বাংলায় সুলতানি শাসনামলে হুসেন শাহী বংশের চার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯), নসরৎ শাহ (১৫১৯-১৫৩২), আলাউদ্দিন ফিরােজ শাহ (১৫৩২-১৫৩৩) ও গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮) বাংলা রাজত্ব করেন। তাদের শাসনকালে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সামরিক ক্ষেত্রে সাফল্য ও বাঙালি প্রতিভার বহুমুখী বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ফলে বাঙালি জীবনে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল। বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসার সম্ভব হয়েছিল। এক কথায় বলা যেতে পারে যে, বাংলার সর্বাঙ্গীণ ক্ষেত্রে উন্নতি পরিলথিত হয়েছিল। তাই হুসেন শাহী যুগকে (১৪৯৪-১৫৩৮) বাংলার ইতিহাসে গৌরবােজ্জ্বল যুগ বলা যেতে পারে।
বাংলার সুলতান তথা হুসেন শাহী সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের খ্যাতি এই বাংলার ঘরে ঘরে জনস্মৃতিতে আজও অম্লান। উড়িষ্যা থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগে তার নাম সুপরিচিত। সুশাসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি জনগণের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। ঐতিহাসিক এ বি এম হাবিবুল্লাহর মতে, ‘Alauddin Husain Shah was unquestionably the best, if not the greatest, of the medieval rulers of Bengal.’ অর্থাৎ “হুসেন শাহ নিঃসন্দেহে বাংলার মধ্যযুগীয় শাসকদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট যদিও তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন না।” এখানে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে বাংলার দু’শাে বছরের সুলতানি শাসনকালের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী কে? উল্লেখ্য যে, একজন শাসকের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে কয়েকটি গুণের ওপর—১) রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায়, ২) রাজ্য সম্প্রসারণ দ্বারা সামরিক প্রভাব বিস্তার, ৩) প্রশাসনিক বিন্যাস দ্বারা রাজ্যে সুশাসন কায়েম, যাতে কোনাে বিদ্রোহ না হয়, ৪) ধর্ম সহিষ্ণুতা দ্বারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ও সমঝােতা বজায়, ৫) শিল্পকলা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা ইত্যাদি। উপরােক্ত গুণাবলির বিচারে হুসেন শাহকে নিঃসন্দেহে শুধু ‘The best’ নয়, ‘The greatest’ সুলতান বলা যায়।
(১)
সাম্রাজ্য বিস্তারে মনােনিবেশ করার পূর্বে হুসেন শাহ অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অরাজকতা সৃষ্টিকারী সৈন্যদলকে তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সুলতানের হত্যাকাণ্ডে প্রধান অংশ নিয়েছিল দেহরক্ষী পাইক দল। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ পাইকদের দল ভেঙে দিয়ে নতুন রক্ষীবাহিনী গঠন করেন। হাবশীদের তিনি রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। তাদের পরিবর্তে তিনি সৈয়দ, মােঙ্গল, আফগান ও হিন্দুদের প্রশাসনে নিয়ে আসেন। হুসেন শাহ অত্যন্ত ধীর ও সুচতুরভাবে দিল্লির সুলতান সিকান্দর লােদীর আগ্রাসনের মােকাবিলা করেন। বহিঃশত্রুর অভিযানে তিনি বিচলিত না হয়ে বিপদের মােকাবিলা করে রাজ্যে সংহতি ও স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করেন। রাজ্যে অসন্তোষ দমনের জন্য তিনি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লােকদের প্রধান অমাত্যদের এবং নিজের অনুগত অনুচরদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। ফলে পূর্ববর্তী সুলতানদের আমলে যে রাজ্য ধ্বংসােন্মুখ অবস্থায় পৌঁছেছিল, তাতে আবার শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল এবং অসন্তোষ ও বিদ্রোহের মূল উৎপাটিত হয়েছিল।
হুসেন শাহের রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল এবং এগুলাের শাসনভার দেওয়া হয়েছিল গভর্নরের ওপর। ঘােড়াঘাট, বারবকাবাদ, বাজুহা, সিলেট, সােনারগাঁও প্রভৃতি প্রদেশ গঙ্গা নদীর উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। গঙ্গার অববাহিকায় ছিল সাতগাঁও, মাহমুদাবাদ, ফতেহাবাদ, বাকলা প্রভৃতি প্রদেশ। গঙ্গা নদীর দক্ষিণে ছিল তান্ডা, শরিফাবাদ, সুলায়মানবাদ এবং মন্দারাণ। সমস্ত প্রশাসনিক অঞ্চল বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। কখনাে আরসা, যেমন আরসা সাতগাঁও, আবার কখনাে ইকলিম, যেমন ‘ইকলিম মুয়াজ্জামাবাদ’। প্রাদেশিক প্রশাসককে বলা হত ‘সর-ই-লস্কর’ অথবা ‘উজির’ অর্থাৎ তার দু’ধরনের কর্তব্য ছিল সেনাধ্যক্ষ এবং মন্ত্রী হিসেবে। সুলতান সরাসরি প্রাদেশিক গভর্ণর নিযুক্ত করতেন। একটি প্রদেশ আবার কয়েকটি জেলা বা মহলে বা শহরে বিভক্ত হত এবং একজন শাসনকর্তার উপর সামরিক কর্তব্য অর্পিত হত। মহলের প্রধান কর্মকর্তাকে বলা হত শিকদার অথবা ‘জঙ্গদার’।
দুঃখের বিষয়, বাংলার অন্যান্য সুলতানদের মতাে হুসেন শাহের প্রামাণিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তার শাসনকালের বেশ কিছুসংখ্যক লিপি পাওয়া গিয়েছে। সমসাময়িক লেখনীতে তাঁর রাজত্বকাল সম্বন্ধে কেবল বিক্ষিপ্ত তথ্য পাওয়া যায়। ফারসি ইতিহাসে কিছু কিছু তথ্য আছে। এদের মধ্যে গােলাম হুসেন সলীমের ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’-এ কতকটা বিস্তৃত ও ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’-এর তথ্য অনেকাংশে অন্য নির্ভরযােগ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। নিজামউদ্দিন আহমদ বখশীর ‘তবকৎ-ই-আকবরী’ ও কাসিম ফিরিস্তার ‘তারিখ-ই-ফিরিস্তা’ গ্রন্থে হুসেন শাহের শাসনকালের অনেক বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে চৈতন্যজীবনী গ্রন্থসমূহেও আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। উড়িষ্যার মাদলাপঞ্জি, অসমের বুরঞ্জী এবং ত্রিপুরার রাজমালায় ওইসব দেশের সঙ্গে হুসেন শাহের যুদ্ধের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। তবে এদের মধ্যে কোনােটিই সমসাময়িক নয় এবং এদের বর্ণনায় পক্ষপাতিত্ব সুস্পষ্ট। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকালেই পর্তুগিজরা প্রথম বাংলায় পদার্পণ করে। ফলে কয়েকজন পর্তুগিজ পর্যটকের ভ্রমণবৃত্তান্তে এবং জো আঁ দ্য বারােস প্রমুখ পর্তুগিজ ঐতিহাসিকদের লেখনীতেও তার সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মােটামুটিভাবে এসব সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকেই আলাউদ্দিন হুসেন শাহের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা যায়। তবে তা কষ্টসাধ্য এবং স্থানে স্থানে অস্পষ্টতা মােটেই অস্বাভাবিক নয়। আক্ষেপ করে বলতে হয় যে, আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সভায় একজন আবুল ফজল ছিল না, থাকলে হয়তাে তার কীর্তিসমূহের বিবরণ থাকত।
হুসেন শাহের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) অভ্যুদয় বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। নদিয়ার একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে চৈতন্যদেব বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সাধন করেন, তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক। বৈষ্ণবেরা তাঁকে ঈশ্বরের অবতার বলে মনে করত। সুকুমার সেন বলেন, “চৈতন্য তাহার জীবৎকালেই পূর্ব ভারতের এক বৃহৎ ভূখণ্ডে ঈশ্বরের অবতার বলিয়া গৃহীত হইয়াছিলেন। অন্যত্রও চৈতন্যবিধাসীর সংখ্যা কম ছিল না। হুসেন শাহের রাজত্বকালে চৈতন্যদেব তাঁর ভক্তিধর্ম প্রচার করেন। হুসেন শাহ চৈতন্যদেবকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।
(২)
অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ রাজ্যসীমা সম্প্রসারণের দিকে মনােনিবেশ করেন। হুসেন শাহ তার সুদীর্ঘ রাজত্বকালে সামরিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি কামতাপুরের খেন রাজ্য দখল করেন, উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অংশে অধিকার বিস্তার করেন, উত্তর বিহার ও দক্ষিণ বিহারের অংশ বিশেষেও তার আধিপত্য ছিল। চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে আরাকান ও ত্রিপুরা রাজের বিরুদ্ধেও তিনি সাফল্য লাভ করেছিলেন। একমাত্র অসম রাজ্যের বিরুদ্ধেই তিনি ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। একথা বললেও বােধ হয় ভুল হবে না যে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে তার রাজত্বকালেই বাংলার শৌর্যবীর্যের সর্বাপেক্ষা অধিক উদ্যম প্রকাশ পেয়েছিল।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের ছাব্বিশ বছর রাজত্বকালে (১৪৯৪-১৫১৯) দেশে নিরাপত্তা সুরক্ষিত ছিল। এটা নিঃসন্দেহে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মনৈপুণ্য ও তাঁর সরকারের দক্ষতার ফলে সম্ভব হয়েছিল। এমনকি তাঁর রাজত্বের একেবারে গােড়ার দিকে তিনি তার প্রজাদের মনে রেখাপাত এবং বহুলাংশে তাদের কল্পনাকে জয় করেছিলেন। তার সমসাময়িক বিজয় গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’ (১৪৯৪-৯৫) নামে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। এতে তিনি সুলতানের কৃতিত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বিজয় গুপ্ত বলেছেন, “সুলতান হােসেন শাহ হচ্ছে রাজাদের তিলক চিহ্ন। যুদ্ধে তাকে অর্জুনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এবং এ কারণে তিনি প্রভাত-সূর্য সদৃশ। রাজা তার বাহুবলে পৃথিবী শাসন করেন। তার প্রদত্ত নিরাপত্তার ফলে তার প্রজারা নিয়মিতভাবে সুখ ভােগ করে। পরবর্তীকালে হুসেন শাহের সামরিক, প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক সাফল্য বিবেচনা করলে সুলতানের প্রতি কবির এ প্রশংসাবাণী যথাযথ বলে মনে হয়।
হুসেন শাহের ধর্মীয়নীতি সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামিমুক্ত ছিল। হিন্দুদের প্রতি তিনি উদার ও সহিষ্ণু ছিলেন। তাঁর সরকারে হিন্দুরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেছিলেন। রাজ্যের প্রধান উজির ছিলেন পুরন্দর খান। গৌড় অভিযানে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়েছিল তাকে। সুবুদ্ধি রায় ছিলেন গৌড়ের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক। গােপাল চক্রবর্তী ছিলেন হুসেন শাহের রাজস্ব আদায়কারী। রূপ গােস্বামী ও সনাতন গােস্বামী দুই ভাই তার অত্যন্ত প্রিয় কর্মচারী ছিলেন। রূপ ছিলেন সাকের-মল্লিক (মন্ত্রী বিশেষ), এবং সনাতন ছিলেন সুলতানের দবির-ই-খাস (ব্যক্তিগত কর্মাধ্যক্ষ্য)। এদেরই বড় ভাই রঘুনন্দনও হুসেন শাহের কর্মচারী ছিলেন। রামচন্দ্র খান দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় একটা জমিদারি ভােগ করেছিলেন। হিরণ্য দাস এবং গােবর্ধন দাসের মজুমদার পরিবারের অবস্থাও ছিল একইরকম। নবদ্বীপের কোতওয়াল ছিলেন জগাই ও মাধাই। আবার তার মন্ত্রী গােপীনাথ বসু, ব্যক্তিগত চিকিৎসক মুকুন্দ দাস, দেহরীদের প্রধান কেশব খান ছত্রী এবং টাকশাল-অধ্যক্ষ অনুপ ছিলেন হিন্দু। রাজমালা অনুসারে গৌর মল্লিককে ত্রিপুরা অভিযানের নেতা নিযুক্ত করা হয়েছিল। দামােদর হুসেন শাহের সরকারে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন। হুসেন শাহের ঘােড়া সংগ্রহ করতেন শ্রীকান্ত ইনি ছিলেন রূপ-সনাতনের ভগ্নিপতি।
