বড় বড় পর্বত শ্রেণী মহারাষ্ট্রের দুদিকে বেষ্টন করে রেখেছে। পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা উত্তর থেকে দক্ষিণে। আর সাতপুরা ও বিন্ধ পর্বতমালা পূর্ব থেকে পশ্চিমে। দেশটি অতি পর্বতসঙ্কুল তাই মহারাষ্ট্রের প্রাকৃতিক পরিবেশে আত্ম রক্ষা ও আক্রমণের জন্য এক স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্গে পরিণত হয়েছে। ১৫৬৫ খৃস্টাব্দে তালিকোটের যুদ্ধে বিজয়নগর রাজ্যের এক ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের পরপরই দক্ষিণ ভারতে মুসলমান আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে মারাঠাগণ বাহমনী ও পরবর্তী আহমদনগর, বিজাপুর, গােলকুণ্ডা প্রভৃতি সুলতানের অধীনে কাজ করত। যে কয়টি মারাঠা পরিবার সম্রাট ও সুলতানদের অধীনে রাজকর্মে আর্থিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল তাদের মধ্যে ভোঁসলে পরিবার অন্যতম। ভোঁসলেদের পারিবারিক বৃত্তি কৃষিকর্ম। শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে প্রথমে নিজাম শাহী সুলতানের অধীনে পরে বিজাপুরের আদিল শাহী সুলতানের অধীনে কাজকর্মে নিযুক্ত থেকে বেশ প্রতিপত্তি বাড়িয়েছিলেন। উত্তর ভারতে মােঘল আর দক্ষিণ ভারতে সুলতানদের যুদ্ধ বিগ্রহের সুযােগে তাঁরা সুলতানী ও মােঘল সাম্রাজ্যে দুর্গ দখল ও লুটতরাজ আরম্ভ করত। এটাই মারাঠাদের জাতীয় চরিত্র। ধর্মগুরু রাম দাসের শিক্ষায় দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ শিবাজী মারাঠীদের জাতীয় চরিত্র আরও সুসংগঠিত করেন।
শিবাজী জুনারের কাছে শিবনের পার্বত্য দুর্গে জন্মগ্রহণ করেন। স্বামীর অনাদরের জন্য জিজাবাঈ ও শিশু শিবাজী দাদাজী কোন্দদেব নামে এক ব্রাহ্মণের আশ্রয় গ্রহণ করেন। মারাঠীদের শৌর্যবীর্যের ঐতিহ্য ছিল তাঁর চরিত্রের ভিত্তি। এছাড়া আর কোন শিক্ষা বিশেষ তিনি পাননি।
শিবাজীকে সাধারণ ইতিহাসে মনে হয় তিনি আদর্শ বীর, বিরাট যােদ্ধা, সুকৌশলী এবং আওরঙ্গজেবের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী। আরও বদ্ধমূল ধারণা হয় যেন আওরঙ্গজেব শিবাজীর কাছে বারবার পরাজয়বরণ করে নাজেহাল হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, শিশুকাল থেকে এ ধারণা মনে ঠাঁই পায় যে, শিবাজী কেবল মারাঠা জাতির গৌরব নন; বরং ভারতে পরিচয় দেয়ার মত রাজা শিবাজী। তাই তিনি জাতীয় বীর। ভারতে প্রধানতম ফটক বােম্বাই-এ তাই বীর শিবাজীর মূর্তি বীর বেশে দণ্ডায়মান।
কিন্তু অপর পক্ষ শিবাজীকে সামান্য সৈনিক, দস্যু, পাহাড়ি উঁদুর, বিশ্বাসঘাতক এবং অকৃতজ্ঞ বলে মনে করেন। নিরপেক্ষ পাঠকদের কাছে সমীক্ষার প্রয়ােজন। তাহলে দুই মতের মধ্যে সমন্বয় অথবা তৃতীয় মতের উপর উদ্ভব হতে পারে। তবে আকবরের ভুল ভ্রান্তি, চরিত্রহীনতা জেনে বুঝে ঢাকা দিয়ে যাঁরা তাঁকে মহামতি, “আকবর দি গ্রেট”, “দিল্লীশ্বর” ও “জদগীশ্বর” উপাধি দিতে কুণ্ঠাবােধ করেননি তারা নিজ গুণে ঠিক বিপরীত পন্থায় আওরঙ্গজেবকে নিন্দা বা তাঁকে খাটো করে প্রকাশ করতে পারেন। মােটকথা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যাদের বিবাদ বিসম্মাদ তারাই হবেন তত বীর তত বাহাদুর। শিবাজীর ক্ষেত্রেও অনেকের মতে তাই।
আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যে এক নতুন জাতির অভ্যুত্থান হয়। এটাই মারাঠা জাতি। এই মারাঠা জাতি আসলে যাযাবর দস্যু আর দস্যুবৃত্তিতে চিরদিনের জন্য ইতিহাসে কুখ্যাতই ছিল। রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে আক্রমণ করত নিরীহ গ্রামবাসী ও শহরবাসীর ওপর। তারপর লুটতরাজ ও অগ্নি সংযােগ করে ধন-দৌলত-অর্থ গহনা নিয়ে চম্পট দিত। আমাদের বাংলাদেশে পর্তুগীজ মগ দস্যুদের মত মারাঠা জাতিও কুখ্যাত ছিল। তাদের অত্যাচারের কাহিনী গ্রামীণ লােকগাথায় ইতিহাসের পাতায় মজুত আছে। তাদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে মানুষ এত আতঙ্কগ্রস্ত ছিল যে, কচি বাচ্চাদের কান্না থামাবার জন্য মা মারাঠা বর্গীয়দের অত্যাচারের আলেখ্য তুলে ধরতেন। যেমন
“ছেলে ঘুমাল পাড়া জুড়াল।
বর্গী এল দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে।
খাজনা দেব কিসে৷”
সাতবাহনদের রাজত্বকাল থেকে মারাঠা জাতির বহু হিংস্র মানুষকে সভ্য ও শিক্ষিত করে যুদ্ধের জন্য সৈন্য বিভাগে লাগানাে হতাে। তুর্কী সুলতান ও মুঘল বাদশারাও তাদের বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দিতে কার্পণ্য করেননি। শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে আহমদ নগরের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মচারী ছিলেন। ১৬৩৬ খৃঃ মুঘলদের হাতে আহমদনগরের পতনের পর তিনি বিজাপুরের সুলতানের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। এখানে তিনি প্রভুকে সন্তুষ্ট করে কর্ণাটে এক জায়গীর লাভ করেন। হঠাৎ উন্নতির আতিশয্যে অনেক সুন্দরীর সহজপ্রাপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর প্রথমা স্ত্রী জিজাবাঈকে উপেক্ষা করতে থাকেন। জিজাবাঈ শিশু শিবাজীকে নিয়ে মুসলমান বিদ্বেষী গোঁড়া ব্রাহ্মণের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণ প্রকৃত শিক্ষিত ছিলেন না। তবে শিবাজীকে এই শিক্ষাই ভালােভাবে দিয়েছিলেন তা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ মুসলমান হিন্দুর শত্রু। অতএব শক্তি সঞ্চয় করে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। যুদ্ধে জিতলে লাভ আর মরলেও স্বর্গ। নিরক্ষর ও শিবাজীর বক্ষ ফলকে কোন্দদেবের মন্দ কথা বিষবৃক্ষ রােপণের এক বৃহৎ বুনিয়াদ বলা যায়।
