বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অংশ সাহিত্য পত্রিকার দান বললে অত্যুক্তি হবে না। সাহিত্যের বর্ষ পরিক্রমায় এক এক ধারা এসেছে, প্রকাশিত হয়েছে এক একটি পত্রিকা। তৈরি হয়েছে নতুন লেখকগােষ্ঠী। প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে সম্পাদক ব্যক্তিত্ব। সচেতন সাহিত্যিক অভিপ্রায় কাজ করেছিল বলেই সাহিত্য পত্রিকা মানেই সাহিত্য আন্দোলন। সব আন্দোলন যেমন ফলপ্রসূ হয় না তেমনি সব পত্রিকা সমান ভূমিকা পালন করতে পারে না। ‘প্রবাসী’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘ভারতী’, ‘সাহিত্য’, ‘সবুজপত্র’, কল্লোল’, ‘প্রগতি’, ‘সওগাত’, ‘মােহাম্মদী’, ‘কালিকলম’, ‘সাধনা’, ‘পরিচয়’ প্রভৃতি বহু আশ্রয় বাংলা পত্রিকার মধ্যযুগে, যখন পাঠক ছিল স্বল্প, সাহিত্যের ধারাকে সচল ও প্রাণবন্ত রেখেছিলেন। সেই সময় এক একটি পত্রিকাকে ঘিরে গড়ে উঠত এক একটি আড্ডা, বলাবাহুল্য সাহিত্যিক আড্ডা। পরিচয়-এর কোন একটি বৈঠকে বুদ্ধদেব বসু, অন্নদাশঙ্কর রায়ের হাতে একটি পত্রিকা দেখেন। ভাষা ইংরেজি। ভেতরে শুধু কবিতা আর কবিতাবিষয়ক আলােচনা। মার্কিনি এই পত্রিকার নাম ‘Poetry’। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার আইডিয়া হয়তাে এই পত্রিকা থেকে অনুপ্রাণিত। বুদ্ধদেব বসুর কথায়,
“আমি জানি না সেটাই হ্যারিয়েট মনরাে -স্থাপিত শিকাগাের ‘পােইট্রি’ কি না—তখনও সেই বিখ্যাত পত্রিকাটির নাম শুনিনি, কিন্তু সেটাতেও ছিলাে শুধু কবিতা আর হয়তাে কিঞ্চিৎ কবিতা-সংক্রান্ত গদ্য। নমুনাটি উল্টেপাল্টে দেখে আমার মনের মধ্যে একটা উশকোনি জাগলাে এ রকম একটি কবিতাসর্বস্ব পত্রিকা বাংলায় কী বের করা যায়? তখন এ নিয়ে কথা বললাম না কারাে সঙ্গে, হয়তাে অসম্ভব ভেবে মনের তলায় চেপে দিয়েছিলাম কিন্তু সেই অঙ্কুর থেকেই ফল ফললাে প্রায় চার বছর পরে—আমার সে-সময়কার ঘনিষ্ঠতম সাহিত্যিক বন্ধু প্রেমেন আমার সঙ্গী, প্রধান উৎসাহদাতা বিষ্ণু দে ও সমর সেন।”
দু-একজন প্রধান কবি ছাড়া বাকি সবার কবিতাই তখনকার সাহিত্য পত্রিকাগুলােতে পাদপূরণের জন্য গল্প, প্রবন্ধের শেষে। ছাপা হত। কবিতার প্রতি এরকম শ্রদ্ধাহীন আচরণে পীড়িত বুদ্ধদেব বসু কবিতা, শুধু কবিতার সযত্ন প্রকাশনার জন্য কবিতা পত্রিকা (ত্রৈমাসিক) প্রকাশ করেন ১৪ই আর্থিন ১৩৪২-এ (অক্টোবর ১৯৩৫)। তখন সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র, সহকারী সম্পাদক সমর সেন। কবিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ছাড়া বিশেষ কোন মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। কবিতা প্রকাশের পটভূমিটি জানা যায় ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন ভাষ্য থেকে, “চলতি সাময়িকপত্রে নিজেদের কবিতা ছাপতে দিতে আজকালকার অনেক কবিই অনিচ্ছুক এবং এ-অনিচ্ছা অন্যায়ও নয়। কেননা অন্নিবাস মাসিকপত্রের পাঁচমিশেলি ভিড়ের মধ্যে সত্যিকারের ভালাে কবিতারও কেমন একটা বাজে ও তুচ্ছ চেহারা যেন হয়ে যায়। কবিতাকে যথােচিত গৌরবে বিশেষভাবে ছেপে থাকে এমন সাময়িকপত্র বর্তমানে দেশে বেশি নেই। অথচ আধুনিক কবিদের অনেকেই নতুন কবিতা লিখছেন— বাইরের পরিমণ্ডলী দূরে থাক, সব সময় নিজেদের মধ্যেও সেগুলাে দেখাশােনার সুবিধে হয় না।
এই কারণে আমরা একটি ত্রৈমাসিক কবিতা পত্র বার করতে বাধ্য হচ্ছি। পত্রিকার নাম হবে ‘কবিতা’ এবং তাতে থাকবে শুধু—কবিতা। আধুনিক শ্রেষ্ঠ কবিরা সকলেই এতে তাঁদের রচনা প্রকাশ করবেন। নবীন কবির ভালাে কবিতাও যতটা পাওয়া যায় প্রকাশিত হবে।” বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের যুগ্ম-স্বাক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল চিঠিটি।
আসলে ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদনা ছিল বুদ্ধদেব বসুর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের পূর্ণতা। জীবনের নানা পর্বেই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন তিনি। নােয়াখালিতে থাকার সময় হাতে লেখা মাসিক পত্রিকা ‘বিকাশ’ অথবা ‘পতাকা’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বার্ষিকী বাসন্তিকা (১৯২৭- ২৮), এই সময়ই ‘প্রগতি’ (১৯২৭-২৯) ছাড়াও ‘কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশের কিছুদিন পরে ‘বৈশাখী’ (১৩৪৮-৫২) নামে একটি বার্ষিকী প্রকাশ করেছিলেন, সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত এবং দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। পরে ‘বৈশাখী’র বেশ কিছু সংখ্যার সম্পাদনা করেছেন বুদ্ধদেব বসু নীহাররঞ্জন রায় এবং জ্যোতির্ময় রায়। এছাড়া ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত ‘চতুরঙ্গ’ ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র, প্রথম বছরটিতে হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ১৯৪২ সালে কিশােরদের উপযােগী বার্ষিকী ‘মধুমেলা’ প্রতিভা বসুর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রাণশক্তি ছিলেন বুদ্ধদেব বসুই।
‘কল্লোল’ পত্রিকায় আধুনিকমনস্ক সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশই প্রথম কবিতাকে অবজ্ঞা ও অসম্মানের স্থান থেকে উদ্ধার করে তাকে যথােপযুক্ত মর্যাদায় যথাযােগ্য স্থানে স্থাপন করতে উদ্যোগী হন। ‘কল্লোল’ ছাড়া অন্য যে-দুটি পত্রিকায় কবিতা গুরুত্ব সহকারে ছাপা হত সে-দুটি পত্রিকা হল, প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয়। কিন্তু দুটি পত্রিকাতেই কবিতা ছাপা হত অল্প পরিমাণে এবং পত্রিকা দুটির কোনােটিতেই নতুনদের প্রবেশাধিকার অবাধ ছিল না। ‘সবুজপত্র’ পত্রিকারও প্রধান কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু সেখানেও রবীন্দ্রনাথকে আলাদা কোনাে গুরুত্ব না দিয়ে। এই ব্যাপারটা আপত্তিকর মনে হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে সুধীন্দ্রনাথকে লেখেন,
“এককালে রাস্তার লােক ধরে কবিতা পড়ে শােনাতুম, এখন অন্যেরা ধরপাকড় করলেও পড়ে শােনাইনে। কেবল মনে একটু আপত্তি হয়, যখন strange bed-fellow -দের সঙ্গে আমার কবিতার মিলন ঘটাও। অনেক সময় অত্যন্ত অসবর্ণ ঠেকে। ভালমন্দর বিচারে নয় বর্ণভেদের বিচারে।”
এই চিঠি পাওয়ার পর সুধীন্দ্রনাথ ‘পরিচয়’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা আলাদাভাবে প্রকাশ করতে শুরু করেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা শুধুমাত্র কবিতারই পত্রিকা হওয়ায় কবিতাকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করার দিন শেষ হয়ে যায় এবং বিশেষ কারও কারও কবিতা গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
বাংলা কবিতার বিবর্তনের ধারায় আধুনিক কাব্য আন্দোলনের এক স্মরণীয় মাইল ফলক ছিল ‘কবিতা’-র আত্মপ্রকাশ। পত্রিকাটি ছিল তরুণ কবিদের নিজেদের মেলে ধরার এক উন্মুক্ত আসরের মতাে। চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন পরিচয়ের আচ্ছা ছিল পােশাকী। কিন্তু ২০২-এর (রাসবিহারী অ্যাভিনিউ) আড্ডা ঘরােয়া। সেই ঘরােয়া আড্ডায় বুদ্ধদেব বসু একদিন জানালেন তিনি একটি পত্রিকা বার করবেন। নাম ‘কবিতা’। তাতে থাকবে শুধু কবিতা এবং নিছক কবিতা সম্বন্ধে আলােচনা। তখন ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বসুমতী’র যুগ। সেইসব পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর প্রায় সব কবিতাই ছাপা হতাে পাদপূরণ হিসেবে। তাই ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্বন্ধে তাঁর (বুদ্ধদেবের) সেই যুগান্তকারী ঘােষণা আমাদের রােমাঞ্চিত করেছিল।” কবিতার প্রতি যথার্থ ভালােবাসার দায়বােধ থেকেই কবিতা পত্রিকার জন্ম হয়েছিল। তিরিশের দশকের কবিদের কবিতাবলির নিরন্তর প্রকাশ ও তাদের কবিতার আলােচনা-সমালােচনার মাধ্যমে আধুনিক কবিতার সমালােচনা পদ্ধতি প্রণয়নে কবিতা পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাছাড়া বাঙালি পাঠকের কাব্য রুচি বদলেও পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ‘কবিতা’তেই প্রকাশিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখ মুখ্য আধুনিক কবির অধিকাংশ কবিতা। এমনকি সমর সেন, সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে ‘কবিতা’কে ঘিরে। পত্রিকাটির আবির্ভাবলগ্নটি স্মরণীয় হয়ে আছে ‘দ্য টাইমস’-এর লিটারারি সা-িমেন্ট’-এ এডওয়ার্ড টমসনকৃত ‘BENGAL : A LAND MADE FOR POETRY’ শীর্ষক সমালােচনামূলক নিবন্ধের জন্য। কবিতা পত্রিকা সম্পর্কে বিশদ বক্তব্যের উপসংহারে এডওয়ার্ড টমসন জানিয়েছিলেন, “বস্তুত বর্তমান যুগ ও সর্বদেশের সাহিত্য সম্বন্ধে এই কবিরা এতই সচেতন যে তাদের রচনায় প্রতিনিয়ত সন্ধানী, পান্থ ও পথিকৃৎ মনের চিহ্ন পাওয়া যায়।…এই কবিরা এমন একটি আন্দোলনের প্রতিভূ, বাংলার এমনকি ভারতের চিন্তাকে যা নতুন রূপ দেবে…।”
প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, আরাে ক’জন অ-কবি বন্ধুর আর্থিক সাহায্যে পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রথম দুই সংখ্যা বিনামূল্যে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন পূর্বাশা প্রেস কর্তৃপক্ষ। ত্রৈমাসিক পর্যায়ে প্রকাশিত কবিতা পত্রিকার আবেদন ক্রমশ বাড়তে থাকল। এক সময় তার প্রাথমিক পরিকল্পনা অতিক্রম করে নিজে নিজেই বেড়ে উঠল। পরবর্তীকালে কবিতা পত্রিকা এমনই এক পরিচিতি লাভ করল যে, বাংলা ভাষার আধুনিক কবিতা ‘এই বিষয়টার একটা একান্ত রঙ্গমঞ্চ গড়ে উঠল যেন। বুদ্ধদেব বসু কয়েক জায়গায় বলেছেন কবিতা পত্রিকা যেন কবিতার পত্রিকা নয়, কবিদের পত্রিকা হয়ে গেছে। কবিতা পত্রিকা সম্পর্কে সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর বেশ কয়েকটি চমৎকার রচনা আছে। আর বুদ্ধদেব বসুর রচনা খানিক পড়লেই মনে হয় তার সারবস্তু অন্য কোনাে ভঙ্গিতে লিখে ঠিক বােঝানাে যাবে না। ‘কবিতা’ পত্রিকার ভূমিকা সম্পর্কে তার একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করার লােভ ছাড়তে পারলাম না,
“তিরিশের বছরগুলিতে যে সব কবিরা নতুন দৃষ্টি ও নতুন সুর নিয়ে এসেছিলেন, যাঁদের ক্রিয়াকলাপ, সন্দেহ নেই, রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কাব্যে প্রথম উল্লেখযােগ্য ঘটনা, তাদের বাহন ও প্রচারকরূপে আমাদের যাত্রারম্ভ।”
‘কবিতা’ পত্রিকার এই যাত্রা ছিল শুভ এবং বেশ জোরের সাথে বলা যায়, এই যাত্রা যখনই সমাপ্ত হল, তা সময়ের কাল থেকে যেমন দীর্ঘ তেমনি কাব্য আন্দোলনের দিক থেকে শুধু ফলপ্রসূই নয়, রীতিমতাে যুগান্তকারী। যে কোন সাহিত্য পত্রিকার জন্যে তা একটি বিরল ঘটনা। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন “আমার এই বৃত্তিটি নির্বাধ ছাড়া পেলাে ‘কবিতা’ বেরােবার পর, কেননা তখনই একের পর এক দেখা দিচ্ছেন নানা বয়সের নতুন ধরণের কবিরা, দেখা দিচ্ছেন বা প্রাপ্ত হচ্ছেন পরিণতি—বাংলা ভাষায় কবিতা লেখা কাজটি হয়ে উঠছে শুধু ব্যক্তিগত উচ্চাশা পূরণের উপায় নয়, রীতিমতাে একটি আন্দোলন’, যায় মুখপাত্র রূপে চিহ্নিত হয়েছে। ‘কবিতা’ পত্রিকা। আমি জানি না সেটা আন্দোলন না সমাপতন, কবিতা নিয়ে কোনাে ‘আন্দোলন’ সম্ভব কিনা সে বিষয়েও আমি নিশ্চিত নই, তবে অন্তত ‘কবিতা’ পত্রিকা এজন্যে কোনাে বিশেষ গৌরব দাবি করতে পারে না, আসল কথা, লগ্ন ছিলাে অনুকূল ও পত্রিকাটি ভাগ্যবান, আর আমার কৃতিত্ব হয়তাে এটুকু যে উৎসাহের ঝেকে দু-একবার ভুল করে থাকলেও মােটের উপর আমি ঠিক ঠিক ঘােড়াগুলিকেই ধরেছিলাম।
জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী দ্বিতীয় দফায় সমর সেন ও সুভাষ মুখােপাধ্যায়, প্রথম দশ বছরে যাঁরা অপর্যাপ্তভাবে প্রকাশিত ও আলােচিত হয়েছেন কবিতা’য় আর তারপর তৃতীয় কিস্তির নরেশ গুহ, অরুণ সরকার … এঁদের বিষয়ে …কিছু বলার প্রয়ােজন করে না।”
১৩৬৭-র চৈত্র সংখ্যাই কবিতা’-র শেষ সংখ্যা, সেটি ছিল পঞ্চবিংশ বর্ষের তৃতীয় সংখ্যা। তখন সম্পাদক এককভাবে বুদ্ধদেব বসু। তৃতীয় বর্ষের সূচনা থেকেই প্রেমেন্দ্র মিত্র আর সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন না ‘কবিতা’-র সঙ্গে, সমর সেনও সম্পাদকরূপে যুক্ত ছিলেন ১৩৪৭-এর পৌষ সংখ্যা পর্যন্ত। তারপর থেকে ১৩৬১-র আধিন সংখ্যা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বুদ্ধদেব একাই কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তারপর বছর চারেক (পৌষ ১৩৬১ থেকে পৌষ ১৩৬৫ সংখ্যা পর্যন্ত) সহকারী সম্পাদক হিসাবে নরেশ গুহ এবং ১৩৬৬-র পৌষ সংখ্যায় সহযােগী সম্পাদক হিসেবে জ্যোতির্ময় দত্ত যুক্ত থাকলেও প্রধানত সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন বুদ্ধদেবই। তবে, যৌথ বা একক—যেভাবেই সম্পাদনার দায়িত্বে থাকুন, সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের ভাষায় কবিতা ছিল একজনেরই হাত-ধরা—বুদ্ধদেব বসুর। তাতে অনেকের সহযােগ থাকলেও, আর কারাে হস্তক্ষেপ গ্রাহ্য হত না। সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের এই মন্তব্যের সমর্থন মেলে এই তথ্য থেকেও—বহু বছর পরে, বুদ্ধদেব যখন অধ্যাপনার দায়িত্ব নিয়ে আমেরিকায়, তখনও নরেশ গুহ ‘কবিতা’য় প্রকাশের জন্য প্রাপ্ত প্রতিটি কবিতা পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে নকল করে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন বুদ্ধদেবের অনুমােদনের জন্য। প্রতিটি কবিতার পাশে নরেশ গুহ নিজের মন্তব্য যােজনা করলেও, অনুমােদনের চূড়ান্ত নির্দেশ আসত প্রবাসী বুদ্ধদেবের কাছ থেকেই।
(২)
আধুনিক বাংলা কবিতার বিবর্তনে কবিতা পত্রিকাটির অশেষ ভূমিকার কথা বলতে গেলে প্রথম দিকের কয়েক বছরের কয়েকটি সংখ্যার কথা উল্লেখ করতে হয়। কবিতার প্রথম বছরের চারটি সংখ্যা বাংলার আধুনিক কাব্য-ইতিহাসে এমন একটি স্বাক্ষর রেখে গেছে যা কোনাে দিন মুছবে না। আধুনিক কবিতা যে নিছক একটা মানসিক বিলাস বা খামখেয়ালী বস্তু নয়—সে কথা ঐ চারটি সংখ্যা থেকেই বাঙালি পাঠকবর্গ অনুভব করেন। সেই সঙ্গে আবিষ্কার করেন এমন সব কবিকে যাঁরা ভবিষ্যতে কবিতার নানা দিক বিজয় করেছেন। যেমন জীবনানন্দ দাশ, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন, মনীশ ঘটক (যুবনা), সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুভাষ মুখােপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের অনেকের কবিতাই আগে নানা পত্রিকায় বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশিত হয়েছিলাে। কিন্তু কবির সম্মান তার পাননি। তাদের কবিতা নিয়ে ভালাে করে আলােচনাও হয়নি। কবিতা পত্রিকাই তাদের প্রথম কবি-সম্মান দেয়, তাদের কবিতা নিয়ে আলােচনা করে। কবিতার প্রথম বছরের সংখ্যাগুলিতেই যে-বিখ্যাত কবিতাগুলি ছাপা হয় তার মধ্যে আছে অজিত দত্তের ‘ন খলু ন খলু বাণঃ (‘সংহত করাে, সংহত করাে অয়ি, / যৌবন-বাণ তীর ভয়ঙ্কর’) (জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ (“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’) (সমর সেনের ‘স্মৃতি’ (আমার রক্তে খালি তােমার সুর বাজে’) (প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘নীল দিন’ (কত বৃষ্টি হয়ে গেছে,/কত ঝড়, অন্ধকার মেঘ/আকাশ কি সব মনে রাখে!’)( বিষ্ণু দে-র ‘বিবমিষা’ (তােমাকে রাখিয়া দূরে তবে মাের চিত্ত প্রাণ রাখে’) (বুদ্ধদেব বসুর ‘চিল্কায় সকাল’ (কী, ভালাে আমার লাগলাে আজ এই সকাল বেলায়/ কেমন করে বলি’) (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র ‘জন্মান্তর’ (আধখানা চাদ রূপার কাঠির পরশে’) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ (‘আবিনে সবাই গেছে বাড়ি’)।
তেত্রিশ পাতা জুড়ে শুধু কবিতা এবং সাত পাতার সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘কবিতার দুর্বোধ্যতা’—এই নিয়ে মােট চল্লিশ পাতার ক্ষীণকায় এবং বিজ্ঞাপনহীন ‘কবিতা’-র প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল। কিউবিস্ট ছাঁদে বিশাল অক্ষরে এর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী অনিল ভট্টাচার্য। প্রথম সংখ্যার কবি-তালিকায় ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, অজিতকুমার দত্ত, প্রণব রায়, স্মৃতিশেখর উপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বাগচী।
সেকালে আধুনিক কবিতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তে অভ্যস্ত বাঙালি পাঠকের যেটি প্রধান আপত্তি ছিল। তাকে ভাঁজে ফঁজে খুলে, আধুনিক কবিতার মূল দর্শনটির সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল—সম্ভবত এই প্রথমবার। এই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ থেকে কিছু অংশ উদ্ধার করলে বােঝা যাবে যে, এই পত্রিকা আধুনিক কবিতার সপক্ষে লড়াই করবার জন্য প্রস্তুত হয়েই আসরে নেমেছে। আধুনিক কবিতার বি(দ্ধে প্রথম ও প্রধান অভিযােগ যে দুর্বোধ্যতা, তার উত্তরে । লেখা হল,
“এখন বলতে গেলে, কবিতা সম্বন্ধে ‘বােঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা ‘বুঝিনে’, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু বােঝায়’ না স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযােগ। ভালাে কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা বােঝা যাবে না, বােঝানাে যাবে না। যে-কবিতা বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে বােঝা যায় তার উচ্চতম রূপ আঠারাে শতকের ইংরেজি কবিতা তাতে আর সবই আছে, কবিতা নেই।”
‘কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি পড়ে একটি লক্ষণ আবিষ্কার করা যায়। এই সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসুর ‘চিল্কায় সকাল’ কবিতাটি বেরিয়েছিল, চিল্কা ভ্রমণে গিয়ে এটি লিখেছিলেন তিনি। কবিতাটি আমরা উদ্ধৃত করতে পারি,
“কী ভালাে আমার লাগলাে
আজ এই সকাল বেলায়।
কেমন করে বলি।…
কী ভালাে আমার লাগলাে
এই আকাশের দিকে তাকিয়ে
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা,
কুয়াশায় ধোঁয়াটে, মাঝখানে চিল্কা উঠছে ছিলকিয়ে।
তুমি কাছে এলে,
একটু বসলে,
তারপর গেলে ওদিকে,
ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে,
তা-ই দেখতে। গাড়ি চলে গেলাে।
—কী ভালাে তােমাকে বাসি,
কেমন করে বলি।
মুখে মুখে রাখিই যদি,
এমন আর দোষ কী বলাে?
