সম্প্রতি পরলােকগমন করেছেন বর্ধমান জেলার মেমারির গোলাম আহমদ মোর্তজা (১৯৩৫-২০২১)। সুবক্তা, লেখক ও ইতিহাসের নিরলস গবেষক। গবেষণা করতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের মধ্যে খুঁজে পান বহু ফাঁকি ও অসত্য-বানােয়াট কথন। ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রবণতাটার সূত্রপাত হয়েছিল; ইতিহাস গ্রন্থ প্রণয়ন করতে বসে আমাদের মান্য ইতিহাসকাররা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছিলেন না। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তাঁদের উপর ভর করেছিল। তাঁদের প্রণীত ইতিহাস গ্রন্থে প্রায়শ খলনায়ক হিসেবে প্রতিপন্ন হচ্ছিল মুসলমান সমাজ, বিশেষত মধ্যযুগের মুসলমান শাসকরা, যা বিকৃত বা অর্ধসত্য মাত্র। ব্রিটিশের এই বিভেদমূলক ইতিহাস সংশােধন হওয়া জরুরি। মিথ্যা ইতিহাসের বিরুদ্ধে কলম ধরা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর ইতিহাসের সংশােধন না হলে হিন্দুমুসলমান সম্প্রীতি সম্ভব নয়। শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস জন্মাবে না দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে—অপরিচয় ও অবিশ্বাস রয়ে যাবে। তাই ভারতের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে গোলাম আহমদ মোর্তজা সাহেব রচনা করেন ‘ইতিহাসের ইতিহাস’। প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার এই গবেষণা গ্রন্থকে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির অভিযােগে বাজেয়াপ্ত করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও পাঞ্জাব সরকার। পরবর্তীতে গােলাম আহমাদ মাের্তজা সাহেবের রচিত ‘পুস্তক সম্রাট’, ‘সেরা উপহার’, বাজেয়াপ্ত ইতিহাস’, ‘চেপে রাখা ইতিহাস’, ‘বজ্রকলম’, ‘এ এক অন্য ইতিহাস’, ‘ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়’, ‘এ সত্য গােপন কেন’, ‘ধর্মের সহিংস ইতিহাস’, ‘বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ’, ‘সিরাজুদ্দৌলার সত্য ইতিহাস ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রভৃতি বিখ্যাত রচনাকর্ম বা গ্রন্থেও ইতিহাসের সত্যাসত্য, শিক্ষা ব্যবস্থায় জালিয়াতিকরণ, জাতীয় সংহতি ও ঐক্য, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, সাম্প্রদায়িক হানাহানির কার্যকারণ ইত্যাদি বলিষ্ঠ কলমে ব্যাখ্যাত হয়েছে। এভাবে অনুসন্ধানী ঐতিহাসিক হিসেবে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ইতিহাসের বিকৃতি ও সাম্প্রদায়িকীকরণ নিয়ে তিনি নিয়মিত বক্তৃতা ও গ্রন্থ লিখেছেন। ইতিহাসচর্চার সাম্প্রদায়িক মােড় গোলাম আহমদ মোর্তজা সাহেব অনেকাংশে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন বলা যায়।
‘ইতিহাসের ইতিহাস’ বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর মাের্তজা সাহেব অবশ্য তাতে না দমে লিখে ফেলেন ‘বাজেয়াপ্ত ইতিহাস’। যে কারণে ‘ইতিহাসের ইতিহাস’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তার জবাব ‘বাজেয়াপ্ত ইতিহাস’। এরপর লেখেন ‘চেপে রাখা ইতিহাস। মূলত ভারত-ইতিহাসের মধ্যযুগ ও আধুনিক পর্বের ইতিহাস বিকৃতির প্রকৃতি ও স্বরূপ অনুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে এখানে। গ্রন্থে ইতিহাসের নানা অসঙ্গতি উল্লেখের পাশাপাশি প্রকৃত ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলােচিত-পর্যালােচিত হয়েছে। আর তা করতে গিয়ে ইতিহাসের নানা দুর্লভ তথ্য, নানা অকথিত ও অনালােকিত ইতিহাস এখানে উদঘাটিত হয়েছে, যেগুলি আমাদের নতুন করে আলােকিত করে। ইতিহাসও সমৃদ্ধ হয়। এখানে যে বিষয়গুলি চর্চিত হয়েছে সেগুলি হল: মুসলিম জাতির মূল্যায়ন, ইসলাম প্রচার-প্রসারে মূল কারণ, ভারতে ইসলামের আগমন থেকে শুরু করে মােঘল সম্রাটগণ সহ বাংলার নবাবদের ইতিহাস, প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের চাপা দেওয়া ইতিহাস (১৭৬০-১৯০৫), ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও নেতৃবৃন্দের ব্রিটিশের পক্ষাবলম্বন, সর্বশেষ স্বাধীনতা আন্দোলন (১৯০৬-১৯৪৭) ইত্যাদি।