১৫৭ শিবাজী বড় হয়ে কোন্দদেবের মন্দ কথা কাজে পরিণত করতে লাগলেন। সেই সময় মাওয়ালী নামে সম্পূর্ণ অসভ্য পার্বত্য জাতির সঙ্গে শিবাজীর মিল (বন্ধুত্ব) হয়ে যায়। শিবাজী তাদের সংগঠিত করলেন এই আশ্বাস দিয়ে যে, তােমরা আমার অধীনে যদি লুঠতরাজে শামিল হও তাহলে প্রত্যেকের অংশে মােটামুটি বখরা পড়বে। আর ভবিষ্যতে আমরা মুঘল রাজধানী পর্যন্ত লুট করতে পারব। তখন আমাদের সুদিন ও সুনাম দুটিই হাতে এসে যাবে। ঐ মাওয়ালী জাতির কথা এক হ্যা তাে হ্যা আর না তাে না। শিবাজী মাওয়ালী জাতিকে নিয়ে একটি সৈন্য বাহিনী গঠন করে বিজাপুর রাজ্যে বারবার হানা দিলেন। বিজাপুরের সুলতান শিবাজীর ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে শিবাজীর পিতা শাহজীকে বন্দি করলেন। পিতাকে উদ্ধার করার শক্তি শিবাজীর ছিল না এবং সম্মুখসমরের নীতিও ছিল না মারাঠা জাতির। তাই শিবাজী সম্রাট শাহজাহানের অনুনয় বিনয় করে আবেদন রাখলেন। সম্রাট শাহজাহানের মধ্যস্থতায় শাহজী মুক্ত হন।
কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর ১৫৫৬ খৃঃ শিবাজী পুনরায় অন্যায়ভাবে এবং বিশ্বাসঘাতকতার সাথে জাওয়ালী অধিকার করেন। আওরঙ্গজেব তখন বিজাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। এই অবসরে মুঘল সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম ভূভাগ তিনি আক্রমণ করেন।
সম্রাট সংবাদ পেয়েই সেখানে মুঘল সৈন্য প্রেরণ করে মারাঠা হানাদারদের বিতাড়িত করেন। শিবাজী হতমান হলেও পুনঃ আক্রমণের সংকল্প তাঁর ছিল। এই সময় ইতিহাসের রুচীশীল অনুরাগীগণের মনে রাখা অবশ্য প্রয়ােজন যে, আওরঙ্গজেব পিতার অসুস্থ সংবাদে দিল্লি ফিরে যান। তখন ১৬৫৮ খৃস্টাব্দ। শিবাজী এক পরম সুযােগ মনে করলেন। কারণ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে তিনি খুব ভয় করতেন। দিবালােকে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করার সাহস আদৌ তার ছিল না।
শ্রী বিনয় ঘােষও তাঁর পুস্তকে ৪৫২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“পিতার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণ্যতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন (১৬৫৮) তারপর শিবাজীর মৃত্যুর দুই বছর পরে আবার দাক্ষিণাত্যে ফিরে আসেন।”
শিবাজীর মৃত্যু হয় ১৬৮০ খৃস্টাব্দে। অতএব ১৬৫৮ থেকে ১৬৮০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত এই ২২ বছর আর। শিবাজীর মৃত্যুর দু বছর পর মােট ২৪ বছর পরে আবার সম্রাট আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে আসেন। আওরঙ্গজেব শিবাজীর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হলে এই সময়ের মধ্যে সারা দাক্ষিণাত্য জয় করে নিতে পারতেন। বলাবাহুল্য, শিবাজী সারা জীবনে আওরঙ্গজেবকে দেখতে পেয়েছিলেন কিনা সন্দেহ। এই সময় ১১ বছর কুমার শাহ আলম, ছয় বছর বাহাদুর শাহ, চার বছর শায়েস্তা খাঁ, দু বছর জয় সিংহ, এক বছর দিলির খাঁ দাক্ষিণাত্যে সুবাদারি করেন। আওরঙ্গজেব দিল্পি থেকে যা ফরমান পাঠাতেন তাতেই ছত্রপতি শিবাজীর দারুণ দুর্দশা হয়েছিল। তাঁর সেনাপতিগণ বারবার পরাস্ত করেছেন শিবাজীকে, বারবার বন্দি করেছেন শিবাজীদের এবং সম্রাট আওরঙ্গজেব বারবার ক্ষমা করেছেন শিবাজীদের।
প্রথম জীবনে শিবাজী বিজপুরের অনেক দুর্গ মাওয়ালীদের সহযােগে আয়ত্ত করেছিলেন। সুলতান ক্রদ্ধ হয়ে দশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরণ করলেন। সেনাপতি ছিলেন আফজল খাঁ। তার পরেই ঘটনা প্রবাহ চতুর্থ শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তক “ইতিহাস পরিচয়” এ আছে,
“শিবাজী দেখলেন, প্রকাশ্য যুদ্ধে তিনি পারবেন না। তাই তিনি এক মতলব আঁটলেন, সন্ধির প্রস্তাব করে তিনি আফজল খার সহিত সাক্ষাৎ করতে চাইলেন। দুই জনে সাক্ষাৎ হল। সাক্ষাতের সময় কোন পক্ষেরই বেশি লােকজন ছিল না। সাক্ষাৎকালে উভয়ে যখন উভয়কে আলিঙ্গন করতেছিলেন সেই সময় তার পােশাকের নিচে লুকায়িত ‘বাঘনখ’ নামক অস্ত্র দ্বারা হঠাৎ আফজল খাঁকে আক্রমণ করে তাঁকে নিহত করলেন। ফলে আফজল খাঁর সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল, তখন শিবাজী তাদের আক্রমণ করে অনায়াসে পরাজিত করলেন।”