মনেরে যায় না ছোঁয়া,
কেমনে চাখবাে তারে।।
দুটি ঠোট—ফুরফুরে ঠোট,
টুকটুক-রঙিন হলাে,
ঠোকরাই পাখির মতাে,
খুটখুট চার কিনারে।
চারদিক ঠুকরিয়ে খাই,
দুটি ঠোট ফলের মতাে,
ঐ মুখ ফুলের মতাে ফুটেছে
আমার পানে খুলে দাও চুলের বােঝা ঝপাঝপ ইতস্তত,
ফুটফুট নরম বুকে টেনে নাও বাহুর টানে।
লােকজন জড়াে হােক,
প্রাণপণে চঁাচাক শিশুরা,
মায়ের মেজাজ হােক আকাশের রােদের মতন—
আমার কী এসে যায়?
তুমি বসে আছাে মাের কাছে
ভিজে তব চুলগুলি ঘরখানি ঠাণ্ডা, পরিস্কার।…
মােদের বাড়িতে বড়াে লােকজন
—বিষম বিভ্রাট— একটু সময় হবে?”
পাশাপাশি ছিল বিষ্ণু দে-র পাঁচটি কবিতা। পঞ্চম কবিতার শেষ ক’টি পঙক্তি এই রকম,
“আমরা যে অতি সুখী সকলেই বলে,
আমাদের উভয়ের প্রেমের গৌরব সকলের মুখে শুনি।
লােকমুখে চলে।
আমাদের উভয়ের হৃদয়ের উৎসব।
সুযােগ পেয়ে তাে তবে পাশাপাশি মিলি?
আমাদের ভালবাসা রিফ্লেক্স্ লিলি।”
এবং সমর সেনের ‘প্রেম’ নামক কবিতাটি, যার শেষ পঙক্তিগুলি এই রকম,
“সমস্ত দিন, আর সমস্ত রাত্রি ভরে—
তােমাকে পাবার বাসনা
বিষাক্ত সাপের মতাে।”
প্রথম সংখ্যাতেই ছাপা হল জীবনানন্দ দাশের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটিও। তার প্রথম স্তবক।
“আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতাে যেন
হায় তারা সব আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভরে গেছে যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাদ—কোনাে সাধ নাই তার ফসলের তরে …”
‘কবিতা’র প্রথম বছরের দ্বিতীয় তথা পৌষ সংখ্যাতেই ছাপা হয় জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ (১৩৪২) নামক বিখ্যাত কবিতাটি, আজ থেকে সাতাত্তর বছর আগে। কবিতা যারা খুব বেশি পড়েননি, তারাও এই কবিতাটি নিশ্চিতভাবেই হয়তাে পড়েছেন বা শুনেছেন। কবিতাটির প্রথম স্তবক,
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি বিম্বিসার অশােকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি আরাে দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”
১৯৪২ সালে বুদ্ধদেব বসুরই প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা ‘কবিতাভবন’ থেকে ‘বনলতা সেন’ কবিতা-সংকলনটি প্রকাশিত হয়। ‘কবিতা’তেই সংকলনটির প্রথম সমালােচনা বেরিয়েছিল “জীবনানন্দ যখন বলেন—…বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখীর নীড়ের মতাে চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। তখনই যেন বুঝতে পারি তার মন কীভাবে কাজ করছে। নাটোরের বনলতা সেনের যে-চোখের সঙ্গে পাখির নীড়ের উপমা নেই নাটোর, বনলতা সেন এবং তার চোখ এ-সমস্তই যে। কোনাে সর্বদেশকালব্যাপী ভাবের উপমা মাত্র তা উপলব্ধি করে আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না।” প্রথম বছরের ২য় সংখ্যাতে প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত সম্পদকীয় আধুনিকতার মােহ’, যাতে তিনি লিখেছিলেন, “যত দিন যাচ্ছে, ততই স্পষ্ট করে উপলব্ধি করছি যে কাব্য ও সাহিত্য সম্বন্ধে আমার ধারণা কিছু সেকেলে। কেননা এখনাে আমি কাব্যবিচার করি আমার ভালাে-লাগা মন্দ লাগা দিয়ে, এবং ঈশ্বর যদি সহায় হন, বাকি জীবন তা-ই করবাে। …কোনাে কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের নিঃস ভারি হয় … কোনাে কবিতা একবার পড়বার পর আমাদের সমস্ত দিন রাত্রিকে হানা দেয়, তারপর কোনাে অলস মুহূর্তে বিদ্যুৎ-ঝলকে তার গূঢ় রহস্য উপলব্ধি করে সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে ওঠে।” এবং এই সংখ্যাতেই ছাপা হয় রবীন্দ্রনাথের চিঠি ‘গদ্যে পদ্যছন্দের কারুশিল্প-কৌশলের বেড়া নেই দেখে কলমকে অনায়াসে দৌড় করাবার সাহস অবারিত হবার আশঙ্কা আছে। কাব্য ভারতীর অধিকারে সেই স্পর্ধা কখনােই পুরস্কৃত হতে পারে না।…তােমরা ফঁাড়া এড়িয়ে গেছ।
কবিতার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর ‘বিচিত্রা’য় ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় একটি সমালােচনা লেখেন—
“কবিতার প্রথম সংখ্যা আমাদের সামনে এল। এমন সুন্দর ছাপান ও বাঁধানাে কোনাে পত্রিকা হাতে পড়লে প্রাণটা খুশি হয়ে ওঠে। তার উপর বিষয় হল কবিতা, কেবল কবিতা। …’কবিতা’ পত্রিকাটি (ছন্দ ভিন্ন) আধুনিক মনােভাবের পরিচয় জ্ঞাপন পত্রিকা হিসেবে হয়নি, কিন্তু একটি উৎকৃষ্ট কবিতা সংগ্রহ হয়েছে, যাতে প্রত্যেক নামজাদা তরুণ কবির অপ্রকাশিত কবিতা স্থান পেয়েছে, যার মূল্য আমার মতে, আজকালকার যে কোন তরুণ ইংরেজ কবির রচনা অপেক্ষা কোনাে অংশে কম নয়।”
দ্বিতীয় বছরে (১৩৪৩-৪৪) ‘কবিতা’য় জীবনানন্দের তেরােটি কবিতা ছাপা হয়, সমর সেনের পাঁচটি, রবীন্দ্রনাথের তিনটি কবিতা এবং ‘গদ্যকাব্য’ নামে প্রবন্ধ ও সমর সেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কয়েকটি কবিতা’র উপর বুদ্ধদেববাবুর বিখ্যাত সমালােচনা ‘নবযৌবনের কবিতা’। তাই বলি, বুদ্ধদেব বসু যদি কবিতা পত্রিকা প্রকাশ না-করতেন এবং সমর সেনের কবিতা নিয়ে উক্ত দীর্ঘ প্রবন্ধ না লিখতেন তাহলে তখনকার দিনের সমর সেন হয়তাে অমন উৎসাহে অত কবিতা লিখতেন না এবং তাঁর কবিতার। প্রতি বিদগ্ধ সমাজের দৃষ্টি পড়তাে না। কবিতা, পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ছিল সমর সেনের চারটি কবিতা ‘অমর স্ট্যান্ডস আপন ইউ’, ‘মুক্তি’, ‘স্মৃতি’, ‘প্রেম’। কবিতাগুলি পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উদার মন্তব্য জানিয়েছিলেন চিঠিতে, “সমর সেনের কবিতা কয়টিতে রূঢ়তার ভিতর দিয়ে কাব্যের লাবণ্য প্রকাশ পেয়েছে। সাহিত্যে এঁর লেখা ব্ল্যাকসই হবে বলেই বােধ হচ্ছে।” উত্তরে পুলকিত বুদ্ধদেব লিখেছিলেন, “.. সমর সেনের কবিতা আপনার ভালাে লেগেছে জেনে বিশেষ খুশি হলাম। এঁর বয়েস অল্প, লিখছেন অল্প দিন ধরে, কিন্তু এঁর কবিতা প্রথম দেখেই আমার মনে হয়েছিলাে বাঙলা গদ্যছন্দে সম্পূর্ণ নতুন একটি সুর ইনি ধরেছেন। তাছাড়া যেটা প্রকৃত কাব্য-বস্তু, তারও অভাব নেই। এঁর পরিচয় দিলে আপনি চিনবেন, ইনি ডক্টর দীনেশ সেনের পৌত্র ও শ্ৰীযুক্ত অরুণ সেনের পুত্র। এখনাে এঁর ছাত্রাবস্থা, এবং ছাত্র হিসেবেও ইনি পয়লা নম্বরের।
সমর সেনের প্রতি বুদ্ধদেবের এই আসক্ত সমর্থনের মাত্রা কোনােদিনই কমেনি। ‘কবিতা’য় সমর সেনের বই-এর আলােচনা করেছেন, অন্য কারাে আলােচনা ছাপিয়েছেন, সমর সেনের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন কবিতায়।
‘কবিতাভবন’ থেকে বেরিয়েছিল সমর সেনের চার বই ‘কয়েকটি কবিতা’, ‘গ্রহণ’, ‘নানাকথা’, ও ‘খােলাচিঠি’। প্রথম বইটি সমর সেন এবং কবিতাভবনে’রও প্রথম কবিতা-প্রকাশনা। বইটির যে-বিজ্ঞাপন বুদ্ধদেব ছাপিয়েছিলেন কবিতা’য় তা থেকেও বােঝা যাবে, সমর সেনের মতাে একজন তরুণ কবির সামর্থ্যে তার সসম্মান আস্থার প্রকাশে কত অবারিত আর মনস্ক ছিলেন তিনি।
সেই বছরেরই চৈত্র সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু আর একটি আশ্চর্য প্রবন্ধ লেখেন জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র উপর। আলােচনামূলক প্রবন্ধটির নাম ‘প্রকৃতির কবি’। জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে আজকের দিনে প্রশংসার জয়ধ্বনি উঠেছে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু-ই প্রথম তাঁর কবিতা সম্বন্ধে আলােচনা করে সবিস্তারে বােঝালেন আধুনিক অর্থে প্রকৃতির কবি কাকে বলে, জীবনানন্দের ছন্দের বিশেষত্ব ঠিক কোনখানে …এই আলােচনা আমি দীর্ঘ করলুম কেননা জীবনানন্দ দাশকে আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান কবি বলে বিবেচনা করি, এবং ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ তাঁর প্রথম পরিণত গ্রন্থ। আমার নিজের তাঁর কবিতা অত্যন্তই ভালাে লাগে, কিন্তু আশা করি নেহাই আমার ব্যক্তিগত অভিরুচির দ্বারা এই মতামত গঠিত হতে দিইনি। আমাদের দেশে কোনাে ক্ষেত্রেই কোনােরকম স্ট্যাণ্ডার্ড নেই, সাহিত্যে একেবারেই নেই। প্রতিভা হয় অবজ্ঞাত, তৃতীয় শ্রেণীর কবি অভিনন্দিত হন অসাহিত্যিক কারণে। আমাদের মূল্যজ্ঞানহীন সমাজের মূঢ়তাকে মাঝে-মাঝে নাড়া দেয়াই দরকার। এ-দেশে মাতৃভাষার সাহিত্যকে যাঁরা শ্রদ্ধা করে ভালােবাসেন (যদি আজকালকার দিনে এমন কেউ থাকেন) তারা ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ নিজের গরজেই পড়বেন, কারণ এ-বইয়ের পাতা খুললে তাঁর একজনের পরিচয় পাবেন যিনি প্রকৃতই কবি, এবং প্রকৃত অর্থে নতুন। বিশেষ করে, ‘শকুন’, ‘পাখীরা’ ‘অবসরের গান’, ‘মৃত্যুর আগে’, ‘ক্যাম্পে’, এসব কবিতা পড়ে তারা স্বতঃই উপলব্ধি করবেন যে বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে এক অপূর্ব শক্তির আবির্ভাব হয়েছে।…” এইভাবে অজস্র লিখেছেন তিনি, জীবনানন্দ সম্পর্কে— সেই ১৯২৭২৮ থেকে ১৯৫৪-৫৫ পর্যন্ত। তর্ক করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, পংক্তি ধরে ধরে বিশ্লেষণ করেছেন, ভঁজে ভাঁজে উন্মােচন করে দেখিয়েছেন জীবনানন্দের রহস্য। আজ বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দের যে প্রতিষ্ঠা আমরা দেখতে পাই, তার ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, একথা বললে অত্যুক্তি করা হয় না। বুদ্ধদেব না থাকলে জীবনানন্দের কবিতা আদৌ প্রকাশিতই হত কিনা সন্দেহ। অন্তত আর কেউ যে এইভাবে তার কবিতা ছাপেননি, সে তথ্য তাে স্বপ্রকাশ। জীবনানন্দের জীবিতকালে গ্রন্থবদ্ধ তার ১৬২টি কবিতার মধ্যে ১১৪টি কবিতা ছাপা হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রগতি’ অথবা ‘কবিতা’ অথবা ‘বৈশাখী’ পত্রিকায়। জীবনানন্দকে ‘নির্জনতম কবি’ আখ্যা তাঁরই দেওয়া।
‘কবিতা পাঠক’ নামক সম্পাদকীয়টিতে (আষাঢ় ১৩৪৩, কবিতা) বুদ্ধদেব আক্ষেপ করেছিলেন যে, অনেকে যেমন বর্ণান্ধ হয়ে জন্মায় তেমনি অনেকেই ‘কবিতাবধির’ হয়েও জন্মায়, তবু উপসংহারে আশা করেছিলেন,
“কবি তৈরী করা যায় না, কিন্তু অনুকূল অনুষঙ্গে কবিতার পাঠক তৈরী হতে পারে। ভালাে পাঠকের সংখ্যা অল্প, কিন্তু বাড়ানাে যেতে পারে এবং ভালাে পাঠক যত বেশি হয় কবির ও কবিতার পথে ততই ভালাে।”
রবীন্দ্রনাথের ‘পত্রপুট’ কাব্যের সমালােচনাতেও বুদ্ধদেব আপত্তি করেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘সমাসে, সন্ধিতে, অনুপ্রাসে, অমৌখিক সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার নিয়ে তবে, আলােচনায় এ কথাও বলেছেন যে, ‘পত্রপুট’-এর কবিতায় তিনি গীতিকবিতার ইঙ্গিতের ঐধৰ্য্য আশা করেননি, তার বদলে কবিতায় খুঁজে পেয়েছেন ‘বিশাল চিন্তার প্রসারিত ডালপালার মর্মর’, পেয়েছেন ‘যত দ্বন্দ্ব যত সমস্যার মেঘ পশ্চিমের সূর্যের চারদিকে ঘন হয়ে এসেছে, তারই অপূর্ব বিচ্ছুরিত বর্ণচ্ছটা।’
‘কবিতা’র তৃতীয় বছরে সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হয় শুধু বুদ্ধদেব বসু এবং সমর সেনের। প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদনা ছেড়ে দেন এবং একটি কবিতা লেখেননি। এই বছরেই সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের দুটি কবিতা সেখানে ছাপা হয়। বুদ্ধদেব বসুর মহৎ একটি গুণ—সব লেখাই যত্ন করে পড়তেন এবং যার মধ্যেই কবিত্বশত্তির ইঙ্গিত পেতেন তাকেই তিনি সাদরে কবিতার আসরে স্থান দিতেন। এই বছরের আর্কিন সংখ্যায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘ক্রসী’র উপর তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে লেখেন সুধীন্দ্রনাথের কবিতা সম্বন্ধে আমার স্বাভাবিক সহানুভূতির অভাব তাঁর ও আমার মেজাজে মিল নেই। তবু এ-কথা বলতেই হবে যে যখনই তাঁর কবিতা পড়ি তখনই মনে মনে প্রশংসা না করে পারিনে। ভবিষ্যতে বুদ্ধদেব বসু অবশ্য তাঁর কবিতার অত্যন্ত অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন। কেন এবং কী করে, সেটা মস্ত বড়াে প্রশ্ন। সে-প্রশ্নের উত্তর একমাত্র বুদ্ধদেব বসু-ই দিতে পারেন।
আধুনিক কবিতা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও ধারা-প্রবণতা নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ‘কবিতা’। এ েত্রে উল্লেখযােগ্য তৃতীয় বর্ষের কবিতা’-র বিশেষ সমালােচনা-সংখ্যাটি। বৈশাখ ১৩৪৫-এ প্রকাশিত এই সংখ্যাটিকে ‘আধুনিক বাংলা কবিতার ইস্তাহার’ বলা চলে। সেই সঙ্গে এটি আধুনিক কবিতা আন্দোলনের নানামুখিনতার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব, অজিত দত্ত, সমর সেন প্রভৃতি বাংলা কবিতার সমকালীন প্রাণপুরুষেরা নানা দিক থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার আলােচনা করেছিলেন এই বিশেষ সংখ্যাটিতে। এই সংখ্যার বিশিষ্ট প্রবন্ধগুলি ছিল—
‘সাহিত্যের স্বরূপ’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘কবিতার কথা’ জীবনানন্দ দাশ। ‘বাংলা মিলের দুরূহ তত্ত্ব’ অজিত দত্ত। ‘স্বগত’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলা কবিতা সমর সেন। ‘কাব্যের বিপ্লব ও বিশ্বেবের কাব্য’ আবু সয়ীদ আইয়ুব। ‘কবি ও তার সমাজ’ বুদ্ধদেব বসু। ‘সম্পাদক সমীপে’ বিষ্ণু দে। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ লীলাময় রায়। ‘কবিতার অনুবাদ’ হমফ্রি হাউস। ‘কবিতার পাঠকদের প্রতি’ হুমায়ুন কবির।
‘কবিতা’র চতুর্থ বছরে (আশ্বিন ১৩৪৫-আষাঢ় ১৩৪৬) অমিয় চক্রবর্তীর ‘খসড়া’-র উপর বুদ্ধদেব বসু একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। ইতােপূর্বে অমিয়বাবুর কবিতা নিয়ে কোথাও দীর্ঘ কোনাে আলােচনা হয়নি। বুদ্ধদেব বসু লেখেন ‘বিস্ময়কর বই …প্রংক্তিতে পংক্তিতে মন চমকে ওঠে। …কিছুরই সঙ্গে এ কাব্য মেলে না…এ একেবারেই আধুনিক, একেবারেই অভিনব। …আঙ্গিকের দিক দিয়েও তাঁর কাব্য অতি দুঃসাহসিক। কিন্তু এটাও বলতে হবে যে, অতি দুঃসাহসিক হবার অধিকারও তার আছে।
চতুর্থ বছরের আষাঢ় সংখ্যায় অজিত দত্তের ‘পাতাল কন্যার’ উপর একটি নাতিদীর্ঘ সমালােচনায় বুদ্ধদেব বসু লেখেন ‘আজকের দিনেও যদি ভালাে রােমান্টিক কবিতা লেখা হয়ে থাকে, তাতেই প্রমাণ করে যে রােমান্টিক যুগ এখনাে শেষ হয়নি। …কবিতাগুলি ভালাে, আশ্চর্য রকম ভালাে। … ব্যক্তিগত হতাশা বা আলস্যকে তিনি (অজিত দত্ত) তার ভবিষ্যৎ কাব্যসৃষ্টির অন্তরায় হতে দেবেন না, এ শুধু আমাদের আশা নয়, দাবি। বুদ্ধদেব বসুর সমালােচনার এটাই বিশেষত্ব—সমালােচনা প্রসঙ্গে লেখকদের ত্র(মাগত উৎসাহ দেওয়া, যেটা সম্পাদকের প্রধান কর্তব্য এবং সমালােচকেরও।
‘কবিতা’র পঞ্চম বর্ষ ও (আশ্বিন ১৩৪৬-আষাঢ় ১৩৪৭) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য, কারণ এবছর থেকেই রবীন্দ্র-রচনাবলীর উপর বুদ্ধদেব বসুর অনবদ্য সমালােচনা প্রকাশিত হতে শুরু করে। ‘কবিতা’ ত্রৈমাসিক পত্রিকা হলেও একটি বিশেষ কার্তিকসংখ্যা এ-বছর প্রকাশিত হয়। এই বিশেষ সংখ্যায় বিষ্ণু দে এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একই নামের দুটি কবিতা বেরােয় এ-যুগের চাঁদ হলাে কাস্তে। ‘কবিতা’র আড্ডাতেই একদিন একই লাইন নিয়ে দু-জন কবিকেই এক-একটি করে কবিতা লেখার অনুরােধ করা হয়, দু-জন কবিই সেই অনুরােধ রক্ষা করেন, ফলে দু-টি সুন্দর বাংলা কবিতার জন্ম।
‘কবিতা’র ষষ্ঠ বছর (আবিন ১৩৪৭-আষাঢ় ১৩৪৮) থেকে সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হয় শুধু বুদ্ধদেব বসুর। সেই বছরেই ‘কবিতাভবন’ থেকে আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্র মুখােপাধ্যায় যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামের এক সংকলন। এই সংকলন গ্রন্থটির প্রকাশের মূলে কিন্তু ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। অতুলচন্দ্র গুপ্ত ‘কবিতা’র বিশেষ কার্তিক-সংখ্যায় এই গ্রন্থের এক দীর্ঘ সমালােচনা করেন। সেই বছরেই প্রকাশিত হয় সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের প্রথম কবিতার বই ‘পদাতিক’। কবিতা’র পৌষ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু প্রায় ১৭ পাতা ধরে বইটির একটি আশ্চর্য সমালােচনা লেখেন। বললেন,
“দশ বছর আগে বাংলার তরুণতম কবি ছিলাম আমি। কিন্তু ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ বেরােনাের পর থেকে সে-সম্মান হলাে বিষ্ণু দে-র ভােগ্য, যতদিন না সমর সেন দেখা দিলেন তার কয়েকটি কবিতা নিয়ে। সম্প্রতি এই ঈর্ষির্তব্য আসন সমর সেনেরও বেদখল হয়েছে, বাংলার তরুণতম কবি এখন সুভাষ মুখােপাধ্যায়।”
একথা সুভাষ মুখােপাধ্যায় নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে, বুদ্ধদেব বসুর এই প্রবন্ধটি কবি হিসেবে তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে খুব সাহায্য করেছিল। একথাও তিনি মানবেন যে তাঁকে কবিতা লিখতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, যেমন তিনি উৎসাহিত করেছিলেন সমর সেনকে। বুদ্ধদেব বসু তার প্রবন্ধে লেখেন,
“এ-কবির ভবিষ্যৎ আমাদের সকলের আশার স্থল। ‘পদাতিক’-এর দুটি দিকই আমি দেখেছি প্রথমে সরল, চড়া গলার কবিতা, ‘গণ’-কবিতা হবার যা দাবী রাখে, অন্যদিকে জটিল আঙ্গিকের সংস্কৃতিবান কবিতা। দু’দিক বজায় রাখা চলবে না, একদিক ছাড়তে হবে। কবি কোন দিক ছাড়বেন?”
