জাতি, বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠী—সব কিছু সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে কাজি নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব। তিনি এক দিকে যেমন দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের প্রেরণা জুগিয়েছেন, অন্যদিকে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এনেছিলেন নতুন জোয়ার। প্রচলিত নিয়ম নীতি, ছন্দগীতি ও গঠননীতিকে যেন চুরমার করে দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাজনৈতিক, সামাজিক পটভূমিতে ধূমকেতুর মতো হঠাৎ তিনি আবির্ভূত হলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি আনলেন চির বিদ্রোহের বাণী। সৈনিক কবি কাজি নজরুল ইসলামের লেখনী অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হয়ে দাঁড়াল ক্ষুধার তরবারি। তিনিই প্রথম প্রমাণ করলেন কলম তলোয়ারের চেয়ে শক্তিশালী। তার এই কণ্ঠকে স্তব্ধ করার বারবার চেষ্টা হয়েছে, লাগানো হয়েছে গোয়েন্দা, বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে একটার পর একটা বই। ব্রিটিশ শাসক তাতেও ক্ষান্ত হননি। সর্বশেষে কবিকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। শত অত্যাচার, উৎপীড়ন সহ্য করেছেন চোখ বুজে, তবুও কবিকে থামানো যায়নি। কারাগার থেকেই ডাক দিয়েছেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ভেঙে ফেলবার জন্য। তাই তো সুভাষচন্দ্র বলেছেন— ‘কারাগারে আমরা অনেকে যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু কাজি নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রভাব তাঁর – লেখার অনেক স্থলেই পাওয়া যায়। এতেই বোঝা যায় যে তিনি একটি জ্যান্ত মানুষ।
পরাধীনতার লাঞ্ছনা, অসহ্য, দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্রতা, সমাজের ভণ্ডামি, ধর্ম ও রাজনীতির নামে অসংখ্য রকমের শোষণ কবিকে ব্যথিত করেছিল। তাই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল শোষিত, নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার। তিনি যথার্থই জনগণের কবি। তবে নিছক সাম্যবাদের কবি হলে তিনি এত বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারতেন। ভারতবর্ষে তখন সবচেয়ে জরুরি সমস্যা পরাধীনতা—কাজি নজরুল সেই পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেই অচিরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এইরকম ব্যাপক জনপ্রিয়তা সমকালীন আর কোনো কবির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়নি। একক লেখক হিসেবে সমসাময়িক কালে তাঁর বই, রচনাই সবচেয়ে বেশি নিষিদ্ধ এবং বাজেয়াপ্ত। নিছক সংখ্যার দিক থেকে অন্য কোনো লেখকের নিষিদ্ধ বইয়ের সংখ্যা অধিক হলেও কাজি নজরুল ইসলামের মতো তাঁরা সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ (সম্পাদক : নলিনীকান্ত সরকার) তে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পরই বাঙালির শিরায় যেন বয়ে গেল তরল অনল। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন: কে এই ‘বিদ্রোহী’র কবি? বিস্মিত সকলে জানল মাত্র ২৩ বছরের তরুণের লেখা। আর এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পরই নজরুল যেন রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। এই প্রসঙ্গে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন—’বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কাজি নজরুল ইসলামের খ্যাতিতে বাঙালি সমাজ একেবারে টগবগ করে উঠল। তরুণ সমাজ তো ‘বিদ্রোহী’র ভাষায় বাক্যালাপ শুরু করে দিল। সকলের মধ্যে সেই মনোভাব ‘আপনারে ছাড়া কাহারে করিনা কুর্ণিস’। পরিমল গোস্বামী লিখেছেন—অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এমন ভাষায় আর কোন বাঙালী কবি চ্যালেঞ্জ জানাননি। সমাজের উৎপীড়নে এমন গর্জন আর কারো মুখে তো শুনিনি । ‘Must fight to the firush’ মন্ত্রে দীক্ষিত আর কোনো বাঙালী কবি শত্রু পক্ষকে এমন আহ্বান জানাননি।
রাজশক্তি স্বভাবতই সচকিত হয়ে উঠল। সবরকম অন্যায়-অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কে এমন ভাবে গর্জে উঠেছে। ‘বিদ্রোহী’র লেখক কে? রক্তচক্ষু সরকারি আমলারা বেসামাল। কিন্তু কোনোভাবেই ‘বিদ্রোহী’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আমলাদের সে দিনকার সেই অসহায় অবস্থার কথা জানিয়েছেন অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত এ কবিতায় হিন্দু-মুসলমান দু’জনেরই এত পুরাণ প্রসঙ্গ ঢুকেছে যে, ব্রিটিশ সরকার সরাসরি একে রাজদ্রোহ বলে চিহ্নিত করতে পারল না। কখনও ঈশান-বিষাণের ওংকার বলছে; কখনও বা ‘ইস্রাফিলের শিঙ্গা’ থেকে উঠেছে রণহুংকার, কখনও বাঁ হাতে নিয়েছে মহাদেবের ডমরু-ত্রিশূল, কখনও বা অর্ফিয়ুসের বাঁশি, কখনও বাসুকির ফণা জাপটে ধরেছে, কখনও বা ‘জিব্রাইলের আগুনের পাখা’ কখনও চড়েছে ‘তাজি বোরবা’কে (পক্ষীরাজ ঘোড়া) কখনও বা উচ্চৈঃশ্রবায়’। বোরাবাক’ হল কোরান কথিত দিব্যঅশ্ব, প্রলয়ের দিনে হজরত মহম্মদ (সাঃ) ঈশ্বর-সকাশে গিয়েছিলেন এই ঘোড়ায় চড়ে। উচ্চৈঃশ্রবা ভারতীয় পুরাণ কথিত স্বর্গীয় তুরঙ্গম— উঠেছিল সমুদ্রমন্থন থেকে। এই দুই অলৌকিক ‘ঘোড়া’ আমাদের বিহুল দৃষ্টির সামনে দিয়ে তীব্র গতিতে উড়ে যায় কোনো এক মহাবিপ্লবের আদর্শলোকে, ভেদ রেখা মুছে দেয় সাম্প্রদায়িকতার।
বিদ্রোহীকে আইনের বেড়াজালে না পেলেও পরবর্তীকালে কবির বহুবই, রচনা রাজরোষ পড়েছে। কবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বারবার ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুসারে।
