মুঘল বাদশাহ শাহজাহান (১৬২৭-১৬৫৮) একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং রােজা রাখতেন। অমুসলিমদের ওপর অত্যাচার তার রাষ্ট্রনীতির অংশ ছিল না। তিনি জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করেননি। তীর্থযাত্রার কর পুনঃপ্রবর্তন থেকেও নিজেকে বিরত রাখেন। এ সময় অমুসলিমরা পূর্বের মতােই রাজ অনুগ্রহ লাভ করতেন এবং উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতেন। উচ্চস্তরের মনসবদারী তখনাে ক্রমবর্ধমান। বহু হিন্দু পণ্ডিত ও শিল্পী এ সময় রাজ পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিলেন।
অথচ ইউরােপীয় ঐতিহাসিক জন এফ রিচার্ডস্ তার ‘দ্য মুঘল এম্পায়ার’ গ্রন্থে১ এবং ভারতীয় ঐতিহাসিক শ্রীরাম শর্মা তার ‘রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস’২ গ্রন্থে বলেছেন, শাহজাহান তাঁর পিতামহ ও পিতার ধর্মসমন্বয় ও ধর্ম-সহিষ্ণুতা নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। সমকালীন ঐতিহাসিক আবদুল হামিদ লাহােরি তার ‘পাদশাহনামা’৩ গ্রন্থে শাহজাহানকে ইসলামের প্রতিভূ বলে অভিহিত করায়, শাহজাহানের ধর্মনীতিকে প্রকটভাবে দেখানাের একটা প্রবণতা দেখা যায়। এ ব্যাপারে ইউরােপীয় ঐতিহাসিকরা কোনাে ঐতিহাসিক পরিস্থিতির পর্যালােচনা ছাড়াই তৎকালীন মুঘল-দরবারে আগত ইউরােপের কিছু ধর্মযাজক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দূত ও পরিব্রাজকদের বিবরণের উপর নির্ভর করে শাহজাহানের ধর্মীয় অনুদারতাকে সমর্থন করেছেন। তাঁরা খােলামনে সবকিছু বিচার করতে দ্বিধা করেছেন। এমনকি যােগ্যতার দিক দিয়ে বিচার করলে, একাদশ শতাব্দীতে আগত আরব-পণ্ডিতদের থেকেও তারা পিছিয়ে ছিলেন। আরব পণ্ডিতরা বিশেষ করে আলবেরুনী (৯৭৩-১০৪৮) যে নিরপেক্ষতা, কঠিন ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ শক্তির ও মনীষার পরিচয় দিয়েছেন ভারতীয় সমাজ-ধর্ম-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পর্যালােচনার ক্ষেত্রে, তা আজও ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। অথচ মুঘল-দরবারে এই পর্যায়ের কোনাে ইউরােপীয় পরিব্রাজকের সন্ধান পাওয়া যায় না। এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, ইউরােপীয়দের দেওয়া বিবরণ ও তথ্য একাদশ শতাব্দীর আরব-মনীষীদের দেওয়া বিবরণের থেকে অনেক অনির্ভর ও অদায়িত্বপূর্ণ।
[১]
কোনাে কোনাে ভারতীয় ঐতিহাসিক, বিশেষ করে ঐতিহাসিক শ্রীরাম শর্মার লেখা গ্রন্থটি ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হওয়ায়, তখনও পর্যন্ত কোনাে তথ্যনির্ভর বই না থাকায় এই বইটিই আমাদের একমাত্র জীবনবেদ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, বইটির পাঠকসংখ্যা অসংখ্য। সঙ্গত কারণেই বহু বছর ধরে এই বইটিই মুঘল-সম্রাটের ধর্মনীতি সম্পর্কে শেষকথা বলার অধিকার অর্জন করেছিল এবং বহু ঐতিহাসিক কোনাে তথ্যের যথার্থতা ছাড়া এই গ্রন্থের উপর ভিত্তি করেই মুঘল-সম্রাটদের ধর্মনীতির ব্যাখ্যা করেছেন। গােটা বইটাতেই তিনি ইংরেজের দৃষ্টিতে সমগ্র মুসলমান শাসনকে হিন্দু-বিদ্বেষের চরম দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। অথচ একজন সৎ ঐতিহাসিকের দায়িত্ব—যথার্থ তথ্য আহরণ করা এবং তার ভিত্তিতে কার্যকারণ বিচার করা। তাই গ্রন্থটির গ্রন্থ-সমীক্ষায় প্রখ্যাত গবেষক মহম্মদ আতাহার আলি শাহজাহানের ধর্মীয় নীতির আলােচনাতেও৪ শ্ৰীশর্মার বেশ কিছু মন্তব্য সুবিবেচনাপ্রসূত নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, যেমন শ্রীরাম শর্মা লিখেছেন, শাহজাহান আদেশ দিলেন যে, কেবলমাত্র মুসলিমদেরই সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত করা হবে।