মুঘল সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থান ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই অভ্যুত্থানের নায়ক তথা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মােহাম্মদ বাবর১ মধ্য এশিয়ার ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য ফরঘনায় ১৪৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারি২ জন্মগ্রহণ করেন। ১৪৯৪-এ মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতা ওমর শেখ মির্জার মৃত্যুর পর তিনি ফরঘনার শাসক হন। অতি বাল্যকাল হতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাবর তার রাজ্যরক্ষার জন্য এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উচ্চাশা পূর্ণ করবার জন্যে সর্বদাই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। ফলে অল্প বয়স হতেই তিনি একজন দক্ষ সৈনিক ও সেনাপতিতে পরিণত হন। সাধারণ সৈনিকের সুখ-দুঃখ ও আনন্দের অনুভূতিগুলি বুঝবার সহজাত ক্ষমতা থাকায় এবং মনুষ্য চরিত্র বিশ্লেষণ করবার যােগ্যতাসম্পন্ন হওয়ায় তিনি সহজেই তার সৈনিকদের নিকট অবিসংবাদী জনপ্রিয়তা পান। তাঁর আত্মজীবনী ‘তুজক-ই-বাবরি’৩ থেকে জানা যায় যে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাধারণ সৈনিকের সঙ্গে দুঃখ-দুর্দশা ভাগ করে নিতে পশ্চাদপদ ছিলেন না।
যদিও বাবর সাধারণ সৈনিকের সঙ্গে আপনার কোনাে ব্যবধান রাখতে সচেষ্ট ছিলেন না, তা সত্ত্বেও সৈন্যবাহিনীতে শৃঙ্খলা রক্ষা করবার জন্যে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনে কোনােরূপ দ্বিধা করতেন না। তিনি শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে সৈনিককে প্রাণদণ্ড দিতেও কোনােরূপ সঙ্কোচবােধ করেননি। সৈন্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধরীতি ও পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করতেন। প্রথম জীবনে মধ্য এশিয়ায় বহু যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকায় তিনি যুদ্ধের নানা কৌশল ও পদ্ধতি আয়ত্ত করেন।
মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত বীর তৈমুর লঙ-এর অধঃস্তন বংশধর হিসাবে বাবর তার খ্যাতিমান পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বহু আকাঙ্খিত ভারত জয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি ‘আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : “আমার হৃদয়ে সর্বদাই হিন্দুস্থানের উপর কর্তৃত্বের কথা জাগরুক ছিল। …আমি এগুলিকে নিজরাজ্য বলেই মনে করি এবং শান্তি বা যুদ্ধ যে পথেই হােক এইসব স্থান দখলের ইচ্ছা করি।৪ বাবর ১৫১৯ থেকে ১৫২৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে চারবার ভারত অভিযান করেন। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযােগে বাবর ১৫০৪ সালে কাবুল অধিকার করেন এবং ‘পাদশাহ’ উপাধি ধারণ করে সেখানে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫১১ সালে তিনি বােখারা ও সমরখন্দ৫ পুনর্দখল করেন। ১৫০৪ থেকে ১৫২৬ পর্যন্ত বাবর কাবুলের অধিপতি ছিলেন। ‘আত্মজীবনী’তে বাবর উল্লেখ করেন : “কাবুল জয় করার পর থেকে এখন পর্যন্ত (১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) আমি হিন্দুস্থান অধিকার করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি। কখনও আমার আমিরদের বিরুদ্ধাচরণ এবং কখনও আমার ভ্রাতাদের বিদ্রোহের জন্য আমি এর বাস্তবায়নে বাধাপ্রাপ্ত হই। অবশেষে এই সমস্ত বাধা-বিপত্তি লঙঘন করে আমি ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে একটি সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাজাউর ও সােয়াত অভিমুখে যাত্রা করি এবং সেখান থেকে ঝিলাম নদীর পশ্চিম তীরে ভেরা পর্যন্ত অগ্রসর হই।” তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাবর ১৫১৯ সালে একদল সেনা নিয়ে ভারতবর্ষে প্রথম অভিযান করেন৭ এবং রাজাউর ও ভেরা দখল করেন। তারপর তিনি ঝিলাম নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত অগ্রসর হন। ১৫২০ সালে বাবর বাদকশান অধিকার করেন। এই বছরে তিনি তৃতীয়বারের মতাে ভারতবর্ষের অভিযান করে শিয়ালকোট অধিকার করেন। ১৫২২ সালে কান্দাহার অধিকৃত হয়। ১৫২৪ সালে ৪র্থঅভিযানে আফগান সেনাদের পরাস্ত করে বাবর লাহাের অধিকার করেন। এই অভিযানগুলির ফলে ভারতবর্ষের সীমান্ত অঞ্চল থেকে অভ্যন্তরে প্রবেশের পথ প্রস্তুত হয়।
১৫২৫ খ্রীষ্টাব্দে বাবর ৫ম তথা শেষবারের মত ভারত অভিযান করেন। তিনি পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ লােদীকে পরাজিত করে পাঞ্জাব অধিকার করেন। এরপর তিনি দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করে ১৫২৬-র ২১ এপ্রিল পানিপথের প্রান্তরে এসে উপনীত হন। দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লােদী (১৫১৭-২৬) ইতিপূর্বেই বাবরের গতিরােধ করবার জন্যে পানিপথে বিশাল সৈন্যবাহিনীর সমাবেশ করেছিলেন। লক্ষাধিক সৈন্যের বিশাল সুলতানী বাহিনী পানিপথের যুদ্ধে বাবরের মাত্র বার হাজার সুশিক্ষিত ও দক্ষ সৈনিকের হাতে বিপর্যস্ত ও পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে বাবর কামান, গােলাবারুদ প্রভৃতি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি দু’জন অটোমান গােলন্দাজ নায়ক ওস্তাদ আলি ও মুস্তফার সাহায্য নিয়েছিলেন।৭ ইব্রাহিম লােদী যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারত ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে দিল্লি ও আগ্রা বাবরের হস্তগত হয়৮—ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের গােড়াপত্তন হল।৯ এরপর ১৫২৭ সালে খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সিংহের সম্মিলিত বাহিনীর শােচনীয় পরাজয়ের ফলে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়। এই যুদ্ধের পর হতে বাবরের রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্র কাবুল হতে ভারতবর্ষে স্থানান্তরিত হয়।১০
(১)
বাবরের আত্মজীবনী ‘তুজক-ই-বাবরি’ সাধারণভাবে ‘বাবরের স্মৃতিকথা’ নামে পরিচিত। ‘আত্মজীবনী’তে বাবর তার সময়ের চারপাশের বিবরণ ও তার ঘনিষ্ঠজনদের কথা বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ কারণে ‘তুজক-ই-বাবরি’ সমকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসাবে পরিচিত। প্রকৃত আত্মজীবনী লেখার সততা ছিল বাবরের মধ্যে। তিনি কোনােরকম গােপনীয়তা বা রহস্যময়তা না রেখে তার সমস্ত কার্যের বিবরণ লিখে গিয়েছেন। গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাবরের সারল্য ও স্পষ্টভাষ্য। তিনি অকপটে নিজের সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা বর্ণনা করেছেন। সাধারণত বাবরের বর্ণনা পক্ষপাতমুক্ত এবং বিষয়মুখী। শুধু ভারত নয়, ‘আত্মজীবনী’তে বাবর কাবুলেরও চমৎকার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বাবর লিখেছেন যে, কাবুলের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। কাবুলের আবহাওয়া ছিল খুবই মনােরম; পৃথিবীতে এমন স্থান আর কোথাও নেই।১১
