আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে? বহু আলােচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন’ অধিনায়ক জয় হে’ গানটি ভারতের জাতীয় সঙ্গীতরূপে গৃহীত হয়েছে। জাতীয় সঙ্গীত স্থির করবার জন্য দুটি প্রসিদ্ধ গানকে কেন্দ্র করে বহুকাল বিতর্ক দেখা যায়— একটি হল বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম’, অপরটি হল রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ । দুটি গানই জাতীয় সঙ্গীতরূপে মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত কারণ উভয় গানই জনগণের মধ্যে স্বাজাত্যবােধ ও স্বদেশপ্রেম সঞ্চারিত করে।
তবে এই দুটি গান ছাড়াও দেশমাতার বন্দনামূলক অনেক কবিতা ও গান দেখতে পাওয়া যায়। ডিরােজিও ও কাশীপ্রসাদ ঘােষ ইংরেজি কবিতায় দেশমাতার বন্দনা করেছিলেন। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মধুসূদন ছন্দে জন্মভূমির প্রশস্তি করেছিলেন। তখনকার দিনে অধিকাংশ স্বদেশপ্রীতিমূলক সঙ্গীতে অবশ্য দেশমাতার বন্দনার সঙ্গে শাসকশ্রেণির স্তুতি করা হত এবং এই সমস্ত গান সাধারণত ভারত বিলাপে রূপান্তরিত হত। তবে সে যুগের অন্যান্য দেশমহিমামূলক গানের সঙ্গে জাতীয় মেলা উপলক্ষ্যে রচিত সঙ্গীতগুলির একটি প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার স্বদেশানুরাগী কয়েকজন ব্যক্তির প্রচেষ্টায় সাধারণের মধ্যে স্বাজাত্যবােধের উন্মেষ সাধন ও স্বদেশের উন্নতির জন্য জাতীয় মেলা বা ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতীয় জীবনে জাতীয় মেলার অন্যতম প্রভাব হল জাতীয় সঙ্গীতের উৎপত্তি। ছন্দ ও সুরে দেশমাতৃকার প্রশস্তি শুরু হয় জাতীয় মেলা হতেই। ১৮৬৮ সালে জাতীয় মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “মিলে সবে ভারত সন্তান, একতান মনপ্রাণ গাও ভারতের যশােগান” গানটি পরিবেশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এই গানটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। জাতীয় মেলার ঐ অধিবেশনে গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘লজ্জায় ভারত যশ গাইব কি করে’ এই গানটিও গীত হয়। জাতীয় মেলার বিভিন্ন অধিবেশনে এই ধরণের বহু দেশাত্মবােধক সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। বঙ্গদেশে পরবর্তীকালে আরও অনেক জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়। বঙ্গদেশে জাতীয় সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে ‘হিন্দুমেলা’ যে গভীর প্রেরণা জুগিয়েছিল তা অনস্বীকার্য।
এই প্রসঙ্গে সরলাদেবী চৌধুরাণীকৃত ‘হিন্দুস্থান’ গানটিও স্মরণীয়। এই বিখ্যাত গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল ১৯০১ সালে কলকাতা বিডন স্কোয়ারে কংগ্রেসের সপ্তদশ অধিবেশনে। এই অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় মহাসভায় পুনঃ পুনঃ গীত এই গানটির প্রথম কয়েক লাইন উদ্ধৃত করছি—
অতীত-গৌরব-বাহিনি মম বাণি, গাহ আজি হিন্দুস্থান।
মহাসভা-উন্মাদিনি মম বাণি, গাহ আজি হিন্দুস্থান।
কর বিক্রম-বিভব-যশ-সৌরভ-পূরিত সেই নাম গান;
বঙ্গবিহার-উৎকলমান্দ্রাজ-মারাঠাগুর্জর-পাঞ্জাবরাজপুতান।
হিন্দু পার্সি জৈন ইসাই শিখ মুসলমান,
গাও সকলকণ্ঠে সকলভাবে—নমাে হিন্দুস্থান,
জয় জয় জয় হিন্দুস্থান, নমাে হিন্দুস্থান।
ভেদরিপু-বিনাশিনি মম বাণি, গাহ আজি ঐক্যগান।
মহাবল-বিধায়িনি মম বাণি, গাহ আজি ঐক্যগান।
বঙ্গবিহার-উৎকলমান্দ্রাজ…
ইত্যাদি এই গানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত ও সম্প্রদায়ের উল্লেখের মধ্যে চিন্তা ও আদর্শগত ঐক্য সুস্পষ্ট।
এর পর এল সেই ১৯০৫ সাল। সেটা ছিল প্রবল প্রতিবাদের যুগ। বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে বিভেদ ঘটানাের চক্রান্ত আইন করে বাস্তবায়িত করা হল। শাসনকাজে সুবিধার ধুয়াে তুলে ১৯ শতকের শেষ থেকেই বাংলা-বিহার-ওড়িশা-অসম নিয়ে গঠিত বড় প্রদেশকে ভাগ করার কথা চলছিল। অসম, বিহার ও ওড়িশাকে পর্যায়ক্রমে স্বতন্ত্র করে আলাদা শাসিত প্রদেশ তৈরি করার বিরুদ্ধে কোনও কথা ওঠেনি। সেই সুযােগে বাংলার পূর্ব আর পশ্চিম অংশকে আলাদা করে দুটি আলাদা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হল। ১৯০৫এর বাংলা ভাগের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই অনেক প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। সেই সব প্রামাণ্য কাজ নিয়ে আলােচনার ক্ষেত্র এটা নয়। বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ২৬টি দেশাত্মবােধক গান রচনা করলেন। সেই গানগুলি তখন বাঙালি জাতিকে আলােড়িত করেছিল। সুরে ও কথায় অনবদ্য সেই গানগুলি বাঙালির প্রাণে আজও সাড়া জাগায়। তার মধ্যে একটি গান ছিল আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি। স্বদেশি আন্দোলন তখন প্রবলভাবে দানা বেঁধে উঠছিল। স্বদেশি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিদেশি শাসকের দমনমূলক অত্যাচারও মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। সেইসময় সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনেক দেশপ্রেমিক গান রচনা করলেন। অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের মুখােমুখি দাঁড়ানাে নির্ভীক নিরস্ত্র কিশাের-তরুণদের জন্য রচিত হয়েছিল : ‘আমায় বেত মেরে কি মা ভুলাবে আমি কি মার সেই ছেলে’। স্বদেশি আন্দোলনের আবেগে রচিত কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের এই গানটির মতাে স্বদেশমাতার গৌরব নিয়ে, বিদেশি জিনিস বর্জন করার আহ্বান জানিয়ে গান রচনা করলেন রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখ। ওই সময়ের স্বদেশি গানের একটা সঙ্কলন ১৯০৬ সালে যােগীন্দ্রনাথ সরকার প্রকাশ করেছিলেন।
আজকের স্বাধীন ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ অধিনায়ক জয় হে’ গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ইংরেজ সরকারের বাংলা ভাগ রদ (১২ ডিসেম্বর ১৯১১) করে বাংলা ভাষাভাষীর জন্য একটি অখণ্ড প্রদেশকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার পরে। এই হিসেবে ২০১১-এ রবীন্দ্রনাথের জনগণমন অধিনায়ক সঙ্গীতের একশ বছর পূর্ণ হল।
১৯১১ সালের ২৬-২৮ ডিসেম্বর কংগ্রেসের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশন বসেছিল উত্তর কলকাতার গ্রিয়ার পার্কে, এখন যেটির নাম সাধনা সরকার উদ্যান। ২৬ ডিসেম্বর যথারীতি বন্দেমাতরম উদ্বোধনী সঙ্গীতে সভা শুরু হল। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৭ ডিসেম্বর বেলা বারােটায় অধিবেশন বসল। শুরুতেই সরলা দেবীচৌধুরাণীর নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়েছিল ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’। কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন অমল হােম, চিত্রলেখা সিদ্ধান্ত প্রমুখগণ। এই প্রথম কোনও প্রকাশ্য সভায় এই ঐতিহাসিক গানের আবির্ভাব ঘটল। সেই থেকে গানটির জনপ্রিয়তা শুরু হয়েছিল। এই সময় থেকেই দেশাত্মবােধক সঙ্গীত রূপেই এটি প্রাধান্য পায়। গানটির ইতিহাস বেশ রহস্যময়। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না— কোথায় বা কবে রচিত হয়েছিল তার কোনও হদিশও পাওয়া যায় না। পরের দিন (২৮ ডিসেম্বর) গানটির খবর বেরােয় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকায়— সেখানে গানটির ইংরেজি অনুবাদও করে দেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় দিনের সভায় দুটি গান গাওয়া হয়—প্রথমে ‘জনগণমন’ অধিনায়ক জয় হে’ ও পরে একটি হিন্দি গান—সেটি সম্রাটের প্রশস্তি ছাড়া আর কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। এই গানটির প্রতিবেদন ‘দ্য ইংলিশম্যান, দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ও রয়টারের। টেলিগ্রামে এমনভাবে করা হয় যে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের গানটিই বুঝি রাজপ্রশস্তি উপলক্ষে রচিত হয়েছিল। এ নিয়ে সে সময়কার রবীন্দ্র-বিরােধী ও রবীন্দ্র-সমর্থকদের মধ্যে এমন বাদানুবাদ হয় যে তর্কটি আজ পর্যন্ত জীবন্ত রয়ে গিয়েছে—এখনও কেউ কেউ মনে করেন যে, ‘জনগণমন’ অধিনায়ক জয় হে’ গানটি আসলে লিখিত হয়েছিল সম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রশস্তি হিসাবেই, এমনকী দিল্লির দরবারেও এই গানটি গাওয়া হয়েছিল। কথাটি সর্বৈব ভুল, দিল্লি দরবারে এ গান কখনওই গাওয়া হয়নি।
‘তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় বাংলা ১৩১৮ সনের মাঘ মাসে (জানুয়ারি ১৯১১) বাংলা গানটি ‘ভারত বিধাতা’ শিরােনামে প্রকাশিত হয়, গানটির পরিচয় দেওয়া হয় ব্রহ্মসঙ্গীত বলে; এই বছরের মাঘােৎসবেও (১৯১২-র ২৫ জানুয়ারি) গানটি ব্রহ্মসঙ্গীত হিসেবেই গীত হয়। ব্রহ্মসঙ্গীত বিভাগের অষ্টম অধ্যায়ে ১৩২৭ সংখ্যক গান হিসেবে ‘জনগণমন’ গানটি লিপিবদ্ধ করা হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সেদিন শুধু গানটি গাননি, গানের শেষে ‘জনগণমন’ -র উদ্দেশ্য এবং স্পিরিট কি এই বিষয়ে বলেন, “আমাদের যাহা কিছু আছে সমস্তই পণ করিয়া ভূমার পথে নিখিল মানবের বিজয় যাত্রায় যেন সম্পূর্ণ নির্ভয়ে যােগ দিতে পারি। জয় জয় জয় হে বিশ্বেশ্বর, মানব ভাগ্যবিধাতা।”
‘জনগণমন’ -অধিনায়ক’ গানটি প্রসঙ্গে অপপ্রচার যে দ্রুত কতদূর বিস্তৃত হয়েছিল তার প্রমাণ ১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকান কবি এজরা পাউণ্ড লণ্ডন থেকে তার পিতা হােমার এল. পাউণ্ডকে এক পত্রে (The selected Letters of Ezra Pound, ed. by D.D. Paige, 1971, P.-14) F-16376301: “There is a charming tale of the last durber anent R.T. one Bengali here in London was wailing to W.B.Y. “How can one speak of patriotism of Bengal when our greatest poet has written this ode to the King?’ And Yeats taxing one of Rabindranath’s students alicited this response. Ah! I will tell you about that poem. The national committee came to Mr. Tagore and asked him to write something for the reception. And as you know Mr. Tagore is very obliging and all that afternoon he tried to write them a poem, and he could not. And that evening the poet as usual retired to his meditation. And in the morning he descended with a sheer of paper. He said, “Here is a poem I have written. It is addressed to the deity. But you may give to the national committee. Perhaps it will content them.’
The joke, which is worthy of Voltaire, is for private consumption only, as it might be constrained politically if it were printed.”
কংগ্রেসের ওই ২৬তম বার্ষিক অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে কোনাে তথ্য জানা যায় না। তবে জানকীনাথ ঘােষালের সভাপতিত্বে অভ্যর্থনা সমিতির যে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তার অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অভ্যর্থনা সমিতির অন্যতম সম্পাদক ডাঃ নীলরতন সরকারের সহকারী জ্ঞানাঞ্জন নিয়ােগী হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড’ পত্রিকায় ১৯৪৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ডাক্তার নীলরতনের নির্দেশে তিনিই রবীন্দ্রনাথের কাছে থেকে গানটি (‘জনগণমন’) এনে তাকে দেন। কংগ্রেসে গীত হবার পূর্বে ডাক্তার নীলরতনের হ্যারিসন রােডের বাসভবনেই গানটির রিহারস্যাল হয়। গায়কদের অন্যতম অমল হােম জানিয়েছেন, দিনেন্দ্রনাথ তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সম্রাট হিসাবে পঞ্চম জর্জের অভিষেক হয় ২২ জুন ১৯১১ তারিখে। এর অব্যবহিত পরেই সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী ভারতবর্ষে আসেন; দিল্লির দরবারে (১২ ডিসেম্বর ১৯১১) তিনি ভারতবর্ষের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সংবাদ সরকারিভাবে ঘােষণা করেন। প্রথম সংবাদটি হল, ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে; দ্বিতীয় সংবাদটি হল, বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব রদ হয়ে গেল। এর পর সম্রাট নেপালে যান শিকার করতে, সেখানে ১০ দিনে ২১টি বাঘ, ৮টি গণ্ডার এবং একটি ভাল্লুককে হত্যা করেন।
কলকাতায় তার সম্মানে সভা অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারি ১৯১২ তারিখে, বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব রদ করবার জন্য তার উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জানানাে হয়। এই অনুষ্ঠানে রাজদম্পতির মাথায় ছাতা ধরে থাকার পুণ্যকর্মটি করেছিলেন নাইট’ ও ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির জমিদার প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর এবং নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়।
এই সময়ে কংগ্রেসের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘জনগণমন’ গানটি দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে গাওয়া হল ১৯১৭ সালে, তৃতীয় দিনের (২৯ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠান আরম্ভ হল এই গান দিয়ে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বক্তৃতায় মেলে উচ্ছ্বসিত স্বীকৃতি : “Brother delegates, at the very outset I desire to refer to the song to which you have just listened. It is a song of the glory and victory of India” গানটির পরিবেশন বিবরণী মেলে ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকায় : “The congress chorus then chanted the magnificent song of sir Rabindranath Tagore, Jana-GanaMana, Maharaja Bahadur of Natore himself joining in aid of the instrumental music.”১ পরদিন অমৃতবাজার পত্রিকাতেও২ সেই একই সমর্থন : ‘The Indian National Congress sat to-day at 11-30 A.M., the proceedings commencing with an inspiring patriotic song of Rabindranath’s sung as usual in chorus, the Mabaraja ofNatore joining in the instrumental music.” ‘দ্য স্টেটসম্যান’ও ৩০ ডিসেম্বর ১৯১৭তে লিখেছিল : A national song composed by Sri Rabindranath Tagore having been sung the following resolution was moved.”
