উইলিয়াম উইলসন হান্টার সাহেব ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি নিয়ে ভারতে আসেন। তিনি ছিলেন স্কটিস, স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। তিনি নানান সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে ১৮৬৮ সালে ‘ দ্য অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ নামে একটি পুস্তক লেখেন। এই পুস্তকে বেনিয়া কোম্পানির মানদণ্ডটি পলাশীর যুদ্ধের পর কেমন করে ধীরে ধীরে রাজদণ্ডর আকার নিচ্ছিল তা অবশ্য তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি প্রায় প্রতিটি জায়গায় লিখেছেন, দুর্ভিক্ষের সময় শাসন ক্ষমতাটি ছিল মুসলিমদের হাতে। এছাড়া শাসন পরিচালনার কাল হাতটি হয়ত তিনি লক্ষ্য করেননি অথবা সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। এই পরিবর্তনটি জীবন মুখোপাধ্যায়, ইয়ং হাজবেন্ড ও জেমস গ্রান্টের লেখা থেকে জানা যায়। মনে করা হয়, হান্টারের এই পুস্তক পাঠেই অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস রচনা করেন। সাহিত্যসম্রাটের তথ্য সংগ্রহের উৎস পুস্তকে দুর্ভিক্ষের ও সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা লিপিবদ্ধ করা হল।
২৩-শে নভেম্বর ১৭৬৯, ৮-১০ অনুচ্ছেদ– ‘ভদ্রমহোদয়, এটি চরম উদ্বেগের বিষয়, আমরা জানাচ্ছি যে খাদ্যশস্যের অভাবের জন্য আমাদের চোখের সামনে সার্বিক ক্লেশকর ঘটনা ঘটছে যা দুঃখজনক অগ্রগতি। কারণ, অস্বাভাবিক খরা দেশের প্রতিটি অংশে ছেয়ে আছে, এটির ব্যাপকতা এত বেশি যে বৃদ্ধ অধিবাসীরাও এমন কোনও ঘটনা মনে করতে পারছেন না। আশঙ্কা হচ্ছে এটি দুর্ভিক্ষে পরিণত না হয়।’ গভর্নর ভেবেলেস্ট চিঠিটি সই করেননি। (পৃ. ২৮০)
“১৭৭০ সালে সারা গ্রীষ্মকালব্যাপী বহু মানুষ মারা গেল। গরু-ছাগল, লাঙল-জোয়াল বেচে ফেলল এবং সঞ্চিত বীজধানও খেয়ে ফেলল। অবশেষে ছেলেমেয়ে বেচতে শুরু করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন হল ক্রেতাও পাওয়া গেল না। তারপর শুরু হয় গাছের পাতা ও ঘাস খাওয়া। ১৭৭০-এর জুন মাসে দরবারের রেসিডেন্ট স্বীকার করে যে, জীবিত মানুষ মরা মানুষের মাংস খেতে শুরু করে। অনশনে শীর্ণ, রোগে ক্লিষ্ট কঙ্কালসার মানুষ দিনরাত সারি বেঁধে বড় বড় শহরে এসে জমা হত। বছরের শুরুতেই সংক্রামক রোগ শুরু হয়। মার্চ মাসে মুর্শিদাবাদে জলবসন্ত দেখা দেয় এবং বহু মানুষ মারা যান। শাহজাদা সাইফুও মারা যান। মৃত ও মুমূর্ষু রোগী স্তূপাকারে পড়ে থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। লাশের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে, তা মাটিচাপা দেওয়ার কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত গলিত লাশ মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছিল।”