অথচ সুখময়বাবুই মত প্রকাশ করেছেন যে, হুসেন শাহ কর্তৃক হিন্দুদের উচচ রাজপদে নিয়ােগের দ্বারা হিন্দুদের প্রতি তার উদার মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না। এই বিষয়ে সুখময় মুখােপাধ্যায় বলেন,
“…সবসময়ে সমস্ত কাজের জন্য যােগ্য মুসলমান কর্মচারী পাওয়া যেত না বলে হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগের প্রথা বাংলায় অনেকদিন আগে থেকেই চলে আসছিল…হােসেন শাহ এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী সুলতানদের প্রথা অনুসরণ করেছিলেন।…এতে রাজা হিসাবে তার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়, হিন্দুদের প্রতি উদার মনােভাবের প্রমাণ মেলে না।”
আব্দুল করিম উপযুক্ত জবাব দেন সুলতানি আমলে উচ্চ রাজপদে নিয়ােগ করার মতাে যােগ্য মুসলমান পাওয়া যেত না, এই কথা ঠিক নয়। আরব, তুর্কিস্থান এবং মধ্য এশিয়ার মতাে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হতে শিক্ষিত এবং দক্ষ মুসলমানেরা প্রায়ই ভারত উপমহাদেশে আগমন করত এবং উচচ রাজপদ লাভ করত, তাদের আগমন তখনও বন্ধ হয়নি। এর প্রমাণ এই যে, দিল্লি সাম্রাজ্যের এই সকল বহিরাগত মুসলমানেরাই উচ্চ রাজপদ লাভ করত, এমনকি মােগল আমলেও বহিরাগত মুসলমানেরা রাজপদে নিযুত্তিতে প্রাধান্য লাভ করত। বাংলায় মুসলমানদের আগমন বন্ধ ছিল না, সুতরাং বাংলায় যােগ্য মুসলমান কর্মচারীর অভাব হওয়ার কথা নয়। সুখময়বাবু বলেছেন যে, সৈয়দ হুসেন সুলতান হুসেন শাহ হবার পূর্বে সর্বশেষ হাবশী সুলতান মুজাফফর শাহের উজির ছিলেন। এছাড়া সুখময়বাবু হুসেন শাহী আমলে উৎকীর্ণ যে ৬৪টি শিলালিপির কথা বলেছেন তা পরখ করলে দেখা যাবে যে অসংখ্য মুসলিম কর্মচারী হুসেন শাহ কর্তৃক নিযুক্ত হন, যারা হয় ছিলেন ‘সর-ই-লস্কর’ অথবা ‘উজির। তাছাড়া সুখময়বাবু যেখানে নিজেই খলিশ খান, হিন্দু খান, রুকন খান, খাওয়াস খান, মজলিস মাহমুদ, শের খান, মজলিস রাহৎ, আতা মালিক, রিফায়ৎ খান, মজলিস-আল-মাজালিস, মুকাবর খান, জাফর খান, নাজির খান, ওয়ালি মুহম্মদ, পরাগল খান, ছুটি বা নসরত খান, হামিদ খান (প্রধান উজির) প্রভৃতি মুসলমান কর্মচারীর কথা বলেছেন, সেখানে তিনি কিভাবে বলতে পারলেন যে, তখন যােগ্য মুসলিম রাজকর্মচারীর অভাব ছিল। নিশ্চয় এটি অতিরঞ্জিত।
অন্যদিকে ইলিয়াসশাহী আমল হতে বাংলার হিন্দুরা উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত হত, পরবর্তী ইলিয়াসশাহী সুলতানেরাও পূর্ববর্তী সুলতানদের নীতি অনুসরণ করতেন এবং হুসেন শাহ এই নিয়ম অনুসরণ করে হিন্দুদের উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন। এটা একদিকে যেমন তার বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতার প্রমাণ, তেমন তার উদারতার প্রমাণও বহন করে। হুসেন শাহের মনােভাব উদার না হলে তিনি পূর্ববর্তী সুলতানদের নীতি অনুসরণ না করলেও পারতেন। হুসেন শাহের হিন্দু কর্মচারীরা অবশ্যই যােগ্য ছিলেন, যােগ্য না হলে তাদের নিযুক্তির প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু মধ্যযুগে যােগ্যতাই উচ্চ রাজপদে নিযুত্তির একমাত্র মাপকাঠি ছিল না। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, হুসেন শাহ হিন্দুদের প্রতি উদার মনােভাব পােষণ করতেন।
(৩)
পনেরাে শতকের শেষ দশক থেকে ষােড়শ শতকের চতুর্থ দশক পর্যন্ত হুসেন শাহী যুগে বা তার সামান্য আগে-পরে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল উল্লেখযােগ্যভাবে। মুসলমান শাসকদের সাহায্য ছাড়া তা সর্বতােভাবে সম্ভব ছিল না। এর সূত্রপাত ইলিয়াস শাহী যুগে যারা ত্রয়ােদশ শতকের অস্থির সামাজিক অবস্থা দূর করে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে এনেছিলেন চতুর্দশ শতকে। চৌদ্দ-পনেরাে শতকেই চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস ওঝা বা মালাধর বসুকে আমরা পাই। আরও একটা ব্যাপার বুঝতে হবে, বাংলার মুসলমান সুলতানগণ দিল্লির মুসলমান সুলতানদের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন এবং সেই কাজে স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বন্ধুত্ব তাদের কাম্য ছিল। প্রয়ােজন ছিল বাংলার সামাজিক-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সুদৃঢ় প্রশাসন গড়ে তুলতে গেলেও। তাই বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমান বিরােধের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান বন্ধুত্বও দেখতে পাই। হুসেন শাহের সময়েও এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।
সুলতান হুসেন শাহের যুগকে বাংলা সাহিত্যের রেনেসাঁর যুগ বলে অভিহিত করা হয়। হুসেন শাহ এবং তার সুযােগ্য পুত্র ও উত্তরাধিকারী সুলতান নসরত শাহও বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। ঐতিহাসিক এ বি এম হাবিবুল্লাহ বলেন,
“It was a period in which the vernacular found its due recognition as the literary medium through which the repressed intellect of Bengal was to find its release.”
হুসেন শাহের কয়েকজন অমাত্য, যথা রূপ, সনাতন ও কেশরী ছত্রী সুকবি ছিলেন। তাছাড়া বাঙালি কবি যশােরাজ খান, কবীন্দ্র পরমের, শ্রীকর নন্দী এবং দ্বিজ শ্রীধর দরবারী পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিলেন। এ যুগের আরও যে সমস্ত কবি সাহিত্যিকদের নাম পাওয়া যায় তারা হচ্ছেন বিপ্রদাস পিপিলাই, শঙ্কর, কিঙ্কর মিত্র, বিজয় গুপ্ত প্রমুখ। সুতরাং হুসেন শাহের আমলে হিন্দু কবি-সাহিত্যিকগণ যে স্বতঃস্ফুর্ত সাহিত্য চর্চা করতেন তাতে সন্দেহ নেই।
এছাড়া সাহিত্যের বিকাশ ঘটে মহাভারত সহ বৈষ্ণব পদাবলী, যােগসিদ্ধ কথা এবং রােমান্টিক কাব্য সব ক্ষেত্রেই। হুসেন শাহের যুগে রচিত হয়েছিল ‘পরাগলী মহাভারত’। হুসেন শাহ চট্টগ্রাম অধিকার করে সেখানে পরাগল খানকে শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন। তিনি তার রাজসভায় জ্ঞানী-গুণীদের নিকট ‘ভারতকথা’ অর্থাৎ মহাভারতের যুদ্ধকাহিনি শােনার পর তা আরও বেশি করে শুনতে আগ্রহী হন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় মহাভারতের বিশালত্ব ও সংস্কৃত ভাষা। পরাগল খান কবীন্দ্র পরমেথরকে বললেন—
‘এহি সব কথা সংক্ষেপে করিয়া।।
একদিনে শুনিতে পারি পাঁচালী রচিয়া।।’
কবীন্দ্র পরমের রাজাজ্ঞায় মহাভারত গ্রন্থকে সংক্ষেপে অনুবাদ করেছিলেন—তার সেই অনুবাদ গ্রন্থের নাম ‘পাণ্ডব বিজয়’। পরাগল খানের নির্দেশে এই কাব্যটি অনুবাদ হয়েছিল বলেই সাহিত্যের ইতিহাসে অনুবাদ গ্রন্থটি ‘পরাগলী মহাভারত’ নামে সমধিক পরিচিত। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেন যে, পরাগল খান স্বয়ং মহাভারতের ‘থীম’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। পরাগল খানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ছুটি খান (ছােটো খান) বা নসরত খান চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনিও তাঁর পিতার ন্যায় উদার ছিলেন। কবীন্দ্র অনূদিত সংক্ষিপ্ত মহাভারতে তিনি তৃপ্ত হতে না পারার জন্যই বৃহদাকারে মহাভারত অনুবাদ করতে নির্দেশ দেন শ্রীকর নন্দীকে। অনুবাদক শ্রীকর নন্দী জৈমিনী মহাভারতের উপর নির্ভর করে কেবলমাত্র ‘অধমেধ পর্ব’ নিয়ে বিরাট আকারে কাব্য রচনার কাজ সমাপ্ত করেন। এই অনুবাদ গ্রন্থটি সাহিত্যের ইতিহাসে ‘ছুটি খানের মহাভারত’ নামে পরিচিত। বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে যশােরাজ খান অনন্য। তার কোনাে কাব্যগ্রন্থ পাওয়া যায়নি, যদিও এক প্রশস্তিতে তিনি বলেছেন—
‘শ্ৰীযুক্ত হুসায়েন
জগৎ ভূষণ
সেই হই রস জান।
পঞ্চ গৌড়ের ভােগ পুরন্দর
ভনে যশােরাজ খান।
‘মনসামঙ্গল’ বা ‘পদ্মাপুরাণ’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা বিজয় গুপ্ত সুলতান হুসেন শাহের পৃষ্ঠপােষকতায় কাব্যচর্চা শুরু করেন। বিপ্রদাস ‘মনসাবিজয়’ (১৪৯৫-৯৬) কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। কাব্যগ্রন্থটি ‘মনসামঙ্গল’-এর সমসাময়িক। সাহিত্যিক গুণাগুণের বিচারে এটি বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’-এর তুলনায় কম নয়। বিপ্রদাস সুলতান হুসেন শাহের উল্লেখ করেন তার কাব্যে
‘সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক্য পরিমাণ।
নৃপতি হােসেন শাহা গৌড়ের প্রধান।’
আমরা পাই শেখ কবীর ও কবিরঞ্জনকেও—দুজনে সুলতান নসরত শাহের পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিলেন। যােগ সাহিত্যের মধ্যে পাই শেখ জাহিদের লেখা ‘আদ্য পরিচয়’। এর মূলকপি পাওয়া না গেলেও ১২০৮ সনে শ্রী নিমাইচরণ দাস কর্তৃক অনুলিপি কৃত একটি গ্রন্থ রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, সম্ভবত সুলতান হুসেন শাহের আমলে ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থটি রচিত হয়। উল্লেখ্য যে, শেখ জাহিদ ছিলেন পাণ্ডুয়ার সুফি-সাধক হযরত নূর কুতুবুল আলমের পৌত্র। তার গ্রন্থটির বিষয়বস্তু দেহতত্ত্ব। এই কাব্য গ্রন্থে কয়েকটি অধ্যায় আছে যেমন ‘গৌরচন্দ্রিকা’, ‘জন্মক্ষণ বিচার’, ‘গর্ভের বিচার’, ‘দশরত্ন বিচার’, ‘দশদ্বার বিচার’ ও ‘দেহতত্ত্ব বিচার’। রােমান্টিক ধারার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি দ্বিজ শ্রীধর, বিদ্যাসুন্দর রচয়িতা—তিনি সুলতান নসরত শাহের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরােজ শাহের সাহায্য পেয়েছিলেন। দ্বিজ শ্রীধর তার কাব্যে সুলতান নসরত শাহের উল্লেখ করেন—
‘নৃপতি নাসির শাহা তনয় সুন্দর।
নাম ছিরি ফিরােজ শাহা সিক শেখর।’
বস্তুত হুসেন শাহ, নসরত শাহ, আলাউদ্দিন ফিরােজ শাহ সকলেই সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। সাবিরিদ খান নামে আরও এক মুসলমান কবি বিদ্যাসুন্দর লিখেছিলেন। সাহিত্যের ইতিহাসের বিস্তারিত আলােচনা আমাদের আলােচ্য বিষয় নয়, শুধু এই কথা বলা দরকার যে, বাংলা সাহিত্যের বিকাশে মধ্যযুগে হুসেন শাহী রাজত্বের গুরুত্ব কম নয় এবং সাহিত্যিক উপাদানে দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির কথাও যথেষ্ট আছে। গ্রামে তাে বটে, নগরেও। হিন্দু সামাজিক অনুষ্ঠানে, বরযাত্রীর দলে, এমনকি সংকীর্তনেও বাঙালি মুসলমানদের দেখা গেছে। শুধু বাংলা নয়, ফারসি সাহিত্যেরও বিকাশ ঘটে এবং তাও হয়েছে। দরবারী সহায়তায়। অথচ সুখময়বাবু বলেছেন,
“আলাউদ্দীন হােসেন শাহ যে বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন সে সম্বন্ধে আমরা কোনাে সূত্র থেকেই সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলাম না।”
