লিখেছেনঃ চৌধুরী আতিকুর রহমান
ব্রিটিশ শক্তি প্রথমবার বাংলা দখলের চেষ্টা করেছিল কবে? ইতিহাসের ছাত্ররা লাফিয়ে উঠে বলবেন কেন পলাশীর প্রান্তরে, ১৭৫৭-তে। আজ্ঞে না, উত্তর সঠিক নয়। ১৭৫৭-এরও আগে শক্তিশালী মুঘলদের সময় তারা একবার চেষ্টা চালিয়েছিল বাংলার কয়েকটা বন্দর ও সারা ভারতে কয়েকটি বন্দর দখলের প্রয়াসের মাধ্যমে। যদিও তাদের সেই প্রয়াস নিষ্ফল হয় এবং শক্তিশালী মুঘল বাহিনীর সামনে পড়ে ন্যাজে-গোবরে হয়ে তারা বাংলা ছাড়তে বাধ্য হয়। এ ব্যাপারে ইতিহাসের ধূসর পাতা একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক। ১৬৬৮ সালে বাংলার ইংরেজ বণিকদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার পাউন্ড ও ১৬৭৫-এ ছিল ৬৫ হাজার পাউন্ড। ১৬৭৭-এ এই রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লক্ষ পাউন্ড। ১৬৮০ ও ১৬৮১ সালে তা দাড়ায় যথাক্রমে ১.৫ লক্ষ ও ২.৩ লক্ষ পাউন্ডে। তবে এই বানিজ্য বৃদ্ধিতে শুধুমাত্র রপ্তানিই ছিল আমদানি ছিল না। কেননা তখনও পর্যন্ত পিছিয়ে থাকা ইউরোপের কর্মক্ষমতা, উদ্যম ও আলস্য বিমুখতা ছাড়া ভারতকে দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না। মুনাফা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও সুবেদারকে দেওয়া নজরানা বা ট্যাক্স ছিল বার্ষিক সেই ৩ হাজার টাকা। ফলে অন্যান্য বিদেশী বণিকদের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বণিকদেরও লোকসান হত। ১৬৮০ সালে আওরঙ্গজেব এই ব্যবস্থা বাতিলের উদ্দেশ্যে ফরমায়েস, রাহদারি, পেশকস ইত্যাদি ব্যক্তিগত উপঢৌকন রদ করে সকলের জন্য সমান বাণিজ্যনীতি বহাল করেন। তিনি সকলের জন্য ৩.৫ শতাংশ (২% পণ্যের জন্য, ১.৫% জিজিয়া কর) কর ধার্য করেন।
সুবিধাভোগী ইংরেজ ঔদ্ধত্য দেখিয়ে তৎকালীন কাশিমবাজার কুঠি প্রধান জব চার্নকের নেতৃত্বে যুদ্ধং দেহি মনোভাব নেয়। মুম্বাই, চেন্নাই ও বাংলার ইংরেজ পরিকল্পনা করেছিল একযোগে মুম্বাইকে কেন্দ্র করে পশ্চিম উপকূল ও পূর্ব উপকূলের চট্টগ্রাম আক্রমণ করে দখল করে নেবে। এই মর্মে তারা সুরাট ও পশ্চিম উপকূলের অন্যান্য বন্দর থেকে সমস্ত ব্যবসা গুটিয়ে এনে মুম্বাইয়ে একত্রিত করে। এছাড়া নির্দেশ দেওয়া হয় সমস্ত মুঘল জাহাজকে আক্রমণ করে দখল করার। এমনকি এতদূর পরিকল্পনা করা হয় যে, চট্টগ্রাম দখল হলে দুর্গ, শহর ও আশপাশের গভর্ণর হবেন চার্নক। চার্নকের বিরুদ্ধে পাটনা ও কাশিমবাজার কুঠি সংলগ্ন দেশীয়রা অসন্তুষ্ট ছিল। হেজেস তার দিননলিপিতে বিস্তারিত লিখেছেন, দেশীয়রা চার্নক ও তাঁর সঙ্গীদের কাছে ৪৩ হাজার টাকা পেতেন। কাজি দেশীয়দের পক্ষেই রায় দেন। টাকা উসুলের জন্য শায়েস্তা খাঁ চার্নককে ঢাকায় আসতে বললে চার্নক তা উপেক্ষা করেন। উপরন্তু বিভিন্ন কারণে বৃটেনের রাজা দ্বিতীয় জেমসের নিকট সম্রাট আওরঙ্গজেব ও সুবেদার শায়েস্তা খাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়ে জেমসকে ৬ টি যুদ্ধজাহাজ বাংলায় পাঠাতে প্ররোচিত করেন।
