মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কখনও কোষাগারের অর্থ ব্যয় করতেন না। টুপি সেলাই করে ও কোরআন নকল করে যে পরিমাণ আয় হত তা দিয়ে সংসার প্রতিপালন করতেন। সেই আওরঙ্গজেবকেই জঙ্গি তকমা দিলেন পূর্ব দিল্লির বিজেপির সাংসদ মহেশ গিরি। ‘আওরঙ্গজেব অ্যান্ড দারাশিকোহ শিকোহ : এ টেল অফ টু ব্রাদার্স’ নামের একটি কনফারেন্সের (২০১৮) উদ্বোধনী ভাষণে এই সাংসদ আওরঙ্গজেবের কঠোর সমালােচনা করে দাদা দারাশিকোহ শিকোহর উচ্ছসিত প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, দারাশিকোহ ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোেধ তুলে ধরেছিলেন, আওরঙ্গজেবের মত ভ্রাতৃঘাতী ও সিংহাসন লােভী ছিলেন না তিনি। আওরঙ্গজেবের মত দারাশিকোহ (Dara Shikoh) জনতাকে দমন করে রাখতেন না। তাই স্কুলে শুধু আওরঙ্গজেব পড়ালে তা হবে ইতিহাসের ভুল পাঠ। দারাশিকোহর কথাও পড়ানাে উচিত, যাতে মানুষ বুঝতে পারে কে ভাল কে মন্দ। ইতিহাস দারাশিকোহকে ঠিকমতাে তুলে ধরতে পারেনি।
১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে সম্রাট শাহজাহানের (Shahjahan) আকস্মিক অসুস্থতার কারণে তার চারপুত্রের মধ্যে সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষ সংঘটিত হয় তা মুঘল ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সময় চার পুত্রের বয়স ছিল— দারাশিকোহ (Dara Shikoh) ৪২, শাহ সুজা (Shah Sujah) ৪১, আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ৩৯ এবং মুরাদ বখস (Murād Bakhsh) ৩৩। চার ভ্রাতারই প্রশাসনিক ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা ছিল। দারাশিকোহ (Dara Shikoh) পাঞ্জাবের, মুরাদ গুজরাটের, আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) দাক্ষিণাত্যের এবং শাহ সুজা বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন। একই মায়ের সন্তান হলেও চার জন কেউই সিংহাসনের জন্য সংগ্রাম করবার মৌলিক দাবি ছেড়ে দিতে রাজি নয়। শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে দারাশিকোহ পিতার শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত থেকে রাজকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। এক সপ্তাহ কঠিন রােগ ভােগের পর সুস্থ হয়ে উঠলে শাহজাহান দিল্লি থেকে আগ্রায় যান। তার পরিকল্পনা ছিল যে, তিনি সেখানে প্রিয়তমা মহিষীর সমাধি সৌধ দর্শন করতে করতে শান্তি ও তৃপ্তির সাথে ইহলােক ত্যাগ করবেন। শাহজাহানের (Shahjahan) অসুস্থতা, তার শারীরিক অবস্থা, আগ্রায় প্রস্থান এসব কিছুই অন্যান্য তিন রাজকুমার জানতে পারলেন না। যদিও তারা শুনেছিলেন যে, সম্রাট অসুস্থ। কিন্তু তিনি জীবিত আছেন না মারা গেছেন, তা তাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। কারণ দারাশিকোহ মন্ত্রীদের নিষেধ করে দেন যে, পিতার অসুস্থতার সংবাদ যেন বাংলায় সুজা, দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) এবং গুজরাটে মুরাদের নিকট প্রেরণ না করা হয়। দারাশিকোহ (Dara Shikoh) কেন্দ্রের সাথে প্রদেশসমূহের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে বাংলা, গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যের সড়ক বন্ধ করে দেন। দারাশিকোহর এই অরাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। রাজকুমারেরা ধরে নেন যে সম্রাট মারা গেছেন। সুতরাং তারা দিল্লির সিংহাসনের জন্য শক্তি পরীক্ষা করতে প্রস্তুত হন। এ খবর পেয়ে সম্রাট শাহজাহান পুত্রদেরকে চিঠি দ্বারা জানান যে, তিনি আরােগ্য লাভ করেছেন। কিন্তু তারা এ চিঠি জাল বলে সন্দেহ করেন এবং ধরে নেন যে দারাশিকোহ এ পত্র প্রেরণ করেছেন।
ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল শাহজাহানের (Shahjahan) পক্ষপাতিত্বমূলক নীতি ও দুর্বলতা। তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশিকোহকে অপর সকল পুত্র অপেক্ষা অধিক স্নেহ করতেন এবং তাকেই উত্তরাধিকারী মনােনীত করেন। আওরঙ্গজেবকে পুত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জেনেও শাহজাহান তার প্রতি সদয় ছিলেন না। অসুস্থ অবস্থায় দারাশিকোহর দ্বারা তিনি পরিচালিত হন এবং দারাশিকোহকে সর্বসম্মতিক্রমে তার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বকে অবশ্যম্ভাবী করে তােলেন। মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের সম্মিলিত বাহিনী দারাশিকোহর বিরুদ্ধে ধর্মাটের যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে শাহজাহান পিতা হিসেবে এই ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব বন্ধের কোনাে ব্যবস্থা করেননি। তিনি ইচ্ছা করলে একটি যুদ্ধ-পরিষদ গঠন করে তার সমর্থকদের নিকট হতে ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারতেন। দারাশিকোহ ও জাহানারার প্রভাবে শাহজাহান আওরঙ্গজেবের প্রতি কতিপয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যেমন- ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে আট বছর শাসনকার্য পরিচালনার পর দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তার পদ হতে আওরঙ্গজেবকে অপসারণ করা হয়। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহারের দ্বিতীয় অভিযানে আওরঙ্গজেব যখন অসামান্য সাফল্য অর্জনের উপক্রম করেন ঠিক তখনই দারাশিকোহর প্ররােচনায় তাকে অবরােধ করার আদেশ দেওয়া হয়। আওরঙ্গজেবের প্রতি দারাশিকোহর বিদ্বেষ প্রকট আকার ধারণ করে যখন তিনি আওরঙ্গজেবের পুত্রের সাথে সুজার কন্যার বিবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। ‘আদব-ই-আলমগীরি’ থেকে আওরঙ্গজেবের প্রতি শাহজাহানের (Shahjahan) কঠোর মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন-
- (ক) আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) যখন সুবাদার ছিলেন তখন তিনি অর্থ সাহায্য ভিক্ষা করলে শাহজাহান তাকে নিরাশ করেন এবং ভৎসনা করেন।
- (খ) আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) কান্দাহার দুর্গ দখলে ব্যর্থ হলে শাহজাহান তাকে অপদার্থ, গুণহীন বলে আখ্যায়িত করেন এবং ভৎর্সনা করেন। অথচ আওরঙ্গজেবের পর ‘দারাশিকোহ ’ কান্দাহার দখলে ব্যর্থ হলে সম্রাট তাকে কিছুই বলেননি।
