হোসেন শাহী মসজিদ, নতুনহাট, মঙ্গলকোট, পূর্ব বর্ধমান। মসজিদটি ভগ্নপ্রায় নয়, সম্পূর্ণ ভাঙা। উঁচু একটি ঢিবির উপর অবস্থিত। সামনে রয়েছে একটি পুকুর। কুনুর নদীর তীরে। ২০০৮-এর জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন আমি যখন গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ঢিবির উপর বনসৃজনের ছোট ছোট চারার কর্ষণ। মসজিদের ১০ বিঘা জমি। তার উপর ৯১ ফিট দীর্ঘ, ৪১ ফিট প্রস্থ মসজিদটি। ১৫১০-এ প্রজাবৎসল বঙ্গীয় স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ আশরফি মসজিদটি নির্মাণ করান। সেইসময় মঙ্গলকোটে ছিল বাদশাহী সড়কের পাশে সরকারি দপ্তরে পরিপূর্ণ।
মসজিদটির সামনের মেহরাব অংশ ও দেওয়াল এবং পিছনের দেওয়ালটি অবশিষ্ট রয়েছে। ছাদ নেই। মেহরাবের উপরে ও অন্যত্র দেওয়ালে টেরাকোটার সূক্ষ্ম লতাপাতার কাজ এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। কোন এককালে যে মেঝে ছিল সেখানে পড়ে আছে কষ্টিপাথরের একটি স্তম্ভ। অবশ্যই মসজিদের ছাদটিকে ধরে রাখত। ছাদ নেই, তাই সেও ভূলুণ্ঠিত।
প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী কেতুগ্রামের সুলতানি স্থাপত্য
হাঁক (ক্রোশ) অন্তর মসজিদ আর ডাক অন্তর দিঘি এই নীতিমালার সফল প্রয়োগ দেখতে গেলে পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদের সড়কপথে সংযোগস্থল ফুটিসাঁকো যেতে হবে কিংবা আহমদপুর-কাটোয়া রেল সংযোগের কুর্মডাঙ্গা স্টেশনে নেমে তিন কিমি উত্তরমুখি গেলে দেখতে পাওযা যাবে একদা টেরাকোটার সূক্ষ কাজে অলঙ্কৃত বর্তমানে বিধ্বস্ত এক মসজিদের কাঠামো। কুর্মডাঙ্গা বা ফুটিসাঁকোকে বলা যেতে পারে তিন জেলার সংযোগস্থল। তবে কাটোয়া থেকে গেলে ফুটিসাঁকোর বাদশাহি সড়ক পার হলেই পশ্চিমে বীরভূম জেলা, বলাই বাহুল্য এখানে সড়কের পূর্বে বর্ধমান জেলা আরও উত্তরে পাঁচ-ছয় কিমি গেলে মুর্শিদাবাদ জেলা। কাটোয়া-আহমদপুর ছোট লাইনের ট্রেন এখন ব্রডগেজ। কাটোয়া থেকে শুরু করে পূর্ব বর্ধমানের শেষ স্টেশন কুর্মডাঙ্গা। এরপরই বীরভূমের দাশকলগ্রাম।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বাংলার স্বাধীন, ধর্মসহিষ্ণু ও প্রজাবৎসল সুলতানদের অন্যতম ১৪৯৪ থেকে ১৫১৯ মোট ২৫ বছর তিনি মালদার গৌড় থেকে বাংলা শাসন করেন। একদা তিনি মুর্শিদাবাদের চাঁদপাড়ায় অবস্থানকালে পুরো এলাকা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হন। গঙ্গা, ময়ুরাক্ষি, অজয় বিধৌত এলাকাটি যথেষ্ট উর্বর হলেও তিনি বুঝতে পারেন এলাকার চাহিদার বিভিন্ন দিকগুলি। পরে যখন বাংলাকে হাবসি সুলতানদের অরাজকতা থেকে বাঁচানোর জন্যে তিনি সিংহাসনে আরোহন করেন তখন ওড়িসা রাজের হাত থেকে হুগলি ও মেদিনিপুর উদ্ধার করে সমস্ত এলাকাটির সংযোগের জন্যে একটি সড়কপথের পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনার ফসল হল গৌড় থেকে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান হয়ে হুগলির মান্দারণ পর্যন্ত বিস্তৃত বাদসাহি সড়ক। ভবিষ্যতের জন্যে রাস্তা চওড়ার ব্যবস্থা রেখে নির্দিষ্ট দূরত্বে মসজিদ, সরাইখানা ও দিঘি কাটান। তারই একটি হল কুলুটিযা-বেড়ুগ্রামের এই মসজিদটি। বর্তমান ঠিকানা কুলুট (কুলুটিয়া), পোস্ট সাদিপুর, থানা কেতুগ্রাম, জেলা পূর্ব বর্ধমান। সেইসময় মসজিদ, সরাইখানা, দিঘি দেখভালের জন্যে কয়েকশো থেকে হাজার বিঘে নিষ্কর জমি প্রদান করা হত। এখানেও তাই হয়েছিল। এই সম্পত্তিকে এখন ওয়াকফ সম্পত্তিরূপে গণ্য করা হয়। রাজ্যসরকারের নথিতে এই আওকাফকৃত সম্পত্তির পরিচয় হল ই সি নম্বর ৩১৩০, যার আওতায় বর্তমানে রয়েছে ঈদগাহ, মাদ্রাসা ও মসজিদ এবং জমির পরিমাণ ১৪ একর ২ শতক অর্থাৎ প্রায় ৩৬ বিঘে।
মসজিদটির এখন ভগ্নদশা হলেও পাশের দিঘিটি এখনও বিদ্যমান এবং এক কালে দিঘি কাটানোর মাটি দিয়ে তৈরী উঁচু পাড়গুলির কিয়দংশ এখনও রয়েছে। রাস্তার পাশে মসজিদটির নিকটেই তৈরী হয়েছে একটি মাদ্রাসা এবং মসজিদের স্মৃতি হিসাবে একটি নতুন মসজিদ। তবে দিঘির এই অংশের পাড়টি কেটে সমতল করে মাদ্রাসা ও মসজিদটি তৈরী হয়েছে। এর ব্যাপ্তি দেখে বোঝা যায় দিঘির পাড়ের উচ্চতা কতটা ছিল?এইরকম আরও একটি দিঘি আছে আরও উত্তরে ২ ক্রোশ দূরে মজলিসপুরে এবং দক্ষিণে বাদশাহি সড়কের পাশে রায়খায়। আরও একটি ভগ্ন মধ্যযুগীয় মসজিদ দেখেছি অজয় পার হয়ে মঙ্গলকোটের নতুনহাটে।
নতুনহাটের মসজিদটির মিম্বর অংশের দেওয়ালটি রয়েছে পাশে পড়ে আছে কষ্টিপাথরের থাম। আমি ১৮ বছর আগে যখন দেখি তখন এই ভাঙা মসজিদ ঘিরে বনসৃজনের একটা চেষ্টা দেখেছিলাম। কুলুটিয়ার মসজিদটির ভিত তৈরী হয়েছে ইঁটের তবে কালো পাথরের একটি টাই বিমের মত আকৃতি প্লিন্থ লেভেলে দেখা যায়। সম্ভবত উত্তর কিংবা পূর্ব অংশে ছিল প্রবেশ দ্বার। ঝোপ জঙ্গলে পেরিয়ে উত্তর প্রান্ত দিয়ে দেখলে আরও একটা খাড়া কালো পাথরের আকৃতি দেখা যায় এবং দেখা যায় খিলানের কাজ। এই অংশ থেকে দেখলে মসজিদটির একদা বিশাল আকৃতিটিকে কল্পনা করা যায়। মসজিদটির এখনও অক্ষত দক্ষিণ ও পশ্চিম দেওয়ালের সমস্ত বহির্গাত্রে সূক্ষ্ম টেরাকোটার লতাপাতার কাজ যা এখনও জ্বলজ্বল করছে। মসজিদটি হয়তো রক্ষা করা যাবে না কিন্তু এই টেরাকোটার কাজের জন্যে দেওয়ালগুলি সংরক্ষণ করা যায। একটি বিশাল বট গাছ মসজিদটিকে ভেঙেছে। তবে বড়গাছের শিকড় ও ঝুরিগুলি গম্বুজের মত একটি আকৃতিকে ধরে রেখেছে। মসজিদের উত্তর অংশ দেখলে মনে পড়ে যায় খেরুর নামক মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি থানার মসজিদটি। একইরকম খিলানের কাজ ও অল্পস্বল্প পাথরের প্লিন্থ, লিন্টেলের কাজ রয়েছে। খেরুর মসজিদটির গায়ে আরবিতে দুটি শিলালিপি দেখা যায়। একটিতে রয়েছে নির্মাতা রাফাত খানের নাম (নির্মাণকাল ১৪৯৪-৯৫)। অপরটিতে হুসেন শাহর নাম। মঙ্গলকোটের মসজিদ ও এই মসজিদ দুটির নির্মাণ উপকরণ ও টেরাকোটার কাজ দেখে মনে হয় নির্মাণকাল হল হুসেন শাহর সময়।
