লিখেছেনঃ হায়দার আলী চৌধুরী
বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত সাম্প্রদায়িক উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ অনেকেই পড়েছেন। সে উপন্যাসে তিনি যবন-বিদ্বেষী সন্তান-সন্ন্যাসীদের কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও সেই সন্ন্যাসীরা যবন-বিদ্বেষী ছিল না। অথচ এই ‘আনন্দমঠ’ যে বাস্তবে ছিল তা হয়ত অনেকে জানেন না। আমরা এখানে সেই সত্যিকার আনন্দমঠের পরিচয় তুলে ধরব।
সম্ভবত মঠটি পূর্বে এক মহলা বিশিষ্ট দালান ছিল। কাছারি বাড়ির সংলগ্ন দুর্গা মন্দির, তার সামনে দেউড়ী ঘর, দুর্গামন্দির-এর উত্তরে অবস্থিত ঠাকুর বাড়ির প্রাঙ্গণে পশ্চিম দিকে এখনও একটি পূর্বেকার আমলের ফুলের বাগান রয়েছে, তবে তা সংস্কারের অভাবে বিলুপ্তির পথে। সেখানে শ্যামরায়ের (রাধাকৃষ্ণ) মন্দির এখনও রয়েছে। পূজাপার্বণাদি এখনও হয়। প্রায় ৪ শত বৎসর পূর্বেকার বাদশাহী আমলের একটি শিবমন্দির এখনও রয়েছে ও পূজাও চলছে। মন্দিরটি লম্বায় ২২ হাত, প্রস্থে ১৫ হাত একটি পাকা দালান। বাড়ির সংলগ্ন পশ্চিম দিকে একটি বিরাট ফলের বাগান (আম, কাঠাল, লিচু ইত্যাদি) এখনও রয়েছে। এই বাগানের পশ্চিম দিকে একটি প্রকাণ্ড দীঘি রয়েছে। বাড়ির পূর্বদিকেও রয়েছে পুরনাে আমলের একটি বিরাট দীঘি। ঘাটগুলি শান বাঁধানাে। বাড়ির সংলগ্ন দক্ষিণে- সামনেই একটি হাট অবস্থিত। হাটটির নাম ‘বাবুর হাট’। উক্ত বাবুর হাটের পশ্চিমে জমিদারদের পুরনাে আমলের ‘যতীন্দ্রকুমার ইউনিয়ন বাের্ড ডিসপেনসারী’ ও একটি পােস্ট অফিস অবস্থিত। পােস্ট অফিসটির নাম ‘ইটাকুমারী’। বাবুর হাটের সংলগ্ন দক্ষিণে আর একটি বিরাট দীঘি রয়েছে। দীঘিটির নাম ‘দেবী ভাসানাে’ দীঘি। হাটের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে একটি শান বাঁধানাে পুষ্করিণী রয়েছে। বাড়ির দক্ষিণে সামান্য দূরে রাস্তার ধারে একটি কালী মন্দিরের ‘পঞ্চমূর্তি আসন রয়েছে। এটিও বহু পুরাতন প্রায় ৫ শত বছরের পূর্বেকার। বাড়ির চতুম্পার্শ্বস্থ প্রাচীরগুলি এখনও বিদ্যমান রয়েছে। তবে সবগুলিই ধ্বংসের পথে।
বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাস্তার ধারে জমিদারদের দেওয়া একটি পূর্বের মধ্যে-ইংরেজী এম-ই স্কুল ছিল। স্থানীয় কতিপয় লােক জবরদস্তি করে জমিদারদের অমতে তাদের কাছারি বাড়িতে একটি জুনিয়র হাইস্কুল বসিয়েছে। জমিদারদের থাকবার ঘরগুলি এখন প্রায় ধসে পড়ছে। কাছারিঘরে তারা থাকতে পারত, যদি না জোর করে সেখানে উক্ত স্কুল বসানাে হতাে।
শ্রী যতীন্দ্র কুমার রায় চৌধুরীর স্মৃতিমন্দির ও তার স্ত্রী ক্ষীরােদা সুন্দরী রায় চৌধুরানীর স্মৃতিমন্দিরও বাড়ির পশ্চিম দিকে বাঁশদহ নামক শ্মশানে মন্দির দুটি পাশাপাশি এখনও রয়েছে।
ইটাকুমারীর জমিদারদের দেওয়া বাদশাহী আমলের নির্মিত ‘আনন্দমঠ’ নামীয় মঠটিই, জমিদার বাড়ি হতে দেড় ক্রোশ উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। লােকেরা বলে থাকে স্থানটির নাম ‘তপস্বীদাঙ্গার মঠ’। অবশ্য আঞ্চলিক ভাষায় নাম সংক্ষিপ্ত হয়েছে। আনন্দমঠ সংলগ্ন স্থানে ত শত তপস্বী থাকত অর্থাৎ ইংরেজ-বিরােধী সন্ন্যাসীরা ‘আনন্দমঠে’ থাকতেন এবং তারা মঠে পূজা-অর্চনা করতেন। মঠের পূর্বধারে একটি জলাশয়কে ‘তপস্বীদাঙ্গার বিল’ বলা হয়ে থাকে। সম্ভবত পূর্বে সেটি খনিত হয়েছিল।
যতীন্দ্রকুমার রায় চৌধুরীর কন্যা ননীবালা দাসগুপ্তা, বয়স ৭০ বছর, উষারাণী দাসগুপ্তা, বয়স ৬৫ বছর তারা ওদের সাক্ষাৎকার বিবরণীতে বলেন :
“আমরা ছােট বেলায় আমাদের পূর্বপুরুষদের দেওয়া ‘আনন্দমঠে’ অনেকবার বেড়াতে গিয়েছি। সে সময় মন্দিরের চূড়া ভেঙ্গে পড়া দেখেছি। ওর আশেপাশে আরও কয়েকটি মন্দির ছিল, কিন্তু ‘আনন্দমঠ’ নামীয় মঠটি ছিল খুবই বৃহদাকার। ঐ সময় আমরা শিবলিঙ্গ দেখেছি। সম্পূর্ণ জায়গাটিকে নিয়ে ‘আনন্দমঠ’ বলা হতাে। আনন্দমঠ ও অন্যান্য মন্দিরের উপরে বিরাট আকারের বট গাছ দাঁড়িয়ে থাকা আমরা দেখেছি। আনন্দমঠ সংলগ্ন চতুম্পার্শ্বস্থ স্থান ব্যাপী বাঁশ ও অন্যান্য গাছ-গাছড়ায় বিরাট জঙ্গল পূর্ণ ছিল। এত ভীষণ জঙ্গল যে, দিনের বেলায়ও জঙ্গলের অনেক জায়গায় সূর্যের আলাে প্রবেশ করতে পারত না। লােকজন ভয়ে একাকী ঐ সব এলাকায় পুর্বে যাওয়া-আসা করত না।”
এ আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনাদের দেখার সময়েও কি আনন্দমঠে পূজা উৎসব হতাে?”