- (গ) আওরঙ্গজেবের (Aurangzeb) কর্মচারী ও সমর্থকদের প্রতি দারাশিকোহ দুর্ব্যবহার করেন এবং শাহজাদাদের রাজধানীতে প্রবেশে বাধাদানের জন্য সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দেন। তাছাড়া ঐতিহাসিক জন রিচার্ডস বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে দেখিয়েছেন যে, শাহজাহান আওরঙ্গজেবের প্রতি অহেতুক কঠোরতা প্রদর্শন করেছিলেন।
আওরঙ্গজেবকে ক্ষমতাহীন করার জন্য তার অধীনস্ত যােগ্য সেনাপতি ও কর্মচারীদের দাক্ষিণাত্য হতে বদলী করে রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়। আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) গােলকুন্ডা ও বিজাপুর অধিকারে উদ্যত হলে দারাশিকোহ শাহজাহানের (Shahjahan) মাধ্যমে আওরঙ্গজেবকে নিরস্ত করেন। দারাশিকোহ মনে করতেন দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) সফল হলে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং সেখানকার ধন-সম্পদ তার শক্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
রাজধানী হতে দূরবর্তী প্রদেশে বসবাসকারী সুজা, আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ও মুরাদ পিতার অসুস্থতার সংবাদ না পেয়ে মনে করেন যে, দারাশিকোহ স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য পিতার মৃত্যু সংবাদ গােপন করে বলপূর্বক সিংহাসন দখল করেছেন। এমন ধারণা করে শাহ সুজা বাংলার তৎকালীন রাজধানী রাজমহলে নিজেকে সম্রাট বলে ঘােষণা করেন এবং নিজ নামে মুদ্রা মুদ্রিত করেন। অতঃপর সুজা দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন কিন্তু ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে বারানসীর নিকটে দারাশিকোহর জ্যেষ্ঠপুত্র সুলায়মান শিকোহর নিকট বাহাদুরগড়ের যুদ্ধে পরাজিত হন এবং নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। এদিকে গুজরাটের শাসনকর্তা মুরাদ সার্বভৌম সম্রাট বলে নিজেকে ঘােষণা করে জাহানারাকে প্রদত্ত সুরাট বন্দর বিধ্বস্ত করেন এবং তার দিওয়ান আলি নকি খানকে নিজ হস্তে হত্যা করেন। অন্যদিকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার যুবরাজ ঔরঙ্গজেব সৈন্য সংগ্রহ করলেও তিনি প্রকাশ্যভাবে বিদ্রোহ করার সমীচীন মনে করলেন না। তিনি সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মুরাদ তাঁকে পত্রে দ্রুততর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরােধ করেন। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) দাক্ষিণাত্য থেকে যাত্রা করেন। মুরাদও এসময় আহমদাবাদ থেকে যাত্রা করেন। উজ্জয়িনীর নিকট মুরাদ আওরঙ্গজেবের সাথে মিলিত হন। আল্লাহ ও রসুলকে (স.) সাক্ষী করে তারা মালবে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। শর্তানুসারে মােগল সাম্রাজ্য দখলের পর—১) মুরাদ পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মির এবং সিন্ধে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করবেন। অবশিষ্ট রাজ্য হবে আওরঙ্গজেবের। যুদ্ধে যে ধনদৌলত পাওয়া যাবে তার এক তৃতীয়াংশ পাবে মুরাদ এবং দুই তৃতীয়াংশ পাবে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb)।
মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের সম্মিলিত বাহিনী উজ্জয়িনীর নিকটবর্তী ধর্মাটে তাবু ফেলে। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে দারাশিকোহ (Dara Shikoh) (শাহজাহান) রাজা যশােবন্ত সিংহ এবং কাসিম খানের নেতৃত্বে রাজকীয় বাহিনী বিদ্রোহী শাহজাদাদের অভিযানকে প্রতিরােধ করার জন্য প্রেরণ করেন। ধর্মাটে উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল ও আত্মঘাতী যুদ্ধ সংঘটিত হয় (১৪ এপ্রিল ১৬৫৮)। কিন্তু আওরঙ্গজেবের উন্নত ধরণের রণকৌশল এবং বীরত্বের নিকট রাজকীয় বাহিনী পর্যদস্ত হয়। আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) জয়লাভ করে রণক্ষেত্র হতে অসংখ্য কামান, হস্তী এবং রণসামগ্রী লাভ করেন এবং এর ফলে তার শক্তি বৃদ্ধি পায়। সেনাপতি যশােবন্ত সিংহ নিজ রাজ্য মারওয়ারে পলায়ন করেন। দারাশিকোহ এ বিপর্যয়ের পর সােলায়মান শিকোকে বিহার হতে ডেকে পাঠান। কিন্তু তার ফিরতে বিলম্ব হয়।
ধর্মাটের যুদ্ধে রাজকীয় মােগল বাহিনীর পরাজয়ের অনেক কারণ ছিল। যশােবন্ত সিংহ সমরকুশলতায় আওরঙ্গজেবের সমকক্ষ ছিলেন না। যে রাজপুত বাহিনী তার অধীনে ছিল তারাও ঐক্যবদ্ধ ছিল না। তদোপরি মুসলিম ও হিন্দু সৈন্যের মধ্যে সমঝােতা ছিল না। সেনাপতি যশােবন্ত সিংহ ও কাসিম খানের মধ্যে রেষারেষি ছিল। বস্তুত যশােবন্ত সিংহ মােগল গােলন্দাজ বাহিনীর কোনাে প্রকার গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি তিনি অশ্বারােহী বাহিনী সন্নিবেশিত করার জন্য যে স্থান নির্ণয় করেন তাও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। নির্ণিত স্থান হতে সৈন্যবাহিনীর অগ্রগমন ও যুদ্ধ করা দুরূহ ছিল। ঐতিহাসিক বলেন যে, সত্যিকারভাবে এ যুদ্ধ ছিল তরবারির সঙ্গে গােলাবারুদের লড়াই। শেষে অশ্বারােহী বাহিনীর উপর গােলন্দাজ বাহিনী চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়। আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) এই যুদ্ধে পলাতক সেনাপতিদ্বয়ের শিবিরের পরিত্যক্ত সকল অস্ত্রশস্ত্র ও ধনদৌলত লাভ করেন। কিন্তু এ সাফল্য অপেক্ষাও অধিক লাভজনক ছিল আওরঙ্গজেবের বর্ধিত মর্যাদা। ধর্মাত ছিল তার পরবর্তী বৃহত্তর সাফল্যের শুভ সূচনা। এক আঘাতে তিনি দারাশিকোহ কে উন্নত ও সম্মানজনক পদ থেকে নিচের পঙক্তিতে টেনে আনেন। যদুনাথ সরকার বলেন,
“দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের বীর এবং ধর্মাটের বিজেতা কোনাে ক্ষতি স্বীকার না করেই যুদ্ধজয়ী হন এবং তার সামরিক খাতি ভারতবর্ষে তাকে সম্পূর্ণরূপে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তােলে।”
