লিখেছেনঃ গোলাম আহমদ মোর্তাজা
১৮৭২ খৃষ্টাব্দে জন্মেছিলেন অরবিন্দ। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৫০ সালেজাত তাঁর ভক্ত ও অনুরক্তের অভাব নেই। আর সেইজন্যই বঙ্কিমের মত তাঁর নামের সঙ্গে ‘ঋষি’ যােগ করে তাঁকে ‘ঋষি অরবিন্দ’ বলা হয়ে থাকে।
ধর্মের দিক দিয়ে অরবিন্দ অত্যন্ত প্রাচীনপন্থী ছিলেন অর্থাৎ বঙ্কিমের মূল আদর্শের সঙ্গে তিনি একমত ছিলেন। খুলে বললে বলতে হয় হিন্দু জাগরণ, হিন্দু উন্নতিই ছিল তাঁর এবং তাঁর গ্রুপের মতাদর্শ। কিন্তু বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, রামমােহন প্রভৃতিনেতাদের সঙ্গে তাঁর একটা পার্থক্য ছিল— ইংরেজ শাসন ও ইংরেজ জাতিকে তিনি মােটেই সুনজরে দেখেননি বা তাদেরকে সমর্থন করেননি। এটা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত মানসিক ব্যাপার ছিল ইংরেজ বিতাড়নে তিনি বা তাঁর দল অস্ত্র ধারণ করেছিলেন এটাও ঐতিহাসিক সত্য। তাঁর এই মহান দিক তাঁকে আরও স্মরণীয় ও বরণীয় করতে যদি তাঁর জাগরণের আওতায় ক্লান্ত বিপ্লবী মুসলিম জাতির জন্য আহ্বান থাকতাে। ভুলক্রমে যদি তিনি মুসলমানদের না নিয়েই এগিয়ে চলার চেষ্টা করে থাকেন তাহলে তা অপরাধ না বলে অসাবধানতা বলে আচ্ছাদনের প্রলেপ প্রয়ােগ করা চলতাে কিন্তু যে পথ ও মত তিনি বা তাঁর দল গ্রহণ করেছিলেন তা মুসলমানদের পুরােপুরি নীতি-বিরােধী এবং মর্যাদা-বিরােধী বলে অনেকে মনে করেন। কে কী মনে করেন তার কোন একটা বেছে নেওয়ার দায়িত্ব পালন না করে বরং অরবিন্দের কাজ, কথা ও জীবনী জেনে বা পড়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ভােগ করা অধিকতর কার্যকরী।
সৌরেন্দ্রমােহন গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেনঃ “পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ধারার ভগীরথ লাল-বাল-পাল ও অরবিন্দ প্রমুখ জাতীয়তাবাদীরা ভক্তিবাদ, অবতারবাদ, লীলাবাদ, অলৌকিকত্ব প্রভৃতিতে বিশ্বাস করতেন। শক্তির বােধনকরে তাঁরা কালী, দুর্গা, ভবানী, বগলা প্রভৃতি দেবীর পূজা করতেন। শিবাজী ছিলেন তাঁদের আদর্শ। বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ ও দয়ানন্দ সরস্বতীর হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ চিন্তাকে অনেকাংশে ভিত্তি করে এই ধারা গড়ে ওঠে।” (দ্রঃ বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃ. ২৫৯)
সৌরেন্দ্রমােহন গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ৪৯৯ পৃষ্ঠার এই পুস্তকে নানা গ্রন্থের উদ্ধৃতি তুলে বইটিকে মজবুত করেছেন। তাতে তিনি আরও লিখেছেন—“পূর্বর্তন আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবাদকে তাঁরা হিন্দু পুনর্জাগরণে পরিমিশ্রিত করেন। পাঞ্জাব কেশরীলালা লাজপত রায় (১৮৫৬-১৯২৮) ছিলেন মুসলমান ও অহিন্দু ধর্মবিরােধী আর্যসমাজে দীক্ষিত। মহারাষ্ট্রে হিন্দু অতীতের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকরে লােকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক [১৮৫৭-১৯২০] গাণপতি ও শিবাজী উৎসবের (১৮৯৩-১৮৯৫) সঙ্গে গােরক্ষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধের উদ্ভাবক বিপিনচন্দ্র পাল হিন্দু জাতীয়তাবাদে পুরােপুরি উদ্বুদ্ধ না হলেও শ্রীকৃষ্ণকেই ভারতের অন্তরাত্মা মনে করতেন। লালা লাজপতের উপর বর্মায় অন্তরীণ আদেশ [১৯০৭] জারি হওয়ায় বিপিনচন্দ্র ত্রস্তচিত্তে সারাদেশে রক্ষাকালী পূজা ও শ্বেতছাগ বলির নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ পত্রিকার প্রচ্ছদে থাকত জগদ্ধাত্রীর ছবি। অন্যদিকে যুগান্তর পত্রিকার প্রচ্ছদে থাকত খড়্গসহ মা কালীর হাত। জনশক্তির বােধন ও শত্রু নিধনকল্পে বরােদায় অরবিন্দ বগলা মৃর্তি গড়িয়ে পূজা করেন (১৯০৩)। গুপ্তসমিতিতে নবাগত কর্মীদের তিনি এক হাতে গীতা এবং অপর হাতে তলােয়ার দিয়ে বিপ্লবের শপথ গ্রহণ করাতেন। লাল-বাল-পাল নামে অভিহিত এই তিনজন আর অরবিন্দ ঘােষ ছিলেন চরমপন্থী দলের প্রধান চার স্তম্ভ। এঁদের মধ্যে অরবিন্দ ছাড়া আর কেউ হিংসাত্মক বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন না।” [বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃ. ২৬৫]
এই উদ্ধৃতি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, কোন মুসলমানের পক্ষে ঐ পন্থায় শপথ নিয়ে ঐ মত সমর্থন করে ইংরেজ বিরােধী আন্দোলনে যােগ দেওয়া কত কঠিন ছিল। অথচ এ তথ্য চাপা পড়ে থাকলে মনে হবে মুসলমানরা ঐ সব গুপ্ত সমিতিতে ব্যাপকভাবে যােগ দেয়নি; সুতরাং স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমান জাতির কোন অবদান নেই। কিছু ভাল ভাল হিন্দু নেতা বা উপযুক্ত হিন্দুকর্মী তাতে যোেগ দিয়েছিলেন এইজন্য যে, তাঁরা বুঝেছিলেন লাঠি খেলা, তলােয়ার খেলা প্রভৃতি শরীরচর্চা নিশ্চয় শুভকর্ম, আর ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জনশক্তি সঞ্চয়ের প্রয়ােজনও আছে। কিন্তু মুসলমান তাতে যােগ দিতে পারে না এটা অনেকে বুঝতে পারলেও মৌনতা অবলম্বন করেছিলেন হয়ত বৃহৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে। কিন্তু যখন দেখা গেল যেখানে সেখানে ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ চলছে তখন অনেকেই বিবেকের তাড়নায় দল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। চিত্তরঞ্জন দাশ, প্রমথনাথ মিত্র, সরলা দেবী প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ পদত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। [দ্রঃ ঐ, পৃ. ২৬২]
‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’ এই দুটি তখন ছিল প্রধান সন্ত্রাসবাদী গুপ্তদল। ১৯০৯ সালে ইংরেজ সরকার এক এক করে ঐ সমস্ত দলকে নিষিদ্ধ করে। তখন ঐ সব দল থেকে বেরিয়ে আসা অনেক কর্মী কংগ্রেসে যােগ দেন। পরের দিকে গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলনের সময় এই দুটি বিপ্লবী দলের অনেক কর্মী ও নেতা কংগ্রেসের সদস্যপদ ও কর্মপন্থা গ্রহণ করেন। [সৌরেন্দ্রমােহনঃ পৃ.২৬২]
বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাই ছিল তাঁর (অরবিন্দের) প্রেরণার উৎস। আনন্দমঠের আদর্শে অরবিন্দ ভবানী মন্দির প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিলেন।” (ঐ, পৃ. ২৬৩]
তিনি কংগ্রেস বিরােধী ছিলেন। কংগ্রেস পার্টির জন্য তিনি আক্রমণমূলক কথা বলতেন। কংগ্রেসের কর্মপন্থাকে বলতেন Political Mandicancy বা রাজনৈতিক ভিক্ষুকতা এবং কংগ্রেসকে বলতেন, Unnational Congress অর্থাৎ অজাতীয় কংগ্রেস। অবশ্য এই কথাগুলাে অরবিন্দ বললেও তার পিছনে যুক্তি দেখাবার মত ক্ষমতা অরবিন্দের ছিল; যেটা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া সহজ ছিল না। তিনি বলেছিলেন, “A body like the Congress, which represents not the mass of the population, but a single and very limited class, could not honestly be called national.” —যার ভাবার্থ হল-কংগ্রেস অল্প কিছু সীমিত লােকের দল, তারা সর্বসাধারণের প্রতিনিধি নয়, তাদের সত্যকার জাতীয় দল বলা যায় না।
অরবিন্দ ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে ‘ভবানী মন্দির’ বই লেখেন। তাতে তিনি তাঁর এমন কর্মপন্থার বর্ণনা দেন যা মুসলমানদের নিরাশ করে। ১৯০৬-এ ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদক হয়ে যেভাবে লেখালেখি হয় তাতে মুসলিম মানস চমকে ওঠে। তার পূর্বেই গােরক্ষা আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, যা মুসলমানদের চিন্তিত করে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায় যে, মুসলমানদের হাত হতে গরুকে বাঁচাবার জন্য যে তােড়জোড় চলে, শাসক খৃষ্টানদের হাত হতে গােরক্ষার তেমন কোন তােড়জোড় করার ইতিহাস সহজলভ্য নয়। তারপরেই ১৯০৬-এ ‘মুসলিম লীগ’ নামে মুসলমান সংস্থার সৃষ্টি হয়। অবশ্য মুসলিম লীগের প্রকৃত জম্মদাতা জিন্নাহ না কতকগুলাে সংস্থা ও নেতৃবৃন্দের ভ্রান্ত পদক্ষেপ—তা বলতে গিয়ে ভাবতে বাধ্য হতে হয়।
বিরুদ্ধবাদীরা অরবিন্দের জন্য ডাকাতির অভিযােগ, মুসলমান বিদ্বেষের অভিযোগ যতােই তুলে ধরুন না কেন, তিনি যে ইংরেজ শাসনকে পুরােপুরিভাবে খতম করতে চেয়েছিলেন তাতে আদৌ সন্দেহ নেই।
সত্যের খাতিরে সত্যান্বেষীদের একথা ভােলা সম্ভব নয় যে, পৃথিবীর প্রত্যেক রাষ্ট্রের মুক্তি যােদ্ধারা লড়াই করেছেন, কারাবরণ করেছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন পথের ভিক্ষুক হয়ে গেছেন তবুও অন্যায়ের কাছে অসত্যের কাছে পরাধীনতার কাছে মাথাত করেননি, টার্গেট হতে মুখ ফিরিয়ে নেননি।
