লিখেছেনঃ সুমিতা চক্রবর্তী
কাজি নজরুল ইসলামকে অনেক ভাবেই আমরা চিনি। তিনি উৎপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ানো একজন সাহিত্যিক; তিনি অসাম্প্রদায়িক মনের মানুষ; তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য অক্লান্তভাবে নিজের লেখনীকে চালনা করেছেন, সেই কারণে তাকে কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে।
তাঁকে দেখা যায় আরও অনেক দিক থেকে। তিনি ছিলেন রোমান্টিক মনের মানুষ। ছিলেন মননশীল। তাঁর অধ্যয়নের পরিধিও ছিল ব্যাপ্ত। অবশ্য বেহিসেবি ছিলেন এবং বাস্তববোধও খুব বেশি ছিল না। তার মনের মধ্যে ছিল এক আনন্দের প্রস্রবণ; সমস্যা সংকটেও যে। আনন্দধারার বেগ ব্যাহত হত না।
কিন্তু কাজি নজরুল ইসলামের মনের একটি দিক ছিল যাকে বলতে পারি আন্তর্জাতিক চেতনা। এই চেতনা খুব বেশি মানুষের মনের মধ্যে থাকে না।
বর্তমান নিবন্ধের বিষয় আন্তর্জাতিক মন ও মননের অধিকারী কাজি নজরুল ইসলামকে বুঝে নেবার প্রয়াস। প্রথমেই স্থির করে নিতে হবে ‘আন্তর্জাতিকতা’ বলতে ঠিক কোন মনোভাবকে বলা হয়। দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো ক্রিয়া বা ভাবনা হলো আন্তর্জাতিক। যেমন— আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় চুক্তি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইত্যাদি। কিন্তু শব্দার্থের এই নিরপেক্ষ প্রয়োগ পরিসর ছাড়িয়ে যদি আমরা শব্দটির ব্যঞ্জনাগুণের মধ্যে প্রবেশ করি তাহলে দাঁড়াবে এই—সমগ্র পৃথিবী ও সামগ্রিক মানবজাতিকে সমদৃষ্টিতে অন্তরে গ্রহণ করবার নামই ‘আন্তর্জাতিকতা’। এই সম-দর্শনকে শুভচেতনা আর কল্যাণ-আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে তবেই আন্তর্জাতিক চেতনা যথার্থ মাত্রা পায়। যদি এই অনুভবের প্রাণ-ধর্মটি কল্যাণবোধ হয় তাহলে যথার্থ আন্তর্জাতিকতা তাকে আমরা বলব না। আন্তর্জাতিক কূটনীতি থাকে; আন্তর্জাতিক গুপ্তচরবৃত্তি থাকে, এমনকি আন্তর্জাতিক হত্যাকারী দলও থাকে।
সভ্যতা এখন অনেক রাষ্ট্রের সমাহার। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও যদিও প্রতিটি রাষ্ট্রকেই প্রধানত নিজেদের স্বার্থ দেখতে হবে; কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকবার কোনও উপায় আজকের পৃথিবীতে আর নেই। রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিকতা অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট হলেও তার মধ্যে থেকেই জেগে ওঠে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান; মাথা তুলে দাঁড়ান কোনো কোনো মানুষ, এই সব প্রতিষ্ঠান আর মানুষের হৃদয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে সেবার, সৌভ্রাতৃত্বের এবং সম-অনুভবের আলো। ‘রেড ক্রস’ এমনই একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তার প্রথম প্রতিষ্ঠা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠানটি নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। মানুষের রোগজনিত এবং রাষ্ট্রীয় শত্রুতার পটভূমিতে মানবজাতির যে কোনো সংকটে সব রকম গোষ্ঠী বিভেদ অস্বীকার করে মানুষকে কেবল মানুষের মূল্যেই সেবা করবার সংকল্পে রেড ক্রস এখনও অবিচল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO) এই আন্তর্জাতিক সাম্যবোধের আদর্শকে সামনে রেখেই গড়ে উঠেছে।
অমিয় চক্রবর্তী ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতামালা প্রদানের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন—“… We shall widen and deepen our unitive faith. Particularly so in a divisive age; for we who serve truth must cross the barriers of ideology and distance…” (Modern HumanismAn Indian Perspective-Madras University Lectures, University of Madras, Madras, India, 1968, Page-1)
সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদের রাজতন্ত্র যখন বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল তখন আন্তর্জাতিক মননের স্বীকৃতি রাষ্ট্রের দিক থেকে ছিল না। কমিউনিস্ট মননের স্বীকৃতির রাষ্ট্রের দিক থেকে ছিল না। কমিউনিস্ট শাসনতন্ত্রের দেশেও দলীয় শাসনতন্ত্র প্রাধান্য পেত। তবুশাসকদলের নেতাদের মধ্যে মত বিনিময়ের একটা পরিসর নীতিগতভাবে থাকত। ব্রিটেন-এর পার্লামেন্টারি মনার্কির মতো। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রের ধারণা এবং স্বীকৃতি ধীরে ধীরে বিশ্বের রাষ্ট্রনীতিতে গৃহীত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) পর। গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলেই আন্তর্জাতিকতাবোধ বিকশিত হতে পারে।
এই আন্তর্জাতিকতাবোধ—অর্থাৎ সামগ্রিক মানবজাতিকে সমদৃষ্টিতে গ্রহণ করা একটি পরাধীন দেশের মানুষের মধ্যে কতটা থাকা সম্ভব? বিশেষত যে দেশ বিদেশি শাসকের অধীন; বিদেশি শাসকের এবং ক্ষেত্র বিশেষে অত্যাচারও মেনে নিতে বাধ্য সেই দেশের নাগরিকদের পক্ষে শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রভাবনা ও আচরণের প্রতি সমদৃষ্টি রাখা কঠিন। বলা বাহুল্য যে শাসক কখনোই নিজেদের সঙ্গে সমমর্যাদায় শাসিতকে দেখে না। প্রাক-স্বাধীনতা যুগের ভারতে বিশ শতকের দু’জন মানুষকে মনে পড়ে। একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর একজন কাজি নজরুল ইসলাম।
রবীন্দ্রনাথ এই দুরূহ সমস্যাটি অতিক্রম করেছিলেন তাঁর ভাবনার গভীরতা থেকে। ‘বড়ো ইংরেজ’ আর ‘ছোটো ইংরেজ’; শাসক শ্বেতাঙ্গ আর শুভ-চিন্তার বাহক শ্বেতাঙ্গ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল তার। কিন্তু নজরুল ইসলামের সমস্ত চিত্তি ঊর্ধ্বমুখী আলোক-শিখার মতো লক্ষ্য নিবদ্ধ রেখেছিল দেশের স্বাধীনতার প্রতি। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম প্রকাশের (১১ আগস্ট, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ) মুহূর্ত থেকেই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে মুখর ছিল তার কণ্ঠ। এ-বিষয়ে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রতিবেদন। এখানে একটিই দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হলো—
“সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।
স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেন না, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক একরকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে।
পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে সকল কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে। (ধূমকেতু, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২২)।
কাজেই কাজি নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে শাসকদের প্রতি সমদৃষ্টি প্রত্যাশা করা যায় না। সে প্রত্যাশা আমরা করছিও না। তিনি রবীন্দ্রনাথ নন। নোবেল পুরস্কার পাননি। সতেরো বছর বয়স থেকে শুর করে বারবার ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর হয়নি। কোনো বড়ো ইংরেজের সঙ্গে পরিচয়ও হয়নি তার। কিন্তু অন্য একটি দিক থেকে ওই সতেরো-আঠারো বছর বয়স থেকেই রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের আন্তর্জাতিকতা তিনি অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। তার কারণ তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন বিশ্বযুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবতাবাদী দর্শনিক; কাজি নজরুল ইসলাম স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক। রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক চেতনার সূত্র ছিল বিশ্বাত্মকবোধ; নজরুল ইসলামের আন্তর্জাতিক চেতনার সূত্র ছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা।