উল্লেখ্য, বুদ্ধদেব বসু একেবারে গােড়া থেকেই সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের অনুরাগী পাঠক। আষাঢ় ১৩৪৫ (জুলাই ১৯৩৮) সংখ্যার কবিতায় তাঁর কবিতা প্রথম প্রকাশ করেন বুদ্ধদেব— তখন তিনি লিখতেন সুভাষচন্দ্র মুখােপাধ্যায় নামে। এর বছর খানেক আগে থাকতে তিনি নানা পত্রিকায় লিখতে আরম্ভ করেছেন। কবিতা পত্রিকায় তার লেখা বেরিয়েছে কার্তিক ১৩৪৯ সংখ্যা পর্যন্ত—তারপর সম্ভবত রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে সুভাষ ‘কবিতাভবন’ থেকে দূরে সরে যান। এই ‘পদাতিক’ বই বেরােবার সময় বুদ্ধদেব বিশেষ অনুরাগী ছিলেন তাঁর কবিতার। এক কপি বই রবীন্দ্রনাথকেও পাঠালেন, সঙ্গের চিঠিতে লিখলেন,… আমি নিজে সুভাষের কবিতার বিশেষ অনুরাগী, এত অল্প বয়সে এতখানি শক্তির প্রকাশ আমার তাে বিস্ময়কর মনে হয়। …” তিনি ‘কালের পুতুল’ গ্রন্থে আরও বললেন …অভিনন্দন তাকে আমরা জানাবাে কিন্তু তা শুধু এই কারণে। নয় যে তিনি এখন কবিকনিষ্ঠ৷ কিংবা নিছক এ-কারণেও নয় যে তার কবিতা অভিনব যদিও তার অভিনবত্ব পদে-পদেই চমক লাগায়। তাঁর সম্বন্ধে সব চেয়ে বড়াে কথা এই যে মাত্র কয়েকটি কবিতা লিখে তিনি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করেছেন যে তিনি শক্তিমান।..
সুভাষ মুখােপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখ্যযােগ্য প্রথমত, তিনি বােধহয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে জীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি, প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না।… দ্বিতীয়ত, কলাককৌশলে তার দখল এতই অসামান্য যে কাব্য রচনায় তার চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি।”
সপ্তম বর্ষের ‘কবিতা’র (আশ্বিন ১৩৪৮-আষাঢ় ১৩৪৯) আর্বিন-সংখ্যার প্রথম পাতাতে একটি ক্রোড়পত্র ছাপা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জন্ম ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮, মৃত্যু ২২ শে শ্রাবণ ১৩৪৮। রবীন্দ্রনাথের তিরােধান সম্বন্ধে রচনাটি এই বলে বুদ্ধদেব বসু শেষ করেছেন,
“…তাকে হারিয়ে আজ যতই শােকাকুল হই একথা কিছুতেই মুখে আনতে পারবাে না যে তিনি নেই। আমাদের প্রাণে যেখানে তিনি জ্বলছেন, সেখানে তিনি স্মৃতি নন, ইতিহাস নন, সেখানে তিনি জীবন্ত, তিনি মনােগােচর, এমনকি ইন্দ্রিয়গম্য। তা যদি হবে তাহলে আমরা বেঁচে থেকে সকল কাজকর্ম করে যাচ্ছি কেমন করে?”
‘কবিতা পত্রিকার কার্তিক-পৌষ ১৩৫১ যুগ্ম সংখ্যাটি ‘নজরুল সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংখ্যায় নজরুলের হস্তান্তর, গ্রন্থপঞ্জি, দুটি অপ্রকাশিত গান ছাড়াও নজরুল সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখলেন জীবনানন্দ দাশ, লীলাময় রায় ও আনওয়ারুল ইসলাম। স্মৃতিকথা লিখলেন নলিনীকান্ত সরকার ও সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। প্রথম প্রবন্ধটিতে নজরুলের মূল্যায়ণ করলেন বুদ্ধদেব,
“…বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরে সবচেয়ে বড়াে কবিত্বশক্তি নজরুল ইসলামের। তিনি যখন সাহিত্য ক্ষেত্রে এলেন তখন সত্যেন্দ্র দত্ত তার খ্যাতির চরম চূড়ায় অধিষ্ঠিত, তার প্রভাব সে সময়টায় বােধহয় রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে। নজরুলের রচনায় সত্যেন্দ্রীয় আমেজ ছিলাে না তা নয়—কেনই বা না থাকবে—কিন্তু প্রথম থেকেই তিনি তাঁর স্বকীয়তা সুস্পষ্ট এবং প্রবলভাবে ঘােষণা করেছিলেন।”
এই সঙ্গে এই সংখ্যা এবং পরবর্তী আষাঢ় ১৩৫২ সংখ্যা ধরে বেরােল নজরুলের ১৮০০ গানের বর্ণনুক্রমিক সুচি—নজরুলের গানের সম্পূর্ণ একটি তালিকা তৈরি করবার প্রথম প্রয়াস। এই কাজেও বুদ্ধদেবই পথিকৃৎ।
আষাঢ় ১৩৬০-এ কবিতা প্রকাশিত হল দ্বিভাষিক সংখ্যা হিসেবে। চোদ্দজন বাঙালি (তার মধ্যে একজন পূর্ব পাকিস্তানের) কবি ও একজন ইংরেজ কবির মূল কবিতা—তাছাড়া বারােজন বাঙালি কবির কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আরাে ছিল দুটি মুণ্ডা কবিতা ও চারটি সাঁওতাল গানের অনুবাদ। এই নিয়ে উপস্থিত হল দ্বিভাষিক সংখ্যা। সম্পাদকীয়তে লেখা হল (বঙ্গানুবাদ) “..পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে আমরা সাম্প্রতিক কালের কয়েকজন উল্লেখযােগ্য বাঙালি কবির রচনার অনুবাদ উপস্থিত করেছি। এগুলি যে সর্বাঙ্গীণ বা পর্যাপ্ত হয়েছে এমন নয়—তা করতে হলে পত্রিকার বদলে একটি প্রশস্ত সংকলনের প্রয়ােজন হত—কিন্তু এতে অন্তত প্রধান প্রবণতাগুলিকে ছোঁয়া যাবে, বােঝা যাবে তরুণ প্রজন্মের কবিদের ওপর কী ধরণের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আমাদের আশা, এই সম্পূরক সংগ্রহটি ভারতে বা ভারতের বাইরে আমাদের পাঠকবর্গের কাছে আধুনিক বাংলা কবিতার একটি পরিচিতি হিসেবে কাজ করবে…।”
আশ্বিন ১৩৬২ সংখ্যায় ‘কবিতা’ কুড়ি বছরে পদার্পণ করল। দীর্ঘ সম্পাদকীয় লিখলেন বুদ্ধদেব। তার কিছু অংশ “.. ‘কবিতা’র কুড়ি বছর আরম্ভ হলাে। হওয়া উচিত ছিলাে একুশ বছর, কিন্তু পুরােনাে পাঠকদের মনে থাকতে পারে— ১৩৫৭ ও ৫৮তে (১৯৫০, ১৯৫১) পত্রিকার প্রকাশ এতই অনিয়মিত ও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল যে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কাগজে কলমে পুরাে বছর আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তা কুড়ি হােক বা একুশ হােক, কোনাে কবিতা-পত্রিকার পক্ষে আমরা বড়াে দীর্ঘকাল টিকে আছি, একথা মানতেই হয়। হয়তাে অসংগতরকম দীর্ঘকাল। পাঁচ, সাত, দশ বছরের উজ্জ্বল জীবনের পরে আমরা যদি অবসিত হতুম, সেইটাই যেন স্বাভাবিক হতাে, সাহিত্যের উত্তম ঐতিহ্যের অনুগামী। ক্লান্তি নামেনি তা নয়, অন্ধকার প্রহর আমরা জেনেছি, কিন্তু সেই মুমূর্মুর্তা অতিক্রম করবার প্রেরণা কখনাে হারিয়ে যায়নি, তা যেন এই পত্রিকারই প্রবাহের মধ্যে নিহিত ছিলাে, তারই আদেশ পালন করে চলেছি আমরা।”
এইভাবে বাংলা কবিতার আধুনিকতার স্বপক্ষে বুদ্ধদেবকে কী পরিমাণে যে সংগ্রাম করতে হয়েছে, ‘কবিতা’-র প্রথম কয়েক বছরের সম্পাদকীয় পড়লেই তা বােঝা যায়। তিরিশ-চল্লিশ দশকের প্রায় সকল শ্রেষ্ঠ কবির অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রথম ‘কবিতা’ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর সেটিও আর একটি কৃতিত্বের দিক। তাছাড়া কবিতা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে নতুন ধারার কবিতা আন্দোলন গড়ে উঠলাে তাকে প্রতিহত করতে বিরােধী শিবিরগুলাে অনেক সময় শালীনতার সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করেছিল। প্রকৃত সেনাপতির মতাে বিরােধীদের সমস্ত আঘাত বুক পেতে নিয়ে সহযােগী কবিদের রক্ষা করতে চেয়েছেন তিনি। সমবয়সী বন্ধু, তরুণ প্রজন্মের কবিদের নতুন প্রকাশিত কবিতার বইয়ের আলােচনায় নতুন একটা যুগের আবির্ভাবের কথাই তিনি বলেছেন নানা ভঙ্গিতে, গভীর যুক্তিনিষ্ঠায়। এখন তাঁর সম্পাদনায় ‘কবিতা’র অধুনা দুপ্রাপ্য বিশেষ সংখ্যাগুলির শিরােনাম উল্লেখ করা হচ্ছে, যাতে সম্পাদক হিসাবে তার পরিকল্পনা ও প্রচারের সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে সহজেই আঁচ করা যায়।
কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ সংখ্যা। তৃতীয় বর্ষ বৈশাখ ১৩৪৫ বিশেষ বর্ষ সংখ্যা
চতুর্থ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা।
আষাঢ় ১৩৪৬ বিশেষ পূজা সংখ্যা,
পঞ্চম বর্ষ কার্তিক ১৩৪৬ বিশেষ গ্রন্থসমালােচনা সংখ্যা,
ষষ্ঠ বর্ষ কার্তিক ১৩৪৭ রবীন্দ্র সংখ্যা,
ষষ্ঠ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা।
আষাঢ় ১৩৪৮ শারদীয় সংখ্যা,
অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা।
কার্তিক ১৩৪৯, সমালােচনা সংখ্যা,
অষ্টম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা।
আষাঢ় ১৩৫০ নজরুল সংখ্যা।
দশম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা।
কার্তিক-পৌষ ১৩৫১ মার্কিন সংখ্যা
ষােড়শ বর্ষ প্রথম সংখ্যা।
ডিসেম্বর ১৯৫০ দ্বিভাষিক সংখ্যা বা ইংলিশ সা-িমেন্ট সপ্তদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা।
আষাঢ় ১৩৬০ জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা
উনবিংশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা।
পৌষ ১৩৬১ আন্তর্জাতিক সংখ্যা
চতুর্বিংশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা।
পৌষ ১৩৬৬ সুধীন্দ্রনাথ স্মৃতি সংখ্যা
পঞ্চবিংশ বর্ষ ১ম-২য় সংখ্যা।
আশ্বিন-পৌষ ১৩৬৭ একথাও মনে রাখা দরকার, খুব নির্বিঘ্নে প্রতিটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে তা নয়, বরং মাঝে মাঝে আর্থিক ও অন্য নানা কারণে থমকে দাঁড়িয়েছে পত্রিকার প্রকাশনা, তা সত্ত্বেও সম্পাদকের কৃতিত্বের আর একটি দিক হলাে, কবিতা পত্রিকায় পঁচিশ বছরের দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় যুগ্ম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে মাত্র চারটি কার্তিক-পৌষ ১৩৫১, আধিন-পৌষ ১৩৫৬, পৌষফাল্গুন ১৩৬৪, আধিন-পৌষ ১৩৬৭। প্রায় কয়েক বছর (৩-৫-৬-৭-৮-৯) পাঁচটি করে সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে। ক্রমিক অনুযায়ী মােট ১০৪টি সংখ্যা।
(৩)
১৯৫৩ সালে বুদ্ধদেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল তার শ্রেষ্ঠ ‘কবিতা’। শ্রেষ্ঠ কবিতা’র নির্বাচন শুরু হয়েছিল ‘বন্দীর বন্দনা’ থেকে। ‘বন্দীর বন্দনা’-র কবিতাগুলিতে যেভাবে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন, সেই ‘আমি’ তার যে কবিতাগুলিতে সত্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র সংকলনে তিনি সেই কবিতাগুলিকেই স্থান দিয়েছিলেন কালানুক্রমিক বিন্যাসে— ভূমিকায় সম্পাদক নিজেই এ কথা জানিয়েছেন। ‘বন্দীর বন্দনা’ নিয়ে সে কালে অনেক অসাহিত্যিক আলােচনা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এ বইয়ের কিছু কবিতা পড়ে লিখেছিলেন—
‘দৈবক্রমে বুদ্ধদেব বসুর লেখার প্রথম যে পরিচয় পেয়েছিলুম, তার থেকে আমার মনের মধ্যে এ বিশ্বাস ছিলাে যে, বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে তিনি সম্মান লাভ করবেন।… কবিতাগুলি সহজ স্বকীয়তার গাম্ভীর্য ছন্দে ভাষায় ও উপমায় ঐশ্বর্যশালী। ভিন্ন গােত্রের মানুষ হলেও শ্রী অরবিন্দ দিলীপকুমার রায়ের প্ররােচনায় ‘বন্দীর বন্দনা’র কবিতা পড়ে লিখেছিলেন—ইজ সার্টেনলি রিমার্কেবল ফর সাে ইয়াং এ পােয়েট।’ ‘বন্দীর বন্দনা’-র ভাষাছাদে মােহিতলাল মজুমদারের কবিভাষার প্রভাব আছে এবং তা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বুদ্ধদেবদের তরুণ বয়সে মােহিতলালই ছিলেন ‘আধুনিকোত্তম।’ রবীন্দ্র-বৃত্ত থেকে বেরোবার সেও ছিল এক দিকদর্শন। সেই সঙ্গে এই সংকলনে স্থান পেয়েছিল ছােটোদের জন্য লেখা কবিতা আর অনুবাদ-কবিতা।
শুধু কবিতার সংকলন আর সম্পাদনা নয়, বুদ্ধদেবের কবি ব্যক্তিত্ব এক লাবণ্যের উদ্ভাসে স্মরণীয় হয়ে আছে সমকালের আর একটি ঘটনায়। ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে বসেছিল সাহিত্যমেলার আসর—এপার বাংলা ওপার বাংলার স্বাধীনতাউত্তর পাঁচ বছরের লেখালেখির উজ্জ্বল অধ্যায়গুলি চিনে নেবার ইচ্ছে ছিল পারস্পরিক সেই মিলনমেলায়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে, বিভারতীর সহযােগিতায় শান্তিনিকেতনের সাহিত্যিক সমাজ এই মেলার পরিকল্পনা ও পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দু-বাংলার নবীন-প্রবীণ লেখকদের সমাগমে, আলাপে-আলােচনায়, গানে-কবিতায়, তর্কে-বিতর্কে ভরে উঠেছিল মেলার তিনটি দিন (২৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১ মার্চ ১৯৫৩)। সাহিত্যমেলার সেই স্মরণীয় পাঁচটি অধিবেশনের মধ্যে একটি বসেছিল সংগীতভবনে, সকালবেলায় কবিতা নিয়ে আলােচনার সেই আসরে চোখে পড়ছিল যেন বাংলা কবিতার জগতের কয়েকটি যুগকে—নানা বয়সের, নানা মতের কবির উৎসুক উপস্থিতি ছিল সেদিনের বক্তাদের ঘিরে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখােপাধ্যায়। তবে সভার সূচনাতেই এ তথ্য জানানাে হয়েছিল যে, আগের দিন গভীর রাতে শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছানােয় বুদ্ধদেব দেহে ও মনে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত—মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও আলােচনায় অংশগ্রহণে অপারগ। সুভাষ মুখােপাধ্যায় তার লিখিত ভাষণে বলেছিলেন, পাঁচ বছরের বাংলা কবিতার বৃত্তান্ত, তবে উল্লেখ করেছিলেন কেবল সেই কবিদের কথাই, যাঁদের কাছে কবিতা। শুধু ব্যক্তিগত আবেগের বিষয় নয়, যাঁদের লেখায় ধরা দেয় সমাজের বাস্তবতা। আর প্রবন্ধ পড়া শেষ হওয়ামাত্র শ্রোতাদের চোখের সামনে ঘটল একটা ঐতিহাসিক বিস্ফোরণ। লাফ দিয়ে উঠলেন বুদ্ধদেব, ভুলে গেলেন যে সভাপতি আছেন একজন, ভুলে গেলেন যে অল্প আগেই তিনি জানিয়েছিলেন আজ বলবেন না কিছু, ভুলে গেলেন যে মাইকটাকে যথাযথ করে দেবার জন্যও সময় চাই একটু। মুখের চেহারা তার পাটে গেছে তখন। একই সঙ্গে ব্যথা আর ত্রোঁধে ভরা এক স্বরে বলতে লাগলেন তিনি সুভাষ যা বলে গেলেন, এই যদি হয় সত্যি সত্যি পাঁচ বছরের বাংলা কবিতার ছবি, তবে তার নিতান্তই দুর্দশা ঘটেছে বলতে হবে। কবিতা এক গাঢ়তর বােধের জগৎ, ভাত-ভাত বলে সরল চিৎকার করলেই সেটা কবিতা হয় না—উত্তেজিত গলায় সে কথা বােঝাতে চাইলেন তিনি। ভাতের জন্য আকুলতার কারণে তিরস্কৃত যমুনাবতী’র কবি, সেদিনের তরুণ শঙ্খ ঘােষ উপস্থিত ছিলেন কবিতা আলােচনার সেই সভায়, বুদ্ধদেবের এই বিস্ফোরণের ছবিটি তারই চোখে দেখা বিবরণ।
জীবনের এই পর্বে বুদ্ধদেব তার দুজন প্রিয় কবিকে হারিয়েছিলে—১৯৫৪ সালে জীবনানন্দ দাশ এবং ১৯৬০ সালে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যু হয়েছিল। ‘কবিতা’ পত্রিকাতে ১৯৫৪ সালে ‘জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা’ এবং ১৯৬০ সালে ‘সুধীন্দ্রনাথ স্মৃতি সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতা পত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যাগুলি খুবই আকর্ষণীয় ছিল। ১৯৫৩ সালেই ‘কবিতা’র আষাঢ় ১৩৬০ সংখ্যায় বুদ্ধদেব একটি ইংরেজি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিলেন, যাতে তিন ও চার দশকের দশজন বাঙালি কবির কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। অনূদিত এই দশ জন কবি ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সমর সেন, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, নরেশ গুহ ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
এরও আগে, একটি দ্বিভাষিক সংকলন ‘মার্কিন সংখ্যা’ প্রকাশ করে ‘কবিতা’-র ষােড়শ বর্ষ শুরু হয়েছিল। ওই সংখ্যায় মার্কিন কবিদের মূল রচনার সঙ্গে কয়েকটি মার্কিন কবিতার বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, অনুবাদক ছিলেন সম্পাদক বুদ্ধদেব। এজরা পাউন্ড ও এলিয়টের পত্রালাপও এই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