কৌতুকের বিষয় হল, ১৯১১ সালের প্রতিবেদনে ‘স্টেটসম্যান’ এই গানটিকে বলেছিল সম্রাটের প্রশস্তিমূলক গান; আর এবার দেখা গেল, সেই ‘স্টেটসম্যান’ই ১৯১৭ সালে গানটিকে অভিহিত করেছে ‘দেশপ্রেমের গান’ বলে। সুতরাং ১৯১১ সালে গানটি যদি রাজবন্দনারূপে রচিত ও গীত হত তাহলে ১৯১৭ সালে ওটি কংগ্রেসের অধিবেশনে গীত ও সর্বসম্মতিক্রমে দেশভক্তির গান বলে স্বীকৃত ও বর্ণিত হতে পারত না।
হ্যাঁ, ব্রিটিশ পত্রিকাগুলি ও সমালােচকরা কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন কংগ্রেসের ওই অধিবেশনে গীত হিন্দিকবি রামভূজ দত্ত চৌধুরির (সরলা দেবীচৌধুরাণীর স্বামী) একটি হিন্দি গানের কথা। কংগ্রেস সেই সময়ে ছিল আবেদনমূলক নীতিতে বিশ্বাসী, নরমপন্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই নরমপন্থী কংগ্রেস সম্রাট পঞ্চম জর্জকে স্বাগত জানিয়ে সম্রাটের প্রশস্তিমূলক উক্ত হিন্দিকবির ‘যুগ জীবে মেরা পাদশা’ গানটি গীত হয়। চিত্রলেখা সিদ্ধান্ত লিখেছেন, “আমিও একজন ‘লিভিং উইটনেস’ ১৯১১ সালের কংগ্রেসের। গানের দলে আমি ছিলাম। একটি রাজবন্দনাও গেয়েছিলাম। কিন্তু সে গানটি রচনা করেছিলেন সরলাদেবীর স্বামী রামভুজ দত্ত চৌধুরী। তার প্রথম লাইন যুগ জীবে, মেরা পাদশা, চহু দিশ রাজ সবায়া’। সবকথা মনে নেই, কিন্তু সুরটি কানে রয়েছে।” (রবীন্দ্রসদনে রক্ষিত শ্ৰীযুক্ত চিত্রলেখা সিদ্ধান্তের একখানি পত্র) রবীন্দ্রনাথের কাছে নিরাশ হবার পর গানটি তার রাজভক্ত বন্ধু-প্রমুখ নরমপন্থী নেতাদের নৈরাশ্য মােচন করেছিল, এই হিন্দি প্রশস্তিটিই হচ্ছে সেই গান। সূচনা সঙ্গীতের পর প্রস্তাব, তারপর সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে ওই গানটি গাওয়া হয়েছিল। অথচ সেই বন্দনাগীতির দায় রবীন্দ্রনাথের উপর চাপিয়ে দিল ইংল্যাণ্ডের ‘ইণ্ডিয়া’, ‘দ্য স্টেটসম্যান’ ও ‘দ্য ইংলিশম্যান’ প্রভৃতি পত্রিকা। কৌশলে লিখল ওই প্রতিবেদন। কেননা, রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে সম্রাট বন্দনা করাতে পারলে সম্রাটের মহিমা বাড়ে। ওই সময় অমৃতবাজার পত্রিকা এবং ‘দ্য বেঙ্গলি’ লেখে প্রকৃত সত্য, বাদশা বন্দনার গান কে গেয়েছিলেন সেই কথা।
কালানুক্রমিক ইতিহাস ঘেঁটে প্রবােধচন্দ্র সেন তাঁর গ্রন্থে৩ বহু তথ্য তুলে ধরে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, এই অপপ্রচারের কারণ ওই ইংরেজি পত্রিকাগুলি। পরে আশীষ নন্দীও বহু ঐতিহাসিক দলিল ব্যবহার করে এই বহু প্রচারিত ভ্রান্তি সম্পূর্ণভাবে খণ্ডন করেছেন।৪ প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক জাতীয় কংগ্রেসের রিপাের্ট। ২৬তম কংগ্রেসের সরকারি রিপাের্টে মুদ্রিত ছিল, ‘অধিবেশন শুরু হয়েছিল বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরারােপিত একটি দেশাত্মবােধক গান দিয়ে। গানটির পর ব্রিটিশ রাজকে অভ্যর্থনা করে তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি হিন্দি গান গীত হয়। অর্থাৎ দুটি পৃথক গানের কথা সুনির্দিষ্টভাবেই উল্লেখ ছিল কংগ্রেসের সেই রিপাের্টে। একটি দেশাত্মবােধক এবং অন্যটি সম্রাটের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হিন্দি গান।
২৮ ডিসেম্বর ১৯১১ তারিখের ইংরেজি ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকাতেও তেমনই উল্লেখ ছিল। পত্রিকাটিতে লেখা হয়: “The proceedings began with the singing of a Bengali song of benediction… This (the loyalty resolution was followed by another song in honour of their Imperial Majesties visit to India.” একই দিনের ‘দ্য বেঙ্গলি’ সংবাদপত্রে দুটি পৃথক story Poh Toni 61604: “The proceedings commenced with a patriotic song composed by Babu Rabindranath Tagore, the leading poet of Bengal (Janaganamana Adhinayaka), of which we give the English translation…then (after the passing of the loyalty resolution) a Hindi song paying heartfelt homage to their Imperial Majesties was sung by the Bengali boys and girls in chorus.”৫ অর্থাৎ কংগ্রেসের ওই দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে সমবেত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানটি উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে গীত হবার পর রাজদম্পতিকে স্বাগত জানিয়ে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘােষণা করার জন্য পঞ্চম জর্জের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন-সূচক দুটি প্রস্তাব আলােচিত ও গৃহীত হয় এবং তার পরে বাঙালি বালক বালিকারা রাজদম্পতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের উদ্দেশ্যে রচিত হিন্দি গানটি সমবেত কণ্ঠে গায়।
২ জানুয়ারি ১৯১২ ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় কংগ্রেস-প্রতিনিধিদের একটি স্টীমার পার্টির বর্ণনা আছে। ওই উপলক্ষে ‘বন্দেমাতরম’, ‘মিলে সব ভারতসন্তান প্রভৃতি দেশভক্তির গানের সঙ্গে উক্ত রাজভক্তির গানটিও গাওয়া হয়েছিল : ‘First there was Bande Maharm, then Miley sob varat santan…the chorus under the able leadership of Mrs. Dutt Choudhury sang the loyal song ‘Jug jibey mere padsa’…Mrs. Dutt Choudhury gave another song. The words were new—at least they seemed to be so, but they were redolent of deep Pathos and patriotism.’
এবারে দেখা যাক, অ্যাংলাে ইণ্ডিয়ান পত্রিকাগুলিতে কী ধরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘দ্য ইংলিশম্যান’ পত্রিকার সংবাদে লেখা হয়, “The proceedings opened with song of welcome to the King Emperor, specially composed for the occasion by Babu Rabindranath Tagore…”৬ ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকাতে একই কথা বলা হয় :“The Proceedings commenced shortly before 12 O’clock with a Bengali song… The choir of girls led by Sarala Devi then (after the loyalty resolution) sang a hymn of welcome to the king specially composed for the occasion by Babu Rabindranath Tagore, the Bengali poet.”৭
‘রয়টার’ পরিবেশিত সংবাদে (When the Indian National Congress resumed its session on Wednesday, December 27, a Bengali song specially composed in honour of the royal visit was sung and a resolution welcoming the King Emperor and Queen Empress was adopted unanimously.’) একই ভুল পরিবেশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের অন্য প্রদেশের সংবাদপত্রগুলিতেও। এমনকী ইংল্যাণ্ডের ‘ইণ্ডিয়া’ পত্রিকাতেও ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের পুনরাবৃত্তি ঘটে। ইণ্ডিয়া’ পত্রিকাতে বলা হয় : “When the proceedings of the Indian National Congress began on Wednessday 27th December 1911, a Bengali song in welcome of the Emperor was sung. A resolution welcoming the Emperor and Empress was also adopted unanimously.৮ এভাবেই সুকৌশলে রবীন্দ্রনাথকে একজন ব্রিটিশভক্ত। রাজকবি বলে চিহ্নিত করা হল। আসলে বিষয়টির প্রতি কোনওরকম গুরুত্ব না দিয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত ও সম্রাটের উদ্দেশ্যে নিবেদিত সঙ্গীতকে তারা এক করে ফেলেন। দেখা যাচ্ছে, এই বিভ্রান্তিমূলক প্রচারের জন্যে পূর্বোক্ত তিনটিপত্রিকাই মূলত দায়ী। রবীন্দ্রনাথের কাছের কয়েকজন ব্যক্তি কবিকে এই ভুল সংবাদের কথা বলতে উনি মাঘােৎসবের সময় (২৫ জানুয়ারী ১২১২) গানটির বিষয়ে ওই নাতিদীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন।
মাঘােৎসবের পরের দিনই অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি ১৯১২ ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টরের নিম্নলিখিত গােপন সারকুলারটি প্রকাশিত হয়— “It has come to my knowledge that an institution known as the “Santiniketan’or Brahmacharyasrama at Bolpur in the Birbhum district of Bengal is a place “altogether unsuitable for the education of the sons of Government servants’. As I have information that some Government servants in this province have sent their children there, I think it necessary to ask you to warn any well disposed Government servant whom you may know or believe to have sons at this institution or to be about to send sons to it, to withdraw them or refrain from sending them, as the case may be; ‘any connection with the institution in question is likely to prejudice the future of the boys who remain pupils of its after the issue of the present warning.”
মনে রাখা প্রয়ােজন, কংগ্রেসে ‘জনগণমন -অধিনায়ক’ গানটি গাওয়া হয় ডিসেম্বর মাসে এবং পরের জানুয়ারি মাসেই (তখনই বিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি হবার সময়) এ সারকুলারটি প্রচারিত হয়। আমাদের পক্ষে প্রাসঙ্গিক বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথ যদি সত্যই রাজার স্তাবকের ভূমিকায় নেমে যেতেন তাহলে এরকম সরকারি সারকুলারের প্রয়ােজনই হত।
রবীন্দ্রনাথ এসব ভ্রান্ত বিবরণের প্রতিবাদ করেছিলেন এমন কোনাে নিদর্শন পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তৎকালেও তিনি স্টেটম্যান’ ও ‘ইংলিশম্যান’ প্রভৃতির মূঢ়তার প্রতিবাদ করাকে আত্মাবমাননা বলেই মনে করতেন। তাছাড়া, ইঙ্গ-ভারতীয় কাগজগুলির বিবরণ তার লক্ষগােচর নাও হয়ে থাকতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যে, কোনাে মিথ্যা রটনার প্রতিবাদ না হলেই তা সত্য হয় না।
যাই হােক, ১৯১৭ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে গীত হবার পর ‘জনগণমন’-র উল্লেখ আবার দেখা যাচ্ছে ১৯১৯ সালে। দক্ষিণ ভারত ভ্রমণকালে অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তর জেলার মদনাপল্লী শহরের থিওসফিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও রবীন্দ্রনাথের বন্ধু জেমস এইচ কাজিনস কবির সম্মানে এক সভার আয়ােজন করেন। সেই সভায় কবি স্বয়ং ‘জনগণমন’ গানটি পরিবেশন করেন। গানটির নামকরণ করেন ‘দ্য মর্নিং সং অফ ইণ্ডিয়া’। গানটির কথা ও সুর শুনে শিক্ষক, ছাত্র ও অন্যান্য দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে কবিকে অনুরােধ করেন ইংরেজিতে মানে বলে দেওয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ গানটির অনুবাদ স্বহস্তে লিখে অধ্যক্ষকে উপহার দেন। গানটি সেই কলেজের দৈনিক প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতিও চেয়ে নেন কলেজের অধ্যক্ষ। পরে কলেজের পত্রিকায় কবির হস্তাক্ষরের প্রতিলিপিসহ প্রকাশিত হয় ‘জনগণমন’-র ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য মর্নিং সঙ অফ ইণ্ডিয়া’। কবি-কৃত এই অনুবাদ কিছু পরিবর্তিত আকারে ১৯৩৪ সালের অক্টোবরে ‘দ্য বিশ্বভারতী নিউজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং পরে ‘দ্য মর্নিং সঙ অফ ইণ্ডিয়া’ নামে কবির পােয়েমস সংকলন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। গ্রন্থখানির সর্বশেষ সংস্করণে (জুলাই ১৯৮৬) শীর্ষনাম বর্জিত হয়ে ৫১ সংখ্যক কবিতা রূপে চিহ্নিত হয়েছে। অনুবাদটির প্রয়ােজনীয় অংশটুকু উদ্ধৃত করা যেতে পারে :
“Thou art the ruler of the minds of all people,
Thou Dispenser of India’s destiny.
The name rouses the hearts
of the Punjab, Sind, Gujrat and Maratha,
of Dravid, Orissa and Bengal.
It echoes in the hills of the Vindhyas and Himalayas,
Mingles in the Jumna and Ganges.
and is chanted by the waves of the Indian Sea.