কাজি নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ কী এবং তার সঙ্গে কবির নিষিদ্ধ গ্রন্থগুলোর প্রাসঙ্গিকতাই বা কী? মাত্র এক দশকের ঝোড়ো হাওয়ার জীবনে কাজি নজরুল ইসলামের রাজনীতির মধ্যে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন মাত্র কয়েকটি বছর। চলমান রাজনৈতিক পটভূমিকায় তখন দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। নজরুল সেই প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। তাই তার কবিতা ও গানের মধ্যে এই পর্বে অনবরতই ছিল শিকল ছেঁড়ার আহ্বান। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্নে পাগল মানবতার পূজারি কাজি নজরুল ইসলামের মধ্যে একই সঙ্গে দেখা দিয়েছিল বিদ্রোহী ও দেশ প্রেমিক সত্তার এক সম্মিলিত রূপযা এ দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা। তিনি যেমন সাম্যবাদীদের দোসর ও সমর্থক, তেমনি তিনি কংগ্রেসীদের আর্থিক (৩০০ টাকা) সাহায্যে কেন্দ্রীয় আইন সভায় উচ্চ পরিষদের সদস্য পদের নির্বাচন প্রার্থী। একদিকে তিনি বাংলার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রেরণার উৎস, অন্যদিকে ছাত্র, শ্রমিক, মজুরদের তিনি সমব্যথী এবং আন্দোলনের সহযাত্রী। তিনি সর্বহারার পক্ষে। যেমন বন্দনা গান করেন, তেমনি পাশাপাশি জাগ্রত বাংলার তরুণ সমাজের তিনি হয়ে ওঠেন আশা আকাঙক্ষার প্রতীক।
কিছুদিনের মধ্যেই নজরুলের ওপর সরকারি রোষ নেমে এল। কাজি নজরুল ইসলামের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয় তার নাম ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালে বাংলা সরকার ফৌজদারি বিধির ৯০-এ ধারানুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত করে। সেন্ট্রাল প্রভিন্স ও বর্মা সরকার যুগপৎ গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধ করে। বাংলা সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তির তারিখ ২৩ নভেম্বর ১৯২২, নম্বর ১৬৬৬১ পি.। ‘যুগবাণী’র নিবন্ধগুলি সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগে’ প্রকাশিত সম্পাদকীয়। আর শেষ নিবন্ধটি ‘জাগরণী’–১৩২৭ সনের আষাঢ়ে ‘বকুল’ পত্রিকার ‘উদ্বোধন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। কলকাতার ‘মেটকাফ প্রেস’ থেকে ছাপা। স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক মাস আগে (১৯৪৭ সালের ৩১ মার্চ) ‘যুগবাণী’র ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
ফৌজদারি বিধির ৯৯-এ ধারা অনুসারে, ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবরের গেজেট ঘোষণায় (১০৭০২০ পি) ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ হয়। আর এই ‘বিষের বাঁশি’র প্রকাশক ছিলেন কবি নিজেই। ‘বিষের বাঁশি’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি অপূর্ব একটি রিক্ত পাত্রে কিশোর হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে আছে তীক্ষ্ণ জিহ্বা বিশাল বিষধর। কিশোরের ভঙ্গিতে ভাবে ভয়ের বিন্দুবিসর্গও নেই। সে তন্বয় তৎপরায়ণ হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। আর তার বাঁশির সুরে জেগে উঠেছে নতুন দিনের সহস্রাংশু সূর্য— যার আর এক নাম লোকচক্ষু, লোক প্রকাশক। ছবিটা এঁকেছেন কল্লোলের সম্পাদক দীনেশ রঞ্জন দাশ।
‘বিষের বাঁশি’র কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে প্রচণ্ড রুদ্ররূপ ধরে বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত হয়েছিল। ‘বিষের বাঁশি’র কবিতা প্রসঙ্গে অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত বলেছেন কবি কাজি নজরুল ইসলামের ‘বিষের বাঁশি এই থর থর প্রাণস্পন্দন যুগের গান। ইহার আঘাত সরকার সহ্য করিতে পারেন নাই বলিয়াই দীর্ঘকাল ইহার প্রচার রদ করা হইয়াছিল। জাতীয় জাগরণের সহায়ক হিসাবে এই গ্রন্থের প্রচার ও প্রসার একান্ত আবশ্যক। —’বিষের বাঁশি’তে প্রধান গান ‘মরণ-বরণ’ গান, প্রধান বাণী ‘বিদ্রোহের বাণী’, প্রথম বন্দনা, ‘বন্দী-বন্দনা’।
বলাই বাহুল্য, বাংলা সরকারের পক্ষে ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ না করে উপায় ছিল না। তবে নিষিদ্ধ করেও ‘বিযের বাঁশি’র প্রচার বন্ধ করা যায়নি। বিষের বাঁশির সুরে দেশ যেন মাতোয়ারা। শুধু বাজেয়াপ্ত করলেই হবে না—যে করে হোক বন্ধ করতে হবে এর প্রচার। তৎপর আমলারা, তৎপর গোয়েন্দারা। চলল পুরোদমে তল্লাশি। পুলিশ বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালিয়ে ৪৪ কপি বই আটক করে। বিষের বাঁশির খোজে যে সব জায়গায় তল্লাশি করা হয় – ১) আর্য পাবলিশিং হাউস, ১৫/১৬ কলেজ স্ট্রিট, ২) ইন্ডিয়ান বুক ক্লাব, কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, ৩) কল্লোল পাবলিশিং, ২৭ নং কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, ৪) ডি.এম. লাইব্রেরি, ৬১ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, ৫) বরেন্দ্র লাইব্রেরি ২৩৪ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, ৬) সরস্বতী লাইব্রেরি, ৯নং রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, ৭) বরেন্দ্র এজেন্সি, ১২/১ কলেজ স্ট্রিট, ৮) বাণী প্রেস, ৩৩এ, মদন মিত্র লেন।
‘বিষের বাঁশি’র খোঁজে যেসব জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়, তার অধিকাংশই কলকাতায়। এছাড়া হুগলিতে কবির বাড়িতেও তল্লাশি হয়। কিন্তু সেখানে কোনো কপিই পাওয়া যায়নি। ‘বিষের বাঁশি’ থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার হয় ২২ বছর পর, তবে পরাধীন আমলেই, ১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল।
‘বিষের বাঁশি’ বাজেয়াপ্ত হবার কিছু দিন পরেই ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর ‘ভাঙার গান’ নিষিদ্ধ হয়। গেজেট বিজ্ঞপ্তি নং ১১৬৫৭। ভাঙার গানের কবিতাগুলি দারুণ আলোড়ন তুলেছিল। কাজি নজরুল ইসলামের নিষিদ্ধ বই পড়ার উৎসাহ তরুণদের মধ্যে বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদ যথার্থ লিখেছেন—
“নজরুলের দু’খানা কবিতার বই ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’- বঙ্গীয় সরকারের দ্বারা বাজেয়াপ্ত হয়ে গিয়েছিল।… নজরুলের নিষিদ্ধ পুস্তক দুখানা সংগ্রহের জন্য অনেকের, বিশেষ করে যুবকদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। আমি তো বহু যুবককে এই বই দু’খানার জন্য আব্দুল হালিমের নিকট আসতে দেখেছি। নিষিদ্ধ জিনিসের জন্য মানুষের একটা অদ্ভুত আকর্ষণ হয়।”
বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দওগুপ্ত ডি. পি. আই-কে লিখিত মন্তব্যে জানিয়েছিলেন,
