লিখেছেনঃ ঐতিহাসিক গোলাম আহমদ মোর্তাজা
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এর জন্ম হয় ১৮১২ খৃষ্টাব্দে বা ১২১৮ বঙ্গাব্দে। ১৫ বছর বয়সেই তাঁর বিয়ে হয়। অবশ্য পত্নী দুর্গামণি দেবীর সঙ্গে তিনি আজীবন সংসার করেন নাই।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কোন সাধারণ লােক ছিলেন না, বরং অসাধারণই ছিলেন। কারণ, সে যুগের অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক পত্র-পত্রিকার বাজারে তিনি বিখ্যাত পত্রিক ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদনা করতেন। এছাড়াও সংবাদ ‘রত্নাবলী’, ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রভূতি তাঁর সম্পাদিত সাময়িক পত্রিকা ছিল। শুধুপত্র-পত্রিকা পরিচালনাতেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন নি ‘প্রবোধ প্রভাকর’ ‘হিত প্রভার’, ‘বােধেন্দু বিকাশ’ প্রভৃতি গ্রন্থও তাঁর দ্বারা রচিত হয়। সবচেয়ে মনে রাখার মত উল্লেখযােগ্য কথা হােল, স্বাধীনতা আন্দোলনের যিনি প্রতিষ্ঠাতা বলে খ্যাত সেই বঙ্কিমচন্দ্রের ইনি ছিলেন ‘শুরু’ [দ্রষ্টব্য আশুতােৰ দেব সংকলিত নূতন বাঙ্গালা অভিধানের চরিতাবলী অধ্যায়ের ১১১৫ পৃষ্ঠা, ১৩৬১ বঙ্গাব্দ]। শ্রীগুপ্তের প্রভাব তাঁর শিষ্যগণের মধ্যে বঙ্কিমের উপরেই যে বেশি পড়েছিল তা পরের আলােচনায় পরিষ্কার হবে। বঙ্কিমচন্দ্রের আলােচনা বঙ্কিম প্রসঙ্গেই হবে, এখন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের লেখনী প্রতিভা কোন দিকে কিভাবে কাজে লেগেছে তার পর্যালােচনা করা যাক।
কলমের কালি লেখকের শিল্পনিপুণতায় যেমন দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারে, তেমনি কলমের অপব্যবহারে দেশে সৃষ্টি হতে পারে বিদ্বেষবাষ্প, হিংসার হিংস্রতা ও সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডবলীলা।
অখণ্ড ভারর্ষে যখন ইংরেজের রাজত্ব তখন তাদের প্রয়ােজন হয়েছিল একদল লেখক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, ঐতিহাসিক ও বিশ্বস্ত কর্মচারীর। অবশ্য ইংরেজ জাতি সাফল্যের সঙ্গে তা সংগ্রহ করেছিলাে হিন্দু এবং অহিন্দু সম্প্রদায় হতে। আর ঐ হিন্দু লেখক গােষ্ঠীর গুরু হিসাবে ধরা যেতে পারে শ্রীঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে, কারণ তাঁর জন্যই বলা হয়, আমাদের দেশের ‘সকলের কবি’—অর্থাৎ শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং নিরক্ষরদের কাছেও তিনি সমানভাবে জনপ্রিয়।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সাহিত্য জগতের গুরু শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এর প্রশংসায় বলেছেন, “রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া যায় যে, এখন আমরা সকলেই মােচা ভুলিয়া কেলা কা ফুল বলিতে শিখিয়াছি। ..