‘কবিতা’ পত্রিকার শততম সংখ্যাটি ছিল আন্তর্জাতিক সংখ্যা। ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান ও সার্বোক্রোট ভাষায় রচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ এবং ভারতীয় ভাষার মধ্যে বাংলা, ওড়িয়া, গুজরাতি, মালয়ালম ও হিন্দি কবিদের অনূদিত রচনা এই সংকলনে স্থান পেয়েছিল। ১৭জন বাঙালি কবি ও ৬জন অন্যান্য ভারতীয় ভাষার কবির কবিতার ইংরেজি অনুবাদ, ইংরেজিভাষী কবিদের সংখ্যা ১৪—এ নিয়ে মােট ৬৯টি কবিতার সংকলন। কবিতার প্রচার এবং দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে ভালাে কবিতার স্বাদ ভারতীয় পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেবার নিরন্তর আগ্রহেই বুদ্ধদেব ‘কবিতা’ পত্রিকার এই বিশিষ্ট সংখ্যাগুলির পরিকল্পনা ও সম্পাদনা করেছিলেন।
এই সংখ্যার বুদ্ধদেব-রচিত ‘সম্পাদকীয়’ মন্তব্য থেকে (বঙ্গানুবাদ) “.এই সংখ্যার কবিতায় আমরা কবিতা আহরণ করেছি দশটি ভাষা থেকে, সাতটি দেশ থেকে, এবং আমাদের এই বিপন্ন শতকের ছটি দশক থেকেই…কিন্তু আমরা কোনােরকম প্রতিনিধিত্বের দাবি করছি না…সম্পাদক ও তার সহযােগীগণ যে কটি ভাষার সঙ্গে পরিচিত, এবং যেসব কবিতা আমাদের সংগ্রহে ছিল বা সংগ্রহ করে ওঠা গেল তার মধ্যে থেকেই বাছতে হল। আমাদের লক্ষ্য ছিল, সাম্প্রতিককালে লেখা আমাদের কবিতার সঙ্গে বিদেশী পাঠকের একটা পরিচয় করিয়ে দেওয়া, অন্য দেশের কবিতা ভারতীয় পাঠকদের সামনে ধরে দেওয়া, কিন্তু আমাদের প্রয়াসের পিছনে ভাষাগত সমবন্টনের কোনাে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না, এই কথাটা আমরা স্বচ্ছভাবে বলে নিতে চাই।
একটি ব্যতিক্রম অবশ্য আছে, অধিকাংশ কবি ও কবিতাই বাংলা ভাষার আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল তাই। কারণ শেষ পর্যন্ত, বা সর্বোপরি, কবিতা তাে বাংলা ভাষারই পত্রিকা! এটাই তাই আমাদের কাছে সঠিক ও স্বাভাবিক বলে মনে হল যে এই সংখ্যাকে আমরা আধুনিক বাংলা কবিতার একটি ক্ষুদ্র সংকলন হিসেবে তৈরি করে তুলব, সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের একটি মিলনভূমিও প্রস্তুত করবার চেষ্টা করব। কিন্তু এখানেও আমরা সর্বাঙ্গীণ বা পর্যাপ্ত হবার কোনাে দাবি করছি না…যেসব কবিতার অনুবাদ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে তাদের মধ্যেই নির্বাচন সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে আমাদের।…পাঠককে বলে দেওয়া দরকার যে অনুবাদে আমরা মূল ভাষার কবিতার রূপান্তর অবিকৃত রাখবার চেষ্টা করেছি, যদিও ছন্দকে বর্জন করতে হয়েছে। কোথাও কোথাও।”
১৯৫৭ সালে সম্পাদক বুদ্ধদেব সংবর্ধিত হলেন। জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রভারতী ভবনে কবিতামেলার পক্ষে থেকে দুজন সম্পাদক সংবর্ধিত হয়েছিলেন সেদিন— ‘কবিতা’-সম্পাদক বুদ্ধদেব ছাড়া অন্যজন ছিলেন ‘পূর্বাশা’-সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। ২৮ বৈশাখ অনুষ্ঠিত সংবর্ধনাসভাটিতে পৌরােহিত্য করেছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সংবর্ধিত দুই সম্পাদকই সেদিন হৃদয়গ্রাহী বক্তব্যের পাশাপাশি কবিতাও পড়েছিলেন। কবিতা পত্রিকাতেও এই সভার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল, লিখেছিলেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।
‘কবিতা’ পত্রিকার ১৩৬৫ সালের আর্থিন সংখ্যায় বুদ্ধদেবের অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছিল বরিস পাস্টেরনাকের ‘জিভাগাের কবিতা’। বুদ্ধদেবের অনূদিত কবিতাগুলি ছিল—‘সাদা রাত্রি’, ‘জবাবদিহি’, ‘প্রত্যুষ’, ‘বিচ্ছেদ’, ‘মিলন’, ‘হেমন্ত, ‘একটি রূপকথা’। অনুবাদের ভূমিকায় বুদ্ধদেব জানিয়েছিলেন তার জিভাগাে পড়ার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন, বহু দিন পরে কীভাবে এক নতুন কবির স্বাদ পেলেন, কীভাবে মনে হল আবার ইউরােপ থেকে কবিতা এল! তুলনা করেছেন তার প্রথম বার বােদলেয়ার ও রিলকে পড়ার, সঙ্গে ভেবেছেন—এই বৃদ্ধের হাত থেকে, কয়েক মুহূর্তের জন্য, আমাদের হারানাে যৌবন আমরা ফিরে পেলাম।
কিন্তু, বুদ্ধদেবের এই পাস্টেরনাক-মুগ্ধতা সেদিন কলকাতার সাহিত্যিক-সমাজে অবিতর্কিত ছিল না। ডাক্তার জিভাগাে উপন্যাসের রচয়িতা পাস্টেরনাককে নিয়ে এই সময়ে পৃথিবী জুড়েই বিতর্ক চলছিল—তবে উপন্যাসটির শিল্পমূল্য নিয়ে সাহিত্যিক বিতর্কের চেয়ে বােধহয় কমিউনিজম ও সােভিয়েট সমালােচনার রাজনীতিক বক্তব্য-বিষয়ই আলােচকদের বিতর্কে সেদিন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল।
পাস্টেরনাকের রচনা ও ‘ডাক্তার জিভাগাে’ উপন্যাসটি সমালােচনার জন্য সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর অনুরােধে আমেরিকা থেকে একটি পত্র-প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। ১৯৫৮-র ১৮ ডিসেম্বর লেখা চিঠিটা কবিতা পত্রিকায় ১৩৬৫-র পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। পাস্টেরনাক প্রসঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর দ্বিতীয় চিঠিও ‘কবিতা’য় ১৩৬৬-র আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যে চিঠিটি ১৯৫৯-এর ৯ এপ্রিল বস্টন এয়ারপাের্টে বসে লিখেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। এই আলােচনায় অমিয় জানিয়েছিলেন,
“পাস্টেরনাকের মতাে কবির কাছ থেকেও রাশিয়ার, অর্থাৎ তাঁর গভীর-জানা সমাজ জীবনের, আরেকটু প্রশস্ত দৃষ্টিসম্পন্ন পরিচয় পাবাে আশা করেছিলাম।”
ওই একই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ১০ মে ১৯৫৯-এ লেখা বুদ্ধদেবের প্রত্যুত্তর। ওই উত্তরে বুদ্ধদেব জানিয়েছিলেন,
“পাস্টেরনাক তার জীবৎকালের দেশীয় ঘটনাবলীকে যেভাবে নিজের মনে অনুভব ও উপলব্ধি করেছেন, জিভাগাের কবিতাগুচ্ছে তা-ই তার লেখনীকে চালিয়ে নিয়েছে, ভাষাকে দিয়েছে প্রাণ, এবং ঘটনাকে বিস্ততা। সেই বিশেষ দৃষ্টি তার পক্ষে নিতান্ত সত্য, আপনাকে বা আমাকে খুশী করার জন্য সেই দৃষ্টিকে বিকৃত বা ব্যাহত করলেই তিনি নিন্দনীয় হতেন।”
বরিস পাস্টেরনাক ও তাঁর এই উপন্যাস নিয়ে আলােচনা সাহিত্যসমাজকে দীর্ঘদিন আলােড়িত করেছিল। ১৯৬০ সালে, দেশ পত্রিকায় ‘বরিস পাস্টেরনাক’ শিরােনামে বুদ্ধদেবের আর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
অমিয় চক্রবর্তীকে প্রত্যুত্তরে লিখতে বসে ব্যথিত বােধ করেছিলেন বুদ্ধদেব ক্ষুব্ধ নয়, তর্কের দিকে উদ্বুদ্ধ নয়, শুধু ব্যথিত। সেই গভীর ব্যথায় তিনি ভেবেছিলেন—এই বিতর্কের সত্যি কি কোনাে প্রয়ােজন আছে, তাদের কুড়ি বছরের সংসর্গের মাঝখানে কেনই বা পাস্টেরনাক কোনাে বাধা হয়ে উঠবেন? কিন্তু এ কথাও বুদ্ধদেব অনুভব করেছিলেন যে,
“কথাটা পাস্টেরনাককে নিয়ে নয়, ‘ডাক্তার জিভাগাে’ উপন্যাসটি নিয়েও নয়, ও সব উপলক্ষ মাত্র, আসল কথাটা আমাদের মনের সেই গভীরতম স্তরকে স্পর্শ করে আছে, সেই ভূমি ও ভিত্তি যেখান থেকে উৎসারিত হচ্ছে ডাল, পাতা মঞ্জরী ও ফলের মতাে আমাদের সব কথা ও নীরবতা, সব চেষ্টা ও প্রতীক্ষার প্রহর। পাস্টেরনাক আমাদের পক্ষে কিছুই না হতে পারেন, কিন্তু তিনি আজ যে প্রেের প্রতীক হয়ে উঠেছেন সে বিষয়ে কিছু অনুভব করবাে না এমন সাধ্য আমাদের নেই।”
সাহিত্যসঙ্গীদের সঙ্গে মতান্তরের ব্যবধান সত্ত্বেও এই প্ররে উত্তর বুদ্ধদেবের কাছে ছিল দ্ব্যর্থহীন।
এর দু-বছর পরেই, ১৯৬১ সালে, দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর বন্ধ হয়ে গেল কবিতা’ পত্রিকার প্রকাশ। সাম্প্রতিক কবিদেব রচনার সঙ্গে বুদ্ধদেবের কবিতাবােধের জগতের দূরত্বকে তাঁর এই নির্মম সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন উত্তরসূরি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তির ভাষায়, বুদ্ধদেব তাকে জানিয়েছিলেন,
“একটা জিনিস স্থির করেছি, ‘কবিতা’ পত্রিকা বন্ধ করে দেবাে। তােমাদের লেখা আমি একদম বুঝতে পারছি না। আর না বুঝে আমি ছাপবাে না।”
শক্তির দুঃখ হয়েছিল এই মারাত্মক ঘােষণা শুনে। তবে, এটা জানতাম উনি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। বুঝিয়ে বলে, হাতে পায়ে ধরেও, কোনাে লাভ হবে না।” বুদ্ধদেবের স্থির সিদ্ধান্ত স্থায়ী হয়েছিল, কবিতা পত্রিকা আর প্রকাশিত হয়নি। ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট বুদ্ধদেব যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান অধ্যাপক পদে যােগ দিলেন। যাদবপুর বিবিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ত্রিগুণা সেনের উৎসাহেই যাদবপুরে সূচনা হয়েছিল তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের। সসম্মান বন্ধুতায় বুদ্ধদেবকে ডেকে নিয়েছিলেন ত্রিগুণা সেন, ভার দিয়েছিলেন নতুন বিভাগের, কিছুটা হয়তাে বিভাগের প্রতি ব্যক্তিগত আস্থা জ্ঞাপনের ইচ্ছাতে, নিজের মেয়ে সুহৃতা সেন-কে এই নবজাত বিভাগের ছাত্রী করে পাঠিয়েছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগটির কৌলীন্য অর্জন করে সাবালক হয়ে দাঁড়াতে সময় লেগেছিল যথেষ্ট, প্রতিষ্ঠার সেই প্রথম পর্বে অনেক যত্নে, অনেক নিষ্ঠায়, অনেক শ্রমে আর পরম মমতায় ধাত্রীত্বের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব, সন্তানলালনের মতােই তিল তিল যত্নে বিভাগটি গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে অধ্যাপকরূপে বিভাগে আহ্বান করে এনেছিলেন বুদ্ধদেবই, সুধীন্দ্রনাথও ছাত্রমহলে জনপ্রিয় ছিলেন। বুদ্ধদেবের কনিষ্ঠা কন্যা রুমি (দময়ন্তী)-র সাথে (যিনি ওই বিভাগের ছাত্রীও ছিলেন) জানা যায়, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ গড়ে তােলবার জন্য নিজেকে প্রায় উৎসর্গ করেছিলেন বুদ্ধদেব, এমনকি তার সারা জীবনের প্রথম প্রেম লেখা—তা-ও অবহেলিত হয়েছে সেই সময়ে।
(৪)
বুদ্ধদেব বসু সমকালের অন্যতম সৃষ্টিশীল কবি হয়ে যে পরিমাণ সময় অনুবাদে ব্যয় করেছেন তার তুলনা শুধু বাংলায় কেন বিশ্বসাহিত্যেও সম্ভবত বিরল। একমাত্র উদাহরণ হিসেবে যাঁকে আমাদের মনে পড়ে তিনি বরিস পাস্টেরনাক। রাষ্ট্রের সঙ্গে আদর্শগত বিবাদ হওয়ায় তিনি দশ বছর নিজে কোনাে কবিতা লেখেননি, শেক্সপিয়ারের অনুবাদ করে কাটিয়েছেন, অন্তরীণ অবস্থায় অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। বুদ্ধদেব যে পাস্টেরনাকের অনুরাগী ছিলেন তার একটা কারণ হয়তাে পাস্টেরনাকের অনুবাদপ্রীতি। কিন্তু তিনিও নিজেকে অনুবাদে নিযুক্ত করেছিলেন বাধ্য হয়ে, বুদ্ধদেব বসুর মতাে স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে নয়। অনুবাদে কেন এত সময় দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব? অনুবাদ কবিতা বিষয়ে তার কয়েকটি মন্তব্য উদ্ধার করে দিলে হয়তাে অনুবাদ সম্বন্ধে তার ধারণাটি স্পষ্ট হবে “..কবিতার অনুবাদ সম্ভব কি সম্ভব নয়, এই মস্ত বড়াে অর্থহীন তর্কটা টপকে পার হয়ে আমি একবারেই বলতে চাই কবিতার অনুবাদও একটি সপ্রাণ, সংক্রামক, মূল্যবান সাহিত্যকর্ম, এবং কখনাে কখনাে অনুবাদক আপন ভাষায় কবি হলে—তা সৃষ্টিকর্মেরও মর্যাদা পায়।…আমরা যারা রুশ, জার্মান, লাতিন, গ্রীক, চৈনিক প্রভৃতি ভাষা জানি না, আমরা সেসব ভাষার কাব্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারি দুটি-তিনটি অনুবাদ মিলিয়ে পড়লে, জানতে পাই কবির মন, কী তিনি বলতে চেয়েছেন, হয়তাে তার ভঙ্গিরও খানিকটা মূলের অনেক রমণীয়তা নিশ্চয়ই বাদ পড়ে, কিন্তু যদি সে কবি শুধু শব্দের বেসাতি না করে কিছু বলেও গিয়ে থাকেন—মােটের ওপর এমন কোনাে দামি জিনিস পাওয়াই যায়, যা আমাদের মাতৃভাষার সাহিত্যে নেই, আর যার সঙ্গে পরিচয়ের ফলে সেই সাহিত্যের ঋদ্ধির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।…”
আসলে বুদ্ধদেব অনুবাদ-কবিতা রচনাকে মৌলিক কবিতাসৃষ্টির একটি ‘সন্নিকট বিকল্প’ বলেই মনে করতেন। এও বিবাস করতেন যে, কোনাে কবির জীবনে যখন এমন পর্যায় আসে, যেসময়ে স্বকীয়ভাবে বলার কথা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন অনুবাদচর্চা কবিকে অপচয় থেকে রক্ষা করে, কলাকৌশলে তাকে আরও নৈপুণ্যের সন্ধান দেয়। বিশেষত, যদি অনূদিত কবির সঙ্গে অনুবাদকের একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তবে সেই অনুবাদকর্ম, অনুবাদককে ও তাঁর রচনাকে নিশ্চিতভাবেই ঋদ্ধ করে। বােদলেয়ারের ক্ষেত্রে বুদ্ধদেবের ঠিক এইটাই ঘটেছিল, এইভাবে বুদ্ধদেবকে ঋদ্ধ করেছিলেন বােদলেয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থার শেষ বছরে খুব সম্ভব সুইনবার্ন মারফত এই ফরাসি কবির অস্তিত্ব-বিষয়ে প্রথম সচেতন হয়েছিলেন বুদ্ধদেব, তারপর বহুবছরের ব্যবধানে ১৯৫২-র দিল্লি-মহীশূরবাসের সময়ে তার সঙ্গী হয়েছিল বােদলেয়ারের গদ্যকবিতার এক খণ্ড—যে বইটি সম্পর্কে বুদ্ধদেব মহীশূর থেকে লেখা চিঠিতে নরেশ গুহকে জানিয়েছিলেন, ‘ছােটো বই, পড়ে উঠতে এক ঘণ্টায় বেশি লাগে না, কিন্তু পড়ে ফেলতে সারাজীবন কেটে যায়। আর তারও পর অনুবাদের দশবছর ব্যাপী সহবাসে’ বােদলেয়ারে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। এই নিরন্তর বােদলেয়ার অনুধ্যানের মধ্য দিয়ে যেন নিজেরই একটা সত্তাকে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই ফরাসি ভাষায় অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বুদ্ধদেব-অনূদিত বােদলেয়ারের কবিতা শুধু অনুবাদকর্ম না হয়ে সাহিত্য-সৃষ্টি হয়ে উঠতে পেরেছিল।
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ ‘কবিতা’ পত্রিকায় নিয়মিত বুদ্ধদেবের অনুবাদে বােদলেয়ারের কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। ‘শীতের প্রার্থনা বসন্তের উত্তর’ ও ‘যে আঁধার আলাের অধিক’-এর কবিতাগুলাে এ সময়ের রচনা। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল শার্ল বােদলেয়ার তাঁর ‘কবিতা’ নামে বইটি, যে-বইতে একটি অসাধারণ ভূমিকা, কবিতাগুলির টীকা, কালপঞ্জি এবং বােদলেয়ারের জীবনপঞ্জিও বুদ্ধদেব যােজনা করেছিলেন। বুদ্ধদেবের অনুবাদের মাধ্যমেই বাঙালি পাঠকের সঙ্গে বােদলেয়ারের প্রথম যথার্থ পরিচয় ঘটল। ভূমিকায় বুদ্ধদেব জানালেন, বােদলেয়ার কীভাবে রােমান্টিকতার ‘পরিশােধন ও পরিশীলন’ করেছেন। রােমান্টিকদের মতাে প্রকৃতি, নগ্নতা, স্বাভাবিকতা সুন্দর নয় বােদলেয়ারের কাছে, তিনি বন্দনা করেন প্রসাধনের, অলংকারের, কৃত্রিমের, অর্থাৎ শিল্পের, অর্থাৎ চেতনার। রােমান্টিকতার পক্ষপাতী বুদ্ধদেবের রােমান্টিক চেতনা এর মধ্যেই নিজের পথ খুঁজে নিল। ‘অদৃশ্যকে দেখতে হবে, অঞতকে শুনতে হবে’, বা জানতে হবে প্রেমের, দুঃখের, উন্মাদনার সবগুলি ‘প্রকরণ’, অথবা ‘খুঁজতে হবে নিজেকে, সব গরল আত্মসাৎ করে নিতে হবে’—রাবাের এই ‘বােদলেয়ার-ভারাক্রান্ত’ কথাগুলিতে বুদ্ধদেব সহমর্মিতা খুঁজে পেলেন।
(৫)
নানা কারণেই বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে অভিনবত্বের দাবি রাখে ‘কবিতা’ পত্রিকা। আধুনিক কবিতার সশ্রদ্ধ পরিবেশন ছিল ‘কবিতা’-র প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি। দলমত নির্বিশেষে ভালাে কবিতার প্রচার ও প্রসারই একমাত্র লক্ষ ছিল বলে এই পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিটিও বিশেষভাবে তাৎপর্যময়। ‘কবিতা’-র পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে সম্পাদকের এই উক্তির প্রতিফলন …কী এসে যায় তুচ্ছ মতভেদে, যখন তিনি এত ভালাে কবিতা লিখছেন?