ধর্মাটের যুদ্ধে দারাশিকোহর বাহিনীকে পরাস্ত করে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) কম্বল নদী অতিক্রম করে আগ্রার অনতিদূরে সামুগড়ের প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। দারাশিকোহ ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে সামুগড়ে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ বাধে। আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ও মুরাদের সম্মিলিত বাহিনী রাজকীয় বাহিনীকে বিপর্যস্ত করতে থাকে। এই যুদ্ধে মুরাদ আহত হন। দারাশিকোহ , খলিলুল্লাহ খান এবং রুস্তম খান বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেও আওরঙ্গজেবের রণকৌশলের নিকট বারবার পর্যদস্ত হতে থাকেন। রাজপুত রাজা রামসিংহও আওরঙ্গজেবের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আঘাত সহ্য করতে পারেননি। অকস্মাৎ দারাশিকোহর হস্তী শর দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হলে দারাশিকোহ হাওদা থেকে নেমে অশ্বারােহী হলেন। এটাই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত করে। দারাশিকোহর সবচেয়ে ভুল ছিল তিনি ত্বরিত আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) মুরাদের যৌথবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালিত করতে পারেননি। এর অবশ্য কারণ ছিল। দীর্ঘ পথশ্রমে দারাশিকোহর বাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এদের শ্রান্তি কাটানাের অবকাশে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) সুযােগ পেয়ে যান সুপরিকল্পিত আক্রমণ পরিচালনা করার। সাময়িক বিরতির পর ৮ জুন আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সম্রাট বাহিনীর কামানের গােলা আওরঙ্গজেবের বাহিনীর লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। দারাশিকোহর বাম প্রান্তে সিপাহশিকোহ (Dara Shikoh) ও রুস্তম খানের বাহিনী অগ্রসর হলে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর গােলার আঘাতে রুস্তম খান ধরাশায়ী হন। ডান দিক থেকে দারাশিকোহর সেনাপতি খলিলুল্লাহ খান আক্রমণ পরিচালনা করলেও তার বাহিনী কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা আক্রমণ পরিচালনা করেছিল মুরাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে। মাঝ অবস্থান থেকে রাজপুতরা আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল। মুরাদ বীরত্বের সঙ্গে আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের তিনটি তীর তার মুখে আঘাত করে। তার মাহুত মৃত্যুবরণ করে। অবশেষে মুরাদকে পিছু হটতে হয়। এগিয়ে আসে রাজপুত বাহিনী। তারা আওরঙ্গজেবের মূল বাহিনীকে আঘাত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের হাতে রাজপুত বাহিনীর পরাজয় ঘটে। তবে রাজপুতদের বীরত্বে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) অভিভূত হয়েছিলেন। ডান অংশের বাহিনীর পরাজয় প্রত্যক্ষ করে দারাশিকোহ বাম দিকের বাহিনীকে পুনরায় শক্তিশালী করে তােলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে বাম দিকের বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি রুস্তম খান নিহত হয়েছেন। ইতিমধ্যে দারাশিকোহর গােলন্দাজ বাহিনীর রসদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় আওরঙ্গজেবের গােলন্দাজরা গােলাবর্ষন করে দারাশিকোহর বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। অবস্থার গুরুত্ব অনুভব করে দারাশিকোহ (Dara Shikoh) হাতির পিঠ থেকে নেমে ঘােড়ায় চড়েন। কিন্তু এতে এক বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়। দারাশিকোহর হাতির হাওদা খালি দেখে তার সৈন্যবাহিনীর ধারণা হয় শাহজাদা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। ফলে দারাশিকোহর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে দারাশিকোহর প্রায় দশ হাজার সৈন্য নিহত হয়। যুদ্ধ ছাড়াও প্রচণ্ড গরম ও দীর্ঘ পথশ্রমেও অনেকে মৃত্যুবরণ করে। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে দারাশিকোহ (Dara Shikoh) আগ্রায় ফিরে আসেন। তিনি সেখানে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার মনােবল হারিয়ে ফেলেছিলেন। এবার দারাশিকোহ পরিবারের সদস্য ও অনুগত সহচরদের নিয়ে দিল্লির পথে পালিয়ে যান। সেখান থেকে শক্তি সঞ্চয় করে পুনরায় আওরঙ্গজেবের মুখােমুখি হওয়ার সংকল্প ছিল তার। শাহজাহান দিল্লির কোষাগারের ধনরত্ন দারাশিকোহকে দেওয়ার জন্য আদেশ পাঠান।
আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) আহত মুরাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেন। এরপর বিজয়ী দুই ভাই আগ্রার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হন। দারাশিকোহর পক্ষে থকে অভিজাতই এখন বিজয়ী শাহজাদাদের পক্ষ অবলম্বন করেন। শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আপন করেন। প্রথমে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আগ্রা শহরে নিজ দখল নিশ্চিত করেন এবং দুরে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সৈন্য মােতায়েন করেন। এ সময় সম্রাটের দেহরক্ষীর দুর্গের ভেতর থেকে গোলাবর্ষণ কররে আওরঙ্গজেবকে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হয়। যমুনা নদী থেকে দুর্গের অভ্যন্তরে জল সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়ে তিনি পিতাকে ‘আত্মসমর্পণ’ করতে আহ্বান জানান। শাহজাহানের (Shahjahan) পক্ষ থেকে জানানাে হয় যে, এই যুদ্ধের জন্য তিনি দায়ী নন। দারাশিকোহই তাকে বাধ্য করেছিল। আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) পিতা শাহজাহানের (Shahjahan) নিকট একটি পত্র প্রেরণ করে ভ্রাতৃসংঘর্যের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হন। শাহজাহান (Shahjahan) ‘আলমগীর’ নামীয় একটি তরবারি তার বিজয়ী পুত্রের নিকট প্রেরণ করেন। অতঃপর শাহজাহান (Shahjahan) দুর্গের ফটক খুলে দেওয়ার আদেশ দেন। সম্রাট তার দেহরক্ষীদের নিরস্ত্র করার আদেশ দেন। জাহানারার মধ্যস্থতায় আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ও শাহজাহানের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। শাহজাহান তার চারপুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেওয়ার প্রস্তাব রাখবেন বলে জানানো হয়। এরপর আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) দুর্গে প্রবেশ করেন এবং পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিতার কাছ থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে আওরঙ্গজেবের অনুগত অনুচররা দারাশিকোহকে লেখা শাহজাহানের একটি পত্র দেখান, যেখানে দারাশিকোহকে তার বিরুদ্ধে গােপন সহযােগিতা করার কথা ছিল। মনােক্ষুন্ন হলেন আওরঙ্গজেব (Aurangzeb)। শাহজাহানের দুর্গ রক্ষার বা একটা মীমাংসার সকল উদ্যোগ ব্যর্থ করে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) আগ্রা দুর্গ দখল করেন। তারপর আমীরদের পরামর্শে বৃদ্ধ পিতাকে প্রাসাদে নজরবন্দী করেন। সম্রাটের সঙ্গে কন্যা জাহানারাও স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণ করে নেন। এখানেই ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই সম্রাট হিসাবে নিজের নাম ঘােষণা করেন। উপাধি গ্রহণ করেন ‘আলমগীর’। প্রকৃত আনুষ্ঠানিক রাজ্যাভিষেক করা হয়েছিল আরও পরে।