স্মর্তব্য যে, ভারতের প্রাচীনযুগ থেকে ইতিহাসের যে ধারা সাধারণ মানুষ বহন করে চলেছিল, মুসলমান বিজয় তাকে ব্যাহত করেনি। মুসলমান শাসকদের ভূমিকাই ছিল খেলার মাঠে অনেকটা রেফারির মতাে। কদাচিৎ নিজেরা খেলেছেন অর্থাৎ ভারতের সামাজিক ও আর্থিক কাঠামােয় তারা বিশেষ কোনও হস্তক্ষেপ করেননি। ধর্মের সুবাদে চাকুরি দেওয়ার প্রস্তাব এলে আওরঙ্গজেবের মতাে সম্রাটও বলে ওঠেন, পার্থিব বিষয়ের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক? এমন বহু বিষয়গুলি আমাদের ইতিহাসে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। ফলে ‘বিবিধের মাঝে মিলন’ আজও দূর অস্ত। এক্ষেত্রে ব্রিটিশদের যে বড় ভূমিকা ছিল তা অস্বীকারের উপায় নেই। গােলাম আহমাদ মাের্তজা নিজেই তাঁর ‘চেপে রাখা ইতিহাস’-এর ‘গ্রন্থাভাষ’ অংশে লিখেছেন,
“আমাদের দেশে বিকৃত ইতিহাস পরিবেশনের জন্য ইংরেওদের দোষ দেওয়া হলেও তাদের কুটনৈতিক জ্ঞান ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারার কথা অস্বীকার করা যায় না। তারা বুঝেছিলেন, ইতিহাসে ভেজাল দিয়েই ভারতবাসীকে অন্ধকারে রাখা সম্ভব এবং এই ইতিহাসের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে। ভারতবর্ষে ক্যানসারের মত বড় সবচেয়ে বড় ব্যাধি হল সাম্প্রদায়িকতা। আর এই সাম্প্রদায়িকতার তিক্ততা অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বেশি একট। এটাকে নির্মূল করতে হলে আমাদের ধারণায় সর্বাগ্রে সঠিক ইতিহাস পরিবেশন অবশ্য কর্তব্য। তাছাড়া এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক জানাজানি, আদান-প্রদানেরও বিশেষ প্রয়ােজন আছে।”
যখন আমরা ইতিহাসচর্চার ধারা সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে পারব, যখন বিশেষ কোনাে শাসক বা শাসক শ্রেণির না পড়ে সমস্ত সমাজের ইতিহাস পর্যালােচনা করব, তখনই একমাত্র আমাদের ইতিহাস চেতনা পক্ষে নিরপেক্ষ হতে পারবে। মিথ্যা ইতিহাসের বিষময় ফল আমাদের শিক্ষা জগৎ ও সাংস্কৃতিক জগৎকে কিভাবে কলুষিত করেছে এবং এখনও করে চলেছে তার বিস্তারিত শব্দরাপ ধরা পড়েছে গোলাম আহমদ মোর্তজা সাহেবের ‘বজ্রকলম’ (১ম খণ্ড), ‘এ এক অন্য ইতিহাস’ (‘বজ্রকলম’-এর দ্বিতীয় খণ্ড) ও ‘ইতিহাসের বিস্ময়কর অধ্যায়’ ইত্যাদি গ্রন্থে। অনেকে এই বইগুলিতে নিছক চমক সৃষ্টি বলতে পারেন, কিন্তু নানান পুষ্প্রাপ্য তথ্য সাজিয়ে লেখক আদতে বলতে চেয়েছেন—ইংরেজ আমলে লেখা ভারতের ইতিহাসে অনেক তথ্য বিকৃতি আছে, আছে মিথ্যার প্রলেপ, রয়েছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার নানা অনুষঙ্গ। আর সে ইতিতহাস মুলত ব্রিটিশদেরই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই লিখিত। তাই ব্রিটিশ লিখিত লালিত-পােষিত সেই সময়ের ইতিহাস ঠিক নয়, বিভ্রান্তিতে ভরা। বহু আকর ও স্বীকৃত গবেষণামুলক গ্রন্থের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে লেখক মোর্তজা সাহেব অনেক ঐতিহাসিক সত্যকে ‘বজ্রকলম’ (১ম খণ্ড) গ্রন্থে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দীর্ঘ শ্রম দিয়ে তিনি ভারতের ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে মুলত মুসলিম সমাজের সংকটের সুত্রপাত নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ আলােচনায় প্রবেশ করতে চেয়েছেন যা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির একটা আন্তরিক উদ্যোগও এই গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়। আর এ জন্য লেখক প্রচলিত ইতিহাসের পথে হাঁটেননি, বরং সেই ইতিহাসের যাবতীয় বিকৃত ও ভুলভ্রান্তিকে চিনিয়ে দিতে যথাসম্ভব প্রয়াসী হয়েছেন।
