আওরঙ্গজেবের রাজত্বে আকবরের তুলনায় বেশি রাজপুত রাজকর্মচারী ছিল। আওরঙ্গজেব ভাতৃঘাতী যুদ্ধে জয়ী হয়ে মুঘল অধিপতি হন। সব ভাইই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও আওরঙ্গজেব কুশলী যোদ্ধা ছিলেন বলে যুদ্ধ জিতে যান। মূল লড়াইটা ছিল শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার সঙ্গে তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবের। আওরঙ্গজেব দাদাকে বলতেন ধর্মচ্যুত, দারা ছোট ভাইকে বলতেন, কোটাহ পাজামা (কট্টর)। তাঁদের এই লড়াই ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তবে দারা ও আওরঙ্গজেবের সিংহাসন লাভের লড়াইয়ে তৎকালীন তিন রাজপুত রাজা; মেবারের রানা রাজ সিং, মারওয়ারের রাজা যশোবন্ত সিং ও আম্বেরের রাজা সওয়াই জয় সিং সম্পূর্ণভাবে আওরঙ্গজেবের পক্ষ নিয়েছিলেন।
আওরঙ্গজেব রানা রাজ সিং কে নিশাণ (নির্দেশ) পাঠান, তিনি সেই সকল রাজাদের বিরোধিতা করেন যারা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে। এর ফলে কলহ, লড়াই, সাধারণ মানুষের ক্ষতিসাধন হয়। এর ফলে “আল্লাহর উন্নতশীল সৃষ্টিকে ধ্বংস করে এবং আল্লাহর সৃষ্টির যে বুনন তা নষ্ট হয়ে যায়”। যে সকল রাজা এরূপ করে তাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তাদের পরীত্যাগ এবং নির্মূল করা উচিত’। উদয়পুরের মহাফেজ খানায় এই নিশাণটি এখনও মজুত রয়েছে।
আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত জীবন এবং তাঁর ধর্মভীরুতার সঙ্গে রাজ্যশাসনের সময় যে কোন ধর্মীয় সম্পর্ক ছিল না তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই নিশান গুলি। প্রকৃতপক্ষে রানা জগৎসিংএর সময় চিতোরে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জগৎসিং কিছু নির্মাণ করেন। শাহজাহান সে নির্মাণ গুলি ধ্বংসের জন্য সেনাপতি সা’আদুল্লাহ খানকে পাঠান। সেনাপতি ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলে জগৎ সিং দারার কাছে প্রতিকারের জন্য প্রতিনিধি পাঠান। তিনিও কিছু করতে পারেননি।
কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে চর্চা করা যেতে পারে যেমন স্যার যদুনাথ সরকারের মন্তব্য; আওরঙ্গজেব ভারতবর্ষকে ‘দার উল ইসলাম’ করতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সমস্ত ভারতবাসীকে ইসলামে দীক্ষিত করতে এবং ধর্মীয় বিরোধীদের শেষ করে দিতে। ইস্তিয়াক হুসেন কুরাইশির বক্তব্য অনুযায়ী, আকবরের ভুল সংশোধন করে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন কিংবা শ্রী রাম শর্মা বলতে চেয়েছেন, আওরঙ্গজেব দেখাতে চেয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের উপর ইসলামের বিজয়।
এসব বলার ফল হল, আরঙ্গজেবের একক হস্তে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, সামরিক ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ধামাচাপা পড়ে যায় যা অনেক সময় ঐতিহাসিক সত্যতার বিরুদ্ধে যায়।
দেখতে পাচ্ছি, আকবরের সময় যত জন রাজপুত বা হিন্দু মনসবদার ছিলেন, শাহজাহানের সময় সেই সংখ্যাটি বেড়ে হয় ২৪%, আওরঙ্গজেবের সময় ১৬৮৯ নাগাদ বেড়ে হয় ৩৩%। রঘুনাথ রায় কায়স্থকে ‘দিওয়ান ই কুল’ উপাধি ও পদ দেন। রঘুনাথ যুদ্ধক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় আওরঙ্গজেবকে সহায়তা দেন। ১৬৬৪-তে মৃত রঘুনাথ সম্পর্কে শোক গাথায় ‘রুককাত ই আলমগীরী’-তে আওরঙ্গজেব লিখেছেন, “তাঁর মত প্রশাসক আমি কখনও দেখিনি”।
বিভিন্ন নথিপত্রে আওরঙ্গজেব যে বহু মন্দির-মঠ, হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ব্রাহ্মণ ও পূজারীদের অনুদান দিয়েছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