সামগড়ে রাজকীয় বাহিনীর উপর বিজয় আওরঙ্গজেবের জন্য ছিল একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী বিজয়। এ যুদ্ধে স্থির হয় শাহজাহানের উত্তরাধিকারী কে হবেন। দারাশিকোহর ব্যর্থতায় আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) উপলব্ধি করতে পারলেন যে, তার স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে। ভারতের সিংহাসন এখন তাঁর নাগালের মধ্যে। কিন্তু দিল্লি যাত্রার পথে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ও মুরাদের মধ্যে শীতল সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। মুরাদ বুঝতে পারেন আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে নিজেকে মােগল সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে বিবেচনা করছে। তাই মুরাদ নিজে সৈন্য সংগঠিত করতে থাকেন। বিষয়টি কুশলী আওরঙ্গজেবের দৃষ্টি এড়ায় না। আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) মুরাদের বিরুদ্ধাচরণ ধূলিস্যাৎ করার জন্য কৌশলে তাকে বন্দি করেন। প্রথমে তাকে সেলিমগড় দূর্গে আটক করে রাখা হয়। পরে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে গােয়ালিওর দুর্গে স্থানান্তরিত করা হয়। তিন বছর পর মুরাদ জেল হতে পলায়নের চেষ্টা করলে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) তার বিহিত ব্যবস্থা করেন। গুজরাটের সুবাদার থাকাকালীন মুরাদ দিওয়ান আলি নকি খানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেন। এই অপরাধের জন্য বিচারকগণ তার প্রাণদণ্ডের রায় দেন। গােয়ালিয়র দুর্গেই তাকে সমাহিত করা হয়।
এবার আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) নিজেকে নিষ্কন্টক করতে চাইলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি দু’দিকে দুটো বাহিনী প্রেরণ করেন। একটি বাহিনী দারাশিকোহকে পশ্চাদ্ধাবন করার জন্য লাহাের অভিমুখে রওনা হয়। অপর বাহিনী অগ্রসর হয় এলাহাবাদের দিকে। সেখানে প্রথমে সুলায়মান শিকোহ ও পরে শাহ সুজাকে দমন করার দায়িত্ব ছিল এই বাহিনীর ওপর। দারাশিকোহ (Dara Shikoh) বিপদ বুঝতে পেরে লাহাের ছেড়ে গুজরাটের দিকে চলে যান। এখানে আহমদাবাদের শাসনকর্তা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। মুরাদের দশ লক্ষ টাকা দারাশিকোহর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই অর্থ দিয়ে দারাশিকোহ (Dara Shikoh) ২০,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন। এ সময় রাজপুত মহারাজ যশােবন্ত সিংহ দারাশিকোহকে আজমীরে আহ্বান জানান এবং তাঁকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। কিন্তু আজমীরে পৌঁছে দেখেন ইতিমধ্যে জয়সিংহের মধ্যস্থতায় রাজা যশােবন্ত সিংহ আওরঙ্গজেবের আজ্ঞাবহে পরিণত হয়েছেন। ইত্যবসরে নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) দারাশিকোহর বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। আজমীরের নিকট দেওয়াইয়ের গিরিপথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দারাশিকোহ পলায়ন করেন।
দারাশিকোহ (Dara Shikoh) পুনরায় আহাম্মদাবাদে ফিরে আসেন। কিন্তু এবার আহমদাবাদের সুলতান তাকে শহরে ঢুকতে বাধা দেন। অনন্যোপায় হয়ে ভাগ্যবিড়ম্বিত দারাশিকোহ আফগানিস্তানের পথে অগ্রসর হন। পথে বােলান গিরিপথে দাদার নামক স্থানে মালিক জিওয়ান নামের এক বালুচ সর্দারের আশ্রয় তিনি লাভ করেন। একবার শাহজাহানের (Shahjahan) রােষানল থেকে দারাশিকোহ (Dara Shikoh) এই বালুচ সর্দারকে রক্ষা করেছিলেন। দারাশিকোহর স্ত্রী নাদিরা বেগম স্বামীর দুর্ভাগ্যের সাথী হয়ে একই সঙ্গে পরিভ্রমণ করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এত ধকল তিনি সইতে পারলেন না, অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং এই দাদারেই মৃত্যুবরণ করলেন। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নাদিরা বেগমের দেহ সমাধিস্থ করার জন্য লাহােরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ মৃত্যুতে দারাশিকোহর মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়। এ সময় তার আশ্রয়দাতা মালিক জীয়ন খান তাঁকে বন্দি করে আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধিদের হাতে সমর্পণ করেন। অথচ এই বিশ্বাসঘাতককেই একদিন প্রাণদণ্ড হতে বাঁচানাের জন্য দারাশিকোহ (Dara Shikoh) তার পক্ষ হয়ে শাহজাহানের নিকট সুপারিশ করেছিলেন। দারাশিকোহকে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। দারাশিকোহ (Dara Shikoh) কারারুদ্ধ হন এবং বিচারকগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দারাশিকোহকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
উত্তরাধিকার সংগ্রামে আওরঙ্গজেবের শেষ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শাহ সুজা। বুরহানপুরে সুলায়মান শিকোহর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে মুঙ্গেরে পালিয়ে গিয়েছিলেন, ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে সুজার সঙ্গে সুলায়মান শিকোহর এক সন্ধি হয়। শর্ত অনুযায়ী বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার অধিকার সুজার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। দিল্লির সিংহাসনে আরােহন করে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) সুজার নিকট পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি সুজাকে বাংলার সাথে বিহারও ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে দারাশিকোহর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সময় পর্যন্ত তাকে বাংলায় থাকতে অনুরােধ করেন। পত্রে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তিনি ভ্রাতার কোনাে চাহিদাই অপূর্ণ রাখবেন না। সুজা আওরঙ্গজেবের কথায় আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি সৈন্য-সামন্ত নিয়ে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। ১৬৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি খাজওয়ার নামক স্থানে সুজা ও আওরঙ্গজেবের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে সুজা পরাজিত হন। মীরজুমলা তার পশ্চাদ্ধাবন করলে সুজা সপরিবারে বাংলা হতে আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আরাকানের মগরাজা প্রথমে সুজাকে নিজ রাজ্যে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে উভয়ের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। অবশেষে ভাগ্যবিড়ম্বিত মােগল শাহজাদা সুজা আরাকানে মগদের হাতে নিহত হন।
