সম্ভাজি ছত্রপতি শিবাজীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ছিলেন। সম্ভবত সর্বাপেক্ষা অনুগত। শিবাজীর মৃত্যুর পর তিনিই হয়েছিলেন মারাঠাদের রাজা। আওরঙ্গজেবের সেনাপতি আম্বেরের রাজা জয়সিংহের সঙ্গে পুরন্দর চুক্তির পর মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি আম্বেরের রাজার সঙ্গে একপ্রকার পণবন্দি হিসাবে থাকতে চলে যান। আওরঙ্গজেব তাঁকে ৫০০০ ঘোড়সওয়ারের মনসবদারিও দেন। তাকে পাঠানো হয় ঔরঙ্গাবাদের প্রিন্স মোয়াজ্জমের সহকারি হিসাবে। বিরারে জায়গীরও দেওয়া হয়। এমনকি বিজাপুরের সুলতানের বিরুদ্ধে যৌথভাবে মারাঠা ও মুঘল বাহিনী লড়াই করে।
সম্ভাজি নেশাগ্রস্ত ছিলেন তাই শিবাজী তাঁকে পানহালা দুর্গে বন্দী করে রাখেন। পিতার অগোচরে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। শিবাজীর মৃত্যুর পর তিনি পানহালা অধিকার করেন। এই সময়ে তাঁর সৎমা রাজারামকে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। সম্ভাজি পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিকে এমনকি মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ করে র্পতা অপেক্ষাও বর্বরতা দেখিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যে আক্রমণ করে। এমনকি চতুর্থ প্রিন্স আকবর তার শিবিরে যোগ দেয়।
মোট কথা সম্ভাজি ঘরে-বাইরে তার শত্রু বাড়িয়ে ফেলেছিল। এই অবস্থায় সম্ভাজির দক্ষিণের সেনাপতি অণুজি সালীহির কেল্লাপতিও সম্ভাজির পক্ষ ত্যাগ করলেন। ১৯-শে মে সম্রাট আওরঙ্গজেবে তাঁকে পুরস্কৃত করলেন-দামি পোশাক, তুঘ, কেটলড্রাম, একটি করে হাতি আর ঘোড়া, নগদ কুড়ি হাজার টাকা। মানকজি ছিল সম্ভার তরফ থেকে সিঙ্গোলার কেল্লাপতি যুদ্ধে হেরে গিয়ে সে দর্শকদের মধ্যে ছিল তাকেও পুরস্কৃত করা হল। দামি পোশাক, দোহাজারী মনসব দিয়ে। বোঝায় যাচ্ছে সম্ভার বৃত্তটি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে।
এরপর আওরঙ্গজেব সম্ভাজির মত দুর্বিনীত মানুষের দিকে নজর দিলেন। শম্ভাজির সঙ্গে যোগ দিয়েছিল আবুল হাসান ও সিকান্দার নামে দুই ব্যক্তি।
দাক্ষিণাত্যের গোলযোগ সামলানোর জন্য ১৬৮৮-র জানুয়ারী ২০ তারিখে তিনি বিজাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সম্ভাজিকে ধরার জন্য শাহজাদা মোহাম্মদ আযমকে পাঠালেন ৪০০০০ সেনা নিয়ে।
সম্ভাজি উঁচু এক পাহাড়ি দুর্গম এলাকায লুকিয়েছিল। বিশাল মুঘল বাহিনী আসছে জেনেও মদের ঘোরে ঔদ্ধত্যর সঙ্গে লাফিয়ে উঠে তার আশপাশের লোকদের তরবারি দিয়ে মেরে বলল, এই দুর্গম জায়গায় মুঘল বাহিনী কি করে আসবে? মুকাররাব খান কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়ার পর ইতিমধ্যে বিদ্যুতের মত দ্রুত এবং বাতাসের মত বেগে, প্রায় ৩-৪ হাজার দক্ষিনের মুঘল বাহিনীর হাতে সম্ভা গ্রেফতার হল।
কবি কলসের সঙ্গে সম্ভা লুকিয়েছিল। একজন ইখলাস খান সাহস নিয়ে গর্ত সদৃশ এলাকা থেকে সম্ভা এবং কবি কলসকে চুলের মুঠি ধরে তুলে আনল। কবি কলস হল একজন, কবি যোদ্ধা এবং কর্নাটকের কান্নুরে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সম্ভাজির একরকম সবরকম সঙ্গী। ১৬৮৪ নাগাদ এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে রায়গড়ে তিনি শাহাবুদ্দিন খানকে পরাজিত করেছিলেন।
