আলাউদ্দিন খিলজি ও রানী পদ্মাবতীর আখ্যান : ইতিহাসের পুনর্বিচারঃ – ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবাহী ঐতিহাসিকেরাই ভারতীয় ইতিহাসের বিশেষ করে মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের সম্পর্কে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হেনরি ইলিয়ট ও ডওসন-এর কথা উল্লেখ করতে হয়। তারা তাদের সম্পাদিত ‘দ্য হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস্ ওন হিস্টরিয়ানস’ বইটিতে (আট খণ্ড) বহু অনৈতিহাসিক বিষয়কে ইতিহাসের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, যা ইতিহাস বিকৃতিরই নামান্তর। ব্রিটিশ প্রভাবিত বা ব্রিটিশের খয়ের খাঁ ভারতীয় ঐতিহাসিকদের অনেকেই সচেতন বা অচেতনভাবে ইতিহাসের সেই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন।১ ফলে ভারতের ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার অভাব থেকে গেছে। আর এইসব অনৈতিহাসিক বা মিথ্যা কথন হিন্দু জনমানসে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল। বিপনচন্দ্রের কথায় এইভাবে উদ্ভব হয়েছিল, ‘সাম্প্রদায়িকতার ছাঁচে ঢালাই মুসলিমরা। যারা জন্মগতভাবে নির্মম, যৌনজীবনে লম্পট এবং আক্রমণাত্মক।’
যৌন ক্ষুধা পরিতৃপ্ত করবার উদ্দেশ্যে হিন্দু রাণীদের সন্ধানে ফেরা মুসলিমদের শয়তান ভাবমূর্তির উপাখ্যানের শুরু সাম্রাজ্যলোভী আলাউদ্দিন খিলজিকে দিয়ে (১২৯৬-১৩১৬), দ্বিতীয় আলেকজান্ডার হওয়া ছিল যার স্বপ্ন। তবে হিন্দু রাণীমাত্রই আক্রমণকারীর লােভ-লালসায় সতীত্ব বিসর্জন দেননি কখনও, আত্মহননের মাধ্যমে ইজ্জত রক্ষা করে গেছেন। দাক্ষিণাত্য বিজয়ে উৎফুল্ল ও উৎসাহিত আলাউদ্দিন খিলজি, বলা যায় ছুরিকা চালনা করেই দিল্লি অধিকার করে নেন ১২৯৬-এর ১৯ জুলাই। মনােযােগী হন দ্রুত সাম্রাজ্যবিস্তারে; ১২৯৭-তে গুজরাটের বাঘেলা রাজপুত নৃপতি দ্বিতীয় রায় কর্ণদেব বশ্যতা স্বীকার করেন। আলাউদ্দিন খিলজির পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু ছিল রাজপুত শক্তির প্রতীক রণথম্বাের দুর্গ। নতুন মুসলমান নামে অভিহিত বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিয়ে আলাউদ্দিন খিলজির কোপে পড়েছিলেন এই দুর্গের রক্ষক হামির দেব। রাজপুত ও মুসলিম বিদ্রোহীরা যুগ্মভাবে দুর্গরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৩০১-এর জুলাইতে আলাউদ্দিন খিলজি স্বয়ং আক্রমণে এসে অধিকার করেন রণথম্বাের দুর্গ। মুসলিমরা ধৃত ও নিহত হয়। শৌর্য ও বীর্যের প্রতিমূর্তি রাজপুত পুরুষেরা যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করেন।
রণথম্বাের অভিযান করার পর আলাউদ্দিন খিলজির আত্মবিশ্বাস অনেক বৃদ্ধি পায়। তাই এবার তিনি রাজপুতনার শ্রেষ্ঠ রাজ্য মেবার আক্রমণ করতে উদ্যোগী হন। মেবার রাজ্য ছিল পাহাড় ও ঘন জঙ্গলে বেষ্টিত। ফলে আক্রমণকারীদের জন্য এই রাজ্যে প্রবেশ করা ছিল দুঃসাধ্য। তবুও সুলতান আলাউদ্দিন হতােদ্যম না হয়ে মেবার আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। রাজপুতনার মধ্যে সম্মানে ও ঐশ্বর্যে সর্বশ্রেষ্ঠ চিতাের দুর্গ আক্রমণ করা বিবেচিত কর্ম বলে আলাউদ্দিনের মনে হয়েছিল। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি এক। বিশাল বাহিনী নিয়ে আলাউদ্দিন খিলজি চিতােরের দিকে অগ্রসর হন। আমীর খসরু অভিযানের সময় সুলতানের সঙ্গে ছিলেন। তিনি দুর্গ অভিযান ও রাজপুতদের আত্মসমর্পণের একটি মনােজ্ঞ চিত্র অঙ্কন করেন।
চিতাের আক্রমণের প্রত্যক্ষ ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মেবারের গুহিলাে রাজপুত রাণা রতন সিংহকে শাস্তি প্রদান। কারণ মেবারের রাজপুতরা শক্তি সামর্থ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বলে তারা দিল্লির প্রভুত্ব বরাবরই অস্বীকার করত। তাছাড়া রতন সিংহ তার রাজ্যের মধ্য দিয়ে আলাউদ্দিনকে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে গুজরাট যেতে দিতে অসম্মত হওয়ায় সুলতান তার প্রতি রুষ্ট ছিলেন। তৃতীয় কারণ হিসাবে একটি বহুল প্রচারিত উপাখ্যান প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, আলাউদ্দিন খিলজির চিতাের আক্রমণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রতন সিংহের অনিন্দ্যসুন্দরী রাণী পদ্মিনীকে লাভ করা।
প্রথমেই আলাউদ্দিন খিলজি চিতাের শহর অবরােধ করেন এবং চিতােরী নামে একটি টিলার উপর শিবির স্থাপন করেন। পরে একদল শক্তিশালী সৈন্য নিয়ে তিনি চিতাের দুর্গ অবরােধ করেন। রতন সিংহ রাজপুত সৈন্যদের নিয়ে প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। মুসলমান সৈন্যদের প্রবল আক্রমণের মুখেও নির্ভীকভাবে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় রাজপুত বীরেরা। রতন সিংহের নেতৃত্বে রাজপুতরা দীর্ঘ সাত মাস মুসলিম আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখে। অতঃপর অবরুদ্ধ দুর্গে খাদ্য, পানীয় ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের অভাব দেখা দিলে উপায়ান্তর না দেখে রাজপুতরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এসময় দুর্গের ভেতরে রাজপুত রমণীরা জহরব্রত পালন করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় বলে প্রচলিত কাহিনিগুলােতে বর্ণিত আছে। এই যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ হাজার রাজপুত সৈন্য মারা যায়। রাজপুত ঐতিহাসিকদের মতে, রাণা অতুল সিংহ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমীর খসরু ও হিসামীর মতে, যুদ্ধের পরেও রতন সিংহ জীবিত ছিলেন এবং আলাউদ্দিন খিলজি তাকে হত্যা করতে নিষেধ করেন। আলাউদ্দিন খিলজি নিজ পুত্র খিজির খাঁর উপর চিতােরের শাসনভার অর্পণ করেন। কিন্তু স্বাধীনতাপ্রিয় রাজপুত জাতির ক্রমাগত আক্রমণে খিজির খান ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে চিতাের পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। তখন সুলতান মালদেব নামের জনৈক রাজপুত সামন্তকে চিতােরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। অবশ্য চিতাের দিল্লির অধীনতা বেশিদিন স্বীকার করেনি। আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যুর পর রতন সিংহের ভাই মালদেব ১৩১৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় চিতাের অধিকার করেন।
(২)
আলাউদ্দিনের চিতাের আক্রমণের কারণ হিসেবে পদ্মিনী-কথা বর্ণিত হয়েছে। রাণী পদ্মিনীর উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে রাজপুতানার চারণ কবিরা অনেক চিত্তাকর্ষক উপকথা রচনা করেন। পরবর্তী সময়ের লেখকদের মধ্যে হাজি উদবির, আবুল ফজল, ফিরিস্তা এবং ন্যান্সি প্রমুখেরা তাদের বিবরণে উক্ত কাহিনির উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এই সমস্ত লেখকদের লেখার মধ্যে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। এলিয়েট অ্যান্ড ডসন’-এর মতাে আরেকটি গ্রন্থ হলাে ঐতিহাসিক কর্নেল জেমস্ টড-এর ‘অ্যানাল অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অফ রাজস্থান’।২ জেমস টড তার অপ্রামাণ্য, চারণগীতি ও গাল-গল্প নির্ভর এই গ্রন্থে নানা অসঙ্গতির কথা উল্লেখ না করেই পদ্মিনীর ঘটনাকে ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবেই দেখিয়েছেন। তবে এই উপাখ্যান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে ইতিহাসবিদ কে এস লাল দেখিয়েছেন, পদ্মিনী ঘটনার কোনাে ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই—“Setting aside the traditional narratives of the story the true facts are that Sultan ‘Alauddin’invaded Chittor in the year 1303 and after a hard fight of about eight months captured it. The brave warriors died fighting the invaders; the brave Rajput women perished in the flames of Jauhar among those who perished was perhaps a Queen of Ratan Singh whose name was Padmini. Except these bare facts all else is a literary conection and lacks historical support.’৩ কাহিনীর যে কোন বাস্তব ভিত্তি নেই এ ব্যাপারে একালের ঐতিহাসিকগণও একমত: ‘Many modern historians dismiss the tale of Padmini as pure fiction.’8
আবুল ফজল কতকগুলাে বিশেষ গুণের অধিকারী নারীর কথা নির্দেশ করতে পদ্মিনী শব্দটি ব্যবহার করেন। গুণবিচারে নারীদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠদের হিন্দি ভাষায় বলা হয় পদ্মিনী। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, সমসাময়িক কোনাে ইতিহাসবিদই পদ্মিনী-কাহিনির কথা উল্লেখ করেননি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করা যায়। তা হচ্ছে পদ্মিনী রতন সিংহের রাণী হিসাবে প্রচারিত হলেও আধুনিক গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন পদ্মিনী ছিলেন ভীম সিংহের স্ত্রী। রতন সিংহ এবং ভীম সিংহের সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় দেড়শ বছর। সে হিসাবে আলাউদ্দিন খিলজি যখন চিতাের আক্রমণ করেন তখন পদ্মিনীর জন্ম হয়নি। সুতরাং আলাউদ্দিনের চিতাের জয়ের পেছনে এ সমস্ত কাহিনির তেমন গুরুত্ব নেই। বরং বলা যায়, সুলতানের সাম্রাজ্যবাদী নীতির অংশ হিসাবেই চিতােরে অভিযান পরিচালিত হয়েছিল।৫