আরাকানে সুজার পরিণতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা একমত নন। স্যার যদুনাথ সরকার বলেন যে, নতুন স্থানে তাঁর ভালাে লাগছিল না। কিছু পাঠান তার সাথে যােগ দেয়। তাদের সহায়তায় তিনি আরাকান রাজকে উৎখাত করে তার রাজ্য দখল করার পর তিনি বাংলায় তার ভাগ্য পুনরায় পরীক্ষা করবেন বলে পরিকল্পনা করেন। এ খবর জানতে পেরে আরাকান রাজ তাকে বন্দি করার চেষ্টা করেন। সুজা ভয়ে জঙ্গলে পলায়ন করেন। যেখানে মগেরা তাকে হত্যা করে। কিন্তু ঐতিহাসিক মার্শম্যান বলেন যে, আরাকান রাজ প্রথমে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। পরে তিনি পলাতক যুবরাজের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করেন। এমনকি আরাকান রাজ সুজার কন্যাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। এতে সুজা ক্ষুব্ধ হন। তিনি হিন্দু রাজার সাথে কন্যার বিবাহ দিয়ে তৈমুর বংশের রক্ত কলুষিত করতে অস্বীকার করেন। এ অস্বীকৃতির জন্য রাজার সৈন্য তাকে আক্রমণ করে এবং তাঁকে বন্দি করে একটি ডিঙি নৌকায় তুলে নদীর মাঝখানে নিয়ে গিয়ে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে। সুজার স্ত্রী ও দুই কন্যা আত্মহত্যা করেন। দুই পুত্র পিতার সাথে নদীতে ডুবে মরে। কনিষ্ঠ কন্যাকে রাজা বলপূর্বক বিবাহ করেন, কিন্তু পরে তিনিও আত্মহত্যা করেন। যাইহােক, এ সমস্ত মতানৈক্য হতে এটা ধারণা করা যায় যে, সুজার মৃত্যুর কারণ এখনাে সন্দেহাতীতভাবে উদঘাটিত হয়নি।
এইভাবে নানা কূটনীতির মাধ্যমে সম্রাট শাহজাহানের জীবৎকালেই তার পুত্রদের মধ্যে সংঘটিত উত্তরাধিকার সংগ্রামের অবসান ঘটে। পিতাকে আগ্রার দুর্গে নজরবন্দী রেখে মােগল সাম্রাজ্যের সিংহাসনকে নিন্টেক করে আসীন হন আওরঙ্গজেব (Aurangzeb)।
আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্তরাধিকার সংগ্রামে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এই বিজয়ের পেছনে সমকালীন পরিস্থিতির আনুকূল্য এবং তার ব্যক্তিগত প্রতিভার ভূমিকা ছিল অনেকখানি। সমকালীন ঐতিহাসিকরা মনে করেন আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) সুন্নি মুসলমান হওয়ায় উলেমা ও মুসলিম অভিজাতদের অনেকের সমর্থন তার বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। তবে বিষয়টিকে এত সরলীকরণের কারণ নেই। এই সাফল্যের প্রথম সােপান হিসাবে সম্রাট শাহজাহানের অসুস্থতা, দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতাকে দায়ী করা চলে। শাহজাহানের অসুস্থ অবস্থায় তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে দূরবর্তী অঞ্চলে নিয়ােজিত ভাইদের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। মধ্যযুগে বিশেষ করে মােগলদের মধ্যে এর পরিণতি কী হতে পারে পূর্ববর্তী যুগের ঘটনাপ্রবাহ দেখে তা অনুধাবন করা উচিত ছিল। সুস্থ হওয়ার পরও শাহজাহান বিবদমান সন্তানদের নিষ্ক্রিয় করার কোনােরকম উদ্যোগ নেননি। অসুস্থতার কারণ বাস্তব বিবেচনা করা শাহজাহানের পক্ষে সম্ভব না হলে দারাশিকোহরই উচিত ছিল সঠিক সংবাদ পাঠিয়ে স্বচ্ছতা তৈরি করা। মােগলদের সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার আইন না থাকলেও বড় ছেলেকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে শাহজাহান কিছুমাত্র অন্যায় করেননি। তাই পুত্ররা যখন প্রকৃত অবস্থা না জেনে সসৈন্যে রাজধানীর দিকে আসছিল তখন শাহজাহান তাদের নিরস্ত্র করতে পারলে এ অবস্থা সামাল দেওয়া যেত। অথবা যুদ্ধের ময়দানে তিনি নিজে নেতৃত্ব দিতে পারলেও সম্রাটের বাহিনীর ঐক্য সুদৃঢ় হত। সেক্ষেত্রে আওরঙ্গজেবের পক্ষে সাফল্য লাভ করা কষ্টকর হত।
সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ আওরঙ্গজেবের সাফল্যকে ভাগ্যের দান অর্থাৎ ‘ইকবাল’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের জীবনী রচয়িতা যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে, আওরঙ্গজেবের বিজয়ের মূলে ছিল তার দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়, ইস্পাতকঠিন সঙ্কল্প, অভিনব যুদ্ধকৌশল, অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, চারিত্রিক কাঠিন্য এবং কূটনৈতিক মেধা। তবে অবশ্যই আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত গুণাবলিই তাকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিল। বিশেষ করে অন্য ভাইদের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক বেশি প্রতিভাবান। দারাশিকোহর চারিত্রিক গুণাবলী বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে, দরবারে বিলাস-ব্যসনে ও মেহান্ধ পিতার বাৎসল্যে দারাশিকোহর রাজোচিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। দারাশিকোহ (Dara Shikoh) নিজেকে অন্যের অধীন রাখা পছন্দ করতেন না। চিন্তা ও বিবেচনার ক্ষেত্রে তিনি ধীরস্থির ও সংযমী ছিলেন না। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিপদ ডেকে আনতেন। সুজা ছিলেন সাহসী, কূশলী ও কূটনীতি বােধসম্পন্ন। কিন্তু অতিরিক্ত বিলাসিতা তার সকল গুণাবলিকে অকার্যকর করে ফেলেছিল। মুরাদ একদিকে যেমন ছিলেন বিলাসী অন্যদিকে তার মধ্যে সূক্ষ্ম বুদ্ধিরও অভাব ছিল। যে কারণে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) সহজেই তাকে ক্রীড়নকে পরিণত করতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি শাহজাহানের সন্তানদের মধ্যে সব দিক থেকে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ছিলেন যােগ্যতম। একাধারে তিনি ছিলেন ধীরস্থির, হিসেবী চরিত্রের অধিকারী, সাহসী, কূটনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন এবং দাক্ষিণাত্যের বিপদসঙ্কুল অঞ্চলে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সুতরাং যােগ্যতম শাহজাদা হিসাবেই তিনি উত্তরাধিকার সংগ্রামে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন। ঐতিহাসিক বেণীপ্রসাদ বলেন,
“Aurangzeb success in the war of succession was due to his personal qualities.”