উত্তরে তারা বললেন, “না, ও সব কিছু হতাে না।”
শ্রীযুক্ত ননীবালা দাসগুপ্তা এবং উষারাণী দাসগুপ্তার ভ্রাতুপুত্র শ্রীযােগেন্দ্র কুমার রায়চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র উপেন্দ্র কুমার রায়চৌধুরী, বয়স ৪৮ বছর তিনি তার সাক্ষাৎকার বিবরণীতে বলেন :
“আমি ৩০/৩৫ বছর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষদের দেওয়া ‘আনন্দমঠ’ দেখতে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ১৬/১৭ বছর। আমার সম্পর্কীয় কাকাবাবু শ্রী জগৎচন্দ্র দত্ত গুপ্ত মহাশয় আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহের শেরপুর টাউনের অধিবাসী। আমরা প্রথমে গিয়ে দেখি, রেল লাইনের পশ্চিমে একটি বাঁশঝাড়ের কাছে আনন্দমঠের ভগ্নাবশেষ এবং শিবমন্দিরের ভিটার উপর শিবলিঙ্গ অবস্থিত রয়েছে এবং রেল লাইনের পূর্ব দিকে তপস্বীদাঙ্গা বিলের দক্ষিণ পাড়ে একটি বিরাট জঙ্গলের মধ্যে উল্লিখিত আনন্দমঠের সরু এ পথ। ওই পথ দিয়ে পশ্চিমদিকে আমি ভিতরে গিয়ে দেখি, জায়গায় জায়গায় অনেকগুলি ভগ্ন মঠ ও মন্দিরের উপরে বট পাকুড়ের গাছ হয়ে রয়েছে এবং দুর্গম পথ গভীর জঙ্গলের জন্য আমি আর সামনে যেতে পারি নাই। এত ভীষণ জঙ্গল ছিল যে, দিনের বেলাও জঙ্গলের অনেক স্থানে সূর্যের আলাে প্রবেশ করতে পারত না।”
আগের সময়কালে তপস্বীদাঙ্গার মাঠ এবং ‘আনন্দমঠের’ চতুম্পার্শ্বস্থ স্থানগুলি বিরাট জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। ইংরেজদের অত্যাচারের ভয়ে অযত্নে স্থানগুলি জঙ্গলাকীর্ণ হয়েছিল। অথবা ইংরেজরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই ঐতিহাসিক স্থানগুলিকে অন্য ঐতিহাসিক স্থানগুলির মত লােকচক্ষুর বাইরে রাখবার জন্য এভাবে ভীষণ জঙ্গল করে রেখেছিল। নবাবের উযীর রাজা শিবচন্দ্র রায়ের সময়কালে এই সব এলাকা বিস্তীর্ণ মঠ ছিল। জঙ্গল ছিল না। ওই সময়গুলিতে ইংরেজদের বিপক্ষীয়দের শক্তি খুব একটা কম ছিল বলে মনে হয় না। অবশ্য পরে প্রচারের মাহাত্ম্যে এবং যে কোনভাবে হােক যুদ্ধে জয়লাভ করার পর ইংরেজদের অজেয় দেখানাে হয়েছে। এখন এই ভীষণ জঙ্গলের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বর্তমানে লােকে আবাদযােগ্য জমি করেছে। স্থানে স্থানে বসতবাড়ি করা হয়েছে, দেখলাম। এই ঐতিহাসিক স্থানটি অযত্নে অবহেলায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে নামগুলি এখনও লােকেরা বলে থাকেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয় আমাদের বর্ণিত ‘আনন্দমঠে’র নাম নিয়ে তার বিখ্যাত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসখানির নাম দিয়েছেন কি? আমাদের কিন্তু তাই মনে হয়। কাউনিয়া রেলওয়ে জংশন হতে দক্ষিণ দিকে এক ক্রোশ দূরে রেল লাইনের পাশে ‘আনন্দমঠের’ স্থানটি অবস্থিত। অন্নদানগর রেল স্টেশন হতে উত্তরে প্রায় এক ক্রোশ দুরে উক্ত আনন্দমঠের তপস্বীদাঙ্গার দীঘি। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয় হিন্দু সন্ন্যাসীদিগকে তপস্বী বলেছেন। আসলে এখানে এই তপস্বীদাঙ্গার দীঘির পার্শ্বস্থিত মাঠে হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের তপস্বীরা এক মাঠে আলাদা আলাদাভাবে তাঁবু খাটিয়েছিলেন এবং তাঁরা একই সঙ্গে ইংরেজ ও ইংরেজপক্ষীয় নবাবের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। জমিদার শিবচন্দ্র রায় সম্রাট পক্ষীয় সুবাদারের একজন বিশিষ্ট উযীর ছিলেন। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার জন্য বঙ্কিমের আনন্দমঠের তপস্বী বলতে শুধু হিন্দু সন্ন্যাসীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা সত্য নয়।
তপস্যীগঙ্গার দীঘি
স্থানীয় লােকেরা উক্ত দীঘিটিকে এখন ‘বিল’ বলে থাকে। দীঘির কোন চিহ্নই অবলুপ্ত হয় নাই। দীঘিটি সুবৃহৎ বলে বিল বলা হয়ে থাকে মনে হয়। [চৈত্র মাসে দীঘির পানি কমে। তথাপি কোন কোন জায়গায় ১৮হাত হতে ২০ হাজ পর্যন্ত গভীর থাকে।] এই স্থানটি যেমনি ঐতিহাসিক, তেমনি দেশপ্রেমিকদের নিকট এককালে স্মরণীয়, বরণীয় এবং আদরণীয় ছিল। আজও তাই থাকবে বলে আমরা আশা করি। তপস্বীদাঙ্গা দীঘিটি হলাে রঙ্গপুর জেলার সদর মহকুমাধীন কাউনিয়া থানার অন্তর্গত। দীঘিটি জলস্থিত এবং পাড়ের কোন কোন অংশের নাম হলাে ‘আরজী শাহবাজ’। আসলে হবে ‘অরাজী শাহবাজ’। অ-টাকে স্থানীয় শব্দে ‘আ’ করে ফেলা হয় উচ্চারণের অস্পষ্টতর জন্য। যেমন ‘আম বাবু গেলেন রাম আনতে’ এখানেও ঠিক তেমনই হয়েছে বলে মনে হয়। তপস্বীদাঙ্গার দীঘির পশ্চিম প্রান্তের নাম হলাে ‘খেপাতী’। আশপাশের কোন কোন স্থানের নাম হলাে শাহবাজ, হরিচরণ লস্কর, বটু বাড়ি। তপস্বীদাঙ্গার দীঘির দক্ষিণ পাড়ে ‘আনন্দমঠ’ অবস্থিত ছিল। আনন্দমঠের ৪০ গজ উত্তরে শিবমন্দির। শিবমন্দিরের শিবলিঙ্গ এবং শিবলিঙ্গের নিচে থালার মত বৃহৎ পাথর (যােনিপাট) বসানাে ছিল। শিবলিঙ্গে দুধ ঢেলে দিলে যে পাথরে এসে পড়ত, সেই পাথর এবং লিঙ্গট্রি স্থানীয় এক ভদ্রলােক তার বাড়িতে নিয়ে গেছেন। ‘আনন্দমঠের’ চিহ্ন ১৯০৩/১৯০৪ সালের মধ্যে ধ্বংস করা বা উৎখাত করা হয়েছে। পার্শ্বস্থিত শিবমন্দিরের গায়ে বিশালকায় বটবৃক্ষ হওয়ায় এবং অযত্নের ফলে মন্দিরের চূড়া ও পাশ আপনা হতে ভেঙ্গে পড়েছে। পরে দেওয়ালের নিচের অংশ এবং মেঝে লােকেরা খুঁড়ে নিয়ে যায় লােকচক্ষুর অন্তরালে। কারণ স্থানগুলি ভীষণ জঙ্গলাকীর্ণ হয়েছিল। সে কথা আমরা পরে বলছি।
গাজীর দরগাহঃ তপস্বীদাঙ্গা দীঘির উত্তর-পশ্চিম কোণে হলাে ‘গাজীর দরগাহ’। এই গাজীরা আর কেউ নয়, ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধকারী ফকির, দরবেশ এবং তাদের দলবল।
কালীর থানঃ গাজীর দরগাহ হতে ২৫০ গজ পূর্বদিকে দীঘির উত্তর পাড়ে ‘কালীর থান’। এখানে একটি কালী মন্দির ছিল। দরগাহ ও কালী মন্দিরের চিহ্নমাত্র এখন নেই, নামগুলি শুধু রয়েছে। স্থানীয় লােকেরা স্থানগুলি দেখিয়ে দেন।