সাহিত্য ছাড়াও শিল্প, চারুকলা ও স্থাপত্যেও হুসেন শাহী যুগ যে ইলিয়াস শাহী যুগের ঐতিহ্য অব্যাহত রাখতে পেরেছিল তার অন্যতম কারণ হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি। স্থাপত্যের নিদর্শন আছে, শিল্পের পরােক্ষ নিদর্শন মুদ্রায়-লেখতে বিদ্যমান। হস্তলিপিরও প্রভূত উন্নতি হয়েছিল ওই যুগে। তবু সংগীত ও চিত্রকলা বিষয়ে তথ্য অপ্রতুল বলে বিশদ ইতিহাসগত আলােচনা করা কঠিন। স্থাপত্যে অবশ্য তা নয়। বহু মসজিদ-মন্দির তার নানা হুসেন শাহী শৈলী নিয়ে আজও বিরাজমান। গৌড়পাণ্ডুয়া (মালদহ জেলায়) সবচেয়ে বড়াে উদাহরণ। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব প্রগতির সূচনা করেছিল। অভিজাত হিন্দুরা আয়ত্ত করেছিলেন ফারসি ভাষা, জানতে চেয়েছিলেন আরবি-ফারসি ঐতিহ্য, মুসলমান অভিজাত শাসকবর্গ বুঝতে চেয়েছিলেন বাংলার প্রাক-মুসলিম হিন্দু সংস্কৃতি। বহু মুসলমান কবির হিন্দু পৌরাণিক ঘটনাবলী ও সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল। যেমন সাবিরিদ খান। তবে অভিজাত উচ্চবর্গীয় সমাজে সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে বিরােধ ছিল। কিন্তু সমাজের নীচের তলায় দরিদ্র বাঙালি মুসলমানের মধ্যে তেমন বস্তুগত পটভূমিকার পার্থক্য না থাকায়, লৌকিক সংস্কৃতির দ্বারা অনেক ৰেত্রেই আচ্ছন্ন হওয়ায়, সেখানে বিরােধের চেয়ে পারস্পরিক সহযােগিতা লথিত হয় বেশি পরিমাণে।
সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে যবন হরিদাস মুসলমান ধর্মত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম অবলম্বন করার পরও সেকালে হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের মনােভাবের পরিচয় বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবৎ’ হতে জানা যায়। হুসেন শাহ হরিদাসকে ডেকে বােঝালেন এবং আবার কলমা পড়ে স্বধর্ম পালন করতে বললেন। এ কথা শুনে হরিদাস বললেন—
‘নামমাত্র ভেদ করে হিন্দুরে যবনে।।
পরমার্থে এক কহে কোরাণে পুরাণে।।…
হরিদাস ঠাকুরের সুসত্য বচন।।
শুনিয়া সন্তোষ হৈল সকল যবন।।
হরিদাসের কথা শুনে ‘সন্তোষ হৈল সকল যবন’ বৃন্দাবন দাসের এই ধারণা যে অমূলক, এমন কথা জোর করে বলা যায়। সেকালের মুলুক পতি ও তাঁর সম্প্রদায়ের মনে হিন্দুধর্মের প্রতি যদি অদৃশ্য বিদ্বেষ থাকত তাহলে শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর প্রেম ধর্ম বাংলায় অবাধে প্রচার করতে পারতেন কি? হুসেন শাহের রাজত্ব সম্পর্কে হিন্দু কবি মৃত্যুঞ্জয় শর্মা রচিত একটি গান পাওয়া যায়। যথা—
‘এমন রাজা আর হবে না প্রজার বহু ভাগ্যবল
ধনে ধ্যানে জ্ঞানে মানে ভাগ্যলক্ষ্মী সদা অটল।
জাত-ধরমের নাই ঠিকানা, হিন্দু-মােসলেমে জানা যায় না
কোরাণ-পুরাণ সবই জানা, অল্পে ফুটে দেবজ্যোতি।’
আসলে তুর্কি আক্রমণের পর বিদেশি বিধর্মী মুসলমান রাজাগণ এ দেশ শাসন করলেও বসবাস করতে করতে স্বাভাবিক ভাবেই তারা এ দেশের মাটি মানুষ ও মানব সংস্কৃতিকে ভালবেসেছিলেন। বিদেশি সকলেই ছিলেন এমনও মনে করা যায় না। তাদের অনেকের জন্মই এদেশে। বিদেশি রাজাগণ সে কারণে দেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পুনর্বিকাশে মনপ্রাণ দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। এবং এই সহায়তার ক্ষেত্রে রাজাগণ কোনােরূপ জাত-বিচার করেননি। তার প্রমাণ মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য। আগেই বলা হয়েছে, এই অনুবাদ সাহিত্য ধারার অপর উল্লেখযােগ্য নজির হল—কবীন্দ্র পরমের ও শ্রীকর নন্দীর মহাভারত অনুবাদ কার্য। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’-এ (খণ্ড-১) মহাভারত অনুবাদ নিয়ে পরাগল খানের সম্পর্কে বলেছেন,
“পরাগল খান যে অতি উদারমতি ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহা না হইলে তিনি মহাভারত শুনিতে চাহিবেন কেন? কোন ফার্সী ‘কিচ্ছা’ বা কারবালা কাহিনীর অনুরূপ কোন ইসলামী গল্পকাহিনী শুনিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতে পারিতেন।”
কবীন্দ্র পরমের তাঁর কাব্যমধ্যে পরাগল খান সম্বন্ধে বলেছেন—
“লস্কর পরাগল। খান মহাদাতা কর্ণসম/দরিদ্র ভুঞ্জায় নিত্য নিত্য।”
কবীন্দ্র পরমের তাঁর রচনার মধ্যে হুসেন শাহ সম্বন্ধেও প্রশস্তি রচনায় লিখেছেন—
“নৃপতি হােসেন শাহ হ এ মহামতি।
পঞ্চ গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।।
অস্ত্রশাস্ত্রে সুপণ্ডিত মহিমা অপার।
কলিকালে হৈব (হৈল?) যেন কৃষ্ণ অবতার।।”
যে যুগে একজন হিন্দু কবি তার মহাভারত কাব্যমধ্যে মুসলমান রাজাকে কৃশণ অবতারের সঙ্গে তুলনা করেছেন, সে যুগে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিল তা সহজেই বিচারগম্য।
কবি শ্রীকর নন্দীও নিজ কাব্য মধ্যে (ছুটি খানের ‘মহাভারত’) তার মুসলমান পৃষ্ঠপােষক রাজা ছুটি খান সম্বন্ধে প্রশংসা করেছেন, যথা—
নসরত শাহা তাত অতি মহারাজা।
রাম বহুশিষ্ঠ পালে সব প্রজা।।
নৃপতি হােসেন সাহা যেঅ ক্ষিতিপতি
সামদানদণ্ড ভেদে পাল-এ বসুমতী।।
তান এক সেনাপতি লস্কর ছুটি খান।
ত্রিপুরার উপরে করিল সন্নিধান।।
মধ্যযুগের সেই সময়ে মুসলমান রাজাগণ যদি ওইভাবে অনুবাদ কর্মে সহায়তা না করতেন তাহলে হয়তাে বাংলা ভাষায় রামায়ণ, মহাভারত হাতে পেতে আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হত। উভয় ধর্মাবলম্বীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও মনােভাব কেমন ছিল তা আমরা ওই সাহিত্যের অনুবাদ কর্মের মধ্য দিয়েও কিছুটা বুঝে নিতে পারি।
(৪)
হুসেন শাহ হিন্দুদের উপর অত্যাচার করেছিলেন বলে কিছু লেখক মত প্রকাশ করেছেন। নবদ্বীপের ব্রাহ্মণগণের উপর হুসেন শাহের অত্যাচার, সুবুদ্ধি রায়ের উপাখ্যান, উড়িষ্যায় হুসেন শাহের মন্দির ধ্বংস—এ সবের উপর লেখকরা তাদের যুক্তি স্থাপন করেছেন। এ সমস্ত লেখকরা ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ (কৃষ্ণদাস কবিরাজ), রামায়ণ’ (কৃত্তিবাস), ‘মনসামঙ্গল’ (বিজয় গুপ্ত), “শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ (মালাধর বসু), ‘মনসাবিজয়’ (বিপ্রদাস পিপিলাই), ‘মহাভারত’ (কবিন্দ্র পরমের ও শ্ৰীকর নন্দী) প্রভৃতি লােক সাহিত্যের উপর ভিত্তি করে অনেক অবান্তর মন্তব্য করেছেন, যা গ্রহণযােগ্য নয়। তাদের যুক্তিগুলি প্রকৃত ঘটনার ভাসাভাসা অনুসন্ধানের উপর স্থাপিত। ফলে এ সমস্ত গ্রন্থকার কর্তৃক প্রণীত গ্রন্থাবলীতে বর্ণিত ঘটনাবলীর কতটা সত্য ও তথ্যনির্ভর তা সঠিকভাবে বলা যায় না।
চৈতন্যদেব নিম্নশ্রেণিকে মর্যাদা দানের জন্য যে ডাক দিয়েছিলেন এবং তাতে যেভাবে সাফল্য লাভ করেছিলেন তাতে সমাজের উচ্চ শ্রেণির স্বার্থে আঘাত পড়ছিল। একই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে কোনােরকম পারস্পরিক সংঘর্ষ না হয় সেজন্য হুসেন শাহ কঠোর হতে বাধ্য হয়েছিলেন। জয়ানন্দ যা বলেছেন তার সারমর্ম দেওয়া যেতে পারে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণরা গৌড়ের সিংহাসন জবরদখল করবে বলে সুলতানের অনুচরবৃন্দ তাকে সংবাদ দিয়েছিল। ক্রোধান্বিত হয়ে সুলতান নবদ্বীপ ধ্বংসের আদেশ দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণদের জাত অপবিত্র করা হয় এবং তাদের বহুজনকে হত্যা করা হয়। হিন্দুদের ধর্মকর্ম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং নবদ্বীপের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি চরম আকার ধারণ করে যার ফলে ভাই বিদ্যাবাচষ্পতিকে গৌড়ে রেখে সার্বভৌম ভট্টাচার্য দেশত্যাগ করে বেনারসে চলে যান।
বাংলা মূলপাঠ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্রাহ্মণরা যে গৌড়ের সিংহাসন দখল করবেন এটা নবদ্বীপের হিন্দু সম্প্রদায় বিশ্বাস করেছিলেন—এ তথ্য বৃন্দাবন দাসও সমর্থন করেছেন। এ ধরণের চিন্তার কারণ যাই হােক না কেন এটা সুলতানকে ত্রে(ধান্বিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি নবদ্বীপের হিন্দু সমাজে ব্যাপ্ত রাজদ্রোহিতার প্রবণতাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। উপযুক্ত বিবরণে আমরা অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায় বাদ দিয়ে সুলতানকে শুধু ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচার করতে দেখি কেন এটা তা ব্যাখ্যা করে। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে তার গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ সম্পর্কে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু তিনি যা করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল রাজদ্রোহিতা দমন করা এবং এতে সাম্প্রদায়িক বােধ বা ধর্মীয় উদ্দীপনার কোনাে ভূমিকা ছিল বলে মনে। হয় না। উপরন্তু জয়ানন্দ বলেছেন যে, এ ঘটনা ঘটেছিল ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্যের জন্মের প্রাক্কালে যখন বাংলার শাসক ছিলেন ইলিয়াস শাহী বংশের জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ। পূর্ববর্তী সুলতান জালালউদ্দিনকৃত কোনাে কাজের জন্য হুসেন শাহকে দায়ী করা যায় না।
নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের উচ্ছেদ তথা অত্যাচারের প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন, “জয়ানন্দ ও লােচন দাসের চৈতন্যমঙ্গলে রাজভয়ের বর্ণনা আছে। সে সময় গৌড়ের বাদশা ছিলেন হুসেন শা এবং বৈষ্ণবের উপর হুসেন শা-র আক্রোশ ও অনুগ্রহের কথা শুধু চৈতন্যমঙ্গল নয় চৈতন্যভাগবতেও পাওয়া যায়।” তাই জয়ানন্দের বর্ণনাকে বলা যায় না পুরােপুরি অসত্য। কিন্তু দেখতে হবে ‘ব্রাহ্মণ ধরিয়া রাজা জাতিপ্রাণ লয়’-এর কারণ কি? এ ঘটনা কি সুলতানের হিন্দু বিদ্বেষজনিত? অর্থাৎ সুলতানের সাম্প্রদায়িক মনােভাবেরই পরিচয়বাহী, না কি তার শ্রেণি স্বার্থের ঐতিহাসিক নিয়মেরই পরিণতি? জয়ানন্দ বর্ণিত ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় ।
১. নবদ্বীপে এই রাজভয় ধারাবাহিক নয়, অকস্মাৎ।
২. শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের উপরেই এই রাজরােষ।
৩. পিরল্যাবাসীরা গৌড়ের্থরের কাছে মিথ্যা সংবাদ প্রদান করে যে, নবদ্বীপের ব্রাহ্মণরা সুলতানের বিপদ ঘটাবে। কেননা শােনা যাচ্ছে, গৌড়ে রাজা হবে ব্রাহ্মণ।
৪. সুতরাং নিশ্চিন্তে বসে থাকলে বিপদ হবে রাজার। এই কথা রাজার গ্রহণীয় মনে হয়েছে, ফলস্বরূপ শাস্তি দিতে শুরু করেছেন ব্রাহ্মণদের।
৫. কিছুদিনের মধ্যেই রাজা ব্রাহ্মণদের আজ্ঞা দিয়েছেন নবদ্বীপে বসবাস করার জন্য। ভয়াল দেবীর স্বপ্নদর্শনে ভীত হয়ে রাজা আরও বলেছেন যে, নবদ্বীপে মুসলমান দেখলে শুধু প্রাণে বাঁচিয়ে রেখে মারতে পারবে যতখুশি।
উল্লেখ্য, নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের উপর এই রাজরােষের কারণ অনুমান করেছেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এক সময় কি নবদ্বীপে যথার্থই একটা রাজনীতিক ষড়যন্ত্রের কথা ও আলােচনা চলেছিল, যার আভাষ ও ইঙ্গিত পেয়েই হােসেন শাহ সেখানকার ব্রাহ্মণদের উচ্ছেদ করবার হুকুম দেয়? রাজা গণেশের মন্ত্রণাদাতা নরসিংহ নাড়িয়ালের বংশধর অদ্বৈত গোঁসাই কি এতটুকু রাজনীতিক জ্ঞানশূন্য ছিলেন যে, কেবল ‘কৃষ্ণ কোথা’ বলে বলে কেঁদে বেড়াতেন?”