প্রাচীনকাল হতে আজ পর্যন্ত নিয়ম আছে সন্ধি করার সময়, কোন চুক্তি করার সময় শত্রু পক্ষকে হত্যা করা মানবতাবিরােধী। কিন্তু শিবাজীর এই রকম বিশ্বাসঘাতকতা ইতিহাসে বিরল। মারাঠা ভক্ত ঐতিহাসিকগণ উল্টো আবার আফজল খাঁকেই দায়ী করেন। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে তুলে ধরা হয়, আফজল খাঁ আলিঙ্গনের সময় শিবাজীকে গলাটিপে মারার চেষ্টা করলে তখন শিবাজী বাঘনখ, দিয়ে তার বক্ষ বিদীর্ণ করেন। কিন্তু যিনি সুশিক্ষিত শক্তিশালী দশ হাজার সৈন্যের সেনাপতি তাঁর পক্ষে শিবাজীকে মারবার জন্য যুদ্ধই যথেষ্ট ছিল এবং সেটাই বীরত্বের নামান্তর হতাে। কিন্তু তিনি শিবাজীর দুর্বল কাতর কণ্ঠের আবেদন মঞ্জুর করে বীরত্বের মহত্তের দিকে খােলা মনে খালি হাতে অগ্রসর হয়েছিলেন। আফজলের মৃত্যুতে শিবাজী নিজের নামে জয় ঢাক বাজিয়ে বীরত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে গর্ববােধ করতে লাগলেন।
শিবাজীর সুনাম চরম সীমায় তােলার আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে যুব প্রস্তুতি নিয়ে মাওয়ালী জাতি ও মারাঠা জাতির বাছাই করা সৈন্য নিয়ে মুঘল ঘাঁটি আক্রমণ করলেন। সংবাদ পেয়ে আওরঙ্গজেব পাঠালেন শায়েস্তা খাঁকে শিবাজীকে শায়েস্ত করতে। শায়েস্তা খাঁ মারাঠাদের বিতাড়িত করে পুনা, চাকান দুর্গ ওকল্যান অধিকার করেন। যুদ্ধ শেষে পুনায় রাত্র-শয্যায় বিশ্রাম করছিলেন। এমন সময় রাতের অন্ধকারে শিবাজী অতর্কিতে শায়েস্তা খাঁর কক্ষে সশস্ত্র আক্রমণ করলেন। শায়েস্তা খাঁ নিন্দ্রা থেকে উঠে দেখলেন দরজায় তরবারি হাতে শিবাজী। তাই তিনি সবলে জানালা ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। এই সময় শিবাজীর তরবারির আঘাতে শায়েস্তা খাঁর দুটি আঙুল কাটা যায়। অত্যন্ত পরিতাপ ও বিপজ্জনক ঘটনার এই খানেই শেষ নয়। শিবাজী শায়েস্তা খাঁর এক নিরপরাধ পুত্রকে পেয়ে গেলেন এবং তিনি নিজে তাকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে পৈশাচিক আনন্দ উপভােগ করলেন। এই ঘটনাটি ঘটে ১৬৬৩ খৃস্টাব্দে।
১৫৯ আবার ১৬৬৪ খৃস্টাব্দে শিবাজী সুরাট লুণ্ঠন করেন, এমনকি তীর্থ যাত্রীদের জাহাজ পর্যন্ত তাঁর অত্যাচার হতে নিষ্কৃতি পায়নি। এই সংবাদে সম্রাট আওরঙ্গজেব বললেন, যে সম্মুখে আসে না, মানবতার ধার ধারে না, এই রকম একটা দস্যু বা পার্বত্য মুষিক না হয়ে শিবাজী যদি একজন রাজা বা বীর হতাে তাহলে আমি কয়েক দিনের জন্য গিয়ে সমুচিত শিক্ষা দিতাম। সম্রাট আওরঙ্গজেব জয় সিং এবং দিলির আঁকে পাঠালেন পাহাড়ি ইঁদুর শিবাজীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
মুঘল বাহিনী পুরন্দুর দুর্গ অবরােধ করেন। দুর্গের ভেতর শিবাজী সপরিবারে বাস করতেন। যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত এবং পরাজিত হলে অশেষ লাঞ্ছনা ভােগ করতে হবে মনে করে শিবাজী পুরন্দুর চুক্তি করেন (জুন ১৬৬৫)। চুক্তি অনুযায়ী তাকে ২৩টি দুর্গ ও ১৬ লক্ষ বাৎসরিক রাজস্বের সম্পত্তি দিতে হল এবং নিজে মুঘল আনুগত্যের বিনিময়ে রাজগড়সহ ১২টি দুর্গ ও বাৎসরিক ৪ লক্ষ টাকা রাজস্বের সম্পত্তি রাখতে অনুমতি পান। যদিও শিবাজীর বিশ্বাসঘাতকতা তাঁদের জানা ছিল, তা সত্ত্বেও বাদশার আইনে কেউ সন্ধি করতে এলে তাঁকে উপেক্ষা না করে স্বাগত জানাতে হবে। তাই শিবাজীকে প্রাণে মারা হল না। তাকে বন্দি করে ১৬৬৬ খৃস্টাব্দে মে মাসে আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হল। সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে যথা সময় খবর পোঁছাল পাহাড়ি ইঁদুর খাঁচায় বন্দি। সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে হত্যার অপরাধে দায়ী তবুও তােমাকে ক্ষমা করলাম আর আগামীতে প্রজাদের ওপর যেন কোন অত্যাচার না হয়। শিবাজী দস্যু জানতেন, সম্রাটের সঙ্গে শালীনতা বজায় রেখে কথা বলতে জানতেন না। তাই শিবাজীর ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে আওরঙ্গজেব আদেশ দিলেন শিবাজীকে নজরবন্দি রেখে শিষ্ঠাচার শেখাতে। আরও আদেশ দিলেন যে, বন্দির প্রতি সর্ব রকম সুব্যবহার করতে। শিবাজীর দেখাশােনার ভার ছিল তার এক মারাঠী আত্মীয়ের ওপর। বন্দি অবস্থায় শিবাজী দরবারে আবেদন করলেন আমি ধর্ম পালনের জন্য বজরাভর্তি মিষ্টি দরিদ্র ব্রাহ্মণদের জন্য পাঠাতে চাই। সম্রাট আওরঙ্গজেব বললেন, ধর্ম পালনের কথা বলেছে, অতএব আবেদন মঞ্জুর না করলে তার ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হবে। এইভাবে ঝুড়িতে করে মিষ্টি পাঠানাের অজুহাতে শিবাজী নিজেই ঝুঁড়িতে বসে পলায়ন করলেন। দাক্ষিণাত্যে হাজির হয়ে শিবাজী প্রথমে চুপচাপ থেকে মারাঠাদের আরও সংগঠিত করতে লাগলেন। তারপর ১৬৭০ খৃস্টাব্দে পুনরায় মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পূর্বেকার মত সুরাটবন্দর লুণ্ঠন করে বলপূর্বক চৌথ আদায় করেন এবং নিজেকে স্বাধীন রাজা বলে ঘােষণা করলেন। ১৬৭৮ খৃস্টাব্দে রায়গড়ে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। শিবাজী রাজা হয়ে “ছত্রপতি” উপাধি গ্রহণ করেন, সম্রাট আওরঙ্গজেব তখন বহু দূরে উত্তর সীমান্তে পাঠান উপজাতিদের বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত। আওরঙ্গজেব যখন শিবাজীর এই চরম পর্যায়ের সংবাদ শুনে বুঝলেন, শিবাজীকে পাহাড়ি ইঁদুর মনে করে উপেক্ষা করা ঠিক হয়নি, তাই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিদ্রোহ দমন করে দাক্ষিণাত্যের দিকে নজর দিলেন, তখন সংবাদ পেলেন শিবাজীর মৃত্যু হয়েছে (৩ রা এপ্রিল ১৬৮০)। এই সংবাদ শুনে তিনি পারসিক কবিতা পাঠ করলেন যার অর্থ-আমার দয়া, ক্ষমা, উদারতা সহনশীলতা এবং দাক্ষিণাত্যে আমার অনুপস্থিতির সুযােগেই শিবাজী ক্ষণিকের ‘ইঁদুর রাজা’ হয়ে মরল।