৫ এ তথ্যের সূত্র হিসাবে কাফি খানের মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।৬ কিন্তু ওই সূত্র অনুসরণ করে ওই পৃষ্ঠায় বা কাফি খানের বইটির অন্য কোথাও সেরকম তথ্য মেলে না। তাছাড়া যদি কাফি খান এমন কথা বলে থাকেন, তার মন্তব্যের তেমন কোনাে মূল্য নেই, যদি না তা সমসাময়িক ইতিহাস রচনা দ্বারা সমর্থিত হয়। কারণ, কাফি খান বইটি লিখেছেন প্রায় একশাে বছর পরে।
শ্রীশর্মার বইটির বহু ভুল-প্রসঙ্গ উল্লেখের মধ্য থেকে একটিকে উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যেতে পারে, যেটি সূত্রনির্দেশ ও বিষয়বস্তু উভয়দিক থেকেই ভুল। বলা হয়েছে ‘বিদ্রোহী ঝুজ্জর সিংহের আশ্রিত যেসব হিন্দু মেয়ে সম্ভবত দাসী ও পরিচারিকা বন্দী হয়, তাদের মুসলিম মনসবদারদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল।’৭ সূত্র হিসাবে দেওয়া হয়েছে আবদুল হামিদ লাহােরির বই৮ এবং কাফি খাঁর বইয়ের৯ তথ্য। কিন্তু কোনােটিতেই নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় কোনােকিছুর উল্লেখ নেই। উল্লিখিত ঘটনার বিবরণ সম্ভবত লাহােরির বইটি১০ থেকে নেওয়া হয়েছে কিন্তু সেখানে মুসলিম বা অমুসলিম মনসবদারদের মধ্যে বন্দিনীদের বিতরণের কোন উল্লেখ নেই। এছাড়া শ্রীরাম শর্মা প্রায়ই এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেগুলি তথ্যভিত্তিক নয়। যেমন, একটি ধর্মান্তরিত লােক একজন মুঘল আমিরকে হত্যা করে কারণ, তাকে নাকি নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল বা দুর্ভিক্ষের সময় যেসব হিন্দু শিশুকে বিক্রি করা হয়েছিল, সরকার তাদের উদ্ধার করার পর ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে।১১ তাই গ্রন্থ-সমীক্ষার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে মহম্মদ আতাহার আলি বলেছেন, বইটির বিষয়বস্তু স্পর্শকাতর। তাছাড়া আজকের দিনে এর একটা রাজনৈতিক তাৎপর্যও আছে, যে কারণে তথ্য সম্পর্কে যত্নবান না হয়ে বিষয়টির শুধু উপরতলায় বিচরণ করা নিরর্থক। তাই তিনি বলেছেন, তথ্য ও সূত্র সম্বন্ধীয় ত্রুটিগুলি সংশােধন না করা পর্যন্ত শ্রীশর্মার বইটি অনায়াসে গ্রহণীয় হবে না।
এজন্যই শাহজাহানের ধর্মনীতির আলােচনা প্রসঙ্গে বইটির গ্রন্থ-সমীক্ষার কিছু নমুনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও, দেওয়ার একান্ত প্রয়ােজন বলে মনে হয়েছে। শাহজাহানের ধর্মনীতির আলােচনার প্রারম্ভকালে তিনি কোন পরিমণ্ডলে বড় হয়ে উঠেছিলেন, তা বিশ্লেষণ করা আমাদের একান্ত প্রয়ােজন। শিশুকাল থেকেই শাহজাহান মহান আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) ছত্রছায়ায় মানুষ হয়েছিলেন এবং আকবরের অভিভাবকত্বেই পাঁচ বছর বয়স থেকে বিখ্যাত পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভ করে তিনি প্রকৃত বিদ্বান ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত হন। আরবি, ফারসি বা হিন্দিতে তার যথেষ্ট অধিকার ছিল এবং বহু গুণী ব্যক্তির সমাবেশে তার দরবার মুখরিত ছিল। তার মনের সৌন্দর্যানুভূতির ছাপ আমরা দেখতে পাই তার অতি সুন্দর হস্তলিপিতে, সঙ্গীতে ও মর্মর-প্রস্তর দ্বারা নির্মিত শ্রেষ্ঠ মুঘল যুগের স্থাপত্য-কার্যে।
কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি অনেক ক্ষেত্রে আকবরকেও হার মানিয়েছিলেন। এমনকি বিস্ত ও দক্ষ সৈনিক হিসেবেও তিনি পিতার আস্থা অর্জন করেছিলেন। দাক্ষিণাত্য বিজয় ও মেবার বিজয়ের নেতৃত্ব তারই ওপর অর্পিত হয়েছিল। অথচ স্যার টমাস রাে, টেরি ও বার্নিয়ের প্রভৃতি ইউরােপীয় পরিব্রাজকদের বিবরণের উপর নির্ভর করে অনেক ঐতিহাসিক শাহজাহানের বিরুদ্ধে স্বভাবনিষ্ঠুর ও হিন্দু-ধর্মবিদ্বেষের অভিযােগ এনেছেন। মধ্যযুগের বাতাবরণে সেদিন সিংহাসন দখলের জন্য শাহজাহানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়েছিল এবং সেই চক্রান্তের যাঁরা বলি হয়েছিলেন, তার জন্য শাহজাহানকে স্বভাব-নিষ্ঠুর বলা যায় না।
[২]
ধর্ম ব্যাপারে শাহজাহান যে সহনশীল ছিলেন, এ তথ্য তার রাজত্বকালের সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে। যদিও সিংহাসনে আরােহনকালে কিছু মুসলমানী রীতি-নীতি প্রবর্তন করেছিলেন এবং বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধকালে সৈন্যদের দ্বারা কিছু মন্দির ধ্বংস হয়েছিল, কিন্তু এর দ্বারা শাহজাহানের হিন্দু-বিদ্বেষ বা ইসলামের পুনরুত্থান ঘটেছিল তা প্রমাণিত হয় না। সমসাময়িক ঐতিহাসিক আবদুল হামিদ লাহােরির বক্তব্যকে বিশ্বাস করে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক শাহজাহান ইসলামের ভিত্তিকে দৃঢ় করেছিলেন—এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা—আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-২৭) যে ধর্মীয় সহনশীলতার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, তাতে তৎকালীন কট্টরবাদী মুসলমানগণ আকবর ও জাহাঙ্গীরের সহিষ্ণুতাকে কখনও সুনজরে দেখেনি। সমস্ত দেশব্যাপী কট্টরবাদীরা সক্রিয় ছিল, কিন্তু মাথা তুলতে পারেনি। স্বভাবতই মুঘল শাসনের প্রতি কট্টরবাদীদের একটা চাপা উত্তেজনা সমগ্র দেশব্যাপী বিরাজ করছিল। বিচক্ষণ কূটনীতিক শাহজাহান তৎকালীন পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী কট্টরবাদীদের চাপা উত্তেজনাকে প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে, রাজনীতিকদের মতাে একটা ছদ্মবেশ ধারণ করে, কিছু শাস্ত্রীয় রীতি-নীতি প্রবর্তন করে কট্টরবাদীদের সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই খলিফার নাম মুদ্রায় ব্যবহার করেছিলেন। উদারনীতিক মহম্মদ বিন তুঘলকও তাঁর রাজত্বকালের (১৩২৫-৫১) শেষের দিকে কট্টরবাদীদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই খলিফাকে ব্যবহার করে নিজেকে রা করতে চেয়েছিলেন। যদিও তিনি রাষ্ট্রের মূলনীতি অক্ষুন্ন রেখেছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে শাহজাহান ও তার পিতা জাহাঙ্গীর হিন্দু-রাজপুত নারীর গর্ভজাত সন্তান ছিলেন, সেহেতু ব্যক্তিগতভাবে হিন্দুদের সঙ্গে তার মৈত্রী তার পিতা ও পিতামহের কালের মতাে অন্ন ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন না। তার রাজদরবার হিন্দুদের কাছে উন্মুত্ত ছিল। হিন্দু শিল্পী, সাহিত্যিক ও সঙ্গীত শিল্পীদের তিনি রাজদরবারে সমাদর করতেন এবং তাদের যথােপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দিতেন। শাহজাহান পূর্ববর্তী মুঘল শাসকদের ন্যায় সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষার পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। সংস্কৃত ও হিন্দি কবিদের অনেক উপঢৌকন দিতেন। তিনি হিন্দুদের জ্ঞান-বিজ্ঞানমূলক গ্রন্থের প্রতি আগ্রহী ছিলেন, সেসব গ্রন্থের