যদি এই অনুমানকে সত্য হিসেবেও ধরা যায় তবুও বলা যায় এই রাজরােষ হওয়ার কথা অদ্বৈত গোঁসাই-এর প্রতি, বড়জোর তার পরিবার পরিজন সম্পর্কে, সেখানে সমস্ত ব্রাহ্মণরা কি দোষ করেছিল? আরও উল্লেখ্য, এই প্রসঙ্গেই বলেছেন। রজনীকান্ত চক্রবর্তীও “চৈতন্যদেবের জন্মের পূর্বে মুসলমানেরা নবদ্বীপের উপর বিস্তর অত্যাচার করিয়াছিল।…সে সময়। হিন্দুদের মনে একটা বির্বাস ছিল যে নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ রাজা হইবে…কাজী গৌড়েরকে জানান যে নবদ্বীপবাসীগণ স্বাধীন হইবার বাসনা করিয়াছে… গৌড়ের নবদ্বীপবাসীগণের শাসনের জন্য কাজীর প্রতি আদেশ করিলেন।”
রজনীকান্তবাবু অবশ্য দিতে পারেননি এই বিস্তর অত্যাচারের প্রমাণ। আরও লক্ষণীয়, আমরা জয়ানন্দের কাব্য থেকে যে তথ্য পাচ্ছি তাতে কাজিদের অভিযােগের কথা নেই, আছে পিরল্যাবাসীদের। যাই হােক, সুলতানকে যে বা যারাই এই খবর দিক না কেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে সংঘটিত হয়েছে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ উচ্ছেদ, তবে এই ঘটনার কারণ নির্ণয়ে প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযােগ্য “নবদ্বীপে ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচারের কারণ পলিটিক্যাল, রিলিজিয়াস নয়।
প্রমথবাবুর এই ঘটনার পলিটিক্যাল’ চরিত্র নির্ণয়ের সঙ্গে সহমত পােষণ করতে আপত্তি নেই কোনাে। কেননা এটা গৌড়েধরের সিংহাসন চ্যুতির সম্ভাবনার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এ ঘটনা ‘রিলিজিয়াস’ নয়—একথাও কি পুরােপুরি সত্য? কারণ বর্ণনা অনুযায়ী একটা বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের উপরই সংঘটিত হয়েছে আক্রমণ। তা সত্ত্বেও প্রগ্ন থেকেই যায়, ধর্মসম্প্রদায়ের উপর এই আক্রমণ কি ধর্মেরই স্বার্থে, না গদির স্বার্থে? বর্ণনা অনুসারে কি বলা যায় না গদির স্বার্থেই সংঘটিত হয়েছে এই আক্রমণ? আর তাতে ধর্মসম্প্রদায় হয়ে গেছে যুক্ত। তাহলে নিশ্চয়ই বলতে আপত্তি থাকে না যে, সুলতান নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে যে আক্রমণ সংঘটিত করেছেন তাতে কোনাে ধর্মসম্প্রদায় যুক্ত হলেও তা তার বিবেচনার মধ্যে রাখেননি। আবার এটাও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যে সুলতান রাজ্যচ্যুতির ভয়ে ‘ব্রাহ্মণদের জাতিপ্রাণ নাশ করে’ সেই সুলতানই আবার ওই ব্রাহ্মণদের শান্ত ও তুষ্ট করার জন্য বলে—
‘নবদ্বীপ সীমাএ যবন যদি দেখ
আপন ইচ্ছাএ মার প্রাণ জানী রাখ।”
অর্থাৎ একই সুলতান নিজ স্বার্থে আঘাতজনিত কারণে যেমন ব্রাহ্মণদের অত্যাচার করেছেন, তেমনই তাদেরও উস্কিয়েছেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে। তাহলে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুলতানের স্বার্থরক্ষাই বড় কথা এবং সেই প্রয়ােজনে তিনি ধর্মকেও ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি। তবে কথিত আছে যে, গৌড়ের সিংহাসনে আরােহণ করেই হুসেন শাহ নবদ্বীপ শহর লুঠ করেছিলেন। জয়ানন্দ মনে হয় এ ঘটনারই উল্লেখ করেছেন যাতে গৌড়ের কিছু হিন্দু হয়তাে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।
সুবুদ্ধি রায়ের জাতিনাশ করা সম্পর্কে হুসেন শাহের বিরুদ্ধে নানা বিরূপ মন্তব্য নানা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এর মধ্যখণ্ড (২৫ পরিচ্ছেদে) অংশে এই ঘটনা সম্পর্কে লিখিত আছে, যথা—
‘পূর্বে যবে সুবুদ্ধি রায় ছিল গৌড় অধিকারী।
হুসেন খাঁ সৈয়দ করে তাহার চাকরী।।
দীঘি খােদাইতে তারে মনসীর কৈল।
ছিদ্র পাএ রায় তারে চাবুক মারিল।।’
হুসেন শাহের পরবর্তীকালে ভাগ্য পরিবর্তন হল। রাজা হয়ে তিনি তার পূর্ব মনিব সুবুদ্ধি রায়কে রাজকার্যে উচ্চপদে নিয়ােগ করলেন। রাজা হবার পর হুসেন শাহের স্ত্রী তার পিঠে বেত্রাঘাতের কারণ জানলে সুবুদ্ধি রায়ের উপর তার প্রতিশােধ নিতে বললেন। একথা শুনে হুসেন শাহ স্ত্রীকে বললেন—
‘আমার পােষ্টা রায় হত পিতা।
তাহারে মারিব আমি ভাল নহে কথা।।
স্ত্রী কহে জাতি লহ যদি প্রাণে না মারিবে।
রাজা কহে জাতি নিলে ইহাে নাহি জীবে।।
স্ত্রী মারিতে চাহে রাজা সংকটে পড়িলা।
করােয়ার পানি তার মুখে দেয়াইলা।।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্ত্রীর অনুরােধে সঙ্কটের মধ্যে পড়ে বাধ্য হয়ে বদনার সামান্য একটু জল সুবুদ্ধি রায়ের মুখে দিয়েছিলেন মাত্র। যেহেতু সুবুদ্ধি রায় তাকে (হুসেন শাহ) কোনাে এক সময় বেত্রাঘাত করেছিলেন। বেত্রাঘাতের ঘটনা যেমন অবাস্তব ও অলীক, তেমনি সুবুদ্ধি রায়কে মুসলমানি বদনা দিয়ে জলপান করিয়ে তার ধর্ম নষ্ট করা হয় তাও অবিধাস্য ও অযৌক্তিক। ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির (প্রতিশােধমূলক) ওই আচরণকে কেন্দ্র করে সমষ্টিগতভাবে হুসেন শাহের উপর সাম্প্রদায়িক দোষারােপ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত সে বিচার করবেন সুধীবৃন্দ।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া চৈতন্যদেবের সমসাময়িক যুগে মুসলমান শাসকদের বা ধর্মীয় নেতাদের হাতে ব্যাপক হিন্দু নির্যাতনের ঐতিহাসিক সাক্ষ প্রমাণ খুব একটা নেই। বর্তমানের সাম্প্রদায়িক হিন্দু বা মৌলবাদী মুসলমানদের পছন্দ হােক বা না হােক ইতিহাস বদলে যায় না। তাই বলা চলে, চৌদ্দপনেরাে শতকের বাংলার রাজনৈতিক, ভৌগােলিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছাড়া ব্যাখ্যা করা যায় না। সামাজিক দিকেও দৃষ্টি দেওয়া বিশেষ দরকার। এখানেও একটা ব্যাপার—যত দোষ নন্দ ঘােষের মতন—সবকিছু মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার একটা অনৈতিহাসিক ব্যাপার আছে। ‘চৈতন্যদেব’ গ্রন্থে ভূমিকা লিখতে গিয়ে দুই পণ্ডিত অধ্যাপক অবন্তীকুমার সান্যাল ও অশােক ভট্টাচার্য যে মন্তব্য করেছেন, তা বরং ইতিহাস-সম্মত এবং নির্ভুল “চৈতন্যের সমকালে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাসিত, কঠোর বিধিনিষেধ ও প্রায়শ্চিত্তবিধানের দণ্ডনির্দেশ চালিত, অলঙ্ঘনীয় বর্ণভেদ ও আচারসর্বস্ব যে বাঙালী সমাজের পরিচয় পাওয়া যায়, তা বাংলাদেশে আগ্রাসী ইসলামের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টার পরিণাম, এমন একটি সরল সহজ ধারণা সাধারণভাবে প্রচলিত আছে। কিন্তু ইতিহাস থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশে শূলপানি-বৃহস্পতিরঘুনন্দন যে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও ব্যবহারশাসন আলােচনা ও বিধিবদ্ধ করেছিলেন, তা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল তুর্কী অভিযানের অনেক আগেই বর্মণ ও সেন রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপােষকতায়। দুটি বংশই ছিল বহিরাগত।” বিস্তারিত আলােচনার সুযােগ এখানে নেই, তবে সামাজিক দুর্বলতার শুরু আদি মধ্যযুগে—গৌড়ের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের রাজত্বের অবসানের পর পৌরাণিক ধর্মাবলম্বী সেন রাজাদের আমলে। দ্বাদশ শতাব্দীতেই নৈতিক অবক্ষয় ও যৌন-ব্যভিচার, সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি, তীব্র বর্ণভেদ, নানা উপধর্মের সৃষ্টি, তান্ত্রিকতার প্রসার, উচ্চবর্ণের হাতে সম্পদ জমে থাকা, নিম্নতম অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছদের চূড়ান্ত ঘৃণা, মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের হাতে শূদ্রদের (যাদের মধ্যেও নানা স্তর) চূড়ান্ত উৎপীড়ন ইত্যাদির কোনওটির জন্যই মুসলমানরা দায়ী নয়। বরং ত্রয়ােদশ শতাব্দী থেকে এই অত্যাচারের ফলেই ক্রমে বৃদ্ধি পায় স্বেচ্ছায় ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়া, যার পিছনে মূলত ইসলামের সাম্যবাদ, সন্ত-পির-দরবেশদের সহজ-সরল আচরণ এবং কিছু সুফি সিলসিলার প্রভাব স্পষ্ট। সমাজের সংহতি কোথায়? পঞ্চদশ শতকে তীব্র জাতিভেদ, ব্রাহ্মণ আধিপত্য ও সেইসঙ্গে ধন-সম্পদের কারণে কিছু অব্রাহ্মণের উচ্চবর্ণের মর্যাদা লাভ ইত্যাদির ফলে যে সমাজ দেখি তার চলমানতা যে রুদ্ধ হবে এ তাে স্বাভাবিক।
(৫)
সুখময়বাবু বলেছেন, হিন্দুদের প্রতি হুসেন শাহের ব্যবহার খুব সন্তোষজনক ছিল না। অন্য এক স্থানে সুখময়বাবু উড়িষ্যা মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংসের কথা বলেছেন ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এর দোহাই দিয়ে। সুখময়বাবুর মূর্তি বা দেবালয় ধ্বংসের অভিযােগ সত্য নয়। হুসেন শাহ যদি মূর্তিভঙ্গকারী হতেন তাহলে তার রাজ্যের অসংখ্য হিন্দু মন্দিরের বিগ্রহ ভেঙে ফেলতে পারতেন। কিন্তু এমন কোনাে ঘটনা কোনাে ঐতিহাসিক বলেননি। অনিরুদ্ধ রায় তার ‘মধ্যযুগের বাংলা ১২০০-১৭৬৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাংলার মধ্যে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙার অভিযােগ তার বিরুদ্ধে নেই।’ (পৃ. ১১৯) তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, হুসেন শাহ সমরাভিযান করে উড়িষ্যায় পুরী দখল করেন এবং সম্ভবত আক্রমণকালে কয়েকটি পাথরের খােদিত ভাস্কর্য বা মূর্তি ভেঙে যায়। কিন্তু আবদুল করিম ‘কটক রাজবংশাবলী’ উল্লেখ করে বলেন যে,
“হােসেন শাহের আসার সংবাদে প্রতাপরুদ্র দেবের সময়ে কটকের রক্ষী সামন্ত রায় বিদ্যাধর দুর্গ ত্যাগ করে চলে যাবার সময় জগন্নাথ প্রতিমাসমূহ নৌকায় চাপিয়ে চিলকা হ্রদ হয়ে পর্বতে আশ্রয় নেন।”
এতে মনে করা যায় যে, প্রধান বিগ্রহসমূহ আক্রমণের পূর্বে সরিয়ে নেওয়া হয়। মাদলা পঞ্জিকাতেও বিগ্রহ ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। তবে ‘মাদলা পঞ্জিকা’ সম্বন্ধে সুখময়বাবুও বিরূপ মন্তব্য করেন, যেমন
“মাদলা পাঞ্জির উল্লিখিত বিবরণকে হুবহু (হুসেন শাহের অভিযান ১৫০৯-র সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় এবং ১৫১০-র সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হয়) সত্য বলে গ্রহণ করতে অসুবিধা আছে।”
এ কথার পুনরুক্তি করে প্রভাত মুখােপাধ্যায় তাঁর “The Gajapati Kings of Orissa’ গ্রন্থে বলেন,
“The dates of the events of this period are wrongly given in the Madala Panji in most cases…. There are indications that the Madala Panji. was compiled shortly after the Mughal conquest of Orissa… The temple priests depended on traditional accounts, true stories and stray records of temple administration when they compiled that Madala Panji.” (P. 7-8)
এছাড়া একথা নিশ্চিতভাবে বলা হয়েছে যে, বাংলার সাথে উড়িষ্যার সংঘর্ষ ১৫০৯-১৫১৮ পর্যন্ত। এমতাবস্থায় আব্দুল করিমের ভাষ্য অনুযায়ী প্রথম দিকের (১৪৯৩-৯৪) মুদ্রায় হুসেন শাহকে যে, কামরূপ-কামতা, জাজনগর ও ‘উড়িষ্যার বিজয়ী’ বা বিজেতা বলা হয়েছে তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়।
তাছাড়া উড়িষ্যায় সুলতান হুসেন শাহের মন্দির ধ্বংস অপরিহার্যভাবে প্রমাণ করে না যে তিনি হিন্দু বিরােধী ছিলেন, কারণ যুদ্ধের আনুষঙ্গিক বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির সময় এ রকম ধ্বংসকার্য সংঘটিত হতেই পারে। সব রাজাই চাইবেন তাদের সীমান্ত নিজ অধিকারে থাক ও সুদৃঢ় থাক। দেবমন্দিরাদির ক্ষতিসাধন করা হয়ে থাকলে তা-ও ওই রাজনৈতিক অধিকার। বিস্তারের অঙ্গীভূত। মন্দির, মসজিদ সৈন্যের দ্বারা নানা কারণে আত্রান্ত হয়ে থাকে।