চার্নকের কথামত বৃটেনের রাজা পূর্ব ভারতের জন্য মোট তিনটি যুদ্ধজাহাজ পাঠান। জন নিকলসনের নেতৃত্বে বিউফোর্ট জাহাজে ছিল ৭০ টি কামান ও ৩ শত সৈনিক, জন মেসনের নেতৃত্বে নাথানিয়েল জাহাজে ছিল ৬৫ টি কামান ও ১৫০ জন সৈনিক। রচেষ্টার জাহাজে ছিল ৬৫ টি কামান ও ১০৮ জন সৈনিক। এছাড়া প্রতিটি জাহাজের সঙ্গে ১২টি কামান ও ২০ জন সৈন্য সহ দ্রুতগামী ফ্রিগেটও ছিল। হুগলি বন্দর দখলের উদ্দেশ্যে রচেস্টারের যুদ্ধ সামগ্রী ও সৈন্য পাঠানো হয় হুগলিতে। ইংরেজ পক্ষে রাজপুত, পর্তুগিজ ও ইংরেজ সহ মোট আরও ৪০০ ফৌজ ছিল। শায়েস্তা খাঁ গুপ্তচর মারফত জেনে, হুগলি বন্দর রক্ষার উদ্দেশ্যে আব্দুল গনির নেতৃত্বে ৩০০০ পদাতিক ও ৩০০ অশ্বারোহী পাঠান। আবদুল গনি যুদ্ধের অঙ্গ হিসাবে ইংরেজ ফৌজকে অবরোধ করে ধোপা নাপিত বন্ধ করে দেন। ৩ কি মি দূরে চন্দননগর থেকে আর্বুথনটের পরিচালনায় নৌ বাহিনী এসে পড়ায় আব্দুল গনি বিপর্যস্ত হয়ে ওলন্দাজদের ডাকেন। শায়েস্তা খাঁ আরও ফৌজ পাঠালে ইংরেজ হুগলি ছেড়ে সুতানুটিতে আশ্রয় নিয়ে কোনরকমে বড়দিন উদযাপন করে।
১৬৮৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে তারা সুতানুটি থেকেও বহিষ্কৃত হলে জব চার্নক বিউফোর্ট জাহাজ নিয়ে বর্তমান মেটিয়াবুরুজ দুর্গ ও নিকলসন একই জাহাজ নিয়ে হিজলি দখল করেন। বিউফোর্ট জাহাজের সঙ্গে কিছু শলপও ছিল। রচেস্টার ও নাথানিয়েল যুদ্ধজাহাজ দুটি নিকটেই বালেশ্বরে অপেক্ষা করছিল। প্রকৃতপক্ষে দূর্গাধিপতি মালিক কাসিম ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে যুদ্ধে যাননি। ফলে ইংরেজরা এক রাতের মধ্যেই বালেশ্বর অধিকার করে এবং মুঘল এলাকাটিকে লুঠ করে জ্বালিয়ে দেয়। হিজলিতে মার্চ-এপ্রিলে গরম বাড়লে ইংরেজদের মৃত্যুহার বেড়ে যায়। সুযোগ বুঝে মালিক কাশিমও লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন।
২৮ শে মে আব্দুস সামাদ মাত্র ৭০০ অশ্বারোহী ও ২০০ গোলন্দাজ নিয়ে ফেরিতে রসুলপুর নদী পার হন এবং ১০-ই জুন হিজলি পুনর্দখল করেন। পরাজিত জব চার্নক উলুবেড়িয়ায় আশ্রয় নেন। চার্নকের স্থলাভিষিক্ত ইংলিশ ক্যাপ্টেন হিথ পুনরায় বালেশ্বর দখল করে সাধারণ মানুষের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেন। এরপর ক্যাপ্টেন হিথ চট্টগ্রাম দখলের পরিকল্পনা করেন কিন্তু অকৃতকার্য হন। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত ইংরেজরা পাততাড়ি গুটিয়ে মাদ্রাজে আশ্রয় নেয় (ফেব্রুয়ারি ১৬৮৯)। ১৬৮৮ নাগাদ শায়েস্তা খাঁ বাংলা ত্যাগ করে আগ্রায় চলে যান। কয়েক বছর পর এই কর্মবীর ইহলোক ত্যাগ করেন।