‘আত্মজীবনী’তে প্রধানত রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাবলি উল্লেখিত হলেও বাবর এখানে সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রও নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। তার বর্ণনায় যুক্ত হয়েছে মানুষের আচার-ব্যবহার, চরিত্র, পােষাক-পরিচ্ছদ, গাছপালা, জীবজন্তু, পাহাড়, উপত্যকা, নদ-নদী, বন-জঙ্গল ইত্যাদি। বিশ্লেষকদের চোখে এসব বর্ণনার ভেতর থেকে প্রকৃতি প্রেমিক, মানব চরিত্রাভিজ্ঞ, তীক্ষ পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী বাবরকে খুঁজে পাওয়া যায়। এই কারণে বাবরকে ভারতবর্ষের ‘প্রথম প্রাকৃতিক ইতিহাস বিজ্ঞানী’ বলা হয়।১২ সমকালীন পারসীয় লেখকদের মতাে আড়ম্বরপূর্ণ ও অলঙ্কারের বাহুল্য ছিল না বাবরের লেখায়। শ্রীমতি এ এস বেভারিজ বাবরের ‘আত্মজীবনী’কে সর্বকালের এক অমূল্য দলিল হিসাবে বর্ণনা করেছেন—একে তুলনা করেছেন সেন্ট অগাস্টাইন ও রুশাের স্বীকারােক্তি এবং গীবন ও নিউটনের স্মৃতিচারণের সঙ্গে। বেভারিজের মতাে ইউরােপীয় অনেক পণ্ডিত একইভাবে বাবরের ‘আত্মজীবনী’র মূল্যায়ন করেছেন। তবে নতুন দেশে এসে সে অঞ্চলের সার্বিক জীবনবােধের সঙ্গে মিশে যাওয়া খুব স্বাভাবিক নয়। এ কারণে ভারতবর্ষ সম্পর্কে বাবরের বর্ণনায় কোথাও কোথাও সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। এসব বিবেচনায় রেখেও বলতে হয় যে, বাবরের ‘আত্মজীবনী’কে সে যুগের সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক ও প্রত্যক্ষ বিবরণ বলে গ্রহণ করা চলে।
সম্রাট বাবর তার জীবনের শেষ বারােটি বছর ঘনিষ্ঠভাবে ভারতবর্ষের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। তাঁর বয়স যখন ৩৬ তখন তিনি বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করে মাতৃভূমি ফরঘনা পুনরুদ্ধারের আশা পরিত্যাগ করে ভারতবর্ষ আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর মাত্র পাঁচ বছর দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৪৮ বছর বয়সে ১৫৩০-এর ২৬ ডিসেম্বর১৩ সম্রাট বাবর রােগাক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক ভাবেই মৃত্যুমুখে পতিত হন।১৪
জীবনের শেষ পর্যায়ে ভারতে অবস্থানের কারণে ‘আত্মজীবনী’র শেষ অধ্যায়গুলাে ভারত সম্পর্কিত বর্ণনায় সমৃদ্ধ। এ পর্যায়ের বর্ণনা থেকে জানা যায়, দিল্লির সিংহাসনে সুস্থিরভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি অপেক্ষাকৃত কম কর্মব্যস্ত ছিলেন। ফলে বিশ্রামসুখ উপভােগের সময় তিনি তার জীবনস্মৃতির ভারতীয় অংশ লিপিবদ্ধ করেন। ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাবরকে আকর্ষণ করেছিল। পাশাপাশি জানা যায়, ভারতে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেও তিনি মুহূর্তের জন্য মাতৃভূমি ফারঘানার স্মৃতি ভুলতে পারেননি; পার্বত্য অঞ্চল কাবলের হাতছানিও তিনি অনুভব করতেন। ফলে ভারতবর্ষের শহর ও গ্রামগুলােকে অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর বলে বর্ণনা করেছেন। পাহাড়-পর্বত, জলপ্রপাত, ঝরণা, ফুলের বাগান প্রভৃতি বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ কাবুলের তুলনায় উত্তর ও মধ্য ভারতবর্ষের সমভূমিকে বৈচিত্র্যহীন ও একঘেয়ে বলে বর্ণনা করেছেন। ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে কাবুলের প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা করে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া বাবরের অন্যতম প্রতিপক্ষ মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহ তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন বলেও তিনি তার আত্মজীবনী’তে ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন। এসব কারণে কোনাে কোনাে সমালােচকগণ বলেন যে, বাবর কোনােদিনই ভারতকে নিজের দেশ বলে বিবেচনা করতে পারেননি অথবা ভালবাসতে পারেননি।
অনুমান করা যায় বাবর যদি আরও কয়েক বছর ভারতে বসবাস করতেন এবং ভারতবর্ষের জনসাধারণের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে পারতেন তবে সম্ভবত ভারত ও ভারতবাসীদের সম্পর্কে নিন্দাসূচক মন্তব্য করতেন না। ভারত সম্পর্কে তার যে কিছু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা ‘আত্মজীবনী’র ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ তিনি তার আত্মজীবনী’তে ভারতবর্ষে বসবাস করার জন্য কতগুলাে অনুকূল সুযােগ-সুবিধার কথাও উল্লেখ করেছেন। ভারতে দক্ষ শ্রমিকের প্রাচুর্যের কথা তার আত্মজীবনীতে রয়েছে। ভারতবর্ষের বর্ষাকালীন প্রকৃতি বাবরকে আকৃষ্ট করেছিল। এর অবশ্য কারণ রয়েছে। ১৫২৬-র ২১ এপ্রিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধের কিছুদিন পরে তিনি আগ্রা যান এবং তখন আগ্রা শহরে গ্রীষ্মের উত্তাপ তার কাছে অসহ্য মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে বর্ষাকালে তিনি যখন আবার আগ্রা গেলেন তখন আগ্রার শ্যামল সৌন্দর্য এবং ফুলেফেঁপে ওঠা যমুনা নদী বাবরের মনে প্রশান্তি এনে দিয়েছিল। এ কারণে তিনি আগ্রাতে পুষ্পেদ্যান রচনা করে তার বসবাসের জন্য ‘চারবাগ’ নির্মাণ করেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চারবাগকে ভারতীয়রা সাধারণভাবে ‘কাবুল’ বলত। ভারতবর্ষের নদীও বাবরকে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি নদীতে সাঁতার কেটে আনন্দ উপভােগ করতেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে স্বর্ণ ও রৌপ্যের কথাও তিনি বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন।
বাবরের মন কাবুলের জন্য আকুল হলেও, তিনি ভারতবর্ষের প্রতিও গভীর অনুরাগ অনুভব করেন। কেউ তার সামনে ভারত সম্বন্ধে ক্ষতিকর ও অশােভন মন্তব্য করলে বাবর তার তীব্র প্রতিবাদ করতেন। বাবর লেখেন, “It (Hindustan) is a wonderful country. Compared with our countries it is a different world; its mountains, rivers, jungles and deserts, its towns its cultivated lands, animals and plants, its people and their tongues, its rains and its winds are all different.’১৫ মহিবুল হাসানের গ্রন্থ১৬ হতে জানা যায় যে, বাবর রাজপুতদের সাহস ও বীরত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেছেন। বাবর হিন্দুস্তানের সময় গণনার পদ্ধতির প্রশংসা করেন। তিনি এই পদ্ধতির উন্নতি সাধন করেন। ময়ূর, তােতাপাখি ও অন্যান্য পাখির সৌন্দর্য দেখে তিনি মুগ্ধ হন। বিভিন্ন প্রকার ফুল দেখেও তিনি আনন্দলাভ করেন। মনে রাখা দরকার, বাবর আলবেরুনী ছিলেন না। বাবরের নানা বিষয়ে কৌতূহল থাকলেও, জনসাধারণের ধর্ম, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক জীবন, আচার-আচরণ ইত্যাদির বিস্তৃত বর্ণনা তার রচনায় পাওয়া যায় না। তিনি হিন্দুদের সম্বন্ধে শুধু বলেন, তাঁরা হলেন পৌত্তলিক এবং তারা আত্মার দেহান্তরিত হওয়ায় বিশ্বাসী। তিনি শিশুহত্যা ও সতী প্রথার উল্লেখ করেননি। এমনকি বাবর হিন্দুস্তানের মুসলমানদের বিষয়েও কোন আলােচনা করেননি।
মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসের যে বর্ণনা বাবরের রচনায় পাওয়া যায় তা খুবই সংক্ষিপ্ত। তাতে কিছু তথ্যগত ভুলও রয়েছে। তিনি মুসলিম রাজ্যের কথা বলেন। কিন্তু কাশ্মীর রাজ্যের কথা উল্লেখ করেননি, অথচ তিনি কাশ্মীর জয় করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। বাংলার সুলতানি শাসন সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বাবর লেখেন, বাংলায় বংশানুক্রমিক শাসন বিরল। তার এই মন্তব্যও যথার্থ নয়। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে তাঁর ‘বাবর ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রবন্ধে১৭ লিখেছেন, কোনাে জাগতিক দম্ভ থেকে নয়, মনের স্বাভাবিক আকুতি থেকে বাবর লেখেন, হিন্দুস্তানে ভাল রুটি, বাজারে খাদ্য-দ্রব্য, উষজলে স্নানের ব্যবস্থা ও কলেজ নেই। তার পৈত্রিক বাসভূমিতে দোকানে সাজানাে নানা প্রকার অপর্যাপ্ত জিনিসপত্র যা তিনি দেখতে পেতেন এবং বিদ্যাচর্চার যেসব কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল তার কথা তার বারে বারে মনে হত। ভারতেও যে বহু শিক্ষার কেন্দ্র ছিল তা বাবর লক্ষ করেননি। এই বিষয়ে তাঁর যে অজ্ঞতা ছিল তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। উল্লেখ করা যায় যে, হিন্দুস্তান সম্বন্ধে বাবরের বিবরণ সেই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল যেখানে তার আধিপত্য ছিল অথবা যে অঞ্চল দিয়ে তাকে সামরিক অভিযানে যেতে হত। সুতরাং তার কাছ থেকে সমগ্র ভারতবর্ষের চিত্র আশা করা যায় না। তবুও হিন্দুস্তান শব্দটি কি অর্থে তিনি চয়ন করেন তা উল্লেখ করা প্রয়ােজন। মধ্যযুগের মুসলমান ভুগােলবিদগণ কোনাে একটি বিশেষ শব্দের মাধ্যমে সমগ্র ভারত সম্বন্ধে উল্লেখ করেননি। সিন্ধুনদীর পূর্ব দিকের অঞ্চলকে তারা ‘হিন্দ’ বলে উল্লেখ করতেন। অন্যদিকে ‘সি’ শব্দটি প্রয়ােগ করা হত সিন্ধু, মারাকান, বালুচিস্তান, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের ক্ষেত্রে। কিন্তু বাবর ‘হিন্দু’, ‘হিন্দুস্তান’ ইত্যাদি শব্দ সমগ্র ভারতকে বােঝাতে ব্যবহার করতেন।১৮ তা থেকে বাবরের দৃষ্টির ব্যাপ্তি উপলব্ধি করা যায়।।
(২)
সমকালীন ও আধুনিক ঐতিহাসিকদের প্রায় সকলেই বাবরকে মধ্যযুগের এশিয়ার রাজ্য শাসকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মেধাবী বলে মন্তব্য করেছেন। বাবরের বিভিন্ন গুণাবলির বর্ণনা পাওয়া যায় তার নিকটাত্মীয় মীর্জা হায়দার রচিত ‘তারিখ-ই-রশিদী’ গ্রন্থে। এখানে মীর্জা হায়দার উল্লেখ করেছেন, বাবরের মধ্যে মানবতা ও সাহসের এক উজ্জ্বল সংমিশ্রণ ছিল। বাবরের কন্যা গুলবদন বেগম রচনা করেছিলেন হুমায়ুননামা। এই গ্রন্থে বাবর সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশংসা করা হয়েছে।১৯ বাবর সম্পর্কে প্রশংসাবাণী আধুনিক লেখকদের লেখনীতেও লক্ষ্য করা যায়। ভিনসেন্ট স্মিথ, হ্যাভেল, রাসব্রুক উইলিয়াম প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ বাবরের প্রতিভা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কথা বহুবার উল্লেখ করেছেন। বাবরের জীবনীকার রাসব্রুক উইলিয়াম বাবরের চরিত্রের আটটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলাে হচ্ছে: বিচক্ষণতা, উচ্চাভিলাষ, যুদ্ধনৈপুণ্য, সুদক্ষ শাসনকৌশল, প্রজাহিতৈষণা, উদার প্রশাসনিক আদর্শ, সৈন্যদের মন জয় করার ক্ষমতা এবং ন্যায়বিচারের প্রবণতা। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ ও শাসক হিসাবে বাবরের মূল্যায়ন করা যায়।
সমসাময়িক যুগের অন্যতম প্রধান বিদ্যোৎসাহী ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসাবে ইতিহাস বাবরকে উচ্চস্থান দিয়েছে। তিনি তাঁর আত্মজীবনী’ রচনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন তুর্কি ভাষায় সাহিত্য রচনায় তিনি ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। তুর্কি ভাষার সেরা দু’জন লেখকের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।২০ গদ্যকার হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তুর্কি ভাষায় তিনি অনেক উঁচুমানের সঙ্গীতও রচনা করেছিলেন। কবি হিসাবেও বাবরের খ্যাতি ছিল।২১ সমসাময়িক তুর্কি কবি আলি শীরের পরেই কাব্যজগতে তার স্থান ছিল। ‘চাঘতাই তুর্কি’ ভাষায় রচিত তাঁর কাব্য সংকলন ‘দিওয়ান’ যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছিল। বাবর পদ্যছন্দের একটি ধারা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। এটি ‘নূবাইয়ান’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি এমন একজন সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন যিনি কবি ও পণ্ডিতদের সান্নিধ্য উপভােগ করতে ভালবাসতেন। তাঁর সভা যারা অলঙ্কৃত করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন শেখ আবুল ওয়াজেদ, মাওলানা আলি জান, মাওলানা আলি খান, তরদি বেগ খাকসার, মাওলানা শামসুদ্দিন ফারঘারি, মাওলানা শামস তালিব, ‘তবকৎই-বাবরি’ গ্রন্থের লেখক শেখ জৈনুদ্দিন, কবি মাওলানা বাকাই, মাওলানা শিহাবুদ্দিন এবং মীর জামালউদ্দিন প্রমুখ।২২ ১৫০০ সাল থেকেই বাবর ফারসি ভাষায় কবিতা রচনা করতে শুরু করেন। অবশ্য ফারসি ভাষায় রচিত কবিতা থেকে তুর্কি ভাষায় রচিত তাঁর কবিতার উৎকর্ষ অনেক বেশী ছিল। তার আগে তুর্কি কবিরা ফারসি কবিদের অনুকরণে কবিতা রচনা করতেন। এই অবস্থা থেকে তুর্কি কবিতাকে উদ্ধার করেন আলি শীর এবং পরে বাবর। বাবর তুর্কি ভাষায় মদ, যুদ্ধ, ভালবাসা, ধর্ম ও সুফিবাদ সম্বন্ধে কবিতা রচনা করেন। তাছাড়া তিনি নানা প্রকার ছন্দের বিন্যাস নিয়ে পরীক্ষা করেন, যথা—গজল, মসনবি, রুবাই ইত্যাদি।২৩ কোনাে কোনাে কবিতায় বাবর তুর্কিদের বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনাকে বিষয়বস্তু করেন। তিনি প্রথম যুগের তুর্কি কবিদের দ্বারা, বিশেষ করে আলি শীর-এর দ্বারা প্রভাবিত হন। তাঁর সঙ্গে বাবরের পত্রালাপ চলত। এসব তথ্য আমরা পাচ্ছি শেখ জৈনুদ্দিন লিখিত বাবরের জীবনী গ্রন্থ ‘তবকৎ-ই-বাবরি’ থেকে।
কাব্য ছাড়াও আইনশাস্ত্রের ওপরও সম্রাট বাবর মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি ‘রিজালা-ই-উরাজ’ নামে অলংকারশাস্ত্রের একটি গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। বাবর একজন দক্ষ ক্যালিগ্রাফিস্ট বা লিপিশিল্পী ছিলেন। তিনি সুন্দর হস্তাক্ষরের যে রীতি বের করেন তাকে ‘খাত-ই-বাবরি’ বলা হয়। এই রীতি অনুসরণ করেই তিনি ‘কোরআন’ সম্পাদনা করেন। এসব ছাড়া তার সাহিত্য তথা গদ্য সৃষ্টির অনুপম নিদর্শন হিসাবে ‘তুজক-ই-বাবরি’ নামের আত্মজীবনীর কথা পূর্বেও আলােকপাত করা হয়েছে। ভূগােল ও বিজ্ঞানেও তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। তার আমলে আরবি ও ফারসির সাথে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যয়ন অধ্যাপনা চলত। তার সময়ে উপনিষদ, ভগবতগীতা এবং যােগবশিষ্ট রামায়ণ সংস্কৃত থেকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। ‘তবকৎ-ই-বাবরি’ গ্রন্থ হতে জানা যায়, ভাস্কর্য নির্মাণেও তার আগ্রহ লক্ষ করা যায়। বাবরের নির্দেশে আগ্রা, গােয়ালিয়র প্রভৃতি অঞ্চলে অনেক সৌধ নির্মিত হয়েছিল। ভারতীয় কারিগরদের কায়িক শ্রম করবার ক্ষমতা দেখে বাবর বিস্মিত হন। কিন্তু ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পে সমন্বয়ের ও সামঞ্জস্যের অভাব দেখে তিনি অখুশি হন। বাবর বাড়ি বা প্রাসাদ নির্মাণের স্থাপত্য রীতি ইরান থেকে নিতে পারতেন, যেমন তিনি উদ্যান তৈরি করার ক্ষেত্রে নিয়েছেন, অথবা সমরকন্দের তৈমুরের তৈরি প্রাসাদ বাড়ির স্থাপত্য রীতি থেকেও নিতে পারতেন; কিন্তু তা না করে বাবর ‘অটোমান স্থাপত্যরীতি’ অনুকরণ করার সিদ্ধান্ত নেন।২৪ দুর্ভাগ্যবশত বাবর যেসব প্রাসাদ বাড়ি নির্মাণ করেন তার কোনই অস্তিত্ব নেই। তাই তাদের নির্মাণ কৌশল সম্বন্ধে কিছুই স্পষ্ট করে বলা যায় না।
(৩)
অনুদার সংকীর্ণতা বা সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বাবরের রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। পারস্যের শিয়া রাজা ইসমাঈল সুন্নিদের ওপর যথেষ্ট উৎপীড়ন করতেন। বাবর তার সঙ্গে নির্দ্বিধায় মৈত্রী স্থাপন করেছিলেন। এমনকি তিনি সমরখন্দে শিয়া সম্প্রদায়কে বিভিন্ন সহযােগিতাও প্রদান করেছিলেন। বাবর আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোনাে কিছুই সম্পন্ন হতে পারে না। ধর্মীয় গোঁড়ামি তার ছিল না।২৫ অমুসলিম প্রজাদের প্রতি তিনি মােটামুটি উদারনীতি গ্রহণ করেছিলেন। ধর্মগত কারণে তিনি কোনাে হিন্দুকে শাস্তি দেননি।২৬
