সেই সময় নাচে গানে পটু গণিকাদের একটা সম্মানীয় নাম ছিল—বাঈজী। ওই সুন্দরী বাঈজী দের বাবু ও জমিদারেরা ভাড়া করে আনতেন। নাচ, গান, বাজনা আর খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে বাজী পােড়ানাে এবং আরও কুৎসিত আমােদ-প্রমােদের উৎসব চলতাে ঢালাওভাবে। বাড়ির এই উৎসবে ইংরেজ মনিবদের নেমন্তন্ন করা হােত। এই ছিল নগর কলকাতার নাগরিক জীবনের একমাত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়। ‘আত্মীয়সভা’ ও ‘ধর্মসভা’র গােষ্ঠীভুক্ত রাজা রামমােহনের বাড়িতে, প্রিন্স দ্বারকানাথের বাগান বাড়িতে, রাজা রাধাকান্ত দেবের গৃহে, মহারাজ সুখময় রায়ের বাড়িতে, রাজা গােপীমােহন দেবের বাড়িতে, বেনিয়ান বারাণসী ঘােষের বাড়িতে এসব জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান নিয়ে পারস্পরিক প্রতিযােগিতা চলত। ১৮২৯ সালে গােপীমােহন দেবের বাড়িতে পূজা উপলক্ষে লর্ড ক্যাম্বারমিয়ার-সহ লর্ড ও লেডি বেন্টিঙ্ক বাঈজী -নাচ দেখার জন্য উপস্থিত ছিলেন। নিকী ছিলেন সেকালের এক নামকরা বাঈজী। নিকী ছাড়াও আশরুন, ফৈয়াজ বক্স, বেগমজান, হিঙ্গুল, নান্নিজান, সুপনজান, জিন্নাত প্রভৃতি সেকালের বিখ্যাত বাঈজীদের নিয়ে এসে নাচগানের ব্যবস্থা করা হত। এই সমস্ত বাঈজীরা তখন শােভাবাজার, চোরাবাগান, বটতলা, শুরাে, মাণিকতলা এককথায় সারা কলকাতা মাতিয়ে রেখেছিল। এইসব বাঈজী নাচের আসরে একদিকে চণ্ডীমণ্ডপে চলেছে দেবী দুর্গার পূজা অন্যদিকে উঠোনের সামিয়ানার তলায় লম্বা খাবার টেবিল তাতে টার্কি, শুয়ােরের মাংস, দেশি বিদেশি কতসব খাবার আর দামি মদ সাজানাে। পর্তুগিজ আর মুসলমান বাবুর্চিরা সেদিন দারুণ ব্যস্ত। বাবুরা দামি পােশাক এমনকী গয়না পরে (অবশ্য হার, বাজু ইত্যাদি) সেজেগুজে কোচানাে কেঁচা হাতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘরের ভিতর বাঈজী নাচ চলছে আর অন্য এক বিরাট বলরুমে ইউরােপীয় নাচ। এ ছিল সেদিনের দুর্গাপুজোর আসর।
নর্তকীদের আনার জন্য পাল্কী পাঠিয়ে দেওয়া হত। সঙ্গে যেত পাইক ও বরকন্দাজ। পাল্কীটাকে বেহারারা নাটমন্দিরের সামনে এনে নামাত। “রাজা সাহেব এগিয়ে আসতেন খুশী উজ্জ্বল দুটো কামাতুর চোখ নিয়ে। মােসাহেবের দল অপরিসীম কৌতুহল নিয়ে পাল্কীর রুদ্ধ দুয়ারের দিকে তাকাতেন। তারপর দরজা দুটো খুলে যেত। নর্তকী নামত, পরনে মসলিনের পেটিকোট ও ওড়না ও সমস্ত দেহ অলঙ্কারে মােড়া, ঠোটে উজ্জ্বল হাসি ঠিকরে পড়ত। রাজা সাহেব এগিয়ে আসতেন, বলতেন, এস বিবিজান।”৪৩ নিকী বাঈজীকে সেই সময়ে (১৮১৯) কলকাতার এক ধনী ব্যক্তি মাসিক এক হাজার টাকা দক্ষিণা দিয়ে রক্ষিতা রূপে গ্রহণ করে সমাজে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।৪৪
মহারাজ সুখময় রায়ের বাড়ির ১৭৯২ সালের দুর্গাপূজা আর বাঈজী নাচের বিবরণ ‘ক্যালকাটা ক্রনিকল’-এ প্রকাশিত হয়।
“The only novelty that rendered the entertainment different from those of lost year, was the introduction or rather the attempt to introduce some English tunes among the Hindusthani Music.৪৫
রাজেন্দ্র মল্লিকের কান-ফোঁড়া উপলক্ষে যে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবানুষ্ঠান হয়েছিল, তার বিবরণ ১৮২৩-র ১৫ মার্চ ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল,
“বাটির বাহিরে যেরূপ আলাে দেওয়া হইয়াছিল ভিতরের আড়ম্বর উহা অপেক্ষা কোন অংশে নূন ছল না। লাল ভেলভেট পাতা পথের উপর দিয়া ভিতরে যাইবার ব্যবস্থা, চারিদিকে সুবর্ণ খচিত ফুলের মালা ও ফুলে সুসজ্জিত, সঙ্গীত ও সৌন্দর্য্যে যেন স্বর্গের নন্দনকানন বলিয়া ভ্রম হয়। নর্তকী গায়িকার সংখ্যা অধিক না হইলেও যে দুইজন নাচিতেছিল তাহারা অলৌকিক সৌন্দৰ্য্যশালিনী। নিকীর গান ও রূপের বর্ণনা তাহার সঙ্গিনীর সঙ্গে মানাইয়াছিল। গােলাপের সহিত পদ্মের বর্ণ যেন মিশ্রিত হইয়া অনুপম কপােলে উজ্জ্বলাভা বিকীর্ণ করিতেছে, চক্ষু হইতে আনন্দ উৎস বিচ্ছুরিত হইতেছে, অন্যটিকে ইউরােপের রবিন পক্ষীর মত সুন্দর মনে হয়, তাহারা যেন কন্দর্পের শর লইয়া ত্রীড়া কন্দুক করিতেছিল। যাহা যেরূপ হওয়া উচিৎ উহা সেইরূপই হইয়াছিল। সুনির্বাচিত সম্মিলনীতে সুমিষ্ট সুরা লেহ্য পেয় শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের সহিত নৃত্যাদিতে যথারীতি আদর আপ্যায়নে আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ পরিতুষ্ট, কিছুরই ত্রুটি ছিল না।”৪৬
আসুন এবার যাই ১৮০৬ সালের শােভাবাজারের রাজা রাজকৃষ্ণের রাজবাড়িতে দুর্গাপূজা ও বাঈজী নাচ দেখতে। সত্যি সত্যি তাে যাওয়া যাবে না, তাই দেখা যাক আমন্ত্রিত অতিথি ধর্মযাজক ওয়ার্ড কি দেখেছিলেন। তিনি শােভাবাজর রাজবাড়িতে এ বছরের দুর্গাপুজোয় উপস্থিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন,
“আমি শােভাবাজার রাজবাড়ীর দুর্গোৎসবে উপস্থিত ছিলাম। চারমহল প্রাসাদের মাঝে উৎসব প্রাঙ্গণ, সামনে ঠাকুর দালান। পুবদিকে একখানা ঘরে মদ ও সাহেবি খানার আয়ােজন হয়েছে সাহেব অতিথিদের জন্যে। ঘরের সামনে দুজন পর্তুগিজ খানসামা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দু’পাশের ঘরে নিমন্ত্রিত এদেশীয় অতিথিরা উপস্থিত। মাঝখানে বিশাল অঙ্গণে হিন্দু নর্তকীদের নাচগান চলছে। সাহেব অতিথিরা চারদিকে কৌচে বসে তন্ময় হয়ে দেখছেন। মাঝে মধ্যে মুসলমান বাঙ্গরা হিন্দুস্থানী গান গেয়ে ও রঙ্গ তামাশা করে আসরের সকলকে আপ্যায়ন করছে। রাত তখন দুটো। বাঈজী ও নাচের মেয়েরা চলে গেল। ক্রমে সাহেব অতিথিরাও বিদায় নিলেন। কেবলমাত্র আমরা কয়েকজন তখনও বসে।”
অভিজাত সমাজের মানুষদের বাড়িতে দরজা বন্ধ করে কড়া পাহারা’র আড়ালে অনুষ্ঠিত হত বাঈজী নাচ, সাহেবদের আপ্যায়ণের উদ্দেশ্যে। আর দরজা খােলা হতাে ইতরজনদের জন্য যখন যাত্রা, কবিগান, খেমটা প্রভৃতির আয়ােজন থাকত। আমােদ-প্রমােদের এই শ্রেণি-বৈষম্যটা ধরা পড়েছিল ইংরেজ ধর্মযাজক ওয়ার্ডের চোখে। ভােররাতে নাচ শেষ হলে এবং অন্যান্য ইংরেজ অতিথিরা বিদায় নিয়ে চলে গেলে এত(ণের বন্ধ সদর দরজা খুলে দেওয়া হলাে এবং পিল পিল করে ‘a vast crowd of natives rushed in almost treading upon one another’, রাজবাড়ির উঠানে ঠেসাঠেসি করে বসে যারা হয় ঠাকুর, ভবানী বেনে ও নিতাই বৈরাগীর কবিগান শুনতে জড়াে হয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে নিশ্চিত মনে রেভারেন্ড ওয়ার্ড দেখছিলেন বাঈজীদের, “সুবেশে সজ্জিত, গাইছে, নাচছে যেন নিদ্রাতুর পদক্ষেপে, তাদের ঘিরে আছে সােফায় কাউচে বসা ইউরােপীয় অতিথিবৃন্দ…।” কিন্তু এবার একেবারে বিপরীত মেজাজের অনুষ্ঠান। গায়কেরা, “কুচ্ছিত গান আর অশ্লীল নাচের ভঙ্গিতে অতিথিদের বিনােদন করছে, তুলে ধরছে তাদের হাত, ঘুরপাক খাচ্ছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে নিজেদের মাথা,…যখন তখন বাঁকিয়ে দিচ্ছে তাদের শরীর আর চিৎকারে তাদের গলা চিরে যাওয়ার জোগাড়।”