আজকের দিনে এ কথাটা অনেকেই মানবেন যে, গত একশাে বছর ধরে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার-প্রসারের জন্যে ভারতে ইতিহাস শিক্ষা অনেকটাই দায়ী। একটুও না বাড়িয়ে বলা চলে যে, ঐতিহাসিকদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিই বরাবর ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক মতবাদকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে এসেছে। সাম্প্রদায়িকতার মুলে বরাবরই ক্রিয়াশীল থেকেছে ইতিহাসের ধারা সম্বন্ধে একটি সুপরিকল্পিত মিথ্যা ধারণা। ‘বজ্রকলম’-এর দ্বিতীয় খণ্ড ‘এ এক অন্য ইতিহাস’ গ্রন্থটির আলােচ্য বিষয়ও মুলত একই। গােলাম আহমাদ মাের্তজা এখানেও ইতিহাস জগতে নিগুঢ় সত্য উদ্ধারে প্রয়াসী এই জন্য যে, ইতিহাসের যথার্থ শিক্ষা বহু ধর্মের দেশ ভারতবর্ষকে ঐক্যের বন্ধনে দৃঢ়বদ্ধ হতে সাহায্য করে।
‘ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়’ গ্রন্থটি ‘চিন্তাভাবনার সুদীর্ঘ পথে নৈরাশ্যের অন্ধকারে আলাে বিকিরিত করতে পারে—এই বার্তা দিয়ে গোলাম আহমদ মোর্তজা ভূমিকায় লিখেছেন,
“…যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত আহত সর্বস্বান্ত আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন মুসলমান, খৃষ্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, হরিজন ও দলিত সমাজের মানুষেরা। প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকেরই যেন জানা হয়ে গেছে যে, বিগত দিনেও দাঙ্গা হয়েছে, সাম্প্রতিককালেও হচ্ছে, আর আগামীতেও দাঙ্গা বা হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকবে মাঝেমধ্যেই। এ যেন একটা স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত।”
এই সাম্প্রদায়িক হিংসা, দাঙ্গার দাওয়াইও গোলাম আহমদ মোর্তজা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক বিপানচন্দ্রের বক্তব্য তুলে ধরেছেন তার ওই গ্রন্থের ৯৩ পৃষ্ঠায়। বিপানচন্দ্র লিখেছেন,
“কিন্তু যখন সাম্প্রদায়িক হিংসাশ্রয়ী ঘটনা ঘটবে, তা দাঙ্গা হােক আর রাতের আঁধারে ছুরি মারা হােক বা সন্ত্রাসবাদ হােক, তার একমাত্র উত্তর হল রাষ্ট্র কর্তৃক তৎক্ষণাৎ এবং কার্যকর পাল্টা হিংস্রতার ব্যবহার। সময়ে সময়ে যখন সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশ হয় হিংস্ররূপে, তখন কেবল রাষ্ট্রই পারে অবস্থার সামাল দিতে।…তারা কেন সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা গুড়িয়ে দিতে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাষ্টীয় শক্তির এমন ব্যবহার করেন। দিন, মাসের পর মাস চলার বদলে এক ঘন্টা বা একদিনও চলতে না পারত।”
গোলাম আহমদ মোর্তজা লিখেছেন ‘পুস্তক সম্রাট’ ও ‘সেরা উপহার। শিক্ষা-সংস্কৃতি-দর্শন-ইতিহাস-বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলিমদের ঐতিহাসিক ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়েছে এই গ্রন্থ দুটিতে। বলা চলে এই দুটি বইয়ের অত্যাধুনিক সংস্করণ যেন সুমিতা দাসের ‘অন্য এক রেনেসাঁ’ (পিপলস বুক সােসাইটি, কলকাতা, ২০১৮)
