যে ইংরেজ জাতি বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই ইংরেজকে হিমশিম্ খাইয়েছিলেন তরুণ যুবক নবাব সিরাজ। ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের ২০শে জুন নবারে ন্যৈ কলকাতার দুর্গে এমন প্রচন্ড আক্রমণ চালায় যা প্রতিরােধ করা ইংরেজদের সাধ্যের বাইরে ছিল। ইংরেজ সৈন্যদের বন্দী করে সিরাজের সম্মুখে আনা হােল। সেনাপতি হলওয়েলও বাদ যাননি। সৈন্যরা ভয়ে কম্পিত কণ্ঠে প্রাণ ভিক্ষা চাইল। নবাব মিঃ হলওয়েলকে হাত বাঁধা অবস্থায় লাথি খাওয়া পশুর মত অসহায় দেখলেন। সিরাজ ইচ্ছা করলে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যেককে হত্যার আদেশ দিতে পারলে। কিন্তু তিনি কারোর প্রতি দুর্ব্যবহার করার আদেশ দেননি। [এ তথ্যের প্রমাণ মেজর বি.ডি. বসুর Rise of the Christian Powar in India গ্রন্থের ৫৮ পৃষ্ঠায় আছে।] কিছু আলেমকে কলকাতা বিজয়ের জন্য আল্লার কৃতজ্ঞতা প্রকাশক উপাসনা ও বন্দীদের উপর নজর রাখবার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। বন্দীরা সকলেই ছিল মদ্যপায়ী। তাদের মদ্যপানের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না বলে তারা খুব বেশি পরিমাণে মদ পান করে উন্মত্ত হয়ে অসামরিক প্রহরী ও আলেমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অত্যাচার করে। সিরাজ এই সংবাদ শুনে তাদের আটক করতে বললেন সেই বন্দীখানায়, যেখানে তারা ভারতীয়দের বন্দী করে রাখতো — এরই কল্পিত নাম অন্ধকূপ হত্যা । [প্রমাণ: মেজর বি. ডি. বসুর ঐ গ্রন্থ, ৫৭ পৃষ্ঠা]
সিরাজের ইতিহাসে অন্ধকূপ হত্যা কাহিনী এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শাসকদের চরিত্রে কলঙ্কের মসিলেপনের এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা। তাই এই অন্ধকূপ হত্যা বা Black Hole সম্বন্ধে একটু আলােচনার প্রয়ােজন।
সুধীরবাবু তাঁর রচনায় বাংলা তথা ভাররেতোণের জন্য মন্তিকের উর্বর পরিচয় দিতে চেষ্টা করে গেছেন। অন্ধকূপ হত্যা -র স্রষ্টা অবশ্য সুধীরবাবু নন, ইংরেজ অনুচর মিঃ হলওয়েল।
এই মিঃ হলওয়েলকে একটু যাচাই করা যাক। ঐ হলওয়েল সাহেই মীরজাফরকে সিংহাসনচ্যুত করায় ষড়যন্ত্র করে মীর কাশিমকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন এবং ৩০৯৩০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন [এর প্রমাণের জন্য ১৭৭২ খৃষ্টাব্দের Report of the Committee of the House of Commons দ্রষ্টব্য]। ঐ হলওয়েলই বিলেতের কতৃপক্ষকে পত্র লিখেছিলেন যে, নবাব মীরজাফর আলি খাঁর জঘন্য চরিত্রের কথা কি আর জানাবাে। তিনি নওয়াজেস মহিষী ঘসেটি বেগম, সিরাজের মা আমিনা বেগম ও সম্রান্ত মহিলাদের ঢাকার রাজ কারাগারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন।
এই পত্রেযর বক্তব্য যে কত ভিত্তিহীন ও অসত্য তা পরে প্রমাণিত হবে। কারণ, হলওয়েল যখন ঢাকায় রাজমহিলাদের মৃত্যুকাহিনী রচনা করেন তার পরেও তাঁরা জীবিত ছিলেন। [Long’s Selection from the Record of India, vol. 1]
মিঃ হলওয়েলের লেখায় প্রমাণ হয় যে, সিরাজের কলকাতা আক্রমণের পূর্বে কলকাতা দুর্গে ষাট জন মাত্র ইউরােপীয়ান ছিল। ঐ ষাট জনের মধ্যে গভর্ণর ড্রেক, সেনাপতি মিনচিন, চার্লস ডগলাস, হেনরী ওয়েডারব্যারন, লেঃ মেপলটফট, রেভারেণ্ড ক্যাস্টন, মিস্টার ম্যাকেট, ফ্রাঙ্কল্যাণ্ড, মানিংহাম ও ক্যাপ্টেন গ্রান্ট প্রভৃতি দশ জন বীরপুরুষ পালিয়ে গিয়েছিলেন।