The extracts translated will show that the publication is of a most objectionable nature, the writer revelling in revolutionary sentiments and inciting youngmen to rebellion and to law breaking. …I recommend that the attention of the special Branch of Criminal Investigation Department may be drawn to this publication.” (24.9.1924)
পুলিশ কমিশনার টেগার্টও অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্তের সঙ্গে একমত হয়ে বইটিকে নিষিদ্ধ করার জন্য মুখ্যসচিবের কাছে সুপারিশ করেন। বইটি বাজেয়াপ্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য স্থানগুলিতে তল্লাসী হয় কিন্তু সব ছাপানো ফর্মা বাঁধাই না হওয়ায় বইগুলির খোঁজ পুলিশ পায়নি। সেজন্যে গোপনে সভা সম্মেলনে বিষের বাঁশি বিক্রি হয়েছে কিন্তু অর্থমূল্য সবটা নজরুলের হাতে পৌঁছেছিল কিনা সন্দেহ।
স্বাধীনতার আগে ‘ভাঙার গানে’র ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠেনি। ১৯৪৯ সালে ভাঙার গানের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হয়। ভাঙার গানের পর প্রলয় শিখা সরকারি রোষে পড়ল। প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু শোকের আগুনে কবির বুক জুলছিল, তাকেই যেন ঢেলে দিলেন ‘প্রলয় শিখা’র শব্দে-শব্দে, ছত্রে ছত্রে। ‘প্রলয় শিখা’ ধাবমান হয়ে ছুটল দেশের সর্বত্র। পুলিশ, গোয়েন্দা, সরকারি আমলারা বেসামাল। ‘প্রলয় শিখা’ বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে। বিজ্ঞপ্তিটি বের হয় ১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর (১৪০৮৭ পি)। ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪এ এবং ১৫৩-এ ধারানুসারে বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। ‘প্রলয় শিখা’ বইয়ের প্রলয় শিখা কবিতাটি প্রথম কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ ভৌমিকের ‘বৈলিক’ পত্রিকাতেই বের হয়। সেজন্য কাগজটি রাজরোষে পড়েছিল। ফলে প্রলয় শিখা বই বের করতে কোনো প্রকাশই রাজি হলেন না। কিন্তু বিদ্রোহী কবি তাতে দমলেন না। তিনি নিজের নামে ও নিজের দায়িত্বে ‘প্রলয় শিখা’ প্রকাশ করলেন— অর্থাৎ নিজেই প্রকাশক ও মুদ্রাকর হলেন। কবির এই ত্রিমূর্তিরূপ বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব ব্যাপার। ‘প্রলয়শিখা’ বাজেয়াপ্ত করেই সরকার ক্ষান্ত হয়নি, রীতিমত কবিকে জেলে ঢোকাবার পথ করে রেখেছিল। রাজদ্রোহের অভিযোগে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট টি, রক্সবার্গের আদালতে মামলা রুজু করেছিল। নব ভারতের ‘হলদিঘাট’, ‘যতীন দাস’ ও ‘জাগরণ’ তিনটি কবিতা আপত্তিকর বিবেচিত হওয়ায় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট কবিকে ছয়মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন (১৯৩০, ১৬ ডিসেম্বর)। এই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করা হয়। ইতিমধ্যে গান্ধী-অরউইন চুক্তি (১৯৩১, ৪. মার্চ) হওয়ায় কবি মুক্তি পান।
‘প্রলয় শিখা’ বইটি শুধু নিদ্ধিই হয়নি, কবি ছ’মাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার হয় ১৯৪৮ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারির গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে (নং ৮৫ পি আর)।
‘প্রলয় শিখা’ নিষিদ্ধ হবার এক মাস পরেই ১৯৩১ সালের ১৪ অক্টোবর ‘চন্দ্রবিন্দু’ নিষিদ্ধ হয়। গেজেটে বিজ্ঞপ্তি (নং ১৭৬২৫ পি)। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৯৯-এ ধারানুসারে বাজেয়াপ্ত হয়। ‘চন্দ্রবিন্দু’ বইটি মূলত ব্যঙ্গবিদ্রপের কবিতা গ্রন্থ। কাজি নজরুল ইসলাম যখন ‘চন্দ্রবিন্দু’র কবিতাগুলো লিখছিলেন, সেই সময়ের কথা জসিমুদ্দিন লিখেছেন—বুলবুলের মৃত্যুর পর আমি কলিকাতায় ছিলাম না। কলিকাতা আসিয়া শোকাতুর কবিকে ডি.এম.লাইব্রেরীতে খুঁজিয়া পাইলাম। দোকানে বেচাকেনার হট্টগোলের মধ্যে এককোণে বসিয়া তিনি হাস্যরস প্রধান ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক বইটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিতেছিলেন। পুত্রশোক ভুলিবার এইঅভিব উপায় দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। দেখিলাম, কবির সমস্ত অঙ্গে বিষাদের ছায়া। চোখ দুটি কাঁদিতে কাঁদিতে ফুলিয়া গিয়াছে। বইটির প্রথম ভাগে আছে দেব-দেবীর স্তুতি গান, প্রেমগীতি, বাউল গীতি, ইসলামি গান প্রভৃতি মোট ৪৩টি গান। আর দ্বিতীয় ভাগে আছে ১৭টি দেশাত্মবোধক কমিক গান। তবে ‘প্রলয় শিখা’র মতো ‘চন্দ্রবিন্দু’ বই লেখা জন্য কবিকে দণ্ডিত হতে হয়নি। চন্দ্রবিন্দুর ওপর বাজেয়াপ্ত আদেশ ইংরেজ আমলেই উঠে যায়। বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহারের গেজেট ঘোষণা হয় ১৯৪৫ সালের ৩০ নভেম্বর।
‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশি, ‘ভাঙার গান’, ‘প্রলয় শিখা’ ও ‘চন্দ্রবিন্দু’ কাজি নজরুল ইসলামের এই পাঁচটি বই নিষিদ্ধ ছাড়া আরও অনেক বই সরকারের রোষ দৃষ্টিতে পড়েছিল, যদিও সেগুলি শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়নি—
১) ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২)—‘অগ্নিবীণা’ কাজি নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতা গ্রন্থ। অগ্নিবীণা’র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘বিদ্রোহী’। ‘অগ্নিবীণা’ নিষিদ্ধ হয়নি ঠিকই। তবে পুলিশ যখনই এ বই পেয়েছে, তখনই আটক করেছে। প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী বংশীধর বন্দ্যোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে (২১-৪-১৯৭৯) জানিয়েছেন— বাল্যে তিনি একবার ‘অগ্নিবীণা’ নিয়ে আসছিলেন, তখন পথে পুলিশ তাঁকে ধরে থানায় নিয়ে যায় ও বইটি কেড়ে নেয়।
