ভারত উপমহাদেশে একটি দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক বিস্তৃত সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন মুঘলরা। মুঘল সাম্রাজ্য টিকেছিল ৩৩০ বছর (১৫২৬-১৮৫৭)।পূর্ববর্তী যুগের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারণাকে অস্বীকার না করে অনেক ক্ষেত্রেই তা গ্রহণ করে মুঘল সম্রাটগণ ভারতে এক উদারনৈতিক শাসন১ প্রবর্তন করতে পেরেছিলেন। শুধু প্রশাসনিক আর সামরিক দক্ষতা নয়, মুঘল সম্রাট ও অভিজাতগণের দক্ষ নীতি নির্ধারণের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল সমকালীন ভারতের সমাজ জীবনে। বহু ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির ধারক ভারতভূমির সামাজিক জীবনের ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছিলেন তারা। সুনির্দিষ্ট ও দক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থা প্রণয়নের ফলে একদিকে যেমন সাম্রাজ্যের অর্থনীতির ভিত্তি দৃঢ় হয়েছিল, অন্যদিকে কৃষক ও বণিকদের জীবনে এসেছিল সমৃদ্ধি এবং গড়ে উঠেছিল নতুন নতুন শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র। মুঘল সম্রাটদের শেষ সফল উত্তরাধিকারী ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র ঔরঙ্গজেব (১৬১৮-১৭০৭)। পিতার জীবনসায়াহ্নে সংঘটিত উত্তরাধিকার সংগ্রামে গভীর কূটনৈতিক জ্ঞান, বীরত্ব ও সমরকুশলতার মধ্য দিয়ে ঔরঙ্গজেব মুঘল সিংহাসন অধিকারের পথকে করেছিলেন নিষ্কণ্টক। পরে মধ্যযুগের উচ্চাভিলাষী অনেক শাহজাদার মতােই পরিস্থিতির অমােঘ পরিণতিতে পিতার জীবদ্দশায় ভারত-অধীশ্বর রূপে সিংহাসনে বসেছিলেন। অতঃপর তাকে অতিক্রম করতে হয় মুঘল যুগের একটি দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ ঘটনাবহুল সুদীর্ঘ কালপর্ব (১৬৫৮-১৭০৭)। নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা, কঠিন মনােবল এবং রাজসিক গুণাবলির সমন্বয় ঘটিয়ে ঔরঙ্গজেব নানা প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে তার জনকল্যাণকামী মানসিকতা বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। অথচ এই ঔরঙ্গজেবকেই আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সম্রাট হিসেবে তুলে ধরা হয়। তার উপর আরােপিত বিতর্কিত বিষয়গুলি হল—
- ১) জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন।
- ২) মন্দির ধ্বংস।
- ৩) অমুসলিমদের জমি বা সম্পত্তি দানের উপর নিষেধাজ্ঞা।
- ৪) ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুদারতা।
- ৫) অমুসলিম কর্মচারীদের প্রশাসন হতে অপসারণ।
- ৬) ধর্মান্তকরণ।
- ৭) ব্যক্তিগত ধর্মনীতির দ্বারা রাষ্ট্রশাসন।
- ৮) ধর্মান্ধতা তথা হিন্দু বিদ্বেষ ইত্যাদি।
(১)
অমুসলিম নাগরিক তথা হিন্দুদের উপর ১৬৭৯ সালে ঔরঙ্গজেব কর্তৃক জিজিয়া করপুনঃপ্রবর্তন করার ঘটনাটিকে মধ্যযুগের ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ বলে মনে করা হয়। এ সম্পর্কে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আনীত হিন্দু-বিদ্বেষের অভিযােগের সবটাই সঠিক নয়। একমাত্র ফিরােজ তুঘলকের (১৩৫১-১৩৮৮) রাজত্বকাল ছাড়া ভারতবর্ষে ঔরঙ্গজেবসহ সমগ্র মুসলমান শাসনকালে অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে নারী, শিশু বা ১৪ বছরের নিম্নের ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, সাধু-সন্ত, ধর্মযাজক, ব্রাহ্মণ, অন্ধ, পঙ্গু, ভিখারি, তীর্থযাত্রী, নিঃস্ব, অসহায়, দিন মজুর, ক্রীতদাস, পাগল, সম্বলহীন, সরকারি সকল কর্মচারী, কৃষকদের জিজিয়া হতে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি অমুসলিম সৈনিকদেরও জিজিয়া কর হতে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ বলতে গেলে অমুসলিম জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ লােককে জিজিয়া দিতে হত। ধনী মুসলিমদের বাধ্যতামূলক জাকাত কর (বাৎসরিক উদ্বৃত্ত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ) দিতে হত। এছাড়া খামস, ফিদিয়া, ওশর (উৎপন্ন ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ) ইত্যাদি করও কেবল মুসলিমদের বাধ্যতামূলকভাবেই দিতে হত। এই সমস্ত কর হিন্দুদের কাছ থেকে আদায় করা হত না। মুসলিমদের এতসব ধর্মীয় কর দিতে হবে অথচু হিন্দুদের কাছ থেকে কোনাে ধর্মীয় কর নেওয়া হবে না, তা হয় না। ইংরেজ, ফরাসি ও পর্তুগীজ বণিকদের ওপরও জিজিয়ার পরিবর্তে ১.৫ শতাংশের একটি অতিরিক্ত শুল্ক চাপানো হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে একথাও বলা জরুরি যে, জিজিয়া বিলুপ্তির জন্য ধনী হিন্দু ব্যবসায়ী-কারিগররা করমুক্ত ছিল, অন্যদিকে মুসলিম ব্যবসায়ী-কারিগরদেরকে সােনা, রূপা, জীবজন্তু ও ব্যবসায়ের পণ্য দ্রব্যের ওপর জাকাত দিতে হত। অমুসলিমরা শুধু খারাজ বা ভূমি-রাজস্ব দিত, যা মুসলিমদেরও দিতে হত। সুতরাং সংখ্যালঘু মুসলিমদের সংখ্যাগুরু অমুসলিমদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণ কর দিতে হত।
স্মর্তব্য যে, ঔরঙ্গজেব কর্তৃক জিজিয়া পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ার ঘটনাটির সঙ্গে ভারতে ধর্মীয় তথা ইসলামিক রাষ্ট্র স্থাপন ও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে বিরােধ জিইয়ে রাখার যে তত্ত্বটি প্রচারিত হয়ে থাকে তা মােটেই যুক্তিযুক্ত নয়। তাছাড়া যে জিজিয়াকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে মুঘলদের ‘হিন্দু বর্জন নীতি’র কথা বলা হয়ে থাকে, তার প্রচলিত সময় ছিল সংক্ষিপ্ত। অথচ জিজিয়াকেই বড় করে হিন্দু-বিদ্বেষের অঙ্গ হিসাবে দেখানাে হয়। শিবলি নােমানি রচিত ‘আল জিজিয়া’ গ্রন্থে ও সতীশচন্দ্রের ‘জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র’ প্রবন্ধে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলােচিত হয়েছে।
ঔরঙ্গজেবের সময়ে প্রজাগণ অহেতুক করভারে জর্জরিত ছিল না। ঔরঙ্গজেব নিপীড়নমূলক বহু সংখ্যক কর প্রত্যাহার করেছিলেন, যেগুলি সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল নাগরিককে আবশ্যিকভাবে প্রদান করতে হত। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, জিজিয়া কর আরােপ করে ঔরঙ্গজেব ৬৬টি (মতান্তরে ৮০টি) প্রচলিত উপকর সাম্রাজ্যের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি সত্বেও কেবল জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে জনস্বার্থে প্রত্যাহার করেছিলেন, যার বাৎসরিক পরিমাণ ছিল প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। নির্দিষ্ট আয়ের উর্ধ্বে কতিপয় হিন্দুকেই শুধু জিজিয়া প্রদান করতে হত, সকল অমুসলমানকে দিতে হত না। দিনমজুর ও যাঁদের সম্পত্তি নেই কিংবা বছরে ৪০ দেরহাম (দশ টাকা) না জমাতে পারে সে দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের জিজিয়া দিতে হত না। এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, অমুসলিমদের মধ্য হতে শুধু আর্থিক সংগতিসম্পন্নদেরকেই জিজিয়া কর দিতে হত। অন্যদিকে মুসলিমদেরও বাধ্যতামূলক জাকাত কর দিতে হত। ঔরঙ্গজেবের সময়ে জিজিয়া মকুব হত এই তথ্যও পাওয়া যায়। ১৭০৪ খ্রীস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধজনিত কারণে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের জিজিয়া মুকুব করা হয়েছিল। ১৬৮৮-৮৯ সালে হায়দ্রাবাদ সুবায় খরার জন্য এক বছরের জিজিয়া মকুব করা হয়েছিল। তাছাড়া সম্রাট আকবর কিন্তু সিংহাসনে বসেই জিজিয়া লােপ করেননি—করেছিলেন ২২ বছর পর, ১৫৭৯ খ্রীস্টাব্দে। আকবরের উদারনীতিবাদকে বড় করে দেখানাের জন্যে আবুল ফজল ইচ্ছাকৃতভাবে জিজিয়া কর রদের সময়কালকে পিছিয়ে ১৫৬৪ সাল বলে বর্ণনা করেছিলেন। তাই যারা আকবরের জিজিয়া প্রত্যাহারের পিছনে ‘প্রজা-প্রীতি’র যুক্তি প্রদর্শন করেন, তাদের কাছে প্রশ্ন ২২ বছর পরে কেন এই ‘প্রজা-প্রীতি’? আর ঔরঙ্গজেব সিংহাসনে আরােহনের ২১ বছর পর জিজিয়া চালু (১৬৭৯) করলেন। ধর্মান্ধতাবশত তিনি এই কাজ করলে সিংহাসনে বসেই (১৬৫৮) করতে পারতেন, ২১ বছর অপেক্ষা করার কোনাে দরকার ছিল না।
(২)
জিজিয়ার মত মন্দির প্রসঙ্গও বহু বিতর্কিত। এখন বহু নতুন তথ্য আমাদের হাতে প্রতিনিয়ত আসছে। ফলে ঔরঙ্গজেবকে নবরূপে তুলে ধরা সহজ হচ্ছে। ১৬৫৯ থেকে ১৬৯৯-র মধ্যে ঔরঙ্গজেব এলাহাবাদের সােমেশ্বরনাথ মহাদেব মন্দির, উজ্জয়িনীর মহাকালেরশ্বর মন্দির, চিত্রকুটের বালাজি মন্দির, গুয়াহাটির উমানন্দ মন্দির, মহারাষ্ট্রের নানদেড় জেলার মােহনপুরের দত্তাত্রেয় গুরু মন্দির, আমেদাবাদের শত্রুঞ্জয় জৈন মন্দির, কাশীর জঙ্গমবাড়ীর শিব মন্দির, অযােধ্যার দন্তধাবন মন্দির, ভারতের প্রাচীনতম নাগেশ্বর মন্দির, আবু পাহাড়ে অবস্থিত মন্দির, জুনাগড়ের মন্দির (গানার) এবং একাধিক শিখ গুরুদ্বার প্রভৃতি ধর্মীয় উপাসনাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে ফরমান জারি করে জায়গির দান করেছিলেন। এভাবে বহু বিখ্যাত ধর্মস্থানে ঔরঙ্গজেব অর্থও দান করেছেন—কখনও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, কখনও মন্দিরগুলির নির্মাণ কাজ বা মন্দিরগুলির দুরবস্থা ঘােচানাের জন্য।২
রেখা যােশীর ‘ঔরঙ্গজেব—অ্যাটিটুডস অ্যান্ড ইনক্লিনেসন্স’ গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, কাশীর বাঙালিটোলায় রক্ষিত ঔরঙ্গজেবের ফরমান থেকে এটা স্পষ্টায়িত হয় যে, তিনি ওই মঠের জন্য তিনবার অর্থদান, ভূমিদান ও আগেকার তিনটি অনুদানকে পুনরায় কার্যকরী করেন। ডাঃ কমল গােভেলের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি যে, পুণের কাছে অবস্থিত চিঁচওয়াড়ে ঔরঙ্গজেব গণপতি মন্দিরের জন্য জমি প্রদান করেছিলেন।৩ গয়ার একটি মন্দিরের জন্য ও আসামে ব্রহ্মপুত্র তীরস্থ মন্দিরের কোনােপুরােহিতের হিতার্থে ঔরঙ্গজেবের ভূমিদানের প্রমাণও পাওয়া গেছে। এরকম আরও তথ্য হয়ত লােকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে পারে।৪ জ্ঞানচন্দ্রের ‘ঔরঙ্গজেব অ্যান্ড দ্য হিন্দু টেম্পলস্’ এবং ‘আলমগীর পেট্রনেজ অ্যান্ড দ্য হিন্দু টেম্পলস্’ রচনা দুটি থেকেও ঔরঙ্গজেবের মন্দির নীতির বহু অপ্রকাশিত কাহিনি জানা যায়।
ঔরঙ্গজেবের মন্দিরনীতি বিষয়ে আলােচনা করতে গিয়ে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বি এন পাণ্ডে লিখেছেন, “যখন আমি ইলাহাবাদ মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান (১৯৪৮৫৩) ছিলাম, তখন একটা মােকদ্দমা আমার সম্মুখে পেশ করা হয়। যেটা সােমেশ্বরনাথ মহাদেব মন্দিরের জায়গীরের বিবাদ কেন্দ্র করে। সেখানকার মহন্তের মৃত্যুর পর সেই জায়গীরের দু’জন দাবিদার দেখা দিল। তাদের মধ্যে একজন এমন একটা দস্তাবেজ পেশ করল, যা তাদের কাছে বংশ পরম্পরায় সংরক্ষিত ছিল। সেটা ঔরঙ্গজেবের জারি করা ফরমান ছিল, তাতে মন্দিরকে একটা জায়গীর ও কিছু নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ ছিল। সেটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, মনে হল এই ফরমানটা জাল। কারণ ঔরঙ্গজেব তাে সবসময় মন্দির ধ্বংস করেছেন, তিনি লিখিতভাবে এই ফরমান কিভাবে জারি করতে পারেন। …জঙ্গমবাড়ী শিবমন্দিরের মহন্তের কাছেও ঔরঙ্গজেবের এই ধরণের অনেক ফরমান ছিল, যা থেকে জানা যায় যে এই মন্দিরের জন্য জায়গীর দেওয়া হয়েছিল। সেগুলাে দেখে ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে এক নতুন চিত্র আমার সম্মুখে উদ্ভাসিত হল এবং আমি একেবারেই অবাক হয়ে গেলাম। ড. সপ্রুর পরামর্শ অনুসারে আমি ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরের মহন্তদের নামে চিঠি লিখলাম যে, যদি ঔরঙ্গজেব তাদের মন্দিরে কোন জায়গীর দিয়ে থাকেন, তাহলে সেই ফরমানগুলাের ফটোকপি তার নামে পাঠিয়ে দেওয়া হােক। আমার আশ্চর্যের সীমা থাকল না, যখন উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দির, ছড়কূটের বালাজী মন্দির, গৌহাটির উমানন্দ মন্দির, শত্ৰুঞ্জয়ের জৈন মন্দির এবং একইভাবে উত্তর ভারতের অন্যান্য মন্দির ও গুরুদ্বারের পক্ষ থেকে আমি এই ধরণের অনেক ফরমান পেলাম যেগুলাে ১৬৫৯ খ্রিঃ থেকে ১৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে জারী করা হয়েছিল।
হিন্দু ও হিন্দু মন্দিরের প্রতি ঔরঙ্গজেবের উদার মনােভাবের এগুলি গুটিকয়েক নমুনা হলেও, ঐতিহাসিকরা তার সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা যে পক্ষপাতিত্বমূলক আর ছবির একটি দিক মাত্র, তা দেখাবার পক্ষে এই যথেষ্ট। ভারতবর্ষ এক বিশাল দেশ। আর সমগ্র দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার মন্দির। যদি যথাযথ গবেষণা করা হয়, আমি নিশ্চিত যে, আরও অনেক উদাহরণ আলােয় উদ্ভাসিত হবে, যা দেখিয়ে দেবে অমুসলিম জনগণের প্রতি ঔরঙ্গজেবের সদাশয় ব্যবহার।”৫
ঐতিহাসিকেরা আহমেদাবাদের নগর শেঠ নির্মিত চিন্তামণি মন্দির ধ্বংসের ক্ষেত্রে। ঔরঙ্গজেবের ভূমিকার কথা বলেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেব যে ওই নগর শেঠকে শত্ৰুঞ্জয় মন্দির, গার্নার ও আবু মন্দিরের জন্য ভূমিদান করেছিলেন তার বেলায় ঐতিহাসিকেরা উদাসীন থাকেন। কোনাে এক যুদ্ধে নগরশেঠ ঔরঙ্গজেবকে সাহায্য করেন। তার বিনিময়ে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ঔরঙ্গজেব নগর শেঠকে গার্নার ও আবুতে অবস্থিত মন্দিরের জন্য জমি দান করেন।৭ জমিদান-সনদগুলির ভাষ্য থেকে বােঝা যাচ্ছে, সম্রাট তার প্রজাবর্গের ধর্ম রক্ষায় খুবই যত্নবান ছিলেন। নিজে ধর্মশীল ছিলেন বলেই অপর ধর্ম, ধার্মিক এবং ধর্মস্থানগুলির হেফাজতের জন্য যত্নবান ছিলেন। শুধু ভূমি বা জমি জায়গীর দান করেই ক্ষান্ত থাকেননি। সেগুলির অধিকার নিয়ে যাতে ভবিষ্যতে রাজার উত্তরসূরী, রাজ-কর্মচারী, আধিকারিকগণ প্রভৃতির মধ্যে জটিলতা, ভুল বােঝাবুঝি ও আইনের ফাঁক-ফোকর না থাকে তার জন্য অতি প্রাঞ্জল, স্বচ্ছ ও যথাযথভাবে বয়ানগুলি লিপিবদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখাগুলির মধ্যে প্রজাদের প্রতি আন্তরিক দরদীভাব ও প্রীতিমধুর সম্পর্ক সূত্রের কথাও সুন্দর রূপে ফুটে উঠেছে। ঐতিহাসিক শের সিং তাঁর ‘মুসলিম রুলার্স ডােনেশান টু টেম্পল নাগেশ্বরনাথ অযােধ্যা’ শীর্ষক যে পাণ্ডুলিপিটি পাটনার খােদাবক্স লাইব্রেরীতে দান করেছেন, তাতে ২৩টি রয়েল অর্ডার রয়েছে। তার মধ্যে একটি অর্ডার ঔরঙ্গজেবের। তাছাড়া কাশ্মীর অঞ্চলে হিন্দু মন্দিরের জন্য যে বৃত্তি ও ভূমিদান করা হয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশ ফরমানই ঔরঙ্গজেবের স্বাক্ষরিত।
আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমরা তুলে ধরতে পারি—
- ১. গুরু রামদাসকে দেরাদুনে গুরুদোয়ারা নির্মাণের জন্য জমিদান করেছিলেন ঔরঙ্গজেব।৮
- ২. গুজরাটে ১৬৭২ সালে জারি হওয়া একটি নির্দেশে হিন্দুদের নিষ্কর জমিদান নিষিদ্ধ বলে ঘােষিত হলেও একাধিক স্থানে কিন্তু জমিদান করার ঘটনাও দেখা গিয়েছিল, যেমন- বৃন্দাবনের বৈষ্ণব মন্দিরে, পাঞ্জাবের সরকার নগরের নাথপন্থী যােগীদের।৯
- ৩. রাজস্থানের সিওয়ানা পরগণার পন্থযােগীদের ১০০ বিঘা জমিদান করেছিলেন ঔরঙ্গজেব।১০
- ৪. বেনারসে ঔরঙ্গজেবের দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়, তাতে তিনি ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দান করতে রামসিংহকে আদেশ দিচ্ছেন।১১
- ৫.তপন রায়চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, তারকেশ্বরের মন্দিরের জমিটা খােদ ঔরঙ্গজেবেরই দেওয়া।১২
কোনাে ঐতিহাসিক কিন্তু প্রমাণ করাতে পারবেন না যে, ধর্মীয় কারণে বা বিদ্বেষবশত ঔরঙ্গজেব কোনাে মন্দির ভেঙেছিলেন। তবে যদুনাথ সরকার বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে মন্দির ধ্বংসের কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু কখন কোন প্রেক্ষিতে এবং কেন তা ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করেছেন তার কোনাে হদিস দেননি। তাছাড়া এটাও প্রমাণিত যে, তার মন্দির ধ্বংস কোনাে রাষ্ট্রীয় নীতির অন্তর্ভুক্ত ছিল না—এগুলি ছিল নিছক ব্যতিক্রমী ঘটনা। অনেক ঐতিহাসিক ঔরঙ্গজেবকে হিন্দুবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করার সময় ‘বেনারস ফরমান’ (১৬৫৯-র ১০ মার্চ) প্রায়ই উল্লেখ করেন। এই ফরমানটি ১৯১১ সালে বাংলার এশিয়াটিক সােসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। ফরমানটি ঔরঙ্গজেব বেনারসের স্থানীয় মুঘল পদস্থ কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে জারি করেন। বেনারস শহর ও শহরতলির কিছু হিন্দু লােকের কাছে হয়রান হয়ে মন্দিরের এক ব্রাহ্মণ তদারক অভিযােগ করেন। তার অভিযােগের ভিত্তিতে এই ফরমান জারি হয়।১৩
ইতিহাসবিদ বি এন পাণ্ডে এই ফরমানের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন: “নতুন নতুন মন্দির নির্মাণের বিরুদ্ধে ঔরঙ্গজেব যে নতুন কোনও নির্দেশনামা জারি করেননি, এ ফরমানে তা অতি স্পষ্ট। যে রীতি-নীতি যথারীতি চালু ছিল, তিনি কেবল তারই উল্লেখ করেন। আর তাতে সংশ্লিষ্ট থাকারই অনুমােদন দেন। যথারীতি বিদ্যমান মন্দিরের ক্ষেত্রে তিনি সেগুলি ধ্বংসের ঘােরতর বিরােধী ছিলেন। এই ফরমান দেখিয়ে দেয় যে, তার হিন্দু প্রজারা শান্তিতে বসবাস করতে সক্ষম হােক, এ ব্যাপারে তিনি ব্যগ্র ছিলেন।”১৪ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে হিন্দু প্রজাদের প্রতি ঔরঙ্গজেব ছিলেন অনেক বেশী উদার ও আন্তরিক। অন্য এক ফরমানে তিনি জানাচ্ছেন: “ইসলামি বিধান অনুসারে আমরা ঘােষণা করছি যে, হিন্দুদের উপাসনালয়গুলি রক্ষণাবেক্ষণ বা তত্ত্ববধান করা হবে।…কোনাে ব্রাহ্মণকে যেন তার উপাসনার কাজে বাধা প্রদান বা কোনও প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করানাে না হয়। আমাদের হিন্দু প্রজাগণ যেন শান্তির সঙ্গে বাস করতে পারে।”১৫
ঔরঙ্গজেব যে হিন্দু জনগণের শান্তিপূর্ণ বসবাসের বিষয়ে প্রকৃতই আগ্রহী ছিলেন, তা দেখাবার জন্য বেনারসের আরও এক ফরমান আমরা তুলে ধরতে পারি। ১০৯১ হিজরীর ১৭রবিউস সানী জারিকৃত এই ফরমানে বলা হয় যে, “…আমাদের শাহী হুকুম হল এই যে, এই উজ্জ্বল আদেশ পাওয়ার পর, বর্তমান ও ভাবী সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হােক, ভবিষ্যতে কেউ যেন কোনােভাবেই গোঁসাইয়ের কাজে হস্তক্ষেপ বা উৎপাত করে, যাতে করে তিনি আমাদের আল্লাহ প্রদত্ত সাম্রাজ্যের অনবচ্ছিন্নতার জন্য প্রশান্ত চিত্তে পূজার্চনা চালিয়ে যেতে পারেন, যে সাম্রাজ্য চির অবিনশ্বর হিসেবে পূর্বনির্ধারিত। এটিকে জরুরী বিষয় বলে বিবেচনা করবেন।”১৬ অন্য ফরমানেও ঔরঙ্গজেব স্পষ্ট জানিয়েছেন, যাতে তার মন্দির ধ্বংসের অভিযােগ সম্পর্কে উত্তর মিলবে— “আমাদের ইসলাম ধর্মানুযায়ী অমুসলমানদের মন্দির ভাঙা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।”
অথচ ভিএ স্মিথের ভাষ্য অনুযায়ী মুলতান, বেনারস প্রভৃতি স্থানে ব্রাহ্মণদের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধীয় বক্তৃতা শুনে জনগণ, বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের সংবাদ শুনে বিচলিত এবং ক্ষুব্ধ ঔরঙ্গজেব প্রাদেশিক গভর্ণরদের নির্দেশ দেন:… to destroy with a willing hand the schools and temples of the infidels …five months later the local officers reported that in accordance with imperial command the temple of Bishanath at Benaras had been destroyed. After a short interval…temple of Kesaba Deva at Mathura, … had been levelled with the ground. The foundation of a large and costly mosque was laid on the site.১৭ যদুনাথ সরকার ‘সিরাতই-আহমদী’ থেকে যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাতেও এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়।১৮ ‘বম্বে গেজিটিয়ার’-এ এবিষয়ে একটি অতিরিক্ত সংবাদ দেওয়া হয় :…he slaughtered a cow in the temple, but Shahjahan ordered the building to be restored to the Hindu.’১৯
ঔরঙ্গজেবকে চরম হিন্দুদ্বেষী বলে প্রমাণ করার জন্যে এই দুটি ঐতিহাসিক তথ্যই যথেষ্ট (তবে এই দুটি তথ্য যে সঠিক নয় তা পরের দিকে প্রমাণ করা হয়েছে)। কিন্তু যদুনাথ সরকার ‘বেনারস ফরমান’-এর কিছু অংশ উল্লেখ করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, “আমাদের পবিত্র আইনানুসারে, আমরা স্থির করেছি যে, পুরাতন মন্দির ধ্বংস করা চলবে না। কিন্তু নতুন মন্দিরও নির্মাণ করা যাবে না।”২০ এই নির্দেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তখন বেনারস ও তার আশেপাশের অঞ্চলে যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মত মন্দির গড়ে উঠছিল, যার কোনাে ধর্মীয় প্রয়ােজন ছিল না। ঔরঙ্গজেব মন্দির তৈরির এই প্রতিযােগিতা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে এই মন্দিরগুলি ছিল সরকারের প্রতি হুমকি স্বরূপ। নতুন মন্দির নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরােপের কারণ এও হতে পারে, ভূমির সরকারি খাজনা ফাঁকি দেবার জন্য অথবা দেবােত্তর বলে সম্পত্তি গ্রাস করার উদ্দেশ্যে হয়তাে নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হত (ভূমি-গ্রাসের এই কৌশল বর্তমানকালেও দুর্লক্ষ্য নয়)। অবৈধ উপায়ে সম্পত্তি হস্তগত করার পথ রােধ করার জন্যই হয়তাে ঔরঙ্গজেব নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করেছিলেন। ‘বেনারস ফরমান’-এ বেনারসবাসী হিন্দু সম্প্রদায় এবং মন্দিরের পুরােহিতদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সরকারি নির্দেশও উল্লেখযােগ্য।২১ সুতরাং ‘বেনারস ফরমান’ প্রসঙ্গে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আনীত হিন্দু-বিদ্বেষ সংক্রান্ত ঢালাও অভিযােগের ভিত্তির যথার্থতা বড়ই প্রশ্নসাপেক্ষ, এ নিয়ে সাবধানতা অবলম্বনই শ্রেয়, সর্বোপরি এ নিয়ে কোনাে সহজ সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে মুসকিল।
মথুরায় কেশব রাইয়ের যে মন্দিরটি ঔরঙ্গজেব ধ্বংস (১৬৬৯) করেন তার কারণ হল, জাহাঙ্গীরের ইঙ্গিতে আকবরের বন্ধু আবুল ফজলকে প্রতারণাপূর্বক হত্যা করে (১৬০২) বীরসিংদেব বুন্দেলা প্রচুর টাকা-পয়সা ও আসবাবপত্র লুণ্ঠন করেন। জাহাঙ্গীর সিংহাসনে আরােহন করলে তিনি তার অনুমতি পেয়ে সেই লুণ্ঠিত টাকায় মথুরায় উক্ত মন্দির নির্মাণ করেন। আবুল ফজলের হত্যার স্মারক এই মন্দিরটি নিয়ে হিন্দু মুসলিমে উত্তেজনা ছড়াত। তাছাড়া বীরসিংহ বুন্দেলা ছিলেন ঔরঙ্গজেবের চরম শত্রু। তিনি রাজনৈতিক বিরােধিতা করতে গিয়ে ভারত সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেন। তার সেই ঔদ্ধত্য খর্ব করতে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিরসন কল্পে ঔরঙ্গ জেব মন্দিরটি ভেঙে ফেলেন।২২
স্মর্তব্য যে, হিন্দুদের একাংশ ঔরঙ্গজেবের রাজত্বলাভের পূর্বে বেশ শক্তিশালী ও হিংস্র হয়ে উঠেছিল। ঔরঙ্গজেব যখন অত্যাচার বন্ধ করতে এগিয়ে এলেন তখন তাদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিল। ১০৭৯ হিজরীর জিলকদ মাসে তার রাজ্যাভিষেকের দ্বাদশ বর্ষে (১৬৬৯) ঔরঙ্গজেব যখন অবগত হলেন যে, ওই সমস্ত হিন্দুরা মুসলিম। শিশুদেরকে সাম্প্রদায়িক বিদ্যা শিক্ষা দিচ্ছে এবং এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, তিনি তখন সেগুলি বন্ধ ও ভেঙে দেওয়ার আদেশ দিলেন। অথচ বিদ্বেষভাবাপন্ন ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের সমস্ত শিক্ষালয় ও ধর্মীয় স্থানগুলি ভেঙে দিয়েছিলেন। ‘মাসের-ই-আলমগিরি’তে লেখা হয়েছে: “ধর্মপ্রাণ সম্রাট জানতে পারলেন যে, থাট্টা ও মুলতান সুবায় বিশেষত বেনারসে মিথ্যাচারী ব্রাহ্মণের দল অলীক গ্রন্থাদি স্কুলসমূহে পড়াতে লেগে গিয়েছে। হিন্দু ও মুসলিম বিদ্যার্থীরা বহু দূরবর্তী পথ অতিক্রম করে উক্ত অভিশপ্ত বিদ্যা অর্জনকল্পে ওই ভ্রষ্টদলের নিকট আগমন করে। সুতরাং সমস্ত সুবার শাসনকর্তাদের নিকট আদেশ প্রেরণ করা হল যে, তারা যেন ওই ব্রাহ্মণদের বিদ্যালয় ও উপাসনালয়গুলাে স্বহস্তে ভেঙে দেন।”২৩ এই বিবৃতি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, কি কারণে এই আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং এর উদ্দেশ্য কি ছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কিছু ঐতিহাসিকরা এই বিশেষ আদেশটাকে সাধারণ আদেশের পর্যায়ে প্রচার করেছেন। যাইহােক, এই ঘটনার মাত্র মাস খানেক পর মথুরা অঞ্চলে হিন্দুরা বিদ্রোহ শুরু করে। ওই বিদ্রোহ দমনকল্পে আবদুন্নবী খান মথুরার ফৌজদার নিযুক্ত হলেন এবং নিহত হলেন (‘মাসের-ইআলমগিরি’)। এই সময়ে মথুরার সেই মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। রমিলা থাপার বলেছেন, বীরসিংহ বুন্দেলা মন্দিরটির মাধ্যমে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। মন্দিরটি ছিল যুদ্ধের আহ্বানের প্রতীক এবং তখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যাতে ধর্ম রাজনীতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এভাবে মন্দিরটি ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক লড়ায়ের অঙ্গে পরিণত হয়েছিল।২৪
(৩)
সাধারণত মন্দির ধ্বংসের কারণ দেখার চেষ্টা করা হয়, তৎকালীন মুসলিম ইতিহাসকারদের বিবরণকে ভিত্তি করে। তাঁরা মন্দির ধ্বংসের পিছনে রাজনৈতিক ও আর্থিক কারণের চেয়ে ধর্মীয় কারণকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় মানুষরা মন্দির ধ্বংসকে কীভাবে দেখেছে তা খুব কমই আলােচনা করা হয়। রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্য পুরাণে’ দেখা যায় যে, স্থানীয় মানুষরা জাজনগরে মুসলমান কর্তৃক হিন্দু মন্দির ধ্বংসকে স্বাগত জানিয়েছিল।২৫ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, সুলতান মাহমুদ কর্তৃক উত্তর-পশ্চিম ভারতের মন্দিরগুলি ধ্বংসের বিবরণ সমকালীন স্থানীয় উপাদানে প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং আমরা পরবর্তীকালে যতই মাহমুদকে হিন্দু মন্দির ধ্বংসকারী ও অত্যাচারী বলে দেখাই না কেন, তৎকালীন মানুষের মনে মন্দির ধ্বংসের ছাপ বেশি পড়েনি।
উল্লেখ্য, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকা সত্বেও সম্ভবত কোনাে নতুন মন্দির স্থাপিত হয়নি।২৬ এরপর বেনারসে জাহাঙ্গীরের আমলে প্রায় ৭৬টি নতুন মন্দির নির্মিত হয়েছিল। প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযােগে কোনাে কোনাে স্থানে এসময়ে মসজিদ ভেঙে মন্দিরও নির্মিত হয়েছিল। ‘মুন্তাখাব-উৎ-তারিখ’ গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে যে, A number of mosques were destroyed by Hindus and temples created in these place.’ ওই গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে, ‘Mosques and prayer-rooms were changed into store-rooms and into Hindu Guard rooms.’ সম্রাট শাহজাহানের আমলে এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। কিন্তু অপকর্মের পুরােপুরি নিরসন হয়নি। তৎকালীন পাঞ্জাবের শহরতলি অঞ্চলের সৈয়দবৃন্দ এবং মাশায়েখদের একটি দল স্থানীয় হিন্দু দুষ্কৃতকারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শাহজাহানের সাহায্যপ্রার্থী হয়। কিছু কিছু দুরাচার দস্যু এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, ৭০ জন মুসলিম নারীদের অপহরণ করে এবং মসজিদগুলাে দখল করে নেয়। এ ব্যাপারে শেখ মাহমুদ গুজরাটিকে মহিলাদের উদ্ধারের জন্য নিযুক্ত করা হয়। হুকুমমতাে তিনি মুসলিম নারীদের উদ্ধার করেছিলেন। বাদশাহ শাহজাহান এই নারীদের বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার জন্য মুসলমানদের আহ্বান করেন। এবং মসজিদ ভেঙে স্থাপিত মন্দিরগুলাে ভেঙে আবার মসজিদ নির্মাণ করেন।২৭ শাহজাহানের পর দারাশিকোর হাতে শাসনভার চলে গেলে দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ চরমে ওঠে। এই দুর্নীতি ঔরঙ্গজেব শক্ত হাতে দমন করেন। মসজিদ ভেঙে যে মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছিল তিনি কেবল সেই মন্দিরগুলিই ভেঙে ফেলেন এবং পূর্ববৎ মসজিদ নির্মাণ করেন।২৮