তাহলে হলওয়েলের বর্ণনানুযায়ীই প্রমাণ হয়, সিরাজের হাতে মাত্র পঞ্চাশ জনের প্রাণহানি হয়। কিন্তু ঐ হলওয়েল সাহেবই আবার কী করে শতাধিক লােকের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করেছেন তা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। [এই তথ্যগুলাের প্রমাণের জন্য Hahwell’s Letter to the Hon’ble Court of Directors, P. 36, dated, 30th Nov 1756 দ্রষ্টব্য]
মিঃ ড্রেকের দুর্গ পরিত্যাগের পর ১৭০ জন দুর্গে জীবিত ছিল বলে উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী মি গ্রে বলেনে, ১৯শে জুন রাত্রে একজন ইংরেজ সৈন্য ৫৭ জন ডাচ সৈন্য সহ শত্রু পক্ষে যােগদান করে [প্রমাণস্বরূপ Gray’s Letter, Hill, Vol. Ip.108 দ্রষ্টব্য]। আবার মিঃ ওয়াটস্ বলেছেন, মিঃ ড্রেকের দুর্গ ত্যাগের পর এবং দুর্গের পতনের পূর্ব পর্যন্ত প্রাচীরের উপরেই নিহত হয় ৫০ জন। Hill: Vol. 1, p.৪৪- তে উক্ত তথ্যের প্রমাণ মেলে।
এদিকে হলওয়েল বলেছেন, গােলন্দাজ বাহিনীর ৩১ জন সৈন্য ২০ শে জুনের দুপুরের পূর্বেই নিহত হয় [p.114] মিঃ মি বলেন, দুর্গের পতনের সময় ১৮ জন সৈন্য পলায়ন করেন [p. 44.] অতএব দেখা যাচ্ছে, একজনের কথার সঙ্গে অন্যজনের কথার মিল নেই। অলীক ঘটনার অসত্যতা এই ভাবেই প্রমাণিত হয়। আর ঐতিহাসিকদের গবেষণায় ও হিসাবে শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে ঐ দুর্গে ৮ থেকে ১০ জন মাত্র ইংরেজ বর্তমান ছিল।
ঐ হলওয়েলের স্বরূপ দেখেই নিরপেক্ষ দৃষ্টি সম্পন্ন লেখক শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্র বলেন, “মুসলমানদের কথাগুড়িয়া দাও। তাঁহারা না হয় স্বজাতির কলঙ্ক বিলুপ্ত করিবার জন্য স্বরচিত ইতিহাস হইতে এই শােচনীয় কাহিনী সযত্নে দূরে রাখিতে পারেন। কিন্তু যাঁহারা নিদারুণ যন্ত্রণায় মর্মপীড়িত হইয়া অন্ধকৃপ কারাগারে জীবন বিসৰ্জন করিলেন, তাহাদের স্বীয় স্বজাতীয় সমসাময়িক ইংরাজদিগের কাগজপত্রে অন্ধকূপ হত্যার নাম পর্যন্তও দেখিতে পাওয়া যায় না কেন?” [‘সিরাজুদ্দৌলা’ দ্রষ্টব্য]
শ্ৰীমতী হেমলতা দেবী লিখিত ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ পুস্তকের সমালােচনা করতে গিয়ে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ইতিহাস’ পুস্তকের দ্বিতীয় মুদ্রণের গ্রন্থ সমালােচনা অধ্যায়ে [১৫৭ পৃষ্ঠা] লিখেছেন, সিরাজুদ্দৌলার রাজ্য শাসনকালে অন্ধকূপ হত্যার বিবরণ লেখিকা অসংশয়ে প্রকাশ করিয়াছেন। যদি তিনি শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়কুমার মৈত্রের ‘সিরাজুদ্দৌলা’ পাঠ করিতেন তবে এই ঘটনাকে ইতিহাসে স্থান দিতে নিশ্চয় কুন্ঠিত হইতেন।”
ডঃ ভােলানাথ চন্দ্র Travels of a Hindoo নামক বিখ্যাত ইংরাজি গ্রন্থের লেখক। তিনি ১৮৯৫ খৃষ্টাব্দে Calcutta University Magazine-এ প্রমাণ করেছেন, অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী একেবারে মিথ্যা। তিনি লিখেছেন এ ছোট ঘরে বেদানার দানার মত করেও যদি লােক রাখা যায় তবুও কোনমতেই ১৪৬ জনের স্থান হতে পারে না। তাঁর ভাষায় – “Thave a very doubtutash In is account ….Geometry contradicting arithmetic give the lle to the story.”