—অমিয় চক্রবর্তী প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করলেও নবীনপ্রবীণ চেনা-অচেনা সব ভালাে কবির জন্যই বুদ্ধদেবের এই মনােভাবই ছিল। ‘কবিতা’-র নিয়মিত লেখকেরাও অনেকেই একে অন্যের কবিতা পছন্দ করতেন না, কখনও ‘কবিতা’-র পাতাতেই প্রকাশিত ব্যঙ্গ কবিতায়, কখনও পারস্পরিক উদাসীনতায় এই অপছন্দ প্রকাশ পেত। কিন্তু বুদ্ধদেব প্রগাঢ় ভালােলাগায় এঁদের সকলেরই অনুরাগী ছিলেন, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বহু ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন ভালাে কবিতা-বিষয়ে তার ভালােবাসার বােধকে। কবিতাপ্রেমিক বুদ্ধদেব নিজের সেই ভালােবাসার বােধকে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে দেবার দায় অনুভব করেছিলেন। অপরিমেয় নিষ্ঠায় ২৫ বছর ধরে সেই দায় বহন করে চলেছিলেন কবিতা পত্রিকার মাধ্যমে।
আধুনিক বাংলা কবিতা বিচারের এক নতুন সমালােচনা-পদ্ধতিও নির্মাণ করেছিল ‘কবিতা’ পত্রিকা। নবীন কবিদের প্রকাশিত প্রতিটি সমকালীন কাব্যগ্রন্থের সমালােচনা প্রকাশিত হয়েছে ‘কবিতা’-য়। এই নতুন কবিতা বিভাগের অধিকাংশ সমালােচনার অক্লান্ত লেখক ছিলেন বুদ্ধদেব স্বয়ং। যেমন, কবিতার প্রথম যুগে এই বিভাগে আলােচিত বইগুলির কয়েকটি ছিল—সমর সেনের কয়েকটি ‘কবিতা’ (আষাঢ় ১৩৪৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ক্রসী’ (আশ্বিন, ১৩৪৪) বিষ্ণু দে-র ‘চোরাবালি’ (চৈত্র ১৩৪৪), অমিয় চক্রবর্তীর ‘খসড়া’ (পৌষ, ১৩৪৫) সব কটি সমালােচনারই লেখক বুদ্ধদেব বসু। আর পৌষ ১৩৪৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর কঙ্কাবতী’। আলােচনা-সমালােচক ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্রনাথের ‘বীথিকা’, ‘পত্রপুট’, ‘শ্যামলী’, ‘খাপছাড়া’, ‘নবজাতক’, ‘সে’, ‘রােগশয্যায়’, ‘আরােগ্য’, ‘জন্মদিনে’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের সমালােচনা প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা’ পত্রিকায়—অধিকাংশই নতুন কবিতা বিভাগেই।
‘কবিতা’-র পাতায় এই আলােচনাগুলি থেকে বুদ্ধদেবের কাব্যদর্শ এবং কাব্য-সমালােচনার প্রবণতাটি চিনে নেওয়া যায়। বােঝা যায়, কবিতার বিচারে বুদ্ধদেব সবসময়েই মনােযােগ দিয়েছেন কবিতার আঙ্গিকের আলােচনায়—মিলের, ছন্দের, ফর্মের বিশ্লেষণে, কিন্তু কবিতার ভাব-ব্যাখ্যায় কখনােই আকৃষ্ট হননি। কবিতায় তিনি প্রধানত খুঁজেছেন ‘শব্দের সম্মােহন’, ‘ছন্দের ইন্দ্রজাল’। তাই ‘কবিতা’-র পাতায় পাতায় তাঁর কাব্য-সমালােচনাগুলি মূলত কাব্যকৌশলেরই আলােচনা হয়ে উঠেছে। আর এ থেকেই এক নতুন সমালােচনার ধরনও গড়ে উঠেছে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘ছড়া’ গ্রন্থের অভিনব সমালােচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব ছড়া লিখেই—দীর্ঘ ছড়াটির শেষাংশে ছিল—
“.একেবারেই অসংলগ্ন, নিতান্ত অসঙ্গত,
ছন্দ যত নৃত্য তােলে চিত্র হানে রং তত।।
মিলের চুনিপান্না জুলে, অনুপ্রাসে চমক দেয়।
অথচ তার একটিও নেই অভিধানের নিমক খায়।…
কেউ বলবে সমাজ-চেতন দৃষ্টিভঙ্গি পাচ্ছি ঠিক,
কেউ বলবে এ তাে নিছক surrealistic।
আমি দেখছি মেঘ করেছে সূয্যি ডােবে-ডােবে,
পূর্ণিমায় আগুন জ্বলে সর্বনাশের লােভে।
তবু বৃষ্টি আজো পড়ে ছন্দে নামে বান,
লাবেণ্যর বন্যা আনে ছেলেবেলার গান।
চিন্তা নেই, চেষ্টা নেই, একটুও নেই দায়িত্ব,
এ কথাটা জানে না যে একেই বলে সাহিত্য।
ভরলাে হৃদয় মধুরতায় শ্যামল হলাে শুষ্কতা,
এই তাে জানি কাব্যকলার প্রথম এবং শেষ কথা।”
সৌন্দর্যবাদী বুদ্ধদেবের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই সমালােচনায়। বােঝা যায় সুইনবার্ন বা অস্কার ওয়াইল্ডের সঙ্গে তার কতখানি প্রাণের যােগ ছিল। বুদ্ধদেবের বােদলেয়ার-মগ্নতার সূত্রও খুঁজে পাওয়া যায় এই প্রবণতা থেকে।
আবার বিষ্ণু দে-র ‘চোরাবালি’ কাব্যগ্রন্থের সমালােচনায় কবির পাণ্ডিত্যসৃষ্ট দূর্বোধ্যতায় বিচলিত বুদ্ধদেব ‘ওফেলিয়া’ আর ‘ক্রোসিডা’ কবিতার সমালােচনায় লিখেছিলেন ‘ও দুটি কবিতায় কেন যে এক স্ট্যাঞ্জার পর আর এক স্ট্যাঞ্জা আসছে, সেটাই আমার কাছে রহস্য।’ কিংবা, খুব সংগতভাবেই বুদ্ধদেব আপত্তি করেছেন বিষ্ণু দে-র অপ্রচলিত, কঠিন শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা নিয়ে। উদাহরণ দিয়েছেন কবিতায় ব্যবহৃত ‘ক্রুতুকৃত অপাপবিদ্ধমবির’, ‘সােশপাশ’ প্রভৃতি শব্দের, যা পাঠকের স্বচ্ছন্দ উপভােগকে নির্যাতিত ও নষ্ট করবে বলেই তার ধারণা। বুদ্ধদেব প্রশ্ন তুলেছেন, আধুনিক কবিতার সাধনা যেখানে কাব্যের ভাষাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি আনার, আপনার কি মনে হয় ন্যায়ের পরিভাষা কি মমির মতাে মৃত ও প্রাচীন সংস্কৃত শব্দের স্থান আছে সেখানে?’
‘কবিতা’-র একটি গুরুত্বপূর্ব বিভাগই ছিল রবীন্দ্র-গ্রন্থ সমালােচনা। নতুন কবিতা বিভাগে যেমন আলাচিত হত রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্যায়ের কাব্যগ্রন্থগুলি, তেমনই রবীন্দ্ররচনাবলির সমালােচনার সূত্রে বুদ্ধদেব আলােচনা করছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের কবিতার বইগুলির। এই আলােচনাগুলি থেকেও বুদ্ধদেবের রবীন্দ্র-ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘কবিতা’-র পাতায়।
রবীন্দ্র রচনাবলির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হলে ‘কবিতা’র পৌষ ১৩৪৬ সংখ্যায় তার মূল্যবান আলােচনা বেরিয়েছিল— বুদ্ধদেবের চোখে রবীন্দ্রনাথের স্থান কোথায় ছিল তা এই আলােচনায় স্বচ্ছভাবে বিম্বিত হয়েছে। বস্তুত আর কোনাে সাহিত্যিক, কি সমালােচক, রবীন্দ্রনাথের এমন অকৃপণ অথচ যথার্থ প্রশস্তি রচনা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই “…রবীন্দ্রনাথ যে সেই বিরল মানবদের একজন, মহাকবি আখ্যা যাঁদের সম্বন্ধে সত্যই প্রযােজ্য, আজ আর তা নিয়ে কোনাে তর্ক নেই। বস্তুত, গত কুড়ি বছর ধরেই এ-সত্যটি বাঙালি সমাজে প্রতিভাত হচ্ছে।…সত্যি বলতে, পৃথিবীর মহৎ কবিকুলের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্থান অলনীয় সুদ্ধ এই কারণে যে তিনি একা, তাঁর জীবনের সাধনায় নিজের ভাষা ও সাহিত্যকে যেমন সর্বতােভাবে ও সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীর অন্য কোনাে কবি তা করতে পারেননি। এত বড়াে কাজ যে একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব, তাকে চোখের সামনে না দেখলে আমরা বিশ্বাস করতে পারতুম না। কোনাে সাহিত্যের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর দেখা যায় না। তার চেয়ে বলশালী কল্পনা, গাঢ়তর আবেগ, মানবচরিত্রে সূক্ষ্মতর দৃষ্টি, কথার আরাে যাদুকর ইঙ্গিতময়তা—পৃথিবীর সাহিত্য খুঁজলে হয়তাে এ সবই পাওয়া যাবে, কিন্তু এ-কথা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনাে কবি সম্বন্ধে বলা যায় না যে তিনি একা স্বদেশের ভাষা ও সাহিত্যের স্রষ্টা। তিনি একাধারে আমাদের আদি ও আধুনিকতম কবি, তিনিই প্রথম ও তিনিই শ্রেষ্ঠ।”
দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই কবিতায় রবীন্দ্রনাথের রচনা প্রকাশিত হয়েছে আর এ থেকে বােঝা যায়, ‘প্রগতি’-র যুগ থেকে ‘কবিতা’-র যুগে কীভাবে বদল ঘটে গেছে সম্পাদকের মানসিকতায়। ‘প্রগতি’-র যুগে রবীন্দ্রনাথকে সহনীয় ও ব্যবহার্য করার জন্য ‘বােঝাপড়ার প্রস্তুতির প্রয়ােজন হয়েছিল বুদ্ধদেবের, অঙ্গীকার করার জন্য প্রয়ােজন হয়েছিল তাকে পরিহার করবার আর ‘কবিতা’-র যুগে এসে প্রয়ােজনের রূপটাই বদলে গেল। এখন আর বুদ্ধদেবের রবীন্দ্রনাথকে পরিহার করার প্রয়ােজন নেই, নিজের আত্মবিধাসী পদক্ষেপ পকে এখন মিলিয়ে নেওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের অসামান্য উপস্থিতির সঙ্গেও। তাই, ‘প্রগতি’-র সচেতন। রবীন্দ্র-অনুপস্থিতির প্রতি তুলনায় কবিতায় দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের অনায়াস অবিরল উপস্থিতি।
বুদ্ধদেবের নিজস্ব কাব্যভাবনার প্রকাশ ঘটেছে ‘কবিতা’-র সম্পাদকীয়গুলিতেও। যেমন, ‘কবিতা’-র প্রথম সম্পাদকীয় ‘কবিতার দুর্বোধ্যতা’য় বুদ্ধদেব লিখেছিলেন,
“কবিতা সম্বন্ধে ‘বােঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝি নে’, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু বােঝায়’ না স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযােগ।”
গদ্য কবিতার প্রয়ােগরীতি নিয়েও নানা আলােচনা ছড়িয়ে আছে—যেমন সম্পাদকীয় রচনায়, তেমনই নানা প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্নদাশঙ্কর (‘লীলাময় রায়’ নামেও) পর্যন্ত নানা জনের আলােচনায়। রবীন্দ্রনাথের প্রধান বক্তব্য ছিল “গদ্যছন্দের রাজত্বে আপাতদৃষ্টিতে যে স্বাধীনতা আছে যথার্থভাবে তার মর্যাদা রক্ষা করা কঠিন।” বুদ্ধদেব বসু সেই সময়ে গদ্যছন্দের দিকে খুব ঝুঁকেছিলেন। এ বিষয়ে তার নিজেরই উক্তি “আমরা বুঝতে পারছিলাম সুধীন্দ্রনাথ ও অন্নদাশঙ্করের অনমনীয় বিদ্ধতা সত্ত্বেও, গদ্যকবিতার প্রতিষ্ঠালাভের আর দেরি নেই—যদিও কল্পনাও করতে পারিনি যে মাত্র তিন দশকের ব্যবধানে, এক নতুন প্রবংশের হাতে কবিতা অর্থ দাঁড়াবে গদ্যকবিতা—আদ্যাশক্তি অক্ষর-ছন্দের পূজারী সারা দেশে প্রায় কেউ থাকবে না।”
রাজনৈতিক মতবাদের স্পর্শহীনতা ‘কবিতা’-র অন্যতম বিশিষ্ট চরিত্র লক্ষণ ছিল। প্রগতি লেখক ‘সংঘ’র সঙ্গে প্রথম পর্বে যুক্ত ছিলেন বুদ্ধদেব, ক্রমশ ‘প্রগতি’ শিবিরের সঙ্গে যােগ বিচ্ছিন্ন হলেও সাম্যবাদী কবিরা কবিতায় অভ্যর্থিতই হয়েছেন। চার থেকে পাঁচের দশক পর্যন্ত বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখােপাধ্যায়, সমর সেন ছাড়াও গােলাম কুদ্স, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, অরুণাচল বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্য, যুগান্তর চক্রবর্তী, সরােজ আচার্য, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে কবিতা পত্রিকায়। বুদ্ধদেব অবশ্য সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের ক্রমশ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার দরুন তাঁর কবিতার ভবিষ্যৎ বিষয়ে শঙ্কিত ছিলেন, যেমন উদবিগ্ন ছিলেন ‘গণযােগী’ বিষ্ণু দে বিষয়েও। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি বিশ্বাস করতেন ভালাে কবিতা কোনাে বাঁধাধরা নিয়ম মানে না। সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র দুবারই ‘কবিতা’য় লিখেছিলেন—নবম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় ‘অবৈধ’, একাদশ বর্ষের চতুর্থ সংখ্যায় ‘ব্যর্থতা’।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের অকাল প্রয়াণের পর বুদ্ধদেব আশ্চর্য মমতায় অসাধারণ শােকবার্তা লিখেছিলেন ‘কবিতা’-র পাতায় যদিও ব্যক্তিগতভাবে সুকান্ত বুদ্ধদেবের ঘনিষ্ঠ পরিচিত ছিলেন না, তার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেও বহু দূরে ছিলেন বুদ্ধদেব। এই শােকবার্তাগুলিকে ‘কবিতা’-র সম্পদ বলা চলে। দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যক-অভিনেতা-নাটককার জীবনের নানা ক্ষেত্রের সুপরিচিত ব্যক্তিত্বদের বুদ্ধদেব এই বিভাগে স্মরণ করেছেন আর এই বার্তাগুলিরও অধিকাংশেরই রচয়িতা ছিলেন বুদ্ধদেবই— দু-একটি ছাড়া, যেমন ‘পল ভালেরি’ বিষয়ে লিখেছিলেন আলেক্স অ্যারনসন, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী সম্পর্কে আলােকরঞ্জন দাশগুপ্ত।
‘কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশের পরের বছরই “লিটল থিয়েটার’ নামে একটা নাটকের দল গড়ে উঠেছিল, যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন প্রতিভা বসু। অভিনয় করার জন্য লেখা হল বুদ্ধদেবের কাব্যনাট্য ‘অনুরাধা’—অবশ্য, সমকালের কিছু সাহিত্যিক আলােচনার প্রতিক্রিয়াও এই নাটকটি রচনার মূলে ক্রিয়াশীল ছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘পরিশেষ’ ও ‘পুনশ্চ’-র ছন্দোবদ্ধ ভাষার কথ্য-রীতি আর গদ্যের কাব্যিক ব্যবহার নিয়ে সমকালীন নানা আলােচনা, এজরা পাউন্ড আর এলিয়টের প্রভাব, সুধীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘গদ্য-পদ্যের বিরােধ ভঞ্জন’ নিয়ে বিতর্ক,—এইসব আলাপ-আলােচনা থেকেই জন্ম হয়েছিল কাব্যনাট্যটির। অনুরাধা’র সংলাপ ছিল এই রকম ‘এর পর কাল আর এর পর কাল আসিলাে কলকাতার আরাে এক কাল আসিলাে কলকাতার আরাে এক দিন ।
চেয়ে দেখাে কলকাতার আরাে এক সকাল। ১৯৩৬ সালের এক শীতের সন্ধ্যেয় বুদ্ধদেবের সে-সময়ের আবাস যােগেশ মিত্র রােডের বাড়িতেই উঠোনে মঞ্চ বেঁধে ‘অনুরাধা’ নাটক অভিনীত হয়েছিল। অভিনেতার দলে ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শিল্পীবন্ধু অনিল ভট্টাচার্য, নায়িকা প্রতিভা বসু আর নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বুদ্ধদেব নিজেই। আমাদের ‘কবিতাভবন’-এ বুদ্ধদেব লিখেছিলেন, তাঁর আয়ুর অনুপাতে তিনি চাকরি করেছেন অল্পদিনই, তার মধ্যে সবচেয়ে লম্বা মেয়াদে তিনি যুক্ত ছিলেন রিপন কলেজের সঙ্গে। রিপন কলেজের সঙ্গে তার এগারাে বছরব্যাপী যােগাযােগের শুরু জীবনের এই পর্ব থেকেই।
(৬)
কবিতা বিষয়ে যেমন সজাগ, তেমনই খুঁতখুঁতে ছিলেন বুদ্ধদেব—এমনকি ছাপা, বানান, প্রুফ দেখা, সমস্ত আনুষঙ্গিক বিষয়েই নিরলস পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। ‘কবিতা’-র সম্পাদক হিসেবেও একই রকম—কবিতা নির্বাচিত হবার পরেও একটি, দুটি শব্দ নিয়ে, বিশেষ কোনাে পঙক্তির ছন্দ নিয়ে তার ভাবনার অন্ত ছিল না। কবিতা পত্রিকায় প্রকাশযােগ্য কবিতাগুলির ক্ষেত্রে এরকম সমস্যায় সাধারণত কবির সঙ্গে যােগাযােগ করে মীমাংসার চেষ্টা করেছেন সম্পাদক বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের সংশােধনের প্রস্তাব অনেক সময়ে তরুণ কবিদের মনােমতাে হয়নি, অনেকে মেনেও নেননি বুদ্ধদেবের সংশােধনী। অলােকরঞ্জন দাশগুপ্তকে বুদ্ধদেব তাঁর কবিতার একটি শব্দ বদলের পরামর্শ দিলে তারুণ্যের উদ্দীপনায় অলােকরঞ্জন তাতে সম্মত হননি। অনুজ কবির এই দ্বিমতকে অশ্রদ্ধা করেননি বুদ্ধদেব, অলােকরঞ্জনের কবিতা অপরিবর্তিতই ছাপা হয়েছিল ‘কবিতা’-র পাতায়। একইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল আনন্দ বাগচীরও। তার কবিতার দুটি পঙক্তি-বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বুদ্ধদেব। দুটি পঙক্তিকে বজ্ঞানে আঁকড়ে ছিলেন আনন্দ বাগচী। তাঁর কবিতাও হুবহু ছাপা হয়েছিল। আবার, কবিতা সিংহ বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, সম্পাদক বুদ্ধদেবের পরামর্শ মেনে নিয়েছিলেন, তাদের কবিতার সংশােধিত পাঠই ‘কবিতা’য় ছাপা হয়েছিল। ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা হয়েছিল শঙ্খ ঘােষের—‘কবিতা’-য় প্রকাশিত হয়েছিল ‘পাথেয়’ নামে তার একটি কবিতা, আর কবির অজ্ঞাতসারেই কবিতাটির তৃতীয় পঙক্তির একটি শব্দ এবং পঞ্চম-ষষ্ঠপক্তি পুরােটাই পালটে দিয়ে বুদ্ধদেব যেন ছেপেছিলেন অন্য পাথেয়। প্রকাশিত কবিতাটি দেখে তাৎক্ষণিকভাবে খুবই প্রতিক্রিয়া হয়েছিল শঙ্খ ঘােষের, কিন্তু পরে তিনি ভেবেছিলেন, …নতুন লেখকের লেখায় একটু-আধটু কলম চালানােয় কোনাে দোষ তাে নেই-ই, বরং সচেতন বিবেকবান সম্পাদকের সেটা অবশ্য করণীয়। বুদ্ধদেব যে ওই কবিতাটির ভালােই চেয়েছিলেন, তাতে তাে কোনাে সন্দেহ নেই। হয়তাে তাড়াহুড়ােয় (কেন না, মার্চে দেওয়া কবিতাটি মে মাসেই বেরিয়ে গিয়েছিল) তরুণটিকে সামনে ডেকে আর বলতে পারেননি সংশােধনের প্রস্তাব, সেটুকু হলে কিছুই আর বলবার থাকত না।
অনেকটা এইরকম একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীরও, শঙ্খ ঘােষের মতােই প্রকাশিত কবিতার লাইন পালটে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল তাঁর কবিতার ক্ষেত্রেও। নীরেন্দ্রনাথের ছন্দবিন্যাসে মিশ্ৰকলাবৃত্তের ধরনটি পছন্দ হয়নি সম্পাদক বুদ্ধদেবের, কিন্তু সম্পাদকের বদলে-দেওয়া রূপটিও মেনে নিতে পারেননি তরুণ নীরেন্দ্রনাথ, তার মনে হয়েছিল, বুদ্ধদেবের পরিবর্তনের ফলে লাইনটা খুব মসৃণ হয়ে গেল। এর ফলে মিশ্রকলাবৃত্তের যে চলনটা, তার মধ্যে কোনও সংশয় বা পরীক্ষানিরীক্ষা রইল না। আমি তাে এই মসৃণতাটা চাইনি। কিন্তু এই কবিতার প্রকাশ ঘিরে নীরেন্দ্রনাথের অল্পবয়সের ‘দুষ্টুমি’তে আর একটা কৌতুকজনক কাণ্ডও ঘটেছিল। পরিণত বয়সের সাক্ষাৎকারে নীরেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন—
“কবিতা’-সম্পাদক বুদ্ধদেবের কাছ থেকে ‘সত্তর-আশিটা কবিতা’ ফেরত পাওয়ার অভিজ্ঞতার পর, শেষ ফেরত-আসা কবিতাটি স্বনামে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় পাঠাবার আগে বন্ধু ননী ভৌমিকের সঙ্গে বাজি রেখে, তাকে দিয়ে কপি করিয়ে, লেখকের নাম পাল্টে ননী ভৌমিকেরই ঠিকানা দিয়ে কবিতা পত্রিকাতেও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তরুণ কবি নীরেন্দ্রনাথ। অল্পদিন পরেই ‘কবিতা’ আর ‘পূর্বাশা’—দুই পত্রিকা প্রকাশিত হবার পর দেখা গিয়েছিল, একই কবিতা বরুণ দেবের নামে ছাপা হয়েছে ‘কবিতা’-য় আর পূর্বাশা-য় প্রকাশ পেয়েছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নামেই। এ-ঘটনায় কৌতুকই বােধ করেছিলেন ‘পূর্বাশা’-সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য, কিন্তু খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব, বুদ্ধদেবের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল কবিতা’-র পরের সংখ্যার সম্পাদকীয়তে, ‘ঘটনাটার উল্লেখ করে’ নীরেন্দ্রনাথকে ভীষণ ‘বকুনি’ দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব, তবে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বুদ্ধদেবের সে-ক্ষোভ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্মরণসভায় বুদ্ধদেবের সস্নেহ অনুরােধেই ‘কবিতা’-য় আমন্ত্রণ সত্বেও আর কোনােদিন কবিতা লেখেননি তিনি, অবশ্য তার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন— ‘ওই বকুনি খাওয়ার পর আর লেখা যায়?’