তিনি ফারসি অনুবাদও করিয়েছিলেন। তিনি চিত্রশিল্প, জ্যোতিষচর্চা, সঙ্গীত, তুলাদান প্রভৃতি অ-ইসলামীয় রীতি-নীতিকেও রাজদরবার থেকে বিদায় দেননি। শাহজাহান সঙ্গীতের প্রতি যে অনুরাগ প্রকাশ করেন তার ফলেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও রাগিনীর উদ্ভব হয়। যদুনাথ সরকার উল্লেখ করেন যে, শাহজাহানের রচিত কতকগুলি হিন্দি সঙ্গীত শ্রবণ করে দরবারের ‘পুণ্যাত্মা সুফিগণ’ মূছা যেতেন। এই সময়ের স্বনামধন্য সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে মুহাম্মদ সালেহ ও জগন্নাথের নাম করা যেতে পারে। হুমায়ূনের রাজত্বকালে মুঘল চিত্রকলার উন্মেষ হয় এবং জাহাঙ্গীরের আমলে এটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এর পর শাহজাহানের রাজত্বে এই উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদিও স্থাপত্যের প্রতি তার অস্বাভাবিক দুর্বলতা ছিল। এই আমলে প্রতিকৃতি একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রূপ গ্রহণ করে। দারাশিকোর এলহাম শাহজাহানের আমলের চিত্রকলার একটি অনবদ্য সৃষ্টি। শাহজাহানের চিত্রশালার পরিচালক ছিলেন ফকিরুল্লাহ, মীর হাসান, অনুপ চতর প্রমুখ এবং চিত্রমণি এই সময়ের বিখ্যাত চিত্রকর ছিলেন।
রাজপুতদের সঙ্গে শাহজাহান মৈত্রী বজায় রেখেছিলেন। মুঘল ঐতিহ্যানুযায়ী মুঘল সম্রাটরা কোনাে বিষয়কে ধর্মনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেননি। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। কিছু মন্দির বিনষ্ট হওয়ার পিছনে এই রাজনৈতিক যুক্তিই কাজ করেছিল। ধর্মনৈতিক প্রেরণায় কোনাে মন্দির বিনষ্ট হয়নি। যদিও কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক বলেছেন, শাহজাহান ১৬৩২ খ্রীস্টাব্দের একটি ‘ফরমান’-এ তাঁর পিতার আমলে যে মন্দিরগুলির নির্মাণ আরম্ভ হয়েছিল, তা বন্ধ করতে আদেশ দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক বি পি সাক্সেনা১২ শাহজাহানের হিন্দু মন্দির ধ্বংসের পিছনে তার ধর্মনৈতিক উদ্দেশ্যকেই দায়ী করেছেন। কিন্তু এটা আমাদের মনে রাখতে হবে—‘সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করলে দেখা যাবে, কোনাে যুগেই কোনাে শাসক মন্দির বা মসজিদ বলে উদারতা দেখায়নি। মুঘলদের ‘সার্বভৌমত্ব’কে যে মন্দিরগুলি থেকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল (অর্থাৎ যে মন্দিরগুলি ছিল রাষ্ট্র বিরােধিতার কেন্দ্র), সেগুলি সৈন্যরা বিনষ্ট করেছিল। উপরন্তু এই সময় একশ্রেণির হিন্দুর মধ্যে চরম ধর্ম-বিদ্বেষ দেখা দিয়েছিল এবং বহু মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল এবং মুসলমানদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। তাছাড়া প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মনে করেন, শাহজাহানের এই ‘ফরমান’টিকে তার ধর্মীয় গোঁড়ামীর দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখা ঠিক নয়। বেনারসের ধনী ব্যক্তিরা যাঁরা মুঘল সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, তাদের শায়েস্তা করার জন্য শাহজাহান এই আদেশনামা জারী করেছিলেন। উপরন্তু বেনারস ছাড়া কোথাও শাহজাহানের রাজত্বকালে মন্দির বিনষ্ট হয়নি। অন্যদিকে শাহজাহানের আমলে জৈন জহুরি শান্তি দাস আহমদাবাদের কাছে একটি সুন্দর জৈন মন্দির তৈরি করেছিলেন। এর জন্য শাহজাহান তাকে জমিদান করেছিলেন।১৩ কাজেই শাহজাহান যে সবসময় নতুন মন্দির নির্মাণের বিরােধী ছিলেন, একথা বলা সঙ্গত নয়। তিনি বৃন্দাবনের বৈষ্ণব মন্দিরগুলিকে অর্থ সাহায্য দান করেও ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