যদিও ইউরােপীয় ও এদেশীয় অধিবাসীরা শহরের দুই বিভিন্ন এলাকায় বাস করতাে এবং এদের জীবনযাত্রার মধ্যে বিরাট পার্থক্য পরিলৰিত হতাে, তা সত্ত্বেও ইউরােপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে সামাজিক ক্ষেত্রে কোনাে যােগাযােগ ছিল না এ কথা বলা যায় না। বড়লাট এবং অন্যান্য ইংরেজ সরকারী কর্মকর্তা ও উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দেওয়া জাঁকজমকপূর্ণ প্রীতিসম্মেলন ও ভােজসভায় ভারতীয় উচ্চশ্রেণির লােকেরা আমন্ত্রিত হতেন এবং তাদের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখান হতাে। যেমন বিশপ হেবারের বিয়াল্লিশতম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ২১ এপ্রিল ১৮২৪ কলকাতা বিশপ ভবনে একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠান ও ভােজসভার আয়ােজন করা হয়েছিল যেখানে বড়লাট লর্ড আমহার্স্ট ও লেডি আমহার্স্ট এবং ইংরেজ কর্মকর্তারা ছাড়া রাজা রাধাকান্ত দেব ও হরিমােহন ঠাকুরের মতাে বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ভারতীয় উপস্থিত ছিলেন। যদিও ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য তারা ইংরেজদের সঙ্গে বসে খাদ্য গ্রহণ করতে পারেননি, তারা পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন যখন বিদায় নেবার আগে বিশপ হেবারের স্ত্রী স্বয়ং ভারতীয় প্রথা অনুযায়ী তাদেরকে পান, গােলাপ জল এবং গােলাপের সুগন্ধি আতর দিয়ে আপ্যায়িত করেন।৪৭ বিত্তবান ভারতীয়রাও ইউরােপীয়দের নিমন্ত্রণ করতেন তাদের নিজের বাসভবনে যেখানে অতি পর্যাপ্তভাবে তাদের আপ্যায়ন করা হতাে এবং সেখানে নর্তকীর দ্বারা নৃত্য পরিবেশন ছিল বিনােদনের অপরিহার্য অংশ।
এমনই একটা বিনােদনের আয়ােজন হয়েছিল রাজা রামমােহনের বাসভবনে। সেখানে নিকী বাঈর মত আধুনিক ‘বসন্ত সেনা’ বহুবার নৃত্যগীতাদি প্রদর্শন করেছিল। এদের উৎসবানন্দের জলসায় দেশীয় ধনিক ও কোম্পানির তােঙ্গ সাহেব কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করতেন। এদের বল্গাহীন আমােদ-প্রমােদের একটি সংযত ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন ফ্যানি পার্ক। তিনি সে সময়ে কলকাতায় এসেছিলেন এবং একজন ধনিক বাঙ্গালী বাবুর বাড়ী’র উৎসবে উপস্থিত হয়েছিলেন। তার বিবরণে জানা যায়,
“..পাশের একটি বড় ঘরে নানারকমের উপাদানে উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানাে ছিল। সবই বাবুর ইউরােপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশী পরিবেশক ‘মেসার্স গাণ্টার অ্যাণ্ড হুপার’ সরবরাহ করেছিলেন। খাদ্যের সঙ্গে বরফ ও মদ্যও ছিল প্রচুর। মণ্ডপের অন্যদিকে বড় একটি হলঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাঈজীদের নাচগান হচ্ছিল এবং ইউরােপীয় ও এদেশী ভদ্রলােকরা সােফায় হেলান দিয়ে চেয়ারে বসে সুরাসহযােগে সেই দৃশ্য উপভােগ করছিলেন।”৪৮
১৮১৪ সালে রাজা সুখময় রায়ের ছেলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বাড়ির দুর্গাপুজোর খবর বেরিয়েছিল ক্যালকাটা গেজেটে। সেদিন শহরের বিখ্যাত বাঈজী নিকী নেচেছিলেন। ২০ অক্টোবর প্রকাশিত এ খবরে জানা যায় দুর্গোৎসবের সময় কলকাতার ধনিক হিন্দুরা পরস্পর অমিতব্যয়ের প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হন এবং তাদের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় টাকার জেল্লা দেখিয়ে যেন তারা সমাজে মান-মর্যাদা অর্জন করতে চান এবং গণ্যমান্য হতে চান সাধারণ মানুষের মধ্যে। রাজা সুখময় রায়ের পুত্র রাজা কিষাণচঁাদ রায় ও তার ভায়েদের গৃহে পুজোর কয়েকদিন নিকী নামে বিখ্যাত বাঈজীর নৃত্যগীত পরিবেশিত হবে। পূর্বাঞ্চলের একজন শ্রেষ্ঠ বাঈজী বলে নিকীর নামডাক আছে। অতএব শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় উৎসব হবে রাজা সুখময় রায়ের গৃহে। নীলমণি মল্লিকের গৃহে নৃত্যগীত হবে বাঈজী ঊষারাণীর। সারা হিন্দুস্থানে ঊষারাণীর মতন সুকণ্ঠ গায়িকা আর দ্বিতীয় নেই।”৪৯
এর দু’বছর পরে এক বাঈনাচের খবর বেরিয়েছিল ‘এশিয়াটিক জার্নাল’-এ। এতে লেখা হয়েছিল,
“We had an opportunity on Monday evening of discovering in which particular house, the attraction of any novelty may be found, but from a cursory view, we fear that the chief singer Nikkee and Ashroon, who are engaged by Neel Munnee Mullick and Raja Ramchunder, are still without rivals in melody and grace. A woman named Zeenut who belongs to Banaras, performs at the house of Buder Nath Baboo, in Jorasanko. Report speaks highly of a young damsel, named Fyz Boksh, who performs at the house of Goroo Parsad Bhos”৫০
এই সংবাদ থেকে বাবুদের বাঈজী নাচের ও অন্যান্য আড়ম্বরের প্রতিযােগিতার কথা জানা যায়।
বহুমূল্য ইউরােপীয় আসবাবপত্রে মাণিকতলার বাড়িটি সুসজ্জিত করে রাজা রামমােহন কলকাতার জীবনযাত্রা শুরু করেছেন। কিন্তু হঠাৎ রাজাদের মতাে তাঁর বিলাস-বৈভবপূর্ণ রাজসিক জীবনযাত্রা। উৎসবে-ভােজে, বাঈজী নাচে ও রক্ষিতা পােষণে অজস্র অর্থ ব্যয় করার তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক ঐতিহ্য তিনিও বহন করে চলেছিলেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, সমসাময়িককালে রাজা রামমােহন রায়ের এক যবনী রক্ষিতা ছিল। উমানন্দন ঠাকুরের এক প্রশ্নের উত্তরে রাজা রামমােহন রায় বলেছিলেন যে, ওরূপ যবনী রক্ষিতা শৈবমতে বিবাহিতা স্ত্রীর সামিল।৫১
অনেকের ধারণা রামমােহন গােপনে এক মুসলমান রমণীকে বিবাহ করেন এবং তার ঘরে এক পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করে। পুত্রটি আর কেউ নন, তিনি রাজারাম রায় যাকে রামমােহন নিজের পালিত পুত্র হিসেবে ঘােষণা করে তাকে নিয়ে ১৮৩১ সালে বিলেতে যান এবং সেখানে তার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন। রামমােহনের মৃত্যুর পর রাজারাম বিলেতেই থেকে যান। রামমােহনের মেয়েটিকে হুগলির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বিবাহ দেওয়া হয়।৫২ কিন্তু বিনয় ঘােষ এমন তথ্য স্বীকার করেননি। তিনি জানিয়েছেন রাজারাম রায় রামমােহনের নিজের সন্তান নন, দত্তক নন, আশৈশব পুত্রবৎ পালিত একজন এদেশীয় সন্তান। তিনি হিন্দুর, না মুসলমানের, না খ্রীস্টানের, না ইহুদীর, কার সন্তান তা আজও জানা যায়নি। হরিদ্বারের মেলায় কোম্পানির কর্মচারী ডিক সাহেব তাঁকে দেখতে পান, তারপর তিনিই তাকে কিছুদিন পালন করেন। যখন সাহেবের স্বদেশে ফিরে যাবার সময় হয়, তখন তিনি রামমােহনের হাতে তাকে সমর্পণ করে যান। তারপর রামমােহনের কাছেই তিনি পুত্রবৎ স্নেহে পালিত হন। রাজারামের এই ইতিহাস ডক্টর ল্যান্ট কার্পেন্টার ১৮৩৫ সালে একটি চিঠিতে জানান। এইরকম কথা হয়েছে যে বিলাত-যাত্রাকালে রামমােহনের সঙ্গী মুসলমান ভৃত্য ‘সেখ বসু’ হলেন রাজারাম। কিন্তু শেখ বকসু ও রাজারাম যে একই ব্যক্তি নন তা দুজনেরই ইংল্যাণ্ড থেকে স্বতন্ত্র জাহাজে কলকাতা ফেরার ঘটনা থেকে স্পষ্ট বােঝা যায়। সেখ বসু ‘জেনােবিয়া’ জাহাজে করে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৩ কলকাতায় ফেরেন, রাজারাম ফিরে আসেন ‘জাভা’ জাহাজে ১৮৩৮ সালের আগস্ট মাসে। রাজারাম ইংল্যাণ্ডে ‘বাের্ড অফ কন্ট্রোলে’ কেরাণীর কাজ করেন প্রায় তিন বছর, কলকাতায় ফিরে এসে সরকারের রাজনৈতিক দত্তরে মাসিক ২০০ টাকা বেতনে কিছুদিন কাজ করেন। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং তত্ত্ববােধিনী সভার সভ্যও ছিলেন। এরপর তার সম্বন্ধে আজগুবি জল্পনা-কল্পনার আর কোনাে অবকাশ থাকতে পারে বলে মনে হয় না।৫৩