আগেই বলেছি মসজিদ, সরাইখানা, দিঘি দেখভালের জন্যে নিষ্কর জমি প্রদান করা হত, যা এখন ওয়াকফ সম্পত্তিরূপে গণ্য করা হয়। সড়ক, দিঘি, মসজিদ, সরাইখানা ও তার দেখভালের জন্যে নিষ্কর জমি এই সমগ্র আইডিযাটা নেন শের শাহ সুরি। তিনি যেহেতু দিল্লিতে বসে দেশ শাসন করতেন তাই তৈরী করেছিলেন শের শাহ সুরি মার্গ বা জিটি রোড, ২ নং জাতীয় সড়ক। বলা যেতে পারে এ ক্ষেত্রেও বাংলা পথ দেখিয়েছিল।
তবাকাত ই- নাসিরীতে মাওলানা মিনহাজউদ্দিন আবু ওমর ই ওসমান বলেছেন, লখনৌর। মেজর এইচ জি রাভার্তী ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে টীকাকারে লিখেছেন, আজকের নগরই হল লখনৌর বা লখর।
এর আগে বর্ধমান জেলার বুক চিরে চলে যাওয়া বাদশাহী সড়কের পার্শ্ববর্তী নতুন হাটের হোসেন শাহী মসজিদের বর্ণনা দিয়েছিলাম। এরপর বাদশাহী সড়ক ধরে ক্রমে উত্তরমুখী ভ্রমণ করে বর্ধমান-বীরভূমের সংযোগস্থল ফুটিসাকোর অদূরে বর্ধমান জেলার কুলুট ভাঙ্গা মসজিদের প্রাচীনত্ব ও স্থাপত্য কীর্তির বর্ণনা দিয়েছিলাম।
এবার শীতে বাদশাহী সড়ক ধরে আরো উত্তরমুখী গমণ করে পৌঁছেছিলাম মুর্শিদাবাদ মুর্শিদাবাদ এর নগরে। সি এ এ-র আন্দোলন ও শারীরিক অসুস্থতা সামলে দুপুর ১২ টায় এসপ্ল্যানেড থেকে নগর গামী স্পেশাল বাসে উঠেছিলাম। পথে ডাকবাংলায় নির্মীয়মান ব্রীজ বাম হস্তে রেখে কান্দি হয়ে ঘুরে সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটায় পৌছালাম নগর। নগরে আত্মীয়ার বাড়িতে স্থান হল।
নগর বা লখনৌর কিংবা লাখর নামটি প্রথম উল্লেখ করেন মিনহাজ উদ্দিন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখক নীহাররঞ্জন রায় মহাশয় তার বাঙ্গালার ইতিহাস নামক বইয়ে গঙ্গার পশ্চিম তটের নবদ্বীপ বা মিনহাজ কথিত নুদীয়ার উল্লেখ করেছেন, নিয়েছেন কর্ণসুবর্ণর নাম। রায় মহাশয় গঙ্গা-মহানন্দা অববাহিকার লক্ষণাবতী বা মিনহাজ কথিত লখনৌতি কিংবা গৌড়ের নাম করেছেন। তিনি দেবকোট বা দেওকোট কিংবা কোটিবর্ষ- বানগড়ের উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি নগরের কোন উল্লেখ করেননি।
মিনহাজ লিখেছেন, দেওকট পৌঁছানোর পর ইখতিয়ারউদ্দিন তিব্বত ও কামরূপ (কামরুদ) অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সেইসময়ই খিলজী আমিরদের মধ্য থেকে মহম্মদ ও আহমদ শেরওয়ান ভাতৃদ্বয়কে তাঁর সেনাবাহিনীর একাংশ দিয়ে নগর বা লখনৌর এবং জাজপুর দখল করতে পাঠালেন। ইখতিয়ার উদ্দিন নিহত হলে নগর বিজয় মুলতুবি রেখে হন্তারক মালিক মর্দানের পিছু ধাওয়া করলেন। পরে নিশ্চয়ই নগর দখল হয়েছিল।