R. Wilson তাঁর Old Fort WHliam in Bengal গ্রন্থে [Vol. II] ৫৯ পৃষ্ঠায় জ্যামিতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন, দেড় ফুটেরকিছু বেশি জায়গা প্রত্যেকের ভাগে পড়েছিল সুতরাং এর মনগড়া কাহিনী। তাড়া এ্যানি বেসান্তও বলেছেন –“Geometry disproving arithmetic aqve them to the story.”
জনৈক বিখ্যাত ফরাসী পণ্ডিত সর্বজনবিদিত সমসাময়িক ‘মুতাআক্ষিরীন’ গ্রন্থের অনুবাদ করতে গিয়ে টীকাস্থলে লিখেছেন, অন্য লােকের কথা দুরে থাকুক, কলকাতার অধিবাসীরাই অন্ধকূপ হত্যার সংবাদ জানত না। যাদের বুকের উপর এরকম ভয়ানক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তারা এর কিছুই জানল না, এটা কি আদৌ সম্ভব?
পলাতক ইংরেজ বীরপুরুষগণের পলায়নের বিবরণে বা সিরাজের প্রতি পিগটের পত্রে অথবা সিরাজকে লিখিত ওয়াটসএর ক্লাইভের বীরত্বপূর্ণ পত্রে অন্ধকূপ হত্যা এর কোন উল্লেখ নেই। এছাড়া সিরাজকে লিখিত ইংরেজদের অন্যান্য চরম পত্রেও অন্ধ কুপের উল্লেখ নেই। এমনকি আলিনগরের সন্ধির কাগজেও তার উল্লেখ নেই।
ক্লাইভ কোর্ট অফ ডিরেক্টরকে যে পত্র লিখেছেন তাতে সিরাজকে কেন সিংহাসনচ্যুত করা হয়েছে তার বিবরণ আছে, কিন্তু অন্ধকূপ হত্যার কোন কথাই সেখানে নেই। অথচ সুধীর কুমার আর নবীন কুমারের নবীন কলমে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করা হয়েছে। তাই এ ধরণের লেখনী বহু দৃঢ়চেতা সৎ মানুষ, যেমন অক্ষয় কুমার মৈত্র, বিহারীলাল সরকার গিরিশচন্দ্র ঘােষ, নিখিলনাথ রায়, কবি রবীন্দ্রনাথ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রভৃতি অনেকের মনে বেদনা দিয়েছিল।
অক্ষয়কুমার মহাশয়ের আন্দোলন এবং কলমের অগ্নিবর্ষণকে নেতাজী দারুণভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ফলে ১৯১৫ খৃষ্টাব্দের ২৪ শে মার্চ কলকাতার হিস্ট্রিক্যাল সোসাইটির মাধ্যমে এসিয়াটিক সোসাইটির ঘরে এক বিরাট সভায় উপস্থিত অক্ষয় কুমার মৈত্র, মিঃ জে, এইচ. লিটল এবং মিঃ এফ. জে. মানাহন প্রমুখের সম্মুখে ঐ অন্ধকূপ হত্যা এর ইতিহাস-উপন্যাস উপকথার মত নিক্ষিপ্ত হয়, অর্থাৎ কাহিনীটি মিথ্যা বলে স্বীকৃতি পায়। তার কিছুদিন পরে জে. এইচ. লিটল Calcutta Historical Society পত্রিকায় তা প্রকাশ করে দেন এবং অন্ধকূপ হত্যা এর জন্য বলা হয় ‘gigantic hoax’ অর্থাৎ প্রকাশ্য ধাপ্পাবাজি। উপরােক্ত তথ্যাদি Bangali Past and Present, Vol. XI. Serial No. 1, p.75 হতে গৃহীত।
১৯৪০ সালের জুন মাসে সুভাষ বসু ঐ অন্ধকূপ হত্যা এর চিহ্ন মনুমেন্টটি ভেঙে ফেলার দাবী করেন। এই নিয়ে বিরাট আন্দোলন হয়। শক্ত ইংরেজ ও মুসলমান বিদ্বেষী অনেকেই সেদিন অবাক অথবা অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, তবে ধৈর্য্যের প্রয়োজন। ইংরেজ রাজত্বের রাজধানী কলকাতার ঐ মনুমেন্ট অবশেষে ইংরেজকে ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য হতে হয়।