একটু আগেই বলা হয়েছে শ্রীমতী ফ্যানি পার্ক ১৮২৩ সালে রামমােহনের মাণিকতলার বাগানবাড়িতে আয়ােজিত ভােজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার ডায়রিতে ঘটনার আরও বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, “বেশ বড় চৌহদ্দীর মধ্যে তার বাড়ী, ভােজের দিন নানা বর্ণের আলাে দিয়ে সাজানাে হয়েছিল। চমৎকার আতসবাজীর খেলাও হয়েছিল সেদিন। আলােয় আলােকিত হয়েছিল তার বাড়ী। বাড়ীতে বড় বড় ঘর ছিল এবং একাধিক ঘরে বাঈজী ও নর্তকীদের নাচগান হচ্ছিল। বাঈজীদের পরণে ছিল ঘাঘরা, সাদা ও রঙ্গীন মসলিনের ফ্রিল দেওয়া, তার উপর সােনারূপাের জরির কাজ করা। সাটিনের ঢিলে পায়জামা দিয়ে পা পর্যন্ত ঢাকা। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, পােষাকে ও আলােয় আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। গায়েতে অলঙ্কারও ছিল নানারকমের। তারা নাচছিল দলবেঁধে বৃত্তাকারে, পায়ের নূপুরের ঝুমঝুম শব্দের তালে তালে।…নর্তকীদের সঙ্গে একদল বাজিয়ে ছিল, সারেঙ্গী মৃদঙ্গ, তবলা ইত্যাদি নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল তারা। …বাঈজীদের মধ্যে একজনের নাম নিকী, শুনেছি সারা প্রাচ্যের বাঈজীদের মহারাণী সে, এবং তার নাচগান শুনতে পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের কথা। বাঈজীদের নাচগান শােনার পর রাতের খাওয়া-দাওয়াও শেষ হল। তারপর এদেশের ভেলকিবাজ জাগলারদের অদ্ভুত সব ত্রীড়াকৌশল আরম্ভ হল। কেউ তলােয়ার লুতে হাঁ করে সেই ধারালাে অস্ত্রটা গিলে ফেললে, কেউ বা অনর্গল আগুন ও ধোঁয়া বার করতে লাগল নাকমুখ দিয়ে। একজন শুধু ডান পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পিছন দিক দিয়ে বাঁ পা তুলে ধরল কাধের উপর। এই ধরণের কৌশল দেখে নকল করার চেষ্টা করাও বিপজ্জনক। বাড়ীর ভিতর সুন্দর ও মূল্যবান আসবাবপত্র সাজানাে এবং সবই ইউরােপীয় স্টাইলে, কেবল বাড়ীর মালিক হলেন বাঙ্গালীবাবু (রামমােহন রায়)।”৫৪
রাজা রামমােহনের অন্তরঙ্গ সুহৃদ প্রিন্স দ্বারকানাথও নিকৃষ্ট আমােদ-প্রমােদ করতেন। ১৮২৩ সালে তার নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে অনেক কৌতুকাবহ ভাঁড়ামির অভিনয় হয়েছিল। ‘সমাচার দর্পণ’-এর সংবাদে৫৫ প্রকাশ “মােং কলিকাতা ১১ ডিসেম্বর ২৭ অগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে শ্ৰীযুত বাবু দ্বারিকানাথ ঠাকুর স্বীয় নবীন বাটীতে অনেক ভাগ্যবান সাহেব ও বিবীরদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়া চতুর্বিধ ভােজনীয় দ্রব্য ভােজন করাইয়া পরিতৃপ্ত করিয়াছেন এবং ভােজনাবসানে ওই ভবনে উত্তম গানে ও ইংলণ্ডীয় বাদ্য শ্রবণে ও নৃত্য দর্শনে সাহেবগণে অত্যন্ত আমােদ করিয়াছিলেন। পরে ভাঁড়েরা নানা শং করিয়াছিল কিন্তু তাহার মধ্যে একজন গাে-বেশ ধারণপূর্বক ঘাস চর্বণাদি করিল।”৫৬
দেশীয় জমিদার-দেওয়ান-বেনিয়ান ও ইউরােপীয় বণিক-কর্মচারীদের আনন্দ দানের জন্য প্রিন্স দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির অনুষ্ঠানে আতসবাজী ও আলাের বিচিত্র খেলায়, আমােদ-প্রমােদের বিলাসে লক্ষে টাকা খরচ হয়েছিল। গভর্ণরজেনারেল লর্ড অকল্যাণ্ডের ভগ্নী মিস ইডেনের সম্মানে যে বিরাট উৎসবানুষ্ঠানের আয়ােজন এই বাগানবাড়িতে করা হয়েছিল, তার বর্ণনা দিয়েছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, “যখন গবর্নর জেনারেল লর্ড অকলণ্ড ছিলেন, তখন আমাদের বেলগাছিয়ার বাগানে। অসামান্য সমারােহে গবর্নর জেনারেলের ভগিনী মিস ইডেন প্রভৃতি অতি প্রধান প্রধান বিবি ও সাহেবদিগের এক ভােজ হয়। রূপে, গুণে, পদে, সৌন্দর্য্যে, নৃত্যে, মদ্যে, আলােকে বাগান একেবারে ইন্দ্রপুরী হইয়া গিয়াছিল।”৫৭
দ্বারকানাথের জীবনীকার কিশােরীচাঁদ মিত্র বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “এখানেই তাঁর আতিথেয়তা রাজকীয় আড়ম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল। এবাড়ির প্রশস্ত উদ্যানের মধ্যে এঁকে বেঁকে প্রসারিত মতিঝিল ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। মতিঝিলটি ঝলমল করত হিন্দু কবির অতি প্রিয় নীলপদ্ম ও অন্যান্য হরেকরকম সুন্দর সুন্দর ফুলের ঐধর্য্যে। ফেব্রুয়ারী ও মার্চ চতুর্দিক প্রসারিত প্রাঙ্গনে যেন পিটুনিয়া, পিঙ্ক, ফ্লস্, সাক্ পার্স, গােলাপ, জিনিয়া প্রভৃতি ফুলের আগুন লাগত। এ বাড়ির সুপ্রশস্ত বৈঠকখানা এমন রীতিতে সজ্জিত হয়েছিল যা সে-যুগে দুর্লভ। ভিলার শিল্পশালার দেওয়ালগুলাে ছিল আধুনিক শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনে অলঙ্কৃত এর কারণস্বরূপ বলা যায় এর মালিক ছিলেন চিত্র এবং ভাস্কর্যের উৎকর্ষ বিচারে যথার্থ অভিজ্ঞ। বৈঠকখানার পিছনে ঝকমক করত মার্বেল পাথরে বাঁধানাে ফোয়ারা, তার উপরে ছিল কিউপিডের একটি মূর্তি। মতিঝিলের মাঝখানে ছিল একটি দ্বীপ, দ্বীপের উপর একটি গ্রীষ্মবাস। একটি ঝােলানাে লােহার সেতু ও একটি হালকা কাঠের সেতুর সাহায্যে গ্রীষ্মবাসটি মূল বাগানের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এ গ্রীবাস ছিল আমােদ-প্রমােদের কেন্দ্র। পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত হলেও বেলগাছিয়া ভিলাকে বলা চলত কলকাতার ওয়েস্ট এণ্ড বা কেনসিংটন। এখানে দ্বারকানাথ অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন। বলতেকী, বেলগাছিয়া ভিলার উৎসবগুলাের মত বিলাসবহুল ও জমকালাে উৎসব সে যুগে খুব কমই হত। অভ্যাগতদের জন্য যে রান্না হত তার প্রণালী ছিল অতুলনীয়। আভিজাত্যে ও শ্রেণীমর্যাদায় অতিথিরাও হতেন অনন্য। খাদ্য তালিকায় থাকত ফরাসী ও প্রাচ্য দেশীয় খাদ্যের অফুরন্ত বৈচিত্র। তাদের মধ্যে অবশ্য সবচাইতে কদর ছিল কাবাব, পােলাও এবং হােসেনীর। মদ আমদানি করা হত সােজা ইউরােপ থেকে। আর দ্রাক্ষা মদিরার মধ্যে সেগুলাে ছিল সেরা জাতের।…
কাউন্সিলের সদস্যরা এবং সুপ্রিম কোর্টের জজরাও দ্বারকানাথের আতিথ্য গ্রহণ করতেন। আর আসতেন বিভাগীয় জেনারেলগণ আর পরগণার জমিদাররা। এধরণের ভােজসভায় পুরনাে সিভিলিয়ানরা এবং ভােগক্লান্ত সামরিক কর্মচারীরা তরুণ সহকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করতেন।… বেলগাছিয়া ভিলাই ছিল সেযুগের একমাত্র ব্যক্তিগত বাগানবাড়ি বা একমাত্র স্থান যেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর ইউরােপীয় ও দেশীয় ভদ্রলােকেরা মিলিত হতেন, মেলামেশা করতেন স্বচ্ছন্দ অন্তরঙ্গতায়।
সে যুগে সমাজের নেতৃস্থানীয়া মহামাননীয়া মিস্ ইডেনের উদ্দেশ্যে দ্বারকানাথ এখানে একটি নৈশ ভােজ এবং নৃত্যোৎসবের আয়ােজন করেন। এ উৎসবটি ছিল উৎসবকর্তা এবং অভ্যাগত উভয়ের পথেই পরিতৃপ্তিদায়ক। এ উৎসব উপলক্ষে কক্ষ গুলাে করা হয়েছিল আলােকোদ্ভাসিত, দর্পণের প্রতিবিম্বে উজ্জ্বল। মির্জাপুর কার্পেট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কক্ষে কক্ষে, বুটিদার রক্তিমাভ কাপড় এবং সবুজ সিল্কের সমারােহে কক্ষ গুলাের উৎসব-সজ্জিত রূপ ছিল অনিন্দ্য। টেবিলগুলাের ওপরের আচ্ছাদন ছিল তে পাথরের। তাতে শােভা পাচ্ছিল বর্ণবৈচিত্রময় পুষ্পস্তবক। দুষ্প্রাপ্য বহু অর্কিড, বিচিত্রভাবে শােভিত ছােট ছােট ঝােপ ও লতাপাতা দিয়ে সাজনাে হয়েছিল সিঁড়ি, বারান্দা, বৈঠকখানা এবং কেন্দ্রস্থিত প্রশস্ত হলঘর। গ্রীষ্মবাস এবং ঝুলন্ত সেতুটিকে সজ্জিত করা হয়েছিল লতাপাতা, পুষ্প, দেওদার পাতা ও বহু বর্ণ-বিচিত্র পতাকা দিয়ে। প্রাঙ্গন এবং জলসরবরাহের কেন্দ্রটি আলােকোজ্জ্বল করা হয়েছিল হাজার হাজার অলঙ্কৃত বাতি দিয়ে। সেকালের জনৈক লেখক উৎসব-স্থানটির বর্ণনা করেছেন। ইন্দ্রপুরীর দৃশ্য বলে। হলঘরটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল মধুর সঙ্গীতে, বহু রাত্রি পর্যন্ত উৎসবের নৃত্য চলেছিল সমানভাবে। সেদিনের রাত্রির মত এত চমৎকার বাজি পােড়ানাে ভিলায় আর দেখা যায়নি। কলকাতার সমস্ত অভিজাত সম্প্রদায় উপস্থিত ছিলেন সে রাত্রির উৎসবে। অভূতপূর্ব আড়ম্বরের মধ্যে সে রজনীর উৎসব সমাপ্ত হয়েছিল।”৫৮