২) ‘সর্বহারা’ (১৯২৬)—কাব্যগ্রন্থ। ‘সর্বহারা’র প্রচ্ছদে ছিল দুই কৃষকের ছবি একজন হিন্দু আর একজন মুসলিম। ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গানে’র মতো ‘সর্বহারা’র কবিতাগুলি (‘কৃষকের গান’, ‘ধীবরের গান’, ‘রাজা প্রজা’, ‘ফরিয়াদি’, ‘সর্বহারা’,) সেদিন জনচিত্তে দারুণ আলোড়ন তুলেছিল। ‘সর্বহারা’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ হয়; গোপন গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয় ‘সর্বহারা’র প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই আছে বিপ্লবের সুর— ‘Almost of all the poems breathe a spirit of revolt!’ পুলিশকর্তা গোয়েন্দা ও আইন বিশারদের পরামর্শ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ‘সর্বহারা’ বাজেয়াপ্ত হবার হাত থেকে বেঁচে যায়।
৩) ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬)—ছোটো আটটি (‘আমার পথ’, ‘মোহরম’, ‘বিষবাণী’, ‘ক্ষুদিরামের মা’, ‘ধূমকেতুর পথ’, ‘মন্দির ও মসজিদ’, ‘তোমার পণ কি।’ ‘হিন্দু-মুসলমান’) নিবন্ধের বই। রুদ্রমঙ্গলের ভূমিকায় আছে—নিশীথ রত্রি। সুখে গতর তিমির। পথ নাই। আলো নাই। প্রলয় সাইক্লোনের আর্তনাদ মরণ-বিভীষিকার রঙ সুর বাজাচ্ছে। তারই মাঝে মাকে আমার উলঙ্গ করে টেনে নিয়ে চলেছে আর চাবকাচ্ছে যে, সে দানবও নয়, দেবতাও নয়, রক্ত-মাংসের মানুষ। ধীরে ধীরে পিছনে চলেছে তেত্রিশ কোটি আঁধারের যাত্রী। তারা যতবার আলো জালাতে চায়, ততবারই নিভে নিভে যায়। তাদের আর্তকণ্ঠে অসহায় ক্রন্দন, বোধন না হতে মঙ্গলঘট ভেঙেছে—শুধু ক্রন্দন, শুধু হা হুতাশশক্তি নাই, সাহস নাই। সুতরাং ‘রুদ্রমঙ্গল’ সরকারি বিষ নজরে পড়লেও বাজেয়াপ্ত হয়নি।
৪) ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭)—ফণিমনসা স্বচ্ছন্দে রাজরোষে পড়তে পারত। সব্যসাচী ‘হিন্দু মুসলমান যুদ্ধ’ কবিতা ছাড়াও রয়েছে—দ্বীপান্তর’, ‘বন্দিনী’, ‘মুক্তিকাম’, ‘বিদায়’, ‘যা শত্রু পরে পরে’। ফণিমনসায় শুধু এইসব কবিতা আছে তা নয়, এই কবিতাগুলি কেবল আপত্তিকর। এই বইটি বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ হয়েছিল, কিন্তু কপাল জোরে বেঁচে যায়।
৫) ‘সঞ্চিতা’ (১৯২৮)—বাছাই কাব্য সংকলন (বাছাই কবির নিজের)। যে বইতে ‘অগ্নিবীণা’ ‘দোলনচাপা’, ‘ছায়ানট’, ‘সর্বহারা’ ‘ফণিমনসা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চিত্তনামা’, ‘সন্ধ্যা’, ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘চোখের চাতক’, ‘বুলবুল’ কবিতা ও গান আছে। এই কাব্যগ্রন্থ সরকারের বিষদৃষ্টিতে পড়বে, তাতে আর আশ্চর্যের কী? নজরুলের শুধুই বাজেয়াপ্ত হয়েছে এমন নয়, শুধু একটি কবিতা লিখে কারাদণ্ড বরণ করেছেন এমন দৃষ্টান্ত বিরল। নজরুলের কারাদণ্ডও হয়েছিল তাঁর নিজেরই প্রতিষ্ঠিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামে একটি কবিতা লেখার জন্য। ‘ধূমকেতু’র। (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৯ আশ্বিন) ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি বের হয়। কবিতাটি লেখার জন্য কবি ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারানুসারে এক। বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কবিতাটি—
আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে তোর জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী!
দেবসেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে
রণাঙ্গনে নামবে কে আর, তুই না এলে কৃপাণ ধরে?
বিষ্ণু নিজে বন্দী আজি ছয় বছরী ফন্দী কারায়
চক্র তাহার চরখা বুঝি, ভণ্ড হাতে শক্তি হারায়!
মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে
অরবিন্দ-চিত্ত তাহার ফুটবে কখন কে তা জানে?
সদ্য অনুসগ্রাস-চ্যূত ব্রহ্মা চিত্তরঞ্জনে, হায়!
শান্তি শুনে তিক্ত এ মন, ক্ষিপ্ত আরও ভীষণ রবে
মরার দেশে মরা শান্তি, সে তো আছেই, কাজ কী তবে?
শান্তি কোথায়? শান্তি কোথায়? কেউ জানি না
মা গো তোর ওই দনুজদলন সংহারিনী মূর্তি বিনা
দেবতারা আজ জ্যোতিহারা, ধ্রুব তাদের যায় না জানা
কেউ বা দৈব অন্ধ মা গো, কেউ বা ভয়ে দিনে কানা
সুরেন্দ্র আজ মন্ত্রণা দেন দানবরাজার অত্যাচারে
দম্ভ তাহার দম্ভেলি ভীম বিকিয়ে দিয়ে পাঁচ হাজারে।
রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক থেকে দিক দিগন্তের
সে কর শুধু পশলো না মা অন্ধকারার বন্ধঘরে
গগন পথে রবিরথের সাত সারথী হাঁকায় ঘোড়া
মর্ত্যে দানব মানব পিঠে সওয়ার হয়ে মারছে কোঁড়া
বারি-ইন্দ্র-বরুণ আজি করুণ সুরে বংশী বাজায়
বুড়িগঙ্গার পুলিশ বুকে বাঁধছে ঘাটি দস্যু রাজায়।
পুরুষগুলোর ঝুঁটি ধরে বুরুশ করার দানব জুতো
মুখে ভজে আল্লা হরি, পূজে কিন্তু ডান্ডা-গুতো
দাড়ি নাড়ে, ফতোয়া ঝাড়ে, মসজিদে যায় নামাজ পড়ে
নাইকো খেয়াল গোলামগুলোর হারেমে সব বন্দী গড়ে।
লানত গলায় গোলাম ওরা, সালাম করে জুলুনবাজে
ধর্মধ্বজা উড়ায় দাড়ি, গালিজ মুখে কোরান ভজে।
তাজ-হারা যার নাঙ্গা শিরে গরমাগরম পড়ছে জুতি
ধর্মকথা বলছে তারাই, পড়ছে তারাই কেতাব-পু…
উৎপীড়ককে প্রণাম করি, শেষে ভগবানকে নমি
হিজড়ে ভীরুর ধর্মকথা ভণ্ডামীতে আসছে বমি।
পুরুষ ছেলে দেশের নামে চুগলি খেয়ে ভরায় উদর
টিকটিকি হয়, বিষ্ঠা কি নাই, ছিঃ ছিঃ এদের খাদ্য ক্ষুদোর!
আজ দানবের রঙমহলে তেত্রিশ কোটি খোঁজা গোলাম
লাথি খায়, চেঁচায় শুধু দোহাই হুজুর, মোলাম! মোলাম!
মাদিগুলোর মাদি দোষ ওই, অহিংসা বোল নাকি নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ, নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি
হান তলোয়ার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র দেখা
মাদিগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা, রক্ত দেখা।
লক্ষ্মী-সরস্বতীকে তোর আয় মা রেখে কমলবনে
বুদ্ধিবুড়ো সিদ্ধিদাতা গণেশ-টনেশ চাই না রণে।
ঘোমটা-পড়া কলা বৌয়ের গলা ধরে দাও করে দূর
ওই বুঝি দেব-সেনাপতি? ময়ূর-চড়া জামাইঠাকুর!
দূর করে দে! দূর করে দে! এ-সব বালাই সর্বনাশী
চাই নাকো ওই ভাঙ খাওয়া শিব, নেক নিয়ে তায় গঙ্গামাসী
তুই একা আয় পাগলি বেটি তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ততৃযায় ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’- র কাঁদন-কেতন কন্ঠে ধরে
‘ম্যায় ভুখা হুঁ’-র রক্তক্ষেপী ছিন্নমস্তা আয় মা কালী
গুরুর বাগে শিখ সেনা তোর হুঙ্কারে ওই ‘জয় আকালী’।
এখনও তোর মাটির গড়া মৃন্ময়ী ওই মূর্তি হেরি
দু-চোখ পুরে জল আসে মা, আর কতকাল করবি দেরি?