পদ্মিনী উপাখ্যানের প্রাচীনতম রচয়িতা সম্ভবত চাঁদ বরদাই। তার গ্রন্থ পৃথ্বীরাজ রাসাে’র পদ্মিনী কাহিনি অংশের নাম ‘পদ্মাবতী সময়’৫ বলাবাহুল্য চাঁদ কবির রচনা থেকে টড এ উপাদান আহরণ করেছেন বলে মনে হয়। টডের লেখার প্রথম ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে রাজস্থানের বিভিন্ন আঞ্চলিক (মেবার, মারওয়াড়, বিকানীর প্রভৃতি) রাজা তথা রাণাদের রাজত্বের ইতিহাস আরম্ভ হয় পুরাকথা ও কিংবদন্তীর মধ্যে—তারপর সন-তারিখ মিলিয়ে পরখ করে নেবার মতাে বৃত্তান্তে তাদের পরিণতি হয়। কিন্তু মিথ থেকে ইতিহাস পর্যন্ত অগ্রসর হবার পর দেখা যায় মুসলমান আক্রমণকারীদের অত্যাচারে তারা ছত্রভঙ্গ ও বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত সুখপ্রদ পরিসমাপ্তি দেখা যায় ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সন্ধি করে নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার মধ্যে। এই ‘পরমকারণবাদ’ টডের ইতিহাসের দিগদর্শন করে। মুসলমান রাজাদের স্বেচ্ছাচারী, শঠ ও ক্রুর না প্রমাণ করতে পারলে ব্রিটিশ রাজত্বের যথার্থ্য, সদাশয়তা ও বদান্যতা স্থাপনা করা সহজ হয় না। প্রসঙ্গত ‘পদুমাবৎ’-এর উদাহরণ মনে রাখলেই ধরা পড়ে, জায়সীর কাব্যে হিন্দু-মুসলমান বিরােধ প্রায় অনুপস্থিত। পরে টডের বৃত্তান্তে এবং (তার ফলে পরে বাঙালির কল্পনাতেও) রাজস্থান কাহিনি মুখ্যত হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের আখ্যান হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে চাঁদ বরদাই-এর ‘পৃথ্বীরাজ রাসাে’র ঊনসত্তরটি সর্গের মধ্যে মাত্র কয়েকটি সর্গে পৃথ্বীরাজের সঙ্গে মহম্মদ ঘােরির যুদ্ধ বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু পরে গল্পের পুনর্লিখন ও পুনর্কথনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কল্পনায় সেইটুকুই এই কাহিনির সার অংশ রূপে বেঁচে রইল।
‘রাসাে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে রচিত বীরগাথার শ্রেণিগত নাম। দলপতি বিজয়ের লেখা ‘খম্মম রাসাে’ (সম্ভবত নবম শতাব্দী) পৃথ্বীরাজ রাসাের’ পূর্বসূরি ছিল এবং কর্নেল টড তার বৃত্তান্তের অন্যতম আকর হিসাবে ‘খম্মম রাসাে’রও উল্লেখ করেছেন। চাঁদ বরদাই-এর সমসাময়িকদের মধ্যে নরপতি নাহা রচিত ‘বিশলদেব রাসাে’ এখনও প্রচলিত আছে। এই কাব্যগুলির ভাষায় রাজস্থানের ডিঙ্গল নামক ভাষা ও অবধ অঞ্চলের ব্রজভাষা মিশ্রিত। প্রধানত চরিতকাব্য হলেও এইসব কবিতায় যুদ্ধবর্ণনা ও শৃঙ্গার রসের প্রাধান্য থাকত। শুক ও শুকীর (সারী) কথােপকথন, নারীর রূপবিবরণ, সমরাঙ্গনের ধ্বনি ও চিত্র ছন্দোবদ্ধ স্তবকে এমনভাবে গ্রথিত হত যাতে চারণ তাকে গীতরূপ দিতে পারে। অন্যান্য চারণবাহিত বীরকথার মতাে পৃথ্বীরাজ রাসাে’ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্ধিত বা সংক্ষিপ্ত হতে থাকে। বলা হয় চাঁদ বরদাই শুধুমাত্র পৃথ্বীরাজের রাজসভার কবি ছিলেন তা নয়, রাজার বিশেষ বন্ধুও ছিলেন এবং কিংবদন্তী অনুসারে রাজার এবং কবির জন্ম একই দিনে হয়েছিল। সেই হিসাবে ‘পৃথ্বীরাজ রাসাে’ দ্বাদশ শতাব্দীতে লেখা ধরে নেওয়া হয়। এই কবিতার ১৬, ৩০৬ স্তবক পাওয়া যায়, অবশ্য পরে অনেক সংক্ষিপ্ত রূপও প্রচলিত হয়েছিল। মহাকাব্যের ভঙ্গিতে বরদাই ধীরে ধীরে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ, প্রেমকাহিনি, দুঃসাহসিক ঘটনাবলি কাহিনির মধ্যে গ্রন্থনা করেন। হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদী সম্পাদিত ‘পৃথ্বীরাজ রাসাে’তে পৃথ্বীরাজের সাঁইত্রিশ জন নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সংযুক্তা পৃথ্বীরাজের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। ইচ্ছনী, শশীব্রতা প্রমুখ অনেক রাণীর নাম এই কবিতায় উল্লেখিত। বহু যুদ্ধের বর্ণনা আছে যেখানে মুসলমানদের কোনাে ভূমিকাই নেই—সেগুলি রাজপুতদের বিভিন্ন বংশের অন্তর্দ্বন্দ্ব। টডের অবদান পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তার প্রেমকে রােম্যান্টিক অনন্যতা অর্পণ এবং কেন্দ্রীয় সংঘর্ষকে হিন্দু-মুসলমানের বিরােধ বলে উপস্থাপিত করা।
১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে মালিক মুহাম্মদ জায়সী তাঁর বিখ্যাত হিন্দি কাব্য ‘পদুমাবৎ’ রচনা করেন। মূলত রাণী পদ্মিনীর-উপাখ্যানই এখানে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু জায়সীর বর্ণনা ইতিহাসধর্মী ছিল না। এটি ছিল রােমান্সনির্ভর কাব্য। মুহাম্মদ জায়সী স্বয়ং তাঁর কাব্যের শেষে চিতােরকে দেহ, রাজাকে (রতন সিংহ) মন, সিংহল দ্বীপকে হৃদয়, পদ্মিনীকে জ্ঞান এবং সর্বোপরি আলাউদ্দীনকে মায়ার প্রতীকরূপে অভিহিত করেছেন। অতএব জায়সী রচিত কাব্যটিকে ঐতিহাসিক কাব্যের মর্যাদা দানের পরিবর্তে রূপক কাব্যের মর্যাদাদান করাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে স্বীকার করতে হয়। এছাড়া জায়সী কাব্যটি রচনা করেছিলেন আলাউদ্দিনের চিতাের জয়ের প্রায় আড়াইশাে বছর পরে। জায়সী ছাড়াও আরও যে সমস্ত পদ্মিনী উপাখ্যান পাওয়া যায় তার সকলই পরবর্তীকালে রচিত। ফলে একেক গ্রন্থে পদ্মিনী একেকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ঘটনাগুলাের মধ্যেও তেমন একটা মিল নেই।
জায়সীর ‘পদুমাবৎ’-এর কাহিনি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করলে দেখা যাবে টডের মাধ্যমে প্রচারিত কাহিনির সঙ্গে তার কোথায় পার্থক্য। কাব্যটির দুটো ভাগ। প্রথম অংশ— রত্নসেন-নাগমতী-পদ্মাবতীর কাহিনি—এখানে প্রেম, রােমাঞ্চ, মিলন একটি পারম্পর্যের সূত্রে গাঁথা। দ্বিতীয় অংশ—আলাউদ্দিনের চিতাের অভিযানের কাহিনি। সিংহলদ্বীপের রাজা গন্ধর্বসেনের অপরূপ সুন্দরী কন্যা দ্বাদশবর্ষীয়া পদ্মাবতী রাজপ্রাসাদের বাইরে এক পৃথক প্রাসাদে সখী সমভিব্যহারে বাস করে। সেখানে হীরামন নামক তােতাপাখি পদ্মাবতীর সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্র ও বেদ পাঠ করে ও রাজকন্যার বিশেষ অনুরাগ লাভ করে। এক সময়ে রাজরােষে এই পাখি জঙ্গলে পালায় যেখানে এক ‘বহেলিয়া’ (পাখি ফাঁদে ফেলা যার পেশা) তাকে ধরে খাঁচায় পুরে নিয়ে চলে যায়। পরে এই পাখি চিতােরের রাজা রত্নসেনের হাতে গিয়ে পড়ে। তােতার মুখে পদ্মিনীর রূপবর্ণনা শুনে রত্নসেন এই না দেখা কন্যার প্রেমে পাগল হয়ে তাকে জয় করার আশায় সিংহল পাড়ি দেন। স্ত্রী নাগমতী এবং রত্নসেনের মা তাকে এই অসম্ভব প্রচেষ্টা থেকে নিরস্ত করতে পারলেন না। রত্নসেনের সঙ্গে তার অধীনস্থ রাজন্যবর্গ ও ষােলাে সহস্র সৈন্য সমুদ্র পার করে সিংহল পৌঁছায়। সেখানে এক শিবমন্দিরে রত্নসেন পদ্মিনীর জন্য তপস্যা আরম্ভ করেন। হীরামনের কাছে রাজার প্রেমের কথা শুনে পদ্মিনী মন্দিরে পদার্পণ করেন, কিন্তু ধ্যানমগ্ন রাজা তার উপস্থিতির কথা টের পান না। রত্নসেন যখন জানতে পারলেন তিনি পদ্মিনীর দেখার সুযােগ হারিয়েছেন তখন তিনি এক চিতা সাজিয়ে প্রাণত্যাগ করতে উদ্যত হন। তার এই প্রয়াস থেকে শিব ও পার্বতী তাকে নিরস্ত করেন। শিবের আদেশে রত্নসেন সিংহলের দুর্গ আক্রমণ করেন—তখনও তিনি সন্ন্যাসীর বেশে। সামান্য সন্ন্যাসী হয়ে রাজকন্যাকে ভালােবাসার অপরাধে রাজা তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যার আদেশ দেন, কিন্তু এই সময়ে চারণকবি গান গেয়ে রত্নসেনের প্রকৃত পরিচয় জানায়। চিতােরের রাজা রত্নসেনের সঙ্গে সিংহলাধিপ গন্ধর্বসেন তার কন্যার বিবাহ দেন এবং তার অনুচরদেরও ষােলাে হাজার পদ্মিনী-চিহ্ন-বিশিষ্ট নারী উপহার দেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে রত্নসেনের প্রথমা স্ত্রী নাগমতীর বিরহের বহ্নিতে রাজত্ব ছারখার হয়ে যাবার উপক্রম হলে এক পাখি তার সন্দেশ নিয়ে সিংহল যেতে প্রস্তুত হয়। রত্নসেনের তখন দেশের কথা মনে পড়ে এবং তিনি সৈন্য, অনুচর ও ষােলাে হাজার পদ্মিনী-নারী সহ দেশে ফেরার জন্য সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। পথে ঝড়ে তার সমস্ত অনুচরদের মৃত্যু হয়। রত্নসেন একটি কাঠের টুকরাে অবলম্বনে ভাসতে থাকেন এবং পদ্মাবতী সমুদ্রদেবের কন্যা লছমীর নিজস্ব দ্বীপে আশ্রয় পান। পরে নানান পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তারা আবার মিলিত হন এবং পুরীতে নতুন অনুচর সংগ্রহ করে চিতােরে ফিরে আসেন। এরপর জায়সী নাগমতী ও পদ্মাবতী দুই সপত্নীর মধ্যে বিবাদ ও রত্নসেনের সভায় রাঘবচেতন নামক এক ব্রাহ্মণের উত্থানের বৃত্তান্ত বিস্তারিত বর্ণনা করেন। রাঘবচেতন রাজাকে প্রবঞ্চনা করতে গিয়ে ধরা পড়ায় রাজা তাকে নির্বাসন দেন। পদ্মাবতী এই খবর শুনে রাঘবচেতনকে ডেকে পাঠান এবং নিজের বহুমূল্য রত্নখচিত বলয় তাকে যাবার আগে উপহার দেন। ব্রাহ্মণ পদ্মাবতীর বিশ্বনন্দিত রূপ দেখে হতবাক হয় এবং রত্নসেনের উপর প্রতিহিংসা নেবার শপথ করে। দিল্লির দরবারে প্রবেশের চেষ্টায় সে সফল হয় এবং সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির কাছে পদ্মাবতীর অতুলনীয় রূপ বর্ণনা করে।