হুসেন শাহের আমলে ধর্মনিরপেক্ষতার চরম বিকাশ ঘটে, নচেৎ তার রাজ্যে কোনাে হিন্দু মন্দির নির্মিত হত না। সুখময়বাবু র ‘লােক স্থাপত্য বিশ্লেষণ ও প্রভাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেন যে,
“..সুলতান হােসেন শাহের আমলে ষােড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নাটোরের ভবানীপুরের ‘দো-চালা’ ছাদ বিশিষ্ট একটি জোড় বাংলা মন্দির নির্মিত হয়। উক্ত মন্দিরটি ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।”
শুধু তাই নয়, অনেক হিন্দু জমিদার মুসলমানদের জন্য মসজিদ ও মুসলিম পীরের শবাধারের উপর মাজার নির্মাণ করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজা প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরে (খুলনা) এবং বসন্ত রায় পীরবাজপুরে (খুলনা) তঁার মুসলিম সৈন্যদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করেন। হাওড়া জেলার রাউতাড়ার মাণিক পীরের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক হিন্দু ভক্ত একটি সৌধ নির্মাণ করেন। সুতরাং হুসেন শাহের ধর্মীয় নীতি ছিল উদার, পরধর্ম সহিষ্ণুতা ও নিরপেক্ষতা দ্বারা পরিচালিত।
সুখময়বাবুর পরস্পর বিরােধী উক্তি দ্বারা প্রমাণ করা যায় তিনি কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা করেন। একস্থানে তিনি বলেছেন,
“হােসেন শাহ যখন এঁদের (পরাগল খান ও তার পুত্র ছুটি খানকে ‘মহাভারত’ শুনার জন্য) কোনাে শাস্তি দেননি, তখন বুঝতে হবে তিনি ধর্মোন্মাদ ছিলেন না।”
অন্যদিকে ‘মনসামঙ্গল’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “অত্যাচারের কথা বাদ দিলেও হােসেন শাহের মুসলমান কর্মচারীদের পরধর্ম বিদ্বেষের নিদর্শন বহু সূত্র থেকে পাওয়া যায়।” বৈষ্ণব কীর্তনকে তারা বলতেন ‘ভূতের সংকীর্তন’। সুখময়বাবু বলেছেন, পরধর্ম সম্বন্ধে উদারতা তার (হুসেন শাহ) খুব বেশি ছিল না। অপরদিকে নিজের ধর্মের প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল খুব বেশি। প্রত্যুত্তরে বলা যায় যে, প্রথমত, যদি নিষ্ঠা বেশি থাকে তাহলে তাকে ধর্মোন্মাদ বা খুব গোঁড়া প্রকৃতির বলা যায়। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন যে, তিনি ধর্মোন্মাদ ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি ‘মনসামঙ্গল’-এ উল্লিখিত ‘ছৈয়দ মােল্লা’র কথা বলেছেন এবং বলপূর্বক হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হত বলে উল্লেখ করেন। উদ্ধৃতিটি এরূপ—
‘কেহ বা জুলুম করে কেহ শুন্য শিরে ধরে
রুজু করি করয়ে নছাব।
জতেক ছৈয়দ মােল্লা জপয়ে ও বিসমিল্লা
সদা মুখে কলিমা কেতাব।।
হিন্দুত কলিমা দিল মুছলমানি শিখাইল।
তথা বৈসে যত মুছলমান।।
বলাই বাহুল্য যে, ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের পর থেকে ইসলাম প্রচার হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে কলুষিত হিন্দু সমাজের পঙ্কিলময় জাতিভেদ প্রথাই ধর্মান্তরিতের মূল কারণ। গল্পোচ্ছলে কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে লেখা ‘চরিতামৃত’ বা ‘মনসামঙ্গল’ কতটুকু ঐতিহাসিকভাবে সত্য তা বিচার্য।
হুসেন শাহ হিন্দু-মুসলমানকে সমভাবে দেখতেন। হুসেন শাহের আমলে হিন্দুদের নির্বিঘ্নে ধর্মকর্ম করার স্বাধীনতা ছিল, একথা সুখময়বাবু স্বীকার করেছেন, তবুও হুসেন শাহকে ‘হিন্দু বিদ্বেষী’ বলতে তাঁর বাধেনি। পরস্পরবিরােধী মন্তব্য সত্য যাচাই-এর পরিপন্থী। সুখময়বাবু অনেক অপ্রয়ােজনীয় ও ভিত্তিহীন মন্তব্য করেছেন, যেমন, “হােসেন শাহ হিন্দু ধর্ম তথা পরধর্মের উপর বিশেষ প্রসন্ন ছিলেন না, তাই সময়ে সময়ে তিনি হিন্দুদের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছেন।” সুখময়বাবু তার গ্রন্থে এ ধরণের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেন, যেমন প্রথমত, “হােসেন শাহ হরি সংকীর্তন একেবারেই পছন্দ করতেন না এবং কোথাও হিন্দুরা হরি সংকীর্তন করলে তিনি স্থানীয় কাজীকে শাস্তি দিতেন।” জনৈক মুসলমান নবদ্বীপের কাজীকে বলেছিল,
হরি-হরি করি হিন্দু করে কোলাহল,
প্রশংসা শুনালে তােমায় করিবেক ফল।
অপরদিকে সুখময়বাবু এও বলেছেন,
“হােসেন শাহের অনুদারতার প্রমাণ মেলে কিন্তু তাঁর ধর্মোন্মত্ততার প্রমাণ মেলে …তিনি যদি ধর্মোন্মাদ হতেন তাহলে তিনি নবদ্বীপের কীর্তন বন্ধ করে দিতেন।”
হুসেন শাহ বাধা দিলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার হত কিনা সন্দেহ। অনিরুদ্ধ রায় তার ‘মধ্যযুগের বাংলা ১২০০-১৭৬৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, হুসেন শাহ আদেশ দিয়েছিলেন। যে কোনাে কাজী বা কোতােয়াল যেন শ্রীচৈতন্যের প্রচারে বাধা না দেয়। সেরকম খবর পেলে তিনি ওই কর্মচারীর প্রাণদণ্ড দেবেন (পৃ. ১১৯)। দ্বিতীয়ত, নবদ্বীপের কাজী প্রসঙ্গে সুখময়বাবু আপত্তিকর কথা লিখেছেন, যা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা সত্য বলা খুবই কঠিন। যেমন, শ্রীচৈতন্য নবদ্বীপলীলার সময় এই কাজী, যার সঠিক নাম ও ধাম দিতে সুখময়বাবু ব্যর্থ হয়েছেন, বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী শ্রীচৈতন্যের অনুসারীদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অর্থাৎ কীর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। কথিত আছে যে, শ্রীচৈতন্য সদলবলে কীর্তনে বেরিয়ে সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেন। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ উল্লেখ আছে যে, এই কাজী (চাঁদ কাজী) শ্রীচৈতন্যের কাছে এসে কাজীর গােবধ নিয়ে বিচারে হেরে গিয়ে শ্রীচৈতন্যের পা ছুঁয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, এ সমস্ত ঘটনা। গল্পের মত শুনায় এবং সুখময়বাবু নিজেই স্বীকার করেছেন যে, একটি অর্বাচনী কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে শ্রীচৈতন্যের মাহাত্ম প্রকাশে ও বৈষ্ণব ধর্মের গুণকীর্তন করার জন্য রসাত্মক গল্প ফাঁদা হয় এবং একটি আজগুবি মনগড়া কথা বলা হয়, যেমন, চাঁদ কাজীকে হােসেন শাহের দৌহিত্র বানানাে হয়েছে। উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত এ ধরণের কাহিনি রূপকথায় ভাল মানায়। কথা হচ্ছে, সুখময়বাবু নিজেই বলেছেন যে, হুসেন শাহ ধর্মান্ধ হলে স্বয়ং নবদ্বীপে গিয়ে কীর্তন বন্ধ করতেন। হুসেন শাহের পৃষ্ঠপােষকতা ছাড়া বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার হত না। আব্দুল করিম বলেন, “হােসেন শাহের রাজত্বকালে চৈতন্যদেব বিনা বাধায় তাঁহার ভক্তি ধর্ম প্রচার করেন। এতে পরধর্মের প্রতি হােসেন শাহের উদার মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।” সুখময়বাবু ‘অনুদার আচরণ’কে উৎপীড়ন ও অত্যাচারের পর্যায়ে ফেলবেন কিনা জানা যায় না। যদি তা হয়, তাহলে একথা নিশ্চিত করে। বলতে হয় যে, সুবুদ্ধি রায় ‘খ’ উপাধি ধারণ করলেও মুসলমান হননি। অনেক হিন্দু অমাত্য খ’ উপাধি ধারণ করলেও তারা হিন্দুই রয়ে গিয়েছেন।
সুখময়বাবু দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন হুসেন শাহ অথবা তার পুত্র নসরত শাহের আমলের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বেনেপােলের (নদিয়া জেলা) জমিদার রামচন্দ্র খান ছিলেন শিবের ভক্ত এজন্য চৈতন্যদেব তাকে সহ্য করতে পারতেন না।
১৫১৫-র কয়েক বছর পরে এই রামচন্দ্রের রাজ-কর বাকি পড়ায় হুসেন শাহের উজিরের নিকট তিনি অপদস্থ হন। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ বলা হয়েছে—
‘দস্যুবৃত্তি করে রামচন্দ্র না দেয় রাজকর।।
ক্ষুব্ধ হএ ম্লেচ্ছ (?) উজীর আইল তার ঘর।।
আসি সেই দুর্গামণ্ডপে বাসা কৈল।
অবধ্য (গরু) বধ করি মাংস সে ঘরে রান্ধাইল।।
রামচন্দ্র খান স্বজাতীয় বৈষ্ণবপন্থী হরিদাস ঠাকুর ও নিত্যানন্দের প্রতি যে অসদাচরণ করেছিলেন, তা সুখময়বাবু উল্লেখ করেন। তাকে তিনি হিন্দু সমাজের অপমান বলেছেন। অপরদিকে মুসলিম উজির কর ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে রামচন্দ্র খানকে স্ত্রী-পুত্র সমেত বন্দি করেন, ঘর-বাড়ি লুট করেন, দুর্গামণ্ডপে বাসা বাঁধেন এবং সেখানে গরু জবাই করে তার মাংস রন্ধন করে ভক্ষণ করেন। এর ফলে তার ‘জাতি-ধন-জন’ নষ্ট হয়ে যায়। ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করার উপায় নেই, কারণ সমসাময়িক ইতিহাসে এর উল্লেখ নেই। বৈষ্ণব সাহিত্য কতটুকু সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য সরবরাহ করেছে তা বলা দুষ্কর।
(৬)
কাজী ও শ্রীচৈতন্যের বিরােধও প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে। সে যুগের সামাজিক জীবনে শ্রীচৈতন্য ভাব-বি-বের জোয়ার আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। যখন ব্রাহ্মণদের পক্ষে হিন্দু সংস্কৃতি সংরক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, তখন শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব। তিনি প্রচার করলেন জীবে দয়া, ঈশ্বরে ভক্তি, বিশেষ করে নাম ধর্ম, নাম সংকীর্তন। কৃষ্ণ নামে ব্রাহ্মণ চণ্ডাল সকলেরই অধিকার। হিন্দু সমাজের উচ্চ ও নিম্নবর্গকে এক ধর্মাচরণে ও ভাবাদর্শে পরস্পরের সন্নিকট করে শ্রীচৈতন্যদেব এক আত্মীয়ভাবাপন্ন হিন্দু সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। এই প্রয়াসকে আমরা আজকের প্রচলিত ভাষায় গণতান্ত্রিক বলতে পারি।
ব্রাহ্মণদের কৌলিন্যপ্রথা এতই কঠোর ছিল যে, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে ছোঁয়াছুয়িও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর এবং মুসলিম রাজদরবারে হিন্দু-মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের লােকদের নিয়ােগ করার ফলে এই ছোঁয়াছুয়ি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়ে ব্রাহ্মণেরা কৌলিন্য রার চেষ্টা করলেও বিদ্যাবুদ্ধিতে পিছিয়ে পড়ায় তাদের পক্ষে সেটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই ব্রাহ্মণদের মধ্যেও ধর্মরক্ষার প্রণে বিরােধ দেখা দেয়। ইসলামের প্রভাব থেকে হিন্দুধর্ম রক্ষার জন্যে কিছু ব্রাহ্মণ হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধনে এগিয়ে আসেন। এই সময় চৈতন্য বর্ণবৈষম্য বিদূরিত করে কৃষ্ণ প্রেমের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই বৈষ্ণব ধর্ম। শ্ৰীচৈতন্যের ধর্মসংস্কারের লক্ষ্য হিন্দু ধর্মকে ইসলামের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা হলেও বর্ণবৈষম্য রােধের চেষ্টা ইসলামের সুফি প্রভাবেরই ফল। কৃষ্ণনাম ও কীর্তন এসেছে সুফিদের হালকা জিকির থেকে। বস্তুত চৈতন্যের ধর্ম হিন্দু-মুসলমানের মিলনের একটা ভূমি প্রস্তুত করেছিল।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে ভক্ত নর-নারীগণের সাধনার প্রধানতম বিষয় রাধাকৃষ্ণলীলা শ্রবণ কীর্তন স্মরণ ও বন্দনা করা। বৈষ্ণব অনুরাগী ও ধর্মাবলম্বী ভক্ত কবিগণ রাধাকৃষ্ণলীলা অবলম্বনে বহু গান বা পদ রচনা করেছিলেন। এর ফলে বাংলা সাহিত্য এক নতুন ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। এই ধারার পরিচয় পদাবলী সাহিত্যে নিহিত আছে। চৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে গড়ে উঠল চরিত্র-সাহিত্য। সে যুগের বেশ কয়েকজন উল্লেখযােগ্য কবি চৈতন্য-জীবনীকার হিসাবে সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