সম্রাট আওরঙ্গজেব সংবাদ পেলেন শিবাজীর পুত্র শম্ভুজী পিতার সমকক্ষ দুষ্ট ও বিদ্রোহী। শম্ভুজীর পরিচয় আওরঙ্গজেব পূর্বেই পেয়েছিলেন। যেহেতু শম্ভুজীকেও শিবাজীর সাথে বন্দি করে আগ্রা দুর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিনিও শিবাজীর সঙ্গে মিষ্টির ঝুড়িতে পলায়ন করেছিলেন। তাঁর দ্বারা বহু রাষ্ট্রদ্রোহী প্রকাশ পেয়েছিল। এখানে আর একটা জরুরি কথা মনে রাখা দরকার দাক্ষিণাত্যে মারাঠা জাতি শুধু মাওয়ালীদের সহযােগে দৌরাত্ম্য করত তা নয়, তারা পেয়েছিল আওরঙ্গজেবের এক অবাধ্য সন্তানকে, নাম আকবর, যেমন করে “মহামতি” আকবরকে প্রশংসার মালা পরিয়ে তার স্বকীয়তা নষ্ট করা হয়েছিল। ঠিক সেইরূপ উপায়ে জাহাঙ্গীরকেও প্রথম জীবনে বিভ্রান্ত হতে হয়েছিল আর শাহজাহানের পুত্র দারা শিকোহকে ঐ একই করচেই পঙ্গু করা হয়েছিল। ঐ একই পন্থায় আওরঙ্গজেবের শত্রুবৃন্দ মারাঠা মাওয়ালী ও সাম্প্রদায়িক হিন্দু। নেতৃবৃন্দ তাকে বুঝিয়েছিল যে, নাম আকবর কাজেও আকবর হলে সারা ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় তার সঙ্গে সহযােগিতা করতে প্রস্তুত। তাই অদুরদর্শী অপরিণত বয়সের আকবর সরল মনে বিশ্বাস করে পিতার বিদ্রোহী হয়ে ত্যাজ্য পুত্রের মত দাক্ষিণাত্যে পিতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যােগ দিয়েছিলেন।
যাই হােক, বৃদ্ধ ম্রাট আল্লাহর ওপর ভরসা করে যুবকের মত মনােবল আর সাহস নিয়ে ১৬৮৬ খৃস্টাব্দে পর পর আক্রমণ করলেন বিজাপুর এবং গােলকুণ্ডা। কারণ বিজাপুর এবং গােলকুণ্ডার সুলতানগণ শিবাজী ও শম্ভুজীকে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে সাহায্য করত। ঐ সুলতানগণের পতনের পর পরাজিত সুলতান সৈন্য শম্ভুজীর দলে যােগ দেয়। সুলতানদের পালা শেষ করে সম্রটি আওরঙ্গজেব মারাঠাদের দিকে দৃষ্টি দেন। ১৬৮৯ খৃঃ শম্ভুজী সম্মুখসমরে দণ্ডায়মান হলেন। আওরঙ্গজেব ২ রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। উপাসনান্তে আওরঙ্গজেব সৈন্যদের উৎসাহবর্ধক ভাষণ দান করেন। মুঘল সৈন্য উত্তাল তরঙ্গরাজির মত যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেমন শুরু তেমনি শেষ। শম্ভুজী ভীষণভাবে পরাজিত ও নিহত হলেন। ন্যায় বিচারের মাপকাঠিতে শম্ভুজী শিবাজী অপেক্ষা বড় বীর ছিলেন। কারণ তিনি অন্তত একবার যুদ্ধের জন্য সাহস সঞ্চয় করেছিলেন এটাই তার কৃতিত্ব। মারাঠা শক্তি বিধ্বস্ত হওয়ার পর শিবাজীর ১৬১ রায়গড়সহ বহু মারাঠা দুর্গ আওরঙ্গজেবের হস্তগত হয় এবং শাহুসহ শম্ভুজী পরিবার বন্দি হয়। ১৬৮৯ খৃস্টাব্দে আওরঙ্গজেব কেবল উত্তর ভারতের নয় দাক্ষিণাত্যেরও অধীশ্বর হন। আওরঙ্গজেব শব্দের অর্থই সিংহাসনের “শােভা”। সত্যই তাঁর নামের সার্থকতা জ্বলন্ত ও জীবন্ত হয়ে রয়েছে আসল ইতিহাসের পাতায়।
শিবাজী ও শম্ভুজীর মৃত্যুর পর মারাঠারা সংগ্রাম শুরু করে। তাঁর ছােট ভাই রাজারাম মহারাষ্ট্রের নেতা নিযুক্ত হন। সেনাপতি শান্তাজী ও ধনজীর প্রযত্নে মারাঠা সৈন্য খুব শক্তিশালী হয়। অপরপক্ষে সম্রাট মনে করেছিলেন মারাঠাদের তেমন। মাথা তােলবার কেউ নেই। এই ধারণা মুঘলদের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল। ১৬৯০ খৃঃ রাজারাম মুঘলদের অতর্কিতে আক্রমণ করে কয়েকটি মুঘল ঘাঁটি দখল করে নেন। পরে মুঘল সৈন্য শান্তাজীকে হত্যা করে। ১৭০০ খৃস্টাব্দে রাজারামের মৃত্যু হলে নেতৃত্ব নিয়ে মারাঠাদের মধ্যে লড়াই ৰাধে। শেষে রাজারামের তৃতীয় শিবাজীর রিজেন্ট হন বীরাঙ্গনা তারাবাঈ। বীরাঙ্গনা তারাবাঈসহ অনেকে পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁদের সমস্ত পরিকল্পনা ৯০ বছরের বৃদ্ধ আওরঙ্গজেবকে এতটুকু টলাতে পারেনি। ভারত সম্রাট আওরঙ্গজেবের ইহকালে প্রস্তুতি শেষ, পরকালের জন্য তৈরি হচ্ছেন তিনি। সারা। জীবন কৃচ্ছু সাধন; ফকিরী জীবনযাপন করে শুকনাে রুটি আর খেজুর পাতার বিছানায় শুয়ে মদ, নারী, গীতবাদ্য বা কোন রকম বিলাসিতা হতে বহু দূরে থেকে ১৭০৭ খৃস্টাব্দে মৃত্যুর মুখাে হয়ে জীবনের শেষ নামায পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে অনুযােগ করলেন,
“হে আল্লাহ! তােমার আইন মত কতটুকু বা চলেছি? যত ভাল কাজ করেছি তার জন্য তুমি প্রশংসার দাবিদার আর যত খারাপ কাজ আমি করেছি তার জন্য দোষী আমি নিজে। তুমি আমায় ক্ষমা কর।”