শ্রীগিরিশ ঘােষের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নামক সঠিক ও সুন্দর বইটি ঐ সময় সাহসের সঙ্গে লিখিত হয়। তার উপর অক্ষয়বাবুর ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ও ‘মীরকাশিম’ অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করে। পরে সত্যচরণ শাস্ত্র একখানি বই লিখলেন তার নাম ‘জালিয়াৎ ক্লাইভ’। সখারাম গণেশ দেউস্কর ‘দেশের কথা’ নাম দিয়ে এ সম্বন্ধেই আর একখানা বই লিখলেন। এটাও বেশ মূল্যবই। এর দু-একটা বাক্য এখানে তুলে ধরছি—“ইংরাজ ইতিহাস লেখকেরা হিন্দু-ছাত্রদের হৃদয়ে মুসলমান বিদ্বেষ প্রজ্বলিত রাখিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিয়াছেন। পরিতাপের বিষয় কোন কোন অদুরদর্শী হিন্দু লেখক কাব্য নাটকাদিতে অনর্থক মুসলমান ভ্রাতাদিগের নিন্দাবাদ করিয়া ইংরাজের উদ্দেশ্যসিদ্ধি বিষয়ে সহায়তা করিতেছেন।”
এদিকে গিরিশচন্দ্র ঘােষ একটি নাটকও লিখলেন, যা সহজলভ্য বিষাক্ত ও চলতি নাটকের একেবারে উল্টো। সাধারণ মানুষের মগজ একটু নড়ে উঠল—তাহলে ‘ইতিহাস’ যা শুনি তা তাে ঠিক নয়। কবি নবীনচন্দ্র সেন ঐ বইটি পড়ে একটি চিঠি লিখলেন গিরিশচন্দ্রের নামে। তাও এখানে তুলে ধরা হােল—
‘ভাই গিরিশ,
বিশ বৎসর বয়সে আমি ‘পলাশীর যুদ্ধ’ লিখিয়াছিলাম, আর তুমি ষাট বৎসর বয়সে ‘সিরাজুদ্দৌলা’ লিখিয়াছ! আমি বিদেশী ইতিহাসে যেভাবে পাইয়াছি সেই ভাবে চিত্রিত করিয়াছি। কিন্তু তুমি সিরাজের নিখুঁত চিত্রটি অঙ্কিত করিয়াছ। অতএব তুমি আমার অপেক্ষা অধিক ভাগ্যবান।”
অত্যন্ত দুঃখের কথা, সিরাজের ইতিহাসে পাওয়া যায় মূলতঃ মুসলমান মীরজাফরের কথা। তাতে প্রমাণ হয় মুসলমান জাতি মানেই বিশ্বাসঘাতক জাতি। ফলস্বরূপ আজ মুর্শিদাবাদ জেলা, এমনকি মুসলমান জাতি বাংলার মাটিতে যেন কলঙ্কিত। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস এ কথাই বলে যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যে আকাশ ছোঁয়া অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল তা মুসলানদেরীতেই। ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আর এই সিপাহী বিদ্রোহের গােড়াপত্তনের দাবীতে যে স্থান গৌরবের অধিকারী তা হােল মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুর।