স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে নানা বােধবিকৃতির স্বরূপ উদঘাটিত হয়েছে ‘বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে। বর্তমানে দেশের সাম্প্রদায়িক কিছু শক্তি বিবেকানন্দকে আশ্রয় করে মুসলমান, তাদের ধর্ম ও তাদের নবি হজরত মােহাম্মদের (সঃ) বিরুদ্ধে যেভাবে কলম ধরে চলেছেন তা দেশের পক্ষে মােটেই শুভকর নয়। তাছাড়া বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে নানা মিথ প্রচলিত। ফলে বিবেকানন্দের আসল মূল্যায়ন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে নিয়েও বােধবিকতি কম হয়নি। ইংরেজের নেমক খাওয়া লেখকরা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। শ্রদ্ধাভাজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সিরাজকে বলছেন “অতি দূরাচার” আর বেন্টিঙ্ককে লছেন ‘চিরস্মরণীয়’ (বিদ্যাসাগর রচনাবলী-২)। নবীনচন্দ্র সেনের মত প্রতিভাধর দেশপ্রেমিক কবি পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে সিরাজের মুখ দিয়ে শুনিয়েছেন—
“ঢাল সুরা স্বর্ণপাত্রে ঢাল পুনৰ্ব্বার,/কামানলে কর সবে আহুতি প্রদান।”
ইংরেজ ঐতিহাসিকের সাক্ষ্য থাকলে কী হবে! বাঙালি কবি তাে প্রভুদের সন্তুষ্টির জন্য সিরাজকে মদ্যপ না বানিয়ে পারেন না। গােলাম আহমদ মাের্তজা সাহেব তার ‘সিরাজুদ্দৌলার সত্য ইতিহাস ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে সমস্ত অপবাদ ঘুচিয়ে সিরাজকে জাতীয় বীরের সম্মান দিয়েছেন।
আমরা জানি, শাসন, শােষণ, লুণ্ঠনের ধারা অব্যাহত রাখতে ব্রিটিশরা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয় ‘বিভক্ত কর এবং শাসন কর’ নীতি। এই নীতির বিষে বিষাক্ত হয়ে ওঠে এতদঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানের পুরুষানুক্রমিক সম্প্রীতি। ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমানদের মন-মজলিসে আর মন্দির-মসজিদে রােপণ করতে থাকে সাম্প্রদায়িক বীজ। এই বীজের অঙ্কুরােদগম ঘটায় কৌশলে মুসলমানদেরকে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পশ্চাদপদ করে এবং হিন্দু জনগােষ্ঠীকে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বসিয়ে ও উক্ত পদের উপযােগী করে গড়ে তােলে। ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ অঙ্কুরােদগমের পর এর কুঁড়িটি সমাজের সর্বস্তরে জেঁকে বসে বড় হতে হতে ক্রমে বটবৃক্ষের চেয়েও বড় হয়ে যায়। অভিশপ্ত এই বৃক্ষের কালাে ছায়া ঐতিহাসিকদেরকেও গ্রাস করে। ফলে অনেক ঐতিহাসিকের ক্ষীণ কণ্ঠে অনুচ্চারণের মতােই উচ্চারিত হয় ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা। ব্রিটিশ শাসনের বিদায়ের পরও এ ধারা অব্যাহত থাকে যা অনেকের মতাে গােলাম আহমদ মাের্তজার হৃদয়ও স্পর্শ করে। ঐতিহাসিক হিসেবে তিনি অনুভব করেন সত্য প্রকাশের গুরুত্ব। পূর্বে উল্লেখিত তার গ্রন্থগুলির কয়েকটিতে অংশত বেশ জোরের সঙ্গে এ বিষয়টি আলােচিত হলেও এ নিয়ে মাের্তজা সাহেবের আলাদা বড় কোনাে গ্রন্থ নেই। তবে এ নিয়ে তিনি ‘এ সত্য গােপন কেন?’ নামে একটি পুস্তিকা লিখেছেন। পুস্তিকা হলেও এটির ধার-ভার কম নয়। এছাড়াও তিনি কয়েকটি সাহিত্য-সমালােচনাধর্মী বই লিখেছেন। যেমন- ‘অনন্য জীবন’, ‘মহানবী মুহাম্মদ (সঃ)’, ‘সৃষ্টির বিস্ময়’, ‘মুসাফির’, ‘রক্তাক্ত ডায়েরি’, ‘রক্তমাখা ছন্দ’, ‘চল্লিশ হাদিস ও বিশ্বসমাজ’, ‘৪৮০টি জাল হাদিস’ ইত্যাদি।
জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এপার বাংলার মুসলিম সমাজের নানা বিবর্তন মাের্তজা সাহেব প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে ইসলামি শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটিয়ে নয়া শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম সমাজে যুগান্তর আনা সম্ভব। বাস্তবে তা তিনি দেখিয়েও গেছেন বিভিন্ন আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকৃমাধ্যমে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।