তারপর বিশ্ব নিয়ন্তা আর বিশ্ব পয়গম্বরের নাম উচ্চারণ করে মুখ ও চোখ বন্ধ করলেন। …… হাল ইতিহাসে মারাঠা জাতিকে বীরের জাতি বলা হয়। তাই মারাঠা বা বর্গীয় শিবাজীকে জাতীয় বীর বলা হয়। বাংলায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ও স্বদেশী আন্দোলনে ১৯০৫ খৃস্টাব্দে শিবাজী উৎসব পালন করা হয়। অনেক দুরদর্শী ঐতিহাসিকের মতে এটা একটা ঐতিহাসিক ভ্রান্ত পদক্ষেপ। কারণ যদি জাতীয় হিন্দু বীর হিসেবে খাড়া করতে হয়, তাহলে প্রতাপ সিংহই উপযুক্ত শ্রেষ্ঠতর বীর। মারাঠা জাতি বা “বর্গীয় হাঙ্গামা” সত্য ইতিহাসের পাতায় খুব বেশি অপরাধী। এই জন্য যে, শােষক জাতিকে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারে তারাই প্রভূত পরিমাণে। সাহায্য করেছিল। পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও লর্ড ওয়েলেসলীর “অধীনতা মূলক মিত্রতা” নীতি গ্রহণ করার ফলেই ভারতে ইংরেজ প্রভুত্ব দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়। (১৮০২)।
প্রকৃত প্রাচীন ইতিহাসে মারাঠা বা বর্গী হাঙ্গামাকারীরা যেভাবেই চিত্রিত হােকনা কেন আসলে যে তারা দস্যু বা লুণ্ঠনকারী ছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রমাণস্বরূপ নিচে কতকগুলাে উদ্ধৃতি উল্লেখ করা গেল,
- (ক) “ইংরেজ বণিকেরা বর্গীয় হাঙ্গামার সুযােগ পেয়ে নবাবের কোন অনুমতি গ্রহণ না করে কলিকাতায় দুর্গ নতুন করে গড়তে আরম্ভ করল।”
- (খ) “এই রূপে রঘুজী (মারাঠা) পুনঃ পুনঃ বঙ্গদেশ লুণ্ঠন করতে লাগল, আলিবর্দী কিছুতেই তাদিগকে পরাস্ত করতে না পেরে গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা নিহত করল।”
- (গ) “মারাঠা অশ্বারােহী সৈন্যরা এদেশে বর্গী নামে পরিচিত। আলিবর্দী খার সিংহাসনে আরােহণের পূর্ব হতেই তারা সময়ে অসময়ে মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ করে লুটপাট করত। আলিবর্দী খার আমলে এদেশে যে আক্রমণ ও লুণ্ঠন চলতে থাকে তাই বরীর হাঙ্গামা” নামে পরিচিত।
- (ঘ) তখনকার শ্রেষ্ঠ ধনী জগৎ শেঠের বাড়ি লুণ্ঠন করে প্রায় আড়াই কোটি টাকা লয়ে প্রস্থান করে।” [উপরােক্ত লেখাগুলাে শ্রী অজয়কুমার সু লিখিত “ঐতিহাসিক প্রশ্নোত্তর” পুস্তক দ্রষ্টব্য]।
- G. Rawlinson M.A.I. F. A. প্রণীত “Sivaji the Maratha” পুস্তকে আছে,
“দক্ষিণ ভারতে মুসলমান সুলতানরা মারাঠাদের বিশ্বাস করে তাদের দায়ীত্বপূর্ণ পদগুলাে ও রাজ্য পরিচালনার ভার দান করেছিলেন। কিন্তু এই অতি উদারতা ও বিশ্বাসের ফলে তাদের ও মুসলিম জাতির পক্ষে মারাত্মক হয়েছিল। শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠাদের বিদ্রোহ ও তদ্বারা আফজল খাঁর হত্যায় নিরীহ জনসাধারণের অসহ্য অত্যাচার উপদ্রব ধন সম্পত্তি লুণ্ঠন ইত্যাদি ব্যাপারে তার নিদর্শন।”
ঐতিহাসিক শরৎ কুমার রায় লিখেছেন,
“মারাঠা দেশ নায়করা হিন্দু রাজ্য সংস্থাপনের অভিলাষ করেছিলেন। সাধারণ লােকের বিশ্বাস মুসলমানরা হিন্দুদের প্রতি উৎপীড়ন করতেন বলে শিবাজী মুসলমানদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্র মুসলমান শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধভাব মারাঠাদের অভ্যুত্থান চেষ্টার একমাত্র কারণ নহে। আসল কথা এই যে, পঞ্চদশ ও ষােড়শ শতাব্দীতে সমস্ত ভারতবর্ষে বিশেষত দাক্ষিণাত্যে ধর্ম সমাজ সাহিত্য প্রভৃতির একটা সংস্কারের যুগ এসেছিল। মুসলমানদের সঙ্গে কেবল বিরুদ্ধ সংঘর্ষের আঘাতেই যে এই সংস্কারের চেষ্টা জেগেছিল তা সত্য নয়। বরং মুসলমান ধর্ম ও সাহিত্যের সংস্পর্শেই তথাকার হিন্দুচিত্তে একটি বিশেষ শক্তি সঞ্চার করেছিল তাহাতে সন্দেহ নেই। রাজস্ব বিভাগের ও ধনকোষের কর্তৃত্ব হিন্দুরা লাভ করেছিল। মারাঠারা সৈন্যদল ভুক্ত হয়ে যেমন অর্থোপার্জন করত তেমনি যুদ্ধ বিদ্যায় দিন দিন উন্নতি লাভ করতেছিল। দাক্ষিণাত্যের মুসলমান শাসনকর্তারা অনেকেই হিন্দু ১৬৩ মহিলা বিবাহ করতেন। এইরূপ হিন্দু মুসলমান বৈবাহিক সম্বন্ধ মুসলমান রাজ্যগুলােতে হিন্দু জাতিকে বাড়িয়ে তুলেছিল। যে সকল হিন্দু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদের দ্বারাও হিন্দুদের ক্ষমতা বেড়ে উঠতেছিল। এদেশের মুসলমানরা কদাচ গোঁড়া হয়ে উঠতে পারেননি। সময়ে সময়ে মুসলমানরা যৎসামান্য অত্যাচার করেছেন তা উল্লেখযােগ্য নয়। সাধারণত এদেশের মুসলমানরা হিন্দু প্রজাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতেন এবং সর্ব প্রকার রাজকার্যের ক্ষমতা হিন্দুদের হস্তে অর্পণ করতেন। ক্রমে বাহুবলে ও বুদ্ধি সুকৌশলে শাসন ও সৈন্য বিভাগে হিন্দুরাই প্রাধান্য লাভ করেছিল। মুসলমান শাসনে হিন্দুদের ক্ষমতার লেশমাত্র ব্যাঘাত না পেয়ে দিন দিন বেড়ে উঠতেছিল। ক্রমশ হিন্দু এমন প্রবল হয়ে উঠছিল যে মুসলমানরা নামে মাত্র শাসনকর্জ ছিলেন। হিন্দুরাই রাজ্যের সর্বত্র ক্ষমতা চালনা করার ফলে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে গােলকুণ্ডা, বিজাপুর, আহমদনগর ও বিদব এই মুসলমান রাজ্যগুলাের সকল ক্ষমতা মারাঠী নীতিবেত্তা যােদ্ধাদের অধিগত ছিল। এই রূপে মারাঠা জাতি শক্তিশালী হয়ে যখন মুসলমান শাসনের বন্ধন ছিন্ন করে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে উঠল তখন এক নতুন বিপদ তাদের সম্মুখে উপস্থিত হল।” [শরৎ কুমার রায়ের “শিবাজী ও মারাঠা” দ্রষ্টব্য।]