একই বছরের ৪-ঠা ফেব্রুয়ারি বোর্ড অব ডিরেক্টরিতে পাঠানো রেসিডেন্টের এক পত্রে জানা যায়,’অবস্থা শোচনীয় হলেও কাউন্সিল এখনও রাজস্ব নির্ধারিত পরিমাণ আদায় কম হয়েছে বলে দেখতে পাননি’। ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বলে সরকারি হিসাবে বলা হয়েছিল। জুন মাসে প্রতি ষোল জনের ছয় জন মারা গিয়েছিল বলে মনে করা হয়। এই সময় স্পষ্ট বোঝা যায় যে কৃষকদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে, সমস্ত জমিতে আবাদ করার জন্য তাদের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। মোট জমির এক-তৃতীয়াংশ দ্রুত পতিত জমিতে পরিণত হয়।
‘১৭৭০-এ প্রকৃতির কৃপণতা কমার লক্ষণ ছাড়াই সরাসরি প্রকৃত ক্ষতিকর স্তরে পৌঁছালো। বছরের মাঝামাঝি পৌঁছানোর আগেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ১ কোটি মানুষ মারা গেল। বছর শেষে একটি সরকারি প্রতিবেদন বলছে কিছু দরিদ্র শ্রেণী-যেমন চুনাভাটির শ্রমিকদের ১৫০ জনের মধ্যে মাত্র পাঁচজন বেঁচে যায় এবং দেশের ১/৩ ভাগ ভূমি জঙ্গলে পরিণত হয়ে গেছে।
জনৈক ইংরেজ কর্মচারী লিখলেন, ‘বাংলার দুরবস্থা কল্পনা ও বর্ণনার অতীত। এবিষয়ে নিঃসন্দেহ যে, বহু স্থানে মৃতের মাংস খেয়ে মানুষ জীবনধারণের চেষ্টা করেছে।’
চার্লস গ্রান্ট বলেছেন, ‘আমি নিজ চোখে দেখলাম, মুর্শিদাবাদে ৭৭ হাজার লোককে অনেক মাস ধরে খাওয়ানোর পরও প্রতিদিন সেখানে প্রায় ৫০০-র মত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বিশেষ একদল লোক রাস্তাঘাট থেকে মৃতদেহ কুড়ানোর জন্য নিয়োজিত হয়। যারা মৃতদেহ কুড়ায় তারাও একে একে ক্ষুধার জ্বালায় মৃত্যুবরণ করে। রাস্তা ঘাটে ও ঘরের মধ্যে পড়ে থাকা মৃতদেহ শিয়াল-কুকুর- শকুন খেতে থাকে। পচা দেহের পুতিগন্ধ ও অর্ধ মৃতদের কান্না কাতরানির জন্য রাস্তায় বের হওয়া যায় না।
ওয়ারেন হেস্টিংস দুর্ভিক্ষের অব্যবহিত পরেই গভর্নর হিসাবে নিযুক্ত হয়ে আনুমানিক একটি হিসাব দিয়ে বলেন,’ প্রায় ১/৩ অংশ (১ কোটি) মানুষ মারা গেছে। তবে সর্বাধুনিক গবেষণায় জানা যায় প্রায় অর্ধেক মানুষ মারা গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষের প্রকোপ কম থাকা জায়গাগুলিতে রাঢ় বাংলার দুর্ভিক্ষ পীড়িত প্রচুর মানুষ পালিয়ে যান। রংপুরের সুপারভাইজার মিস্টার প্রয় মুর্শিদাবাদ রেভিনিউ কাউন্সিলকে জানান, ওই এলাকার প্রায় ২/৩ অংশ শ্রেষ্ঠ জমি লোকের অভাবে পতিত জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এহেন ভুতুড়ে পরিবেশে যারা জীবিত আছে তারাও অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত সমস্ত এলাকার জন্যই এ মন্তব্য কমবেশি প্রযোজ্য।