তৎকালে প্রচলিত একটি ব্যঙ্গাত্মক ছড়ার মধ্যেও বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে আয়ােজিত আমােদ-অনুষ্ঠানের খ্যাতির পরিচয় পাওয়া যায়,
“বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুঁরি কাটারি ঝঝনি, খানা খাওয়ার কত মজা, আমরা তার কি জানি? জানেন ঠাকুর কোম্পানী।”৫৯
১৮৫৬-এ এই বাগানবাড়ি বিক্রি হয়ে যাওয়ায় ‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকা৬০ দুঃখপ্রকাশ করে লিখেছিল,
“হা যে উপবন প্রস্তুতকরণে দ্বারকানাথবাবু দুই লক্ষ টাকার অধিক ধন বিসৰ্জ্জন করিয়াছিলেন এবং যে কাননে এক রজনীতে ইংরাজাদি ভােজনে দশ বিশ সহস্র উড়িয়া গিয়াছিল, গত শনিবারে সেই বাগান বিক্রয় হইয়া গিয়াছে।”৬১
আমােদ উৎসবে টাকা ওড়ানাের প্রতিযােগিতায় ইংরেজ নবাবরা দেশীয় বাবু নবাবদের তুলনায় পিছিয়ে ছিলেন না। তারাও উৎসব উপলক্ষে নাচগানের আসর বসাতেন এবং লক্ষ টাকার আতসবাজীর খেলা দেখানাে হত। ১৮০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আতসবাজীর খেলার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায়—
“আতসবাজীতে হাতির লড়াই দেখানাে হল আকাশে। উপরে বাজি ফাটল, তার ভিতর থেকে আগুনের দুটি হাতি বেরিয়ে এল এবং লড়াই করল। আগুনের একটি আগ্নেয়গিরি থেকে কিছুক্ষণ ধরে আকাশে রংবেরংয়ের রকেট উদ্গীরিত হতে থাকল। আবার একটি বাজি ফাটল আকাশে এবং তার ভিতর থেকে আগুনের রেখায় আঁকা দুটি মন্দির ভেসে উঠল চোখের সামনে, ভারতের দেবদেউল। মন্দিরের পাশে একটি বাজির ঝর্ণা থেকে অজস্র ধারায় আগুনের বিন্দু ঝরতে থাকল এবং বিন্দুগুলি নীল রঙের। অবশেষে সূর্য-চন্দ্র-তারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বাজির আকাশে এবং তার ভিতর থেকে একটি বৃত্তাকার আগুনের ভূমণ্ডল ঘুরতে ঘুরতে ছিটকে বেরিয়ে এল এবং তার ভিতর থেকে আবার অগ্নিকণা বিচ্ছুরিত হতে থাকল। আশ্চর্য হল, আগুনের মধ্যে ফার্সি হরফে লেখা কল্যাণ হােক সকলের।”৬২
জীবিকা নির্বাহের জন্য রাজা রামমােহনের অর্থোপার্জনও সর্বাংশে সুস্থ ও নিষ্কলঙ্ক ছিল না বলে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিশােরীচাঁদ মিত্রের মতাে সেকালের বিধাসযােগ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রচলিত জনরবের প্রতি অঙ্গুলি সঙ্কেতে বলেছেন যে, সেকালের অন্যান্য বাঙালি দেওয়ানের মতাে রাজা রামমােহনও সরকারি কর্মে লিপ্ত থাকাকালীন উৎকোচ গ্রহণ করে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। ক্যালকাটা রিভিউ’তে কিশােরীচাঁদ মিত্র লিখেছেন,
“দেওয়ান হিসাবে কাজ করে তিনি এত টাকা উপার্জন করেছিলেন, যাতে ‘বছরে দশ হাজার টাকা আয়ের জমিদার হতে পেরেছিলেন। একথা সত্য হলে এই অসাধারণ মানুষটির নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ জাগে।”৬৩
এ সম্পর্কে কে.এস. ম্যাকডােনাল্ড বলেছেন,
“দেওয়ান হিসাবে দশবছরের চাকরিজীবনে তিনি এত টাকা সঞ্চয় করেছিলেন, যা দিয়ে তিনি বার্ষিক ১০০০ পাউণ্ড অথবা মাসিক ১০০০ টাকা আয়ের সম্পত্তি কিনেছিলেন। এই ঘটনা তার খ্যাতি বৃদ্ধির সহায়ক হয়নি। তাছাড়া সলােমনের মতাে না হয়ে ধন-উপার্জন ও সম্পদ রক্ষা করাকে জীবনের লক্ষ বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, এমনকি সেটাকে জ্ঞানের কাছে দ্বিতীয় স্থান পর্যন্ত দেননি।”৬৪
অরবিন্দ পােদ্দার বলেছেন,
“এসব পদে অধিষ্ঠিত থাকার কালে সে সময়কার বল্গাহীন স্বর্ণমৃগয়ার দিনে, বেশ কিছু উপরি পাওনার ব্যবস্থাও সমগ্র অর্থনীতিক কাঠামােতে জড়িয়ে ছিল। অন্যান্যদের মত তিনিও যদি এর সুযােগ গ্রহণ করে থাকেন তাে বিস্ময়ের কারণ নেই। …এসব সাক্ষ থেকে সামগ্রিক যে চিত্রটি স্পষ্ট হয় তা হল, কলকাতায় বুদ্ধিমার্গীয় আলােড়নে জড়িয়ে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত, এবং সম্ভবত তারপরেও, তিনি ছিলেন বিত্তের সন্ধানে ধাবমান এক ব্যক্তি, যিনি অর্থ উপার্জনের ব্যাপারে নৈতিক প্রণটিকে বিশেষ গুরুত্ব দান করার প্রয়ােজন বােধ করেননি।”৬৫ কারণ নয়া ভূস্বামীশ্রেণির কাছে অর্থ ছিল পরমার্থস্বরূপ। তাই তারা ন্যায়-নীতিবােধ বিসর্জন দিয়ে বিত্তশালী হয়েছেন তেকায় প্রভুদের সাহচর্যে, সান্নিধ্যে ও দৃষ্টান্তে জন্মের সেই পরম লগ্নেই কলকাতার অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির মানুষ এক অসুস্থ খেলায় মেতেছিল। তাতে স্বার্থবুদ্ধিই একমাত্র বুদ্ধি, দুর্নীতিই একমাত্র নীতি, ষড়যন্ত্রের চাপা ফিসফিসানিই একমাত্র আলাপের ভাষা।”৬৬
উপরের বিষয়গুলি মনে রেখে রাজা রামমােহনের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তার কর্মপ্রয়াস সম্পর্কে আলােচনা করলে তাঁর মূল্যায়ন যথার্থ ও ইতিহাস-সম্মত হবে। কারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা ও চরিত্র তার মতামত ও কর্মপ্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করে।
পােষাক-পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রা জীবিকা নির্বাহ বিষয়ে শহরের অন্যান্য ধনিক বাবুদের সঙ্গে রাজা রামমােহনের কোনাে প্রভেদ ছিল না। তিনি এদের মতাে পােষাক-পরিচ্ছদ, এদের মতাে জীবনযাত্রা এবং এদের মতাে কোম্পানির কাগজ, ভূসম্পত্তি ও নানারকম আয়ের (জ্ঞাত ও অজ্ঞাত) উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তবে রামমােহন শিক্ষাদীক্ষায় এদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিলেন। দেওয়ানি লাভের পূর্বে তিনি আরবি-ফারসি ও সংস্কৃত শাস্ত্র গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। জন ডিগবির দেওয়ান রূপে রংপুরে থাকাকালে রামমােহন ইউরােপীয় ইতিহাস-বিজ্ঞান-দর্শনের বহু গ্রন্থ পাঠ করেন এবং বিধের বিভিন্ন দেশসমূহের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কিত বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। বেন্থাম, হিউম, রিকার্ডো, জেমল মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমূখ সেকালের শ্রেষ্ঠ ইউরােপীয় চিন্তাশীলদের রচনাবলী পাঠে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। কলকাতায় ও ইংল্যাণ্ডে বসবাসকালে। রাজা রামমােহনের বিভিন্ন কর্মপ্রয়াসের মধ্যে তাদের প্রভাব অনুভূত হলেও তা সামন্ত-স্বার্থের জন্য খণ্ডিত ও পরস্পর-বিরােধী ছিল।৬৭
উল্লেখ্য, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাই সে যুগের কলকাতার নব্যধনী পরিবারে বাঈ নাচের প্রচলন। আশুতােষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেসকল নৃত্য উত্তর ভারত অঞ্চল হইতে বাংলাদেশে প্রসার লাভ করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে…বাঈজী নাচ অন্যতম। যতদূর জানা যায়, বাঈ নর্তকীরা কলকাতায় এসেছিলেন উত্তর ভারত থেকে। গুরুসদয় দত্তর মতে,
‘…the Nautch and the Khemta (the Khemta dance is merely a corrupt form of Nautch)…were imported into Bengal in comparatively recent times from northern Indian cities’.