আর যেই যা বলুক ঈশ্বরগুপ্ত মােচা বলেন। তিনি আরও লিখেছেন, “মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙ্গালীর কবি— ঈশ্বরগুপ্ত বাঙ্গালার কবি। এখন আর খাঁটি বাঙ্গালী কবি জন্মে না— জন্মিবার যাে নাই জন্মিয়া কাজ নাই।” মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করে শেষ সিদ্ধান্তে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য লিখেছেন, “তাঁহার যাহাআছে তাহা আর কাহারও নাই। আপন অধিকারের ভিজ্ঞ তিনি রাজা।” [দ্রষ্টব্য শ্রীঅমরেন্দ্রনাথ রায় সংকলিত সমালােচনা সংগ্রহ,কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ সংস্করণ ১৯৫৫, পৃষ্ঠা ২১৫-২১৭)
‘শত্রুতা করিয়া তিনি কাহাকেও গালি দেন না। মেকির উপর রাগ আছে বটে, …তবে ইহা স্বীকার করিতে হয় যে, ঈশ্বরগুপ্ত মেকির উপর গালিগালাজ করিতেন।” “অশ্লীলতা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এর কবিতার একটি প্রধান দোষ। তবেইহাও জানি, ঈশ্বরগুপ্তের অশ্লীলতা প্রকৃত অশ্লীলতা নহে… ঈশ্বরগুপ্ত ধর্মাত্মা, কিন্তু সেকেলে কবি।” ঈশ্বচন্দ্রের অশ্লীল লেখনীর স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে ঋষি বঙ্কিম ব্যারিষ্টারের মত বলেছেন, “পক্ষান্তরে, স্ত্রী-পুরুষের মুখচুষনআমাদের সমাজেঅতি অল্পীল ব্যাপার, কিন্তু ইংরেজের চক্ষে উহা অতি পবিত্র কার্য্য।” (ঐ, পৃষ্ঠা ১৯-২২৩]
“তিনি ঈশ্বরকে (অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে নিকটে দেৰিনে, যেন প্রত্যক্ষ দেখিলে, যেন মুখামুখী হইয়াকথা কহিলে। আপনাকে যথার্থ ঈশ্বরের পুত্র ঈশ্বরকে আপনার সাক্ষাৎ মূর্তিমান পিতা বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস করিতেন।” ঋষি বঙ্কিম ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তার পুত্র প্রমাণ করেই ক্ষান্ত হলেন না, শেষে লিখলেন, “ধন্য ঈশ্বরচন্দ্র। তুমি পিতৃপদ লাভ করিয়াছ সন্দেহ নাই। আমরা কেহই তােমার সামলােচক হইবার যােগ্য নহি।” [পৃষ্ঠা ২২৬]
বঙ্গের সমস্ত কবিদের সামনে রেখে বঙ্কিম লিখেছেন, “এমন বাঙ্গালীর বাঙ্গালা ঈশ্বরগুপ্ত ভিন্ন আর কেহই লেখে নাই—আর লিখিবার সম্ভাবনাও নাই। কেবল ভাষা নহে, ভাবও তাই।” বঙ্কিম শ্ৰীগুপ্তের রাজনীতির উপর মন্তব্য করে বলেছে, “ঈশ্বরচন্ত্রের রাজনীতি বড় উদার ছিল। তাহাতেও যে তিনি সময়ের অগ্রবর্তী ছিলেন, সে কথা বুঝাইতে গেলে অনেক কথা বলিতে হয়, সূতরাং নিরস্ত হইলাম।” (পৃষ্ঠা ২৩০, ২৩২)
বঙ্কিম যে ঈশ্বরগুপ্তের এক নম্বর ভক্ত ও শিষ্য ছিলেন উপরের লেখাতেই প্রমাণ হােল কি সেটা ছেড়ে দিয়েও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, “বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বরগুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু হিলেন, বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন।” (ঐ, পৃষ্ঠা ২৫৩)