দুর্ভিক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হওয়ায় এক-তৃতীয়াংশ জমি দ্রুত জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। এই জঙ্গলের বর্ণনাকালে হান্টার সাহেব বারবার ‘মুসলিম মিসরুল’-এর কথা বলে জঙ্গল সৃষ্টির দায় মুসলিম শাসকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ধোয়া তুলসীপাতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। হান্টার সাহেবের লেখায় জানা যায়, মীরজাফরের সময়ই ক্লাইভের ব্যবস্থাপনায় নবাবের বাহিনীর যে ৭০ হাজার জওয়ানকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, পদচ্যুত সেই সৈন্যদল যত্রতত্র ঘুরে ফিরে বেড়াত। যেখানে যেত ব্যাপক লুটপাট করত। এরা প্রায়ই কোম্পানির পোশাক পরে গ্রামের সাধারণ গৃহস্থর কাছ থেকে ব্যাপক তোলা আদায় করত। এরা নিজেদের বলতো গৃহহীন ভক্তের দল এবং ৫০ হাজার লোকের দল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরত। কাউন্সিল ১৭৭৩-এ লিখল আইন অমান্যকারী একদল ডাকাত যারা সন্ন্যাসী বা ফকির নামে পরিচিত ছিল, এরা এই দেশটিতে বহু পূর্ব থেকেই ছিল এবং ধর্মীয় তীর্থ করার ভান করত। প্রধান এলাকাগুলিতে ঘুরে বেড়াত; এবং যেখানে যেত ব্যাপক লুটতরাজ চালাত যা এদের অভ্যাসকে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রকাশ করত। দুর্ভিক্ষের পর বছর গড়ালে এদের সংখ্যা স্ফীত করল ক্ষুধার্ত মানুষের দল, যাদের না ছিল বপনের বীজ, না ছিল চাষ শুরুর ব্যবস্থা। ১৭৭২-এর শীতল আবহাওয়া এদের নিম্নবঙ্গে টেনে আনল। ৫০ হাজার মানুষ গৃহদাহ, ধ্বংস কার্য ও ব্যাপক লুটতরাজ শুরু করল। কালেক্টররা সেনাবাহিনীকে ডাকলেও প্রাথমিক বিজয়লাভের পর সম্পূর্ণ পরাজিত হল এবং ক্যাপ্টেন টমাস (সেনাপতি) তাঁর সমস্ত বাহিনী নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। শীত শেষের মুখে, কাউন্সিল কোর্ট অফ ডিরেক্টরের কাছে রিপোর্ট দিতে পারল যে, একজন দক্ষ কমান্ডারের নেতৃত্বে সাফল্যের সঙ্গে তাদের পরাস্ত করা গিয়েছে। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই দেখা গেল যে এই রিপোর্টটি ছিল ভুয়ো। ১৭৭৩-এর ৩১-শে মার্চ ওয়ারেন হেস্টিংস সরাসরি অনুমোদন করলেন যে, ‘টমাসের পর যে কমান্ডারকে নিযুক্ত করা হয়েছিল অসুখকরভাবে তাঁর ভাগ্যেরও একই পরিনতি হয়েছে’। চার ব্যাটেলিয়ান সৈন্য লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে নিযুক্ত ছিল এবং জমির মালিকদের উপর থেকেও পিটুনি কর তুলে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু যৌথবাহিনীও কোন ফল দিল না। কোনরকম রেভিনিউ আদায় করা গেল না এবং গ্রামের বাসিন্দারাও লুণ্ঠনকারীদের সঙ্গে সর্বতোভাবে একাত্মবোধ করেছিল। সমস্ত পল্লী এলাকার শাসনব্যবস্থা বিকল হয়ে গেল। (দি অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল পৃ. ৪৯-৫০)।
মীরজাফরের সময়ই ক্লাইভের ব্যবস্থাপনায় নবাবের বাহিনীর ৫০ হাজার সেনাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। হান্টার সাহেব তাঁর বর্ণনায় এদের পদচ্যুত ও তলানি বললেও এরা এবং পরবর্তীতে যোগ দেওয়া দুর্ভিক্ষের বুভুক্ষুর দল ( দুর্ভিক্ষ ও পরবর্তী বুভুক্ষু সৃষ্টির জন্যেও ব্রিটিশ দায়ী) পলাশি অপেক্ষাও বেশি বাধাদান করেছিল এবং বৃটিশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ দীর্ঘদিন লড়াই করেছিল। হান্টার যতই ইংরেজ প্রশাসনকে আড়াল করুন তথাকথিত ৫০ হাজার চালচুলোহীন ফকির- সন্ন্যাসীর সঙ্গে গৃহী গ্রামবাসীরাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল নিদারুন অত্যাচার থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য।