সাহিত্যের ইতিহাসে চৈতন্যদেবের নামের সঙ্গে বাংলার সুলতান হিসাবে হুসেন শাহর নামও জড়িত হয়ে আছে। মুসলমান সুলতান, দেওয়ান ও কাজীর শাসনাধীন আমলে চৈতন্যদেব অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে খােল করতাল মৃদঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যভাণ্ডসহ যেভাবে সরবে মিছিলসহ নগরকীর্তন করতেন তাতে সে সময় অবৈষ্ণবগণ তথা রক্ষণশীল ব্রাহ্মণগণ অধৈর্য হয়ে উঠতেন। মনে হয় তারই পরিণতি হিসাবে পথে পথে হরিনাম প্রচারকালে নিত্যানন্দ ও হরিদাস ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী দুই ভাই জগাই ও মাধাই-এর হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন। জগাই ও মাধাই-এর ক্রোধের মােকাবিলা করার জন্য স্বয়ং শ্রীচৈতন্যকে হাজির হতে হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে ওই দুই ভাই শ্রীচৈতন্যের গুণগ্রাহী ভক্ত হিসাবে পরিচিত হয়েছিল।
হুসেন শাহ হিন্দুদের ধর্মীয় ব্যাপারে কোনােরূপ হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করেন। ফলে তার শাসনকালে হিন্দুরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উদযাপনে, শিক্ষায় ও ধর্ম প্রচারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভােগ করতে সক্ষম হয়। সমসাময়িক বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, ব্রাহ্মণগণ শ্রীচৈতন্যের বি-বাত্মক চিন্তাধারার প্রতি খুবই বিরূপ ছিলেন। ধর্ম প্রচারের কার্য থেকে তাকে নিরস্ত করার জন্যে রাষ্ট্রীয় সাহায্য লাভের অভিপ্রায়ে ব্রাহ্মণগণ সুলতান হুসেন শাহের নিকট শ্রীচৈতন্যের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। ক্ষুদিরাম দাস লিখেছেন,
“শ্রীচৈতন্যের ভক্তদের সংকীর্তনে কাজীর লােকজন যে বাধার সৃষ্টি করেছিলেন তার কারণ পণ্ডিত অর্থাৎ ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কাজির কাছে অহরহ ‘লাগানি’। এ তথ্য বৃন্দাবন দাস দিচ্ছেন।”
বিচক্ষণ সুলতান শ্রীচৈতন্যের কার্যাবলী সম্পর্কে নিরপেক্ষ ভাবে অনুসন্ধান করেন এবং এর ফলে বুঝতে পারেন যে,
চৈতন্যের বৈষ্ণব চিন্তাধারা হিন্দুদের কোনও ক্ষতিসাধন করছে না, বরং হিন্দু সমাজের উন্নতি বিধান করাই তার চিন্তাধারা ও প্রচারণার লক্ষ্য। হিন্দুর সামাজিক জীবনে শ্রীচৈতন্যের ধর্ম প্রচারের গুরুত্বের কথা উপলব্ধি করে হুসেন শাহ তার ধর্ম। প্রচার কার্যে কোনােরূপ বাধার সৃষ্টি করেননি। তার ওপর বৈষ্ণব গুরুর প্রচার কার্যে বাধা না দেওয়ার জন্য হুসেন শাহ সরকারি কর্মচারী ও অন্যান্যদের প্রতি এক আদেশ জারি করেন। এমনকি তিনি শ্রীচৈতন্যের কোনােরূপ ক্ষতিসাধন করার বিরুদ্ধে তাদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন। সে সময়ে নবদ্বীপ ছিল আম্বুয়া মুলুকের অন্তর্গত। ওই মুলুকের কাজীর কাছে নালিশ করেছিল অবৈষ্ণবগণ। কাজী দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য কঠোর হতে বাধ্য হয়েছিলেন মাত্র। কাজীকে কেউ কেউ ভয় দেখিয়ে এও বলেছিলেন—চৈতন্যদেব লােক পাচ্ছে, হিন্দুয়ানি জাহির করছে, সুতরাং তাকে জব্দ না করলে মুসলমানি রাজত্ব টিকবে না।
শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে কাজীর ও মুসলমানদের কেমন সম্বন্ধ ছিল সে বিষয়ে আলােচনার পূর্বে একই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত অবৈষ্ণব বিশেষত স্মার্ত ও শাক্তগণ শ্রীচৈতন্য সম্বন্ধে কেমন ধারণা পােষণ করতেন তা জানা প্রয়ােজন। তাহলে সে আমলে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক নির্ধারণ করা সহজ হতে পারে।
হাবসী আমলের শেষে হুসেন শাহী আমলে চৈতন্যের নগর সংকীর্তনের উৎপাতে অবৈষ্ণবগণ তথা ব্রাহ্মণগণ ভীত হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া বৈষ্ণবগণও মনে করেছিলেন যে, এর ফলে হয়তাে মুসলমান শাসক ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের কোনােরকম ক্ষতি করতে পারে। সে সময় দেশে গুজব রটনা হয়েছিল বৈষ্ণবদের ধরার জন্য নৌকাযােগে সুলতানের পাইক আসছে— তার পরিচয় কথা—
‘কেহাে বলে আরে ভাই পড়িলা প্রমাদ।
শ্রীবাসের লাগি হৈল দেশের উন্মাদ।।
আজি মুই দেয়ানে শুনিল সব কথা।
রাজার আজ্ঞায় দুই নাও আইসে হেথা।
শুনিলেক, নদীয়ার কীর্তন বিশেষ।
ধরিয়া নিবারে হৈল রাজার আদেশ।।
কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। এটি নিছক গুজব মাত্র। মুসলমান সুলতান নৌকাযােগে পাইক যদি পাঠাতেন বৈষ্ণবদের ধরার জন্য তাহলে অবশ্যই তার পরিচয় পাওয়া যেত। কিন্তু তেমন কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ওই গুজবে চৈতন্যভক্ত শ্রীবাস পর্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছিলেন। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব ভক্তগণকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন—
“ওহে শ্রীনিবাস কিছু মনে ভয় পাও।
শুনি তােমা ধরিতে আইসে রাজ-নাও।
মুই গিয়া সর্ব আগে নৌকায় চড়িমু।
এই মত গিয়া রাজগােচর হইমু।।
চৈতন্যদেবের ভক্ত পার্ষদদের প্রতি মুসলমান শাসক যত না অত্যাচার করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি অত্যাচার, খারাপ ধারণা ও ঘােরতর বিপক্ষতা পােষণ করেছেন ব্রাহ্মণগণ তথা স্মার্ত ও শাক্ত অবৈষ্ণবগণ। বৈষ্ণবগণ সম্বন্ধে অবৈষ্ণবগণ নিজেদের মধ্যে পরস্পর কি বলাবলি করত তার পরিচয় যথা—
এ বামুনগুলা রাজ্য করিবেক নাশ।
ইহা সবে হৈতে হবে দুর্ভিক্ষ প্রকাশ।।
এ বামুনগুলা সব মাগিয়া খাইতে।
ভাবুক কীর্তন করে নানা ছলা পাতে।।…
কেহ বলে যদি ধানে কিছু মূল্য চড়ে।
তবে এগুলারে ধরি কিলাইমু ঘাড়ে।।
এছাড়া বৈষ্ণবগণ যখন রাত্রিকালে শ্রীবাসের ঘরে দরজা বন্ধ করে নামগান করত সে সম্বন্ধে তারা কিরূপ বিরূপ মনােভাব পােষণ করত তার পরিচয় পাওয়া যায়, যথা—
কেহ বলে আরে ভাই মদিরা আনিয়া।
সবে রাত্রি করি খায়। লােক লুকাইয়া।।…
কেহ বলে আরে ভাই সব হেতু পাইল।
দ্বার দিয়া কীর্তনের সন্দর্ভ জানিল।।
রাত্রি করি মন্ত্র পড়ি পঞ্চকন্যা আনে।
নানাবিধ দ্রব্য আইসে তা সবার সনে।।
ভক্ষ ভােজ্য গন্ধমাল্য বিবিধ বসন।
খাইয়া তা সবা সঙ্গে বিবিধ রমন।।
ভিন্ন লােক দেখিলে না হয় তার সঙ্গ।
এতেক দুয়ার দিয়া করে নানা রঙ্গ।।
মনে হয় এসব নানাবিধ কারণেই শ্রীবাসের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিপক্ষ গণ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে,
‘শ্রীবাস বামনার এই নদীয়া হৈতে।
ঘর ভাঙ্গি কালি নিয়া ফেলাইমু স্রোতে।।
ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এটা তাদের নিছক পরিকল্পনা মাত্র ছিল। বাস্তবায়িত করার নানা অসুবিধা ছিল। মনে হয় প্রধান বাধা ছিল কাজীর সুশাসন। শ্রীচৈতন্যের প্রতি মুসলমান কাজী কি ধারণা পােষণ করতেন সে বিষয়ে জানা যায় যে, পারস্পরিক সম্পর্ক খুব একটা খারাপ ছিল না বরং ভালাে বলা যায়। শ্রীচৈতন্যের নাম কীর্তনে মেতে ওঠার ফলে শাক্ত ও নৈয়ায়িকগণ কাজীর নিকট বৈষ্ণবদের বিরুদ্ধে নালিশ করল। কাজী এই নালিশ পেয়ে কীর্তন করতে নিষেধ করেছিলেন। আর সেই সঙ্গে বলেছিলেন—সর্বস্ব দণ্ডিয়া তারে জাতি যে লইমু। এই নিষেধ বার্তাই শ্রীচৈতন্যকে আরও বেশি করে নগরকীর্তন করার উৎসাহ জুগিয়েছিল। ফলে তিনি তিন দলে কীর্তনের আয়ােজন করলেন। সামনের দলের অগ্রভাগে রাখলেন যবন হরিদাসকে। মুসলমান কাজী যাতে যবন হরিদাসকে দেখে কোনােরূপ অত্যাচার করতে সাহস না পায়। মাঝে রইলেন অদ্বৈত আর শেষের দলের প্রথমেই রইলেন চৈতন্য ও নিত্যানন্দ। দেখা যাচ্ছে যে, কাজীর নিষেধকে তিনি অগ্রাহ্য করলেন। এবং এখানেই শ্রীচৈতন্য শান্ত হলেন না, কাজীর প্রতি যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করলেন। তার বর্ণনা পাই বৃন্দাবন দাসের লেখায়। যথা—
‘ক্রোধে বােলে প্রভু আরে কাজি বেটা কেথা।
ঝাট আন ধরিয়া কাটিয়া ফেলাে মাথা।।
নির্যবন করাে আজি সকল ভুবন।
পূর্বে যেন বধ কৈলু সে কালযবন।।
প্রাণ খএ কোথা কাজি গেল দিয়া দ্বার।
ঘর ভাঙ্গ ভাঙ্গ প্রভু বােলে বারবার।।
এরকম ঘটনা সম্ভব নয়। এ বৃন্দাবন দাসের কল্পনা এবং বিব্ধ মনের আত্মতুষ্টি মাত্র। বিমানবিহারী মজুমদার তার ‘শ্রীচৈতন্য চরিতের উপাদান’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন,
“তাহার আদেশে ভক্তগণ কাজীর ঘর ভাঙিলেন ও ফুলের বাগানের গাছ উপড়াইয়া ছারখার করিলেন। তারপর বিম্ভর যখন বলিলেন, ‘অগ্নি দেহ ঘরে তােরা না করিহ ভয়।’ তখন ভক্তেরাই তাহাকে বুঝাইয়া শান্ত করিলেন।
‘হাসে মহাপ্রভু সর্বদাসের বচনে।
হরি বলি নৃত্যরসে চলিলা তখনে।।”
কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেন,
“উদ্ধত লােক ভাঙ্গে কাজীর ঘর পুষ্পবন।
বিস্তারি বর্ণিলা ইহা দাস বৃন্দাবন।।
তবে মহাপ্রভু তার দ্বারতে বসিলা।
ভব্য লােক পাঠাইয়া কাজীরে বােলাইলা।।
দূর হৈতে আইলা কাজী মাথা নােয়াইয়া।
কাজীরে বসাইলা প্রভু সম্মান করিয়া।।
প্রভু বােলে আমি তােমার আইলাম অভ্যাগত।
আমা দেখি লুকাইলা এ ধর্ম কি মত৷৷”
নিরুপায় কাজী কি আর করেন। শেষ পর্যন্ত কাজী আত্মীয়তা পাতিয়ে শ্রীচৈতন্যকে বললেন—
‘নীলাম্বর চক্রবর্তী হয় তােমার নানা।
সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা।।।
ভাগিনার ক্রোধ মামা অবশ্য সহয়।
মাতুলের অপরাধ ভাগিনা না লয়।।
এই ছিল সে সময়ের অবস্থা। কাজীরই অত্যাচারের কথা বহু পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে দেখা যায়। কিন্তু শ্রীচৈতন্যও দৃঢ়চিত্ত ছিলেন। কাজী ধর্মীয় কারণে কীর্তন নিষেধ করেননি। অবৈষ্ণব প্রজাদের আবেদনে তিনি ওই নিষেধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যাতে অবৈষ্ণবদের সঙ্গে বৈষ্ণবদের কোনাে বড়াে রকমের বিরােধ না বাধে সেজন্য। মনে হয়, কাজী যদি সে সময় কীর্তন করতে নিষেধ না করতেন তাহলে হয়তাে অবৈষ্ণবদের সঙ্গে তাদের বড়াে রকমের বিরােধিতার মােকাবিলা করতে হত। সাধারণ মুসলমান ও কাজী যদি কঠোর হতেন তাহলে হয়তাে শ্রীচৈতন্যের ওইরূপ আচরণ করা খুব একটা সম্ভব হত না। সে যুগে শ্রীচৈতন্যের ওই বিরােধ ছিল রাজনৈতিকভাবে মুসলমান কাজীর সঙ্গে। সামাজিক ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে সাধারণ মুসলমানের তেমন কোনাে বিরােধ ছিল না। থাকলে নিশ্চয়ই সে বিরােধের পরিচয় আমরা সাহিত্যের পাতায় অবশ্যই পেতাম। সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের তেমন কোনাে বড়াে রকমের বিরােধের বর্ণনা সে সময়ের সাহিত্যে নেই বললেই হয়।
বৈষ্ণব ষড় গােস্বামীগণের মধ্যে রঘুনাথ দাসও একজন ছিলেন। মুসলমান উজির রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে অভিযােগ পেয়ে তদারক করতে এসে হিরণ্য গােবর্ধনকে না পেয়ে তার পুত্র রঘুনাথকে বন্দী করেছিলেন। উজির রঘুনাথকে ভয় দেখিয়েছিল—“বাপ জেঠাকে হাজির করে না দিলে শাস্তি পাবে। উজির ভয় দেখিয়েছিল মাত্র। শাস্তি তাে দেনইনি এবং সে সাহসও পাননি। রঘুনাথ সেই উজিরকে যেকথা বুঝিয়েছিলেন তা লক্ষণীয়, যথা—“আমার বাপ জেঠা ও তুমি ভায়ের মত ছিলে। ভাইদের মধ্যে ঝগড়া যেমন আজ আছে কাল নাই, তােমাদের বিবাদও তেমনি একদিন মিটিয়া যাইবে। তুমি আমার বাপ-জেঠার মতাে। আমাকে শাস্তি দেওয়া তােমার উচিত নয়।”
রঘুনাথের সেই কথায় উজিরের মন গলে গিয়েছিল।
সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে যবন হরিদাস বৈষ্ণব মতাবলম্বী হলে পর কাজী তাকে মত পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু সেজন্য সাধারণ মুসলমানগণ হরিদাসের তেমন বিরােধিতা করেননি। কাজী এবং সে যুগের মুসলমান যদি তেমনভাবে তার বিরােধিতা করতেন বা তার প্রতি ভীষণভাবে বিরূপ হতেন তাহলে হরিদাসের পথে ওইভাবে বৈষ্ণব ধর্মাচরণ করা সম্ভব হত কি?