মিনহাজ বলেছেন, লখনৌতি সাম্রাজ্যের দুটি ডানা গঙ্গার দুই পাশে বিস্তৃত। পশ্চিম দিকটিকে বলা হয় রাই (রাঢ়), লখনৌর নগরীটি সেই দিকেই অবস্থিত। পূর্ব দিকটিকে বলা হয় বারিন্দ (বরেন্দ্র)। লখনৌতি ও লখনৌর একই সরলরেখায় অবস্থিত। দেওকোট থেকে লখনৌতির যতটা দূরত্ব লখনৌতি থেকে লখনৌর ঠিক ততটা দূরে। লখনৌর থেকে দেওকোট পুরো এলাকা জলা জমি, ডোবা ও জলজ উদ্ভিদের জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বর্ষাকালে অগম্য। ইউয়াজ খিলজি উঁচু বাঁধ দিয়ে নগর থেকে গৌড় হয়ে দেবকোট পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করলেন। প্রতিটি বিচ্ছিন্ন জনপদ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হলো।
এলাকার ব্রাহ্মণি, দ্বারকা, ভাগিরথি, মহানন্দা ইত্যাদি নদীগুলি এই জলা জঙ্গলের কারণ। পরবর্তী শাসক ইউয়াজ খিলজি জলা-জঙ্গল ও নদীসমূহের পাশে উঁচু বাঁধ দিয়ে লখনৌর থেকে লখনৌতি হয়ে দেওকোট পর্যন্ত চলাচলের যে রাস্তা তৈরি করেন সেই সমস্ত পথটি সাকুল্যে ১০ দিনের।
ভ্রমণের সময় আত্মীয়ের মোটর সাইকেলে ৪ কিমি দূরে শেরপু পৌঁছলাম। সেখান থেকে আরও দেড় কিমি দূরে সাঁকো ঘাট পৌছালাম। অদূরেই ব্রাহ্মণী ও দ্বারকা নদী পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মোটর সাইকেল বাদশাহী সড়কের উপর রেখে একটা নিচু জমিতে নামলাম। গন্তব্য অদূরেই একটি ঝোঁপ মত এলাকা। বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। মাথা নিচু করে ঢুকেই দেখলাম তাবিজের বিজ্ঞাপন। তবে কোন মাজার বা কবরস্থান দেখলাম না। দেখলাম, দুপাশে সার সার খিলান দেওয়া সরু সরু ইটের মোটা প্রাচীরের দেওয়াল। দেখলেই বোঝা যায় প্রাচীর দুটির উপর দিকটি কোন এক সময় যুক্ত ছিল। যা সেতুর ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছু নয়। দুটি প্রাচীরের সার সার খিলান গুলির মাত্র উপরের অংশ দেখা যায়। বুঝতে পারা যায় মাটির নিচে বেশিরভাগ অংশই প্রোথিত।
কালের নিয়মে যা প্রায ধ্বংসপ্রাপ্ত ইতিহাসিক মূল্য নিরূপণ করা যায়নি। তবে অনুমান করা যায় খিলজী নির্মিত রাস্তাটি যে জলাভূমির উপর দিয়ে গিয়েছিল তারই একটি নমুনা ভাঙা সেতু হিসাবে রয়ে গেছে।
বর্তমান ব্রাহ্মনি নদীর উপরে যে সেতু তা পুরনো সেতুর ৫০০ মিটার দূরে অবস্থিত। নতুন সেতুর উপর উঠে দূরে দেখা গেল দুই নদীর মিলনস্থল।
শেরপুর এলাকাটি নগর থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শেরপুর ও নাগর এবং সাঁকোঘাট খড়গ্রাম থানার অন্তর্গত। শেরপুরে একটি পুরনো মসজিদ আছে। স্থানীয় মানুষ বলেন, শেরপুর গ্রামটির নাম পাঠান শাসক শের শাহের নাম থেকে এসেছে এবং শেরপুর মসজিদ ও নগরের মসজিদ দুটি শের শাহের আমলে তৈরি। দুটি মসজিদের সামনে বিশাল দীঘি রয়েছে। দুটি মসজিদে এখনো ব্যবহৃত হওয়ায় তাদের প্রাচীনত্ব বোঝা কিছুটা মুশকিল। তবে গম্বুজ দেখে বলা যেতে পারে এদের নির্মাণ হয়েছিল মধ্যযুগে। তাই বলা যেতে পারে বাদশাহী সড়কের পাশের দিঘি ও মসজিদ একত্রে থাকা মানে এদের বয়স হোসেন শাহের আমলের সমসাময়িক বা তার আগে।