যেহেতু মহারাষ্ট্রে মহিলাদের উপাধি বাঈ, তার থেকেই অনুমিত হয় যে এই নর্তকীরা মহারাষ্ট্র থেকে আগত। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ লিখেছিল বাইদিগের নৃত্য মহারাষ্ট্রীয়।…পুরাণের ন্যায় এই নৃত্যের গাম্ভীৰ্য্য আছে।৬৮ তাছাড়া উত্তর ভারতের পতনােন্মুখ মুঘল রাজদরবার থেকে এই নর্তকীদের অনেকেই চলে আসেন নতুন মহানগরী কলকাতায় পৃষ্ঠপােষকদের সন্ধানে। মনােমােহন বসু সম্পাদিত ‘মধ্যস্থ’, “উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বাঈজী সম্প্রদায়ের…সুশিক্ষিতা নর্তকীদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লিখেছিল যে এঁদের নৃত্যকৌশল, গীতির ভাবানুযায়ী হাবভাব, অঙ্গভঙ্গি, কুটী প্রভৃতি যথার্থ ভাবুক লােকে দেখিলে বিস্ময়ােফুল্ল না হইয়া থাকিতে পারেন না।”৬৯ মিসেস বেলনস-এর মতাে ইউরােপীয় চিত্রশিল্পীদের বহু ছবিতে এইসব নৃত্যপটীয়সীদের ‘অঙ্গভঙ্গি, কুটী’ ইত্যাদি আভাস পাওয়া যায়। ঘাঘরার চওড়া ঘেরের দুই কোণ দুই হাতে ধরে, সারেঙ্গীর সুরের তালে মৃদু পদসঞ্চালন ছাড়া আর কোনাে বৈচিত্র্য ছিল বলে মনে হয় না এঁদের নাচে। খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক হেবারের স্ত্রীর বর্ণনুযায়ী এই নৃত্যশৈলীতে থাকে বাহু, মস্তক এবং দেহের কষ্টসাধ্য সঞ্চালন আর সর্বদা শ্লথ গতিতে অস্থির পদযুগল কখনাে কখনাে স্থান পরিবর্তন করে।৭০ তাদের পােষাক সম্বন্ধে শ্রীমতী হেবারের মন্তব্য—তাদের পােশাক তাে যেন শালীনতার প্রতিমূর্তি উদ্ধৃত করে পরবর্তী যুগের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পত্রিকা ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’, বাঈজী নাচের উপর ব্রাহ্ম সমাজ-সংস্কারকদের আক্রমণ (খতে গিয়ে বলেন আমরা মানি ভারতীয় নাচ প্রাণহীন, কিন্তু তাতে কামুকতা বা দুর্নীতির চিহ্নমাত্র নেই।৭১
বাঈজীদের মধ্যে যাঁরা তদানীন্তন ইউরােপীয় পর্যটকদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছিলেন তারা অধিকাংশই গায়িকা রূপে পরিচিতা। রামমােহন রায় প্রভৃতি বাঙালি ধনী পৃষ্ঠপােষকদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত ইউরােপীয় শ্রোতারা ‘নিকী’-র কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তখনকার ইতালীয় অপেরা গায়িকা অ্যাঞ্জেলিকা ক্যাটলানি (১৭৮০-১৮৪৯) ও জার্মান গায়িকা এলিজাবেথ বিলিংটন (১৭৬৮-১৮১৮)-এর তুলনা করতেন। এই দুই ইউরােপীয় গায়িকার মতাে ‘নিকী’র গলা খেলত উচ্চ সপ্তকে।
শােভাবাজারের রাজকৃষ্ণ দেব, জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার, সিমলের দে-রা দুর্গাপূজার সময় এইসব বাঈজী নর্তকীদের দৈনিক ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রণামী দিয়ে নিযুক্ত করতেন। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে, এইসব রাজা-রাজড়ারা আর ছিলেন না, ঐসব বাঈজী নর্তকী ও তাদের বংশধরেরা তখনাে কলকাতায় আসর জমিয়ে বসে ছিলেন। দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্তে আগমনে’ (১৮৮৯) খবর পাচ্ছি তখনকার দিনের ‘বাঈওয়ালির মধ্যে ইলাহিজান…বিখ্যাত’। সঙ্গে সঙ্গে যােগ করা হচ্ছে— “খেমটাওয়ালিদের মধ্যে হরিদাসী ও কামিনী বিখ্যাত।” পৃথকীকরণের চেষ্টাটা লক্ষণীয়। পুজোয় এবং বিবাহ উপলক্ষে, গ্রামাঞ্চলে জমিদার ও ধনীগৃহে এ শতাব্দীর শুরুতেও এঁদের বায়না দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতাে।
যদিও ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা খেমটার সঙ্গে সঙ্গে বাঈ নাচেরও বিরােধিতা করতেন, ইংরেজি শিতি বাঙালির অধিকাংশের কাছেই বাঈ নাচ তার বনেদি, রাজদরবার-সম্পর্কিত উৎসের জন্য পার পেয়ে গিয়েছিল। ‘বঙ্গদর্শন’ ও ‘মধ্যস্থ’-র মতাে নব্যশিথিত বুদ্ধিজীবীদের মুখপত্রের চোখে বাঈ নাচ শুধু রুচিসম্মত বলেই বিবেচিত হয়নি, ‘পৌরাণিক গাম্ভীর্যের পরিচায়ক বলে সম্মানিত হয়েছে।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পলাশি যুদ্ধের পর দুর্গাপুজো উপলক্ষে শােভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ তৈরি করিয়েছিলেন আদি রাজবাড়ির সঙ্গে আদি-ঠাকুরদালান। আর সেই সঙ্গে তৈরি করিয়েছিলেন একটা নাচঘর, যেখানে বসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ক্লাইভরা বাঈ-নাচ দেখে কৃতার্থ হয়েছিলেন। রেভারেন্ড ওয়ার্ডের বিবরণীতে একটা জিনিস লক্ষণীয়—শােভাবাজারের রাজকৃষ্ণদেব, যিনি বাবা নবকৃষ্ণের মত, একদিকে অভিজাতবর্গের বিনােদন—বাঈ নাচের পৃষ্ঠপােষক। আবার একই সঙ্গে নিম্নবর্গের জনপ্রিয় কবিগান অনুষ্ঠানেরও উদ্যোক্তা।
আসলে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে কলকাতা মহানগরীতে ইংরেজদের সহযােগিতায় নবকৃষ্ণের মতাে জমিদার বা রূপলাল মল্লিকের মতাে বেনিয়ানরা, যাঁরা প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে বাঙালি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাদের তখনও পর্যন্ত কোনাে স্পষ্ট সাংস্কৃতিক রুচি গড়ে ওঠেনি। মুঘল রাজদরবারের ধ্বংসাবশেষের প্রতিনিধিরূপে বাঈ নৃত্যের পাশাপাশি গ্রাম বাংলা থেকে শহরে আগত লােকসংস্কৃতির নতুন অভিব্যক্তি কবিগান, আখড়াই-এর নব্যরূপ ইত্যাদির সহাবস্থান সে যুগের কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতের এক কৌতুহলােদ্দীপক বৈশিষ্ট্য। এক যুগ পরিবর্তনকালীন অবস্থায় এক শ্রেণির সাংস্কৃতিক চিন্তায় ও চর্চায় যে অসমঞ্জস্য ভাবধারার অরাজকতা ঘটেছিল, তার সব চেয়ে প্রকৃষ্ট নিদর্শন—শােভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেবের রাজবাড়ির অনুষ্ঠানগুলি। মুঘল বাদশাহ শাহ আলম দ্বারা মহারাজ উপাধিতে বিভূষিত নবকৃষ্ণ একই সঙ্গে নতুন ইংরেজ শাসকদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, যখন ১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের পর পলাতক ইংরেজদের তিনি খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপােষকতায় যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তার জীবনীকার লিখছেন,
“খ্যাতনামা গীতিকার হয়ে ঠাকুর এবং নিতাই দাস (সে যুগের বিখ্যাত কবিওয়ালা হয় ঠাকুর ও নিতাই বৈরাগী) তারই আশ্রিত ছিলেন। কলকাতার সমাজে ‘নচ’ (বাঈজী নাচ) ঢােকালেন তিনি এবং তাকে জনপ্রিয় করে তুললেন। ইংরেজদের ধারণা সাধারণ্যের প্রমােদ ব্যবস্থায় এটা আমাদের প্রধান উপকরণ। এ হলাে বাঈ না।”৭২
নবকৃষ্ণের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ নাচঘরে বাঈনাচের বিবরণ আমরা ইতিহাসে পাই,
“ঝাড়বাতি জ্বলছে। টানাপাখা দুলছে। নাচঘরের পুবমাথায় তাকিয়ার ওপর মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন নবকৃষ্ণ দেব। তার পরণে জোড়। মাথায় খিড়কিদার পাগড়ি। পায়ে লপেটা-পাদুকা। তাঁর দু-পাশে বসে আছেন দামী পােশাক পরা এদেশীয় ইয়ার-বন্ধুরা। নবকৃষ্ণ তখন চব্বিশ বছরের তরুণ।
নাচঘরের পশ্চিম দিকে সােফার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছেন ক্লাইভ সাহেব। তাঁর দু-পাশে বসে আছেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পনির হােমরা চোমরারা। সবারই পরণে আঠারাে শতকের ইউরােপীয় পােশাক। সবারই হাতে পানপাত্র। পর্তুগিজ খানসামা পানীয় পরিবেশন করছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে বসে আছে বাজনাদাররা। মাঝখানে বাঈজী নাচছে। গান গাইছে।
কে এই বাঈজী? কী তার নাম ? কেউ বলেন বুলবুল, কেউ বলেন ময়না, আবার কেউ বলেন মুনিয়া। ক্লাইভ তার নাম দিয়েছেন জেম। সাহেব আর বাবুদের দেওয়া নামের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে তার আসল নামটি। মুনিয়ার বয়স কত হবে? খুব বেশি হলে আঠারাে। যৌবন উপছে পড়ছে তার শরীরে। অঢেল তার রূপ। যেন কোনাে বিখ্যাত শিল্পী মাটি দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করেছেন তার শরীরটা। তারপর মনের মতন করে তাতে বুলিয়ে দিয়েছেন রঙের তুলি। এরকম কাম-উদ্দীপক শরীর কলকাতার নারীদের মধ্যে নেই বললেই চলে। তার নাচ? যেন কল্পনার স্বর্গ থেকে বাস্তবের পৃথিবীতে নেমে এসেছে অপ্সরা রম্ভা। কলকাতার প্রথম মুজরােয় এরকম আশ্চর্য তয়ফার আবির্ভাবের কথা ভাবাই যায় না। আর তার গান? গলা? সুর? এরকম মিষ্টি গলা কলকাতার বাবুরা আগে কখনাে শােনেননি। খাঁটি বিলিতি সাহেব ক্লাইভও শােনেননি এরকম মনভােলানাে সুর।
মুনিয়া একটা গান শেষ করতে না করতেই বাবুদের কাছ থেকে আর একটা গানের ফরমাস আসছে। তার নাচ দেখে গান শুনে খুশি হয়ে বকশিশ হিসেবে বাড়িয়ে ধরছেন মুঠো ভর্তি মােহর। কেউ বা তার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন দামী মুক্তোর মালা। নাচতে নাচতেই দু-হাতে মালাটা লুফে নিয়ে গলায় পরে নিচ্ছে সে। কোনাে বাবু টাকা দিচ্ছেন খেলিয়ে। এক হাতে বাড়িয়ে ধরছেন টাকা। মুনিয়া নিতে আসছে। বাবুটি অমনি অন্য হাতে টাকাগুলাে সরিয়ে ফেলছেন পাকা খেলুড়ে। কিন্তু মুনিয়াও কমতি যাচ্ছে না।
কোনাে কোনাে সময় চালাকির খেলায় বাবুকে হারিয়ে দিয়ে টাকাগুলাে বাবু অন্য হাতে সরিয়ে ফেলার আগেই ছোঁ মেরে কেড়ে নিচ্ছে। ফলে একটু ছোঁয়াছুঁয়িও হচ্ছে।