বিজয় গুপ্তের রচনার মধ্যে ‘হাসান-হােসেন পালা’ আছে। এই পালায় হিন্দুর উপর মুসলমান কাজীর দৌরাত্ম্যের একটি বর্ণনা আছে। যদিও এই পালাটি বিজয় গুপ্তের রচনা কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। মনে হয় কোনাে পালাকার পরবর্তীকালে ওই পালাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কারণ বিজয় গুপ্তের মত পণ্ডিত কবি যিনি কাব্যের মধ্যে রাজার অতাে প্রশংসা করেছেন। তার পথে ওই বিশৃঙ্খলার ঘটনা লিপিবদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না। আর যদি এই ঘটনা তারই লেখা হয় এবং কল্পিত কাহিনি না হয় তাহলে দেখতে হবে ঘটনাটি স্থানীয় কাজীর অত্যাচার মাত্র। এতে সামগ্রিকভাবে মুসলমানের হিন্দু নির্যাতন ধরা যুক্তিযুক্ত হবে না।
‘হাসান-হােসেন পালা’ হতে জানা যায়, হান্টি গ্রামের নিকট হাসান-হােসেন নামে মুসলমান দুই ভাই ছিল
“কাজিয়ানী করে তারা, জানে বিপরীত।
তাদের সম্মুখে নাই হিন্দুয়ানী রীত।।”
এই শ্রেণির কাজীর ছিল এক শ্যালক। সে হিন্দুদের উপর কেমন অত্যাচার করত সে প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে, যথা—
“যাহার মাথায় দেখে তুলসীর পাত।
হাতে গলে বান্ধি নেয় কাজীর সামাত।।
পরের মারিতে কিবা পরের লাগে ব্যথা।
চোপড় চাপড় মারে দেয় ঘাড় কাতা।।
সে যে ব্রাহ্মণের পৈতা দেখে তার কান্ধে।
পেয়াদা বেটা লাগ পাইলে তার গলায় বান্ধে।।”
এরকম ঘটনার সঙ্গে রাজ্য প্রশাসনের কোনাে যােগ না থাকাই স্বাভাবিক। তবে ব্যক্তিগত বিদ্বেষবশত কোনাে প্রজার প্রতি রাজ-শ্যালকদের এমন অত্যাচার বহুপূর্বে হিন্দুযুগেও ছিল। তার প্রমাণ ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটক। প্রমথ চৌধুরীর মন্তব্য “হােসেন শ্যালকের অত্যাচার চড়-চাপড়ের উপর তাে ওঠেনি। স্বয়ং কাজী সাহেবও হিন্দুদের উপর মারপিট করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু তার রাগের যথেষ্ট কারণ ছিল। কাজী সাহেবের মােল্লাকে কতকগুলাে গয়লার ছেলে মিলে অযথা প্রহার দেয়। মােল্লা তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে কাজীর কাছে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করে যে,
‘হের দেখ দাড়ি নাহি মুখে রক্ত পড়ে।
দন্ত ভাঙ্গিয়াছে মাের চোপড় চাপড়ে।।
পরিধান ইজার আমার দেখ সব ভাঙ্গা।
ছাগলের রক্তে দেখ মুখ মাের রাঙ্গা।।”
মােল্লার কথায় কাজী সাহেবের উত্মা ঘটলে পর—
‘শুনিয়া কোপিল কাজী, চারিদিকে চায়।।
হারামজাত হিন্দুর হয় এতবড় প্রাণ।
আমার গ্রামেতে বেটা করে হিন্দুয়ান।।
গােটে গােটে ধরিব গিয়া যতেক ছােমরা।
এড়া রুটি খাওয়াইয়া করিব জাতিমারা।।
এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী বলেন, “মুসলমানী যুগের যে সকল বাংলা রচনার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে তার মধ্যে অপর কোনাে গ্রন্থে হিন্দুর ধর্মের প্রতি মুসলমানের বিদ্বেষের এতাদৃশ প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবে একটু ভেবে দেখলে দেখা যায় যে এক্ষেত্রে কাজী সাহেব অসাধারণ Fanaticsm-এর প্রমাণ দেননি। আজকের দিনে ছােকরার দল যদি কোনাে খ্রীষ্টান পাদ্রীকে ওভাবে নিগ্রহ করে তাহলে একালের শাসনকর্তাদের হাতে তাদের সমান নিগৃহীত হতে হয়। তারপর কাজী হচ্ছেন ধর্ম-বিষয়ক ম্যাজিস্ট্রেট, সুতরাং ন্যায়ত তার কর্তব্য হচ্ছে ছােকরাদের ওরকম হঠকারিতার জন্য শাস্তি দেওয়া। আর এক কথা, এক্ষেত্রে হােসেন কাজী মুখে যা বলেছিলেন কার্যত তা করেননি। কাজীর মাতা ছিলেন। হিন্দুর কন্যা এবং তার কথামত হাসান-হােসেন দু’ভাই হিন্দুদের মারপিট না করে নিজেরা বয়েদ লেখা তাবিজ ধারণ করেন। প্রমথ চৌধুরীর মতে, এ ঘটনা সম্ভবত বিজয় গুপ্তের সম্পূর্ণ মনগড়া। আবার এমনও হতে পারে যে, কবি নিজে কোনাে সময় কাজীর কোপে পড়েছিলেন। দ্বিজ বংশীদাসের মনসামঙ্গলে ওই ঘটনার ঐরকম বর্ণনা আছে। যদিও দ্বিজ বংশীদাস বিজয় গুপ্তের দু’শ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
অন্যদিকে সাধারণ মুসলমানের প্রতি শ্রীচৈতন্য তেমন কোনাে বিরূপ ধারণা পােষণ করতেন না। তার প্রমাণ হিসাবে বলা যায় যে, শ্রীবাসের গৃহে শ্রীচৈতন্যের উৎসব উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হতাে তাতে শ্রীবাসের পরিজন দাসদাসী সকলেই শ্রীচৈতন্যের অনুগ্রহ লাভ করতেন। এই অনুগ্রহ লাভ হতে শ্রীবাসের মুসলমান দরজিও বঞ্চিত হননি। তার বর্ণনা যথা—
‘শ্রীবাসের বস্ত্র দিয়ে দরজী যবন।
প্রভু তারে নিজরূপ করাইল দর্শন।
এছাড়া মুসলমান হরিদাসকে শ্রীচৈতন্য অত্যন্ত সুনজরে দেখতেন। হরিদাসকে স্বগৃহে স্থান দিয়েছিলেন এবং সেই হরিদাস দেহরক্ষার পর তার পদধূলি ভক্তদের নিতে বলেছিলেন। হরিদাসের মৃত্যুতে তিনি শােকাভিভূত হয়ে নিজ হাতে তাকে কবরস্থ করেছিলেন। সুতরাং একথা বলাই যায় যে শাসক, কাজী ও শ্রীচৈতন্যের মধ্যে মধুর সম্পর্ক পরিলতি না হলেও তাদের মধ্যে উল্লেখ করার মত বিরােধ ছিল না সে-সময়ে। প্রাগাধুনিক চৈতন্যজীবনীগুলি থেকে কখনও মনে হয় না যে মুসলমানদের বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গ্রাস থেকে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার জন্যই বৈষ্ণবীয় পরিমণ্ডল ও ধর্মান্দোলন শুরু হয়েছিল। রমাকান্ত চক্রবর্তী চমৎকার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া হিন্দু-মুসলিম বিরােধ সমাজে কিছু পরিমাণে থাকলেও চৈতন্যের গােড়ার দিকের জীবনীতে তা আদৌ ‘মৌল’ বিষয় নয়।৪৭ বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ খুঁটিয়ে পড়লে হিন্দু সমাজের অন্তর্নিহিত সংকটের হেতু যে তারা নিজেরাই, তা বােঝা যায়।
বস্তুত ওই সংকট থেকে মুক্তির উপায় ছিল আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ও ব্যবহারিক আচরণে মানবিকতাকে ও ঔদার্যকে স্থান দেওয়া। শ্রীচৈতন্য এই মানবিকতার সন্ধান পেয়েছিলেন ভত্তি(বাদের মধ্যে। প্রচলিত ভক্তিবাদকেই তিনি একটি বিশিষ্ট ও শক্তিশালী ধর্মীয় মতাদর্শ হিসাবে নবরূপে গড়ে তুলেছিলেন। এই সূত্রে ভক্তিবাদের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক প্রসঙ্গতআলােচিত হতে পারে কিন্তু সর্বভারতীয় চিত্র আমাদের উপজীব্য নয় বলে তাতে বিরত থাকা গেল (এ বিষয়ে তারাচাঁদসহ বহু লেখক আলােচনা করেছেন)। আমাদের প্রণটি হল, ইসলামের কাছে কি শ্রীচৈতন্যের ঋণ নেই? মধ্যযুগে ভক্তি পন্থার উপর ইসলামের প্রভাব সুবিদিত, বিশেষত সুফীবাদের। কিন্তু রামানন্দ, কবীর বা নানকের ক্ষেত্রে তা যতখানি সত্য চৈতন্যের ক্ষেত্রে তা নয়। এনামূল হক গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও ইসলামিক অতীন্দ্রিয়বাদের মধ্যে কিছু সম্ভাব্য সাদৃশ্য খুঁজে পেলেও তার সবটা মেনে নেওয়া যায় না। শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে কোনও সুফি-সাধকের সংস্পর্শের বা তার ইসলামি শাস্ত্র, সাহিত্য পড়ার কিংবা নবদ্বীপে সুফি দর্শনচর্চার কোনও প্রমাণ নেই। তবে সমসাময়িক ধর্ম হিসেবে প্রভাব কিছু থাকতেই পারে। বিশেষত সাম্য ও জাতিভেদবিরােধী মনােভাবে।
শ্রীচৈতন্যবাদে ইসলামের প্রভাব কম একথা যেমন সত্য তেমনি তার ধর্মান্দোলন ইসলাম-বিরােধী ছিল না একথাও সত্য। শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক কোনও রচনায় এর প্রমাণ নেই। উত্তরকালীন চৈতন্যজীবনীতে যেমন অতিরঞ্জনের ঝোঁক স্পষ্ট, তেমনি উত্তরকালের বৈষ্ণবধর্মে ইসলাম বিরােধিতা লক্ষণীয়। কৃষ্ণদাস কবিরাজ যেমন পক্ষপাতদুষ্ট যদিও তার ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-ই শ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ। তাঁর রচনায় বিজুলী খান ও উড়িষ্যার সীমান্ত অধিকারীর ধর্মান্তকরণের ঘটনা। আছে, তবে তা বির্বাসযােগ্য নয়। বৈষ্ণবধর্মে মুসলমানদের দীক্ষাগ্রহণ অবশ্যই সীমিত। এমনকি যবন হরিদাসও সম্ভবত জন্মসূত্রে মুসলমান নন, পরে হিন্দুধর্মচ্যুত হন মুসলমান পরিবারের সঙ্গে যােগাযােগের ফলে। তিনি মুসলমানদের বৈষ্ণবধর্মে টেনে এনেছেন, এমন বক্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ইতিহাসবিদ মমতাজুর রহমান তরফদার। তবে বৈষ্ণবদের ভক্তিবাদ ও সংকীর্তন নিম্নবর্ণের মুসলমান বাঙালিদেরও আকৃষ্ট করেছিল একথা সত্য। বৈষ্ণবধর্মের প্রসারের ফলে হিন্দু থেকে মুসলমানে ধর্মান্তর যে কমে গিয়েছিল তাও নিশ্চিত। তবে শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপলীলায় ‘কাজী দলন’ ঘটনাটি সম্পর্কে আরও কিছু বলা দরকার। নবদ্বীপের কাজী একবার কীর্তন নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন, তার বিরুদ্ধে শ্রীচৈতন্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিশাল শােভাযাত্রা সংগঠিত করেন এবং শেষপর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। কিন্তু এই ‘বিজয়’ নিয়ে উল্লাস এবং হিন্দু মৌলবাদী ব্যাখ্যার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।৪৮ কেউ কেউ একে ‘গণ আন্দোলন এবং ‘অহিংস সত্যাগ্রহের প্রথম নিদর্শন’ পর্যন্ত বলে ফেলেছেন।৪৯ সাম্প্রতিককালেও ‘কাজী দলন’ নিয়ে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার বিরাম নেই। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ ভাবেই রমাকান্ত চক্রবর্তী লিখেছেন,
“কাজী দলন নিঃসন্দেহে চৈতন্যের নৈতিক সাহসের প্রমাণ, কিন্তু তা তার উপরে কোনাে কোনাে ব্যক্তি কর্তৃক আরােপিত মুসলমান বিরােধিতার প্রমাণ নয়।”
কাজীর কাজকে আদৌ মুসলমান শাসকের হিন্দুদের ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ বলা যায় না। কারণ সুলতানি আমলে স্বীকৃত হিন্দুধর্মের আচার-আচরণ-ক্রিয়াকর্মের স্বাধীনতায় রাষ্ট্রগতভাবে হস্তক্ষেপের কোনও প্রমাণ নেই। হুসেন শাহ হিন্দুদের উপর উৎপীড়নের পক্ষপাতী ছিলেন, ইতিহাস থেকে একথা ভাবারও কারণ নেই। কাজীর কর্তব্যের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নটি জড়িত। নগর সংকীর্তনে কোলাহলময় উন্মত্ত শােভাযাত্রা ব্যাপারটি নতুন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির তা বন্ধ করাও আশ্চর্যজনক নয়। কাজেই অবাঞ্ছিত উপদ্রব মনে করে কাজীর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বােঝা যায়। শ্রীচৈতন্যের প্রতিবাদও প্রশংসনীয় এবং তার প্রচেষ্টাতেই বৈষ্ণবধর্ম স্বীকৃতি পায়। আবার কাজী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে যে সংযম ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যােগ্য।
রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে কাজীর সঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের বিরােধের প্রসঙ্গকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু চৈতন্যদেবের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের বিরােধের উল্লেখমাত্র করেননি, অথচ ব্রাহ্মণরাই তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন এবং একটি মত অনুসারে ব্রাহ্মণদের ভয়েই তিনি বাংলা থেকে নীলাচলে যান, কিন্তু সেখানে নাকি ব্রাহ্মণরাই তাকে হত্যা করে সমুদ্রের জলে তার দেহ ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এ ধরণের অনুমান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শ্রীচৈতন্য বাইরে গেলে তার সঙ্গে কাশীধর ও গােবিন্দ সর্বদা থাকতেন। দৌড়ালে তারাও পিছনে পিছনে। ছুটতেন এবং হয়ত বা আরও অনেকেই সঙ্গ নেওয়ার চেষ্টা করতেন। আর স্বয়ং প্রতাপরুদ্র এবং তার প্রশাসনে সতত যাঁর ও যাঁর ভক্তগােষ্ঠীর সেবাযত্নের জন্য উন্মুখ তাঁকে হত্যা করা আজকালকার মত অত সহজ ছিল না, আর তার প্রয়ােজনও কিছুমাত্র ছিল না। শ্রীচৈতন্যের দেহত্যাগ বিষয়ে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থগুলির নীরবতা একদিক দিয়ে শ্রদ্ধার যােগ্য হলেও প্রত্যাশা-পূরক হয়নি। পায়ে ইটের আঘাত লাগার পর জুরে মৃত্যু এমন বিবরণ জয়ানন্দ দিয়েছেন, কিন্তু তখনই প্র করতে হয় যে, তার মরদেহ গেল কোথায়, তাকে সমাধিস্থ করা হয়নি? শ্রীচৈতন্যের দেহত্যাগ বিষয়ে অন্যান্য চরিতগ্রন্থগুলিরও নীরবতা একালে নানান উদ্ভট কল্পনার প্রশ্রয় দিয়েছে।