বাংলার বুকে ১৭৬৯ নাগাদ সুপারভাইজার রূপে কয়েকজনকে বসানো হয়েছিল– পূর্ণিয়ায় মিস্টার ডুকারেল, বীরভূমের মিস্টার হিগিনসন, রাজশাহীর মিস্টার ক্লজ, মুর্শিদাবাদের মিস্টার রিড ইত্যাদি। এদের কাজই ছিল রাজস্ব আদায় ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখা। এর জন্য সংশ্লিষ্ট রাজস্ব আদায়কারী সাধারণ দেশীয় জমিদারবর্গ কতটা নিষ্ঠুর ব্যবস্থাপত্র নিচ্ছে তা দেখা এদের কাজ ছিল না। এরা এবং এদের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত বর্ধিত হারে রাজস্ব আদায় ও সেই রাজস্ব যথাসম্ভব বাংলায় কম খরচ করে সিংহভাগ ইংল্যান্ডে পাঠানোর দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখত। জমিদারদের অবস্থা ছিল শাঁখের করাতের মত। তাঁরা যথাসম্ভব অধিক পরিমাণে বোর্ডের চাহিদামত রাজস্ব আদায়ে বাধ্য ছিল। এরজন্য স্বল্পসংখ্যক রায়তের (বেশিরভাগই দুর্ভিক্ষ পীড়িত ও পরবর্তীকালে মারা গিয়েছিল) উপর চরম অত্যাচার চালানো হত। রাজস্ব আদায় না হলে জমিদারি কেড়ে নিয়ে একদা তাদেরই দ্বারা অত্যাচারিত ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের মত রায়তদের গোত্রে ফেলে দেওয়া হত। প্রাক্তন জমিদার ও অভিজাতদের কিছু অংশ যোগ দেন ফকির সন্ন্যাসীদের সঙ্গে।
১৭৮৪ নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ এলাকাগুলিতে বারবার সরকারি পরিবর্তন দেখে পার্লামেন্ট অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন রাজা, জমিদার, সামন্ত প্রভু ও অন্যান্য দেশেজ জমির মালিকদের দুঃখ কষ্ট দেখে আহত হয়ে নির্দেশ দেওয়া হল, দেশের প্রাচীন আইন ও প্রথার উপর ভিত্তি করে একটি স্থায়ী সরকার দেওয়া হোক। ৩০ বছর ধরে কোর্ট অফ ডিরেক্টর বাংলার আভ্যন্তরীণ শাসনের জন্য দেশজ ব্যক্তিত্ব কিংবা ইংরেজ– কাদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হবে তা নিয়ে দোলাচলে ছিল। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিতে লিখেছিলেন, ‘কোম্পানির কোনও কর্মচারীকে কালেক্টর পদে বসানো হলে কিংবা ইংরেজ শক্তিকে প্রতিষ্ঠাকল্পে যদি কোনও প্রকার উদ্যোগ নেওয়া হয় তবে মুখোশ উন্মোচিত হয়ে প্রকাশিত হয়ে পড়বে ইংরেজ শক্তি নবাবের শক্তির সমান এবং প্রদেশে কোম্পানিই শাসক (গভর্নর)’। এই বক্তব্য অনুযায়ী দিল্লির বাদশা কতৃক ক্ষমতা অর্পণের পর প্রথম ৪ বছর দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার প্রচলন করা হয় এবং সরকারের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড ন্যস্ত হয় দেশীয়দের উপর। কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে ক্রমে এই বোধ জেগে উঠলো আমাদের এরকম দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া একই সঙ্গে পুরুষোচিত নয় এবং অযৌক্তিক। মিস্টার হলওয়েল অন্ধকূপ হত্যার (১৭৫৬) পর প্রধান জীবিত ব্যক্তি এবং নথিবদ্ধকারী জোরালোভাবে নিজ অবস্থান প্রকাশ করলেন, “আমরা এই প্রদেশসমূহে ৮ বছর ধরে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছি এবং বড় এলাকা দখল করা ও কর আদায় সত্বেও কোম্পানি আমাদের দ্বারা কি রকম উপকৃত হয়েছে? আমরা কি একইভাবে শিকারটিকে ঠুকরে যাব, যতক্ষণ না ফাঁসটি আমাদের গলায় না চেপে বসে এবং ধ্বংস করে দেয়? আমরা সাহস করে বলি শাসন ক্ষমতা আমাদের”।
১৭৬৯-এর আগে প্রদেশটির বড় বড় ডিভিশন গুলিতে কোন ইংরেজ সুপারভাইজার নিয়োগ করা হয়নি। এই ভদ্রমহোদয়গণ এতই অল্প ছিলেন যে কোনও একটি ডিপার্টমেন্ট দেখভাল করাই ছিল অসম্ভব। তবুও কাউন্সিল আশা করে সমস্ত আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থার কষ্টকর নজরদারী (পৃ. ১৮০-১৮১)। বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, দ্বৈত শাসনটি ছিল মুখোশ। প্রকৃত শাসক যেই থাকুক শাসক তৈরীর হাতটি কোম্পানির এবং এদের ঠুকরে ঠুকরে বাংলাকে খেয়েও শখ মেটেনি, চেয়েছিল গিলে খাওয়ার ব্যবস্থাপনা। এতসব জেনেও হান্টার সাহেব বারবার বলেছেন ইংরেজরা শাসন শুরু করে বহু পরে, অষ্টাদশ শতকের আশির দশকে।
টুকরে টুকরে খাওয়ার এবং সামগ্রিকভাবে গিলে খাওয়ার পরিমাণ জানতে গেলে হান্টারের আশ্রয় নিতে হয়। ১৭৭২ পর্যন্ত ব্রিটিশ জনতার সামনে বাংলা একটি বিশাল গুদামঘর রূপে উদ্ভাসিত হত যেখানে প্রচুর অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ইংরেজ ব্যবসা করে বিরাট পরিমাণ লাভ করেছিলেন তারা জানতেন মানুষ রয়েছেন কিন্তু একে তারা মনে করতেন দুর্ঘটনা এবং এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিতেন সিয়েরা লিওনের ক্ষেত্রে আমরা যেমন করি এটি তার থেকেও কম (পৃ.২৩)।
বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত কোম্পানির ব্যবসা বলতেছিল ইংল্যান্ড থেকে রোপ্য এনে বিনিময় ভারতীয় পণ্য ১৭৬৫ নাগাদ যখন থেকে নিম্নবর্গের রাজস্ব আদায় কোম্পানি হাতে এলো তখন থেকে দেখতে পেল বাৎসরিক অতিরিক্ত সম্পদ হাতে এসেছে যা মূলধন আমদানির প্রয়োজন শেষ করে দিল যদি কোন জেলা ধরা যাক বীরভূম ৯০ হাজার পাউন্ড হাজার থেকে ৬ হাজার পাউন্ডের বেশি যেন জেলাটির শাসনে ব্যবহৃত না হয় সাধারণভাবে রাখা হতো রাখা হতো সৈন্যবাহিনী প্রতিপালনের জন্য বাকি ৬০ হাজার পাউন্ড শুধুমাত্র লিডেন স্ট্রিটে কোম্পানির আধিকারিকদের বিক্রয়ের জন্য রেশম, মসলিন কাপড় অন্য বস্তু উৎপাদনের জন্য ব্যয় করা হতো সহজ ভাষায় বাংলা আদায় কৃত ভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় মূলধন হিসেবে আসা বন্ধ হয়ে গেল তবে মূল্যবান ধাতু আসা বন্ধ হল না বাৎসরিক মূল্যবান ধাতুর ব্যবহার সহ সম্পদের বহির্গমনের ধাক্কা বাংলাকে সহ্য করতে হয় দিল্লিতে কর প্রদানসহ মুম্বাই মাদ্রাজ চীনের ফ্যাক্টরি গুলি এই সম্পদ ছাড়া বাঁচবো না (পৃ -২১৭)।