মুঘল বংশের শাসকগণ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি স্থাপনের নিমিত্ত এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে নতুন ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। বাবরই প্রকৃতপক্ষে তার সূচনাকারী। বাবর অমুসলমানদের প্রতি যে কতখানি সহনশীল মনােভাব পােষণ করতেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর রচিত একটি গােপন ‘শেষ ইচ্ছাপত্র’ বা ‘অসিয়তনামা’য়, যেটি তিনি তাঁর পুত্র হুমায়ুনের জন্য রেখে গিয়েছিলেন। পুত্র হুমায়ুনের প্রতি বাবরের উপদেশ—‘শেষ ইচ্ছাপত্র’ সংক্রান্ত দলিলটি ভূপালের রাজ্য গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। ‘দ্য ইন্ডিয়ান রিভিউ’-এ দলিলটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়, অনুবাদক সৈয়দ মাহমুদ। বাংলা অনুবাদে সেটি দাঁড়ায়, “হে আমার পুত্র, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ ভারতবর্ষে বাস করে; রাজার রাজা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এই দেশের শাসনভার তােমার হাতে ন্যস্ত করেছেন। সুতরাং তােমার কর্তব্য হল :
১. তােমার মনকে ধর্মীয় সংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হতে দেবে না এবং সকল শ্রেণির মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মীয় আচারাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে সকলের প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করবে;
২. বিশেষ করে গােহত্যা থেকে বিরত থাক, এর ফলে ভারতবর্ষের জনগণের হৃদয়ে তুমি স্থান করে নিতে পারবে। এর দ্বারা তােমার সঙ্গে এদেশের মানুষ কৃতজ্ঞতা রজুতে আবদ্ধ হবে;
৩. তুমি কখনও কোনও সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ধ্বংস করবে না এবং সবসময় ন্যায়বিচারের প্রতি অনুরক্ত থাকবে, যাতে রাজার সঙ্গে প্রজাদের সুসম্পর্ক বজায় থাকে এবং এই ভূখণ্ডে শান্তি ও সন্তুষ্টি বিরাজ করে।
৪. অত্যাচারের তরবারির চেয়ে ভালবাসা ও কর্তব্যপরাণয়তার তরবারি দিয়ে ইসলাম প্রচার অধিক সাফল্য অর্জন করবে।
৫. শিয়া ও সুন্নিদের পরস্পরের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ সবসময় উপেক্ষা করে চলবে, তা না হলে এগুলাে ইসলামকে দুর্বল করে দেবে।
৬. তােমাদের প্রজাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে বছরের বিভিন্ন ঋতুর বৈচিত্র্যের সঙ্গে তুলনা করবে, তাহলে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকবে।”২৭
বাবরের এই উপদেশ বা ‘শেষ ইচ্ছাপত্র’-তে আমরা একজন ধর্মনিরপেক্ষ ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রশাসককে দেখতে পাই। সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষের অযােধ্যায় রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ নিয়ে যে বিতর্কের ঝড় সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনীতিতে অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে এবং এর ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হিংসাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট বাবরের ঐ নির্দেশনামা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিচার করা প্রয়ােজন। মৌলবাদী হিন্দুদের বিশ্বাস যে, যে স্থানটিতে বাবরি মসজিদ অবস্থিত সেটি ছিল রামের জন্মস্থান এবং পূর্বে ওখানে একটি মন্দির ছিল। তাদের ধারণা যে, সম্রাট বাবরের নির্দেশে কিংবা তার সময়কালে ওই মন্দিরটি। ভেঙে ফেলা হয় এবং ওখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, সেটিই হল বাবরি মসজিদ। যেহেতু রাম হলেন ঈশ্বরের অবতার, তার জন্মস্থানে যে মন্দিরটি ছিল সেটা যদি পুনঃনির্মাণ করা যায় মসজিদটি ভেঙে দিয়ে, তাহলে একটা বিরাট পুণ্যের কাজ হবে। বিশ্বহিন্দু পরিষদ এই আন্দোলনের প্রবক্তা। কিন্তু হিন্দু মৌলবাদীদের এই দাবি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী। প্রথমত, রাম কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নন; দ্বিতীয়ত, হুমায়ুনের প্রতি বাবরের নির্দেশনামা যেটি একটি ঐতিহাসিক দলিল, সেটিতে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, বাবর মােটেই হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল মনােভাব পােষণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। বস্তুত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, আনুমানিক চোদ্দ শতক থেকে এই উপমহাদেশের ধর্ম ও সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে বিদ্যমান রক্ষণশীলতার পাশে এক আধ্যাত্মিক মানবতাবাদী ও সমন্বয়ধর্মী এবং পরমতসহিষ্ণুতার ধারার উন্মেষ ঘটেছিল, সেটা আঠার শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের প্রথমদিক পর্যন্ত এই মহাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হয়।
শাসকরা কেমন হবেন, এই বিষয়েও বাবরের একটি স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি ‘ভাল’ ও ‘ন্যায়পরায়ণ’ শাসকদের প্রশংসা করতেন এবং ‘অত্যাচারী শাসকদের অপছন্দ করতেন। এই কারণে তিনি কয়েকজন মুসলমান শাসকের নিষ্ঠুরতা ও অপশাসন তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন। কিন্তু বাবর নিজেও সমালােচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। অবশ্য শাসক হিসেবে তার বর্বর আচরণের দৃষ্টান্ত শুধু বিরলই ছিল না, তার প্রকাশ সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই ঘটেছে। প্রতিপক্ষরা যাতে বাবরের কোনও ক্ষতি করতে না পারে তার জন্যে তাদের মনে বাবর ভীতি সঞ্চার করতেন। কিন্তু যারা বাবরের বিরােধিতা না করে আত্মসমর্পণ করত, তাদের সঙ্গে তিনি সহৃদয় আচরণ করতেন। এমনকি পরাজিত আফগানদের প্রতিও তিনি দয়া প্রদর্শন করেন। নীতিগতভাবে বাবর নির্বিচারে হত্যা ও সম্পত্তি ধ্বংসের বিরােধী ছিলেন। নিরীহ মানুষদের সম্পত্তি নষ্ট করার জন্যে বাবর সৈনিকদের শাস্তিও দেন। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার অত্যাচারের দৃষ্টান্ত থেকে তার চরিত্রের বিচার করলে ভুল হবে। তুলনায় তার ঔদার্যবােধের ও মানবিক আচরণের উদাহরণ অনেক বেশী পাওয়া যায়। শত্রুদের প্রতি তিনি ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শনও করেন। বাবরের চরিত্রে আত্ম-জাহির করার ভাব ছিল না। নম্রতা তার চরিত্রকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।