ঐতিহাসিক ভি ডি মহাজন উল্লেখ করেন,
“Aurangzeb success was partly due to his own qualities of head and heart. He was great general and a statesman. No one could equal him in diplomacy and statecraft.”
দারাশিকোহর সৈন্যবাহিনী অপেক্ষা আওরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনী ছিল রণনিপুণ এবং সুশৃঙ্খল। ঐতিহাসিকদের মতে, ৫০,০০০ সৈন্য দ্বারা গঠিত দারাশিকোহর বাহিনী আকারে সুবৃহৎ ও অজেয় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এই বাহিনী বিভিন্ন সম্প্রদায় ও স্থান হতে অল্প সময়ের মধ্যে সংগৃহীত অপটু যােদ্ধাদের দ্বারা গঠিত ছিল, যারা বিপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণ সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিহত করতে পারেনি। সামুগড়ের যুদ্ধে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) অসামান্য সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন। অন্যদিকে সামুগড়ের যুদ্ধে দারাশিকোহ (Dara Shikoh) হাতীর পিঠ থেকে নেমে ঘােড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা শুরু করলে তার সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পলায়ন করে। এছাড়া দারাশিকোহ (Dara Shikoh) তার পুত্র সােলায়মান শিকোহ এবং রাজা জয়সিংহের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে যুদ্ধ শুরু করে তার পতন ডেকে আনেন। এক কথায় বলতে গেলে দারাশিকোহ (Dara Shikoh) কোনও দিক থেকেই আওরঙ্গজেবের সমকক্ষ ছিলেন না। ধর্মাটের যুদ্ধেও রাজপুত রাজা যশােবন্ত সিংহ বীরত্ব ও সামরিক কৌশল প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হন।
আওরঙ্গজেবের গােলন্দাজ বাহিনী ছিল অতি দক্ষ। অন্যদিকে রাজকীয় গােলন্দাজ বাহিনী তেমন সুসজ্জিত ছিল না। বস্তুত দারাশিকোহর (Dara Shikoh) মতাে সব নেতা সামুগড়ের যুদ্ধে ঐগুলাের যথােপযুক্ত ব্যবহারও করতে পারেননি। সংক্ষেপে বলা যায় যে, এটা ছিল ঢিলেঢালা গতির বিরুদ্ধে তৎপরতার, জড়তার বিরুদ্ধে উৎসাহসিকতার এবং জটিলতা ও অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে শওলার বিজয়।
দারাশিকোহ (Dara Shikoh) উদারনীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী ছিলেন। চিরাচরিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সুন্নী ইসলামের প্রতি তার বিরাগ ছিল বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন। শিয়া মতাবলম্বীদের তিনি পৃষ্ঠপােষকতা করতেন এবং উপনিষদ ও অথর্ব বেদ ফারসিতে অনুবাদ করে তিনি হিন্দুদের প্রীতিভাজন হন। শাহজাহান ধর্মভীরু ছিলেন এবং তার তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবও ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু দারাশিকোহকে শাহজাহান সমর্থন করলে দরবারের সুন্নী সম্প্রদায়ের উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পায়। কারণ এর ফলে সুন্নী প্রভাব স্তিমিত হয়ে শিয়া প্রভাব সুদূরপ্রসারিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই কারণে অমুসলমান নামে চিহ্নিত করে দারাশিকোহর বিরুদ্ধে সুন্নীরা আওরঙ্গজেবের পক্ষেই জোটবদ্ধ হয়।
আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ছিলেন সুন্নী মুসলমান এবং নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী। সুতরাং তার বিজয়ের জন্য সুন্নী মুসলমানগণ তার পক্ষে কাজ করেছিলেন। ভি ডি মহাজন উল্লেখ করেন,
“The orthodeox Muslims of India not, only prayed but also worked for his victory.”