কবি শামসুর রহমানকে বুদ্ধদেব বসু চিঠিতে (৩ মে ১৯৫৫) লিখেছিলেন,
“তােমার কাছে অপরাধী আছি, দুটো চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি। কিন্তু নিরুত্তরতা মানেই নিঃসাড়তা নয়। এবারে যে-দুটি কবিতা পাঠিয়েছে তা পড়ে একটা কথা আমার মনে হলাে। কিছুদিন ধরে তুমি অনবরত তিন বা তিন-দুই পাঁচ মাত্রার ছন্দে কবিতা লিখে আসছে। এই ছন্দ ছােটো লিরিকের উপযােগী, কিন্তু কোনাে গম্ভীর ভাবের বড়াে কবিতার পক্ষে নয়। এর মধ্যে একটা মিষ্টত্ব আছে (অন্তত তােমার লেখায়) সেটাও, শেষ পর্যন্ত, হানিকর। প্রবহমানতা এর স্বধর্ম নয়, তার ফলে বাক্যবন্ধ বেঁকে-চুরে যায়, সিনট্যাক্স এলিয়ে পড়ে। তুমি কিছুদিন পয়ারে লেখাে না? বা স্বরবৃত্তে? স্বরবৃত্তের চালও হাল্কা, যেখানে কবিতার সংগঠনের প্রয়ােজন করে সেখানে বাংলা ভাষায় পয়ার ছাড়া উপায় নেই। তােমার বলবার কথাও একঘেয়ে হয়ে আসছে, বিভিন্ন কবিতাকে আলাদাভাবে সব চেনা যাচ্ছে না। অথচ রচনা হিসেবে প্রায় প্রত্যেকটিই ভালাে। কিন্তু শুধু ‘ভালাে লেখা’য় তৃপ্ত থেকো না কবিতা লিখতে চেষ্টা করাে।…”
‘কবিতা’-র শেষ পর্বের দুজন উল্লেখযােগ্য কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। শক্তি তঁার ‘সনেট যম’ পাঠিয়েছিলেন ‘কবিতা’-র ঠিকানায়, সামান্য সংশােধন করে ছাপবেন, এই মর্মে বুদ্ধদেবের চিঠি পেয়ে শক্তির মনে হয়, “হাতে স্বর্গ পাই, কিংবা মনের মধ্যে কি এক অবাস্তব হাওয়া বাড়তে থাকে।” সুনীল জানিয়েছেন, “কবিতা’ পত্রিকায় আমার পাঠানাে প্রথম কবিতাই ছাপা হয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয় কবিতা,— ‘উনিশে বিধবা মেয়ে’—বুদ্ধদেব বসু আমাদের ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়ে লিখলেন, কবিতাটি তার পছন্দ হয়েছে, কিন্তু কিছু কিছু পরিবর্তন করা দরকার। আমি পরিবর্তন করে পাঠালুম। তিনি আবার ফেরৎ পাঠিয়ে বদলাতে বললেন—আমি আবার পাঠালুম, পনেরাে লাইনের কবিতা তিরিশ লাইন হয়ে গেল। এইভাবে বুদ্ধদেব বসু দূর থেকে আমার শিক্ষকতা করেছেন।” সুনীলের প্রথম কবিতা ‘প্রেমের কবিতা’ (আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে’) ছাপা হয় আষাঢ় ১৩৬০ সংখ্যায়। পরবর্তী সাত বছরে সুনীলের মােট ৯টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ‘কবিতা’য়।
কীভাবে শেখানেত বুদ্ধদেব বসু, কবিতা লিখতে শেখানাে সম্ভব কিনা, এসব প্ররে উত্তরের কিছু ইসারা পাওয়া যাবে বুদ্ধদেবের সুনীল-উল্লিখিত চিঠিদুটির একটি থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধার করলে “..তােমার তিনটি কবিতার মধ্যে দুটি আমার বিশেষ ভালাে লাগলাে, তাই কয়েকটা সংশােধনের জন্য লিখছি। বিধবার গল্পটায় গল্পাংশ আর একটু থাকা দরকার, অর্থাৎ ঘটনার গুপ্ত নায়ক, কবিতার ‘আমি’—সে যে শুধু অবিবেকী নয়, ভীরু, কাপুরুয, সাধারণ অর্থে দুর্জন—তার বর্ণনা করে স্তবক থাকা দরকার। বীরসিংহের সিংহশিশুর অনুগ্রহে সে তাে বিয়ে করতে পারতাে, বাঁচাতে পারতাে মেয়েটাকে। সে যে তা ইচ্ছে করেই করলাে না, সেই কথাটা বিনা উচ্ছ্বাসে কেজো এবং উদাস ধরনে বলা চাই, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ল্যাকোনিক’। তাহলেই শেষ চার লাইন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
রচনাতেও ত্রুটি আছে। প্রথম স্তবকে স্তনের উল্লেখের পরে দ্বিতীয় স্তবকে তা আর চলতে পারে না। যদিও ‘আচার, অন্ন’—মানে, নিয়ম-নিষ্ঠা, কিন্তু ঠিক বােঝা যায় না, বদলাতে হবে। সুপবিত্রে’র ‘সু’ নেহাই অক্ষর ভরানাের জন্য এসেছে। দ্বিতীয় স্তবকটি সম্পূর্ণ নতুন করে লেখা দরকার।… এইভাবে দুটি কবিতা পরিমার্জনা করে শীঘ্র পাঠালে আষাঢ় সংখ্যাতেই ছাপা হতে পারে।…”
‘কবিতা’-র এই শিক্ষকতায় বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকার একটি মূল্যায়ন পাওয়া যায় পরবর্তী প্রজন্মের ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায়। ‘কৃত্তিবাস’এর ষােড়শ সংকলনে ‘কবিতা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আক্ষেপ শােনা যায় একটি অস্বাক্ষরিত রচনায়—
“কবিতা পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে বলে বুদ্ধদেব বসুর উপর রাগ করতে পারি না। তবু তিনি অন্তত ২৬ বছর চালিয়েছেন। শুধু মনে হয়, প্রথম লিখতে আরম্ভ করার সময় আমরা ভাবতুম যদি কখনাে কবিতা পত্রিকায় আমার রচনা ওঠে, তবে জীবন ধন্য হবে। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতুম ‘কবিতা’ পত্রিকার দিকে চেয়ে, মলাট ওলটাতে সাহস হত না, যদি সূচীপত্রে আমার নাম না দেখি। এখন যারা কবিতা লিখতে শুরু করবেন—তাদের জন্য এ স্বর্গ রইল না। তারা কোন্ কাগজে নিজের লেখা দেখে জীবন ধন্য করবেন?”
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ‘কবিতা’-র শেষ যুগে নতুন কবিদের কবিতার জগৎ থেকেও যেন দূরে সরে আসছিলেন বুদ্ধদেব, বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন,
“We belonged to the same literary family. As members of a family, we occasionally quarelled but could not ever dream of being separated. He never rejected us. When he folded up ‘Kavita’ it was because he frankly admitted that he had failed to understand the sort of poetry we were trying to produce.But what I am trying to say is that there was no let-up on his part in trying to understand us.’
এইভাবে ‘কৃত্তিবাসগােষ্ঠী’ বলে পরিচিত এবং তাদের সমসাময়িক কবিদের—অর্থাৎ বাংলা আধুনিক কবিতার দ্বিতীয় প্রজন্মের কবিদের কয়েকজনের প্রথম লেখা কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল চৈত্র ১৩৫৬
শঙ্খ ঘােষ ‘পাথেয়’ আথিন ১৩৫৮ আনন্দ বাগচী ‘দুটি কবিতা পৌষ ১৩৫৯
অলােকরঞ্জন দাশগুপ্ত নামখােদাই’ আর্থিন ১৩৬৩ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘বােধি’ চৈত্র ১৩৬২
শরকুমার মুখােপাধ্যায়
(নমিতা মুখােপাধ্যায়’ নামে) মধুর বিস্মৃতি’ আধিন-পৌষ ১৩৬৪
সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত ‘তিন শূন্য’ চৈত্র ১৩৬৪
মণিভূষণ ভট্টাচার্য ‘স্থিতি পৌষ ১৩৬৫
তারাপদ রায় ‘দুটি অপ্রাকৃত কবিতা আথিন ১৩৬৬ দিব্যেন্দু পালিত ‘দয়িতার প্রার্থনা’ পরের প্রজন্মের দুজন বিশিষ্ট কবির রচনা কবিতায় কখনাে প্রকাশিত হয়নি—উৎপলকুমার বসু ও বিনয় মজুমদার। উৎপলের কবিতা নাকি বুদ্ধদেব বসু বুঝতে পারতেন না। আর বিনয় মজুমদার সম্ভবত কবিতায় কখনাে লেখা পাঠাননি।
আমরা কেবল পূর্ব থেকেই বিখ্যাত অথবা ‘কবিতা’ যাঁদের বিখ্যাত করেছে, তাদের কথাই আলােচনা করি কবিতা পত্রিকা প্রসঙ্গে। কিন্তু এমন বহু কবি আছেন যাঁরা ‘কবিতা’য় একবারই মাত্র লিখেছেন অথচ পরবর্তীকালে কবিরূপে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। আবার কেউ কেউ আছেন কবিতার জগতে না হলেও অন্য ক্ষেত্রে কীর্তিমান। আর বেশ কিছু কবি হারিয়ে গেছেন। এঁদের বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর বিশেষ কৌতূহল ছিল। এই থেমে যাওয়া অথবা লুপ্ত কবিদের বিষয়ে কিছু বলার আগে আরাে কয়েকটি তথ্যের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আর্বিন ১৩৪২ থেকে চৈত্র ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত এই পঁচিশ বছরের কিছু বেশি সময়ে কবিতার বাংলা লেখকের সংখ্যা তিনশাে পঁয়তাল্লিশ জনের মতাে। তার মধ্যে মহিলা কবি-সমালােচক হবেন। তিরিশজন। অবশ্য এই তালিকা ত্রুটিযুক্ত হতে পারে। কেননা, আজকের পাঠকের অজানা নেই যে শরৎকুমার মুখােপাধ্যায়ের ‘কবিতা’য় আবির্ভাব নমিতা মুখােপাধ্যায় নামে। অনুরূপভাবে বুদ্ধদেব বসু তার শেষ স্মৃতিচারণে সুস্মিতা সরকারের গদ্যকবিতার কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেই সঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে, এটি কোনাে পুরুষের ছদ্মনাম, তবে নামটি শেষ পর্যন্ত মনে করে উঠতে পারেননি। যাই হােক, কবিতার প্রথম মহিলা কবি প্রতিভা বসু—পৌষ ১৩৪৩-এ তার দুটি কবিতা—পরিচ্ছেদ এবং ‘বিরহ’ প্রকাশিত হয়। এখানে বলা যেতে পারে যে, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে পরিচয়ের আগেই ‘প্রগতি’ পত্রিকার শেষ বর্ষে প্রতিভা বসু একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু তাকে জানান যে, “লেখাটি তার মনঃপুত হয়েছে, বলা যায় ভালােই লেগেছে, তবে দুঃখের বিষয় এই যে, কাগজ আর বেরুবে না। কবিতাটি অন্যত্র কোথাও প্রকাশিত হলে সে খুশি হবে। আপনি অনুমতি করলে সে নিজেই কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারে।” কবিতায় ছাপা প্রসঙ্গে প্রতিভা বসু জানিয়েছেন যে, তিনি নিজেই সম্পাদকের বিবেচনার জন্য তার অজ্ঞাতে তার ফাইলে রেখে দেন। কাছাকাছি সময়ে ডাকে ছায়া দেবীর কবিতা আসে। ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম বছরে কোনাে মহিলা কবি নেই বলে দুই-একজন অভিযােগ করেছিলেন।
‘কবিতা’য় একবারই লিখেছেন এরকম কবির সংখ্যা একশাে জন। এই দীর্ঘ নামের তালিকায় আছেন অবন্তী সান্যাল, অরুণ ভট্টাচার্য, অশােক মিত্র, অসীম রায়, অমল হােম, আনােয়ার পাশা, আল মাহমুদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আহসান হাবিব, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, কাজী নজরুল ইসলাম, কান্তিচন্দ্র ঘােষ, চিত্ত ঘােষ, নৃপেন্দ্র ভট্টাচার্য, প্রণবকুমার মুখােপাধ্যায়, মানসী দাশগুপ্ত, মৈত্রেয়ী দেবী, যশােদাজীবন ভট্টাচার্য, রাম বসু, রামেন্দ্র দেশমুখ্য, শঙ্খ ঘােষ, সানাউল হক, সিদ্ধের সেন, সুশীলকুমার গুপ্ত, স্বদেশরঞ্জন দত্ত, হীরালাল দাশগুপ্ত। বলা বাহুল্য, এঁদের সবাই কবি নন অথবা সেই অর্থে কবিতার চর্চা করেননি, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে বিশিষ্ট।
অমল হােম যে ‘কবিতা’য় একবার কবিতা লিখেছিলেন, সে কথা বুদ্ধদেব বসু ‘আমার যৌবন’-এ উল্লেখ করেছেন। আরেকটি তথ্যের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ‘কবিতা’র দুজন লেখক বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন। ভাষাতাত্ত্বিক প্রাবন্ধিক মােফাজেজল হায়দার চৌধুরী (১৯২৬-৭১) একবারই ‘কবিতা’য় লিখেছিলেন। তবে কবিতা নয়, বুদ্ধদেব বসুর ছন্দ বিষয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন ১৩৫৩-র আর্থিন সংখ্যায়। কবি-ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক আনােয়ার পাশা (১৯৬৮-৭১) মুক্তিযুদ্ধে নিহত হন। ‘নদী-নিঃশেষিত হলে’-র (১৩৭১) কবি আনােয়ার পাশার ‘পথ চলে যে লােকটা’ প্রকাশিত হয় কবিতায়,
“ব্যস্ত হয়ে পথ চলে যে লােকটা আমি তাকে চিনি।
হাটে, মানুষের ভিড়ে, পাটের কারবারে গঞ্জে,
তাকে প্রতিদিনই দেখা যাবে নগ্নপদে বিড়ির টুকরাে চেপে ঠোটে,
নৈশ ব্যবসায়ে কিছু প্রসন্নতা হয়তাে বা জমেছে ললাটে।
জুটেছে স্তাবক বহু, নিষিদ্ধ পাড়ায় আনাগােনা মৃৎপাত্রে
ফেনায়িত স্বদেশী পানীয় আনে অন্য সম্ভাবনা জীবনের নিত্য রাতে,
আর তার চোখের পাতায় কালিমা-আল্পনা আঁকা রাত-জাগা সুখের ছোঁওয়ায়।
এই প্রভাতের রৌদ্রে পথে-চলা ঐ যে পথিক—
নিতান্ত নগণ্য, আছে পৃথিবীর এককোণে অখ্যাত অচেনা, জীবনে সে পৃথিবীকে, মানুষের সভ্যতাকে কিছুই দেবে না। অজানা দেউলে যেন প্রদীপ সে জ্বলবে ক্ষণিক, একদিন নিভে যাবে। তবু এই সৃষ্টির সীমায় তার।
শূন্যস্থানটুকু ভ’রে দিতে অবিকল তার মতাে অন্য কেউ নাই।” যাঁরা কবিতায় একবারই লিখেছেন অথচ পরে কবিতা লেখা বন্ধ করেননি, তাদের সবার ক্ষেত্রে কারণ এক নয়। কারও কারও ক্ষেত্রে ছিল সম্পাদকের প্রতি অভিমান, কারও বেলায় নিছক উদাসীনতা এবং কেউ কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কথা বলেছেন। অশােক মিত্র যে একদা কবিও ছিলেন, সেকথা আজ অনেকে ভুলে গেছেন। কবিতায় প্রকাশিত হয় তার ‘তুমি মাের সর্বনাশ’ কবিতাটি, যার প্রথম কয়েকটি পঙক্তি হল,
“তুমি মাের সর্বনাশ
অগ্নির অক্ষরে
এই কথা লিখে যায় গ্রীষ্মের বাতাস।”
অশােক মিত্র জানিয়েছেন, “কবিতা পত্রিকায়ই শুধু নয়, সাধারণভাবে আমি কাব্যচর্চা থেকে নিজেকে বিরত করেছিলাম। আমার কবিতার প্রধান এবং সম্ভবত একমাত্র—গুণগ্রাহী ছিলেন অরুণকুমার সরকার। বুদ্ধদেব বরাবরই বলতেন আমার কবিতা মক্সো ছেড়ে গদ্যচর্চা করা উচিত। অতি ধ্রুব কথাই বলতেন।”
সিদ্ধের সেনের ‘অনুরণন’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এর প্রথম স্তবক হল,
“আর তাে কিছুই কিছু নয়
জাদুকরী রঙের আকাশে
স্মরণের সায়াহ্নবেলায়,
ক্ষণেক সুরের রেশ ভাসে।”
‘কবিতা’র পুরনাে সংখ্যাগুলি ঘাঁটতে ঘাঁটতে এরকম অনেক মধুর চমক লাগে। নরেন্দ্রনাথ মিত্র কবিতা লিখতেন? তাঁর ‘নিরিবিলি’ কবিতা গ্রন্থের সহৃদয় সমালােচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু “…শ্রীনরেন্দ্রনাথ মিত্রের পাঠকসংখ্যা আজ বিপুল, কিন্তু এ বইখানা পড়ে (বা দেখে) আজকের দিনের কম পাঠকেরই সন্দেহ হবে যে এর প্রণেতা ও তাদের প্রিয় কথাশিল্পী একই ব্যক্তি..নরেন্দ্রনাথ প্রথম যৌবনে গল্পের পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন, আমি কয়েকবার ‘কবিতায় তার রচনাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলাম, কবি হিসেবে তার পরিণতির সম্ভাবনা, সেকালের অন্যান্য উদ্যোক্তাদের তুলনায়, তার মধ্যে কম ছিলাে বলা যায় না।” পৌষ ১৩৪৪ থেকে আষাঢ় ১৩৪৭ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ৫টি কবিতা কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কবিতা’ সাথী হয়ে থাকবে পি জে চৌধুরী, সরােজ (রঞ্জন) আচার্য, সৌরীন্দ্র মিত্রও এককালে কবিতা লিখেছিলেন। সরােজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি-পরিচয়ের কথাই বা ক’জন জানেন?