মাননীয় শরৎ কুমারের লেখা পর্যালােচনায় গােলাম রব্বানি (বর্ধমানী) সাহেব লিখেছেন, “মারাঠাদের পক্ষে উক্ত নতুন বিপদ হইতেছে আওরঙ্গজেবের আবির্ভাব।” আওরঙ্গজেবের পূর্বে ও পরে এমন একটিও বার্ষিক রাজনীতিবিদ দেখা যায়নি, যিনি তাঁর সমকক্ষ। সারা সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তা হয়েও রাজকোষ থেকে এক পয়সাও নিতেন না। টুপি সেলাই আর পবিত্র কোরআন কপি করে যা পেতেন তাই দিয়ে খেতেন শুকনাে রুটি আর মধু। সারা ভারত এবং বহির্ভারতে ছিল তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার। এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময়মত নামায, যুদ্ধ ক্ষেত্রে নামায, গভীর রাত্রে আল্লাহর কাছে দণ্ডায়মান হয়ে প্রার্থনারত, তদুপরি জ্ঞানার্জনের জন্য পড়াশােনা কখন যে কি করতেন, কেমন করে করতেন তা আজ চিন্তা করলে কিনারা পাওয়া যায় না।
আওরঙ্গজেবের ব্যবহারিক চরিত্র ছিল অত্যন্ত মধুর। তার ব্যক্তিগত জীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল মুহূর্তগুলাে লিপিবদ্ধ করলে একটি সুখপাঠ্য পুস্তক তৈরি হবে যদিও এই বক্ষমাণ পুস্তকে অরই দু-একটা মাত্র ঘটনা তুলে ধরা হলাে সম্রাট আলমগীর তাঁর পুত্রের জন্য একজন গৃহ শিক্ষক নিয়ােগ করেছিলেন। একদিন মৌলবী সাহেব প্রচণ্ড বৃষ্টির দিনে কোন রকমে ভিজে ভিজে জমাটবদ্ধ কাদা পেরিয়ে এসে হাজির হলেন তার কর্মস্থলে। রাজপুত্র দেখেই বললেন, ইস! একদম গােটাই ভিজে গেছেন যে! আজ এত কষ্ট করে না এলেই পারতেন। মৌলবী সাহেব বললেন, তা হয় না বাবা, কর্তব্য কাজে অবহেলা করা অপরাধ।
যাহােক এখন পাদুটো ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু রাজপুত্রকে দিয়ে তাে পা ধোয়ার পানি আনা যায় না, তাই মৌলবী সাহেব ইতস্তত করতে লাগলেন। বাদশাহ পুত্র ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ছুটে গিয়ে পানি এনে দিলেন। কিন্তু তাতেও আর এক অসুবিধা এক হাতে পানি ঢেলে আর এক হাতে কাদা পরিষ্কার করা বড় মুশকিল হচ্ছে। মৌলভী সাহেব কোন রকমে সংকোচ কাটিয়ে বললেন, বাবা পানিটা একটু পায়ে ঢেলে দিতে পার? রাজপুত্র ততক্ষণাৎ পানি ঢালতে লাগলেন। এমন সময় রাজ দরবারে যাওয়ার পথে স্বয়ং বাদশাহ আলমগীর ব্যাপারটি লক্ষ্য। করে গেলেন। মৌলভী সাহেবের বুকের ভেতরটা ধক ধক করে উঠল। আজ আর ঘাড়ে মাথা থাকে না বােধ হয়। রাজপুত্র দিয়ে পায়ে পানি ঢালানাের ব্যাপারটা স্বয়ং বাদশাহ দেখে গেছেন। মৌলবী সাহেব নিজেকে একটু শক্ত করে ভাবল, শিক্ষকের স্থান সবার উপরে অতএব তার ভয় কিসের?
এমন সময়ে দরবারে মৌলবী সাহেবের ডাক পড়ল। মৌলবী সাহেব তো ভয়েই দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য। কোন রকমে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে দরবারে উপস্থিত হলেন। তখন বাদশা আলমগীর বলতে লাগলেন,
“দরবারে আসার পথে দেখলাম আমার ছেলে আপনার পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর আপনি নিজ হাতে কাদা পরিষ্কার করছেন। এটা কি বেয়াদবী নয়? কেন, সে কি নিজ হাতে আপনার পায়ের কাদাটুকু পরিষ্কার করে দিতে পারে না? এটা আমার পুত্রের উপযুক্ত কাজ হয়নি। শিক্ষকের স্থান বাদশাহেরও উপরে।”
সমস্ত শুনে মৌলবী সাহেব অশ্রুসিক্ত নয়নে কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন, বাদশাহ, আপনি সত্যই মহৎ।
এছাড়া আধ্যাত্মিক উন্নতিতেও তার এমন বিশেষ ভূমিকা ছিল, যা একটি একটি করে তুলে ধরলে পৃথক একটি পুস্তকেই সম্ভব। তবু প্রমাণস্বরূপ পেশ করার প্রয়ােজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতেই একটি মাত্র ঘটনা লিপিবদ্ধ করা গেল।
মুসলমান হয়ে প্রত্যহ পঞ্চীয় প্রার্থনা নামায না পড়লে তাকে শাস্তি নিতে হতাে। আর হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর সময়ে তাে পৃথিবীতে এমন একটিও মুসলমান ছিলেন না, যিনি প্রত্যহ নামায পড়তেন না। তবে শাস্ত্রানুযায়ী পাগল, শিশু প্রভৃতির জন্য তা প্রযােজ্য নয়।
একদিন সম্রাট আলমগীরের নিকট সংবাদ এল ‘একজন লােক নাকি নামায পড়েন না এবং সব সময় উলঙ্গ থাকেন। অথচ তিনি একজন নামকরা পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত। তার অনেক অলৌকিক প্রভাবে লােক তার দিকে আকর্ষিত।’ এই সংবাদে সম্রাট একদিন স্বয়ং তাঁর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কাপড় না পরা শক্ত অপরাধ তা কি আপনি জানেন না?” তিনি হেসে উত্তর দিলেন, “পাবাে কোথায়?” সম্রাট একখানা পােশাক পরিয়ে দিয়ে বললেন, “আজ শুক্রবার, জুমআর নামায পড়া ফরজ (অবশ্য পালনীয়) তা কি আপনি স্বীকার করেন?”