এই বর্ণনা শুনে উত্তেজিত আলাউদ্দিন খিলজি চিতাের আক্রমণ করে দাবি করেন, রাণীকে তার হাতে সমর্পণ করা হােক। রত্নসেন আলাউদ্দিনকে সম্মান প্রদর্শন করতে রাজি হলেও পদ্মিনীকে দিতে রাজি হলেন না। তার সহচর গােরা ও বাদলের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি আলাউদ্দিনকে নিজের প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে আনলে আলাউদ্দিন কৌশলে পদ্মাবতীকে দেখবার সুযােগ পান। আলাউদ্দিন রত্নসেনকে দিল্লির কারাগারে বন্দী করে রাখেন। গােরা ও বাদল দিল্লি অভিমুখে রওনা হয় রত্নসেনকে মুক্ত করার জন্য। পদ্মাবতী ও তার সখীদের ছদ্মবেশে গােরা ও বাদলের সৈন্যেরা কারাগারে প্রবেশ করে রত্নসেনকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়—কিন্তু ফেরার পথে তারা ধরা পড়ে। গােরা যুদ্ধে প্রাণ দেয়, কিন্তু বাদল রাজাকে নিয়ে চিতােরে ফিরে আসে।
ইতিমধ্যে রাজার অনুপস্থিতিতে প্রতিবেশী কুম্ভলমীরের রাজা দেবপাল দূতী পাঠিয়ে পদ্মাবতীকে নিজের কাছে আনবার প্রস্তাব করেন। অপমানিতা পদ্মাবতী রত্নসেনকে এই লাঞ্ছনার কথা বর্ণনা করাতে তিনি দেবপালকে শাস্তি দিতে কুম্ভলমীরে যাত্রা করেন। আলাউদ্দিন চিতাের পৌঁছােবার আগে ফেরবার প্রতিশ্রুতি তিনি রাণীকে দিয়েছিলেন, কিন্তু সম্মুখযুদ্ধে দেবপাল এবং রত্নসেন উভয়েই নিহত হন। চিতােরের সৈন্যরা আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে শেষ যুদ্ধে নিষ্ক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুই রাণী নাগমতী ও পদ্মাবতীসহ দুর্গের নারীরা সকলে সহমরণে প্রাণ দেন। আলাউদ্দিন খিলজি যুদ্ধ জয় করে শূন্য দুর্গের উপর অধিকার পান।
‘পদুমাবৎ’ কাব্যের মূল ঝোঁক ছিল আধ্যাত্মিক। এখানে সুফি সাধনা ও তাত্ত্বিক গুরুত্বই প্রাধান্য পেয়েছে। জায়সীর মূল বক্তব্য তার কাব্য রচনার যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: “আমি এই জেনে এই গান রচনা করলাম, তা যেন এই জগতে কীর্তি চিহ্ন হয়ে বর্তমান থাকে। এখন কোথায় সেই রাজা রত্নসেন, এমন বুদ্ধিমান শুকপাখিই বা কোথায়? কোথায় সুলতান আলাউদ্দিন? কোথায় রাঘব চেতন যে পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা করেছিল? কোথায় সুরূপা রাণি পদ্মাবতী? কেউ নেই শুধু তাদের কাহিনি আছে। যার যশ এবং কীর্তি থাকে সেই ধন্য। ফুল মরে কিন্তু তার গন্ধ মরে না।”৬
আলাউদ্দিনের শাসনকালের আড়াইশাে বছর পরে জায়সী যখন হিন্দি ভাষায় ‘পদুমাবৎ’ লেখেন, তখন এই ধরণের প্রণয়কাব্য যা সুফি ও ভক্তির তাত্ত্বিক প্রভাবে রচিত তার একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়—যিনি জায়সীর কাব্যকে বাংলায় অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন, ভূমিকায় লেখেন যে, সমকালীন সাহিত্যে মােল্লা দাউদের ‘চায়ন’, কুতুবনের ‘মৃগাবতী’, মনঝনের ‘মধুমালতী’ ও জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। যার মধ্যে জায়সী নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ।
প্রতিটি কাব্যের বৈশিষ্ট্য, সূচনায় মােহাম্মাদ (সঃ) ও তার চার খলিফার গুণকীর্তন, পীরের যশােগান ও সমকালীন সুলতানদের উদ্দেশ্যে স্তুতি নিবেদন করে প্রেম কাহিনির পরিবেশন। প্রায় সব রচনার ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ফারসির সঙ্গে সংস্কৃত কাব্যের আঙ্গি কের মিশ্রণ ঘটেছে, আবার এর সঙ্গে মিশে গেছে লােকগাথা। চায়ন’এ যেমন লােকগাথা প্রাধান্য পেয়েছিল, মনঝনের ‘মধুমালতি’তে রূপকথা, জায়সী তাঁর কাব্যে রূপক ও সমকালীন বাস্তবতার একটি মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন যা তখনকার সাহিত্যে বিরল। ইতিহাসের তথ্য তার কাহিনিতে গতি সঞ্চার করেছিল, কাব্যকে ভারাক্রান্ত করেনি।
‘পদুমাবৎ’ কাব্যের পরিচিতির ক্ষেত্রগুলি বিচার করলে দেখা যায়, একই সঙ্গে কাহিনিটি গৃহীত হয় রাজসভায়, নাগরিক সমাজে ও সুফি সাধকদের সম্মেলনে। এইখানেই জায়সীর ‘পদুমাবৎ’-এর গুরুত্ব। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কল্পনার জগতে বিচরণ ‘পদুমাবৎ’-কে করে তুলেছিল মার্গি ও লােক সংস্কৃতির মিলনের ক্ষেত্র।
(৩)
পঞ্চদশ শতক থেকেই রাজস্থানের রাজপুত রাণাদের নিয়ে যে বীরগাথাগুলি রচিত হয়, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজকীয় ক্ষমতার বৈধতা দান। ১৪৫৩ সালে পদ্মনাভ নামক এক নাগরি ব্রাহ্মণ রচনা করেন ‘কানহাডত্তে’ প্রবন্ধ। এটি লেখা হয় কানহাডত্তের বংশধর অক্ষয়রাজের অনুরােধে। তিনি ছিলেন জালােরের রাজা ও পদ্মনাভের পৃষ্ঠপােষক। চার খণ্ডে বিভক্ত কাব্যটি। কাহিনির মূল আখ্যান গড়ে উঠেছে দেশপ্রেম, বীরত্ব ও রাজবংশের সম্মানকে কেন্দ্র করে। এই সম্মান রক্ষার্থে রাজপুত রাজপুরুষদের যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন ও রাজপুত নারীদের সহমরণ উদ্যাপন।
“পঞ্চদশ শতকে রাজপুত রাণাদের এইসব বীরগাথার সূত্র নিহিত আছে তাদের বংশাবলীতে। আদি মধ্যযুগ থেকেই (সপ্তম থেকে দশম শতক) রাজপুতদের ক্ষত্রিয়ত্ব প্রমাণ করবার জন্য এই রচনাগুলির সৃষ্টি। চতুর্বর্ণ হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার জন্য রাজপুতরা কী কী দায়িত্ব পালন করেছিলেন—দেশ, ধর্ম ও জাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের আত্মত্যাগ, শুধু সাহিত্যে নয়, শিলালিপিতে, স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, শিল্পে খােদিত হয়। কিছু জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক এর থেকে সিদ্ধান্তে আসেন যে রাজপুতরাই আর্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, মহাভারত ও রামায়ণে বর্ণিত সূর্য ও চন্দ্র বংশের বংশধর।
তাদের লেখায় আলাউদ্দিনকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেই ‘শত্রু’ হিসাবে যিনি রাজ্যগ্রাসী, ক্ষমতালােভী ও হিন্দু সংস্কৃতি রক্ষায় প্রধান বাধা। এর ফলে জাতীয়তাবাদী রচনায় ‘পদুমাবৎ-এর বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়ায় এক রেখায় আঁকা রাজপুত বীরত্ব ও মুসলমান রাজশক্তির দ্বন্দ্বের কাহিনি। বীরত্বের যে কাহিনিতে দেশপ্রেম ও ধর্মরক্ষা প্রধান কর্তব্য, তাতে যােগ হয় নারীকে রক্ষার ও মাতৃভূমিকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব। যে শত্রু, তার চরিত্রেও রূপান্তর ঘটে।”৭ এইভাবে আলাউদ্দিন যিনি প্রথমে চিহ্নিত হয়েছিলেন রাজ্যগ্রাসী, অত্যাচারী শাসক হিসাবে, তিনি হয়ে উঠলেন আরও নীচ, কামুক। সমসাময়িক ‘চিতাই বার্তা’ বা ‘কানহাডত্তে’ প্রবন্ধে যে পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে পদ্মাবতী-আলাউদ্দিন উপাখ্যান পরবর্তী কিছু ঐতিহাসিকের সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে উৎসাহিত করে। ফলে বহু রচনায় রাজপুত বীরত্বের কাহিনির কেন্দ্রে থাকে সতীসাধ্বী নারী ও তাকে অপহরণে ইচ্ছুক মুসলমান সম্রাট—যাকে ছাড়া কাহিনি অচল হয়ে উঠবে। ব্রাহ্মণ্য ও পিতৃতান্ত্রিক আদর্শে নিয়ন্ত্রিত হয় নায়ক-নায়িকার জীবন। এই জন্যই ইতিহাসে যা সম্ভব হয় না, তা সম্পন্ন হয় সাহিত্যে। জায়সীর কাব্য এই ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। তার আধ্যাত্মিক যুক্তি হিন্দু-মুসলমানকে সমানভাবে স্পর্শ করে। সেখানে আমরা দেখি, আলাউদ্দিন যখন চিতােরে প্রবেশ করলেন, তখন সবাই মৃত: “সুলতান এসে যখন সব বিবরণ শুনলেন, উজ্জ্বল দিনের আলােয় যেন রাত্রি ঘনিয়ে এল। তিনি চিতার এক মুঠো ছাই নিয়ে (বাতাসে) উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এ জগৎ মিথ্যা।”৮
এইভাবে কাহিনির মধ্যে সুফি মসনবি ধারার সঙ্গে বীরত্ব ও যুদ্ধের আখ্যানের প্রথাগত কাহিনিশৈলী ওতপ্রােতভাবে বিজড়িত। তার সঙ্গে টড বর্ণিত অপেক্ষাকৃত সােজাসুজি কাহিনির শুধু শেষাংশের মিল আছে। টডের আখ্যানেও পদ্মিনী সিংহলের রাজকন্যা এবং চিতােরের রাণী—কিন্তু তার স্বামীর নাম ভীমসিংহ। টড তাঁর বর্ণনায় এই কাহিনির ঐতিহাসিকতার উপর একেবারেই জোর দেননি, বরং তিনি পাঠককে মনে করিয়ে দেন পরমা সুন্দরী রমণীকে পদ্মিনী বলার একটা পরম্পরা ছিল যা কবিদের গানের মাধ্যমে জীবিত থাকত। আলাউদ্দিন খিলজির চিতাের আক্রমণের প্রসঙ্গেও তিনি কবিগাথার উল্লেখ করে বলেন চারণদের গানে যশােলাভ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছার চেয়ে পদ্মিনীর রূপের মােহকেই এই যুদ্ধের প্রাথমিক কারণ মনে করা হয়। টড সমানেই কিংবদন্তী ও ইতিহাসের মিশ্রণকে তার বর্ণনার একটা সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেন কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে যখন টডের প্রবল প্রতাপ তখন আমরা প্রায়ই দেখি বাঙালি নাট্যকার, কবি, সাহিত্যিক ও পাঠ্যপুস্তক লেখকেরা ‘মহামতি’ টডকে নির্ভুল ঐতিহাসিক হিসাবে অনায়াসে মেনে নিয়েছেন।
(৪)
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে যখন জেমস টড চারণ ও ভাটদের গাথা থেকে এই কাহিনি অংশত লিপিবদ্ধ করে তাকে ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেন তখনও কিংবদন্তীর ছায়া তার ওপর দৃশ্যমান। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলা সাহিত্যে কীভাবে এই কাহিনি অবিসংবাদিত ইতিহাসে পরিবর্তিত হয় তার বিশ্লেষণে ঔপনিবেশিক যুগে বঙ্গদেশের নিজস্ব মানসিক চাহিদা বিবেচনা করা দরকার। ভারতের অতীত থেকে যেসব সদগুণের উদাহরণ দিয়ে পরাজিত জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব ছিল জেমস্ টডের বিবরণে তার অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়। টড নিজের বিবরণকে তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের পদবাচ্য করেননি। তার বইয়ের নাম থেকেই তা স্পষ্ট। এছাড়াও বর্ণনার উৎস হিসেবে তিনি প্রায়ই কিংবদন্তী, কাহিনি ও গানের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি এই বইকে ইতিহাসের মর্যাদা দেয় কারণ তারা ভারতীয় অতীতের এই ধরণের বীরত্বের কাহিনি বিশ্বাস করতে বিশেষ আগ্রহী ছিল।