এভাবে বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংসের কাহিনিও বানােয়াট। এটি ধ্বংসের কারণ: ঔরঙ্গজেবের বাংলা অভিযানের সময় বহু হিন্দুরাজা তার সহযাত্রী হন। কাশীতে শিবির স্থাপন করা হলে হিন্দু রাজাদের রাণীরা গঙ্গাস্নান সেরে পূজা দিতে যান। পূজা দিয়ে ফেরার পথে দেখা যায় কচ্ছের রাণীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাশী তােলপাড় করে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় মন্দিরের গর্ভগৃহে ধর্ষিত অবস্থায়। ক্ষুব্ধ হিন্দু রাজারা এর প্রতিকার চান। ঔরঙ্গজেব হিন্দু রাজাদের দাবি মেনেই বিগ্রহ সরিয়ে মন্দির ভূলুণ্ঠিত করেন। পুরােহিতকে শাস্তি দেন। ঐতিহাসিক বি এন পাণ্ডে তার ‘ইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতি’ গ্রন্থে ‘মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসের বিকৃতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…বাংলা অভিমুখে যাত্রাপথে আওরঙ্গজেব যখন বারাণসীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার অধীনস্থ রাজারা অনুরােধ করেন যদি একদিনের যাত্রা বিরতি ঘটানাে যায় তাহলে রাজ-মহীষীরা বারাণসী গিয়ে গঙ্গাস্নান করে প্রভু বিশ্বনাথকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন। আওরঙ্গজেব সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যান। বারাণসীর পাঁচ মাইল দূরে সেনা-শিবির স্থাপিত হল। মহীষীরা…গঙ্গাস্নান সেরে গেলেন বিশ্বনাথের মন্দিরে। পূজার্চনা শেষে সবাই ফিরে এলেন। এলেন না শুধু কচ্ছের মহারাণী। মন্দির এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল, কোথাও পাওয়া গেল না। এটি আওরঙ্গজেবের গােচরে আনা হলে তিনি ক্রুব্ধ হয়ে উঠলেন। রাণীর খোঁজে পাঠালেন ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের। শেষ পর্যন্ত ..তারা নিখোঁজ রাণীকে দেখতে পেলেন ধর্ষিতা আর ক্রন্দনরত অবস্থায়। কক্ষটি ছিল প্রভু বিশ্বনাথ দেবের ঠিক নিচেই। রাজারা প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন। অপরাধ যেহেতু জঘন্য অতএব তারা দণ্ডযােগ্য অবস্থা গ্রহণের দাবি জানালেন। আওরঙ্গজেব আদেশ দিলেন, বিশ্বনাথ যেহেতু কলুষিত হয়েছে, অতএব প্রভু বিশ্বনাথকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করে মন্দির ভূমিসাৎ হােক। আর মােহান্তকে বন্দী করে শাস্তি দেওয়া হােক।”২৯ পট্টভি সীতারামাইয়া প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে এই তথ্য তাঁর গ্রন্থে৩০ লিপিবদ্ধ করেছেন।
এছাড়া তৎকালীন পাটনা মিউজিয়ামের প্রাক্তন কিউরেটর পি এন গুপ্তও এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। কেউ কেউ অপবাদ দিয়ে থাকেন ঔরঙ্গজেব মন্দির ভেঙে ওই স্থানেই মসজিদ নির্মাণ করেন। এটা বানানাে গল্প। মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ভিন্ন সময়ে ভিন্ন জমিতে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিদ্রোহ দমন ও মসজিদের পূর্ব-রূপায়ণ এবং ধর্মস্থান শুদ্ধিকরণের উদ্দেশ্য ছাড়া ঔরঙ্গজেব হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেননি। বরং মন্দির নির্মাণের জন্য দিয়েছেন অসংখ্য ফরমান, অঢেল সম্পত্তি, বাড়িয়েছেন উদার হস্তের দান। ঐতিহাসিকেরা সেদিকে ফিরে তাকাননি। ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজত্বের প্রথম ২২ বছর কোনাে ধর্মীয় নীতি গ্রহণ করেননি। কিন্তু বিদ্রোহীদের সঙ্গে রাজপুতদের যােগসাজস ঔরঙ্গজেবকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। তাঁরা মুঘল সার্বভৌম শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। এক ফরমান হতে জানা যায় যে, কিছু হিন্দু কুলিদের উৎপাতে মুসলমানেরা আহমেদাবাদের জামে মসজিদে নামাজ পড়তে পারত না। এ সময় রাজপুত বিদ্রোহীরা অনেক মসজিদও ধ্বংস করে। তাছাড়া গুজরাটে হিন্দুরা মসজিদ নির্মাণে বাধা দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও বদলে যায় এবং সেখানকার মন্দির ভাঙা হয়। এছাড়া ১০৭৯ হিজরীতে খাণ্ডেলায় রাজপুতরাও বিদ্রোহ করে ও তাঁদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠানাে হয় এবং সেখানকার মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়। ওই বছরেই সর্বসাধারণের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং যােধপুর ও উদয়পুর তার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ঔরঙ্গজেব এই দুটি রাজ্যের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন এবং সেখানকার মন্দিরগুলাে ধ্বংস করেন। যত মন্দির ধ্বংস হয়েছিল তার সমস্ত স্থানে বিদ্রোহ অত্যন্ত প্রবল আকারে দেখা দিয়েছিল। অথচ ইউরােপীয় ও ভারতীয় কিছু ঐতিহাসিক বলেন যে, ঔরঙ্গজেব মন্দির ধ্বংস করেছিলেন বলেই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু একথা সত্য যে, বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল বলেই মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল।৩১ তাই বলা যায়, ঔরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসের আদেশ ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। বি এন পাণ্ডে তাঁর পূর্বোক্ত গবেষণামূলক গ্রন্থে বহু তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, ঔরঙ্গজেব মােটেই হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন না। অপ্রিয় কাজ তিনি করতে বাধ্য হয়েছেন আইনশৃঙ্খলাগত কারণে, কারও প্রতি বিদ্বেষবশত নয়। প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করলে ঔরঙ্গজেব কেন, কোনােকালেই কোনাে শক্তিই মন্দির বা মসজিদ ধ্বংস করতে কুষ্ঠিত হয় না।
ঔরঙ্গজেব শুধু মন্দিরের ক্ষেত্রে নয়, মসজিদের ক্ষেত্রেও কোনােরকম অন্যায় থাকলে ধ্বংসের আদেশ দিতেন। যেমন গােলকোণ্ডার মুসলিম নবাব তানশাহ (প্রকৃত নাম আবুল হাসান শাহ) ঔরঙ্গজেবকে খাজনা ফাঁকি দিয়ে তা মাটির নিচে পুঁতে তার উপর মসজিদ নির্মাণ করেন। ঔরঙ্গজেব ওই মসজিদকে ভেঙে দিয়ে খাজনার অর্থ উদ্ধার করেন।৩২
(8)
১৬৭২-এ ঔরঙ্গজেব এক আদেশনামা বলে হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিমদের জমি বা সম্পত্তি দানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এর পেছনে হিন্দু বিদ্বেষকে খোঁজা বােধহয় ঠিক নয়, হয়তাে এক্ষেত্রে কোনাে বিশেষ কারণ ছিল। নইলে এই সময়ে কিংবা তার আগে বা পরে ঔরঙ্গজেব আবার বহু হিন্দুদের জমি বা সম্পত্তি দান করবেন কেন! এ ধরনের ৪৮টি দানপত্ৰ৩৩ সংগ্রহ করেছেন কে কে দত্ত তাঁর গ্রন্থে। এই অনুদানগুলি সবই ছিল নিঃশর্ত ও স্থায়ী। গ্রহীতারা ছিলেন হিন্দু সন্ন্যাসী ও তাঁদের শিষ্যরা, বৃদ্ধ হিন্দু সৈনিক ও কানুনগােরা। প্রাপকদের মধ্যে যেমন ছিলেন হতদরিদ্র দুখরন মিসরি, তেমনই করমুক্ত ৫৫ বিঘা জমির গ্রহীতা লীলা ব্রাহ্মণ। বিনিময়ে এমনকি রাজানুগত্যের শর্তও তিনি দাবি করেননি। অধ্যাপক টি এস গ্রেওয়াল ও বি এন গােস্বামী সম্পাদিত গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে, উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের ছােট গ্রাম জাখবরে বসবাসকারী নাথ যােগীদের প্রচুর করমুক্ত জমি দান করেন ঔরঙ্গজেব।৩৪ এই যােগীরা মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্যে পুজা প্রার্থনা করতেন। আসামের গোঁসাইদের তিনি নিষ্কর ভূমিদান করেছিলেন। বেনারসের ব্রাহ্মণদেরও তিনি জমি অনুদান দিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এমন ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়।
ঔরঙ্গজেব শৈব সম্প্রদায়ের জন্যও বহু নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। বিহার থেকে পাওয়া অনেক সনদের সাক্ষ্য থেকে হিন্দু মন্দিরের জন্য তাঁর নিষ্কর জমি দানের কথা জানা যায়।৩৫ ঔরঙ্গজেবের জন্যই সেখানকার জৈন সম্প্রদায়ও নিষ্কর ভূমি পেয়েছিল। এই দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্য মধ্যযুগের জৈন সাহিত্য ঔরঙ্গজেবের খুব প্রশংসা করেছে।৩৬ ঐতিহাসিক বিনয় ঘােষের ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ হতে জানা যায়, হাওড়ার বাঁশবেড়িয়ার জমিদার রামেশ্বর রায়কে ঔরঙ্গজেব ১৬৭৩ সালে ৪০১ বিঘা নিষ্কর জমির জায়গীর ও ১২টি পরগণার জমিদারী প্রদান করে গেছেন। গৌহাটির উমানন্দ মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য পূর্ববর্তী রাজার সম্পত্তির বরাদ্দ ঔরঙ্গজেব ফরমান জারি করে বহাল রেখেছিলেন। মহাকালেশ্বর মন্দিরের দীপ দিবারাত্রি প্রজ্জ্বলিত রাখতে চার সের ঘি-এর বরাদ্দ করেছিলেন তিনি।
জঙ্গম বাড়ির মহন্তের কাছে রক্ষিত কয়েকটি ফরমানে দেখা যায়, হিন্দু হােক মুসলিম হােক, ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রজার অধিকার খর্ব কখনও মেনে নিতে পারেননি। কঠোরভাবে অন্যায় বা জুলুমের মােকাবিলা করেছেন। কাশীর জঙ্গমদের (শৈব) সম্পত্তি নাজির বেগ জবরদখল করলে তিনি হিন্দুদের পক্ষে রায় দিয়ে ফরমান জারি করেন।৩৭ জঙ্গ মবাড়ির মঠাধ্যক্ষের কাছে সংরক্ষিত অপর এক ফরমানে দেখা যাচ্ছে, সম্রাট ঔরঙ্গজেব জঙ্গমদের দেওয়া হয়েছে এমন জমির দখলী স্বত্ব বহাল রাখতে ১০৭৮ হিজরী ১ রবিউল আউয়াল (১৬৬৯) আদেশ জারি করছেন।৩৮ এই ফরমান কেবল ঔরঙ্গজেবের স্বভাবগত বিচারবােধেরই পরিচয় দেয় না, হিন্দু প্রার্থীর মধ্যে নিসার বিতরণে তিনি যে কোনাে বৈষম্য করেননি, তাও দেখিয়ে দেয়। খুব সম্ভব ঔরঙ্গজেব ওই ১৭৮ বিঘা জমি জঙ্গমদের দান করেন। ১০৭১হিজরীর পাঁচ রমজান (১৬৬২) অন্য একটি ফরমানও পাওয়া যাচ্ছে যেখানে এই জমির উল্লেখ ছিল।৩৯ ১০৯৮ হিজরীতে (১৬৮৯) ঔরঙ্গজেব বেনারস শহরের জনৈক হিন্দু ধর্মগুরুকে আর একখানি জমি-মঞ্জুরীর জন্য ফরমান জারী করেন।৪০ এছাড়া ঔরঙ্গজেব ১৬৬৬-এ (রাজত্বের ৯ম বছরে) আসামের গৌহাটির উমানন্দ মন্দিরের পূজারী সুদামনের অনুকূলে যে ফরমান জারির মাধ্যমে মন্দিরের জন্যে ভূমিদান করেন।৪১
(৫)
মুঘল পরিবারের লােকজনদের হিন্দুদের হােলি উৎসবে যােগ দেবার রীতিকে ঔরঙ্গজেব বন্ধ করেননি। প্রিয় নাতি আজিম-উল-হাসানকে হােলির বেশ পরিহিতি দেখে তিনি কেবল ঠাট্টা করেছিলেন মাত্র। তার সময়ে মুঘল রাজদরবারে হিন্দু সভাসদদের ‘রাম রাম’ বলে অন্যান্যদের এমনকি সম্রাটকে সম্বােধন করার ব্যবস্থাও বহাল ছিল। পরবর্তী মুঘল সম্রাটরা তেমন কোনাে উচ্চ ভূমিকা নিতে না পারলেও, অমুসলমানদের প্রতি উদারতাকে তারা সাধারণভাবে অব্যাহত রেখেছিলেন। অবশ্য ঔরঙ্গজেবের পরে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতা এবং মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের প্রক্রিয়ায় ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনে নতুন কোনাে প্রয়াসের সুযােগও ছিল না। এ সত্ত্বেও বলা যায় যে, দিল্লির রাজসভাতে ১৮২৫ সালে দুর্গাপুজা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
জ্ঞানচন্দ্র তার ‘Freedom of worship for the Hindu under Alamgir’ প্রবন্ধে৪২ বার্নিয়ের-এর বরাত দিয়ে হিন্দুদের প্রতি ঔরঙ্গজেবের সহনশীলতা ও উদারতার কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে, ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের নিকট মােটেও ভীতিপ্রদ ছিলেন না, আর তিনি অত্যাচারীও ছিলেন না।৪৩ অথচ তার বিরুদ্ধে ধর্মান্ধতার অপবাদ প্রচারিত হয়েছে। ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, একবার দক্ষিণ ভারতের এক হিন্দু রাজার রাজ্য (মল্লারপুর) জয় করার পর ঔরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর কেউ কেউ সেখানে মাংস খাওয়ার জন্য গাে হত্যা করতে চাইলে তিনি গাে-হত্যা বন্ধের নির্দেশ দেন পাছে সেখানকার হিন্দু-প্রজারা অসন্তুষ্ট হন। ফরমানে বলা হয় যে, মল্লারপুর রাজ্যের মধ্যে যে গােহত্যা করবে, তার কাজকে রাজদ্রোহ বলে গণ্য করা হবে। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক নুরুল হাসানের লেখাতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে।৪৪ এখানে ঔরঙ্গজেব প্রশাসনিক স্বার্থকে ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। এছাড়া ঔরঙ্গজেব তার হিন্দু প্রজাদের ধর্মীয় ভাবানুভূতিকে মর্যাদা দেওয়ার। উদ্দেশ্যে আসামের বাংলা লিপিতে পৌরাণিক কাহিনি সম্বলিত মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন।৪৫
যদুনাথ সরকার বলেন, শিল্পকলা, সংগীত, নৃত্য এবং এমনকি কবিতা তার বিতৃষার উদ্রেক করত। মুঘল সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালােচনা করলে প্রতীয়মান। হবে যে, চিত্রশিল্প, স্থাপত্যকলা, সাহিত্যচর্চা তার রাজত্বে অব্যাহত ছিল। তিনি প্রকৃত অর্থে বিদ্বান ছিলেন। তিনি নীতিশাস্ত্র, আরবি ব্যবহারতত্ত্ব এবং ফারসি সাহিত্য নিবিষ্টভাবে চর্চা করতেন। আজকের ‘হিন্দু কোড বিল’-এর অগ্রদূত ‘ফতােয়া-ইআলমগীরী’ ঔরঙ্গজেবের আমলেই সূত্রবদ্ধ করা হয়। তিনি সারা দেশ থেকে হিন্দু পণ্ডিতদের সমবেত করে মনুসংহিতা, অর্থশাস্ত্র ও অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রের ভিত্তিতে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাগুলির অপসারণ করে হিন্দুদের জন্য ধর্মীয় সামাজিক নিয়ম চালু করার উদ্যোগ নেন। তিনি ফারসি ভাষায় চিঠি ও নথিপত্র স্বয়ং লিপিবদ্ধ করতেন। পত্রগুলি থেকে তার ফারসি ভাষার উপর দখলের পরিচয় পাওয়া যায়। তার সময়ে তুর্কি ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণ রচিত হয়। তিনি কবিতাও রচনা করতেন। তারই পৃষ্ঠপােষকতায় বিদুষী কন্যা জেবুন্নেসার সাহিত্যক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখা সম্ভব হয়। জেবুন্নেসারচিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘দিওয়ান-ই-মাকফী’। ঔরঙ্গজেবের আমলের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন পাটনার আব্দুল কাদির। তিনি লক্ষাধিক কবিতা লিখেছিলেন। ঔরঙ্গজেবের উৎসাহে কাশ্মীরে মােল্লা শফিউদ্দিন আরবি গ্রন্থ ‘তাফসির-ই-কবীর’ ফারসিতে অনুবাদ করেন।
কোরআন শরীফ ঔরঙ্গজেব সিকাস্তা ও নাসতালিক পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করেন। ঔরঙ্গজেব শিল্পকলাকে ঘৃণা করতেন—এটি গ্রহণযােগ্য নয়। কারণ শাহজাহানের রাজত্বে মুঘল স্থাপত্য কলার স্বর্ণযুগ সূচিত হলে অকস্মাৎ এই রীতি-পদ্ধতি তার পুত্রের আমলে অবলুপ্ত হবে—এটি বিশ্বাস করা যায় না। প্রথমত, ঔরঙ্গজেব দিল্লির লালকেল্লাতে মােতি মসজিদ নামে মার্বেল ও লাল পাথরের একটি অপূর্ব ইমারত নির্মাণ করেন। ১৬৭৪ সালে লাহােরের বাদশাহী মসজিদ নির্মাণ ঔরঙ্গজেবের ধর্মানুরাগই নয়, স্থাপত্য শিল্পের প্রতিও তার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। ১৬৭৮ সালে দাক্ষিণাত্যের ঔরঙ্গাবাদে ঔরঙ্গজেবের পত্নীর সমাধি নির্মিত হয়। একনজরে এটিকে তাজমহলের অনুকরণ বলা যায়, যদিও আগ্রার অমরকীর্তির মতাে এটি সুষমামণ্ডিত ছিল না।