১৬৫ তিনি বললেন, “অবশ্যই, নামায পড়া খুব দরকার, আমি আজ নামায পড়তে যাব।” তারপর মসজিদের প্রথম সারিতে নামায পড়তে পড়তে চিৎকার করে বললেন, “হে ইমাম, তাের খােদা আমার পায়ের তলায়।” তার পর ছুটে মসজিদ থেকে বেরিয়ে পলায়ন করেন। পরে তাকে ধরে এনে মােরতাদ (পথভ্রষ্ট) বলে প্রাণদণ্ড দেওয়া হলাে। কিন্তু সম্রাট আলমগীরের মনে বারবার একটা প্রশ্নের উদয় হতে লাগল তিনি কি ঠিক করলেন না ভুল করলেন? রাত্রে দু রাকাত নামায পড়ে শুয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন, হযরত মুহাম্মদ (দ.) যেন বিচারাসনে বসে আছেন আর সেই প্রাণদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি এক হাতে নিজের কাটা মাথাটা ধরে ফরিয়াদ করে বলছেন, “হে নবী, আলমগীর আমার প্রাণদণ্ড দিয়েছে আপনি বিচার করুন।” উত্তরে হযরত যেন বলছেন, “তুমি আমার প্রতিষ্ঠিত প্রিয় শরীয়তের আইন অমান্য করেছিলে কেন? অতএব আমার আলগীর যা করেছে ঠিকই করেছে।” আওরঙ্গজেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি তাঁর শিক্ষক মােল্লাজিকেও সমস্ত ব্যাপারে খুলে বললেন। মােল্লাজিও বললেন, “তােমার প্রাণদণ্ড দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ তিনি পূর্ণ পাগল ছিলেন তা না হলে কখনই উলঙ্গ থাকতেন না। আর তাের খােদা আমার পায়ের তলে কথাটায় তাের শব্দটা যােগ না থাকলে নিশ্চয়ই অমার্জনীয় অপরাধ হতাে। এখন মনে হচ্ছে যিনি নামায পড়িয়েছেন সেই ইমামের কিছু ত্রুটি আছে।” ইমাম সাহেবকে ডাকার পর জিজ্ঞাসা করা হল তিনি স্বীকার করলেন যে, হা, আমি অনিচ্ছাকৃতভাবেই ভাবছিলাম আমার কন্যাগুলাের বিবাহের জন্য অনেক অর্থের প্রয়ােজন।” যদি আমার কুরআন পাঠ সুন্দর ও চিত্তাকর্ষণ হয় তাহলে হয়তাে সম্রাট খুশি হয়ে আমার অভাবের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করতে পারেন।” মােল্লাজিও বললেন, “শরীয়তের সমাধান এই যে, অনিচ্ছাকৃতভাবে নামায অবস্থায় যে কথাই উদয় হােক নামায তাে নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্ব হতে উদ্দেশ্য যদি ম্রাটকে মুগ্ধ করা আর অর্থোপার্জন হয় তাহলেই সর্বনাশ।”
যাই হােক, মােল্লাজিও সম্রাটকে বললেন, ঠিক যেখানে দণ্ডিত লােকটি দাঁড়িয়ে ছিল সে জায়গাটি খুঁড়তে আদেশ কর। সম্রাটের আদেশে তাই করা হলাে। কিন্তু আশ্চর্যের দৃশ্য দেখা গেল সেখানে স্বর্ণ রৌপ্যের মুদ্রাভর্তি একটা বড় পাত্র। মােল্লাজিও বললেন, এখানে তাের খােদা বলতে এই মুদ্রাগুলাে।
অনেক সময় মহান মানুষের অন্তরে এমন অনেক কথার উদয় হয়, যা পরে সত্যে পরিণত হয়। এরই নাম মােজেজা, কেরামত ইত্যাদি। অবশ্য তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। ইন্দ্রজালের সঙ্গে কেরামত মােজেজা পার্থক্য এখানেই যে, ইন্দ্রজাল ইচ্ছা করলেই সম্ভব আর কেরামত মােজেজা ইচ্ছা করলেই সম্ভব হয় ।
আরেকটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা সেদিনেও বহুল প্রচারিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে সব যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। পাঞ্জাবে একটি গ্রামের নাম ছিল ‘আলমগীর’। একদিন সম্রাট আলমগীরের একজন মুসলমান সেনাপতির অধীনে একদল সৈন্য বাহিনী ওই পল্লীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে জনৈক ব্রাহ্মণের এক অপরূপ সুন্দরীর গােলাপের ন্যায় মুখশ্রী দেখে লােভাতুর সেনাপতি তার পিতার নিকট মেয়েটিকে বিয়ে করলে প্রস্তাব দেন এবং সিদ্ধান্ত জারি করেন যে, আজ থেকে এক মাস পরেই সে তার বাড়িতে বর বেশে উপস্থিত হবে।
কন্যার পিতা স্বয়ং আলমগীরের শরণাপন্ন হলেন এবং তাকে সমস্ত ঘটনা। বলে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। সম্রাট তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
“যাও, নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাও; নির্দিষ্ট দিনে আমি তােমার বাড়িতে উপস্থিত থাকব।”
ব্রাহ্মণ নানা চিন্তার ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সত্যিই কি সম্রাট স্বয়ং আসবেন? না তার পক্ষ হতে কোন প্রতিনিধি পাঠাবেন। আর যদি সত্যিই তিনি আসেন তবে সঙ্গে নিশ্চয়ই লােক লস্কর, হাতী, ঘােড়া পাঁচ শ’র কম হবে না। তাঁদের সে থাকতে দেবে কোথায় ইত্যাদি অনেক চিন্তা।
অবশেষে সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বিবাহের আগের দিন সম্রাট আলমগীর একাই এসে উপস্থিত হলেন ব্রাহ্মণের বাড়িতে। ব্রাহ্মণ তাে অবাক। অতঃপর ঐ দরিদ্র ব্রাহ্মণের এক জীর্ণ কামরায় সারারাত এবাদত (উপাসনা) ও মােনাজাতে (প্রার্থনা) অশ্রু বিসর্জন করে কাটালেন। ইনি কাঁদছেন কেন? এর কিসের অভাব? সকলে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগল কিন্তু প্রকাশের অনুমিত নেই। একি শুধু তােমার মেয়ে এযে আমারও মেয়ে।
পরদিন মুঘল সেনাপতি বর বেশে ব্রাহ্মণের ঘরে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করেই দেখলেন উলঙ্গ তরবারি হাতে সম্রাট আলমগীর স্বয়ং। উদভ্রান্ত যৌবনের বুকভরা আবেগ আর মুখভরা হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেল। যার দাপটে শত্রু সৈন্য থর থর করে কাঁপে, যার হৃদয়ে ভয়ভীতি অথবা দুর্বলতা কখনও স্থান পায় না, আজ সেই হৃদয় কাল বৈশাখী ঝড়ের মত দুরু দুরু শব্দে যেন কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু দুঃখ, লজ্জা, শাস্তি আর অপমানের আশঙ্কায় জ্ঞানহারা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন বলিষ্ঠ দেহ সেনাপতি। কন্যার পিতা সম্রাট আলমগীরের সুবিচার, দায়িত্ববোধ অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা দেখে আনন্দে অশ্রু গদ গদ কণ্ঠে বললেন, আপনি আমার বিশেষ করে আমার কন্যার ইজ্জত রক্ষা করেছেন। আপনার এই ঋণ অপরিশােধ্য। সম্রাট ব্রাহ্মণকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করে বললেন, ভাই এই মহান দায়িত্ব আমার। আমি যে আমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পেরেছি এতেই আমি ধন্য।