কিন্তু পদ্মিনীর আখ্যানাংশের ঐতিহাসিকতায় বিশ্বাসী ঐতিহাসিকের বক্তব্য : The Mewar tradition which accepts the story is a very old one, handed down from generation to generation.”৯ কিন্তু এর উত্তরে বলা যেতে পারে—“Tradition is no doubt a source of history but it is surely the weakest one, and until it is corrected by contemporary evidence-literary, historical, epigraphical and numismatical-it cannot be accepted as true history.’১০
মালিক মুহাম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্য রচনার ৭০ বৎসর পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ফিরিস্তাকেও পদ্মিনীর বিবরণ দান করতে দেখা গেছে।১১ কিন্তু তিনি তার বর্ণনায় চিতােরের রাণার নামােল্লেখ পর্যন্ত করেননি। এমনকি পদ্মিনীর সঙ্গে রতন সিংহের প্রকৃত সম্পর্ক বিষয়েও তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। পদ্মিনী রতন সিংহের পত্নী না কন্যা— এ বিষয়ে তার যথেষ্ট সংশয় ছিল। ঐতিহাসিক হাজি উদবিরও তার রচনায় রতন সিংহের নামােল্লেখ পর্যন্ত করেননি। এবং তিনি ‘পদ্মিনী’ বলতে রমণী বিশেষের পরিবর্তে বিশেষ কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের অধিকারিণী স্ত্রীলােককেই অভিহিত করেছেন। এমনকি চিতাের অধিকারের পূর্বে অথবা রতন সিংহের সুলতানের হাতে বন্দী হওয়ার পরে পদ্মিনীকে লাভের দাবী জানানাে হয়েছিল, সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত ছিলেন বলে মনে হয় না। জায়সীর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী ঐতিহাসিক আবুল ফজলকেও পদ্মিনীর নামােল্লেখ করতে দেখা যায়নি। আবুল ফজলের গ্রন্থে এইটুকু মাত্র উল্লিখিত হয়েছে—Sultan Alauddin Khilji, ruler of Delhi, heard that Rana Ratan chief of Mewar possessed a most beautiful woman.’১২ আলাউদ্দিনের চিতাের বিজয়ের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আমীর খসরু। কিন্তু তাঁর গ্রন্থেও পদ্মিনীর উপাখ্যান অনুল্লিখিত রয়েছে। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারণি ‘তারিখ-ই-ফিরােজশাহী’ গ্রন্থে সম্রাট আলাউদ্দিনের রাজত্বকালের বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করলেও তাকেও কিন্তু পদ্মিনী, রতন সেন, লক্ষ্মণ সিংহ প্রভৃতি কারও বিষয়েই উল্লেখ করতে দেখা যায়নি।
জেমস টড পদ্মিনীকে সিংহলরাজ হামিরশংকের কন্যারূপে অভিহিত করেছেন। কিন্তু মহামহােপাধ্যায় ওঝা বলেছেন, রতন সিংহের সমসাময়িক সিংহলরাজ ছিলেন চতুর্থ প্রকরমবাহু।১৩ আলাউদ্দিন কর্তৃক আয়নায় একবারের জন্য পদ্মিনীর রূপ দর্শনের অনুরােধ জ্ঞাপন ও রানা কর্তৃক সেই অনুরােধ রক্ষা বিষয়ে জেমস টড যা বর্ণনা করছেন, সে সম্বন্ধেও আধুনিককালের ঐতিহাসিকের অস্বীকৃতি বর্তমান: ‘This is unbelievable. Ratan who successfully fought the Muslims for eight years could never have consented to satisfy such a humiliating and absurd request of Alauddin.’১৪
জেমস টড পদ্মিনীকে ভীম সিংহের পত্নীরূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পদ্মিনীর অস্তিত্বকে স্বীকার করলে তাকে রতন সিংহের পত্নী বলেই মেনে নিতে হয়। কবিরাজ শ্যামল দাসজী তাঁর রচিত ‘মেবারের ইতিহাসে’ ভীমসিংহকে লক্ষ্মণ সিংহের পিতামহ এবং আলাউদ্দিনের সমসাময়িক কালে সমর সিংহের পুত্র রতন সিংহ মেবারে রানা ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন।১৫
সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্যে আলাওল ‘পদ্মাবতী’র কাহিনি লিখেছেন। আলাওলের উৎস গ্রন্থ হিন্দি ‘পদুমাবৎ’ রচয়িতা মালিক মুহাম্মদ জায়সী শের শাহের সমসাময়িক এবং উঁদ বরদাই-এর প্রায় ৩৫০ বছর পরবর্তী। কিন্তু জায়সী চাদ কবির রচনা দেখেছিলেন কিনা তার প্রমাণ বা স্বীকৃতি নেই।১৬
আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ বাংলায় পদ্মিনী কাহিনির অনুবাদ। তবে এটা নিছক অনুবাদ নয়। জায়সীর কাব্যের সঙ্গে কিছু তফাতও আছে। আলাওলের ‘পদ্মাবতী’র শেষাংশে সম্পূর্ণ অন্য কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। আলাওলের কাহিনিতে শুধুমাত্র প্রেম বা আধ্যাত্মিকতা নয়, রাজনৈতিক মতাদর্শর কথাও উল্লেখিত হয়েছে—যা আদর্শ শাসকের একটি ভাবমূর্তি গঠন করে। আলাওলের আলাউদ্দিন সেই আদর্শ রাজা। কাহিনি তাই শেষাংশে একটি বিশেষ মােড় নেয়। দেবপাল রাজপুত রাজা হওয়া সত্ত্বেও, রত্নসেনের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ান। দেবপালকে তাই যুদ্ধে নিহত করেন রত্নসেন। আহত অবস্থায় ফিরে এলেও আরও বেশ কিছুদিন তিনি বাঁচেন ও পদ্মাবতীর গর্ভে তার দুই পুত্র হয় চন্দ্রসেন ও ইন্দ্রসেন। পূর্ব আঘাতের বিষক্রিয়ায় রত্নসেনের মৃত্যু হলে তার দুই স্ত্রী নাগমতি ও চন্দ্রাবতী একই সঙ্গে সহমরণ করেন। এই যে সহমরণ, যেখানে ব্যক্তিগত শােক গােষ্ঠীগত ক্রিয়া থেকে পৃথক, সেখানেই কাহিনির পার্থক্য ও আলাওলের স্বকীয়তা লক্ষণীয়।
আলাউদ্দিনের চিতাের অভিযান যে রাজনৈতিক কারণে সংগঠিত হয়, তা আলাওলের বর্ণনায় স্পষ্টায়িত হয়। তার সমসাময়িক বারণির লেখায় যে আদর্শ রাজার চিত্র জনমানসে। প্রতিষ্ঠা করা হয়, তা মুঘল আমলে আবুল ফজলের রচনায় পরিণত হয় আকবরের রূপায়ণে। মুঘল আমলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জন্য আকবর তার হিন্দু প্রজাদের অভিজাত শ্রেণিতে স্থান করে দেন (অন্যান্য মুঘল সম্রাটগণও এই কাজ করেছিলেন)। নিজে চিতাের অধিগ্রহণ করলেও, রাজপুত রাণাদের প্রতিষ্ঠা করেন তাদের নিজেদের দেশে। ওয়াতন জায়গিরধারী এইসব রাজপুত সর্দাররা মুঘল সম্রাটের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রজা হয়ে ওঠেন। আলাওল যেহেতু মুঘল শাসনব্যবস্থায় ভাল দিকটা লক্ষ করেন, তিনি শুধু আদর্শ রাজা নন, আদর্শ প্রজার চিত্রটাও তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তােলেন।১৭ আলাওলের বর্ণনায় সামন্ততান্ত্রিক অনুষ্ঠানও স্পষ্ট হয়ে ওঠে : “মৃত্যুকালে বাপ মােরে তােমার চরণ।/ভূমি চুম্বি সমর্পিল করিয়া যতন।।” এর উত্তরে আলাউদ্দিন বলেন : “যে পুনি মরিয়া গেল না কর শােচনী/নিয়মিত রাজ্য ভােগ যাবত জীবন/চান্দেরী মারােয়া রাজ্য তােমা বশ কৈলু।”১৮
এই অংশের টীকাতে সম্পাদক দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য উল্লেখযােগ্য : “রত্নসেনের মৃত্যু সংক্রান্ত আনুপূর্বিক কাহিনি শুনে সুলতানের শােক এবং সমস্ত বিবাদের স্মৃতি মুছে ফেলে পদ্মাবতীর অনাথ পুত্রদ্বয়কে সমাদরসহ অভ্যর্থনার যে চিত্র এখানে আছে তাতে মূল কাহিনির ট্র্যাজেডি অনুবাদে ট্র্যাজিকমেডিতে পরিণত। পদ্মিনীকে না পাওয়ার ব্যর্থতা ভুলে আলাউদ্দিন যেভাবে পদ্মিনীর পুত্রদের আহ্বান করে পাশে বসিয়ে পিতৃশােকের সান্ত্বনা দিয়েছেন, তাতে সুলতানের প্রেমভাব প্রকাশ পেলেও কাহিনির পরিণাম যতদূর সম্ভব মেলােড্রামাটিক হয়েছে।”১৯ এই উক্তিতে ফুটে উঠেছে ‘পদুমাবৎ’ কাব্যপাঠের দুটি মূল সমস্যা। প্রথম, আলাওল ও জায়সী একই কাহিনি অবলম্বন করলেও তাদের বাস ছিল ইতিহাসের দুটি ভিন্ন অধ্যায়ে। জায়সীর মধ্যে সুফি মতাদর্শ যে প্রভাব বিস্তার করেছিল, আলাওলের ক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হয় অন্যভাবে। ফলে আলাউদ্দিনকে আলাওল ও জায়সী দু’জনে দুভাবে দেখেছেন ও ভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায় যে, ১৮৭০-৮০-র দশক থেকে।
শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেতনায় বিজিত জাতির আত্মমােক্ষণের প্রচেষ্টার প্রথম পর্ব শুরু হয়। বলেন্দ্রনাথ প্রভৃতি লেখকরা পাশ্চাত্য দেশ থেকে আসা বিপ্লবের তরঙ্গকে স্বাগত জানান। এর ফলে একদিকে ইতিহাসের নতুন পাঠ, অন্যদিকে বিদেশি রােমান্টিক সাহিত্যের আকর্ষণে বাংলায় যে কাব্য রচনা হতে থাকে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-১৮৮৭) পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮) তার একটি উল্লেখযােগ্য নিদর্শন। মঙ্গ লকাব্য ভারাক্রান্ত মধ্যযুগীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যাঁকে জেহাদ ঘােষণা করতে দেখা গেল, তিনি যুগ সন্ধিক্ষণের কবি ভারতচন্দ্র। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ সর্বপ্রথম আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় প্রতিফলিত। বাংলা কাব্য সাহিত্যের ধারায় তাই ‘অন্নদামঙ্গ ল’ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। অন্নদামঙ্গলের পরবর্তী যে কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে এক উল্লেখযােগ্য সংযােজন, সেটি নিঃসন্দেহে ‘পদ্মিনী’ উপাখ্যান। এই কাব্যটি রচনায় রঙ্গলাল চারণ কবির ভূমিকা পালন করেছেন। তাই সাহিত্যিক মূল্যের কথা বাদ দিলেও বিশেষত স্বাদেশিক সাহিত্য রচনার ইতিহাসে ‘পদ্মিনী উপাখ্যানের এক বিশিষ্ট স্থান স্বীকৃত।
(৫)