They pray of thy blessing and sing thy praise,
Thou Dispenser of India’s destiny,
Victory, Victory, Victory to thee.”
১৯২৭ সালে জাভা থেকে কন্যা মীরাকে লেখা এক দীর্ঘ চিঠির একটি অংশে কবি বলেছিলেন : “আমি কয়েকবছর আগে ভারতবিধাতার যে জয়গান রচনা করেছি, তাতে ভারতের প্রদেশগুলির নাম গেয়েছি—বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গার নামও আছে। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে, ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের ও সমুদ্র পর্বতের নামগুলি ছন্দবদ্ধ করে কেবলমাত্র একটি দেশ পরিচয়ের গান আমাদের লােকের মনে গেঁথে দেওয়া ভাল। দেশাত্মবােধ বলে একটা শব্দ আমরা কথায় কথায় ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু যার দেশজ্ঞান নেই তার দেশাত্মবােধ হবে কেমন করে।”
রবীন্দ্রনাথ ২৯.৩.৩৯ তারিখে সুধারাণী দেবীকে লেখা ‘পূর্বাশা পত্রিকায় প্রকাশিত (ফাল্গুন ১৩৫৪) এক চিঠিতে বলেছিলেন : “শাশ্বত মানব ইতিহাসের যুগ যুগ ধাবিত পথিকদের রথ যাত্রায় চিরসারথি বলে আমি চতুর্থ বা পঞ্চম জর্জের স্তব করতে পারি, এরকম অপরিমিত মূঢ়তা আমার সম্বন্ধে যাঁরা সন্দেহ করতে পারেন তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আত্মাবমাননা।” রবীন্দ্রনাথই বিশ্বের একমাত্র কবি যিনি তিনটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ জাতীয় সঙ্গীতের সুরস্রষ্টা। তিনি নিজেই যখন জনগণমনের অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছেন তারপরেও সংশয়ের জায়গা কোথায় ? ১৯৪১-এর বৈশাখে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে নন্দগােপাল সেনগুপ্তকে (‘কাছের মানুষ রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের লেখক) কবি লেখেন : “গানটি সম্বন্ধে আমার বক্তব্য আগেই বলেছি। বলেছি পতনঅভূদয়বন্ধুর পথে যে চিরসারথির রথ যুগ যুগ ধরে চলেছে, তিনি কোনাে দেশ বিদেশের জর্জ নন। কিন্তু শিরঃপীড়া যাঁদের প্রবল, তাঁরা স্বস্তি পাচ্ছেন না। এদের রসনা আমি কি দিয়ে শান্ত করব?” তাছাড়া গানের যে প্রথম প্যারাটি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বলে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত। হয়েছে, তার পরেও আরও চারটি স্তবক রয়েছে। তার মধ্যে চতুর্থ স্তবকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে / স্নেহময়ী তুমি মাতা…। আমরা পঞ্চম জর্জকে তাে পুরুষ বলেই জানি। এখানেই শেষ নয়। পঞ্চম স্তবকে বলছেন : ‘রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব উদয়গিরি ভালে…নিদ্রিত ভারত জাগে। এখানে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা অকাট্যভাবেই উপস্থিত। আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। এ ব্যাপারে অনেকেই হয়তাে আরও বেশি আলােকপাত করতে পারবেন। তাই প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক।
বাস্তবিক, নেতাজি সুভাষচন্দ্র একাই এই গানের যে গ্রহণযােগ্যতা তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা অসামান্য। ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা প্রথম দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে। সুভাষচন্দ্র জার্মানিতে পৌঁছেছিলেন ১৯৪১ সালে এবং সেই বছরে নভেম্বর মাসে জার্মানির বন শহরে ‘দ্য ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ‘দ্য ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর প্রথম অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪১ সালের ২ নভেম্বর। সেই অধিবেশনেই গৃহীত হয়েছিল ব্রিটিশ-বিরােধী যুদ্ধের শপথ ‘জয় হিন্দ’, সেই যুদ্ধের জাতীয় নেতা সুভাষচন্দ্র বসু ‘নেতাজি’ এবং জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ -অধিনায়ক’। জাতীয় সঙ্গ শীত সংক্রান্ত বিষয়টি ছিল অধিবেশনের অন্যতম মূল আলােচ্য বিষয়। এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি জানা যায় নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহযােগী এবং এন জি গণপুলের সমসাময়িক বর্ণনায়। উপরােক্ত অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বার্লিন শহরে। ওই অনুষ্ঠানে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ সঙ্গীতটির গুরুত্ব অনুধাবন করে ঘােষণা করা হয়েছিল যে, ওই সঙ্গীতে প্রতিফলিত হয়েছিল ভারতের সমস্ত ধর্ম ও প্রদেশের মিলন-কেন্দ্রের আদর্শ। সেই আদর্শের জন্যই গানটিকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়ার প্রসঙ্গটি নির্দিষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় গানটি যন্ত্রসঙ্গীত সহযােগে প্রথম পরিবেশিত হয়েছিল ১৯৪২ সালে। ‘ইন্দো জার্মান কালচারাল সােসাইটি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, হামবুর্গে। এই ঐতিহাসিক দিনেই ভারতের জাতীয় পতাকা বিদেশে প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল।
সুভাষচন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ-হিন্দ বাহিনীর সেনাপতির পদ গ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ২৫ আগস্ট এবং ‘আজাদ হিন্দ’ অর্থাৎ স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন ২১ অক্টোবর। তারও পূর্বে ৫ জুলাই (১৯৪৩) সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন এবং সেই দিনই গানটি গাওয়া হয়। ‘জনগণমন’ -অধিনায়ক, জয় হে’ জাতীয় সঙ্গীতরূপে স্বীকৃতি পেল। নেতাজি আজাদ হিন্দ সরকারের সচিব সেক্রেটারি আনন্দমােহন সহায়কে নির্দেশ দিলেন গানটির হিন্দুস্থানী অনুবাদ করতে। সহায়জি লয়ালপুরের তরুণ কবি হুসেনের সহায়তায় গানটিকে হিন্দুস্থানীতে রূপান্তরিত করেন। হিন্দুস্থানীতে রূপান্তরিত করবার সময়ে কিছুটা পরিবর্তিত হলেও মূল ভাব ও সুর অক্ষুন্ন রাখা হয়। বাংলা রূপের সঙ্গে এই হিন্দুস্থানীরূপের পার্থক্য বিশেষ কিছুই ছিল না। আরজি হুকুমত-ই-আজাদ হিন্দের নির্দেশ নামাতে উল্লেখ করা হয় : ‘টেগােরস সঙ জয়-হে হ্যাজ বিকাম আওয়ার ন্যাশন্যাল অ্যান্থেম।’
মেজর জেনারেল শাহনাওয়াজ খান-এর গ্রন্থ (‘আই.এন.এ. অ্যাণ্ড ইটস নেতাজি’) থেকে জাতীয় সঙ্গীত সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্য উদ্ধার করা যায়। তবে অপাতত বাহুল্য বিবেচনায় তা থেকে নিবৃত্ত হয়ে মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আজাদ হিন্দ কর্তৃক জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার তিনটি অবিস্মরণীয় দিন হল—৫ জুলাই ১৯৪৩ যেদিন সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা জগৎ সমক্ষে প্রকাশ্যে ঘােষিত হল, ২১ অক্টোবর ১৯৪৩ যেদিন সিঙ্গাপুরে হুকুমত-ই-আজাদ হিন্দ আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হল এবং ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসের প্রথমার্ধের কোনাে একদিন (সঠিক তারিখটি বলা যাচ্ছে না) যেদিন আজাদ হিন্দ বাহিনী মৌড়ক রণক্ষেত্রে জয়লাভ করে ভারতের মাটিতে প্রথম ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
আজাদ হিন্দ সরকার গৃহীত এই জাতীয় সঙ্গীত ভারত ও ভারতের বাইরে তখন প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জাতীয় সঙ্গীতটি শুনে জার্মান ও জাপানের শিক্ষিতমহল কতখানি অভিভূত হয়েছিলেন তা আজাদহিন্দ সরকারের সচিব আনন্দমােহন সহায় ১৯৪৯-এর ১০ মার্চ ‘দ্য নেশান’ পত্রিকায় লিখেছিলেন : “Many highly educated japanees admitted that our anthem beat theirs in inspiring people and on many occasions they said so publicly. Netaji told me that Germans in Germany told him frankly that although they considered their anthem the best in the world, they found our anthem as inspiring as their, if not more.”
এইভাবে জার্মানি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, নানা জায়গায় এই গান গেয়ে এর আন্তর্জাতিক পরিচিতি তৈরি করেন নেতাজিই। যে গান নাকি একদিন ইংলণ্ডেশ্বরের জন্য তৈরি হয়েছিল, সেই গানের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন মূর্ত হয়ে উঠল দেশে-বিদেশে। হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টনদের দেশের আহ্বান প্রচারিত হল এই গানেই। ‘বন্দেমাতরম’ বিষয়ে মূল আপত্তি ছিল যে, সেটি যেন বাংলার গান, বাঙালির গান, জনগণমন বিষয়ে ঠিক সেই জায়গাটাতেই সমর্থন তৈরি হয়ে উঠল :এই গান সর্ব ভারতের। আশ্চর্য যে, দু’একটি ভাঙা পংক্তি বাদ দিলে এই গানের কথা শুনে যেন বােঝাও গেল না সেটি আসলে বাংলা গান, বাঙালি কবির রচনা। সুর শুনলে বােঝা যায় না যে, সেটা ঠিক কোন্ দেশি সুর। কোনও খণ্ড-পরিচয়ের ছাপ রইল না এই গানে। ভারতের জাতীয় সঙ্গ শীতকে তাে সেই খণ্ডতার উপরে উঠতে হতই।
নেতাজি নিজেই এই সঙ্গীতটি গাইতেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হিসেবে। পরবর্তীকালে জওহরলাল নেহরু নিজেও বলেছিলেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামের সময় ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ সঙ্গীতটি জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় সেনানীরা বার বার গেয়েছিলেন রণক্ষেত্রের বিভিন্ন ঘটনায়।৯ গান্ধিজি যিনি ‘বন্দেমাতরম’কে জাতীয় সঙ্গীতরূপে ব্যবহারের পক্ষে একসময় দৃঢ়মত পােষণ করেছিলেন, তিনিও ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ সঙ্গীতটির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়ে ‘হরিজন’ পত্রিকায়১০ লিখেছিলেন : ‘এ তাে শুধু গান নয়—সমগ্র জাতির প্রার্থনামন্ত্র।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সন্ধিক্ষণে, মধ্যরাতে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ সঙ্গীতের প্রথম অংশটি নিজে গেয়েছিলেন শ্রীমতী সুচেতা কৃপালনী। তবে, এই সময় ‘জনগণমন-অধিনায়ক’-এর পাশাপাশি ‘বন্দেমাতরম’ গানটিও গাওয়া হয়। সে সময় এই দুটি গানই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিচিত ছিল। কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই দুটি গান সম্বন্ধে সমস্ত রাজ্যগুলির মতামত চেয়ে পাঠান। মধ্যপ্রদেশ বাদে সব রাজ্যই ‘জনগণমন’ -র পক্ষে রায় দেয়। জওহরলাল নেহেরু এক চিঠিতে লিখেছেন, “এই সুর সাধারণভাবে সমাদর লাভ করেছিল, সে কথা ছেড়ে দিলেও, তখন আমাদের পক্ষে গত্যন্তর ছিল না, কারণ তখন অপর কোনও জাতীয় সঙ্গীতের উপযুক্ত সুরসঙ্গীতআমাদের কাছে নেই যা বাইরে পাঠানাে যায়। সেই পরিস্থিতিতে আমি সকল প্রাদেশিক গভর্ণরকে জনগণমন অথবা অপর কোন সঙ্গীত জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে চিঠি লিখি। তাঁদের বলি, তারা যেন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে উত্তর দেন। আমি তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিই, এ বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত করবে গণপরিষদ, তবে বাইরের দূতাবাস বা সামরিক বিভাগের জন্য অবিলম্বে অস্থায়ী কিছু সিদ্ধান্ত করা দরকার। একজন গভর্ণর বাদে (মধ্যপ্রদেশের গভর্ণর) সকলেরই ‘জনগণমন’র পক্ষে বলেন। তদানুযায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা স্থির করে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত গণপরিষদ স্থির সিদ্ধান্ত করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘জনগণমন’ -ই জাতীয় সঙ্গীতরূপে ব্যবহৃত হবে। তাছাড়া বাহান্ন সেকেণ্ডের সময়সীমায় জাতীয় সঙ্গীতের নির্বাচনে ‘বন্দেমাতরম্’ বা ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’-র থেকে এই সহজতাই ‘অধিনায়ক’ করে দিল ‘জনগণমন’ কে। স্বাধীনতা লাভের পর সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বৃন্দবাদনে পরিবেশিত হয় ‘জনগণমন’ ।
১৯৪৮-র ১৫ আগস্ট দিল্লির লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় শিখ রেজিমেন্টের ব্যান্ডে এই গানটি বাজানাে হয়। শেষপর্যন্ত ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০ তারিখে ভারতের সংবিধান স্বাক্ষর করার সময় রাজেন্দ্রপ্রসাদ গণপরিষদের সভাপতিরূপে ঘােষণা করলেন, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হবে ‘জনগণমন’—তবে তার সঙ্গে ‘বন্দেমাতরম’ গানটিও সমান মর্যাদা ভােগ করবে। তারপর সমস্ত সাংসদ উঠে দাঁড়িয়ে সমস্বরে গানটি পরিবেশন করেন, তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শ্রীমতী পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজেন্দ্রপ্রসাদ জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে তার ঘােষণায় বলেছিলেন : ‘জনগণমন’ নামের রচনা ও সুর ভারতের জাতীয়সঙ্গীত (ন্যাশনাল অ্যানথেম) হবে—ক্ষেত্র বিশেষে সরকারের অনুমােদনক্রমে শব্দের হেরফের হতে পারবে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বন্দেমাতরম্ নামের যে গান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে সেটি জনগণমনের মত সমান সম্মান পাবে ও একই সঙ্গে সমান মর্যাদা পাবে।” ‘জনগণমন’ জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পাওয়ার পরও বিতর্ক শেষ হল না। প্রেসিডেন্টের ঘােষণার মধ্যে ধোঁয়াশা রয়েছে। তিনি বন্দেমাতরম্কে ‘জনগণমন’ এর সমান মর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় গান (ন্যাশনাল সঙ) বলে গেছেন। দুটি সঙ্গীতের ব্যবহারিক প্রয়ােগ স্পষ্ট করে বলেননি। অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এম.সি. চাগলা-র সুপারিশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা জনগণমন অধিনায়ককে জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি দেয়।