১৬৭ সম্রাট আলমগীর আজ নেই সত্য, কিন্তু তার মহমান্বিত অমর আলেখ্য মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে রয়েছে ঐ গ্রামের প্রতিটি অণু পরামাণুতে। ঐ ঘটনার পরই ঐ পল্লীর নামকরণ হয় ‘আলমগীর’ গ্রাম, আর যে কামরায় সম্রাট আলমগীর এবাদত করেছিলেন এখনও পর্যন্ত সেখানে কেউ জুতাে পায়ে দিয়ে প্রবেশ করে না।
এমনিই এক মহৎ ও উদার চরিত্রের সাধককে ইতিহাসে হিন্দু বিদ্বেষী বলে চিত্রিত করতে ঐতিহাসিকদের কলম এতটুকু কেঁপে ওঠেনি।
আজও ঐতিহাসিক মন্দির “বালাজী বা বিষ্ণু মন্দির” যেটি চিত্রকূটের রামঘাটের উত্তর দিকে অবস্থিত, সেই মন্দিরে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে লেখা আছে “সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মিত বালাজী মন্দির।” মুসলমানকে মূর্তিপূজায় অংশগ্রহণ বা মূর্তি, মন্দির নির্মাণে নিষেধ আছে। কিন্তু যখন হিন্দু প্রজা বা সংখ্যালঘু প্রজাদের মন্দির যে কোন রূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেখানে তাদের ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব মুসলমান বাদশাহের ওপর পড়ে। অতএব এত উদার সম্রাট আওরঙ্গজেবকে কুরঙ্গে রঞ্জিত করা নিঃসন্দেহে বিকৃত মানসিকতার বিকাশ। যদি পচা ইতিহাসের পােকাটে পাতায় ইতিহাসের সব তত্ত্ব ও তথ্য আছে বলে কেউ দৃঢ়মনে বিশ্বাস করেন তাহলে কিছু বলার নেই। নচেৎ অনুরােধ করব, হিন্দু তীর্থস্থান বারানসী ধামে গিয়ে দেখুন। সেখানে বহু পুরাতন মন্দিরের রক্ষক ও সত্ত্বাধিকারীদের নিকট সংরক্ষিত সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলের বহু ফরমান বা দলিল দেখে অবাক হতে হবে। মিথ্যা অভিযােগে অভিযুক্ত হিন্দু বিদ্বেষী আওরঙ্গজেব হিন্দু মন্দিরসমূহের রক্ষাকল্পে জায়গীরস্বরূপ প্রচুর সম্পত্তি দিয়েছিলেন।
“এই প্রকার কাশ্মীর প্রদেশে হিন্দু মন্দির রক্ষার্থে বাদশাহ কর্তৃক যে সমস্ত জমি ও বৃত্তিদান করা হয়েছে সেই ফরমান দেখিয়ে অবগত হওয়া যায় যে তার মধ্যে অধিকাংশ ফরমানে আওরঙ্গজেবের নাম অঙ্কিত রয়েছে।” [দ্রঃ Islam and civilization]
বেনারস বা কাশীতে কয়েকজন নবদীক্ষিত মুসলমান অতিভক্তির নামে হিন্দু মন্দির ও পূজারীদের কিছু ক্ষতি করেছিল। সংবাদ পেয়ে সম্রাট ক্ষতিপূরণস্বরূপ প্রচুর অর্থ এবং তার স্থায়িত্বের জন্য একটি ফরমান জারি করেন। বিদ্যোৎসাহী ও অনুসন্ধিৎসু পাঠক পাঠিকাদের জন্য তার বঙ্গানুবাদটি এখানে উল্লেখ করছি-
“প্রজাদের মঙ্গলার্থে ব্যথিত হৃদয়ে আমরা ঘােষণা করছি যে, আমাদের ছােট-বড় প্রত্যেক প্রজা পরস্পর শান্তি ও একতার সঙ্গে বাস করবে এবং ইসলাম বিধান অনুসারে আরও ঘােষণা করছি যে, হিন্দুদের উপাসনালয়গুলোর রক্ষণাবেক্ষণ বা তত্ত্বাবধান করা হবে। যেহেতু আমাদের কাছে আকস্মিক সংবাদ পৌঁছেছে যে, কতিপয় লােক আমাদের বারানসী ধামে অবস্থিত হিন্দু প্রজাগণের সঙ্গে অসম্মানজনক নিষ্ঠুর ব্যবহার করতে এবং ব্রাহ্মণগণকে তাদের প্রাচীন ন্যায়সঙ্গত উপাসনার অধিকারে বাধা দিতে মনস্থ করেছে। এবং আরও আমাদের কাছে জানানাে হয়েছে যে, এই সমস্ত অত্যাচারের ফলে তাদের মনে দারুণ দুঃখ ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অতএব আমরা এই ফরমান প্রকাশ করছি এবং এটা সাম্রাজ্যের সর্বত্র জানিয়ে দেওয়া হােক যে, এই ফরমান (অর্ডিন্যান্স) জারি হওয়ার তারিখ হতে কোন ব্রাহ্মণকে যেন তার উপাসনার কাজে বাধা দান বা কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না করা হয়। আমাদের হিন্দু প্রজাগণ যেন শান্তির সঙ্গে বাস করতে পারে এবং আমাদের সৌভাগ্য ও উন্নতির জন্য আশীর্বাদ করেন।” [দ্রঃ ইসলামিক রিভিউ]
আজ যে সাম্যবাদ সারা বিশ্বের মানুষের মস্তকে আলােড়ন সৃষ্টি করেছে, যে সাম্যবাদের অভিনব বন্যায় পৃথিবীর পুরাতন সব ঐতিহাসিক রাজা বাদশাহ ও তাঁদের শাসননীতি, ধর্মনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ‘মধ্য যুগের অসভ্যতা’ বলে অনেকের ধারণা হয়েছে, কার্লমার্কসের যে নতুন চিন্তাধারা নতুন পথ আর পাথেয়। দান করে পৃথিবীকে রক্ষা করতে উপস্থিত হয়েছে সেই সম্বন্ধে আজ প্রমাণিত সত্য কথা এই যে, মুসলমান রাজা বাদশাদের উদার ব্যবহার, সাম্যবাদ ও অর্থনৈতিক নৈপুণ্য বর্ণনা করে গেছেন ঐ বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ে আর পর্যটক ‘তার্ভার্নিয়ের’। তাদের লেখা হতে জানা যায়, শাহজাহানের প্রখ্যাত পুত্র আওরঙ্গজেবের সাম্যবাদ, অর্থনীতি, শাসননীতির এত সুব্যবস্থা ছিল, যা যেকোন নিরপেক্ষ মানুষের মনকে আনন্দ এবং বিস্ময়ে অভিভূত করে। কার্লমার্কস ইতিহাসের ঐ অধ্যায় পড়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত হয়ে গিয়েছিলেন। কার্লমার্কস এও বুঝেছিলেন, আওরঙ্গজেবের রাজত্বের যত বৈশিষ্ট্য সবই কিন্তু ইসলাম ধর্ম তথা কুরআন আর হাদীসের বৈশিষ্ট্য। কারণ আওরঙ্গজেব কুরআনবিরােধী কোন কাজ করতে কোনদিনই ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি এই সঙ্গে আরও বুঝেছিলেন, যে মুসলমান বাদশাহ যত অন্যায় করেছেন তিনি তত কুরআনের নীতি থেকে দূরে ছিলেন; তাই আজ কার্লমার্কসের কমিউনিজম বৃক্ষেও ইসলামী ফল, ফুল, আর লতা-পাতার সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সৌন্দর্যমণ্ডিত এ বৃক্ষটি সুস্থ ধর্মীয় সমাজে গ্রহণযােগ হয়ে ওঠেনি। তার কারণ বৃক্ষটির শিকড় ও মূল কেটে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ নাস্তিকতা নীতিই তার মূল কারণ।
যদি নাস্তিকতা নীতির পরিবর্তন করে কোন নতুন নেতা সাম্যবাদকেই পরিবেশন করতে এগিয়ে আসেন তাহলে আজ যে মুসলমান ওলামা, মুফতিগণ দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছেন তারা প্রত্যেকে ঝাঁপিয়ে পড়বেন সারা বিশ্বে ঐ নীতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের ন্যায়নীতিতে মার্কস যে মুগ্ধ হয়েছিলেন তা শ্রী বিনয় ঘােষকেও কিঞ্চিৎ স্বীকার করতে হয়েছে। তিনি লিখেছেন,
“বার্নিয়েরের বিশ্লেষণ পাঠ করে কার্লমার্কসের মত মনীষীও মুগ্ধ হয়েছিলেন।” (ভারত জনের ইতিহাস, ৪৮৭ পৃ:)
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।