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বে মুঘল চিত্রকলার বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত না হলেও যে কয়েকটি মিনিয়েচার অথবা আবক্ষ চিত্র রয়েছে তাতে তাকে মুঘল শিল্পকলারই ধারক বলা যেতে পারে। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বে চিত্রশিল্পীগণ তিরােধান করেননি। ঔরঙ্গজেবের যুদ্ধাভিযান এবং অবরােধের দৃশ্য দেখে মনে হয় যে, তিনি চিত্রকলাকে অবহেলা করেননি। বিজাপুর অবরােধের দৃশ্য অতি চাতুর্যের সঙ্গে চিত্রকর ফুটিয়ে তােলেন। তাছাড়া যদি আমরা ধরেই নিই যে, ঔরঙ্গজেবের সময়ে চিত্রকলার মর্যাদাহানি হয়েছিল, তাহলেও এর একটা ইতিবাচক দিকও কিন্তু ছিল। চিত্রকলায় ঔরঙ্গজেবের অনাগ্রহের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চিত্রকররা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে পাঞ্জাব ও রাজস্থানে চিত্রকলার বিকাশ ঘটে।
ঔরঙ্গজেব সংগীতের বিরােধী ছিলেন এবং তাঁর আমলে সংগীতকে সমাধিস্থ করা হয় বলে অভিযােগ থাকলেও বস্তুত তার দরবারে সংগীতের চর্চা একেবারে বন্ধ হয়নি। তার রাজত্বের প্রথম দিকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে সজ্জিত গায়কগণ দরবারে সংগীত পরিবেশন করতেন এবং তিনি তা শ্রবণ করতেন। ঔরঙ্গজেব দু’টি বিখ্যাত সংগীত গ্রন্থ রচনার অনুমতি দেন—ফকিরউল্লাহর ‘রাগদর্পণ’ আর মির্জা খানের ‘তােহফাতুল হিন্দ’। ফারসি ভাষায় রচিত ‘রাগদর্পণ’-এর চতুর্থ অধ্যায়ে ফকিরউল্লাহ তৎকালীন ভারতীয় সংগীতের বর্ণনা দিয়েছেন এবং যেসব অঞ্চলে এইসব সংগীত পরিবেশিত হয় সেসব অঞ্চলের কথাও উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটি ঔরঙ্গজেবের নামে উৎসর্গ করা হয় এবং এতে মুঘল যুগের সংগীত-রীতি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যও সংকলিত হয়েছে। তােহফাতুল হিন্দ গ্রন্থটির রচনাকাল ১৬৭৫-র পূর্বে। ‘তােহফাতুল হিন্দ’-এর অর্থ ভারতের উপহার। ঔরঙ্গজেবের গুণকীর্তন দিয়েই এই গ্রন্থের সূত্রপাত। গ্রন্থে বলা হয়েছে ভারতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা মহাদেব, ইনিই রাগরাগিনীর জন্মদাতা। মির্জা খান সংগীতের বিভিন্ন উৎসের বর্ণনা দিয়ে সংগীতকে সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন। এছাড়া ভারতে প্রচলিত ফারসি সংগীতের বিশদ বিবরণও লেখক এ গ্রন্থে দিয়েছেন।
এশিয়াটিক সােসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস্ ‘তােহফাতুল হিন্দ’ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করেন এবং ১৭৯৯ সালে তার নিজের লেখা গ্রন্থ “অন দ্য মিউজিক্যাল মােডস্ অব দ্য হিন্দুজ’-এ এ সম্পর্কে আলােচনা করেন। ১২২৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘সংগীত তরঙ্গ গ্রন্থে রাধামােহন সেনও ‘তােহফাতুল হিন্দ’ সম্পর্কে মন্তব্য করেন। ১৮৩৪ সালে উইলিয়ামএর লেখা ‘এ ট্রিটাইজ অন দ্য মিউজিক অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে মিশ্র রাগের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তা ‘তােহফাতুল হিন্দ’ থেকে সংগৃহীত। বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত এবং জিয়াউদ্দিন রচিত ‘মির্জা খানস্ গ্রামার অফ দ্য ব্রজভাষা’ গ্রন্থে মির্জা খানের সঙ্গীত বিষয়ক লেখনীর উপর বিস্তারিত আলােচনা রয়েছে।
তাছাড়া ঔরঙ্গজেবের সময়ে ফারসি ভাষায় ভারতীয় মার্গ সংগীতের ওপর সবচেয়ে বেশি গ্রন্থ লেখা হয়। ঔরঙ্গজেব নিজে বীণাবাদক ছিলেন।৪৬ পর্যটক বার্নিয়ের দিল্লিতে তার বাড়ির ছাদ থেকে রাজপ্রাসাদের নহবৎ শুনতেন এবং তার প্রশংসাও করেছেন। পাশাপাশি বলা দরকার যে, দরবারী গান-বাজনা বন্ধ ও গায়কদের ভাতা দিয়ে বিদায় জানানাে হলেও যন্ত্রসংগীত বা নহবৎ অবশ্য চলতে থাকে। দরবারের মহিলারা ও অভিজাতরাও গানের প্রতি তাদের উৎসাহদান অব্যাহত রেখেছিলেন।৪৭ সুতরাং ঔরঙ্গজেব সংগীতের বিরােধী ছিলেন এবং তার আমলে সংগীতকে সমাধিস্থ করা হয় বলে যে অভিযােগ করা হয় তা একেবারেই ঔরঙ্গজেবের প্রতি ক্রোধবশত মন্তব্য বলে মনে হয়। তবে অষ্টাদশ শতকে সংগীতের ক্ষেত্রে বেশকিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহের আমলে (১৭২০-৪৮)।
মুঘল আমলে একসঙ্গে অনেকগুলি ভাষার প্রচলন ছিল বলে বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণ চর্চার প্রয়ােজন অনুভূত হত। সতেরাে শতকের মধ্যভাগে তাই ব্যাকরণ রচনার কাজ হাতে নেওয়া হয়। ঔরঙ্গজেবের সময়ে তুর্কি ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণ রচিত হয়। এ সময়ে সাহিত্যচর্চাও অবহেলিত ছিল না। যদুনাথ সরকার বলেন, “ঔরঙ্গজেব কবিতা পছন্দ করতেন না”, কিন্তু অপর এক স্থানে তিনি উল্লেখ করেন যে, তারই বিদুষী কন্যা জেবুন্নেসার পৃষ্ঠপােষকতায় সাহিত্যক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখা সম্ভব হয়। জেবুন্নেসা একজন প্রতিভাবান কবি ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্য গ্রন্থের নাম “দিওয়ান-ই-মাকফী। আরবি ও ফারসি ভাষায় তিনি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সমস্ত কোরআন মুখস্থ করায় জেবুন্নেসা পিতার নিকট হতে ৩০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা লাভ করেন। ঔরঙ্গজেবের আমলের শ্রেষ্ঠ কবি হলেন আব্দুল কাদির বিদিল। ইনি পাটনার অধিবাসী ছিলেন। তিনি লক্ষাধিক কবিতা লিখেছিলেন। আফগানিস্তানেও তার কবিতা জনপ্রিয় ছিল। ঔরঙ্গজেবের উৎসাহে কাশ্মীরে মােল্লা শফিউদ্দিন আরবি গ্রন্থ ‘তাফসির-ই-কবীর’ ফারসিতে অনুবাদ করেন। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে যে সমস্ত প্রখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচিত হয় তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য—‘ফতােয়া-ই-আলমগীরী’, ‘মুনতাখাব-আল-জেবুর’, ‘আলমগীরনামা, ‘মাসের-ই-আলমগীরী’, ‘তারিখ-ই-দিলকুশা’, ‘খুলাসাত-উৎ-তাওয়ারিখ।’ ঔরঙ্গজেবের লিখিতপত্র ও নথিপত্র ‘আদব-ই-ঔরঙ্গজেব’ নামে সংকলিত হয়েছে। সুতরাং ঔরঙ্গজেবকে যাঁরা সৃজনশীল শিল্প সাধনার বিরােধী বলে মনে করেন, এসব ঘটনা তাঁদের ধারণার বিরুদ্ধে যায়।
মেলা নিষিদ্ধকরণের বিষয়টিও বলা দরকার। ১০৭৯ হিজরীতে বুরহানপুরে পবিত্র মহররম উপলক্ষে তাজিয়া বের হয়। এই তাজিয়াকে কেন্দ্র করে দু’দলের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে এক গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। পরিণামে বিরাট হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সংঘটিত হয়। এই সংবাদ শুনে সম্রাট ঔরঙ্গজেব এক আদেশ দ্বারা মহররম উপলক্ষে তাজিয়া বের করা নিষিদ্ধ করে দিলেন। কাফি খান তাঁর ‘মুন্তাখাব-উল-লুবাব’ গ্রন্থে৪৮ এই গণ্ডগােলের বিবরণ দিয়েছেন। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সম্রাট হিন্দুদের মেলাও বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু বিদ্বেষী ঐতিহাসিকের দল প্রচার করে বসলেন যে, তিনি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই এমন করেছেন।
ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতি তথা হিন্দুদের প্রতি নীতিকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ হিসাবে দায়ী করা অনৈতিহাসিক। সতীশচন্দ্র লিখেছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণে পুষ্ট আধুনিক মানসিকতায় ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির কোনও কোনও অংশ যতই অবাঞ্ছনীয় ও প্রগতি বিরােধী মনে হােক না কেন, বাস্তবধর্মী ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবার সময় কার্য ও কারণের ব্যবধানকে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না।৪৯ মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার কারণ হল সামাজিক অবক্ষয় অর্থাৎ এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যখন সমাজ আর আর্থিক দিক থেকে অগ্রসর হতে পারছিল না। তাছাড়া মুঘল যুগে কৃষিজ উদ্বৃত্ত সম্পদের বেশিরভাগ ব্যয় হত রাজপুরুষদের বিলাস-ব্যসনে, যুদ্ধ বিগ্রহে নতুবা সিন্দুকবন্দী হয়ে পড়ে থেকেছে, পুনর্বিনিয়ােগযুক্ত হয়ে অর্থনীতির কাজে লাগেনি। মুঘল অর্থনীতির ধনতন্ত্রের স্তরে উত্তরণ ঘটেনি।৫০ সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, মুঘল সাম্রাজ্য পতনের জন্য ঔরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতা বা হিন্দুবিদ্বেষী নীতি দায়ী নয়, দায়ী আঠারাে শতকের পরিবেশ।
(৬)
কর্মচারীদের প্রতি পক্ষপাতশূন্য অভিব্যক্তি ঔরঙ্গজেবের বহু পাণ্ডুলিপিতে বিস্তৃত। হয়েছে। একদা কোনাে এক ব্যক্তি ঔরঙ্গজেবকে এই মর্মে দরখাস্ত করে যে, হিন্দু রাজা ও অন্যান্যরা যারা সরকারি কাজে নিযুক্ত রয়েছে তাদের স্থানে মুসলিম কর্মচারী নিয়ােগ করা হােক। প্রত্যুত্তরে নিরপেক্ষ ঔরঙ্গজেব বললেন: “এইসব জাগতিক ব্যাপারের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কী? প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়ােজন কী? তােমার জন্য তােমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম। যদি (তােমাদের কথা মতাে) এই নিয়ম চালু করা হয়, তাহলে আমায় তাে সকল (হিন্দু) রাজা ও তাদের অনুগামীদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে।”৫১ আর এক চিঠিতে তিনি ঘােষণা করেন :
“কারাে ধর্ম নিয়ে আমাদের কি চিন্তা থাকতে পারে? যীশুকে তার ধর্ম অনুসরণ করতে দাও, আর মােজেসকে তার নিজের ধর্ম।” আসলে আবুল ফজলের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের মূলনীতিগুলি যে মুঘল রাষ্ট্রনীতিতে স্থায়ীভাবে স্থান পেয়েছিল তা আরও প্রমাণিত হয় ‘আখাম-ই-আলমগিরি’-তে৫২ সংরক্ষিত ঔরঙ্গজেবের পত্রাবলীর অন্তর্গত এমন সব বিভিন্ন উক্তি থেকে। একটি কৌতুহলােদ্দীপক দলিলও উদয়পুরের নথি থেকে আলােয় এসেছে। এটি একটি নিশান৫৩ বা রাজাদেশ, ঔরঙ্গজেব যা মেবারের রাণা রাজসিংহকে পাঠিয়েছিলেন। এতে পরমত সহিষ্ণুতার ছাপ ছিল।
ঔরঙ্গজেবের সময় বাংলার হিন্দুদেরকে বড় বড় পদমর্যাদা, জায়গীর ও বড় বড় জমিদারী দেওয়া হয়। গভর্ণর, গভর্ণর জেনারেল পদ পর্যন্ত দেওয়া হয়, এমনকি মুসলমান প্রদেশ আফগানিস্তানেরও উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন একজন রাজপুত। আসলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় তিনি কারও চেয়ে কম ছিলেন না। অমুসলিম রসিকলাল ছিলেন সম্রাটের অতি বিশ্বাসভাজন। আর এই কারণে ঔরঙ্গজেব তাকে রাজস্ব বিভাগের সর্বোচ্চ পদে বসিয়েছিলেন। রাজস্ব বিভাগে মুন্সীর পদগুলি হিন্দুদের একচেটিয়া ছিল বলা যায়। এর কারণ, যাতে কর আদায়ের নামে হিন্দু সম্প্রদায় কোনােভাবে অত্যাচারিত না হয়। পুলিশ বিভাগ, গুপ্তচর বিভাগ প্রভৃতি বিভাগেও হিন্দু কর্মচারীর সংখ্যা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হত। রাজকার্যে হিন্দু নিয়ােগের ব্যাপারে ঔরঙ্গজেবের উদারতা ছিল দেখার মত। সাকি মহম্মদ মুস্তাইদ খান রচিত ‘মাসের-ই-আলমগিরি’ গ্রন্থে উল্লেখিত সাধারণ পদাধিকারী ও সেনানায়কদের নাম বাদে যে সমস্ত হিন্দু ঔরঙ্গজেবের সময়ে পদস্থ কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন—রাজা ভীম সিং (উদয়পুরের মহারাণা রাজসিংহের পুত্র, ৫ হাজারী), ইন্দ্র সিং (মহারাণা জয়সিংহের ভ্রাতা, ৩ হাজারী), বাহাদুর সিং (মহারাণা জয়সিংহের ভ্রাতা, দেড় হাজারী), রাজা মান সিং (ফৌজদার), অচলাজি (শিবাজীর জামাতা, ৩ হাজারী), আরজুজী (শিবাজীর পুত্র শম্ভুজীর আত্মীয়, ৫ হাজারী), মাজী (২ হাজারী), রাও অনুপ সিং (খেলাত), রাজা অনুপ সিং (দূর্গরক্ষক), রাজা উদিয়াত সিং (ফৌজদার, আড়াই হাজারী), উদয় সিং (সাড়ে তিন হাজারী), বাসুদেব সিং (তিন হাজারী), কাথুজী (৪ হাজারী), সরসাল বুন্দিয়া (দূর্গরক্ষক), বসন সিং (দেড় হাজারী), রামাদ (আড়াই হাজারী), লােকচঁাদ (খেতাব), ভাগু বানজারা (৫ হাজারী), জাকিয়া (৩ হাজারী), রূপ সিং (এক হাজারী), সুভান (৫ হাজারী, খেলাত, নাকাড়া), শিব সিং (দেড় হাজারী), আন্ধাতা (দুর্গরক্ষক) , কিশাের দাস (দূর্গরক্ষক), রাজা কুলিয়ান (এক হাজারী) প্রমুখ।৫৪
এই তালিকায় আরও কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। সর্বাগ্রে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, উদয়পুরের মহারাণার পুত্র ও ভ্রাতাও এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মারাঠিধিপতি শিবাজীর কতিপয় স্নেহভাজন ও আত্মীয়-স্বজনের নামও এতে পাওয়া যাচ্ছে।৫৫ এঁরা শুধু নামমাত্র পদধারী ছিলেন না, বরং তারা ঔরঙ্গজেবের হয়ে মরণপণ যুদ্ধ করতেন। এঁদের মধ্যে সকল রকম পদের লােকই ছিলেন। অর্থাৎ সৈন্য বিভাগেরও ছিলেন, শাসন বিভাগেরও ছিলেন। চিন্তা করে দেখুন, সৈন্যদলের নেতৃত্ব, দূর্গরক্ষক, জেলাসমূহের নাজিমের পদ ও ফৌজদারী ইত্যাদি অপেক্ষা অধিকতর দায়িত্বপূর্ণ পদ আর কি হতে পারে? অথচ এ সমস্ত দায়িত্বশীল পদে হিন্দুরা অধিষ্ঠিত ছিলেন। ঔরঙ্গজেবের চরম অনুদারনীতির সময়েও বুদি ইত্যাদি এলাকার রাজপুত ও অন্যান্য এমনকি হিন্দুরা ব্যাপকভাবে ওরঙ্গজেবকে সাহায্য করে এবং দুর্গাদাস নিজে ঔরঙ্গজেবের কাছে মনসব’ গ্রহণ করেন। এই সমস্ত ঘটনাবলী পর্যালােচনা করে ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “রাজপুতগণ আলমগীরের সাহায্যকল্পে একটা অঙ্গুলি প্রদর্শন করতেও ইচ্ছা করেনি।”৫৬
অথচ ইউরােপীয় ঐতিহাসিকগণ তাদের চিরাচরিত অভ্যাসমত প্রচার করে থাকেন যে, ঔরঙ্গজেব সমস্ত হিন্দুদের জন্য সরকারি চাকরির দ্বার রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন৫৭, যদিও তা পারেননি। কিন্তু আসল ব্যাপার শুধু এইটুকু যে, ১০৮২ হিজরীতে তিনি সুবাদার ও তায়াল্লকদারদের এই হুকুম জারী করেছিলেন যে, পেশকার ও দেওয়ান এবং বিশেষ মহলের খাজানা ও ট্যাক্স আদায়কারী পদসমূহে যেন হিন্দুদেরকে নিয়ােগ করা না হয়। কাফি খান লিখছেন, “সুবাদার এবং তায়াল্লকদারগণ যেন পেশকার ও দেওয়ান পদে হিন্দুদেরকে অপসারণ করে মুসলমানদের ভর্তি করেন এবং ট্যাক্স আদায়ের জন্য বিশিষ্ট মহলগুলােতেও মুসলিম কর্মচারী নিয়ােগ করেন।”৫৮
এটা সুবিদিত যে, ওই সমস্ত পদে হিন্দু কায়স্থরাই অধিকাংশ নিযুক্ত হত, যাঁরা ঘুষ গ্রহণে নামকরা ছিল। ধর্মীয় স্বাতন্ত্রের সঙ্গে বাদশাহর এই আদেশের কোনাে সম্পর্কই ছিল না। তাছাড়া এই আদেশটাও বেশিদিন বলবৎ রইল না। ওটাকে সংশােধন করা হল এইভাবে, একজন পেশকার হিন্দু আর একজন পেশকার মুসলমান নিযুক্ত থাকবে। কাফি খান লিখেছেন, “এটাই স্থিরিকৃত হল যে, সমস্ত দেওয়ানী দফতরের পেশকার এবং সরকারের বখশী পদসমূহে একজন পেশকার মুসলমান ও একজন পেশকার হিন্দু নিয়ােজিত হবে।”৫৯ এই ব্যবস্থা গ্রহণের পেছনে হিন্দুদের ঘুষ গ্রহণ ও অসদুপায় অবলম্বনের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করা ছাড়া আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? অন্যথায় সামাজিক বা ধর্মীয় রেষারেষিই যদি এর কারণ হত তাহলে হিন্দুদেরকে যুক্তভাবে নিয়ােগ করবার অর্থই বাকি?