বুদ্ধদেব বসু তার শেষ স্মৃতিচারণে মুকুল ভট্টাচার্য নামে একজন কবির কথা উল্লেখ করেছেন। এই কবির পরিণতি বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। তাঁর কবিতাটির নাম ‘একুশ’—প্রকাশিত হয় বৈশাখ ১৩৫৭-এ। কবিতাটির কয়েক লাইন হল,
‘এবার গ্রীষ্মে একুশে পড়ল।
হায় রে কোথাও নেই কোরক আমের-জামের।
তা হােক, তা হােক, আমার গ্রীষ্ম একুশে পড়ল।
যেদিকে তাকাই শুকনাে পাতার ঝরা রাশি আর ধুলাে।
তা হােক, তা হােক।
আমার বৃন্তে গ্রীষ্মে কোরক কোন্ পাখি কবে
ফেলে গেছে তার টুকরাে খড়।
সেই খড় উড়ে আমার গ্রীষ্মে উঠল ঝড়?
১৯৬১ সালে ‘কবিতা’-র প্রকাশ বন্ধ হল, আড্ডাও ভেঙে গেল, যখন ১৯৬৬ সালে ২০২, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-র বিখ্যাত ‘কবিতাভবন’ ছেড়ে প্রায় তিরিশ বছরের স্মৃতি নিয়ে বুদ্ধদেব সস্ত্রীক, সপুত্র চলে এলেন নাকতলার নেতাজি সুভাষচন্দ্র রােডে নবনির্মিত বাড়িতে।
(৭)
বুদ্ধদেব প্রথম রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন ঢাকায়, ছাত্রাবস্থাতেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা গিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে, তখন বুদ্ধদেব ঢাকা ইনটারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র। সেই সময় বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথকে প্রথম চোখে দেখেছিলেন বুড়িগঙ্গার ওপর নােঙর-ফেলা একটা স্টিম-লঞ্চে। রবীন্দ্রনাথের ঢাকা আগমন উপলক্ষে আয়ােজিত সভার জন্য একটি ছন্দোবদ্ধ ‘প্রশস্তি’ও বুদ্ধদেব রচনা করেছিলেন, যদিও সেটি সভায় দাঁড়িয়ে পড়ার ভার দিয়েছিলেন বন্ধু সুধীশ ঘটককে। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথও পড়েছিলেন বুদ্ধদেবের কবিতা, সে-কথা জানিয়েছিলেন ১৩৩৮-এর কার্তিকের ‘বিচিত্রা’-য় ‘নবীন কবি’ নিবন্ধে। কিশাের কবিটির লেখায় ছন্দ, ভাষা এবং ভাবগ্রন্থনের পরিচয় পেয়ে তার মনে হয়েছিল, “কেবল কবিত্বশক্তি মাত্র নয়’, বুদ্ধদেবের মধ্যে কবিতার প্রতিভা রয়েছে, একদিন প্রকাশ পাবে। রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যের ভিত্তি শুধু ঢাকায়-পড়া সেই একটি মাত্র কবিতাই নয়, এই সময়ে দিলীপকুমার রায় ‘কাচি-ছাঁটা পাতায়’ বুদ্ধদেবের কয়েকটি কবিতা রবীন্দ্রনাথকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। খণ্ডিত অবস্থায় পড়লেও, বুদ্ধদেবের কবিতার প্রশংসাই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কবিতাগুলিকে বলেছিলেন ‘ছন্দে ভাষায় ও উপমায় ঐধর্যশালী’।
এরপরে বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন কলকাতায়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ৪ ও ৭ চৈত্র, জোড়াসাঁকোর ‘বিচিত্রা’ কক্ষে রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় ‘কল্লোল’ ও কল্লোল-বিরােধীদের বিবাদভঞ্জনী সভা হয়েছিল, সেই সভায় বুদ্ধদেবও উপস্থিত ছিলেন।
১৩৩৮বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছরের জন্মােৎসবে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জয়ন্তী-উৎসর্গ’, ‘রবীন্দ্র পরিচয় সভা’ কর্তৃক প্রকাশিত এই বইটিতে অন্যতম লেখক ছিলেন বুদ্ধদেব। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা প্রবন্ধটির রচয়িতা বুদ্ধদেবের বয়স তখন মাত্র তেইশ।
বুদ্ধদেবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত আলাপ ঘনিষ্ঠ হল ১৯৩৫-এ ‘কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশের পর। ‘কবিতা’-র প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতি ছিল ইচ্ছাকৃতই। বুদ্ধদেব-জায়া প্রতিভা বসু জানিয়েছেন বিস্তৃতভাবে,
“কবিতা পত্রিকা বেরোলাে ১৯৩৫ সনের আশ্বিন মাসে। এই পত্রিকা বার করবার পরিকল্পনা অনেকদিন যাবতই করছিলেন। গল্প-উপন্যাসের অল্প জায়গা থাকলেও তার পাদদেশেই কবিতার আশ্রয় এটা বুদ্ধদেবের পথে কোনােক্রমেই সহনীয় ছিল না। অসহিষ্ণু হয়ে কত সময় কাগজ ছুঁড়ে ফেলতে দেখেছি, তারপরেই বলেছেন, ‘খাই না খাই, এটার জন্য একটা বিহিত আমাদের করতেই হবে। আমি তৎক্ষণাৎ রাজী, নিশ্চয়ই আমি চাঁদা তুলে টাকা দেব তােমাকে। তারপরেই ডাকা হল প্রেমেন্দ্র মিত্রকে, চিঠি লেখা হল অচিন্ত্যকুমারকে, সমর সেন এলেন, কামাক্ষীপ্রসাদ এলেন, সব মাথা একত্র হয়ে তৈরী হল কবিতা পত্রিকা। প্রথম সংখ্যা এদের চ্যালেঞ্জ, রবীন্দ্রনাথের হাত না ধরে চলতে পারেন কিনা তার চ্যালেঞ্জ। সে জন্য প্রথম সংখ্যায় তার লেখা প্রার্থনা করা হয়নি।”
‘কবিতা’-র প্রথম সংখ্যাটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন বুদ্ধদেব, তারপর চিঠিতে প্রার্থনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘দুএকটি কবিতা বা গদ্যের নতুন কোনাে ভঙ্গির রচনা। কবিতা রবীন্দ্রনাথের দান থেকে বঞ্চিত হয়নি, দ্বিতীয় সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ কবিতা। প্রথম সংখ্যার সমালােচনা করে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটিও প্রকাশিত হয়েছিল ‘চিঠিপত্র’ বিভাগে, যে-চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ‘কবিতা’ বিষয়ে তার ভালােলাগা প্রকাশ করেছিলেন। নবীন কবিদের খেয়ার নৌকা এই পত্রিকার প্রতিটি রচনাতেই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-বারােয়ারির দল বাঁধা লেখার মত হয়নি বলে আনন্দিত হয়েছিলেন। এই চিঠিতে প্রত্যেক কবির কবিতা-বিষয়েও আলােচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, গদ্য ছন্দের বৈশিষ্ট্য বিষয়ও আলােচনা করেছিলেন। বুদ্ধদেবের কবিতা সম্পর্কে তার মনে হয়েছিল, তার কবিতা তিনটি গদ্যের কণ্ঠে তালমান-ছেড়া লিরিক এবং ভালাে লিরিক’। ‘কবিতা’-র প্রথম সংখ্যায় বুদ্ধদেবের এই কবিতা তিনটি’ ছিল—‘চিল্কায় সকাল’, ‘ঘুমের গান’, এবং ‘বিরহ’।
রবীন্দ্রনাথ ‘কবিতা’ পত্রিকা যে আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন এবং পড়ে খুশি হতেন তা আমরা রবীন্দ্রনাথের সংশ্লিষ্ট চিঠিপত্র থেকেই জানতে পারি। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র ভবনে রক্ষিত বুদ্ধদেব বসুর কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা ৩৬। ১৩৮১ বঙ্গাব্দের ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায় ‘চিঠিগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর লেখা চিঠিগুলিও ঐ সংখ্যায় পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩৮৩তে বুদ্ধদেব বসুর রচনাসংগ্রহের তৃতীয় খণ্ডে দুজনের সংশ্লিষ্ট চিঠিগুলি গ্রন্থিত হয়েছে। ৩৪ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্র সংখ্যা কবিতা পড়ে মন্তব্য করেছিলেন—এ আমার পরে বিস্ময়জনক।
শুধু মতামত প্রার্থনা নয়, ‘কবিতা’ পত্রিকার জন্য বুদ্ধদেব বারেবারেই রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা প্রার্থনা করে চিঠি দিয়েছেন। এই প্রার্থনা সম্বলিত চিঠিগুলির ভাষা ও বিনম্রতা বিশেষভাবে লক্ষ করার মতাে—
১. ‘আগামী সংখ্যার জন্য আপনার দু’একটি কবিতা প্রার্থনা করি। গদ্যের নতুন কোনাে ভঙ্গির রচনা পেলে খুশি হই।
২. ‘আশাকরি ‘কবিতা’র দ্বিতীয় সংখ্যা আপনার কাছে পৌঁছেছে। এর পরবর্তী সংখ্যার জন্য আপনার একটি কবিতা প্রার্থনা করি। এবারে আপনার দীর্ঘ ও সুন্দর কবিতাটি পেয়ে এমন মনে করবার সাহস হয়েছে যে, এই ত্রৈমাসিক হয়তাে আপনার সহযােগিতা থেকে বঞ্চিত হবে না। এমনি গদ্যের কোনাে নতুন ঢঙের দীর্ঘ কবিতা পেলে খুব খুশি হবাে।
৩. কবিতার আগামী পৌষ সংখ্যার জন্য আপনার একটি কবিতা পেলে খুব খুশি হব। আপনার গদ্য কাব্যে যে বৈচিত্র্য ও বিস্তৃতি প্রকাশ পাচ্ছে, তার ফসল থেকে ‘কবিতা’কে নিশ্চয়ই বঞ্চিত করবেন না?’
৪. ‘গত বছরের মতাে এবারের বৈশাখে ‘কবিতা’র একটি বিশেষ সংখ্যা বার করবার ইচ্ছা করছি। এই সংখ্যার জন্য আপনার একটি রচনা প্রার্থনা করি।
৫. আগামী আশ্বিনে ‘কবিতা’র পঞ্চম বর্ষের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হবে। এই সংখ্যার জন্যে আপনার একটি কবিতা প্রার্থনা করি।
৬. ইতিমধ্যে আর্থিন সংখ্যার জন্য একটি কবিতা কি পেতে পারি? আপনার ভাণ্ডার তাে অফুরন্ত, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কবিতাটি পেলে ছাপার কাজ আরম্ভ করতে পারি।
সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘতম চিঠিটি দিয়েছিলেন মৃত্যুর আড়াই মাস আগে। ঐতিহাসিক ঘটনা, ঐতিহ্য পারম্পর্য কিভাবে সাহিত্যে প্রতিফলিত হবে তা ঐ দীর্ঘতম চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন। বুদ্ধদেব এই চিঠিটি কবিতায় প্রকাশ করার অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তার অনুমতিও দিয়েছেন। বুদ্ধদেবের গল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে অভিমত চিঠিতে জানিয়েছিলেন সেগুলিও বুদ্ধদেব ‘কবিতা’য় প্রকাশ করবার আগে চিঠি লিখে অনুমতি নিয়ে নিয়েছেন।
১৯৩৮-এর জুলাই মাসে ‘কবিতা’-য় রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত সদ্যপ্রকাশিত ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’-এর ক্ষুব্ধ সমালােচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব। এই দীর্ঘ সমালােচনায় বুদ্ধদেব বইটির নানা অসংগতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। গভীর অতৃপ্তিতে পরেও ‘আমাদের কবিতাভবন’-এ লিখেছিলেন, এমন একটি নিশ্চরিত্র সংগ্রহ যে চোখে দেখেও বির্বাস হয় না রবীন্দ্রনাথই সম্পাদক। আধুনিকদের মধ্যে জীবনানন্দ অবহেলিত বিষ্ণু দে এবং সমর সেন সংকলনটিতে অনুপস্থিত, এটা সহজে মেনে নিতে পারেননি বুদ্ধদেব। শােনা যাচ্ছিল, অচিরকালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’-এর যাবতীয় ব্যর্থতা সংশােধন করে পরিমার্জিত একটি সংস্করণ সম্পাদনা করবেন, কিন্তু সেই প্রতীক্ষায় শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বুদ্ধদেব নিজেই একদিন কাজে নেমে পড়লেন। নেমে পড়লেন, কিন্তু নিজে নেপথ্যে থেকে, সংকলনের দায়িত্ব দিলেন দুজন বৈদগ্ধ্যবান ব্যক্তির হাতে যাঁরা কবি নন—আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়। আধুনিক বাংলা কবিতা’ (শ্রাবণ ১৩৪৬) শীর্ষক এই সংকলনটির নির্বাচনে প্রথম কবি রবীন্দ্রনাথ, শেষ হয়েছে তরুণতম সুভাষচন্দ্র মুখােপাধ্যায়-এর কবিতা দিয়ে। আঠাশ পৃষ্ঠাব্যাপী সম্পাদকদ্বয়ের পৃথক দুটি ভূমিকা বাদ দিয়েও, একশ নব্বই পাতায় পঁয়ত্রিশ জন আধুনিক কবিকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। কিন্তু এই নির্বাচনে বুদ্ধদেব স্বয়ং সন্তুষ্ট হতে পারেননি, সংকলনটির অপরিপূর্ণতার কথা উল্লেখ করে পরবর্তীকালে লিখেছেন,
“আমরা আরম্ভ করেছিলাম, লিপিকা’ দিয়ে, কথা ছিলাে বিশ শতকের সত্যিকার প্রতিনিধি হবে বইটা কিন্তু নির্বাচন কালেই লক্ষ্য করেছিলাম সেই ধরণের কবিতা প্রাধান্য পাচ্ছে যাকে তখনকার ভাষায় বলা হতাে ‘সমাজসচেতন’, তুলনায় অন্য জাতের কবিরা উপেক্ষিত হচ্ছেন—ভূমিকা দুটিতেও সেই ভক্তি সুপরিস্ফুট। আমার পথে সবচেয়ে বড় বেদনার কারণ জীবনানন্দ—যাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র পরেও আরাে অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা বেরিয়ে গেছে ততদিনে, অথচ যিনি স্থান পেয়েছিলেন অতি সংকীর্ণ, আমি বহু তর্ক করেও অন্যান্যদের বােঝাতে পারিনি যে জীবনানন্দ শুধু ‘বর্ণনাধর্মী’ লিপিকার নন, অতি গভীর ভাবনাঋদ্ধ এক কবি, আমাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। আমি অগত্যা আপস করেছিলাম যাতে অন্তত বইটা বেরিয়ে যায় এবং বন্ধুতা অটুট থাকে, কিন্তু অসন্তোষ ভুলতে পারিনি। এবং এই কারণে এবং প্রকাশকের ইচ্ছা অনুসারেও, যখন চৌদ্দ বছর পরে নতুন সংস্করণের ডাক এলাে, আমি সম্পাদনার ভার গ্রহণ করলাম।”
বলাবাহুল্য, বুদ্ধদেবের সম্পাদনায় শেষােক্ত সংকলনটির কলেবর বৃদ্ধি লাভ করেছিল কবি ও কবিতার নতুন সংযােজনে, মােট উনপঞ্চাশ জন কবি স্থান পেয়েছিলেন। সম্পাদিত সংকলনটিতে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন করেছেন নিজের কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। কবি ও কবিতার নির্বাচনে সর্বোপরি সংকলনটির চরিত্র নির্ধারণে বুদ্ধদেবের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির ফলে, শিরােনাম এক থাকা সত্ত্বেও, সব রকমের অদল-বদলসহ, শেষােক্ত সংকলনটি প্রায় নতুন গ্রন্থের মর্যাদা দাবী করে।
বুদ্ধদেবের নিজস্ব সম্পাদনায় ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-র যে নতুন সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল তা এক নতুন চেহারা পেল। এই নতুন সংস্করণের সূচনায় বুদ্ধদেব নতুন ভূমিকা লিখলেন, তাতে আধুনিক বাংলা কবিতার একটি নতুন সংজ্ঞা নির্দেশ করলেন। এই সংস্করণে সংযােজিত হল প্রমথ চৌধুরী ও অবনীন্দ্রনাথের কবিতা, আর সুধীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-অমিয় চক্রবর্তীবুদ্ধদেব তিরিশের এই পঞ্চপাণ্ডবের পারস্পরিক বৈচিত্র্যকে চিহ্নিত করে বুদ্ধদেব জানালেন, তারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্রভাবে ‘নতুন’, সেই সঙ্গে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তরুণতর আধুনিক কবিদের দিকেও।
‘আধুনিক বাংলা কবিতা’র নবতম সংস্করণে, পূর্বোক্ত সম্পাদকদ্বয়ের ভূমিকা দুটি স্বাভাবিক কারণেই বর্জিত, কিন্তু বুদ্ধদেব তার নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় নিজের সম্পাদনার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সুন্দরভাবে জানিয়েছেন “বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার সমগ্র রূপটি দেখবার পক্ষে যাতে সাহায্য হয়, এই গ্রন্থ সংকলনে মনে মনে আমি তাই ইচ্ছে করেছি। আশা করি সে ইচ্ছে একেবারে ব্যর্থ হবে না। অবশ্য ‘সমগ্র’ বললে বড্ড বেশি বলা হয়ে যায় ছােটো নৌকোয় ইচ্ছেমতাে যাত্রী তুলতে পারিনি, আমি যেমন নির্বাচন করতে গিয়ে বারংবার লােভে দ্বিধায় কম্পমান হয়েছি, তেমনি কোনাে পাঠকও নিশ্চয় নালিশ জানাবেন তাদের বিশেষ প্রিয় কোনাে কোনাে কবিতা নেই বলে। তবু অন্তত এটুকু বলা যায় যে গত পঁচিশ বা তিরিশ বছরের বাংলা কবিতার মােটামুটি পরিচয় থাকলাে এখানে, অন্তত আগ্রহ জানাবার পথে, আনন্দ পাবার পথে, ফিরে ফিরে পড়ার এবং ভাষার পক্ষে যথেষ্ট।
নিশ্চয় এই বইয়ের ভাগ্যে এমন পাঠকও জুটবে, যিনি এটুকু পরিচয়েই তৃপ্ত হবেন, আর যদি কারাে মনে আরাে নিবিড় ও বিস্তারিতভাবে জানাবার জন্য আগ্রহে জেগে ওঠে সে তাে খুব সুখের কথাই।”
এই সংকলন-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে বুদ্ধদেব জানিয়েছিলেন যে, এই বইতে রবীন্দ্রনাথের কবিতাই প্রথম ও প্রধান হলেও বইটি তারা উৎসর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশেই, কারণ অনুজ কবিরা তাদের শ্রদ্ধার অর্ঘ্য রবীন্দ্রনাথকেই নিবেদন করতে চান। আধুনিক কবিতার এই নতুন সংকলনটি আস্ত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে, সে-কথা তিনি বুদ্ধদেবকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন শিশুতীর্থ নামে তাঁর ‘কক্ষচ্যুত পথহারা’ ‘গদ্যছন্দের রচনাটি’কে অখ্যাতি থেকে উদ্ধার করে এই সংকলনে স্থান দেবার জন্য সংকলনকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছিলেন।
তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থের নামকরণেই তিনি রবীন্দ্র-শরণাপন্ন হয়েছেন। রডােডেনড্রন গুচ্ছ’ (১৯৩২), ‘যেদিন ফুটলাে কমল’ (১৯৩৩), ‘হে বিজয়ী বীর’ (১৯৩৩), ‘একদা তুমি প্রিয়ে’ (১৯৩৩), ‘ঘরেতে ভ্রমর এলাে’ (১৯৩৫), ‘হঠাৎ আলাের ঝলকানি’ (১৯৩৫), ‘আমি চঞ্চল হে’ (১৯৩৭), ‘সব পেয়েছির দেশে’ (১৯৪১), ‘ছায়া কালাে-কালাে’ (১৯৪২), ‘অন্য কোনখানে’ (১৯৫০) গ্রন্থগুলি সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