জওহরলাল নেহরুর আগ্রহই হােক কিংবা রবীন্দ্রনাথ-জওহরলালের মিলিত উদ্যোগেই হােক, জনগণমনকে ভবিষ্যতে স্বাধীন সার্বভৌম ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত রূপে অগ্রাধিকার দেবার মানসিকতা কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে নির্মিত হয়ে গিয়েছিল। গণপরিষদে যখন সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলােচনা চলছিল, তখন একদিনের অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জওহরলাল নেহরু একটি বিবৃতিতে (২৫ আগস্ট ১৯৪৮) জানিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে বন্দেমাতরমের সুমহান অবদান সত্ত্বেও অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে কণ্ঠসঙ্গীতে ওই গান যতটা সাবলীল অর্কেষ্ট্রায় ও যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে সুরের আবহ সৃষ্টিতে ততটা সাবলীল নয়; বরং সেক্ষেত্রে জনগণমনের সাবলীলতা ও প্রয়ােগ-নিপুণতা অধিক। অন্য কথায়, বৃন্দবাদ্যে সুরের মূর্ধনা ও আবেদন বড় কথা, শব্দঝংকার নয়। সেই মানদণ্ডের বিচারে কালারফুল টিউন অ্যাণ্ড সুপিরিয়র ব্যাণ্ডওয়ার্দিনেস’— ‘জনগণমন’ কে অগ্রাধিকর দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসগুলােকে এর টিউন বাজাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই বিবৃতিতে তিনি আরও জানিয়েছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্যবাধকতায় শব্দবিন্যাসের অদলবদল প্রয়ােজন হতে পারে।
১৯৪৮-এর ৩০ নভেম্বর বিশ্বভারতীর গভর্নিং বডির তরফে দেশবাসীর প্রতি একটি আবেদনে জনগণমনকে পঞ্চম জর্জের নাম থেকে বিযুক্ত করে একে জাতীয় সঙ্গীতের যথােপযুক্ত মর্যাদা দানের জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। ওই বিবৃতিতে অন্যান্যদের মধ্যে স্বাক্ষর করেছিলেন অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, ক্ষিতিমােহন সেন শাস্ত্রী, নন্দলাল বসু, হাজারিপ্রসাদ দ্বিবেদী, নীহাররঞ্জন রায়। ১৯১১ সনের কংগ্রেস অধিবেশনের সরকারী প্রতিবেদনে গানটিকে দেশাত্মবােধক সঙ্গীতরূপে চিহ্নিত করা হয়েছিল, এই তথ্য গভর্নিং বডি প্রমাণস্বরূপ দাখিল করেছিলেন, এবং আরও দাবি করেছিলেন পরে মাঘােৎসবে বহুজনকণ্ঠে যে গান ব্ৰহ্মসঙ্গীত রূপে নিবেদন করা হয়েছে সে গান কখনও পঞ্চম জর্জের নামের সঙ্গে সংযুক্ত হতেই পারে না। কমিটির সদস্যগণ উপসংহারে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘জনগণমন’ কে পঞ্চম জর্জ নামের সঙ্গে যুক্ত করার অর্থ রবীন্দ্রনাথের প্রতি অবমাননা এবং জাতীয় মর্যাদার পক্ষে গ্লানিকর।
বিশ্বভারতীর প্রতিনিধিদের সমর্থনে কলকাতার কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক একটি বিবৃতি প্রচার করেন ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৪৮। তাতে অন্যান্যদের মধ্যে স্বাক্ষর করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রাজশেখর বসু, বিনয় সরকার, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু। তাদের বক্তব্য, যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই বন্দেমাতরমকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে অগ্রাধিকার দেবার পক্ষে, তবুও দেশবাসীর নিকট তাদের অনুরােধ তারা যেন ইংল্যাণ্ডের কোন রাজার নামের সঙ্গে সংযুক্ত করে ‘জনগণমন’ eর মত অনবদ্য সঙ্গীতটিকে কলঙ্কিত না করেন।
এমন প্রচারের জোয়ারে এক অন্য মাত্রা সংযােজন করেন সে আমলে বিদ্বৎসমাজে অতিশয় শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী অতুলচন্দ্র গুপ্ত। তিনি এক বিবৃতিতে (ডিসেম্বর ২৬, ১৯৪৬) জানান, জনগণমন পঞ্চম জর্জের প্রশংসা করে রচিত হয়েছে— এই গুজবের প্রতিবাদ করে বিশ্বভারতীর গভর্নিং বডি একটি বিবৃতি দিয়েছেন, ঐরকম গুজবের প্রতিবাদ যে করতে হচ্ছে তাতে লজ্জায় ম্রিয়মান হতে হয়। তিনি ওই বিবৃতিতে আরাে বলেন : “যারা রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা সকলেই রবীন্দ্রনাথের জীবন ও মন সঠিক বুঝতে পারবে এটা আশা করা যায় না; রবীন্দ্রনাথ যে কোনাে ইংরেজ রাজা বা পঞ্চম জর্জের মহিমা কীর্তন করে গান বা কবিতা রচনা করতেই পারেন না, একথা বুঝবে তাও প্রত্যাশা করা যায় না। যে কেউই তাে ওই অপরূপ কবিতাটি পড়ে দেখতে পারেন। ‘দারুন বিপ্লব মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে/সঙ্কট দুঃখত্ৰাতা’ এই কথাগুলাে কোনাে ব্রিটিশ রাজার উদ্দেশ্যে নিবেদিত, একথা বলার মত নির্বোধ যারা তারা তাে সমালােচনারই অযােগ্য। আশা করা যায়, রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত মূল্যায়নে যারা ইচ্ছুক নয় বা ঐরকম বুদ্ধিশুদ্ধি যাদের নেই তাদের বােঝাবার কোন চেষ্টা বিশ্বভারতী করবে না। ওরা শুধু ভৌগােলিক অর্থেই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশবাসী।”১১
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ভাষ্য তথা তার পরিবেশিত তথ্য এই যে :“During my last visit to him I requested him to compose a National Anthem for the new India. At that time I did not have ‘Jana-Gana-Mana’, our present National Anthem, in mind. He died soon after. It was a great happiness to me when some rears later after the coming of Independence we adopted “Jana-Gana-Mana’ as our National Anthem. I have a feeling of satisfaction that I was partly responsible for this choice, not only because it is a great national song, but also because it is a constant reminder to all our people of Rabindranath Tagore.”
শেষ বাক্যে জওহরলাল গানটি সম্পর্কে সারকথা বলেছেন। অর্থাৎ যখনই এই বিশেষ জাতীয় সঙ্গীত গীত হবে তখনই দেশবাসী মনে করবে মহান রবীন্দ্রনাথকে। আজ আমাদের চেতনায় অনেকান্ত রবীন্দ্রনাথের স্বরূপের মধ্যে থেকে আলাদাভাবে তার দেশভাবনার ঐকান্তিক সদিচ্ছা ও বিশ্বপটে ভারত আত্মার এক গৌরবময় ভূমিকা নির্মাণের মহত্ব ফুটে উঠেছে। জাতীয় সঙ্গীত তাে সবদেশেই থাকে এবং সবদেশের মানুষ তাদের জাতীয় সঙ্গীতকে স্বতন্ত্র এক উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠা করে, সেই গানের অন্তর্গত সবকটি বাণী দ্যেতনা পরম বিশ্বাসে উচ্চারণ করেন। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বাড়তি গৌরব হল গানের চেয়ে গানের স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবােধ। যে গান উপলক্ষিক স্বদেশি গান রচনার আবেগে উৎসারিত হয়েছিল পরবর্তীকালে তার দ্বিজত্ব ঘটে জাতীয় সঙ্গীতের সার্বিক প্রসারিত সর্বভারতীয় চিত্তপটে।
স্মর্তব্য যে, ‘বন্দেমাতরম’ থেকে ‘জনগণমন’ সঙ্গীত চয়নের প্রশ্নে তখনকার ভারতীয় সমাজ ছিল যথেষ্ট উত্তাল ও কখনও কখনও দ্বিধাবিভক্ত। ধর্ম চিরকালই ভারতীয় জনদেবতার মূল আহার্য বস্তু। আবার একই সঙ্গে বিভেদকামীদের মূল অক্সিজেন।
‘বন্দেমাতরম’ বর্জন-প্রক্রিয়ায় সেটিই হয়ে উঠেছিল মূল কারণ। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত হলেও, বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দেমাতরম’ স্বতন্ত্রভাবে রচনা করেছিলেন, রচনাকাল ১৮৭৫ সাল। ১৮৮২ সাল ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় (প্রথম খণ্ড, দশম পরিচ্ছেদ’) এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। শােনা যায়, সেই সংখ্যার কোনও একটি পাতায় বেশ কিছুটা ফাকা জায়গা ছিল এবং পেজ মেকাপের জন্যই ‘বন্দেমাতরম’ সেখানে স্থান পায়। বঙ্কিমচন্দ্র যদিও তাঁর এই সৃষ্টি সম্বন্ধে খুবই উচ্চাশা পােষণ করতেন। বলেছিলেন, এই গানে বঙ্গদেশ মাতিয়া উঠিবে। সত্যই তাই ঘটেছিল। বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলনে ‘বন্দেমাতরম’-এর প্রবেশ ও গুরুত্বপ্রাপ্তির দিনক্ষণ সম্বন্ধে সঠিক ধারণা না পাওয়া গেলেও এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় এটি আক্ষরিক অর্থেই ‘রণধ্বনি’ হয়ে উঠেছিল। প্রকাশের অব্যবহিত পরেই ‘বন্দেমাতরম’ গানে প্রথম সুর দেন ভাটপাড়ার যদুনাথ ভট্টাচার্য। এরপর ১৮৯৬ সালের কলকাতা কংগ্রেসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘দেশ রাগে’ সুর দিয়ে বন্দেমাতরম’ গেয়েছিলেন। এক কথায় ভারতীয় রাজনীতিতে ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত ও বন্দেমাতরম্ ধ্বনি বাংলার মহার্ঘ এক উপহার।
এখন প্রশ্ন, কংগ্রেস কেন বন্দেমাতরম্-বিরােধী কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করল? তদানীন্তন জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই সত্যকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছেন ঐতিহাসিকরা। ১৯৩৭ সাল, যখন ‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে বিতর্কের দানা বেঁধে উঠেছিল, তার বেশ কিছু সময় আগেই ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়েই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়েছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলে অনেকগুলি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত, আবার বাংলা ও পাঞ্জাব প্রভৃতি প্রদেশে মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভা। মুসলিম লিগ তার লখনউ সম্মেলনে বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে (মুসলিম লিগের বক্তব্য ছিল : বন্দেমাতরম-তত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দর্শন ছাড়া কিছুই নয়) প্রস্তাব গ্রহণ করে—যা স্বাভাবিকভাবেই পরিপুষ্টতা লাভ করে ইংরেজ শাসকদের মন্ত্রণায়। তখন কংগ্রেস নেতৃত্ব পড়লেন দ্বৈত সমস্যায়। এপর্যন্ত যে বাংলা স্বাধীনতা সংগ্রামের নরমপন্থী ও চরমপন্থী দুই ভূমিকাতেই চরম সফল, সেখান থেকেই বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ! আবার নির্বাচিত সরকারের দাবি-দাওয়া অগ্রাহ্য করার রাস্তাও খােলা নেই। বাধ্য হয়েই জাতীয় কংগ্রেস ‘বন্দেমাতরম’ জাতীয় সঙ্গীত থাকবে কি থাকবেনা—এই বিতর্কের মােকাবিলায় সংগঠনের অন্দরমহলের বিভিন্ন স্তরে আলাপ-আলােচনা শুরু করল।
ইতিহাস বলছে, বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে কংগ্রেস সরকারিভাবে কোনও সঙ্গীতকেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করেনি। যদিও তার বিভিন্ন জাতীয় সম্মেলনে অন্যান্য সঙ্গীতের সঙ্গে ‘বন্দেমাতরম’ও গাওয়া হত। এটাও দেখা গেল, বিভিন্ন কংগ্রেস শাসিত প্রদেশের সরকারি অনুষ্ঠানে ‘বন্দেমাতরম’ ‘জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হচ্ছে।
কিন্তু কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের কাছে ‘জাতীয়তার প্রতীক এই আবেগের পরিবর্তে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরে তার গ্রহণযােগ্যতার প্রশ্নটিমুখ্য হয়ে উঠেছিল। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ কংগ্রেসের নিরুপায় অবস্থানকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছে: “ওয়ার্কিং কমিটি অনুভব করে যে, অতীতের দীর্ঘত্যাগও সহনের ঐতিহ্য এবং সর্বজনীন ব্যবহারের জন্য (বন্দেমাতরম’) গানটির প্রথম দুটি স্তবক আমাদের জাতীয় আন্দোলনের জীবন্ত ও অবিচ্ছেদ্য অংশ।…এই স্তবক দুটিতে এমন কিছু নেই, যার বিরুদ্ধে কারও পক্ষে আপত্তি করা সম্ভব। গানের বাকি স্তবকগুলি প্রায় কারও জানাই নেই বা সেগুলি প্রায় গাওয়াই হয় না।.. (জাতীয়) সঙ্গীতের একটি প্রামাণ্য সংকলনের প্রয়ােজন দীর্ঘদিন ধরে বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছে। ওয়ার্কিং কমিটি তাই এই উদ্দেশ্যে একটি সাব-কমিটি গঠন করছে, যার সদস্য হবেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু এবং নরেন্দ্র দেব।…প্রাপ্ত সঙ্গীতগুলির মধ্যে যেগুলি জাতীয় সঙ্গীত সংকলনে স্থান লাভের যােগ্য বলে সাব-কমিটি বিবেচনা করবে, সেগুলি সে ওয়ার্কিং কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেবে।…সাব-কমিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরামর্শ করবে ও তার উপদেশ গ্রহণ করবে।”১২