শুধু তাই নয়, এমন কোনাে বিভাগ ছিল না যে বিভাগে সম্ভব সত্ত্বেও হিন্দু কর্মচারী নিয়ােগ করা হয়নি। এমনকি ঔরঙ্গজেব আইন জারী করেছিলেন যে, প্রত্যেক বিভাগে হিন্দু কর্মচারী নিয়ােগ করা আবশ্যক। ঔরঙ্গজেব হিন্দু বিরােধী হলে, তার বিরুদ্ধে কেবল হিন্দুরাই বিদ্রোহ করত। কিন্তু উত্তরপশ্চিমের ইউসুফ জাই ও আফ্রিদি প্রভৃতি পাঠান উপজাতি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। মারাঠা ও পাঠান বিদ্রোহে আঞ্চলিক স্বাধীনতার লক্ষ্য কাজ করে। তাছাড়া কুশল খান, আকমল খান প্রভৃতি বিদ্রোহীদের তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। বিজাপুর গােলকোণ্ডায় তাে হিন্দু রাজা ছিলেন না। ছিলেন মুসলিম সুলতান। বিদ্রোহ দমন করে ঔরঙ্গজেব ওই রাজ্য দুটি দখল করেন। তিনি হিন্দু-বিদ্বেষী হলে হিন্দু-শিবাজীর সঙ্গে যুদ্ধে রাজপুত সেনাপতি জয়সিংহকে পাঠাতেন না। আমরা এও জানি, তিনি তাঁর হিন্দু ওমরাহদের স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্মাচরণের সুযােগ দিয়েছিলেন। এই ‘হিন্দু-বিদ্বেষী’ সম্রাট বন্দী শিবাজীর কথামতাে তাঁর রাজ্য মহারাষ্ট্রে ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য ঝুড়িতে করে মণ-মণ মিঠাই পাঠিয়েছিলেন। তাঁর এই উদারতা ঐতিহাসিক লেনপুলকেও মুগ্ধ করেছিল।৬০
ইতালীয় চিকিৎসক ডাঃ কারিরী, যিনি দাক্ষিণাত্যে ১৬৯৫ সালে ঔরঙ্গজেবের দর্শনলাভ করেছিলেন, তিনি ঔরঙ্গজেবকে তার ৭৮ বছর বয়সে দেখেছিলেন। তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা হল: “তিনি পরিষ্কার সাদা ধবধবে মলমলের পােশাক পরে বার্ধক্যের যষ্ঠি হাতে করে আমিরদের দলে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর উষ্ণীষে জমরুদের একটা বড় টুকরা জুলজুল করছিল। তিনি বিচারপ্রার্থীদের দরখাস্তগুলাে গ্রহণ করলেন এবং চশমা ব্যতিরেকেই তা পাঠ করে স্বহস্তে দস্তখত করতে লাগলেন। তার সৌম্য ও প্রসন্নমূর্তিতে। স্বতঃতই প্রতীয়মান হত যে, তিনি তার কর্মব্যস্ততার জন্য অত্যন্ত আনন্দবােধ করতেন।”৬১ তিনি দিনে দুই-তিনবার আম-দরবার করতেন, কারও জন্য আদৌ কোনাে বাধা-নিষেধ ছিল না। নগণ্যতম ব্যক্তিও সম্রাট সমীপে নিজ বক্তব্য পেশ করতে পারত।
ঔরঙ্গজেব ১০৮২ হিজরীতে এক আদেশ৬২ জারি করলেন যে, জেলায় জেলায় সরকারি প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হােক এবং সর্বসাধারণকে জানিয়ে দেওয়া হােক যে, স্বয়ং বাদশাহর বিরুদ্ধেও যাঁরই যে কোনাে অভিযােগ থাক না কেন, সে তা পেশ করতে পারবে এবং সরকারি প্রতিনিধি তার কৈফিয়ত প্রদান করবেন। দাবী প্রমাণিত হলে সরকারি প্রতিনিধির কাছ থেকে অধিকার আদায় করা যাবে। ঔরঙ্গজেবের পূর্বে এমন বেনজির কোনাে ব্যবস্থাই প্রবর্তিত ছিল না।
(৭)
শিখ গুরু তেগবাহাদুর ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করার জন্য ঔরঙ্গজেব শিখগুরুর প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করেন বলে অনেক ঐতিহাসিক লিখেছেন। একথা ইতিহাসবর্জিত। তেগবাহাদুর সম্পর্কে ঔরঙ্গজেবকে বৃথা দোষারােপ করা হয়। পূর্বাপর ঘটনা অজানার ফলে এই ধরনের ভুল ব্যাখ্যা জিজিয়ার মতই ঔরঙ্গজেবকে ঘিরে দানা বেঁধে ওঠে। ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র বলেন, “তেগবাহাদুরের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব শিখদের প্রতি অবিমিশ্র শত্রুতার মনােভাব নেননি। বরং তাদের আভ্যন্তরীণ বিরােধে হস্তক্ষেপে অনীহা ও তাদের ধর্মের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শনের আভাসই আছে। মনে হয়, পাল্টা কর গ্রহণের প্রতি ঔরঙ্গজেবের দৃঢ় মনােভাব, পাঞ্জাবে শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রশ্ন এবং তেগবাহাদুরের বিরুদ্ধে মুঘল দরবারে তার বিরােধী দলগুলির ষড়যন্ত্রই তেগবাহাদুরের মৃত্যুর কারণ।”৬৩ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার গ্রন্থে৬৪ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, ঔরঙ্গজেব ও তেগবাহাদুরের দ্বন্দ্ব মূলত রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়। এই দুই গবেষকের গবেষণায় জানা যায়, তেগবাহাদুরের ইসলামে ধর্মান্তরের বানানাে কাহিনির জন্য কিছু ঐতিহ্যবাদী ঐতিহাসিকের অবৈজ্ঞানিক ইতিহাসচর্চা দায়ী।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ১৬৮৯ সালে ঔরঙ্গজেব শিবাজীর পৌত্র শাহুজীকে গ্রেপ্তার করেছিলেন (একই সঙ্গে শাহুজীর পরিবারের আরও অনেকে বন্দি হয়। মুঘলেরা বন্দি স্ত্রীলােকদের সঙ্গেও অত্যন্ত সদ্ব্যবহার করে)। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। ঔরঙ্গজেব তাঁকে নিজ তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন এবং তার উপযুক্ত শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাদশাহী ক্যাম্প সংলগ্ন স্থানে তার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। বয়ঃপ্রাপ্তি হলে তার সঙ্গে সম্মাননীয় পরিবারের দুটি মারাঠা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর শাহুজীকে সাত হাজারী মনসব, ‘রাজা’ উপাধি ও পতাকা দান করেছিলেন সম্রাট ঔরঙ্গজেব। শুধু তাই নয়, তার বিশেষ অবস্থানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য শাহুকে ঔরঙ্গজেব শিবাজীর স্বরাজ্য ও দাক্ষিণাত্যে ‘সরদেশমুখী’ কর আদায়ের অধিকার দিতে পর্যন্ত প্রস্তুত ছিলেন। এভাবে শাহুজী দিল্লির মুঘল দরবারে বহু বছর অতিবাহিত করেন ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু (১৭০৭) পর্যন্ত। কিন্তু সুযােগ পেয়েও ঔরঙ্গজেব তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেননি। বরং শাহুজী ঔরঙ্গজেবের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছে।
পাশাপাশি মহামতি অশােকের (খ্রিঃপূঃ ২৭৩-২৩২) কথা ভাবুন। সমস্ত ঐতিহাসিকেরা তার ধর্মীয় উদারতার প্রশংসা করেছেন। যেন কোনাে অনুদার দিক তাঁর জীবনে পাওয়া যায় না। অশােকের অসহিষ্ণুতার কিছু দিক আমরা তুলে ধরতে পারি—
- ১. তিনি নিজের ৯৯জন ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেন ও ‘চণ্ডাশােক’ উপাধি পান।
- ২. খ্রিঃ পূঃ ২৬০-এ অশােক কলিঙ্গ রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে রাজ্যটি প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এই যুদ্ধে ১লক্ষ লােক মারা যায় ও দেড় লক্ষ লােক নির্বাসিত হয়। পরে অবশ্য অশােকের মনে অনুশােচনা দেখা দেয়। কিন্তু এই ধ্বংসকাণ্ডকে অসহিষ্ণুতার দিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না? তাছাড়া অহিংস অশােক ওই দেড় লক্ষ নির্বাসিতদের প্রতি কি পরে কোনােরকম উদারতা দেখিয়েছিলেন?
- ৩. কলিঙ্গ লিপিতে অশােক ধর্মমহামাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করে দেন—“তােমরা এভাবে কর্তব্য সম্পাদন করাে এবং আমার প্রতি তাদের (প্রান্তবাসীদের) মনে আস্থা জন্মাও যেন তারা এই বিশ্বাস করে যে রাজা তাদের পিতার মত, রাজার নিজের প্রতি যে অনুকম্পা, তাদের প্রতিও তেমন এবং তারা রাজার সন্তানতুল্য।”৬৫ অশােক এখানে বর্বর প্রান্তবাসীদের জয় করতে চেয়েছেন যুদ্ধের পরিবর্তে ভালােবাসা দিয়ে। তবে এটাও পরিষ্কার যে, প্রয়ােজন হলে বলপ্রয়ােগে অশােক পিছপা হবেন না। সেকথাও ১ নম্বর। কলিঙ্গ অনুশাসনে বলা হয়েছে—“রাজার ঋণ শােধ করতে সচেষ্ট হও, তা না হলে রাজা সন্তুষ্ট হবেন না—পরিণতিতে মহাদুঃখ।৬৬ কোনাে শিলালিপিতে অশােক সেনাবাহিনী হ্রাস করার কথা লেখেননি। গুরুত্বপূর্ণ ১৩ নম্বর প্রস্তরলিপিতে অশােকের চিত্ত পরিবর্তন ও ধর্ম বিজয়ের আদর্শের কথা উকীর্ণ আছে। সেখানেও রাজা বলছেন, তিনি অনুতপ্ত, তথাপি তার শাস্তি দেবার ক্ষমতা আছে। তারা দুষ্কর্ম থেকে বিরত হােক এবং শাস্তিভােগ করুক।’৬৭ অর্থাৎ অশােক কখনই শাস্তি দেবার ক্ষমতা পরিত্যাগ করেননি। পাশাপাশি তিনি জনগণকে ধর্মান্তরিত করার জন্য সরকারিভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছিলেন। অথচ ঔরঙ্গজেবের কথা ভাবুন, তার ভারত রাষ্ট্র কখনও ধর্ম প্রচারে আগ্রহ দেখায়নি।
(৮)
মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসে ঔরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত ধর্মনীতির দ্বারা তার রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা কতটা প্রভাবিত হয়েছিল, তা বর্তমানে বিতর্কের সূচনা করেছে। এর প্রধান কারণ আকর সুত্রসমূহ বিশ্লেষণ না করে গ্রন্থ রচনা। ভারতীয় লেখকগণ সমকালীন ও প্রায় সমকালীন আরবি-ফারসি সূত্ৰসমূহ ব্যবহার না করে পূর্বসূরি ইউরােপীয় লেখকদের ইংরেজি গ্রন্থ অনুসরণ করেছেন। ইউরােপীয় পর্যটক ও লেখকগণ আরবি ফারসি গ্রন্থের বক্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তাদের বিবরণগুলি ও গ্রন্থগুলি খুঁটিয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ না করে গৃহীত হওয়ায় ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে বিতর্ক আরও জোরালাে হয়েছে। তাছাড়া যদুনাথ সরকার ও শ্রীরাম শর্মার মতাে প্রখ্যাত ঐতিহাসিকরাও আকর উপাদানগুলি যথাযথ ব্যবহার না করায় চরম ঐতিহাসিক সত্য বহু ক্ষেত্রে বিকৃত হওয়ার সুযােগ পেয়েছে।৬৮
উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার প্রাক্কালে পরাধীন ভারতবর্ষে ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দে শ্রীরাম শর্মা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের পথ অনুসরণ করেই তাঁর বিখ্যাত পূর্বোক্ত গ্রন্থটি লেখেন। তখনও পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণাধর্মী তথ্যনির্ভর বই একটিও ছিল না। সঙ্গত কারণেই শ্রী শমার কাজটি বহু বছর ধরে বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আদৃত হয়েছে। বর্তমানে মধ্যযুগের ইতিহাসের প্রখ্যাত গবেষক মহম্মদ আতাহার আলি গ্রন্থটি সমীক্ষা৬৯ করে বলেছেন, বইটির অন্যান্য অংশের মতাে ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে আলােচনার শেষে সংযােজিত টীকাগুলিতেও বড় রকমের ভুল ও অসঙ্গতি থেকে গেছে। আমাদের জানানাে হয়েছে, ঔরঙ্গজেবের শাসনের শেষ দিকে শিখদের গণহত্যা করার জন্য ঢালাও হুকুম দেওয়া হয়েছিল।৭০ এবং এই প্রসঙ্গটি নাকি ‘মাসের-ই-আলমগিরি’তে৭১ উল্লেখ রয়েছে। অথচ ‘মাসির-ই-আলমগিরি’তে শিখ গণহত্যার কোনাে উল্লেখ নেই। অন্য কোনাে সূত্র থেকে রাম শর্মা এটা পেয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু তারও উল্লেখ নেই। অন্য আরও অনেক ভুল তথ্য আছে যেগুলি সংশােধন হওয়া প্রয়ােজন। আগ্রার একটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জনৈক শিখ কর্তৃক সম্রাটকে পাথর ছোঁড়ার উল্লেখ করা হয়েছে, যেটির উল্লেখ শ্ৰী শৰ্মা পরেও করেছেন এবং ১৬৯৩-এর সংবাদপত্রাবলির (নিউজ লেটারস) মতাে অবিশ্বাস্য সূত্র উদ্ধৃত করেছেন।
যদুনাথ সরকারের মতাে জাতীয় ঐতিহাসিক ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ায় তাঁর আলােচনায় মূল ইতিহাসের অন্যান্য দিক যেমন-অর্থনৈতিক সংকট, জায়গীরদারি সংকট, মনসবদারি সংকট, কৃষি সংকট, অভিজাতদের দল ও রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়গুলি উপেক্ষিত হয়েছে। ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকদের গুরুত্বপূর্ণ অভিযােগ যে, তিনি সিংহাসনে বসে তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মনীতিকে রাষ্ট্রের নীতিতে প্রয়ােগ করে মহাভুল করেন। দরবারে ঔরঙ্গজেব যে সমস্ত ইসলামীয় নীতি প্রয়ােগ করেছিলেন স্যার যদুনাথ সরকার তার বিবরণ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে স্যার যদুনাথ ব্যবহার করেছেন ঔরঙ্গজেবের দরবারের অনুমােদিত ইতিহাস আলি মুহাম্মদ খানের ‘মিরাতউল-আহমদি’ ও কাফি খানের পূর্বোক্ত রচনা ‘মুনতাখাব-উল-লুবাব’। যদুনাথের মতে, আকবর ভারতবর্ষে যে সহনশীল ও নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা থেকে ঔরঙ্গ জেব প্রত্যাবর্তন করে মুঘল সাম্রাজ্যকে একটি ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তাঁর মতে, মুসলিম ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রে হিন্দুরা জিম্মি’৭২ বলে পরিগণিত অথাৎ হিন্দুরা যেহেতু মুসলিম রাষ্ট্রে প্রকৃত নাগরিক ছিল না, তাই ঔরঙ্গজেব তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করেন। তিনি হিন্দুদের প্রতি এই বৈষম্য-নীতি অবলম্বন করায় তাঁকে চরম বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়। উপরােক্ত ঐতিহাসিকরা ঔরঙ্গজেবের গোঁড়া মতবাদকে দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখিয়েছেন যে, তিনি তাঁর জন্ম বা অভিষেক বার্ষিকীতে উৎসব সমারােহ বন্ধ করে দেন। পূর্বে জন্মদিনে সম্রাটকে ধনরত্ন দ্বারা অভিনন্দনের যে রীতি৭৩ ছিল, তা তুলে দেন এবং তাঁর নির্দেশে ‘নওরােজ’ বা নববর্ষের উৎসব, যা ছিল শুধু বিলাসিতা ও অহংকার প্রদর্শনের নামান্তর, বন্ধ হয়ে যায়। দরবারে। রাজকর্মচারীদের মধ্যে মদ্যপানের নিয়মিত রমরমিয়ে আসর বসত, তিনি কঠোর হাতে এই মদ্যপান নিষিদ্ধ করেন। তিনি দরবারে জুয়াখেলাও নিষিদ্ধ করেন।৭৪ আসলে জনগণের নৈতিক চরিত্রের উন্নতিসাধনের জন্য তিনি খুবই সচেষ্ট ছিলেন। ‘মুহতাসিব’ নামক রাজকর্মচারী জনগণের নৈতিক চরিত্রের দিকে লক্ষ্য রাখতেন। এই কর্মচারীদের। দায়িত্ব ছিল প্রকাশ্যে যাতে মদ বা অন্যান্য নেশাদ্রব্য (যেমন- ভাঙ) খাওয়া না হয়, তা তদারকি করা। তারা নিষিদ্ধপল্লী জুয়ার আড্ডা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাপের ক্ষেত্রে বাটখারা পরীক্ষা করার দায়িত্বেও ছিলেন। অন্যদিকে তিনি জ্যোতিষীদের দিয়ে কোষ্ঠী বিচার করার পূর্বের নিয়ম বন্ধ করারও আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই আদেশ কেউ মান্য করেনি, এমনকী মুঘল রাজপরিবারের লােকজনেরাও। এক্ষেত্রে কিন্তু ‘গোঁড়া’ ঔরঙ্গজেব বল প্রয়ােগের পথে যাননি।
ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধতার গুরুতর অভিযােগ এনেছেন শ্রীরাম শর্মা তাঁর বিখ্যাত পূর্বোক্ত গ্রন্থে। তিনি বলেছেন, ঔরঙ্গজেবের সময়ে হিন্দু-কর্মচারীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছিল এবং তিনি হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। রাজপুতদের সঙ্গে বিরােধও ঔরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতার দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই গ্রন্থে। কিন্তু প্রখ্যাত গবেষক আতাহার আলি ফারসি সূত্রসমূহ ব্যবহার করে বলেছেন যে, শ্রীরাম শর্মা সরকারি চাকরিতে হিন্দুদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে হ্রাস। পেয়েছিল বলে যে যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন, তা প্রশ্নাতীত নয়।৭৫ তিনি এই অনুমান থেকে শুরু করেছেন যে, ঔরঙ্গজেবের আমলে মনসবদারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছিল। ‘১৬৫৭-তে শাহজাহানের আমলে সাকুল্যে ৮০০০ মনসবদার ছিল, সেখানে ১৬৯০-তে মনসবদারের সংখ্যা হয় ১৪,৫৫৬।৭৬ প্রথম সংখ্যাটির সূত্র হিসেবে ওয়ারিস (পাণ্ডুলিপি) থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, যদিও লাহােরি বলেছেন ১৬৪৭ সালেই ওই সংখ্যক মনসবদার ছিল। ১৬৯০ সালের মনসবদার সংখ্যার সূত্র হিসেবে ‘জওয়াবিৎ-ই-আলমগীরী’-র উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু ওই গ্রন্থের মূলপাঠ থেকে দেখা যায় তথ্যটির মারাত্মক ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ‘জওয়াবিৎ-ই-আলমগীরী’-তে আছে ‘উচ্চপদস্থ ওমরাহ, দরবারের কর্মচারী দুই-ঘােড়ার সওয়ার, গােলন্দাজ ও ভৃত্যবর্গ (অহদী)’ অর্থাৎ মনসবদার, নিম্নপদস্থ অশ্বারােহী সৈনিক এবং অন্যান্য কর্মচারী যাঁদের সম্রাটের কোষাগার থেকে সরাসরি বেতন দেওয়া হত তাঁদের সংখ্যা ছিল ১৪,৪৪৯ (১৪,৫৫৬ নয়)। ১৬৪৭ সালের যে সংখ্যা লাহােরি উল্লেখ করেছেন—তার সঙ্গে এটির মিল আছে—“৮০০০ মনসবদার এবং ৭০০০ অহদী ও ঘােড়সওয়ার গােলন্দাজ, অর্থাৎ মােট ১৫০০০।৭৭ তাহলে মনসবদারের সংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে শ্রীশৰ্মা যা বলেছেন, তা কোথায় হয়েছে? এবং মনসবদারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছিল, শর্মার এই অনুমান যদি ভ্রান্ত হয় তাহলে তার পরবর্তী যুক্তি (পৃ. ১১৯), যে হিন্দু মনসবদারের সংখ্যা বেশি হলেও শাহজাহানের আমলে যত ছিল তার দ্বিগুণ হয়নি, একেবারেই তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার ১১৯ পৃষ্ঠায় তিনি ঔরঙ্গজেবের হিন্দু মনসবদারের সংখ্যা দিয়েছেন ১৪৮, কিন্তু পরিশিষ্টে৭৮ ১৬০ জনের নাম-তালিকা পেশ করেছেন, এবং এই তারতম্যের কোনাে ব্যাখ্যা দেননি। আবার ওই তালিকাটিও অসম্পূর্ণ, এটিকে অনেকটাই বর্ধিত করা যেতে পারে। কাজেই, ঔরঙ্গজেবের আমলে হিন্দু আমিরের সংখ্যা আপেক্ষিকভাবে হ্রাস পেয়েছিল, এই ধারণার কোনাে ভিত্তিই নেই—অন্তত শ্রী শর্মা যে সমস্ত তথ্যসূত্র দিয়েছেন সেগুলিকে প্রামাণ্য ধরলে। আতাহার আলি দেখিয়েছেন যে, আকবরের সময়ে (১৫৯৫) মুঘল দরবারের মােট ৯৮ জন মনসবদারদের মধ্যে হিন্দু ছিলেন ২২ জন; এই সময়ে বড় অভিজাত বা মনসবদারদের (৫০০০ ও তদূর্ধ্ব) মধ্যে হিন্দু ছিলেন মাত্র একজন। শাহজাহানের সময়ে (১৬২৮-৫৮) ৪৩৭ জন মনসবদারদের মধ্যে মােট হিন্দু ছিল ৯৮ জন আর বড় মনসবদারদের মধ্যে হিন্দু ছিলেন ১২ জন। ঔরঙ্গজেবের প্রথম পর্বে (১৬৫৮-৭৮) ৪৮৬ জনের মধ্যে হিন্দু মনসবদারদের সংখ্যা ছিল ১০৫ জন, দ্বিতীয় পর্বে (১৬৭৯-১৭০৭) ৫৭৫ জনের মধ্যে হিন্দু মনসবদার ছিলেন ১৮২ জন।৭৯ আতাহার আলি আরও দেখিয়েছেন যে, ১৬৫৮-১৬৭৮ পর্বে ঔরঙ্গজেবের সময়ে ৫১জন বড় অভিজাতের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ১০ জন। কিন্তু ১৬৭৯-১৭০৭ পর্বে ৭৯ জন বড় অভিজাতের মধ্যে হিন্দু ছিলেন ২৬ জন।৮০ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ঔরঙ্গজেবের আমলে হিন্দু কর্মচারীর (নিম্ন বা উচ্চ শ্রেণি) সংখ্যা ক্রমবর্ধমান ছিল।
আতাহার আলি বলেছেন, সেইসব অভিমতের বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে যেগুলির খুব একটা ইতিহাসগত ভিত্তি নেই। যেমন, এই অভিমতটি—ঔরঙ্গজেবের নীতি ছিল রাজপুত বিরােধিতা। বাস্তবে ঔরঙ্গজেবের সময়ে রাজপুত বিরােধিতার তেমন নজির নেই। ১৬৭৯-৮০ সালের রাজপুত বিদ্রোহের কারণগুলি সমসাময়িক বিবরণের পার্থক্য ও আধুনিক মতভেদের ফলে অস্পষ্ট রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আজমীরের সংবাদদাতা কর্তৃক উল্লিখিত ‘ওয়াকা-ই-আজমীর’-এর বিবরণগুলি এই সময়ের প্রকৃত তথ্যের উপর দৃষ্টিপাত করে। ফলে ঔরঙ্গজেব ও রাজপুতদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃত স্বরূপ উন্মােচিত হয়েছে।৮১ বরং রাজপুতরা সম্রাটের নেকনজরেই ছিল। প্রমাণ হিসাবে আতাহার আলি তাঁর ‘দ্য মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব’ গ্রন্থে বলেছেন, ১৬৫৮-৭৮ পর্বে মােট ৪৮৬ জন মনসবদারদের মধ্যে রাজপুত ছিলেন ৭১জন আর ১৬৭৯-১৭০৭ পর্বে ৫৭৫ জনের মধ্যে রাজপুত ছিলেন ৭৩ জন।৮২ এমনকি তিনি দেখিয়েছেন, মানসিংহ ছাড়া মুঘল রাজদরবারে ঔরঙ্গজেবের পূর্বে কোনাে রাজপুত অফিসারকে সাত হাজার মনসব দেওয়া হয়নি। ঔরঙ্গজেব জয়সিংহ ও যশবন্ত সিংহকে ৭০০০ মনসব পদে উন্নীত করেছিলেন। সবচেয়ে বিস্ময়ের ঘটনা, ধর্মাট ও খাজওয়ার যুদ্ধে যশবন্ত সিংহের ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে ভূমিকা সত্ত্বেও তাঁকে ৭০০০ মনসবদার পদে নিয়ােগ করা হয়েছিল। আতাহার আলি আরও বলেছেন যে, রাজপুত বিদ্রোহ বলতে যদি বােঝায় সমগ্র জাতির বিদ্রোহ, তাহলে সেই অর্থে রাঠোর ও শিশােদীয়দের বিদ্রোহ ‘রাজপুত বিদ্রোহ ছিল না।৮৩ কারণ কছওয়া, হাড়া, ভাটি ও বিকানীরের রাঠোররা সকলেই মুঘল শাসনের অনুগত ছিল।৮৪ অন্যদিকে যুবরাজ আকবর নিজের জীবন বিপন্ন করে রাজপুত বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।৮৫ এমনকি ঔরঙ্গজেবের অগ্রণী আমিরদের অন্যতম বাহাদুর শাহ খান কোকলতাশও অজিত সিংহকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ঔরঙ্গজেবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।৮৬ এইসব তথ্য থেকে বলা যায়, ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের মেরুদন্ড ভাঙার জন্য হিন্দুশক্তির মূল আধার রাজপুত জাতির মেরুদণ্ড ভাঙতে চেয়েছিলেন, এমন বক্তব্য যুক্তিযুক্ত নয়। মেবার, মাড়ােয়ার যুদ্ধে ঔরঙ্গজেব সব সময় চেষ্টা করেছেন রাজপুতদের একটা বড় অংশকে তার পাশে পেতে। মেবারের রাণা জগৎ সিং বা মাড়ােয়ারের ইন্দার সিং তাঁরই হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া জয়পুরের রাজা রামসিং, মহারাণা রাজসিংহের পুত্র বাহাদুর সিং, রাজা অনুপ সিং, রাজা উদিয়াত সিং, রাজা রাজরূপ সিং, কবীর সিং, অর্ঘনাথ সিং, প্রেমদেব সিং প্রমুখেরা সম্রাটের বিশেষ অনুগ্রহভাজন ছিলেন। রাজরূপ সিংকে ঔরঙ্গ জেব এত বিশ্বাস করতেন যে, কাশ্মীরের শ্রীনগরের রাজার বিরুদ্ধে গােটা যুদ্ধটাই তার অধীনে পরিচালিত হয়েছিল। আসামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রেমদেব সিংকে তিনি বাছাই করেছিলেন। সবদিক বিচার করে একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, সম্ভবত রাজপুতদের গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক বৈরীভাব ১৬৭১-এ সংঘটিত রাজপুত বিদ্রোহের মূল উৎস ছিল।
(৯)
শ্রীরাম শর্মা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু জহিরুদ্দিন ফারুকি৮৭, পার্সিভ্যাল স্পীয়ার৮৮, সতীশচন্দ্ৰ৮৯, আতাহার আলি, ইরফান হাবিব, হরবংশ মুখিয়া, আর এম ইটন, গৌতম ভদ্র৯০ প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ তাদের গ্রন্থে ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে, ঔরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসের পিছনে ধর্মের ভূমিকা ছিল গৌণ। ঔরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসের কাহিনি কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার উপর গড়ে উঠেছে বলে মনে করেন পার্সিভ্যাল স্পীয়ার ও সতীশচন্দ্র। এটা ভাবা ভুল যে, মন্দির ধ্বংস করার জন্য কোনাে সাধারণ সরকারী আদেশ বা ফরমান জারি করা হয়েছিল।৯১ আতাহার আলি বলেছেন যে, শ্রীরাম শর্মা দেবালয় ধ্বংসের প্রশ্নে এবং হিন্দুদের প্রতি মুসলিম উলেমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে সঙ্গত কাজই করেছেন। কারণ, উলেমাগণ দৃঢ়মত পােষণ করেন যে, হিন্দুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করাই হয়নি এবং যদি কিছু হয়ে থাকে সেজন্য হিন্দুরাই দায়ী। এইরকম তর্কিত প্রশ্নে শ্রীরাম শর্মা বেশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তবুও মনে হয় যে, তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে উদাসীন থেকেছেন। যেমন, কয়েকটি হিন্দু-মন্দির ঔরঙ্গজেব অক্ষত রাখতে দিয়েছিলেন এটা স্বীকার করলেও, ওই প্রসঙ্গে জ্ঞানচন্দ্রের বহু মন্দির সংক্রান্ত দলিল, কিংবা ১৬৯৯ খ্রীস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের হরদোই জেলার গােপামাউতে ঔরঙ্গজেব কর্তৃক নির্মিত বিখ্যাত মন্দিরের কথা (বিষয়টি এ ফরাের তার ‘মনুমেন্টাল অ্যান্টিকুইটিজ অ্যান্ড ইন্সক্রিপসনস’ গ্রন্থে৯২ উল্লেখ করেছেন) শ্রীরাম শর্মা উল্লেখ করেননি। ১৬৬৯ সালে ঔরঙ্গজেব সুরাটের কাজিকে মন্দির ধ্বংস করার অভিযােগে বরখাস্ত করেন, তথ্যটি অনিরুদ্ধ রায় তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।৯৩ অথচ এমন তথ্যও শ্রীশর্মার কাছে কোনাে গুরুত্ব পায়নি।
আজমীরের সংবাদদাতার প্রতিবেদনের (১৬৭৯-১৬৮০) কথাও উল্লেখ করেছেন শ্রীরাম শর্মা। কিন্তু আকর্ষক ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেননি, যার থেকে তখনকার রাজপুতদের গােষ্ঠী রাজনীতির পরিচয় পাওয়া যায়। ওই সরকারি প্রতিবেদন অনুসারে, রাজা যশবন্ত সিংহের প্রধান মহিষী ও অন্যান্য রাঠোর সর্দাররা রাজার মৃত্যুর পর পুত্র অজিত সিংহের রাজ্যলাভের দাবি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যােধপুরের সমস্ত মন্দির নিজেরা ভেঙে ফেলতে রাজী ছিলেন।৯৪ তাঁদের শর্ত ছিল, মাড়ােয়ারের শাসক হিসেবে অজিতকে স্বীকৃতি দেবেন ঔরঙ্গজেব। ঔরঙ্গজেব কিন্তু অজিতের এই দাবি মেনে নেননি। ঔরঙ্গজেব যদি ধর্মীয় সংকীর্ণতার জন্যই অর্থাৎ বলপূর্বক হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যেই মাড়ােয়ার আক্রমণ করার কথা চিন্তা করে থাকেন, তাহলে তার পক্ষে এই প্রস্তাব মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক ছিল এবং এটাই ছিল সুবর্ণ সুযােগ। সতীশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন যে, কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন যে, ঔরঙ্গজেব নাকি অজিত সিংহকে যােধপুর ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এই শর্তে যে, অজিত সিংহকে মুঘল দরবারের মানুষ করা হবে এবং পরে তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হবে। সতীশচন্দ্রের মতে, সমসাময়িক কোনাে সূত্রে এই ধরণের তথ্য পাওয়া যায় না।৯৫
রাণা রাজসিংহের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের সম্পর্ক ভালাে ছিল না। এই অবস্থায় মাড়ােয়ার সমস্যা রাজসিংহকে মুঘল বিরােধিতায় প্রণােদিত করে। তিনি রাজপুতদের উত্তরাধিকার সমস্যায় ঔরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত বলে মনে করেন। অন্যদিকে অজিত সিংহের মা ছিলেন মেবারের রাজকন্যা। তাই এই সমস্যায় তার পক্ষে নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ঔরঙ্গজেব কর্তৃক জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন ও মন্দির ভাঙার নীতি মেবারের রাণার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। সতীশচন্দ্র অবশ্য উভয় বক্তব্য বিরােধিতা ও যুক্তির বিরােধিতা করেছেন। তাঁর মতে, রাজসিংহ ঔরঙ্গজেবের হিন্দুনীতির বিরােধিতা ও প্রতিবাদ করেছিলেন, এমন কোনাে প্রমাণ নেই।৯৬ অন্যদিকে সতীশচন্দ্র আরও উল্লেখ করেছেন যে, অজিত সিংহের মায়ের সঙ্গে রাজসিংহের কোনাে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। অর্থাৎ কোনাে ব্যক্তিগত কারণে তিনি এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেননি। সতীশচন্দ্রের মতে, এই বিরােধের আসল কারণ ছিল রাজনৈতিক।৯৭
যদুনাথ সরকার থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি ছিল সংকীর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামির নিদর্শন এবং এখানেই তিনি আকবরের রাজপুত নীতি থেকে সরে এসেছিলেন। আতহার আলি ও সতীশচন্দ্র অবশ্য ভিন্নমত পােষণ করেন। এঁদের বক্তব্যের মূল কথা হল, রাজনৈতিক ও তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনের কথা মাথায় রেখেই ঔরঙ্গজেব তার রাজপুত নীতি নির্ধারণ করেছিলেন। এখানে ধর্মের কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। ঔরঙ্গজেব যে রাজপুত তথা হিন্দুবিরােধী ছিলেন না, তার প্রমাণ হিসাবে তারা বলেছেন যে, তাঁর রাজদরবারে রাজপুতসহ বহু হিন্দু মনসবদার ছিলেন (পূর্বেই তা বিস্তারিতভাবে আলােচিত হয়েছে)। অন্যদিকে ঔরঙ্গজেবের আমলে রাজপুতদের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন ও সম্পর্ক যে কিছুটা শিথিল হয়েছিল, সতীশচন্দ্র তা স্বীকার করে মন্তব্য করেছেন, উত্তর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দাক্ষিণাত্য বিজয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং স্বাভাবিকভাবেই রাজপুত মৈত্রীর মূল্য হ্রাস পায়।৯৮ এই দৃষ্টিকোণে আকবরের রাজপুত নীতির সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির মৌলিক পার্থক্য ছিল।
(১০)