(৭)
হুসেন শাহ শ্রীচৈতন্যকে ভগবানের অবতার বলে মনে করতেন। হিন্দুদের প্রতি তিনি যে দয়া ও সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন তা তৎকালীন হিন্দু কবিদের তাকে রাজাদের বিধের অলঙ্কার (জগৎ-ভূষণ’) এবং কৃষ্ণের অবতার (কৃষ্ণবিতার’) রূপে আখ্যায়িত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। উত্তর ভারতের অধিকাংশ সুলতান হিন্দুদের উপর জিজিয়া বা মাথাপিছু কর ধার্য করেছিলেন। কিন্তু হুসেন শাহের সময়ে বাংলায় এ বিধি প্রচলিত ছিল না, কারণ সমকালীন বৈষ্ণব সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের বর্ণনার জন্য যথেষ্ট স্থান ব্যয় করলেও এর কোনাে উল্লেখই করেনি। মুসলমানদের কাছ থেকে সরকার যাকাত আদায় করেছেন বলেও মনে হয় না। বস্তুত হুসেন শাহ এক ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করেছিলেন। এটা শাসক শ্রেণি যে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আসীন ছিলেন অনেকাংশে সে কারণে হতে পারে। চারিদিক থেকে গৌড় রাজ্য শত্রুভাবাপন্ন বহু রাজ্য দ্বারা বেষ্টিত ছিল। ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে লােদীরা সরে যেতে না যেতেই মুঘল সাম্রাজ্যবাদের উদীয়মান ঢেউ সবকিছু জয় করে নিতে শুরু করেছিল। এ অবস্থায় হুসেন শাহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণির জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের বনিয়াদ শক্তিশালী করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন।
(৮)
হুসেন শাহের পর তাঁর পুত্র নসরত শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। রাজকার্যে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়াছিলেন। মুঘল-বাদশাহ বাবরের সঙ্গে সংঘর্ষকে তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের প্রতিও তার যথেষ্ট প্রীতি ছিল। যদুনাথ সরকার ‘হিস্টরি অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থে বলেছেন,
“Like his father he continued to watch with sympathy the progress of Bengali literature. He himself is said to have ordered a Bengali translation of the Mahabharat, which would perhaps be the earliest of its kind. It was to the active interest of one of his officers, Chhutikhan of Chitagong, that we own Srikara Nandis translation of his epic. Another of his officers named Kaviranjan, was himself a poet of repute and has made affectionate mention of his sovereing.”
১৫৩২ সালে নসরত শাহ আততায়ীর হস্তে নিহত হন। নসরত শাহের পর তার ছােটভাই আব্দুল বদর অল্প সময় সিংহাসনে বসেন। পরে নসরত শাহের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরােজ শাহ (১৫৩২-৩৩) রাজা হন। অল্প সময়ের রাজত্বকালে তিনি তাঁর পিতা ও পিতামহের ন্যায় কবিপােষক ছিলেন। এ সংবাদ ‘কবিরাজ’ শ্রীধরের ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের ভণিতা হতে জানা যায়। যথা—
নৃপতি-নসির শাহা তনয় সুন্দর।
সর্বকাল-নলিনীভােগিত মধুকর।।
রাজা শ্রীপােরােজ শাহা বিনােদ সুজ্ঞান।
দিজ ছিরিধর কবিরাজ পরমান।।
পূর্বরাজা আব্দুল বদর ভাইপাে ফিরােজ শাহকে হত্যা করে আবার সিংহাসনে বসেন। এবার তিনি গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ নাম ধারণ করেন। তার অকর্মণ্যতার ফলেই তিনি শেরা খান ও পর্তুগীজদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হন। এর ফলে সামরিক বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাকে অর্থ সংকটের মােকাবিলা করতে হয়। ১৫৩৮ সালে শেরের আফগান বাহিনী গৌড় অধিকার করলে বাংলায় হুসেন শাহী আমলের অবসান ঘটে।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, ঢাকা বিথবিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৭২, পৃ. ১৫১।
- ২. সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ৫ম পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৫৩৪।
- ৩. গােলাম হুসেন সলীম রিয়াজ-উস-সালাতিন (বাংলার ইতিহাস), রামপ্রাণ গুপ্ত কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, সােপান, পাবলিশার, নতুন সংস্করণ, কলকাতা, ২০১১, আবদুস সালাম কৃত ইংরেজি অনুবাদ, কলকাতা, ১৯০৪ পুনর্মুদ্রণ, দিল্লি, ১৯৭৫ আকবরউদ্দিন অনুদিত, ঢাকা, ২০০৮।
- ৪. নিজামউদ্দিন আহমদ বখশী তবকৎ-ই-আকবরী, ২ খণ্ড, বি দে ও হুসেইন সম্পাদিত, কলকাতা, ১৯২৭-৪১, আহমদ ফজলুর রহমানকৃত বাংলা অনুবাদ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৮।
- ৫. মুহাম্মদ আবুল কাসিম ফিরিস্তা তারিখ-ই-ফিরিস্তা, ইংরেজি অনুবাদ- দ্য হিস্টরি অফ মহামেডান পাওয়ার ইন ইণ্ডিয়া টিল ইয়ার এডি ১৯১২, ৪ খণ্ড, জে ব্রিগস্ সম্পাদিত, কলকাতা, ১৯০৮, পুনর্মুদ্রণ, কলকাতা, ১৯৬৫।
- ৬. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড-১, ৫ম সং, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ২৯৩।
- ৭. বসন্তকুমার ভট্টাচার্য সম্পাদিত, বিজয় গুপ্ত মনসামঙ্গল, ৩য় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ৪, দেখুন-মমতাজুর রহমান তরফদার, হােসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০১, পৃ. ৫৭।
- ৮. মৃণালকান্তি ঘােষ সম্পাদিত, বৃন্দাবন দাস চৈতন্যভাগবৎ, আদি খণ্ড, ৪র্থ সংস্করণ, কলকাতা, পৃ. ৮, ৮২, মধ্যখণ্ড, পৃ. ২০৫ এবং অন্ত্যখণ্ড, পৃ. ৩১৬ ও ৩৫০, সুকুমার সেন, মধ্যযুগের বাঙ্গালা ও বাঙ্গালী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ১৩৫২, পৃ. ১৪-১৫, সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাসের দু’শাে বছর স্বাধীন সুলতানদের আমল, ভারতী বুক স্টল, কলকাতা, ১৯৬২, পৃ. ২৬৪-৮৪, অনিরুদ্ধ রায়, মধ্যযুগের বাংলা ১২০০-১৭৬৫, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ১১৮-১৯।
- ৯. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ৩৩৫।
- ১০. দীনেশচন্দ্র সেন, হিস্টরি অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার, কলকাতা, ১৯১১, পৃ. ২৩৭-৩৮, সুকুমার সেন সম্পাদিত, বিপ্রদাস পিপলাই মনসাবিজয়, কলকাতা, ১৯৬৭।
- ১১. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, প্রাচীন বাংলা পুঁথির বিবরণ, খণ্ড-১, ২য় অংশ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৩২০, পৃ. ১০-১২।
- ১২. প্রদ্যোৎ ঘােষের ‘গম্ভীরা লােকসঙ্গীত ও উৎসব একাল ও সেকাল’ গ্রন্থ হতে গান সংগৃহীত। রচনা তারিখহীন।
- ১৩. দ্রঃ- দীনেশচন্দ্র সেন ও বিনােদবিহারী কাব্যতীর্থ সম্পাদিত, ‘ছুটি খানের মহাভারত’, কলকাতা, ১৯৪৯।
- ১৪. আর ডি ব্যানার্জি, বাংলার ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড-২, কলকাতা, ১৩২৪, পৃ. ৩০৬-০৭, রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস, খণ্ড-২, মালদহ, ১৯০৩, পৃ. ১০৩, ১০৬, ১০৭ এবং ১২৩, তমােনাশ দাশগুপ্ত, অ্যাম্পেক্টেস্ অফ বেঙ্গলি সােসাইটি ফ্রম ওল্ড বেঙ্গলি লিটারেচার, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ৯২। সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪৭, ৫৫০।
- ১৫. অতুলকৃষ্ণ গােস্বামী সম্পাদিত, জয়ানন্দ চৈতন্যমঙ্গল, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৩০৭, পৃ. ১১-১২। দেখুন-মমতাজুর রহমান তরফদার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮।
- ১৬. প্রমথ চৌধুরী, প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান, বিভারতী, কলকাতা, পৃ. ৭।
- ১৭. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন-ইন্দুভূষণ মণ্ডল, মধ্যযুগীন বাংলার ধর্মীয় চরিত্র, পরিবেশক-পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০২।
- ১৮. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বাঙ্গালার ইতিহাস, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ১০১।
- ১৯. রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস, খণ্ড-১, মালদহ, ১৯০১, পৃ. ১২।
- ২০. অবন্তীকুমার সান্যাল ও অশােক ভট্টাচার্য সম্পাদিত, চৈতন্যদেব, সরস্বতী লাইব্রেরী, কলকাতা, ২০০৩, ভূমিকা, পৃ. ২৬।
- ২১. বাংলাদেশের লােকশিল্প, সােনারগাঁও, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃ. ১০৭-৮।
- ২২. S. M. Hasan, Muslim Monuments of Bangladesh, Dhaka, 1987, P. 170.
- ২৩. অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি, পৃ. ১২২-২৩।।
- ২৪. সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, পৃ. ৫৫১ রমেশচন্দ্র মজুমদারও বাংলাদেশের ইতিহাস’র দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন, “হুসেন শাহ যদি ধর্মোন্মাদ হইতেন, তাহা হইলে নবদ্বীপের কীর্তন বন্ধ করায় সেখানকার কাজীর ব্যর্থতা বরণ করার পর স্বয়ং অকুস্থলে উপস্থিত হইতেন এবং বলপূর্বক কীর্তন বন্ধ করিয়া দিতেন।…হুসেন শাহের রাজধানীর খুব কাছেই রামকেলি, কানাই-নাটশালা প্রভৃতি গ্রামে বহু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব বাস করিতেন। ত্রিপুরা অভিযানে গিয়া হুসেন শাহের হিন্দু সৈন্যরা গােমতী নদীর তীরে পাথরের প্রতিমা পূজা করিয়াছিল (‘রাজমালা’)। হুসেন শাহ ধর্মোন্মাদ হইলে এসব ব্যাপার সম্ভব হইত না।”
- ২৫. গােপাল হালদার, বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা, খণ্ড-১, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ. ৬৩-৬৪।
- ২৬. এম এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, খণ্ড-১, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ১০।
- ২৭. এনামুল হক, বঙ্গে সুফী প্রভাব, ঢাকা, ১৯৫৫, পৃ. ১৭১।
- ২৮. ক্ষুদিরাম দাস, দেশ কাল সাহিত্য, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১৪-১৫।
- ২৯. কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃত, বসুমতি সাহিত্য মন্দির, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ২৬১।
- ৩০. বিস্তারিত দেখুন-মুসা কালিম, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৪।
- ৩১. নরেশচন্দ্র জানা, বৈষ্ণব ছয় গােস্বামী, কলকাতা, ১৯৬৭, পৃ. ১০৩।
- ৩২. রমাকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস, দেখুন-অবন্তীকুমার সান্যাল ও অশােক ভট্টাচার্য সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, কলকাতা।
- ৩৩. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, খণ্ড-২, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ. ২৭৫-২৭৭।
- ৩৩. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, যুগাবতার শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ১৮৮।
- ৩৫. বিশ্বহিন্দু বার্তা, মহাপ্রভু সংখ্যা, চৈত্র ১৩৯১।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।