আমাদের মনে পড়তে পারে উনিশ শতকের আরও দু’জন বাঙালি মনীষীর কথা। একজন রাজা রামমোহন রায়। স্পেন-এর শোষণ থেকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে মুক্ত হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার কোনো কোনো উপনিবেশ। সেই সংবাদে আপ্লুত হয়ে নিজের গৃহে আলোক-সজ্জার আয়োজন করেছিলেন তিনি; ভোজের নিমন্ত্রণে আপ্যায়িত করেছিলেন বন্ধুদের। ফ্রান্স-এ ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে গণবিপ্লব দেখা দিলে তিনি সমর্থন করেছিলেন সেই বিপ্লব। রামমোহন রায়ের স্বদেশিকতাবোধ কারওর চেয়ে কম ছিল না। তার স্বদেশিকতাবোধ ব্যাপ্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক মননে। মনে পড়ে স্বামী বিবেকানন্দকে। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস চার জুলাই উপলক্ষ্যে কবিতা লিখেছিলেন তিনি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কাজি নজরল ইসলাম যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন সেই প্রসঙ্গে আমরা এবার আসব। বহুব্যাপ্ত এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। কাজি নজরুল ইসলামের ভাবনার সঙ্গে যে অংশটি যুক্ত হয়েছিল, অতি সংক্ষেপে কেবল সেই সূত্রটুকুই উল্লেখ করব আমরা।
বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল দুটি শিবিরের মধ্যে। কাজি নজরুল ইসলাম ঘটনাচক্রে একটি শিবিরভুক্ত ছিলেন। কারণ ভারত ছিল সেই শিবিরের এক প্রধান শক্তি ব্রিটেন-এর উপনিবেশ। কিন্তু সেই যুদ্ধে যে ভারতীয় সৈনিকেরা ছিলেন তাঁদের অনেকের পক্ষেই ঔপনিবেশিক প্রভু ব্রিটেন-এর প্রতি প্রকৃত আনুগত্য বোধ করা সম্ভব ছিল না।
বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন-এর বিরোধীপক্ষে ছিল তুরস্ক। সেই তুরস্ক-এর নেতা কামাল পাশা (১৮৮১-১৯৩৮) অধিকার করে নিলেন তার হৃদয়। কেন? কামাল পাশা মুসলমান বলে? সেটি প্রকৃত কারণ নয়। মুসলমান বলে কাউকে তিনি রেয়াত করতেন না তার বহু প্রমাণ তার কবিতায় আছে।।
কামাল পাশাকে গৌরবমণ্ডিত করে দেখেছিলেন নজরুল ইসলাম দুটি কারণে।
এক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর, সন্ধি স্বাক্ষরিত হবার পরও বিজয়ী মিত্রবাহিনী তুরস্ককে দাবিয়ে রাখতে চাইছিল। এই প্রবণতা বৃহৎ শক্তির দেশগুলির ক্ষেত্রে রাজনীতির প্রাঙ্গণে চিরকালই লক্ষণীয়। তুরস্ক-এর বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনী গ্রিস-এর সেনাদলকে পাঠাতে লাগল। এই যুদ্ধ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছিল ১৯২০ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত। এই ঘটনা আলোড়িত এবং ক্ষুব্ধ করল নজরুল ইসলামকে। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর, সন্ধি স্বাক্ষরিত হবার পরও দুর্বলতার দেশকে বিপদগ্রস্ত করবার জন্য, স্বাধীন হতে না দেবার জন্য কেন এত তৎপরতা? গ্রিস বা তুরস্ক এবং মিত্রবাহিনীর কোনো দেশই কাজি নজরুল ইসলামের নিজের দেশ নয়। কিন্তু তিনি যে-কোনো দেশের স্বাধীনতার পক্ষে। এই যুদ্ধে তুরস্ক-এর সেনাবাহিনীরঅধিনায়ক ছিলেন মুস্তাফা কামাল। ১৯২০ থেকেই যুদ্ধ শুরু হয় এবং তুরস্কের জয় ঘোষিত হয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট। ধরে নেওয়া যায় কবিতাটিরচিত হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট-এর শেষ অথবা সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক (১৯২১ অক্টোবর-নভেম্বর) সংখ্যায়।