ঔরঙ্গজেবের অসহিষ্ণু ধর্মনীতির ফলশ্রুতি হিসেবে হিন্দু পুনর্জাগরণ ও ধর্মীয় চেতনাবােধের সূচনা হয়—এটি সম্পূর্ণ অলীক ভাবনা। কারণ রাজপুতনার মত দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহও ঐতিহাসিক পটভূমির বিচারে অনিবার্য ছিল। এই বিদ্রোহের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। ঔরঙ্গজেবের পূর্বেও (আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলেও) দাক্ষিণাত্যে মুঘল অভিযান প্রেরিত হয়; কিন্তু একমাত্র ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ও মুঘল সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ বলে বিজাপুর ও গােলকোণ্ডা রাজ্যদুটি অধিকারের প্রয়ােজনীয়তা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তবে একথা বলা মারাত্মক ভুল যে, সুন্নীপন্থী ঔরঙ্গজেব আক্রোশবশে গােলকোণ্ডা ও বিজাপুরের শিয়া রাজ্য ধ্বংস করতে মনস্থ করেন। শিয়াদের প্রতি বিরূপ মনােভাব পােষণ করলে ঔরঙ্গজেব কখনই মীর জুমলার মতাে শিয়া শাসককে বাংলার শাসক হিসেবে নিযুক্ত করতেন না। তাছাড়া তার আমলে বেশিরভাগ ইরানীয় মনসবদারই ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের। মুঘল প্রশাসন তাদের হাতে পরিচালিত হত স্বীকৃত নিয়মকানুন অনুযায়ী। সুন্নী ঔরঙ্গজেব কিন্তু পদোন্নতির পুরস্কার ধার্য করতেন না একথা ভেবে যে, কে কোন ধর্মের বা সম্প্রদায়ের লােক কিংবা এমন কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, তিনি শিয়াদের বিরুদ্ধে সুন্নীগণকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন।৯৯ দ্বিতীয়ত, এই দুই রাজ্য মুঘল সম্রাটকে নিয়মিত করদানে বিরত থাকায় অভিযান প্রেরণ করতে হয়। তৃতীয়ত, শাহজাদা আকবরের সাথে মারাঠা বীর শম্ভুজীর সন্ধিতে ঔরঙ্গজেব বিচলিত হয়ে পড়েন এবং পুত্র আকবরকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে তাকে দাক্ষিণাত্যে অভিযান করতে হয়। আসলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে দাক্ষিণাত্যে মুঘল প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। অপরদিকে সম্রাট ঔরঙ্গজেব ভারতবর্ষে ‘হিন্দু জাগরণের অগ্রদূত’ ছত্রপতি শিবাজীর আবির্ভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং বিশ্বাসঘাতকতার বশবর্তী হয়ে শিবাজী আফজল খানকে নৃশংসভাবে স্বহস্তে হত্যা করলে তার বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, মারাঠাগণ মুঘল রাজ্য ধ্বংসে তৎপর রয়েছে। বিভিন্ন কারণে মারাঠাদের দমন করা সম্ভব না হলেও শিবাজীর প্রতি ঔরঙ্গজেবের উদার মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায় শিবাজীর দিল্লি আগমন, সংবর্ধনা ও ‘রাজা’ খেতাব লাভে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ঔরঙ্গজেব ও দারাশুকোর মধ্যের যুদ্ধকে একদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্যদিকে উদার আদর্শবাদের লড়াই বলে ধরা যায় না। এক্ষেত্রে যদুনাথ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্যণীয়। দারার সঙ্গে ভ্রাতৃঘাতী সংগ্রামে হিন্দুরা দারার দিকে আর মুসলিমরা ঔরঙ্গজেবের পক্ষে লড়াই করেছিল বলে লিখেছেন যদুনাথ। ঐতিহাসিক এ এল শ্রীবাস্তবও অনুরূপ মন্তব্য করে লিখেছেন, দারা হিন্দুদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ও ঔরঙ্গজেব অমুসলমানদের প্রতি তিক্ত শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন।১০০ এই বক্তব্য সঠিক নয়। ১৬৫৮৫৯ সালের উত্তরাধিকারের যুদ্ধে (সমুগড়ের যুদ্ধে) হিন্দু ও মুসলমান অভিজাতরা উভয়পক্ষেই প্রায় সমানভাবেই ছিল। রাজপুত রাজাদের ক্ষেত্রেও এটা ঘটে। শিয়ারাও সমানভাবে দু’পক্ষে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আতাহার আলি সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই যুদ্ধে ১০০০ জাট ও তার উপরের অভিজাতদের মধ্যে ২৭ জন ইরানি (মুসলিম) ছিলেন ঔরঙ্গজেবের দিকে এবং ২৩ জন ইরানি ছিলেন দারার পক্ষে। অপরদিকে ২৩ জন হিন্দু অভিজাত ঔরঙ্গজেবকে সমর্থন করেছিলেন, বিপরীতে ২৪ জন হিন্দু অভিজাত দারার পক্ষাবলম্বন করেছিল। এই তথ্য নিতান্ত ধর্মের ভিত্তিতে অভিজাতদের কোনও জোট হয়েছিল বলে প্রমাণ করে না। তাই যারা ঔরঙ্গজেব ও দারার লড়াইকে সাম্প্রদায়িক রঙে চিত্রিত করেন উপরােক্ত তথ্য তাদের বিরুদ্ধেই যায়। আসলে ঔরঙ্গজেব কোনাে সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষমূলক পদক্ষেপ নিলে তা তার উদ্দেশ্য সাধনে বিপর্যয় ডেকে আনত।১০১
(১১)
আমাদের ভুললে চলবে না যে, মধ্যযুগে রাষ্ট্র বিশেষ অধিকারের মাপকাঠিতেপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অভিজাত বংশ ও শিক্ষা-দীক্ষাই ছিল সেকালের যােগ্যতার মানদণ্ড। সেকালে শিক্ষিত লােক বিরল ছিল। শিক্ষার সামাজিক কোনাে তাগিদ মধ্যযুগে ছিল না। সুতরাং এই অশিক্ষাই হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের এক বিরাট অংশকে রাষ্ট্রের উচ্চপদে নিয়ােগের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ‘দেশজ মুসলমানরা’ হিন্দুদের চেয়ে অবহেলিত ছিল। ঔরঙ্গজেবের সময়ে কেন সমগ্র মুসলমান শাসনকালেই ‘দেশজ মুসলমান’দের সঙ্গে অভিজাত মুসলমানদের সামাজিক লেনদেন পর্যন্ত ছিল না। শিক্ষাদীক্ষায় প্রাগ্রসর ছিল বলে ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে হিন্দুদের স্থান ‘দেশজ মুসলমনদের’ চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। তাই ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে হিন্দু বিদ্বেষের দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখানাে বােধহয় ঐতিহাসিক দিক থেকে যথার্থ নয়।১০২
ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের ওপর ইচ্ছাকৃত অত্যাচার করেননি, তাদের ধর্মমন্দির ইচ্ছাকৃত বিধ্বস্ত করেননি বা তাদের আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধার সৃষ্টি করেননি। ‘জিলাপির’ হয়েও ভারতবর্ষ অর্থাৎ ‘দার-উল-হারব’কে ‘দার-উল-ইসলাম’-এ (ইসলামি সাম্রাজ্যে) তিনি রূপান্তরিত করেননি। নির্দিষ্ট আয়ের উর্ধ্বে কতিপয় হিন্দুকেই শুধু জিজিয়া প্রদান করতে হত, সকল অমুসলমানকে দিতে হত না। তাছাড়া নির্দয়ভাবে এই কর আদায় করা হত না। প্রয়ােজনে কিস্তিতে জিজিয়া আদায় হত। আর ধর্মান্তরকরণের জন্য এই কর চাপানাে হয় বলে যে অভিযােগ করা হয় তা ভিত্তিহীন। কারণ জিজিয়া দেওয়ার ভয়ে অমুসলমান মুসলিম হয়ে গেলে জিজিয়ার চেয়েও অনেক বেশি কর তাকে দিতে হত।
ঔরঙ্গজেব হিন্দু ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ৫ শতাংশ ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ২.৫ শতাংশ হারে বাণিজ্য কর নিতেন। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে এটাকে অবশ্যই বৈষম্য বলে মনে হবে। এক্ষেত্রে বলতে হয়, মুসলিম ব্যবসায়ীদের মুসলিম হওয়ার কারণে জাকাত হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে ২.৫ শতাংশ কর দিতে হত (এই কর কোনাে অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করা হত না)। তাহলে ফল দাঁড়াল এই যে, অমুসলিম ব্যবসায়ীদের মতাে মুসলিম ব্যবসায়ীদেরও দিতে হত ৫ শতাংশ কর—ব্যবসার জন্য ২.৫ শতাংশ ও জাকাত হিসেবে ২.৫ শতাংশ। একইভাবে বলা যায় যে, হিন্দুদের পাল্কিতে চড়তে দেওয়া হত না বা এই ধরনের অন্যান্য অভিযােগগুলিও ভিত্তিহীন।।
তবে এমন নয় যে, ঔরঙ্গজেব অসহিষ্ণু ছিলেন না। কিন্তু প্রশ্ন এখানে যে, এক্ষেত্রে কেন বিরাজমান নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতকে (অন্য সম্রাটের ক্ষেত্রে সাধারণত যেটা ভাবা হয়) বিচার করা হবে না? কেন ঐতিহাসিক বিচার বিশ্লেষণের সময় নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা হবে না? সেইসঙ্গে এটাও ঠিক যে, ঔরঙ্গজেবের সময়ে মন্দির আক্রান্ত হয়েছিল। তবে ধর্মস্থান হিসেবে নয়, বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল বা শত্রুর আশ্রয়স্থল ধনভাণ্ডার বা যৌন ব্যভিচারের কেন্দ্র হিসেবেই সেগুলি আক্রান্ত হয়। এসময় অনেক বিদ্রোহী অঞ্চলে মন্দির ছিল বিদ্রোহীদের গােপন যােগাযােগের স্থান এবং অস্ত্রাগার, অর্থাৎ মন্দিরগুলি ব্যবহৃত হত রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র রচনার নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে, কোনাে রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে যা বরদাস্ত করা সম্ভব নয়। শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় ও বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানাে হত। ফলে ধর্মস্থান ভঙ্গ হত বা আক্রান্ত হত যুদ্ধের নিয়মেই। সেখানে মন্দির-মসজিদ কোনােটাই বাদ যেত না। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বর্ণমন্দির অভিযানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তখন কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসী এই অভিযানকে সমর্থন করেছিলেন।
(১২)
প্রশাসক হিসাবে সম্রাট ঔরঙ্গজেব সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বলতেন, “আমি আইন অমান্য করলে প্রজাবর্গও আইন অমান্য করবে। তিনি শাসনব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাস করেই ক্ষান্ত হননি, এর পরিচালনায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্বয়ং দৃষ্টি নিবন্ধ করতেন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি সরকারের সমস্ত কার্য পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা করতেন।১০৩ দরবারের আচার-অনুষ্ঠান পালনে কঠোরতা অবলম্বন করতেন ও বিচারকার্য সমাধা করতেন এবং নিয়মানুবর্তিতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে রাজকার্য পালন করতেন। এহেন ঔরঙ্গজেব ততটা কৃতকার্য হতে পারেননি, যতটা তার হওয়া উচিত ছিল। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
ক. ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষের দিকে মুঘল দরবারের রাজনীতি ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করছিল। আমির-ওমরাহগণ ভােগী জীবনযাপনে বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন।
খ. মারাঠাদের দমনকার্যে তিনি প্রয়ােজনের অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে তিনি প্রায় ২৫ বছর অতিবাহিত করেন।১০৪
গ. স্বভাবের দিক দিয়ে ঔরঙ্গ জেব অত্যন্ত মিতব্যয়ী ছিলেন। কিন্তু শাহজাহানের পরিত্যক্ত সিংহাসনে উপবেশনকারীর পক্ষে এটা শােভনীয় ছিল না।
মােটকথা, ঔরঙ্গজেবের যে চরিত্র-চিত্র ইতিহাসে অঙ্কিত হয়েছে তা মূলত বিদ্বেষদুষ্ট ও শত্রুতার রঙে রঙীন। তার ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে তার সামগ্রিক ধর্মীয় নীতি সম্পর্কে বাঁধাধরা ছকে কোনাে সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কিন্তু তাই বলে তিনি মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ছিলেন একথা বলাও অতিরঞ্জিত হবে। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি সচেতনভাবেই ধর্মীয় সহনশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই প্রশ্ন হল, ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার যে বিশাল দিকগুলি রয়েছে তা কেন উপেক্ষা করা হবে? আমাদের পাঠ্য পুস্তকে ওই দিকগুলিকে কেন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে না? কেন তার নেতিবাচক দিকগুলিকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেখান হবে? কেন ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকবে না? তাহলে আমরা কি ঔরঙ্গ জেবের ইতিহাসকে হিন্দুদের জন্য একরকম আর মুসলমানদের জন্য অন্যরকম মানদণ্ডে দেখব? আর এই দুরকম মানদণ্ড কি ভারতীয় জনগণের মনে সাম্প্রদায়িক বিভেদব্যবধান সৃষ্টি ও বর্ধন করবে না? যুগের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার বিকাশ ও নানা অজানা তথ্য উন্মােচনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের বহু অতিকথা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়, বহু অভিনব মাত্রা সংযােজিত হয়ে আলােকিত হয় অন্ধকারময় ইতিহাস। ঔরঙ্গজেবের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই ঘটেছে। এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের বেশী করে যত্নশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে, যাতে করে ঔরঙ্গজেব-সম্পর্কে সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ সর্বজনগ্রাহ্য ইতিহাস বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. মুঘল সম্রাটদের উদারনৈতিক শাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে হলে দেখুন ইবনে হাসান, দ্য সেন্ট্রাল স্ট্রাকচার অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৬৭। এস এ কিউ হুসাইনি, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আন্ডার দ্য মুঘলস, ঢাকা, ১৯৫২। যদুনাথ সরকার, মুঘল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, প্রথম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯২০; চতুর্থ সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৫২; নিউদিল্লি, ১৯৭২। আই এইচ কুরেশি, দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার, করাচি, ১৯৬৬।
- ২. বি এন পাণ্ডে, ইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতি, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৪,পৃ. ৩৮ ৪৮। জ্ঞানচন্দ্রের বিভিন্ন প্রবন্ধ, দ্য জার্নাল অফ পাকিস্থান হিস্টরিক্যাল সােসাইটি, অক্টোবর ১৯৫৭, পৃ. ২৪৭-৫৪; জুলাই ১৯৫৮, পৃ. ২০৮-১৩; অক্টোবর ১৯৫৮, পৃ. ২৬৯-৭২; জানুয়ারি ১৯৫৮, পৃ. ৫৫-৫৬; জানুয়ারি ১৯৫৯, পৃ. ৩৬-৩৯ এবং এপ্রিল ১৯৫৯, পৃ. ৯৯-১০০। আরও দেখুন- ওমপ্রকাশ, কালচারাল হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, নিউ এজ পাবলিকেশন, নিউ দিল্লি, ২০০৫। আমেদাবাদের জগন্নাথ মন্দিরের জন্য। ঔরঙ্গজেব ২০০ গ্রাম দান করেছিলেন।দেখুন-গােবিন্দ পানসারে, কে ছিলেন শিবাজি, মনীষা গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ৩৫।
- ৩. পেট্রিয়ট, ২৩ জুন ১৯৭১।
- ৪. সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, ডি এম লাইব্রেরী, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ৭৩।
- ৫. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮-৩৯।
- ৬. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯।
- ৭. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮।
- ৮. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, অনূবাদ- সায়ন দে ও রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ৩৪০।
- ৯. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪০।
- ১০. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪০। অনিরুদ্ধ রায়, মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস, খণ্ড-১, প্রগতিশীল প্রকাশক, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ২২১। সমর মল্লিক ও স্বস্তিকা মল্লিক, মুঘল আমল, ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ৩৫০।
- ১১.তেসলিম চৌধুরী, ভারতের ইতিহাস ১৫২৬-১৮১৮, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৩, পৃ. ৩৮৪।
- ১২.তপন রায়চৌধুরী, কেবল গুজরাত কেন?’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ ডিসেম্বর ২০১২।
- ১৩. বেনারস ফরমান, দ্য জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, কলকাতা, ১৯১১, পৃ. ৬৮৯।
- ১৪.বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১।
- ১৫. ইসলামিক রিভিউ, ১৯২৪, পৃ. ২৯৮।
- ১৬. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১-৪২।
- ১৭. ভি এ স্মিথ, অক্সফোর্ড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, অক্সফোর্ড, ১৯৬৭, পৃ. ৪১৬।
- ১৮. যদুনাথ সরকার, হিস্টরি অফ ঔরঙ্গজেব, খণ্ড-৩, কলকাতা, ১৯২১, পৃ. ২৮০।
- ১৯. যদুনাথ সরকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮০।