এইভাবে শুরু হল বন্দেমাতরম্ বিরােধী অভিযান। আর সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হল রবীন্দ্রনাথকে। ১৯৩৭-এর অক্টোবরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ও এআইসিসি-র সভা। জওহরলাল নেহরু কলকাতায় এসেই বেলঘরিয়ায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করলেন। বন্দেমাতরম্ সূত্রে গঠিত সাব-কমিটির সদস্যরাও মিলিত হলেন এই সময়ে। একেশ্বরবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত রবীন্দ্রনাথ বন্দেমাতরমে’র প্রথম দুটি স্তবক ছাড়া অন্য স্তবকগুলির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে।১৩ সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “..আমি শুধু এটুকু জানি যে, ভারতবাসী হিসাবে আমার শক্তি যেন ভারতের দেবীমূর্তি তৈরি করে তার উদ্দেশ্যে বস্তু সম্পর্কহীন ভাবাবেগপূর্ণ স্তুতিবর্ষণে ব্যয়িত না হয়, তা যেন যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব আমার দেশবাসীর মঙ্গল করতে, তাদের জীবন উন্নত করতে যথাসাধ্য নিযুক্ত থাকে…।” রবীন্দ্রনাথ কিন্তু প্রথম দুটি স্তবক সম্বন্ধে উচ্ছসিত ছিলেন। ১৯৩৭ সালের ৩০ অক্টোবর বন্দেমাতরম্ বিতর্কসূত্রে সংবাদপত্রে তার যে বিবৃতি প্রকাশিত হয় তার কিছু অংশ এই প্রকার : “.গানটির প্রথম অংশে যে সুমধুর ভাব ও ভক্তি প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের মাতৃভূমির শ্রীময়ী ও কল্যাণময়ী রূপের উপর যে গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে, তা আমার কাছে…বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করেছিল।”
কিন্তু সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব বন্দেমাতরমের অঙ্গচ্ছেদ পরিকল্পনা থেকে কিছুতেই সরে এলেন না। কলকাতায় সভা চলাকালীন ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত ঘােষণা করল
বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতের প্রথম দুটি কলিমাত্র গাওয়া চলবে এবং জাতীয় সঙ্গীত বিবেচনার জন্য প্রথমে কমিটি ও সবশেষে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু ও নরেন্দ্র দেব প্রমুখেরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলােচনা করে ঠিক করে নেবেন জাতীয় সঙ্গীত কী হতে পারে।
‘বন্দেমাতরম’ গানটি সম্পর্কে কংগ্রেসের মনােভাবে বাংলার বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। বাংলা সংবাদপত্রে ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গণ্য করার পক্ষে তারা প্রস্তাব দেন। ঠিক এই সময় ৩ নভেম্বর, ১৯৩৭ তারিখে ‘ম্যাড্রাস মেল’ পত্রিকায় এক বিবৃতিতে মদনাপল্লী কলেজের অধ্যক্ষ ড. কাজিনস ‘জনগণমন’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দান করার প্রস্তাব রাখেন :“My suggestion is that Dr. Rabindranath’s own intensely patriotic, ideally stimulating, and at the same time world-embracing ‘Morning Song of India…’ should be confirmed officially as what it has for almost twenty years been unofficially, namely the true National Anthem of India. This real expression of aspiration for the highest welfare of a whole people…is universally know in the contry…
True, Dr. Tagore made the Vandemataram tune, and true he sang it-but alone, as fits it. Janagana specifically recognises the diversity of human life in India…”
বাংলা পত্র-পত্রিকা রে-রে করে ওঠে। প্রশ্ন তােলে, রবীন্দ্রগীতির মধ্যে আদৌ জাতীয়তাবােধ নামক বস্তুটি আছে কি? ‘জনগণমন’ যে কারণে লেখা হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নের তােড় এবং জোড়, দুই-ই ক্রমশ বাড়তে থাকে। এও বলা হয় যে, আসলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই কায়দা করে কাজিনসকে দিয়ে প্রস্তাবটি আনিয়েছেন।
জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসু ‘জনগণমন’ কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত করার ব্যাপারে আগ্রহী থাকলেও, কংগ্রেসের অনেকেরই এই বিষয়ে দ্বিমত ছিল। ভারতের রাজনীতিমহল জাতীয় সঙ্গীতের নির্বাচন নিয়ে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ-বিরােধীরা প্রচার করেন, গানটি পঞ্চম জর্জের কলকাতা আগমনকে কেন্দ্র করে রচিত। সেই পুরনাে অ্যাংলাে ইণ্ডিয়ান সংবাদপত্রের পুনরাবৃত্তি। এই সময় পুলিনবিহারী সেন গানটির রচনার উপলক্ষ জানতে চেয়ে কবিকে পত্র লিখলে, তিনি ১০ নভেম্বর ১৯৩৭ তারিখে লেখা এক চিঠিতে উত্তরে জানান, ‘জনগণমন’ অধিনায়ক গানটি কোনাে উপলক্ষে-নিরপেক্ষভাবে আমি লিখেছি কিনা তুমি জিজ্ঞাসা করেছ। বুঝতে পারছি এই গানটি নিয়ে দেশের কোনাে কোনাে মহলে যে দুর্বাক্যের উদ্ভব হয়েছে তারই প্রসঙ্গে প্রশ্নটি তােমার মনে জেগে উঠল। ফ্যাসিস্ট নীতিতে মতভেদ নিরাপদ নয়, কঠিন শাস্তি তার জন্যে নির্দিষ্ট, তেমনি আমাদের মতভেদকে চরিত্র দোষের সামিল করে পুরুষ ভাষায় নিন্দা করা হয় আমার জীবনে বারবার তার পরিচয় পেয়েছি, কখনাে তার প্রতিবাদ করিনি। তােমার চিঠির জবাব দিচ্ছি কলহের উত্মা বাড়াবার জন্য নয়, ঐ গান রচনা সম্বন্ধে তােমার কৌতুহল মেটাবার জন্য।…
সে বৎসর (১৯১১) ভারত সম্রাটের আগমনের আয়ােজন চলছিল। রাজ-সরকারের প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনও বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরােধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি ‘জনগণমন’ অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘােষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয় বন্ধুর-পন্থায় যুগযুগধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক—সেই যুগ যুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনও জর্জই কোনওক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। কেননা, তাঁর ভক্তি যতই প্রবল থাক, বুদ্ধির অভাব ছিল না। আজ মতভেদবশত আমার প্রতি ক্রুদ্ধ ভাবটা দুশ্চিন্তার বিষয় নয় কিন্তু বুদ্ধিভ্রংশটা দুলক্ষণ।” ২০ নভেম্বর ১৯৩৭ বিচিত্রা’ পত্রিকায়ও এটি প্রকাশিত হয়।
চিঠিতে উল্লেখ না থাকলেও এই বন্ধুটির পরিচয় বিষয়ে প্রবােধচন্দ্র সেন লিখেছিলেন, বন্ধুটি সম্ভবত আশুতােষ চৌধুরি।১৪ তার সাহিত্যবুদ্ধির উল্লেখ আছে ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে। ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট-এর ওই সংখ্যায় গানটি প্রসঙ্গে লেখা হয় :“…in December (1911) Rabindranath composes, at the request of Asutosh Chaudhuri, for the twenty-sixth session of the India National congress in calcutta, his famous national song, JanaGana-Mana-Adhinayaka…” কিন্তু আশুতােষ চৌধুরি যে ওই সময়ে ‘রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান’ হননি, তার প্রমাণ ব্যারিস্টার আশুতােষ চৌধুরি কলকাতা হাইকোর্টের অন্যতম বিচারপতির কর্মর্ভার গ্রহণ করেন গানটি রচনার পরে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১২ (সােমবার, ২২ মাঘ ১৩১৮) আর তাছাড়া তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ‘স্যার’ উপাধিতে তিনি ভূষিত হন অনেক পরে ১৯২১ সালে। পুলিনবিহারীকে লেখা কবির পত্রেও উল্লেখ করা হয়েছে : ‘এ গান বিশেষভাবে কংগ্রেসের জন্য লিখিত হয়নি। সুতরাং এমন অন্যায় অনুরােধের জন্য আশুতােষ চৌধুরিকে কোনােভাবেই দায়ী করা চলে না। দায়ী করা যায় পাথুরিয়াঘাটার মহারাজা প্রদ্যোতকুমার ঠাকুরকে। এ প্রসঙ্গে রবি জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন : “বরং উক্ত রাজসরকারে’ প্রতিষ্ঠাবান… বন্ধু হিসেবে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির ‘স্যার (১৯০৬) এবং ‘মহারাজা’ (১৯০৮) প্রদ্যোতকুমার ঠাকুরকে (১৮৭৩-১৯৪২) গ্রহণ করা সঙ্গত। প্রবােধচন্দ্র সেন তাঁর গ্রন্থে ‘দ্য ওরিয়েন্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত বনবিহারী মুখােপাধ্যায়ের একটি পত্রাংশ উদ্ধৃতি করেছেন,
‘The Historical Record of the Imperial visit to India, 1911’ (1914) গ্রন্থ অবলম্বনে তিনি লেখেন : “The only Indian musical programme for the occasion was composed and presented to their Magesties by Prof. Dakshina Sen and Sir Pradyot Tagore during the pageant at calcutta on the 5th January. 1912.’১৫ বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ দক্ষিণাচরণ সেন (১৮৬০-১৯২৫) পাথুরিঘাটা ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে সঙ্গীত সূত্রে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। জনগণমন’ গান যে পঞ্চম জর্জের উদ্দেশ্যে রচিত হয়নি, এ কথা বুঝতে পেরেই প্রদ্যোতকুমার সম্ভবত দক্ষিণাচরণকে দিয়ে গান রচনা করেন।”১৬
অচিরেই বাংলাদেশে উঠল প্রতিবাদের ঝড়। বাঙালি মনের ক্ষোভ ও যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি দেখা গেল তৎকালীন খবরের কাগজ ও অন্যান্য পত্রিকায়। আনন্দবাজার পত্রিকা ব্যঙ্গ ত্মিক ভঙ্গিতে লিখছে, “যে বিচার-মূঢ়তায় অন্ধ হইয়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্তের কঠোর নিন্দা করিয়াও শেষ পর্যন্ত উহা প্রকারন্তরে মঞ্জুর করিতে ইস্তত করেন। নাই, এবং যে কর্তৃত্বাভিমানের বশবর্তী হইয়া জনমতের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সেই বিজাতীয় সিদ্ধান্ত দেশের উপর চাপাইয়া দিতে চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই—বন্দেমাতরম্ বিরােধী প্রস্তাবের মধ্যে সেই বুদ্ধিভ্রংশতাই পুনরায় দেখা যাইতেছে।”১৭
এর পর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের যৎকিঞ্চিৎ’-এ লিখল: “রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীতের ব্যবচ্ছেদের সম্মতি দিলেও বাংলার অন্যান্য প্রবীণ সাহিত্যিক স্বর্গত বঙ্গিমচন্দ্রের অমর রচনার প্রতি এই অসম্মানের প্রতিকারার্থে সমবেত হইয়াছেন ইহা আশার কথা। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় হস্তক্ষেপ অনুমােদন করিয়া রবীন্দ্রনাথ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন, তাহার কুফল যে শেষ পর্যন্ত তাহার উপরে আসিয়াও বর্তাইতে পারে ইহা সম্ভবত তিনি ভাবিয়া দেখেন নাই। টেক্সটবুক কমিটি হইতে তাহার রচনার অংশবিশেষ পরিবর্তন ও পরিবর্জনের জন্য প্রস্তাব করিলে তিনি যে যুক্তি দেখাইয়া প্রবল প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও সেই যুক্তি এবং সেইরূপ প্রতিবাদই তিনি করিবেন আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি না করিলেও বাংলার অন্যান্য বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা সাহিত্যগুরুর সম্মানরক্ষায় সচেষ্ট হইলেও সে চেষ্টা সার্থক হইবে বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি।”১৮ ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ অনুরাগী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ও ধারাবাহিকভাবে ধীর স্থির ভঙ্গিতে বন্দেমাতরমের পক্ষে মত প্রকাশ করে গিয়েছেন। তিনি প্রবাসী পত্রে১৯ প্রসঙ্গ কথায় বন্দেমাতরম শিরােনামে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেন। ওই রচনাটি থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি : “গানটি যে মুসলমান বিদ্বেষপ্রসূত বা মুসলমানবিদ্বেষজনক নহে, সে বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। মুসলমানদের কোনাে নিন্দা থাকা দুরে থাক, ইহাতে কোথাও মুসলমানদের উল্লেখ পর্যন্ত নাই। বরং ইহাতে মুসলমানদিগকেও মাতৃভূমির সন্তান বলিয়া ধরিয়া জন্মভূমি যে সংঘশক্তিতে বলীয়সী তাহাই বলা হইয়াছে। গানটি রচনার সময় বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার সহিত যুক্ত ছিল এবং সমগ্র বাংলা প্রদেশের লােকসংখ্যা তখন সাত কোটি ছিল। এইজন্য সপ্তকোটি কণ্ঠ ও দ্বিসপ্তকোটি ভূজের উল্লেখ। পরে যখন গানটিকে সমগ্র ভারতের উপযােগী করিবার। নিমিত্ত সপ্তকে ত্রিংশ করা হয়, তখন ভারতবর্ষের লােকসংখ্যা ছিল ত্রিশ কোটি। সপ্ত কোটি এবং ত্রিংশ কোটি উভয়ের মধ্যেই মুসলমান আছেন। জাতি যে মুসলমানদেরও বলে বলীয়ান, বঙ্কিমচন্দ্র তাহাই বুঝাইতে চাহিয়াছিলেন। সুতরাং গানটি মুসলমানবিরােধী নহে।”
বলা বাহুল্য, কবি এ-সবের কোনাে জবাব দেননি। এসবের পরিণাম কি কবি তা ভালাে করেই জানতেন। বহু দুঃখেই তিনি প্রমথ চৌধুরিকে লিখেছিলেন (১৮ কার্তিক, ১৩২৮) : “.আমার মন ম্যাপের গর্তর মধ্যে আর কোনদিন দেবতা খুঁজবে না। বুঝতে পেরেছি এই নিয়ে ঘরে পরে আমাকে ত্যাগ করবে। আমি ঠিক করেছি, যার যা মনের সাধ মিটিয়ে নি, আমি আর কথা কইব না।”২০
বন্দেমাতরমের ব্যাপারে এইভাবে হিন্দু মধ্যবিত্ত কিভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল তার আভাস পাই রবীন্দ্রনাথেরই চিঠি থেকে। প্রমথ চৌধুরিকে লেখা বিরক্তিমূলক পূর্বোক্ত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছিলেন, “…দেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে হুকুম আসচে যে সময় খারাপ অতএব বাঁশি রাখ, লাঠি ধর’। যদি তা করি তাহলে কর্তারা খুশি হবেন, কিন্তু আমার এক বাঁশিওয়ালা মিতা আছেন কর্তাদের অনেক উপরে। তিনি আমাকে একেবারে বরখাস্ত করে দেবেন। কর্তারা বলেন, “তিনি আবার কে? এক ত আছে ‘বন্দেমাতরম্। তাদের গড় করে আমাকে আজ বলতে হচ্চে—‘আমার বন্দেমাতরম্ ভুলিয়েচেন ঐ তিনি। আমি দেশ ছাড়া ঘর ছাড়া দলে। আমি ভূগােলের প্রতিমার পাণ্ডাদের যদি আজ মানতে বসি তাহলে আমার জাত যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভূগােলের প্রতিমার পাণ্ডারা শুধু পাণ্ডা নয়, তারা গুণ্ডা—অতএব মার খেতে হবে। তাই সই। মার শুরু হয়েছে।