বুড়াবুড়ির থানঃ কালীর থানের ২৫/৩০ গজ পার্শ্বে বুড়াবুড়ির থান। স্থানীয় অশিক্ষিত হিন্দুগণ মহাদেব ও তাঁর স্ত্রী কালী দেবীকে বুড়াবুড়ি বলে থাকেন। উক্ত স্থানেও একটি শিব ও কালী মন্দির ছিল। এখন চিহ্নমাত্র নেই।
আনন্দমঠের ৬০০ গজ উত্তর দিকে আরও একটি বুড়াবুড়ির মন্দির ছিল। তারও কোন চিহ্নমাত্র নেই। সম্ভবত বুড়াবুড়ি নামীয় মন্দিরগুলি নিম্নশ্রেণীর হিন্দু যােদ্ধাগণের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। তারা ঐ দুটি মন্দিরে পূজা-অর্চনা করত।
রাজঘাটঃ তপস্বীদাঙ্গা দীঘি বা বিলের দক্ষিণ পাড়ের একটি ঘাটের নাম হলাে ‘রাজঘাট’। উক্ত নামটি ইংরেজ-বিরােধী জমিদার নবাবের উযীর রাজা শিবচন্দ্র রায়ের নাম স্মরণ করিয়ে দেয়।
বামনী ঘাটঃ রাজঘাটের পূর্ব-দক্ষিণে আর একটি ঘাটের নাম হলাে ‘বামনী ঘাট’ (ব্রাহ্মণী ঘাট)।
ইংরেজ-বিরােধী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী ব্রাহ্মণী ছিলেন বলে উক্ত নামকরণ হয়েছে। ঘাটের পার্শ্বস্থিত স্থানগুলিতে উযীর রাজা শিবচন্দ্র রায় এবং ব্রাহ্মণী জমিদার জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী সময় সময় এসে তাবু ফেলতেন। দীঘির পূর্ব পাড়ের নাম ‘বনগাঁও’। এই সব অঞ্চল যখন আমি পায়ে হেঁটে হেঁটে বেড়াই, ঐ সময় আমি ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। তাই পূর্ব দিকের বর্ণনা দিতে পারলাম না। তবে যেটুকু জেনেছি তা এখানে উল্লেখ করবার চেষ্টা করব।
মানস-নদী ও দেশীয় সন্তানদের আস্তানাঃ তপস্বীদাঙ্গা দীঘির চতুম্পার্শ্বস্থ কয়েক মাইল জুড়ে ইংরেজবিরােধী দেশীয় সন্তানদের আস্তানা ছিল। প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় কাজ করতেন। হিন্দু, মুসলমান সকল সম্প্রদায় ও সকল শ্রেণীর লােক মিলে বিদেশী ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহ করতেন। কাউনিয়া থানার উত্তর-পশ্চিম দিকে হলাে ‘ধূমির কুঠি’। ধূমির কুঠির পাশে সরাইখানা। ধূমির কুঠির সামনে দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে মানস-নদী।
সুবাঘাটঃ ধূমির কুঠিতে যাওয়া-আসার ঘাটকে এখন অবধি বলা হয়ে থাকে ‘সুবাঘাট’। মানস-নদী দক্ষিণ দিকে সােজা চলে এসেছে জমিদার শিবচন্দ্র রায়ের বাড়ির পূর্ব দিক দিয়ে আনন্দমঠের পশ্চিম প্রান্ত হয়ে কুঠির পাড় (মােগলকুঠি)। উক্ত কুঠির উত্তর পার্শ্ব দিয়ে মনস-নদী আরও দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে।
চৌকির ঘাটঃ কুঠির পাড়ের সংলগ্ন একটি ঘাটকে এখনও ‘চৌকির ঘাট’ বলা হয়ে থাকে। তপস্বীদাঙ্গা দীঘির চতুষ্পর্শ নিয়ে চৌকির ঘাট, কুঠির পাড় প্রভৃতি স্থান। ইংরেজ-বিরােধীদের সংরক্ষিত স্থান ছিল বলে মনে হয়। তা না হলে চৌকির ঘাট বা পাহারা দেওয়ার ঘাট বলা হয় কেন?