নবকৃষ্ণ বাঈজীকে বলছেন, ‘নাচো, নাচো। আচ্ছারকম নাচ দেখাও। ক্লাইভ সাহেব এসেছেন। ওঁর বন্ধুরা এসেছেন। নাচ দেখিয়ে ওঁদের আনন্দ দাও।’ বলেই তিনি ফুড়ুক ফুড়ুক করে আলবলার নল টানতে লাগলেন।…
মুনিয়া নাচতে নাচতে সাহেবদের দিকে এগিয়ে এলাে। ক্লাইভ হাততালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করলেন। মুনিয়া সাহেবের আরাে কাছে এলাে। ক্লাইভের গা ঘেঁসে নাচতে লাগলাে।..মুনিয়া নাচতে নাচতে সাহেবদের কাছ থেকে বাবুদের দিকে এগিয়ে এলাে। নবকৃষ্ণ আর তার বন্ধুরা মুগ্ধ হয়ে তার নাচ দেখছেন, গান শুনছেন।”
মুনিয়ার জন্ম লক্ষ্ণৌ শহরে। ভারতের খানদানী বাঈজীদের জন্ম এই শহরেই। বাঈজী -মহল্লায় তাদের কোঠা। মহল্লার নাম চক অথবা চৌক। শহরের নামী বাঈজীদের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন অযােধ্যার নবাব। এরকম একজন বাঈজী হচ্ছে রােশনী। মুনিয়া তারই একমাত্র মেয়ে। মেয়েকে নিজের হাতে নিজের মতন করে তালিম দিয়ে তৈরি করেছে রােশনী। অনেক সময় মা আর মেয়ে দুজনেই একই আসরে নেচে থাকে। মায়ের বয়স ছত্রিশ, মেয়ের বয়েস তার অর্ধেক। নবকৃষ্ণ চেয়েছিলেন মা আর মেয়ে দুজনকেই তাঁর বাড়ির প্রথম নাচের আসরে নাচাতে। কিন্তু রােশনীর অন্য জায়গায় বায়না থাকায় আসতে পারেনি। কাজেই কেবল মুনিয়াকে পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে নবকৃষ্ণকে।
“মুনিয়ার নাচ দেখে ক্লাইভ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে একটা কাণ্ড করে বসলেন। মুনিয়া নাচতে নাচতে তার দিকে এগিয়ে আসতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ধরতে গেলেন দু-হাত বাড়িয়ে। মুনিয়া অমনি পেছিয়ে গেল, কিন্তু নাচ থামলাে না।
ক্লাইভের রােখ চেপে গেল। তিনি মুনিয়াকে ছুটে ধরতে গেলেন। নেশায় তার শরীর ছিল টলােমলাে। পায়েও বল ছিল না। কাজেই তিনি মুনিয়াকে ধরার আগেই মেঝের ওপর পড়ে গেলেন। তাঁকে তােলার জন্য ছুটে এলেন তার সঙ্গীরা। ছুটে এলেন বাবুরা। ক্লাইভ বলে কথা। পলাশীর যুদ্ধের হিরাে। তার পতন চোখে দেখাও তােষামােদকারী ইয়ার বন্ধুদের কাছে পাপ। মহাপাপ।”
সেকালের বাবুদের সবচেয়ে সেরা নারী ছিল নিকীবাঈ। সংসদ বাঙালী চরিতাভিধানে নিকী সম্বন্ধে বলা হয়েছে,
“১৯শ শতাব্দীর এক নামকরা বাঈজী। ঐ শতাব্দীর প্রথম থেকেই পশ্চিমের বাঈজীরা কলিকাতায় আসতে থাকেন এবং পােষকতা পেয়ে অনেকেই পেশাদার জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ক্রমে কলিকাতায় পশ্চিমা বাঈজীদের রীতিমত একটা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। তৎকালীন সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ১৮২৩ খ্রীঃ নর্তকী নিকী রাজা রামমােহন রায়ের মানিকতলার বাগানবাড়িতে নাচেন। ঐ সময়ে বেগমজান, হিঙ্গুল, নান্নিজান, সুপনজান প্রভৃতি আরও কয়েকজন নর্তকী-গায়িকার নাম পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হত। উক্ত ১৯শ শতাব্দীর প্রথমভাগে নিকী, মধ্যভাগের হীরাবুলবুল এবং শেষভাগে শ্রীজান বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিলেন।”
নিকীকে নিয়ে সেকালের কলকাতার বাবুরা নিজেদের মধ্যে নির্লজ্জভাবে দরকষাকষি করতেন। ফলে নিকীর বাজার দর বেড়ে যেতাে হু হু করে। অনেক সময় তা হয়ে পড়তাে আকাশছোঁয়া। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায়৭৩ ছাপা হয়েছিল শহর কলিকাতায় নিকী নামে এক প্রধান নর্তকী ছিল। কোনও ভাগ্যবান লােক তাহার গান শুনিয়া ও নৃত্য দেখিয়া সন্তুষ্ট হইয়া এক হাজার টাকা মাসে বেতন দিয়া তাহাকে চাকর রাখিয়াছেন। ১৮০৮ সালের ৬ অক্টোবর দুর্গাপুজোর সময় মহারাজা নবকৃষ্ণেরর পুত্র রাজকৃষ্ণ শােভাবাজার রাজবাড়ির নতুন মহলে বাঈ-নাচের আসর বসিয়েছিলেন। নিকীর নর্তকী হিসেবে সেখানেই আবির্ভাব ঘটে। এই আসরে উপস্থিত ছিলেন লর্ড মিন্টো।
বাঈজীর ব্যাপারে পুরনাে কলকাতার দু-জন বাবু খুব বিখ্যাত ছিলেন। একজন হচ্ছেন মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের পুত্র রাজকৃষ্ণ দেব, যার কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। অন্যজন হচ্ছেন চুড়ামণি দত্তের সন্তান কালীপ্রসাদ দত্ত। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির একজন। নিম্নপদস্থ সামরিক অফিসার ছিলেন ফ্রেডরিক উইন। তিনি রাজকৃষ্ণের বাড়িতে নাচের আসরে উপস্থিত ছিলেন। তার লেখা থেকে জানা যায়, রাজকৃষ্ণ সেবার তিনরাত ধরে চার-পাঁচ দল বাঈজীকে নাচানাের জন্যে বায়না করেছিলেন। এই বাঈজীদের মধ্যে নিকীও ছিল। তার বয়স তখন চোদ্দ বছর। উইনের ভাষায় ‘নিকীর মুখাকৃতি এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন রতিদেবী স্বয়ং গঠন করিয়াছেন। আমি স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম যে, তিনরাত্রি নাচিবার জন্য নিকীকে যে বারােশত টাকার নগদ এবং সেই দামের দু-জোড়া শাল পারিশ্রমিক দেওয়া হইল, তাহা তাহার গুণের সমতুল্য বটে।’ ১৮১৪ সালে কিষাণচন্দ্র রায়ের বাড়িতে, ১৮১৫ সালে রামচন্দ্র রায়ের বাড়িতে আর ১৮৩২ সালে আশুতােষ দেবের বাড়িতে নিকী নেচেছিল বলে খবরে প্রকাশ। ১৮১৯ সালেও নিকী রামচন্দ্র রায়ের বাড়িতে নেচেছিল বলেও জানা যায়। এরপর চারবছর তার কোনাে খবর পাওয়া যায়নি। ১৮২৩ সালে সে রামমােহন রায়ের মানিকতলার বাগানবাড়ির মুজরােয় হাজির ছিল।
‘ক্যালকাটা জার্নাল’-এ৭৪ খবর বেরিয়েছিল,
“নূরবক্স নামে আর এক মন মাতানাে সতেজ যুবতীকে জনসাধারণের সঙ্গে পরিচয় করানাের ফলে মরশুমটা হয়ে থাকবে উল্লেখযােগ্য। যেসব ভাগ্যবান ব্যক্তি এই যুবতীকে দর্শন করার সুযােগ পেয়েছেন, তাদের সাগ্রহ ভালােবাসায় তার গুণের কথা বর্ণনা পেয়েছে। যখন তার নাচ-গানের শৈলী অভ্যাসের ফলে উন্নত হবে, প্রকৃতিস্থ। হবে অভিজ্ঞতার দরুন, তখন সে প্রাচ্যের সাইরেনদের মাঝখানে নিকী আর আশরুনের পাশে করে নেবে যােগ্য আসন, নাচ-গানের দুনিয়ায় রাজত্ব করবে তারাই তিনজন।”
এ থেকে বােঝা যায় নিকী আর আশরুনের পরেই থাকার কথা ছিল নূরবক্সের স্থান। কলকাতার বাঈজীদের নামের তালিকায় প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকা উচিত ছিল তার নাম। কিন্তু কোথায় কী! ১৮১৯ সালে আবির্ভাব-লগ্নেই তিরােভাব ঘটলাে কলকাতার প্রতিভাময়ী বাঈজী নূরবক্সের। টলে উঠলাে না বাঈজী -সম্রাজ্ঞী নিকী বা আশরুনের সিংহাসন। একটা অসাধারণ প্রতিভার বিনাশ ঘটলাে।
১৮১৪ সালের ২০ অক্টোবর ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ খবর বেরােলাে আশরুন দুর্গাপুজোয় নীলমণি মল্লিকের বাড়িতে নেচেছে। ১৮১৫ সালে আশরুন আবার দুর্গাপুজো উপলক্ষে রামচন্দ্র রায়ের বাড়িতে নেচেছিল। আশরুনের শেষ খবর ছাপা হয়েছিল ১৮১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ‘ক্যালকাটা জার্নাল’-
‘The approach of the ‘Grand Hindoo festival’ of the Doorgah Poojah has once more called forth into action the feeling of emulative rivalry so conspicuously displayed at the season, by the wealthy natives in their splendid preparations for the ‘Nautches’.
The friends of Moharaja Ramchunder Roy and Baboos Nilmoney and Bustom Doss Mullick may indulge in anticipation of the highest gratification, from the arrangements which these gentlemen have respectively made to render their mansions the scene of jocund festivity, and varied amusement. At an expense of no ordinary magnitude, they have retained for the occassion, groups of the most celebrated female singers that have ever performed at this Presidency and those who have listened to the voluptuous melody and magic pathos of Nikkhi, or to this sweet and varied tones of Ashoorun, will require little inducement to partake once more of the festivities of the season; and give themselves up to smoothing influence of the concord of sweet sound’. The season will be rendered remarkable for introducing to the notice of the public another Eastern Lais, the youthful and fascinating Noor Bukhsh. The personal accomplishments of the young female, are dilated upon interms of enthusiastic admiration by those who have had an opportunity of seeing her; and we are glad to learn that her professional merits are rated highly enough by Commissioners to warrant an expectation that when her powers had been improved by practice, and matured by experience, she will attain a distinguished place among the triumvirate of Eastern Syrens, and assume her status by the side of Nikkhi and Ashoorun.
Of the elegant and significant decorations with which the mansions of the above wealthy natives are adorned, we regret our inability to convey even a faint idea. The most costly production of European art,…candelabrum mirrors…etc. have been collected together, at an immense expense; and what ever the…imagination of fanciful test of an Asiatic could suggest as likely to contribute to the splendour, of the scene, has been added with an unspairing hand.
