লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
একশো বছর আগের এক সন্ধ্যা, তারিখটা তিরিশে জুন। স্থান লণ্ডনের হ্যাম্পস্টেড হীথ-এ শিল্পী রোটেনস্টাইনের বৈঠকখানা। সান্ধ্য আসরে উপস্থিত হয়েছেন ইয়েটস, এজরা পাউণ্ড, মে সিনক্লেয়ার, ইভলিন আণ্ডারহিল প্রমুখ লণ্ডনের কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তারা ছাড়াও খবর পেয়ে অনাহূতভাবে এসেছেন একজন ধর্মযাজক, তাঁর নাম চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ। তিনি অন্যান্যদের মতো কাব্যরসিক হিসেবে আসেননি, এসেছেন একজন ভারতপ্রেমিক রূপে। কেমব্রিজ ব্রাদারহডের ধমর্যাজকরূপে তিনি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম আসেন, তারপর যযাগ দেন দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের অধ্যাপকরূপে এবং ভারতে থাকতে থাকতে ভালোবেসে ফেলেন ভারতকে। ১৯১২ সালে কলেজের গ্রীষ্মবকাশে লণ্ডনে এসে শুনলেন রোটেনস্টাইনের গৃহে রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর নামে ভারতীয় কবির লেখা কবিতা পড়ে শোনাবেন স্বয়ং ইয়েটস। বিনা নিমন্ত্রণেই এজ চলে এলেন কবিতা পাঠের আসরে। সে অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে এডুজ পরে লিখেছেন, ইট ওয়াজ এ নাইট অব ইনার ইলিউমিনেশন অ্যাণ্ড ক্লিয়ার ভিশন। আর এডুজের মৃত্যুর পরে বার্ধক্যে প্রায় অচল দেহে শান্তিনিকেতনের মন্দিরে এসে রবীন্দ্রনাথ সেই প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে করে বললেন, ‘সে রাত ছিল। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত। এন্ড্রুজ আমার সঙ্গ নিয়েছিলেন। নিস্তব্ধ রাতে তার মন পূর্ণ ছিল গীতাঞ্জলির ভাবে। ঈশ্বরপ্রেমের পথে তাঁর মন এগিয়ে এসেছিল আমার প্রতি প্রেমে।.. এমনতরো অকৃত্রিম অপর্যাপ্ত ভালোবাসাকে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যের মধ্যে গণ্য করি।’ আর গান্ধিজি ‘হরিজন’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘নট ওনলি ইংল্যাণ্ড, বাট হিউম্যানিটি হ্যাজ লস্ট এ টু সন অ্যাণ্ড সারভেন্ট।… হি ওয়াজ এ টু ফ্রেণ্ড অব দ্য পুওর অ্যাণ্ড ডাউনট্রডন ইন অল ক্লাইমস। ভারতের মানুষ তখন তার নাম দিয়েছিল দীনবন্ধু।
এমন যে মহান মানুষ এন্ড্রুজকে, হয় তার জন্মদিনে নয় তার মৃত্যুদিনে, বছরে অন্তত একবার তাকে স্মরণ করার মধ্যে আমরা নিজেদেরকেই শ্রদ্ধেয় করে তুলতে পারি। তাকে বিস্মৃত হয়ে আমরা কী নিজেদেরই ক্ষুদ্র করে ফেলছি না? তবু ভালো যে ড. তপনকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘ট্যাগোর অ্যাণ্ড দ্য বিশ্বভারতী’ গ্রন্থখানিতে এন্ড্রুজের লেখা রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীর ওপরে ন’টি প্রবন্ধ, তিনটি কবিতা ও রবীন্দ্রনাথকে লেখা তিনটি কবিতা ন’টি চিঠি একত্রে সংকলন করে এন্ড্রুজকে স্মরণ করার একটা উপলক্ষকে আমাদের সামনে সাজিয়ে দিয়েছেন। প্রবন্ধগুলির মধ্যে তিনটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এন্ড্রুজর প্রথম সাক্ষাতের, আলাপ-সালাপের, ভাব বিনিময়ের ও গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠার স্মৃতিতে ভরপুর। পড়ার পরে মনে হয় যেন পুণ্যস্নান করে উঠলাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ, প্রাচীন ভারতের আদর্শে স্থাপিত শান্তিনিকেতন আর আধুনিক বিশ্বে দেশে দেশে সহযোগিতার আদর্শে স্থাপিত বিশ্বভারতীর উদ্দেশ্য ও তা যাপন আর সাধনের উপায় সম্বন্ধে