…মরার ভয়ে চঁাদসাগর শিবকে ছেড়ে সাপের দেবতার কাছে হার মেনেছিল, সেইখানেই তার গাল রয়ে গেল। আমি কিন্তু শিবকে ছাড়ব না। আমার শিব সকল জগতের—কিন্তু সাপের দেবতার জায়গা হচ্ছে গর্তের ভিতরে। সেই গর্তের মুখে দুধকলা জোগাবার বায়না যাঁরা নিয়েছেন তারা যে-ফলের লােভ করেন আমি সেই ফলকে বড় মনে করি নে।”২১ এর থেকে পরিষ্কারভাবে বােঝা যায় যে, কবি বন্দেমাতরম্ বিশ্বাসীদের স্বাদেশিকতাকে। কোনভাবেই সমর্থন করতে পারছেন না। তাছাড়া বন্দেমাতরম্ ধ্বনিকে তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া বাণীতে তিনি ‘বন্দেমাতরম’-র পরিবর্তে ‘বন্দেভ্রাতরম’ শ্লোগান গ্রহণের পক্ষে বলেছিলেন।২২ এমন ডাক কার্যকর হবার কথা নয়, হয়ওনি। ক্ষেত্রবিশেষে সন্তানের দেশমাতৃবন্দনা যে ভয়াল রূপ ধারণ করতে পারে রবীন্দ্রনাথ তা দেখতে পেয়েছিলেন। বন্দেমাতরম-র ব্যাপারে শান্ত স্বভাবের কবি বুদ্ধদেব বসুও যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন তা বােঝা যায় বুদ্ধদেব বসুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে। ওই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন : “ “শ্রীহর্ষে’ বন্দেমাতরমপন্থীর পক্ষে তােমার লেখা পড়ে বিস্মিত হয়েছি ..তুমি আমাকে গাল দাও নি। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়।”২৩
বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ আরও (২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৭) লিখেছিলেন, “তর্কটা হচ্ছে এ নিয়ে যে ভারতবর্ষে ন্যাশনাল গান এমন কোনাে গান হওয়া উচিত যাতে একা হিন্দু নয়, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান—এমনকি ব্রাহ্মও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে যােগ দিতে পারে। তুমি কি বলতে চাও, ‘ত্বংহি দুর্গা’ ‘কমলা কমলদল বিহারিণী’ ‘বাণী বিদ্যাদায়িনী ইত্যাদি হিন্দু দেবী নামধারিণীদের স্তব যাদের প্রতিমা পূজি মন্দিরে মন্দিরে’ সর্বজাতিক গানে মুসলমানদের গলাধঃকরণ করাতেই হবে। হিন্দুদের পক্ষে ওকালতি হচ্ছে এগুলি আইডিয়া মাত্র। কিন্তু যাদের ধর্মে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ তাদের আইডিয়ার দোহাই দেবার কোনাে অর্থই নেই।”২৪
‘বন্দেমাতরম’ গান যে মুসলিমদের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না তার কারণ ‘আনন্দমঠে’র সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা। গানটি রচনার দু বছর পরে ওই গানের অনুষঙ্গে যে কল্পনাকে বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বিগ্রহের রূপ দেন তা একান্তরূপে হিন্দুত্বের প্রতীক শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মের মানুষের পক্ষে তার অক্ষরগত অর্থ বিবাদীও বটে : “বাহুতে তুমি মা শক্তি (হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি/ তােমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে/ত্বং হি দুগা দশপ্রহরণধারিণী/ কমলা কমলদলবিহারিণী।” রমেশচন্দ্র দত্ত ‘Encyclopaedia Britannica’-তে এই গীতের অর্থ নির্দেশ করে হিন্দু আদর্শের কথা লিখেছেন: “The poem, then, is the work of a Hindu idealist who personified Bengal under the form of a purified and spiritual Kali.” তিনি আনন্দমঠের কেন্দ্রীয় বক্তব্য সম্বন্ধে লিখেছেন, “The general moral of the Ananda Math, then, is that British rule and British education are to be accepted as the only alternative to Musalman oppression …but acceptance of British rule, if is none the less inspired by the ideal of the restoration, sooner or later of a Hindu Kingdom in India.”
আনন্দমঠের যুদ্ধে প্রকৃত শত্ৰু কারা এ নিয়ে অনেক মতবিভেদ আছে। মুসলমান নবাব, তার পৃষ্ঠপােষকই ইংরেজ কোম্পানি? পরবর্তীকালে কংগ্রেস ও রাষ্ট্রবাদী নেতারা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন যে বঙ্কিমচন্দ্র পরােক্ষে ইংরাজবিরােধী ধর্মযুদ্ধের কথা বলেছেন। অন্যদিকে, হিন্দুরাষ্ট্রবাদীরা বারবার একে মুসলমানবিরােধী হিন্দুবিপ্লব মনে করেছেন। বিশ শতকে দেখি যে বন্দেমাতরম মন্ত্র যেমন কংগ্রেস আন্দোলনের, তেমনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শ্লোগান।
তবে দুয়েকটা ব্যাপার এড়ানাে যায় না। এ মন্ত্রে বন্দিত দেশমাতা এক নিখাদ হিন্দু দেবীমূর্তি। গানটির প্রথম আবির্ভাব ঘটে এমন একটি পরিস্থিতিতে যেখানে মুসলমান সেনাদল ও হিন্দু-জনতার সংঘর্ষ শুরু হতে যাচ্ছে। উপন্যাসে অন্যত্র মুসলমানের মসজিদ ভেঙে রাধামাধবের মন্দির গড়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, এমন এক দেশাত্মবােধের কল্পনা করা হল যা ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে কোনমতেই গ্রহণীয় নয়। না তারা দেবীবন্দনা করতে পারেন, না তারা আনন্দমঠের মুসলমানবিদ্বেষী কথা অগ্রাহ্য করতে পারেন। এই দেশাত্মবােধ সম্পূর্ণই হিন্দুরাষ্ট্রবাদ। এখানে যেমন মুসলমান নেই, তেমনই নেই সাধারণ মানুষ।
এমনকি, দেশের মাটিও ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। বন্দেমাতরমের গােড়ায় আছে। সুজলা-সুফলা এক মােহন নিসর্গচিত্র। গানের মাঝখানে এই দেশ মিশে যায় এক যুদ্ধপরায়ণ দেবীমূর্তির মধ্যে। মিলিয়ে যায় মাটি, গাছপালা, আকাশ। সমস্ত চোখ জুড়ে জেগে থাকে শুধুমাত্র এক বিশাল করাল কালীমূর্তি, দশপ্রহরণধারিণী। ভাষাও বদলে যায় : শুরুতে যেমন দীর্ঘপ্রলম্বিত, সব মাত্রা ছিল, কোমল শব্দচয়ন ছিল, পরে তা কর্কশ, দ্রুত অস্ত্রনিনাদের মাত্রা নেয়। দেশ যদি মা হয়, তবে তার সন্তানের হাতে হাতে অস্ত্র। তাদের জন্মই হয়েছে প্রতিহিংসার মুহূর্তে, প্রতিহিংসার উদ্দেশ্যে। দেশ যখন দেবীমূর্তি হয়ে দাঁড়ায় তখন তা আর মানুষের থাকে না, মানুষ তার নিবেদিত বলি, তার প্রহরণ মাত্র।
রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে বারবার ‘বন্দেমাতরম্’ দলের নিন্দা করেছেন, দেবীমূর্তিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার সমালােচনা করেছেন। তার এই সমালােচনা শুরু হয় স্বদেশি আন্দোলনের যুগে। আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র থেকে, নায়কের ভূমিকা থেকে ধীরে ধীরে তিনি সরে আসেন অনেক দূরে—অরবিন্দ ঘােষ-বিপিন পালের নিন্দাভাজন হয়ে, উগ্রবাদী রাজনীতির জগতের বিশ্বাস হারিয়ে অনেক পরে, বাংলাদেশ যখন আবার এক হয়েছে ও কার্যনীতি নােয়ানাে হয়েছে, তখন তিনি তার নিজস্ব সমালােচনা বিশদভাবে উপস্থাপিত করেন ঘরে বাইরে উপন্যাসে। এবং তার সমালােচনার লক্ষ্য হল বন্দেমাতরমের চিন্তা ও কল্পনা।
নিখিলেশ ও সন্দীপের বিভেদের একটা বড় কারণ হল নিখিলেশ মাটি-জল-মানুষের বাইরে দেশ বলে কিছু আছে তা মানবে না। এবং সে দেশকল্পনায়, বা দেশনায়কের প্রতি আনুগত্যে দেবত্ব আরােপ করতে রাজি নয়। ঈশ্বর সব দেশের, সব নেতার ঊর্ধ্বে, তাকে কোনাে সীমিত স্বার্থের গণ্ডীতে টেনে নামানাে যায় না। তিনি সারা পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ ও ন্যায়ের আধার, মূর্তি, কোন বিশেষ দেশের বা নেতার সম্পত্তি নন। দেশকে ভালবাসা এক ও দেশকে ঈশ্বরজ্ঞান করা আর এক।
তাছাড়া, দেশ কি? তা এক অপরূপ কল্পনা, এক দেবীমূর্তি ? না তা এক অগণ্য মানুষের জনসমষ্টি, যার প্রধান ভাগ নিরক্ষর, অত্যাচারিত, দরিদ্র? নিখিলেশের দেশ হল পঞ্চু এক অশিক্ষিত চাষা, যে রাজনীতি বােঝে না, রাষ্ট্রকে চেনেন। যার প্রতি যেমন ইংরেজ সরকার, তেমনই স্বদেশি আন্দোলন—দুইই সমান উদাসীন।
‘বন্দেমাতরমে’র সঙ্গে বিতর্কে নেমে রবীন্দ্রনাথ দেশ নিয়ে আগেই একটি গান লিখেছিলেন, যাতে দেশ স্বয়ং ঈশ্বর নয়, ঈশ্বরের ন্যায়নীতির পথে চলতে শিখেছে। ঈশ্বর যেমন এদেশের তেমন আর সব দেশের আদর্শস্বরূপ। দেশ অখণ্ড দেবীমূর্তি নয়, বহু মানুষের, সংস্কৃতির সঙ্কলন। দেশ কোনাে আত্মিক ধারণা নয়, দেশ সজীব মানুষের আবাস। দেশ দ্বেষ-হিংসা। ও যুদ্ধবিগ্রহ নয়, তা কল্যাণ ও ন্যায়ের চিন্তায় আত্মনিবেদিত। ১৯২৩ সালে যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হল, তখন থেকে বন্দেমাতরম প্রতি শাখায় প্রতিদিন সম্পূর্ণ আবৃত্তি করা হয়। সংঘের মতে, এই হােল রাষ্ট্রের প্রকৃত দেশাত্মবােধক সঙ্গীত।২৫ ‘জনগণমন’ গানটিকে তারা বদলে দিয়ে বন্দেমাতরম্কে সে জায়গায় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বরণ করতে চায়। এবং সেইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও ‘জনগণমন’ গান সম্বন্ধে বহুদিন ধরেই সংঘ অপপ্রচার চালিয়ে এসেছেন।
সংঘ পরিবার এখনাে তবু অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। রামজন্মভূমি আন্দোলনের সময়ে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আহ্বানে বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেত্রী সাধ্বী ঋীতাম্ভরা একটি অডিও ক্যাসেটে দারুণ মুসলমান বিদ্বেষী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, উত্তর ভারতের পথে পথে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।২৬ সেই বক্তৃতার জ্বালাময়ী ভাষা শুনে শুনে বহু জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা
বাধে, বহু মুসলমান এই হিংসার প্রত্যক্ষ শিকার। এই বক্তৃতার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের গানকে দেশদ্রোহিত, বিশ্বাসঘাতকতার নিদর্শন বলে চালানাে হয়েছে।২৭ এ আক্রোশ কেন? এখানে আমরা অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সংঘ পরিবারকে একাকার করে ফেলতে পারি না। বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তা জটিল, বহুমুখী, পরিবর্তনশীল, বহু বিচিত্র সম্ভাবনাময়। সংঘ পরিবার তার থেকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী কিছু কিছু ব্যাপারে হেঁকে তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। এখানে সংঘের ব্যবহারটাই আমাদের প্রণিধানযােগ্য।
তবু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, বঙ্কিমচন্দ্র দেশাত্মবােধের একটি সজীব প্রতিমা রচনা করে তাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিন্দু-মুসলমান পারস্পরিক বিদ্বেষের রক্তাক্ত জমিতে। সে প্রতিমা হিন্দু বিশ্বাসের জগৎ থেকে তুলে আনা। দেশপ্রেমের অন্য সব ধারণা—যা লােকহিতকর, যা ন্যায়পন্থী—সব এখানে অস্পষ্ট। এবং এই প্রতিমা মানুষের যেমন ঊর্ধ্বে, তেমনই মানুষের বহুলতা, সংস্কৃতির বহুলতা এর অখণ্ডিত মূর্তির কাছে মিথ্যা বলে মনে হয়। যেহেতু মূর্তিটি হিন্দুপ্রতিমা, সে কারণে এই অখণ্ড একক সংহতির অন্য নাম হিন্দুধর্ম, হিন্দুসমাজ বা হিন্দুরাষ্ট্র।
স্বাভাবিকভাবেই ‘বন্দেমাতরম’ গানটি সম্পর্কে মুসলিম মধ্যবিত্তের একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। বন্দেমাতরম সম্পর্কে সহনশীল পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল একটি জিজ্ঞাসা, যেমন : বাংলাদেশে সাতকোটি লােকের বাস। তার মধ্যে অর্ধাধিক মুসলমান। এই যে বিশাল বাঙালি জাতি, যার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান আছে, তাদের জন্য যে জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়েছে, তা হতে মুসলমান বাদ পড়ল কেন? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে যদি ধরা যায় তাহলে মুসলমানরা, যাদের সংখ্যা অর্ধেকেরও অধিক, তারা কিন্তু বাদ পড়েনি, গানে সাত কোটি বাঙালির এবং তাদের চৌদ্দ কোটি বাহুর কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই অন্তর্ভুক্তি বাদ দেওয়ার চাইতেও অগ্রহণযােগ্য। কেননা এতে মুসলমানদেরকে মুসলমান হিসাবে না-দেখিয়ে দেবীর পূজারী হিসাবে, অর্থাৎ হিন্দু হিসাবে উপস্থিত করা হয়েছে। মুসলমান এতে উৎফুল্ল হবে কেন; তার বিরূপ হবার কথাই, এবং সেটা সে ঠিকই হয়েছে। বাংলার সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে তাদেরকে বরং দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়াই হয়েছে, একপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়, যারা দেবীর বন্দনা ও পূজা করে; অপরপক্ষে মুসলিম সম্প্রদায় যারা মূর্তিপূজাবিরােধী। সাম্প্রদায়িকতার জন্য পথ প্রশস্ত করার কাজে এভাবে সহায়তা দান করা হয়েছে। সকল বাঙালিকে হিন্দু হিসাবে কল্পনা করাটা কোনাে পরিকল্পনাতেই বৈধ নয়।
দেশমাতা প্রতিমার রূপ ধরেন এবং দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গায় রূপান্তরিত হন। জাতীয়তাবাদের উপর অনিবার্যভাবে হিন্দুত্বের রঙ এসে পড়ে। ফলে গীতটি জাতীয়।
আন্দোলনে প্রবল প্রেরণা সঞ্চার করলেও ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় একটা ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলার দিকে এই গানের ভূমিকা অনুকূল ছিল না। এই কারণেই জাতীয় নেতারা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘বন্দেমাতরম’-র বিরােধিতা করেন।