দরবারের রেসিডেন্ট হিসাব দিলেন এই কয়েকদিনে বাৎসরিক যে কর আদায় হল তার অঙ্ক এক কোটি আটত্রিশ লক্ষ দুই হাজার ছয় শত তিরানব্বই সিক্কা টাকা নয় আনা দশ পাই (১,৩৮,০২,৬১৩:৯১০)। এছাড়াও আরও ২,০৩,৩০৭ টাকা প্রজাদের কাছ থেকে নিংড়ে নেওয়ায় মোট আদায় হয় ১,৪০,০৬,০৩০ টাকা। এর মধ্যে ৮,০৩,২১৫ (মাত্র ৫ শতাংশর মত কেটে নেওয়া হয়েছিল যেখানে ৩৫ শতাংশর মত লোক মারা গিয়েছিল) টাকা বিভিন্ন প্রদেশের ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাদের সাহায্যার্থে পাঠানো হয়েছিল। একইসঙ্গে গত বছরের ৬,১৪,২১৯৮ টাকা আদায় বাকি থাকল যা ছিল নিউ পুর্নিয়ার যা শুরু হয়েছিল ১০-ই এপ্রিল ১৭৭০ থেকে। বাংলার জন্য কর আদায়ের ১,৫২,৪৫৯৭৯.১৫২ টাকার (দুর্ভিক্ষের বছরে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেল) একটি নতুন ফর্দ তৈরি হল। মোহাম্মদ রেজা খানের তরফ থেকে আমাদের রেসিডেন্ট অনুকূল পরিবেশ পেয়ে আদায়ের সামান্য আশা জাগিয়েছেন, যদিও জনসংখ্যার দিক থেকে দেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
“১৭৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে বিহারের কর সংগ্রহের যে হিসাব পাওয়া যায়, তা আমাদের গল্প প্রচুর সন্তুষ্টি বিধান করার পর সর্বশেষ হিসাব হল ৪৩,৬১,৬৫১ টাকা ৬ পাই, যা গত বছরের ট্রেজারি, লাভ, সুদ, বাটা ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ থেকে ২,৬৫,০৪৪ টাকা ১০ আনা বাদ দিয়ে সর্বমোট আদায় হল ৪৬,২৬,৬৯৫ টাকা ১০ আনা। এর থেকে প্রমাণ হল দুর্ভিক্ষের বছরের কর বাবদ প্রাপ্ত টা টাকার পরিমানের থেকে ৪,২৫,৭৪৭ টাকা ৯ আনা ৩ পাই বেশি আদায় হয়েছে (পৃ.২৮৩-২৮৪ ও ২৮৬)। দুর্ভিক্ষে মারা যায় ১/৩ ভাগ, প্রায় ১ কোটি মানুষ। মানুষই কর দেয়, কিন্তু সেই কর দাতাদের তিন ভাগের এক ভাগ পরপারে গমন করলেও ব্রিটিশের অতিরিক্ত কর আদায় প্রচেষ্টায় বাংলার ধুঁকতে থাকা জনতা কি রকম অপরিসীম অত্যাচার সহ্য করেছিল তা ভাবলেও শরীরে কাখটা দেয়। এটাও ভেবে শিহরণ জাগে প্রায় সকলেই আমাদেরই পূর্বপুরুষ তাঁরা কি অপরিসীম দুঃসহ দিন পার করে এসেছিলেন।
হান্টার সাহেব ঘটনা পরম্পরার বিপরীতে গিয়ে, বহুবার গির্জার স্তোত্র পাঠের মত করে “মুসলমান মিসরুল কথাটি ব্যবহার করেছেন এবং বোঝাতে চেয়েছেন, এই অপশাসনই যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের মূল। অথচ উনি অনবধানবশত এমন কিছু সত্য কথা বলে গিয়েছেন, যা থেকে প্রমাণিত হয় ঔপনিবেশিক ও লোভাতুর শাসন মুসলিম শাসনকালের একদা সমৃদ্ধশালী বাংলাকে পথে বসিয়েছিল। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র যদি হান্টার বর্ণিত টামাসের ঘটনাটি সঠিক চিত্রিত করতেন তবে হিন্দু-মুসলিম লড়াইটি তাঁর উপন্যাসে বর্ণিত হত না।