আওরঙ্গজেবের সামরিক বিজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল মুঘল সম্রাজ্যের প্রজাবৃন্দ দারাশিকোহ (Dara Shikoh) ও অন্য শাহজাদাদের সমর্থন করেননি। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে অভিষেক উৎসবে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) বিনা বাধায় জনগণের সমর্থন লাভ করেন। এ ধরনের বিবিধ দিকের সমন্বয়েই আওরঙ্গজেব উত্তরাধিকার সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলেন।
সম্রাট শাহজাহান পুত্রের হাতে বন্দি হয়ে আট বছর জীবিত ছিলেন। এ সময় তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন কনৌজের সৈয়দ মুহম্মদ। এই ধার্মিক ব্যক্তি তাকে ধর্মতত্ত্ব শুনাতেন। তিনি তার অফুরন্ত সময়ের অংশ ইবাদত বন্দেগি ও নানাপ্রকার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যয় করতেন। তার শুশ্ৰষাকারিণী ছিলেন তার আদরের দুলালী জাহানারা। তিনি সুফী সাধক গরিব নওয়াজ খাজা মঈন উদ্দীন চিশতীর ভক্ত ছিলেন। তিনি পিতার পরিচর্যায় সময় অতিবাহিত করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বন্দিদশায় নানা দুঃখ-কষ্ট ও মর্মপীড়ার মধ্যে শাহজাহানের আটটি বছর কেটে যায়। অবশেষে ১৬৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে ৭৪ বছর বয়সে তিনি ইহলােক ত্যাগ করেন। অন্তিম ইচ্ছানুসারে তাঁকে তার প্রিয়তমা মহিষী মমতাজের পার্শ্বে সমাধিস্থ করা হয়। পিতার মৃত্যুর একমাস পর আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) আগ্রার প্রাসাদে ভগ্নী জাহানারার সাথে সাক্ষাৎ করেন। জাহানারা তাঁকে একটি পত্র দেন। জাহানারা আওরঙ্গজেবকে ক্ষমা করার জন্য পিতার নিকট আবেদন করেছিলেন। উক্ত পত্রে আওরঙ্গজেবকে ক্ষমা করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।
আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ও দারাশিকোহর মধ্যের যুদ্ধকে একদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্যদিকে উদার আদর্শবাদের লড়াই বলে ধরা যায় না। দারাশিকোহর সঙ্গে ভ্রাতৃঘাতী সংগ্রামে হিন্দুরা দারাশিকোহর দিকে আর মুসলিমরা আওরঙ্গজেবের পক্ষে লড়াই করেছিল বলে লিখেছেন স্যার যদুনাথ সরকার। এ এল শ্রীবাস্তবও অনুরূপ মন্তব্য করে লিখেছেন, দারাশিকোহ হিন্দুদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ও আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) অমুসলমানদের প্রতি তিক্ত শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। এই বক্তব্য সঠিক নয়।
১৬৫৮-৫৯ সালের উত্তরাধিকারের যুদ্ধে (সামুগড়ের যুদ্ধে) হিন্দু ও মুসলমান অভিজাতরা উভয়পক্ষেই প্রায় সমানভাবেই ছিল। রাজপুত রাজাদের ক্ষেত্রেও এটা ঘটে। শিয়ারাও সমানভাবে দু’পক্ষে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আতাহার আলি সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই যুদ্ধে ১০০০ জাট ও তার উপরের অভিজাতদের মধ্যে ২৭ জন ইরানি (মুসলিম) ছিলেন আওরঙ্গজেবের দিকে এবং ২৩ জন ইরানি ছিলেন দারাশিকোহর পক্ষে। অপরদিকে ২৩ জন হিন্দু অভিজাত আওরঙ্গজেবকে সমর্থন করেছিলেন, বিপরীতে ২৪ জন হিন্দু অভিজাত দারাশিকোহর পক্ষাবলম্বন করেছিল। এই তথ্য নিতান্ত ধর্মের ভিত্তিতে অভিজাতদের কোনও জোট হয়েছিল বলে প্রমাণ করে না। তাই যারা আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ও দারাশিকোহর লড়াইকে সাম্প্রদায়িক রঙে চিত্রিত করেন উপরােক্ত তথ্য তাদের বিরুদ্ধেই যায়। আসলে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) কোনাে সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষমূলক পদক্ষেপ নিলে তা তার উদ্দেশ্য সাধনে বিপর্যয় ডেকে আনত।
আওরঙ্গজেবের সময়ে রাষ্ট্রীয় আইনে মুরাদ ও দারাশিকোহ (Dara Shikoh) প্রাণদণ্ড হয় এবং সুজারও অসম্মানজনক মৃত্যু হয়। স্মর্তব্য যে, এসবই হয়েছে আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে বসার পরে। অথচ সিংহাসনে বসার পূর্বে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটলে তা আরও অর্থপূর্ণ হত এবং ‘সিংহাসনের জন্য ভাইদের হত্যা করেছিলেন’ অপবাদটির সারতা প্রমাণ হত। কিন্তু যখন তা হয়নি তখন অপবাদটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন। তােলা যায় বৈকি। কারণ সিংহাসনের জন্য হত্যা করলে তা সিংহাসন পাওয়ার পূর্বেই করা হত। পাশাপাশি অন্যচিত্রও রয়েছে, যা আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। দারাশিকোহর পুত্র সিপাহশিকোহকে ১৬৭৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে উপযুক্ত মনসব দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আওরঙ্গজেবের এক কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ দেওয়া হয়। দারাশিকোহ র কন্যা জানি বেগমের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মহম্মদ আজমের বিবাহ দেওয়া হয়। মুরাদের ছেলে ইজ্জত বখশকেও বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়ে মনসব দেওয়া হয় এবং আওরঙ্গজেবের আর এক কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ দেওয়া হয়। আওরঙ্গজেবের পরিবার ও পরাজিত ভাইদের সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের মধ্যে আরও অনেক বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছিল। এভাবে তৃতীয় প্রজন্মে এসে আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) ও তাঁর পরাজিত ভাইদের পরিবারগুলাে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
আওরঙ্গজেবের তিন ভাই ভারত রাষ্ট্রের অধিপতি হওয়ার পক্ষে অনুপযুক্ত ছিলেন। পিতার অত্যধিক স্নেহের ছায়ায় মানুষ হয়ে দারাশিকোহ (Dara Shikoh) যুদ্ধবিগ্রহ ও রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারে প্রায় অনভিজ্ঞ ছিলেন বলা চলে। সম্রাট শাহজাহান নিজের কাছে রেখে তাকে শাসন ব্যাপারে শিক্ষা দেন। শাসন বিষয়ক শিক্ষা ছাড়াও দারাশিকোহ (Dara Shikoh) সকল ধর্মে সার সংগ্রাহী মানসিকতা ছিল। তিনি হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে পড়াশুনা করেন। বেদ ও পুরাণের প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক ছিল। তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ছিল ‘সিয়ার-উল-আসরার’ (নিগঢ় রহস্য) বেদ, উপনিষদ ও হিন্দু দর্শন ছিল এর আলােচ্য বিষয়। তিনি আরও চারটি গ্রন্থ রচনা করেন—সাকিনাৎ-উল-আউলিয়া, সাফিনাৎ-উল-আউলিয়া, মাজমা-উল-বাহরাইন এবং বাবা লাল দাস। তার এতগুলাে রচনা দেখে বুঝা যায় যে, তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মৃদু চেষ্টাও তিনি করেন। কিন্তু পিতার আদরে তঁার সকল গুণাবলি নষ্ট হয়ে যায়। সমর কুশলতা, নেতৃত্ব ও কূটবুদ্ধির দিক থেকে তিনি অন্য ভ্রাতাদের তুলনায় নিম্নমানের ছিলেন।
