা (ফারসি), ইংরেজি অনুবাদ-মির্জা কালিচ বেগ, করাচি, ১৯০০ দিল্লি, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৭৯, পৃ. ১৬৮-৬৯, আরও দেখুন- চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩২।
- ৬৬. ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৩, চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৩।
- ৬৭. ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৬ চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৩।
- ৬৮. দেখুন-ঈশ্বরীপ্রসাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬। আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, ২০১৫, পৃ. ৭।
- ৬৯. ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৭ চাচনামা, বাংলা অনুবাদ-মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৩।
- ৭০. আল্লামা বালাজুরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪১।
- ৭১. টি ডব্লিউ আর্নল্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৮।
- ৭২. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯।
- ৭৩. ইলিয়ট ও ডওসন, প্রাগুক্ত, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৪।
- ৭৪. উদ্ধৃত- মজুমদার দত্ত ও চৌধুরী, অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, ম্যাকমিলন, লন্ডন, ১৯৬০, পৃ. ২৫৭।
- ৭৫. লােগান, মালাবার, খণ্ড-১, পৃ. ২৪৫ দেখুন-তারাচঁাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮।
- ৭৬. সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, ডি এম লাইব্রেরী, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১২৪-২৫।
- ৭৭. বিকোষ, খণ্ড-১৪, পৃ. ২৩৪।
- ৭৮. এস এম ইকরাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫।
- ৭৯. তারাচাঁদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮।
- ৮০. লােগান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩১।
- ৮১. ইনস, মালাবার অ্যান্ড অ্যানজেনগাে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, পৃ. ১৯০৷
- ৮২. তারাচাঁদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০-৩২।
- ৮৩. নেলসন, মাদুরা ডিস্ট্রিক্ট ম্যানুয়েল, পৃ. ৭৮-৭৯।
- ৮৪. তারাচঁাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১।
- ৮৫. তারাচঁাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১।
- ৮৬. এস এম ইকরাম, মুসলিম সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া, নিউইয়র্ক, ১৯৬৯, পৃ. ২১।
- ৮৭. এস এ এ রিজভি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬ ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৫।
- ৮৮. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩।
- ৮৯. আই এইচ কুরেশী, দ্য মুসলিম কমিউনিট অফ দ্য ইন্দো-পাকিস্তান সাবকন্টিনেন্ট, দ্য হেগ, ১৯৬২, পৃ. ৪০-৪২।
- ৯০. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।
- ৯১. ই বি হ্যাভেল, এরিয়ান রুল ইন ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৯২১, পৃ. ২৫৬। কিন্তু ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র বলেছেন, আরবীয় পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীরা বাগদাদের খলিফাদের ছায়াতলে মুক্তভাবে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ স্বাধীনতা ভােগ করতেন। ফলে আরবে বিজ্ঞান ও সভ্যতার বিস্ময়কর উন্নতি সম্ভব হয়েছিল। ভারতীয় পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীরা এরকম স্বাধীনতা ভােগ করতেন কিনা সে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারতে প্রবেশের পথ পায়নি। এ যুগে ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের গতি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আরবীয় জ্ঞানবিজ্ঞান যদি ভারতে প্রবেশ করত, তাহলে ভারতীয় বিজ্ঞান ও সভ্যতা বিশেষভাবে যে সমৃদ্ধ হত তা বলা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার সেটা নানা কারণে সম্ভভ হয়নি। আরবীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সমন্বয় ঘটলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মােচিত হত। তবে এটা আমাদের মেনে নিতে হবে যে, পরবর্তীকালে দিল্লি সুলতানি আমলে (১২০২-১৫২৬) হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির যে মেলবন্ধনের ধারা লক্ষ করা যায়, তাকে বহুলাংশে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল সিন্ধুদেশে উদার আরবীয় শাসনের ভাবধারা ও কৃষ্টির অপ্রত্যক্ষ প্রেরণা। তবে ই বি হ্যাভেলের এরূপ মতামতকে অতিরঞ্জিত বলে মতপ্রকাশ করেছেন ঐতিহাসিক আই এইচ কুরেশিও। তিনি লিখেছেন, “Hindu historians have exaggerated the cultural importance of this conquest. They seem to think that it was by coming into contact with Hindų learing in Sịnd that the Arabs were civiļized. This view, however, exaggerates Hindu influence in Arab civilization. The Arabs were more indedted to Greek, Roman and Bzxantine traditions than to the learning of the Hindus whose contribution was very limited. Even in astronomy in which the Hindus were strong, the Muslims absorbed Greek traditions, rather than Hindu. Muslim philosophy, medicine, mathematics, sciences and even, fundamentals of political thought ‘leặrned upon the teachings of Greek masters, though of course, the Muslims were by no means averse to learning from any one who was capable of teaching. In all probability the Arab learned the Arab system of notion form the Hindus. The conquest of Sind was not the only agent which brought the Arab and Hindự together; Arab contacts with India were older, even in Sind: Arabs were living before the conquest. From the point of view of the history of Islam the importance of the conquest of Sind lies in the fact that it was here that a the mass of the population was Buddhist and disliked the tyranny of Hindu rule. The Arabs found it easier to reconcile them to their regime. The political power of the Muslims saw fluctuations in Sind, but there is no record of a Hindu or a Buddhist rebellion, which is a remarkable testimony to the success of the Arabs in making theis rule acceptable. Another testimony is that the majority of the population was gradually converted to Islam.” See-History of the Freedom Movement, Part-I, Renessan publishing house, Delhi, 1984, P.-8.
- ৯২. সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১।
- ৯৩. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।
- ৯৪. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।
- ৯৫. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।
- ৯৬. উদ্ধৃত-মােহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাস, গ্রন্থ কুটির, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৩।
- ৯৭. সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।