সুকুমার সেন বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসের দ্বিতীয় খণ্ডে ঈশ্বরগুপ্তের জন্য বলেছেন, তিনিই হনে আধুনিক কালের কবি গােষ্ঠীর প্রথম প্রবর্তক। আরও বলেছে, “রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ অধিকারী, দীনবন্ধু মিত্র ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—তাঁহার এই চারি মুখ্য শিষ্যের মধ্যে একমাত্র রঙ্গলালই কবিতার সরণি শেষ অবধি আঁকড়াইয়া ছিলেন। দ্বারকানাথ অল্প বয়সে মারা যান। বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসের পথ ধরেন, দীনবন্ধু নাটক প্রহসনের।” [পৃষ্ঠা ১০১]
যাঁরা বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত তাঁদের উদারতা, মহত্ব, বীরত্ব ও স্বাধীনতা-প্রবণতা থাকলে তা যেমন মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে, তেমনি সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা, কাপুরুষতা ও গােলামীপ্রবণতা থাকলে তার প্রভাবও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। তাই এবানে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের লেখার কিছু চাপা পড়া নমুনা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাত্র। কলমের কালি, কেমন করে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে প্রাচীর তুলতে পারে, কেমন করে দেশকে ভাগাভাগি করতে পারে, কেমন করে ইংরেজের বন্দনা করতে পারে, কেমন করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে চেপে দিতে পারে গভীর চিন্তাসহ লক্ষ্য করার বিষয়।
মুসলমানদের খুশী করার জন্য অথবা হেয় করার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নিজে বা কারাের গােপন ইঙ্গিতে লিখলেন,
“একেবারে মারা যায় যত চাঁপদেড়ে (দাড়িওয়ালা)।
হাসফাঁস করে যত প্যাঁজখাের নেড়ে।
বিশেষতঃ পাকা দাড়ি পেট মােটা ভুড়ে।
রৌদ্র গিয়া পেটে ঢােকে নেড়া মাথা কুঁড়ে।
কাজি কোন্না মিয়া মােরা দাঁড়িপাল্লা ধরি।
কাহাযাের তােবাল্লা বলে আল্লা মরি।
মুসলমান জাতি কত অসভ্য, মুখ ও শুব্ধ কথা বলায় অপটু, অথবা তার বিপরীত কিছু একটা প্রমাণের জন্য তিনি লিখেছেন,
“দিশি পাতি নেড়ে যারা,
তাতে পুড়ে হয় সারা,
মলাম মলাম মামু কয়।
হাদুবাড়ি খেনু ব্যাল,
প্যাটেতে মাখিনুি ত্যাল
নাতি তবু নিদ নাহি হয়।
এঁদে দেয় ফুফু নানী
কলুই ডেলের পানি
কঁাচাক্যালা কেচুর ছালন..”
ইংরেজ বিতাড়নে যখন মুসলমানরা উঠেপড়ে লেগেছে তখন বঙ্কিম বাবুদের গুরু লিখলেন,
“চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়।
ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির ফেন রয়।।…
“ভারতের প্রিয়পুত্র হিন্দু সমুদয়।
মুক্তমুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।।”
(‘দিল্লির যুদ্ধ’, ‘গ্রন্থাবলী’, পৃষ্ঠা ১৯১)