শের শাহ বিহার বিজয়ের পর তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড় বিজয় করেন। তাই বলা যেতে পারে বাদশাহী সড়কের আশপাশের কিছু নির্মাণ তার সময়ও হতে পারে।
শেরপুর আতাই মসজিদ
মসজিদটা ভাঙ্গা। ছাদ নেই, কিন্তু টেরাকোটার কাজগুলো এখনও অবিকৃত। ছাদ নেই, কিন্তু কেউ সিমেন্টের দুই ধাপ সিঁড়ি তৈরি করে মসজিদে প্রবেশের পথ সুগম করে রেখেছে।
এর আগে শেরপুর এবং তার থেকে দেড় কিলো মিটার দূরে ব্রাহ্মণী নদীর উপর ইউয়াজ খলজি নির্মিত এক মধ্যযুগের সেতুর ছবি ও বর্ণনা দিয়েছিলাম। সেখানে লিখেছিলাম শেরশাহর সময়ই এক মসজিদ নির্মিত হয়েছিল যা এখনও ব্যবহৃত হয়।
দু ক্রোশ দূরে নগরে অনুরূপ একটি মসজিদ রয়েছে। উভয় শের শাহী মসজিদই নির্মিত হয়েছে বাদশাহি সড়কের উপর। সমস্ত এলাকাটি এককালে বিশাল জনপদ হিসেবে গড়ে উঠেছিলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাবাকাত ই নাসিরির বর্ণনা অনুযায়ী জলা-জঙ্গলে পরিপূর্ণ দুর্গম এলাকাটির বুক চিরে সেতু ও আলপথ নির্মাণ করে নগর থেকে দিনাজপুরের দেবকোট পর্যন্ত ১০ দিনের পথ নির্মাণ করা হয়।
নগর বাদশাহী সড়ক থেকে নগর কলেজের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা বেরিয়ে গেছে সেই রাস্তা ধরে ২ কিলোমিটারের মত এগিয়ে গেলে আতাই নামে একটি গ্রাম আছে। এখন শুধুই গ্রাম, তবে মধ্যযুগে এটিও নগর-ইন্দ্রানি-শেরপুর নগরায়নের একটি অংশ ছিল।
মুর্শিদাবাদ এর ইতিহাস বলছে মসজিদটি নির্মাণ করেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৩)। এই জনপদটি কোন এক কালে বাংলার রাজনীতিতে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছিল। সম্রাট আকবর মানসিংহকে সুবেদার হিসাবে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন সমস্ত বাংলা জয় করার জন্য। তিনি রাজমহল, গৌড় পান্ডুয়া, ঘোড়াঘাট, বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, উড়িষ্যার একাংশ দখল করে ঢাকায় একটি মুঘল উপনিবেশ গড়ে তুললেও পূর্ববঙ্গের ভাটি এলাকায় মসনদ ই আলা ইসা খাঁ পুত্র মুসা খাঁ, কেদার রায়-কে বাগে আনতে পারেননি। এমনকি পাঠান কররানি ও বারোভূঁইয়াদের প্রভাব নগর ও বর্ধমান জুড়ে বিস্তৃত ছিল। আইন ই আকবরি (এশিয়াটিক সোসাইটি পৃ. ৩৬৩, ৪৯৬) অনুযায়ী শরিফাবাদ সরকার যার বিস্তৃতি বর্ধমান থেকে মুর্শিদাবাদ এর ফতে সিং সরকার পর্যন্ত। এরই অন্তর্গত ছিল শেরপুর আতাই। ১০০৯ হিজরিতে মহা সিং আফগানদের পরাজিত করেন।