gozle postarat Bande Mataram and Indian Nationalism’factancy ‘Visva Bharati News’-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন।২৮ তিনি তাতে লিখেছেন: “My sympathy, at any rate, is with the Mahommedans in this controversy, for I believe that if I were a Mahommedan I should resent the particular garb this song gives to my love of my country. Though one can have no sympathy with the fanaticism of some Bengali Mahommedans who are out to smell idolatory in all literary use of Hindu mythology, still I should say that the spirit of the imagery and invocation employed in this song is more than merely literary and is such that it is unfair to force the monotheistic followers of the Prophet of Arabia to swallow it in the name of Indian Nationalism.” কংগ্রেসের অহিংস নীতির সঙ্গে বন্দেমাতরম গানের ভাবমূর্তির কোনও সঙ্গতি আছে কিনা প্রবন্ধের শেষে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখলেন: “Finally, one would like to ask protagonists of the Congress creed of Non-violence, how far the image of the ten-armed deity, flourishing weapons, represents their creed.” এটি অবশ্য কৃষ্ণ কৃপালনীর ব্যক্তিগত অভিমত। তখন সুভাষচন্দ্রের শরীর অসুস্থ। কলকাতায় দিন দুই থেকে ৯ই অক্টোবর (১৯৩৭) রাত্রে দার্জিলিং মেলে তিনি এক পক্ষকালের জন্য কার্সিয়াং যাত্রা করেন। যাত্রার পূর্বে কলকাতায় আসন্ন ওয়ার্কিং কমিটি ও এ.আই.সি.সি. অধিবেশনের প্রস্তুতির ব্যাপারে সহকর্মীদের সাথে আলােচনা ও প্রয়ােজনীয় নির্দেশাদি দিয়ে যান। কলকাতা অধিবেশনে ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীত নিয়ে যে একটা তুমুল ঝড় উঠবে এ কথা বুঝতে পেরে তিনি চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এই সময় তার রবীন্দ্রনাথের কথা মনে আসে। এই সম্পর্কে তার অভিমতের উপর দেশের লােক যতখানি গুরুত্ব দেবে এমন আর কারও কথায় দেবে না। তাই এই সম্পর্কে তিনি কবিকে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত লিখে জানানাের জন্য অনুরােধ করেন। কবি তার জবাবে সুভাষচন্দ্রকে যে পত্রটি লিখেন, সেটি যথাযথভাবে এখানে উদ্ধৃত করা হল : “বন্দেমাতরং গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দুর্গার স্তব এ কথা এতই সুস্পষ্ট যে এ নিয়ে তর্ক চলে না। অবশ্য বঙ্কিম এই গানে বাংলাদেশের সঙ্গে দুর্গাকে একাত্ম করে দেখিয়েছেন, কিন্তু স্বদেশের এই দশভুজামূর্তিরূপের যে পূজা সে কোনাে মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না। এবারে পূজা সংখ্যার বহু সাময়িকপত্রেই দুর্গাপূজার প্রসঙ্গে বন্দেমাতরং গানের শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করে দিয়েছে—সহজেই দুর্গার স্তবরূপে একে গ্রহণ করেছে। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি সাহিত্যের বই, তার মধ্যে এই গানের সুসংগতি আছে। কিন্তু যে রাষ্ট্রভাষা ভারতবর্ষের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র সেখানে এ গান সর্বজনীনভাবে সঙ্গত হােতেই পারে না। বাংলাদেশের একদল মুসলমানের মধ্যে যখন অযথা গোঁড়ামির জেদ দেখতে পাই তখন সেটা আমাদের পক্ষে অসহ্য হয়। তাদের অনুকরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আব্দার নিয়ে জেদ ধরি তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয় হয়ে ওঠে। বস্তুত এতে আমাদের পরাভব।”২৯
সুভাষচন্দ্রকে এটি কবির ব্যক্তিগত পত্র। সন্দেহ নেই, কবির এই যুক্তি ও বক্তব্য সুভাষচন্দ্র আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু সে কথা স্পষ্ট করে সেই প্রবল উত্তেজনার মধ্যে বলতে গেলে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যে কি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হবে সে কথা চিন্তা করে সুভাষচন্দ্র সম্ভবত এই বিতর্কে প্রায় সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলি অবশ্য তার জন্য সুভাষচন্দ্রের উপর কিছুটা অখুশিই থাকলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতায়। সাংবাদিকদের দারুণ উৎকণ্ঠা, রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে নীরব কেন, তিনি কী বলেন? রথীন্দ্রনাথ সাংবাদিকদের পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, দেশের বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে আলােচনা না হওয়া পর্যন্ত কবি এ বিষয়ে কোনাে বিবৃতি প্রচার করবেন না। সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন যে, বিশ্বভারতী-র পত্রিকায় কৃষ্ণ কৃপালানীর প্রবন্ধে ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীত সম্পর্কে যে অভিমত প্রকাশিত হয়েছে তা বিশ্বভারতীর কিংবা কবির মত নয়।৩০
যাই হােক, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর আবার নতুন করে জাতীয় সঙ্গীত চয়নের প্রশ্নে শুরু হয় আলাপ আলােচনা, তারই ফলশ্রুতি ‘জনগণমন’ অধিনায়ক জয় হে,—বিতর্কের পাঁকে জন্ম নিল দেশের কোটি কোটি মানুষের চেতনার শপথ।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ অধিনায়ক জয় হে’কে নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। কথা উঠেছিল, শুধুমাত্র যে সব প্রদেশ ব্রিটিশ-শাসনের অধীনে ছিল আমাদের জাতীয় সঙ্গ শীতে সেইসব প্রদেশের কথা উল্লেখিত হয়েছে। যেসব রাজ্য দেশিয় রাজাদের অধিকারে ছিল, যেমন কাশ্মীর, রাজস্থান, অন্ধ্র, মহীশূর, কেরল এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এর ভিতরে নেই। নেই ভারত মহাসাগর, আরব সাগর। ওই দুই সমুদ্রে পর্তুগিজ আধিপত্যের কারণেই কি? এই সব বিতর্ক তাে বিতর্ক তােলার জন্যই। রবীন্দ্রনাথকে যে কোনওভাবে ছােট করার জন্য। অবশ্য ওইসব প্রশ্নের বিপক্ষে যুক্তি সাজিয়েছিলেন অন্য পক্ষ। তারা বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ অখণ্ড ভারতের সীমানাকেই শুধু তার এই গানে প্রকাশ করেছিলেন। সেই কারণেই সীমান্তের প্রদেশগুলি উল্লেখিত হয়েছিল তাঁর গানে। আর দেশিয় রাজারা তাে পরাধীন ভারতের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন না, ভারতের স্বাধীনতার পর তারা ভারতের সঙ্গে আসবেন কিনা কে বলতে পারত তখন! আসলে বিতর্ক তুলে রবীন্দ্রনাথকে হেয় করার মানুষজন যেনতেন-প্রকারণে কবিকে হেয় করবেন তাই এইসব প্রশ্ন তােলা। রবীন্দ্রনাথ তাে বক্তৃতা সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে কিংবা প্রবন্ধ লিখে কাশ্মীর রাজস্থান ইত্যাদি। প্রদেশের নাম বাদ দেননি। তিনি রচনা করেছেন একটি গান, যার ভেতরে অখণ্ড ভারতের রূপ বর্ণনা করেছেন, এই উপমহাদেশের আত্মিক শক্তিকে উজ্জীবিত করেছেন, তা তাে ইঙ্গিতময় হবেই। নামতা পড়ার মতাে সব প্রদেশের নাম নিলে কী তা আর জাতীয় সঙ্গীত হত? হত তাে মদিখানার লিস্ট। এবার ভাবি কী আছে আমাদের এই অনপম জাতীয় সঙ্গ ীতে? দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ। দ্রাবিড় উল্লেখে কি সমগ্র দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় বংশােদ্ভূত জনজাতি বােঝায় না? ভারত মহাসাগর বা আরব সাগর? বঙ্গোপসাগরও নেই তাে, আছে জলধিতরঙ্গ। দুটি সমুদ্রের ব্যঞ্জনাকি এর ভিতরে আসে না? আছে বিন্ধ্য, হিমাচল— এর ভেতরে ওই পর্বত দুটির সানুদেশের সমস্ত অঞ্চল এসে যায়। গঙ্গা আছে যমুনা আছে, গঙ্গা যমুনা দুই নদীর তীরের সমস্ত জনপদ এসে যায়। কবিতা তাে কবিতাই হয়ে উঠবে। তার ছন্দ যদি ভেঙে যায়, তবে তা গ্রহণ করবে কেন মানুষ? যে গানে সুর নেই সে গান কি গান হয়ে ওঠে? ছন্দ আর সুর রাখতে গিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম, মণিপুর তাে নেই (মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশের অস্তিত্ব তখন ছিল না)। কিন্তু আছে তাে হিমাচল আর হিমাচল নিশ্চয় এই ভারতের নতুন প্রদেশটি নয়, তার জন্মই তাে স্বাধীনতার পর ১৯৪৮এর ১৫ এপ্রিল। এই হিমাচল তাে উত্তর ঘিরে থাকা হিমাদ্রি হিমালয়ের আঁচল। হিমালয়ের কোলে থাকা, ছোঁয়ায় সব রাজ্য। হিমালয় থাকলে সব থাকে। যাঁরা বিতর্ক তােলেন তারা এই অনুভবের বহু দূরে। এসব বােঝেনই না। শিল্প কবিতা গান আর সুরের সঙ্গে তাদের তফাৎ শত শত আলােকবর্ষ। কিছু মানুষ আছেন এইসব তর্ক উসকে দিতে। ২০০৫ সালেও সঞ্জীব ভাটনগর নামে এক উগ্র-জাতীয়তাবাদী সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে আর্জি জানালেন, সিন্ধুপ্রদেশ যেহেতু দেশভাগ স্বাধীনতার পর আর এই ভারতের অন্তর্গত নয়, জাতীয় সঙ্গীত থেকে ওই নামটি বাদ দিয়ে কাশ্মীরের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হােক।
পিটিশনের মােদ্দা কথাটা হল: যেহেতু স্বাধীন ভারতের মানচিত্রের চৌহদ্দির মধ্যে, ‘সিন্ধু প্রদেশের অস্তিত্ব নেই, তাই ‘পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মারাঠা—এই লাইনটি থেকে ‘সিন্ধু’ শব্দটি বাতিল করতে হবে। বদলে ঢােকাতে হবে কাশ্মীরের’ নাম। সওয়াল জোরদার করতে সঞ্জীব ভাটনগর ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। সংবিধান চালু হওয়ার মুখে, গণ-পরিষদে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেছিলেন, ‘জনগণমন’ সঙ্গীতটিই স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পাবে, তবে প্রয়ােজন বুঝলে, সরকার ওই সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কিছু অদল বদল করতে পারবে। তাছাড়া আবেদনকারী সঞ্জয় ভাটনগর আরও যুক্তি দেখিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং হিন্দিতে ‘জনগণমন’ অনুবাদের সময় বাংলা সিন্ধু’ শব্দের বদলে ‘সিন্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ফলে এটি পরিষ্কার যে, রবীন্দ্রনাথ শব্দটি ভৌগােলিক ভাবেই ব্যবহার করেছেন। তার কথায় : রবীন্দ্রনাথ নিজে যেখানে অনুবাদে ‘সিন্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, সেখানে অন্য কারও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ধােপে টেকে না। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছিল, সরকার রবীন্দ্রনাথের রচনায় কোনওরকম হস্তক্ষেপ করতে চায়।
এ বিষয়ে সরকারের মতামত আদালতকে দৃঢ়ভাবে জানানাে হবে। পাশাপাশি, কেন্দ্রের পক্ষে এও জানানাে হয়েছিল, এতদিন পর এই আপত্তির কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। স্বাধীনতা। আন্দোলনে সিন্ধু প্রদেশের মানুষের অবদানও কিছু কম ছিল না। এখন জাতীয় সঙ্গীত থেকে শব্দটি বাদ দিলে তাদের ভাবাবেগে আঘাত লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। সর্বোপরি, রবীন্দ্রনাথের রচনা কাট ছাঁট করাও কোনও অধিকার কোনও সরকারের নেই।
কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের এই বিতর্ক নতুন করে ভারতীয় জাতি নির্মাণের, জাতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। জাতি কি তবে কেবল রাষ্ট্রনির্ভর— যার কোনও ভৌগােলিক অংশ বাদ যাওয়া বা যুক্ত হওয়া প্রতিফলিত হবে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে? ‘সিন্ধু’ গেল, কাশ্মীর’ এল (এটা কি মিউচুয়াল এক্সচেঞ্জ?) তাতে না হয়, বিশ্ববাসীও জানল, কাশ্মীর আমাদেরই কিন্তু অসম সহ উত্তরপূর্বের সাত রাজ্য কী বলবে? তারাও যে নেই!! সিকিম, রাজস্থানের মানুষ বা আন্দামানের দ্বীপবাসীরা!! এছাড়া জাতীয় সঙ্গীতের শব্দ বদল বা নতুন সংযােজনের অধিকার রাষ্ট্রের হাতে থাকে কী করে! রাষ্ট্র নতুন কোনও গানকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দিতেই পারে, প্রচলিত গানকে ত্যাগ করতেই পারে, কিন্তু কিছুতেই কারও কোনও মৌলিক রচনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিস্ময় এখানেই, আবেদনটি বালখিল্য আচরণ হিসাবে খারিজ না করে কেন নােটিশ পাঠানাে হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারকে, প্রশ্ন এটাই। অবশ্য এমনও হতে পারে, মাননীয় বিচারপতিরা এই বিতর্ককে চিরতরে বন্ধ করার জন্যই হয়তাে নােটিশ পাঠিয়েছিলেন। জানা নেই। উল্লেখ্য, ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘জনগণমন’ অধিনায়ক’ গানটি। তখন অবিভক্ত দেশ। কিন্তু ১৯৫০ সালে জাতীয় সঙ্গীতে হিসাবে গানটি যখন স্বীকৃতি পায়, তখন দেশভাগ হয়ে গিয়েছে। তখন নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই ‘সিন্ধ’ শব্দটাকে রাখা হয়েছে। তাহলে কি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভুলে যাবে দেশ ভাগের স্মৃতি! কোনও গানেরই অভিধার অর্থটিই সব নয়। সামগ্রিক ব্যঞ্জনাটিই আসল। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে অক্ষরিক অর্থে না দেখে, সামগ্রিকভাবে ভাবা উচিত।
সত্যি বলতে কি, জন্ম থেকেই আধুনিক জাতীয়তাবাদ এই ফান্দে পড়েছে। কে তার আপন, কে তার পর—এই ঝামেলা মেটার নয়। দেখলেন না, সব সম্প্রদায়কে তুষ্ট রাখতে ‘বন্দেমাতরম্ গেল, এল ‘সেকুলার’, ভৌগােলিক জাতীয়তাবাদী ‘জনগণমন’ । অথচ কৌমবাদী রাজনীতির হাত থেকে তারও নিস্তার নেই। এইসব পন্ডশ্রমের চেয়ে, জাতীয়তাবাদীরা বরং আগে বলুন, জাতি কাকে বলে?