তুরস্ক এর যুদ্ধে এবং তুরস্ক-এর স্বাধীনতা রক্ষায় আরও একজন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। আনোয়ার পাশা (১৮৮১-১৯২২)। একই কারণে তাকে নিয়েও কবিতার অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন নজরুল ইসলাম। যদিও পরবর্তীকালে কামাল ও আনোয়ার পাশার পথ কিছু ভিন্ন হয়ে যায় তা সত্ত্বেও প্রথম দিকে তারা দুজনেই তুরস্কের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করেছিলেন। বলে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন নজরুল ইসলাম। দুটি কবিতাই স্থান পেয়েছে ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২) কাব্যগ্রন্থে।।
একই কারণে কিছুকাল পরে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগরে বসে নজরুল ইসলাম লিখলেন ‘চিরঞ্জীব জগলুল’ নামের কবিতা (১৬ ভাদ্র, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ)। কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যার ‘নওরোজ’ পত্রিকায়। কবিতাটি সংকলিত হয়েছে ‘জিঞ্জির’ কাব্যগ্রন্থে (প্রকাশ ১৯২৮)। কে এই চিরঞ্জীব জগলুল ? তিনি ছিলেন মিশর-এর স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রামী এক জননেতা। সাদ জগলুল (Saad Zagloul, ১৮৫৯-১৯২৭) জন্মগ্রহণ করেছিলেন নীলনদের অববাহিকায় অবস্থিত একটি গ্রামে, মধ্যবিত্ত পরিবারে। পরিবারে শিক্ষার প্রচলন ছিল। বিশ্বদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হলেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল যথেষ্ট উন্নতমানের এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা সেখানে নিষিদ্ধ ছিল না। সেখানেই ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন এবং শাসকবিরোধী কোনো কাজ ও লেখার জন্য গ্রেফতার হয়ে যান। অবশ্য অল্পদিন পরেই মুক্তি পেয়েছিলেন।
এখানে মিশর-এর রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু জানতে হবে। ভারতের মতোই মিশরের ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতির চরিত্র অনুযায়ী, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যেমন ভারতে ছিল, তেমনই মিশরেও ব্রিটিশ শাসকেরা প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় কাজেশাসিত দেশের শিক্ষিত শ্রেণির ব্যক্তিবর্গকে কিছুটা কাজের ও মত প্রকাশের অধিকার দিতেন। সাদ জগলুল ছিলেন মেধাবী এবং গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার অধিকারী। ব্রিটিশ শাসকেরা এই সুশিক্ষিত, অভিজাত এবং যুক্তিনিষ্ঠ মানুষটিকে দূরে রাখলেন না। ফলে জগলুল প্রথমে হলেন শিক্ষামন্ত্রী (১৯০৬-০৮); তার পরে হলেন বিচার বিভাগের মন্ত্রী (১৯১০-১৯১২); সবশেষে হলেন লেজিসলেটিভ অ্যাসেমরি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সর্বত্রই ঔপনিবেশিকতাবিরোধী জনজাগরণ শুরু হয়। মিশরেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দেখা দিলে সাদ জগলুল সেই আন্দোলনে যোগ দিলেন এবং ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে দাবি করলেন স্বাধীনতা। ব্রিটিশ প্রশাসন তাকে মাল্টাতে নির্বাসিত করলে জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী নেতার সমর্থনে মিশর-এ বিপ্লবের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় স্বদেশে। তিনি কিন্তু এসেই জাতীয়তাবাদী দলেই যোগ দেন। তিনি হয়ে ওঠেন জাতীয় নেতা। আন্দোলনের চাপে ১৯২২-এ মিশরে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। এর পর ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচন সংগঠিত হলে প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জাতীয়তাবাদী দল জয়লাভ করে এবং মিশরের প্রধানমন্ত্রী হন সাদ জগলুল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তার মতান্তর এবং দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মিশরের নাগরিকদের মধ্যেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বদা মতের ঐক্য ঘটতো না। তার ফলে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে জগলুলকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনতে হয়। তিনি পার্লামেন্ট-এর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। ক্রমশ তার শরীর ভেঙে পড়তে থাকে। তার প্রয়াণ ঘটে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। সেই প্রয়াণ উপলক্ষ্যেই এই শোক -কবিতা লিখেছিলেন নজরুল ইসলাম। কামাল পাশার জীবন সম্পর্কে আমাদের কিছুটা ধারণা আছে, কিন্তু সাদ জগলুল সম্পর্কে আমরা কমই জানি। নজরুল ইসলাম এই সম্পূর্ণ ইতিহাস জ্ঞাত ছিলেন। তিনি সাদ জগলুলকে স্বাধীনতা সংগ্রামী রূপেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিকোণ ছিল সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক।
‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদক নজরুল ইসলামের এই আন্তর্জাতিক চেতনা সম্পাদকীয় আদর্শের মধ্যেও বারবার অভিব্যক্ত হয়েছে। এই পত্রিকায় বিভিন্ন স্তম্ভে বাইরের দেশের খবর থাকত। সেই সংবাদসমূহের প্রধান যোগসূত্র ছিল বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতার সংগ্রাম। বিশেষ উল্লেখযোগ্য-আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবীদের সম্পর্কে সচেতন ছিলেন সম্পাদক।
নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছিলেন কাবুলের রাজা আমানউল্লাহ (১৮৯২-) কে নিয়ে। কিন্তু রাজপ্রশস্তি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না।
আমানউল্লাহ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তৃতীয় ইংরেজ-আফগান যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। তখনও তিনি রাজপদে অভিষিক্ত হননি। বস্তুত আফগানিস্তানকে তিনিই ব্রিটিশ প্রাধান্য মুক্ত করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ। আগেই তিনি একাধিক ইউরোপীয় দেশ ভ্রমণ করেছিলেন; ১৯২৯ এর পর তিনি কিছুকাল ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অতঃপর ইতালিতে রোমের সন্নিকটে এক প্রাসাদে বাকি জীবন। অতিবাহিত করেন। জুরিখ-এ তাঁর মত্যু হয়। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় আফগানিস্তানের জালালাবাদে। আমানউল্লাহ-কে শ্রদ্ধা নিবেদন করবার কারণ ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং প্রগতিপন্থার প্রতি নজরুল ইসলামের সমর্থন।
নজরুল ইসলামের আন্তর্জাতিকমননের এক উজ্জ্বল ও গভীর সাক্ষ্য বহন করে তার সাহিত্য অনুরাগ। এখানে তিনি বিশ্বসাহিত্যের এক নিমগ্ন পাঠক। সেই বিশ্ব সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক। এমনকি জাতীয়তাবাদী উচ্ছাসের ভেদরেখাও সেখানে বিলুপ্ত।
বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না যখন ভাবি, যদিও মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তবু নির্দিষ্টভাবে কোনো একটি স্কুলে বেশিদিন পড়েননি। শেষ বিদ্যালয় ছিল শিয়ারসোল রাজ স্কুল। যদিও ভালো স্কুল, কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের ধারণা সেখানে পাওয়া সম্ভব ছিল না। প্রবেশিকা পরীক্ষা না দিয়েই আঠারো বছর বয়সে চলে গেলেন লাহোর, করাচি, নওশেরা। সেনা প্রশিক্ষণ শিবিরে বিভিন্ন দেশের পত্রিকা হাতে আসত। পড়েছেন রাজদ্রোহমূলক