এডুজের মূল্যবান মতামতে সমৃদ্ধ প্রবন্ধ বা ভাষণ আছে একটি। একটি প্রবন্ধে শ্রীনিকেতনে পল্লি পুনর্গঠনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে পর্যালোচনা করেছেন তা বর্তমান ভারতের পরিপ্রেক্ষিতেও প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ, এলমহার্স্ট, এন্ড্রুজ প্রভৃতি মানুষের ভবিষ্যৎ চিন্তার বিস্তার ও মানব প্রেমের গভীরতা আমাদের কাছে কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। বিশ্বভারতী, রবীন্দ্রনাথও গান্ধিজি সম্বন্ধে আলব্রেফেট শোয়াইঞ্জারএর নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন একটি প্রবন্ধে—এটি যেন বিশ্বমনীষার এক পরাক্রান্ত মোহনা। রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছর বয়স পূর্তি উপলক্ষে ১৯৩১ সালে এজ ‘দ্য পোয়েট নামে যে প্রবন্ধটি লেখেন সেটিও এখানে সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতাই ১৯১২ সালে এজকে অভিভূত করেছিল, কিন্তু ১৯৩১-এ তিনি লিখছেন— যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, কবির কোন্ বৈশিষ্ট্য তাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তবে তিনি বলবেন, স্বাধীনতা তথা মুক্তির জন্য কবির নির্ভীক প্রেম এবং সত্যের প্রতি সংরক্ত অনুরাগ যা এই পড়ন্ত বয়সেও তাকে গড়ে তুলেছে ‘দ্য মোস্ট ডেয়ারিং অ্যাডভেঞ্চারার অব আওয়ার ওন টাইমস, বোথইন হিজ থটস্অ্যাণ্ড হিজ অ্যাকশনস।’ সব জায়গার চেয়ে শান্তিনিকেতনই কেন তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা তা-ই ব্যাখ্যা করেছেন ‘শান্তিনিকেতন’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক বহুকাল আগেই চুকে গেলেও ওই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে, প্রবন্ধটি এন্ড্রুজের লেখা বলেই।
গ্রন্থটির দ্বিতীয় অংশে রয়েছে রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত রবীন্দ্রনাথকে লেখা এন্ড্রুজের নটি চিঠির সংকলন। এগুলির মধ্যে প্রথম ছটি চিঠি এভুজের শান্তিনিকেতনে যোগ দেওয়ার আগে কখনও দিল্লি থেকে কখনও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কখনও ইংল্যাণ্ড থেকে লেখা। কোনও চিঠিতে আর্তি ভরা মায়ের কথা, কোনও চিঠিতে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের যন্ত্রণার কথা বেরিয়ে এসেছে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। ষষ্ঠ চিঠিটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ ভিত্তিক ধর্মোপলব্ধির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ হয়েছে যে সাধনা’গ্রন্থে সেই গ্রন্থকে উপলক্ষ করে এন্ড্রুজ এই দীর্ঘ চিঠিতে আপন ধর্মচিন্তাকে ভাষা দেওয়ার ছলে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের এক নতুন ভূমিকা রচনা করেছেন। পত্রের আকারে লেখা হলেও আসলে এটি একটি অসাধারণ প্রবন্ধ। এমনই আর একটি বিশেষ অর্থগর্ভ চিঠি হল ১৯১৫ সালের মে মাসে লেখা সপ্তম চিঠিটি। রবীন্দ্রনাথের ৫৫তম জন্মদিনের অব্যবহিত পূর্বে লেখা এই চিঠিটিতে এন্ড্রুজ বোঝার চেষ্টা করেছেন যে রবীন্দ্রনাথের নিকটতম মানুষটি কে ‘কীনলি ইনটেলেকচুয়াল’ রামমোহন, না ‘মেডিটেটিভ অ্যাণ্ড ডিপলি রিলিজিয়স’ দেবেন্দ্রনাথ? এখানে এডুজ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন ‘সাধনা’ গ্রন্থটির ওপরে। সাধনা’-তে এডুজ একই সঙ্গে পেয়েছেন শান্তি’ ও শক্তি’। অষ্টম ও নবম চিঠি দুটি ১৯১৭-তে এন্ড্রুজের