মহিষাসুর বধ করে তুই ভেবেছিলি রইবি সুখে
পারিসনি তা, ত্রেতা যুগে টলল আসন রামের দুখে।
আর এলিনে রুদ্রাণী তুই, জানিনে কেউ ডাকল কি না?
রাজপুতানায় বাজল হঠাৎ ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’-র রক্তবাণী
বৃথাই গেল সিরাজ-টিপু-মীর কাশীমের প্রাণ বলিদান
চণ্ডী, নিলি যোগনায়া রূপ, বললে সবাই ‘বিধির বিধান’।
হঠাত কখন উঠল ক্ষেপে বিদ্রোহিনী ঝাঁপি রাণী
ক্ষ্যাপা মায়ের অভিমানেও এলিনে তুই, মা ভবানী।
এমনি করে ফাঁকি দিয়ে আর কতকাল নিবি পূজা?
পাষান বাপের পাষান মেয়ে, আয় মা এবার দশভূজা!
অনেক পাঠা মোষ খেয়েছিস! রাক্ষসী, তোর যায়নি ক্ষুধা?
আয় পাষাণী, এবার নিবি আপন ছেলের রক্তসুধা
দুর্বলদের বলি দিয়ে ভীরুর এ-হীন শক্তিপূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভূজা।
সেইদিন জননী তোর সত্যিকারের আগমনী
বাজবে বোধন-বাজনা, সেদিন গাইব নব জাগরণী
কৈলাশ হতে গিরিরাণীর মা দুলালী কন্যা আয়
আয় উমা আনন্দময়ী, আয় উমা আনন্দময়ী।
(ধূমকেতু, ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯২২)
এই সংখ্যায় ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ নামে একটি ছোটো নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এগারো বছরের মেয়ে লীলা মিত্রের লেখা। এই লেখাটিও রাজরোষে পড়ে। সরকার নজরুলের কবিতাটির সঙ্গে, এই নিবন্ধটিও বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। পৃথিবীর অন্য কোথাও এত কম বয়সি কারো লেখা রাজরোষে পড়েছে কি না সন্দেহ। এ সম্পর্কে মুজফফর আহমেদ লিখছেন— “সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের নেতারা ‘ধূমকেতু’র প্রতাপ চাটুজ্যে লেনের বাড়িতেই বেশী, এসেছেন। এই বাড়ীতে গিয়েই অধ্যাপক সাতকড়ি মিত্রের সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় হয়। তার একটি ছোট বোন ছিল। এগারো বছর বয়স হবে। এ বয়সেই সে লিখতে পারতো। তার ছোট ছোট লেখা ‘ধূমকেতু’তে ছাপা হয়েছে। আনন্দময়ীর আগমনের সঙ্গে বাংলার সরকার এই লেখাটিও বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। এই মেয়েটির নাম আমি ভুলে গেছি। মমতা মিত্র কি।” আসলে মেয়েটির নাম মমতা মিত্র নয় লীলা মিত্র। নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরে কী হল, সে বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী মুজফফর আহমেদ লিখছেন—এর মধ্যে ‘ধূমকেতু’র অফিস তল্লাশির ও ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ১৪৪- এ ধারা অনুসারে ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক কাজী নজরুল ও তাঁর মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফজালুল হক সায়েবের বিরুদ্ধে গিরেফতারী পরওয়ানা বার হয়ে গিয়েছিল। তারিখটা ১৯২২ সালের ৮ই নভেম্বর দিন। কমরেড আব্দুল হালীম আর আমি সে দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এক দোকানে চা খেয়ে বেড়াতে বেড়াতে ‘ধূমকেতু’ অফিসে গেলাম। আমরা তখন চাঁদনীর ৩ নম্বর গুমঘর লেনে ছাত্রদের বাড়ীতে রাতে, ঘুমাতাম। ৭নং প্রতাপ চাটুজ্জ্যে লেনস্থিত ‘ধূমকেতু’ অফিসে গিয়ে দেখলাম অত সকালেও শ্রী বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এসে ‘ধূমকেতু’র জন্য লিখছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে এক সঙ্গে অনেকগুলো জুতোর শব্দ শোনা গেল। পুলিশ এসেছে ‘ধূমকেতু’র অফিস তল্লাশির পরওয়ানা ও কাজী নজরুলের নামে গিরেফতারী পরওয়ানা নিয়ে। নজরুল তখন সমস্তিপুরে গিয়েছিল বলে গিরেফতার হয়নি। পুলিশ আসায় মুহূর্তের ভিতরে বীরেনবাবু যে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন আমরা কিছুই টের পেলাম না। পুলিশ প্রথমে নজরুলকে খুঁজলো। আমরা জানালাম তিনি কলকাতার বাইরে কোথাও গেছেন, তখন পুলিশ আমাদের গভর্নমেন্ট অর্ডার দেখালো যে, ২৬ সেপ্টেম্বর (১৯২২) তারিখে ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতা ও ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ (অধ্যাপক শ্রী সাতকড়ি মিত্রের ছোট্টো বোনটির লেখা) শীর্ষক একটি ছোট্ট লেখা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। পুলিশ ওই সংখ্যার কপিগুলি নিয়ে যাবেন বললেন। তারপরে বাড়ীতে তল্লাশি হলো ২৬ সেপ্টেম্বর সতারিখের ‘ধূমকেতু’ যে কয়খানা পাওয়া গেল। তাই নিয়ে পুলিশ চলে গেলেন, আমাকে সার্চলিস্ট দিয়ে গেলেন।
তখন নজরুল ইসলাম সমস্তিপুর থেকে কুমিল্লা চলে গেছেন। পুলিশ তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে আসে। কলকাতার তদানীন্তন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে কবির বিচার হয় (বিচারক সুইনহোও কবি ছিলেন। তাঁর নামে কলকাতায় একটি রাস্তাও আছে)। ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি সুইনহো মামলার রায় দেন। প্রখ্যাত আইনজীবী মলিন মুখোপাধ্যায় বিনা পারিশ্রমিকে নজরুলের পক্ষ সমর্থন করেন। বিচারক সুইনহো রাজদ্রোহের অভিযোগে কবিকে দোষী সাব্যস্ত করে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন। ক্ষোভের কথা, একজন কবি হয়েও সুইনহো কী করে আর একজন কবিকে সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে ফেলেন— প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত করেননি?