১) আওরঙ্গজেব মথুরা, বারানসি, গয়া, গৌহাটির উমানন্দ মন্দির ইত্যাদি জায়গার মন্দিরের জমির নবীকরণ করেন। বেশ কিছু মন্দিরে প্রদীপ জ্বালানোর জন্য ঘি-এর ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে রয়েছে আগ্রার মহাবটেশ্বর মন্দির।
২) দেরাদুনের গুরুদুয়ারায় উপহারসামগ্রী পাঠান।
৩) রাজস্থানের দিদানা পরগনায় নাথপন্থী যোগীদের মদদ ই মাস জমি অনুদান হিসাবে দেন।
৪) পরগনা সেওয়ানায় গণেশ ফকির ও তাঁর বংশধরদের তুমি দান করেন এবং হুকুম নামা জারি করেন তাঁদের যেন কেউ বিরক্ত না করে আর তাঁরা যেন সালতানাতের জন্য প্রার্থনা করেন।
৫) মন্দিরের জন্যে জমি দান করেন, উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দির, ব্রজভূমির বলদেব গ্রামের দাওজি মন্দিরে, এলাহাবাদের সোমেশ্বর মন্দিরে। এছাড়াও বৃন্দাবন নথির ১৭০৪-এ দেখা যায়, ব্রজভুমিতে ব্রজানন্দ গোঁসাই নামক চৈতন্য গোঁসাই বৈষ্ণব দলের জন্য ‘খরজ সাদির ও ওয়ারিদ’ নামক পরোয়ানা বলে দূরবর্তী ও আশপাশের গ্রামের অতিথিদের থাকা ও খাওয়ার খরচের জন্যে জমি দান করেন।
স্যার যদুনাথ সরকার আওরঙ্গজেব কর্তৃক মন্দির ধ্বংসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। মালারনা, জয়পুর, যোধপুর আম্বের, উদয়পুর, মথুরা, কাশি ইত্যাদি স্থানের নাম তাঁর তালিকায় রয়েছে।
মিনা ভার্গব তাঁর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং মুঘল ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছেন,
আওরঙ্গজেবের মন্দিরের জন্য অর্থ দান, ভূমি দান ও পূজার সামগ্রী দান নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি যেমন মন্দিরও ভেঙেছেন তেমনি বহু মন্দির পাশ কাটিয়ে গেছেন বা রক্ষা করেছেন।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তিনি দুমুখো নীতি নিয়ে চলতেন। কিন্ত গভীর পর্যালোচনার পর জানা যায় মূর্তি ধ্বংসের ব্রত নিয়ে তিনি এসকল কাজ করেননি। এর পিছনের কারণগুলি হল-বিদ্রোহ দমণ, বিরোধীদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমন বা বাদশাহর প্রতি আনুগত্যহীনতা।
মথুরার কেশবজী মন্দির, কাশি বিশ্বনাথ মন্দির এবং রাজস্থানের বেশ কয়েকটি মন্দির ধ্বংসের পেছনে কারণগুলি বলতে গিয়ে মিনা ভার্গব যা লিখেছেন তা হল, কাশির জমিদারদের এক বিদ্রোহ দমনের সময় সম্রাট জানতে পারেন ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে আগ্রা দুর্গ থেকে শিবাজীর পলায়নের ক্ষেত্রে কাশির বেশ কিছু জমিদারের হাত ছিল তাই ষড়যন্ত্রের স্থানগুলিকে ভেঙে ফেলা হয়। আম্বেরপতি মান সিংহের প্রপৌত্র মির্জা রাজা জয় সিংহের প্রাথমিক সক্রিয় সাহায্যে শিবাজী আগ্রা দুর্গ থেকে পলায়ন করেন। সেই সময় জয়সিংহ কাশি বিশ্বনাথ মন্দিরটি পুণঃ নির্মাণ করছিলেন। বাদশাহর সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়ে জয়সিংহ ও তাঁর প্রিয় স্থান গুলির উপর। ১৬৬৯-এর সেপ্টেম্বরে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করা হয়।
প্রায় একই সময়ে মথুরার জাঠরা সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা মথুরার মসজিদের এক ইমামকে মেরে ফেলে। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে মথুরার কেশবজী মন্দির ধ্বংস হয়। যোধপুরের মহারাজা যশোবন্ত সিং এর মৃত্যুর পর রাথোড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় রানা রাজসিংহ রাথোড়-শিশোদিয়া বন্ধুত্ব স্থাপন করতে গিয়ে সম্রাটের পক্ষ ত্যাগ করেন। এই সময়ই বিদ্রোহের আঁচ পেয়ে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মালারনা, খান্ডেলা, আম্বের, উদয়পুর, চিতোর ইত্যাদি এলাকায় ধ্বংসকার্য শুরু হয়ে যায়।