ফিজি-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যাণ্ড পরিক্রমাকালে লেখা। ফিজির চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের দুর্দশা নিবারণের কাজে ক্লান্ত এজ সিডনিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের নতুন নাটক ‘দ্য সাইকাল অব স্প্রিং’ পড়ে শুনিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠজনদের কাছে। ক্লান্তিজাত অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুরোধের চাপে দ্বিতীয় একদিন পড়ে শোনাতে হল বৃহত্তর শ্ৰোতৃমণ্ডলীর সামনে। পাঠের পরে তাঁর কাছে এসে কে কী। বললেন, সেসব বিস্তারিতভাবে চিঠিতে জানালেন রবীন্দ্রনাথকে। প্রথমেই জানিয়েছেন হাসপাতালের এক মেট্রনের কথা। হাসপাতালে তার জিনিসের তাকে ‘গীতাঞ্জলি’ রেখে দিয়েছেন যাতে ফুরসত পেলেই পড়তে পারেন। ভীষণ আধ্যাত্মিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে ও সমস্ত ‘অর্গানাইজড রিলিজিয়ন’-এ বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি শান্তি পেয়েছেন ‘গীতাঞ্জলি’-তে। শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রতিক্রিয়াতে এন্ড্রুজের নিজের ক্লান্তিও রূপান্তরিত হয়েছে উদ্যমে। নবম চিঠিতে দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে এন্ড্রুজের ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতার পরিচয়। বলা দরকার যে প্রবন্ধ ও পত্রগুলিতে উল্লেখিত ব্যক্তি বা ঘটনার জন্য যেখানে যে পাদটীকা প্রয়োজন সেখানে সম্পাদক সেরকমই পাদটীকা দেওয়াতে আজকের পাঠক নিঃসন্দেহে খুবই উপকৃত হবেন, তবে ১৬৪ পৃষ্ঠার পাদটীকাতে এজ প্রথমবার ফিজি যান ১৯২১ সালে আছে, ওটা হবে ১৯১৫ সাল।
এই গ্রন্থে দুটি আলোকচিত্র আছে, একটি এন্ড্রুজের, আর একটি এডুজ-গুরুদেবের একসঙ্গে এবং আছে এন্ড্রুজের আঁকা গুরুদেবের একটি প্রতিকৃতি। এই প্রতিকৃতিটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এন্ড্রুজ যাজক পরিবারে জন্মেছিলেন, নিজেও যাজকই ছিলেন, ছিলেন একান্ত খ্রিস্ট অনুরাগী। বলে রাখা ভালো, খ্রিস্টীয় সভ্যতা মূলত মানুষের প্রতি প্রেম ও শান্তিদাতা এবং দীনদুঃখীর পরিত্রাতা যিশুখ্রিস্টের ধারণা ও সাধনার বিরোধী। এই দাতা ও ত্রাতা খ্রিস্টই ছিলেন এন্ড্রুজের আদর্শ। রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিটি প্রসঙ্গে খ্রিস্টের প্রসঙ্গ এসে গেল, কারণ এই প্রতিকৃতিতে খ্রিস্টের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় আদলটি অত্যন্ত তাৎপর্যময় বলে মনে করি।
এ গ্রন্থটির সঙ্গে এডুজকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলি ‘লেটার্স টু এ ফ্রেণ্ড’ পড়লে আধুনিক যুগের দুই মহৎ ব্যক্তিত্বের সংলাপে ও সংযোগে আমাদের মধ্যেও কিছু মহৎ ভাবনা ও প্রেরণা সঞ্চারিত হবে।
সবশেষে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে ড. নিখিলেশ গুহের এডুজের জীবন ও কর্মের বিশদ তথ্যপূর্ণ সুলিখিত প্রবন্ধটির। কত পরিশ্রম করে কী গভীর শ্রদ্ধায় এই ভূমিকাটি লিখেছেন ড. গুহ তা দেখে তাকেও পৃথকভাবে শ্রদ্ধা জানাই।
এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত ‘ট্যাগোর অ্যান্ড দি বিশ্বভারতী’ গ্রন্থটির আলোচনা, দৈনিক স্টেটসম্যান ২৯/০৭/২০১২
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে জানতে নিচের লেখাগুলি পড়ুন,
১) রবীন্দ্র রচনায় শিক্ষা ও সমাজ ভাবনা
২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাসক হিসাবে একজন অত্যাচারী ব্যক্তি ছিলেন