মধ্যযুগে মন্দির বিনষ্টের ব্যাপারে এ বি এম হবিবুল্লাহর অভিমত, সমসাময়িক মুসলমান ঐতিহাসিকদের একটা প্রবণতা ছিল, ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে অনেক অতিরঞ্জিত ঘটনা লিপিবদ্ধ করা১৪, যা আজ প্রমাণিত হয়েছে। যেমন— হাসান নিজামী কালিঞ্জরের সব মন্দির ধ্বংস হয়েছিল বলে বিবরণ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রাক্-মুসলিম যুগের মাহবা, খাজুরাহাে, কোনারক, কৈলাশনাথসহ সব মন্দির আজও বর্তমান আছে।১৫ তাই মুঘল যুগের কট্টরবাদী ঐতিহাসিকদের, যদিও তাদের সংখ্যা স্বল্প, তাদেরও অতিরঞ্জনের প্রবণতা ছিল। এই তথ্যগুলি আমাদের যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে অনুধাবন করতে হবে।
অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শাহজাহানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুদারতার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে খ্রীস্টানদের চার্চগুলি ধ্বংসের অভিযােগ এনেছেন। কিন্তু সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেছেন, পর্তুগীজ খ্রীস্টানরাও মুঘল আইনকে গ্রাহ্য করত না। এমনকি স্থানীয় সুবাদারদের অগ্রাহ্য করে পর্তুগীজ জলদস্যুরা গ্রামবাংলায় ত্রাসের রাজত্ব চলিয়েছিল। স্থানীয় যুবক-যুবতীদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত। এমনকি মমতাজ মহলের দু’জন মহিলাকে পর্যন্ত ধরে রাখার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। স্বভাবতই শাহজাহান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই পর্তুগীজদের দমন করেছিলেন এবং শাহজাহানের পর্তুগীজ দমনকে সমসাময়িক লেখকরা, বিশেষ করে বার্নিয়ের ও আধুনিক ঐতিহাসিক আবদুর রসিদ১৬ যথার্থ বলে সমর্থন করেছেন। পর্তুগীজ জলদস্যুদের কঠোর হস্তে দমনের ফলে ফিরিঙ্গিদের অত্যাচার বাংলায় প্রশমিত হয়। ১৬৩২ সালের মধ্যে হুগলি থেকে পর্তুগীজদের উচ্ছেদ করা হয়।
[৩]
শাহজাহানের আমলে কেবল মুসলমানদের উচ্চপদে নিয়ােগ করা হত, এই অভিযােগের পিছনে কোনাে ঐতিহাসিক তথ্য নেই। কারণ, তার সময়ে হিন্দু রাজকর্মচারী বা মনসবদারের সংখ্যা ছিল ১৬ শতাংশ আর তার পিতা জাহাঙ্গীরের সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১২ শতাংশ। তাছাড়া আকবরের শাসনকাল অপেক্ষাও শাহজাহানের সময়ে হিন্দু অফিসারদের সংখ্যা বেশি ছিল। রাজা রঘুনাথ শাহজাহানের খাজাঞ্চি ছিলেন। শাহজাহান পুত্র ঔরঙ্গজেবকে লিখেছিলেন যে, হিন্দুদের প্রতি বিরুদ্ধাচারণমূলক আচরণ করবে না। শাহজাহান নিজ সাম্রাজ্যে হিন্দুদেরকে প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করতে দ্বিধা করেননি। তিনি যেসকল হিন্দুদের বিভিন্ন পদ ও মনসব দান করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন—রায়রায়ান দয়ান্ত রায় গুজরাতী, রায়-রায়ান রাজা জগন্নাথ দাস, মহারাজা যশােবন্ত সিং রাঠোর, রাজা জয়সিং, রাজা জগৎসিং, রাজা বিঠলদাস গৌড়, রাজা ভাঞ্জসিং, বালুজী দক্ষিণী, রাও অমর সিং, রাজা রায়সিং, হামরান দক্ষিণী, রূপ সিং রাঠোর, রাজা অমরসিং রাঠোর, সওরশাল হাডা, কমাণ্ডার সিং হাডা, উদাজী রাম দক্ষিণী, রাজা পাহাড় সিং বুন্দিলা, মাধবসিং হাডা, রাজা জগৎ সিং, রায় কাশীদাস, হরিসিং রাঠোর, গােপালসিং গােবর্ধন সিং রাঠোর প্রমুখ। এক্ষে ত্রে মনােহর সিংহ রাণাওয়াৎ রচিত শাহজাহানের হিন্দু মনসবদার’ গ্রন্থটিতে১৭ প্রদত্ত মনসবদারদের সূচি ইতিহাস পাঠকের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবদুল হামিদ খান লাহােরি-কৃত ‘পাদশাহনামা’, ওয়ারিস-কৃত ‘পাদশাহনামা’ ও মুহাম্মদ সালেহ কস্তু-কৃত ‘আমল-ই সালেহ’১৮ প্রভৃতি গ্রন্থে প্রদত্ত শাহজাহানের অন্তিম বছরগুলিতে পদস্থ মনসবদারদের সূচি এবং তাছাড়া ওইসব গ্রন্থে বর্ণিত