১৮৫৮ সাল ভারতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় মুহূর্ত ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ও ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। এই একই সালে প্রকাশিত হয় রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’। এই সময় থেকে ভারতীয়রা এক জটিল আনুগত্যের সমস্যা থেকে মুক্ত হলেন। এতদিন পর্যন্ত তারা ছিলেন আইনত মুঘল সম্রাটের, যদিও প্রায় সারা দেশেই সামাজিক-উদ্বৃত্ত কর গ্রাস করছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। মতাদর্শগতভাবেও একদিকে সেকালের বিধান, অন্যদিকে পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চার প্রভাবে নতুন করে আত্মসমীক্ষা শিক্ষিত বাঙালিদের কাছে কয়েকটি সমস্যার সৃষ্টি করে। রঙ্গ লালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’-এর ভূমিকায় এই চিন্তাগুলির কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় : “এই অভিনব কাব্যের প্রণয়ন ও প্রকটন সম্বন্ধে আমার কিঞ্চিদ্বক্তব্য আছে। ১২৫৯ বঙ্গ ব্দের বৈশাখ মাসে একদা বীটন সমাজের নিয়মিত অধিবেশনে কোন কোন সভ্য বাঙ্গ লা কবিতার অপকৃষ্টতা প্রদর্শন করেন। কোন মহাশয় সাহসপূর্বক এরূপও বলিয়াছিলেন যে বাঙ্গালীরা বহুকাল পর্যন্ত পরাধীনতা-শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকতে তাহাদিগের মধ্যে প্রকৃত কবি কেহই জন্মগ্রহণ করে নাই। প্রত্যুত স্বাধীনতা-সুখবিহীনতায় মানসিক স্বাচ্ছন্দবিরহ হয়, সুতরাং পরিপীড়িত পরাধীন জাতির মধ্যে যথার্থ কবি কোনরূপেই কেহ হইতে পারেন না। আমি উক্ত মহাশয়দিগের অযুক্তি নিরসন নিমিত্ত ঐ সভায় এক প্রবন্ধ পাঠ করি…।”২০
গ্রন্থের ভূমিকায় কবি গ্রন্থ রচনার ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, কুন্তীর প্রসিদ্ধ জমিদার কালীচন্দ্র রায় চৌধুরী এবং রাজা সত্যচরণ ঘােষাল বাহাদুরের অনুরােধেই তিনি টডের গ্রন্থানুসরণে এই কাব্যগ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হন। কবির ভাষায়—“আমি উভয়ােক্ত মহাত্মার অনুরােধে কর্ণেল টড বিরচিত রাজস্থান প্রদেশের বিবরণ পুস্তক হইতে এই উপাখ্যানটি নির্বাচিত করিয়া রচনারম্ভ করিয়াছিলাম।”
কবি রঙ্গলাল তার কাব্যে বিষয়বস্তু নির্বাচনের ব্যাপারে গতানুগতিকতাকে পরিহার করে কেন ‘রাজস্থানের বিষয়কে নির্বাচিত করলেন, সে প্রসঙ্গে কৈফিয়ৎ দান করে বলেছেন : “এস্থলে ইহাও জিজ্ঞাস্য হইতে পারে, আমি এতদ্দেশীয় প্রাচীন পুরাণেতিহাস হইতে কোন উপাখ্যান না লইয়া আধুনিক রাজপুত্রেতিহাস হইতে তাহা গ্রহণ করিলাম ইহার কারণ কি?—এতদুত্তরে বক্তব্য এই যে পুরাণেতিহাসে বর্ণিত বিবিধ আখ্যান ভারতবর্ষীয় সর্বত্র সকল লােকের কণ্ঠস্থ বলিলেই হয়, বিশেষত ঐ সকল উপাখ্যান মধ্যে অনেক অলৌকিক বর্ণনা থাকাতে অধুনাতন কৃতবিদ্য যুবকদিগের উত্তাবৎ শ্রদ্ধাই নহে, এবং এতদ্দেশীয় জনসমাজে বিদ্যাবৃদ্ধির বান্ধব মহানুভবদিগের মতে তদ্রপ অদ্ভুত রসাশিত কাব্যপ্রবাহে ভারতবর্ষীয় যুবকদিগের অত্যুবর্বর চিত্তক্ষেত্র প্লাবিত করা কর্তব্য নহে। পরন্তু ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অন্তর্ধান কালাবধি বর্তমান সময় পৰ্যন্তেরই ধারাবাহিক প্রকৃত পুরাবৃত্ত প্রাপ্তব্য। এই নির্দিষ্ট কালমধ্যে এদেশের পূর্ধ্বতন উচ্চতম প্রতিভা ও পরাক্রমের যে কিছু ভগ্নাবশেষ, তাহা রাজপুতানা দেশেই ছিল। বীরত্ব, ধীরত্ব, ধার্মিকত্ব প্রভৃতি নানা সদগুণালঙ্কারে রাজপুতেরা যে রূপ বিমণ্ডিত ছিলেন, তাহাদিগের পত্নীগণও সেইরূপ সতীত্ব, সুধীত্ব এবং সাহসিকত্ব গুণে প্রসিদ্ধ ছিলেন। অতএব স্বদেশীয় লােকের গরিমা প্রতিপাদ্য পদ্য পাঠে চিত্তাকর্ষণ এবং তদৃষ্টান্তের অনুসরণে প্রবৃত্তি প্রধাবন হয়, এই বিবেচনায় আমি উপস্থিত উপাখ্যান রাজপুত্রেতিহাস অবলম্বন পূর্বক রচিত করিলাম।”—অর্থাৎ নিছক রস-চর্চার পরিবর্তে প্রধানত স্বাদেশিক চেতনার বশবর্তী হয়েই যে কবি রাজপুত কাহিনিকে তার কাব্যের বিষয়বস্তু রূপে নির্বাচিত করেছিলেন সে বিষয়টি এখানে সুপরিস্ফুট।
সমালােচক যথার্থই বলেছেন: “প্রাচীন যুগের বীরত্ব ও ঐতিহ্য জ্ঞাপন ইতিকথাকে কাব্যের কথাবস্তুরূপে গ্রহণ করিয়া রঙ্গলাল বাংলা সাহিত্যের একটা নূতন দিক উদঘাটিত করিয়াছেন। প্রাচীন অতীতের গৌরব কাহিনী একদিকে যেমন সহজেই পাঠককে বিমােহিত করিয়া জাতীয়তাবােধে প্রেরণা দেয়, তেমনি অতীতের ঘনান্ধকারে অবলুপ্ত এই কাহিনীগুলি এক অপরূপ রােমান্সরস পরিবেশন করিয়া চিত্তকে রসাবিষ্ট করে।”২১ ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কাব্যটি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনার পূর্বে জেমস টডের ‘রাজস্থান’ গ্রন্থে বর্ণিত আখ্যানটির আকর্ষণ ও বৈচিত্র্য বিষয়ে প্রথমে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলায় পদ্মিনী ও আলাউদ্দিনের উপাখ্যান, উনবিংশ শতকে নতুন করে উজ্জীবিত করেন জেমস টড। তাঁর রচিত ‘অ্যানলস অ্যাণ্ড অ্যান্টিকুইটিস অব রাজস্থান’ দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৮২৯ ও ১৮৩২ সালে। ১৭৯৮ সালে মাত্র ষােলাে বছর বয়সে টড ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ সামরিক কলেজের ছাত্র হিসাবে যােগদান করেন। তিনি ভারতবর্ষে থাকেন ২৪ বছর। এর মধ্যে ১৭ বছর অতিবাহিত করেন মধ্য ভারত ও রাজপুতানায়। এই সময় তিনি বিভিন্ন ভাবে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ করেন। চারণ কবিদের রচনা, গাথা, মহাকাব্যগুলি ছিল তার প্রধান উৎস।
১৮২০ থেকেই টডের ‘রাজস্থান-এর অনুবাদ লক্ষ করা যায় বাংলায়। এই বছর থেকে কবি সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার টডের ‘রাজস্থান’ অনুবাদে উদ্যোগী হন, যদিও তিনি নিজের নাম ব্যবহার করেননি। তাঁর ‘রাজস্থানের ইতিবৃত্ত’ পাঁচটি খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৮৭২-৭৩ সালে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে গােপাল মুখােপাধ্যায় টডের ‘রাজস্থান’ অনুবাদ করেন—এই অনুবাদ পবিত্র রাজস্থান’নামে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। চারুবার্তার’ ভূতপূর্ব সম্পাদক যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক অনূদিত এবং অঘােরনাথ বরাট কর্তৃক প্রকাশিত ‘রাজস্থান’ নামক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১২৯০ বঙ্গাব্দে। এর ভূমিকায় প্রকাশক টডের ভূয়সী প্রশংসা করে লেখেন যে, টডের মতাে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে ভারতের অতীত গৌরব সম্পর্কে জানা গেছে।
সুবিশাল ‘রাজস্থান’ গ্রন্থ বহুবিধ চরিত্র এবং বৈচিত্র্যময় আখ্যানের আকর স্বরূপ। কিন্তু তবু এর মধ্যে এমন দু’একটি চরিত্র এবং ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যা একাধিক কারণেই বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। এইজন্য এই সকল চরিত্র ও আখ্যান অবলম্বন একাধিক গ্রন্থ রচিত হতে দেখা গেছে। পদ্মিনীর উপাখ্যান ‘রাজস্থান’ গ্রন্থে বর্ণিত এমনই এক আকর্ষণীয় বিষয় যা একাধিক কারণেই লেখকদের আকৃষ্ট করেছে।
অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারিণী রাজা ভীম সিংহের পত্নী পদ্মিনীর প্রতি সম্রাট আলাউদ্দিনের প্রলােভন এবং তাকে লাভের আশায় নিজ শিবিরে আগত বৃদ্ধ রাজার প্রতি সম্রাটের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা; অতঃপর পদ্মিনী অসীম সাহসিকতার সঙ্গে কিরূপে রাজাকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন, সে কাহিনি কেবল চিত্তাকর্ষকই নয়, সেই সঙ্গে বিস্ময়করও বটে। এরপর প্রতারিত সম্রাট প্রতিহিংসা চরিতার্থতার জন্য চিতাের আক্রমণ করলে চিতাের রক্ষার জন্য রাজপুতগণ সর্বস্ব পণ করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে সংগ্রাম করেও শেষ পর্যন্ত মাতৃভূমিকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে অসমর্থ হলে পদ্মিনীসহ সকল ক্ষত্রিয় রাজপুত রমণী কঠিন জহরব্রতের অনুষ্ঠানে প্রাণ বিসর্জন দেয়। বাস্তবিক, চিতাের রক্ষার ব্যাপারে রাজপুত বীরগণের বীরত্ব রাজপুতানার ইতিহাসকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। আর সেই সঙ্গে কঠিন জহরব্রতের ন্যায় গাম্ভীর্যময় ও বিষাদ ভারাক্রান্ত অনুষ্ঠানের বর্ণনা পদ্মিনীর উপাখ্যানকে করে তুলেছে অধিকতর আকর্ষণীয়। এইজন্যই কবি রঙ্গলাল এবং পরবর্তীকালে নাট্যকার ক্ষীরােদপ্রসাদ বিশেষভাবে পদ্মিনীর উপাখ্যানকেই তাদের কাব্য ও নাটকের বিষয়বস্তু রূপে নির্বাচন করেছিলেন।
(৬)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’-এ বর্ণিত সকল ঘটনাই কর্ণেল জেমস টডের ‘Annals and Antiquities of Rajastan’-র অনুরূপ। কেবলমাত্র গােরা-বাদল প্রসঙ্গ রঙ্গলাল উপেক্ষা করেছেন। জেমস টড সম্রাট আলাউদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতা বিষয়ে উল্লেখ করে বলেছেন: “The Rajpoot unwilling to be out done in Confidence accompanied the king to the foot of the fortress, amidst many complimentary excuses from his guest at the trouble he thus occasioned. It was for this that Alla risked his own safety, relying on the superior faith of the Hindu. Here he had an ambush; Bheemsingh was made prisoner, hurried away to the Tatar camp, and his liberty made dependent on the surrender of Padmini.’২২ আলােচ্য কাব্যেও সম্রাটের এই বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে—