১৬০১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ আতাইয়ে মানসিংহের পৌত্র মহাসিংহের নেতৃত্বে পাঠান ও ভূঁইয়া বাহিনীর যে লড়াই হয় সেই লড়াইয়ে মুঘল বাহিনী পাঠান ও ভূঁইয়াদের যশোর ও ভুষণা পর্যন্ত বিতাড়িত করে। এদের তাড়া করে মহা সিংহ ঢাকায় উপস্থিত হন। তবে ঢাকাকে কেন্দ্র করে সমস্ত বাংলাকে মুঘল অধীনে আনার কৃতিত্ব জাহাঙ্গীর নিযুক্ত সুবাদার শায়খ সেলিম চিশতীর পৌত্র ইসলাম খান চিশতির।
সোনারুন্দি রাজবাড়ি মুর্শিদাবাদ
আজমউদদৌল্লা আমিরুল উলা জগদিন্দু দানেশমন্দ (জ্ঞানী) নিত্যানন্দ দেব বাহাদুর। নাম শুনে অবাক হবেন না। এককালে মুসলিম বাদশাহী দরবারে উপস্থিত হিন্দু জ্ঞানীগুণী ও রাজন্য বর্গের এইরকমই উপাধি হত। প্রকৃত নাম ছিল নিত্যানন্দ দালাল জাতিতে ছিলেন তন্তুবাই। ফার্সি ভাষা শেখেন জ্ঞাতি কাশিমবাজারের রাজা মনিন্দ্র চন্দ্র রায়ের কাছে।
উত্তমরূপে ফার্সি ভাষা শিখে তিনি বৃন্দাবনে যান তীর্থ করতে। তীর্থ শেষে তিনি দিল্লীর মুঘল দরবারে উপস্থিত হন। তখন মুঘল দরবারে সীমিত ক্ষমতা নিয়েও দ্বিতীয় শাহ আলম বাদশাহী করছেন (১৭৬০-১৮০৬)। দরবারে উপস্থিত হয়ে নিত্যানন্দবাবু নিজ বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ও ফার্সি ভাষার উপর দখলের কারণে সম্রাটের নজরে পড়ে যান।
সম্রাটের মৃত্যুর পর ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারুন্দি গ্রামের এক প্রান্তে ৫৪ বিঘা জমির উপর বিশাল রাজপ্রাসাদ ও মন্দির নির্মাণ করেন, দিঘিও খনন করেন। তিনি রাজবাড়ীকে উঁচু প্রচীর দিয়ে ঘেরেন এবং চারটি তোরণ নির্মাণ করেন। এর মধ্যে দুটি এখনও টিকে আছে। এই তোরণের একটির মধ্য দিয়েই আমরা প্রবেশ করেছিলাম। রাজবাড়ির অভ্যন্তরে একটি মন্দির নির্মাণ করেন যেখানে বৃন্দাবনের অনুকরণে আছে রাধা কৃষ্ণ মূর্তি ও অষ্টসখীর মূর্তি। তিনি নাম দেন কিশোরী বনোয়ারিলালজি। মোট ২২ টি মন্দির সহ কুঞ্জ নির্মাণ করেন। মূর্তি গুলিকে সেই মন্দিরে রেখে স্নান করানো হতো।
তোরণ দিয়ে ঢুকলেই ডান দিকে পড়ে সুদৃশ্য গোলাপি পাথরের প্রাসাদ। সামনে একটু এগোলেই দেখা যাবে দিঘির ঘাট এবং খাবারের লোভে পোষা মাছের আনাগোনা।
তিনি গঙ্গাতীরে উদ্ধারনপুর পর্যন্ত একটি রাস্তাও নির্মাণ করেন যা এখনও বর্তমান। আমরা গিয়েছিলাম কেতুগ্রাম থেকে সালার যাওয়ার পথে চার চাকার বাহনে। পথটি হল, বন্দর নামক স্থানে উদ্ধারনপুর যাওয়ার রাস্তাটিকে ডান দিকে রেখে সোনারুন্দির দিকে। কাটোয়া আজিমগঞ্জ রেললাইনের সালার স্টেশন থেকে সোনারুন্দি মাত্র দশ কিলো মিটার।
নিত্যানন্দ বাবুর তিন পুত্র ছিল, জগদিন্দ্র বনোয়ারী লালবাহাদুর, জগদিন্দ্র বনোয়ারী গোবিন্দ দেব বাহাদুর, আজমউদ্দোল্লা বনোয়ারি কৃষ্ণবাহাদুর।
সম্প্রীতি খুঁজতে হয় না, সম্প্রীতি অন্তর থেকে ব্যবহারিক জীবন থেকেই আসে। সম্প্রীতির এই নকশী কাঁথায় কৃষ্ণ বাহাদুরও হয়ে যান আজমউদ্দৌল্লা, নিত্যানন্দ দানিশমন্দ। অতীত সম্প্রীতির তুলনায় বর্তমান ভারতীয় রাজনীতি হল, “কাঁচের ঘরে ষন্ড সদৃশ”।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।