হয়নি এমন মনসবদারদের বিবরণ অন্যত্র থেকে নিয়ে ইতিহাস শিক্ষার্থীর জ্ঞান আহরণের জন্য একত্র করা হয়েছে মনােহরের গ্রন্থে। বহু জাঠদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে যাদের শাহজাহান মনসবদার পদে নিযুক্ত করেছিলেন, এদের বর্ণনা আছে হায়দ্রাবাদের ‘অর্জ-ই-চেহরা’, বিকানীরের ফরমান ও নিশান’, শেখ ফরিদ চকরির ‘জখিরাৎ-উল-খানিন’, কেবলরাম-এর তাজকিরাৎউল-উমারা’১৯, ‘আদব-ই-আলমগিরী’২০ এবং জালাল তাবতাবায়ী-র ‘বাদশাহনামা’তে।
শাহজাহানের ধর্মনীতি সঠিকভাবে পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁর শাসনকালে মহান আকবরের পরধর্মসহিষ্ণু নীতি অগ্ন ছিল।২১ তিনি সাধারণভাবে মন্দির নির্মাণের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি এবং ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেননি। তিনি সুফিবাদের চরম পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। আকবরের সঙ্গে তুলনা করলে শাহজাহানকে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে উচ্চে স্থান দিতে হয় আবার ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে তুলনা করলে, তাকে অনেক বেশি ধর্মীয় সহিষ্ণু বলে মনে হয়। এই সমস্ত দিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, শাহজাহান পরধর্ম-বিদ্বেষী ছিলেন না। দরবারের কট্টরবাদীদের গােষ্ঠী রাজনীতি থেকে নির্বাসনের উদ্দেশ্যে শাহজাহান ধর্মীয় কূটনীতি গ্রহণ করেছিলেন মাত্র।
এটা আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না যে, হিন্দু-রাজারা বুকের রক্ত দিয়ে শাহজাহানের সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া দারাশুকো যে মুঘল রাজত্বকালে সর্বধর্ম-সমন্বয়ের জন্য ‘দ্বিতীয় আকবর’ অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন, তাতে শাহজাহানের চরম পৃষ্ঠপােষকতা বা ধর্মীয় উদারতা না থাকলে দারাশুকোর পক্ষে মহান আকবরের ধর্মসহিষ্ণু নীতির প্রবত্তা হয়ে ওঠা সম্ভব হত না এবং শাহজাহানের সকল পুত্রদের চেয়ে তিনি পিতার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারতেন না। এমনকি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজেও শাহজাহানের পৃষ্ঠপােষকতা ছাড়া দারাশুকো ক্ষমতাশালী হতে পারতেন না। সমসাময়িক ঐতিহাসিকরাও শাহজাহান অ-মুসলমানদের প্রতি অন্যায় করেছেন বা উদাসীন ছিলেন এই অভিযােগ আরােপ করেননি। ইউরােপীয় পর্যটক মানুচি সম্রাট শাহজাহানের ন্যায় বিচারের প্রশংসা করেছেন।২২ ঐতিহাসিক কাফি খান লিখেছেন। “আকবর বিজেতা ও আইন প্রণেতা হলেও বিজিত অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থার প্রতিটি বিভাগের সুষ্ঠু বিন্যাসে ভারতবর্ষের এমন কোনাে শাসনকর্তা ছিলেন না যিনি শাহজাহানের সমতুল্য ছিলেন। যদিও ঈধরীপ্রসাদ শাহজাহানকে ‘ঔরঙ্গজেবের অগ্রদূত’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক আর পি ত্রিপাঠী তাঁর গ্রন্থে২৩ বলেছেন,
‘His reign by no means, an era of general religious persecution, bigotry and intolerance.’