অরবিন্দ বােমা রিভলভার নিয়ে গুপ্তহত্যা ডাকাতি প্রভৃতি করতে গিয়ে অপরকে আঘাত দিয়েছেন সত্য কথা, তবে তাঁর নিজের কতটুকু আঘাত করার ক্ষমতা ছিল তাও বিচার্য বিষয়। সৌরেন্দ্রমােহন গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “অরবিন্দ রাজনৈতিক ডাকাতি ও গুপ্তহত্যা কর্মতৎপরতার অধিনায়রূপে অভিযুক্ত হয়ে বৎসরকাল (১৯০৮-০৯ বিচারাধীনে কারারুদ্ধ থাকেন। তাঁর এই কারাজীবন পরবর্তীকালের চিন্তাভাবনার দিক থেকে বিশেষ অর্থবহ” (ঐ, পৃ. ২৬৮)। অবশ্য বিচারে অরবিন্দ নিদোষী প্রমাণিত হন। কিন্তু জেলে একবছর ধরে তাঁর উপর প্রহার ও উৎপীড়ন চালানাে হয়। যখন তিনি জেল থেকে বেরিয়ে এলেন তখন দেখা গেল জেলের শাস্তি এবং বন্ধুবান্ধবদের অনাগ্রহের ফলে অরবিন্দের শাসক ইংরেজের বিরুদ্ধে যে মনােভাব ছিল তার পরিবর্তন হয়ে একটা ভাবান্তর ঘটেছে। শাসকের প্রহার বা হাতুড়ির আঘাতে বিপ্লবীর ধর্ম অনুযায়ী বিপ্লবের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার কথা, কিন্তু তিনি যা বললেন তা অনেক ভক্তের কাছে উল্টোই মনে হবেঃ “কর্তৃপক্ষের অত্যাচার ও উৎপীড়ন সম্পর্কে [অরবিন্দ বলেন যে, দমননীতি যেন ঈশ্বরের হাতুড়ি– যা দিয়ে পিটিয়ে তিনি আমাদের একটি শক্তিশালী নেশনে পরিণত করতে চান এবং আমাদের যন্ত্রস্বরূপ ব্যবহার করে বিশ্বকে পরিচালনা করাই তাঁর ইচ্ছা। তিনি আমাদের ধ্বংস চান না; ছাঁচে লােহা পেটানাের মতাে তিনি আমাদের নবরূপে সৃষ্টি করতে চান।…এইসময় অরবিন্দের উপর পুলিশের আবার বিষনজর পড়ে। প্রথমে কিছুদিন চন্দননগরে আত্মগােপন করে থেকে পরে সবার অলক্ষ্যে পণ্ডিচেরি চলে যান। তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের এইখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে। সেখানে তিনি গভীর যােগ সাধনায় নিমগ্ন হন.. [অরবিন্দ] বলেন যে, ভগবানই ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করবেন, আর যথাসময়েই স্বাধীনতা অর্জিত হবে, এখন সকলের কর্তব্য যােগস্থ হয়ে কাজ করা—ভগবানে আত্মসমর্পণ করাই হল যােগসাধনার প্রথম পদক্ষেপ। কারাগারে তিনি (দেবতা) বাসুদেবের এই মর্মেই ‘আদেশ’ পেয়েছিলেন।” [দ্রঃ সৌরেন্দ্রমােহন, পৃ. ২৬৮-৭০]
ইংরেজ শাসকদের এজেন্ট জমিদাররা কর আদায়ের নামে যে অত্যাচার করতেন তার ইতিহাস পড়লে চমকে যেতে হয়। ইংরেজ সরকারকে যেখানে তিনটি কোটি টাকা কর দিতে হােত সেখানে গরীব চাষীদের ও শ্রমিকদের কাছ থেকে আদায় করা হােত ১৮ কোটি টাকা। মনগড়া এমন কতগুলাে কর আদায় করা হােত যা জানাতেও লজ্জাবােধ হয়। তার সংখ্যা হবে ১৫ বা ততােধিক। যেমন টহরী, বিয়ের সেলামী, পূজাপার্বনী, জমিদার পুত্রদের স্কুল-খরচা, জমিদার পরিবারে তীর্থ খরচা, রসদ খরচা অর্থাৎ সাহেবরা এলে তাদের খাতির তােয়াজ করতে যে খরচা, ডাক খরচা, ভিক্ষা বা মাঙ্গন অর্থাৎ জমিদারের ঋণ শােধ করার জন্য কর, পুলিশ খরচা, ভােজ খরচা, সেলামী অর্থাৎ চাষী নতুন বাড়ি করলে তার দক্ষিণা, আয়কর, খারিজ, দাখিল, নজরানা প্রভৃতি। ডক্টর বদরুদ্দিন উমরের পুস্তকে এ তথ্য থাকলেও চিন্তাশীল লেখক রাধারমণ সাহার পাবনা জেলার ইতিহাস-এর ৯২ পৃষ্ঠা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। কর হাড়াও জমিদাররা ১৬ রকম শাস্তি দিতেন গরীব চাষী ও প্রজাদের। যেমন দণ্ডাঘাত বা বেত্রাঘাত, চর্মপাদুকা প্রহার, বাঁশ ও লাঠি দিয়ে বক্ষস্থল দল, খাপরা দিয়ে নাসিকা কৰ্শ মদন, মাটিতে নাসিকা ঘর্ষণ, পিঠে হাত বেঁধে বংশ দণ্ড দিয়ে মােড় দেওয়া, গায়ে বিচুটি পাতা দেওয়া, ধানের গােলায় পুরে রাখা, চুনের ঘরে বন্ধ করে রাখা, লৱরিচের ধোঁয়া দেওয়া ইত্যাদি। [দ্রঃ সাময়িক পত্রে বাংলা সমাজ চিত্র ও বিনয় ঘােষ, ২য় খণ্ড-৩৯, ১২৩]
এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মুসলমান প্রধান চাষীসমাজ বা শােষিত সমাজ আগ্নেয়গিরির মত বিস্ফোরিত হয়ে জমিদারদের উপর আক্রমণ করে। তখন সমস্ত বাংলা সংবাদপত্রগুলাে হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের হাতেই ছিল। তার আগে মুসলমান উচ্চবিত্ত শ্রেণী খতম হয়ে গেছে। সুতরাং রটিয়ে দেওয়া হােল যে, এটা হিন্দু-মুসলমানের লড়াই। সেই সময় সন্ত্রাসবাদীদের বিখ্যাত নায়ক যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তা অতীব দুঃখের—“কলকাতার যুগান্তর দলের প্রধান স্বয়ং অরবিন্দ ঘােষ কলকাতা হতেই ইন্দ্রনাথ নন্দী, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, সুধীর সরকার প্রভৃতি ৬ জন যুবক বােমা, পিতল বা রিভলবার নিয়ে ময়মনসিংহে হিন্দুদের রক্ষার জন্য জামালপুর গমন করে। এই ৬ জন এসে বােমা ও পিস্তল দিয়ে কৃষকদের ঘায়েল করে।” বলা বাহুল্য, উল্লিখিত ৬ জন সন্ত্রাঘাদীকে অরবিন্দ ঘােষই পাঠিয়েছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে ঋষি অরবিন্দ নামে খ্যাতি অর্জন করেন। [পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীলবিদ্রোহ পৃ. ৩৭; সুপ্রকাশ রায় : ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ২৮৮-৮৯]
কিন্তু ওটা যে সাম্প্রদায়িক লড়াই ছিল না, ওটা যে শুধুমাত্র শােষিত ও শােষকেরলড়াই ছিল তা বিপেক্ষ বিচারে স্বীকৃত। সুপ্রকাশ রায়ের ভাষায়—“বাংলাদেশের সেকালের যুগান্তর সমিতির সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীনায়কগণ তাঁহাদের চিন্তাধারাও আজন্ম পালিত সংস্কার অনুযায়ী ১৯০৭ খৃষ্টাব্দের জামালপুরের ঘটনার যে বিকৃত ব্যাখ্যাই করিয়া থাকুন না কেন, এই ঘটনাটি শ্রেণীসংগ্রামের একটি বিক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত ব্যঞ্জত, জমিদার মহাজন বিরােধী সংগ্রাম ব্যতীত অন্য কিছু নয়।” [সূপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ২৯০]
তাহলে বােঝা গেল, অরবিন্দের ইংরেজ বিরােধী মনােভাব থাকা সত্ত্বেও ইংরেজদের এজেন্টদের সাহায্য ও সহযােগিতা বিষয়ে তাঁর পদক্ষেপ যে সঠিক হয়েছিল, তা তাঁর ভক্তদের পক্ষেও বলা মুশকিল। স্বদেশী আন্দোলনের নাম করে এই সন্ত্রাসবাদী দল যখন মুসলমানদের ডেকেছিল তখন আপামর মুসলিম জনসাধারণ সাড়া যে কেন দেয়নি তা সহজেই অনুমেয়।