১৯২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি অর্ধই সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’র শেষ সংখ্যায় নজরুল ইসলাম আদালতে দাঁড়িয়ে যে অনবদ্য ভাষায় অবিস্মরণীয় সাক্ষ্য দেন সেটি ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে ছাপা হয়—
“আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী! তাই আমি রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে রাজার মুকুট; আরধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আরজন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড। রাজার পক্ষে রাজার নিযুক্ত রাজবেতনভোগী, রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে–সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অনন্তকাল ধরে সত্য–জাগ্রত ভগবান।
আমার বিচারককে কেহ নিযুক্ত করে নাই। এ মহাবিচারকের দৃষ্টিতে রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, সুখী-দুঃখী সকলে সমান। এঁর সিংহাসনে রাজার মুকুট আর ভিখারির একতারা পাশাপাশি স্থান পায়। এঁর আইন–ন্যায়, ধর্ম। সে আইন কোনো বিজেতা মানব কোনো বিজিত বিশিষ্ট জাতির জন্য তৈরি করে নাই। সে আইন বিশ্ব-মানবের সত্য-উপলব্ধি হতে সৃষ্ট; সে আইন সর্বজনীন সত্যের, সে আইন সার্বভৌমিক ভগবানের। রাজার পক্ষে–পরমাণু পরিমাণ খণ্ড-সৃষ্টি; আমার পক্ষে–আদি অন্তহীন অখণ্ড স্রষ্টা।
রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনে–রুদ্র। রাজার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য স্বার্থ, লাভ অর্থ; আমার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ।
রাজার বাণী বুদ্বুদ্, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র।
আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়-দ্রোহী নয়, সত্য-দ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্য-স্বরূপ।
সত্য স্বয়ং প্রকাশ। তাহাকে কোনো রক্ত-আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না। আমি সেই চিরন্তন স্বয়ম্-প্রকাশের বীণা, যে বীণায় চির-সত্যের বাণী ধ্বনিত হয়েছিল। আমি ভগবানের হাতের বীণা। বীণা ভাঙলেও ভাঙতে পারে, কিন্তু ভগবানকে ভাঙবে কে? একথা ধ্রুব সত্য যে, সত্য আছে, ভগবান আছেন – চিরকাল ধরে আছে এবং চিরকাল ধরে থাকবে। যে আজ সত্যের বাণীকে রুদ্ধ করেছে, সত্যের বীণাকে মূক করতে চাচ্ছে, সে-ও তাঁরই এই ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র সৃষ্ট অণু। তাঁরই ইঙ্গিতে-আভাসে, ইচ্ছায় সে আজ আছে, কাল হয়তো থাকবে না। নির্বোধ মানুষের অহংকারের আর অন্ত নাই; সে যাহার সৃষ্টি, তাহাকেই সে বন্দি করতে চায়, শাস্তি দিতে চায়। কিন্তু অহংকার একদিন চোখের জলে ডুববেই ডুববে।
যাক, আমি বলছিলাম, আমি সত্যপ্রকাশের যন্ত্র। সে যন্ত্রকে অপর কোনো নির্মম শক্তি অবরুদ্ধ করলেও করতে পারে, ধ্বংস করলেও করতে পারে; কিন্তু সে-যন্ত্র যিনি বাজান, সে-বীণায় যিনি রুদ্র-বাণী ফোটান, তাঁকে অবরুদ্ধ করবে কে? সে-বিধাতাকে বিনাশ করবে কে? আমি মরব, কিন্তু আমার বিধাতা অমর। আমি মরব, রাজাও মরবে, কেননা আমার মতন অনেক রাজবিদ্রোহী মরেছে, আবার এমনই অভিযোগ-আনয়নকারী বহু রাজাও মরেছে, কিন্তু কোনো কালে কোনো কারণেই সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হয়নি–তার বাণী মরেনি। সে আজও তেমনই করে নিজেকে প্রকাশ করেছে এবং চিরকাল ধরে করবে। আমার এই শাসন-নিরুদ্ধ বাণী আবার অন্যের কণ্ঠে ফুটে উঠবে। আমার হাতের বাঁশি কেড়ে নিলেই সে বাঁশির সুরের মৃত্যু হবে না; কেননা আমি আর এক বাঁশি নিয়ে বা তৈরী করে তাতে সেই সুর ফোটাতে পারি। সুর আমার বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং আমার বাঁশি সৃষ্টির কৌশলে। অতএব দোষ বাঁশিরও নয় সুরেরও নয়; দোষ আমার, যে বাজায়; তেমনই যে বাণী আমার কণ্ঠ দিয়ে নির্গত হয়েছে, তার জন্য দায়ী আমি নই। দোষ আমারও নয়, আমার বাণীরও নয়; দোষ তাঁর–যিনি আমার কণ্ঠে তাঁর বাণী বাজান। সুতরাং রাজবিদ্রোহী আমিও নই; প্রধান রাজবিদ্রোহী সেই বাণী-বাদক ভগবান। তাঁকে শাস্তি দিবার মতো রাজশক্তি বা দ্বিতীয় ভগবান নাই। তাঁহাকে বন্দি করবার মতো পুলিশ বা কারাগার আজও সৃষ্টি হয় নাই।
রাজার নিযুক্ত রাজ-অনুবাদক রাজভাষায় সে-বাণীর শুধু ভাষাকে অনুবাদ করেছে, তাঁর প্রাণকে অনুবাদ করেনি। তাঁর সত্যকে অনুবাদ করতে পারেনি। তার অনুবাদে রাজানুগত্য ফুটে উঠেছে, কেননা, তার উদ্দেশ্য রাজাকে সন্তুষ্ট করা, আর আমার লেখায় ফুটে উঠেছে সত্য, তেজ আর প্রাণঙ কেননা আমার উদ্দেশ্য ভগবানকে পূজা করা; উৎপীড়িত আর্ত বিশ্ববাসীর পক্ষে আমি সত্য-বারি, ভগবানের আঁখিজল! আমি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি।
আমি জানি এবং দেখেছি–আজ এই আদালতে আসামির কাঠগড়ায় একা আমি দাঁড়িয়ে নেই, আমার পশ্চাতে স্বয়ং সত্যসুন্দর ভগবানও দাঁড়িয়ে। যুগে যুগে তিনি এমনই নীরবে তাঁর রাজবন্দি সত্য-সৈনিকের পশ্চাতে এসে দণ্ডায়মান হন। রাজ-নিযুক্ত বিচারক সত্য-বিচারক হতে পারে না। এমনই বিচার প্রহসন করে যেদিন খ্রিস্টকে ক্রুশে বিদ্ধ করা হল, গান্ধিকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল, সেদিনও ভগবান এমনই নীরবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁহাদের পশ্চাতে। বিচারক কিন্তু তাঁকে দেখতে পায়নি, তার আর ভগবানের মধ্যে তখন সম্রাট দাঁড়িয়েছিলেন, সম্রাটের ভয়ে তার বিবেক, তার দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গেছিল। নইলে সে তার এই বিচারাসনে ভয়ে বিস্ময়ে থরথর করে কেঁপে উঠত, নীল হয়ে যেত, তার বিচারাসন সমেত সে পুড়ে ছাই হয়ে যেত।
বিচারক জানে আমি যা বলেছি, যা লিখেছি তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু হয়তো সে শাস্তি দেবে, কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য। তবু জিজ্ঞাসা করছি, এই যে বিচারাসন – এ কার? রাজার না ধর্মের? এই যে বিচারক, এর বিচারের জবাবদিহি করতে হয় রাজাকে, না তার অন্তরের আসনে প্রতিষ্ঠিত বিবেককে, সত্যকে, ভগবানকে? এই বিচারককে কে পুরস্কৃত করে? – রাজা না ভগবান? অর্থ না আত্মপ্রসাদ?