- ২০. যদুনাথ সরকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮১। এই নির্দেশ ছিল সাময়িক ও আঞ্চলিক। ভারতবর্ষের সর্বত্র এই নির্দেশ লাগু হয়নি। আর এম ইটনের এক তথ্য হতে জানা যায় যে, ঔরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৮-১৭০৭) শুধু বাংলাতেই নির্মিত হয়েছিল ৫০টিরও বেশি ইটের বড় বড় নতুন মন্দির।
- ২১. যদুনাথ সরকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮১।
- ২২. শের খান লােদী: মিরাত-উল-খেয়াল, বাংলা অনুবাদ, কলকাতা, ১৯৪৮, পৃ. ১২৮ ১২৯।
- ২৩. মহম্মদ সাকি মুস্তাইদ খান: মাসের-ই-আলমগিরি, যদুনাথ সরকার কর্তৃক অনুদিত, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৫৫, পৃ. ৮১।
- ২৪. Romila Thapar, Communalism and Historical Legacy : Some Facts; Social Scientist, June-July 1990, P.-13. মথুরার মন্দির ধ্বংস প্রসঙ্গে রমিলা থাপার আরও বলেছেন, ‘মথুরায় মন্দির নির্মাণ ও ধ্বংসপ্রাপ্তি উভয়ের কারণ হিসেবে মুঘল সাম্রাজ্য বুন্দেলা রাজ্য শাসক ও রাজপুত রাজবংশের মধ্যেকার দীর্ঘকালীন জটিলতা সক্রিয় ছিল। (দেখুনরমিলা থাপার, ধর্মস্থান ধ্বংসের পিছনে, মার্কসবাদী পথ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, কলকাতা)।
- ২৫. রামাই পণ্ডিত: শূন্যপুরাণ, ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃ. ১৫৯-৬০।
- ২৬. শিবলী নােমানী: আওরঙ্গজেব পার এক নজর, বাংলা সংস্করণ- আওরঙ্গজেব : চরিত্র বিচার, হাসান আলি কৃত অনূদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮২, পৃ. ৬০।
- ২৭. আবদুল হামিদ খান লাহােরি:পাদশাহনামা বা বাদশাহনামা, কবিরউদ্দিন ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, খণ্ড-২, কলকাতা, ১৮৯৮, পৃ. ৫৭-৫৮।
- ২৮. শিবলী নােমানী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩, ৭৬।
- ২৯. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮-৪৯।
- ৩০. পটুভি সীতারামাইয়া, দ্য ফেদার্স অ্যান্ড দ্য স্টোনস, দিল্লি, ১৯৬৭। আরও দেখুন মণিশংকর আয়ার, কনফেসনস অফ এ সেকুলার ফান্ডামেন্টালিস্ট, পেঙ্গুইন বুকস, নিউ দিল্লি, ২০০৬, পৃ. ৬৫।
- ৩১. ঔরঙ্গজেব দিল্লি, আগ্রা, লাহাের প্রভৃতি বড় বড় শহরের মন্দিরগুলাে ধ্বংস করেননি। তাঁর সময়ে বেনারস, থাট্টা, মুলতান, মারােয়াড়, মেবারের কয়েকটি মন্দির ভাঙা হয়েছিল। বেনারস ছিল হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান। সেখানকার অধিকাংশ মন্দির ঔরঙ্গজেবের সমগ্র রাজত্বকাল জুড়ে (১৬৫৮-১৭০৭) অক্ষত ছিল, শুধু কয়েকটি মন্দির না ধ্বংস করে উপায় ছিল না।
- ৩৩. দেখুন কে কে দত্ত, সাম ফরমানাস, সনদস অ্যান্ড পরওয়ানাস ১৫৭৮-১৮০২, খণ্ড ২, পাটনা, ১৯৬২, নং- ৩৬, ৪৫, ৫১, ৫৮, ৬০, ৬৪, ১১৩, ১১৭, ১৩০, ১৫৪, ২১৯-২২১, ২৬২, ২৬৩, ২৭৮-৮০, ৩০০, ৩০৮, ৩২৫, ৩২৬, ৩৩০, ৩৬৪, ৩৭৮ প্রভৃতি। আরও দেখুন-প্রসিডিংস, ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল রেকর্ডস কমিশন, ১৯৪২, ১৯৪৯, ১৯৫৫।
- ৩৪. দেখুন- টি এস গ্রেওয়াল ও বি এন গােস্বামী সম্পাদিত, দ্য মুঘলস অ্যান্ড দ্য যােগীস অফ জাখবর, সিমলা, ১৯৬৭।
- ৩৫. গৌতম ভদ্র, মুঘল যুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা,পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪২০, পৃ. ৩০। আরও দেখুন-জ্ঞানচন্দ্রের প্রবন্ধ, জার্নাল অফ পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল সােসাইটি, ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৫৯
- ৩৬. জ্ঞানচন্দ্র, আলমগীরস টলারেন্স ইন দ্য লাইট অফ কনটেম্পােরারি জৈন লিটারেচার; দেখুন-জার্নাল অফ পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল সােসাইটি, ১৯৫৭, পৃ. ২৪৭-৫৪।
- ৩৭. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২।
- ৩৮. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২-৪৩।
- ৩৯. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২-৪৩।
- ৪০. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪।
- ৪১. আসাম রিসার্চ সােসাইটি মুখপত্রে প্রকাশিত, জানুয়ারি-এপ্রিল ১৯৪২, পৃ. ১-১২।
- ৪২. জ্ঞানচন্দ্র, ফ্রিডম অফ ওয়ারশিপ ফর দ্য হিন্দু আন্ডার আলমগীর, জার্নাল অফ দ্য পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল সােসাইটি, ১৯৫৮।
- ৪৩. স্ট্যানলি লেনপুল, আওরঙ্গজীব অ্যান্ড দ্য ডিকে অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার, সুনীতা পাবলিকেশন, দিল্লি, ১৯৮৭, পৃ.৬৯-৭১।
- ৪৪. সৈয়দ নুরুল হাসান, মধ্যযুগের ভারতে রাষ্ট্র ও ধর্ম সংক্রান্ত কিছু সমস্যা; অন্তর্ভুক্ত। অনিরুদ্ধ রায় ও অন্যান্য সম্পাদিত, মধ্যযুগের ভারত, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ৮। আরও দেখুন-সৈয়দ নুরুল হাসান, ভারতের ইসলামী সংস্কৃতিতে সহিষ্ণুতা ও উদারতার ঐতিহ্য, পাক্ষিক বসুমতী, ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩, কলকাতা।
- ৪৫. বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫।
- ৪৬. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, অনুবাদ-সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ১৩৭।
- ৪৭. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৭।
- ৪৮. কাফি খান, মুন্তাখাব-উল-লুবাব, ইলিয়ট ও ডওসন অনুদিত এবং স্যার ডব্লিউ হেগ সম্পাদিত, কলকাতা, ১৮৬৮-৭৪,পৃ. ২১৩-১৪।
- ৪৯. ঔরঙ্গজেবের হয়ে রাজপুত ভীম সিংহ মারাঠাদের আন্দোলন দমন করতে কোনাে আপত্তি করেননি। অন্যদিকে বান্দা সিরহিন্দ শহরের গণ্যমান্য মুসলিমদের হত্যা করলেও মুসলিমদের নামাজ পড়তে কোনাে বাধা দেননি। তার অধীনে ৫০০০ মুসলিম সৈন্য লড়াই করেছিল। এইসব কথা মাথায় রাখলে মুঘল আমলে কৃষক বিদ্রোহে ধর্মের ভূমিকা থাকলেও আমরা তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ খুঁজে পাই না।
- ৫০.শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ৭৮ আরও দেখুন- অনিরুদ্ধ রায়, এ ডিসকাশন অন দ্য ক্রাইসিস অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মুখপত্র, ১৯৬৯।
- ৫১. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৪।
- ৫২. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, আখাম-ই-আলমগিরি (ঔরঙ্গজেবের চিঠিপত্রের সংকলন, ইহা ‘অ্যানেকডােটস অফ ঔরঙ্গজেব’-এর মূল ফারসি গ্রন্থ, যদুনাথ সরকার কর্তৃক অনূদিত, কলকাতা, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৬৩), পৃ. ৩৯।
- ৫৩. শ্যামল দাস কবিরাজ, বীর বিনােদ (হিন্দি ভাষায় লিখিত মেবারের এই পুস্তক ফারসি ও রাজস্থানী আকর গ্রন্থের উপর নির্ভর করে রচিত। মুঘল বাদশাহ ও শাহজাদাগণ উদয়পুরের রাজপুত রাণাগণকে যে সকল ফরমান ও নিশান দিয়েছিলেন, ৪ খণ্ডে রচিত এই পুস্তকে প্রায়ই তার পূর্ণ বিবরণ রয়েছে), খণ্ড-২, পৃ. ৪১৯-২০, টীকা। উক্ত টীকায় নিশান-এর পূর্ণ পাঠ্যাংশ পুনরুদ্ধৃত হয়েছে; তার পরে অন্য নিশানও রয়েছে।
- ৫৪. শিবলী নােমানী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৫-৬৭।
- ৫৫.শুধু তাই নয়, বহু মারাঠারা তার সময়ে নিরাপদে সরকারী পদে আসীন ছিলেন। (দেখুন-সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, পৃ. ৩৪৫)
- ৫৬. দেখুন- শিবলী নােমানী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮।
- ৫৭. এলফিনস্টোন, হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, আলিগড়, ১৯৭৬, পৃ. ১২১।
- ৫৮. কাফি খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫২।
- ৫৯. কাফি খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫২।
- ৬০. স্ট্যানলি লেনপুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১।
- ৬১. এলফিনস্টোন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩।
- ৬২. কাফি খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৯।
- ৬৩. গৌতম ভদ্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৪। পারিবারিক ষড়যন্ত্রের কারণে শিখগুরু তেগবাহাদুরকে হত্যা করা হয়েছিল বলে মনে করেন সতীশচন্দ্র। (দেখুন-সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, অনুবাদ- সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ১৪৮)।
- ৬৪.শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৯৮৪
- ৬৫. এন এ নিকম ও রিচার্ড ম্যাককেয়ন, অশােকের অনুশাসন, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া, ১৯৬৭, পৃ. ৭৫।
- ৬৬. এন এ নিকম ও রিচার্ড ম্যাককেয়ন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩।
- ৬৭. এন এ নিকম ও রিচার্ড ম্যাককেয়ন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬।
- ৬৮. সেলিম চৌধুরী, ভারতের ইতিহাস ১৫২৬-১৮১৮, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৩, পৃ. ৩৮০।
- ৬৯. আতাহার আলি, মুঘল সম্রাটদের ধর্মনীতি; অন্তর্ভুক্ত-ইরফান হাবিব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-২, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, ৩য় সংস্করণ, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ১৬০।
- ৭০. শ্রীরাম শর্মা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১।
- ৭১.মহম্মদ সাকি মুস্তাইদ খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৩।
- ৭২. ইসলামি রাষ্ট্রের বিশেষ সুরক্ষিত অমুসলিম নাগরিককে ইসলামি পরিভাষায় ‘জিম্মি বলা হয়। এঁরা কোনােভাবেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নয়। জিম্মি’রা মুসলমানদের মত সমান মর্যাদার অধিকারী।
- ৭৩. জন্মদিনে সােনা-রূপার দ্বারা সম্রাটের ওজন নেওয়ার প্রথা।
- ৭৪. কেমব্রিজ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯২৮, পৃ. ২৩০।
- ৭৫. আতাহার আলি, মুঘল সম্রাটদের ধর্মনীতি, প্রাগুক্ত, কলকাতা, ২০০৯।
- ৭৬. শ্রীরাম শর্মা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৯।
- ৭৭. আবদুল হামিদ খান লাহােরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১৫।
- ৭৮. শ্রীরাম শর্মা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৪-২৮।
- ৭৯. আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, বাংলা অনুবাদ-ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল অভিজাত শ্রেণি, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ৪০-৪১।
- ৮০.আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫।
- ৮১. দেখুন- আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৮।
- ৮২.আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০-৪১।
- ৮৩. দেখুন- আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০।
- ৮৪. দেখুন- আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০।
- ৮৫. দেখুন- আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০।
- ৮৬.সাকি মুস্তাইদ খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮।
- ৮৭.জহিরুদ্দিন ফারুকি, ঔরঙ্গজেব অ্যান্ড হিজ টাইসম, দিল্লি, ১৯৯৩।
- ৮৮.পার্সিভ্যাল স্পীয়ার, অক্সফোর্ড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড, ১৯৫১।
- ৮৯.সতীশচন্দ্র, মুঘল রিলিজিয়াস পলিসিজ, দিল্লি, ১৯৯৩।
- ৯০. গৌতম ভদ্র, মুঘল যুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ, ১৪২০।
- ৯১. দেখুন-সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯।
- ৯২.এ ফরাের, মনুমেন্টাল অ্যান্টিকুইটিজ অ্যান্ড ইন্সক্রিপসনস ইন দ্য নর্থ-ওয়েস্টার্ন প্রভিনসেস অ্যান্ড আউথ, এলাহাবাদ, ১৯৯১, পৃ. ২৭৯।
- ৯৩. অনিরুদ্ধ রায়, মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস, খণ্ড-১, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ৩১০।
- ৯৪.ওয়াকা-ই-আজমির (এটি সংবাদ লেখকের বিবরণ, এই বিবরণীতে মুঘল শাসন ব্যবস্থা ও ১৬৭৮-৮০ পর্যন্ত রাঠোর বিদ্রোহ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য রয়েছে), পৃ. ১৬৭, ও ২৪৪-৪৬। দেখুন- আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০।
- ৯৫.সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, অনুবাদ-সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫২। আরও দেখুন- সতীশচন্দ্র, মিডিয়াভেল ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, এন সি ই আর টি, দিল্লি, ১৯৯৭, পৃ. ২২৫।
- ৯৬.সতীশচন্দ্র, মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, এন সি ই আর টি, পৃ. ৩০৯। আরও দেখুন অনিরুদ্ধ রায়, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪২।
- ৯৭.সতীশচন্দ্র, মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, এন সি ই আর টি, পৃ. ৩১০।
- ৯৮.সতীশচন্দ্র, মিডিয়াভেল ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, এন সি ই আর টি, পৃ. ৩১৪।
- ৯৯. যদুনাথ সরকার, অ্যানেকডােটস্ অফ ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮।
- ১০০. এ এল শ্রীবাস্তব, মুঘল এম্পায়ার, দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ, আগ্রা, ১৯৫৭, পৃ. ৩২০।
- ১০১. আতাহার আলি, ১৬৫৮-৫৯ সালের উত্তরাধিকারের যুদ্ধে ধর্মীয় প্রশ্ন, অন্তর্ভুক্ত। ইরফান হাবিব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-৪, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২০০৫, পৃ. ১১৮-১২০। আরও দেখুন-আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২-৩৪।
- ১০২. বিদ্যাধর মহাজন, মুঘল রুল ইন ইন্ডিয়া, রামনগর, এস চঁাদ, ১৯৯২, পৃ. ১৮২।
- ১০৩. দেখুন- সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত,খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৩।
- ১০৪. ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি অসফল বলা যাবে না। আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান যা পারেননি, ঔরঙ্গজেব তা পেরেছিলেন। অর্থাৎ সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটেছিল ঔরঙ্গজেবের সময়েই। প্রভা দীক্ষিত লিখেছেন, ..ভারতীয় ইতিহাসের যে কোন মনােযােগী ছাত্রই জানেন, হিন্দুধর্ম ধ্বংস করার জন্য দীর্ঘ ২৫ বছর কাল দাক্ষিণাত্যে কাটাননি আওরঙ্গজেব। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দাক্ষিণাত্যের সমস্ত শাসকের স্ব-শাসনকে ধ্বংস করে দক্ষিণ ভারতকে মুঘল সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তােলা। (প্রভা দীক্ষিত, কমিউনালিজম—এ স্ট্রাগল ফর পাওয়ার, নিউ দিল্লি, ১৯৭৪)। ফলে পরবর্তীতে সহজেই দক্ষিণ ভারত ভারত সাম্রাজ্যের বিশেষ অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।