ইসলাম ধর্মের রীতি অনুযায়ী তিনি নামাজ পড়তেন ও রােজা রাখতেন। সুফি সাধকের প্রভাবে বাবর কুসংস্কারমুক্ত ও সহনশীল ছিলেন। যুদ্ধে জয়লাভের প্রয়ােজনে ‘জিহাদ’ ঘােষণা করলেও এবং জয়লাভের পরে ‘গাজী’ ও অন্যান্য উপাধি ধারণ করলেও, তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তা করতেন।২৮ ধর্মান্ধতার মনােভাব থেকে এইসব শব্দের চয়ন ও ব্যবহার করেননি। অবশ্য দুটো ক্ষেত্রে বাবরের অসহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দে আফগানদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ে তিনি শাহবাজ কালাদার-এর কবর ভেঙে দেন। আর একবার ১৫২৮ খ্রীষ্টাব্দে গােয়ালিয়রের কাছে উরওয়া উপত্যকায় বাবর সম্পূর্ণ উলঙ্গ পাথরের এক দেবতার মূর্তি দেখে তা ধ্বংসের নির্দেশ দেন।২৯ মূর্তির নগ্নতা বাবরের সংবেদনশীলতাকে আহত করে। এই একটি মাত্র দৃষ্টান্ত ছাড়া বাবর কর্তৃক মূর্তি বা মন্দির ভাঙার অন্য কোনাে দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। তিনি গােয়ালিয়রের আরও একটি মন্দির দেখে খুবই আকৃষ্ট হন। এই মন্দিরটি ইলতুৎমিস নির্মিত মসজিদের পাশেই ছিল। হিন্দুস্তান অভিযানের সময়ে বাবর হিন্দু যােগীদের পবিত্র স্থান ‘গুর-খাতরি’র কাহিনি শুনতে পান। বাবর এই স্থানটিও পরিদর্শন করেন। তিনি হিন্দু যােগীদের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করেননি। গুর-খাতরির যােগীদের একজন মুসলমান শিষ্যও ছিল। এই মুসলমান শিষ্য অ-ইসলামীয় আচার-অনুষ্ঠান করলেও বাবর তাকে অথবা যােগীদের বাধা দেননি। গুর-খাতরি ও কাচওয়া অঞ্চলের যােগীদের যেসব জমি-জমা ও সম্পত্তি ছিল, তাতে বাবর তাদের অধিকার মেনে নেন, কোনাে কিছুই কেড়ে নেননি। তিনি এই যােগীদের কেন্দ্র ভ্রমণ করার সময়ে প্রজাদের ভীতসন্ত্রস্ত হতে নিষেধ করেন।
সম্রাট বাবর ৫০০ বিঘা জমি অযােধ্যার দন্তধবন কুণ্ড-এর আচার্য স্বামী শত্রুঘ্নকে দান করেন। শুধু তাই নয়, বাবর এই সিদ্ধ যােগীর কাছে আশীর্বাদ নিতেও যেতেন। ড. রাধেশ্যাম সুকুল জানাচ্ছেন এই তথ্য।৩০ এই দন্তধবন-কুণ্ড আজও অযােধ্যা গেলে দেখা যাবে। ওই যােগীর বংশধররা আজও সেই জমির দানপত্র ভােগদখলকারী।।
বাবর বহু মন্দিরকে বহু কিছু দান করে গেছেন। এর মধ্যে হনুমান গড়ি ও জন্মস্থান, নাগেশ্বরনাথ, সিদ্ধগিরির মঠ ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। হিন্দুদের ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাবরের দানপত্র আজও রয়েছে। ওই দানের জন্য হিন্দু প্রতিষ্ঠানগুলি বাবরের কাছে ঋণ স্বীকারও করেছে। রাম রক্ষিত ত্রিপাঠী তার শ্রীরাম জন্মভূমি ইয়া বাবরি মসজিদ mit Toally forc316501, Hanuman Garhi, Dant Dhavan Kund, Janmasthan, Nageshwarnath and Sidh Giris Math etc. Hindu institution are grateful to Babar.’৩১
আবদুল কুদ্দুস গাঙ্গোহী নামে ভারতবর্ষের একজন সাধক বাবরের কাছে একটি পত্র লিখে ইসলামি বিধান অনুযায়ী হিন্দুদের ক্ষেত্রে নানা প্রকার অসুবিধা সৃষ্টি করতে উপদেশ দেন। এমনকি এই সাধক হিন্দুদের সরকারী পদ থেকেও বিতাড়িত করতে বলেন। কিন্তু বাবর তার উপদেশ অগ্রাহ্য করেন। উল্লেখ্য এই, বাবর হিন্দু প্রজাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেন। তিনি হিন্দুদের সেনাবাহিনীতে ও প্রশাসনে নিযুক্ত করেন। ড. রাধেশ্যাম সুকুল তার ‘বাবর’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে আরও জানাচ্ছেন, বাবর হলেন প্রথম মুঘল সম্রাট যিনি তার সেনাবাহিনীতে হিন্দুদের নিয়ােগ করেন। কিন্তু কতজন হিন্দুকে তিনি সরকারী বা সামরিক পদে নিযুক্ত করেন তার কোনাে নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায় না। ‘বাবরনামা’ গ্রন্থ থেকে মাত্র কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়। মানুচির গ্রন্থ হতে জানা যাচ্ছে যে, হিন্দুর ছেলে দিবা (পিতার নাম সিক্ত) ছিলেন বাবরের প্রথম হিন্দু কর্মচারী। এই হিন্দু কর্মচারীর ছেলে হামুশি ছিলেন কূটনীতি ও রাজনীতি উভয় বিষয়েই বাবরের উপদেষ্টা।৩২ বাবরের বিবরণ থেকে জানা যায়, বহুসংখ্যক হিন্দু অফিসার ভূমি রাজস্ব দপ্তরে কাজ করেন। ভারতে কর্তৃত্ব স্থাপনের কয়েক বছরের মধ্যেই মৃত্যু হওয়ায় বাবরের প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া না গেলেও, ভারতবর্ষের মত বহু জাতি, সংস্কৃতি ও বহু ধর্মের সমাজ শাসনের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা থাকে, সে বিষয়ে বাবরের সচেতনতা যথেষ্ট ছিল।৩৩ স্বভাবতই বাবরের চিন্তায় ‘সেকুলার’ উপাদান পাওয়া যায়। মধ্যযুগের প্রেক্ষাপটে ভাবলে বাবরের চিন্তাকে যথেষ্ট অগ্রসর বলা যায়।
বাবর প্রজাপীড়ক শাসকের শাসনের নিন্দা এবং শাসকের ন্যায় বিচারের প্রশংসা করতেন। একজন রাজার যেসব দায় দায়িত্ব থাকে তার গুরুত্বের কথাও বাবর উল্লেখ। করেন। তিনি পুত্র হুমায়ুনকে কর্তব্যে অবহেলা করতে নিষেধ করেন। বাবর বলেন, প্রজাদের যাতে সমৃদ্ধি ঘটে এবং তারা যাতে নিরাপদ ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে সেদিকে শাসকদের লক্ষ্য রাখা দরকার। মহিবুল হাসান কয়েকটি তথ্য উদ্ধৃতি করে বাবরের মনােভাব আলােচনা করেন। একজন শাসক হিসেবে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্যে বাবর খাজা কালানকে স্মরণ করিয়ে দেন: If the townwall be not solid, or subjects not thriving, if provisions be not in store or the treasury not full, it will be laid at the back of the inefficiency of the Pillar-of-the-State.’৩৪
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী এবং নকসবন্দী সুফি সাধকের অনুরাগী বাবর ফৌজদারী ও দেওয়ানী আইনের ক্ষেত্রে ইসলামি বিধান অনুসরণ করে চলতেন। তাঁর জীবনীকার জৈনুদ্দীন লেখেন, “বাবর সব সময়ে ঈশ্বরের আইন পছন্দ করতেন।” কিছু ফরমান থেকে জানা যায়, বাবর ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিদের অর্থ অথবা জমি দান করতেন। আগের শাসকরা মসজিদ, মন্দির ও ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিদের জন্য যা দান করেন তা বাবর অব্যাহত রাখেন।
ভারতবর্ষের আগমনের শুরু থেকেই বাবর ভারতীয়দের সাথে সদয় ব্যবহার করে এসেছেন। এস কে ব্যানার্জী তাঁর ‘বাবর অ্যান্ড দ্য হিন্দু’ নিবন্ধে লিখেছেন: ‘From the beginning of his invasion, Babar behaved magnanimously towards the people of the country, most of whom where Hindus.’৩৫ একই নিবন্ধের শেষে শ্রীব্যানার্জি দ্বিধাহীন মন্তব্য করেছেন যে, এখন এটা পরিষ্কার যে বাবরের মত মানুষ কখনােই হিন্দুদের প্রতি নির্দয় মনােভাবাপন্ন হতে পারেন না।
(৪)
অথচ এই বাবরকে অযােধ্যায় রাম মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করার অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়। বাবর সম্পর্কে বহু কথা আবুল ফজলের অন্য গ্রন্থ ‘তারিখ আলফি’তে রয়েছে। রাম জন্মস্থান মন্দির বা অন্য কোনাে একটিও মন্দির বাবর ধ্বংস করে থাকলে আবুল ফজল বা সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা কি কোথাও তা উল্লেখ করতেন না? শুধু তাই নয় বাবরের পর থেকে আকবরের সময় পর্যন্ত অযােধ্যার মাটিতে কোনাে মন্দির নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের কোনাে বিরােধ থাকলে আবুল ফজল বা ওইসব ঐতিহাসিকরা অবশ্যই উল্লেখ করতেন।
বাবর তাঁর ‘স্মৃতিকথা’য় বেশ কিছু ঘটনার কথা দু’বার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রামজন্মস্থান মন্দির ধ্বংস বা বাবরি মসজিদ নির্মাণের কথা একটি বারের জন্যও কোথাও উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ সাধারণ মাপের বিদ্যাবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদেরও বুঝতে বেগ পেতে হয় না যে বাবরের নামে কলঙ্ক লেপন ইংরেজদের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত আর হীন মনােভাবের ফসল। বাবরের ‘আত্মজীবনী’তে গােয়ালিয়র প্রাসাদের স্থাপত্যের প্রশংসা রয়েছে। ধৌলপুর পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যের কথাও বাদ পড়েনি। বাদ পড়েনি সেখানকার দশফুট গভীর কূপ খননের কথাও। আর কিনা তিনি বাদ দিলেন রামমন্দির ভাঙার কথা? হীন চক্রান্ত আর কাকে বলে!
মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ার তত্ত্ব সরকারিভাবে প্রথম প্রকাশ করেন শ্রীমতি বেভারিজ, তাঁর ‘মেমােয়ার্স অফ বাবর’ গ্রন্থে, যা ছিল ‘বাবরনামা’র অনুবাদ। এভাবে ব্রিটিশরা মন্দির ভাঙার গল্প ছড়ায়, অন্যদিকে কোনাে ঐতিহাসিক তত্ত্ব প্রমাণ ছাড়াই সেইসব গল্প গাথাকেই তথ্য হিসাবে তাদের গেজেটিয়রে ও গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করতে থাকে। অনুবাদিকা শ্রীমতি বেভারিজ ‘বাবরনামা’র কোথাও মন্দির ভাঙার কথা খুঁজে না পেয়ে (বাবরনামা’র কোনাে সংস্করণে বা কোনাে ভাষ্যে ১৫২৬-৩০ এর মধ্যে তৎকালীন অযােধ্যার কোনাে মন্দির বাবর ভেঙেছিলেন বলে উল্লেখ নেই) ‘ফুট-নােটে’ তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও মন্তব্য ব্যক্ত করলেন, “বাবর মুসলমান হওয়ায় এবং প্রাচীন হিন্দু তীর্থের পবিত্রতা ও মর্যাদায় মুগ্ধ হওয়ায় মসজিদ নির্মাণের জন্য মন্দিরের ‘অন্ততঃ আংশিক স্থানান্তর করাতেন।” তার যুক্তি অত্যন্ত সরল: “…মহম্মদের একনিষ্ঠ অনুগামীর মত অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর অসহিষ্ণুতা ছিল।” অর্থাৎ বাবর মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ে তােলা অত্যন্ত উচিৎ কর্তব্য বলে মনে করতেন—এই যুক্তি সহজেই খাড়া করা যায়। শ্রীমতি বেভারিজ মন্দিরের জমিতে মসজিদ গড়ে তােলার বক্তব্যের সপক্ষে কোনাে ঐতিহাসিক তথ্য পেশ করেননি। ‘মেমােয়ার্স অফ বাবর’ প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে, যখন ভারতবর্ষ ছিল স্বাধীনতার জন্য গণআন্দোলনে উত্তাল। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না শ্রীমতি বেভারিজ হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরােধ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই অনুমানকে তত্ত্ব হিসেবে উপস্থিত করতে চেয়েছিলেন।
বস্তুত অন্য ধর্মের পীঠস্থান সম্পর্কে বাবরের রাষ্ট্রনীতি শ্রীমতি বেভারিজের বক্তব্যকে আদৌ সমর্থন করে না। বাবর পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু ছিলেন এমন নজির ইতিহাসে তেমন নেই।৩৬ আর মুসলিম বলেই তিনি কোরআনের নির্দেশ মেনে চলবেন এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে কোরআনের স্পষ্ট নির্দেশ যে, বিবাদস্থলে নামাজপাঠ আল্লাহর কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। অতএব মসজিদ নির্মাণের প্রশ্নই ওঠে না। সাধারণ যুক্তি খাটালেও বাবরকে মন্দির ধ্বংসকারী হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। বাবর অযােধ্যার পথে পা বাড়িয়েছিলেন পাঠানদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। আর পাঠানরাও মুসলমান। পাঠানদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে বাবরের দরকার এদেশীয় হিন্দুদের সমর্থন ও সহযােগিতা। সেক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মানসিকতায় আঘাত হানা তার পক্ষে আত্মহত্যার নামান্তর নয় কি? অযােধ্যা নিয়ে গবেষক সুশীল শ্রীবাস্তব-এর মন্তব্য: ‘It will be worth noting here the Pathans themselves were Muslims; so it would be unfair to say that Babar’s antagonism was directed only at the Hindus.’ আরও বলা হয় যে, হিন্দুদের এটাই বহু যুগের বিশ্বাস যে, অযােধ্যায় রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এটার কোনও প্রমাণ নেই যে, রামমন্দির ভাঙা হয়েছিল। বাবরের আগে এদেশে রামমন্দির ছিলই না তাে মন্দির ভাঙবে কে? তাছাড়া বাবর ১৫২৬ সালে দিল্লি দখল করেই ১৫২৮ সালে প্রথমেই দিল্লিতে মন্দির না ভেঙে কেন অযােধ্যায় গিয়ে মন্দির ভাঙেন তারও তাে একটা জবাব চাই? প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মা তার গ্রন্থে৩৭ প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, ১৬ শতকের আগে এদেশে রামমন্দির বা রাম পূজার প্রচলন ছিল না। ১৬ শতকে তুলসীদাস যখন হিন্দি রামায়ণ লিখলেন তখন থেকেই দেশে শুরু হল রামপুজা। ১৫৭৫-৭৬ সালে যখন তুলসীদাস ‘রামচরিতমানস’ লিখেছিলেন তখন তার মধ্যে মন্দির ভাঙার কোনও কথা নেই। ১৫৯৫-৯৬ সালে আবুল ফজল অযােধ্যায় রামের বাসস্থান ছিল বলেছেন, রামের জন্মভূমি বলেননি। উল্লেখ্যযােগ্য যে, অযােধ্যাতে যে দুজন ইহুদি নবীর কবর রয়েছে সে সম্পর্কেও তিনি বলেছেন। কিন্তু রামের জন্মভূমিতে মসজিদ করা হয়েছে, এরকম কোনও ইঙ্গিত তিনি দেননি।
১৬০৮ থেকে ১৬১১ সালের মধ্যে উইলিয়াম ফিঞ্চ অযােধ্যাতে এসেছিলেন। উনি বলেছেন যে, এখানে রামের দূর্গ ও বাড়ি আছে। উনি রামকোট (দূর্গ) ও স্বর্গদ্বারের কথা বলেছেন, কিন্তু রামের জন্মের কোনও কথা বা মন্দিরের কথা বলেননি। ১৬৯৫ – ৯৬ সালে সুজন রায় ভাণ্ডারী তাঁর বই৩৮ সমাপ্ত করেন, যার মধ্যে ভারতবর্ষের তীর্থক্ষেত্রগুলাের ভৌগােলিক বিবরণ আছে। অযােধ্যা যে রামচন্দ্রের বাসস্থানের জন্য পুণ্যতীর্থ সে কথাও বলেছেন। ইহুদিদের কবরের কথাও বলেছেন। কিন্তু এর মধ্যে রামজন্মভূমি বা রামমন্দিরের কোনও কথা নেই। ১৭৫০-৬০ সালে রায় চতুরমন সাকসেনা তার বই৩৯ শেষ করেন, যার মধ্যে ভারতবর্ষের ভৌগােলিক বর্ণনা রয়েছে। যদুনাথ সরকার এর কিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন। এতে অযােধ্যাকে রাজা দশরথের ছেলে রামচন্দ্রের জন্মস্থান বলে ধরা হয়েছে। কিন্তু রামের জন্মস্থান বা রামমন্দির নিয়ে নিশ্চিত করে কোনও কথা বলা নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাবরি মসজিদ তৈরি (সম্ভবত ১৫২৮-২৯ সালে বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ তৈরি করেন, তৈরি করার পর এতে একটি শিলালেখ লাগানাে হয়, যার থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়) হবার ২০০ বছরের মধ্যে কোনও ইঙ্গিত সমকালীন লেখার মধ্যে নেই যে, ঠিক কোথায় রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল এবং মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল এ রকম কোনও ইঙ্গিতও নেই।
স্থাপত্য এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে বাবরের ধ্যান-ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাবরনামা’ গ্রন্থ থেকে। ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে আকবরের রাজত্বকালে ‘বাবরনামা’র একটি ফারসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সেই গ্রন্থে অবশ্য মসজিদের কোনও উল্লেখ নেই। তবে একথা সত্য, দীর্ঘদিন ধরেই বাবরি মসজিদের সঙ্গে এদেশের মুসলমানদের একটা অন্তরের যােগ ছিল। মসজিদটি ভারতবর্ষের মুসলমানদের উপাসনা সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হয়ে যায়।
১৭৮৯ সালে জার্মান জেসুইট পাদ্রী জোসেফ টিফেন থালারের বই ফরাসি ভাষায়। পন্ডিত জে বারনুলি অনুবাদ করে বার্লিন শহর থেকে প্রকাশ করেন (“Description historique et geographic de l’Inde’) এই গ্রন্থের রামদূর্গের কথা বলা হয়েছে কিন্তু রামমন্দিরের কোনও উল্লেখ নেই। মসজিদ তৈরি হবার প্রায় ২৫০ বছর পরেও স্থানীয় লােকের মনে বিশ্বাস ছিল না যে, ওখানে একটা রামমন্দির ছিল। এরও ২০ বছর পর এই বিশ্বাস জন্মাতে থাকে। ১৮১০ সালে ফ্রান্সিস বুকানন অযােধ্যায় এসে মন্দির ভাঙার কথা শােনেন। অবশ্য বুকাননের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট নয় যে, মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল কিনা।৪০
তাছাড়া গুরু নানকের (১৪৬৯-১৫৩৯) রচনা থেকে জানা যায়, তিনি বাবরের অভিযান ও তার সেনাবাহিনীর ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করেন। ১৫২০ খ্রীষ্টাব্দে বাবর তৃতীয়বার হিন্দুস্থান অভিযান করেন। বিদ্রোহী আফগানদের দমন করে বাবর শিয়ালকোট যান। এখানে তিনি কোনই বাধা পাননি। তাই স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন ও সম্পত্তি নষ্ট হয়নি। কিন্তু শিয়ালকোটের কাছে সয়ীদপুর অঞ্চলের অধিবাসীরা আত্মসমর্পণ না করায় বাবর এই অঞ্চল আক্রমণ করে ধ্বংস করেন, তিন হাজার নরনারীকে ক্রীতদাসে পরিণত করেন এবং যারা লােদীদের সমর্থন করে তাদের হত্যা করেন। বহু লােককে বন্দী করা হয়। এই ঘটনার সময়ে গুরু নানক ও তাঁর শিষ্য মারদানা সয়ীদপুরে ছিলেন এবং বাবরের ধ্বংসকার্য প্রত্যক্ষ করেন। বাবরের সৈন্যদের অত্যাচারের এক মর্মস্পর্শী বিবরণ গুরু নানক দেন। অন্যান্যদের সঙ্গে গুরু নানক ও মারদানাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আবদ্ধ করা হয়। তাদের কায়িক শ্রম করতে বাধ্য করা হয়। গুরু নানক যখন মস্তবড় বােঝা বহন করেন তখন এক ঘটনা ঘটে। তার খবর পেয়ে বাবর নিজে কারাগারে গিয়ে গুরু নানকের সঙ্গে দেখা করেন। তাকে দেখে বাবর এতটা প্রভাবিত হন যে বাবর বলে ওঠেন: ‘ওই ফকিরের চোখেমুখে আমি যেন ঈশ্বরকে দেখলাম। এবং তার পায়ের কাছে বসে পড়ে বাবর জিজ্ঞেস করেন তার জন্যে তিনি কি করতে পারেন। গুরু নানক সমস্ত বন্দীদের মুক্তিদান করতে এবং তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে বলেন। বাবর তাই করেন। কোনাে কোনাে গবেষক সয়ীদপুরে নানকের উপস্থিতি ও বাবরের সঙ্গে তার। সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে সন্দেহ পােষণ করেন। ডব্লিউ. এইচ. ম্যাকলিয়েড সয়ীদপুরে গুরু নানকের উপস্থিতি মেনে নেন, কিন্তু গুরু নানক-বাবর সাক্ষাৎকার তথ্য নির্ভরযােগ্য মনে করেন না। অন্যদিকে মহিবুল হাসান ‘পুরাতন জনম-সখি’ উল্লেখ করে বলেন, এই ঘটনার সততা সম্বন্ধে সন্দেহ করার কোনাে কারণ নেই। বাবরের চরিত্র ও সাধু সন্তদের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধার মনােভাব থেকে এই ঘটনা মহিবুল হাসানের কাছে সত্যি বলেই মনে হয়েছে।৪১