সঞ্জীব ভাটনগরের এই আবদার মেনে নেওয়া অসম্ভব! যাঁরা ‘জনগণমন’-কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দিয়েছেন তাদের মাথায় তাে এমন উদ্ভট প্রশ্ন আসেনি? জঘন্যতম প্রস্তাব! ‘সিন্ধু’ কথাটা নিয়ে তাে আমাদের পাকিস্তানের আপত্তি তােলার কথা। ওরা তাে তােলেনি। পাকিস্তানের থেকে আপত্তি উঠলে তখন ভেবে দেখা যাবে। আগ বাড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে এইসব ছেলে মানুষী করার কোনও মানে হয় না।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা তিনি বদল করতে বলছেন, কেননা সিন্ধু প্রদেশ পাকিস্তানে। সিন্ধু নদী, সিন্ধু সভ্যতা চুলােয় যাবে? আর সিন্ধু প্রদেশ ওপারে থেকে গেলেও সিন্ধু নদী কি নেই? যে সিন্ধি জনজাতি দেশবিভাগের পর তাদের নিজস্ব ভূখণ্ড ছেড়ে এই ভারতে আশ্রয় নিল, তাদের হারানাে দেশের চিহ্ন হিসেবে এই শব্দটি থাকা দরকার। দেশভাগে শেষ অবধি পাঞ্জাব আর বাংলা দু’ভাগ হল, আর ভৌগােলিক অবস্থানের কারণে সিন্ধু প্রদেশটিকে ভাগ করার উপায় ছিল না, সম্পূর্ণই চলে গেল পাকিস্তানে। বাঙালি শেষ অবধি খণ্ডিত বাংলায় এল, পাঞ্জাবিও তাই। সিন্ত্রিদের নিজের রাজ্যই থাকল না এই ভারতে। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর হারানাে দেশকে সম্মান দিতে সিন্ধু তাে থাকবেই এই গানে। সিন্ধিজনজাতি ভারতেরই অধিবাসী। আসলে রবীন্দ্রনাথ রাজ্যে রাজ্যে খণ্ডিত এই বিশাল ভারতবর্ষকে এক সুত্রে বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন। অনুভব করেছিলেন এত বৈচিত্র্যের ভেতরেও রয়েছে এক অন্তরের ঐক্য। আর রবীন্দ্রনাথের এই দেশ বন্দনায় ছিল সেই সুর। রবীন্দ্রনাথ অন্য কবিতায় বলেছিলেন, “হেথায় আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন…শক হুন দল পাঠান মােগল এক দেহে হল লীন। সব গান সব কবিতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ অধিনায়ক জয় হে’-এ।
রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ কিছুই ত্যাগ করে না। গ্রহণ করে সকলকে আপন করে নেয়। ‘ভারতবর্ষ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বহু জাতি, উপজাতি, বহুভাষী অধিবাসীর বাসভূমি এই দেশের সার্থকতা হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করার ক্ষমতাকে। কিন্তু এই ঐক্য স্থাপনের জন্য ভারতবর্ষ ‘বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয় সেগুলিকে কখনওই নষ্ট না করে ‘ভিতরকার নিগূঢ় যােগকে’ অধিকার করে। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু লেখা ও বক্তৃতায় ‘নেশন’এবং ন্যাশনালিটি’-র ধারণার তীব্র সমালােচনা করেছেন। এর জন্য তিনি নিজেও কম সমালােচিত হননি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় সেই ঘটনার কথা, রবীন্দ্রনাথ, শান্তিদেব ঘােষ এবং আরও কয়েক জনকে ডেকে বলেছিলেন নিজের দেশকে তিনি কত ভালবেসেছিলেন আর তার পর মৃদু গলায় গেয়েছিলেন ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গানটি।
আসলে রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন যে পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা ‘নেশন’-এর ধারণা দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফেরালেও সেই শান্তি অনেকটা নঞর্থক, যা স্টিম রােলারের মতাে চাপ দিয়ে সব কিছু সমান করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে ‘প্রেমহার’এর সবকটি ফুল সমানভাবে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথ বার বার সাবধান করেছিলেন যে, পৃথককে জোর করে এক করলে, তাদের পার্থক্যকে যথাস্থানে বিন্যস্ত না করলে তারা একদিন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন হয় এবং বিচ্ছেদের সময় ঘটে প্রলয়। স্বাধীনতাউত্তর ভারতবর্ষ আন্তরিকভাবে গ্রহণের ব্যর্থতা এবং তৎপরবর্তী বিচ্ছেদের এইসব প্রলয়ের ক্ষত নিজ শরীরে বহন করে চলেছে। রামচন্দ্র গুহ রবীন্দ্রনাথের ‘নাশানালিজম’ গ্রন্থের নতুন একটি সংস্করণের ভূমিকায় ‘আইডিয়া অফ ইণ্ডিয়া’-এর আলােচনা প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের এই ইনক্লসিভ সত্ত্বার কথা উল্লেখ করে মনে করিয়ে দিয়েছেন বেশ কয়েক দশক আগে করা রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণীর কথা যা এখন স্বচ্ছন্দে আল কায়দা জঙ্গিগােষ্ঠী, মাওবাদী বা উগ্র হিন্দুবাদীদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করা যায়।
বর্তমান ভারতের অনেকগুলি ব্যাধিরই কারণ হল আন্তরিকভাবে অপরকে তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য সমেত আপন করে নিতে পারার ব্যর্থতা। ফলে বৈচিত্র্য প্রতিভাত হয় প্রভেদে। মিলন পরিণত হয় বিচ্ছেদে, নিজ নিজ সংস্কৃতি, আদর্শ ও ধর্মীয় বিশ্বাস অন্যের ওপর আরােপের চেষ্টায় সৃষ্টি হয় বিরােধ। তাই আঞ্চলিক বা সাংস্কৃতিক অস্মিতার ওপর ভর করে তৈরি হচ্ছে ক্ষোভের পুঞ্জ। সময় হয়েছে কালদশী সেই পুরুষের কথা শােনার, যিনি লেখায়, কর্মে শুনিয়েছেন গ্রহণের মন্ত্র—শুনিয়েছেন ‘জনগণমন’ অধিনায়ক জয় হে’ গানেও। আবার, সেই গান যদি বিভিন্ন প্রান্তের ভারতবাসীর, বিবিধ উচ্চারণে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে নিশ্চয় আরও বেশি করে উজ্জ্বল হবে আমাদের এই দেশের ‘পতনঅভ্যূদয়বন্ধুর পন্থা’। প্রাণের নিগূঢ় যােগ সম্ভব হবে।
তথ্যসূত্র:
১. দ্য বেঙ্গলি, ৩০ ডিসেম্বর ১৯১৭।
২.অমৃতবাজার পত্রিকা, ৩১ ডিসেম্বর ১৯১৭।
৩. প্রবােধচন্দ্র সেন, ইণ্ডিয়াজ ন্যাশনাল অ্যানথেম, কলকাতা, ১৯৪৯।
৪. আশীষ নন্দী, দ্য ইল্লেজিটিমেসি অফ ন্যাশনালিজম : রবীন্দ্রনাথ টেগাের অ্যাণ্ড দ্য
পলিটিক্স অফ সেলফ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৪, পৃ. ৮৬-৮৮।
৫. দ্য বেঙ্গলি, ২৮ ডিসেম্বর ১৯১১।
৬. The Englishman, 28.12.1911.
৭. The Statesman, Dec. 28, 1911.
৮. India, December 29, 1911.
৯. আর টি নায়ার, ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সঙস অ্যাণ্ড সিম্বলস, ১৯৮৭।
১০. হরিজন, ১৯ মে ১৯৪৬।
১১. দেখুন—অরবিন্দ পােদ্দার, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত—উত্তরকালের প্রার্থনা, প্রত্যয়, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ৩০-৩২।
১২. হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২৬ অক্টোবর ১৯৩৭।
১৩. অমৃতবাজার পত্রিকা, ৯ মে ১৯৩১।
১৪. ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, টেগাের মেমােরিয়াল সাপ্লিমেন্ট, পৃ.-১৮।
১৫. প্রবােধচন্দ্র সেন, ইণ্ডিয়াজ ন্যাশনাল অ্যানথেম, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৪।
১৬. প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, ষষ্ঠ খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৩, পৃ. ২৫৬।
১৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ অক্টোবর ১৯৩৭।
১৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ নভেম্বর ১৯৩৭।
১৯. প্রবাসী, অগ্রহায়ণ ১৩৪৪।
২০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, খণ্ড-৫, পত্র-৮৭, কলকাতা, পৃ. ২৭১।
২১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, খণ্ড-৫, পত্র-৮৭, কলকাতা, পৃ. ২৭০।
২২. নেপাল মজুমদার, ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, খণ্ড-৪, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ.১৯০।
২৩. বুদ্ধদেব বসু রচনা সংগ্রহ, খণ্ড-৩, কলকাতা, পৃ. ৫৯০।
২৪. বুদ্ধদেব বসু রচনা সংগ্রহ, খণ্ড-৩, কলকাতা, পৃ. ৫৯০-৫৯১।
২৫. তপন বসু ও অন্যান্য, খাকি শর্টস অ্যাণ্ড স্যাফ্রন ফ্ল্যাগস্—এ ক্রিটিক অফ হিন্দুত্ব, ট্র্যাক্টস্ ফর দ্য টাইমস, ওরিয়েন্ট লংম্যান, দিল্লী, ১৯৯৩।
২৬. তনিকা সরকার, দ্য ভয়েস অফ সাধ্বী ঋীতাম্ভরা : অ্যাসপেক্টস অফ কন্টেম্পােরারি হিন্দুত্ব, ‘দ্য লিটল ম্যাগাজিন’, ১ম খণ্ড, ৫ম সংখ্যা, নভেম্বর- ডিসেম্বর ২০০০।
২৭. তনিকা সরকার, বন্দেমাতরম বনাম জনগণমন’; দেখুন- আধুনিকতার দু-একদিক : ধর্ম, সাহিত্য ও রাজনীতি, ক্যাম্প, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ১২-১৩।
২৮. বিশ্বভারতী নিউজ, অক্টোবর ১৯৩৭।
২৯. নেপাল মজুমদার, ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, খণ্ড-৪, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১৯১।
৩০. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই কার্তিক ১৩৪৪, কলকাতা।
লিখেছেনঃ আমিনুল ইসলাম