“দুরন্ত পাঠান পতি পেয়ে তারে করে।
সেইক্ষণে কারাগারে লয়ে বদ্ধ করে।।”
এরপর সম্রাটের উক্তিতে বলা হয়েছে :
“অতএব বৃথা কেন বাড়াইবে গােল।
পদ্মিনীরে এনে দাও রাখ মন বােল।।
সব দিক রক্ষা পাবে হইবে মঙ্গল।
একেবারে নিবে যাবে সমর অনল।।”
আলাউদ্দিন সম্পর্কে টডের উষ্মা উচ্চকণ্ঠে ঘােষিত হয়েছে। টডের কথায়, আলাউদ্দিন ছিলেন, ‘One of the most vigorous and warlike sovereigns who have occupied the throne of India. In success, and in one of the means of attainment, a bigoted hipocricy, he bore striking resemblance to Aurangzeb…’
(৭)
আলাউদ্দিন দু’বার চিতাের আক্রমণ করেছিলেন এবং ফিরিস্তার ভাষায় : ‘Chitor…was stormed, sacked and treated with remorseless barbarity by the Pathan (Khalji) emperor, Ala-ud-din.’২৩ বিখ্যাত ঐতিহাসিক কে. এস. লাল অবশ্য মনে করেন, সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ অভিজাতদের প্রতি আলাউদ্দিনের আচরণের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা অতিরঞ্জিত। তবে এটা যথার্থ, অভিজাতগণ এতদিন যে ক্ষমতা দিল্লি সুলতানি যুগে ভােগ করে আসছিলেন, আলাউদ্দিন তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। আধুনিক কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন, আলাউদ্দিনের এই প্রশাসনিক নির্দেশ সবচেয়ে কঠোর হয়েছিল হিন্দুদের প্রতি। তিনি সীমাহীন স্বেচ্ছাতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি হিন্দুদের কাছ থেকে নানাবিধ কর আদায় করে তাদের আর্থিক প্রতিপত্তি সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করার চেষ্টা করেন। এ ব্যাপারে আলাউদ্দিনের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু জমিদার শ্রেণির লােকের অর্থনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করা। জিয়াউদ্দিন বারনির একটি মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে স্যার হেগ লিখেছেন, আলাউদ্দিনের সমগ্র রাজ্যে হিন্দুরা চরম দারিদ্র ও দুর্দশাসীমার নীচে পতিত হয়। এমনকি হিন্দু জমিদার শ্রেণির মহিলাগণও মুসলমান গৃহে পরিচারিকার বৃত্তি গ্রহণ করতে বাধিত হয়েছিল। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ হেগের মন্তব্যকে অতিরঞ্চিত বলেই মনে করেন। ডঃ সতীশচন্দ্র মনে করেন, আলাউদ্দিন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন, যে সমস্ত হিন্দু কর্মচারী বংশানুক্রমিকভাবে খাজনা আদায় করতেন, তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। তাই আলাউদ্দিন এই উচ্চপদাধিকারী হিন্দু কর্মচারীগণের, যথা চৌধুরি, খুৎ, মুকাদ্দম প্রভৃতির ক্ষমতা খর্ব করতে চেয়েছিলেন। এঁরা যেহেতু হিন্দু কর্মচারী ছিলেন এবং এঁরাই সংখ্যায় বেশি ছিলেন। স্বভাবতই মনে হতে পারে, হিন্দুরাই তার নীতির শিকার হয়েছিলেন। তার নীতি হিন্দু-মুসলমান সকলের প্রতিই সমভাবে প্রযুক্ত হয়েছিল। হিন্দু-বিদ্বেষ তার শাসননীতর মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল।
তাছাড়াপর্যটক ইবন বতুতা আলাউদ্দিন খিলজিকে ‘ওয়ান অফ দ্য বেস্ট সুলতান’২৪ বললেও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারণি তাকে নির্মম’, ‘রক্তলােলুপ’ বলে বর্ণনা করেছেন। হিন্দুদের প্রতি বিশেষত অনমনীয় রাজপুতদের প্রতি, আলাউদ্দিন কঠোর ছিলেন, এমনকি বিদ্বিষ্ট ছিলেন বলে জিয়াউদ্দিন বারণি জানিয়েছেন।২৫ স্বাভাবিকভাবে রঙ্গলাল এই সমর্থনে উত্তেজনা বােধ করেছেন। বলা বাহুল্য, রাজপুতানার ইতিহাস হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বের ইতিহাস। ফলে বাংলা কাহিনি কাব্যের আধুনিক ধারার সূচনায় একদিকে যেমন বাঙালি হিন্দুর চিত্ত রাজপুত বীরত্বকে মহিমান্বিত মূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল, অন্যদিকে তেমনি মুসলমানকে দেখল আক্রমণকারী শত্রুর ভূমিকায়। প্রকৃতপক্ষে রঙ্গলাল মুসলিম গৌরব বা বীরত্বকাহিনিকে এদেশীয় ভাবেননি, তাই তার কোনাে উল্লেখ তাঁর কাব্যের দীর্ঘ ভূমিকায় নেই।
‘পদ্মিনী উপাখ্যানে’র কাহিনি বর্ণিত হয়েছে জনৈক ব্রাহ্মণের জবানীতে, যদিও কিছুক্ষণ পরপরই কবি “অসামাজিক লােকের ন্যায় বক্তার মুখ বন্ধ করিয়া নিজেও দু’কথা বলিয়া লইয়াছেন।”২৬ অবশ্য কাহিনি-অঙ্গে কবি নির্লিপ্ত নন বলেই এইসব স্বাগতােক্তিতে তার স্বাধীনতার কামনা, পরাধীনতার বেদনা, দেশপ্রীতি এবং ‘বিদেশাগত’ মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে।
কাব্যের সূচনায় বর্ণিত চিতাের দুর্গ-দুয়ারের বৈশিষ্ট্য : যবনের কার্যতাহে নহে দৃশ্যমান। এই মৌলিক হিন্দুকীর্তি দেখে কবির চিন্তা ‘কোথায় সেদিন যেদিন ভারতভূমি ছিলেন স্বাধীন। মধ্যযুগের কবিরা যেমন পৃষ্ঠপােষক রাজার কীর্তি বর্ণনা করতে গিয়ে তাকে জগৎ-বিজয়ী বলে উল্লেখ করতেন রঙ্গলালও তেমনি ভঙ্গিতে ‘রাজপুত্র ইতিহাসএর ‘আদ্যস্থান’ চিতােরপুরীর বীরগাথা রচনা করেছেন।
‘পদ্মিনী উপাখ্যানে’ আলাউদ্দিন মুখ্যত ‘যবন রাজা’ নামে পরিচিত। কাব্যের শেষের দিকে চিতাের অধিকার অংশে কেবল তার নাম ব্যবহৃত। তিনি পদ্মিনীর প্রতি আসক্ত ছিলেন। মুসলমান পুরুষের রূপলালসা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যত কাহিনি প্রচলিত আছে রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ তার অন্যতম। “আলাউদ্দীনকে উপলক্ষ্য করে সামগ্রিকভাবে মুসলিম জাতির প্রতি তাঁর (কবির) বিদ্বিষ্ট মনােভাবের অনাবৃত প্রকাশ ঘটেছে। ভীম সিংহ ও আলাউদ্দীন পরস্পরের ধর্ম-নিন্দায় ব্যাপৃত হয়েছেন, নিন্দাংশ ভারতচন্দ্রানুসারী, রঙ্গরসিকতা গ্রাম্যতাযুক্ত।”২৭
১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহ তথা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম সম্মিলিত বাহিনীর শােচনীয় পরাজয়ের পর ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। মুসলমান সমাজের সচেতন অংশকে এ পরাজয়ের ঘটনা দিশাহারা করে তুলেছিল। একদিকে পরাধীনতার কবলে আত্মসমর্পণ অন্যদিকে অনগ্রসর সমাজ—এই প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত হয় পদ্মিনী উপাখ্যান। প্রকৃতপক্ষে রঙ্গলাল এ কাব্যে “এককালের শাসক মুসলমানদের সম্পর্কে তার অন্তর্জালা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বাংলা কাহিনী কাব্যের আধুনিক ধারার সূচনায় বাঙালী হিন্দুর চিত্তে রাজপুত বীরত্বকে মহিমান্বিত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।”২৮ ফলে ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কাব্য বিচারে সার্থক না হলেও মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশে তা যথেষ্ট সফল হয়েছিল।
মুসলমান অবরুদ্ধ চিতাের দুর্গের অভ্যন্তর-দৃশ্য বর্ণনায় এবং দেশের শ্রীহীন অবস্থার বর্ণনায় রঙ্গলাল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, অবশ্য পদ্মিনী কর্তৃক বন্দী ভীম সিংহকে উদ্ধার প্রসঙ্গ রচনায় কবি বাস্তবতার মর্যাদা রক্ষা করেননি। সমালােচক বলেন, এতে “অলৌকিকত্ব না থাকিলেও কিছু ভােজবাজির প্রভাব আছে; …পাঠান-শিবির সৈন্যশূন্য না থাকিলে ইহা যে কোন উপায়ে সম্ভব হইল তাহার বর্ণনা দিতে কবি কার্পণ্য করিয়াছেন।”২৯ অবশ্য একথা সত্য, পদ্মিনী উপাখ্যানে যবন রাজার রূপাসক্ত হৃদয়ে কিছু মানবিকতাও সঞ্চার করেছেন কবি। অবরুদ্ধ চিতােরের অবস্থার প্রেক্ষাপটে আলাউদ্দিনের স্বগত চিন্তা : “মনে ভাবে দূর হউক মিছে করি রণ/বিপদ ঘটিল এক নারীর কারণ।”৩০
তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যসাধন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয়দের উত্তেজিত করে তােলা মুখ্য হলেও, রঙ্গলালের দেশপ্রীতি ও স্বাধীনতার কামনা কয়েকটি সুস্পষ্ট চরণে বাস্তব হয়ে উঠেছে। এই সঙ্গে এ কাব্যের ভূমিকায় কথিত অধীন জাতির আত্মগৌরব উদ্বোধনের সচেতন প্রয়াস সম্পর্কে মন্তব্য স্মরণ প্রসঙ্গটি স্পষ্টতর হবে। যুদ্ধে ভীমসিংহের পরাজয় ও রাণীর ‘অগ্নি প্রবেশের পর আলাউদ্দিনের ‘চিতােরাধিকারের বর্ণনা—“যবনের অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে কতবার/এইবার হইল সকল।।/আলাউদ্দীনের দণ্ড করে সব লণ্ড ভণ্ড/কি বলিব যে হল দুর্গতি।।/ভাঙ্গিয়া পড়িল যত দেবালয় শত শত/শিল্পচাতুরীর এক শেষ।।/লুটে নিল সব ধন, চিতােরের সিংহাসন/ছত্র দণ্ড অস্ত্র রাজবেশ।।/পােড়াইয়ে ছারখার করিলেক ঘরদ্বার/বাদশার আদেশে কেবল।।/পদ্মিনীর মনােহর অট্টালিক পরিকর।/নষ্ট না করিল দুষ্ট দল।।”
পদ্মিনীর আত্মহত্যার সংবাদ আলাউদ্দিন পাননি। তাই চিতাের অধিকারের পর তার আনন্দিত কল্পনা :
“রূপসী পঙ্কজ হ্রদ,
পদ্মিনী কোকনদ
প্রধানা মহিষীপদ লবে।
সর্বোপরি যার স্থান
কমলাদেবীর মান
এইবার লঘুকল্প হবে।”
কমলাদেবীর পরিচয় হিসাবে কবির পাদটীকা: “ইনি গুজরাট অধিপতির মহিষী ছিলেন। আলাউদ্দিন নেহারওয়ালা অধিকার পূর্বক উক্ত ভূপতির অন্যান্য সম্পত্তির মধ্যে কুলকামিনী হরণ করিয়া লইয়া আইসে। কমলাদেবী অসামান্য রূপলাবণ্যবতী ছিলেন, তজ্জন্য আলাউদ্দিন তাহাকে প্রধান মহিষী করে এবং তদাবধি হিন্দু-নৃপ-ললনাগণ হরণে লােলুপ হয়।”
লক্ষ্যণীয় যে, কবি কমলাদেবীকে সম্মান দেখালেও আলাউদ্দিন বাদশার প্রতি কোনােরকম শ্রদ্ধাবােধই প্রকাশ করেননি। কাব্যশেষ হয়েছে সমকালীন হিন্দুদের দুর্বলমতিত্ব সম্পর্কে বিলাপ ও শাসক ইংরেজ সরকারের প্রতি সশ্রদ্ধ মন্তব্যে :
“কি আছে এখন আর!