চান ঘাটঃ এরই এক পার্শ্বের ঘাটকে বলা হয় ‘চান ঘাট’। সম্ভবত স্নান করার ঘাট ছিল বলে মনে হয়। আনন্দমঠের বা তপস্বীদাঙ্গার বিলের চতুস্পার্শ্বস্থ স্থানগুলি সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা ঘােরতর জঙ্গল করে রেখেছিল। তন্মধ্যে বেতবন খুব ঘন করে লাগান হয়েছিল, যার ফলে বেতগাছের অসংখ্য কাটা হওয়ায় সাধারণ লােকজনের পক্ষে এই বনে প্রবেশ একরূপ অসাধ্য হয়ে পড়েছিল। আরও নানা গাছ-বট, পইকড়, ডুমুর, পুকুরের পাড় দিয়ে বাঁশ, বেত বাঁশ, নানা কাটার গাছ সুচতুর ইংরেজরা লাগিয়েছিল। বনে চিতা বাঘ (রয়েল বেঙ্গল টাইগার), বুনাে শূকর পালে পালে চরে বেড়াত। নানা জাতের সর্প এবং বিষধর সর্প এই সমস্ত জঙ্গলে বিচরণ করত। এই লেখার ৫/৬ বছর পূর্বেও একটি ভীষণ বড় চিতাবাঘ মারা হয়েছিল। বাঘটিকে যে লােক মারেন, তার নাম ময়েজউদ্দীন। ময়েজউদ্দীন দোনালা বন্দুক দিয়ে বাঘকে প্রথম গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ লাফ দিয়ে এসে ময়েজউদ্দীনের একটি হাত কামড়ে ধরে। ময়েজউদ্দীন অবিচলভাবে মাটিতে ঠেস দিয়ে বন্দুকের নল বাঘের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে। দ্বিতীয় গুলি ছুঁড়েন। এইভাবে বাঘটি সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়।
ময়েজউদ্দীনের হাতটি যখম হয় কিন্তু ময়েজউদ্দীনের জীবন রক্ষা পায়। উক্ত ঘটনার কিছু দিন পর আনন্দমঠ যে স্থানে অবস্থিত ছিল, ঐ স্থানে ৩ জন যুবক বনের ভিতর ঢুকে। জমিরউদ্দীন নামে এক যুবক দেয়াশলাইর কাঠি দিয়ে বনে আগুন ধরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে এক পাল বুনাে শূকর ওদের তাড়া করতে আসে। যুবক ৩টি উপায়ান্তর বেনা দেখে ডুমুর গাছে উঠে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে চিল্কার দেওয়ার আশেপাশের কাজকরা লােকজন এসে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
চতুর্দিকে জঙ্গল তখন প্রায় একরূপ শেষ হয়ে গেছে। শুধু ‘আনন্দমঠের’ চতুষ্পর্শ্বে উক্ত জঙ্গল ছিল। এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। লােকজন বসত-বাড়ি নির্মাণ করে প্রায় জায়গাগুলিকে আবাদযােগ্য ভূমিতে পরিণত করেছে। এই সমস্ত এলাকা উযীর জমিদার শিবচন্দ্র রায়ের জমিদারীর অন্তর্গত ছিল।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।