ঐতিহাসিক এলফিনস্টোন শাহজাহানকে ‘ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা মহিমামণ্ডিত সম্রাট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. জন এফ রিচার্ডস্, দ্য মুঘল এম্পায়ার, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি, ১৯৯৩।
- ২. শ্রীরাম শর্মা, রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৪০( এশিয়া পাবলিশিং হাউস, ২য় সংস্করণ, বম্বে, ১৯৬২।
- ৩. আবদুল হামিদ খান লাহােরি, পাদশাহনামা, ইলিয়ট ও ডওসন অনূদিত, খণ্ড-১, লন্ডন, ১৮৬৭।
- ৪. আতাহার আলি, মুঘল সম্রাটদের ধর্মনীতি অন্তর্ভুক্ত ইরফান হাবিব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-২, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ৩য় সংস্করণ, ২০০৯, পৃ. ১৬২-৬৩।
- ৫. শ্রীরাম শর্মা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮২।
- ৬. মুহাম্মদ হাসিম খান ওরফে কাফি খান মুন্তাখাব-উল-লুবাব, ইলিয়ট ও ডওসন অনুদিত এবং ডব্লিউ হেগ সম্পাদিত, খণ্ড-১, পৃ. ৩৯৯-৪০০।
- ৭. শ্রীরাম শর্মা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯১।
- ৮. আবদুল হামিদ খান লাহােরি, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯।
- ৯. মুহাম্মদ হাসিম খান ওরফে কাফি খান, প্রাগুক্ত, খণ্ড-১, পৃ. ৫২২-২৩।
- ১০. আবদুল হামিদ খান লাহােরি, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ.১৩৩।
- ১১. শ্রীরাম শর্মা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯১।
- ১২. বি পি সাক্সেনা, হিস্টরি অফ শাহজাহান অফ দিল্লি, এলাহাবাদ, ২য় সংস্করণ, ১৯৭৬।
- ১৩. সতীশচন্দ্র লিখেছেন, “শাহজাহান সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন তার রাজত্বকালের ষষ্ঠ বর্ষে (১৬৩৩)। তিনি এক আদেশ জারি করে বলেছিলেন যে কোনাে মন্দির যার নির্মাণকার্য জাহাঙ্গিরের আমলে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি সেগুলাে আর নির্মাণ করা যাবে না। এই হিসাবে বেনারসের প্রায় ৭৬টি মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধের সময়েও বহু মন্দির ও গির্জা ধ্বংস করা হয়েছিল। বুন্দেলা বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে ওর্চায় বীর সিংহ দেও-এর একটি মন্দির ভেঙে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। পর্তুগিজদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় হুগলির একটি খ্রিস্টান গির্জা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তবে এটা মনে হয় না যে শাহজাহান নতুন করে কোনাে মন্দির নির্মাণ করতে না দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ১৬২৯ সালে তিনি আহমেদাবাদের প্রথম সারির জৈন অলংকার ব্যবসায়ী শান্তিদাসকে জৈন সন্তদের থাকার অন্য বিশ্রামাগার নির্মাণের জন্য জমি দান করেছিলেন। আহমেদাবাদে শান্তিদাস একটি সুন্দর জৈন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যার কোনােরকম বিরােধিতা করতে দেখা যায়নি মুঘল কর্তৃপরে তরফ থেকে। ১৬৫৪ সালে যখন গুজরাটের সুবেদার ছিলেন ঔরঙ্গজেব, তখন তিনি এই মন্দিরের ভিতরে নামাজ পড়ার জন্যে একটি ‘মিহরব’ (কুলুঙ্গি) তৈরি করে মন্দিরটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন। আসলে এই ঘটনা গুজরাটে ঔরঙ্গজেবের নতুন তৈরি মন্দির ভেঙে ফেলার কর্মসূচির একটা অংশ ছিল। তবে শান্তিদাস ও মােল্লা আবদুল হাকিম নামে এক বিদ্বজ্জনের মিলিত অভিযােগের ভিত্তিতে শাহাজাহান ওই মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষার্থে নব নির্মিত