উল্লেখ্য, ‘বাবরনামা’ গ্রন্থে গুরু নানক-বাবর সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে কোনও উল্লেখ নেই। গুরু নানকের লেখা থেকেই তা জানা যায়। তিনি বাবরের তৃতীয় ও পঞ্চম অভিযানের সময়ে যে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও নারীদের উপর নির্যাতন হয় তা প্রত্যক্ষ করেন। প্রথমে সয়ীদপুরের ধ্বংসলীলা সম্বন্ধে গুরু নানকের প্রতিক্রিয়া সঙ্গীতের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়। তারপর তিনি লাহােরে বাবরের সৈন্যদের নিষ্ঠুরতা ও পানিপথ যুদ্ধের পরের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন। তাতে হিন্দু-মুসলমান রমণীদের দুঃখ-বেদনার এক মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য, গুরু নানক তীব্র ভাষায় বাবর ও তার সেনাবাহিনীর বর্বরতার নিন্দা করেন। গুরু নানকের রচনা থেকে দুটো বিষয়ে স্পষ্ট করে জানা যায় :
১. বাবর প্রাধান্য স্থাপনের সময়ে হিন্দু-মুসলিম উভয়কেই নির্বিচারে হত্যা করেন।
২. বাবর হিন্দু মন্দির অপবিত্র বা ধ্বংস করেন এমন ঘটনা গুরু নানক উল্লেখ করেননি। গুরু নানক অযােধ্যাতেও গিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি সেখানে ‘বাবরি মসজিদ দেখেছেন। এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৫২৮ খ্রীষ্টাব্দে। বাবর যদি রাম জন্মস্থান ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করতেন তাহলে অযােধ্যার অধিবাসীদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই তা গুরু নানক শুনতে পেতেন। সেক্ষেত্রে তিনি নিশ্চয়ই সে কথা উল্লেখ করতেন এবং তার প্রতিবাদ করতেন। বাবরের সমসাময়িক ও তার তীব্র সমালােচক গুরু নানকের রচনায় কিন্তু তা পাওয়া যায় না।৪২
বি পি সিংহ একজন পুরাতত্ত্ববিদ। তিনি রামচন্দ্রের ঐতিহাসিক তত্ত্বে বিশ্বাসী। তিনি বলেছেন, অযােধ্যার লােকবসতির প্রথম পর্যায়টা যদি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের হয়ে থাকে, তবে রামচন্দ্রের কাল তাে বুদ্ধদেবের সমসাময়িক হবে, কারণ রামায়ণের বিবরণে রামচন্দ্রের পূর্ব-পুরুষদের যে তালিকা রয়েছে, তাদের জন্য কিছুটা সময় তাে ছেড়ে দিতেই হয়। অপর আর একজন ঐতিহ্যবাদী পুরাতত্ত্ববিদ হলেন আর জি গৌর। তিনি অযােধ্যার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বি বি লালের বক্তব্য নিঃসংশয়ে মেনে নিয়েছেন। তবে রামায়ণের কাল যে মহাভারতবর্ষের চাইতে অনেক প্রাচীন, এই ঐতিহ্যগত ধারণার তিনি সমর্থক। তাই তিনি মনে করেন—Gradually the whole episode of Rama along with his geograghical surroundings was transferred from the land of Saptasindhu and transplanted in the region of Ayodhya’ অর্থাৎ মূল ঘটনাটা আদৌ অযােধ্যার নয়ই। আর যদি রামচন্দ্রকে অযােধ্যারই সন্তান বলে মানতে হয়, তবে রামায়নের কাহিনির আরও বহু ব্যাপার ছাঁটাই করতে হয় এবং মেনে নিতে হয় রামচন্দ্র কৃষ্ণের পরে জন্মেছিলেন।
(৫)
অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। বাবর বিজিত দেশসমূহে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিধান করার ক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন। কূটনীতিবিদ হিসাবেও তিনি সাফল্য লাভ করেছিলেন। বাবর তার সর্বশক্তি নিয়ােগ করে অভ্যন্তরীণ গােলযােগ এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে সবসময়ই সচেষ্ট থাকতেন। তিনি দিল্লির সুলতানদের মতাে খেলাফতের প্রতি অনুগত ছিলেন না। বরং নিজেকে ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ােজিত শাসক বলে মনে করতেন। পারস্যের রীতিনীতি ও আদবকায়দা তিনি তার রাজদরবারে প্রচলিত করেছিলেন।
প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে পূর্ণ সাফল্য লাভ করতে পারেননি সম্রাট বাবর। প্রশাসনের ক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষের প্রথাগুলােকেই ব্যবহার করেছিলেন—যুগােপযােগী নতুন কোনাে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রচলন করতে পারেননি। কেন্দ্রীয় শাসনকে শক্তিশালী না করে বাবর সামন্ত অধিপতিদের ওপর স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এতে করে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সামন্ত অধিপতিগণ নিজ নিজ অঞ্চলে প্রায় অর্ধস্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনকি তারা তাদের অঞ্চল নিজস্ব আইন অনুযায়ী শাসন করতেন। কেন্দ্রীয়ভাবে বাবর সমগ্র সাম্রাজ্যের জন্য একটি সাধারণ শাসনপ্রণালী ও সাধারণ আইন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেননি। এসব কারণে বাবরের সাম্রাজ্যে সুনিয়ন্ত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রশাসনের বদলে অনেকগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সমষ্টি গড়ে উঠেছিল।
মুঘল সাম্রাজ্য দু’শ বছরেরও অধিককাল দাপটের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বলা যায়, বাবরের সাহস ও বহুমুখী প্রতিভাই দীর্ঘস্থায়ী মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করে দিয়েছিল। এ কারণে বাবরের নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এছাড়াও বাবর তার অনুপম ও ধ্রুপদী ‘আত্মজীবনী’ রচনা করে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে নিজের স্থান দখল করে আছেন।৪৩ এশিয়ার দুই শক্তিশালী গােষ্ঠী মােঙ্গল ও তুর্কিদের যাবতীয় গুণাবলির সমন্বয় ঘটেছিল বাবরের মধ্যে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পারসীয়দের মানসিক উৎকর্ষ। এভাবে সম্রাট বাবর মধ্য এশিয়া ও ভারতবর্ষের মধ্যে এবং তৈমুর-চেঙ্গিস ও আকবরের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন করেছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. তুর্কি ভাষায় বাবর শব্দের অর্থ বাঘ। দেখুন-ঈশ্বরীপ্রসাদ, এ শর্ট হিস্টরি অফ মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া, এলাহাবাদ, ১৯৩৯, পৃ. ২১৪।
- ২. দ্য কেমব্রিজ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯২৮, পৃ. ৩।
- ৩. বাবর : তুজক-ই-বাবরি (বাবরনামা), এ এস বেভারিজ কৃত ইংরেজি অনুবাদ (মূল তুর্কি থেকে), ১৯২১, নিউদিল্লি, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৭০।
- ৪. বাবর : তুজক-ই-বাবরি (বাবরনামা), প্রাগুক্ত, ১৯৭০, পৃ. ৩৮০; আরও দেখুন এস এম এডােয়ার্ডস ও গ্যারেট, মুঘল রুল ইন ইন্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৬২, পৃ. ২।
- ৫. আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ১৭৭।।
- ৬. এস এ এ রিজভি, দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, অনুবাদ-অংশুপতি দাশগুপ্ত, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ১৮৩।
- ৭. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, অনুবাদ-সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ২০১৪, পৃ. ৪।
- ৮. বাবর :তুজক-ই-বাবরি (বাবরনামা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৬-৭৪। আগ্রাতে গােয়ালিয়রের শাসকের পরিবারবর্গ বাবরের পুত্র হুমায়ুনকে এ সময় উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন ‘কোহিনূর’ নামে বিশ্ববিখ্যাত হীরক। দেখুন-এস এ এ রিজভি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫।
- ৯. মজুমদার দত্ত রায়চৌধুরী, অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, ম্যাকমিলন, লন্ডন, ১৯৬০, পৃ. ৪২৫।
- ১০. উইলিয়াম রাসব্রুক, অ্যান এম্পারর বিল্ডার অফ দ্য সিক্সটিন্থ সেঞ্চুরি, লন্ডন, ১৯১৮; পুনর্মুদ্রণ, ১৯৬২, পৃ. ১৫৬-৫৭।
- ১১. মজুমদার দত্ত রায়চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩, পাদটীকা।