১৩৪২-এর পৌষ সংখ্যা থেকে ১৩৬৭-এর আষাঢ় সংখ্যা পর্যন্ত কবিতা পত্রিকার পাতায় বুদ্ধদেব বসু একদিকে রবীন্দ্র রচনাবলীর সমালােচনা সূত্রে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পূর্ব রচনাগুলি সম্পর্কে যেমন আলােচনা করেছেন, তেমনি সদ্য প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাগুলি নিয়েও আলােচনা করেছেন। এভাবে সমকালে প্রকাশিত বহু স্বতন্ত্র কবিতা ছাড়াও, ‘ছেলেবেলা’, ‘রােগশয্যায়, ‘আরােগ্য’, ‘গল্পস্বল্প’, ‘গােরা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চিঠিপত্র ১-৬ খণ্ড’, ‘শেষের কবিতা’, ‘দুই বােন’, ‘মালঞ্চ’, ‘আত্মপরিচয়’, ‘সাহিত্যের স্বরূপ’, ‘চার অধ্যায়’, ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’, ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’, ‘লেখন’, ‘বৈকালী’, ‘বুদ্ধদেব’ প্রভৃতি রবীন্দ্ররচনার সমালােচনা প্রকাশিত হয়েছে ‘কবিতা’র পাতায়। রবীন্দ্ররচনাবলী-অষ্টাদশ খণ্ড পর্যন্ত সমালােচিত হয়েছে। এ ছাড়াও রবীন্দ্র-রচনার ইংরেজি তর্জমা এবং ভিন্ন ভিন্ন লেখক-সমালােচকদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত বহু গ্রন্থ প্রবন্ধ সমালােচনাও ‘কবিতা’র পৃষ্ঠায় পর্যালােচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ছােটো কবিতা, রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্র সমালােচনা, ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য, রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও গদ্যশিল্প—প্রভৃতি বিষয় নিয়ে সাধারণ আলােচনাও করেছিলেন বুদ্ধদেব তাঁর ‘কবিতা’র পাতায়। কিন্তু অসীম রবীন্দ্রসাগর সঙ্গমে স্নান করা যে তার অসাধ্য—সেই দীনতা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে তিনি বলেছেন।
‘রচনাবলী’র প্রথম খণ্ড হাতে পেয়ে, অন্য অনেকের মতাে, আমিও খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম, এমনকি, নিজের সাধ্যের সীমা বিচার না করেই, হাত দিয়েছিলাম তার সমালােচনায়। আশা ছিলাে, কবিতা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এক-একটি খণ্ডের সমালােচনা লিখে যাবাে। এইভাবে নতুন করে রবীন্দ্রনাথ পড়াও হবে, আর তার বিষয়ে আমার বহুদিনের সঞ্চিত এবং অনবরত পরিবর্তমান ভাবনাগুলিকেও অন্তত নিজের কাছে, স্পষ্ট করে তুলতে পারবাে।…
আলােচ্য বিষয়ের পরিমাণের কাছে আমার সংকল্পের পরাভব ঘটতে দেরি হলাে না। নিজের অবসরের সঙ্গে রবীন্দ্রপ্রতিভার আয়তনগত বৈষম্য লক্ষ করে, কয়েকটি প্রবন্ধ লেখার পর, আমি আলােচনার জন্য শুধু কথা সাহিত্যকে বেছে নিলাম। কবিতা ও অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে কথা সাহিত্যের প্রতি এই পক্ষপাত আকস্মিকভাবে ঘটেনি, একাধিক কারণ ছিলাে তার। প্রথমত, আমার মনে হলাে, রবীন্দ্রনাথের কবিতার তুলনায় কাহিনীর আলােচনায় আমার পক্ষে অপঘাতের আশঙ্কা কম, কেন না তার কবিতা বিষয়ে আমি তখন পর্যন্ত (হয়তাে এখনাে পর্যন্ত) মনস্থির করতে পারিনি, কিংবা সেই বিরাট বিষয়ের সমকক্ষ হতে আমাদের দেরি আছে। দ্বিতীয়ত, আমি অনুভব করেছি (এখনাে করি) যে এই কথাসাহিত্য বাঙালি পাঠকের কাছে যথাযােগ্য সম্মান পায়নি।”
‘কবিতা পত্রিকার পাতায় রবীন্দ্র প্রসঙ্গ নিয়মিত এবং বিশেষভাবেই আলােচিত হত কিন্তু প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেবের সারা জীবনের লেখালেখির একটা বড়াে অংশই রবীন্দ্র-সাহিত্যকে কেন্দ্র করে রচিত তার সাহিত্য-প্রবন্ধগুলি। রবীন্দ্রনাথ কথাসাহিত্য (১৯৫৫), ‘Tagore : Potrait of a Poet’ (১৯৬২), ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৬৩), বা কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)—প্রভৃতি নানা উপলক্ষে রচিত বইতে বা নানা নিবন্ধে বুদ্ধদেবের রবীন্দ্র-ভাবনার পরিচয় ছড়ানাে আছে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করা যায় যে, যদিও ‘পূরবী’-র কবিতা-আবৃত্তি বুদ্ধদেবের নবযৌবনের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা, ‘শেষের কবিতা’ বা ‘চার অধ্যায়’ বিষয়ে তার অভিনিবেশ গভীর, রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের গদ্যছন্দ বা গদ্যভাষা—বিষয়েও তিনি উচ্ছ্বসিত, কিন্তু তবু ‘মানসী’ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বের রবীন্দ্র রচনা যতটা আকর্ষণ করে বুদ্ধদেবকে, ‘বলাকা’ থেকে ‘শেষ লেখা’ পর্বের রবীন্দ্র রচনার উত্তরখণ্ড-বিষয়ে তিনি যেন ততটাই উদাসীন। শুধু রচনাবলির বিচারে নয়, আবাল্য-প্রিয় রবীন্দ্রনাথকেই যেন দুটি সত্তায় বিভক্ত করে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব—একটি তার শিল্পীসত্তা, অন্যটি তার সমাজমনস্ক সত্তা। নিজের মনের প্রবণতার সঙ্গে রং মিলিয়ে শিল্পী, মরমি রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটিতেই আকৃষ্ট হয়েছেন বুদ্ধদেব, সমাজসচেতন সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের প্রতিমা তাকে আকর্ষণ করেনি। বুদ্ধদেব যেন নিজের জগৎকেই খুঁজেছেন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে, আর নিজের জন্য গড়ে নিয়েছেন নিজস্ব এক রবীন্দ্রনাথ।
তিনের দশকের শেষে সারা দেশে উত্তেজনা ও বিতর্কের ঝড় উঠেছিল—‘বন্দেমাতরম্ গানটি ভারতের জাতীয়সংগীত হিসেবে গৃহীত হতে পারে কি না, এই ছিল সেদিনের তর্কের বিষয়। এই সময়ে ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকায় এই বিষয়ে বুদ্ধদেবের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, যা পড়ে বুদ্ধদেবকে ‘বন্দেমাতরবাদীর পথে’ মনে করে বিস্মিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এক চিঠিতে (২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৭)রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবকে লিখেছিলেন,
“শ্রীহর্ষে বন্দেমাতরমপন্থীর পথে তােমার লেখা পড়ে বিস্মিত হয়েছি …তুমি আমাকে গাল দাওনি। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়।”
বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে ওই চিঠিতে বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছিলেন,
“তর্কটা হচ্ছে এ নিয়ে যে ভারতবর্ষে ন্যাশনাল গান এমন কোনাে গান হওয়া উচিত যাতে একা হিন্দু নয়, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান—এমনকি ব্রাহ্মও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভত্তির সঙ্গে যােগ দিতে পারে। তুমি কি বলতে চাও, ‘ত্বংহি দুর্গা’ ‘কমলা কমলদল বিহারিণী’ ‘বাণী বিদ্যাদায়িনী’ ইত্যাদি হিন্দু দেবী নামধারিণীদের স্তব যাদের প্রতিমা পূজি মন্দিরে মন্দিরে’ সর্বৰ্জাতিক গানে মুসলমানদের গলাধঃকরণ করাতেই হবে। হিন্দুদের পক্ষে ওকালতি হচ্ছে এগুলি আইডিয়া মাত্র। কিন্তু যাদের ধর্মে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ তাদের আইডিয়ার দোহাই দেবার কোনাে অর্থই নেই।”
দেশ জুড়ে বাঙালি হিন্দু সমাজের উন্মত্ত বিক্ষোোভের আলােড়নে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত রবীন্দ্রনাথের চিঠির উত্তরে বুদ্ধদেব ১৯৩৮-এর ১ জানুয়ারি লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘শ্রীহর্ষ’-এর প্রবন্ধ তিনি যথেষ্ট বিস্তৃতভাবে লিখতে পারেননি। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজের মনােভাব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধদেব, জানিয়েছিলেন, ‘বন্দেমাতরম’ বাক্যটিই শুধু স্লোগান হিসেবে মূল্যবান বলে তিনি মনে করেন, সমগ্র গানটি যে ‘অহিন্দু ভারতের একেবারেই অযােগ্য—এবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার কোনােই মতদ্বৈধ নেই।
(৮)
খ্যাতনামা হােক আর না হােক যে কোনাে কবির রচনাকে সমান মর্যাদা দিয়ে যথার্থ শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রসাধনের বৈশিষ্ট্যে প্রকাশ করাটাই ছিল সম্পাদক বুদ্ধদেবের আবির্ভাবকালীন মূল উদ্দেশ্য কিন্তু রচনাকালীন উপন্যাসের মতাে ‘কবিতা’সেই প্রাথমিক পরিকল্পনা অতিক্রম করে নিজে নিজেই বেড়ে উঠল।” এবং এই মন্তব্য অনুসরণ করে আজ নতুনভাবে স্মরণ করা দরকার ‘কবিতা’কে সাফল্যের উঁচু মঞ্চে উত্তীর্ণ করে একটি বিশেষ যুগকে ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত করে গিয়েছেন বুদ্ধদেব। কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় প্রায় আঠারাে বছর পরে, তার অভিযানের সুবর্ণ সাফল্যের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ‘কবিতা’র সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন,
“কবিতা— বিশেষত বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতা—এই বিষয়টার একটি একান্ত রঙ্গমঞ্চ গড়ে উঠলাে যেন—রচনায়, আলােচনায়, কোনাে এক সময়ে সংলগ্ন এক পয়সায় একটি গ্রন্থমালায়। সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র কবিতাকে এই প্রাধান্য দেবার প্রয়ােজন ছিলাে, নয়তাে সেই উঁচু জায়গাটি পাওয়া যেতাে না, সেখান থেকে উপেক্ষিত কাব্যকলা লােকচ র গােচর হতে পারে। ‘কবিতা’ যখন যাত্রা করেছিলাে, সেই সময়কার সঙ্গে আজকের দিনের তুলনা করলে এ কথা মানতেই হয় যে কবিতা নামক একটা পদার্থের অস্তিত্ব বিষয়ে পাঠক সমাজ অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন, সম্পাদকেরাও একটু বেশি অবহিত—এমনকি সে এতদূর জাতে উঠেছে যে কবিতা লিখে অর্থপ্রাপ্তিও আজকের দিনে কল্পনার অতীত হয়ে নেই।”
‘কবিতা’ তার নিরলস শ্রমের গুণে পত্রিকা থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এমনকি শুধু বাংলা কবিতার সীমানায় আটকে থাকেনি ‘কবিতা’, সম্পাদকের দূরদৃষ্টিতে ‘কবিতা’ বিশ্বকাব্যচর্চা বিদ্যালয়ের ভূমিকাও পালন করেছে।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে ‘প্রগতি’ পত্রিকার সম্পাদনার প্রধান দায়িত্ব ভার হাতে নিয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব, কিন্তু সাতাশ বছর বয়সে তার নেতৃত্বে ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রকাশ বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক উদ্যোগ হিসাবেই চিহ্নিত। আসলে, বাংলা সাহিত্যে উত্তর-রবীন্দ্র আধুনিক কাব্যশাখার অগ্রগতির প্রয়ােজনের সঙ্গেই সম্পৃক্ত হয়ে উঠেছিল তার দীর্ঘ সম্পাদক-জীবন। কেবলমাত্র কবিতা এবং কাব্য-আলােচনা দিয়ে কোনাে পত্রিকা প্রকাশ করার দুঃসাহস বুদ্ধদেব বসুর আগে কেউ করেননি। ‘কবিতা’ যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তার আগে পর্যন্ত অধিকাংশ পত্রিকাতেই কবিতার প্রয়ােজন হতাে শুধুমাত্র পাদ পূরণের জন্য। কবিতা লিখে সম্মান-দক্ষিণা পাবার কথা কবিরাও কল্পনানেত্রে তখন দেখতে পাননি। বুদ্ধদেব বসু কবিতার সেই অপমান ঘুচিয়েছেন। কবিতার ইতিহাস তাই কবি ও কবিতার সম্মানিত হওয়ার ইতিহাস। বাইরের দিক দিয়ে শান্ত কিন্তু অন্তরে চির-অশান্ত এই মানুষটি তার প্রতিভা, উদ্যম, উৎসাহ ও কর্মকুশলতায় বাংলার সাহিত্য ক্ষেত্রে এমন একটি স্বাক্ষর রেখেছেন যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. সমীর সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসুর জীবন, দ্বিতীয় সংস্করণ, বিকল্প, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ৬৯।
- ২. বুদ্ধদেব বসু, আমাদের কবিতাভবন, শারদীয় দেশ, ১৯৮১, কলকাতা। বুদ্ধদেব বসু, সাহিত্যপত্র স্বদেশ ও সংস্কৃতি, বেঙ্গল পাবলিশার্স, ১৯৫৭, কলকাতা, পৃ. ১০৮
- ৩. ‘বিচিত্রা’, কার্তিক ১৩৪২। সমীর সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসুর জীবন, দ্বিতীয় সংস্করণ, বিকল্প, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ৯১-৯২।
- ৪. ২৫ মে ১৯৩৭ সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে চিঠি, ২৫ নং, চিঠিপত্র-১৬, বিভারতী, কলকাতা।
- ৫. দেশ সাহিত্য সংখ্যা, কলকাতা, ১৩৮১।
- ৬. ‘দ্য টাইমস’, ৩৫বর্ষ, সংখ্যা-১৭৭৫, ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬, সুবীর রায়চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু ‘প্রগতি’ থেকে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’, ‘কলকাতা’ ২০০০, ১ম বর্ষ, ৮-৯ যুগ্ম সংখ্যা, নববর্ষ ১৩৯১, পৃ. ৫৬। কবিতা’, ‘বিদেশী সাহিত্য বিভাগ’, আষাঢ় ১৩৫৩।
- ৭. সুভাষ মুখােপাধ্যায়, শাপভ্রষ্ট দেবশিশু, কলকাতা, ৭-৮ যুগ্মসংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৬৮-জানুয়ারী ১৯৬৯, দেখুন-জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত, বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা, প্রতিভাস, কলকাতা, ২০০২, পৃ. ৩১।
- ৮. ‘কবিতা’, সম্পাদকীয়।
- ৯. বুদ্ধদেব বসু রচনাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃ. ৫৮৩।
- ১০. সুবীর রায়চৌধুরী, কবিতা ও সে-যুগের লেখক সমাজ, দেশ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৯৭, কলকাতা।
- ১১. রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র, ষােড়শ খণ্ড, বিভারতী, কলকাতা, পৃ.১৯৫।
- ১২. কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ‘কবিতার সাত বছর’, ‘কলকাতা’, ৭-৮ যুগ্মসংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৬৮-জানুয়ারী ১৯৬৯, দেখুন জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত, বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা, প্রতিভাস, কলকাতা, ২০০২, পৃ. ৫০।
- ১৩. প্রভাতকুমার দাস, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু ‘প্রগতি’ থেকে ‘কবিতা’, দেখুন- তরুণ মুখােপাধ্যায় সম্পাদিত, শতবর্ষে বুদ্ধদেব বসু, ইউনাইটেড বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ২৫১-৫২।
- ১৪. শঙ্খ ঘােষ, তিরিশ বছর আগে, সাহিত্য মেলা, শান্তিনিকেতন, ১৯৮৯, এখন সব অলীক, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৪০১, পৃ. ২৭।
- ১৫. বুদ্ধদেব বসু, পাস্টেরনাক প্রসঙ্গে, দেখুন-সঙ্গ-নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ, এম সি সরকার অ্যাণ্ড সন্স, কলকাতা, ১৯৬৩, পৃ. ৬০।
- ১৬. শক্তি চট্টোপাধ্যায়, গদ্যের গাস্থ্যে, দেশ সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৮৩, শক্তি চট্টোপাধ্যায় গদ্য সংগ্রহ-১, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ. ১৫।
- ১৭. ‘কবিতার অনুবাদ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘কবিতা’, আষাঢ় ১৩৬১।
- ১৮. সুদক্ষিণা ঘােষ, বুদ্ধদেব বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ৫৯-৬০।
- ১৯. বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত, আধুনিক বাংলা কবিতা, কলকাতা, ১৩৬০, পৃ. ১৬।
- ২০. বুদ্ধদেব বসু, ‘অনুরাধা’, ৩০ নভেম্বর, কবিতাভবন বার্ষিকী-২, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ২৭৫।
- ২১. মল্লিকা সেনগুপ্তকে দেওয়া নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার, ‘বইয়ের দেশ’, এপ্রিল-জুন ২০০৬, কলকাতা, পৃ. ১৪০-৪১।
- ২২. ভূঁইয়া ইকবাল, বুদ্ধদেব বসু, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ১৬৪।
- ২৩. শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এইসব পদ্য, দেশ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৭৯, কলকাতা।
- ২৪. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবিতার সুখদুঃখ, ‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৭৯, কলকাতা।
- ২৫. প্রভাতকুমার দাস, কবিতা পত্রিকা সুচিগত ইতিহাস, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ, পৃ. ৭১।
- ২৬. ‘কৃত্তিবাস’, চৈত্র ১৩৬৯।
- ২৭. দেশ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৮২।।
- ২৮. সুবীর রায়চৌধুরী, বাংলা কবিতাপত্রের ইতিহাস, দেখুন-অলােকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, আধুনিক কবিতার ইতিহাস, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৪১৯।
- ২৯. পত্রসংখ্যা-২, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫, ‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৮১, কলকাতা।
- ৩০. রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র, ষােড়শ খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলকাতা, পৃ. ৪৬৭-৬৮।
- ৩১. বুদ্ধদেব বসু রচনা সংগ্রহ, খণ্ড-৩, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃ. ৫৯০।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।