সম্ভার ২৫ জন মূল সঙ্গী সম্ভার স্ত্রী পুত্ররা গ্রেফতার হল। আকুজি নামক স্থানে সম্রাট খবরটি পেলেন। তিনি হুকুম দিলেন শৃঙ্খলিত ও যথাযথ ফৌজ দ্বারা পরিবৃত অবস্থায় সম্ভাকে আনা হোক। কোথা থেকে কোনও বাধা ছাড়াই ফেব্রুয়ারি মাসে সম্ভাকে বাহাদূরগড়ে সম্রাটের সামনে পেশ করা হল। সম্রাট ক্রোধান্বিত হয়ে হুকুম দিয়েছিলেন তাঁর সামনে আসার দু ক্রোশ দূর থেকেই যেন সম্ভার মাথায় কালাহ ই জাঙ্গালা নামক বিচিত্র কাঠের টুপি পরিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে কোন বন্দিকে কাঠের টুপি পরানো মানে তার মৃত্যুদন্ড অনিবার্য এবং ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র। সঙ্গী সাথীদের ভাঁড়ের মতো পোশাক পরান হল, ধীর গতির উটের পিঠে চাপান হলো একে একে সকলের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন শাস্তি ধার্য হল।
সম্ভাকে ধরার পর মুকাররব খান ও তার পুত্র ইখলাস খান, আত্মীয়-স্বজন এবং অন্যান্যদের যথাযথ পুরস্কৃত করার পর জনতা শবে বরাত উৎসবের জন্য সেদিন রাতে ভাবগম্ভীর অবস্থায় থেকে বন্দিদের নিয়ে কি হবে এসব সাত-পাঁচ ভেবে কোন আনন্দ উপভোগ করেননি। তার পরদিন ঈদুল ফিতরের আনন্দের মত করে জনতা এই সম্ভাকে দেখার জন্য সুখ ও আনন্দ সহকারে দলে দলে আসতে লাগল। মোদ্দা কথা এই লোকটি তার ব্যবহারের জন্যই সকলের কাছে অপ্রিয় হয়েছিল। আওরঙ্গজেব তাঁকে মনসবদারি থেকে যুবরাজ হিসাবে সমস্ত ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি সম্রাটকে সব রকমভাবে লজ্জিত ও অপদস্থ করেছিলেন। প্রথমে পিতার সঙ্গে পালিয়ে যান। তারপর সব রকম ভাবে সম্রাটের বিরোধিতা করেন।
সম্ভাকে সমস্ত ক্যাম্পের চারিদিকে ঘোরানো হল, তারপর দর্শক আসনে বসা সম্রাটের সামনে সম্ভাকে পেশ করা হল। সম্রাট তার আগেই তাঁর সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ সেরে নিয়েছিলেন। বাদশা সিংহাসন থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসলেন এবং সম্ভাকে সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বললেন। এরপর দুই হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করলেন এবং তাঁর চোখ চকচক করে উঠল।
সব শেষে কবি কলসকে বাঘ নখ দিয়ে কিরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আফজাল খানের মৃত্যুর বদলা নেওয়া হয়েছিল। ৩-রা মার্চ সম্রাট কোরেগাঁওয়ে উপস্থিত হলেন ১১-ই মার্চ ১৬৮৯ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
সম্ভার স্ত্রী- পুত্র এবং আত্মীয়-স্বজন সম্ভার মৃত্যুদণ্ডকে খুব শান্ত ভাবে মেনে নিয়েছিলেন। কোথায় এখন সম্ভার অহংকার এবং তার রাহিড়ী দুর্গের অভেদ্যতার অহংকার। যে ব্যক্তি সম্ভাকে ধরেছিল সেই ব্যক্তিকে খান-ই-জাহানফাত জঙ্গ উপাধি, নগদ ৫০ হাজার টাকা, রত্নখচিত পাদানিসহ একটি ঘোড়া, মহামূল্যবান পোশাক, রত্নখচিত হাতলযুক্ত একটি ছোরা, মনসবদারর উৎস উচ্চ আসন দেওয়া হল। পুত্র এখলাস খানও পুরস্কৃত হলেন।
- [মা”শির ই আলমগিরী, মা’শির উল উমারা অন্যান্য কয়েকটি বই ও নেট থেকে নেওয়া।]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।