সিরাজ জানতেন মীরজাফরের হাবভাব। তাহলে এখানে একটা প্রশ্ন হবে, সিরাজ যদি জাননে মীরজাফরের দ্বারা স্বাধীন ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ উদয় হবে, তাকে কেন তা পূর্বাসে সরিয়ে দেননি? স্বাধীন ভারতের প্রতি সিরাজের এটা কি নিষ্ঠুরতায় উত্তরে বলব, না। কারণ মীরজাফর একদা সিরাজের সম্মুখে পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে শপথ করে বলেছিলেন, তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিংহাসন রক্ষা করতে চেষ্টা করবেন। তাই পবিত্র কুরআনের সম্মানার্থে বিশ্বাসঘাতকতার পূর্বেই তাঁকে শাস্তি দিতে পারেন নি।
বীর সিরাজ মিঃ ওয়াটস সাহেবকে সপরিবারে বন্দী করে কাশিমবাজার হতে মুর্শিদাবাদ দিয়ে এসেছিলেন। সিরাজ-জননী আমিনার কোমলতায় সিরাজের করুণাবতী স্ত্রী লুৎফুন্নেসা তাঁদের মুক্তি দিয়েছিলেন। যখন সিরাজ এই ঘটনা শুনলেন তখন গর্ভধারিণী মা বা সহধর্মিণী স্ত্রী কাউকে তিরস্কার অথবা কারাে কাছ থেকে কৈফিয়ৎ চাওয়ার কোন ভূমিকাই নিতে পারেন নি। এটা সিরাজের সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতা না নিষ্ঠুরতা, তারও বিবেচনার ভার চলমান সমাজের উপরেই রইল।
রাজা রাজবল্লভ আলিবর্দীর আমলে প্রজাদের সর্বনাশ সাধন করে যে বিরাট অঙ্কের ধন সঞ্চয় করেছিলেন এবং তাঁর পুত্র কৃষ্ণদেব মারফত সেই প্রচুর অর্থ যখন ইংরেজদের ঘাঁটিতে পাচার হয়েছিল তখন সিরাজ রাজবল্লভ ও তাঁর পুত্র কৃষ্ণদেবের উপর স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং ঠিক তারপরেই তিনি কলকাতায় দুর্গ নির্মাণের অপরাধে কলকাতা আক্রমণ করেছিলেন। বলাবাহুল্য, এই কৃষ্ণদেবের পাচার করা প্রচুর অর্থই কলকাতায় দুর্গ নিমার্ণে ইংরেজদের হাত শক্ত করেছিল। তাই কৃষ্ণদেবের কাণ্ডকে কেন্দ্র করেই সিরাজের কলকাতা অভিযান। যুদ্ধ শেষে হলওয়েল সাহেব, উমিচাঁদ ও কৃষ্ণদেবকে বন্দী করে তাঁর সামনে আনা হােল। সিরাজ যখন তাঁদের হাতের মুঠোয় পেলেন তখন তাঁরা জেনে নিয়েছিলেন, প্রাণদণ্ডই হয়ত তাঁদের যােগ্য শাস্তি। কিন্তু তিন জনেই যখন ক্ষমা প্রার্থনা করলেন সিরাজ প্রত্যেককে ক্ষমা করে মুক্তি দিলেন।
আরও একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কলকাতা বিজয়ের পর মানিকচাঁদকে কলকাতার দায়িত্ব দিয়ে, তাঁকে প্রসিডেন্ট নিযুক্ত করে নবাব আদেশ দিলেন, বাজার হাট যেন বন্ধ না থাকে। কারণ বাজার ও দোকানপাট বন্ধ থাকলে, ইংরেজরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যেভাবে কোণঠাসা হয়েছিল, খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর অভাবে তারা মারা যেতে পারে [C.R. Wilson: Old out William of Bengal, vol. I, p. 301]। এ রকম আরও অনেক মহানুভবতার দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে নবাবকে নিষ্ঠুর বলে চিহ্নিত করা যাবে কি না তা বিচারের জন্য বাকী রইল।