প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনকে কৌশলে ‘সিপাহী যুদ্ধ’ নাম দিয়ে ইতিহাসকে কেমনভাবে পাল্টাবার চেষ্টা করা হয়েছিল, তখনকার পত্রিকা, কবি-সাহিত্যিক ও উপন্যাস – স্রষ্টাদের ভূমিকা মন দিয়ে দেখলে তা বােঝা যাবে। শুধু তাই নয়, ইতিহাসের প্রকৃত রূপরেখা অঙ্কনেও তা যথেষ্ট সাহায্য করবে। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের লড়াই থেকে হিন্দু বীর যুবক ও বীরাঙ্গনা যুবতীদের কোন্ কায়দায় থামিয়ে রাখা হয়েছিল, এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়—কলমের যাদু।
ব্যাপকভাবে যখন অমুসলমান জোয়ানরা আন্দোলনে যােগ দিলেন না তখন স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের পরাজিত হতে হােল। দখল করা দিল্লি ছেড়ে পালাতে হােল। ঠিক তখন ঈশ্বরগুপ্ত লিখলেন:
“ভয় নাই আর কিছু ভয় নাই আর।
শুভ সমাচার বড় শুভ সমাচার।
পুনবার হইয়াছে দিল্লী অধিকার…”
দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ও বেগম জিনাত মহল যখন বন্দী হলেন তখন তাঁদের পুত্রদের হত্যা করে কাটা মাথাগুলাে বাহাদুর শাহকে উপঢৌকন দিয়ে নিষ্ঠুর উপহাসকরা হয়েছিল। ইশ্বরগুপ্ত ঐ ঘটনাকে সামনে রেখে লিখলেন,
“..বাদশা বেগম দোঁহে ভােগে কারাগার।
অকারণে ক্রিয়াদোষে করে অত্যাচার।
মরিল দু’জন তাঁর প্রাণের কুমার।।
একেবারে ঝাড়ে বংশে হল ছারখার।”
এক সময় অত্যাচারী ইংরেজরা যখন মুসলমানদের হাতে মার খাচ্ছিল তখন বেদনায় ব্যথিত হয়ে ‘গুরু’ ঈশ্বরগুপ্ত লিখলেন,
“দুর্জয় যবন নষ্ট,
করিলেক মান ভ্রষ্ট
সব গেল ব্রিটিশের ফেম।…
শুকাইল রাঙ্গা মুখ,
ইংরাজের এত দুখ,
ফাটে বুক হায় হায় হায়।”
বঙ্কিম-গুরুর কামনা ছিল, মুসলমানরা পরাজিত হয়ে ইংরেজরা যেন জয়ী হয়—তাই লিখলেন:
“যবনের যত বংশ,
একেবারে হবে ধ্বংস
সাজিয়াছে কোম্পানীর সেনা।”
“গরু জরু (স্ত্রী) লবে কেড়ে
চাঁপদেড়ে যত নেড়ে
এই বেলা সামাল সামাল।”
বিপ্লবে মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুরা কেউ যােগ দেন নি, এ কথা ঠিক নয়। লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া তােপী,নানা সাহেব ও কুমার সিংহের মত অনেক বীর যে তাঁদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন ইতিহাস তার জীবন্ত সাক্ষী। নানার মত বীরকে তিনি ‘পুষ্যি এঁড়ে দস্যি ভেড়ে’ বলেই ক্ষান্ত হন নি, আরও লিখলেন:
“নানা পাপে পটু নানা’
নাহি শুনে না, না।
অধর্মের অন্ধকারে হইয়াছে কানা।
ভাল-দোষে ভাল তুমি ঘটালে প্রমাদ।
আগেতে দেখেছে ঘুঘু শেষে দেখ ফাঁদ।।
[নানা সাহেব-গ্রন্থাবলী’, পৃষ্ঠা ১৮৯]
সম্মানীয়া নারী শহীদ লক্ষ্মীবাঈ-এর জন্য লিখেছেন
“হ্যাদে কি শুনি বাণী, ঝাঁসীর রাণী,
ঠোট কাটা কাকী।।
মেয়ে হয়ে সেনা নিয়ে, সাজিয়াছে নাকি।
‘নানা’ তার ঘরের ঢেঁকি…
হয়ে শেষে ‘নানা’র নানী, মরে রাণী
দেখে বুক ফাটে
কোম্পানীর মুলুকে কি বর্গিগিরি খাটে।” (কানপুরের যুদ্ধ জয়-গ্রন্থাবলী’, পৃষ্ঠা ১২)
অপর দিকে রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতি ভক্তিতে লিখলেন:
“এই ভারত কিসে রক্ষা হবে।
ভেব না মা সে ভাবনা।
সেই তাঁতিয়া তােপীর মাথা কেটে
আমরা ধরে দেব নানা’ [পৃষ্ঠা ১৩৬]
বৃটিশের প্রতি আনুগত্যে ও বৃটিশ-অনুগত যারা তাদের সাহস যােগাতে লিখলেন:
“জয় তােক ব্রিটিশের, ব্রিটিশের জয়।
রাজ-অনুগত যারা, তাদের কি ভয়।”[গ্রন্থাবলী’, পৃষ্ঠা ৩২০)।
এই ধরণের লেখাই যে আজ ভারতকে বিভক্ত করেছে, মানুষের মনে বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কোথায়? অবশ্য কেউ কেউ বলতে পারেন, উল্লিখিত উদাহরণগুলাে তাে সব কবিতার অংশ, কবিতায় কবির ভাব কখন কী হয় বলা দায়। যদি তাই ইহয়, তাহলে এবারে তাঁর অন্যান্য লেখনী অর্থাৎ তখনকার যে কাগজের তিনি সম্পাদক ছিলেন সেই বিখ্যাত ‘সংবাদ প্রভাকরে’র সম্পাদকীয় কলমের উপর দৃষ্টি দেওয়া যাক।
একেবারে ১৮৫৭র জুন মাসের ২০ তারিখের সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদকীয় থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হল – “কয়েক দল অধার্মিক অবাধ্য অকৃতজ্ঞ হিতাহিত বিবেচনা বিহীন এতদ্দেশীয় সেনা অধার্মিকতা প্রকাশ পূর্বক রাজ বিদ্রোহি হওয়াতে রাজ্যবাসী শান্ত স্বভাব অঞ্চন সধন প্রজা মাত্রেই” দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদকীয় কলমে আরও লিখলেন- “যাবনাধিকারে আমরা ধর্ম বিষয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্ত হই নাই, সর্বদাই অত্যাচার ঘটানাে হইত। মহরমের সময়ে সকল হিন্দুকে গলায় ‘বদি’ অর্থাৎ যাবনিক ধর্মসূচক একটি সূত্র বান্ধিয়া দর্গায় যাইতে হইত, গমি অর্থাৎ নীরব থাকিয়া ‘হাঁসন’ ‘হোসেনে’র মৃত্যুর জন্য শােক চিহ্ন প্রকাশ করিতে হইত। কাছা খুলিয়া কুর্শিস করিয়া ‘মাের্চে’ নামক গান করিতে হইত। তাহা না করিলে শােণিতের সমুদ্র প্রবাহিত হইত। এইক্ষণে ইংরাজাধিকারে সেই মনস্তাপ একেকালেই নিবারিত হইয়াছে, আমরা অনায়াসেই চর্চ নামক খ্রষ্টীয় ভজনা মন্দিরের সম্মুখেইগভীর স্বরে ঢাক, ঢােল, কাড়া, তাসা, নহবৎ, সানাই, তুরী, ভেরী, বাদ্য করিতেছি, ‘হ্যাডাং’ শব্দে বলিদান করিতেছি, নৃত্য করিতেছি, গান করিতেছি, প্রজাপালক রাজা তাহাতে বিরক্ত মাত্র না হইয়া উৎসাহ প্রদান করিতেছে।…নবাবী সময়ে আদব কায়দা করিতে করিতে কর্মচারিদিগের প্রাণান্ত হইত। গাড়ি, পালকি চড়া দূরে থাকুক হুজুরদিগের চক্ষে পড়িলে জুজুর মত সং সাজিয়া প্রাণ হাতে করিয়া থাকিতে হইত। বর্তমান রাজ মহাত্মারা যে বিষয়েই একেকালেই অভিমান শূন্য সমস্ত কর্মচারি যথােচিত মর্যাদার সহিত সুখে স্ব স্ব কর্ম নির্বাহ করিতেছেন, পথিকেরা কি মহারাণী কি গভর্ণর জেনারেল সকলের পাশ ঘেসিয়া নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে গমনাগমন করিতেছে। কেহ যদি ‘সেলাম’ না করে তাহাতে কিছুমাত্র ক্ষোভ নাই…যবনাধিকারে এই বঙ্গদেশের লােকেরা সময়ে সময়ে দস্য, তাকবিশেষত: বর্গির হেঙ্গামায় হৃতসর্বহইয়া কি পর্যন্ত আন্তরিক যারা সদ্যোগ না করিয়াছেই ক্ষণে সেই যাতনার জাতনাই।”
সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের প্রতি হিন্দুর রাজভক্তি কমবে না – এ কথা স্মরণ করিয়ে সম্পাদক ঈশ্বরগুপ্ত লিখেছেন: “জগদীশ্বর আপন ইচ্ছার বিদ্রোহি দিগে শাসন করুন; যাহারা বিদ্রোহি হয় নাই, তাহার দিগের মঙ্গল করুন, কোন কালে যেন তাহাদিগের মনে রাজভক্তির ব্যতিক্রম না হয়। হিন্দু সমাজের পক্ষ হতে সম্পাদক আরও লিখলেন, “হে আমারদিগের শরীরে বল নাই, মনে সাহস নাই, যুদ্ধ করিতে জানিনা, অতএব প্রার্থনাই আমাদিগের দূর্গ, ভক্তি আমার দিগের অস্ত্র এবং নাম জপ আমার দিগের বল….”।
১৮৫৭-র ঐ অগ্নিবর্ষের ২৯শে জুনের সম্পাদকীয় থেকে আর একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি, “অবােধ যবনেরা উপস্থিত বিদ্রোহ সময়ে গবর্ণমেন্টের সাহায্যার্থ কোন প্রকার সদনুষ্ঠান না করাতে তাহারদিগের রাজভক্তির সম্পূর্ণ বিপরীতাচরণ প্রচার হইয়াছে এবং বিজ্ঞ লােকেরা তাহারদিগের নিতান্ত অকৃতজ্ঞ জানিয়াছেন..যে সকল স্থানে বিদ্রোহানল প্রজ্বলিত হইয়াছে তাবত স্থানেই যবনেরা অস্ত্র ধারণ পূর্বক নিরাশ্রয় সাহেব বিবি বালক বালিকা এবং প্রজাদিগের প্রতি হৃদয় বিদীর্ণকর নিষ্ঠুরাচরণ করিয়াছে, সাহেবের মধ্যে অনেকে আপনাপন বহুকালের যবন ভৃত্যের দ্বারা হত হইয়াছে, অধুনা যবন প্ৰজাদিগের প্রতি গবর্ণমেন্টের এমত অবিশাস জন্মিয়াছে যে এইনগরে যে স্থানে অধিক যবনের বাস সেই স্থানেই অধিক রাজপ্রহরী নিযুক্ত হইয়াছে, নাগ বলন্টিয়ার সেনাগণ অতি সতর্কভাবে মাদরাসা কালেজ রক্ষা করিতেছে, যবনদিগের অন্তঃকরণে কিকারণ গবর্ণমেন্টের প্রতি কিভাবের আবির্ভাব হইয়াছে তাহা আমরা কিছুই নিরূপণ করিতে পারিলাম না।”
মুসলমান বিপ্লবীদের যখন নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হচ্ছিল ঠিক তখন-২২.৬.১৮৫৭ সংবাদ প্রভাকরের সংবাদে নয়, সম্পাদকীয়তে ছাপা হােল—“বন্য পশু শিকার নিমিত্ত শিকারিগণ যেমন পরমানন্দে দলবদ্ধ হইয়া গমন করে, শ্বেতাঙ্গ সৈন্যগণ সেইরূপ পুলকিত চিত্তে সিপাহি শিকারে গমন করিতেছে, নরাধম অকৃতজ্ঞদিগের আর রক্ষা নাই…”।
অপর একটি সম্পাদকীয়তে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মুসলমানদেরকে উপদেশ দিয়ে লিখলেন, “তােরা এখনাে ক্ষান্ত হ…তােদের কুমন্ত্রণাতেই তৈমুর বংশ একেবারে ধ্বংস হইল, তােদের দোষেই প্রাচীন রাজধানী দিল্লীনগর রসাতশয়ী হইল, তোঁদের দোষেই দিলীশ্বরের কারাবাস হইল…ওরে দুরান্ন…গলবন্দ্রে বিশ্ববিজয়ী বৃটিশ গবর্ণমেন্টের নিকট শির নত কর… দয়াবান গবর্ণমেন্ট অপরাধ মার্জনা করিবেন,…রাজানুগত্য স্বীকার করিলে জগদীশ্বর তােদের প্রতি কৃপানেত্রে নেত্রপাত করিকেন।”
স্বাধীনতা আন্দোলনের মুক্তিযযাদ্ধারা পরাজিত হয়ে যখন নেপালের গভীর অরণ্যে ও পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগােপন করেছিলেন তখন বিপ্লবীদের লক্ষ্য করে বঙ্কিমের শুরু শ্ৰী ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ঐ সংবাদ প্রভাকরেই লিখলেন—“নেপাল-দেশের অরণ্য পর্বতাদি স্থানে কিলবিল কিলবিল করিতেছে, দুরাত্মাদের দুরবস্থা দৃষ্টে কান্না পায়, দুঃখও বােধ হয়, আবার রঙ্গরস দেখিয়া হাসিতেও হয়,..