In a word, the reader who has never witnessed the magnificient specatacle of a Doorgah Poojah in Calculta, we can only assure him, that he will find the splendid fiction of Arabian Nights completely realised; in the fairy palace of Raja Ramchunder Roy, on the evening of the 26th, 27th and 28th instant.”৭৫
সত্যিকথা বলতে কী, বাবুদের দরকষাকষির ফলে বহু বাঈজী তাঁদের রক্ষিতা হয়ে থাকতে বাধ্য হতাে। বাবুরা সারারাত বাঈজী নিয়ে পড়ে থাকতেন বাগানবাড়িতে। বসতবাড়ির চাইতে বাগানবাড়ি আর পত্নীর চাইতে উপপত্নী ছিল বাবুদের কাছে বেশি প্রিয়। অনেক সময় উপপত্নীর গর্ভে বাবুদের ঔরসজাত সন্তানও জন্ম নিতাে। তবে সেসব সন্তান সামাজিক বা আইনী স্বীকৃতি পেতাে না। এদিকে বাবুদের বিয়ে করা পত্নীরা পতি-সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে কখনাে সখনাে পরপুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতেন। ফলে পরপু(ষের ঔরসে তাদের গর্ভে সন্তান এসে যেতাে। মজার ব্যাপার, এসব সন্তানরা কিন্তু সামাজিক বা আইনী স্বীকৃতি পেয়ে যেতাে। ট্র্যাজেডির ব্যাপার, বৈধ হতাে অবৈধ, আর অবৈধ হতাে বৈধ। কেবল এখানেই ছিল উপপত্নীর চাইতে পত্নীর বেশি জোর। বাবুকে নিয়ে টানাহঁচড়ায় উপপত্নীর কাছে পরাজয়ের শােধ পত্নীরা এভাবেই নিতেন।
যেসব বাবু আর সাহেব সেকালে বউবাজারে বাঈজী পাড়ায় আসতেন, তঁারা রতনবাঈকে চিনতেন, রতনবাঈয়ের মেয়ে বুনুকেও চিনতেন। বুনুর মত সুন্দরী মেয়ে বউবাজারে আগে কখনাে জন্মায়নি। বুনুকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে বাবু-সাহেবদের মধ্যে রীতিমতন রেষারেষি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এক হাজার দু-হাজার করতে করতে পঁচিশ হাজার দর উঠলাে তার। এর আগে বউবাজারে কোনাে বাঈজীর মেয়ের এতাে দর উঠেনি। পঁচিশ হাজার দরটা সত্যিই অস্বাভাবিক। যখন টাকায় কুড়ি সের চাল পাওয়া যায়, তখন পঁচিশ হাজার দরটাকে আকাশছোঁয়া বলতেই হয়।
১৮১৯ সাল। বাবু রূপচাদ রায়ের বাড়িতে দুর্গাপুজো উপলক্ষে বাঈজী নাচের আসর বসবে। আসরে চমক সৃষ্টির জন্যে তিনি কাঠেীর থেকে বাঈজী আনার জন্যে একজন দালালকে আগাম দিলেন। সেই দালালের ভুলু মল্লিকের বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল। সে বুনুকে দেখেছিল। ভুলু মল্লিকের সঙ্গে পরামর্শ করে বুনুকে সেই দালাল কাশ্মীরী বাঈজী বলে রূপাদ রায়ের বাড়িতে চালিয়ে দিল। বুনুর আসল পরিচয় গােপন রাখা হয়। তবে বুনু কাউকে নিরাশ করেনি। রূপে, নাচে-গানে দর্শকদের সে মাতিয়ে দিল। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮১৯ নবমীর রাতটা বুনু স্মরিণীয় করে রাখলাে। রূপচাঁদ রায়ের বাড়িতে বুনুর নাচ প্রশংসা পেলাে খবরের কাগজেও। ৬ অক্টোবর, ১৮১৯ ‘ক্যালকাটা জার্নাল’-এ ফলাও করে বুনুর সম্বন্ধে লেখা হলাে। তার পরিচয়ে বলা হলাে, সে হচ্ছে কাশ্মীর সুন্দরী। বুনুকে নাচিয়ে রূপচাঁদ বেশ নাম কিনলেন। ‘ক্যালকাটা জার্নাল’-এ লেখা হয়,
“The annual festival of Doorga Poojah was celebrated this season by the Hindoos of respectability and opulence, with its usual pomp and ceremony.
The evening of the 26th, 27th and 28th Ultimo, were devoted to ‘Nautches’ at some of the most respectable houses. Upon this occasion every requisite that could contribute to the pleasure of the guests were studied; and we will give them the credit in saying, that their endeavours to please, kept pace with their intentions. The apartments appropriated to the exception of European visitors, were superbly decorated, and displayed, a brilliancy in illumination, seldom witnessed before; it combined European taste, with oriental magnificence. The hours announced for public entertainments to commence, was about 9’O clock, when some of the most rare, skilful, and select dancing women were brought forward, and while at the house of Raja Ramchunder, the famed Nikkee enchanted the company with her Syren voice. Crowds of spectators were assembled at Roopchand Roy’s to admire the graceful movements and the attractive charms of Bunnoo, a fair Cashmerian damsel, that seemed even to rival and outvie the former, Roopchund’s house was the centre of attraction, and continued to be crowded till 6 A.M. on the last eveing of ‘Nautches’. On the afternoon of the 29th, Doorgah was conveyed to the sacred river, with accumulations of joy, and this last ceremony concluded the festival and poojah.৭৬
এ সময়ে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’-এ৭৭ একটি চিঠি ছাপা হয়। চিঠিটার লেখক হচ্ছেন একজন আরমানি। তিনি তার নাম প্রকাশ করেননি। চিঠিটায় বুনুর জন্ম পরিচয় উদঘাটিত হয়—তাঁর জন্ম কলকাতায়, কাশ্মীরে নয়। বুনু কাশ্মীরী কি কলকাত্তাইয়া, সেটা বড়াে কথা নয়। বুনু অল্প বয়েসেই যে পাকা বাঈজীদের মতন নাচ-গান করতে পেরেছে, বাবুদের মন জয় করতে পেরেছে, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বেনারস ছিল বাঙালিবাবুদের কাছে দ্বিতীয় কলকাতা। তীর্থ করতে আসার নাম করে বাঙালিবাবুরা এখানে এসে বাঈজীদের নিয়ে মজে থাকতেন। এসব বাবুদের অনেকেরই তখন নিজস্ব বা ভাড়াবাড়ি ছিল বেনারসে। পরিবারের বিধিনিষেধ থেকে এসব বাড়ি মুক্ত থাকত। কাজেই এখানকার বাড়িতে বাঈজী নিয়ে রাত কাটাতে তাদের কোনাে অসুবিধা ছিল না। জগৎ মল্লিক ছিলেন কলকাতার এরকম এক বাবু। তিনি যখন বেনারসে আসতেন তখন তুলসী নামে এক বাঈজীকে নিয়ে মজে থাকতেন তার বাসায়। ১৮১৪ সালে জয়কৃষ্ণ রায়ের বাড়িতে দুর্গাপুজো উপলক্ষে বাঈ নাচের আসর বসেছিল। সেই আসরে কলকাতার অনেক গণ্যমান্য সাহেব-বাবু-বিবি উপস্থিত থাকতেন বাঈনাচ দেখার জন্য। জয়কৃষ্ণ এই আসরে এক বাঈজীকে উপস্থিত করলেন, যার কলকাতায় এই প্রথম আবির্ভাব। সেই বাঈজী হচ্ছে তুলসীর মেয়ে মিশ্রীবাঈ। মিশ্রীবাঈয়ের নাচের খবর ‘ক্যালকাটা গেজেট’ ছেপেছিল ১৮১৪ সালের ২০ অক্টোবর।
১৮১৫ সালের দুর্গোপুজোর সময় জোড়াসাঁকোর বৈদ্যনাথবাবুর বাড়িতে নাচতে এসেছিল বাঈজী জিনাতবাঈ। ১৮২৩ সালের ১৫ মার্চ হিঙ্গুলবাঈ ও বেগমজান নামে দু’জন বাঈজী মতিলাল মল্লিকের বাগানবাড়িতে নেচেছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। তাছাড়া কলুটোলার নগেন সরকার আর তার ছেলে খগেন সরকার হচ্ছেন প্রবাদের ‘নগেন’ আর ‘খগেন’। নগের সরকার ছিলেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মুৎসুদ্দি। ১৮ শতকের শেষ দশকে তিনি তিন কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন। উনিশ শতকের গােড়ায় বাঈজী নিয়ে বাবা-ছেলের মধ্যে যে লজ্জাকর লড়াই হয়েছিল, তাতেই তারা কলকাতায় কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। একজোড়া বাঈজী নিয়ে নগেন আর খগেনের মধ্যে লড়াই বেঁধেছিল। সেই বাঈজী দুজনের নাম হচ্ছে সুপনজান ও নান্নিজান। এছাড়া আমরা আর এক বাঈজীর সন্ধান পাচ্ছি, তার নাম হাসিবাঈ, সে বউবাজারে ১৮১৮ সালের অক্টোবর মাসে মুজরাে অনুষ্ঠানে নেচেছিল। ১৮৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাসির জীবনাবসান ঘটে।
গওহরজান আর এক নামকরা বাঈজী। তার জন্ম ১৮৭৩ সালে। গওহরের আসল নাম এঞ্জেলিনা, বাবার নাম রবার্ট উইলিয়াম, ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কাশীতে ছিল তাঁর বাসস্থান। মায়ের নাম ভিক্টোরিয়া হেমিংস। ভিক্টোরিয়া ছিলেন অসাধারণ রূপসী। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। নতুন তার নাম হয় মালকাজান। এসময় সে মেয়ের নামও পাল্টে দিল—এঞ্জেলিনা হল গওহরজান, সংক্ষেপে গহর। গবেষক সােমনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,
“মুজরােয় নেশার ঘাের লাগিয়ে দেবার মন্ত্র মালকাজানের হাতের মুঠোয় ছিল। এবং সেই বিদ্যা গােপন রাখেননি আদরের মেয়ে গহরজানের কাছে। বিদ্যেধরীদের ছলাকলায় সবটুকু বিদ্যে উজাড় করে শিখিয়ে ছিলেন মেয়েকে। এর জোরেই গহর বয়সকালে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। হিন্দুস্থানের সেরা বাঈজীরা ছিল তার প্রতিযােগী। মায়ের রঙরূপটুকুর সঙ্গে পেয়েছিলেন নিস্পাপ মুখশ্রী। অদ্ভুত লাবণ্যময়ী ছিলেন গহরজান। নাচগান শিখতে কোনদিন পরিশ্রমের পরােয়া করেননি। জীবনে যখন যেখানে ভাল গুরুর সন্ধান পেয়েছিলেন, উঠেপড়ে লেগে অল্পদিনেই শিক্ষা শেষ করেছিলেন। পরে যখন জীবিত অবস্থাতেই প্রায় কিংবদন্তীর মত অবস্থা তার, সে সময়ও শেখার বিরাম ছিল না।”
গওহরজানকে বলা হত ‘ইণ্ডিয়ান নাইটিঙ্গেল’। তার দক্ষিণা ছিল ১৫০০ টাকা। জানা যায়, ১৯০২ সালে পাটনায় একটা বিয়েবাড়ির আসরে গওহরজান একখানা স্বরচিত গজল গেয়ে সবাইকে মােহিত করে দিয়েছিল। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, পাথুরিয়াঘাটার জমিদার ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘােষ গওহরকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। ১৯২০ সালে ভূপেনবাবুর বাড়িতে মালকাজানের সঙ্গে গওহরও নেচেছিল। পরে গওহর বােম্বাই চলে যায়। তারপর সেখান থেকে মহীশূরের মহারাজা কৃষ্ণরাজ ওয়ারিয়রের দরবারে গিয়ে হাজির হয়। মহারাজা তাকে মাসে দু’হাজার টাকা মাইনের গায়িকার চাকরিতে নিয়ােগ করেন। কিন্তু মহীশূরে যাওয়ার দু’বছর পরে ১৯২৯ সালে গওহর মারা যায়। গওহরের সংক্ষিপ্ত জীবনী ছাপা হয় ১৯৩০ সালের ১৮ জানুয়ারি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায়। এতে লেখা হয়েছিল,
“A loss has been sustained by the death in Mysore of Madame Gauhar Jan, where she was Court singer and dansense to H. H. the Maharaja of Mysore.”