দাসত্ব শৃঙ্খল সার
প্রতি পদে বাধা পদে পদে
দুর্বল শরীর মন,
ম্রিয়মান হিন্দুগণ
তত্ত্বহীন মত্ত দ্বেষমদে।।”
এই শােচনীয় অবস্থায় বর্তমানে একমাত্র আশার কথা :
“ভারতের ভাব্যজোর দুঃখ বিভাবরী ভাের,
ঘুম ঘাের থাকিবে কি আর?
ইংরাজের কৃপাবলে মানস উদয়াচলে
জ্ঞানভানু প্রভায় প্রচার।”৩১
এইসব রচনা প্রসঙ্গে সমালােচকের উক্তি: “মােঘল যুগে যদি ভারতবর্ষ পরাধীন হয়ে থাকে তবে ইংরেজ যুগেই কি সে স্বাধীন হয়েছে ? স্বভাবতই আজ আমরা এই প্রশ্ন করি, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে স্বাধীনতা এবং স্বদেশ চেতনার প্রসার ও গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ জাতির প্রশস্তি উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘকাল লক্ষ্য করি।”৩২
‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কাহিনির এই পরিণতি সম্পর্কে প্রথম উল্লেখযােগ্য আপত্তি করেন রামগতি ন্যায়রত্ন। তার মন্তব্য, কাহিনিরসের দিক থেকে অন্তত উপেক্ষণীয় নয়: “আলাউদ্দীন পদ্মিনীর জন্য উন্মত্তবৎ হইয়াছিল, কিন্তু চিতাের দুর্গে প্রবেশ করিয়া অন্বেষণ করিয়াও যখন পদ্মিনীকে দেখিতে পাইলেন না, তখন পদ্মিনী কোথায় গেল তাহার অন্বেষণ করিলেন না! পদ্মিনীর জন্য খেদ করিলেন না—পদ্মিনী প্রাপ্ত না হওয়ায় এত ধন, এত সৈন্য ও এত সময়ের ধ্বংস যে অনর্থক হইল, তাহা ভাবিয়া নির্বিষন্ন মনে একবারও আক্ষেপ করিলেন না!—করিলে ভাল হইত…।”৩৩ রামগতি ন্যায়রত্নের এই সমালােচনার বিরুদ্ধে মন্মথনাথ ঘােষ বলেন, “আমাদের মনে হয় দিল্লীর অধিপতির পক্ষে উচ্চৈস্বরে আক্ষেপ প্রকাশ করা নিতান্ত অশােভন হইত, তাহার দুষ্কার্যের গুরুত্ব নীরবে উপলব্ধি করাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত।”৩৪
কিন্তু যুক্তি সুন্দর হলেও রঙ্গলালের আলাউদ্দিন সম্বন্ধে একথা বলা চলে না। “কাব্যের শেষে ‘দুষ্কার্যের গুরুত্ব নীরবে উপলব্ধির’ইঙ্গিতমাত্রও নেই, বরং কাহিনীকাব্য রচনাকালে চরিত্রসৃষ্টির নাট্যকৌশল রঙ্গলালের অজ্ঞাত ছিল এবং উদ্দেশ্যমূলক আবেগবিহ্বলতাবশত বাস্তবতার চেতনা ও পরিমিতিবােধ সর্বদাই অবহেলিত হয়েছে। কবি শক্তির দুর্বলতা এর প্রধান কারণ নিঃসন্দেহে। অবশ্য কবি অবলম্বিত ইতিহাসে’র ত্রুটিপূর্ণ তথ্য ও ভ্রান্ত অভিমত এজন্য অনেকাংশে দায়ী।”৩৫
(৮)
আসলে বাঙালি সমাজে পদ্মিনীর আবির্ভাব বিশেষ তাল্পৰ্যবাহী। বাঙালির অবচেতনে নারীর সতীত্ব ও জাতীয় সম্মান ঊনবিংশ শতক থেকেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তাই ইতিহাসকে পুরা-কাহিনির আদলে গড়ে তােলা হয়। ঐতিহ্য সন্ধানী ভারতীয় সাহিত্যিক ও শিল্পীদের কাছে যে রূপকল্প প্রয়ােজনীয় হয়ে দাঁড়ায় তা দেশকে শুধু মাতৃরূপে নয়, একই সঙ্গে সতী ও দেবী হিসাবেও চিহ্নিত করে। এই রূপকল্পের প্রধান শিল্পী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার লেখা কিশােরপাঠ্য ইতিহাস ‘রাজকাহিনি’—এখানে পদ্মিনী দেবীরূপেই কল্পিত হন: “…যখন দ্বিপ্রহরের স্তব্ধ রাজপুরে হাজার হাজার রাজপুত বীরের চোখের সম্মুখে আবার সেই দেবী মূর্তি ম্যায় ভুখা হু’ বলে প্রকাশ হলেন, তখন আর কারাে মনে কোনাে সন্দেহ রইল না…কেবল ভীম সিংহ যেন সেই দেবীমূর্তির ভিতরে পদ্মিনীকে দেখে মনে মনে তােলপাড় করতে লাগলেন—এ কি দেবী, না পদ্মিনী ? পদ্মিনী না দেবী? তারপর, মহাবলির উদযােগ হল।”৩৬
সমগ্র বর্ণনার মধ্যে দিয়ে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের যে রূপ ফুটে ওঠে তা একদিকে ভয়ংকর, অন্যদিকে ১৯০৬ সালের স্বদেশী মতাদর্শের বিশেষ প্রকাশ। পরে অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই স্বদেশিয়ানার এই উগ্রতা হতে সরে আসেন, কিন্তু তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে এর প্রভাব থেকে যায়। আর পাঠ্য ইতিহাসে আলাউদ্দিনকে করে তােলা হয় সব মুসলমান সম্রাটের প্রতীক, যে একই সঙ্গে মূল বাসিন্দাদের উৎখাত করতে চায় তাদের দেশভূমি হতে আর তার সঙ্গে তার লালসা গ্রাস করে শুধু নারীকে নয়, সব কিছু যা সুন্দর, যা পবিত্র—“বারাে হাজার রাজপুতনীর সঙ্গে রাণী পদ্মিনী অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিলেন—চিতােরের সমস্ত ঘরের সমস্ত সােনামুখ, মিষ্টি কথা আর মধুর হাসি নিয়ে এক-নিমেষে চিতার আগুনে ছাই হয়ে গেল।”৩৭ যা রয়ে গেল তা প্রতিহিংসার ইচ্ছা। আর রয়ে গেল পক্ষপাতদুষ্ট তথা সাম্প্রদায়িক ইতিহাস ও সাহিত্য রচনার কয়েকটি সূত্রও। এর প্রভাব হতে এখনকার ইতিহাসও যে মুক্ত নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রঙ্গলালের উৎস গ্রন্থ ‘রাজস্থান প্রণেতা কর্ণেল টডের রাজপুত-প্রীতি ও মুসলিমবিদ্বেষের স্বরূপ এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা দরকার। রাজস্থানের নতুন সংস্করণের সম্পাদক উইলিয়াম ক্রুক স্পষ্টতই বলেছেন—’Tod fells us little of his relations with supreme Government during his four years service as Political Agent. He was notoriously a partisan of the Rajput princes, particularly those of Mewar and Marwar he is never tired of abusing the policy of the Emperor Aurangzeb and, fortunately for the success of his work, Muhammadan form only a slight minority in the population of Rajputana. This attitude naturally exposed him to criticism. Writing in 1824 Bishop Heber (fn. “Narrative of a Journey through the Upper Provinces’, ed. 1861, ii, 54), while he recognises that he was held in affection and respect by “all the upper and middling classes of society’, goes on to say: His misfortune was that in consequence of his favouring the native princes so much, the Government of Calcutta were led to suspect him of corruption, and consequently to narrow his powers and associate other officers with him till he was disgusted and resigned his place… ৩৮
কর্ণেল টডের ভ্রান্ত মন্তব্য ও সিদ্ধান্তের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে উইলিয়াম ক্রুক বলেছেন: ‘His taste for the study of history and antiquities, ethnology, popular religion, and superstititions was stimulated by the pioneer work of Sir Jones and other writers of the ‘Asiatic Researches.’ He was not a trained philologist and he gained much of his information from his Guru, the Jain Yati Gyanchandra, and the Brahman Pandits whom he employed to make inquiries on his behalf. They, too, were trained scholars in the modern sense of the term, and many of his mistakes are due to his rashness in following their guidance.৩৯
সর্বোপরি, লােককাহিনি ও লােককাব্য থেকে নির্বিচারে উপাদান গ্রহণ টডের আর একটি দুর্বলতা এবং যেহেতু বাঙালি কবিরা টডের রচনা থেকে এসব কাহিনিই আহরণ করেছেন, সেহেতু এগুলাের ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কেও নির্মোহ হওয়া প্রয়ােজন। সম্পাদক উইলিয়াম ক্রুক এ প্রসঙ্গে নির্মম মন্তব্য করতে ইতস্তত করেননি: ‘In estimating the Value of the local authorities on which the history is based, Tod reposed undue confidence in the epice and ballads composed by the poet Chand and other tribal bards. It is belive that more than one of these poems have disappeared since his time, and these materials have been only in part edited and translated. The value to be placed on bardic on literature is a question not free difficulty…. The poet may occasionally record facts of value, but in his zeal for the honour of the tribe, which he represent, he is tempted to exaggerate victories, to minimize defeats. This is a danger to which Indian poets are particularly exposed. Their trade is one of fulsome adulation, and in a state of society like that of Rajputs, where tribal and personal rivalries flourish, the temptation to give a false colouring of history is great. In fact, bardic literature is often useful not as evidence of occurances in antiquity, but as an indication of the habits and beliefs currents in the age of the writer. It exibits the facts, not as they really occured, but as the writer and his contemporaries supposed that they occured. The mind of the poet with all its prejudices, projects itself into the distinct past’৪০