- ১২. এম এস রানধাওয়া, পেইন্টিংস অফ বাবরনামা, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, দিল্লি, ১৯৮৩, পৃ. ৯।
- ১৩. এস এইচ হােদিওয়ালা, হিস্টরিক্যাল স্টাডিজ ইন মুঘল নুমিসমেটিকস, কলকাতা, ১৯২৩ পৃ. ২৬২।
- ১৪. শ্রীরাম শর্মা, স্টোরি অফ বাবরস ডেথ, ক্যালকাটা রিভিউ, সেপ্টেম্বর ১৯৩৬। ১৫. বাবর : তুজক-ই-বাবরি (বাবরনামা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২৫-২৬। ১৬. মহিবুল হাসান, বাবর : ফাউন্ডার অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার ইন ইন্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৮৫।
- ১৭. অমলেন্দু দে, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা, রত্না প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৯২।
- ১৮. মহিবুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৬। ১৯. গুলবদন বেগম : হুমায়ুননামা, এ এস বেভারিজ কৃত ইংরেজি অনুবাদ, লন্ডন, ১৯০২।
- ২০. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।
- ২১. মজুমদার দত্ত রায়চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩২।
- ২২. শেখ জৈনুদ্দিন, তবকৎ-ই-বাবরি (বাবরের জীবনী গ্রন্থ), ১৯১৯, পৃ. ১৯২।
- ২৩. শেখ জৈনুদ্দিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯২।
- ২৪. শেখ জৈনুদ্দিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৪-৯৬।
- ২৫. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।
- ২৬. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০।
- ২৭. দ্য ইন্ডিয়ান রিভিউ, আগস্ট ১৯২৯, পৃ. ৪৯৯।
- ২৮. সতীশচন্দ্র লিখেছেন, “হিন্দুদের প্রতি বাবরের মনােভাব কীরকম ছিল ? একথা সত্য যে রানা সঙ্গর বিরুদ্ধে চালানাে সামরিক অভিযানকে বাবর ‘জেহাদ’ বলে ঘােষণা করেছিলেন এবং সে যুদ্ধে জয়লাভের পর সুরা ত্যাগ করে ও সুরাদানি ভেঙে তিনি রীতিমতাে ‘গাজি’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। তবে এগুলি অবশ্যই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণােদিত পদক্ষেপ। রানার ঘনিষ্ঠ সহযােগী চন্দেরির শাসক মেদিনী রাও-এর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানও ‘জেহাদ’ বলে ঘােষিত হয়েছিল। এবং সেটিও ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। আর খানুয়ার যুদ্ধ জয়ের পরে পরাজিত প্রতিপক্ষের সৈনিকদের মাথার খুলি দিয়ে স্তম্ভ নির্মাণের বিষয়টা আসলে মােঙ্গল ও তৈমুরীয়দের একপ্রকার প্রথা ছিল। এটা যে কেবল যুদ্ধজয়ের স্মৃতিচিহ্নই ছিল তা নয়, বিপক্ষ শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টির এক মােক্ষম মাধ্যমও ছিল। এই প্রথা বাবর আফগান ও রাজপুতদের বিরুদ্ধেও একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন।” (সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, অনুবাদ- সায়ন দে ও রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ৪৭)।
- ২৯. সতীশচন্দ্র লিখেছেন, “বাবর হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এমন কোনাে সূত্র মেলেনি এখনও। আগ্রার পাশেই ছিল মথুরা, আর বাবর সে এলাকা দিয়ে বহুবার গােয়ালিয়র দুর্গের অভ্যন্তরে অবস্থিত রাজকীয় প্রাসাদ ও মন্দির প্রদর্শন করেছিলেন এবং সেখানকার ছবি তুলে ধরেছিলেন নিজের স্মৃতিকথায়, কিন্তু একবারও সেগুলি বিনষ্ট করা বা ধ্বংস করার চেষ্টা করেননি। শুধু উরওয়া উপত্যকার জৈন দেবদেবীর মূর্তি ভেঙে দেবার নির্দেশ বাবর দিয়েছিলেন কারণ সেগুলি ছিল সম্পূর্ণভাবে নগ্ন। নির্দেশমতাে কেবল মূর্তিই ভাঙা হয়েছিল, মন্দির নয় এবং পরে সেই মন্দিরে জৈন সাধকরা পুনরায় মূর্তি নির্মাণ করে নিয়েছিলেন।” দেখুন-সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭-৪৮।
- ৩০. রাধেশ্যাম সুকুল, সচিত্র প্রামাণিক ইতিহাস, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ১৬।
- ৩১. রামরক্ষিত ত্রিপাঠি, শ্রীরাম জন্মভূমি ইয়া বাবরি মসজিদ, ১৯৮৭, পৃ. ৫-৬।
- ৩২. মানুচি : স্তোরিয়া দ্য মােগর অর মুঘল ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, ডব্লিউ আরভিন অনূদিত ও সম্পাদিত (৪খণ্ড, ১৯০৬-০৮); নিউ দিল্লি, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৮১, পৃ. ৬১। ৩৩. এস এ এ রিজভি, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৮-৮৯।
- ৩৪. মহিবুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬১; বাবর : তুজক-ই-বাবরি (বাবরের জীবনী গ্রন্থ), প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২৫-২৯, ৬৪৫-৪৬।
- ৩৫. S. K. Banerjee, ‘Babar and the Hindus’, Journal of the United Provinces Historical Society, July 1936.
- ৩৬. সতীশচন্দ্র লিখেছেন, “বাবর যে ধর্মীয় ব্যাপারে বেশ নমনীয় ছিলেন এবং হিন্দুদের প্রতি তার যে সেরকম কোনাে বিদ্বেষ ভাব ছিল না তার প্রমাণ মেলে ভারতবর্ষের স্বাধীন হিন্দু রাজাদের প্রতি তার আচরণে। বাবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করার পরেও পাঞ্জাবে গােক্ষরদের প্রধান হাতি গােক্ষরদের তার পৈতৃক ভূমিতে পূর্বের মতােই শাসন করার অনুমতি দিয়েছিলেন বাবর। ফল স্বরূপ আদম গােক্ষর এক বিশাল গােক্ষর সেনাবাহিনী সহযােগে বাবরের সঙ্গে আগ্রা পর্যন্ত এসেছিলেন এবং খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের হয়ে যুদ্ধও করতে দেখা গিয়েছিল সেনাবাহিনীকে। সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন সঙ্গোর গােক্ষর। তাছাড়া বাবর রানা সঙ্গ-র মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের সঙ্গেও রাজনৈতিক বােঝাপড়ায় আসতে চেয়েছিলেন। তাই। রানা সঙ্গের বিধবা পত্নী রানি পদ্মাবতী তার পুত্র বিক্রমজিৎ যখন ভ্রাতার দ্বারা নিপীড়িত হচ্ছিল তখন স্বয়ং বাবরের সাহায্যের প্রার্থনা করেছিলেন। রানি বাবরকে রনথম্বর ও মহম্মদ খলজির মুকুট আর কোমরবন্ধ সমর্পণের বিনিময়ে ৭০ লক্ষ টঙ্কা অর্থমূল্যের পরগনা ও সম্পত্তি চেয়েছিলেন। যদিও কোনাে চুক্তি হয়নি তবুও বাবর রানির দূতকে সসম্মানে আপ্যায়ন করেছিলেন এবং রানির চাহিদা অনুযায়ী বায়না নয় বরং শামসাবাদ দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।” দেখুন-সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮।
- ৩৭. রামশরণ শর্মা,ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ও রামের অযােধ্যা, পত্রপুট, কলকাতা, ১৯৯৭।
- ৩৮. সুজন রায় ভাণ্ডারী, খুলাসাৎ-উৎ-তওয়ারিখ, জাফর হাসান সম্পাদিত, দিল্লি, ১৯১৮।
- ৩৯. রায় চতুরমন সাকসেনা, চাহার গুলশান, আবদুস সালাম সংগৃহীত, আজাদ গ্রন্থাগার, আলিগড়; যদুনাথ সরকার কর্তৃক অংশবিশেষ অনূদিত ও ভাষ্যকৃত, ইন্ডিয়া অফ ঔরঙ্গজেব, কলকাতা, ১৯০১।
- ৪০. সতীশচন্দ্র লিখেছেন, “বলা হয়ে থাকে যে, সম্বল ও অযােধ্যা—বাবরের ভারতে সাম্রাজ্যের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রেই নাকি বাবরের নির্দেশে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু সম্বল ও অয্যোধ্যায় প্রাপ্ত লেখ অনুযায়ী সে জায়গায় মসজিদ নির্মাণের জন্যে স্থানীয় শাসকদের যথাক্রমে মির হিন্দু বেগ ও মির বাকি-র কৃতিত্ব লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং ঈষৎ উল্লেখ রয়েছে বাবর কর্তৃক মসজিদ নির্মাণের নির্দেশের। কিন্তু সেখানে কোথাও এটা বলা নেই যে ওই জায়গায় হিন্দু মন্দির ছিল বা হিন্দু মন্দির ভাঙা হয়েছিল। বরং যে দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই দুই বৃহৎ মসজিদের নির্মাণকার্য সম্পন্ন হবার কথা বলা হয়েছে, তাতে এটা মনে হতে পারে যে ওখানে হয়তাে পূর্বে মসজিদই ছিল আবার বাবর কেবল সেগুলি সংস্কার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মাত্র। ফলে পরিস্কারভাবেই এই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে ওই অঞ্চলে আগে আদৌ কোনাে হিন্দু বা বৌদ্ধ মন্দির ছিল কি? আর থাকলে কে ও কবে তা ধ্বংস করেছিল?” দেখুন-সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপোেস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮।
- ৪১. মহিবুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২-৫৩।
- ৪২. সুরিন্দর কাউর ও তপন সান্যাল, দ্য সেকুলার এম্পারর বাবর, সিরহিন্দ, ১৯৮৭, পৃ. ৪৭-৫২।
- ৪৩. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ইতিহাস, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।
আরও পড়ুন,
সম্রাট আওরঙ্গজেব ও মন্দির ধ্বংসের অজানা ও রোমাঞ্চকর ইতিহাস
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।