এই কাগজে আরও লেখা হয়,
“Her fame as a songstress earned her the title of ‘Indian Nightingle’ and when gramophone records were first made of Indian songs, she was the first to be approched.”
দুর্গাপুজো ছাড়াও দোল আর রাসের সময়ও বাঈজী নাচ হত। তবে সে খুব কম। বাগবাজারে গােকুল মিত্রের মদনমােহনের রাসােৎসব হত। মদনমােহনের ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণে ছিল এক বড় দিঘি। সেখানে বেশ কয়েকদিন ধরে নৌকার উপর মেয়ে কবির আসর বসত। মেয়ে কবির আসর অবশ্য শহরে বেশিদিন চলেনি। দুর্গাপুজো ছাড়াও মাঝেমধ্যে বাঈজী নাচের আসর বসত বাবুদের বাড়িতে বা বাগানবাড়িতে। তবে সে খুব কম। রাজা নবকৃষ্ণ মিস রংহ্যাম নামে এক মেম সাহেবের জন্মদিন উপলক্ষে বাঈজী নাচের আসর বসিয়েছিলেন। এই বাঈনাচের খবর বেরিয়েছিল হিকির বেঙ্গল গেজেটে।
শেষে বলি, উনিশ শতকের বিকাশমান শহর কলকাতায় নানা ধরণের লােক এসে ভিড় জমিয়েছিল। সুযােগ সন্ধানী যারা, তারা দেওয়ানী বা মুৎসুদ্দিগিরি কর্ম করে বেশ দু’পয়সাও করে নিল। নিয়ে অভিজাত পংক্তি ভূক্ত হবার জন্য গ্রামে-গঞ্জে জমিদারি কিনল এবং শহরে এসে সেই জমিদারির লাভের বখরা নিয়ে তারা একদিন হঠাৎ কাড়িকাড়ি টাকার মালিক হয়ে উঠল। সমাজে তারা ‘বাবু’ নামে স্বীকৃতিও পেল। এই শ্রেণিভুক্ত সবাই কিন্তু টাকার পেছনে ছুটেননি, অনেকে অবসর সময়ে সমকালীন সমাজধর্ম ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও করছিলেন, এবং তাদের এই চিন্তা-ভাবনার মধ্য দিয়েই উনিশ শতকের সূচনায় কলকাতায় এক নব জাগরণের সূত্রপাত হয়। অদৃষ্টবাদে বিবাসী বাঙালির জীবনে এই নবজাগরণ যে কিছু পরিমাণে যুক্তিবাদ নিয়ে এল, তাতে এ যুগের মানুষদের একটা অংশ (‘নববাবু’রা) হয়ে উঠল অনেকটা ইহমুখী। একান্ত অদৃষ্ট নির্ভরতা ছিল যার স্বভাবধর্ম, এই সময় থেকে সে নিজের অদৃষ্ট নিজেই তৈরি করতে চাইল, সহায়ক হল সমকালের পরিবেশ। নবকৃষ্ণ, গঙ্গাগােবিন্দ, গােবিন্দরাম, গােপীমােহন, রামদুলালরা হঠাৎ যেন ধনকুবেরের সেই ধন হাতে পেলেন। এই ইহমুখিনতাই হঠাৎ-বড়লােকদের প্রাণিত করেছিল প্রমােদে গা ভাসিয়ে দিতে। ভােগেই জীবনের সার্থকতা—এই মন্ত্রে বিধাসী হওয়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে (যেমন দুর্গোৎসব), বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি উপলক্ষে তাদের এই ভােগবাদী জীবনের চিত্রটা ফুটে উঠত। কলকাতার এই ‘নববাবু’দের ভােগবাদী তথা উহ্ঙ্খল জীবনের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছিল সেকালের এই ‘বাঈ-কালচার’—যে কালচার’ উনিশ শতকের কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশকে যথেচ্ছভাবে কলুষিত করে তুলেছিল।
বাঈজী কালচার এবং সেকালের কলকাতার ‘বাবু’ সম্প্রদায় [পর্ব ১]
তথ্যসূত্র :
- ৪৩. অতুল সুর, কলকাতার চালচিত্র, কলকাতা, পৃ. ১৯৩।
- ৪৪. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ১ম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ. ১২১।
- ৪৫. ক্যালকাটা ক্রনিকল, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৭৯২।
- ৪৬. প্রমথনাথ মল্লিক, কলকাতার কথা, মধ্যকাণ্ড, কলকাতা, পৃ. ১৪৩-৪৪।
- ৪৭. R. Heber, Narative of a Journey through the Upper Provinces of India from Calcutta to Bombay, 1824-25; with an account of a journey to Mabras and Southern India, London 1828, P. 103.
- ৪৮. Fanny Parkes, Wanderings of a Pilgrim, in search of the picturesque, during twenty four years in the East; with revelations of life in the zenana, London 1850; বিনয় ঘােষ, সুতানুটি সমাচার, কলকাতা, পৃ. ৩৪২।
- ৪৯. Calcutta Gazette, 20th October 1814.
- ৫০. এশিয়াটিক জার্নাল, আগস্ট ১৮১৬, পৃ. ২০৫-২০৬।
- ৫১. অতুল সুর, কলকাতার চালচিত্র, কলকাতা, পৃ. ৪৪।
- ৫২. দেখুন সুশীলকুমার গুপ্ত, ঊনবিংশ শতাব্দিতে বাংলার নবজাগরণ ১৮০১-১৮৬০, কলকাতা, ১৯৫৯, পৃ. ৫৪।
- ৫৩. সা-িমেন্টারি নােটস্, পৃ. ২৯৭-৩০১ বিনয় ঘােষ, রামমােহন রায়ের জীবনচরিত দেখুন- বিনয় ঘােষ, প্রবন্ধ সংগ্রহ, প্রকাশ ভবন, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ২৫১।
- ৫৪. Fanny Parkes, Wanderings of a Pilgrim, in search of the picturesque, during twenty four years in the East; with revelations of life in the zenana, London 1850; বিনয় ঘােষ, সুতানটি সমাচার, কলকাতা, পৃ. ৩৩৫-৩৭।
- ৫৫. সমাচার দর্পন, ২০ ডিসেম্বর ১৮২৩।
- ৫৬. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ১ম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ. ১২৩।
- ৫৭. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মজীবনী, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত, বির্বভারতী, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৬২, পৃ ৩৯।
- ৫৮. কিশােরীচাঁদ মিত্র, দ্বারকানাথ ঠাকুর দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ কর্তৃক ‘Memoir of Dwarkanath Tagore’ গ্রন্থের অনুবাদ, কলকাতা, পৃ. ৮১-৮৪।
- ৫৯. কিশােরীচাদ মিত্র, দ্বারকানাথ ঠাকুর দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ কর্তৃক “Memoir of Dwarkanath Tagore’ গ্রন্থের অনুবাদ, কলকাতা, পৃ. ২৮৭।
- ৬০. সম্বাদ ভাস্কর, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৫৬।
- ৬১. বিনয় ঘােষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ৩য় খণ্ড, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ৪৯৯।
- ৬২. বিনয় ঘােষ, মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ২০।
- ৬৩. Calcutta Review. Vol-IV, No. VIII, P. 364.
- ৬৪. Rev. K. S. Macdonald : Raja Rammohun Roy, The Bengali Religious Reformer. P. 5. ৬৫. অরবিন্দ পােদ্দার, রামমােহন উত্তরপক্ষ, প্রত্যয়, দ্বিতীয় প্রকাশ, কলকাতা, ২০০৩, পৃ. ২৩।
- ৬৬. আবুল কাশেম চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যে সামাজিক নকশা পটভূমি ও প্রতিষ্ঠা ১৮২০-১৮৪৮, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮২, পৃ. ৭৯।
- ৬৭. কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, রাজা রামমােহন রায় বঙ্গদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি, বর্ণপরিচয়, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ৬৭।
- ৬৮. বঙ্গদর্শন, ‘যাত্রা’, কার্তিক ১২৮০।
- ৬৯. মধ্যস্থ, অগ্রহায়ণ ১২৮০।
- ৭০. হিন্দু পেট্রিয়ট, ৬ নভেম্বর ১৮৭১।
- ৭১. হিন্দু পেট্রিয়ট, ৬ নভেম্বর ১৮৭১।
- ৭২. এন এন ঘােষ, ‘মেমােয়ার্স অফ মহারাজা নবকিষেণ’ ইন রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব, কলকাতা, পৃ. ১৯২।
- ৭৩. সমাচার দর্পন, ১৬ অক্টোবর ১৮১৯।
- ৭৪. ক্যালকাটা জার্নাল, ২২ সেপ্টেম্বর ১৮১৯।
- ৭৫. ক্যালকাটা জার্নাল, ২২ সেপ্টেম্বর ১৮১৯।
- ৭৬. Calcutta Journal, 6th. October 1819.
- ৭৭. ক্যালকাটা জার্নাল, ১৭ অক্টোবর ১৮১৯।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।