কুলুঙ্গি সরিয়ে শান্তিদাসকে পুনরায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দিয়েছিলেন। রাজকীয় ফরমান জারি করে বলা হয়েছিল যে এই মন্দিরের কোনাে জিনিস যদি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে তাহলে তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে আর যদি কিছু ক্ষতি হয় তাে তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া হবে। একই ভাবে জাহাঙ্গিরের আমলে মথুরায় নির্মিত বীর সিংহ দেও বুন্দেলার অপরূপ মন্দিরের ব্যাপারেও এসময় কোনাে হস্ত(েপ করা হয়নি। পাকিস্তানের প্রথম সারির ঐতিহাসিক আই.এইচ. কুরেশির মতে নতুন মন্দির নির্মাণে শাহজাহান যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন তা নিছকই প্রতীকী ছিল এবং এই উদ্যোগ কার্যত একটা নিয়ম ছিল যার কার্যকারিতা প্রায় ছিলই না…(এটি) এমন কোনাে প্রভাবশালী ঘােষণা ছিল না যা দেখে মনে হবে যে হিন্দুত্ববাদকে নির্মূল করার অভিসন্ধি ছিল, বরং রাষ্ট্রে ইসলামকে যে আবার প্রধান ধর্ম হিসাবে দেখা হচ্ছে তা বােঝানাের জন্য এসব করা হয়েছিল। এ সময় নির্মিত দিল্লির জামা সমজিদ ও আগ্রার তাজমহলের মতাে একাধিক চোখ ধাঁধানাে মসজিদ বা স্থাপত্য মুসলিম জন্নতের ধারণার বহিঃপ্রকাশ ছিল বলা যায় এবং তা সম্ভবত শাহজাহানের তরফ থেকে নেওয়া ইসলামের ক্ষমতা ও মহিমার প্রদর্শনের নীতির একটা অংশও ছিল। এ ধরনের মসজিদ নির্মাণ মুঘল আমলে নতুন কিছু ছিল না। এ সময় আগের মতােই বৃহত্তর সহিষ্ণুতার নীতিও বজায় ছিল যার প্রমাণ মেলে শাহজাহান কর্তৃক বৃন্দাবনে বৈষ্ণব মন্দির নির্মাণের জন্য জমি দানের স্বীকৃতি দেওয়ায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার একটি আদেশ যেখানে হিন্দুদের একাধিক পূজনীয় ঈশ্বর থাকার কারণে এবং পূজারিরা তাদের ধর্মমত ও উপাচার অনুসারে এই সকল ঈথরের আরাধনায় সদা ব্যস্ত থাকার জন্যে মন্দিরে ঘন্টা বাজানাে মঞ্জুর করা হয়েছিল। এটা আকবরের ‘সুলহ-ই-কুল’ নীতির যথার্থতা ছাড়া আর কি?” দেখুন-সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বাংলা অনুবাদ- সায়ন দে ও রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ৩০৯-১১।
- ১৪. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, দ্য ফাউন্ডেশান অফ মুসলিম (ল ইন ইন্ডিয়া, বাংলা অনুবাদ- অনিরুদ্ধ রায়, ভারতে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ২৭২।
- ১৫. ক্যানিংহাম রিপাের্টস, ২১ অধ্যায়, পৃ. ২৫, ৫৮-৫৯ ও ৭১-৭৯।
- ১৬. আবদুর রসিদ, সােসাইটি অ্যান্ড কালচার ইন মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, কলকাতা, ১৯৬৯।
- ১৭. দেখুন-মনােহর সিংহ রানাওয়াৎ, শাহজাহানের হিন্দু মনসবদার, হিন্দি সাহিত্য মন্দির, যােধপুর, ১৯৮৪।
- ১৮. মুহাম্মদ সালেহ কম্বু লাহােরি, আমল-ই-সালেহ, জি ইয়াজদানি সম্পাদিত, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, কলকাতা, ১৯২৩।
- ১৯. কেবলরাম, তাজকিরাৎ-উল-উমারা, পাণ্ডুলিপি, ব্রিটিশ মিউজিয়াম অতিরিক্ত সংগ্রহ, ১৬, ৭০৩।
- ২০. কাবিল খান সম্পাদিত, আদব-ই-আলমগীরী, লাহাের, ১৯৭১।
- ২১. সতীশচন্দ্র, মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, পাট-২, এন সি ই আর টি, দিল্লি, ১৯৯৭, পৃ. ২৫৬-৫৭।
- ২২. দেখুন-আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৩২১।
- ২৩. আর পি ত্রিপাঠি, রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার, এলাহাবাদ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৬০।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।