অরগুণে নয়, বরগুণে দড়.. প্রায় ভাবতেই কেহ জেনেরল, কেহ কর্ণেল, কেহ কাপ্তেন ইত্যাদি উপাধি ধারা করিয়াছে, নবাব, দৌলা, খাঁ, বাহাদুরের তাে ছড়াছড়ি হইয়াছে, আবার দুই চারিজন নাক কানকাটা কমাণ্ডার ইন-চিফ বাহাদুর এবং লার্ড গবর্ণর জেনেরল সাহেব ইত্যাদিও হইয়াছে বাবাজীদের রাজ্য তাে পাঁচপােয়া কিন্তু কলেক্টর মেজিষ্ট্রেট, জজ, দেওয়ান, খাজাঞ্চি সঙ্গে সঙ্গেই রহিয়াছে, আহা। নেড়ে চরিত্র বিচিত্র, ইহারা অদ্যজুতা গড়িতে গড়িতে কল্য ‘সাহাজাদা’ ‘পীরজাদা’ ‘খানজাদা’ ‘নবাবজাদা’ হইয়া উঠে, রাতারাতি একে আর হইয়া বসে, যাহা হউক বাবাজীদের মুখের মতন হইয়াছে, অঙ্গের রঙ্গ দেখিয়া অন্তরঙ্গভাবে গদগদ হইয়াছিলেন, এদিকে জানেন না যে ‘বাঙ্গাল বড় হেঁয়াল..।”
আন্দোলন থামার পর ব্যাপকভাবে ফাঁসি, দ্বীপান্তর ও কারাবাসে শাক্তি বিশেষত মুসলমানদের ভাগ্যে যখন নেমে এল তখন সম্পাদকীয়তে সম্পাদক আরও জানালেন, ফাঁসির জন্য তিনি বা তাঁরা খুব খুশী, তবে শ্বেতাঙ্গদের শাস্তির ব্যাপারেও যেন পক্ষপাতিত্ব না করা হয়। (বিনয় ঘােষ সম্পাদিত ও সংকলিত সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজ চিত্র প্রথম খণ্ড, ‘সংবাদ প্রভাকর’ রচনা সংকলন, কলিকাতা ১৯৬২-র ২২৬-৫২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
নিরপেক্ষ কোন হিন্দু তখন দেশে ছিলেন না, একথাও ঠিক নয়। অবশ্য এও ঠিক যে, নিরপেক্ষ যাঁরা ছিলেন তাঁদের প্রভাব এদের নাম ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ।
বঙ্কিমচন্দ্র, সুকুমার সেন প্রভৃতি লেখা ঈশ্বরগুপ্তের জন্য অনেক কিছু লিখে থাকলেও শ্রীতারাপদ মুখােপাধ্যায় কিন্তু লিখেছেন- “সংরক্ষনশীল মনের দৃঢ় সংস্কারে যখন কম্পন লাগিয়াছে তখন ইংরেজের শিক্ষা সভ্যতার উপর তিনি বিযােগার করিয়াছেন, ইহা ছাড়া প্রকৃত দেশপ্রীতি ঈশ্বরচন্দ্রের ছিল বলিয়া মনে হয় না।”(দ্রষ্টব্যঃ ‘আধুনিক বাংলা কাব্য’ মিত্র ও ঘােষ, দ্বিতীয় ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ৫৭)।
অপর দিকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ও তাঁদের গ্রুপের মহান ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এর জন্য যা লিখেছেন তার মানুষের ভক্তিমাল্য ছিন্ন করে। তাঁর ভাষায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত “খাঁটি জিনিস বড় ভালবাসিতেন, মেকির বড়”। একথা যদি সত্য হয় তাহলে মেনে নিতে হবে যেহেতু ঈশ্বরগুপ্ত ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা বিপ্লবের তীব্র বিরােধিতা ও শত্রুতা করেছিলেন সেহেতু এ স্বাধীনতা আন্দোলন আসল ছিলিনা, বরং তা ‘মেকি’ ও ‘নকল’ ছিল। এও মেনে নিতে হবে যে, স্বাধীনতার চেষ্টা করা ছিল অন্যায় কাজ আর ইংরেজের গােলামী করা ছিল মহান কাজ। সেই সঙ্গে স্বভাবতই এ প্রশ্নও আসে—ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবীরা কি তাহলে স্বাই সুপথগামী, না কুপথগামী?—এর উত্তর চিন্তাশীল পাঠক ও সূক্ষ্মদর্শীরাই দেনে।