তার ওপর, “…the fragment of local ballades scattered through the text are unfortunately copied from very incorrect texts.’৪১ ঐতিহাসিক কালিরঞ্জন কানুনগাের দৃষ্টিতে (কালিকারঞ্জন কানুনগো, শের শাহ, কার মজুমদার অ্যাণ্ড কোম্পানি, কলকাতা) টডের রাজস্থান কাহিনী ‘too legendary for historical purposes’ তাই শের শাহের ইতিহাস রচনায় ঐতিহাসিক কালিরঞ্জন কানুনগাে টডকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। জেমস্ টডের ‘রাজস্থান’-র স্বরূপ সম্পর্কে কানুনগাে যথার্থই বলেছেন: “ধরুন আজ হইতে দুই শত বৎসর পরে কোন রাজনৈতিক কিংবা প্রাকৃতিক বিপ্লবে আমাদের দেশ হইতে আকবর, আওরঙ্গজেব প্রভৃতির সমসাময়িক ফার্সি ইতিহাস এবং স্যার যদুনাথ ইত্যাদির গবেষণামূলক ইতিহাস নষ্ট হইয়া গিয়াছে—শুধু বঙ্কিমচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলালের উপন্যাস ও নাটকগুলি রহিয়া গেল। এ অবস্থায় আমেরিকার কোন পণ্ডিত যদি এদেশের ইতিহাস উদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হন এবং উপন্যাস ও নাটকগুলির চুম্বক-কথা ইতিহাসের আকারে লিখিয়া যান, উহা যেরূপ ইতিহাস দাঁড়াইবে টডের ইতিহাসও প্রায় সেই রকম দাঁড়াইয়াছে।”৪২
‘রাজস্থান’ কাহিনির এই সার্বিক সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ রেখেই টড-নির্ভর বাংলা রচনাবলির বিচার করতে হবে এবং এ বিচারের প্রথম গ্রন্থ হলাে রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’। টড বর্ণিত পদ্মিনী কাহিনি প্রসঙ্গে স্মিথ স্পষ্টতই বলেছেন—’They cannot be regarded as sober history.৪৩ তাছাড়া পদ্মিনী উপাখ্যানের যে কোনাে ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই, তা ঐতিহাসিক কানুনগাে প্রমাণ করেছিলেন প্রবাসী পত্রিকার ১৩৩৭ সালে ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে।৪৪ কিন্তু ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় আলাওলের ‘পদ্যাবতী পুঁথি’ অবলম্বন করে প্রমাণ করার একদা চেষ্টা করেছিলেন যে, পদ্মিনী একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। নিখিলবাবুর এই লেখা প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী’-র ১৩৩৮-এর চৈত্র সংখ্যায়।৪৫ এই প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক কানুনগাে আবার লিখলেন ‘পদ্মাবৎ কাব্য এবং পদ্মিনীর অনৈতিহাসিকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে নিখিলবাবুর সমস্ত যুক্তিকে খণ্ডন করেছেন ঐতিহাসিক কানুনগাে এবং তার সিদ্ধান্ত : ইতিহাসে পদ্মিনী রানীকে খোঁজা বৃথা।৪৬
সুতরাং আলাউদ্দিনের হিন্দু বিদ্বেষকে প্রকট করে দেখাবার জন্য চিতাের আক্রমণের প্রধান কারণ হিসেবে যে পদ্মিনীর প্রসঙ্গ এক শ্রেণির ঐতিহাসিকরা তুলে ধরেন, তার স্থান ইতিহাসে নেই। আর পদ্মিনী কাহিনি পুরােটাই কাল্পনিক এবং উদ্ভট উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর মাত্র।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. অশীন দাশগুপ্ত, ইতিহাসচর্চা ঐতিহাসিক: আজকের দায়; অন্তর্ভুক্ত-রণবীর চক্রবর্তী, কুণাল চক্রবর্তী ও অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ২০।
- ২. James Tod, ‘Annals and Antiquities of Rajastan’ or the Central and Western Rajput States of India, Ed. by William Crooke, Vol.-I, Oxford University Edinburgh, 1920, P. 307-12.
- ৩ .KS Lal, History of the Khaljis (Conquest of Chittor), | rev. edition, Delhi, 1980, P. 129-130.
- ৪. R Prasannan, Myth-7, The self-sacrifice of the fair queen Padmini, The Week (Kochi), Mid-year special, 29 June 2003, P. 47.
- ৫. রামচন্দ্র শুক্ল, ‘হিন্দী সাহিত্য কা ইতিহাস, ইন্ডিয়ান প্রেস লিমিটেড, প্রয়াগ, ১৯৯০, পৃ. ৪৮-৪৯।
- ৬. দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, পদ্মাবতী জায়সী ও আলাওল, খণ্ড-১, কলকাতা, ১৯৮৪, পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।
- ৭. রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়, পদ্মিনীর আখ্যান: ইতিহাসের বিভিন্ন পাঠ, অন্তর্ভুক্ত পুলক চন্দ সম্পাদিত, নারীবিশ্ব, গাংচিল, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ৪৯।
- ৮. দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।
- ৯. Ishwari Prasad, History of Medieval India, Allahbad, 1940, P. 226.
- ১০. K S_Lal, ibid, P.129; দেখুন-বরুণকুমার চক্রবর্তী, টডের রাজস্থান ও বাংলা সাহিত্য, অপর্ণা বুক ডিস্ট্রিবিউটার্স, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ২৫।
- ১১. The History of Mahomedan power in India till year AD 1912, Translated from the original persian of Mahammad Kasim Firishta, by J Briggs, Calcutta, 1908, Vol.-1; দেখুন বরুণকুমার চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫-২৬।
- ১২. Abul Fazl, The Ain-i-Akbari, translated and edited by H Blockman and H S Jarrett, Calcutta, 1873-94, Vol.-II, P. 269; দেখুন- বরুণকুমার চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬।
- ১৩. গৌরীশংকর হীরাচঁাদ ওঝা, রাজপুতানে কা ইতিহাস, খণ্ড-২, প্রবাসী ১৩৩৭, পৃ. ৪৬১।
- ১৪. K S_Lal, ibid, P.121; দেখুন-বরুণকুমার চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬।
- ১৫. বরুণকুমার চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬।
- ১৬. রামচন্দ্র শুক্ল সম্পাদিত, ‘জায়সীর কাব্য গ্রন্থাবলী’র ভূমিকা, প্রথম সংস্করণ, ২য় সংস্করণ ১৯৩৫, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৬১।
- ১৭. রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২-৫৩; আর শ্রীনিবাসন, দ্য মেনি লাইভস অফ এ রাজপুত কুইন, দিল্লি, ২০০৭, পৃ. ১০৪-১০৫।
- ১৮. দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, পদ্মাবতী জায়সী ও আলাওল, খণ্ড-২, কলকাতা, ১৯৮৪।
- ১৯. দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩০।
- ২০. রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মিনী উপাখ্যান, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, তৃতীয় সংস্করণ, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
- ২১.তারাপদ মুখােপাধ্যায়, আধুনিক বাংলা কাব্য, মিত্র ও ঘােষ, কলকাতা, ১৩৬১, পৃ. ৬৯।
- ২২. James Tod, ibid, Chap.-VI, P. 219.
- ২৩. James Tod, ibid, Introduction, P. XIII.
- ২৪.V A Smith, Oxford History of India, Oxford, London, Second edn., 1928, P. 231.
- ২৫.V A Smith, ibid, P. 232 & 234.
- ২৬. রামগতি ন্যায়রত্ন, ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’, গিরীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, চুচুড়া, ১৩৪২।
- ২৭. মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ. ৫৫-৫৬।
- ২৮. মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬।
- ২৯.তারাপদ মুখােপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫।
- ৩০.শান্তিকুমার দাশগুপ্ত ও শ্রীহরিবন্ধু মুখুটি সম্পাদিত, রঙ্গলাল রচনাবলি, দত্ত চৌধুরী অ্যান্ড সন্স, কলকাতা, ১৩৮১, পৃ. ১৪৭।
- ৩১. শান্তিকুমার দাশগুপ্ত ও শ্রীহরিবন্ধু মুখুটি সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৬।
- ৩২. ভবতােষ দত্ত, বাঙালীর সাহিত্য, অণিমা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃ. ১৭৬।
- ৩৩. রামগতি ন্যায়রত্ন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৬।
- ৩৪. মন্মথনাথ ঘােষ, ‘রঙ্গলাল’, কলকাতা, ১৯৩৬, পৃ. ২০৫।
- ৩৫. মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬।
- ৩৬. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজকাহিনি, ষষ্ঠ একত্রিত সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৬১, পৃ. ১১।
- ৩৭. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১।
- ৩৮. James Tod, ibid, Introduction, P. XXVII-VIII.
- ৩৯. James Tod, ibid, Introduction, P. XXVIII.
- ৪০. James Tod, ibid, Introduction, P. XXX.
- ৪১. James Tod, ibid, Introduction PP. XIII.
- ৪২. কালিকারঞ্জন কানুনগাে, ‘পদ্মাবৎ কাব্য এবং পদ্মিনীর অনৈতিহাসিকতা’, অন্তর্ভুক্ত। রাজস্থান কাহিনী, মিত্র ও ঘােষ পাবলিশার্স, কলকাতা, সপ্তম মুদ্রণ, ১৪১৭, পৃ. ২১০।
- ৪৩. V A Smith, ibid, P. 233.
- ৪৪. কালিকারঞ্জন কানুনগাে, পদ্মিনী উপাখ্যান ও তাহার ঐতিহাসিকতা, প্রবাসী, ফাল্গুন ১৩৩৭।
- ৪৫. নিখিলনাথ রায়, ‘পদ্মাবতীর ঐতিহাসিকতা, প্রবাসী, চৈত্র ১৩৩৮।
- ৪৬. কালিকারঞ্জন কানুনগাে, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।