লেখাপত্র এবং বিভিন্ন দেশের বিদ্রোহের ইতিহাস। তার সৌভাগ্যই বলতে হবে, সেনা-ছাউনিতে যে মৌলবিসাহেব ছিলেন তিনি আরবি-ফারসি জানতেন এবং সাহিত্যও ভালোবাসতেন। তার কাছেই পড়েছেন হাফিজ আর ওমর খৈয়ম-এর লেখা। কিন্তু তাই বলে মিল্টন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কিটস, বার্নাড শ-র লেখা সেখানে তিনি পড়েননি। আনাতোল ফ্রস, বালজাক আর জোলার লেখা সেখানে পড়া সম্ভবই নয়। নুট হামসুন, যোহান বয়ার, সেলমা লাগেরলফ সম্পর্কে সৈনিক নজরুল ইসলামের ধারণা থাকা সম্ভব বলে মনে হয় না। তিনি পড়েছিলেন। হুইটম্যান, পড়েছিলেন পুশকিন, টলস্টয়, দস্টয়েভস্কি, গোর্কি। সেইসঙ্গে নোগুচি, এমনকি কিপলিং। ফ্রয়েড-এর সম্পর্কেও তাঁর ধারণা ছিল।
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে (১৯১৮) নজরুল ইসলাম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এসে পড়লেন কলকাতায়। আশ্রয় নিলেন মুজফফর আহমদ-এর সঙ্গে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র ঘরে।।
মুজফফর আহমদ-এর সংস্পর্শে আসবার ফলে বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে নজরুলের সংযোগ অব্যাহত রইল। ওখান থেকেই নতুন পত্রিকা প্রকাশিত হলো ‘মোসলেম ভারত’। নজরুল লিখতে লাগলেন উপন্যাস ও কবিতা। অন্যান্য পত্রিকার মধ্যে ছিল ‘অঙ্কুর’, ‘বকুল’, ‘বঙ্গনুর’, ‘সাধনা’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘নারায়ণ’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘উপাসনা’, ‘ভারতী’, ‘মানসী’ ও ‘মর্মবাণী’, ‘প্রবাসী’, ‘সহচর’। নজরুল-এর লেখা প্রকাশিত হয়েছে এই সব পত্রিকায়। তিনি এগুলি তো অবশ্যই পড়তেন। পড়তেন সমকালে প্রকাশিত প্রায় সব পত্রিকাই।
মুজফফর আহমদ ছিলেন মার্কসবাদী। নজরুল ইসলাম কিন্তু কলকাতায় আসবার আগেই রুশ বিপ্লব সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। নজরুল ইসলামের বন্ধু প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা জমাদার শম্ভ রায়ের (নজরুল ইসলামের পল্টনের বন্ধু) চিঠি থেকে জানা যায় রুশ বিপ্লবের সাফল্যের সংবাদেতারা সকলেই উৎফুল্ল হয়েছিলেন। তখন থেকে মার্কসবাদের আন্তর্জাতিক দর্শন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তাঁরা। মুজফফর আহমদের সাহচর্যে এই আন্তর্জাতিক মনন-ভুবন অনেকখানি সম্প্রসারিত হয়েছিল।
কিন্তু যে পত্রিকাটি এই সময় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করেছিল সেটি হলো ‘কল্লোল’ (১৯২৩-১৯২৯)। সম্পাদক ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ, সহ সম্পাদক ছিলেন গোকুলচন্দ্র নাগ। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগের হাওয়াকে সব বেড়া ভেঙে চলাচলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তাঁরা। প্রথম থেকেই নব্য ইউরোপীয় সাহিত্যের আদর্শে বাংলা ভাষায় আধুনিকতা, বাস্তবতার বোধ এবং প্রগতিচিন্তাকে তারা স্বাগত জানালেন। প্রথম থেকেই পত্রিকার গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মণীশ ঘটক এবং নজরুল ইসলাম। প্রথম থেকেই এই পত্রিকার প্রবণতা ছিল দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
তাঁরা বিশেষভাবে ফরাসি, স্ক্যান্ডিনেভীয় এবং রুশ সাহিত্যিকদের সচিত্র সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাদের লেখার পরিচয় ছাপতেন। জার্মানি, ইটালি, স্পেন, পোল্যান্ড, জাপানও বাদ যেত না। এখান থেকেই বিশ্বসাহিত্যে নজরুল ইসলামের প্রকৃত অবগাহন।
‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ নামে তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘প্রতিকা’ নামের একটি বার্ষিক সাহিত্য-সংকলনে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। পরে ১৯৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দে ‘বুলবুল’ পত্রিকায় (পৌষ-চৈত্র, ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) সেটি পুনর্মুদ্রিত হয়। তিনি লিখেছিলেন—“বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের দিকে একটু ভালো করে দেখলে সর্বাগ্রে চোখে পড়ে তার দুটি রূপ। এক রূপে সে শেলীর Skylark-এর মতো, মিল্টনের Birds of Paradise-এর মতো এই ধূলিমলিন পৃথিবীর ঊর্ধ্বে উঠে স্বর্গের সন্ধান করে, তার চরণ কখনও ধরার মাটি স্পর্শ করে না; … আর এক রূপে সে এই মাটির পৃথিবীকে অপার মমতায় আঁকড়ে ধরে থাকে—” এর পর তিনি Keats-কে ‘স্বপ্নচারী’ বলে উল্লেখ করেছেন। Whitman-কে বলেছেন ‘মাটির মানুষ। তাঁদের রচনা থেকে উদ্ধৃতিও দিয়েছেন।
উল্লেখ করতে ভালো লাগে যে, ইউরোপ আমেরিকার সাহিত্যিকদের কথা বলবার সময়ে কোনো শ্বেতাঙ্গ-বিদ্বেষ নজরুল ইসলামের মনের মধ্যে ছিল না।
নজরুল ইসলামের বিশ্ব সাহিত্যবোধের অন্তঃপ্রবাহে আন্তর্জাতিক মননের সূত্রটি কোথায় ছিল তার ইঙ্গিত আমরা পেয়ে যাই প্রবন্ধেরই। কয়েকটি ছত্রে। লেখক বিবৃত করেছেন রুশ বিপ্লবের প্রা-কালীন রাশিয়ার জনজীবনের পটভূমি। তুলে ধরেছেন মানুষের বেদনার কথকতা। রুশ সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “এই নির্বাসনে সাইবেরিয়ায় জন্ম নিল দস্তয়েভস্কির ‘Crime and Punishment’। রাস্কলনিকভ যেন দস্তয়ভস্কিরই দুঃখের উন্মাদ মূর্তি, সোনিয়া যেন ধর্ষিতা রাশিয়ারই প্রতিমূর্তি। যেদিন রাস্কলনিকভ এই বহু-পরিচর্যারতা সোনিয়ার পায়ের তলায় পড়ে বলল, “Ibow down not to thee, but to suffering humanity in you!” সেদিন সমস্ত ধরণী বিস্ময়ে, ব্যথায় শিউরে উঠল।”
এখানেই ছিল তার আন্তর্জাতিক চেতনার মূল মন্ত্র—’সাফারিং হিউম্যানিটি’–’উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল।
কাজি নজরুল ইসলামের আন্তর্জাতিকতাবোধের আরও একটি স্তর আছে। তার সন্ধানে আমাদের ফিরে যেতে হবে বর্তমান বিশ্বসাহিত্য থেকে প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রকেন্দ্রিক সাহিত্যে। ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্য থেকে কাজি নজরুল ইসলাম শাস্ত্রীয় আচার বর্জন করে ছেকে নিয়েছিলেন মানবধর্ম। ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় লিখেছিলেন— “কোরাণ-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও যত সখ,-”
উল্লিখিত শাস্ত্রগ্রন্থগুলি ছাড়াও আছে গ্রিক ও রোমক পুরা-কথা। বাইবেল-এর মধ্যে আছে ইহুদিদের আদি বাইবেল আর খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের নব্য বাইবেল। পুরাণের সঙ্গেই উপনিষদের বাণীকেও তিনি ভোলেননি। কিন্তু সমস্ত শাস্ত্রীয় উপাদানের ভেতর থেকে তিনি নিষ্কাশন করে নিয়েছেন কেবল মানুষের ধর্মকেই।
ধর্মশাস্ত্রজীবীদের তিনি ব্যবসায়ীদের চেয়ে অধিক মূল্য দেননি।
“উহারা রত্ন বেনে, রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে!”
কাজি নজরুল ইসলাম তথাকথিত রত্ন-ব্যবসায়ীকে তুচ্ছ করেছিলেন। কারণ তিনি চিনতেন রত্নাকরকে—সমুদ্রকে। মানবতার সমুদ্র। যদিও আজকের জটিল রাষ্ট্রনীতির যুগে মানুষ সমুদ্রের বুকেও রাষ্ট্রীয় ভেদরেখা টেনেছে; কিন্তু সেই ভেদরেখা দিয়ে সাগর তরঙ্গের মধ্যে প্রাচীর নির্মাণ করা যায়নি। সাগরজলের চলাচল নির্বাধ আন্তর্জাতিক। নজরুল ইসলামের হৃদয়ের ব্যাপ্তিও ছিল সমুদ্রের মতোই। আন্তর্জাতিকতার বোধ সচেতন চর্চায় তিনি অবশ্যই অনেকটা অর্জন করেছিলেন; কিন্তু এই আন্তর্জাতিক চেতনা ছিল তাঁর সহজাত সমুদ্র-সমান মানবধর্মবোধে।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।