শুনেছি, আমার বিচারক একজন কবি। শুনে আনন্দিত হয়েছি। বিদ্রোহী কবির বিচার বিচারক কবির নিকট। কিন্তু বেলাশেষের শেষ-খেয়া এ প্রবীণ বিচারককে হাতছানি দিচ্ছে, আর রক্ত-উষার নব-শঙ্খ আমার অনাগত বিপুলতাকে অভ্যর্থনা করছে; তাকে ডাকছে মরণ, আমায় ডাকছে জীবন; তাই আমাদের উভয়ের অস্ত-তারা আর উদয়-তারার মিলন হবে কিনা বলতে পারি না। না, আবার বাজে কথা বললাম।
আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না, এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো – এ কি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এতদিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত-আত্মা মাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসন-ক্লিষ্ট বন্দি সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি রাজদ্রোহী? এ ক্রন্দন কি একা আমার? না–এ আমার কণ্ঠে ওই উৎপীড়িত নিখিল-নীরব ক্রন্দসীর সম্মিলিত সরব প্রকাশ? আমি জানি, আমার কণ্ঠের ওই প্রলয়-হুংকার একা আমার নয়, সে যে নিখিল আর্তপীড়িত আত্মার যন্ত্রণা-চিৎকার। আমায় ভয় দেখিয়ে মেরে এ ক্রন্দন থামানো যাবে না! হঠাৎ কখন আমার কণ্ঠের এই হারা-বাণীই তাদের আরেক জনের কণ্ঠে গর্জন করে উঠবে।
আজ ভারত পরাধীন না হয়ে যদি ইংলন্ডই ভারতের অধীন হত এবং নিরস্ত্রীকৃত উৎপীড়িত ইংলন্ড-অধিবাসীবৃন্দ স্বীয় জন্মভূমি উদ্ধার করবার জন্য বর্তমান ভারতবাসীর মতো অধীর হয়ে উঠত, আর ঠিক সেই সময় আমি হতুম এমনই বিচারক এবং আমার মতোই রাজদ্রোহ-অপরাধে ধৃত হয়ে এই বিচারক আমার সম্মুখে বিচারার্থ নীত হতেন, তাহলে সেই সময় এই বিচারক আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যা বলতেন, আমি তো তাই এবং তেমনি করেই বলছি!
আমি পরম আত্মবিশ্বাসী! তাই যা অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, – কাহারও তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কাহারও পিছনে পোঁ ধরি নাই, – আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই–সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য-তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে,–তার জন্য ঘরের-বাইরের বিদ্রুপ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত আমার উপর পর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুর ভয়েই নিজের সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লাভ-লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রয় করি নাই, নিজের সাধনালব্ধ বিপুল আত্মপ্রসাদকে খাটো করি নাই, কেননা আমি যে ভগবানের প্রিয়, সত্যের হাতের বীণা; আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা। আমি অজানা অসীম পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। এ আমার অহংকার নয়, আত্ম-উপলব্ধির আত্মবিশ্বাসের চেতনালব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি। আমি অন্ধ-বিশ্বাসে, লাভের লোভে, রাজভয় বা লোকভয়ে মিথ্যাকে স্বীকার করতে পারি না, অত্যাচারকে মেনে নিতে পারি না। তাহলে যে আমার দেবতা আমায় ত্যাগ করে যাবে। আমার এই দেহ-মন্দির জাগ্রত দেবতার আসন বলেই তো লোকে এ-মন্দিরকে পূজা করে, শ্রদ্ধা দেখায়, কিন্তু দেবতা বিদায় নিলে এ শূন্য মন্দিরের আর থাকবে কি? একে শুধাবে কে? তাই আমার কণ্ঠে কাল-ভৈরবের প্রলয়তূর্য বেজে উঠেছিল, আমার হাতে ধূমকেতুর অগ্নি-নিশান দুলে উঠেছিল, সে সর্বনাশা নিশানপুচ্ছে মন্দিরের দেবতা নট-নারায়ণ-রূপ ধরে ধ্বংস-নাচন নেচেছিলেন। এ ধ্বংস-নৃত্য নব সৃষ্টির পূর্ব-সূচনা। তাই আমি নির্মম নির্ভীক উন্নত শিরে সে নিশান ধরেছিলাম, তাঁর তূর্য বাজিয়েছিলাম। অনাগত অবশ্যম্ভাবী মহারুদ্রের তীব্র আহ্বান আমি শুনেছিলাম, তাঁর রক্ত-আঁখির হুকুম আমি ইঙ্গিতে বুঝেছিলাম। আমি তখনই বুঝেছিলাম, আমি সত্য রক্ষার, ন্যায়-উদ্ধারের বিশ্ব-প্রলয় বাহিনীর লাল সৈনিক। বাংলার শ্যাম শ্মশানের মায়ানিদ্রিত ভূমিতে আমায় তিনি পাঠিয়েছিলেন অগ্রদূত তূর্যবাদক করে। আমি সামান্য সৈনিক, যতটুকু ক্ষমতা ছিল তা দিয়ে তাঁর আদেশ পালন করেছি। তিনি জানতেন, প্রথম আঘাত আমার বুকেই বাজবে, তাই আমি একবার প্রলয় ঘোষণার সর্বপ্রথম আঘাতপ্রাপ্ত সৈনিক মনে করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেছি! কারাগার-মুক্ত হয়ে আমি আবার যখন আঘাত-চিহ্নিত বুকে, লাঞ্ছনা-রক্ত ললাটে, তাঁর মরণ-বাঁচা চরণমূলে গিয়ে লুটিয়ে পড়ব, তখন তাঁর সকরুণ প্রসাদ চাওয়ার মৃত্যুঞ্জয় সঞ্জীবনী আমায় শ্রান্ত, আমায় সঞ্জীবিত, অনুপ্রাণিত করে তুলবে। সেদিন নতুন আদেশ মাথায় করে নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ আমি, আবার তাঁর তরবারি-ছায়াতলে গিয়ে দণ্ডায়মান হব। সেই আজও-না-আসা রক্ত-উষার আশা, আনন্দ, আমার কারাবাসকে–অমৃতের পুত্র আমি, হাসি-গানের কলোচ্ছ্বাসে স্বর্গ করে তুলবে। চিরশিশু প্রাণের উচ্ছল আনন্দের পরশমণি দিয়ে নির্যাতিত লোহাকে মণিকাঞ্চনে পরিণত করবার শক্তি ভগবান আমায় না চাইতেই দিয়েছেন! আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই; কেননা ভগবান আমার সাথে আছেন। আমার অসমাপ্ত কর্তব্য অন্যের দ্বারা সমাপ্ত হবে। সত্যের প্রকাশ-ক্রিয়া নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচারকে দগ্ধ করবে। আমার বহ্নি-এরোপ্লেনের সারথি হবে এবার স্বয়ং রুদ্র ভগবান। অতএব, মাভৈঃ! ভয় নাই।
কারাগারে আমার বন্দিনী মায়ের আঁধার-শান্ত কোল ও অকৃতী পুত্রকে ডাক দিয়েছে, পরাধীনা অনাথিনি জননীর বুকে এ হতভাগ্যের স্থান হবে কিনা জানি না, যদি হয় বিচারককে অশ্রু-সিক্ত ধন্যবাদ দিব। আবার বলছি, আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই। আমি ‘অমৃতস্য পুত্রঃ’। আমি জানি –
ওই অত্যাচারীর সত্য পীড়ন
আছে, তার আছে ক্ষয়;
সেই সত্য আমার ভাগ্য-বিধাতা
যার হাতে শুধু রয়।”
উল্লেখ্য, রাজবন্দীর জবানবন্দী কাজি নজরুল ইসলাম লিখিত একটি প্রবন্ধ। কাজি নজরুল ইসলাম সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। সেই পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনেও নিষিদ্ধ হয়। নজরুলকে জেলে আটক করে রাখার পর তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি লিখিতভাবে আদালতে উপস্থাপন করেন তাঁর পৃষ্ঠার বক্তব্য।
তার লেখা যে যে কাগজে বেরুতে সেসব কাগজও পুলিশের শ্যেণদৃষ্টিতে পড়ত। পুলিশের খাতায় তার সব লেখাই ছিল সমান আপত্তিকর। তার একাধিক গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তার গ্রন্থ বাজতে রাখা বিপদজনক ছিল। সব বই যদিও নিষিদ্ধ হয়নি তবু তাঁর রচিত বই তল্লাশীর সময় পাওয়া গেলেই পুলিশ আটক করত এবং হেনস্তা করত। শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দিত। এরকম কয়েকটি উদাহরণ ডঃ শিশির কর উল্লেখ করেছেন। ১৯৩২ সালে মুর্শিদাবাদে অভিরঞ্জন সাহা নামের এক ভদ্রলোকের বাড়ি তল্লাশীর সময় সঞ্চিতা পাওয়া যায়। পুলিশ মামলা দায়ের করার রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন-’
As regards the book ‘Sanchita’, this was one of the documents for the possession of which we sanctioned prosecution of Abhi Ranjan Saha uls Sec. 36 of the B. S. T. 0. Act 1932.’