আইনবিদ বিমলানন্দ বাবু লিখেছেন, “মুসলমানরা যখন রাজনীতিতে ‘ইনসাল্লা’ ঢােকালেন, তখন আমরা খুব চটেছিলাম। কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমাদের ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র দেবী দুর্গাকে দেশজননীর বাহ্যিক রূপ বলে প্রচার করে গেছেন এবং অরবিন্দ, তিলক, বিপিন পাল প্রভৃতি সকল নেতাই বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শের পূজারী ছিলেন। অরবিন্দ ও অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের উদগাতা ছিলেন, তারই সমর্থনে সাহিত্যিক গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী লিখেছেনঃ ‘আমরা দেখিয়াছি দেখিতেছি অরবিন্দ এই বঙ্কিম প্রদর্শিত জাতীয়তাকেই সজ্ঞানে ১৮৯৪, খৃষ্টাব্দ হইতেই অনুসরণ করিতেছেন। ব্রাহ্মসমাজের অথবা মুসলমানের তিনি ধার ধারেননা। কি এক পায়ে দাঁড়াইয়া বগলা মন্ত্র যপ বা বগলামূর্তি পূজা শেষ করিয়া আসিয়াছেন। গুপ্ত সমিতিতে মাকালীও আছেন এবং শ্রীগীতাও আছে। এতে মুসলমান ভ্রাতাগণ যদি বলেন—এ ব্যবস্থায় দেশ উদ্ধারের জন্য আমরা যাই ই বা কি করিয়া, আর থাকিই বা কোন্ মুখে? আমাদের একটা পৃথক ধর্ম ও তার অনুশাসন আছে’—এ কথার জবাব ত চরমপন্থীদের ঐ গুপ্ত সমিতির দেওয়াই কর্তব্য। ..হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাই অরবিন্দের জাতীয়তা, কংগ্রেসী জাতীয়তা তাঁহার জাতীয়তা নহে, বরং জাতীয়তার বিপরীত বস্তু। বঙ্কিম-অরবিন্দ-বিপিন পাল এবং তাঁদের উত্তরসূরী বিপ্লববাদীরা বাংলায় এবং তিলকও তাঁর উত্তরসূরী মহারাষ্ট্র ও উত্তর ভারতে যে জাতীয়তার আমদানী করলেন, তা ছিল নিছক হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ। মুসলমানগণ স্বভাবতই এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি হতে ১৯০৫ হতে শুধু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন তা নয়—তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় বিষে বিষাক্ত রাজনীতির উম্মেষ হােল।” (শ্রীবিমলানন্দ শাসমল : ভারত কী করে ভাগ হলাে, পৃ. ২৩-২৪]
তাহলে আইনজীবী বিমলানন্দবাবু প্রামাণ্য তথ্য দিয়ে বােঝালেন যে, ১৯০৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত হিন্দুদের উৎকট সাম্প্রদায়িকতা এবং মুসলমানদের দূরে ঠেলে পৃথক রেখে দেবার জন্য তাঁরাই দায়ী। আর এইজন্যই বােধ হয় ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে মুসলিম লীগ জন্ম নিতে বাধ্য হয়েছিল। শ্রীবিমলানন্দ বাবুও লিখেছেন—“১৯০৬ সালের সুরাট কংগ্রেসে যখন তিলক-অরবিন্দ প্রভৃতি চরমপন্থী নেতারা নরমপন্থীদের অপসারিত করে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানটিকে দখল করলেন, তখন স্বভাবতই এঁদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কংগ্রেসকেও প্রভাবিত লাে। ১৯০৬ সালেই কংগ্রেস সাধারণভাবেই হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ালাে। এবং তারই প্রতিযােগী হিসাবে দাঁড়ালাে (ঐ সালেই) নব প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ।” তাহলে মুসলিম লীগের জন্মদাতা কে বা কারা তা যেভাবেই শেখানাে হােক না কেন, আসল ইতিহাস যে দেশের ছাত্র ও জনসাধারণকে আসল শিক্ষা দেবে তাতে সন্দেহ নেই।