দারাশিকোহর চঞ্চল স্বভাব এবং রুক্ষ মেজাজের জন্য দরবারের অনেকেই তার বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিলেন। উত্তরাধিকারের জন্য তার যােগ্যতার ব্যাপারে এডওয়ার্ড ও গ্যারেট মন্তব্য করেন:
“তার প্রয়ােজনীয় স্বাভাবিক যােগ্যতার সঙ্গে চারিত্রিক কিছু মারাত্মক দোষ ছিল, যা তার সাফল্যের ক্ষেত্রে বিরাট বাধার সৃষ্টি করে।”
যদুনাথ সরকার বলেন:
“যুদ্ধ ও শাসনকার্যের ক্ষেত্রে তার (দারাশিকোহ) কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। বিপদ ও সংকটের অতি কঠিন পরীক্ষায় মানুষকে বিচার করতে তিনি কখনও শিখেননি এবং তিনি কর্মরত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যােগাযােগ হারিয়ে ফেলেন। অতএব মুঘলদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক উপযােগীর টিকে থাকবার বাস্তব পরীক্ষা হিসাবে প্রচলিত সেই উত্তরাধিকারের যুদ্ধে তিনি অযযাগ্য বলে প্রমাণিত হন।”
স্যার লেনপুল বলেন,
“দারাশিকোহ ছিলেন দুর্বল, অভিমানী ও হঠকারী লােক; সুন্দর মনােভাব ও বিচিত্র মানসিক ভাবধারায় পরিপূর্ণ, কিন্তু কখনও নিজের বা অন্যের উপর প্রভুত্ব অর্জন করতে তিনি পারেননি এবং এমন মুহূর্তে নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন যখন ঠাণ্ডা বিচারশক্তির খুবই প্রয়ােজন। তিনি হয়ত একজন কবি বা অলৌকিক দার্শনিক হতে পারতেন কিন্তু কখনও ভারতের শাসক হতে পারতেন না।”
দারাশিকোহর অহংকারী স্বভাবের দ্বারা দরবারে তিনি অনেকেরই শত্রুতে পরিণত হন। দারাশিকোহর বিরুদ্ধে মদ্যপান ও ব্যাভিচারের অভিযোগও ছিল।
শাহ সুজা চরিত্রগত দিক থেকে আরও নীচ প্রকৃতির লােক। মানুষ হিসাবে তিনি সাহসী এবং বাংলার একজন সফল শাসনকর্তা। কিন্তু আমােদ-প্রমােদের প্রতি তার ঝোঁক অত্যন্ত প্রবল। এটা তার মানসিক গুণাবলিকে ধ্বংস এবং সঠিক মুহূর্তে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণে অসমর্থ করে দেয়। সুজার ধীরস্থির ভাবে কোনও কাজ করার ক্ষমতা ছিল না। মদ্যপানের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি তার অনেক সদগুণ নষ্ট করেছিল। মুঘল দরবারের ফরাসি চিকিৎসক বার্নিয়ার বলেন :
“তিনি তার আমােদ-প্রমােদের খাস দাস ছিলেন এবং একবার তিনি অসংখ্য নারী দ্বারা পরিবেষ্টিত হলে সারাদিন-রাত নাচে, গানে ও মদ্যপানে কাটিয়ে দিতেন।”
তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) নিঃসন্দেহে সবার চাইতে উপযুক্ত। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সৈনিক ও সেনাপতি। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অতুলনীয় যােগ্যতা থাকা সত্বেও তিনি একজন সাম্রাজ্যের সমস্ত সুন্নী অভিজাতদের আস্থাভাজন। তাছাড়াও তিনি একজন গভীর পরামর্শদাতা, কাজে সুনিপুণ এবং স্বভাবে শীতল ও ধীর-স্থির। কালীকিঙ্কর দত্ত বলেন :
“তিনি অসাধারণ শ্রমশীলতা এবং গভীর কূটনৈতিক ও সামরিক বুদ্ধিমত্তা এবং শাসনকার্যে অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।”
কূটনৈতিক জ্ঞান দ্বারা তিনি অনেক শত্রুর হৃদয় জয় করেন। সামুগড়ের যুদ্ধে তিনি গর্ব করতে পারেন যে, দারাশিকোহ (Dara Shikoh) সেনাবাহিনীর মধ্যে ৩০,০০০ তার (আওরঙ্গজেব) সমর্থক। রাজনীতির জটিলতা সম্বন্ধে তার যে অভিজ্ঞতা ছিল তা আর কারও ছিল না। শাহজাহানের পারিষদেরা জানতেন যে, আওরঙ্গজেবই সিংহাসনের যােগ্যতম উত্তরাধিকারী এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে হয়ত শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হবেন। বার্নিয়ার যথার্থই বলেন,
“তিনি ছিলেন একজন সুবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিক, একজন মহান নৃপতি এবং নানাধিক এবং অসাধারণ মেধার অধিকারী।”
মুরাদ বখস একজন সরল, উদার ও সিংহের ন্যায় সাহসী যুবরাজ। কিন্তু অত্যধিক মদ্যপান তাকে নেতৃত্বের জন্য অযােগ্য করে তােলে। রাষ্ট্র পরিচালনার কোনাে গুণই তাঁর ছিল না। স্যার লেনপুলের মতে,
“শাহজাহানের কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন একজন তেজস্বী আস্ফালনকারী। তিনি সিংহের মতাে সাহসী, দিনের মতাে স্পষ্টভাষী ও সাদাসিধা, রাজনীতিতে নির্বোধ, কূটনীতিতে হাতাশাগ্রস্ত এবং তরবারি পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত।”
লেনপুল আরও বলেন,
“যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন প্রবল ভীতি এবং বােতল-বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। পরামর্শে তিনি বােকা এবং লাম্পট্যে সীমাহীন।”
স্যার যদুনাথ সরকার তাঁকে ‘মােগল বংশের নষ্টমতি’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁকে সর্বত্র পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু সকল স্থানেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। রাজপুত্র ভাববিলাসী, চরিত্রহীন ও মদ্যপায়ী হলে রাষ্ট্রের পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
আওরঙ্গজেব (Aurangzeb) সিংহাসন লােভী ছিলেন না, বরং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেককে অকল্যাণ হতে রক্ষা করতে, সর্বোপরি ভারত রাষ্ট্রকে সমকালের জটিলতা হতে সঠিক দিশা দেখাতে অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনেতা হিসেবে তাঁকে উত্তরাধিকারীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী যুবরাজদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রভেদ সংঘর্ষকে প্রভাবান্বিত করে ঠিকই, কিন্তু উদারপন্থী এবং অদক্ষ সেনাধ্যক্ষ ও রাজনীতিক দারাশিকোহ (Dara Shikoh) বুদ্ধিমান আওরঙ্গজেবের সমকক্ষ ছিলেন না। আওরঙ্গজেবের উন্নতমানের সেনাপতিত্ব এবং কৌশলের নিকট অযােগ্য সুজা ও মুরাদকে বিপর্যস্ত হতে হয়।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।