অভিরঞ্জন সাহার ন’মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। ১৯৩৫ সালে বীরভূমের নলহাটির শৈলজামোহন সেন ও তার পুত্রের বাড়িতে তল্লাশীর সময় আপত্তিকর বইপত্রের সঙ্গে সঞ্চিতা পাওয়া গিয়েছিল তাঁদেরও শাস্তি হয়েছিল। পাবনার উল্লাপাড়া থানার মোহনপুর চরের উপেন্দ্রনাথ ঘোষের অন্যান্য রাজদ্রোহমূলক বইয়ের মধ্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ পাওয়া গিয়েছিল, তার পনেরো মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। এভাবে আরো অনেককে নজরুলের বই রাখার অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
নজরুলের বই বাজেয়াপ্ত হলেও তার বইয়ের আকর্ষণ কমেনি বরং বেড়েই চলেছিল। ১৯২৮-২৯ সালের মধ্যে সঞ্চিতা’, ‘বুলবুল’, ‘জিঞ্জীর’, ‘চক্রবাক’, ‘সন্ধ্যা’, ‘চোখের চাতক’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ বেরোয়। ১৯৩০-৩২ সালের মধ্যে কাজি নজরুল ইসলাম গীতিকা’, ‘সুরসাকী’, ‘জুলফিকার’, ‘বনগীতি’, ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস, ‘ঝিলমিল’, ‘আলেয়া’ নাটক বেরোয়। তার বইয়ের অসম্ভব চাহিদা ছিল। গোপালদাস মজুমদার তার অসংখ্য বইয়ের মধ্যে একটি মাত্র বই বিক্রির হিসেব ‘স্মরণ-বরণ’ (১৯৮১) আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন এই ভাবে, “তখনকার দিনে বাইশ’শ করে ছাপা বই এক বছরের মধ্যে ফোর্থ এডিসন হওয়া দুঃস্বপ্নের কথা। নজরুলের ‘বুলবুল, কিন্তু তাই হয়েছিল। দাম পাঁচ সিকা। পাঁচ শিকা থেকে কত শিকে যে লাভবান হয়েছি তা ঈশ্বরের অনুগ্রহ, নজরুলের বন্ধুপ্রীতি এবং আমার সৌভাগ্যের নিদর্শন।”
কাজি নজরুল ইসলামই বাংলার প্রথম দণ্ডিত লেখক, এমন নয়। তার আগে বেশ কিছু কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক সরকারি রোষে পড়েছেন এবং দণ্ডিত হয়েছেন। তবে নজরুলকে কারারুদ্ধ করা হলে সারা দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। যে সব বাঙালি কবির বই ইংরেজ আমলে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল নিঃসন্দেহে নজরুল তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কবি।
নজরুলের বাজেয়াপ্ত বইয়ের প্রচার বন্ধে সরকারের ব্যর্থতার কথা অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত বলেছেন- ‘নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নজরুলের কবিতার বইকটির বিক্রি বন্ধ করা যায়নি। নানা সভায়, সন্মিলনে প্রায় প্রকাশ্যেই বই বিক্রি হচ্ছে। কলকাতার অলিগিলি ফুটপাথ তো আছেই। কিন্তু সে গোপন বিক্রির উদার মুনাফার একটি শীর্ণ অংশও নজরুলের হাতে এসেছিল কিনা সন্দেহ।
পরপর বই গুলো নিষিদ্ধকরণ ও কারাদণ্ডের আদেশের জন্য কবির জনপ্রিয়তা ভীষণ ভাবে বেড়ে গেল। তার দণ্ড প্রাপ্তির খবর পেয়ে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলনে প্রতিবাদ সভায় দেশ যেন ফেটে পড়েছিল। সেই সাথে তার কবিতাগুলো লোকেরা মুখে মুখে তুলে নিয়েছিল। নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি সহজাত আগ্রহ থাকেই। তাই গ্রন্থগুলো বাজেয়াপ্ত হলেও মানুষের হৃদয়ের ওপর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রভুত্ব চলল না। আর কোনো বাঙালি কবির এতগুলো গ্রন্থ নিষিদ্ধ বলে কোনো সরকারই ঘোষণা করেননি। আর নজরুলের গ্রন্থগুলো নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করার মূলে ছিলেন বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক সরকারি পদাধিকারি অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত। তিনি ছিলেন ইংরেজ অনুগত রাজ কর্মচারী, যিনি টেগার্টের মন জয় করবার জন্যে এ ব্যাপারে অত্যধিক বা দৃষ্টিকটু ভাবে অধিক আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
কাজি নজরুল ইসলামের তিনটি (‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘চন্দ্রবিন্দু’) বইয়ের রাহুমুক্তি স্বাধীনতার আগেই এবং কবির সব ক’টি বই থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ তার জীবদ্দশাতেই প্রত্যাহৃত হলেও কবি তা জানতে পারলেন না। তখন কবির কণ্ঠরুদ্ধ। যে কবির কণ্ঠকে রদ করার জন্য রাজশক্তি আইনের বেড়াজাল বেঁধেছিল এবং কবিকে কারাগারে নিক্ষেপ করতেও ইতস্তত হননি, প্রকৃতির অমোঘ বিধানে কবির সেই কণ্ঠ হঠাৎ হল বাণীহারা, সুরহীন। কবির বোধশক্তি প্রায় লোপ পেয়েছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৭৬ সাল দীর্ঘ ৩৫ বছর পর্যন্ত কবি কিছুই সৃষ্টি করে যেতে পারেননি। মৃত্যুর আগেই তিনি সবকিছু ভালো মলের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ
- ১) সত্যরঞ্জন সেনগুপ্ত (সম্পাদিত)—নজরুল স্মৃতি
- ২) পরিমল গোস্বামী—আমি যাঁদের দেখেছি।
- ৩) অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত—জৈষ্ঠের ঝড়
- ৪) মুজফফর আহমেদ—কাজী নজরুল ইসলাম
- ৫) শিশির কর—নিষিদ্ধ নজরুল
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।